হানাবাড়ীর রহস্য – কিশোর উপন্যাস – শাহরিয়ার কবির
০১. নতুন বইয়ের লিস্টি দেয়া হয় নি বলে
বড়দিনের লম্বা ছুটির পর নতুন বছরে স্কুলের নতুন ক্লাসে ঢােকার আনন্দই আলাদা। অন্য স্কুল থেকে বদলি হয়ে দু’একজন নতুন ছেলে আসে। নতুন টিচাররা আসেন। নতুন বইয়ের লিস্টি না দেয়া পর্যন্ত শুধু গল্প করেই শেষ হয় ক্লাসের পিরিয়ডগুলো।
রাতুলরা সেবার নাইনে উঠে বাংলা সেকেণ্ড পেপারের ক্লাসে পেলো শুভদারঞ্জন স্যারকে। সেভেন-এইটে থাকতে ওরা দু’বার কি তিনবার পেয়েছিলো এই স্যারকে। অন্য কোন স্যার না আসাতে তিনি ওদের দুতিনটে ক্লাস নিয়েছিলেন। ওতেই ওরা মেতে গিয়েছিলো। কি দারুণ সব ভূতের গল্প আর অলৌকিক, রােমহর্ষক কাহিনী জানেন শুভদারঞ্জন স্যার! আর বলেনও এমনভাবে বিশ্বাস না করে পারা যায় না।
‘আত্মা অবিনশ্বর।’ এই বলে গল্প শুরু করতেন তিনি। গোল রােলগোন্ডের চশমার ভেতর দিয়ে গোল গোল চোখ দুটো সবার মুখের ওপর বুলিয়ে দেখতেন কথাটা সবাই বুঝতে পেরেছে কিনা। তারপর একটু সহজ করে বলতেন, মানুষের দেহের মৃত্যু হয়, আত্মার মৃত্যু নেই। এরপর গলাটা এক ধাপ নামিয়ে বলতেন, “আমাদের চারপাশে লক্ষ কোটি আত্মা মুক্তির আশায় ছটফট করে ঘুরছেন। এঁদের কারাে বয়স হাজারের কোঠা পেরিয়ে গেছে। মুক্তি না পেয়ে সারাক্ষণ দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। কখনো মুক্তির আশায় কারাে শরীরে ভর করছেন। তারপর নিজেই চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন, কে জানে হয়তো এখানেও কোনো অতৃপ্ত আত্মা ঘুরছেন। আমাদের চিত্ত অস্থির, অপবিত্র, তাই ওঁদের দেখি না।’ এটুকু বলে জোড় হাতে অদৃশ্য আত্মার উদ্দেশে প্রণাম জানাতেন— যাঁরা মহাপুরুষ, যাঁদের চিত্ত পবিত্র, তাঁরা সব ঠিকই দেখেন।’
গন্ধীবাবা আর মছলীবাবা নামের সিদ্ধপুরুষদের নানারকম অলৌকিক ক্ষমতার কথাও বলতেন শুভদারঞ্জন স্যার। আরও বলতেন কালীনাথ তান্ত্রিক, সিধু ফাঁসুড়ে আর তারাময়ী ব্রহ্মচারিণীর অদ্ভুত, বিচিত্র সব গল্প।
পীর-ফকিরে বিশ্বাস রহমতুল্লা স্যারেরও কম ছিলো না। তোমরা তো দাদাজী কেবলার কথা শােন নাই।’ শুদ্ধ বাংলা বলার যথাসাধ্য চেষ্টা করেও তিনি বলতে পারতেন না। তবে তার জন্য গল্পের রােমাঞ্চে কোনো ঘাটতি ছিলো না। ‘দাদাজী কেবলার নফর আছিলো দুইটা জীন। দাদাজীরে খুব ডরাইতো। জ্বীনগো আল্লাপাকে আগুন দিয়া বানাইছে। তেনাগে শরীর ভরা রাগ, মগার দাদাজীরে জ্বীনেরা খুব মানতো। আমি দেখছি ওনাগোরে। অজগর সাপের সুরত ধইরা শুইয়া আছিলেন আব্বা হুজুরের মাজারে। একবার এক নালায়েক খাদেম বিনা ওজুতে খানকা শরিফে আসছিলো। দুই জ্বীনের তখন গোস্বা হইছিলো খুব। দাদাজী বুঝাইয়া অগোরে ঠাণ্ডা করেন।‘ এরপর খাবিস জ্বীন কি করে বশ করতে হয় সেসব বলতেন রহমতুল্লা স্যার। ছিলেন ড্রইং-এর টিচার। হাতের লেখা মুক্তোদানার মতো জ্বলজ্বল করতো।
স্কাউট টিচার নিকোলাস স্যার ক্লাস এইটে ভূগোল পড়াবেন শুনে রাতুলরা আহলাদে আটখানা হলো। ক্লাসে যখন পড়ানোর কিছু থাকে না, তিনি বিদেশ ঘােরার গল্প বলেন। স্কাউটিং করার সুবাদে বহু দেশ ঘুরেছেন তিনি। ইন্দোনেশিয়ার কোন দ্বীপে একবার মানুষখেকো মানুষের পাল্লায় পড়ে কিভাবে বেঁচে এসেছিলেন সে গল্প তিনি যতোবার শােনান ততোবারই রােমাঞ্চ হয় ক্ষুদে শ্রোতাদের। রেঙ্গুনের এক বুড়িকে মা ডেকে কুকরির কোপ খেতে খেতে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচেছিলেন—সে গল্পও কখনো পুরােনো হয় না। কোরিয়াতে দুই অমায়িক বুড়াে তাকে লাউডগা সাপের সুপ না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়বেন না। শেষে অক্টোপাসের ঝােল খেয়ে ওদের অভিমান ভাঙাতে হয়েছিলো। অক্টোপাস আর জেলি ফিশ খেতে নাকি রবারের মতো, মােটেই উপাদেয় নয় একথা তিনি ছেলেদের এমনভাবে বুঝিয়েছেন, জীবনে কেউ এ দুটি প্রাণী খাওয়ার কথা মুখে আনবে না।
প্রথম দিকে নিরানন্দের মনে হয়েছিলো কামেলালি স্যারের ক্লাস। ব্ল্যাকবাের্ডে হাতের লেখা লিখতে দিয়ে টেবিলে পা তুলে ঝিমুতেন তিনি। দু’দিন না যেতেই ছেলেরা আবিষ্কার করে ফেললো, এই ক্লাসে পরম নিশ্চিন্তে কাটাকুটি খেলা যায়, স্যারের কার্টুন আঁকা যায়, নিচু গলায় গল্প করা যায়, ইচ্ছে করলে প্রহেলিকা বা রােমাঞ্চলহরী সিরিজের গল্পের বইও পড়া যায়; কেউ বারণ করবে না। বলা বাহুল্য কামেলালি স্যারের ক্লাসটিও রাতুলদের জন্য ভারি সুখের ছিলো।
এ কথা তো সবাই জানে বেশিদিন একটানা সুখের ভেতর কাটালে সুখও একঘেয়ে মনে হয়। গল্প শুনে আর গল্প করে যখন ক্লাস শেষ হতো, শীতের বিকেলে নরােম রােদে রবির সঙ্গে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরার সময় রাতুলের আর বলার কিছু থাকতো না। ছােড়দির দেবর রবি গত বছর বরিশাল থেকে এসে ওদের ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। নেহাত বৃত্তি পেতো বলেই ভর্তি হতে পেরেছিলো, নইলে রাতুলদের মিশনারি স্কুল মফস্বল থেকে কেউ এসে পড়ার সুযোগ পাবে এমন কথা কেউ বলতে পারে না। প্রথম দিকে রবি খুব উত্তেজিত ছিলো। পরে রাতুলদের কাছে যখন সব কিছু একঘেয়ে মনে হতে লাগলো, রবিও ভাবলো নিকোলাস স্যারের মতো বিদেশে ঘুরতে না পারলে জীবনের কোনো দামই নেই। অনেক সময় মনে হতো সত্যিই কি তিনি এতো সব দেশ ঘুরেছেন? রাতুল অবশ্য বলেছে নিকোলাস স্যার ভ্রমণকাহিনী লিখলে আট-দশটা মোটা মোটা বই লিখতে পারবেন। ওর কথারই বা বিশ্বাস কি! রাতুল নিজেও তো গপ্পো মারার সুযোগ পেলে ছাড়ে না।
স্কুল থেকে ফিরে কুমোরটুলির বাড়ির বিরাট ছাদের এক কোণে বসে ওরা দুজন ভাবে, অ্যাডভেঞ্চার ছাড়া জীবন অসার। নিচে সেজদা ছোড়দার বন্ধুদের নিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলে, ছাদের কোণ থেকেও ওদের হল্লা শোনা যায়। দূরে বাদামতলি ঘাট দেখা যায়, সূর্যটা নবাববাড়ির গম্বুজের আড়ালে চলে গেলে বরিশাল খুলনার স্টীমারের ডাক শোনা যায়। রাতুল বলে, কোথাও যদি যাই জাহাজেই যাবো।
রবি বলে, আমিও জাহাজের কথা ভেবেছি।
তুই কখন ভাবলি? তোকে তো আমিই প্রথম ট্রেজার আইল্যাণ্ড আর সুইস ফ্যামিলি রবিনসন পড়তে দিয়েছি?
তুই জাহাজে চড়বি, সাঁতার জানিস? কোন দিন তো লঞ্চেও চড়িস নি। শুধু বই পড়ে অ্যাডভেঞ্চার হয় না।
সবই যদি জানিস তবে একাই যা না!
আমি বুঝি তাই বলছি! তুই আমার চেয়ে বই অনেক বেশি পড়েছিস, এ কথা কি অস্বীকার করেছি?
তোদের গ্রামের বাড়িতে গেলে আমাকে সাঁতার শিখিয়ে দিস।
তোর আর যাওয়া হয়েছে! গরমের ছুটিতে কতো করে বললাম চল, তুই তো কানেই তুললি না।
তুই তো জানিস, ছোড়দিকে এখনো তোর মা যেতে বলেন নি। বেনুদা মাকে না জানিয়ে তোর ছোড়দিকে বিয়ে করেছে বলেই না মা একটু চটেছিলেন। গরমের ছুটিতে গিয়ে দেখেছি, বউ দেখার জন্য মা ছটফট করছেন, আবার লজ্জায় বলতেও পারছেন না।
বেনুদা বুঝি সেজন্যে বাড়ি গেছে?
তবে আর বলছি কি! মার রাগ পড়ে গেছে। বেনুদা ফিরে এসে ভাবীকে নিয়ে যাবে।
রাতুলদের বাড়িতে ওর বাবা, কাকা, জ্যাঠা, তাদের ছেলেমেয়ে আর আত্মীয়স্বজন মিলে বিরাট সংসার। দুঃখের বিষয় হলো, রবি আসার আগে রাতুলের কাছাকাছি বয়সের একজনও ছিলো না। ছোড়দি যদি এতো নাটক করে বেনুদাকে বিয়ে না করতো, রবির সঙ্গেও এ জন্মে দেখা হতো না।
ছোড়দির বিয়ে নিয়ে সে এক দারুণ কাণ্ড! বেনুদা ছিলো সেজদার বন্ধু, মাত্র ডাক্তারি পাস করেছে। বাড়ির ছেলের মতোই আসা-যাওয়া করে, তাস খেলে, ব্যাডমিন্টন খেলে, ছোড়দি-মেজদিদের নিয়ে সিনেমায় যায়। কেউ জানতেও পারে নি কোন ফাঁকে বেনুদার সঙ্গে ছোড়দির এতো জানাশোনা হলো। তবে রাতুলের কথা আলাদা।
গত শীতে একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে রাতুল দেখে সারাবাড়ি থমথম। করছে। দুএকজনকে জিজ্ঞেস করলো–কি হয়েছে? কেউ কিছু বলে না। রাঙা নানী রাতুলদের দুঃখিনী রাজকন্যার আর ঘুঁটে কুড়োনির গল্প বলতেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করতেই চাপা গলায় রাগে ফেটে পড়লেন–হবে আবার কি? যা হবার নয় তাই হয়েছে। তোমাদের ছোড়দি ডাক্তার ছোঁড়াকে বিয়ে করবে বলে বায়না ধরেছে। ছিঃ ছিঃ কি লজ্জার কথা, আমি কোনোদিন এমন কথা মুখ ফুটে বলতে পারতাম!
সেজদা কোথায় যেন যাচ্ছিলো। রাঙা নানীর শেষের কথা শুনে গম্ভীর হয়ে বললো, তোমার কি আর বিয়ের বয়স আছে যে এসব কথা তোমাকে বলতে হবে! বয়স থাকলে ঠিকই বলতে।
রাঙা নানী বললেন, চোরের মার দেখি বড় গলা! ওই ঘোড়াকে তুই-ই এনেছিস এ বাড়িতে। হাবুকে বলবো যাবার আগে তোকে সায়েস্তা করতে।
এনেছিলাম বলেই না অতো ভালো জামাই পেলে। এই বলে সেজদা চলে গেলো।
রাতুল জানতো এরকম কিছু একটা ঘটবে। ছোড়দি নিজের পছন্দের কথা নিজে বলাতে বড়দের সবার মুখ ভার। তবে সেজদা-মেজদা কাউকে বুঝিয়ে, কাউকে ভয় দেখিয়ে, রাজি করিয়েছে।
রাগ বেনুদার মারও কম নয়। শরীর ভালো নয় বলে বিয়েতে এলেন না। বেনুদার বাবা নেই। থাকে হোস্টেলে। বরিশাল থেকে কাকারা এসে বিয়ে দিলেন।
বিয়ের পর বেনুদা যখন বাড়ি ভাড়া করে ছোড়দিকে নিয়ে যাবে বললো, বড়দের তখন সে কি রাগ! বলা হলো–আগে পশার-টসার জমুক, তারপর দেখা যাবে। ঠিক হলো ছোড়দির পরীক্ষা পর্যন্ত বেনুদাকে এ বাড়িতে থাকতে হবে। বেনুদা তবু গাঁইগুই করলো। ছোট ভাইর নাকি গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা হচ্ছে না। ওকে আনতে হবে। আলাদা বাসা না করলেই নয়। শুনে রাঙা নানী ধমক লাগালেন–এমনিতে বাপু ঢের অপকম্মো করেছে। মুরুব্বিদের কথা মান্য করতে শেখো। তোমার ভাই এমন কোন নবাবের নাতি যে, ওর জন্যে আলাদা বাসা লাগবে? ও আমাদের রাতুলের সঙ্গে থাকবে। এ বাড়িতে রাতুল ছোঁড়ার সঙ্গী কেউ নেই। একসঙ্গে পড়াশোনা করবে। ওরও উপকার হবে।
রাঙা নানীর কথা কেউ অমান্য করে না। বেনুদা আপত্তি করলেও রবিকে আসতে হলো। রাতুলও ভারি খুশি। দুদিনেই ওরা দুজন বুঝে ফেললো, ওদের মতো বন্ধু পৃথিবীতে দুটো নেই। আর এ বাড়িতে ওরা অন্য সবার চেয়ে আলাদা।
রোজকার মতো সেদিন সন্ধে অব্দি ছাদে বসে গল্প শেষ করে রাতুলরা নিচে নেমে শুনলো ছোড়দি নাকি শ্বশুরবাড়ি যাবে। বাবা অফিস থেকে ফিরে চা খেয়ে দোতলার ঘরে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে খবরের কাগজ দেখছেন–জেঠিমা এসে বললেন, বেনুর মার মান ভেঙেছে। চিঠি লিখেছেন তার বউমাকে পাঠাতে। বেনু বরিশালে ওদের জন্যে অপেক্ষা করবে, রবি যেন নীনাকে নিয়ে যায়।
বাবা মৃদু হেসে বললেন, ভালোই তো। কালই পাঠিয়ে দাও।
জেঠিমা একটু ইতস্তত করে বললেন, আমি বলি কি, রবির সঙ্গে রাতুলও যাক না। মেয়েটা প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে।
জেঠিমার কথা শুনে আনন্দ আর উত্তেজনায় রাতুলের বুক ঢিবঢিব করতে লাগলো। বরিশাল থেকে ষাট মাইল দুরে সমুদ্রের কাছে এক অজ পাড়াগাঁয়ে রবিদের বাড়ি। জীবনে লঞ্চে ওঠে নি রাতুল। এ সুযোগ স্টীমারেও ওঠা হবে। কি মজাই না হবে।
হঠাৎ বাবার কথা শুনে রাতুলের সব আনন্দ মুহূর্তের ভেতর কর্পূরের মতো উবে গেলো। বাবা জেঠিমাকে বললেন স্কুল খুলে গেছে। খামোকা দুজনের পড়া নষ্ট করার কি দরকার। রবি একাই যাক। পরে রাতুলের কাছ থেকে ক্লাসের পড়া জেনে নেবে।
ক্লাসে যে এখন পড়াশোনা কিছু হয় না, কথাটা বাবাকে জানানো দরকার। রাতুল ঘরে ঢুকে এটা-সেটা নাড়তে লাগলো। বাবা বললেন, এখানে ঘুরঘুর করছিস কেন, পড়ালেখা নেই?
লুডুঘর খুঁজছি, বলে রাতুল মিছেমিছি তাকের ওপর খুঁজতে লাগলো।
পড়ার সময় লুডুঘর কেন?
যে কথা বলার জন্যে রাতুল ঘরে ঢুকেছিলো, টপ করে বলে ফেললো, বুকলিস্টের পাত্তাই নেই! কবে দেয় তারও ঠিক নেই।
তাহলে আর অসুবিধে কি। জেঠিমা বললেন বাবাকে–বইয়ের লিস্টি দিলেও পড়া শুরু হতে আরও আট-দশদিন, ওরা খুব বেশি হলে দিন পনেরো থাকবে।
রাতুল ভালোমানুষের মতো–যেন কিছুই জানে না, জেঠিমাকে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাবো জেঠিমা?
জেঠিমা বাবাকে পানের খিলি সাজিয়ে দিয়ে, নিজে একটা মুখে পুরে চিবুতে চিবুতে বললেন তোদের ছোড়দি বরিশাল যাবে। রবি নিয়ে যাবে। সঙ্গে তুইও যাবি। কাল তোদের ইশকুলে গিয়ে কাজ নেই। সব গোছগাছ করতে হবে। রবিকে বলে ধোপাবাড়ির কাপড়গুলো আলাদা করে রাখিস।
.
০২. রাজবাড়ি বললেও আসলে হানাবাড়ি
খুব পুরোনো বাড়ি?
তোকে আর বলছি কি! আসলে কতো পুরোনো মার দাদুও বলতে পারবে না। সবাই ওটাকে পুরেনো রাজবাড়ি বলে।
স্টীমারের ডেকে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো রাতুল আর রবি। ভোর ছটায় স্টীমার ছেড়েছে বাদামতলি ঘাট থেকে। এখন এগারোটা বাজে। এর ভেতর একবারও ওরা কেবিনে যায় নি। ছোড়দি সেখানে একা বসে বেগম পত্রিকা পড়ছে। দুবার উঠে এসে ওদের ডেকেছিলো ভেতরে যাওয়ার জন্যে। রাতুল যায় নি, রবিকেও যেতে দেয় নি। ছোড়দি বলেছে বাড়ি ফিরে নাকি জেঠিমাকে বলে মার খাওয়াবে। অমন অনেক কথাই ছোড়দি বলে। মার খাওয়ানো অতো সোজা নয়। তখন বেনুদা থাকবে। বিয়ের আগে লুকিয়ে বেনুদার চিঠি এনে ছোড়দিকে দিতে বলে, ওকে একটু বেশি আদর করে বেনুদা। যেমন ছোড়দি বেশি আদর করে রবিকে।
নিজেদের বাড়ির গল্প বলতে গিয়ে রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলো রবি। রাতুলকে এসব কথা আগে কখনো বলে নি। ভেবেছে, রাতুল যদি ওকে অহংকারী ভাবে! আড়চোখে একবার রবির দিকে তাকিয়ে রাতুল বুঝলো, আরো কথা বলার জন্য ও মুখিয়ে আছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে সন্দেহের গলায় বললো, তাহলে তুই বলতে চাস তোরা আগে রাজা ছিলি!
রবি একটু অপ্রস্তুত হলো–ঠিক রাজা নয়, আমাদের পূর্বপুরুষরা বড় জমিদার ছিলো। ওই তল্লাটে অতো বড় বাড়ি কোথাও ছিলো না বলে সবাই ওটাকে রাজবাড়ি বলতো। এখন অবশ্য কিছুই অবশিষ্ট নেই। ছোটবেলায় সদর দরজার পাশে দুটো শ্বেতপাথরের সিংহ দেখেছিলাম। সেগুলো পর্যন্ত চুরি হয়ে রবিকে বললো, মনে কর আমরা তোদের পুরোনো বাড়িতে এক কলসি মোহর পেলাম। কেমন হবে বল তো?
তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? রবি চোখ দুটো মোহরের মতো গোল করে বললো, ভয়ে এখনো রাজবাড়ির ধারে-কাছে খুনে ডাকাত পর্যন্ত যায় না, আর তুই যাবি মোহর আনতে? মাঝে মাঝে তুই এমন উল্টোপাল্টা কথা বলিস, শুনলেই ভয় করে।
অমন করে তাকাস না রবি। চোখের মণি দুটো ঠিকরে বেরিয়ে যাবে।
রবি গম্ভীর হলে বললো, এসব কথা আমাদের বাড়িতে গিয়ে কাউকে বলিস না। পুরোনো বাড়ির জ্বীনরা বিরক্ত হয়–এমন কাজ কেউ কখনো করে না।
কি করে বুঝলি, সাপগুলো যে জ্বীন?
বাবার দাদু, আমাদের বড়বাবা মস্তবড় কামেল ছিলেন। একবার দেখেছিলেন তিনি। সন্ধেবেলা গোরস্থানে কার কবর জেয়ারত করে ফেরার সময় শোনেন পুরোনো বাড়িতে কিসের যেন শব্দ হচ্ছে, অনেকটা দরুদ পড়ার মতো। কাছে গিয়ে দেখেন, অনেকগুলো সাপ কাতার বেঁধে নামাজ পড়ছে। বড়বাবাকে দেখে ওদের একজন মানুষের চেহারা ধরে বেরিয়ে এলো। বললো, হুজুর আপনি বুজুর্গ মানুষ। আপনার আব্বা হুজুরের কাছে আমরা কোরান শরীফ পড়েছি। আমরা আপনাদের খেদমতগার। মানুষের অত্যাচারে লোকালয়ে বসে আল্লার এবাদত করতে পারি না। তাই এই বিরান বাড়িতে এসে থাকছি। আপনার কাছে আমাদের আরজি, এখানে কোনো আদমের আওলাদ যেন আমাদের বিরক্ত না করে। শুনে বড়বাবা বললেন, ঠিক আছে, আমি বলে দেবো সবাইকে। তবে তোমাদেরও বলছি, তোমরা এ বাড়ি ছেড়ে লোকালয়ে এসো না। আমাদের ছেলেমেয়েরা সব সময় পাক-সাফ থাকে না। দেখলে তোমাদের রাগ হতে পারে। জ্বীন বললো, না হুজুর, আমরা এ বাড়ির বাইরে যাই না। জেনেশুনে কেউ আমাদের ক্ষতি না করলে আমরা কারো ক্ষতি করি না। এই বলে জ্বীনটা বড়বাবাকে সালাম দিয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেলো।
রবির কথা শুনে রাতুলের খাবি খাওয়ার দশা হলো–বলিস কি! সত্যি সত্যি তোর বড়বাবা জ্বীনের সঙ্গে কথা বলেছিলো?
রবি গম্ভীর হয়ে বললো, মুরুব্বিদের নিয়ে আমরা কখনো মিছে কথা বলি । আমার বড়দাদুর কাছে দুটো জ্বীন এসে কোরান শরীফ পড়তো। সেজন্যে জ্বীনরা আমাদের বাড়ির কাউকে এখনো কিছু বলে নি।
তুই যে বললি ও বাড়ির জিনিসপত্র সব চোরে নিয়ে গেছে। জ্বীনের ভয় থাকলে চোর ঢোকে কি করে?
রবি কাষ্ঠ হেসে বললো, তোর মতো অবিশ্বাসী মানুষের তো অভাব নেই! চুরি যারা করেছে তারা ফলও ভোগ করেছে। শ্বেতপাথরের সিংহ দুটো নিয়েছিলো সর্দার বাড়ির খুনে ছেলে ছানাউল্লা। দুবার খুনের দায়ে জেল খেটেছে। ডরভয় বলতে কিছু ছিলো না। নিয়মিত শহরে যেতো, ভেবেছিলো শহরে নিয়ে বিক্রি করতে পারলে ভালো দাম পাবে। সঙ্গে এক চ্যালা নিয়ে সিংহ দুটো বস্তায় পুরে নৌকায় উঠেছে। শীতের সময়, ঝড়-তুফানের নাম-নিশানা নেই। নৌকা যখন মাঝনদীতে, হঠাৎ কোত্থেকে একটুকরো মেঘ এসে আকাশ অন্ধকার করে ফেললো। শুরু হলো ভীষণ ঝড়। ঘনঘন বাজ পড়তে লাগলো। একবার ভীষণ শব্দে একটা বাজ পড়লো নৌকার ওপর। মাঝি ছিটকে পড়লো নদীর ভেতর। সাঁতার কাটতে কাটতে মাঝি দেখলো, বস্তা ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়লো দুটো সাদা সিংহ। চোখের পলকে ভয়ঙ্কর এক ডাক ছেড়ে ছানাউল্লা আর তার চ্যালাকে মুখে তুলে নিয়ে শূন্যে লাফ দিলো। তারপর আর কিছু দেখে নি মাঝি। একটু পরেই দেখে ঝড় থেমে গেছে, আকাশের সব মেঘ বাতাসে উড়ে গেছে। বিকেলের শান্ত নদীতে নৌকা ভাসছে। মাঝি নৌকায় উঠে দেখলো, পাটতনের ওপর ছেঁড়া বস্তা দুটো পড়ে আছে, এখানে-সেখান রক্তের দাগ। দাদা তখন বেঁচে ছিলেন। মাঝি ফিরে এসে সোজা দাদার পায়ের উপর পড়লো হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো, বস্তায় করে ওরা রাজবাড়ির সিংহ নিচ্ছে, ও জানতো না। ওরা তো পাপের ফল ভোগ করেছে, ওর যেন কিছু না হয়। দাদা বললেন, তোর কিছু হলে তখনই হতো। বাড়ি যা। যাবার পথে মাজারে কটা মোমবাতি দিয়ে যাস। এরপর অবশ্য পুরোনো বাড়ির কোনো জিনিস খোয়া গেছে বলে শুনি নি।
রবি যেভাবে কথাগুলো বলছিলো, রাতুল বিশ্বাস করে ফেলেছিলো। তবে বাড়িতে বড়দা মেজদা যেভাবে জ্বীন-ভূত নিয়ে হাসিঠাট্টা করে, শুনতে শুনতে এটাও ওর মনের ভেতর শেকড় গেড়ে বসেছিলো, পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু নেই। নিকোলাস স্যারও ক্লাসে বলেন, মানুষ যখন কোনো কিছুর ব্যাখ্যা করতে পারে না, যখন বলতে পারে না কেন এমন হলো, তখনই বলে অলৌকিক কোনো কারণে ঘটেছে। শুভদারঞ্জন স্যারের কথা তিনি হেসে উড়িয়ে দেন। এ নিয়ে অবশ্য শুভদারঞ্জন স্যার সামনে কিছু না বললেও আড়ালে বলেন, নাস্তিক। রহমতুল্লা স্যার বলেন, নাসারা।
ছানাউল্লার সিংহ চুরির ঘটনা সত্যি হলেও ঝড়-তুফানের গল্পটা বানানোও হতে পারে। কে জানে দলে হয়তো মাঝিও ছিলো। বিক্রি করে লাভের বখরা নিয়ে গণ্ডগোল হয়েছে, ছানাউল্লা আর তার চ্যালাকে মেরে নদীতে ফেলে দিয়েছে। মাঝি জানে রাজবাড়ির কর্তারা ওর সহায় থাকলে থানা-পুলিশ কিছু করতে পারবে না। তাই ঝড়-তুফানের গল্প ফেঁদে রবির দাদাকে পটিয়েছে।
রাতুল হঠাৎ বললো, আচ্ছা রবি, সেই মাঝিটা এখন কোথায় রে?
ওরা গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। যে বছর দাদা মারা গেলেন, সে বছরই চলে গেলো। বললো, হুজুর নেই আমাকে কে বাঁচাবে? বাবা তো চাকরির সুবাদে বাইরে বাইরে থাকতেন।
রাতুল আপন মনে বললো, মাঝি ঠিকই বলেছে। তোর দাদা ছাড়া ওকে আর কেউ বাঁচাতে পারতো না।
রবি বললো, এতোক্ষণে আমার কথা বুঝি তোর বিশ্বাস হলো?
রাতুল মৃদু হেসে কথা পাল্টালো–তুই হানাবাড়ি বইটা পড়েছিস রবি?
অবাক হয়ে রবি বললো, না, পড়ি নি। কেন, কার লেখা? কি আছে ওতে?
প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা হানাবাড়ি। আমার শেলফে আছে, পড়িস। আপন মনে কথাগুলো বললো রাতুল–মনে হচ্ছে তোদের রাজবাড়িটা হানাবাড়ির মতোই একটা কিছু হবে।