১১. বিস্ময়ের চরম সীমানায়
সারারাত প্রচণ্ড ঝড় আর বৃষ্টিতে আমরা বহুক্ষণ ঘুমোতে পারিনি। দিদা চলে যাওয়ার পরও আমরা অনেক রাত অব্দি জেগেছিলাম। দুলালদা খাসিয়াদের গ্রামে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। তিনি এখন গ্রামের কৃষকদের অবস্থা তদন্ত করছেন। ওদের গত দশ বছরের পুরো অবস্থাটা জেনে নিচ্ছেন। খাসিয়ারা দুলালদাকে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছে। কৃষক সমিতি সম্পর্কে ওরা দারুণ উৎসাহী। দুলালদা আগে ওদের ভেতর কাজ করেছিলেন। তখন তিনিও খাসিয়াদের ভাষাও শিখেছিলেন। দুলালদার মতে, কারো সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে গেলে, বিশেষ করে তারা যদি শিক্ষা-সংস্কৃতির দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকে, তাহলে তাদের ভাষা অবশ্যই জানতে হবে। দুলালদা সাঁওতাল আর ওঁরাওদের ভাষায় চমৎকার কথা বলতে পারেন।
ভোরে আমার আর দুলালদার ঘুম একসঙ্গেই ভাঙলো। আমি উঠে রামুকেও ঘুম থেকে তুলে দিলাম। দুলালদা জানালা খুলে দিলেন। বাইরে ঘন কুয়াশা। সারা আকাশ মেঘে ঢাকা। হু হু করে গায়ে সঁচ-ফোঁটানো ঠাণ্ডা ঝড়ো বাতাস বইছে। আমি বললাম, যাবেন কীভাবে দুলালদা?
দুলালদা হেসে বললেন, না গেলে চলবে কী করে?
চাদর মুড়ি দিয়ে আমরা তিনজন বেরিয়ে পড়লাম। বিজুর চাদরটা জোর করেই দুলালদার গায়ে জড়িয়ে দিলাম। বললাম, আজ বিজুকে ঘর থেকে বার করা যাবে না। মেজদা ওর জন্যে হেমেন্দ্রকুমারের রচনাবলী এনেছেন।
দুলালদা মৃদু হেসে বললেন, তোমরা দুজন তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেছে। বিজু তোমাদের তুলনায় একটু পিছিয়ে আছে।
আমি আর রামু কাঁধে হাত রেখে হাঁটছিলাম। দুলালদার কথা শুনে আমরা দুজন মুখ টিপে হাসলাম। বিজু কোনো-কোনো ব্যাপারে আমাদের চেয়েও বেশি বখে গেছে, এটা শুধু আমি আর রামুই জানি। আমরা সবাই শীতে কাঁপছিলাম।
কমলালেবুর বাগানের শেষপ্রান্তে এসে ঝর্নার দিকে তাকাতেই সবার মাথা ঘুরে গেলো। আমাদের পরিচিত ঝিরঝিরে ঝর্নাটির চেহারা একরাতেই একেবারে অন্যরকম হয়ে গেছে। গত বন্যার সময় শুধু ঝর্নার এরকম চেহারা দেখেছিলাম। তখন তো বর্ষা ছিলো-বন্যার আগে থেকেই নদীর মতো হয়ে গিয়েছিলো। এখন ঝর্নাটি উত্তাল নদীর মতো ফুলেফেঁপে প্রচণ্ড শব্দ করে বয়ে চলেছে। পাহাড় থেকে বড়বড় পাথর স্রোতের টানে গড়িয়ে আসছে। একটানা চাপা গর্জন শোনা যাচ্ছে। ঝর্নার এরকম শব্দ আমি আগে কখনো শুনিনি।
দুলালদা শুকনো মুখে বললেন, যাবো কী করে? একেবারেই যে যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়ে গেছে।
আমি বললাম, আপনি খেপেছেন দুলালদা। পানিতে নামার সঙ্গে সঙ্গে আপনি ছাতু হয়ে যাবেন।
রামু বলল, দুলালদা ফিরে চলুন।
দুলালদা কাষ্ঠ হেসে বললেন, দিনের বেলায় তোমাদের ওখানে থাকি কী করে! মেজদা এসেছেন। অন্য কেউ কোনো দরকারে ছাদে উঠতে পারে। বিজুর কথামতো সারাক্ষণ খাটের নিচে লুকিয়ে থাকা যায় নাকি!
আমি হেসে বললাম, থাকার জন্যে আপনি মোটেই ভাববেন না দুলালদা। আপনি হাসি খালাদের বাসায় থাকবেন। তিনি আপনাকে দেখলে দারুণ খুশি হবেন।
দুলালদাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আমরা দুজন তার দুহাত ধরে সোনিয়াদের বাসায় নিয়ে এলাম। কালকের মতো সোনিয়া ছোট্ট কাঠের গেটটার পাশে ঘুমঘুম চোখে দাঁড়িয়েছিলো। ওর হাতে দুটো লাল গোলাপ। আমাদের সঙ্গে দুলালদাকে দেখে সোনিয়া ভারি অবাক হলো।
রামু বললো, দেখ সোনিয়া কাকে এনেছি। দুলালদা আজ তোদের বাসায় থাকবেন।
সত্যি বলছিস রামু? বলে সোনিয়া হাসি খালাকে ডাকতে ডাকতে দৌড়ে ঘরের দিকে গেলো।
আমরা ভেতরে ঢুকলাম। হাসি খালার লনে সবুজ ঘাসের ডগায় রূপোলি শিশিরকণা জমে আছে। দুলালদা বললেন, ভারি সুন্দর লন। হাসি খালা নিশ্চয় বাগান খুব ভালোবাসেন।
হাসি খালা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন। দুলালদার কথা শুনে মৃদু হাসলেন। বললেন, এসো ভেতরে এসো।
আমাদের তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে হাসি খালা খাবার ঘরে গিয়ে বসলেন। টেবিলে সাদা মোরগের মতো দেখতে একটা টিকোজির পাশে ধবধবে সাদা টি-পট। সাদা বোধ হয় হাসি খালার প্রিয় রঙ। দেয়াল থেকে শুরু করে টেবিলক্লথ, চেয়ারের কুশন, চায়ের কাপ সবই সাদা। হাসি খালার পরনে আগের মতোই সাদা শাড়ি। কলেজের মেয়েদের মতো ধবধবে সাদা কার্ডিগান পরেছেন। হাসি খালার ঘরে ঢুকলে মনটা অদ্ভুত সুন্দর এক প্রশান্তিতে ভরে যায়।
ঝর্নার কথা শুনে হাসি খালা বললেন, রাতে বৃষ্টির জন্যে এরকম হয়েছে। পাহাড়ের পানি নেমে গেলেই আবার আগের মতো হয়ে যাবে।
দুলালদা বললেন, রাতে ঝড়ও কম হয়নি। আমি ভাবছি গ্রামের ওরা কী অবস্থায় আছে! ঘরটর সব হয়তো উড়ে গেছে।
হাসি খালা বললেন, কাল সকালেই যেতে পারবে, এখন তো আর বর্ষাকাল নয়।
সোনিয়া বললো, অবশ্য আজ যদি বৃষ্টি না হয়।
দুলালদা মৃদু হেসে বললেন, বৃষ্টির কথা আর মুখে এনো না সোনিয়া। শীতকালের বৃষ্টির মতো বিরক্তিকর আর কিছু হয় না।
সোনিয়াদের বেঁটেখাটো নেপালি বাবুর্চি রামথাপা চায়ের পটে করে গরম পানি আনলো। হাসি খালা বড়বড় চায়ের পাতা ভিজিয়ে কিছুক্ষণ টিকেজি দিয়ে ঢেকে রাখলেন। মৃদু হেসে বললেন, সকালে আমার কয়েক কাপ চা খাওয়া হয়।
রামু বললো, এরকম চা পেলে আমি সারাদিন খেতাম।
হাসি খালা বললেন, এবার বাগান থেকে এলেই পাঠিয়ে দেবো।
চা খেয়ে আমরা দুজন উঠে পড়লাম। ওদিকে হয়তো মেজ জেঠিমা আমাদের মুণ্ডপাত করছেন। দুলালদাকে বললাম, বিকেলে চা খেতে আসব। তখন দেখা হবে।
সোনিয়া আমাদের সঙ্গে গেট পর্যন্ত এলো। গোলাপ দুটো সোনিয়া ললিপপের মতো ধরে রেখেছিলো। আমি বললাম, আজ যে দুটো গোলাপ সোনিয়া?
সোনিয়া বললো, আজ তোরা দুজনেই ভালো কাজ করেছিস। অবশ্য ঝর্নাকেও একটা দেয়া উচিত।
সোনিয়া আমাদের দুজনকে গোলাপ দুটো দিলো। সারা পথ গোলাপের গন্ধে বিভোর হয়ে বাড়ি ফিরলাম।
ঘরে ঢুকতেই বিজু বললো, নিচে যাও, মেজ জেঠিমা মর্নিংওয়াক করার মজা দেখাবেন।
বিজু বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে হিমালয়ের ভয়ংকর পড়ছিলো। রামু বললো, মা খুব রেগে আছেন নাকি বিজু?
বিজু হেসে বললো, রেগেছিলেন বৈকি। দিদা রাগের গোড়ায় পানি ঢেলে দিয়েছেন। বলেছেন, সকালে মর্নিংওয়াক করলে শরীর ভালো হয়। জেঠিমা পরে বলেছেন, এই কাজটি তো ছাদেও করা যায়। এই শীতের ভেতর বাইরে যেতে হবে কেন!
আমি হেসে বললাম, দিদা যতদিন আছেন ততদিন আমাদের কোনো ভাবনাই নেই।
রোদ নেই বলে সেদিন মেজদার স্যুটিং হলো না। দুপুর পর্যন্ত আমরা মেজদার ঘরে বসে গল্প করলাম। মেজদা একসময় বললেন, এসব যাচ্ছেতাই ছবি বানাতে আর ভাল্লাগছে না। আমি ঠিক করেছি একটা মনের মতো ছবি বানিয়ে আবার লেখার জগতে ফিরে যাবো।
ঊর্মিলাদি গম্ভীরমুখে মাথা নেড়ে সায় জানালেন। ছবির নায়িকা ঊর্মিলাকে মেজদা বলেছেন ঊর্মিলাদি ডাকতে। তিনিও আমাদের সঙ্গে বসে গল্প করছিলেন। সাজগোজ না করলে ঊর্মিলাদিকে খুবই সুন্দর দেখায়। রঙটা যদিও ফর্শা নয়–তবে ফর্শা হলে তাকে এতটা ভালো লাগতো না।
দুপুরে আমাদের খাওয়ার জন্যে ডাকতে এসে দিদা মেজদাকে বললেন, এই যে পন্টু। তোকে একটা কথা বলব ভেবেছিলাম। পচা-পচা ছবি বানিয়ে টাকা পয়সা তো কম রাজগার করিসনি। অনেক আজেবাজে লোকের বিস্তর কালো টাকা সাদা করে দিয়েছিস। এখন সৎপথে কিছু টাকা ব্যয় কর।
মেজদা হেসে বললেন, অত ভূমিকা না করে বললেই পারো তোমার কিছু টাকার দরকার।
দিদা বিরক্ত হওয়ার ভান করে বললেন, আহ পন্টু, সবকিছু এত সংক্ষেপে বুঝতে যাওয়া ভালো নয়। টাকা আমার জন্যে নয়। আমি ভাবছি বুড়ো বয়েসে কিছু সমাজসেবা করবো। গ্রামে একটা ইশকুল করার ইচ্ছে আছে আমার।
আমি আর রামু কোনরকমে হাসি চাপলাম।
মেজদা আগের মতো হেসে বললেন, ঠিক আছে দিদা। কিছু টাকা নিশ্চয়ই দেবো। কত দিতে পারবো তোমাকে পরে জানাচ্ছি। তবে এরজন্যে আমার টাকাকে গালি দিচ্ছো কেন? অসৎ পথে টাকা রোজগার করতে হলে, এদ্দিনে ছবি না বানিয়ে মন্ত্রী হতাম।
তোর মুরোদ আমার জানা আছে। বলে দিদা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
মেজদা ঊর্মিলাদিকে বললেন, দিদার মতো মানুষ আজকাল খুব কমই দেখা যায়। আমি জানি দিদা একবার যখন বলেছেন, স্কুল না বানিয়ে ছাড়বেন না।
বিকেলে আমরা যখন বেরুতে যাবো তখনই ঝরঝর করে বৃষ্টি নামলো। সন্ধ্যে অবধি এমনই অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরতে লাগলো, মনে হল চেরাপুঞ্জির সব মেঘ বুঝি পথ ভুল করে আমাদের জাফলং-এ চলে এসেছে।
সন্ধের পর বৃষ্টিটা একটু ধরে এলো। আমরা সবাই সোনিয়াদের বাসায় যাওয়ার জন্যে এতক্ষণ বৃষ্টির মুণ্ডুপাত করছিলাম। বৃষ্টি কমতেই রামু বলল, চল,
সোনিয়াদের বাসা থেকে এক্ষুনি একবার ঘুরে আসি। দুলালদা
রামুর মুখের কথা মুখে রইলো। রামুর পেছনে চোখ পড়তেই আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। বড়দা এসে দাঁড়িয়েছেন আমাদের দরজায়। আমি শুধু বললাম, একী বড়দা আপনি!
রামু সঙ্গে সঙ্গে পেছনে তাকালো। বিজু বই ফেলে খচমচ করে উঠে বসলো। আমাদের তিনজনের মুখ হা হয়ে গেলো। বড়দার জামাকাপড় সব ভেজা। চুলের ডগায় পানির ফোঁটা জমে আছে। বড়দা কাঁপতে কাঁপতে মৃদু হাসলেন। বললেন, চাচাবি না, জেল থেকে পালিয়ে এসেছি। জলদি শুকনো কাপড় বের করে দে। শীতে একেবারে জমে গেছি। আবু, নিচে গিয়ে দিদার কানে কানে শুধু বলবি, আমি এসেছি।
আমি এক ছুটে নিচে নেমে গেলাম। দিদা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলেন। কথাটা বলতেই তাঁর হাত থেকে চায়ের কাপটি পড়ে ভেঙে গেলো।
পচার মা ছুটে এসে বললো, ও কি মা, কাপ ভাঙলো কী করে? দিদা ওকে ধমক দিয়ে বললেন, তুই নিজের চরকায় তেল দে পচার মা। বাড়িতে তুই ছাড়া আর কেউ বুঝি কাপ ভাঙতে পারবে না?
আমি কি তাই বলেছি? বলে এতটুকু জিব কেটে পচার মা বেরিয়ে গেলো।
আমি আর দিদা চিলেকোঠার ঘরে ঢুকে দেখি বড়দা লেপ মুড়ি দিয়ে বিছানার ওপর বসে আছেন। দিদাকে দেখে বললেন, ভালো আছো তো দিদা! তোমাকে দেখার জন্যে জেল থ্রেকে পালিয়ে চলে এলাম।
দিদা কাছে গিয়ে বড়দার কপালে চুমু খেয়ে বললেন, আমি জানতাম তুই আসবি। কবে বেরিয়েছিস জেল থেকে? পথে কোনো বিপদ হয়নি আসতে? তারপর দিদা বিজুকে বললেন, দৌড়ে রান্নাঘরে যা বিজু। কেতলিতে চা বানানো আছে। এখনি বানিয়েছি। এককাপ চা আর কখানা বিস্কুট নিয়ে আয়।
বিজু দৌড়ে নিচে চলে গেলো। বড়দা মৃদু হেসে বললেন, এখনো তুমি সবদিকে নজর রাখতে পারো দিদা। আমি জেল থেকে বেরুইনি। ঢাকা থেকে কুমিল্লা নেয়ার পথে ট্রেন থেকে পালিয়েছি। আজ নিয়ে মোট উনিশ দিন হলো; এতদিন টঙ্গীর এক পুরোনো এলাকায় লুকিয়েছিলাম।
রামু বললো, ট্রেন থেকে কী করে পালালেন বড়দা, সে কথা আগে বলুন।
দিদা কটমট করে রামুর দিকে তাকালেন। বড়দা হেসে বললেন, যাচ্ছিলাম ট্রেনে করে। সঙ্গে গার্ড ছিল দুজন, আর একজন পুলিসের সাব-ইন্সপেক্টর! খুব ভদ্র আর নিরীহ কয়েদি ছিলাম বলে হাতকড়া লাগায়নি। ট্রেনে লোকজনও খুব বেশি ছিলো না। একটা খোলা পুল পার হবার সময়ই দরজা দিয়ে বাইরে লাফ দিয়েছিলাম। পানিতে ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই শুনি গুলির শব্দ। ট্রেন থামতে থামতে সাঁতরে আমি অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম। তবে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে একট পচা লাশ। কয়েকদিন গ্রামে লুকিয়েছিলাম। সেখানে থাকতে খবর পেলাম, পুলের কাছে একটা গুলি-খাওয়া লাশ পাওয়া গেছে। চেহারাটা চেনা যায়নি। একেবারেই ডিকম্পোজড হয়ে গেছে। পুলিস রিপোর্ট পাঠিয়েছে লাশটা যে আমার এ-ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই!
দিদা বললেন, পুলিশ তো আমাদের কিছুই জানায় নি!
বিজুর আনা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বড়দা বললেন, এত ব্যস্ত হচ্ছো কেন, ওদেরকে কাগজপত্তোর তৈরি করার সময় দেবে না?
তুই এখন এলি কোত্থেকে?
ছাতকে মেজকার ওখানে ছিলাম গত দুদিন। মেজকা তো ওখানকার শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের ভেতর আমাদের লাইন নিয়ে দারুণ কাজ করছেন। মেজকা আমাকে বললেন, তুই নেই বলে কাজ কি থেমে থাকবে! একটা কিছু তো করতে হবে। তাই ট্রেড ইউনিয়নের মজুরদের রাজনীতির তালিম দিচ্ছি। আমি বলেছি, মেজকা আপনি এমন এক জায়গায় কাজ করছেন, আর এমন এক সময়ে বাস করছেন যখন চুপচাপ বসে থাকতে চাইলেই থাকা যায় না। কদিন পরে দেখলাম ওখানে থাকা নিরাপদ নয়। পুলিস আর আইবির লোক সারাক্ষণ ঘুরঘুর করছে। ভাবলাম এলাকায় যাওয়ার আগে তোমাকে দেখে যাই। মেজকা সঙ্গে আসতে চাইছিলেন। আমি বারণ করেছি। আমি চাই না আমার পালিয়ে আসার কথা কাকিমাদের কানে যাক। ওঁরা দুদিনেই তাহলে সবখানে জানিয়ে দেবেন। এই বলে বড়দা আমাদের দিকে তাকালেন–বড়দাকে যদি ভালোবাসিস তাহলে এসব কথা কাউকেই বলতে পারবি না।
বিজু বললো, দুলালদাকেও না?
বড়দা ভুরু কুঁচকে বললেন, দুলালদা কে?
আমরা দিদার দিকে তাকালাম। দিদা আস্তে আস্তে বললেন, তোর মতোই একজন ইন্ডিয়া থেকে এসেছে। তারপর দুলালদার সব কথা বড়দাকে খুলে বললেন, এমনকি ইশকুলের কথাও। বড়দা সব কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ও এখন কোথায়?
আমি বললাম, হাসি খালাদের বাড়িতে। আজ ঝর্নার ঢল নেমেছে বলে গ্রামে যেতে পারেন নি।
বড়দা দিদাকে বললেন, খুবই বুদ্ধিমান ছেলে মনে হচ্ছে দিদা। ওর সঙ্গে আমি কথা বলবো।
দিদা বললেন, তুইও তাহলে হাসিদের বাসায় চলে যা। আমাদের এখানে এখন অনেক লোকজন। পন্টু এসেছে, স্যুটিং করবে বলে। তাছাড়া তোর বাপ টের পেলে হৈচৈ বাঁধাবে।
বড়দা একটু বিব্রত হয়ে বললেন, হাসি খালার সঙ্গে যে আমার ভালো আলাপ নেই। কবে একবার কথা হয়েছিলো। তাছাড়া তার ওখানে যাওয়া কি ঠিক হবে?
বড়দাকে বাধা দিয়ে রামু বলল, হাসি খালার মতো ভালো মানুষ আর হয় না বড়দা। দুলালদার সঙ্গে কি আলাপ ছিলো নাকি! আসলে তিনি বিপ্লবীদের ভালোবাসেন।
আমি বললাম, ওখানে আপনার কোনো অসুবিধে হবে না বড়দা। চলুন, দুলালদার সঙ্গেও দেখা হবে।
বড়দা মৃদু হেসে বললেন, তোরা দেখছি অনেক বড় হয়ে গেছিস। এবার তোদের কাজে লাগাতে হবে।
বিজু সঙ্গে সঙ্গে বললো, দুলালদা আমাদের ইশকুলের কাজ দিয়েছেন।
দিদা বললেন, গেলে তোরা এখনই বেরিয়ে পড়। কুটু, কাল রাতে অবশ্যই দেখা করবি। একবেলা তোকে নিজ হাতে বেঁধে না খাওয়ালে মনে শান্তি পাবো না।
বড়দা উঠে গিয়ে দিদার পাশে দাঁড়ালেন। নিচু হয়ে দিদার কপালে চুমু খেয়ে বললেন, তুমি একটুও বদলাও নি দিদা।
দিদাকে চুমু খেতে বড়দা ছাড়া অন্য কাউকে কখনো দেখিনি। আমি, রামু, বিজু, তিনজন একসঙ্গে হেসে ফেললাম। আমি বললাম, দিদার সব আদর শুধু বড়দার জন্যে।
দিদা হেসে বললেন, চুপ কর নেমকহারাম। হাসিদের বাসায় গিয়ে আবার সোনিয়ার সঙ্গে জমে যাস নে।
বড়দাকে নিয়ে হাসি খালাদের বাসায় গিয়ে দেখি দুলালদা, হাসি খালা আর সোনিয়া ড্রইংরুমে বসে আছে। দুলালদার গায়ে জলপাই রঙের নতুন সুয়েটার, যেটা হাসি খালাকে দেখেছি বুনতে। হাসি খালা বড়দাকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, কুটু কবে এলে?
বড়দা মৃদু হেসে বললেন, আজই এসেছি। আপনার রান্নার অনেক প্রশংসা শুনেছি সেজ কাকিমার কাছে। তাই আজ এসে আর লোভ সামলাতে পারলাম না।
হাসি খালা লজ্জায় লাল হলেন। বড়দা দুলালদাকে বললেন, আপনি নিশ্চয়ই দুলাল!
দুলালদা হেসে বললেন, আর আপনি তো বড়দা! তারপর দুলালদা হাত মেলানোর জন্যে উঠে এলেন, বড়দা তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, আপনার কথা দিদার কাছে শুনেছি।
হাসি খালা গভীর মমতাময় চোখে বড়দা আর দুলালদাকে দেখছিলেন। চশমার কাঁচের ভেতর তার চোখ দুটো তখন ছলছল করছিল।
বড়দা আর দুলোলদা পাশপাশি একটা সোফায় বসলেন। দুলালদা বললেন, আবু রামু দাঁড়িয়ে কেন, বোসো।
বড়দা বললেন, আজ ওরা বাড়ি চলে যাক দুলাল। কাল আমরা সাবই মিলে গল্প করবো।
হাসি খালা মিষ্টি হেসে বললেন, সকালে তোমরা তাহলে এখানেই খেও।
.
১২. হারিয়ে যাওয়ার ঠিকানা
পরদিন সকালে আমরা মেজ জেঠিমাকে বলে হাসি খালাদের বাসায় চলে এলাম। আনন্দ আর উত্তজনার অথৈ সমুদ্রে ভাসছিলাম আমরা। বিজু ঘুম থেকে উঠে বলছিলো, আমার ইচ্ছা করছে, কিছুক্ষণ কোথাও বসে মনের সুখে কাঁদি।
হাসি খালারা খাবারঘরে বসে কথা বলছিলেন। আমি গিয়ে সোনিয়ার পাশের চেয়ারটিতে বসলাম। রামু আর বিজু বসলো আমাদের মুখোমুখি, বড়দার দুপাশে। হাসি খালা সবাইকে সবুজ চা ঢেলে দিলেন।
বড়দা দুলালদাকে বললেন, তুমি কৃষকদের অবস্থা তদন্ত করা সম্পর্কে যে কথা বললে দুলাল, এখন সবার আগে এ-কাজটিই করতে হবে। কৃষক-শ্রমিকদের জানতে হবে! আক্ষরিক অর্থে নয়, পুরোপুরি একাত্ম হতে হবে ওদের সঙ্গে। পেটি বুর্জোয়া নেতৃত্বে আমার বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। আমাদের এখানে যে এতগুলো কমিউনিস্ট পার্টি, এর প্রধান কারণ হচ্ছে পেটি বুর্জোয়াদের নেতৃত্ব। পেটি বুর্জোয়া চিন্তা থেকে পার্টিতে আমলাতান্ত্রিকতা আসে। ব্যাপকভাবে কৃষক-শ্রমিক ক্যাডার পার্টিতে না থাকলে এবং তাদের রাজনীতি-সচেতন না করলে, এইসব পেটি বুর্জোয়া নেতৃত্ব আর উপদলীয় কোন্দল থামানো যাবে না। আমরা শুধু মুখেই বলি কমিউনিস্ট পার্টি হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণীর পার্টি অথচ শ্রমিকদের সত্যিকারের অবস্থা আমরা কিছুই জানি না। অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। পরিবর্তনের প্রতিটি ধাপ আমাদের জানা না থাকলে আমরা সবসময় পেছনে পড়ে থাকবো।
বড়দার অনেক কথা ঠিকমতো সবাই বুঝতে না পারলেও আমরা অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে ওঁর কথা শুনছিলাম। বড়দার কথাগুলোর সঙ্গে গভীর আন্তরিকতা মিশেছিলো, যে জন্যে প্রতিটি কথা আমাদের মনকে স্পর্শ করতে পেরেছিলো। বড়দা বললেন, আমি চিরকাল গ্রামে থেকে কাজ করেছি। সেদিন তিন বছর পর আবার গ্রামে গেলাম। তিন বছরের পরিবর্তন দেখে বিস্ময়ে আমি হতবাক হয়ে গেছি। আমাদের কৃষকরা হাল, গরু, জমি, ভিটেমাটি সব বিক্রি করে শহরের ফুটপাতে বসে বসে না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে। এর চেয়ে দুঃসময়ের কথা কি ভাবা যায় দুলাল? আমাদের দ্বন্দ্বগুলো এত পরিষ্কার, তবু আমরা বিপ্লবীরা একটি সঠিক নেতৃত্ব আর তত্ত্বে সজ্জিত কমিউনিস্ট পার্টিতে একত্রিত হতে পারছি না। ভবিষ্যতের মানুষ আমাদের এই অক্ষমতাকে কখনো ক্ষমা করবে না।
দুলালদা বললেন, বড়দা আমি আর তত্ত্বের জটিলতায় ফিরে যেতে চাই না। আমি এখানেই থাকবো। এখানেই কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করবো, কৃষক সমিতি করবো, গোপনে পার্টি সংগঠন দাঁড় করাবো। বাংলাদেশের মানুষ কেন না-খেয়ে মরছে এই দুদিনে গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে কাজ করে আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি। কীভাবে ধান-চাল এখান থেকে ইন্ডিয়ায় পাচার হচ্ছে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। কারা এগুলো করছে তাও আমরা জানি। আমার কাছে বাংলাদেশে আর ভারতে কোনো পার্থক্য নেই। দুটো দেশেই আমাদের কমন এনিমির বিরুদ্ধে লড়তে হবে। জনগণের শত্রু দুটো দেশেই এক।
বড়দা বললেন, তোমার সঙ্গে থেকে যেতে ভারি লোভ হচ্ছে দুলাল। তুমি সঠিক পথেই এগুচ্ছো। আমি কদিন থাকবো তোমার এখানে। তারপর আমাদের এলাকায় ফিরে যাব। তুমি বলছ তোমাদের পার্টি ভেঙে গেছে, নেতারা কেউ বাইরে নেই। আমাদের অবস্থা ঠিক একইরকম। তাতে কি আমরা কাজ থেকে পালিয়ে গিয়ে দূরে বসে-বসে হতাশ হবো?
দুলালদা আর বড়দা তাঁদের কাজের বিষয় নিয়ে বহুক্ষণ আলোচনা করলেন। কমিউনিষ্ট পার্টির কাজ সম্পর্কে আমার কোনো সঠিক ধারণা ছিলো না। তবু মনে হলো আমি যেন বড়দাদের দলেরই একজন। শুধু আমি নই, টেবিলে আমরা যারা বসেছিলাম, তখন আমরা সবাই ভাবছিলাম দেশে একটা পরিবর্তন আসুক, যাতে দেশের কোনো মানুষকে না-খেয়ে মরতে না হয়, আমাদের মতো ছেলেরা সবাই যেন স্কুলে যেতে পারে আর দারুভূইর মতো মানুষদের যেন বুড়ো বয়সে এভাবে কারো চাকরি করতে না হয়।
বড়দা আর দুলালদা মানুষের অবস্থা ভালো করার জন্যেই কাজ করছেন। তাদের জন্যে ছোট্ট সোনিয়া ভাবে, আমাদের বুড়ো দিদাও ভাবেন–আমরা সবাই ভাবি। তাদের জন্যে কিছু করতে পারলেই মনে হয় জীবনটা সার্থক হবে। আমরা হারিয়ে যাওয়া ঠিকানা খুঁজছিলাম। আমি ভাবছি দুলালদা আর বড়দার মতো কি কখনো আমরা এভাবে দেশের অগণিত খেটে-খাওয়া মানুষের ভেতর হারিয়ে যেতে পারবো?
সেদিন থেকে দিদা মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে পুরোনো জামাকাপড় জোগাড় করা শুরু করলেন। বাড়িতে মেজদার স্যুটিং-এর লোকেরা দিদার কাণ্ড-কারখানা দেখে দারুণ অবাক হয়ে গেলো। স্কুলের জন্যে নায়ক আব্বাস, কমেডিয়ান আলতামাস, নায়িকা ঊর্মিলাদি থেকে শুরু করে মেজদার পুঁচকে এ্যাসিস্টেন্টটিও টাকা দিলো। আমরা তিন জন আমাদের স্কলারশিপের পুরো টাকাটাই দিদাকে দিয়ে দিলাম–হারিয়ে যাওয়ার সময় সঙ্গে নেয়ার জন্যে এতদিন ধরে যে টাকা যখের ধনের মতো আগলে রেখেছিলাম। আমাদের মা-কাকিমারা অবশ্য বললেন, দিদা নাকি সব কাজেই বাড়াবাড়ি করেন। আমাদের মনে হলো এতবড় একটা কাজে হাত দিয়েছি আমরা, বাড়াবাড়ি তো হবেই। এটা তো আর কাকিমাদের রুমালে ফুলতোলার মতো সাধারণ কাজ নয়। এ কথাটা দুলালদা আমাদের বলেছিলেন।
একদিনেই দিদা প্রায় তিনশ জামাকাপড় জোগাড় করলেন। দিদা ছোটদের কাপড় বেশি করে চেয়ে নিচ্ছিলেন। রাতে সব কাপড় হাসি খালাদের বাড়িতে জড়ো করা হলো। ঠিক হলো পরদিন সকালেই বড়দা দুলালদা, রামু বিজু, দারুভূই আর আমি যাবো খাসিয়াদের গ্রামে। দারুভূই বলছিলো, ঝড়ে নাকি ওদের ঘরবাড়ি সব ভেঙে গেছে।
ভোরে আমরা ছজন পিঠে কাপড়ের বোঝা নিয়ে খাসিয়াদের গ্রামে গেলাম। পাহাড়ের ওপর মাচার মতো ঘর বেঁধে থাকে ওরা। আমরা গ্রামে যেতেই সবাই দুলালদাকে ঘিরে ধরলো। দারুভূই আর দুলালদা ওদের সঙ্গে কথা বললেন। আমরা কিছুই বুঝলাম না। বড়দা ঘুরে ঘুরে সব দেখছিলেন।
কাপড় পেয়ে ওরা ভারি খুশি। বাচ্চারা খালি গায়ে আগুনের ধারে বসেছিলো। চীনা পুতুলের মতো নিষ্পাপ বাচ্চাদের কষ্ট দেখে আমার প্রায় কান্না এসে গিয়েছিলো। রামু-বিজুর অবস্থাও দেখলাম একইরকম। আমাদের ইচ্ছে হলো দুলালদার মতো ওদের সঙ্গে থেকে যাই। দুলালদা বললেন, ওদের জন্যে খুব কষ্ট হচ্ছে, তাই না আবু? অথচ ওরা জানে না ওরাও আমাদের মতো ভালো থাকতে পারে। ভালো খাবার, ভালো কাপড়–সবই পেতে পারে। এরা কষ্ট করছে বলেই কিছু মানুষ বিলাসিতা করতে পারছে। এরা সংখ্যায় অনেক বেশি, তবু কষ্ট করে, কারণ ওরা জানে না কিছু লোক কীভাবে ওদের বঞ্চিত করছে।
সেদিন আমরা সন্ধ্যে পর্যন্ত খাসিয়াদের গ্রামে ছিলাম। গ্রামের যে ঘরগুলো পড়ে গিয়েছিলো, সেগুলো তোলার কাজে ওদের সাহায্য করলাম। দুলালদা বললেন, ওদের ঘরগুলো তোলা শেষ হলে কাল-পরশু আমরা ইশকুলের জন্য ঘর তুলবো।
ঘর তুলতে গিয়ে সেদিনই একটা গণ্ডগোল হয়ে গেলো। আমাদের গ্রামে আসার আগে কয়েকজন গরিব চাষী মহাজনের কাছে গিয়েছিলো, বনে বাঁশ কাটার অনুমতি নেয়ার জন্যে। মহাজন লামা সিনতেং বলেছে বিনে পয়সায় কাউকে বাঁশ দেবে না। দুলালদা শুনে বললেন, বন কি মহাজনের নাকি! বন তৈরি করেছেন উব্লাউ নাংথাউ অর্থাৎ ঈশ্বর। লামার সিনতেং কি নিজেকে ঈশ্বর মনে করে? একজন বললো, এতদিন বনে কাঠ কাটতে গেলে লামার অনুমতি লাগতো। দুলালদা বললেন, লামা তোমাদের ঠকাতো। ও যে একটা পাজির হদ্দ, এ কথা তো তোমরা সবাই জানো। দেবতার বনকে ও নিজের বন বলতে পারে না। শুনে কয়েকজন বললো, তাইতো, ঈশ্বরের পৃথিবীতে সবাই সমান। ঈশ্বরের বনে কারো অধিকার নেই। আমরা কাঠ কেটে উ ব্লাউ নাংথাউর পুজো দেবো, তাতেই ঈশ্বর খুশি হবেন।
দারুভূই ওদের সবকথা আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছিলো। ঈশ্বরের জয় হোক, বলে সবাই ধারালো কুড়োল আর দা হাতে বাঁশ কাটতে বনে চলে গেল। দুলালদাও ওদের সঙ্গে গেলেন। আমরা ঘর বাঁধার কাজ করছিলাম। দারুভূই অবশ্য আমাদের প্রথম বাধা দিয়েছিল। ওকে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করেছি।
দুলালদারা দুপুরের দিকে বাঁশ কেটে ফিরলেন। দুলালদার সঙ্গীরা দেখলাম দারুণ উত্তেজিত গলায় কী যেন বলাবলি করছে। দুলালদা দারুভূইকে বললেন, মহাজনের লোকেরা বাধা দিতে এসেছিলো। প্রথমে আমরা ওদের শান্তভাবে বুঝিয়েছি। পরে যখন বেশি হম্বিতম্বি করতে শুরু করলো, তখন কয়েকজন দা হাতে করে ওদের দিকে তেড়ে গেলো। ব্যস, তখনি সব কটা চোখের পলকে হাওয়া।
বড়দা হেসে বললেন, শ্ৰেণীসগ্রাম তাহলে শুরু হয়ে গেছে দুলাল।
দুলালদা বললেন, ওদের ভেতর কয়েকটা ছেলে পেয়েছি বড়দা, একেবারে হিরের টুকরো। খুব শিগগিরই ওদের হাতে গোটা এলাকার কাজ ছেড়ে দিতে পারব।
সন্ধ্যে পর্যন্ত প্রায় সব কটা ঘর বানানো শেষ হয়ে গেলো। আমরা কচি ছাগলের ঝলসানো মাংস দিয়ে যবের রুটি খেয়েছিলাম। এদের এখানে ধান, যব, ভূট্টা, সবই হয়। পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ির মতো থাক কেটে ভূট্টা আর যবের চাষ করে। এখনো এদের অর্ধেক ফসল লামা সিনতেং-এর গোলায় দিয়ে আসতে হয়। কারণ এসব জমির মালিক নাকি সে। দুলালদা বললেন, সামনের বার ফসল নিতে লামা বেচারার একটু কষ্ট হবে। এরা বলছে লামাকে ওরা তিনভাগের একভাগ ফসল দেবে, তাও যদি ফসল ভালো হয়।
সূর্য যখন দূরের খাসিয়া পাহাড়ের আড়ালে ডুবে গেলো তখন বড়দা বললেন, রামু, আবু, বিজু–তোমরা এবার দারুভূইকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাও। আমি আর দুলাল এখানে থাকবো। এরা বলছে রাতে লামা সিনতেং গণ্ডগোল করতে পারে।
দারুভূই বললো, গণ্ডগোল আর কি, হয়তো চোরের মতো এসে কারো ঘরে আগুন ধরিয়ে দেবে।
আমি বললাম, হাসি খালা যদি আপনাদের কথা জিজ্ঞেস করেন তাহলে কী বলবো?
দুলালদা বললেন, ওঁকে বলো দুতিনদিন আমাদের এখানে থাকতে হবে। দিদা যদি আরো কিছু কাপড় যোগাড় করেন তাহলে দারুভূইকে নিয়ে তোমরা কাল সকালে চলে এসো। আমি চাই ইশকুল ঘরটা তোমরাই বানাবে।
উত্তরদিক থেকে তখন হু হু করে শীতল বাতাস বইছে। মাঠের মাঝখানে আগুন জ্বালিয়ে গ্রামের সবাই তার চারপাশে বসে গল্প করছে আর মদ খাচ্ছে। বড়দা আর দুলালদাও ওদের সঙ্গে বসে পড়েছেন। ওদের সকলের মুখে আগুনের লাল ছায়া কাঁপছে। দুলালদা বলছিলেন, একটা স্ফুলিঙ্গই দাবানল সৃষ্টি করতে পারে। গ্রামের বারুদের মতো মানুষগুলো যেভাবে উত্তপ্ত হচ্ছে, সারাদেশে দাবানল জ্বলে উঠতে আর বেশি দেরি নেই।
পিয়াইন নদী পার হয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, দূরে পাহাড়ের বুকে একটুকরো স্ফুলিঙ্গ ধিকিধিকি জ্বলছে। মনে মনে ভাবলাম লামা সিনতেংরা কখনো এই আগুন নেভাতে পারবে না।
আমরা তিনজন বাড়ি ফেরার পথে হাসি খালাদের বাসায় গেলাম। দেখি দিদা বসে হাসি খালার সঙ্গে গল্প করছেন। এতদিন আমাদের ধারণা ছিলো দিদা হাসি খালাকে পছন্দ করেন না। অথচ ওঁরা দুজন একটা সোফায় পাশাপাশি বসে অন্তরঙ্গভাবে কথা বলছিলেন। দিদার সঙ্গে হাসি খালার এই অন্তরঙ্গতার যোগসূত্র যে দুলালদা একথা অনুমান করতে এতটুকু কষ্ট হলো না। রামু বলল, হাসি খালা, দুলালদা আর বড়দা দুতিনদিন গ্রামে থাকবেন।
হাসি খালা দিদাকে বললেন, আপনাকে বলিনি, দুলাল আজ ফিরবে না! কুটুকে পেয়ে ও এখন সব কিছু ভুলে যাবে।
বিজু বলল, আজ কি কোনো কাপড় পেয়েছো দিদা?
অনেক! দিদা বললেন, তোরা দুদিনেও নিতে পারবি না।
রামু বললো, তার মানে আমরা কালও গ্রামে যাচ্ছি।
সোনিয়া বললো, মা, কাল আমি আবুদের সঙ্গে যেতে চাই, অবশ্য তোমার যদি আপত্তি না থাকে।
হাসি খালা হেসে বললেন, বেশ তো যেও।
সোনিয়া গভীর কৃতজ্ঞতার চোখে হাসি খালা আর আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। আমি মৃদু হাসলাম। ওর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, সোনিয়া আমি জানতাম, একদিন তুই ঠিকই দুলালদার বন্ধু দীপার মতো আমাদের সঙ্গে মিশে যাবি।
দিদা বললেন, যাই হাসি। অনেক গল্প করলাম। কাল আবার আসবো। তুমি বাছা নিজেকে এভাবে গুটিয়ে রেখো না। তোমার ঘাড়েই সমিতির সব কাজ চাপাবো।
সোনিয়া আমাদের সঙ্গে গেট পর্যন্ত এসে প্রত্যেকের হাতে একটা করে তাজা গোলাপ গুঁজে দিলো। দিদা মিষ্টি হেসে বললেন, পাগল মেয়ে! কাল তোর জন্যে নারকোলের চিঁড়ে আনব।
মেঘ কেটে গিয়ে আকাশে তখন রূপোর মতো চাঁদ উঠেছে। সারা আকাশ চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছে। অল্প অল্প কুয়াশায় আমি, রামু আর বিজু-দিদাকে ঘিরে হাঁটছিলাম। আমাদের সবার মন আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। আমি ভাবছিলাম, আমাদের একরত্তি শহর জাফলং-এ এসে দুলালদা এই তিনদিনে কী অঘটনই না ঘটিয়েছেন। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো কতগুলো নিঃসঙ্গ মানুষের জীবনধারা তিনি উল্টোখাতে বইয়ে দিয়েছেন। হাসি খালা এখন দিদার সঙ্গে পাশাপাশি বসে হেসে গল্প করেন। আমি জানি সোনিয়া এখন আমার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু। আসলে একটি মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা সবাই একই লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি। আমি গর্ব বোধ করলাম শেষ পর্যন্ত বাবাও আমাদের মিছিলের একজন হয়ে গেলেন। বাবাকে এখন মোটেই দূরের কেউ মনে হচ্ছে না। বড়দা আর দুলালদাদের মতো মানুষরা আছেন বলেই অনেক দুঃখ আর যন্ত্রণার ভেতর নতুন ভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখা যায়। স্কুলে যখন রচনা লিখতে হতো, বড় হলে তুমি কী হতে চাও এতদিন কি আবোল-তাবোল কথাই না লিখতাম!
রামু একসময় বললো, মাত্র তিনদিনে কত কিছু ঘটে গেলো।
আমি বললাম, হারিয়ে যাওয়ার ঠিকানা খুঁজে পেয়েছিস রামু?
রামু মৃদু হেসে বললো, আমি চিরদিনের জন্যে হারিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছি আবু। আমি জানি তুইও তাই ভাবছিস।
আমি রামুর কাঁধে হাত রাখলাম। জয়ন্তিয়া পাহাড়ে দুলালদা আর তার বিপ্লবী সঙ্গীদের কথা ভাবলাম। এখন ওঁরা আগুনের চারপাশে বসে পুরোনো সমাজটাকে ভেঙে নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখছেন, আর আগামী দিনের কাজের পরিকল্পনা করছেন। দুলালদা হয়তো দীপার কথা ভাবছেন। সোনিয়া কি এখন আমার কথা ভাবছে?
আমি বুক ভরে সোনিয়ার দেয়া শিশির-ভেজা লাল গোলাপের গন্ধ নিলাম।