বহুরূপী – কিশোর উপন্যাস – শাহরিয়ার কবির
০১. শিংটোলার ছআনি দশআনি
শিংটোলার জমিদারদের নিকুঞ্জ-কুটিরের মতো বড় আর পুরোনো বাড়ি গোটা তল্লাটে দ্বিতীয়টি নেই। সেই কোম্পানির আমলের বানানো। বংশের আদিপুরুষ নিকুঞ্জ নারায়ণ রায়ের নামে এ-বাড়ি বানিয়েছিলেন তার অধস্তন চতুর্থ পুরুষ কালী নারায়ণ রায়। জয়পুর থেকে মার্বেল আনানো হয়েছিলো, কড়ি-বরগা আর দরজা-জানালার কাঠ এসেছিলো বার্মা থেকে, ঝাড়লণ্ঠন এসেছিলো ভেনিস থেকে–সে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড।
পাড়ার লোকেরা অবশ্য অনেক আজেবাজে কথা বলতো। নাকি নিকুঞ্জ নারায়ণ রায়ের বংশে ফাঁসুড়ের রক্ত আছে। যদিও কালী নারায়ণ বলতেন ইদ্রাকপুরে তাদের জমিদারি কেনা হয়েছিলো স্বপ্নে পাওয়া গুপ্তধনের টাকায়, অনেকে সেসব কথা বিশ্বাসও করতো, তবে অবিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা কোনোকালেই কম ছিলো না।
অত জাঁকজমক করে বাড়ি বানানো, লক্ষ্ণৌ থেকে বাইজি আর গানের ওস্তাদ আনিয়ে নবাবদের সঙ্গে টক্কর দেয়া–সবকিছু তিন পুরুষেই কপুরের মতো উবে গেলো। কালী নারায়ণের চতুর্থ পুরুষে এসে শরিকদের ভেতর সম্পত্তি ভাগ হলো। দেনার দায়ে বসতবাড়ি ছাড়া বাকি সবই নিলামে উঠলো। নিকুঞ্জ কুটিরের দশাও একরকম না থাকার মতোই। কোথায় গেলো ভেনিসের ঝাড়বাতি, দরজা-জানালার বর্মী-নক্সা আর দেয়ালের চকমিলান কারুকাজ! সিংহদরজার থামের ওপর বসানো সিংহ দুটোর দশাও তেমনি। একটার লেজ উড়ে গেলো কবে কেউ টেরও পেলো না, আরেকটার সামনের এক ঠ্যাং ভাঙা–দুটোরই আস্তর খসে ভেতরের সুরকি বেরিয়ে গেছে।
ইংরেজদের রাজত্ব শেষ হওয়ার পর ইতুর বড়দাদু ঠিক করলেন কলকাতা থেকে ঢাকা চলে আসবেন। ওঁদের ওয়েলেসলি স্ট্রিটের বাড়িটা প্রথমে বিক্রি করার জন্য দালাল ধরলেন। সে-সময় বাড়ি কেনার গরজ নেই কারো। উল্টোপাল্টা দাম বলার জন্য তিন তিনটে দালাল ইতুর বড়দাদুর লাঠিপেটা খেয়ে পালালো। ওঁর সঙ্গে স্কুলে পড়তেন ঢাকার নিকুঞ্জ কুটিরের ছআনি শরিকদের এক ছেলে। পরে বাপ মরার পর নিজেই মালিক হয়েছেন, তবে ঢাকার বাড়ির খোঁজখবর সামান্যই রাখতেন। এক বিটকেল নায়েব ছিলো, বাড়িতে সে ভাড়াটে বসিয়েছিলো। বছরে একবার এসে কিছু টাকা দিয়ে যেতো, বারো মাসের ভাড়া যা হওয়ার কথা তার অর্ধেকেরও কম। বলে নিকুঞ্জ কুটির নাকি ভুতুড়ে বাড়ি, বেশিদিন কোনো ভাড়াটে থাকে না, ন্যায্য ভাড়াও পাওয়া যায় না।
বাড়ি বিক্রির খবর শুনে ছআনি শরিক একদিন নিজে এলেন ইতুর বড়দাদুর সঙ্গে দেখা করতে। ভূতের কথা গোপন করে বন্ধুকে বললেন, যখন ঢাকা যাবে। ঠিক করেছো, তখন আমার বাড়িটা গিয়ে একদিন দেখে এসো। তোমার পছন্দ হলে আমি ওটার সঙ্গে তোমার এ বাড়ি বদল করতে পারি।
কথাটা ইতুর বড়দাদুর মনে ধরলো। শিংটোলার নিকুঞ্জ কুটিরের ছআনি অংশ দেখে তাঁর পছন্দও হলো। বাড়ি অনেক পুরোনো বটে, তিরিশ-চল্লিশ বছরে কোনো মিস্তিরির হাত লাগে নি, রঙও কেউ করে নি, তবে জায়গা অনেকখানি। পেছনের জমিতে আম, কাঁঠাল, নারকেল আর লিচুর গাছ আছে বেশ কয়েকটা। দেরি করলে যদি হাতছাড়া হয়ে যায়–কলকাতায় এসেই কাগজপত্র সব পাকা করে ফেললেন। ছআনি শরিকও ভূতুড়ে বাড়ির হিল্লে করতে পেরে ভারি খুশি।
শিংটোলার বাড়িতে আসার অনেক পরে ইতুদের জন্ম হয়েছে। বড়দাদু এ-বাড়িতে এসেই রঙ মেরামত সব করেছিলেন, তবু পুরোনো চেহারাটা রয়েই গেছে। পাড়ার লোকদের কাছে নিকুঞ্জ নারায়ণের বংশের সব কীর্তি-কাহিনী ইতুরা জন্মের পর থেকেই শুনছে। ইতুর দিদা ভীষণ কড়া মানুষ। বলেন, ওদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছি তো, তাই এ-বাড়ি সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলে। আসার পর থেকে বছরে কটা মিলাদ পড়াই হিসেব করেছিস? আমি তো চোখ বুজলেই দেখতে পাই সারা বাড়িতে ফেরেশতারা গিজগিজ করছে।
ইতুরা চোখ বুঝে কখনো ফেরেশতা দেখে নি ঠিক, তবে খারাপ কিছুও দেখে নি। দিদার কথা শুনে একদিন মিতু বললো, বাড়িতে তো আমরাই গিজগিজ করি দিদা। তুমি আমাদের কথা বলছো?
বড়রা সবাই দিদাকে আজরাইলের মতো ভয় পেলেও ছোটরা সবসময় ওঁর আহ্লাদ পেয়ে এসেছে। মিতুর কথায় দিদা এতটুকু রাগলেন না। মুখ টিপে হেসে বললেন, তোরা সব ইবলিশের ঝাড়। বাচ্চা থাকতে সবাই ফেরেশতা থাকে, তোরাও ছিলি একসময় এখন সব আস্ত শয়তান হয়েছিস।
ইতুর তিন দাদুর ছেলেমেয়ে–ওদের বাবা, কাকা, জ্যাঠা আর ফুপিরা মিলে আঠারো ভাইবোন। সবাই অবশ্য এ-বাড়িতে থাকে না। বড় দাদুর এক ছেলে রাঙা জেঠু অনেক আগে–সেই ইংরেজ আমলে ভূপালে গিয়ে আস্তানা গেড়েছেন, দেশে ফেরার কথা মুখেও আনেন না। বিয়ে করেছেন সেখানকার এক নামী বংশে। রাঙা জেঠিমার কথা ইতুরা কেবল বড়দের মুখে শুনেছে, চোখে দেখে নি। ওঁদের ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখা করতে গিয়েছিলো কেউ বিলেতে, কেউ আমেরিকায়। পড়ার পাট শেষ করে কেউ দেশে ফেরে নি। ভূপালে রাঙা জেঠু আর জেঠিমা বাড়িতে একগাদা কুকুর আর বেড়াল পুষ্যি নিয়ে দিব্বি আরামে দিন কাটাচ্ছেন। ইতুদের আরেক কাকা থাকেন রেঙ্গুনে। তিনিও সেখানে বর্মী বিয়ে করে থিতু হয়ে বসেছেন। এ-বাড়িতে ইতুরা কাকাতো, জ্যাঠাতো ভাইবোন মিলে ডজনখানেকের মতো। ক্লাস সিক্স-এ পড়া ইতুরই বয়সী এক গণ্ডা ভাই রয়েছে।
নিকুঞ্জ কুটিরের দশআনি শরিক ইংরেজ আমলেই কলকাতায় থাকতেন। তবে ছআনির মতো সুবিধের মক্কেল না পাওয়াতে তার অংশটুকু বহুদিন খালি পড়েছিল। ইতুরা সেখানে লুকোচুরি খেলতো। বুড়ো পাহারাওয়ালা বনমালী ওদের কিছুই বলতো না। তবে গত একমাস ধরে ও-বাড়িতে ঘষামাজার কাজ শুরু হয়েছে। সেই থেকে ওদেরও সেদিকে যাওয়া বন্ধ। কারা নাকি কিনেছে ও বাড়ি।
রোববার সকালে ইতুদের বাড়ির বাসি কাপড় নিতে এসে গিরিবালা ধোপানি দিদাকে বললো, আইজকা একটু কম দিয়েন বড়মা। আইজ ম্যালা কাপড় ঘোয়ন লাগবো।
গিরিবালার কথা শুনে ভারি অবাক হলেন ইতুর দিদা। প্রতি রোববার কাপড় নিতে এসে সবসময় ও বলে, বড়বাড়ির কাপড় বেশি না ওইলে মাইনষে কি কয় বড়মা! আঠারো খানই দিলেন? কুড়ি পুরাইয়া দ্যান না গো বড় মা! কাপড় যাই দেয়া হোক গিরিবালা সবসময় বেশি ধুতে চায়। নাকি তার পোষায় না।
ইতুর দিদা জানতে চাইলেন, আজ যে বড় কম নিতে চাইছিস গিরি! আর কোন রইসের কাপড় ধুচ্ছিস শুনি?
দোক্তাওয়ালা বড় একখিলি পান মুখে দিয়ে বুড়ি গিরিবালা বললো, আপনেরা অখনও হোনেন নাই বড়মা? দশআনি বাড়িত নতুন ভাড়াইটা আইছে। ক্যামন মানুষ আইলো দ্যাখতে গেছিলাম কাইল রাইতে। পয়লা দিনই দশআনি গিন্নিমা পঞ্চাশখানা ধরায়া দিছে।
ওমা কখন এল, দেখি নি তো! ইতুর মেজো জেঠিমা শুনে অবাক হলেন–কারা এসেছে গো গিরিবালা?
দিদা গম্ভীর হয়ে মেজো জেঠিকে বললেন, আমার কথার মাঝখানে কথা বলো কেন? আফসারউদ্দিনের ওঠার সময় হয়ে গেছে। যাও, ওর চা দিয়ে এসো।
মেজো জেঠিমা জিভ কামড়ে সরে গেলেন সামনে থেকে। দিদা বললেন, ওদের কর্তা কী করে শুনেছিস?
গিরিবালা ঢক করে পানের পিক গিলে বললো, তা কইবার পারুম না। তয় গিন্নিমা যে কী সোন্দর দেখতে! এত বয়স হইছে–মুখখানা দুম্না পিতিমার মতোন। বাড়ির বউ-ঝিরাও পরির মতোন। পোলারাও কম সোন্দর না বড়মা।
দিদার ভারি দুঃখ এ-বাড়িতে তাঁর মতো দুধে আলতায় গায়ের রঙ আর কারো নয়। মেয়েগুলো বেশিরভাগই শ্যামলা, বড় নাতনীটি যা কিছুটা ফর্শা। আর ছেলেগুলোকে কালোই বলতে হয়। দশআনির নতুন ভাড়াটেদের মেয়েরা পরির মতো শুনে তিনি খুশি হলেন না। তাঁর সাবালক নাতি রয়েছে গোটা চারেক, দুই নাতনীর বিয়ের বয়স হয়েছে। বড়টির জন্য ঘটকও লাগিয়েছেন। অপ্রসন্ন গলায় দিদা গিরিবালাকে বললেন, ও-বাড়ির কাপড় ধুয়ে যদি তোর সময় না থাকে তাহলে থাক, আমি হরিমতিকে খবর দিই। আজকাল তোর থোয়াও ঠিক হয় না।
গিরিবালা বললো, এইটা কেমুন কতা বড়মা! আপনেগো কাপড় ধুইবার পারুম না–এ-কতা কইলে আমার মুখে বিলাই মুতবো না! আপনে আমার কম উস্কার করছেন বড়মা! দরকার ওইলে ওই বাড়ির কাপড় আর ধুমু না।
গিরিবালা চলে যাওয়ার মিনিট কুড়ি পরে ছআনি শরিকের চিলেকোঠার ঘরে দেখা গেল এ-বাড়ির ইতু, মিতু, রন্টু, ঝন্টু আর ছোটনকে। পাড়ার সবাই ওদেরকে পঞ্চপাণ্ডব বলে। দিদার কাছে মহাভারতের গল্প শুনে নিজেরা সাইজমতো নাম মিলিয়ে নিয়েছে। সবার বড় মিটমিটে পাজি ছোটন হল যুধিষ্ঠির। গায়ে-গতরে বড়সড় মিতু হল ভীম, সবচেয়ে বুদ্ধিমান ইতু বলেছে সে নাকি অর্জুন আর সেজকাকার জমজ পাজি দুটো হল নকল সহদেব।
গিরিবালার অস্পষ্ট খবরের জন্য বসে থাকে নি পঞ্চ পাণ।ডব। মিতুকে নিয়ে নিজেদের কাঁচাপাকা কুল পাড়ার সুবাদে দশআনি শরিক থেকে সকালেই ঘুরে এসেছে ছোটন। ছআনির ঝাকড়া নারকেলি কুলগাছের অর্ধেক পড়েছে দশআনির বাগানে। পাড়তে হলে ওদিক থেকেই সুবিধে। পাঁচিলের উপর দাঁড়িয়ে মিতু তুমুল জোরে ডাল ঝাঁকাচ্ছিলো আর ছোটন টপাটপ করে ঝরেপড়া কুল কুড়োচ্ছিলো, তখনই দেখলো ওদের কাছাকাছি বয়সী ফ্ৰকপরা দুটি মেয়ে সদ্য চুনকাম করা দশআনি বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। বয়সে অল্প ঘোট মেয়েটা দুপাশে দুটো বেণী ঝোলানো, কাছে এসে রিনরিনে গলায় বললো, তোমরা আমাদের গাছের বরই পাড়ছ কেন? এক্ষুণি চলে যাও এখান থেকে।
সাদা রিবন দিয়ে পনিটেল চুল বাঁধা মেয়েটা ওকে চাপা গলায় বলল, এই সিমকি কী অসভ্যতা হচ্ছে, ওটা আমাদের গাছ নাকি! ওদের গাছেরটা ওরা
পাড়ছে, তুই চেঁচাচ্ছিস কেন?
সিমকি অবাক হয়ে বলল, বারে ছোটপা, তুই-ই তো বললি ওদের সঙ্গে ভাব জমানোর জন্য এভাবে ধমক দিতে! এখন যে বড় অসভ্যতা বলছিস?
সিমকি এসে যেভাবে ওকে ধমক দিয়ে কথা বলছিলো, ছোটন ভেবেছিলো শক্ত একটা জবাব দেবে। ওর পরের কথা শুনে হাসি চেপে আবার কুল কুড়োতে লাগলো। এক ফাঁকে আড়চোখে দেখলো সিমকির কথা শুনে পনিটেল-এর ফর্শা মুখ লাল হয়ে গেছে। আরো চাপা গলায় ও সিমকিকে বললো, তুই একটা হদ্দ বোকা মেয়ে সিমকি, ওদের চলে যেতে বলছিস কেন?
সিমকি বুঝে উঠতে পারলো না ও কী বলবে। অবাক হয়ে নিজের বোনকে দেখলো কিছুক্ষণ। তারপর কাছে এসে ছোটনকে বললো, এই তোমরা আমাদের সঙ্গে ভাব করবে?
ছোটন হাসি চেপে গম্ভীর হওয়ার ভান করে বলল, তোমরা কারা?
বারে, দেখ নি বুঝি, আমরা যে কাল সন্ধ্যায় এলাম! এটা তো আমাদের বাড়ি। তোমার নাম কী?
আমাদের দুটো নাম আছে, কোটা বলবো?
তোমার যেটা খুশি বলো।
আমার নাম যুধিষ্ঠির আর ওর নাম ভীম।
নাম শুনে দুই বোন হেসে গড়িয়ে পড়লো। হাসতে হাসতে পনিটেল বললো, আমাদের আগের বাড়িতে যে গোয়ালাটা দুধ দিতো ওর নাম ছিলো যুধিষ্ঠির আর
ভীম আমাদের জুতো মেরামত করতো।
মিতু রেগে গিয়ে বললো, মহাভারত পড়লে এমন অসভ্য কথা বলতে না। লোকে আমাদের পঞ্চপাণ্ডব বলে, সেজন্যে ওসব নাম বলা। আমার ডাক নাম। মিতু, ওর নাম ছোটন।
সিমকি বললো, আমার নাম–
জানি, সিমকি। বাধা দিয়ে মিতু বললো, তোমার ছোটপার নাম কী নিমকি?
সিমকি হেসে বললো, না, ওর নাম রিমকি। আমার একটা ছোট ভাই আছে। ওর নাম নিমকি!
খেতে কেমন? গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করলো ছোটন।
কাছে যেও। হাসতে হাসতে রিমকি বললো, কামড়ে দাঁত বসিয়ে দেবে। নতুন চারটে দাঁত গজিয়েছে। যা পায় তাই কামড়ায়।
মিতু বললো, ভাব করতে হলে আমাদের আরো তিনজন আছে। সবার সঙ্গে করতে হবে।
ঠিক আছে। সিমকি বললো, আমাদেরও দুটো মামাতো ভাই আছে–রাঙা আর পিটু। তোমরা দল ভারি করতে চাইলে আমরাও করতে পারি। জানো না তো রাঙার গায়ে কী জোর! রোজ দুবেলা জিমনাসিয়ামে গিয়ে ব্যায়াম করে।
মিতু কাষ্ঠ হেসে বললো, দেখা যাবে, পাঞ্জায় কে জেতে!
ছোটন জানতে চাইলো, এখানে আসার আগে তোমরা কোথায় ছিলে?
রিমকি বললো, নবরায় লেন-এ। এর চেয়ে বড় বাড়ি ছিল ওটা।
সিমকি বললো, ওটা ভাড়া বাড়ি ছিলো। এটা আমাদের নিজেদের।
রিমকি বললো ওরা কোন্ স্কুলে পড়ে, ছুটির দিনে কত মজা করে–এইসব। একটু পরে বাড়ির ভেতর থেকে ইতুদের কাজের ঝি দুখির মার মতো একজন কার মা এসে রিমকি-সিমকিকে ডেকে নিয়ে গেল।
ছোটন আর মিতু উত্তেজিত হয়ে ঘরে ফিরে সবাইকে কুল-পাড়া অভিযানের ঘটনা জানালো। ইতু সব শুনে গম্ভীর হয়ে বললো, গায়ে পড়ে ভাব জমাতে চাইছে–ভেবে দেখতে হবে অন্য কোনো মতলব আছে কিনা।
রন্টু বললো, তুই সব কিছুতেই সন্দ করিস। দুটো মেয়ে ভাব জমাতে চেয়েছে, এতে মতলবের কী হল?
ঝন্টু বললো, মেয়ে দুটো দেখতে কেমন রে!
মিতু উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, একেবারে পরির মতো!
আহ্ আস্তে বল্! চাপা গলায় ধমক দিল ছোটন। সিঁড়িতে শব্দ শুনছিস? নির্ঘাত ছোড়দি আসছে।
ক্লাস টেন-এ উঠেই ছোড়দি নিজেকে বড়দি-মেজদির মতো বড় ভাবতে শুরু করেছে। সুযোগ পেলেই ছোট ভাইগুলোর ওপর পণ্ডিতি ফলায়। ছোটন ঠিকই ভেবেছিলো। ছোড়দি এসে বললো, স্কুল ছুটি বলে লেখাপড়া সব শিকেয় তুলে এখানে বসে আড্ডা মারা হচ্ছে বুঝি!
ছোটন বিরক্ত হয়ে বললো, তোর সামনে পরীক্ষা বলে এখনই আবোল-তাবোল বকা শুরু করেছিস! ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে জানিস না বুঝি! নতুন ক্লাসে না-ওঠা পর্যন্ত কিসের পড়া শুনি?
গাছ থেকে পড়া হতে পারে। বলল মিতু।
না আকাশ থেকে পড়া। ছোড়দির কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়েছি। ফোড়ন কাটলো ইতু।
রেজাল্ট বেরোবার পর পিঠে যখন বড় জেঠুর বেতের বাড়ি পড়বে তখন বুঝবে পড়া কাকে বলে। পাকামো না করে নিচে যাও। দিদা ছোটনকে বাজার করতে ডেকেছেন।
বাজার করতে ছোটনের আপত্তি নেই। দুআনা চারআনা যা বাঁচে সেটা ওর। তবে চারআনার বেশি বাঁচলে দিদা পুরোটাই নিয়ে নেন। সেজন্যে যা-ই বাজার করুক ছোটন হুঁশিয়ার হয়ে গেছে। এখন ও চারআনার বেশি বাঁচায় না।
দিদা ক্লাস নাইনের ছোটনের হাতে বাজারের ফর্দ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, চার আনা বাঁচাবার জন্য সেদিনের মতো আবার পচা বেগুন আনিস না!
ছোড়দি ফোড়ন কাটলো, চারআনা না আটআনা বাঁচায় তুমি কি বাজারে গিয়ে দেখেছো দিদা!
বেআক্কেলে কথা বলবে না হোসেনেআরা। আমি কোন্ আহ্লাদে বাজারে গিয়ে দেখতে যাবো?
বড়দের সবাইকে দিদা পোষাকি নামে ডাকেন। যখন থেকে তিনি কাউকে পোষাকি নামে ডাকা শুরু করবেন, তখন থেকে বুঝতে হবে তারা বড় হয়ে গেছে, কথা বলতে হবে হিসেব করে। অল্প কদিন ধরে ছোড়দিকে দিদা পোষাকি নামে ডাকা আরম্ভ করেছেন।
বাজারে যাওয়ার সময় ছোটন মিতুকে সঙ্গে নিয়ে যায় ব্যাগ বয়ে আনার জন্য। এর জন্য ওকে দুপয়সার পেয়ারা নয়তো অন্যকিছু কিনে দিতে হয়। ছোটরা বাজারে যাওয়ার পর ঝন্টু ইতুকে বললো, যাবি নাকি নারকেলি পাড়তে?
ইতু ভুরু কুঁচকে বললো, ও-বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে ভাব জমানোর জন্য বুঝি তর সইছে না!
তোর সবকিছুতে বাড়াবাড়ি! এই বলে নিরীহ রন্টুকে সঙ্গে নিয়ে ঝন্টু দশআনি বাড়িতে গেল কুল পাড়তে।
ইতু রহস্যলহরী সিরিজের নতুন বইটা নিয়ে চিলেকোঠার ঘরে পড়তে বসলো। ওদের ক্লাসের বিজনের কাছ থেকে এনেছে, অর্ধেকের বেশি পড়াও হয়ে গেছে; পরশু ফেরত দিতে হবে। কয়েক পাতা পড়ে ওর মনে হল ঝন্টুর সঙ্গে যাওয়া উচিত ছিলো। আরো দুপাতা পর নায়ক যখন পাহাড়ের চূড়ায় ভিলেনের সঙ্গে লড়তে গিয়ে হঠাৎ ছিটকে পড়েছে কিনারে, কোনোরকমে একহাত দিয়ে পাথরের কার্নিশ ধরে ঝুলছে ছহাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে, তখন ইতুর মনে হলো ঝন্টুরা কী করছে দেখা দরকার। বই রেখে সে উঠে পড়লো।
ছাদের ওপর থেকে দশআনি বাড়ির বাগান পুরোটা দেখা যায়। ইতু তাকিয়ে দেখলো কুলগাছের পাশে ঘরের ওপর বসে মেয়ে দুটোর সঙ্গে জমিয়ে গল্প করছে ঝন্টুরা। হাঁদারাম রন্টুটা অসভ্যের মতো হাসছেও। রাগে ইতুর গা জ্বলে গেলো।
.
০২. দশআনির ওপর দিদার রাগ
ছোটন আর মিতু বাজারে যাওয়ার জন্য সদর দরজা দিয়ে বেরোতেই সামনে পড়ল দশআনির রিমকিদের বড়ভাই। ছোটনদের মেজদার বয়সী হবে, চব্বিশ-পঁচিশের কাছাকাছি, দেখতে মেজদার চেয়ে অনেক সুন্দর, দেব সাহিত্য কুটিরের বইয়ের ছবিতে যেমন দেখা যায়। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা থাকাতে একটু বেশি ভারিক্কি মনে হচ্ছিলো, পায়জামা-পাঞ্জাবিপরা, হাতে বাজারের থলে।
ছোটনদের দেখে অমায়িক হেসে মার্জিত গলায় যুবকটি বললো, তোমরা বুঝি এ-বাড়িতে থাকো! আমরা কাল এসেছি তোমাদের যমজ বাড়িতে।
গম্ভীর হয়ে ছোটন বললো, জানি। সকালে রিমকিদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। আপনি তখন বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন।
তাই বুঝি! কই তখন তো আমার সঙ্গে পরিচয় করতে এলে না? মিতু ফিক করে হেসে বললো, পাড়ায় যারা নতুন আসে তারাই আগে এসে পুরোনোদের সঙ্গে পরিচয় করে!
বাব্বা, এতোও জানো! ঠিক আছে, পরিচয় দিচ্ছি। আমার নাম সাইফ হায়দার চৌধুরী। দুবছর ধরে মেডিকেল কলেজে পড়াই। তিন ভাই চার বোনের ভেতর আমি সবার বড়! এই বলে রিমকির ভাই ছোটনদের দিকে হাত বাড়ালো।
ছোটনরা ওর সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজেদের পরিচয় দিলো। বললো, আপনাকে আমরা সাইফ ভাই বলবো।
সাইফ মৃদু হেসে বললো, তোমাদের খুশি। বাজারে যাচ্ছ নিশ্চয়? চলো একসঙ্গে যাই।
ছোটন বললো, আপনি কি সত্যি সত্যি ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ান?
হ্যাঁ।
আমাদের বড়দি মেডিকেলে পড়ে।
তাই নাকি! কোন্ ইয়ারে?
ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে। রেজাল্ট এখনো দেয় নি।
কী নাম বলতো?
জাহানারা তরফদার।
জাহানারা তোমাদের বড়দি? খুব ভালো করেই চিনি। ভারি লক্ষ্মী মেয়ে।
সাইফের কথা শুনে ছোটন আর মিতু একে অপরের দিকে তাকালো। বাড়িতে বড়দির ধমকের ভয়ে ওরা পালিয়ে বাঁচে না, আর তার টিচার বলছে লক্ষ্মী মেয়ে!
কথাটা বলেই ফেললো মিতু–বড়দি কিন্তু খুব রাগী।
তাই নাকি! সাইফ হেসে বললো, জাহানারাকে কিন্তু কখনো আমার রাগী মনে হয় নি। লেখাপড়ার ব্যাপারে ও খুব সিরিয়াস।
বড়দি রোজ ছ-সাত ঘণ্টা পড়ে। লেখাপড়ার ব্যাপারে সিরিয়াস–এটাও মিথ্যে নয়, তবে লক্ষ্মী মেয়ে কথাটা ওকে মানায় না।
সাইফ ওদের বাড়ির কথা আরো জানতে চাইলো। কে কী করে, আগে কোথায় ছিলো, বড় হয়ে ওরা কে কী হবে এসব মামুলি কথা। সাইফের সঙ্গে বাজার করতে গিয়ে ছোটনদের ভালো-ভালো জিনিস কিনতে হলো। চারআনা বাঁচাবার কথা আর মনে থাকলো না। বাজারে চমৎকার ভঁসা পেয়ারা উঠেছিলো। মিতু কেনার কথা বলতে ভুলে গেলো। সাইফের সঙ্গে কথা বলে ওরা দুজন অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ওর মহাভক্ত হয়ে গেলো।
বাড়ি ফেরার পর বাজার দেখে দিদা ভারি খুশি। বললেন, বাজারে আজ এত ভালো তরকারি উঠেছে কেন রে ছোঁড়ারা? নিশ্চয় কোনো রহস্য আছে?
মিতু বলল, আজ যে সাইফ ভাই আমাদের সঙ্গে বাজার করেছেন!
সাইফ ভাই আবার কে? ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলেন দিদা।
দশআনিতে কাল যারা এসেছে। জানো দিদা, সাইফ ভাই বড়দিকে ভালো করে চেনে! বড়দিদের কলেজে পড়ায়।
দিদা ধমক দিয়ে বললেন, কলেজে পড়ায় বলতে হয় না, পড়ান বলবে। আদব-কায়দা সব কি শিকেয় উঠেছে?
ভালো বাজার করার পরও মিতুর জন্য দিদার ধমক খেয়ে ছোটনের মন খারাপ হয়ে গেলো। দিদারও রাগের কারণ ছিলো। সকালে গিরিবালা ধোপানি ও-বাড়ির লোকদের সম্পর্কে যে-সব কথা বলেছে, শোনার পর থেকে দিদার মন ভালো নয়।
ছোটন আর মিতু ওপরে ওদের চিলেকোঠার ঘরে এসে দেখে ইতু একা খাটে শুয়ে আছে। পাশে অযত্নে খোলা পড়ে আছে রহস্যলহরী সিরিজের বই। ছোটন জানতে চাইলো, রন্টু ঝন্টু কোথায় গেছে?
ইতু মুখ ভার করে বললো, তোমাদের নতুন পাওয়া বান্ধবীদের সঙ্গে বসে গল্প করছে।
ওরা কি ডেকেছিলো?
ডাকলে তো কথা ছিলো না। বেহায়ার মতো নিজেরা গেছে কথা বলতে! মেয়ে দুটো ভাববে আমরা কী হ্যাংলা গায়ে পড়ে আলাপ করতে চাচ্ছি।
তা কেন ভাববে? মিতু বুঝিয়ে বললো, ওরা কখনো আমাদের হ্যাংলা ভাববে না। বন্ধুত্বের জন্য ওরা আমাদের সব শর্ত মেনে নিয়েছে। তুই যাস নি কেন?
গায়ে পড়ে কারো সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগে না।
জানিস, বাজারে যাওয়ার পথে এক কাণ্ড হয়েছে। এই বলে সাইফের সঙ্গে পরিচয়ের কথা ইতুকে সব জানালো ছোটন। বয়সে একবছরের ছোট হলেও ইতুর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় ও বুঝি স্কুল পেরিয়ে গেছে।
সাইফের কথা শুনে ইতু উঠে বসলো। বললো, বড়দিকে বলবি না?
মিতু বললো, ধমক খাবে কে, তুই?
আমার মনে হয় না বড়দি ধমক দেবে। বিজ্ঞের মতো বলল ইতু।
ছোটন বলল, চল তাহলে। আমার তো মনে হয় বড়দির ধমক থেকে বাঁচার একটা ব্যবস্থা আমরা করতে যাচ্ছি। বড়দি উল্টোপাল্টা কিছু বললে সাইফ ভাইকে বলে দেব না!
ইতুদের বড়দি ওর ঘরে বসে পেল্লাই আকারের গ্রের এ্যানাটমির বই খুলে কী যেন দেখছিলো। ছোটন নিরীহ গলায় বললো, বড়দি তুমি সাইফ ভাইকে চেনো?
ঘাড় বাঁকিয়ে বড়দি ওর দিকে তাকালো। ভুরু কুঁচকে রাগী গলায় বললো, সাইফ ভাই কে?
ডাঃ সাইফ হায়দার চৌধুরী। তোমাদের কলেজে নাকি পড়ান?
বড়দির কোঁচকানো ভুরু স্বাভাবিক হলো। গলা থেকে সমস্ত রাগ কর্পূরের মতো উবে গেলো–চিনবো না কেন? সপ্তাহে আমাদের দুটো ক্লাস নিতেন তিনি। তোরা জানিস কীভাবে?
পরিচয়ের বৃত্তান্ত শুনে বড়দির চেহারা কোমল হয়ে এলো। বলল, তিনি সত্যি সত্যি বলেছেন আমি লক্ষ্মী মেয়ে?
সত্যি বলছি বড়দি। তোমার অনেক প্রশংসা করেছেন।
আর কী বলেছে? বড়দির কান লাল হলো।
বলেছে, পড়াশোনার ব্যাপারে তুমি নাকি খুব সিরিয়াস।
মৃদু হেসে বড়দি বললো, তিনি নিজেও লেখাপড়ার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস।
মিতু বললো, সাইফ ভাইর ছোটবোন দুটোও খুব ভালো। আজ সকালে নিজে থেকে ওরা আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চেয়েছে।
ভালোই তো। নরম হেসে বড়দি বলল, সাইফ ভাইর বোন যখন নিশ্চয় খুব সুন্দর দেখতে!
একেবারে পরির মতো। উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো মিতু।
বড়দির হাবভাব দেখে ইতু খুব অবাক হলো। অনেক চেষ্টা করেও ও মনে করতে পারলো না, বড়দি কারো সঙ্গে হেসে কথা বলেছে।
বিকেলে ওরা রোয়াকে বসে এ নিয়ে অনেকক্ষণ কথা বললো। সবশেষে ইতু উপসংহার টানলো, এ কথা স্বীকার করতেই হবে, সাইফ ভাইর নামের একটা আলাদা জাদু আছে।
ছোটন বলল, জীবনেও আমি বড়দিকে হাসতে দেখি নি।
ওদের ভেতর বুদ্ধিশুদ্ধি একটু কম হলো রন্টুর। বলল, বড়দির সঙ্গে সাইফ ভাইর বিয়ে হলে দারুণ মানাবে।
ইতু ধমক দিয়ে বললো, অসভ্যের মতো কথা বলিস না রন্টু। দিদার কানে গেলে সবার পিঠের চামড়া তুলবেন।
মুখ কালো করে রন্টু বললো, আমাদের নিজেদের সব কথা দিদাকে বলতে হবে কেন? আমি–
রন্টুর কথা শেষ হলো না। সিং দরজার দিকে মুখ করে বসেছিলো মিতু। বললো, আরে, রিমকিরা আসছে যে!
সবাই ঘুরে তাকালো। রিমকি-সিমকির সঙ্গে দিদার বয়সী এক মহিলা। এত বয়স হয়েছে তবু কী সুন্দর দেখতে! রিমকি এগিয়ে এসে বললো, আমাদের নানি তোমাদের দিদার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছেন।
সবার পেছনে ছিল রিমকিদের কাজের বুয়া বেদানার মা। হাতে মিষ্টির দুটো হড়ি। ইতুরা উঠে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে বললো, স্লামালেকুম!
রিমকির নানি মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন। বেদানার মা একগাল হেসে বললো, ওয়ালাইকুম সালাম। কী লক্ষ্মী সব পোলাপাইন। তোমাগো দাদিআম্মা কই গো?
ওরা রিমকিদের ভেতরে নিয়ে গেলো। যেতে যেতে রিমকি ইতুকে বললো, তুমি বুঝি অর্জুন?
ইতু গম্ভীর হয়ে বলল, আমার নাম ইখতিয়ারউদ্দিন খান তরফদার।
জানি। মুখ টিপে হেসে রিমকি বললো, সারাক্ষণ তুমি বই নিয়ে পড়ে থাকো, আর ক্লাসে সবসময় ফার্স্ট হও। তোমার সব কথা আমি শুনেছি।
রিমকির কথা শুনে ইতুর মনটা নরম হলো। যতটা ভেবেছিলো এরা ততটা খারাপ নয়। খারাপ কেন ভালোই বলতে হবে। এত মিষ্টি নিয়ে পাড়ার কেউ কখনো ওদের বাড়িতে দেখা করতে আসে নি। ইতুর ফার্স্ট হওয়ার খবরও জেনে গেছে। বললো, ফার্স্ট হওয়া এমন কী কঠিন কাজ!
তোমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কে ফার্স্ট হতে যাবে বলো। শোনার পর থেকে ভাবছি তোমার ইংরেজি নোটের খাতাটা দেখবো। ইংরেজিতে আমার নম্বর কখনো পঞ্চাশের ওপর ওঠে না।
ঠিক আছে, কাল এসো–দেখাব।
দিদা ওঁর ঘরে ছিলেন। রিমকির নানি অমায়িক হেসে বললেন, আপনাদের নতুন প্রতিবেশী আমরা। পরিচয় করতে এলাম।
রিমকি, সিমকি এসে দিদাকে সালাম করলো। মিষ্টির হাড়ি দুটো টেবিলের ওপর রেখে বেদানার মাও রিমকিদের মতো দিদার পা ধরে সালাম করলো। দিদা কাষ্ঠ হেসে একবার বললেন, থাক বাছা থাক। আরেকবার বললেন, এত মিষ্টি আনবার কি দরকার ছিলো?
নানি বললেন, মিষ্টি মুখে দিয়ে পরিচয় করলে সারা বছর মিষ্টি কথা শুনবো।
নানিকে দিদার ঘরে রেখে ইতুরা রিমকিদের নিয়ে চিলেকোঠায় এল। বাড়ি ভাগের সময় উঁচু পাঁচিল দিয়ে ছাদও দুভাগ করা হয়েছে। ছাদে ওঠার সিঁড়ি আর চিলেকোঠা ইতুদের ভাগে পড়েছে। এত বড় ছাদ দেখে রিমকিরা বেজায় খুশি। সিমকি তো ছাদে উঠেই প্রজাপতির মতো ডানায় ভর করে এক পাক উড়ে এলো। রিমকি বললো, আহা ছাদটা যদি আমাদের হত।
ইতু বলল, রোজ এসে খেললেই হয়।
রিমকি বললো, ছোটনদের সঙ্গে বড়দার আলাপ হয়েছে বুঝি! তোমাদের বড়দিকে দেখতে হবে একবার।
ইতু বললো, বড়দি খুব রাগী মেয়ে।
রিমকি মুখ টিপে হাসলো–আমাদের দেখলে তিনি মোটেই রাগবেন না।
পৌষ মাস না আসতেই বেশ শীত পড়ে গেছে। ডিসেম্বর মাস পুরোটাই স্কুল বন্ধ। ছোটন রিমকিকে বললো, শীতে কি তোমরা পিকনিক করো?
নবরায় লেন-এর বাড়ির ভেতরে করতাম। জবাব দিলো রিমকি।
বাড়ির ভেতরে বুঝি পিকনিক করে? মুখ টিপে হাসলো মিতু। শহরের বাইরে না গেলে কিসের পিকনিক?
আমাদের ওই বাড়ির পেছনে বড় একটা আমবাগান আছে। ওখানে নিজেরা রান্নাবাড়ি করতাম।
আমরা প্রত্যেক বছর পিকনিকে যাই। ভঁট দেখিয়ে বললো মিতু তেজগাঁয়ে আমাদের একটা বাগানবাড়ি আছে। ঘোড়ার গাড়িতে যেতে দুঘণ্টা লাগে।
এ বছর যাও নি?
যাবো, এত তাড়া কিসের? ছোটন বললো, শীতটা আরো পড়ুক।
সিমকি বললো, আমাদের সঙ্গে নেবে? পিকনিকে আমরাও চাঁদা দেব।
সিমকির কথা শুনে রিমকি আর ছোটনরা একটু বিব্রত বোধ করলো। রিমকি ভাবলো বাড়িতে কারো সঙ্গে কথা না বলে হুট করে এভাবে যেতে চাওয়া ঠিক হচ্ছে না। ছোটনরা ভাবলো, দিদাকে না জানিয়ে রাজি হলে শেষে যদি দিদা বেঁকে বসেন। আমতা আমতা করে ইতু বললো, একসঙ্গে পিকনিক করলে ভালোই হবে। তবে সবকিছু ঠিক করেন দিদা আর বড় জেঠু। ওঁদের আগে বলতে হবে।
রিমকি কাষ্ঠ হেসে বললো, সিমকি এমনি বলেছে। নানি আমাদের যেতে দিলে তো!
দুখির মা এসে বললো, ম্যামানগো দাদিআম্মায় মিষ্টি খাওনের লাইগা বোলায়! চলেন গো সোন্দর মাইনষের সোন্দর মাইয়ারা।
রিমকি-সিমকি দুখির মার সঙ্গে চলে গেলো। রন্টু বললো, সবাই মিলে একসঙ্গে পিকনিকে গেলে কী মজাই না হবে!
ঝন্টু বললো, মনে হয় না দিদা রাজি হবেন।
ছোটন বললো, দিদাকে রাজি করানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
কীভাবে দিদাকে রাজি করানো যেতে পারে এ-নিয়ে ওরা অনেক জল্পনা-কল্পনা করলো। শেষে ঠিক হলো সাইফ ভাইকে দিয়ে কথাটা প্রথম বড়দিকে বলতে হবে। বড়দি সেটা দিদার কাছে পাড়বে। বড়দের ভেতর লেখাপড়ায় ভালো বলে বড়দিকে দিদা একটু বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু কখনো সেটা কাউকে বুঝতে দেন না। তবে ছোটরা অনেক কিছুই লক্ষ করে, যা বড়দের চোখে পড়ে না।
একটু পরে ছুটতে ছুটতে রিমকি-সিমকি এসে বললো, আমরা এখন যাচ্ছি। কাল সকালে বাগানে এসো।
রিমকিরা চলে যাওয়ার পর ছোটনরাও নিচে নামলো। শুধু ইতু ওর শেষ না-করা বইটা নিয়ে বসলো।
সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় নামলে প্রথমে পড়ে ঢাকা-বারান্দা। বারান্দার পাশে আগে বসার ঘর, তার পর দিদার আর অন্যসব ঘর। ছোটরা ভেবেছিলো দিদার ঘরের পাশ দিয়ে চুপিচুপি বেরিয়ে যাবে। সন্ধে হতে চলেছে, এ-সময় বাইরে যাওয়া বারণ। অথচ পিকনিকের কথাটা সাইফ ভাইকে না বললেই নয়। ছোটদের স্কুল বন্ধ থাকলেও মেডিকেল কলেজে ক্লাস হচ্ছিলো। সাইফ ভাই কালই পিকনিকের কথাটা বড়দিকে বলতে পারে। বড়দিদের ক্লাস না থাকলেও ও রোজ কলেজে যায়। নাকি যে-কোনো দিন ফল বেরোবো।
দিদা কার সঙ্গে যেন কথা বলছিলেন। ওঁর একটা কথা ছোটনদের কানে যেতেই ওরা থমকে দাঁড়ালো। দিদা বলছিলেন, ওসব হচ্ছে বড়লোকি ঢং। নাকি কুমিল্লা থেকে রসমালাই এনেছেন! কে খাবে ওসব! দিও ওই ছেঁড়াগুলোকে, আহ্লাদ করে দোতালায় নিয়ে এসেছে। নিচের বসার ঘরে বসালেই হত!
বড় ফুপি বললেন, আমার তো ভদ্রমহিলাকে ভালোই মনে হলো। বেথুন থেকে বি এ পাশ করেছেন, এতটুকু অহংকার নেই।
পড়ার নেই তো কী হয়েছে! রূপের অহংকার তো ষোলআনাই আছে। শুনলে না, হাসতে হাসতে দিব্যি বললো, আমাদের বংশে কালো কেউ নেই!
না থাকলেও কি আছে বলবে আম্মা? দেখলেনই তো নানি-নাতনি সবাই কী সুন্দর!
তোমার কি আর কোনোকালেই বুদ্ধিসুদ্ধি হবে না আকিকুননেসা? নেই তো নেই, সেটা বড় গলায় বলাটা মোটেই ভালো শোনায় না। তোমাকে আরো বলি বাছা, কিটকিটে ফর্শা হলেই যে মানুষ সুন্দর হয় যারা এমন মনে করে, তাদের সবাই বোকার হদ্দ বলে। যাক, এসব নিয়ে আলোচনা না করে রান্নাঘরে গিয়ে তোমার ছোট চাচার জন্য কখানা রুটি বানিয়ে দাও গে। ওর তো আবার তোমার রুটি ছাড়া মুখে রোচে না।
বড়ফুপি ঘর থেকে বেরোবার আগেই ছোটনরা ঝুলবারান্দায় চলে গেলো। রিমকির নানির ওপর ভীষণ রেগে আছেন দিদা–এ-কথাটা ভাবতেই ওদের পিকনিকে যাওয়ার উৎসাহ থিতিয়ে গেলো। বড় ফুপির সঙ্গে ওঁর কথা থেকে এটুকু শুধু পরিষ্কার হয়েছে ও-বাড়ির সবাই ফর্শা বলে দিদার যত রাগ। কারণ এ-বাড়িতে দিদা ছাড়া আর কেউ ও-বাড়ির ছেলেমেয়েদের মতো ফর্শা নয়।
বড় ফুপির পেছন-পেছন দিদাও যে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন ছোটনরা টের পায় নি। বারান্দায় ওদের দেখে দিদার মনে হলো এগুলোকে এখন থেকে সাবধান করে দিতে হবে। কাছে গিয়ে শান্ত গলায় বললেন, শুনলাম আজ সকালে নাকি তোমরা দশআনি বাড়িতে গিয়েছিলে? মতলব কী শুনি!
ছোটদের যখন দিদা তুমি বলেন তখন বুঝতে হবে তিনি রেগে আছেন। বেশি রেগে গেলে আপনি বলেন। দিদার কথা শুনে কাষ্ঠ হেসে ছোটন বললো, কুল পাড়তে গিয়েছিলাম।
কুল পাড়তে গিয়ে ও-বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে অত গল্প কিসের বাছা! এই বেলা সাবধান করে দিচ্ছি–যখন-তখন ও-বাড়ি যাওয়া চলবে না।
কেন দিদা? বোকার মতো প্রশ্ন করলো সাদাসিধে রন্টু।
তোমরা এখন বড় হচ্ছো! শান্ত গলায় দিদা বললেন, আমি চাই না তোমরা এমন কিছু করো, যাতে এ-বাড়ির লোকদের কারো কাছে ছোট হতে হয়!
ছোটন বললো, ওরা চাইলে তখন কথা না-বলাটাও তো অভদ্রতা হবে।
সেটা তোমরা জানো। আমি এসব পছন্দ করি না, শুধু এইটুকু মনে রাখলেই চলবে। এই বলে দিদা নিচে নেমে গেলেন।