১-২. নেলী খালার জলপাই-সবুজ চিঠি

নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড় – কিশোর উপন্যাস – শাহরিয়ার কবির

নেলী খালার জলপাই-সবুজ চিঠি

সূর্যটা এখন ঠিক মাথার ওপরে। আমাদের রূপলাল লেনের পুরোনো বাড়িটার বিশাল ছাদের কোথাও একরত্তি ছায়া নেই। গোটা ছাদ জুড়ে ঝাঁ-ঝাঁ রোদ। পাশের বাড়ির চৌধুরীদের কামরাঙ্গা গাছের ডালে কয়েকটা পাতিকাক মাঝে মাঝে অলস গলায় ডাকছে। খুব একটা বাতাসও নেই। গোটা আকাশটা জুন মাসের গনগনে রোদে ঝলসে যাচ্ছে।

বাবু আর আমি চিলেকোঠায় বসেছিলাম। আট দিন আগে বাবু আমেরিকা থেকে এসেছে। ওখানে মিসৌরীর এক স্কুলে পড়ে। ওর বাবা, অর্থাৎ আমার মেজকাকা ওয়াশিংটনে আমাদের এ্যাম্বেসিতে কাজ করেন। বলতে গেলে আমি এক রকম জোর করেই বাবাকে দিয়ে মেজকাকাকে চিঠি লিখিয়ে বাবুকে এনেছি। নইলে গরমের লম্বা ছুটিটা একা আমার কী করে যে কাটতো ভেবে পাই না।

আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। কদিন আগে আমাদের হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। আগের মতো আমি ফার্স্ট হয়েছি। স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে আমার মিশতে ইচ্ছে করে না। ক্লাসে ফাস্ট হই বলে সবাই আমাকে হিংসে করে। আড়ালে বলে, আমার নাকি দেমাগে মাটিতে পা পড়ে না। আমি তো কাউকে ফার্স্ট হতে বারণ করি নি। রকিবুল ফি বছর ওদের বাড়িতে স্যারদের নেমন্তন্ন করে খাওয়ায়। ওর বাবা মস্ত বড়ো ব্যবসায়ী। প্রায়ই বিদেশে ঘোরেন। আর রকিবুল স্যারদের কলম, রুমাল এসব প্রেজেন্ট করে। ওর বাবা নাকি সিঙ্গাপুর না হংকং থেকে ওসব আনেন। তবু রকিবুল সেকেন্ডের ওপরে উঠতে পারে নি। সারা ক্লাসে ও আমার নামে বাজে কথা বলে বেড়ায়। ক্লাসের ছেলেরাও ওর নামে অজ্ঞান। তাই বাবু ছাড়া আমার আর কোনো বন্ধু নেই।

দুবছর আগে বাবু আমেরিকা গিয়েছিলো। তখন ও দেখতে ছিলো অসম্ভব ফর্সা আর রোগা। এখন ও আগের চেয়ে অনেক লম্বা শরীরটাও ভালো হয়ে গেছে। ফর্সা রঙটা এখন আর ফ্যাকাশে মনে হয় না। নীল জিনসের ট্রাউজার আর সেইন্ট-এর ছাপঅলা গেঞ্জি পরা বাবুকে আমেরিকান ছবির কাউবয়দের মতো মনে হয়। তবে এখনো আমার সঙ্গে পাঞ্জায় হেরে যায়।

গত আট দিন আমরা সারা দিন সারা রাত শুধু কথা বলেছি। আমাদের যতো কথা ছিলো, এ কদিনে সব বলা হয়ে গেছে। বাবু এখন চিলেকোঠার খাটে বসে এ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরী ফিন পড়ছে। আর আমি বাবার পুরোনো ইজি চেয়ারে শুয়ে ভাবছিলাম হাক ফিনের জীবনটা কী মজা করেই না কেটেছে! ওর মতো যদি বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে পারতাম, তাহলে বেশ হতো। একটা ছোট্ট নৌকা নিয়ে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যেতাম। আর এমন একটা নির্জন দ্বীপ আবিষ্কার করে ফেলতাম, যেখানে মড়ার খুলি আঁকা গাছের নিচে আগেকার দিনের হার্মাদদের লুকিয়ে রাখা দারুণ সব গুপ্তধন রয়েছে। কিন্তু একা কী করে যাই! হাক ফিন একা এ্যাডভেঞ্চার করে নি। ওর সঙ্গে নিগ্রো চাকরটা ছিলো। আমার সঙ্গে বাবু থাকলে বেশ হতো। বাবুকে এ কথা বললে ও এক্ষুনি হেসে খুন হবে, আর রাতে খাবার টেবিলে বাবা-মাকে বলে দেবে। তবে হাক ফিনের বইটা যে বাবুর ভালো লাগছে, সেটা আমি ঠিক টের পেয়েছি। মাঝে মাঝে ও মুখ টিপে হাসছে আর আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে।

গত মাসে ভাইয়ার একখানা চিঠি পেয়েছিলাম। কোত্থেকে লিখেছে বুঝতে পারি নি। চিঠিতে ভাইয়া কখনো নিজের ঠিকানা লেখে না। এর আগে ভাইয়ার আরো দুটো চিঠি পেয়েছিলাম আমি। একটা চিঠির খামের উপর পোস্ট অফিসের সিল পড়তে পেরেছিলাম আমি। বাংলাদেশে রাঙ্গাপানি নামে যে কোনো জায়গা

আছে আমি জানতাম না। সার্ভের প্রকাণ্ড ম্যাপ খুঁজে বের করেছি। চট্টগ্রামের পাহাড়ের ভেতর একটা থানার নাম হচ্ছে রাঙ্গাপানি। চা বাগান আছে সেখানে। ভাইয়া চা বাগানে কী করছে বুঝি না। বাবাকে আমি জিজ্ঞেস করতে পারি নি। ভাইয়া তিন বারই চিঠিতে বারণ করেছে, বাবাকে যেন চিঠির কথা না বলি। প্রথম চিঠিটা শুধু মাকে দেখিয়েছিলাম। ভাইয়াকে আমার দারুণ রহস্যময় মনে হয়।

ভাইয়ার শেষ চিঠিটা আমি বাবুকে দেখিয়েছি । বাবুকে চিঠি দেখাতে তো আর বারণ করে নি ভাইয়া। শুধু বলেছে গোপন রাখতে। আমি জানি বাবু গোপন রাখবে। কারণ আমার মতো বাবুরও কোনো বন্ধু নেই। ওর সব কথা আমাকেই শুনতে হয়। বাবু চিঠি পড়ে গম্ভীর হয়ে বলেছিলো, অপুদা বিপ্লবীদের দলে ঢুকেছে। আমার কাছে ভাইয়া তখন আরো রহস্যময় হয়ে গেলো। আমি ভেবেছিলাম ভাইয়া বুঝি রবিনহুডের মতো একটা কিছু করছে। বাবুকে প্রশ্ন করেছিলাম, তুমি কী করে বুঝলে? বাবু আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করেছে, অপুদা তোমাকে যে বইগুলো পড়ার কথা বলেছে, পড়েছো? ভাইয়া আমাকে বলেছিলো, ওর আলমারির নিচের তাকে যে বইগুলো আছে গরমের ছুটিতে যেন সেগুলো পড়ি। আমি শুধু যে গল্পের শেষ নেই, আর ইস্পাত পড়েছি। আরেকটা শুরু করেছিলাম, কিছুই বুঝি নি। তাছাড়া চুপচাপ বসে পরীক্ষার পড়ার মতো প্রবন্ধের বই আমি বেশিক্ষণ পড়তে পারি না।

বাবু আমাকে বিপ্লবীদের অনেক কথা বলেছে। ও নাকি সিনেমায় দেখেছে বলিভিয়া, গুয়াটেমালা আর মেক্সিকোর বিপ্লবীরা কীভাবে কাজ করে। আমার একবার ইচ্ছে হয়েছিলো বাবুকে বলি–চলো, আমরাও বিপ্লবীদের দলে যোগ দিই। বাবু যদি মাকে বলে দেয়, সেই ভয়ে বলি নি।

প্রায় তিন বছর হতে চললো, ভাইয়া বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। বাবা তখন এমন গম্ভীর থাকতেন যে, ভয়ে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারতাম না। মা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতেন। একদিন মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ভাইয়ার কথা। মা কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, তোর বাবার সঙ্গে মতের মিল হয় নি বলে ও বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। একটু পরে মা বিড়বিড় করে বলেছিলেন, অপু এখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে। মাকে যখন আমি ভাইয়ার প্রথম চিঠিটা দেখালাম, তখন মার চোখে অদ্ভুত এক আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছিলো, যা আমি কোনোদিন দেখি নি।

ভাইয়া আমার চেয়ে আট বছরের বড়ো। তার ছোট আমার এক বোন ছিলো। ও নাকি জন্মাবার পর মাত্র ছমাস বেঁচেছিলো। বাড়িতে এখন আমি একা। মাঝে মাঝে ডিজনীর এ্যাডভেঞ্চারও একঘেয়ে মনে হয়। নিজের পায়ে। দাঁড়াবার আগে যে কিছু করা যাবে না, এটা আমি পরিষ্কার বুঝেছি। বাবা বিকেলে মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে চাইনিজ চেকার খেলেন। তাতে কি আর সময় কাটানো যায়!

দূরে আমাদের স্কুলের ঘড়িটায় বারোটার ঘন্টা বাজলো। এক দুই করে আমি নয় পর্যন্ত গুনে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। ঘন্টা-বুড়ো পিটারের ক্লান্ত চেহারাটা মনে পড়লো। গলি দিয়ে ফেরিঅলারা লেস ফিতা, ঢাকাই শাড়ি বলে সুর করে ডেকে যাচ্ছিলো। আমি জানি ঢাকাই শাড়িঅলা বুড়ো হাতেমালি এখন চৌধুরীভিলার গাড়ি বারান্দার নিচে বসে গামছা ঘুরিয়ে বাতাস খাচ্ছে। কামরাঙ্গা গাছের কাকগুলো ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে এখন বসে ঝিমুচ্ছে।

গত বছর এ সময়ে ছোট নানু আর নেলী খালা এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে। আমাদের বাড়ির অনেক দিনের জমে থাকা গম্ভীর, গুমোট বাতাস নেলী খালা চোখের পলকে উড়িয়ে দিলেন। ছোট নানু ফরেন সার্ভিসে ছিলেন। রিটায়ার করে বহু দিন পর দেশে ফিরেছেন। নেলী খালার প্রায় পুরো জীবনটাই বিদেশে কেটেছে। মা বলেছেন, নেলী খালার বয়স নাকি এখন সাতাশ। ছোট নানু কয়েক দিন থেকে কক্সবাজারে তাঁর নিজের বাড়িতে চলে গিয়েছেন। নেলী খালা গরমের ছুটির একটানা দুমাস আমাদের সঙ্গে ছিলেন।

বাবুকে নেলী খালার সব কথা বলে ফেলেছি। মার সঙ্গে রোজ এক বার করে নেলী খালার ঝগড়া হতো। নেলী খালা ছেলেদের মতো চুল কেটেছেন বলে মার রাগ, মার পছন্দ করা পাত্রকে নেলী খালা বিয়ে করবেন না বলে রাগ, নেলী খালা চাকরি না করে ব্যবসা করবেন বলে রাগ–এতো রাগ নিয়ে মা সারাক্ষণ নেলী খালার ওপর টং হয়ে থাকতেন। মা যতো রাগতেন, নেলী খালা ততো হাসতেন। আর মাকে আরো চটাতেন। একদিন নেলী খালা বললেন, জানো শানুপা, আমাদের ল্যান্ডলেডি মিসেস থম্পসন লেখাপড়া তেমন কিছু করেন নি। অথচ নিজে দুদুটো দোকান চালান, ক্যাশ দেখেন, লাইসেন্স রিনিউ করানোর জন্যে ছুটোছুটি করেন। তুমি এতো সব ডিগ্রী নিয়ে জামান সাহেবের হেঁশেল ঠেলবে আর বসে বসে মোটা হবে, এটা কেমনতরো কথা! শুনে বাবা হেসে বললেন, আমার ওপর দোষ চাপিও না নেলী, এক বার চাকরির কথা বলাতে সাত দিন তোমার বোন আমার সঙ্গে কথা বলে নি। আর মা রেগেমেগে বললেন, দ্যাখো, আমাকে চটাবে না কিন্তু। শেষে আমি অনর্থ করবো। মোটা হবার কথা বললে মা ভীষণ রেগে যেতেন। মেয়েদের কাজ মেয়েদের করা উচিত। মেয়ে হয়ে ছেলেদের কাজে নাক গলানো আমি একদম পছন্দ করি না।

নেলী খালা মাকে বলতেন, এখনো তুমি একেবারে সেকেলে রয়ে গেছো। কাজই যখন করবে না, তখন ডিগ্রী নেয়ার কী দরকার ছিলো? বাবা গম্ভীর হয়ে বলতেন, ডিগ্রী ছাড়া তোমার বোনকে আমি বিয়ে করতাম ভেবেছো? নেলী খালা হেসে গুঁড়িয়ে যেতেন। এখন নিশ্চই আপনার মনে হচ্ছে ডিগ্রী থাকা আর

থাকা দুটোই শানুপার জন্যে সমান। মা তখন এতো রেগে যেতেন যে কোনো কথা বলতে পারতেন না। উঠে গিয়ে রান্নাঘরে ক্ষেন্তির মাকে ঝেড়ে বকতেন, এতো বেলা হলো, এখনো তোমার…।

মা যখন হার মানতেন, নেলী খালা তখন আমাকে নিয়ে পড়তেন। বলতেন, সকালবেলা ঝুপঝাঁপ করে কটা ডন আর বৈঠক করলেই শরীর ভালো থাকে না। তোমাকে তো খেলতে যেতে দেখি না আবির?

আমি বলতাম, মাঠ কোথায় যে খেলতে যাবো? স্কুল খোলা থাকলে মাঝে মাঝে বাস্কেটবল প্র্যাকটিস করি। শুনে নেলী খালা–কুছ পরোয়া নেই বলে মিস্তিরি ডাকিয়ে তিন দিনের ভেতর আমাদের ছাদে টেবিল টেনিস খেলার টেবিল বানিয়ে ফেললেন। আমি শিরীষ কাগজ ঘষে টেবিলটা মসৃণ করলাম। নেলী খালা রং লাগালেন। তারপর সকাল-বিকেল টেবিল টেনিস, দুপুরে এয়ার গান দিয়ে চাঁদমারি তাক করা, ক্রসওয়ার্ড পাযল–এসব সমানে চলতে লাগলো। সন্ধেয় বাবা ঘরে ফিরলে নেলী খালা মার সঙ্গে খুনসুটি করতেন। আর রাতে বাবা, মা, আমি, নেলী খালা সবাই মিলে চাইনিজ চেকার খেলে গরমের ছুটির দুটো মাস যে কীভাবে কাটিয়ে দিলাম টেরই পেলাম না।

একদিন কক্সবাজার থেকে নানুর চিঠি পেয়ে নেলী খালা হুট করে চলে গেলেন। যাবার সময় মার সে কি ফোঁসফোঁস কান্না আর উপদেশ–নেলী, এটা বিলেত নয়, ঠিকমতো চলাফেরা করিস, আমার পছন্দমতো যখন বিয়ে করবি না, তখন নিজে দেখেশুনে একটা বিয়ে কর। মামারও তো বয়স হয়েছে। মামী বেঁচে থাকলে–বলে মা আঁচলে চোখ মুছেছিলেন। মার কাণ্ডকারখানা দেখে আমার হাসি পেলেও নেলী খালা চলে যাচ্ছেন ভাবতে গিয়ে বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছিলো।

তুমি কিসসু ভেবো না শানুপা। আমি ঠিক থাকবো। এই বলে নেলী খালা মার গালে আর আমার কপালে চুমো খেয়ে গাড়িতে উঠলেন। নেলী খালা চলে যাবার পর আমাদের পুরোনো বাড়িটা যেন আরো একা, সময়গুলো যেন আরো বিষণ্ণ হয়ে গেলো। আমি আবার আগের মতো দশটা-চারটা স্কুলে যেতে শুরু করলাম।

মা বলেন, নেলী খালার নাকি বড়ো ভুলো মন। মা এরকম অনেক কথাই বলেন। তবে যখন নেলী খালাকে এভাবে বকেন, তখন আমার ভালো লাগে না। আমি মাকে বলি, ভুলো মন হলে তোমাকে মাসে দুটো করে চিঠি লিখতো না। মা তখন পান চিবুতে চিবুতে একগাল হেসে বলেন, ও তো মামার বকুনি খেয়ে লেখে। আর আমার চিঠির জবাব না দিলে আমিই বা লিখবো কেন বল! নেলী খালা বাবা-মা দুজনকেই আগের মতো হাসি-খুশি করে দিয়ে গেছেন।

জলপাই-সবুজ কাগজে মাকে চিঠি লিখতেন নেলী খালা। আমি মাকে বলে সব চিঠিই পড়তাম। দেখতাম, আমার কথা কী লিখেছেন, আর তিনি নিজে কী উদভুট্টি কাণ্ড করলেন। মার ভাষায় নেলী খালা নতুন যা কিছু করেন সব নাকি উদভুট্টি কাণ্ড। চিঠি পড়ে পান চিবুনো বন্ধ করে মা খুব গম্ভীর মুখে বাবাকে পড়তে দিতেন, দেখ, নেলীর কাণ্ডখানা দেখ। বাবা পড়ে হাসতেন। আর মা রেগে যেতেন, হেসো না বাপু। ওর এসব উদভুটি কাণ্ড দেখে গা জ্বলে যায়। মামাটাও দিন দিন কী যেন হচ্ছেন! বাবা হেসে বলতেন, মন্দ কি। নেলী নতুন কিছু করছে। ওকে উৎসাহ দেয়া উচিত। আমাদের এখানে এমনটি আগে কখনো হয় নি। শুনে মা আরো রেগে যেতেন। বলতেন, মামাকে দুটো কড়া কথা লিখতে হবে। নেলী খালা সব চিঠিতে আমাকে চুমো পাঠাবেন আর একটা উদভুট্টি কাণ্ড করার কথা লিখবেন–যেটা পড়ে মা রেগে যাবেন আর বাবা হাসবেন।

একদিন নেলী খালা লিখলেন, শানুপা, ডিমের কারবারে সুবিধে করতে পারছি না। পাইকারগুলো বিট্রে করছে। তাছাড়া এখানে কোল্ড স্টোরেজ সিস্টেম নেই। প্রচুর লোকসান হচ্ছে। মা চিঠিখানা জোরে জোরে পড়ে শোনালেন বাবাকে। তারপর বললেন, কেমন, আগে বলি নি এটা বিলেত নয়? তখন তো কানেই গেলো না। বোঝ এখন! তারপর আরেক চিঠিতে নেলী খালা লিখলেন–ভারি বিচ্ছিরি রকমের ঝিমুনি ধরেছে মুরগিগুলোকে। নামমাত্র দামে ছেড়ে দিতে হচ্ছে। মুরগির ব্যবসা গুটিয়ে ফেলবো। মা একগাল হেসে বাবাকে বললেন, যাক বাপু, এ্যাদ্দিনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। ব্যবসার ভূত তাহলে নেলীর ঘাড় থেকে নেমেছে। বাবা শুনে মুখ টিপে হাসলেন।

মাকে বেশিদিন হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে হলো না। নেলী খালা পরের চিঠিতেই লিখলেন–চমৎকার বাজার পেয়েছি। তরকারির ব্যবসা শুরু করেছি। গ্রাম থেকে জীপে করে এনে শহরে ছাড়বো। সহজে নষ্ট হবার ভয় নেই। চমৎকার হবে! কী বলো শানুপা? মা তক্ষুনি গোল রিমের চশমাটা পরে মুখ কালো করে নেলী খালাকে লিখলেন, নেলী, তুমি তো কখনো আমার পরামর্শ গ্রহণ কর নাই। তোমার ভালো-মন্দ তুমিই বোঝ। তবে মেয়ে মানুষের ব্যবসা করাটা আমি ভালো মনে করি না। আমার কথা যখন শুনিবে না তখন তোমার যাহা খুশি করিতে পার। মামী বাঁচিয়া থাকিলে কখনো এইরূপ হইতে দিতেন না। আমি এখনো বলি, তুমি লেখাপড়া শিখিয়াছ। যদিও তোমার বিচার-বুদ্ধির উপর আমার যথেষ্ট আস্থা নাই, তবুও বলি নিজে দেখিয়া শুনিয়া একটি বিবাহ কর। নতুবা বল তো আমরা পাত্র দেখি। মামা কোনো দিন এ বিষয়ে ভাবিবেন না বলিয়া যেন পণ করিয়াছেন।

মার এ ধরনের গুরুগম্ভীর চিঠির জবাবে নেলী খালা লিখলেন, শানুপা, এতো সুন্দরভাবে কাজ এগুচ্ছে যে কী বলবো! ইচ্ছে করছে তোমাকে এনে দেখাই। দশ-বারোটা গ্রাম ঘুরে ভেজিটেবল সংগ্রহ করা ভারি থ্রিলিং ব্যাপার। আর দর-দস্তুরের মতো মজার জিনিস দুটো নেই। তুমি যদি দেখতে শানুপা, তাহলে তোমারও শেয়ারে নেমে যেতে ইচ্ছে করতো। চিঠি পড়ে মা তো বাবাকেই একচোট বকলেন, তুমি তো নেলীকে কিছুই লিখবে না। ওর আক্কেলখানা কি, দেখ তো! আমার নাকি তরকারি বেচতে ইচ্ছে করবে। ভাবো দেখি ব্যাপারটা!

বাবা খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে খুব গম্ভীর হয়ে মাকে ভালো করে দেখে বললেন, মানাবে। খুব একটা খারাপ লাগবে না।

কথাটা শুনে আমার এতো হাসি পেলো যে, ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে হলো। মা রেগেমেগে দুদিন বাবার সঙ্গে কথা বললেন না।

অনেক দিন হল নেলী খালার চিঠি আসছে না। বাবু ছাড়া আমাকে কেউ চিঠি লেখে না। অথচ চিঠি পেতে আমার খুব ভালো লাগে। নেলী খালার চিঠিগুলোতে যদিও মজার মজার কথা থাকে, কিন্তু আমার জন্যে শুধু একটা করে চুমো। বাবুর চিঠি সবটাই আমার। আমি বার বার পড়ি। তারপর লম্বা একটা চিঠি লিখে পনেরো দিন অপেক্ষা করি। ওর চিঠি পেতে এক দিন দেরি হলেও আমার ভীষণ রাগ হয়।

দমকল আপিসের পেটা ঘড়িতে দুটোর ঘন্টা বাজলো। বাবু বইটা শেষ করে হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম, কেমন লাগলো? বাবু শুধু বললো, চমৎকার!

স্কুল না থাকলে আমরা বারোটা বাজার আগেই দুপুরের খাবার খাই। বিকেলে বাবা এলে জলখাবার। মা তখন লুচি, নয় ভাসা-পরোটা ভাজেন। আলুর দম তৈরি করেন। মা চমৎকার রান্না করেন। খাবার টেবিলে বসে বাবু এত প্রশংসা করে যে, মা লাল-টাল হয়ে ওর পাতে দুটোর বদলে চারটা মাছের টুকরো তুলে দেন। আমার তখন খুব হাসি পায়। মার বকুনির ভয়ে খাবার টেবিলে হাসা যায় না।

বাবু হাই তুলে বললো, আজ প্রচুর খাওয়া হয়ে গেছে।

আমি বললাম, ঘুম পেলে ঘুমিয়ে নাও।

ও মাথা নাড়লো–আমি দিনে ঘুমোই না।

বাবু আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘুড়ি ওড়া দেখছিলো। একটা ঘুড়ি সুতো ছিঁড়ে ভাসতে ভাসতে দূরে চলে গেলো। বাবু বললো, আমরা যদি হাক ফিনের মতো একটা এ্যাডভেঞ্চার করতে পারতাম, তাহলে দারুণ মজা হতো।

আমি বললাম, তুমি তো কদিন পরই চলে যাবে। আমার তখন খারাপ লাগবে। একা থাকতে আমার খুব কষ্ট হয়। মনে হয় ভাইয়ার মতো কোথাও বেরিয়ে যাই।

বাবু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, তোমাকে তো বলেছি আবির, কলাম্বিয়াতে আমার কোনো বন্ধু নেই। তোমার চিঠি পেলে কী যে ভালো লাগে! তুমি খুব সুন্দর লিখতে পারো। আমি তোমার মতো লিখতে পারি না।

তুমি কি আমার কথা খুব ভাবো বাবু?–আমি মনে মনে কথাগুলো বললাম।

বাবু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর একটু হেসে বললো, আমাদের দুটো মেয়ে বন্ধু থাকলে খুব মজা হতো।

আমি হেসে ফেললাম–ওখানে তো তোমার বান্ধবীর অভাব হবার কথা নয়।

বাবু আগের মতো হেসে মাথা নাড়লো–ওখানকার মেয়েদের আমার ভালো লাগে না।

গরমের দুপুরগুলো এতো বড় যে কাটতেই চায় না। চারিদিক কেমন সুমসাম। একটা ঘুমঘুম ভাব। চারপাশের দালান, কার্নিশে বসা শালিক, এখানে সেখানে একটা দুটো গাছের মাথা–সব কিছু যেন গরমে ক্লান্ত হয়ে ঝিমুচ্ছে। চিলেকোঠার পুরোনো ফ্যানটা পুরো স্পীডে কটকট শব্দ করে ঘুরছে। মনে হচ্ছে ফ্যানের ভেতর থেকেও গরম বাতাস বেরুচ্ছে।

বাবু বললো, তোমার নেলী খালা তো তোমাকে খুব ভালোবাসেন।

আমি বললাম, বাসে। তবে নেলী খালা আমাকে তো চিঠি লেখে না।

বাবু একটু গম্ভীর হয়ে বললো, এখানে তো তুমি ভালোই আছো। মা বাবা আছেন, নেলী খালা আছেন। ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতে পারো। ওখানে ডরমেটরিতে থেকে একা আমার সময়গুলো কীভাবে কাটে একবার ভাববা তো!

আমি একা থাকি বলে একা থাকার কষ্ট সব সময় অনুভব করি। ওকে বললাম, বাবা বলেছে ইশকুল ফাইনালের পর আমাকে তোমাদের কাছে পাঠিয়ে দেবে। তারপর আমরা একসঙ্গে থাকবো।

বাবু হেসে বললো, সে তো দুবছর পরের কথা। এখন যে দুমাস একসঙ্গে থাকবো, একটা কিছু তো করতে হবে। এভাবে ঘরে বসে আর কদ্দিন কাটাবো?

আমি বললাম, কাল চলো, নদীর ওপারে যাবো। নৌকোয় ঘুরে বেড়াতে আমার খুব ভালো লাগে।

চিলেকোঠার ছায়াটা ছাদের ওপর আস্তে আস্তে লম্বা হয়ে পড়লো। রোদের ঝাঁঝটা একটু কমে এলো। চৌধুরীদের কামরাঙ্গা গাছের কাকগুলো আর আমাদের। ছাদের কার্নিশের ছায়ায় বসা শালিকগুলো উড়ে চলে গেলো। আকাশে একটা দুটো ঘুড়ি উড়তে শুরু করলো। আমি আর বাবু তখন টেবিল টেনিস খেলতে গেলাম।

ভাগ্যিস গত বছর নেলী খালা টেবিলটা বানিয়েছিলেন। রঙটা একটু ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো আগের মতো মসৃণ রয়েছে। ক্ষেন্তির মা রোজ দুবেলা টেবিলটা মুছে রাখে। বলে, মেম খালাম্মা যখন আবার আসবেক তখন মোকে বোকবেক। আমি বাপু তার মদ্দি নেই। তারপর বলে, আহা, কী ভালো ছিলেক গো মেম খালাম্মা! যাবার বেলায় মোকে লুকিয়ে দশটে টাকা দিলেক বটে। আর ক্ষেন্তির জন্যে একখান বাহারি বোম্বাই শাড়ি। শাড়িখান আমি তুলে রেখেচি। হ্যাঁগো ছোট মেয়া, আবার কবে আসবেক গো মেম খালাম্মা?

ক্ষেন্তির মা নেলী খালাকে বলে মেম খালা। প্রথম দিন দেখে গালে হাত দিয়ে মাকে বলেছিলো, ও আম্মা, আপনার বুনটিকে দেখে মেম নোকের পারা মনে লয় গো। নেলী খালা শুনে হেসে কুটোপাটি! বললেন, তাহলে আমাকে তুমি মেমই ডেকো।

নেলী খালা গতবারের মতো যদি এবারও আসতেন, তাহলে খুব মজা হতো। খেলতে খেলতে কথাটা বাবুকে বললাম। বাবু শুনে দারুণ খুশি হয়ে বললো, তাহলে আজই একটা চিঠি লিখে দাও।

আমার চিঠি লেখার আগেই নেলী খালার চিঠি এসে গেলো। বিকেলে খাবার টেবিলে যখন ফুলকো লুচি দিয়ে ডিমের কালিয়া খাচ্ছি, তখন দেখলাম মার চেহারাটা খুব গম্ভীর। বাবা বাবুকে বললেন, কি বাবু, কেমন লাগছে সব?

বাবুর মুখে তখন আস্ত একখানা লুচি। কথা বলার মতো অবস্থা ছিলো না। ও শুধু ঘাড় নাড়লো। আমি হাসি চাপতে গিয়ে ফিক করে হেসে ফেললাম। মা কটমট করে আমার দিকে তাকালেন। বাবু মুখের লুচিটা সাবাড় করে মাকে বললো, কী চমৎকার কালিয়া! আমি জীবনেও এতো চমৎকার রান্না খাই নি। আমি মার দিকে তাকালাম। নির্ঘাত একগাল হেসে বাবুর পাতে আরেক চামচ তুলে দেবেন। কিন্তু মা হাসলেন না। লালও হলেন না। যেন কথাটা তার কানেই যায় নি। গম্ভীর হয়ে বাবাকে বললেন, নেলীর চিঠি এসেছে।

আমি বাবার দিকে তাকালাম। আগের মতো বাবা নিশ্চয়ই মাকে পড়তে বলবেন। বাবা খেতে খেতে বললেন, কী লিখেছে?

বাবার খাওয়া শেষ হয়ে এসেছে। মা নিজে না পড়ে চিঠিখানা বাবার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, পড়ে দেখো।

হাত ধুয়ে বাবা চিঠিখানা পড়লেন। পড়তে পড়তে তার কপালে ভাঁজ পড়লো। আগের মতো চিঠি শেষ করে হাসলেন না। বরং গম্ভীর হয়ে মাকে বললেন, এ কাজটা নেলী ভালো করে নি।

মা উদাস গলায় বললেন, তুমি তো এ্যাদ্দিন গা করো নি। নেলী কোনদিনই বা ভালো কাজ করেছিলো! মামার জন্যে কষ্ট হচ্ছে আমার। বুড়ো বয়সে এরকম টানা-হাচড়া!

বাবা বললেন, মামার মত দেয়া উচিত হয় নি।

আমি আর বাবু দুজন দুজনের দিকে তাকালাম। বাবুর চোখে প্রশ্ন। আমারও। বাবু আমাকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করতে বললো। আমি ঢোক গিলে মাকে বললাম, মা, নেলী খালার কী হয়েছে।

মা মহা বিরক্ত হয়ে বললেন, হবে আর কি! মাথায় ভূত চেপেছে।

বাবা আমার দিকে তাকালেন তোমার নেলী খালা কক্সবাজারের বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে কোথায় কোন নুলিয়াছড়িতে একটা অনেক দিনের পুরোনো জমিদার বাড়ি কিনেছে। কক্সবাজার থেকে তিরিশ মাইলের মতো দক্ষিণে সমুদ্রের তীরে। বার্মার বর্ডার নাকি ওখান থেকে মাত্র পাঁচ মাইল দূরে।

মা বললেন, আর বাড়িরও বলিহারি যাই। আশেপাশে আধ মাইলের ভেতর কোনো জনমানুষ নেই। নেলী নাকি ওটাকে সরাইখানা বানাবে। পেয়িংগেস্ট রাখবে। শুনে পিত্তি জ্বলে যায়।

বাবা কিছু না বলে উঠে চলে গেলেন। বোঝা গেলো নেলী খালার এই উদভুটি কাণ্ডখানা বাবাও পছন্দ করেন নি। আমার কাছে সবকিছু ঝাঁপসা মনে হলো।

রাতে খাবার পর মা যখন পান চিবুতে চিবুতে আমাকে ডেকে তাকের ওপর থেকে দোক্তার কৌটোটা নামিয়ে আনতে বললেন, তখন আমি বললাম, নেলী খালার চিঠিটা পড়তে দেবে মা?

আলমারির মাথায় রেখেছি, আবার হারায় না যেন। ওতে নেলীর নতুন ঠিকানা লেখা আছে।

নেলী খালার চিঠি নিয়ে এক ছুটে আমার ঘরে এলাম। বাবু সেখানে আমার জন্যে বসে ছিলো। চার পাতার মস্ত চিঠি। দুজন হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। চিঠির সবটাই সেই অচেনা নুলিয়াছড়ির বর্ণনা। নেলী খালা যেভাবে লিখেছেন, মনে হয়

বাংলাদেশে এতো সুন্দর আর রহস্যময় কোনো জায়গা থাকতে পারে। চিঠির শেষ কলাইন পড়ে আমি আর বাবু দুজন একসঙ্গে দুজনের দিকে চোখ তুলে তাকালাম! নেলী খালা লিখেছেন, আবিরের তো পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। এই গরমে ওকে রূপলাল লেনের গলিতে আটকে রাখার কোনো মানে হয় না। ছেলেটাকে তুমি যেভাবে আঁচলের তলায় রেখে দিয়েছো, ভবিষ্যতে ও কোনোদিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না। ছুটির কটা দিন আমার কাছে থাকুক। সমুদ্রের বাতাসে শরীরটাও ভালো হবে। আসছে রোববার দুপুরে আমি ওকে আনার জন্যে চট্টগ্রাম স্টেশনে থাকবো। তোমার কর্তার নিশ্চয়ই অমত হবে না। এরপর নেলী খালা বাবার কথা লিখেছেন।

চিঠি পড়া শেষ করে দুজন চুপচাপ বসে রইলাম। আমি কী বলবো ভেবে। পেলাম না। নেলী খালার জলপাই-সবুজ রঙের চিঠিটাকে মনে হলো ভূমধ্যসাগরের কোনো জলপাই দ্বীপে যাবার ডাক এসেছে। বাবু কী যেন ভাবলো। তারপর আস্তে আস্তে বললো, তুমি তাহলে নুলিয়াছড়ি যাচ্ছো?

ওর গলটা কেমন যেন বিষণ্ণ মনে হলো। আমি ওর কাঁধে হাত রাখলাম। বললাম, তোমাকে বাদ দিয়ে নয়।

বাবু হাসলো। হাসলে ওকে ভারি সুন্দর দেখায়। বললো, রোববারের আর তিন দিন।

পরদিন সকালে খাবার টেবিলে মাকে বললাম, মা, নেলী খালা যে আমাকে যেতে বলেছে তুমি বলো নি কেন?

মা রুটিতে মাখন লাগাতে লাগাতে বললেন, বলি নি আমার ঘাট হয়েছে। যাও, রোববার সকালের ট্রেনে উঠে আমায় কেতাথ করো।

আমি বললাম, বাবুও আমার সঙ্গে যাবে।

বাবা বললেন, তা তো যাবেই। ও এখানে একা থাকবে নাকি! তোমাদের যাবার ব্যাপারে কাল রাতে তোমার মার সঙ্গে কথা বলেছি। নেলীকে আমি আজই টেলিগ্রাম করে দেবো।

তারপর দুটো দিন যেন চোখের পলকে কেটে গেলো। আমি আর বাবু সারাদিন টেবিল টেনিস, চাইনিজ চেকার খেলে আর নানারকম প্ল্যান কষে সময় কাটিয়ে দিলাম। মা সারাক্ষণ পেছনে লেগে রইলেন–জামাকাপড় কী নিতে হবে, সব কি আমাকে করতে হবে? আচার আর ডালের বড়ির কথা যাবার সময় যেন ভুলে যেও না।

একগাদা লটবহর নিয়ে মা-বাবা রোববার কাক-ভোরে আমাদের ট্রেনে তুলে দিতে এলেন। ফোঁসফোঁস কান্না জুড়ে দিলেন। ট্রেন চলতে শুরু করলো। বাবা হাত নাড়লেন। বললেন, নেলীকে টেলিগ্রাম করতে বলো।

প্ল্যাটফর্মটা যতোক্ষণ দেখা গেলো, ততোক্ষণ মা আর বাবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। মার জন্যে আমার কষ্ট হলো। মা সবার জন্যে এতো ভাবেন যে সামান্য কিছুতেই কেঁদে ফেলেন। মা-বাবাকে ছেড়ে এই প্রথম আমি বাইরে যাচ্ছি। যখন প্ল্যাটফর্মটা আর দেখা গেলো না, তখন আমি কামরার ভেতরে তাকালাম। বাবু জিনিসপত্র সব গুটিয়ে রেখে আমার পাশে এসে বসলো। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো, আমরা সত্যিই তাহলে নুলিয়াছড়ি যাচ্ছি।

আমিও তেমনি তেমনি ফিসফিস করে বললাম, না, জলপাই দ্বীপ!

.

০২. নুলিয়াছড়ির অভিশপ্ত বাড়ি

স্টেশনে শ্যাওলা-সবুজ রঙের শাড়ি পরা নেলী খালাকে দেখামাত্র সারা পথের একঘেয়েমির কথা সঙ্গে সঙ্গে ভুলে গেলাম। ট্রেনে উঠলে প্রথম দিকে আমার ভালো লাগলেও শেষে মনে হয় পথ ফুরোলেই বাঁচি। ট্রেনটা আস্তে আস্তে থামছিলো। নেলী খালা এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলেন। আমি জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে ডাকলাম নেলী খালা!

নেলী খালা আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে চলন্ত কামরার সঙ্গে দৌড়োতে শুরু করলেন। প্ল্যাটফর্মের ওপর মস্ত বড়ো এক ট্রাঙ্কের ওপর পানদান হাতে বসেছিলেন ইয়া মোটা এক বিহারী ভদ্রমহিলা। দৌড়োতে গিয়ে নেলী খালা ভদ্রমহিলার দামী কাতান শাড়ির জরির কাজ করা আঁচলটা মাড়িয়ে দিলেন। ভদ্রমহিলা কটমট করে উঠে দাঁড়িয়ে দুহাত নেড়ে কি সব বলে চেঁচাতে লাগলেন। আমি আর বাবু নেলী খালার উদভুট্টি কাণ্ড দেখে হেসে খুন।

ট্রেন থামলো। হাঁপাতে হাঁপাতে নেলী খালা বললেন, তোরা এলি তাহলে। ঝাড়া আধা ঘন্টা বসে আছি। এই বলে আমাদের বড়ো সুটকেস দুটো টেনে নামালেন। আমরা এয়ার-ব্যাগ আর বেতের ঝুড়িটা নিয়ে নামলাম।

বাবুকে দেখে নেলী খালা বললেন, এই বুঝি বাবু? এ তো দেখি ক্ষুদে ওমর শরীফ!

কদিন আগে আমি ওমর শরীফের একটা ছবি দেখেছিলাম। ওই ছবিতে ওমর শরীফ এক পাদ্রী সেজেছিলো। মাথার মাঝখানে ছোট্ট বাটির মতো সাদা টুপিটা দেখে মনে হয়েছিলো, ওখানটায় বুঝি গোলা করে চুলগুলো কেউ চেঁছে। দিয়েছে। মনে পড়তেই আমি হেসে গড়িয়ে পড়লাম। আর বাবুর তো কান লাল হয়ে গেলো।

নেলী খালা ভুরু কুঁচকে বললেন, এতো হাসির কী হলো! ওমর শরীফ আমার ফেভারিট এ্যাকটর। ঝুড়িটা আমাকে দাও। সুটকেসগুলো আশা করি তোমরা নিতে পারবে।

একটা কুলি এসে নেলী খালার হাত থেকে ঝুড়িটা নিতে চাইলো। নেলী খালা বিনয়ে গলে গিয়ে বললেন, কেন ভাই কষ্ট করবেন। আমিই তো দিব্যি নিতে পারি। নেলী খালার কথা বলার ভঙ্গি দেখে কুলিটা জিব কেটে পালিয়ে বাঁচলো।

স্টেশনের বাইরে যেতে যেতে নেলী খালা আমাকে বললেন, ওজন দেখে তো মনে হচ্ছে তোমরা সারা বছর থাকার মতলব নিয়ে এসেছে।

আমি হাসি চেপে গম্ভীর হয়ে বললাম, বেতের ঝুড়ির সব জিনিসই তোমার নেলী খালা। রীতিমতো একখানা হেঁশেল সাজিয়ে দিয়েছেন বলতে পারো।

দুহাতে ধরে বেতের ঝুড়িটা জীপের পেছনে তুলে নেলী খালা ড্রাইভিং সীটে বসলেন। আমরা দুজন বসলাম তার পাশে। ব্যাক গিয়ারে চমৎকার পাশ কাটিয়ে নেলী খালা স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেন, আমার আরো দুটো গেস্ট আছে। মিরাবুর মেয়েরাও আমাদের সঙ্গে যাবে। বেচারীরা এতোক্ষণে নির্ঘাত আমার ওপর চটে আছে। আমি ওদের দেড়টায় তুলে নেবো বলেছি।

আমি অবাক হয়ে বললাম, তোমার মিরাবু কে নেলী খালা? আগে তো কখনো বলো নি!

নেলী খালা মুখ টিপে হেসে বললেন, বলি নি তোকে অবাক করে দেবো বলে। ওঁর দুটো চমৎকার মেয়ে আছে। ললি আর টুনি। তোর কথা শুনে আলাপ করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। তুই যে লুকিয়ে কবিতা লিখিস, এ কথা ওদের বলে দিয়েছি।

আমি আড়চোখে বাবুর দিকে তাকালাম। বাবু ঘাড় ফিরিয়ে দোকানপাট দেখতে লাগলো। পাঁচ মিনিটের ভেতর আমরা ললি, টুনিদের বাড়িতে এসে গেলাম। মার বয়েসী স্মার্ট এক জন ভদ্রমহিলার সঙ্গে ওরা বারান্দায় বসেছিলো। নেলী খালা গাড়ি থেকে নামলেন না। বললেন, ললি টুনি ঝটপট পেছনে উঠে পড়ো। আলাপ-টালাপ সব পরে হবে। অনেক দেরি হয়ে গেছে। সন্ধের ভেতরে বাড়ি ফিরতে পারলে বাঁচি। তারপর আমাকে আর বাবুকেও ঠেলে পেছনে পাঠিয়ে দিলেন। আমাদের পেছনে উঠতে দেখে ললি টুনির ছোটটি জিব বের করে ভেংচি কাটলো। ওর সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম।

নেলী খালা বললেন, বুড়ো মুৎসুদ্দিকে তুলতে হবে। আমার জন্যে বেচারা দাঁড়িয়ে থাকবেন। মিরাবু, তুমি কিসসু ভেবো না। আমি কক্সবাজার থেকে ফোন করবো।

নেলী খালা গাড়ি ঘোরালেন। ওর মিরাবু পেছন থেকে চেঁচিয়ে বললেন, ভাবতে সময় দিলি কই নেলী, সাবধানে ড্রাইভ করিস বাছা। ছোট মামাকে মনে করে, আমার… তাঁর কথা আর শোনা গেলো না। নেলী খালা প্রচণ্ড স্পীডে গাড়ি চালালেন।

আমি আর বাবু ললি টুনির মুখোমুখি বসেছিলাম। দুজনেই বেলবটম প্যান্ট আর ফ্রিলের জামা পরেছে। নেলী খালা বললেন, ললি, তোমাদের ব্যাগ নিয়েছো তো? একটা মেয়ে মিষ্টি হেসে বললো, নিয়েছি নেলী খালা। বুঝলাম, ওরই নাম ললি।

ললির চুলগুলো ববৃছাট করা। মুখটা আদুরে রাশান পুতলের মতো। চোখে রোল গোল্ডের চশমা। আর টুনি যে আমাকে দেখছিলো–ওর চুলগুলো লম্বা হলেও ওকে ললির চেয়ে বেশি স্মার্ট মনে হলো। লম্বা চুল দিয়ে ও মাথার দুপাশে বেণীর বদলে দুটো খোঁপা করেছে। খোঁপা দুটো আরেকটু উঁচুতে বাঁধা হলে ঠিক দুটো শিং-এর মতো মনে হতো। কথাটা ভেবে আমি হেসে ফেললাম। টুনি সঙ্গে সঙ্গে বললো, এই, আমাকে দেখে হাসছেন কেন? খবরদার, হাসতে পারবেন না।

ওর কথা বলার ধরন দেখে আমি আর বাবু দুজনেই হেসে ফেললাম। ললি একটু লজ্জা পেয়ে বললো, তুমিই ওকে হাসাচ্ছো টুনি। গাড়িতে ওঠার সময় তুমি জিব বের করেছিলে কেন? তোমার জামার কলার ঠিক করো।

টুনি তড়বড় করে বলে উঠলো, এ মা, তুমি কী মিথ্যুক ললিপা! তুমিই তো আমাকে জিব দেখাতে বললে। আর নিজে এখন–।

ললি হেসে ফেলে বললো, ভালো হবে না বলছি টুনি।

ললি আর টুনি দুজনকেই আমার ভালো লেগে গেলো। বাবুর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম ও মিটি মিটি হাসছে। মনে হলো বাবুরও ভালো লেগেছে।

শহর থেকে বেরিয়ে মস্ত বড়ো এক ছাতিম গাছের তলায় এসে নামলেন নেলী খালা। ছাতিমতলা থেকে গুটি গুটি পায়ে এক জন বুড়ো দ্রলোক এগিয়ে এলেন। আসুন মিঃ মুৎসুদ্দি। নেলী খালা বললেন, আধঘন্টা দেরি হয়ে গেছে। ভারি দুঃখিত।

বুড়ো মুৎসুদ্দি গাড়িতে উঠতে উঠতে চেঁচিয়ে বললেন, শরীর খারাপের কথা বলছেন? তা বয়স তো আর কম হয় নি।

আমরা সবাই হেসে উঠলাম। বুড়ো মুৎসুদ্দি কিছুই দেখতে পেলেন না। গাড়ি ছাড়ার একটু পরেই তিনি ডান হাতটা ডান কানের পাশে নিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, শুনলাম মিস চৌধুরীরা নাকি নুলিয়াছড়ির হার্মাদদের ভূতুড়ে বাড়িটা কিনেছেন?

নেলী খালা বললেন, তা একরকম কিনেছি বলতে পারেন। আপনি কার কাছে শুনলেন?

বুড়ো মুৎসুদ্দি আগের মতো চেঁচিয়ে বললেন, কী বললেন? ভূত বলে কিছু নেই নাকি?

বাবু বললো, এ যে দেখি প্রফেসর হেঁশোরাম হুঁশিয়ারের চিল্লানোরাসের মতো চ্যাঁচাচ্ছে?

বাবু আমাদের বাসায় সুকুমার রায়ের লেখা প্রফেসর হেঁশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়রী গল্পটা পড়েছিলো। আমি হেসে নেলী খালাকে বললাম, এই চিল্লানোরাস মুৎসুদ্দি সায়েবটি করেন কী? নেলী খালা পেছনে না তাকিয়ে জবাব দিলেন–উনি কক্সবাজারের একটা মোটেলের মালিক।

বুড়ো মুৎসুদ্দি বললেন, ওটা যে ভূতুড়ে বাড়ি, আপনার বিশ্বাস হয় না বুঝি! তালুকদারদের ওয়ারিশটা তো দিব্যি মোটেল ফেঁদে বসেছিলো। কেন আপনাকে আদ্ধেক দামে বেচে রেঙ্গুন পালালো, বুঝতে পারেন নি? আসলে ওটা একটা অভিশপ্ত বাড়ি।

ললি বললো, অভিশপ্ত বাড়ি কেন বলছে নেলী খালা?

নেলী খালা বললেন, কী জানি বাপু। সস্তায় পেয়েছি বলে সবার হয়তো গা জ্বালা করছে, তাই আর কি।

বুড়ো মুৎসুদ্দি বললেন, তাই বলুন, আমি ভেবেছিলাম আপনি বুঝি আজকালকার ছেলেদের মতো ভূত বিশ্বাস করেন না। ঠিক আছে, আমাদের মঠ থেকে আপনাকে রক্ষাকবচ এনে দেবো।

নেলী খালা হেসে বললেন, বুড়োকে নিয়ে এ এক জ্বালা! সারাক্ষণ কানের কাছে চাঁচাবেন। আবির ঠিকই বলেছে–আস্ত একখানা চিল্লানোরাস।

বুড়ো মুৎসুদ্দি একগাল হাসলেন–না, না, ধন্যবাদের কী আছে! প্রতিবেশীর যদি এটুকু উপকার না করতে পারি।

আমরা সবাই আরেক দফা কোরাসে হাসলাম। পকেট থেকে একটা চুইংগাম বের করে বুড়ো মুৎসুদ্দি টুপ করে মুখে ফেলে নেলী খালার সঙ্গে তাঁর মোটেলের গল্প জুড়ে দিলেন। নেলী খালার যে সে-সব গল্প শোনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিলো না–তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো। কিন্তু দুহাত নেড়ে বুড়ো যেভাবে চেঁচিয়ে কথা বলছিলেন, না শুনে উপায়ও ছিলো না।

আমি চোখ তুলে ললির দিকে তাকালাম। ললি আমাকেই দেখছিলো। মুখ টিপে হেসে ও বাইরের গাছপালা দেখতে লাগলো। বাবু টুনির সঙ্গে কোন ক্লাসে পড়া হয়-টয়, এ ধরনের কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। আর টুনিও ওর ঝোলানো শিং-এর মতো খোঁপা দুটো নেড়ে নেড়ে সে-সব কথার জবাব দিচ্ছে। আমার কেমন যেন ঘুম ঘুম লাগছিলো। আড়চোখে আর এক বার ললির দিকে তাকালাম। তখনো ললি পাহাড়-নদী এসব দেখছিলো। বাতাসে ওর রেশমের মতো নরোম লালচে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে। ললির চেহারা দেখে মনে হয় ওর বোধ হয় কোনো দুঃখ-টুঃখ নেই। একটু আদুরে ভাব। অথচ আমাকে আর বাবুকে দেখলেই মনে হয় আমাদের অনেক দুঃখ। একা থাকার দুঃখটা সারাক্ষণ আমাদের পেছনে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ায়। মনে মনে ভাবলাম নুলিয়াছড়িতে গিয়ে ললিকে আমার বন্ধু হতে বলবো। বাবুর মনে হয় টুনিকে ভারি পছন্দ হয়ে গেছে। ওরা দুজন হাসছিলো আর কথার ঝর্ণা বইয়ে দিচ্ছিলো। বাবু যে এত কথা বলতে পারে, আগে কখনও টের পাই নি। ললিকে মনে হলো, ও বোধ হয় চুপচাপ থাকতে ভালোবাসে। আমি নিজেও বেশি কথা বলতে পারি না।

শেষ বিকেলে আমরা কক্সবাজারে এলাম। বুড়ো মুৎসুদ্দিকে তার মোটেলে নামিয়ে দেয়া হলো। নেলী খালাকে একগাদা ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি আমাদের দিকে তাকালেন। একগাল হেসে বললেন, হায় ঈশ্বর! এই ক্ষুদে ডাকাতদের এতোক্ষণ আমার চোখেই পড়ে নি!

টুনি ফিক করে হেসে ফেললো। বললো, আগে দেখতে পেলে যে চুইংগামের ভাগ দিতে হতো! গাড়িতে ওঠার পর একটার পর একটা কেবল খেয়েই যাচ্ছেন।

চুইংগাম কথাটা বোধ হয় বুড়ো মুৎসুদ্দির কানে ঢুকেছে। বত্রিশ পাটি দাঁত দেখিয়ে–না, ভুল বললাম, ওঁর সামনের চারটা দাঁত নেই–আটাশটা দাঁত বের করে তিনি পকেটে হাত দিলেন। একগাদা চকলেট আর চুইংগাম বের করে আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, চললাম ভাই ডাকাতের দল। পরে দেখা হবে।

নেলী খালা গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। আমাকে বললেন, আবির সামনে আসবে নাকি? ললির দিকে তাকালাম। একটু হেসে বললাম, থাক নেলী খালা, এখানে বেশ আছি।

গুড বাই কক্সবাজার লেখা সাইনবোর্ডটাকে পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে গেলাম। কিছু দূর গিয়ে নেলী খালা সমুদ্রের বীচে নেমে গেলেন। বললেন, বীচ দিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি পৌঁছুতে পারবো।

সমুদ্র তখন শেষ বিকেলের সোনালি রোদের আলোতে ঝলমল করছিলো। বড়ো বড়ো ঢেউগুলো তীর থেকে ভেতরে এসে অনেক দূর পর্যন্ত নরম বালিগুলো ভিজিয়ে দিচ্ছিলো। আমাদের বাঁ পাশে খাড়া পাহাড়গুলো সোজা উঠে গেছে। পাহাড়ের মাথায় ঘরবাড়ি। ঝাউবনে শাঁ শাঁ বাতাস বইছে। বাতাসে আমাদের সবার চুল-টুল সব এলোমেলো হয়ে গেছে। ললি চুইংগাম চিবুতে চিবুতে বললো, চিল্লানোরাস মুৎসুদ্দি আসলে কিন্তু খারাপ লোক নয়।

নেলী খালা বললেন, কটা চুইংগাম পেয়েই পছন্দ হয় গেলো! আবিরের কপালটা দেখছি ভালো নয়।

লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে গেলো ললির–নেলী খালা, ভালো হবে না বলছি। আমি মুখ ফিরিয়ে সমুদ্র দেখতে লাগলাম।

হিমছড়ি পেরুনোর পর আমাদের পাহাড়ী পথ ধরতে হলো। দুপাশে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে সরু রাস্তা এঁকেবেঁকে ওপরে উঠে গেছে। কিছু দূর যাবার পর ছোট একটা বাজারের মতো মনে হলো। কয়েকটা খড়ের ঘর, দোকানপাট এইসব। লোকগুলোর চেহারা দেখে মনে হলো বার্মিজ। মেয়েরাও লুঙ্গি পরেছে। নেলী খালা বললেন, এটা নুলিয়াছড়ির হাট। আর প্রায় এক মাইল পথ যেতে হবে।

রাস্তার ওপর গজিয়ে থাকা ঘাস দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে এ পথে কেউ খুব একটা চলাফেরা করে না। চারদিক কেমন ঠাণ্ডা, সুমসাম। সন্ধে হয়ে এসেছে। দুপাশে বুনো ঝাউ আর দেবদারু বন পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে নেমে গেছে।

একটু পরে গাড়িটা পশ্চিম দিকে ছোট্ট একটা মোড় নিতেই চোখে পড়লো নেলী খালার সেই বাড়ি। পাহাড়ের মাথায় কালো ছায়ার মতো একটা দুর্গ যেন। পশ্চিমের বিশাল আকাশে লাল বেগুনি আর কালো মেঘের ঘনঘটা। সন্ধেবেলার আবছা আলোতে বাড়িটা অজানা সব রহস্য গায়ে জড়িয়ে একা গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিলো। মস্ত কাঠের গেট পেরিয়ে গাড়ি বারান্দার নিচে আসা পর্যন্ত কেউ কোনো কথাও বলতে পারলাম না।

গাড়ির শব্দ শুনে ঘেউ ঘেউ করে প্রকাণ্ড কালো শরীর আর লোমঅলা একটা কুকুর ছুটে এলো। আর হারিকেন হাতে এলো বর্মী চেহারার একটা ক্ষুদে দৈত্যের মতো লোক।

নেলী খালা মিষ্টি গলায় ডাকলেন, স্ক্যাটরা! কুকুরটা এক লাফে নেলী খালার গায়ে উঠে তার গাল-টাল সব চেটে একাকার করে দিলো। হাসতে হাসতে নেলী খালা বললেন, থাক থাক খুব হয়েছে। বাথিন, জিনিসপত্রগুলো নামিয়ে ফেলো। আবিরবা দাঁড়িয়ে আছো কেন?

ক্ষুদে দৈত্যটা আমাদের দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হাসলো। ললি ঢোক গিললো। আমি ওর কাছে এসে বললাম, চলো ললি, ভেতরে যাই।

নেলী খালা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, বড়িবি, গ্যাস লাইটগুলো জ্বালো নি কেন? বাড়িটাকে একেবারে কবর বানিয়ে রেখেছো দেখছি!

আমরা চার জন নেলী খালার পেছন পেছন ভেতরে ঢুকলাম। এক-একটা ঘর প্রকাণ্ড বড়ো। দেয়ালে বাতিদানে টিমটিমে আলো জ্বলছে। ঘর জুড়ে একটা ছায়া ছায়া ফিকে অন্ধকার। স্টাডিরুমে বসে মোটা একটা চুরুট টানছিলেন না। আমি গিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। আসার সময় মা পই পই করে নানুকে সালাম করার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। আমার দেখাদেখি বাবু, ললি আর টুনিও নানুকে সালাম করলো। নানু বললেন, তোমাদের কোনো কষ্ট হয় নি তো আবির?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, না, নানু। একটুও কষ্ট হয় নি।

নানু নেলী খালাকে বললেন, নেলী, ওদের ঘরে নিয়ে যাও। সবার চোখমুখ কেমন শুকিয়ে গেছে। আমি খাবার টেবিলে আলাপ করবো।

নেলী খালা বললেন, চলো সবাই। দোতালায় তোমাদের জন্যে দুটো রুম রেডি করে রেখেছি। সবগুলো ঘর এখনো গুছিয়ে উঠতে পারি নি। কাল থেকে তোমরা সবাই আমাকে ঘর সাজাতে সাহায্য করবে।

দোতালায় ওঠার সিঁড়ির ধাপগুলো যেমন উঁচু তেমনি চওড়া। ভারি সেগুন কাঠের সিঁড়ির বাঁকগুলোতে মিটমিটে দেয়াল-বাতি জ্বলছিলো। নেলী খালা বললেন, ইলেকট্রিসিটির জন্যে এ্যাপ্লাই করেছি। আশেপাশে কোথাও নেই বলে ঝামেলা হচ্ছে।

সিঁড়ির শেষে দোতালার লম্বা করিডোর। নেলী খালা দুটো মুখোমুখি ঘর দেখিয়ে বললেন, একটা আবির আর বাবুর, আরেকটা ললি আর টুনির। ভাগ্যিস ফার্নিচারসহ পেয়েছিলাম। নইলে এতো বড়ো বাড়ির ফার্নিচার কিনতে কিনতে আমাকে ফতুর হতে হতো। একা থাকতে ভয় করবে না তো ললি টুনি?

টুনি শুকনো গলায় বললো, না, ভয় করবে কেন? বোঝা গেলো টুনি বেশ ভয় পেয়েছে।

বাবু হেসে বললো, ভয় কী টুনি! আমরা তো কাছেই আছি।

টুনির ভয়টা ধরা পড়ে যাওয়াতে ও চটে গিয়ে বললো, থাক, বেশি বাহাদুরি করতে হবে না! দেখা যাবে কারা ভয় পায়।

ঘরের ভেতর প্রকাণ্ড একটা খাট। নতুন বিছানা পাতা। দেয়ালে একটা ডিমের মতো বড়ো আয়না। তার সামনে পেল্লাই এক কাঠের সিন্দুক। কোনায় শ্বেতপাথরের টেবিলে কালো পাথরের ফুলদানি। ফার্নিচারগুলোতে নতুন পালিশ দেয়া হয়েছে। হালকা নীল ডিসটেম্পার করা দেয়াল। ফুলদানিতে ফুলসুদ্ধো এক কামিনীর ডাল। ঠাণ্ডা মিষ্টি একটা গন্ধ সারা ঘরে ছড়িয়ে ছিলো। আমি বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে বললাম, চমৎকার নেলী খালা!

নেলী খালা এগিয়ে এসে ভারি কাঠের জানালাগুলো খুলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে এক ঝলক দমকা তাজা বাতাস আর সমুদ্রের গর্জন ভেসে এলো। আমরা চার জন জানালার ধারে ছুটে গেলাম। পাহাড়টা সোজা সমুদ্রের ভেতর নেমে গেছে। সামনে বিশাল সমুদ্র। তারার আলোতে কালো ঢেউগুলো চকচক করছে। বাবু ফিসফিস করে বললো, এতো সুন্দর বাড়ির কথা আমি ভাবতেই পারি নি।

আমি বেশ জোর গলায় ঘোষণা করলাম, নেলী খালা, এ ঘরটা আমাদের। মেয়েদের তুমি অন্য ঘরে নিয়ে যাও।

ললি, টুনি, নেলী খালার সঙ্গে বেরিয়ে গেলো। যাবার আগে টুনি আমার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটলো, আমি না দেখার ভান করে বাবুর কাছে গিয়ে বললাম, চমৎকার, তাই না বাবু!

বাবু আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, সিম্পলি মার্ভেলাস।

ঘরের পাশেই বাথরুম। বেসিন–টেসিন নেই। বড়ো বড়ো বাথটাবে তোলা পানি। আমাদের ঘরের মেঝেটা ভারি কাঠের, কিন্তু বাথরুমের মেঝে শ্বেতপাথরের। আমরা দুজন মুখ-হাত ধুয়ে চুল-টুল আঁচড়ে নিচে খাবারের ঘরে গিয়ে দেখি বিরাট এক টেবিল বোঝাই খাবার সামনে নিয়ে নানু আর নেলী খালা বসে আছেন। আমাদের দেখে বললেন, ললি টুনি এলো না? বড়িবি যাও তো, ওদের ডেকে আনন।

গ্যাস বাতির আলোতে খাবার ঘরটা বেশি উজ্জ্বল দেখাচ্ছিলো। আমরা দুটো ভারি মেহগনি কাঠের চেয়ার টেনে বসলাম। একটু পরে ললি টুনি এলো। ওরাও জামাকাপড় পাল্টে এসেছে। বাবু টুনির দিকে তাকিয়ে বললো, মেয়েদের সব কিছুতেই দেরি।

নেলী খালা খাবার বেড়ে দিতে দিতে বললেন, মেয়েদের সঙ্গে ওভাবে লাগতে যেও না বাবু। আমিও মেয়েদের দলে।

বাবু সঙ্গে সঙ্গে বললো, আপনি তো আর সাধারণ মেয়ে নন।

নেলী খালা চোখ দুটো গোল করে বললেন, একেবারে অসাধারণ বানিয়ে ফেললে?

টুনি বললো, আমিও সাধারণ মেয়েদের দলে নই।

বাবু বললো, সেটা এখনো প্রমাণ হয় নি।

ওদের কাণ্ড দেখে আমি আর ললি একসঙ্গে হেসে ফেললাম। খেতে খেতে নেলী খালা হেসে বললেন, হ্যাঁরে আবির, আমার এই বাড়ি কেনা নিয়ে শানুপা চ্যাঁচামেচি করেন নি?

আমি বললাম, করে নি আবার! বাবাও বললো, তোমার এ কাজটা নাকি ভালো হয় নি।

নেলী খালা হেসে বললেন, তোর বাবা আবার শানুপার সঙ্গে গলা মেলাচ্ছেন কেন? ওঁকে তো বেশ বুদ্ধিমান বলেই জানতাম। তবে যাই বলিস, আমি যে ঠকি নি, এখন নিশ্চয়ই তোরা বুঝতে পারছিস।

আস্ত একখানা হাঁসের মাংস মুখে পুরে আমি কোনো রকমে বললাম, সে আর বলতে!

বাবু বললো, চমৎকার হয়েছে মাছের কোপ্তাটা।

আমি খেতে খেতে নেলী খালাকে গম্ভীর হয়ে বললাম, বাবুকে আরো দুটো কোপ্তা দাও নেলী খালা।

নেলী খালা কোপ্তার বাটি বাবুর দিকে ঠেলে দিয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি বললাম, বাবুর যখন কোনো কিছুর দরকার হয়, তখন ওভাবেই বলে।

সবাই ওর দিকে তাকিয়ে একসঙ্গে হেসে উঠলো। বাবুও রাগতে গিয়ে হেসে ফেললো। বললো, এটা কোনো কথা হলো? আমি যদি বলি, ওই ঝাড়বাতিটা চমৎকার, তাহলে আমার পাতে ঝাড়বাতি তুলে দেবে নাকি! সবাই আরেক দফা হাসলো।

টুনি বললো, বলে দেখলেই হয়।

নানু প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, তবে যাই বলিস নেলী, নিজেদের জন্যে বাড়িটা চমৎকার হলেও এখানে তুই মোটেলে থাকার লোক কোথায় পাবি? এত দূর কেউ কি এখানে এসে থাকতে চাইবে?

নেলী খালা বললেন, ওসব আমার হাতে ছেড়ে দাও আব্দু। আমি অলরেডি টুরিস্ট ব্যুরোকে পাঠাবো বলে একটা প্রজেক্টের স্কীম তৈরি করে ফেলেছি।

সবশেষে পুডিং খেতে খেতে নেলী খালা বললেন, তোমাদের সবাইকে আমি কাল সকালে একটা অবাক করা সংবাদ উপহার দেবো। এখন খেয়েই ঘুমোতে যাবে।

আমরা সবাই হৈচৈ করে উঠলাম–তা হবে না নেলী খালা। এখন যদি কিছু না বলল, তাহলে আমাদের ঘুমই হবে না। এতোক্ষণ কেন বলল নি!

নেলী খালা এ ধরনের আক্রমণের জন্যে তৈরি ছিলেন না। লাজুক হেসে আমতা আমতা করে বললেন, এখনও আমি শিওর নই। তবে আমার মনে হচ্ছে, এই নুলিয়াছড়ির কোথাও বোধ হয় আমরা একটা সোনার খনি-টনির সন্ধান পেতে পারি। সোনার খনি খুঁজতে গিয়ে তোমাদের ছুটির দিনগুলো বেশি একঘেয়ে মনে হবে না। ব্যাস, এর বেশি কিছু এখন বলবো না। এতে যদি তোমাদের ঘুম হয় তবে আমি রেহাই পাই।

সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠতে উঠতে বাবু বললো, নেলী খালা যা বললেন, এ নিয়ে আলাপ করে সারারাত জেগে কাটিয়ে দেয়া যায়। একবার ভাবো তো সোনার খনি আবিষ্কার করবো আমরা। আমার মনে হচ্ছে আমরা ওয়াল্ট ডিজনীর কোনো এ্যাডভেঞ্চার ওয়ার্ল্ডে এসে পড়েছি।

ললি টুনি আমাদের গুড নাইট বলে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো । টুনিটা বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। সোনার খনি আবিষ্কারের উত্তেজনায় ওর ভয় যদি কিছুটা কাটে।

বাবু ঘরে ঢুকে বললো, কী করে ছুটি কাটাবো ভেবেই পাচ্ছিলাম না। এখন মনে হচ্ছে ছুটিটা আরো লম্বা হলে ভালো হতো।

ঘরের ভেতর এতো বাতাস যে একটু শীত শীত করছিলো। নেলী খালা অবশ্য বিছানার ওপর কম্বলও রেখে গেছেন। সারা ঘর চাঁদের আলোয় ভরে আছে। কামিনী ফুলের গন্ধ পাচ্ছিলাম। বাবু যদিও বলছিলো গল্প করে সারারাত কাটিয়ে দেবে, তবু আমরা এতো ক্লান্ত ছিলাম যে বিছানায় শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম।