০৫. বড়দির বিয়ের প্রস্তাব
চট্টগ্রাম থেকে সাইফের ফেরার কথা ছিলো রাতে। কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় সকালেই ফিরে এসেছে। বাড়িতে আসতেই বাবা বললেন, আর একঘণ্টা আগে এলে সবার সঙ্গে পিকনিকে যেতে পারতি।
সবার সঙ্গে মানে? পিকনিকে যাওয়ার কথা সাইফ কিছু জানতো না।
ও বাড়ির সবাই ফি-বছর পিকনিকে যায়। এবার আমাদেরও নেমন্তন্ন করেছে।
শুনে সাইফের মন খারাপ হলো। ওকে বাদ দিয়ে সবাই পিকনিকে গেছে, এটা ঠিক পছন্দ হচ্ছিলো না ওর।
বাবা বললেন, তোর ছাত্রীর রেজাল্ট শুনেছিস? জাহানারা সেকেন্ড ক্লাস থার্ড হয়েছে।
বাবার কথা শুনে সাইফের চেহারা উজ্জ্বল হলো। জাহানারা পরীক্ষায় ভালো করবে জানতো। এতটা ভালো আশা করে নি।
বাবা আড়াচোখে সাইফকে দেখছিলেন। হাসি চেপে খবরের কাগজের আড়ালে মুখ ঢেকে বললেন, জয়দেবপুর এখান থেকে এমন কিছু দূর নয়। বাসে বড়জোর ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। ট্রেনে আরো কম লাগে।
সাইফ একটু অবাক হয়ে বললো, তুমি কি আমাকে এখন জয়দেবপুর যেতে বলছো বাবা?
বাবা নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিলেন–গেলে ক্ষতি কী! বাড়িতে থাকলে হোটেলে গিয়ে খেতে হবে। তোর মা শুধু দুজনের খাবার রেখে গেছে।
মনে মনে খুশি হলেও সাইফ সেটা প্রকাশ করলো না। বললো, আমি সেলিমদের বাসায় যাচ্ছি। ওর গাড়ি পেলে যাবো। এতক্ষণ ট্রেন জার্নি করে এসেছি। আবার বাসের ধকল পোষাবে না।
সেলিমদের বাড়ি এসে ওকে পেলো না। সাইফের তখন মনে হল বাসে দুঘণ্টার জার্নি–এমন আর কঠিন কী কাজ! গুলিস্তান থেকে উঠে বসলো জয়দেবপুরের বাসে।
সাইফের ভাগ্য ভালো বলতে হবে। বাস ওকে দেড়ঘণ্টায় জয়দেবপুর পৌঁছে দিলো। বাস থেকে নেমে রাজবাড়ির দিকে যেতেই ও জাহানারাকে দেখতে পেলো। পিকনিকের হইচই থেকে বেশ দূরে শালগাছের নিচে হাঁটছে। ছআনির লোকজনদের ভেতর জাহানারাই সাইফের বেশি পরিচিত। তাই সে ওদিকেই গেলো।
জাহানারা সাইফকে দেখে খুব অবাক হলো। বললো, সাইফ ভাই, আপনি?
মৃদু হেসে সাইফ বললো, বাবার কাছে তোমার পাসের খবর পেলাম। ভাবলাম অভিনন্দন জানানোনা দরকার।
লাজুক হেসে জাহানারা বললো, এর জন্য কষ্ট করে এতটা পথ এলেন!
তাছাড়া বাবা আরো একটা কথা বলেছেন। রাতে আসবো বলে মা বাড়িতে আমার খাবার রেখে যান নি। বাবা বললেন, হয় পিকনিকে যেতে হবে, নয় হোটেলে গিয়ে খেতে হবে। তুমি বোধহয় জানো না, হোটেলের খাবার আমি পছন্দ করি না।
জাহানারা বলল, ভালো করেছেন। চলুন ওদিকে যাই।
ওদিকে হইচই বেশি দেখে তুমিই তো এখানে চলে এসেছে। আমাকে আবার ওদিকে নিতে চাইছো কেন? ভূপালী জেঠিমার আজগুবি গপ্পো শোনার জন্য?
জাহানারা হেসে বললো, জেঠিমার শরীর খারাপ, আসেন নি। আপনি ওঁর খবর পেলেন কোথায়?
জানো না বুঝি! তোমাদের বাড়িতে আমার কম করে হলেও গোটা পাঁচেক গুপ্তচর রয়েছে। ওদের কাছে সব খবর পাই।
এরপর সাইফ আর জাহানারা শালবনে বসে ঘণ্টা-দুয়েক অনেক কথা বললো। ছোটদের মতে সেগুলো জরুরি আর প্রাইভেট হলেও আসলে তেমন জরুরি বা প্রাইভেট কিছুই ছিলো না।
শেষ দুপুরে খাওয়ার সময় সাইফকে দেখে সবাই খুব খুশি। ইতু লক্ষ্য করলো বড়দির চেহারায় রাগী ভাবটা একেবারেই নেই। সবার সঙ্গে হেসে কথা বলছে। খেতে বসে ডাক্তারদের নিয়ে মজার মজার গল্প বলে সবাইকে হাসিয়ে মারলো বড়দি।
ফেরার পথে ছোটন ইতুরা সবাই স্বীকার করলো আগে কোনো পিকনিকে এত মজা হয় নি। রিমকি-সিমকিও বললো ওদের নবরায় লেনের বাড়ির পিকনিকে এর সিকিভাগ মজাও হতো না।
পরদিন মীর্জা এহতেশাম এলো দুপুরের ঠিক পরে। বেবি আইসক্রিম থেকে অর্ডার দিয়ে বানিয়েছে চমৎকার ফুলের নকশা-করা লালচেরি বসানো মস্ত বড় দুটো আইসক্রিম কেক। ছোটনরা জীবনেও এত মজার আইসক্রিম খায় নি। আইসক্রিম খেতে খেতে ওরা শুনলো এহতেশাম ভাইয়া ওদের সবাইকে নাজ-এ সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবে। জ্বলে ভার্নের এ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইট্টি ডেজ বইটা ইতুর পড়া ছিলো। সেই বইয়ের ছবি শুনে ভীষণ রোমাঞ্চিত হলো ওরা।
মীর্জা এহতেশাম টিকেট কেটেই এনেছিলো। বড়দি থেকে শুরু করে রন্টু-ঝন্টু পর্যন্ত সব মিলিয়ে দশজন। বড়দা মেজদা বয়সে বড়দির চেয়ে বড় বলে ওরা আঁট দেখিয়ে গেলো না। বড়দা অবশ্য বললো, ছবিটা ওর দেখা। ওরা না যাওয়াতে ছোটন ইতুরা খুশিই হলো। আরো খুশি হতো ছোড়দিটাকে রেখে যেতে পারলে। অসভ্যের মতো ও যে-ভাবে হেসে হেসে এহতেশাম ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলছিলো–মনে হচ্ছিলো ও বড়দি হয়ে গেছে। ওরা খুব ভালো করেই জানে বড়দির পাশের জন্য এহতেশাম ভাইয়া সবাইকে ছবি দেখাচ্ছে। অথচ বেচারাকে ছোড়দি এক মুহূর্তের জন্যেও বড়দির কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না।
তবে বড়দি খুব সেজেছে। এহতেশাম ভাইয়া ওর জন্য গোলাপি রঙের যে জামদানি শাড়িটা এনেছে–ওটাই পরেছে। মেজো জেঠিমা ওর কানে ছোট্ট দুটো সোনার ফুল আর গলায় এক চিলতে হার পরিয়ে দিয়েছেন। তাতেই বড়দিকে পরির মতো লাগছিলো। ছোড়দা ঠাট্টা করে বললো, বড়দি, তোকে নতুন বউয়ের মতো লাগছে। অন্য সময় হলে বড়দি নিশ্চয় একটা কড়া ধমক লাগাতো, অথচ ইতু লক্ষ্য করলো, ছোড়দাকে কিছু না বলে বড়দি শুধু লাজুক হাসলো।
রহস্যটা বোঝা গেলো রাতে। ভূপালী জেঠিমা মাঝপথে ওঁর গল্প বলার আসর ভেঙে দিয়ে বললেন, ছোটরা এবার নিচে গিয়ে খেলা করুক। আমরা বড়রা কিছু জরুরী কথা বলব।
সেদিন রিমকি-সিমকিরা আসে নি। ছোটনরা ভূপালী জেঠিমার ঘর থেকে বেরিয়ে আর নিচে গেলো না। বড়দের জরুরি কথাটা শোনা ওদের জন্যেও জরুরী হয়ে পড়েছিলো। মেজদি, ছোড়দি নিচে চলে যেতেই ওরা আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ভূপালী জেঠিমার দরজায় কান পাতলো। দিদাকে বলতে শুনলো, ছেলে তো খুবই ভালো রাঙাবউ।
ভালো বলে ভালো! পান চিবোতে চিবোতে ভূপালী জেঠিমা বললেন, আমাদের খানদান তো আপনি ভালো করে জানেন চাচিজান। মীর্জা এহতেশাম চাচাজানের এক লওটা বেটা আছে। ব্যবসাপাতি সব ও পাবে। কত দিলদরাজ লাড়কা আপনারাতো দেখেছেন। ওর সঙ্গে বিয়ে হলে জাহানারা বিটিয়া বহুৎ সুখ পাবে।
বড় ফুপি বললেন, জাহানারাকে একবার জিজ্ঞেস করলে ভালো হতো না?
দিদা শক্ত গলায় বললেন, তোমার বিয়ের সময় কি আমরা তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম আকিকুননেসা?
শুকনো গলায় বড় ফুপি বললেন, তখনকার কথা আলাদা! তাছাড়া জানু ডাক্তারি পাশ করেছে। বুদ্ধিসুদ্ধি আছে–।
ওর থাকলেও তোমার বুদ্ধিসুদ্ধি একেবারেই লোপ পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে বাছা। এ-বাড়ির সব বিয়ে মুরুব্বিরা ঠিক করেন।
ভূপালী জেঠিমা বললেন, চাচিজান বেআদবি মাফ করবেন। জাহানারা বিটিয়াকে পুছ করতে ঝামেলা কোথায়? আমার তো মনে হয় ও এহতেশামকে পছন্দ করেন। আজ দেখলেন না সিনিমায় যাওয়ার সময় কীরকম সাজলো!
জিজ্ঞেস করতে হলে মেজো বউ করুক। গম্ভীরমুখে দিদা বললেন, ওকে বলে দিও উত্তরটা যেন–হ্যাঁ হয়।
যা বোঝার বুঝে নিয়ে আসর ভাঙার আগেই কেটে পড়লো ছোটনরা। ইতুর মা নিচে ওদের ভাত বেড়ে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। ঝটপট খাওয়া সেরে ওরা চলে এলো ওদের চিলেকোঠার ঘরে।
মিতু বললো, শিগগিরই আমরা তাহলে একটা বিয়ে খেতে যাচ্ছি।
ছোটন বললো, আমার মনে হয় বড়দি সাইফ ভাইকে পছন্দ করেন।
ইতু মাথা নাড়লো–আমার মনে হয় না। সাইফ ভাই বড়দির টিচার। ওঁর সঙ্গে হেসে দুটো কথা বলা মানে ওঁকে পছন্দ করা নয়। বরং আজ সিনেমায় যাওয়ার আগে ছোড়দা যেভাবে এহতেশাম ভাইয়ার কথা বলে বড়দির সঙ্গে ঠাট্টা করছিল, বড়দি তো কিছুই বললো না।
ঝন্টু বললো, তোর কি মনে হয় বড়দি সত্যি সত্যি এহতেশাম ভাইয়াকে পছন্দ করে?
ইতু মাথা নেড়ে সায় জানালো। ছোটন তবু বললো, বড়দির সঙ্গে সাইফ ভাইর বিয়ে হলে ভালো হত।
ও ভাবছিল রিমকিদের কথা। সাইফ ভাইয়ের সঙ্গে বড়দির বিয়ে হলে রিমকিদের সঙ্গে মেলামেশার জন্য কেউ ওদের বারণ করতে পারবে না। মিতুর পছন্দ মীর্জা এহতেশামকে। বলল, এহতেশাম ভাইয়ারা কী বড়লোক দেখেছিস? আমার তো মনে হয় বড়দির জন্য সাইফ ভাইর চেয়ে এহতেশাম ভাইয়াই বেশি ভালো হবে।
কেন, খাওয়ায় বলে? ফোড়ন কাটলো ইতু।
খেতে একটু বেশি পছন্দ করে মিতু। কিন্তু এ নিয়ে কিছু বলাটা ও মোটেই পছন্দ করে না। ইতুর কথা শুনে বিরক্ত হলো–কেউ কাউকে খাওয়ালে বুঝি দোষ হয়ে যায়?
খাওয়ানোর ভেতর যদি মতলব থাকে, সেটা নিশ্চয় দোষের ব্যাপার!
বড়দির সঙ্গে কার বিয়ে হলে ভালো হয় এ নিয়ে ওদের ভেতর অনেক কথা হলো। দল ভারি মীর্জা এহতেশামের সমর্থকের। সাইফের পক্ষে ছিল ছোটন আর ইতু। শেষে মিতু নিরপেক্ষ হয়ে গেলো। বললো, যার সঙ্গে হোক, বিয়েটা শিগগির হওয়া দরকার।
ছোটন আর ইতু ভেবেছিলো মীর্জা এহতেশামের সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে বড়দি নিশ্চয় আপত্তি করবে। মেজো জেঠিমা যখন এ-ব্যাপারে বড়দির মত জানতে গেল,সুবোধ বালিকার মতো বড়দি বললো, কাকে বিয়ে করবো এ নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। তোমরা যা ভালো মনে করো করবে। আমার ইচ্ছে ইন্টার্নিশিপটা শেষ করে বিয়ে করা।
তার মানে তো আরো দুবছর।
তাতে কী! দুবছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে। আমাকে নিশ্চয় তোমরা বোঝা ভাবছো না?
ছিঃ জানু! তোকে কেন বোঝা ভাবতে যাবো! বড়বু বেঁচে থাকলে–কথা শেষ না করে মেজো জেঠিমা চোখে আঁচল চাপা দিলেন।
বড়দি মেজো জেঠিমার বুকে মাথা রেখে বললো, তোমরা কি কোনো দিন টের পেতে দিয়েছো আমার যে মা নেই!
এ-কথা শুনে ডুকরে কেঁদে উঠলেন মেজো জেঠিমা। আড়িপাতার দল সরে গেলো দরজার আড়াল থেকে।
মীর্জা এহতেশাম যখন শুনলো ওকে বিয়ের ব্যাপারে বড়দির আপত্তি নেই, তখন প্রায় প্রতিদিন আসতে লাগলো ইতুদের বাসায়। প্রথমদিকে বড়দা একটু দূরে সরে থাকছিলো বয়সে বড়দির বড় বলে। কদিন পর লুকিয়ে আলাদা করে বড়দা আর ছোটকাকে ছবি দেখিয়ে এহতেশাম ওদেরও পটিয়ে ফেললো। ছোটরা তো এমন সব উপহার পেতে লাগলো যেগুলো ছিল ওদের স্বপ্নের জগতে। স্ট্যাম্প এ্যালবামের সঙ্গে রাশি রাশি স্ট্যাম্প, কয়েন এ্যালবামের সঙ্গে নানাদেশের কয়েন, কয়েকরকম গেমস, ইতুর জন্য দেব সাহিত্য কুটিরের পূজোবার্ষিকী–সব মিলিয়ে সবাই ধরে নিলো মীর্জা এহতেশামের সঙ্গেই বড়দির বিয়েটা খুব সুখের হবে।
শুধু সাইফ ব্যাপারটা পছন্দ করলো না। ছুটির দিন বাজার করতে গেলে ছোটনের সঙ্গে প্রায়ই ওর দেখা হয়। পরের রোববার বাজারের পথে যেতে যেতে ছোটন বললো, শুনেছেন সাইফ ভাই, বড়দির সঙ্গে এহতেশাম ভাইয়ার বিয়ের কথা চলছে!
এহতেশাম ভাইয়া মানে?
ভূপালী জেঠিমার এক ভাই-এর ছেলে। বিরাট বড়লোক।
যার সঙ্গে তোমরা প্রায় বিকেলে বেড়াতে বেরোও?
হ্যাঁ, দেখেছেন ওকে?
একদিন মোড়ের ডিস্পেন্সারিতে দেখেছিলাম। কী নিয়ে মালিকের সঙ্গে তর্ক করছিলো। কথাবার্তা শুনে তো খুব কালচার্ড মনে হলো না।
কাষ্ঠ হেসে ছোটন বললো, ওদের অনেক বড় বংশ। ভূপালে সবাই জেঠিমাদের পরিবারকে চেনে।
সে তো তোমাদের জেঠিমা বলেছেন। তোমরা নিশ্চয় যাচাই করতে যাও নি?
আমরা যাই নি। ওঁদের বিয়েতে দাদু, জেঠুরা গিয়েছিলেন। ওঁরা বলেছেন বনেদি পীর বংশ জেঠিমাদের।
তোমাদের বড়দির কি মত আছে এ বিয়েতে?
বড়দি আপত্তি করে নি। শুধু বলেছে ইন্টার্নিশিপটা শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে।
বড়লোকের বউদের জন্য ইন্টার্নিশিপটা নিশ্চয় জরুরী নয়।
শুকনো গলায় ছোটন বললো, বড়দির তাই ইচ্ছে।
সাইফ কিছুক্ষণ কোনো কথা বললো না। দুজন চুপচাপ হাঁটতে লাগলো সূত্রাপুরের বাজারের দিকে। একসময় আপন মনে সাইফ বললো, জাহানারা সম্পর্কে আমার ধারণা অন্যরকম ছিলো।
ছোটন একটু ইতস্তত করে জানতে চাইলো–বড়দিকে আপনি কী ভাবতেন?
সাইফ ছোটদের মুখের দিকে তাকালো। ওকে কেমন যেন অপরাধী মনে হচ্ছিল। একটু হেসে ছোটনের কাঁধে হাত রেখে সাইফ বললো, যে মেয়ে এত চমৎকার রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়,জীবনানন্দ দাশ আর বিষ্ণু দের কবিতা পছন্দ করে, ভালো আবৃত্তি করে, সে কেন বিয়ের জন্য একটা হাফ-খোট্টাকে পছন্দ করবে?
কথাটা বলা উচিত হবে কিনা কিছুক্ষণ ভাবলো ছোটন। তারপর বলেই ফেললো–আপনি কিছু মনে করবেন না সাইফ ভাই। সেদিন পিকনিকে আপনাকে আর বড়দিকে ঝোঁপের আড়ালে কথা বলতে দেখেছিলাম। ভেবেছিলাম আপনারা বুঝি একজন আরেকজনকে পছন্দ করেন। এহতেশাম ভাইয়ার সঙ্গে বড়দির বিয়ে হোক এটা ইতুর আর আমার ভালো লাগে নি। আমরা নিজেরা বলাবলি করছিলাম আপনার সঙ্গে বড়দির বিয়ে হলে ভালো হতো। কিন্তু বড়দি যখন বিয়ের কথা শুনে কিছু বললো না, তখন মনে হলো আমরা আপনাদের ভুল বুঝেছিলাম।
ছোটনের কথা শুনে সাইফ অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। বললো, সেদিন আমি জাহানারাকে অভিনন্দন জানাতে গিয়েছিলাম। তাছাড়া বাড়িতে বাবাও বললেন, পিকনিকে যেতে।
ছোটন অভিযোগের গলায় বললো, আমাদের ধারণা যদি ঠিক না হয়, তাহলে বড়দির সঙ্গে হাফখোট্টা না ফুলখোটার বিয়ে হল–এ নিয়ে আপনি কেন ভাবছেন?
ছোটনের কথার কী জবাব দেবে সাইফ ভেবে পেলো না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আস্তে আস্তে বললো, তুমি ঠিকই বলেছো ছোটন। তোমাদের বড়দি কাকে পছন্দ করবে, কাকে বিয়ে করবে–এ নিয়ে আমার কিছু উচিত হয় নি।
ছোটনের মনে হলো সাইফ কিছু একটা বলতে চেয়েও ঠিক বলতে পারছে । কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ও বললো, এহতেশাম ভাইয়া মানুষ হিসেবে খুবই ভালো। কিন্তু বড়দির সঙ্গে তার বিয়ে হবে এটা আমি এখনো মানতে পারছি না। একটু থেমে আবার বললো, আপনার সঙ্গে যদি পরিচয় না থাকত তাহলে হয়তো এ নিয়ে ভাবতাম না।
সামান্য হেসে সাইফ বললো, কথাটা তোমার বড়দিকে বলল, আমাকে কেন বলছো?
বলছি–আপনাকে আমরা সবাই পছন্দ করি বলে।
তোমাদের বড়দি নিশ্চয় করে না।
জানি না। আগে একবার মনে হয়েছিলো করে।
সেটা মীর্জা এহতেশামের সঙ্গে পরিচয়ের আগে।
পিকনিকের দিনও বড়দি আপনার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলেছে।
তেমন কোনো কথা নয় ছোটন–যাতে মনে হতে পারে তোমাদের বড়দি আমাকে পছন্দ করে।
আপনিও কি বড়দিকে পছন্দ করেন না? কেন করবো না? তোমাদের সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম দিনই বলেছিলাম জাহানারা খুব ভালো মেয়ে।
কথা বলতে বলতে বাজার এসে গেলো। বাড়ি ফেরার সময় ছোটন সাইফকে বললো, বড়দির সঙ্গে কথা বলে আপনাকে জানাবো।
.
০৬. হীরের নেকলেস চুরি
ছোটনের কাছে সব কথা শুনে ইতু বললো, এখন আর বলে কী লাভ। এহতেশাম ভাইয়া তো জেনে গেছে বড়দির এ বিয়েতে অমত নেই।
বড়দি দুবছর অপেক্ষা করতে বলেছে, এটা ভুলে যাচ্ছিস কেন? জবাব দিলো ছোটন।
তাহলে কি তুই মনে করিস বড়দিকে সাইফ ভাইয়ের কথা বলা দরকার?
সাইফ ভাইকে আমি কথা দিয়েছি যে!
বড়দিকে একা পাওয়া কঠিন কিছু নয়। বেশির ভাগ সময় বড়দি ওর নিজের ঘরে পড়াশোনা করে সময় কাটায়। ছোটন আর ইতু এসে যখন সাইফের সব কথা খুলে বললো, শুনে অনেকক্ষণ গম্ভীর মুখে চুপচাপ বসে রইল বড়দি। একবার ছোটনদের দিকে তাকালো। ওর মনে হলো এতদিন ওদের যতটা ছোট ভাবতো আসলে ওরা ততটা ছোট নয়। ভালো লাগলো মেজো ও সেজো কাকার ছোট ছেলে দুটো তাকে নিয়ে ভাবছে বলে। বললো, আমি সাইফ ভাইর সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই। কলেজে নয়, বাইরে কোথাও।
নৌকা ভাড়া করে বুড়িগঙ্গার ওপার থেকে ঘুরে এসো না, ভালো লাগবে। এই বলে ছোটন একবার ইতুকে দেখলো। তারপর বললো, আমরা একদিন ঘণ্টা হিসেবে ভাড়া করে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম। দারুণ মজার। মাত্র ছআনা ঘণ্টা।
বড়দি মৃদু হেসে বললো, একটা চিঠি দেবো সাইফ ভাইকে। লুকিয়ে পৌঁছে দিতে পারবি? মিতু, রন্টু, ঝন্টু, রিমকি, সিমকি কেউ জানতে পারবে না।
তুমি ভেবো না বড়দি। ইতু বলল, আমরা ঠিক পৌঁছে দেবো। কাকপক্ষিও টের পাবে না।
বড়দি অল্পকথায় ছোট্ট একটা চিঠি লিখে খামে পুরে মুখ বন্ধ করে ইতুর হাতে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে ওটা প্যান্টের পকেটে লুকিয়ে ফেললো ইতু। তারপর ওরা দুজন ভালো মানুষের মতো মুখ করে বড়দির ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
ছোটন চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলো, এখনই যাবি?
ইতু মাথা নেড়ে সায় জানালো–তুই ওপরে যা। দুজনকে একসঙ্গে বেরোতে দেখলে মিতু রন্টুরাও আসতে চাইবে। বলিস, সাইফ ভাইর কাছ থেকে আমি গল্পের বই আনতে যাচ্ছি।
ছোটন মুখ টিপে হেসে চিলেকোঠার ঘরে চলে গেলো। ভেজা বেড়ালের মতো ইতুও ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো, কেউ লক্ষ্য করলো না।
চিঠি পড়ে সাইফ বললো, জাহানারা আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে।
ইতু বললো, জানি। আমি আর ছোটন বলেছি নৌকা ভাড়া করে বুড়িগঙ্গা থেকে বেড়িয়ে আসতে। মিলব্যারাক ঘাট থেকেই ভালো নৌকা পাবেন।
ভালো বুদ্ধি বের করেছো তো! তোমাকে একটা উপহার দেয়া উচিত। এই বলে সাইফ ওর বইয়ের আলমারির ভেতর থেকে নতুন একখানা পথের পাঁচালী বের করে ইতুকে দিলো–এ বই পড়েছো?
নাম শুনেছি, পড়ি নি। এটা কি বড়দের বই?
আমি ক্লাস সিক্সে থাকতে প্রথম পড়েছি। এখনো পড়ি। বলতে পারো সব বয়সের বই।
ইতু ক্লাস এইটে পড়ে। ভয় ওর ছোড়দিকে নিয়ে। একদিন নীহাররঞ্জনের উল্কা পড়তে দেখেছিলো ছোড়দি। বড়দাকে বলে বকুনি খাওয়ালো–ও নাকি আজে বাজে নভেল পড়া শুরু করেছে। বড়দাকে বলার অবশ্য কারণও ছিলো। ওর আগে ছোড়দি নিজে পড়তে চেয়েছিলো,–দেয় নি বলে যত রাগ! রঙচঙে মলাট দেখে একবার স্কুলের লাইব্রেরি থেকে এনেছিলো সঞ্জীবচন্দ্রের কণ্ঠহার বইটা। লাইব্রেরিয়ান টিচার গম্ভীরমুখে বলেছিলেন–কার বই নিচ্ছ জানো তো! ইতু মাথা নাড়তে তিনি বললেন, বঙ্কিমচন্দ্রের ভাই হচ্ছেন সঞ্জীবচন্দ্র। লাইব্রেরিয়ান কিছু বললেন না, অথচ ছোড়দি দেখেই–এ মা, এসব অসভ্য নভেল পড়িস তুই! বলে বইটা ওর হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেলো। ও চেঁচামেচি করতে পারতো, বড়দার বকুনির ভয়ে কিছু বললো না। শুধু লুকিয়ে ছোড়দির হোমওয়ার্ক-করা খাতার দুপাতার মাঝখানটায় চিবোনো চুইংগাম সেঁটে দিয়েছিলো।
পথের পাঁচালী দেখে ছোড়দি আবার কী কাণ্ড বাঁধায়, এই ভেবে ওটাকে জামার ভেতর খুঁজে বাড়ি এলো ইতু। বাইরের বসার ঘর পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে যাবে একেবারে বড় জেঠুর মুখোমুখি। চোরের মতো ওকে ঘরে ঢুকতে দেখে বললেন, তোর পেটটা অমন ফুলে আছে কেন, ফেঁপেছে নাকি?
শুকনো গলায় ইতু বললো, না জেঠুমণি।
তবে?
ও কিছু নয় এমনি। বলে জেঠুর সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচলো ইতু।
চিলেকোঠার ঘরে রিমকি-সিমকিরাও ছিলো। রিমকি, ছোটন, মিতু আর ঝন্টু লুডু খেলছিলো। সিমকি আর রন্টু খাতা নিয়ে বসে খেলছিলো কাটাকুটি।
রিমকিকে দেখে সাইফ ভাই আর বড়দির কথাটা বলার জন্য ইতুর বুকের ভেতরটা আঁকুপাঁকু করছিলো। এসব ক্ষেত্রে কথা না বলে থাকতে পারাটা দারুণ কঠিন ব্যাপার। ইতু ভাবলো বড়দি বিশ্বাস করে ওকে একটা কাজ দিয়েছে। বড়দির বিশ্বাসের দাম ওকে আর ছোটনকে দিতেই হবে। খাটে উঠে বালিশ টেনে আধশোয়া হয়ে ইতু পথের পাঁচালী পড়তে বসলো।
বিকেলে ওকে একা পেয়ে ছোটন বললো, দিয়েছিলি ঠিকমতো? ইতু মাথা নেড়ে সায় জানালো। ছোটন আবার বললো, বড়দিকে আমি জিজ্ঞেস করছিলাম। নাকি কাল যাবে।
আমি ভাবছি বড়দি যদি মত পাল্টায়, এহতেশাম ভাইয়ার কী অবস্থা হবে!
তোর কি মনে হচ্ছে বড়দি মত পাল্টাবে?
তাই তো হওয়া উচিত। সাইফ ভাইর সঙ্গে এহতেশাম ভাইয়ার কোনো তুলনাই হতে পারে না।
পরদিন বিকেলে বড়দি বান্ধবীর বাড়িতে যাবার নাম করে বেরিয়ে গেলো। ইতু আর ছোটন খেলা ফেলে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিলো বড়দির ফেরার জন্য। রিমকিরা লুডু খেলতে বসে দুবার ডেকেছিলো ছোটনকে। মাথা ব্যথার কথা বলে ও এড়িয়ে গেলো। ইতু বসেছিলো পথের পাঁচালী নিয়ে। কয়েক পাতা পড়ে একবার নিয়ে যায়, আবার ছাদে আসে–এই করে বিকেল কাটালো।
সন্ধে নাগাদ ছোটন আর ইতু বড়দিকে ঢুকতে দেখলো সিং দরজা দিয়ে। কাউকে কিছু না বলে দুজন চুপিচুপি বড়দির ঘরে এলো। ওদের দেখে বড়দি ম্লান হাসলো। ছোটন বললো, তুমি কী ঠিক করলে বড়দি?
বড়দি শুকনো গলায় বললো, সবাইকে একবার মত জানিয়ে দিয়েছি। এখন অন্য কথা বললে রাঙা জেঠিমার কাছে কারো মুখ দেখাবার জো থাকবে না।
সাইফ ভাই কী বললেন?
বললেন, আমি যা ভালো মনে করি তাই করতে।
ইতু ভেজা গলায় বললো, কী হয় বড়দি, এখন যদি মত পাল্টাও! আমরা সবাই দিদাকে বলবো।
না রে, তা আর হয় না। এ-বাড়িতে আমিই প্রথম মেয়ে, বিয়ের ব্যাপারে যার মত জানতে চাওয়া হয়েছে। একবার বলেছি এহতেশামকে বিয়ে করতে আমার আপত্তি নেই। আবার বলবো আরেকজনকে বিয়ে করতে চাই–বাবা শুনলে ভারি কষ্ট পাবেন।
বড়দির কথা শুনে ইতু আর ছোটন কষ্ট পেলো। কাছে এসে দুজনের কাঁধে হাত রেখে বড়দি বললো, এসব কথা ভুলে যা। কোনোদিন ঘুণাক্ষরেও কেউ যেন জানতে না পারে। মনে থাকবে তো লক্ষ্মী ভাই?
ওরা বুঝতে পারছিলো এসব কথা বলতে বড়দির খুব কষ্ট হচ্ছে। ইতু জানে ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেই বড়দি দরজায় খিল দিয়ে কাঁদতে বসবে। ওদেরও খুব কান্না পাচ্ছিলো। বড়দির কথায় সায় জানিয়ে ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
তখনো চিলেকোঠার ঘরে রিমকি-সিমকিরা মিতুদের সঙ্গে লুডু খেলছিলো। আজ ওদের নানিও এসেছেন। ভূপালী জেঠিমার সঙ্গে জমিয়ে গল্প করছেন। ইতু আর ছোটন বাইরে রোয়াকের ওপর গিয়ে বসে রইলো চুপচাপ।
কিছুক্ষণ পর ছোটন বিরক্ত হয়ে বললো, ধ্যাৎ! কিছুই ভালো লাগছে না।
ইতু বললো, ভূপালী জেঠিমা না এলেই বরং ভালো ছিলো।
ছোটন একটু পরে বললো, ভূপালী জেঠিমা না এলে ও-বাড়ির সঙ্গে মেলামেশা যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো–ভুলে গেছিস বুঝি।
আসল কালপ্রিট হচ্ছেন সেজকা। পিকনিকের গাড়ি ঠিকমতো জোগাড় হলে এহতেশাম ভাইয়া চান্স নিতে পারতো না।
আসতে চাইলে অনেক ছুতো করে আসা যায়।
ইতু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, এহতেশাম ভাইয়ারই বা কী দোষ! বড়দি মানা করলেই সব চুকে যেতো।
ছোটন সায় জানালো, সাইফ ভাই ওকে যতটা খারাপ ভাবছেন এহতেশাম ভাইয়া কি ততটা খারাপ! ভালো বাংলা না জানলে কী হবে, ওর মনটা তো খুব বড়। যারা ভালো বাংলা জানে না, রবীন্দ্রসঙ্গীত তেমন শোনে নি, তাদের ভেতর কি ভালো মানুষ নেই?
ঠিক তখনই লম্বা সাদা ফোর্ড গাড়ি নিয়ে এহতেশাম ভাইয়া এসে ঢুকলো। গাড়ি থেকে নামলো দুটো মস্ত বড় আইসক্রিম কেক-এর বাক্স নিয়ে। কাছে এসে হেসে বললো, বহুৎ পেরেশান মালুম হচ্ছে। কোনো ঝুটঝামেলা হয় নি তো!
না এহতেশাম ভাইয়া। ইতু বললো, ভেতরে যান, বড়দি ঘরেই আছে।
কাল আমরা সবাই বাগদাদ কা চোর দেখবো। মনে আছে তো তোমাদের?
ছোটন আর ইতু সামান্য হেসে মাথা নেড়ে সায় জানালো। তারপর মীর্জা এহতেশামের হাত থেকে আইসক্রিমের বাক্স নিয়ে সবাই দোতালায় গেলো।
এহতেশাম ভাইয়া এসেছে শুনে চিলেকোঠা থেকে মিতু, রন্টু, ঝন্টু আর রিমকি-সিমকিও নেমে এলো। ছোড়দি রোজকার মতো ফাজলামো শুরু করলো। বড়দাও নিচে নিজের ঘরে যেতে যেতে বললো, যাওয়ার সময় দেখা করে যেও।
এহতেশাম মিষ্টি করে হেসে সায় জানালো। ইতুরা লক্ষ্য করেছে এহতেশাম ভাইয়া যখন আসে তখনই বাড়ির সবাই উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। প্রত্যেকবার পান খাওয়ার জন্য দুটাকা বখশিস পেয়ে দুখির মারও আহ্লাদের সীমা নেই। রাতে দিদা জোর করে মীর্জা এহতেশামকে খাইয়ে দিলেন।
এহতেশাম চলে যাওয়ার পর বড়রা দিদার ঘরে আলোচনায় বসলো। বিয়ের ব্যাপারে নাকি ও দেরি করতে চাইছে না। বলেছে বিয়ের পর জাহানারা ইন্টার্নিশিপ করুক কিংবা বিলেতে গিয়ে আরো ডিগ্রি আনুক, ও কোনো কিছুতেই আপত্তি করবে না। একমাত্র ছেলের বউ দেখার জন্য ওর আব্বা নাকি অস্থির হয়ে পড়েছেন। দিদা বললেন, এ-মাসের শেষে একটা ভালো তারিখ আছে। এহতেশাম বলে গেছে সেদিন হলে ভালো হয়। ওর ইচ্ছে রাঙাবউ থাকতে থাকতে বিয়েটা হয়ে যাক।
ভূপালী জেঠিমা এ আসরে ছিলেন না। বড় জেঠু বললেন, এহতেশামকে বিয়ে করতে জানুর যখন আপত্তি নেই তখন এ মাসের শেষে হতেই পারে। দিন-কুড়ি সময় হাতে আছে। জানুর মার গয়না তো কম নেই। পুরোনো দুএক সেট ভেঙে নতুন করে গড়ে নিলেই হবে।
দিদা বললেন, আমাদের হীরের নেকলেসটাও তো জানু পাবে।
ইতুদের বাড়ির এই এক রেয়াজ। ওদের বংশের এক আদিপুরুষ মোঘল দরবারে কাজ করতেন। নাকি সম্রাট শাহজাহান একটা হীরের নেকলেস দিয়েছিলেন তাঁকে। সেই থেকে বংশে যার প্রথম বিয়ে হয় নেকলেসটা সে পায়। দিদার কাছ থেকে পেয়েছিলেন বড় জেঠিমা। তাঁর একমাত্র মেয়ে জাহানারা। স্বাভাবিকভাবেই নেকলেসটা তার ভাগ্যে রয়েছে। বড় ফুপি দিদার কথা শুনে ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এই প্রথম হীরের নেকলেস আমাদের বংশের বাইরে চলে যাচ্ছে!
ছাগলের মতো কথা বোলো না আকিকুন নেসা। ছেলে হলে বংশ, মেয়ে হলে বংশ নয়–এসব আদ্যিকেলে কথা আমাকে বলতে এসো না। বংশ না হলে তুমিই বা কেন জামাইর বাড়ি ফেলে এ-বাড়িতে থাকো? ভালো করেই জানেনা আমার কাছে ছেলেমেয়ে সব সমান।
দিদার ধমক খেয়ে চুপসে গেলেন বড় ফুপি। মেজো জেঠু বললেন, সময় যখন বেশি নেই, কাজগুলো ভাগাভাগি করে নিলে ভালো হয়।
খাতা কলম নিয়ে বসো। আগে আত্মীয়-স্বজনদের লিস্টি করো।
ছোটকা উঠে কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে বসলো। বিরাট লিস্টি। রন্টু আর ঝন্টুর ঘুম পাচ্ছিলো। ইতুর মনে হলো এ-বৈঠক কয়েক ঘণ্টা চলবে। অন্যদের ইশারায় বললো ওপরে যেতে। সবাই ঘরে এসে লেপের তলায় ঢুকলো।
ঘরটা চিলেকোঠা হলে কী হবে, এমনিতে বেশ বড়। একটা বড় আর একটা মাঝারি খাট ফেলার পরও অনেক জায়গা রয়েছে। একদিকের দেয়াল ঘেঁষে ওদের পড়ার জায়গা। কাঠের একটা বড় বাক্স আছে–ওপরে এটা-সেটা রাখা যায়, ভেতরে ওদের যাবতীয় সম্পত্তি। পুরানো আমলের জিনিস, খুলতে দু-তিনজন লাগে।
মাঝারি খাটে শোয় ইতু আর ছোটন, বাকি তিনজন বড় খাটে। পৌষ মাস এখনো শুরু হয়নি, এরই ভেতর শীত নেমে গেছে। মিতু লেপের তলা থেকে কচ্ছপের মতো মাথা বের করে বললো, বড়দির বিয়েতে দারুণ মজা হবে। এহতেশাম ভাইয়ার কাছ থেকে বাজি পোড়ানোর পয়সা নিতে ভুলিস না।
রাতে ঘুমের ভেতর ওরা সবাই বড়দির বিয়ে নিয়ে বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখলো। মজার স্বপ্ন দেখছিলো ছোটন–এহতেশাম ভাইয়া এসেছে হাতির পিঠে চেপে। সাইফ ভাই কোত্থেকে এসে চামরের মতো বড় একটা পালক দিয়ে হাতির পায়ের তলায় সুড়সুড়ি দিলো। হ্যাঁক হ্যাঁক করে হেসে উঠল হাতিটা। সামনের দুপা তুলে একপাক নাচলো। সেই সঙ্গে এহতেশাম ভাইয়া ধপাস করে নিচে পড়ে গিয়ে–পাগড়ি কাহাঁ, পাগড়ি কাহাঁ বলে চেঁচাতে লাগলো। ভূপালী জেঠিমা চেঁচাচ্ছেন–সেহনাই বাজাও মেঠাও লাও বলে। স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমের ভেতরই শব্দ করে হাসলো ছোটন।
পরদিন সকাল না হতেই দিদা সবাইকে কাজ গছালেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বড়দের কাউকে একদণ্ড বসতে দিলেন না। তবে বিকেলে ছোটরা সবাই হইচই করে এহতেশামের সঙ্গে মায়া সিনেমায় গিয়ে বাগদাদ কা চোর দেখে এলো। রাতে খাবারের পর কাজের ভয়ে বড় আর মেজো জেঠু পালিয়েছিলেন ইতুদের চিলেকোঠায়। সিগারেট টানতে টানতে বড় জেঠু বললেন, নিচে গিয়ে কেউ পাহারা দে। মা যেন টের না পান আমরা এখানে।
ষাটের কাছে বয়স হলো বড় জেঠুর। এখনো দিদার সামনে সিগারেট খান না। বেশি ইচ্ছে করলে ছাদে এসে নয়তো রাস্তায় গিয়ে মোড়ের চায়ের দোকানে বসে কয়েক টান মেরে আসেন।
সিঁড়ির গোড়ায় বসে পাহারা দিচ্ছিলো ইতু। হঠাৎ লক্ষ্য করল দিদা তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে না দেখে নিচে চলে গেলেন। একটু পরে ব্যস্ত পায়ে আবার উঠে এলেন দোতালায়। ইতুকে দেখে চাপা উত্তেজিত গলায় বললেন, তোর জেঠুরা কোথায় দেখেছিস?
ছাদে বসে কথা বলছে। ইতু বললো ডেকে দেব?
শিগগির আমার ঘরে আসতে বল্। এই বলে দিদা নিজের ঘরে ঢুকলেন।
ইতু দৌড়ে এসে বড় আর মেজো জেঠুকে বললো, তোমাদের দুজনকে এক্ষুণি দিদা ওঁর ঘরে যেতে বলেছেন।
কেন, কিছু বলেন নি? শুকনো গলায় জানতে চাইলেন জেঠু। যেন দিদা ওঁর সিগারেট খাওয়ার কথা জেনে গেছেন।
ইতু বললো, জানি না কেন! দিদাকে খুব পেরেশান মনে হলো।
দুই ভাইয়ের হাতে সিগারেট–আধখানাও শেষ হয় নি, নিভিয়ে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে বড় জেঠু নেমে যাওয়ার পর ইতুরাও পা টিপে নিচে নামলো। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলো, ঘরের ভেতর মা, কাকি, জেঠি, ফুপি, বাবা, কাকা, জ্যাঠারা সবাই রয়েছেন। ভূপালী জেঠিমার শরীর ভালো নয় বলে তিনি সবার আগে খেয়ে ঘুমিয়ে গেছেন। দিদা বড় জেঠু আর বড় ফুপির নাম ধরে বললেন, শোন সদরুদ্দিন, আকিকুননেসা আর সবাই। বাড়িতে একটা ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।
দিদার কথার ধরনে সবার মুখ শুকিয়ে গেলো। বড় জেঠু মিনমিনে গলায় জানতে চাইলেন–কী হয়েছে মা?
আমাদের হীরের নেকলেসটা পাওয়া যাচ্ছে না।
সে কী মা! আঁতকে উঠলেন বড় ফুপি-কোথায় ছিল ওটা?
ছিল জায়গামতোই। আমার আলমারির গয়নার বাক্সে। অন্যসব গয়না ঠিক আছে, শুধু হীরের নেকলেসটা নেই।
চাবি কার কাছে ছিল মা?
ইতুর বাবার কথায় বিরক্ত হলেন দিদা–নেকু নেকু কথা বোলো না কামরুদ্দিন। আমার আলমারির চাবি যে সবসময় আমার আঁচলে বাঁধা থাকে, এটা তোমাদের কারো অজানা থাকার কথা নয়।
টের পেলেন কখন ওটা যে নেই? প্রশ্ন করলেন বড় ফুপি।
একটু আগে। জাহানারার বিয়েতে ওর মার কখানা গয়না দেবো স্যাকরাকে নতুন করে গড়ে দেবার জন্য–বাক্স খুলে দেখি ওটা নেই।
শেষ কবে দেখেছিলে হীরের নেকলেসটা? জানতে চাইলেন বড় জেঠু।
দিন দশেক আগেও দেখেছিলাম, পষ্ট মনে আছে। রাঙাবউ ওর জড়োয়া সেটটা তুলে রাখতে দিলো, বাক্স খুলে ওগুলো রাখলাম। তখনো ওটা বাক্সে ছিলো।
এর মধ্যে চাবিটা একবারও হাতছাড়া করেন নি মা?
মেজ ফুপির কথায় আবার বিরক্ত হলেন দিদা–চাবিটা যে আমি কখনো হাতছাড়া করি না এটা তোমার জানা নেই বলতে চাও জরিফুন নেসা?
ছোটবেলার এমন এক ঘটনার ইঙ্গিত দিলেন দিদা–মেজো ফুপির মুখটা শুকিয়ে গেলো, যদিও অন্যরা কিছুই টের পেলো না। মেজো ফুপির শুকনো মুখ দেখে দিদার মায়া হল। গলাটা একটু নরম করে বললেন, ঘুমানোর সময়ও চাবি আমার আঁচলে বাঁধা থাকে।
কে নিতে পারে হীরের নেকলেস? আপন মনে প্রশ্ন করলেন মেজো জেই।
তুমি কি কাউকে সন্দেহ করো মা? জানতে চাইলেন বড় জেঠু।
কাকে সন্দেহ করবো? বলে দিদা বড় ফুপির দিকে তাকালেন–কারো কারো এটা পছন্দ নয় যে, এ-বংশের নেকলেসটা জাহানারার কাছে যাক।
বড় ফুপি শুকনো গলায় বললেন, সেদিন আমি কথাটা বলেছিলাম বংশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। আব্ব সবসময় বলতেন, এ-নেকলেসটার জন্যই আমাদের বংশের কাউকে বড় রকমের কোনো বিপদে পড়তে হয় নি।
বড় ফুপির চোখে চোখ রেখে দিদা খরখরে গলায় বললেন, বংশের মঙ্গলের কথা ভেবে তোমরা কেউ যদি নেকলেসটা লুকিয়ে রাখো এই বেলা বের করে দাও। আমার মন বলছে ওটা জাহানারাকে না দিলেই বংশের অমঙ্গল হবে।
ছি ছি, এসব আপনি কী বলছেন মা? বিব্রত গলায় বললেন বড় ফুপি–আমরা কেন নেকলেস লুকোতে যাবো? জানু কি আমাদের মেয়ে নয়?
দিদার কথায় দুঃখ পেয়ে চোখে আঁচল দিলেন বড় ফুপি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিদা বললেন, যেভাবে হোক নেকলেসটা খুঁজে বের করতেই হবে।
পুলিসে খবর দিলে হয় না? ভয়ে ভয়ে কথাটা বললেন মেজ জেঠু।
পুলিস কবে চোরাই মাল উদ্ধার করেছে আমার জানা নেই বাপু। দিদা শান্ত গলায় বললেন, নিজেরা ভালো করে খুঁজে দেখো। নিতান্তই যদি না পাওয়া যায়, পুলিসকে বলতে হবে বৈকি। তবে এও বলি, পুলিস এসে বাড়ির লোকজনদের উল্টোপাল্টা জেরা করবে–সে বড় লজ্জার কথা।
মেজ জেঠু বললেন, সত্যি সত্যি যদি ওটা চুরি হয়, জানুর বিয়ের আগে পুলিস খুঁজে বের করতে পারবে বলে তো মনে হয় না।
দরকার হলে জাহানারার বিয়ের তারিখ একবছর পিছিয়ে দেবো। হীরের নেকলেস ছাড়া জাহানারার বিয়ে হবে না।
বিয়ের তারিখ পেছানোর দরকার কি মা? বড় জেঠু বললেন, এত ভালো একটা ছেলে পাওয়া গেছে ওরকম না হলেও জানুকে আমি হীরের একটা নেকলেস কিনে দিতে পারবো।
না সদরুদ্দিন, আমি ওটাই চাই। কীভাবে খুঁজে বের করবে তোমরা জানো। আমার শেষ কথা হলো, জাহানারা ওই নেকলেস পরেই বিয়ে করবে।
কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন দিদা। বাইরে ছোটরা যারা দরজার আড়াল থেকে ঘরের ভেতরের দমবন্ধ করা নাটকের সংলাপ শুনছিল, তারা সবাই পা টিপে গুটিগুটি চলে গেলো তাদের চিলেকোঠার ঘরে।