৯-১১. পথ হারিয়ে গুপ্তধনের গুহায়

পথ হারিয়ে গুপ্তধনের গুহায়

ফতেদের ঘরের পাশ দিয়ে আসার সময় ওদের অনুসরণ করার প্ল্যানটার কথা মনে পড়লো। ছুটে গিয়ে বাবুকে ঘুম থেকে ডেকে তুলোম। বাবু ঘুমঘুম চোখে উঠে বসলো। অবাক হয়ে বললো, কী হয়েছে!

উত্তেজিত গলায় বললাম, আজ রাতে ফতে আর গোবর কোথায় যায়। দেখবো।

বাবু ঘুমজড়ানো গলায় বললো, তুমি কি ভেবেছো ওরা আজ রাতেও আলো দেখাবে?

আমি বললাম, ভাববো কেন, কাল গোবর বিড়বিড় করে বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে যখন নিচে নামছিলো, তখন আমি শুনেছিলাম।

মনে হলো আমার কথা বাবুর বোধগম্য হয়েছে। ফুটো দিয়ে তাকানোর কথা বলতে ও আপত্তি করলো না।

মেঝের ফুটো দিয়ে আমরা আমাদের চোখ দুটো ওদের ওপর সারাক্ষণ বিঁধিয়ে রাখলাম। গোবর একসময় বললো, এ বাড়ির ঘোড়াগুলো বাপু সুবিধের নয়। অষ্টপহর কুত্তো একটা নিয়ে যেন পেছনে লেগেই আছে।

ফতো খেঁকিয়ে উঠে বললো, তুইও তো বাপু কম যাস না। এক শ বার তোকে বলেছি, কুত্তো দেখে কক্ষনো ওরকম করিস নে। গিলে খাবে নাকি?

নিজের রোগা লিকপিকে শরীরটাকে ভালো করে দেখে গোবর বললো, গিলে খেতে কতক্ষণ! তোর মতো বপু থাকলে না হয় কথা ছিলো।

ফতে ধমক দিয়ে বললো, ম্যালা ফ্যাচফ্যাচ করিস নে গোবরা।

এরপর ফতে কালো ব্যাগটা খুলে একটা চ্যাপটা মদের বোতল বের করলো। ছিপি খুলে ঢকঢক করে খানিকটা গলায় ঢেলে আবার ছিপি বন্ধ করে ওটা ব্যাগের ভেতর রেখে দিলো। আড়চোখে করুণ মুখে গোবর ওটা এক বার দেখলো। তারপর বললো, যাবার তো সময় হয়ে এলো, যাবি নে?

কব্জি উল্টে হাতঘড়িটা এক বার দেখলো ফতে। বললো, যেতে হয় তাহলে। ব্যাগ থেকে লম্বা একটা টর্চ বের করে কয়েক বার জ্বালিয়ে দেখে বললো, আন্নাকালীর মন্দিরে ক বার আলো জ্বলে দেখিস। গুনে গুনে ঠিক ততোবার জ্বালাবি।

গোবর একটু বিরক্ত হয়ে বললো, হয়েছে, আর জ্ঞান দিতে এসো না বাপু! এই করে চুল পাকিয়ে ফেললাম। নাও, সিন্দুকটা ধরো। যা ভারি! কাল একা সরাতে গিয়ে আমার প্রাণ-পাখিটা আরেকটু হলে বেরিয়ে যেতো।

আমি আর বাবু ফুটো দিয়ে পরিষ্কার দেখতে পেলাম দেয়ালের দিক থেকে ওরা সিন্দুকটা সরিয়ে আনলো। ফতে বললো, ঠিক আছে, যাচ্ছি। এখন আর বন্ধ করে কাজ নেই। ঘরে তো আর কেউ আসছে না।

ফতে দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেলো। সিন্দুকের আড়ালে সম্ভবত কোনো দরজা রয়েছে। দরজাটা দেখা গেলো না। ফতে চলে যাওয়ার পর কালো ব্যাগ খুলে গোবর আরেকটা লম্বা টর্চ বের করলো। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে মদের বোতলটা বের করে কয়েক ঢোক গিলে ফেললো। পাশের টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা এনে খানিকটা পানি বোতলে ঢেলে ছিপি বন্ধ করে আগের মতো রেখে দিলো। তারপর আপন মনে যাই, ছাদের ঠাণ্ডা বাতাসে নেশাটা একটু ধরবে।–এই বলে গোবর টর্চ হাতে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।

সিঁড়িতে ওর পায়ের শব্দ শুনে আমি আর বাবু দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। উঁকি মেরে দেখি, স্ক্যাটরার ভয়ে একেবারে সিঁটিয়ে গিয়ে পা টিপেটিপে গোবর দোতালার ছাদে উঠে যাচ্ছে। একটু পরে আমরা দুজন একছুটে গোবরের ঘরে এসে ঢুকলাম।

ভেবেছিলাম সিন্দুকের আড়ালে বুঝি কোনো দরজা আছে। কাছে এসে দেখলাম দরজা নয়, একটা সুড়ঙ্গের মতো নিচে নেমে গেছে। কয়েক ধাপ সিঁড়িও আছে। ভেতরটা একেবারে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। বাবু আমার দিকে তাকালো একবার। আমি বললাম, একটা দেয়াশলাই হলে ভালো হতো।

দাঁড়াও, আমার ছোট টর্চটা নিয়ে আসি। এই বলে বাবু ছুটে গিয়ে এক মিনিটের মধ্যে একটা খেলনার মতো ছোট্ট টর্চ নিয়ে হাজির হলো। আলো জ্বালিয়ে দেখালো। আলো কম হলেও পথ দেখা যাবে।

আমি টর্চটা হাতে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে পড়লাম। বাবু আমার পেছন পেছন এলো। সিঁড়ির কয়েক ধাপ নিচে একটা ঘরের মতো। দুদিকে দুটো পথ রয়েছে। একটা সমুদ্রের দিকে, আরেকটা পাহাড়ের দিকে। ফতের কথা মনে পড়লো। ও গোবরকে পাহাড়ের আলোর দিকে লক্ষ্য রাখতে বলেছে। তার মানে পাহাড়ে অন্য কেউ আলো দেখাবে। যে-পথ সমুদ্রের দিকে গেছে আমরা সে-পথ ধরে এগুলাম।

পথ মানে সুড়ঙ্গ। একটা সঁতসেঁতে ভাব, ভ্যাপসা গন্ধ। উত্তেজনায় বুকের ভেতরটা ঢিবঢিব করছিলো। ললি টুনির কথা মনে পড়লো। কাল যদি ওরা শোনে আমরা ওদের ফেলে এসব কাণ্ড করেছি, তাহলে মহা হৈচৈ বাধাবে। ওদের বুঝিয়ে বলতে হবে। দরকার হলে টুনিকে না হয় একটা ভয়ের কথা বলে দেবো।

বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর মুখে ঠাণ্ডা বাতাস এসে লাগলো। আমি টর্চ নিভিয়ে ফেললাম। একটা বাঁক পেরুতেই সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ শুনলাম। অন্ধকার ফিকে হয়ে এলো। একটু পরেই সুড়ঙ্গের মুখে সমুদ্র চোখে পড়লো। চাঁদের ম্লান আলোয় দেখলাম সমুদ্রের তীর থেকে বেশ দূরে মস্ত বড় একটা কালো নৌকো।

বাইরে গিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি একেবারে সমুদ্রের তীরে এসে গেছি। অনেক ওপরে বিশাল বাড়িটা সারা শরীরে অন্ধকার মেখে পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। গাটা ছমছম করে উঠলো। কিন্তু ফতে কোথায়? আশেপাশে তাকিয়ে ওকে দেখতে পেলাম না। বাবু হঠাৎ চাপা গলায় বললো, আবির দেখে যাও।

আমি এগিয়ে গেলাম। বাবু আঙুল তুলে বললো, ওই দেখ! আরেকটা নৌকো।

এদিকটায় খালের মতো একটা পানির স্রোত এসে সমুদ্রে মিশেছে। আমাদের সেই সোনাবালি নদীও হতে পারে। নদীতে নয়, তীরের বালির ওপর একটা ছোট্ট স্পীড বোটের মতো, চাঁদের ফ্যাকাশে আলোতেও চকচক করছিলো। আমি বললাম, ফতে তাহলে এখনো আসে নি।

আমার কথা শেষ না হতেই ফতের গলা শুনলাম। আরেক জন লোকের সঙ্গে বকবক করতে করতে এদিকেই আসছে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা ভোলা জায়গা ছেড়ে পাহাড়ের দিকে চলে গেলাম।

ফতে বলছিলো, কোন এক ব্যাটা এসেছে–রবারের চাষ করার নামে গোয়েন্দাগিরি করছে। কালও মাল বেশি সরাতে পারি নি। এদিকে রোজই তো শুধু জমছে। বড়ো কত্তা ক্ষেপে গেছে। বলেছে আজ যদি কিছু হয়, তাহলে আমাদের কারো মুখ দর্শন করবেন না। গোবরাকে তো বলেছেন, তুই যখন কুত্তো দেখে ভয় পাস, তখন তোকে ডালকুত্তো দিয়ে খাওয়াবো। সেই থেকে গোবরা খচে আছে।

ফতের সঙ্গী লোকটা বপুর দিক থেকে ফতেকেও ছাড়িয়ে গেছে। তবে ফতের মতো চর্বি জমা নয়, রীতিমতো মাসলঅলা পেটা শরীর। একমুখ কালো দাড়ি–অনেকটা পাইরেটদের মতো। যেন কিছু সন্দেহ করছে, ঠিক এভাবে চারপাশে এক বার তাকিয়ে দেখে বাজখাই গলায় বললো, আমার যেন মনে হলো ফতে, কিছু একটা যেন সরে গেলো। যেন মানুষের মতো। যেন–শুনে আমাদের সারা শরীর হিম হয়ে গেলো।

ফতে ধমক দিয়ে বললো, মানুষ দেখার আর জায়গা পেলি নে। কোথায় কি শেয়াল না ভাম দেখেছিস। তুই অযথা ভাবছিস।

ছক্কা নামধারী ফতের সঙ্গীটা খুঁতখুঁত করতে লাগলো। এক বার আমাদের দিকেও মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। আমরা দুজন একেবারে পাহাড়ের গায়ে লেপ্টে আছি। দেখতে পেয়েছে বলে মনে হলো না। হাঁটতে হাঁটতে আবার বললো, অমন করছিস কেন ছক্কা! তোদের এক শ বার বলি কাজের সময় বেশি মাল টানিসনে! কেমন, নেশা ধরেছে তো!

ছক্কা বিড়বিড় করে কী যেন বললো, শুনতে পেলাম না। এরপর ফতে একটু চুপ থেকে বেশ জোরেই বললো, ছক্কা, তেলের টিন দুটো এনেছিস?

ছক্কা বললো, কোথায় আনলাম! তুই কি আনতে বলেছিলি নাকি?

ফতে তখন একটু রেগে গিয়ে বললো, যা, এক্ষুনি গিয়ে নিয়ে আয়। আমি এদিকটা দেখছি।

ছক্কা তখন পেছন ফিরে আমাদের পাশ দিয়ে হনহন করে হেঁটে সুড়ঙ্গের ভেতর ঢুকে গেলো। আর ফতে বড়ো কালো নৌকোর দিকে কয়েক বার টর্চের আলো ফেললো। নৌকোর ভেতর থেকে একটু পরে কাল রাতের মতো আলো জ্বলে উঠলো, আবার নিভে গেলো। আমরা অবাক হয়ে ফতে আর কালো নৌকোর সংকেত দেখছিলাম। ঠিক এমন সময় আমার একটা হাত কে যেন সাঁড়াশির মতো চেপে ধরলো। চমকে উঠে এক ঝটকা মেরে পেছনে তাকিয়ে দেখি ছক্কা–সব কটা দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসছে। যেভাবে চেপে ধরেছিলো, ঠিক সেভাবেই ধরে রইলো। বাবুর অবস্থা ঠিক আমার মতো। বাবু প্রাণপণে হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো। কিছুই হলো না, বরং ছক্কার দাঁতগুলো আরো বেশি দেখা গেলো।

ওসব চেষ্টা ছক্কার কাছে করে লাভ নেই চান্দু। বাড়াবাড়ি করলে হাত ভেঙে যেতে পারে। হয়তো আমিও ভুল করে একটু মোচড় দিতে পারি। খুব শান্ত গলায় কথাগুলো বললো ছক্কা। তারপর গলা চড়িয়ে ফতেকে ডাকলো–আজও দুটো পাখি ধরেছি ফতে, তবে রাম পাখি নয়, চড়ুই পাখি।

আসলে ছক্কার কাছে আমরা চড়ুই পাখির মতোই। অমন লোহার মতো শরীর আমি টেলিভিশনের কোনো ছবিতেও দেখি নি। ফতে একগাল হেসে বললো, ধরে রাখ। চড়ুই পাখি আবার বেশি ছটফট করে।

ছক্কা আমাদের দুজনকে প্রায় শূন্যে দুলিয়ে ফতের কাছে নিয়ে গেলো। ফিকে অন্ধকারে ফতে প্রথমে আমাদের চেহারা দেখে নি–রাবার মাস্টার দেখি ক্ষুদে গোয়েন্দা লাগিয়েছে। বল ছোঁড়া এখানে কি করে এলি! এই বলে এগিয়ে এসে বাবুর থুতনিটা তুলে ধরে ফতে যেন ধাক্কা খেলো–এ কি, তোমরা! তারপর কর্কশ গলায় ধমক দিয়ে বললো, তোমরা এখানে এলে কীভাবে?

বাবু রেগে গিয়ে বললো, আমাদের খবরদারী করতে হবে না। ভালো চাও তো এক্ষুনি ছেড়ে দাও, নইলে সব্বাইকে পুলিশে দেবো।

খিকখিক করে ফতে বিচ্ছিরি রকম হেসে বললো, ও বাবা, তেজ কতো! রোসো বাছা, গোয়েন্দাগিরির মজা দেখাচ্ছি। কান দুটো যদি মাথার সঙ্গে লাগানো দেখতে চাও, এই বেলায় ভালোয় ভালোয় বলে ফেল বাপু, তোমরা কোন পথে এখানে এসেছো?

বাবু চুপ করে রইলো। ফতে ওর কান ধরার জন্যে হাত বাড়ালো। আমি বললাম, ওর কান ধরতে হবে না। আমি বলছি। তুমি যে-পথে এসেছে, আমরাও সে-পথে এসেছি।

বটে বটে! এই তো দিব্যি কথা বেরুচ্ছে। তা বাপু তোমার বন্ধুটি গোঁয়ার কম নয়। তুমি বেশ বুদ্ধিমান। তাহলে বাছা এবার তুমিই বলো দিকি নি, আমার ঘরে কেন ঢুকেছিলে? আর আমি যে এখানে, সেটাই-বা জানলে কী করে? তাছাড়া অন্ধকারে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?

একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন শুনে আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। তারপর ঢোক গিলে বললাম, বারে, তোমাকে ডাকার জন্যে একটা লোক এলো যে! দরজার ঘন্টা শুনে আমরা নিচে এলাম। এক জন লোক বললো, এখানে মিস্টার ফতেউল্লা বলে একজন গেস্ট থাকেন না? ওঁকে ডেকে দিন। আমরা তখন তোমার ঘরে এসে নক করলাম। দেখি সাড়াশব্দ নেই। তারপর দরজা ধাক্কা দিতে খুলে গেলো। দেখি তুমি ঘরে নেই। তারপর শ্রী গোবর্ধনের ঘরে গেলাম। সেখানেও কেউ নেই। আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম, যদি বিপদ-টিপদ কিছু হয়! তারপর আবার তোমার ঘরে এসে ভালো করে খুঁজলাম! তখনই এই পথটা চোখে পড়লো। ভাবলাম হয়তো এ-পথেই কোথাও গেছে। তাই খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসেছি। এসে যখন তোমাকে ডাকতে যাবো তখনই তো ছক্কা এসে ধরলো।

কথাগুলো এতো সুন্দরভাবে গুছিয়ে বললাম যে, বলার পর আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। ফতেও দেখলাম একটু চিন্তায় পড়ে গেছে। বললো, যে লোকটা ডাকতে এসেছিলো, সে দেখতে কেমন?

আমার হঠাৎ বুড়ো মুৎসুদ্দির কথা মনে পড়লো । অবিকল ওঁর চেহারার বর্ণনা দিয়ে বললাম, কানেও কম শোনেন। শুনে ফতে আরো চিন্তিত হয়ে পড়লো। বিড়বিড় করে বললো, মনে হচ্ছে বুড়ো মুৎসুদ্দি এসেছিলো। তবে কি আমাদের কথায় বুড়ো রাজি হয়েছে! আমার তো কিছুই মাথায় ঢুকছে না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে কী যেন ভাবলো ফতে। তারপর বললো, দেখ বাছারা, আমি মানতে পারি তোমরা কোনো পাপ মন নিয়ে আমাদের পেছনে লাগো নি। কিন্তু মনে পাপ জাগতে কতোক্ষণ। বিশেষ করে তোমরা আমাদের অনেক কথাই শুনে ফেলেছে। আমাদের ভালোর জন্যেই তোমাদের আটকে রাখা উচিত। বড়ো কত্তা যদি ঝামেলা বাড়াতে না চান, তাহলে হয়তো মেরেও ফেলতে পারেন। তবে সে দায় বাপু আমি নিচ্ছি না। তোমাদের নুন খেয়েছি আমি। আমি শুধু তোমাদের দুজনকে বড়ো কত্তার হাতে তুলে দেবো।

আমি মন দিয়ে ফতের কথাগুলো শুনলাম। ওষুধে কিছুটা ধরেছে বটে, তবে আরো ধরা উচিত ছিলো। আমি একটু টিপ্পনি কেটে বললাম, তা নুন যখন খেয়েছে আর সেটা যখন মনেও রেখেছো, তখন সবচেয়ে পুণ্যের কাজ হবে। আমাদের বাড়িতে যেতে দেয়া।

ফতে একটু বিষণ্ণ গলায় বললো, ওটি মাপ করতে হবে বাছা। অনেক পাপ করেছি জীবনে। এটুকু পুণ্যে তার কিছুই কাটবে না। বরং এই পুণ্যের লোভ করলে হাতে হাতকড়া পড়তে আর বেশি দেরি হবে না। ছক্কা, তুই গোবরাকে আলো দেখিয়ে আজকের মতো বারণ করে দে। ও দুটিকে আমার হাতে দে। কী আর করা। আজও মাল গেলো না। বড়ো কত্তা এমনিতে রেগে বাখারি হয়ে। আছেন। এ দুটোকে দেখিয়ে যদি শান্ত করা যায়, দে দেখি।

ফতের হাতে আমাদের তুলে দেয়ার জন্য ছক্কা যখন সাড়াশির বাঁধনটা হালকা করলো, ঠিক তখনই প্রাণপণ শক্তিতে এক ঝটকা মেরে ছক্কার হাত থেকে বেরিয়ে এলাম। বাবুও ঠিক তাই করলো। হতভম্ব ছক্কার চোখের সামনে দিয়ে আমরা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সুড়ঙ্গে ঢুকে গেলাম।

বেশি দূর আর নিশ্চিন্তে যাওয়া গেলো না। একটু পরেই পেছনে ভারি ভারি পায়ের শব্দ শুনলাম। বুঝলাম ছক্কা আর ফতে দুজনই ছুটে আসছে। ওদের কথাও শুনলাম। ছক্কা বলছে, এক্ষুনি ধরে ফেলবো ওস্তাদ। এটুকু পুঁচকে ছোঁড়া আমার সঙ্গে মামদোবাজি করবে? এ জন্মে আর হবার নয়।

ফতে ধমক দিয়ে বললো, ম্যালা বকিস নে ছক্কা। ও দুটোকে না পেলে তোকে আজ শূলে চড়ানো হবে।

পেছন থেকে ফতে টর্চের আলো ফেলছিলো। তাতেই আমরা পথ দেখে ছুটছিলাম। মাটি এবড়োথেবড়ো বলে বেশ জোরে দৌড়ানোও যায় না। বাবু একবার হোঁচট খেয়ে পড়েও গেলো। ওকে টেনে তুলে আবার প্রাণপণে ছুটতে লাগলাম।

বেশ কিছুক্ষণ পর মনে হলো ফতে আর ছক্কাকে একটু পেছনেই ফেলে এসেছি। এবার এতো জোরে না ছুটলেও চলবে। তাছাড়া ওদের টর্চের আলোও দেখা যাচ্ছিলো না। বাবু ওর ছোট টর্চটা বের করে বোতাম টিপলো। আর সঙ্গে সঙ্গে আমরা থমকে দাঁড়ালাম।

আমরা সুড়ঙ্গের ভেতরই দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু এদিকে সুড়ঙ্গটা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। আগের চেয়ে অনেক চওড়া। বাবু হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি আস্তে আস্তে বললাম, ওপরে ওঠার পথ অনেক আগেই পেছন ফেলে এসেছি। দৌড়ে আসছিলাম বলে সময়টা ঠিক বুঝতে পারি নি। আমরা পথ। হারিয়ে ফেলেছি।

বাবু বললো, এখন কী করবে? ফিরে যাবে? আমি বললাম, পেছন গিয়ে লাভ নেই। ফতে আর ছক্কা নিশ্চয়ই এতো সহজে ছেড়ে দেবে না। চলো সামনে এগুই। মনে হচ্ছে সামনে একটা বের হবার পথ পাবো।

বাবু কোনো কথা না বলে এগিয়ে চললো। আমি কাছে এসে ওর একটা হাত ধরলাম, তুমি ভয় পেয়েছে বাবু? ভয় পেলে আর কোনো দিন এখান থেকে বেরুতে পারবো না।

বাবু আমার হাতটা চেপে ধরে বললো, না, ভয় পাই নি।

একটু পরেই আমরা একটা বড়ো গুহার মতো ঘরে এসে পড়লাম। বাবু চারপাশে টর্চের আলো ফেললো। আমার একটা হাত বাবুর হাতে ধরা ছিলো। সে আমার হাতটা আরো চেপে ধরলো। আমি চমকে উঠে চারপাশে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার মুখটা হাঁ হয়ে গেলো।

গুহার মতো যে-ঘরটাতে আমরা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, ওটাকে কী বলবো! মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত সাজানো শুধু রাশি রাশি টাকা আর সোনার তাল। সব এক শ টাকার নোট আর ছোট ইটের মতো সোনার টুকরো। সিঁড়ির মতো চারপাশে ধাপে ধাপে উঠে গেছে। বাবুর ছোট্ট টর্চের ম্লান আলোতেও সেই সমস্ত সোনা রীতিমতো ঝলসে উঠলো। আমি কেন, আমাদের বংশের কেউ কোনো দিন একসঙ্গে এতো টাকা আর সোনা দেখে নি। আমার মনে হলো, কেউ যদি চোখ বেঁধে আমাকে এখানে নামিয়ে দিতো, তাহলে আমি বলতাম, এটা নিশ্চয় স্টেট ব্যাঙ্কের স্ট্রংরুম!

বাবু অনেকক্ষণ পর ফিসফিস করে বললো, এটাই তাহলে সোনার খনি!

আমি শুধু বললাম, সোনার খনি নয়, গুপ্তধন। টাকাগুলো মনে হচ্ছে আসল নয়।

মুহূর্তের মধ্যে আমরা ভুলে গেলাম ছক্কা আর ফতে এখনো আমাদের তাড়া করে ফিরছে; খুব শিগগিরই ওরা এখানে এসে যাবে। বিস্ময়ে আর উত্তেজনায় আমরা রীতিমতো কাঁপছিলাম।

কতোক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম মনে নেই। ছক্কা আর ফতের গলা শুনে আমাদের চমক ভাঙলো। ফতেকে বলতে শুনলাম, কোথায় যে গেলো ছোঁড়া দুটো! আর ছক্কা বললো, মালখানায় একবার দেখলে হয় না ওস্তাদ?

আমরা আবার হুঁশ ফিরে পেলাম। সামনে শুধু একটাই যাবার পথ। পেছনের পথ ধরে ছক্কা আর ফতে আসছে। ছক্কার সেই সাঁড়াশির মতো হাত আর ফতের ভয়ঙ্কর কথাগুলো মনে পড়লো। দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আমরা সামনের পথেই ছুটলাম, পেছনে শুধু ছক্কার গলা শুনলাম, ওস্তাদ, এদিকে পায়ের শব্দ শুনছি।

এক গুহা থেকে আরেক গুহায়–এভাবে কয়েকটা গুহা থেকে বেরিয়ে আসার পর অবশেষে আমাদের থামতে হলো। আগে খেয়াল না করেই সেই গুহাটার ভিতরে ঢুকে পড়েছিলাম। এ ছাড়া অবশ্য অন্য কোনো পথও ছিলো না। ঢুকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই টের পেলাম এবার আমরা সত্যিই ধরা পড়ে গেছি।

গুহার ভেতর আলো জ্বলছিলো। দশ-বারোটা যাচ্ছেতাই চেহারার লোক সেখানে গোল হয়ে বসে আছে। মাঝখানে এক বিশাল টাকার পাহাড়। সব দশ টাকা আর একশ টাকার নোট। লোকগুলো টাকা গুনে ব্যাগে ভরছিলো।

যে-লোকটা আমাদের প্রথম দেখলো, তার চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসার মতো হলো। হাত থেকে টাকার ব্যাগটা খসে পড়লো। এক জন–তোর কি হলোরে পঁচা! অমন করছিস কেন?–এই বলে পঁচার দৃষ্টি অনুসরণ করে যেইমাত্র আমাদের দিকে তাকালো, তক্ষুনি তার দশাও ঠিক পঁচার মতো হলো। এরপর সবাই আমাদের দিকে ফিরে তাকালো। আর চোখগুলোকে আলু বানালো।

আমরা দুজন কিছুই বলতে পারলাম না। চুপচাপ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পরে ছক্কা এসে ঢুকলো। চিৎকার করে আমাদের দিকে ছুটে এলো–এইবার চান্দু, কোথায় পালাবে? এতোক্ষণ ঘুঘু দেখিয়েছি, এবার ফাঁদ দেখাবো। এরপর ছক্কার সাঁড়াশির মতো দুটো হাত আমাদের দুজনের কবজি চেপে ধরলো। প্রতিবাদ করার এতটুকু শক্তি ছিলো না। আমরা অবশেষে ছক্কার হাতে আত্মসমর্পণ করলাম।

তারপর আমাদের শুধু দেখার পালা। ছক্কা বললো, এক জন গিয়ে এক্ষুনি শক্ত দেখে দড়ি নিয়ে আয়। এ দুটোকে কোনো বিশ্বাস নেই। জাত কেউটের ছা!

ঘরের লোকদের ভেতর পঁচা আমাদের প্রথম দেখেছিলো। ওর উৎসাহটাই দেখলাম সবচেয়ে বেশি। আমি আনছি ওস্তাদ–এই বলে পঁচা চোখের পলকে দুখানা নাইলনের কর্ড নিয়ে এলো। সেগুলো দেখে ছক্কা সব কটা দাঁত বের করে বললো, এবার হাত দুখানা দেখি বাছাধন!

বাবু একবার বুঝি দরজার দিকে তাকিয়েছিলো। ছক্কা বললো, ইতিউতি তাকিয়ে কোনো লাভ নেই। এবার কোনো গণ্ডগোল বাঁধিয়েছো তো বড়ো কত্তা আসা পর্যন্ত বসে থাকবো না। আমি নিজেই পিটিয়ে দুরমুশ করে দেবো।

পঁচা এসে আমাদের প্রত্যেকের হাত দুখানা পেছনে নিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিলো। এর পর ছক্কা আমাদের ধাক্কা দিয়ে সামনে ঠেলে দিলো। বাবু হুমড়ি খেয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে ওর কপাল কেটে দরদর করে রক্ত নেমে এলো। আমি পড়তে পড়তে সামলে নিলাম।

এতোক্ষণে ফতে কথা বললো, ওদের পাশের ঘরে নিয়ে আয় ছক্কা। আর পঁচা গিয়ে বড়ো কত্তাকে খবর দে!

ছক্কা আমাদের ঘাড় ধরে শূন্যে ঝুলিয়ে পাশের গুহায় নিয়ে গেলো। ফতে বললো, ভেবেছিলাম বাছা তোমাদের জন্যে বড়ো কত্তার কাছে একটু ওকালতি করবো। তা তোমাদেরই বাপু কপাল মন্দ। আমার এই বাতের শরীর নিয়ে বাপের জন্মে কখনো এমনি ভাবে ছুটি নি। নিজের কপাল নিজেই খেলে। আমি কী করবো!

আমি বললাম, নিজের চরকায় তেল দাও।

বাবু বললো, এবার ম্যারাথন রেসের জন্যে তৈরি হওগে। জাহেদ মামা এক্ষুনি এলেন বলে।

ছক্কা আমাদের মাথায় দুটো গাট্টা মেরে বললো, বলি নি ওস্তাদ, জাত কেউটের ছা! কিরকম চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলছে দেখ!

ছক্কার গাট্টা খেয়ে আমি আর বাবু চোখে হলুদসর্ষে ফুল, নীল তারা–সব একসঙ্গে দেখতে লাগলাম। ফতে বললো, থাক এখানে বসে। যাই ওখানে একটা খবর দিয়ে আসি। তোদের বাড়ির কেউ টের পেলো কিনা কে জানে। আর পেলেই বা কি!

ফতে বেরিয়ে যাওয়ার পর ছক্কা পকেট থেকে চ্যাপটা একটা মদের বোতল বের করে মেঝের ওপর পা ছড়িয়ে বসলো। ঢকঢক করে কয়েক ঢোক গিলে বললো, অনেক দিন নিজের হাতে কাউকে সাবাড় করি নি। হাত দুটো ভারি নিশপিশ করছে। বড়ো কাকে বলে এবারের কাজটা আমি নিজেই করবো।

পাশের ঘর থেকে একজন ছক্কাকে ডেকে বললো, ওস্তাদ, একা পুরো বোতল মেরে দেবে নাকি! আমরা তোমার পেসাদ পাবো বলে কখন থেকে বসে আছি।

একগাল হেসে ছক্কা উঠে পাশের ঘরে গেলো। বাবু আমার দিকে তাকালো। ওর মুখে রক্তের দাগ। মুছে দিতে যাবো–খেয়াল হলো, আমারও হাত দুটো পেছনে বাঁধা। আমি ফিসফিস করে বললাম, তুমি বসে থাকো। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।

বুদ্ধিটা এসেছিলো খোলা চিমনি ঢাকা বাতিটা দেখে। কোনো একটা ছবিতে দেখেছিলাম, এ রকম এক অবস্থায় নায়কটা বাতির আগুনে হাতের বাঁধন পুড়িয়ে ফেলেছিলো।

পাশের গুহায় ওদের জমজমাট আসর বসেছে। আমি চুপি চুপি বাতিটার কাছে গেলাম। একটা প্যাকিং বাক্সের ওপর রাখা ছিলো বাতিটা। বুকটা তখন টিবটিব করছে। আন্দাজের ওপর বাতির আগুনে হাতটা রাখলাম। বাবু একটু হাতটা ডানপাশে সরাতে বললো। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম আলোর অনেক দূরে আমি হাত রেখেছি। একটু লজ্জাও পেলাম। হাতটা সরিয়ে ফেললাম। আর ততোক্ষণে হাতের ধাক্কা লেগে চিমনিটা কাত হয়ে পড়ে ঝনঝন শব্দ করে ভেঙে গেলো।

কী হচ্ছে ওখানে–-বলে ছক্কা ছুটে এলো। ভাঙা চিমনি আর আলোর কাছে আমাকে দেখে ব্যাপারটা বুঝতে ওর একটুও অসুবিধে হলো না। মোলায়েম গলায় বললো, ছিঃ, অমন কাজ কেউ করে! হাতে ফোস্কা পড়বে যে। তারপর এগিয়ে এসে মাথায় আরেকটা গাট্টা মেরে আমাকে দেয়ালের দিকে ছুঁড়ে দিলো–ফের মামদোবাজি করা হচ্ছে। এই বলে ছক্কা আলোটা নিয়ে চলে গেলো।

মাথায় হাত না দিয়েও টের পেলাম ওখানে দুটো সুপারি গজিয়েছে। ছক্কার গাট্টা যারা খায় নি, তাদের কখনো বলে বোঝানো যাবে না, কী ভয়ঙ্কর গাট্টা মারতে পারে এই বদমাশটা! ললি টুনির কথা মনে পড়লো। ওরা এখনো কি নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে? ওদের বলে আসা উচিত ছিলো। কোনো রকমে যদি ওরা জানতে পারে, তাহলে এতোক্ষণে সবাই নিশ্চয়ই আমাদের খুঁজতে বেরিয়েছে। জাহেদ মামার লোকদের যারা খুন করেছে, তাদের খুঁজতে খুঁজতে তিনি যদি এমন সময় লোকজন নিয়ে এখানে এসে পড়তেন, তাহলে বেশ হতো। দেয়ালে। মাথা রেখে বসে বসে এমনি সব আজগুবি কথা ভাবছিলাম। এমন সময় পঁচা এলো। আমাদের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলো। তারপর পাশের গুহায় গিয়ে বললো, বড়ো কত্তা এক্ষুনি আসবেন। তোমরা সব গুছিয়ে নিয়ে বাইরে পাহারার ব্যবস্থা করো।

এক জন পঁচাকে জিজ্ঞেস করলো, মাল কি আজও যাবে না ওস্তাদ! ট্যাক যে গড়ের মাঠ।

লোকটার কথার ধরন দেখে মনে হলো কলকাত্তাইয়া। পঁচা বললো, ও নিয়ে তোরা ভাবিস না। যে দুখানা হীরের টুকরো পেয়েছি–বড় কত্তা সব পুষিয়ে দেবেন।

আমাদের ওপর খেয়াল রেখো ওস্তাদ–এই বলে ভেতরের লোকগুলো ঢুলতে ঢুলতে একে একে বেরিয়ে গেলো। গুহার ভেতর শুধু রইলো ছক্কা আর পঁচা। বসে বসে মদ খাচ্ছিলো ওরা। দুর্গন্ধে ভরে আছে গুহার ভেতরটা।

.

১০. শুধু অবাক হবার পালা

আমাদের বোধ হয় একটু ঝিমুনির ভাব এসেছিলো। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে একটা লোক ভেতরে ঢুকলো। চারপাশে তাকিয়ে ডাকলো, পঁচা ওস্তাদ, তুমি কোথায়?

পঁচা ভেতরে থেকে জবাব দিলো–এখানে ষাঁড়ের মতো চাচাচ্ছিস কেন?

লোকট ভেতরে ঢুকলো। পঁচা ওকে ধমক দিয়ে বললো, তোদর এক শ বার বারণ করেছি না আমাকে পঁচা বলে ডাকবি না। বাপ-মা আদর করে বলতো বলে তোরাও আমার মা-বাপ হলি নাকি! আমাকে পঞ্চানন ওস্তাদ বলবি, নইলে মুণ্ডুটা ধড় থেকে আলাদা করে ফুটবল খেলবো।

লোকটা একটু বিরক্ত হয়ে বললো, তা না হয় খেললে। এখন লেকচার থামিয়ে ছেঁড়া দুটোকে নিয়ে খাস কামরায় এসো। বড়ো কত্তা ডাকছেন।

বড়ো কত্তার কথা শুনে পঁচা মিনমিনে গলায় বললো, বড়ো কত্তা ডাকছেন, আগে বলবি তো।

পঁচা আমাদের ঘাড় ধরে টেনে তুললো। ছক্কা বললেলা, খবদ্দার ছোঁড়া, তোদের মেরেছি বা ধমক দিয়েছি–এসব কথা যদি বড়ো কত্তাকে বলিস, তাহলে মরার সময় টের পাবি আমি কী রকম রসিয়ে রসিয়ে মারতে পারি।

ছক্কা আর পঁচা আমাদের কয়েকটা গুহার ভেতর দিয়ে ওদের বড়ো কত্তার খাস কামরায় নিয়ে এলো। কিন্তু বড়ো কত্তা কোথায়? এযে দেখি আন্নাকালীর পাহাড়ের সেই নিকুঞ্জ পাকড়াশী! পাশে ফতে বসে আছে। আমাদের দেখে পাকড়াশী লোম ওঠা, উকুন-অলা, বেতো কুকুরের মতো খেঁকিয়ে উঠলো–তোদের আস্পদ্দা তো বাছা কম নয়, আমার পেছনে লাগতে আসিস? তোদের জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে ফেললেও আমার রাগ যায় না।

বাবু ভালোমানুষের মতো বললো, আপনার প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ। আপনি এসবের মধ্যে আছেন আমরা জানবো কী করে?

পাকড়াশী আগের মতো খ্যাকখ্যাক করে বললো, থাক থাক, আর আদিখ্যেতা দেখাতে আসিস নে। সবাই পঞ্চমুখ হোক আর পঞ্চাশ মুখ হোক, তোদের আমি ছাড়ছি নে। তোরা আমাকে পথে বসাবার জো করেছিলি। তোদের সঙ্গে ছুঁড়ি দুটো যে ঘুরতো, সেগুলো কোথায়?

বাবু কী যেন বলতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ ঘেউঘেউ শব্দ শুনে ঘরমুদ্ধো

সবাই চমকে উঠলো। বাবু চাপা গলায় বললো, স্ক্যাটরা আসছে।

আমি চিৎকার করে ডাকলাম, স্ক্যাটরা।

সঙ্গে সঙ্গে ঘেউ করে স্ক্যাটরা ভেতরে ঢুকলো। ছুটে এসে আমার গাল চেটে দিলো। হাত বাঁধা বলে আমি আদর করতে পারলাম না। স্ক্যাটরা বুঝতে পেরে পেছনে গিয়ে দাঁত দিয়ে কর্ডটা ছেঁড়ার চেষ্টা করলো। আমরটা না পেরে বাবুর কাছে গেলো। তার পর ছক্কা আর পঁচাকে দেখে মহা চিৎকার জুড়ে দিলো।

পাকড়াশী চেঁচিয়ে বললো, এই কুত্তোটা এখানে এলো কী করে! ওর কথা শেষ না হতেই ললি টুনি ছুটতে ছুটতে এসে ভেতর ঢুকলো। আমাদের এই অবস্থা দেখে ওরা হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। স্ক্যাটরা তখন ওদের কাছে ছুটে গেলো।

আমি বললাম, তোমরা কী করে এখানে? গোবর্ধন কোথায়?

টুনি হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, গোবর্ধনকে ধরে শেকল আটকে রেখে এসেছি। বাথিনকে পাঠিয়েছি জাহেদ মামার কাছে।

পাকড়াশী খিকখিক করে হেসে বললো, ভালো কাজ করেছিস। কই রে বাথিন, টিকটিকিটাকে কী বলেছিস এসে এদের বল।

ওপাশের পথ দিয়ে বাথিন এসে ভেতরে ঢুকলো। তারপর পাকড়াশী আদর করে ডাকলো, গোবর, তুই আবার কোথা গেলি!

লাজুক মুখে গোবর এসে পাকড়াশীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ললি আর টুনির চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেলো। পাকড়াশী বললো, অমন করে তাকাস নে বাছা, চোখের মণিটা ঠিকরে বেরিয়ে যাবে। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বললো, সব কটাই তাহলে ধরা পড়লো। এবার টিকটিকিটার ব্যবস্থা করে এক্ষুনি আমরা জাহাজ নিয়ে কেটে পড়বো। গোবর, ঘুড়ি দুটোকেও এগুলোর মতো বেঁধে ফেল।

গোবর একটা দড়ি হাতে যেইমাত্র ললি টুনির দিকে এগিয়েছে, তখনই স্ক্যাটরা ঘেউ করে ওর দিকে তেড়ে গেলো। গোবর ওরে বাপ বলে এক লাফে পিছিয়ে এসে একেবারে পাকড়াশীর কোলে বসে পড়লো।

পাকড়াশী ওকে কান ধরে টেনে তুললো। রেগে চেঁচিয়ে বললো, এখনো তোর কুত্তোর ভয় যায় নি দেখছি। বলেছি না ফের ভয় পেলে তোকে ডাল কুত্তো দিয়ে খাওয়াবো। দাঁড়া, ডাল কুত্তো নয়, আজ তোকে এই কেলে কুত্তো দিয়েই খাওয়াবো।

স্ক্যাটরা সমানে ঘেউঘেউ করতে লাগলো। পাকড়াশী বিরক্ত হয়ে বললো, কুত্তোটাও যেন সাপের পাঁচ পা দেখেছে। ছক্কা, এটাকেও বেঁধে ফেল।

এবার স্ক্যাটরা চিৎকার করে ছক্কার দিকে তেড়ে গেলো। ছক্কা হাত দিয়ে বাধা দিতে গেলো। সেই হাতে স্ক্যাটরা গাঁক করে কামড় দিয়ে এক খাবলা মাংস তুলে নিলো। তারপর স্ক্যাটরা প্রচণ্ড গর্জন করে পাকড়াশীর দিকে ছুটে গেলো। স্ক্যাটরার দাঁতে রক্ত, চোয়াল বেয়ে রক্ত পড়ছে। ওকে তখন রীতিমতো ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছিলো।

হাউমাউ করে চেঁচিয়ে পাকড়াশী বললো, এতোগুলো তোরা ঘরের মধ্যে–কুত্তোটাকে কেউ আটকাতে পারিস না!

এমন সময় ফতে কোমর থেকে একটা ছুরি বের করে স্ক্যাটরার দিকে ছুঁড়ে মারলো। আমি সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে ডাকলাম, স্ক্যাটরা।

স্ক্যাটরা যদি সেই মুহূর্তে ফিরে না তাকাতো, তাহলে ছুরিটা ওর চোখে গিয়ে বিধতো। তার বদলে মাথার চামড়ায় আঁচড় কেটে ছুরিটা ছিটকে বেরিয়ে গেলো। পাকড়াশীকে ফেলে স্ক্যাটরা ফতের টুটি কামড়ে ধরলো। ফতে তার বিশাল শরীর নিয়ে মেঝেতে দড়াম করে আছড়ে পড়লো।

এই ফাঁকে দুটো লোক এসে চোখের পলকে ললি টুনির হাত দুটো পিছমোড়া করে বেঁধে ফেললো। দুজন গিয়ে জাপটে ধরলো স্ক্যাটরাকে। মনে হলো বাঁচবার আর বুঝি কোনো আশা নেই। বাবুর দিকে তাকালাম। অসহায়ভাবে ও মুখ ঘুরিয়ে নিলো।

পাকড়াশী দেওয়ালের সাথে লাগানো আলমারিটার কাছ ছুটে গেলো। এক ঝটকায় আলমারি খুলে ভেতর থেকে ভেতর থেকে কালো ছোট্ট একটা পিস্তল বের করে আনলো।

আগে কুত্তোটাকে শেষ করবো–এই বলে স্ক্যাটরার দিকে তাক করে ট্রিগার টিপতে যাবে, ঠিক তখনই দরজার কাছে যেন বোমা পড়লো–।

হ্যান্ডস আপ এভরি বডি। সবাই মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়াও।

পাকড়াশীর হাত থেকে পিস্তলটা খসে পড়ে গেলো। টুনি চিৎকার করে শুধু বললো, জাহেদ মামা!

জাহেদ মামার সঙ্গে আরো কয়েক জন আর্মি অফিসার, পুরো ইউনিফর্ম পরা, প্রত্যেকের হাতে পিস্তল আর পেছনে দুটো স্টেনগানের নল চকচক করছে। দুজন স্টেনগানধারী সৈন্য ভেতরে এসে পজিশন নিলো। স্ক্যাটরা ছুটে গিয়ে জাহেদ মামার গাল-টাল চেটে একাকার করে দিলো। এক জন অফিসার এগিয়ে এসে পাকড়াশী, ফতে, গোবর, ছক্কা, পঁচা আর বাথিনকে হাতকড়া পরিয়ে দিলেন। জাহেদ মামা আমাদের হাতের বাঁধন কেটে দিতে দিতে বললেন, তোমাদের এরা বেশি মারধোর করে নি তো?

আমি বললাম, বেশ কিছু করে নি। ছক্কা শুধু মাথায় গাট্টা মেরে কটা সুপুরি বানিয়ে দিয়েছে।

হাতকড়া পরা ছক্কা কটমট করে আমার দিকে তাকালো। টুনি ওকে ভেংচি কাটলো। ললি শুধু মুখ টিপে হাসলো।

বাবু বললো, আরও তো ছিলো জাহেদ মামা। ওরা কোথায়?

জাহেদ মামা একটা রুমাল বের করে বাবুর কপালের রক্তটা মুছে দিতে দিতে বললেন, সব কটা ধরা পড়েছে। তোমরা সাংঘাতিক একটা কিছু করে

ফেলেছো!

এমন সময় আমরা নেলী খালার গলা শুনলাম। আমার ছেলেমেয়েরা কোথায়? বলতে বলতে নেলী খালা এসে ভেতরে ঢুকলেন। স্ক্যাটরা যথারীতি ছুটে গিয়ে তাঁর গলা চেটে দিলো।

নেলী খালা এক বার আমাকে, এক বার বাবুকে আর এক বার ললি টুনিকে চুমো খেতে খেতে বললেন, আমাকে না জানিয়ে এতো সব করা হয়েছে! আমি শুধু ভেবে ভেবে মরি। আমি বুঝি তোদের কেউ নই! বলতে বলতে নেলী খালা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।

জাহেদ মামা এগিয়ে নেলী খালার কাঁধে হাত রেখে বললেন, নেলী, ওদের নিয়ে ঘরে ফিরে যাও। আমি ঘন্টাখানেকের মধ্যে ফিরে আসছি।

স্ক্যাটরাকে জড়িয়ে ধরে নেলী খালা বললেন, ইশ, তোর মাথা কেটে গেছে দেখছি! কী করে এমন হলো?

টুনি বললো, ওই কালোদেড়ে ছক্কা শয়তানটা স্ক্যাটরাকে ছুরি মেরেছিলো।

নেলী খালা এবার পাকড়াশীকে ধরলেন আপনার পেটে পেটে যে এতো বিদ্যে, তা তো জানতাম না নিকুঞ্জ বাবু। আমার অতিথি দুজনও দেখি বহাল তবিয়তে আছে।

গোবর নালিশ জানাবার মতো করে করুণ গলায় বললো, আপনার কুত্তোটা ফতের গলা কামড়ে দিয়েছে দিদি।

নেলী খালা এক বার ফতের দিকে তাকালেন। ওর গলা রক্তে ভেসে যাচ্ছিলো। বেশ করেছে।–বলে নেলী খালা আমাদের নিয়ে বেরিয়ে এলেন।

আমরা যে-পথ দিয়ে এসেছিলাম, নেলী খালা তার উল্টো দিকের পথে গেলেন। টুনি বললো, এপথে তোমরা এলে কী করে?

নেলী খালা অবাক হয়ে বললেন, কেন, আমরা সবাই এ পথে এসেছি। ওদের একটা লোককে দুঘা বসাতেই সব দেখিয়ে দিলো। বাইরে থেকে অবশ্য আমরা স্ক্যাটরার গলার শব্দ শুনেছিলাম।

স্ক্যাটরা ওর নাম শুনে আরেক দফা নেলী খালাকে চেটে দিলো।

বাবু বললো, আমরা ফতের ঘরের ভেতর দিয়ে এখানে এসেছি। আপনি ওর ঘরের নিচে সুড়ঙ্গ দেখেন নি নেলী খালা?

নেলী খালা বললেন, তাড়াহুড়োয় চোরাপথ একটা দেখেছিলাম বটে। ভেবেছি আণ্ডারগ্রাউণ্ড সেলারে যাবার পথ বুঝি ওটা। আমি তো তোমাদের না দেখে জীপ নিয়ে সোজা জাহাজের ওখানে গেলাম। ততক্ষণে অবশ্য জাহেদরা বেশ কটাকে ধরে ফেলেছে।

আমরা সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভেতরটা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো । ওদিকের মতো এবড়োথেবড়ো নয়। বাবুর মিটমিটে টর্চের আলোতে চারপাশে দেখছিলাম। বাবু বললো, নেলী খালা সোনার খনি দেখেন নি?

নেলী খালা চমকে উঠে বললেন, কোথায় সোনার খনি!

টুনি অবাক হয়ে বললো, তুমি কোথায় দেখলে?

আমি বললাম, সোনার খনি নয়। চোরাই সোনা। ওরা পাচার করার জন্যে তাল তাল সোনা একটা গুহার ভেতর স্তূপ করে রেখেছে। জাহেদ মামারা নিশ্চয়ই উদ্ধার করবেন।

বাবু বললো, কিসের টাকা?

আমি বললাম, টাকার পাহাড়। সব দশ টাকা আর এক শ টাকার নোট। পাকড়াশীর লোকেরা গুনে গুনে বস্তায় ভরছিলো।

ললি বললো, তোমরা সত্যিই তাহলে গুপ্তধন আবিষ্কার করেছে!

আমি বললাম, বলতে পারো। তবে এ গুপ্তধন হার্মাদদের নয়, ওদের মতো আরেক পাজি নিকুঞ্জ পাকড়াশীর।

আমরা এর পর একটা সরু সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম। ভ্যাপসা একটা গন্ধ নাকে আসছিলো। অনেক সিঁড়ি। নেলী খালা বলেলেন তোমরা তাহলে গুপ্তধন খুঁজতে এখানে এসেছিলে?

বাবু বললো, প্রথমে গুপ্তধন খোঁজার প্ল্যান ছিলো। পরে লরেল হার্ডির আলোর সংকেত দেখে অন্য কিছু ভেবেছিলাম। তদন্ত করতে গিয়েই এতো কিছু।

টুনি বললো, ওই পাজি দুটোকে লরেল হার্ডি বলো না। লরেল হার্ডি অনেক ভালো। গোবরটা কী শয়তান! তোমাদের ঘরে না দেখে আমরা ওকে শেকল আটকে রেখে এসেছিলাম। দিব্যি বেরিয়ে এসেছে।

বাবু টুনিকে বললো, তোমরা স্ক্যাটরাকে না আনলে এতোক্ষণে আমাদের প্রাণ-পাখি খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে যেতো।

টুনি বললো, ছিঃ, কী নোংরা কথা!

নেলী খালা বললেন, আমার বাপু মাথায় কিছু ঢুকছে না। ললি টুনি কি তোমাদের সঙ্গে আসে নি?

টুনি বললো, দেখ না নেলী খালা। আমাদের না বলে দিব্যি এ্যাডভেঞ্চার করতে বেরিয়েছেন। আমাকে আর ললিপাকে না বলে আসার মজাটা টের পেয়েছো তো?

আমি বললাম, মজা আর বলতে! এখনো মাথায় দুটো সুপুরি টনটন করছে।

বাবু ফিক করে হেসে বললো, আমার একটা।

আমি বললাম, তাই বলে তোমার মতো আমার কপাল ফাটে নি।

.

অবশেষে আমরা বাইরে এলাম। অবাক হয়ে চারপাশে তাকালাম। এ যে দেখি সেই ছাতিম গাছ আর আন্নাকালীর মন্দির। মন্দিরের প্রতিমা রাখার বেদিটার নিচে যে একরম একটা সুড়ঙ্গ আছে, আমরা কেউ ভাবতেও পারি নি।

অল্প দূরে নেলী খালার জীপটা দাঁড়িয়ে ছিলো। ড্রাইভিং সীটে বসে স্টার্ট দিতে দিতে নেলী খালা বললেন, এখনো আমার মাথায় ঢুকছে না। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমি শানুপাকে স্বপ্নে দেখছিলাম। আচারগুলো রোদে দিচ্ছি না বলে তিনি আমাকে বকছিলেন। তখনই বাইরে দরজা খোলার শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেলো। উঠে দেখি ফতে গোবর্ধন কেউ ঘরে নেই। ওপরে গিয়ে দেখি তোমরা চার মূর্তি নেই। স্ক্যাটরাকে ডাকলাম। ওটাও নেই। আব্দুকে শুধু বললাম, আমি জাহেদের কাছে যাচ্ছি। আবির, বাবু, ললি, টুনিকে বোধ হয় ফতে গোবরা কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে।

জাহেদ মামার বাংলোর সামনে বনমালী দাঁড়িয়ে ছিলো। বাবু বললো, নেলী খালা, জাহেদ মামার ফ্রীজ থেকে একটু বরফ নিন।

টুনি বললো, বরফ কী করবে, খাবে?

বাবু বললো, অতো সখ নেই, মাথার সুপুরিগুলোর জন্যে।

নেলী খালা জীপ থামাতেই বনমালী ছুটে এলো। বললো, সবকিছু ঠিক আছে তো বিবিজি?

নেলী খালা এতোক্ষণে হাসলেন–সব ঠিক আছে। তুমি আমাদের একটু বরফ এনে দাও।

বনমালী ছুটে গিয়ে ফ্লাস্কে করে বরফ এনে দিলো। নেলী খালা বললেন জাহেদের ফিরতে একটু দেরি হবে। আর কোনো ভয় নেই বনমালী।

বনমালী সবগুলো দাঁত বের করে বললো, কী যে বলেন বিবিজি! বনমালী ভয় পাবার বান্দা নয়।

গাড়িতে যেতে যেতে বাবু নেলী খালার প্রশ্নের জবাব দিতে লাগলো। অনেক রাত হয়েছে। পাহাড়ের ওপর কালো আকাশে শুধু তারার মিছিল। গুহার ভেতরের গুমোট বাতাসের রেশটুকু চলে গেলো। ললিকে আস্তে আস্তে বললাম, বুকের ব্যথাটা এখনো আছে ললি?

ললি মাথা নেড়ে বললো, এখন নেই।

ঘরে নানু আমাদের জন্যে স্টাডিতে পায়চারি করছিলেন, আমাদের দেখে তিনি রীতিমতো অবাক হলেন। নেলী খালাকে ধমক দিতে গিয়ে হেসে ফেললেন–আমার চার কাপ চা খাওয়া হয়েছে। তোমরা আমার ঘুম নষ্ট না করে ছাড়বে না দেখছি!

নানুকে বললাম, আজ আর ঘুম হবে না। বসুন, আপনাকে সব খুলে বলছি। জাহেদ মামা এক্ষুনি এসে পড়বেন।

নানু বললেন, মারামারি হয় নি তো? বাবুর কপাল কাটলো কী করে?

বাবু বললো, অনেক কিছু হতে পারতো। তবে সে রকম কিছুই হয় নি।

নেলী খালা ফ্লাস্ক থেকে আমাদের বরফ বের করে দিলেন। মাথার সুপুরিতে বরফ ঘষতে ঘষতে নানুকে সব খুলে বললাম। ততোক্ষণে জাহেদ মামাও এসে গিয়েছিলেন। তিনিও শুনলেন। কিছু কিছু জেরাও করলেন–পাকড়াশীকে তোমরা সন্দেহ করলে কীভাবে?

আমি বললাম, প্রথমে ওরা পাহাড়ে আলো আর সেই অদ্ভুত লম্বা মানুষ দেখে, তারপর ফতে গোবরকে ওর বাসায় যেতে দেখে। ফতেরা যদিও অস্বীকার করেছিলো, পরে আমরা লুকিয়ে ফলো করে টের পেয়েছিলাম ওদের সঙ্গে পাকড়াশীর যে সম্পর্ক আছে সেটা ওরা গোপন রাখতে চায়। ভাইয়া যে বলেছিলো পাকড়াশীটা খুব পাজি, সে কথা আর জাহেদ মামাকে বললাম না। ভাইয়ার কথা কাউকেই বলবো না।

টুনি বললো, আবির যে লম্বা মানুষ দেখেছিলো, ওকে ধরেছো জাহেদ মামা?

জাহেদ মামা হেসে বললেন, মানুষটা লম্বা নয়। রণ-পা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়। লোকজনকে ভয় দেখানোও হয়, আবার তাড়াতাড়ি চলাফেরাও যায়। এবার বলো, ফতে গোবরকে প্রথম কী দেখে সন্দেহ করলে?

আমি বললাম, সেই যে খাবার টেবিলে গোবর স্ক্যাটরাকে দেখে ভয় পেলো, তখন ফতে বিড়বিড় করে বলেছিলো, এসব কাজে ওস্তাদ কেন যে এমন ভীতুর ডিমগুলোকে সঙ্গে দেয় বুঝি না। তাতেই প্রথম সন্দেহ হলো। তারপর হাঁপানির রোগী বলে দোতালায় থাকলো না, অথচ তরতর করে পাহাড় বেয়ে উঠলো। এ ছাড়া মেঝেতে কান পেতে ওদের কথা শুনেছিলাম। শেষে মেঝে ফুটো করে ওদের কাণ্ডকারখানা দেখে ফেললাম।

জাহেদ মামা বললেন, ওরা যে পাহাড়ে পাহাড়ে কী রকম শেয়ালের মতো সুড়ঙ্গ কেটে রেখেছিলো, বাইরে থেকে বোঝার এতোটুকু সাধ্যি নেই। আমরা পাঁচটা মুখ খুঁজে পেয়েছি। আরও খোঁজা হচ্ছে।

আমি বললাম, সেই সব সুড়ঙ্গের মুখে নিশ্চয়ই একটা গাছ আছে, যেখানে মড়ার খুলি আঁকা রয়েছে?

জাহেদ মামা হেসে মাথা নাড়লেন। নেলী খালা শুধু অবাক হচ্ছিলেন।

জাহেদ মামা এরপর নেলী খালাকে বললেন, তোমার স্ক্যাটরা যে কী উপকার করেছে নেলী। ওকে একটা মেডেল দেয়া দরকার। ও ভেতর থেকে না চাঁচালে কিছুতেই বুঝতে পারতাম না, মাটির নিচে এতো কিছু ঘটছে। আসলে ওর চাঁচানি শুনেই পাকড়াশীর লোকগুলো ঘাবড়ে গিয়েছিলো। নইলে হাজার পেটালেও ওরা স্বীকার করতো না।

আমি বললাম, স্ক্যাটরা না এলে এতোক্ষণ আমরা জাহাজে থাকতাম। তবে বাথিন যে ওদের দলের এটা আমরা আগে কখনো ভাবি নি।

স্ক্যাটরা যেই শুনলো ওকে নিয়ে কথা হচ্ছে, তক্ষুনি ছুটে এসে ময়লা পা নিয়ে জাহেদ মামার কোলে উঠে বসলো।

নেলী খালা গরম পানি এনে বাবুর কপালে আর স্ক্যাটরার মাথায় ভালো করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন।

সেই রাতে আমাদের কথা যেন আর ফুরোতেই চায় না। নেলী খালা বললেন, আমি শুধু ভাবছি শানুপা শুনলে কী করবেন।

আমি হেসে বললাম, কী আর করবেন। বুঝবেন উদভুটি কাণ্ড করার ব্যাপারটা শুধু একচেটিয়া তোমার নয়। আমরাও উদভুটি কাণ্ড করতে পারি।

নানু হেসে বললেন, শানু আর জামানকে আসতে লিখে দাও। সাত দিনের ছুটি পেতে জামানের নিশ্চয়ই অসুবিধে হবে না।

জাহেদ মামা একটু লাজুক হেসে বললেন, আমিও লম্বা একটা ছুটির দরখাস্ত দেবো ভাবছি।

টুনি বললো, তারপর আমরা সবাই মিলে সত্যিকারের সোনার খনি আর হার্মাদদের গুপ্তধন খুঁজবো।

ললি বললো, পিকনিকের কথা বাদ দিচ্ছো কেন? আমরা রোজ পিকনিক করবো।

মা এলে যে কী দারুণ মজা হবে, আমি ভাবতেই পারছিলাম না। এমনও তো হতে পারে যে, ভাইয়ার সঙ্গে মার দেখা হয়ে গেলো। নির্ঘাত আনন্দে ফিট হয়ে যাবেন। আর ভাইয়া যখন সব শুনবে, তখনও কি ভাববে আমি ছোট্টটি রয়ে গেছি, যাকে সব কথা বলা যায় না? সে-রাতে আমাদের কারোই ঘুম এলো না। বাইরে যখন কাক ডাকলো, তখন নেলী খালা আমাদের চার জনকে চার গ্লাস দুধ এনে দিলেন। দুধ খাওয়ার পর আধখানা ভেলিয়াম টু দিয়ে বললেন, এটা খেয়ে এক্ষুনি ঘুমুতে যাও। সন্ধেয় জাহেদের ওখানে বিরাট এক পার্টি আছে।

.

১১. পার্টিতে আরও চমক

পরদিন সকালে এগারোটায় আমাদের ঘুম ভাঙলো। মাথায় হাত দিয়ে দেখলাম ফুলোটা অনেক কমেছে। আমি যখন উঠে বসেছি, তখনো বাবু ঘুমিয়ে ছিলো। ওর মাথায় ব্যান্ডেজ করা। ভারি মায়া লাগলো ওকে দেখে। আস্তে আস্তে ওকে ডেকে তুলোম। ঘুমঘুম চোখে বাবু আমার দিকে তাকালো। নেলী খালা জানালার ভারি পর্দাগুলো সব টেনে দিয়েছেন বলে ঘরের ভেতরটা বেশ অন্ধকার ছিলো। বাবু বললো, আজকের প্রোগ্রাম বলো।

আমি একটু হেসে বললাম, কেন জাহেদ মামার পার্টি!

ললি টুনি দেখলাম আমাদের আগেই উঠে পড়েছে। টুনি ফুলো মুখে দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে বললো, হিরোদের দেখি ঘুম ভেঙেছে। নিচে গিয়ে দেখো যে জিওলজিক্যাল সার্ভে থেকে দুজন বুড়ো ভদ্রমহিলা এসেছেন। নেলী খালা ওদের বোঝাচ্ছেন আসল হিরো হলো তোমরাই।

আমি বললাম, জাহেদ মামা কি নকল হিরো?

বাবু ললি টুনি একসঙ্গে হেসে ফেললো। আমি আর বাবু মুখ-হাত ধুয়ে ললি টুনিকে নিয়ে নিচে এলাম।

নেলী খালা জিওলজিক্যাল সার্ভের বুড়ো ভদ্রমহিলাদের সঙ্গে আমাদের এমনভাবে পরিচয় করিয়ে দিলেন যে, আমরা দুজন পাকা টমেটোর মতো লাল হয়ে গেলাম।

খাবার টেবিলে বসে টুনি আমার কানে কানে বললো, ভদ্রমহিলারা তোমাদের দুজনকে পছন্দ করে ফেলেছেন। কথাটা বোধহয় এবার পাকা করেই যাবেন। নইলে নেলী খালা, শানু খালাকে চিঠি দেয়ার জন্যে এতো ব্যস্ত হয়ে পড়তেন না।

আমার মুখের ভেতর আস্ত একটা ডিম, তাই কোনো কথা বলতে পারলাম না। মারার জন্যে হাত তুলোম। টুনি একছুটে পালিয়ে গেলো। বাবু অবাক হয়ে বললো, কী বলেছে টুনি?

টুনির কথা শুনে বাবু আর ললি হেসে গড়িয়ে পড়লো।

সন্ধেবেলা আমরা সবাই সেজেগুজে জাহেদ মামার বাংলোতে এলাম। নেলী খালা চমৎকার ময়ূরকণ্ঠী নীলের ভেতর ছাই রঙের নকশা-আঁকা সিল্কের শাড়ি পরেছেন। আমি পরেছিলাম, বাবু যে শার্টটা আমার জন্যে আমেরিকা থেকে এনেছিলো। বাবুকেই সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগছিলো। বেচারার মাথার ব্যান্ডেজটা নেলী খালা খুলতে দেন নি। ললি টুনি রাশান মাশকা পুতুলের মতো সেজেছিলো। টুনির চুলগুলো অবশ্য আগের মতোই ঝোলানো শিং-এর মতো খোঁপা করা। ললি জামার সঙ্গে রং মিলিয়ে চওড়া রিবন দিয়ে ওর রেশমের মতো নরোম আর চকচকে চুলগুলো বেণী বেঁধেছে। নানু পরেছেন হালকা ছাই নীল রঙের সামার স্যুট। স্ক্যাটরা বেচারাও বাবুর মতো ব্যান্ডেজ খুলতে পারে নি। ললি ওর গলায় একটা লাল রিবন বেঁধে দিয়েছে।

জাহেদ মামা দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলেন। গাঢ় নীল প্যান্টের সঙ্গে হালকা নীল শার্টে জাহেদ মামাকে ঠিক বিদেশী ছবির নায়কদের মতো দেখাচ্ছিলো। ওঁর পাশে পুরো ইউনিফর্ম পরা একজন আর্মি কর্নেল। জাহেদ মামা হেসে আমাদের দেখিয়ে বললেন, এরা সেই ক্ষুদে গোয়েন্দার দল।

কর্নেলের সঙ্গে আমরা হাত মেলালাম। তিনি বললেন, ইউ লিটল ডেভিলস। তোমাদের সত্যিই তুলনা হয় না!

সেদিন সন্ধ্যায় জাহেদ মামার বাগানে একটা দারুণ পার্টি হলো। বাগানে ছোট ছোট টেবিল-চেয়ার পেতে রীতিমতো জমকালো আয়োজন করা হয়েছে। অতিথিরা আসার পর সবাইকে প্রথম লেবুর ঠাণ্ডা শরবৎ দেয়া হলো। শরবৎ খেতে খেতে জাহেদ মামা ছোটখাটো বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন। পাকড়াশী যে কতো দুর্ধর্ষ এক স্মাগলার, কীভাবে তারা সকলের অগোচরে সোনা পাচার আর জাল টাকার কারবার করতো, আমরা কীভাবে সে-সব খুঁজে বের করলাম–শুনে গেস্টদের চোখ ছানাবড়া। কক্সবাজার থেকে কয়েক জন সাংবাদিক এসেছেন। তাঁরা ঘনঘন ছবি তুললেন। ছবি থেকে আমরা চার জনও বাদ পড়লাম না। টুনি এক জন বুড়ো সাংবাদিককে বললো, আমাদের ছবি আপনারা খবরের কাগজে ছাপবেন?

মিষ্টি হেসে সাংবাদিক ভদ্রলোক বললেন, নিশ্চয়ই, দেখবে প্রথম পাতাতেই ছাপা হয়ে গেছে–যেখানে মন্ত্রী-টন্ত্রীদের ছবি ছাপা হয়।

বুড়ো সাংবাদিকের গলার স্বরটা কেমন যেন চেনা চেনা মনে হলো। একটু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাতেই মনে হলো চশমার ভেতর দিয়ে বুঝি আমাকে চোখ টিপলেন।

বাবু আরেক জন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলছিলো। বুড়ো বললেন, চলো তোমার সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলবো।

ললি টুনি তখন বাবুর কথা শুনছিলো। বুড়ো সাংবাদিকের সঙ্গে আমি জাহেদ মামার ড্রয়িংরুমে এলাম। মুখ টিপে হেসে চশমাটা খুলে বুড়ো বললেন, কি রে, চিনতে পারিস নি তো।

আমি হাসলাম–চেহারা যতোই লুকোও না কেন ভাইয়া, তোমার গলা শুনে আমি ঠিক ধরে ফেলেছিলাম।

ভাইয়া হাঁপ ছেড়ে বললো, যাক বাঁচা গেলো, নেলী খালাও চেহারা দেখে চিনতে পারে নি। গলা তো আর সবাই চেনে না। তবে যাই বলিস, তোরা যে কাজ করেছিস, এর কোনো তুলনা হয় না।

আমি লজ্জা পেলাম–তুমি যখন বললে পাকড়াশী তোমাদেরও কাজের ক্ষতি করেছে, তখন আমার জিদ চেপে গিয়েছিলো।

ভাইয়া মৃদু হেসে আমার হাত তার হাতের মুঠোয় পুরে বললো, তোকে নিয়ে আমার ভয় ছিলো। এতোদিনে নিশ্চিন্ত হলাম। চল এবার ওদিকে যাই। বেশি দেরি হলে সন্দ করবে।

বাগানে এসে দেখি কক্সবাজার থেকে বুড়ো মুৎসুদ্দিও এসেছেন। কী আশ্চর্য! তিনি নাকি গোয়েন্দা বিভাগের একজন জাদরেল অফিসার। এদের ধরার জন্যে ছদ্মবেশে অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছিলেন। তাঁর কানে কম শোনার ব্যাপারটা পুরোপুরি অভিনয় ছিলো। বললেন, কানে তিনি আমাদের কারো চেয়ে কম শোনেন না। এই বলে আড়চোখে একবার নেলী খালার দিকে তাকালেন–মিস চৌধুরীর সরস মন্তব্যগুলো আমি খুব উপভোগ করতাম। তবে সব পক্ষের কথাবার্তা শোনার জন্যে আমার না শোনার ভানটা অনেক কাজে লেগেছে।

নেলী খালা এতখানি জিব কেটে লাল-টাল হয়ে সে যে কী কাণ্ড! আমরাও কম লজ্জা পাই নি। বাবু তো ওঁকে চিল্লানোরাস বলেছিলো। ফতে ওঁর কথা শুনে কী মন্তব্য করেছিলো সেটাও বললাম। তিনি হেসে বললেন, আমিও জাল প্রায় গুটিয়ে এনেছিলাম। তবে সব কটাকে একসঙ্গে ধরা আমার কম্মো ছিলো না।

তারপর নানু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঘোষণা করলেন, আসছে শীতে মেজর জাহেদ আহমেদের সঙ্গে আমার মেয়ে নেলীর বিয়ে হবে।

সবাই হাত তালিতে ভেঙে পড়লো। নেলী খালা লাল হলেন। জাহেদ মামা। লাজুক হাসলেন। আমরা চার জন অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকালাম। তারপর দ্বিগুণ জোরে হাততালি দিলাম।

মুৎসুদ্দি সায়েব নেলী খালাকে গান গাইবার জন্যে অনুরোধ করলেন। মুৎসুদ্দি আর বলি কেন, ওটা তো ছদ্মনাম। ওঁর আসল নাম হলো তানভীর হোসেন চৌধুরী। নেলী খালা একটু আপত্তি করে খালি গলায় পর পর অনেকগুলো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেন। নেলী খালা যে এতো সুন্দর গাইতে পারেন, আগে কখনো আমরা টের পাই নি।

অনুষ্ঠানের শেষে এক বিশাল ভোজ। শুধু খেতে খেতেই ঝাড়া একটি ঘন্টা লেগে গেলো। খোলা লনে টেবিল-চেয়ার পেতে খাবার ব্যবস্থা হয়েছিলো। অল্প সময়ে জাহেদ মামা সব কিছু এতো সুন্দর করে আয়োজন করেছেন যে, সবাই খুব প্রশংসা করছিলো।

খাবার পর অতিথিরা একে একে নেলী খালা আর জাহেদ মামাকে অভিনন্দন জানিয়ে চলে গেলেন। সাংবাদিকরা সবাই জাহেদ মামার জীপে করে এসেছিলেন। ভাইয়াও ওদের সঙ্গে চলে গেলো। যাওয়ার সময় ভাইয়া আমাদের সবাইকে আবার অভিনন্দন জানালো। নেলী খালাকে বললো, মিস চৌধুরী, শুভ কাজের নেমন্তন্ন পাঠাতে ভুলে যাবেন না। নেলী খালা লজ্জায় লাল হলেন। ওঁরা চলে যাবার পর শুধু রইলেন কর্নেল আর বুড়ো মুৎসুদ্দি, থুড়ি তানভীর সায়েব। এঁরা দুজন আলাদা গাড়ি নিয়ে এসেছেন। নানু, জাহেদ মামা আর নেলী খালা বারান্দায় বসে ওঁদের সঙ্গে কথা বলছিলেন।

আমরা লনে একটা দেবদারু গাছের পাশে বসে ছিলাম। সমুদ্রের উদ্দাম বাতাসে বারান্দার লতা-গোলাপের ঝাড় থেকে এলোমেলো পাপড়ি খসে পড়ছিলো। দূরে ঝাউবনে শা শাঁ শব্দ হচ্ছিলো। বাবু আর টুনি অল্প দূরে বসে কী একটা কথা বলে হাসাহাসি করছিলো। আমি ভাবছিলাম নেলী খালা আর জাহেদ মামার কথা। নেলী খালা কী সুন্দরভাবে এক জন আর্মি মেজরকে ভাইয়াদের দলে নিয়ে এলেন।

ললি আমার পাশে বসেছিলো। গোলাপের দুটো পাপড়ি ওর মাথায় এসে পড়েছে। পাপড়িগুলো আলতোভাবে তুলে ললিকে বললাম, এতো চুপচাপ কেন ললি! কথা বলো!

ললি আস্তে আস্তে বললো, সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।

স্ক্যাটারা আমাদের পাশে শুয়েছিলো। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলাম। বললাম, আমি এই কটা দিনের কথা চিরদিন মনে রাখবো। একটু থেমে আবার বললাম, বাড়ি ফিরে গেলে একা-একা আমার খুব খারাপ লাগবে। তুমি আমাকে চিঠি লিখবে ললি?

আমার পিঠে আলতোভাবে একটা হাত রেখে ললি আস্তে আস্তে বললো, লিখবো। আমাকে তোমার খুব কাছের এক জন বন্ধু ভাববে।

আমি বললাম, আমি তোমার মতো একজন বন্ধুর অপেক্ষায় ছিলাম।

ললি মৃদু হাসলো। কোনো কথা বললো না। ওকে খুব পবিত্র, নরোম আর সুন্দর মনে হচ্ছিলো।

রাত আরো গম্ভীর হলো। টুনি আর বাবু ঘাসের ওপর শুয়ে আছে। আমরা দুজন চুপচাপ বসে সমুদ্রের গর্জন শুনছি। উতলা বাতাসে তখনো গোলাপের পাপড়িগুলো এলোমেলা ভেসে বেড়াচ্ছিলো।