০৭. বিপ্লবীদের জন্য দিদার সহানুভূতি
বাড়ি ফেরার পথে বিজু আর রামু হাসি খালাকে নিয়ে গল্প করছিলো। বিজু বললো, হাসি খালা কী চমৎকার ফুট পুডিং বানিয়েছে দেখেছিস! এখনো আমার জিভে স্বাদ লেগে আছে।
রামু বলল, হাসি খালা এখনো দেখতে কী সুন্দর! দেখে মনে হয়, ছোট কাকিমার বয়সী।
আমি চুপচাপ হাঁটতে হাঁটতে সোনিয়ার কথা ভাবছিলাম। ওর রেশমের মতো নরম চুলের ছোঁয়া, গোলাপের মতো মিষ্টি গন্ধ, কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে কথা বলা, সবকিছু মিলিয়ে আমি যেন রূপকথার কোনো জগতে চলে গিয়েছিলাম।
রামু আমার কাছে এসে বললো, সোনিয়া কিন্তু তোকেই পছন্দ করেছে। আমি দেখেছি বারবার ও আড়চোখে তোকে দেখছিলো।
আমার জামাটা বুকের কাছে যেন ছোট হয়ে গেলো। আহ্লাদে গলে গিয়ে রামুকে বললাম, এখনো কিছু বলা যায় না। তুই যে আমার চেয়ে হ্যান্ডসাম এটা সবাই জানে।
রামু সরলভাবে বলল, কিন্তু আমি যে কথা বলতে পারি না।
এখন না পারলে পরে পারবি। অনেকে বেশি কথা বলা পছন্দ করে না।
সোনিয়া কিন্তু বেশি কথা বলে।
আমার কাছে ওর বেশি কথা বলা ভালো লাগে।
রামু হেসে বললো, তোর কাছে তো ওর সবই ভালো লাগবে।
বিজু বললো, দুলালদা নিশ্চয়ই হাসি খালার কথা শুনে অবাক হয়ে যাবেন।
দুলালদার কথা শুনে আমি স্বপ্ন থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম। বললাম, দুলালদার ফিরতে নটা-দশটা বাজতে পারে। কালকের মতো খাবার ওপরে নিয়ে যেতে হবে।
রামু বললো, পচার মা ভালো করে খিড়কি দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
আমি বললাম, তাতে কী? লোহার সিঁড়ি দিয়ে নেমে খুলে রাখলেই হবে।
বাড়িতে ফিরতেই দিদা বললেন, এতক্ষণ কোথায় ছিলি? পন্টুর চিঠি এসেছে।
ঘরদোর সব গোছাতে হবে। অথচ তোরা সেই দুপুরের পর থেকে বাতাসে। মিলিয়ে গেছিস।
আমি বললাম, হাসি খালার ওখানে আমাদের চায়ের নেমন্তন্ন ছিলো। মেজদা কী লিখেছে চিঠিতে? ঘর গোছাতে হবে কেন?
দিদা একগাল হেসে বললেন, পন্টু আসছে যে! কবে চিঠি লিখেছে। সেই চিঠি পেলাম আজ দুপুরে। ও দলবল নিয়ে আসছে। এখানে নাকি ছবির সুটিং করবে।
আমরা জীবনে কখনো ছবির সুটিং দেখি নি। আমি অবশ্য কয়েকবার ঢাকা গিয়েছিলাম, কিন্তু তখন মেজদার কোনো ছবির সুটিং ছিলো না। জাফলং-এর কেউ কখনো স্যুটিং দেখেছে বলে মনে হয় না। আনন্দে আমরা তিনজন আত্মহারা হয়ে গেলাম। বিজু তো–কী মজা বলে দিদাকে জড়িয়ে ধরলো।
দিদা হাসতে হাসতে বললেন, মন্টু হাঁদার নাটক করা শিকেয় উঠেছে। সেই বিকেল থেকে তোদের বড় জেঠু ওদেরকে খাঁটিয়ে মারছে। একতলায় দুটো ঘর আর দোতালার একটা ঘর খালি করাতে হচ্ছে। হাঁদা চেয়েছিলো তোদের ঘরে থাকতে। ওর ঘরটাও খালি করতে হচ্ছে কিনা। আমি ভালোমতো বকে দিয়েছি। বলে দিদা চোখ মটকালেন।
এবার দিদাকে আমি আর রামু মিলে জড়িয়ে ধরলাম–তোমার মতো ভালো দিদা পৃথিবীতে আর দুটো নেই।
থাক অত সোহাগ দেখাতে হবে না। তোমাদের খাবার জালের আলমারিতে তোলা আছে। ওগুলো নিয়ে ওপরে চলে যাও। একগাল হেসে দিদা বললেন, বিজুর মাকে নারকোলের বরফি বানানোর জন্যে বসিয়ে দিয়েছি। আজ তো আর ওর মাথা ধরে নি যে তোমরা ওপরে গিয়ে খাবে। যাও কুয়োতলায় গিয়ে মুখহাত ধুয়ে নাও গে।
আমরা তিনজন নাচতে নাচতে কুয়োতলায় গেলাম। বিজু শ্যাওলায় পা পিছলে আছাড় খেয়েও হাসলো! পচার মা থালা বাসন ধুতে এসে বললো, মেজদা আসবেন বলে বুঝি খুব আনন্দ হচ্ছে! মা বলেছেন আজ তোমাদের রান্নাঘরে খাওয়া হবে না। ওখানে আমরা নারকোলের চিড়ে বরফি বানাবো।
বিজু বললো, তোমরা সারা রাত চিড়ে বরফি বানাও না, কে বারণ করেছে!
আমাদের জন্যে ভাত-তরকারি সবই অন্যদিনের চেয়ে অনেক বেশি ছিলো। দিদা দুপুরে হাঁড়ি কাবাব রান্না করেছিলেন। সেই অপূর্ব খাদ্যটিও আলমারিতে একবাটি আমাদের জন্যে রাখা হয়েছে। এসবই যে দিদার কাণ্ড বুঝতে আমাদের এতটুকু কষ্ট হলো না।
সবকিছু গুছিয়ে ঘরে রেখে খিড়কির দরজাটা খুলে দেয়া হলো। রামু বললো, আজ একটু দেরি করেই খাই, কী বলিস বিজু?
বিজু রান্নাঘর থেকে আসার সময় পকেটে করে দুখানা নারকেলের বরফি এনেছিলো। তাই রামুর কথায় আপত্তি করলো না। আমার তো আজ রাতে কিছু না খেলেও চলবে।
সবকিছু কেমন যেন পরিপূর্ণ মনে হচ্ছিলো। আমরা তিনজন ছাদের কার্নিশের ধারে বসেছিলাম। চাঁদের আলোয় সারা পৃথিবীটা ভেসে যাচ্ছে। ঝাউবন আর জয়ন্তিয়া পাহাড়ের গা বেয়ে চাঁদের আলো হালকা কুয়াশার সঙ্গে মিশে গিয়ে শব্দহীন স্নিগ্ধ এক ঝর্নার মতো গড়িয়ে পড়ছে। বিজু বলল, আবু চেরাপুঞ্জি যেতে চেয়েছিলি না? আমার কিন্তু এখন কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।
আমি বললাম, চেরাপুঞ্জিই যে আমাদের কাছে এসে গেছে। দুলালদা যখন বললেন, আমি চেরাপুঞ্জি থেকে আসছি, তখন মনে হয়েছিলো আমি নিজেই যেন চেরাপুঞ্জি চলে গেছি।
রামু বললো, আমরা হারিয়ে যাওয়ার ঠিকানা খুঁজছিলাম। এখন আমার মনে হচ্ছে আমি নিজের ভেতর হারিয়ে যাই।
রামুর মুখে এ ধরনের কথা শুনে আমি একটুও চমকে উঠি নি। কাল দুলালদা, আজ সোনিয়া আমাদের বয়স অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন থেকে আমরা অভিজ্ঞতার সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে যাবো আমাদের অনেকদিনের অচেনা জগতে। দুলালদা আর সোনিয়া যেন অন্তহীন সেই সিঁড়ি, যে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলে আকাশে ছোঁয়া যায়।
সাধু নিকোলাসের গির্জার ঘড়িতে নটার ঘন্টা বাজলো। আমাদের বাড়ির আলো তখন প্রায় সবই নিভে গেছে। শুধু রান্নাঘরে আলো জ্বেলে সেজ কাকিমা মেজদার জন্যে নারকেলের মিষ্টি তৈরি করছিলেন। মেজদা এসব খাবার ভারি পছন্দ করেন। আমাদের নেড়ি কুত্তো টেমিটা কয়েকবার ঘেউঘেউ করে ডাকলো। তার একটু পরেই এলেন দুলালদা।
বিজু বলল, টেমি কি আপনাকে দেখে ডাকলো নাকি দুলালদা?
দুলালদা হেসে বললেন, ওটা কি তোমাদের কুকুর? আমি আস্তে একটা ধমক দিতেই পালিয়ে গেলো।
বিজু বললো, টেমি এমনই। কাউকে ভয় পেতে দেখলেই শুধু ওর সাহস বাড়ে।
দুলালদা বললেন, নিচের দরজাটা আমি বন্ধ করে দিয়ে এসেছি।
আমি বললাম, ভালো করেছেন। আজ দরজা খোলা দিয়ে বাড়িতে রীতিমতো নাটক হয়ে গেছে।
দুলালদা ভুরু কুঁচকে বললেন, ট্রাজেডি না কমেডি?
আমরা তিনজন একসঙ্গে হেসে বললাম, কমেডি।
যাক বাঁচালে! দুলালদা হাঁফ ছেড়ে বললেন, তাহলে পরেই শুনবো। তোমাদের খাওয়া-দাওয়ার পর্ব কি মিটে গেছে?
রামু বললো, বারে, আমরা তো আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি।
দুলালদা ব্যস্ত হয়ে বললেন, বলো কী! তোমরা খেয়ে আমার জন্যে কিছু রেখে দিলেই তো পারতে! এসব ছেলেমানুষির কোনো মানে হয়?
আমি হেসে বললাম, আহ্ দুলালদা। আপনি আমাদের গেষ্ট। আপনাকে বাদ দিয়ে কি খাওয়া যায়!
দুলালদা হেসে ফেললেন–গেস্ট নয় বরং ঘোস্ট বলতে পারো। ভূতের মতো এসে তোমাদের কাঁধে চেপেছি।
বিজু মুখ টিপে হেসে বললো, সত্যি বলছি দুলালদা। আপনি যদি সত্যিকারের ভূত হতেন তাহলে আমি ভারি খুশি হতাম। ভূত দেখার ভারি সখ আমার।
দুলালদা বললেন, তাহলে তোমার উচিত ছিলো আজ আমার সঙ্গে যাওয়া। আমি খাসিয়াদের ভূত-পূজো দেখে এসেছি। ভূতকে খুশি করার জন্য যে ছাগলটি বলি দেয়া হয়েছিলো, তার মাংসও খানিকটা চেখে দেখেছি।
বিজু চোখ কপালে তুলে বললো, বলেন কী দুলালদা! দারুভুই যে আমাদের কখনো বলে নি ওরা ভূত-পূজো করে?
দুলালদা বললেন, শুধু ভূত নয়, ওরা দেবতার পূজোও করে। ওদের ঈশ্বরকে ওরা বলে উ ব্লাউ নাংথাউ। একজন দেবতার নাম উ ব্লাই উমতুং, আর একজনের নাম উ ব্লাই সংসপহ। এরকম অনেক দেবতা আছে ওদের। চলো, আগে খেয়ে নিই। পরে তোমাদের খাসিয়াদের গল্প বলবো। যাই বলো ওদের মতো ভালো, নিরীহ মানুষ আর হয় না। ভালো হওয়ার জন্য ওদের দুঃখও অনেক।
রামু বলল, আপনি মুখহাত ধুয়ে নিন। কাল ইচ্ছে করলে আপনি শাওয়ারে গোসল করতে পারবেন।
দুলালদা হেসে বললেন, একদিনে অনেক কিছু ঘটে গেছে দেখছি।
আমি বললাম, আরো দেখবেন। সারাদিন যে কত নাটক হয়েছে!
দুলালদা আগের মতো হেসে আবার বললেন, ট্রাজেডি না কমেডি?
আমরা তিনজন এক সঙ্গে জবাব দিলাম, কমেডি।
খেয়ে উঠে একটা সিগারেট ধরিয়ে দুলালদা সবেমাত্র খাসিয়াদের ভূতপূজোর গল্প শুরু করেছেন তখনই দরজার বাইরে কয়েকটা টোকা পড়লো। আমরা সবাই ভীষণরকম চমকে উঠলাম। দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দিয়েছিলাম। দুলালদা সিগারেটটা সঙ্গে সঙ্গে নিভিয়ে ফেললেন। বিজু বললো, দুলালদা এক্ষুণি আপনি খাটের তলায় লুকিয়ে পড়ুন।
দরজায় আবার টোকা পড়লো। সেই সঙ্গে দিদার গলা শুনলাম, আমাকে কতক্ষণ বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবি?
দুলালদা বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। দিদার গলা শুনে আমি মৃদু হেসে বললাম, ভয় নেই দুলালদা। দিদাকে আপনার কথা বলেছি।
রামু দরজা খুলে দিতেই দিদা ভেতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। দিদার হাতে তার মস্ত বড় পানের বাটা। দুলালদাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে, একগাল হেসে বললেন, তুমিই তো দুলাল! ছোঁড়রা তোমার যে-রকম বর্ণনা দিয়েছে তাতে হাজার লোকের ভিড়ের ভেতরও তোমাকে খুঁজে বের করে ফেলতাম।
দুলালদা মৃদু হেসে বললেন, আপনি বসুন!
দিদা আমাদের খাটের উপর বসে আস্ত একটা পান মুখে দিয়ে বললেন, বসবো বলেই তো এসেছি। তুমিও বোসো। তোমাকে সকালেই দেখেছিলাম আমি। আমার এই নাতিগুলো এমনই ভালো যে হাঁড়ি-কাবাবের লোভ দেখাতেই তোমার কথা সব বলে ফেললো। তুমি দেখছি ওদের সবই বলে দিয়েছে।
আমি বললাম, কাবাবের লোভ না দেখালেও দুলালদার কথা তোমাকে বলতাম দিদা। তোমার কাছে কোনো কথা আমরা লুকোই না।
দিদা চোখ পিটপিট করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তাহলে একটু আগে দুলালকে খাটের তলায় লুকোতে বলেছিলো কে?
বিজু লজ্জায় লাল হয়ে বললো, আমি তো ভাবলাম ছোড়দা বুঝি এলো, তুমি বললে ছোড়দা আমাদের সঙ্গে থাকতে চেয়েছে? দিদা বললেন, চেয়েছিলো। তারপর ওকে এমন বকে দিয়েছি যে, কক্ষনো তোদের ঘরে শুতে চাইবে না! যাকগে ওসব, যে-জন্যে এসেছি সেটা আগে শেষ করি। তুমি বাছা সঙের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি? খাটের ওপর পা তুলে আরাম করে বোসো। শরীরের ওপর দিয়ে তো কম ধকল যায় নি।
দুলালদা লাজুক হেসে খাটে উঠে বসলেন। দিদা পান চিবুতে চিবুতে বললেন, কিছু মনে কোরো না বাপু। তোমার কথা শোনা অব্দি সারাক্ষণ তোমাকে নিয়ে ভেবেছি। আমার কুটুও এসব করে জেলে গিয়ে পচছে। তোমরা মানুষের অবস্থা ভালো করতে চাও, দেশের মঙ্গল চাও, কুটু আমাকে সবই বলেছে। এখন তোমার কথা বলো। তুমি কী করবে ঠিক করেছো? তোমাকে পুলিস তাড়া করছে, আর তুমিও এখানে-সেখানে পালিয়ে বেড়াচ্ছো-এটা বাপু ভালো কথা নয়। আজকাল শুনি তোমাদের মতো ছেলেদের ধরলে আর জেল পর্যন্ত নেয়ার দরকার মনে করে না ওরা। পথেই নিকেশ করে দেয়। কে মেরেছে কে জানে! ওরা বলে, একদল আরেক দলকে মারছে। এটা বাছা মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। আমি বলি কী, তুমি আমাদের বাসায় থেকে যাও। আবুদের মাস্টার হয়েই না হয় থাকলে। এই এলাকায় যখন কাজ করতে চাও, এখানে থাকলে ক্ষতি কী! আমার বাড়িতে থাকলে বিশ্বাস দারোগা তোমার কেশাগ্রটিও স্পর্শ করতে পারবে না।
দিদার কথা শেষ হওয়ার পর দুলালদা কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলেন না। দিদা যে দুলালদাকে এভাবে থাকতে বলবেন এটা আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। দিদার জন্যে গর্বে বুকটা ভরে গেল।
দুলালদা একটু পরে আস্তে আস্তে বললেন, দিদা আপনার স্নেহের কথা আমি চিরকাল মনে রাখব। মা মারা যাবার পর কেউ আমার ভালোর জন্যে আপনার মতো বলে নি। কাজ আমি এখানেই করবো। আরো কয়েকদিন হয়তো আপনাদের বাসায় থাকতে পারি। তবে আপনি যেভাবে থাকতে বলছেন দিদা, সেভাবে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়! আমি গ্রামেই থাকবো। গ্রামের মানুষদের সঙ্গে আমি মিশে যেতে চাই। আজ সারাদিন ওদের সঙ্গে ছিলাম! ওদের দুঃখ-দুর্দশা যে কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে চোখে না দেখলে কল্পনাও করা যাবে না। আপনাদের বাসায় থেকে কাজ করাটা হয়তে অনেক নিরাপদের হবে। কিন্তু এখানে থেকে ওদের সঙ্গে আমি একাত্ম হতে পারবো না। একটু থেমে দুলালদা আবার বললেন, বিপদের সবরকম ঝুঁকি নিয়েই তো এত বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছি। এতদিন পরে কি বিপদের ভয়ে দায়িত্বে অবহেলা করব দিদা?
দিদা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন–তুই একেবারে কুটুর মতো কথা বলছিস দুলাল। আমি জানি তোদের বিপদের কথা বলে বেঁধে রাখা যাবে না। কুটু যাবার সময় বলে গিয়েছিলো, একজন কুটু মরলে তার বদলে হাজারটা কুটু জন্মাবে। ওরা কতজনকে মারবে? মরণকে হুকুমের চাকর শুধু তোরাই বানাতে পারিস। আমরা অকেজোরা কেবল মরণের ভয়ে আগে থাকতেই আধমরা হয়ে থাকি।
দুলালদা এবার আর কোনো কথা বললেন না। দিদার কান্না দেখে আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন করতে লাগলো। দিদা চোখ মুছে বললেন, যখন যেখানে থাকিস এই বাড়িটাকে তোর নিজের বাড়ি মনে করবি। যখন যা দরকার হবে এই বুড়িকে বলবি। আমি বেঁচে না থাকলেও ওরা থাকবে। তুই যে বললি তোর কথা কেউ ভাবে না–কথাটা সত্যি নয়রে দুলাল! তুই যাদের জন্যে কাজ করিস তারা সবাই তোর কথা ভাববে। তোর কিছু হলে ওদের কী হবে সেটাও একবার ভাবিস। আমরা যারা তোদের মতো কিছু করতে পারি না অথচ দেশের গরিব মানুষের কথা ভাবি, আমরা তোদের কথা ভুলে থাকবো তা কি হয়। কুটু আর ওর বন্ধুদের কথা ভেবে রাতে আমার ঘুম হয় না। আমি জানি এখন তোদের সময় খুব ভালো যাচ্ছে না। ঝোঁকের মাথায় কোনো কাজ করতে যাসনে। এটা তো তোকে মনে রাখতে হবে, আজকের এই অবস্থায় আসতে তোর ছবছর সময় লেগেছে। একবার তোরা কী এক সর্বনেশে খুনের নেশায় মেতে গিয়ে হাজার হাজার ছেলেকে হারালি। শুধু ভুল স্বীকার করাটাই বড় কথা নয়। সামনে যাতে ভুল না হয় সেজন্যে ভেবেচিন্তে কাজ করা উচিত।
দুলালদা মৃদু হেসে বললেন, আপনি এত কথা জানলেন কী করে দিদা? দিদা বললেন, আমার বয়সটা কি তোর চোখে পড়ছে না? এই বয়সে কম জিনিস তো আর দেখি নি! নিজের হাতে একসময় বোমার মশলাও বানিয়েছি। যাকগে ওসব কথা। তোকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়। কাল সকালে উঠেই তো আবার চোরের মতো পালাবি। দিদা পানের বাটার ভেতর থেকে একটা কাগজের ঠোঙা বের করলেন। আমাকে বললেন, এর ভেতর নারকোলের বরফি আছে। দুলালকে সকালে খেতে দিস!
আমরা তিনজন দিদার কাণ্ড দেখে শুধু অবাকই হচ্ছিলাম। দিদা খাট থেকে নেমে দুলালদার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, আজ রাতে আর ওকে গল্প শোনাবার জন্যে জ্বালাস নে।
.
০৮. একটি অপরূপ সকাল
পরদিন মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙল। ঘরের ভেতর তখনো অন্ধকার। উঠে জানালা খুলে দিলাম। আকাশের কালো রঙটা সবেমাত্র ফিকে হয়ে এসেছে। কুয়াশায় একহাত দূরের জিনিসও ভালো দেখা যাচ্ছে না।
দুলালদাকে রাতে আমরা স্প্রিং বের-করা নোংরা ডিভানে শুতে দিই নি। দুলালদা এখনো ঘুমোচ্ছেন। বিজুর লেপ গায়ে দিয়েছেন তিনি। গত বছর এরকম শীতের সময় নাকি তিনি জব্বলপুরের মার্বেল পাহাড়ে ছিলেন। ওখানকার শীতের কথা শুধু বইয়েই পড়েছিলাম। দুলালদার কাছে সেই শীতের গল্প শুনে আমরা হিম হয়ে গিয়েছি। কী অদ্ভুত জীবন দুলালদার! প্রতিটি মুহূর্তেই নতুন কিছু ঘটছে, বৈচিত্র্যে সবটুকু সময় ভরপুর হয়ে আছে। দুলালদা ঘুমের ভেতর হাসছেন! স্বপ্ন দেখছেন হয়তো। দুলালদার মতো পবিত্র চেহারার মানুষ আমি শুধু বইয়ে আঁকা ছবিতেই দেখেছি। কী রকম নিষ্পাপ হাসেন দুলালদা!
সোনিয়া একদিন আমাকে বলেছিলো, মন পবিত্র না হলে কেউ নিষ্পাপ হাসতে পারে না। সোনিয়ার হাসি যে নিষ্পাপ একথা আমি ওকে বলি নি। আমার কিছু আবিষ্কার, আমি চাই একান্তভাবে আমারই থাকুক। যেমন সোনিয়াকে আমার ভালো লাগে একথা কাউকেই বলা যাবে না। এমনকি সোনিয়াকেও নয়।
কুয়াশা না থাকলে জয়ন্তিয়া পাহাড়ের সূর্যোদয় ভারী সুন্দর লাগে। এখানো সূর্য ওঠে নি। উলের চাদরটা গায়ে দিয়ে বাইরে এলাম। সঙ্গে সঙ্গে ঘন কুয়াশার ভেতর ডুবে গেলাম। মনে হলো পৃথিবীতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। ছাদের ওপর একা একা হাঁটতে ভালো লাগছিলো। দিদা বলেন, সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে উঠে বাইরে ঘুরলে মন পবিত্র হয়। কথাটা তিনি মিথ্যে বলেন নি। সোনিয়ার কথা ভাবতে ভাবতে সেদিন ভোরে, কুয়াশার সমুদ্রে ভেসে আমি স্বর্গে চলে গিয়েছিলাম। এমনিতে স্বর্গ-নরক না থাকুক, আমাদের সবার মনের ভেতর স্বর্গের অস্তিত্ব ঠিকই আছে।
দুলালদা কখন এসে যে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন টের পাইনি। মৃদু হেসে তিনি আস্তে আস্তে বললেন, তুমি ঘুম থেকে উঠে আমাকে তুলে দাও নি কেন আবু? তোমার সঙ্গে তাহলে অনেকক্ষণ কুয়াশায় ডুবে থাকা যেতো।
আমি বললাম, আপনি স্বপ্ন দেখছিলেন দুলালদা। তাই ঘুম ভাঙাই নি। শেষ রাতের স্বপ্নগুলো সুন্দর হয়।
তুমি কী করে জানলে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম?
ঘুমের ভেতর আপনি হাসছিলেন যে! আপনার ঠোঁটও নড়ছিলো।
দুলালদা বললেন, বহুদিন পরে মা আর দীপাকে স্বপ্নে দেখলাম। স্বপ্নের ভেতর মনে হচ্ছিলো মা বারবার দীপা হয়ে যাচ্ছেন। আর দীপাকে মনে হচ্ছিলো মার মতো।
দুলালদা মৃদু হাসছিলেন। ভোরের নরম আকাশের মতো প্রশান্ত আর পবিত্র মনে হলো তাকে।
আমি দুলালদাকে হাসি খালা আর সোনিয়ার কথা বললাম। আপনার জন্যে কাঁদবার অনেক মানুষ আছে। এই বলে কথা শেষ করলাম।
দুলালদা কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বললেন হাসি খালা আর সোনিয়া সত্যিই খুব ভালো। হাসি খালাকে বোলো ওঁর কথা আমার মনে থাকবে। কয়েকদিন পরে আমি ওঁর সঙ্গে দেখা করবো।
আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম। দুলালদা বললেন, আমি এখন যাবো। তুমি কি আমাকে একটু এগিয়ে দেবে?
আমি বললাম, নিশ্চয়ই দেবো। নইলে এত ভোরে আমি কখনো উঠতাম না।
দুলালদা বললেন, খুব কষ্ট হয়েছে তাই না! শীতের ভোরে সহজে লেপের তলা থেকে বেরুতে ইচ্ছে করে না।
আমি হেসে বললাম, একবার বেরিয়ে পড়লে আর লেপের তলায় ফিরে যেতেও ইচ্ছে হয় না।
দুলালদা মৃদু হেসে বললেন, আমাদের মতো বুঝি? একবার বেরিয়ে পড়তে পারলেই হয়ে গেলো!
আমি বললাম, ঠিক আপনাদের মতো নয়। আপনি কি ইচ্ছে করলেই বাড়ি ফিরে যেতে পারবেন?
আমার কখনো সে রকম ইচ্ছে হয় না আবু।
আপনার কথা আলাদা। কিন্তু অনেকের তো ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। তখন তো ফেরার পথ বন্ধ হয়ে যায়।
ওদের প্রথমেই ভাবা উচিত। অনেকের জন্য আবার এভাবে বেরিয়ে আসাটা ঠিকও নয়। আমি একটা ঘর ছেড়ে হাজারটা ঘর পেয়েছি। এটাই আমার আনন্দ। আমি কেন নিউ আলীপুরের নিষ্প্রাণ দমবন্ধ করা সেই বাড়িতে, আমার শত্রুদের দুর্গে ফিরে যাবো?
সবাই কি আপনার মতো হতে পারে? কথাটা আমি এত আস্তে বলেছিলাম যে দুলালদা বোধহয় শুনতে পান নি।
ঘরে ঢুকে দেখি রামু আর বিজু অঘোরে ঘুমোচ্ছে। আমি দিদার দেয়া নারকেলের বরফি আর চিড়েগুলো দুলালদাকে দিলাম। ওগুলো রুমালে বেঁধে নিয়ে দুলালদা বললেন, আমি এখন যাদের বাড়িতে যাবো, ওদের বাচ্চারা এগুলো পেলে ভারি খুশি হবে। মানাতিনরা খুবই গরিব; কাল পুজো ছিল বলে ওরা চাট্টি খেতে পেয়েছিলো। নইলে অনকেদিন শুধু পাহাড়ি ঘাসের বীজ পুড়িয়ে আর সেদ্ধ করে খায়।
আমি কয়েক মুহূর্ত দুলালদার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, এক মিনিট দাঁড়ান দুলালদা। আমি আসছি।
এক ছুটে আমি নিচে চলে গেলাম। রান্নাঘরে যাওয়ার সময় দিদার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। দিদা তসবি জপছিলেন। আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেন।
আমি বললাম, আরো কিছু বরফি নেবো দিদা।
দিদা ঘাড় নেড়ে সায় জানিয়ে ওঁর ঘরের দিকে চলে গেলেন। একটা কাগজের ঠোঙায় করে কয়েক মুঠো চিড়ে আর বরফি নিলাম। সেজ কাকিমা মেজদার জন্যে এত বেশি তৈরি করেছেন যে, আরো কিছু নিলেও টের পেতেন না। বরফিগুলো এনে দুলালদাকে দিতেই তিনি হেসে বললেন, সেজ কাকিমা জানলে রাগ করবেন না?
আমি বললাম, দিদা জেনেছেন। সবকিছু সামলানোর ভার এখন দিদার ওপর।
ওঁকে বুঝি বলেছো, আমার জন্যে বরফি নিচ্ছো? আমাকে কী পেটুকই না ভাববেন তিনি!
না আপনার কথা বলি নি। দিদা নামাজ পড়ে উঠে তসবি গুনছেন। এসময় তিনি কারো সঙ্গে কথা বলেন না। আমি শুধু বলেছি বরফি নিচ্ছি।
রামু-বিজুর ঘুম সহজে ভাঙবে বলে মনে হয় না। আমি বললাম, চলুন দুলালদা, ওদের আর তুলবো না। যদিও ফিরে এলে ওদের বকুনি শুনতে হবে, তবে আপাতত মনে হচ্ছে ঘুমোনোটাই ওরা বেশি পছন্দ করছে।
দুলালদা মৃদু হেসে বললেন, বেশ তো চলো। ফেরার পথে তুমি যে একা হয়ে যাবে!
দুলালদাকে আর বলা হলো না যে, আমি ইচ্ছে করেই একা যেতে চাই। পথে সোনিয়ার সঙ্গে যদি দেখা হয়। সেই সময়টুকু শুধু আমারই জন্যে থাকুক।
আগের মতো আমরা দুজন লোহার সিঁড়ি বেয়ে নেমে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। দুলালদাকে পচার মার আবর্জনা ফেলা আর ডাকাত দেখার কথা বললাম। দিদা কীভাবে ওকে বকুনি দিয়েছেন সে কথা শুনে দুলালদা হাসতে হাসতে বললেন, দিদার কোনো তুলনা হয় না।
আকাশে ভোরের আলো আরেকটু স্বচ্ছ হলেও কুয়াশার ঘোর তখনো এতটুকু কাটে নি। নুড়ি-বিছানো পথে আমরা দুজন চুপচাপ হাঁটছিলাম। দুলালদা আমার কাঁধে হাত রেখেছেন। মনে হল আমি অনেক বড় হয়ে গেছি।
সোনিয়াদের বাড়ির কাঁচের জানালাগুলো সব বন্ধ। একটা ঘরে টেবিল ল্যাম্পের মৃদু আলো জ্বলছে। ওটা হাসি খালার ঘর। দুলালদা বললেন, এটা সোনিয়াদের বাড়ি না?
আমি বললাম, আপনার মনে আছে তাহলে! কাল ভোরে ফেরার পথে সোনিয়া আর হাসি খালাকে জানালার কাছে বসে থাকতে দেখেছিলাম। সোনিয়া আমাদের দেখেই হাত নেড়েছিলো।
দুলালদা বললেন, হাসি খালা কি লেখাপড়া জানেন?
আমি বললাম, ঢাকায় থাকতে তিনি ওখানকার এক কলেজে পড়াতেন। অনেক বই আছে ওঁর। আমাদের দিদাও বেথুনে পড়েছিলেন। অবশ্য বি এ পাশ করার আগেই দাদুর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো।
দুলালদা হেসে বললেন, আমাদের দেশের মেয়েরা কি পরীক্ষায় পাশ করার জন্যে বি এ, এম এ, পড়ে? দিদাদের সময়ে অবশ্য রান্না আর সেলাই জানলেই চলতো। গান জানলে ভালো হতো।
আমি হেসে বললাম, সেই সঙ্গে গায়ের রঙটা ঘসে দেখা হতো, দাঁতগুলো ঠুকে দেখা হতো, চুলগুলো মেপে দেখা হতো।
দুলালদা শব্দ করে হাসলেন–তুমি এত কথা জানলে কোত্থেকে?
দিদা বলেছেন। বেগুনে পড়া দিদাকেও এসব পরীক্ষায় পাশ করতে হয়েছিলো।
দুলালদা একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন–আমাদের দেশের মেয়েরা এত অসহায় যে বলার নয়। ভেবে দেখো, দিদার মতো মেয়েকেও এসব মেনে নিতে হয়েছিলো। মেয়েদের শক্তি যে ছেলেদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, এটা উপলব্ধি করতে আরো অনেক সময় লাগবে। কী অদ্ভুত নিয়ম! সোনিয়ার বাবা আরেকটা বিয়ে করলেও সোনিয়ার মাকে সব কিছু মেনে নিতে হবে!
আমি বললাম, তার চেয়েও বিচ্ছিরি ব্যাপার হচ্ছে সোনিয়ার বাবার জন্যে হাসি খালাকেই দায়ী করা হয়। অথচ হাসি খালার মতো পবিত্র মানুষ আমি খুব কম দেখেছি।
দুলালদা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আপন মনে বললেন, আমার মাকেও কম দুঃখ সইতে হয় নি।
আমি ভাবছিলাম দুলালদার কথা। তাঁর দুঃখ কি কম! যে পার্টির জন্য তিনি সব কিছু ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন, এতদিন পরে দেখেলেন সেই পার্টি ভুল কাজ করেছে। কতদিনের বন্ধুরা চোখের সামনে মরে গেছে। দুলালদা দীপার কথা বলতে গিয়ে একবার বলেছিলেন, কাজের ভেতর দিয়ে যে বন্ধুত্ব হয় সেটাই হচ্ছে আসল। আমি আর সোনিয়া যদি কখনো বিপ্লবী হয়ে যাই, যখন আমার সঙ্গে সোনিয়া ছাড়া আর কেউ থাকবে না, তখন যদি সোনিয়া মরে যায় তাহলে আমিও যে ওর সঙ্গে মরে যাবো! দুলালদা আরো অনেক কিছু সহ্য করেছেন। নেতাদের স্বার্থপরতা, পার্টি টুকরো-টুকরো হয়ে যাওয়া, নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে অবিরাম ছুটে চলা–এতকিছুর পরও দুলালদা হাসছেন, কাজ করেছেন, বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছেন। একেই তো বলে সত্যিকার অর্থে বেঁচে থাকা। দিদা ঠিকই বলেন, আমরা অকেজোরা মরার ভয়ে মারা যাবার আগেই মরে থাকি।
কমলালেবুর বাগানের শেষ প্রান্তে এসে দুলালদা বললেন, ঠিক আছে আবু, এবার আমি যেতে পারবো।
আমি বললাম, দুলালদা আপনাকে আমি ঝর্না পর্যন্ত এগিয়ে দেবো। দুলালদা মৃদু হেসে বললেন, কাল বলবে, ঝর্নার ওপারে পৌঁছে দেবো। আর পরশু বলবে জয়ন্তিয়া পাহাড়ে পৌঁছে দেবো।
আমি হেসে বললাম, ঠিক ধরেছেন দুলালদা। একদিন এভাবেই আপনার সঙ্গে বেরিয়ে পড়বো।
দুলালদা আমার কথার কোনো প্রতিবাদ না করে চুপচাপ হাঁটতে লাগলেন। নুড়ি-বিছানো পাহাড়ের ঢালু পথে নামতে দুলালদার এখনো বেশ অসুবিধে হয়। অথচ আমরা তরতর করে নেমে যাই। দুলালদাকে বললাম, আমার হাত ধরুন দুলালদা। নইলে পিছলে যাবেন।
দুলালদা আমার হাত ধরে হেসে বললেন, কাল সন্ধ্যেয় পাহাড় থেকে নামার সময় পিছলে গিয়েছিলাম। তখন মনে হয়েছে পিছলে পড়াটা খুব একটা খারাপ কিছু নয়। মজাই লাগে।
আমি বললাম, আমরা এটাকে বলি গড়িয়ে যাওয়া খেলা। এখনো মাঝে মাঝে খেলি। ছুটে এসে পাহাড়ের ঢালুতে পা ছেড়ে দেই। বেশ মজার খেলা।
দুলালদা বললেন, মজা, তবে বেশি খেললে প্যান্ট ছিঁড়ে যাবার ভয় আছে।
আমি আর দুলালদা একসঙ্গে হেসে উঠলাম। কুয়াশার পর্দা স্বচ্ছ হয়ে চোখের সামনে ঝর্নাটা যেন লাফিয়ে উঠলো। কলকল শব্দ তুলে আয়নার মতো স্বচ্ছ ঝর্নাধারাটি অবিরাম বয়ে চলেছে। বড় বড় সব পাথর ঝর্নার পানিতে মাথা উঁচু করে পড়ে আছে। নিচে রঙিন নুড়ি ছড়ানো। ঝর্নার ওপর কে যেন কুয়াশার একটুকরো ফিনফিনে চাদর বিছিয়ে রেখেছে।
দুলালদা প্যান্ট গুটিয়ে স্যান্ডেল হাতে নিয়ে বললেন, এবার কেটে পড়া আবু। পানিতে তোমার পা জমে যাবে। পানিটা এমন ঠাণ্ডা যে মনে হয় ধারালো ছুরির ওপর দিয়ে হাঁটছি।
আমি বললাম, কদিন পরে ছুরির ওপর দিয়ে হাঁটা ঠিকই অভ্যেস করে ফেলবো দুলালদা।
দুলালদা আমার কাঁধ চাপড়ে ঝর্নার পানিতে নেমে গেলেন। ঠাণ্ডার কথা ভেবে আমি নিজেই শীতে কাঁপতে লাগলাম। কুয়াশার ভেতর দুলালদা পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দূরে একটা বনমোরগ কাঁপাকাঁপা গলায় ডেকে উঠলো। মনে হলো, খাসিয়াদের গ্রামগুলো দুলালদাকে ডাকছে।
ওপরে তাকিয়ে দেখি আকাশ থেকে সাদা কুয়াশার পর্দা ঝুলছে। তার ভেতর ফ্যাকাশে সূর্যটা ভাসছে। আমাদের কমলা বাগানের চিহ্নটি কোথাও নেই। নিজেকে হঠাৎ ভীষণ একা মনে হলো। দুলালদা চলে গেলেন খাসিয়াদের গ্রামে। রামু-বিজু ঘরে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। আমার চারপাশে কোনো লোকজন নেই। ঝর্নার একটানা মৃদু শব্দ ছাড়া কোথাও এতটুকু শব্দ নেই। উত্তরের পাহাড় থেকে হু হু করে একঝলক হিমেল বাতাস চোখেমুখে আঁচড় কেটে বয়ে গেলো। আর তখনই মনে পড়লো সোনিয়ার কথা। শীত তাড়াবার জন্যে আমি সটান দৌড় দিলাম।
সোনিয়াদের বাসার কাছে এসে দেখি ও কাঠের ছোট্ট গেটটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে মিষ্টি হেসে বললো, দুলালদাকে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলি বুঝি?
আমি হেসে বললাম, তুই জানলি কী করে?
সোনিয়া বললো, আমি জানালার পাশে ছিলাম যে! দুলালদা জানালার দিকে তাকিয়েছিলেন। অবশ্য তিনি আমাকে দেখতে পান নি। আলোয় থাকলে অন্ধকারের কিছু দেখা যায় না।
আমি চেঁচিয়ে বললাম, কী চমকার কথা বললি সোনিয়া! অথচ অন্ধকারে থাকলে আমরা ঠিক আলো দেখতে পাই।
সোনিয়ার মুখে গোলাপের ছায়া পড়লো। কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। চারপাশে কুয়াশার সাদা দেয়াল তখন রোদের আলোয় দ্রুত গলে যাচ্ছে। একটা দুটো নাম-না-জানা পাখি ডাকতে শুরু করেছে। সোনিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো ও যদি দীপার মতো হতো তাহলে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে কাউকে পরোয়া করতাম না। আস্তে আস্তে সোনিয়াকে বললাম, একদিন তোকে দীপার গল্প বলবো। দুলালদার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলো দীপা।
সোনিয়া বড় বড় চোখে আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বললো, দাঁড়া, আমি এক্ষুনি আসছি।
সোনিয়া ছুটে গিয়ে লনের উপর জমে-থাকা কুয়াশায় হারিয়ে গেলো। একটু পরে আবার কুয়াশার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। ওর হাতে মস্ত বড় একটা লাল গোলাপ। কোনো কথা না বলে সোনিয়া গোলাপটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। গোলাপের মখমলের মতো নরম পাপড়িতে মুক্তোর দানার মতো শিশির লেগেছিলো। ওর হাত থেকে গোলাপটা নিয়ে বুক ভরে গন্ধ নিলাম। কাল সন্ধ্যায় এরকম এক মিষ্টি গন্ধে আমার বুকটা ভরেছিলো।
সোনিয়ার মোমের মতো গালে তখনো গোলাপের ছায়া জড়িয়ে আছে। ঠোঁট দুটো গোলাপের সদ্য ফোঁটা কলির মতো। আমি মৃদু হেসে বললাম, এটা কিসের জন্যে সোনিয়া?
সোনিয়া বলল, তুই যে এরকম দারুণ বিচ্ছিরি এক শীতের ভোরে দুলালদাকে পৌঁছে দিতে গেছিস, সেজন্য এটা তোর পাওনা ছিলো।
আমি ফিসফিস করে বললাম, সোনিয়া, এরকম সুন্দর সকাল আমার জীবনে কখনো আসে নি।
সোনিয়া মৃদু হেসে বললো, বিকেলে তোরা আসবি তো?
আমি বললাম, নিশ্চয়ই।