৭-৮. গভীর বনে মড়ার খুলি

গভীর বনে মড়ার খুলি

তখন চারদিকে প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে কালো অন্ধকার জমছিলো। আমরা দূর থেকে পাকড়াশীর ঘরের বারান্দায় আলো দেখতে পেলাম। বারান্দায় বসা পাকড়াশীকে ফতে আর গোবর হাত নেড়ে কী যেন বোঝাচ্ছিলো। মাঝে মাঝে পাকড়াশী ওদের ধমকে দিচ্ছিলেন।

হঠাৎ কেঁই কেঁই করে বিচ্ছিরি গলায় ডাকতে ডাকতে পাকড়াশীর কুকুর ঘেঁদী বারান্দার দিকে ছুটে গেলো। বুঝলাম পাজি কুকুরটা আমাদের দেখে ফেলেছে। স্ক্যাটরা গরগর করে একটা হুঙ্কার ছাড়তে যাচ্ছিলো। সঙ্গে সঙ্গে ইশারায় ওকে থামিয়ে দিলাম। কিন্তু বারান্দায় গিয়ে খেদী আমাদের দিকে তাকিয়ে সমানে কেঁই কেই করতে লাগলো।

পাকড়াশী চেঁচিয়ে গদা, গদা বলে কাকে যেন ডাকলেন। তারপর বিরক্ত হয়ে বললেন গদা, দেখ তো খেদী এমন ভয় পেলো কেন? নির্ঘাত শেয়াল-টেয়াল দেখেছে। শেয়ালের জ্বালায় হাঁস-মুরগির কারবার আমাকে গোটাতে হবে। নাকি চোর-ছ্যাচড় এলো–দেখ নারে গদা।

শেয়াল দেখে কোনো কুকুর ভয় পায়–কথাটা আমি জীবনে প্রথম শুনলাম। খুব হাসি পেলো। কিন্তু হাসার বদলে আমাদের পালাতে হলো, কারণ ততোক্ষণে গদা নামধারী একটা দৈত্যের মতো লোক হেলেদুলে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিলো আর বলছিলো, শেয়াল নয় কত্তা, মানুষ।

ভাগ্যিস এদিকটায় গাছপালা বেশি ছিলো বলে, গদা আমাদের চিনতে পারে নি। নইলে ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিলো আমাদের চার জনকে বগলদাবা কর পাকড়াশীর কাছে নিয়ে যেতে ওর দু মিনিটের বেশি সময় লাগবে না। আর পাকড়াশী যে আমাদের গোয়েন্দাগিরি আদৌ পছন্দ করবেন না, সে-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার ওপর কথাটা যদি জাহেদ মামা আর নেলী খালার কানে একবার উঠিয়ে দেয়, তাহলে লজ্জায় মাথা কাটা যাবে। তাই আমরা কোননা দিকে না তাকিয়ে সটান দৌড় দিলাম। কাউকে কিছু বলতে হয় নি। আমরা চারজন একই সঙ্গে ছুটছিলাম। স্ক্যাটরাও তাল মিলিয়ে সমানে ছুটলো। কিছুক্ষণ পর যখন মনে হলো নিরাপদ দূরত্বে চলে এসেছি, তখন আমরা থামলাম।

গদার–শেয়াল নয় মানুষ শুনে পাকড়াশী এমন জোরে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন যে, তখনো সেই চাচানি আমাদের কানে বিধে ছিলো। ললি বললো, বাব্বা, পাকড়াশী মশাই এতো জোরে চাচাতে পারেন।!

বাবু বললো, আমার মনে হচ্ছে কানের ভেতর বুঝি প্রজাপতি উড়ছে।

টুনি ওদের কথায় কান না দিয়ে কাঁদো গলায় বললো, ললিপা তোমরা কোথায় এসেছো? আমার ভয় লাগছে।

টুনির কথা শুনে বাবু ধমক দিতে যাচ্ছিলো। ঠিক তখনই স্ক্যাটরা এমন ভাবে গরগর করে উঠলো যে, বাবু টুনিকে কিছু বলার সুযোগ পেলো না। সন্দেহজনক কিছু দেখলেই স্ক্যাটরা এভাবে শব্দ করে। তখন ওর ঘাড়ের কাছের লোমগুলো খাড়া হয়ে যায়। টুনি ললির গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। আমরা চারপাশে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না।

হঠাৎ খেয়াল হলো গদার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে আমরা উলটো পথে দৌড়েছিলাম। ফিরে যেতে হলে আমাদের আবার পাকড়াশীর বাড়ির ওপর দিয়েই যেতে হবে। এদিকটায় গাছপালা বেশ ঘন হয়ে বেড়ে উঠেছে। আকাশে তখনো শেষ সন্ধ্যার কিছু ম্লান আলো মেঘের ফাঁকে ছড়িয়ে ছিলো। কিন্তু গাছের নিচে অন্ধকার ভালো রকমই জেঁকে বসেছে।

কিছুক্ষণ গরগর করে স্ক্যাটরা থেমে গেলো। ওর ঝোলা কান দুটোকে যতোখানি খাড়া করা সম্ভব, তার চেয়ে বেশি খাড়া করে কোনো অচেনা শব্দ শোনার চেষ্টা করলো। আমরা কোথাও কিছু দেখতে না পেয়ে অবাক হয়ে স্ক্যাটরার দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটু পরে স্ক্যাটরা আবার গরগর করে শব্দ করলো। বেশ কিছু দূরে ঝোঁপঝাড়ের ভেতরে একটা পুরোনো সেগুন গাছের দিকে ও তাকিয়ে ছিলো। মনে হলো সাদা মতো কী যেন একটা নড়াচড়া করছে। স্ক্যাটরাকে আমি ইশারায় থামিয়ে দিলাম। বাবু ললি টুনি একসঙ্গে আমার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো। কোনো কথা না বলে ওদের ঝোঁপটার দিকে আঙুল তুলে দেখালাম।

কিছুক্ষণ পর ওরাও দেখতে পেলো। টুনির অবস্থা দেখে মনে হলো ও বুঝি ফিট হয়ে যাবে। আমি ওর হাতটা ধরে টের পেলাম–ঠকঠক করে কাঁপছে।

আমি ওর কানে ফিসফিস করে বললাম, ভয় কি টুনি! আমি আছি, বাবু আছে। তাছাড়া স্ক্যাটরা একাই তো এক শ।

টুনির কাঁপুনি কমলো। তবে ললি কতটুকু ভয় পেয়েছে সেটা বোঝা গেলো । বাবু ওর কাঁধে হাত রেখেছিলো। স্ক্যাটরার ভাবসাব দেখে মনে হলো ইশারা পেলে ও ঝোঁপটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

আচমকা আমাদের চোখের সামনে সাদা বস্তুটা একটা লম্বা মানুষ হয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে আমি ভাবলাম, পরশু সন্ধ্যেয় যখন জাহেদ মামা বাংলো থেকে ফিরছিলাম, তখন কি এই লোকটাকেই দেখেছিলাম? লোকটা লম্বায় আট ফুটের কম হবে না। চেহারাটা দেখা যাচ্ছে না। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সাদা আলখাল্লায় ঢাকা।

দুহাতে আমাকে আঁকড়ে ধরে টুনি তোতলাতে লাগলো–ভূ-ভূ-ভূত!

আমি চাপা গলায় বললাম, না মানুষ। এটাকেই সেদিন ছাতিমতলায় দেখেছিলাম।

ললি ফিসফিস করে বললো, এতো লম্বা মানুষ!

বাবু বললো, হতে পারে। হার্মাদারা তো এদেশী মানুষ নয়। আফ্রিকায় কেথায় যেন আট ফুট লম্বা মানুষ থাকে।

বাবুর যুক্তি শুনেও টুনির ভয় গেলো না। আমিও কম ভয় পাই নি। তবে এখন ভয় পেলে যে টুনিকে সামলানোই দায় হবে। ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, লোকটাকে আমার চেনা মনে হচ্ছে। দেখি ও কী করতে চায়।

এমন সময় স্ক্যাটরা আবার গরগর করে উঠতে যাচ্ছিলো। ওকে চাপা গলায় ধমকে দিলাম। সেই লোকা ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এসে সোজা গভীর বনের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। আমরাও সমান দূরত্ব রেখে ওকে অনুসরণ করলাম। স্ক্যাটরা সঙ্গে ছিলো বলেই সেদিন এরকম সাহস দেখাতে পেরেছিলাম।

লোকটাকে প্রথম যেখানে দেখছিলাম, সেই সেগুন গাছটার কাছে আসার পর হঠাৎ ওকে হারিয়ে ফেললাম। চোখের পলকে লোকটা কর্পূরের মতো উবে গেলো। আকাশে চাঁদ উঠেছে। তবু বনের ভেতর বেশ অন্ধকার। সাদা কাপড় পরা না থাকলে দশ হাত দূরের কাউকেও দেখা যেতো না। কোথাও কাউকে দেখতে না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়লাম।

আমি টের পাচ্ছিলাম, টুনি এসব বাজে কাজের চেয়ে ঘরে ফেরার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। সেগুন গাছের তলায় এসে বাবু বললো, লোকটা এখানে বসে এতোক্ষণ কী করছিলো?

আমি একটু হেসে বললাম, তোমার কথা মতো যদি হার্মাদ হয়, তাহলে নিশ্চয়ই গুপ্তধন পুঁতে রেখেছে।

টুনি বিরক্ত হয়ে বললো, এটা কি ঠাট্টা করার সময়! চলুন ফিরে যাই।

আমি বললাম, একা যেতে পারবে?

টুনি তক্ষুনি আমার পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিলো। আমি বললাম, তাহলে বারবার যাওয়ার কথা বলবে না।

গুরুতর কিছু ঘটতে দেখলে ললি সব সময় গম্ভীর হয়ে যায়। ও আস্তে আস্তে বললো, লোকটা কোথায় গেলো দেখলে হতো না?

টুনি ললিকে ধমকে বললো, তুমিও বুঝি ওদের দলে ঢুকলে ললিপা?

ললি ভয় পায় নি দেখে আমার খুব ভালো লাগলো।

বাবু সত্যি সত্যিই গুপ্তধন খোঁজার জন্যে সেগুন গাছের চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখছিলো। হঠাৎ চাপাগলায় আমাকে বললো, আবির, দেখে যাও জলদি।

আমরা তিন জন ওর কাছে ছুটে গেলাম। বাবু বললো, দেখ, মড়ার খুলি।

চাঁদের ফ্যাকাশে আলোয় দেখলাম, সেগুন গাছের গায়ে একটা কঙ্কালের মাথার খুলি আঁকা রয়েছে। আমি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম। একটু ভেজা ভেজা মনে হলো। শুঁকে দেখলাম তাজা সেগুন কাঠের গন্ধ। বললাম, লম্বু তাহলে এতোক্ষণ বসে বসে এটাই আঁকছিলো।

ললি শুকনো গলায় বললো, তবে যে বাথিন বলছিলো মড়ার খুলি হার্মাদদের আমলের আঁকা।

বাবু বললো, আমিও তো তাই বলছি। এই লোকটা নির্ঘাত হার্মাদদের কেউ হবে। নইলে এতো লম্বা হয় কী করে!

আমি বললাম, চৌদ্দ পুরুষ আগে ওর কেউ হার্মাদ থাকতে পারে। তবে রণ-পা পরে তুমিও ওর মতো লম্বা হতে পারো বাবু।

বাবু বললো, তুমি কী করে বুঝলে ও রণ-পা পরেছে?

আমি বললাম, ওর হাঁটার ধরন দেখেই বোঝা যায়। আমি এক বার সার্কাসে দেখেছিলাম একটা জোকার রণ-পা পরে কিভাবে হেঁটেছিলো।

টুনি ভয়-টয় ভুলে অবাক হয়ে বললো, রণ-পা কী আবির?

আমি পাণ্ডিত্য ফলানোর জন্যে ধীরেসুস্থে বলতে আরম্ভ করলাম, রণ-পা হলো–

বাবু বাধা দিয়ে বললো, এক ধরনের বাঁশের পায়ের মতো। দুটো বাঁশের গিঁটে পা রেখে পা-টা লম্বা করে নেয়। তাড়াতাড়ি হাঁটা যায় এতে।

ললি বললো, ভয়ও দেখানো যায়।

আমি একটু হাসলাম ললি কি ভয় পেয়েছো?

ললি কথার জবাব দেয়ার আগে বাবু বললো, তুমি কী করে বুঝলে যে এই খুলিটা ওই লোকটা ছাড়া আর কেউ আঁকে নি?

আমি বললাম, সেগুন কাঠের তাজা গন্ধ বেরুচ্ছে। তাছাড়া ভেজাও রয়েছে। দু শ বছর আগের আঁকা কোনো মড়ার খুলি থেকে তাজা সেগুন কাঠের গন্ধ বেরুবে না।

টুনি হাঁপ ছেড়ে বললো, তাই বলো। আমি তো ভয়েই মরি, সত্যিই বুঝি লোকটা তখনকার দিনের কোনো প্রেতাত্মা হবে।

ললি গম্ভীর হয়ে বললো, তা তো বুঝলাম, লোকটা প্রেতাত্মা নয়–মানুষ। বাথিন আমাদের মিছে কথা বলেছে। কিন্তু লোকটা রণ-পা পরেই বা কেন ঘুরছে, আর কেনই বা সেগুন গাছের গোড়ায় মড়ার খুলি আঁকছে!

বাবু বললো, হয়তো কোনো গুপ্তধন লুকিয়ে রেখেছে এখানে।

টুনি বললো, তুমি কি বলতে চাও, যতগুলো গাছে এরকম মড়ার খুলি আঁকা রয়েছে, ততগুলো গাছের নিচে লোকটা গুপ্তধন লুকিয়ে রেখেছে?

বাবু বিরক্ত হয়ে বললো আহ, সব সময় তর্ক করো কেন টুনি! এমনও তো হতে পারে, লোকটা কোনো গুপ্তধন খুঁজছে। যে-সব গাছের নিচে খোঁজা শেষ হয়েছে, হয়তো লোকটা সে-সব গাছে চিহ্ন দিয়ে রাখছে।

আমি হেসে বললাম, তর্ক করো না টুনি। বাবুর মাথায় গুপ্তধনের ভূত চেপেছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, লোকটা কে?

ললি বললো, আর মড়ার খুলিই বা কেন আঁকছে?

আমি বললাম, গুপ্তধন হোক বা অন্য কিছুর জন্যে হোক, কিছু গাছ চিহ্ন দিয়ে আলাদা করে রাখছে। মড়ার খুলি আঁকার আরেকটা উদ্দেশ্য হতে পারে স্রেফ ভয় দেখানো।

টুনি বললো, এ মা! লোকটা কী পাজি!

আমি হাসলাম ভালো যে নয় আমি হলপ কর বলতে পারি। এই জঙ্গলে রাতের বেলা এভাবে ভয় দেখিয়ে কোনো ভালো লোক নিশ্চয়ই ঘুরে বেড়াবে না।

টুনি বললো, আমার কিন্তু এখনো ভয় লাগছে।

বাবু ধমক দিয়ে বললো, আবার ভয়ের কথা শেষ না করেই বাবু তিন লাফে আমার কাছে ছুটে এসে–ওরে বাবা ওটা কি!–বলে ভয়-টয় পেয়ে এক যাচ্ছেতাই কাণ্ড করে বসলো। সুযোগ পেয়ে স্ক্যাটরাও ঘেউ ঘেউ করে বার দুই ডেকে নিলো। আর টুনি কাঁদো কাঁদো গলায় ললিপা, দেখ না আমাকে কেন মিছেমিছি ভয় দেখাচ্ছে বলে নাকীকান্না জুড়ে দিলো।

আমি দিশেহারা হয়ে প্রথমে বাবুকে ধমক দিলাম, তারপর স্ক্যাটরা আর টুনিকে। বাবুকে বললাম, কী দেখেছো বলবে তো!

বাবু একটু লজ্জা পেয়ে বললো, আমার পায়ের ওপর দিয়ে কী যেন ছুটে গেলো। আমি–কথা শেষ না করে আরেক লাফে বাবু ললির কাছে চলে গেলো।

বাবুর ভয়ের কারণটা দেখলাম। আমার হাসি চাপা দায় হয়ে পড়লো। দুটো কাঠবেড়ালীর ছুটোছুটিতে ও যদি এভাবে ভয় পায়, তাহলে আমি কোথায় যাই! কাঠবেড়ালী দেখে ললিও হেসে বললো, ও তো কাঠবেড়ালী বাবু। ভয় পাচ্ছো কেন?

তবে এরকম কাঠবেড়ালী আমি আগে কখনো দেখি নি। একেবারে কুচকুচে কালো দেখতে। ছোট চোখ দুটো চাঁদের আলোয় হীরের কণার মতো চকচক করছে।

বাবু হাঁপ ছেড়ে বললো, তাই বলো। আমি ভাবি আর কি যেন!

এমন সময় বেশ দূরে একটা নারকেল গাছের দিকে তাকিয়ে স্ক্যাটরা আবার আগের মতো গরগর করে উঠলো। আমরা চার জন চমকে উঠে একসঙ্গে তাকিয়ে দেখি, সেই লম্বা লোকটা। স্ক্যাটরাকে কিছু বলার আগেই ও ঘেউ ঘেউ করে লোকটার দিকে ছুটে গেলো। আর স্ক্যাটরার সেই বন-কাঁপানো, পিলে চমকানো ডাক শুনে লোকটা মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে আট ফুট লম্বা লোকটার বদলে খুবই সাধারণ একটা লিকলিকে শরীরের লোক লাফ দিয়ে উঠে ছুটে পালাতে পালাতে চেঁচিয়ে বললো, ওরে বাবারে খেয়ে ফেল্লেরে! ওরে ফতে, ওরে পচারে! তোরা আমাকে ফেলে কোথায় গেলিরে! চোখের পলকে আমাদের পরিচিত শ্রী গোবর্ধন অন্ধকারে হারিয়ে গেলো।

আমরা চার জন এক অপরের দিকে তাকালাম। কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারলাম না। লোকটাকে ওভাবে ছুটে পালাতে দেখে স্ক্যাটরাও ফিরে এলো। গলার স্বরটা স্ক্যাটরার কাছেও অচেনা নয়। ললি বললো, শ্রী গোবর্ধনই তাহলে এতোক্ষণ রণ-পা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো!

বাবু উত্তেজিত গলায় বললো, ফতে আর পঁচা নিশ্চয় ওর সঙ্গে আছে।

ললি বললো, কিন্তু ওরা এখানে কী করছে, সেটাই তো জানা গেলো না।

আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, আজ রাতে সব জানা যাবে। আজ রাতেই–

আমার কথা শেষ না হতে স্ক্যাটরা আবার গরগর করে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে ইশারায় ওকে থামিয়ে দিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি, চিমনি-ঢাকা বাতি হাতে তিনটে লোক আমাদের দিকে আসছে।

বাবু ফিসফিস করে বললো, ফতেরা আসছে।

আমি চাপা গলায় ওদের সতর্ক করে দিয়ে বললাম, চুপ। কোনো কথা নয়। পাশের ঝোঁপটার ভেতরে ঢুকে পড়ো।

স্ক্যাটরাকে নিয়ে আমরা চার জন পাশের কেয়া গাছের ঝোঁপটার ভেতর ঢুকে পড়লাম। ওরা কথা বলতে বলতে এগিয়ে এলো। কথা ঠিক নয়, ফতে সারাক্ষণ গোবরকে ধমক দিচ্ছিলো–ওই কুত্তোই তোকে খাবে। আজ যদি বড়ো কত্তাকে

বলেছি, তাহলে আমার নামে যেন লোকে সাতটা নেড়ি কুত্তো পোষে। শেষ কালে ফেঁদীর ডাক শুনে তুই ভয় পেতে শুরু করলি? তোকে নিয়ে কী করে চলবে র‍্যা!

গোবর মিনমিন করে বললো মা কালীর দিব্যি ওস্তাদ। ওটা খেদী নয়। ওই ছোঁড়াগুলো যেটাকে নিয়ে ঘোরে, সেটা।

ফতে বললো, তোর মুণ্ড। তারপর গলা তুলে আদর করে ডাকলো, খেদী, খেদী! কোথায় গেলি বাছা। রাতে-বিরেতে বাইরে কেন ঘুরছিস? খেদী! কোনো সাড়া না পেয়ে ফতে ক্ষেপে গিয়ে বললো–কোথায় গেলো হারামজাদা কুত্তোটা!

আমাদের ঝোঁপটার প্রায় গা ঘেঁষে ফতেরা বেরিয়ে গেলো। স্ক্যাটরার গলাটা যে চাঁচানোর জন্যে কী রকম নিশপিশ করছে, বুঝতে এতোটুকু অসুবিধে হলো না। খেদী হলে এতোক্ষণে কী করতো জানি না, তবে স্ক্যাটরার মতো ভালো কুকুর আর হয় না।

ফতেদের আলোটা বনের ভেতর হারিয়ে যাবার পর টুনি বললো, ললিপা, ফিরে চলো।

ললি আমাকে বললো, আবির কি আরো থাকতে চাও?

আমি একটু ভেবে বললাম, ঠিক আছে ফিরে চলো।

যেতে যেতে ললি বললো, নেলী খালা এতোক্ষণে নিশ্চয় আমাদের কথা ভাবতে শুরু করেছেন।

বাবু বললো, তবে নেলী খালা এটাও জানেন যে, স্ক্যাটরা আমাদের সঙ্গে আছে।

ভাঙা চাঁদটা আরেকটু ওপরে উঠে এসেছে। বনের ভেতরটা অদ্ভুত রকম সুমসাম। দূরে কয়েকটা পাখির ডানা ঝাঁপটানো শুনতে পেলাম। কোথাও নাম-না-জানা ফুল ফুটেছে। অচেনা মিষ্টি বুনো গন্ধে বাতাসটা ভারি হয়ে আছে। আমরা চার জন চুপচাপ হাঁটছিলাম। পায়ের নিচে শুকনো পাতার খসখস শব্দ হচ্ছিলো। খেয়াল করলাম কেউ কোনো কথা বলছে না। মাঝে মাঝে এমন একটা সময় আসে, যখন অনেক কথা বলার থাকলেও কিছুই বলা হয় না। এতোক্ষণ প্রচণ্ড এক উত্তেজনার সময় কাটানোর পর আমাদের অবস্থাও সে রকম হয়েছিলো।

বাবু হাঁটতে হাঁটতে একসময় বললো, আমরা ঠিক পথে যাচ্ছি তো আবির?

আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম। দূরে পাহাড়ের নিচে সোনাবালি নদী চাঁদের আলোয় চিকচিক করছিলো। আমি একটু হেসে বললাম, নদী পেয়েছি, পথ চিনতে অসুবিধে হবে না। হয়তো একটু বেশি ঘুরতে হতে পারে।

ললি আস্তে আস্তে বললো, হাঁটতে আমার ভালোই লাগছে।

আমি ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললাম, আমারও।

বাবু বললো, মড়ার খুলির রহস্যটা কিছুই বোঝা গেলো না আবির। তুমি কি কিছু ভাবছো?

আমি বললাম, ভেবেছি। আজ রাতে আমরা অনেক কিছু জানতে পারবো। হয়তো সবই জেনে যাবো। জাহেদ মামার সঙ্গে দেখা হলে ভালো হতো।

বাবু একটু হেসে বললো, গিয়ে দেখবে, নেলী খালা আর জাহেদ মামা বসে গপ্পো করছে।

টুনি মুখ টিপে হেসে বললো, তাহলে তো বেঁচে যাই।

ললি বললো, তুমি খুব পাজি হয়েছে টুনি।

আমি টুনিকে নিয়ে একটা হাসির কথা বলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় বাবু বললো, নদীতে ওগুলো কী, দেখ তো আবির।

স্ক্যাটরাও গরগর করে উঠলো। ওকে একটা ধমক দিয়ে নদীতে তাকিয়ে দেখি অনেকগুলো মোষের মতো জন্তু সারি বেঁধে পানি খাচ্ছে।

টুনি বললো, গরুই তো মনে হচ্ছে।–বলে আড়চোখে একবার ললির দিকে তাকাতে ভুললো না।

আমরা আরো কাছে এগিয়ে গেলাম। বাবু উত্তেজিত গলায় বললো, গরু নয়, বাইসন। আমি ওয়াইল্ড ওয়েস্টের ছবিতে এরকম বাইসন দেখেছি।

ভালো করে বাবুর বাইসনগুলো দেখে আমি পাণ্ডিত্য ফলানোর সুযোগ পেয়ে গেলাম। বললাম, বাইসন নয় বাবু। এগুলো হচ্ছে নীল গাই। হিল ট্র্যাক্টের জঙ্গলে এক সময় প্রচুর নীল গাই পাওয়া যেতো। বাবা অনেক নীল গাই শিকার করেছেন। আজকাল অবশ্য খুব কমই দেখা যায়।

টুনি বললো, সত্যি বলছেন এগুলো নীল গাই! কী মজা ললিপা! স্কুলে গিয়ে নীল গাইর গপ্পো করা যাবে।

আমি বললাম, কেন, কালো কাঠবেড়ালী যে দেখলে, সেটা তো আরো দুর্লভ।

বাবু বললো, লরেল হার্ডিই বা কম কিসে! গোবর যা দেখালো–আমি তো কোনো দিনই ভুলবো না।

আমি বললাম, পা চালিয়ে চলো সবাই। নীল গাইরা মাঝে মাঝে ক্ষেপে গিয়ে তাড়া করে। তখন এরা বাইসনের চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।

টুনি শুকনো গলায় বললো, আপনি খালি ভয় দেখাতে পারেন।

বাকি পথটা আমরা সবাই মিলে দৌড়ে পার হলাম। শেষের দিকে অবশ্য খুবই আস্তে হাঁটতে হয়েছে, কারণ ললির বুকের ব্যাথাটা আবার বেড়েছিলো। আমরা যখন ঘরে ফিরলাম, ঘড়িতে তখন আটটা বাজে।

নেলী খালা গাড়ি বারান্দার নিচে পায়চারি করছিলেন। স্ক্যাটরা ছুটে গিয়ে ওঁকে আদর করতেই এক ধমক লাগালেন–থাক থাক, ওসব শুকনো আদর দেখাতে হবে না।

আমি ভাবলাম, এ সময়ে জাহেদ মামার থাকাটা খুব দরকার ছিলো। নেলী খালা রীতিমতো রেগে গেছেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে নেলী খালা বললেন বেড়াতে তো কাউকে আমি বারণ করি নি। জাহেদ বলে গেলো ওর দুটো লোককে কারা যেন খুন করে সমুদ্রের তীরে ফেলে রেখেছে। বেচারা জাহেদ হিমছড়ি আর কক্সবাজার ছুটোছুটি করে মরছে। আমি একা কত জনের কথা ভাববো!

আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, বলো কি নেলী খালা! কারা খুন করলো?

নেলী খালা বিরক্ত হয়ে বললেন, সেটা যদি কেউ জানতো, তাহলে জাহেদকে এতো ছুটোছুটি করতে হতো না। আমি শুধু শুনেছি দুটো খুন হয়েছে, আর লাশ দুটোর পাশে বালিতে দুটো মড়ার খুলি আঁকা রয়েছে।

আবার মড়ার খুলি! তার মানে গোবররা কি খুনের সঙ্গেও জড়িত? গভীর উত্তেজনায় আমাদের সবার চোখ চকচক করছিলো। বাবু কী যেন বলতে যাচ্ছিলো। নেলী খালা বাধা দিয়ে বললেন, আর কোনো কথা নয়। এক্ষুনি খেয়ে শুতে যাও।

আমরা যখন রাতের খাবার খেয়ে ওপরে উঠতে যাবো, তখনই ফতে গোবর এসে ঘরে ঢুকলো। নেলী খালার পাশে স্ক্যাটরাকে দেখে গোবর ফতের একটা হাত আঁকড়ে ধরলো। নেলী খালা গম্ভীর হয়ে বললেন, আপনারা খেয়ে নিন। আমি অত্যন্ত দুঃখিত, সঙ্গে বসতে পারছি না।

গোবর বললো, তাতে কি, তাতে কি! তবে কুত্তোটাকে দিদি আপনার সঙ্গে নিয়ে গেলে একটা ভাতও গিলতে পারবো না।

দোতালায় এসে ঘরে ঢুকে আমি বাবুকে বললাম, আজ রাতেই একটা কিছু ঘটবে।

বাবুর দুচোখে তখন ঘুমের জোয়ার নেমেছে। ঘুম-জড়ানো চোখে পিটপিট করে তাকিয়ে বললো, কী ঘটবে?

আমি বললাম, বোসো। এত ব্যস্ত হচ্ছো কেন, আমাকে একটু ভাবতে দাও।

এতো বড়ো প্ল্যানটা একটু ভূমিকা ছাড়া কীভাবে বলা যায় আমি ভেবে পেলাম না। বাবু বিরক্ত হয়ে বললো, তুমি সারারাত ধরে বসে বসে ভাববা। বলেই পাশ-বালিশটা টেনে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

বাবুর ওপর আমার খুব রাগ হলো। আমি ভাবছিলাম ফতে গোবরকে আজ রাতে অনুসরণ করবো। ললির বুকের অসুখটা আবার বেড়েছে বলে ও খাবার পরই ঘরে চলে গেছে। টুনিও নিশ্চয় এতোক্ষণে আলো দেখবার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে নাক ডাকতে শুরু করেছে। বাবু, ললি, টুনি সব কটাকে দারুণ স্বার্থপর মনে হলো। মনে মনে ঠিক করলাম, আগামী তিন দিন বাবুর সঙ্গে কথাই বলবো না।

.

০৮. আরও কিছু সূত্র

বাবুদের স্বার্থপরতার কথা ভেবে যখন সব কিছু অসার মনে হচ্ছিলো, ঠিক তখন দেখি নেলী খালা পা টিপে টিপে আমাদের ঘরে ঢুকলেন। আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, তুমি অমন করে হাঁটছো কেন নেলী খালা? পায়ে কি কিছু বিধেছে!

নেলী খালা ঠোঁটের উপর আঙুল চেপে ফিসফিস করে বললেন, চুপ! তারপর কাছে এসে বললেন, আমার ঘরে চল। একটা জিনিস দেখাবো।

আমি অবাক হয়ে নেলী খালাকে অনুসরণ করলাম। নেলী খালা আবার কখন থেকে আমাদের মতো গোয়েন্দাগিরি শুরু করলেন, ভেবে কোনো কূলকিনারা পেলাম না।

নেলী খালার মতো পা টিপে টিপে নিচে এসে তার ঘরে ঢুকলাম। ঢুকতেই আমার চোখ দুটো কপালে উঠে গেলো, আর মুখটা হাঁ হয়ে গেলো। কী বলবো কিছুই ভেবে পেলাম না। চোখের সামনে দেয়ালের মিটমিটে আলোর নিচে ভাইয়া হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।

অমন করে তাকিয়ে আছিস কেন? কথা বল। তুই তো দেখছি আমার চেয়েও লম্বা হবি!–বলতে বলতে ভাইয়া এগিয়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।

আমি কথা না বলে শুধু ভাইয়াকেই দেখছিলাম। নেলী খালা গত বছর জিনসের যে নীল ট্রাউজারটা ভাইয়ার জন্যে এনেছিলেন, সেটাই তার পরনে। গায়ে একটা খদ্দরের পাঞ্জাবি। ভাইয়া দাড়ি রেখেছে। দাড়ি রাখলে যে কাউকে সুন্দর লাগতে পারে, ভাইয়াকে দেখার আগে কোনো দিনই কথাটা আমি বিশ্বাস করতাম না।

আমি বললাম, তুমি কেমন আছো ভাইয়া? কোথায় থাকো? কী করছো?

ভাইয়া হেসে বললো, আস্তে আস্তে। খুব ভালো আছি। কোথায় থাকি, কী করে বলি! বলতে পারিস সারা বাংলাদেশেই আছি। কী করছি, এক কথায় কি আর বলা যাবে? বরং কখনো নেলী খালার কাছে শুনিস আমরা কী করছি। তোদের কথা বল। তুই তো ফাস্ট হবি আমি জানি। মা-বাবা কেমন আছেন রে?

আমি বললাম, ভালো। তোমার প্রথম চিঠি পড়ে মা কেঁদেছিলেন। আগে খুব কাঁদতেন। এখন আর কাঁদেন না।

ভাইয়া বললো, না কাঁদলেই বাঁচি। কাল তোকে হাটে দেখেছিলাম। সঙ্গে ওরা ছিলো বলে ডাকি নি। মনে হচ্ছে নতুন জায়গাটা তোদের খুব ভালো লেগে গেছে।

আমি বললাম, ভালো আর বলতে! এত সুন্দর জায়গার কথা আমি ভাবতেই পারি না।

ভাইয়া মুখ টিপে হেসে রহস্য করে বললো, প্রদীপের নিচেই যে অন্ধকার!

অন্ধকার কোথায় দেখলে ভাইয়া? আমি অবাক হলাম।

আগে বল, সেদিন নদীর পানিতে সবাই মিলে কী খুঁজছিলি?

আমি নেলী খালার দিকে তাকালাম। নেলী খালা লাজুক হেসে বললেন, তোমাকে বলি নি অপু। আমার ধারণা, এ নদীর কাছাকাছি কোথাও সোনার খনি আছে। আমি নদীর বালুর সঙ্গে সোনার গুঁড়ো পেয়েছি।

বলো কী নেলী খালা! এমন একটা জিনিস তুমি এদ্দিন চেপে ছিলে?

না, না। আমি এখনো পুরোপুরি শিওর নই। নেলী খালা বললেন, জিওলজিক্যাল সার্ভে ডিপার্টমেন্টকে চিঠি লিখেছি। ওরা একটা সার্ভে টীম পাঠিয়েছে। ওদের একটা জার্নালে পড়েছি। মনে হচ্ছে হিল ট্রাক্টে সোনা পাওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়।

নেলী খালার কথা শুনতে শুনতে কী যেন ভাবছিলো ভাইয়া। চিন্তিত গলায় বললো, এখন মনে হচ্ছে একটা সূত্র খুঁজে পেয়েছি।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কিসের সূত্র?

বলছি। নেলী খালার দিকে তাকালো ভাইয়া–পাকড়াশীকে তোমার কেমন মনে হয় বলো তো?

নিকুঞ্জ পাকড়াশীর কথা বলছিস? কেন, ভালোই তো!

কী রকম ভালো? ভাইয়া রহস্যময় হাসলো।

আমি বাড়ি কেনার পর নিজে এসে দেখা করে গেছেন। প্রথম দুদিন রান্না করে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছেন। সব সময় তোকজন পাঠিয়ে খোঁজখবর নেন। এক বার অবশ্য বলেছিলেন, এ বাড়িটার ভীষণ বদনাম। কিনে ভালো করি নি। এখনো নাকি কী সব আশরীরী আত্মা এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়। এক জন ওয়েল উইশারের মতো বাড়ির কাজের লোকজনদেরও সাবধান করে দিয়েছেন। আমি ওতে কান দিই নি। পুরোনো দিনের লোকজন এসব বলেই থাকে।

তার সম্পর্কে তোমার আর্মি অফিসার বন্ধুর কী ধারণা?

একটু লাল হয়ে নেলী খালা বললেন, জাহেদ বলেছে, কক্সবাজার আর হিমছড়িতে নাকি দুটো চ্যারিটেবল ডিসপেন্সারি চালান পাকড়াশী মশাই। নির্বিরোধী শান্তিপ্রিয় লোক। বড় খামার আছে একটা। একা মানুষ। খামারে প্রচুর আয় হয়। তাই দান-খয়রাতের সুযোগ পেলে ছাড়েন না।

হুঁ। গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়লো ভাইয়া। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, পাকড়াশীকে তোমরা যতোটা ভালো বলে জানো, আমরা তা মনে করি না।

নেলী খালা ভুরু কুঁচকে বললেন, খারাপ কী দেখলে?

মৃদু হেসে ভাইয়া বললো, এটা তো স্বীকার করবে, তোমার আর জাহেদ সাহেবের চেয়ে এই এলাকাটা আমি বেশি চিনি?

তাতে কী হলো?

পাকড়াশীকে আমরা প্রথম থেকেই সন্দ করছি। জায়গাটার ন্যাচারাল বিউটি দারুণ। তবে এত বড় একটা খামার চালাবার জন্যে মোটেই সুবিধের নয়। তুমি নিজেই তো ভেজিটেবলের ব্যবসা করতে গিয়ে গচ্চা দিলে। কক্সবাজারের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ। টেকনাফ বা উখিয়ার অবস্থাও এর চেয়ে ভালো। তবু সেখানে এ ধরনের কোনো খামার নেই। অথচ এখানে এত বড় একটা খামার ফেঁদে বসার তাৎপর্যটা কী–এ নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাতে হয়েছে।

হয়তো জায়গাটা পাকড়াশীর কোনো কারণে ভালো লেগেছে। যেমন আমার লেগেছে। এতে সন্দ করার কী আছে?

পাকড়াশী তোমার মতো এ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় নয় নেলী খালা। অত্যন্ত প্র্যাকটিক্যাল লোক। পাকড়াশীর এখানে আসার পর অচেনা লোকের আনাগোনা অনেক বেড়েছে। আমাদের কাজ করতে হয় স্থানীয় লোকদের সঙ্গে। ওদেরও অনেকের ধারণা, এখানে থাকার পেছনে পাকড়াশীর বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য আছে। এখানকার লোকজন এত ভালো যে, মানুষ খুন করা দূরে থাক, সামান্য চুরি পর্যন্ত করে না। অথচ পাকড়াশী আসার পর বেশ কয়েকটা লোক খুন হয়েছে।

তোর যুক্তি মোটেই জোরালো মনে হচ্ছে না অপু। মাথা নেড়ে নেলী খালা বললেন, আমাকে যারা ভূতের ভয় দেখিয়ে এ বাড়ি থেকে তাড়াতে চায়, হয়তো তারাই পাকড়াশীকে নিয়ে এসব কথা বলে বেড়াচ্ছে। তুই যেভাবে বলছিস, সেভাবে তো বুড়ো মুৎসুদ্দিকেও সন্দ করা যায়।

কেন, মুৎসুদ্দি বুড়ো কী বললো?

তিনিও আমাকে ভূতের ভয় দেখিয়েছেন। সে দিন আসার সময় আবিররাও শুনেছে।

তার স্বার্থ?

স্বার্থ তো একটাই। আমি চলে গেলে এ বাড়িটায় তিনি মোটেল চালু করতে পারেন। অলরেডি কক্সবাজারে একটা মোটেল উনি চালাচ্ছেন।

কিছুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবলো ভাইয়া। তারপর বললো, মুৎসুদ্দিও খারাপ লোক হতে পারে, তাতে করে পাকড়াশী ভালো হচ্ছে না। তুমি যে একটু আগে নদীর কথা বললে, আমার মনে হচ্ছে পাকড়াশীও বোধ হয় এটা জানে। নইলে সমুদ্র পর্যন্ত নদীর দুপাশে দেড় শ একর জমি কী কারণে লীজ নিয়ে রেখেছে? খামারে তো পাঁচ-ছয় একরের বেশি জমি নেই।

এই কথা? হাসলেন নেলী খালা-পাকড়াশী মশাই আমাকে বলেছেন রাবারের চাষ করবেন। জমি নাকি তার আরও লাগবে।

এতোক্ষণ চুপচাপ নেলী খালা আর ভাইয়ার কথা শুনছিলাম। যেখানে আমার সন্দেহের জট পেকে আছে, সেটা ভাইয়া কিছুটা ধরতে পেরেছে। আজ সন্ধ্যার ঘটনার পর আমারও মনে হয়েছে পাকড়াশী নিপাট ভালোমানুষ নয়। কিন্তু ফতে আর গোবর কী উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে, তার সঙ্গে পাকড়াশীর কী সম্পর্ক সেটা জানতে না পারলে জট খোলা যাবে না। ফতে গোবর যে লোক ভালো নয়, এর প্রমাণ তো আমরা পেয়েই গেছি। ভাইয়া আর নেলী খালাকে ওদের সম্পর্কে যতোটুকু জানতাম বললাম, শুধু বাড়ির ভেতরের ঘটনাগুলো বাদ দিয়ে।

ভাইয়া সব শুনে বললো, রণ-পা শুধু ভয় দেখাবার জন্য পরে না। এসব জায়গায় যেখানে যোগাযোগ সবচেয়ে খারাপ, সেখানে দূরের পথে যাবার জন্য কেউ কেউ এখনো রণ-পা পরে।

নেলী খালা বললেন, ওদের ব্যবসার কাজে পাকড়াশীর সঙ্গে দেখা করা বা কথা বলার ভেতর অন্যায় কিছু নেই। আমি লোক দুটোকে পছন্দ করি না ম্যানার শেখে নি বলে।

গত রাতে ফতে আর গোবর আন্নাকালীর পাহাড়ে যে আলোর সংকেত পাঠিয়েছিলো, সে কথা নেলী খালাদের আর বললাম না। এ কথা কে না জানে, বড়োরা কখনো ছোটদের স্বাধীনভাবে কোনো কাজ করতে দেয় না। ফতে গোবরের ব্যাপারে আমাদের তদন্ত চালিয়ে যেতে হবে।

ভাইয়া নেলী খালাকে বললো, মেজর জাহেদের সঙ্গে একটা ব্যাপারে আমি একমত। এই এলাকায় যে স্মাগলিং হচ্ছে, তার সঙ্গে স্থানীয় কোনো লোক জড়িত নয়। তুমি বরং তাকে পাকড়াশী আর মুৎসুদ্দির ওপর বিশেষভাবে নজর রাখতে বোলো। আবিররা তো ফতে গোবরের ওপর নজর রেখেছেই।

নেলী খালা বললেন, তুই তাহলে বলতে চাস খুনটাও বাইরের লোকে করেছে।

আমার তাই ধারণা।

অথচ জাহেদ খুনের ব্যাপারে স্থানীয় লোকদের সন্দ করে বসে আছে। এখানকার স্থানীয়রা বাইরের লোকদের নাকি একেবারেই পছন্দ করে না।

সেটা ঠিক। আর পছন্দ করবেই-বা কেন? বাইরের লোকেরা এসে এখানকার জমি-টমি সব লীজ নিয়ে স্থানীয়দের ওপর অত্যাচার তো কম করছে না। তবে সমস্যাটা খুনোখুনির পর্যায়ে এখনো যায় নি। আমি অনেক দিন ধরে এদের ভেতর কাজ করছি তো। আসলে লোকগুলো খুবই নিরীহ আর শান্তিপ্রিয়। একটু থেমে ভাইয়া কী যেন ভাবলো। তারপর বললো, অবশ্য কতোদিন এরকম নিরীহ থাকবে বলা মুশকিল। বান্দরবন আর খাগড়াছড়ির দিকে গোলমাল শুরু হয়ে গেছে।

নেলী খালা বললেন, তোরা সাবধানে থাকিস অপু।

ভাইয়া মৃদু হাসলো–তোমার বন্ধুকে বলে দিও, স্মাগলার খুঁজতে গিয়ে আবার যেন আমাদের পেছনে না লাগে। আমি অবশ্য মেজর জাহেদের কথা বলছি না। তিনি ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, এটা আমরা জানি। কিন্তু নর্থে আর্মির লোকেরা আমাদের ওপর কম অত্যাচার করছে না।

ভাইয়ার শেষের কথাগুলো আমার কাছে ভীষণ রোমাঞ্চকর মনে হলো। বাবু বলছিলো, সাউথ আমেরিকায় বিপ্লবীদের সঙ্গে আর্মির সব সময় যুদ্ধ হচ্ছে। সেখানে বিপ্লবীরা গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছে। ভাইয়ারা কি সেরকম কিছু করেছে?

ভাইয়া আমার মুখের দিকে তাকালো। বুঝলো আমি কী জানতে চাইছি। মৃদু হেসে বললো, তোর সঙ্গে আলাদাভাবে আরেক দিন কথা বলবো আবির। কি বলতে চাইছিস বুঝতে পারছি। আজ আমার সময় নেই। নেলী খালা, তুমি বরং ওকে বোলো আমরা কী করছি।

আমি বললাম, তুমি শুধু এটুকু বলো, পাকড়াশী কি তোমাদের কাজের কোনো ক্ষতি করছে?

নিশ্চয়ই করছে। ভাইয়া শক্ত গলায় বললো, পাকড়াশীর মতো লোকেরা দেশের শত্রু। চোরাচালান যারা করে, তারা সবাই দেশের শত্রু। আর আমরা তো দেশের জন্যেই কাজ করি।

নেলী খালা নিরীহ গলায় বললেন, পাকড়াশী চোরাচালান করে, এটা তোমার ধারণা। প্রমাণ তো কিছু পাওয়া যায় নি?

আমি মনে মনে বললাম, প্রমাণ আমরাই খুঁজে বের করবো।

ভাইয়া হেসে বললো, তাছাড়া পাকড়াশীদের ধরার জন্যে যেভাবে আর্মি ক্যাম্প বসানো হয়েছে, এতেও আমাদের কম ক্ষতি হচ্ছে না।

এরপর ভাইয়া উঠে দাঁড়ালো–আজ আর কোনো কথা নয় আবির। তোরা তো আছিস কিছু দিন। পরে কথা বলবো। আশা করি তোর বন্ধুদের আমার ব্যাপারে কিছু বলবি না। বাবুর কথা শুনেছি, খুব শার্প ছেলে। সামান্য একটু আঁচ পেলেই অনেক কিছু বুঝে ফেলবে।

আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, তোমার সঙ্গে এখানে দেখা হওয়ার কথা বলবো না ভাইয়া। তবে তোমার চিঠির কথা ওকে বলেছি। ওই তো বললো তুমি বিপ্লবীদের গোপন দল করছে।

তবেই দ্যাখ, কী রকম ছেলে ও। ভাইয়া হাসলো–আমি তো দলের কথা চিঠিতে কিছু লিখি নি।

তুমি আমাকে যে-সব বই পড়তে বলেছে, সেগুলো দেখেই ওর অমন ধারণা হয়েছে।

ভাইয়া নেলী খালাকে বললো, কই, আমার জিনিসটা দাও।

নেলী খালা আলমারি খুলে একটা খাম এনে দিলেন ভাইয়াকে। ভাইয়া সেটা না খুলে পকেটে খুঁজে বললো, এবার তাহলে যাই।

নেলী খালা ম্লান হেসে বললেন, সাবধানে থাকিস অপু।

ভাইয়া আমার চিবুক নেড়ে আদর করে আর কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আমি আর নেলী খালা কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। ভাবছিলাম, ভাইয়ার জীবনটা শুধু রোমাঞ্চের নয়, কষ্টেরও। নেলী খালা আস্তে আস্তে বললেন, অপুটা এ রকমই। মাঝে মাঝে হুট করে আসে, আবার হুট করে চলে যায়। আজ এসেই বললো, খেতে দাও। সারা দিনে দুটো পাহাড়ী কলা ছাড়া আর কিছু খাই নি।

আমি বললাম, রোজ রাতে এসে খেয়ে গেলেই তো পারে। রাতে কে দেখবে!

একটু হেসে নেলী খালা বললেন, ও কি এখানে থাকে! মাসে এক বার, বড় জোর দুবার আসে, আবার কখনো দুমাস পরেও আসে। তোরা আসবি খবর পাঠিয়েছিলাম। তাই এসেছিলো এবার।

আমি বললাম, ভাইয়ার হাতে খামে করে কাকে চিঠি পাঠালে নেলী খালা?

নেলী খালা মৃদু হেসে বললেন, চিঠি নয়, টাকা। আমি প্রতি মাসে ওদের দলের জন্যে কিছু চাঁদা দিই। ওদের টাকা-পয়সার ভীষণ টানাটানি। অপু তো একা নয়, ওর মতো বহু ছেলে আছে যারা ঘরবাড়ি সব ছেড়ে সর্বক্ষণ পার্টির কাজ করছে। ওদের জন্যে তো খরচ আছে।

নেলী খালার জন্য গভীর ভালোবাসায় বুকটা ভরে গেলো। আমরা ভাইয়ার জন্য যতো না ভাবি, তার চেয়ে বেশি ভাবেন তিনি। বললাম, নেলী খালা, আমার স্কলারশিপের টাকা থেকে ভাইয়াদের জন্য যদি কিছু পাঠাই, তুমি ওদের দিতে পারবে?

কেন পারবো না! মিষ্টি হেসে নেলী খালা বললেন, অপু আমাকে বলেছে, পারলে জাহেদের কাছ থেকেও টাকা নিতে।

আমি উৎসাহের সঙ্গে বললাম, বাবুকে যদি বলি, ও নিজেও খুশি হয়ে দেবে।

সেটা কি উচিত হবে? চিন্তিত গলায় নেলী খালা বললেন, সব জানাজানি হয়ে যাবে না?

ও নিয়ে তুমি ভেবো না। আমি এমনভাবে চাইবো যে বাবু বুঝতে পারলেও কিছু জানতে চাইবে না।

নেলী খালা কাছে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, তুই তাড়াতাড়ি বড় হ। তোকে আরও কাজ করতে হবে। বাবা একা না হলে আমিও পুরোপুরি কাজে নেমে পড়তাম। এবার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়। রাত কম হয় নি।

নেলী খালার ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় মনে হলো, এতক্ষণ বুঝি স্বপ্ন দেখছিলাম, যে স্বপ্নের কথা বাবু, ললি, টুনি কাউকে বলা যাবে না, যা কিনা একান্তভাবেই আমার।

ভাইয়া বলেছে পাকড়াশীর জন্য তাদের কাজের অসুবিধে হচ্ছে। তার মানে তাহলে এই দাঁড়াচ্ছে যে, আমরা যদি প্রমাণ করতে পারি পাকড়াশী আসলে এক জন স্মাগলার, তাহলে ভাইয়াদেরও উপকার হবে।

নুলিয়াছড়িতে বেড়াতে এসে এতোসব ঘটনার ভেতর জড়িয়ে যাবো, স্বপ্নেও ভাবি নি। নেলী খালা একটু আগে বললেন, বড় হলে নাকি কাজের ভার দেবেন। কাজ তো এরই মধ্যে আমরা শুরু করে দিয়েছি। পাকড়াশীকে ধরতে গিয়ে মেজর জাহেদের মতো অফিসারও হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। অথচ পাকড়াশী সম্পর্কে আমরা যতোটুকু জানি, তার অর্ধেকও তিনি জানেন কিনা সন্দেহ। ঠিক করলাম, আজ রাতেই একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলবো।

ভাইয়ার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, বাবুর সঙ্গে কথা বলবো না, পৃথিবীটা কি অসার,–এইসব। সে-সব কথা মনে পড়াতে হাসি পেলো। মনে হলো ভাইয়ার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমার বয়স অনেক বেড়ে গেছে। সাহস আর মনের জোরও বেড়ে গেছে অনেক।