৫-৬. আন্নাকালীর পাহাড়ে আলোর সংকেত

আন্নাকালীর পাহাড়ে আলোর সংকেত

পরদিন সকালে খাবার টেবিলে গিয়ে দেখি শ্রী গোবর্ধন আর মিস্টার ফতেউল্লা সেখানে নেই। নানু খেয়ে উঠে গেছেন। শুধু নেলী খালা স্ক্যাটরাকে বসে বসে শুকনো টোস্ট খাওয়াচ্ছেন। ললি বললো, তোমার গেস্টদের এখনো ঘুম ভাঙে নি নেলী খালা?

নেলী খালা বললেন, ওরা খুব সকালে উঠে টেকনাফ গেছে। রাতে আসতে পারে। নইলে কাল ফিরবে।

আমরা খেতে বসে গেলাম। পরিজ, টোস্ট, ডিম, মাখন টেবিলে সব স্তূপ হয়ে আছে। মনে হলো দুমাসে শরীরটা বোধহয় ডবল হয়ে যাবে। বাবু বললো, নেলী খালা, আজ আমরা পাহাড়ে বেড়াতে যাবো।

আমি আড়চোখে নেলী খালার দিকে তাকালাম। নেলী খালা মুখ টিপে হেসে বললেন, সোনার খনি খুঁজবে বুঝি?

টুনি বললো, শুধু সোনার খনি খুঁজবো কেন, আবির বলেছে পাহাড়ে নাকি হার্মাদদের লুকোনো গুপ্তধন আছে।

আমি তখন টুনিকে ধমক লাগাতে গিয়ে বিষম খেলাম। ললি ভুরু কুঁচকে টুনির দিকে তাকালো। নেলী খালা আমাকে দেখে হেসে ফেললেন–যেখানেই যাও, দুপুরের আগে ফিরে আসবে। আমি একটু হিমছড়ি যাবো। কিছু জিনিসপত্তোর কিনতে হবে।

ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে বাবু টুনিকে বললো,–তোমাকে নিয়ে আর পারা গেলো না। গুপ্তধনের কথা নেলী খালাকে বলার কী হলো শুনি?

টুনি শুধু বাবুকে খানিকটা জিব বের করে দেখালো।

বাইরে রোদ ঝলমল করছিলো। বাতাস ঠাণ্ডা বলে রোদের তাপ গায়ে লাগলো না। সে কি জোর বাতাস! ললির খোলা চুল একেবারে এলোমেলো হয়ে গেলো। টুনি রোজই ঝোলানো সিং-এর মতো দুটো খোঁপা করে। তাই ওর চুল কিছুটা ঠিক ছিলো। আমার আর বাবুর তো কথাই নেই। ললির চুলের ওপর কটা রাধাচূড়ার পাপড়ি উড়ে এসে পড়লো। আমি দেখলাম, ললির চোখের পাতা দুটো অল্প অল্প কাঁপছে। বাবু আর টুনি হাত ধরাধরি করে আমাদের আগে আগে হাঁটতে লাগলো। স্ক্যাটরা আমার পাশে হাঁটছিলো। আমরা সেই সোনাবালি নদীর দিকে যাচ্ছিলাম, যেখানে নেলী খালা তিন রত্তি সোনা পেয়েছিলেন।

নদীতে যেতে হলে পাহাড়ী পথ ছেড়ে জঙ্গলের ভেতর কিছু দূর হাঁটতে হয়, নেলী খালা পথ বলে দিয়েছিলেন।

আমরা তখন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটছিলাম। বাবু আমাকে বললো, মড়ার মাথার খুলি আঁকা কোনো গাছ চোখে পড়ে কিনা দেখো তো।

টুনি বুনোফুল, প্রজাপতি আর পাখি দেখতে দেখতে একটু পেছনে পড়ে গিয়েছিলো। বাবুর কথা ওর কানে যাওয়া মাত্র ও তিন লাফে ললির কাছে এসে গেলো। বাবু গম্ভীর হতে গিয়ে হেসে ফেললো–দিনের আলোতেও ভয়!

মড়ার খুলি আঁকা গাছের আগে সোনাবালি নদীটাই চোখে পড়লো। ঠাণ্ডা ইস্পাতের চাঁদরের মতো চকচক করছিলো নদীটা। কাছে এসে বোঝা গেলো পানিটা চুপচাপ বসে নেই–মসৃণ এক স্রোতের মতো বয়ে যাচ্ছে। আর নদীতে এতো স্বচ্ছ পানি থাকতে পারে, আগে কখনো দেখি নি। অবশ্য আমার নদী দেখা মানে বুড়িগঙ্গা আর ট্রেনে যে কটা নদী দূর থেকে চোখে পড়ে। নদীর তলায় সূর্যের আলো পড়ে সারা নদী আলো হয়ে আছে। তলায় সোনালি বালি চিকচিক করছে। এতটুকু শ্যাওলা নেই কোথাও। ছোট বড়ো অনেক রকম মাছ পরম নিশ্চিন্তে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। কয়েকটা মাছ আমাদের পায়ের শব্দ শুনে পানির ওপর মাথা তুলে দেখলো, আবার সঙ্গে সঙ্গে স্ক্যাটরার গরগর গলার শব্দ শুনে কয়েকটা বুদবুদ উড়িয়ে টুপ করে পালিয়ে গেলো।

ললি বললো, মাঝখানে খুব বেশি গভীর নয়।

টুনি গম্ভীর হয়ে বললো, তবু তুমি ডুবে যাবে।

ললি ওর কথায় কান না দিয়ে বললো, আরো হাঁটবে, না এখানে বসবে?

বাবু বললো, বসবে কি? আমরা নিশ্চয়ই পিকনিক করতে আসি নি!

আমি বললাম, কিছুক্ষণ বসা যাক বাবু। ভারি সুন্দর লাগছে। এরকম নিরিবিলি পাহাড়ী নদীর কথা শুধু বইয়ে পড়েছি।

বাবুর খুব একটা বসার ইচ্ছে ছিলো না। তবু বসলো। বিড়বিড় করে বললো, মাঝে মাঝে তোমার যে কী হয়!

আমি মনে মনে হাসলাম। ললি বসতে চাইলো বলেই তো বসলাম। ও অবশ্য বসার কথা বলে নি, তবে আমি ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম বসতে চাইছে। ললি গভীর চোখে আমার দিকে তাকালো। আমি একটু হাসলাম। টুনি ততোক্ষণে পাতলা পাথরের টুকরো নিয়ে নদীতে ব্যাঙ লাফানোর খেলা শুরু করে দিয়েছে।

আমি আর ললি একটা গাছের ছায়ায় বসেছিলাম। স্ক্যাটরা শুয়েছিলো আমাদের পাশেই। গরমে ওর জিব বেরিয়ে গেছে। নদীর ওপারে সেগুন আর বুনো ঝাউয়ের ঘন জঙ্গল। আমি ভাবছিলাম, এক দিন চার জন মিলে যদি ওই জঙ্গলে হারিয়ে যাই, তাহলে বেশ হয়। কথাটা ললিকে বলবো, এমন সময় দেখি নদীর ওপারে অনেক দূর দিয়ে দুটো লোক হনহন করে হেঁটে কোথায় যেন যাচ্ছে। ললিও ওদের দেখতে পেলো। উত্তেজিত গলায় বললো, দেখো, দেখো–আমাদের সেই লরেল হার্ডি।

ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম তাই তো, এ যে দেখি মিস্টার ফতে আর শ্রী গোবর্ধন! বাবু টুনিকে ডেকে দেখালাম। ওরা এতো অবাক হয়ে গেলো যে কিছুই বলতে পারলো না। বাবু অনেকক্ষণ পর বললো, ওরা না টেকনাফ গেছে? রাতের আগে ফিরবে না?

আমি বললাম, দেখা যাক দুপুরে ওরা খেতে আসে কিনা। যদি আসে তাহলে বুঝবো, হয়তো কোনো কারণে টেকনাফ যায় নি।

ললি বললো, টেকনাফ না গেলেও ওরা ওদিকে কোথায় যাচ্ছে?

টুনি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। বললো, চলো, আমরা এপার থেকে ওদের ফলো করি। দেখি ওরা কোথায় যায়।

টুনির কথাটা আমাদের সবারই পছন্দ হলো। টুনি একটা কাজের কথা বলেছে বটে। আমি ওর পিঠ চাপড়ে বললাম, ঠিক বলেছো টুনি। চলো, ওদের ফলো করি।

ফলো করার কথা শুনে স্ক্যাটরা কী বুঝলো জানি না। তবে ও লাফিয়ে উঠে গা ঝাড়া দিয়ে ঘনঘন লেজ নাড়তে লাগলো।

আমরা চার জন গাছের আড়ালে থেকে ওদের ফলো করতে লাগলাম। প্রথম দিকে অনেকখানি পথ দৌড়ে ওদের কাছে এসে গিয়েছিলাম। শ্রী গোবর্ধনরা বেশ জোরেই হাঁটছিলো। জায়গাটা দুটো পাহাড়ের মাঝখানে অনেকটা মালভূমির মতো। তাই গাছপালা খুব ঘন ঘন হয়ে গজিয়েছে। টুনি তো এক বার একটা বুনো লতার সঙ্গে পা আটকে ধপাস করে পড়ে গেলো। বাবু ছুটে গিয়ে টেনে তুললো ওকে। ঘাসের ভেতর পড়েছে বলে খুব একটা লাগে নি। স্ক্যাটরা শ্রী গোবর্ধনদের দেখতে পেয়েছে। এক বার জোরে ডেকে উঠতে যাচ্ছিলো, ইশারায় ওকে থামিয়ে দিয়েছি। এ ধরনের ইশারা-ইঙ্গিত স্ক্যাটরা খুব ভালো বোঝে।

টুনির পর এবার বাবুর পালা। বাবু শুধু বুনো লতায় পা আটকেই পড়লো না, সেই সঙ্গে ওর জামাটা শক্ত কাঁটা ঝোঁপের ভেতর আটকে গেলো। টানতে গেলে সুন্দর জামাটা ছিঁড়ে যাবে, তাই আমরা সবাই মিলে একটা একটা করে কাটা ছাড়িয়ে ওকে উদ্ধার করলাম। ওর হাতেও কাঁটার আঁচড় লেগেছে। কিন্তু সেদিকে মনোযোগ দেয়ার সময় নেই। শুধু টুনি কিছু ঘাস চিবিয়ে ওর হাতে লাগিয়ে দিলো। উঠে দাঁড়িয়ে দেখলাম শ্রী গোবর্ধনরা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। প্রায় পাহাড়ের কাছাকাছি।

আমরা আবার ছুটলাম। এবার আরো বেশি করে ঝোপে আটকে গেলাম। অচেনা পথে যা হয়। আমরা যখন পাহাড়ের কাছে পৌঁছলাম, তখন দেখি শ্রী গোবর্ধনরা পাহাড় বেয়ে এটা-ওটা ধরে তরতর করে ওপরে উঠে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। ওদের মতো আমরাও যদি নদীর এ পাড়ে পাহাড় বেয়ে উঠি, তাহলে ওদের সঙ্গে আমাদের দূরত্বটা অনেক বেড়ে যাবে। এক হতে পারে নদী পার হয়ে ওপারে যাওয়া। কিন্তু এদিকে নদীটা পাহাড় থেকে নামছে বলে স্রোতের বেগ খুব বেশি; মাঝে মাঝে পাথর-টাথরও গড়িয়ে পড়ছিলো।

আমরা ওদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েই ছিলাম। হঠাৎ দেখি একটা ঝাকড়া ছাতিম গাছের আড়ালে ওরা হারিয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে আমার আগের দিনের ঘটনাটা মনে পড়লো। সেই লম্বা মানুষটাও এই রকম একটা ছাতিম গাছের আড়ালে গিয়ে মিলিয়ে গিয়েছিলো। আমাদের পাহাড়টার ওপরে তাকালাম। গাছপালার মাথার ভেতর দিয়ে অনেক দূরে মেজর জাহেদের লাল টালির ছাদঅলা বাংলোটা চোখে পড়লো। বাবুকে বললাম, কিছু বুঝতে পারছো?

বাবু ললি টুনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম, কাল ঠিক এই গাছটার তলা থেকেই সেই লোকটা কপুরের মতো উবে গিয়েছিলো । আশেপাশে আর কোথাও ছাতিম গাছ নেই। ওদিকে চেয়ে দেখো, মেজরের বাড়িটা; কাল বিকেলে আমরা যেখানে গিয়েছিলাম।

ওরা সবাই এক বার ছাতিম গাছ আর এক বার মেজরের বাংলোটা দেখলো। সবাই রীতিমতো অবাক হয়ে গেছে। টুনি বললো, আমরা তাহলে মেজরের বাড়ির কাছেই আছি!

বাবু বললো, চলো, ওপরে ওঠা যাক।

আমরা সবাই পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগলাম। এ পাহাড়ে গাছপালা খুব বেশি নেই। রবারের চাষ করার জন্যে মেজর জমি-টমি পরিষ্কার করে ফেলেছেন। কয়েকজন লোক মাটি কাটছিলো। চুলের ছাঁট দেখেই বোঝা যায় এরা কারা।

ওপরে উঠে সবাই রীতিমতো ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। গেটের কাছে আগের মতো বনমালী দাঁড়িয়ে ছিলো। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম, জাহেদ মামা আছেন না?

বনমালী ভুরু কুঁচকে বললো, সে কি বাছা! তিনি তো সকালেই তোমাদের বাড়িতে গেছেন।

বাবু বললো, তাই তো, মনেই ছিলো না। আমাদের পানি খাওয়াতে পারেন বনমালী বাবু?

বনমালী এতখানি জিব কেটে বললো, তা কেন পারবো না বাছা। এসো, ঘরে এসো।

আমরা সবাই বারান্দায় হাত-পা ছড়িয়ে বসলাম।

বনমালী ফ্রীজ থেকে পানির বোতল আর তবক-মোড়া সন্দেশ বের করে দিলো। প্রত্যেকে পুরো এক বোতল পানি শেষ করে বুঝলাম আমাদের আসলে ভয়ানক তেষ্টা পেয়েছিলো। স্ক্যাটরাও এক বাটি পানি সাবাড় করে জিব বের করে গরমে হাঁপাতে লাগলো। আমি আর বাবু বাংলোর ঠাণ্ডা লাল সিমেন্টের মেঝেতে শুয়ে পড়েছিলাম। টুনি বললো, অতো শুয়ে আর কাজ নেই। দেরি করলে নেলী খালা আবার আমাদের খুঁজতে বেরুবে।

আমরা উঠে পড়লাম। স্ক্যাটরা বেচারা আরো কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে চেয়েছিলো। আমাদের হাঁটতে দেখে ও একটা হাই তুলে পেছন পেছন আসতে লাগলো।

মেজরের সঙ্গে আমাদের দেখা হলো পথে। তিনি রীতিমতো হৈচৈ করে উঠলেন–কিহে, কাল যে বললে সকালে দেখা হচ্ছে। আজ দেখি সকাল না হতেই সব হাওয়া। আমি এতোক্ষণ তোমাদের জন্যে বসে ছিলাম।

টুনি বললো, আপনার বাসা থেকে ফ্রীজের পানি আর সন্দেশ খেয়ে এলাম।

আমি বললাম, দুপুরে আপনি আমাদের সঙ্গে খাবেন ভেবেছিলাম। তাই এদিকটা ঘুরেফিরে দেখছিলাম

নেলী তাই বলছিলো। কিন্তু আমাকে খেয়েই এক জায়গায় বেরুতে হবে। এই বলে মেজর ডান চোখ টিপলেন–খবর পেলাম সন্ধ্যের দিকে ওদিকটায় কিছু শিকার-টিকার পাওয়া যাবে। যাই দেখি।

আমরা সবাই হাসলাম। ললি বললো, কাল এসে শিকারের গল্প শুনিয়ে যাবেন।

মেজর হেসে বললেন, নেলীও আমাকে ঠিক তাই বলেছে। ঠিক আছে, কাল যাবো। সকালে অন্য কোথাও পালিয়ে যেও না। চলি তাহলে।

আমরা এগিয়ে গেলাম। টুনি হঠাৎ ফিক করে হেসে বললো, আবির যে তখন মেজরকে জাহেদ মামা বললেন? উনি কি আপনার মামা?

আমি একটু আমতা আমতা করে বললাম, বারে, নেলী খালার বন্ধু তো! মামা বললে দোষ কী? তাছাড়া মেজর জাহেদ বললে বনমালী ক্ষেপে যেতো।

এখন ভাববে সত্যিই বুঝি মামা হন।

বাবু গম্ভীর হয়ে বললো, এমনও তো হতে পারে, কদিন পরে খালু হয়ে গেলেন। নেলী খালার বন্ধু যখন–!

টুনি ছুটে এসে বাবুর পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে বললো, যাঃ, কী অসভ্য! দাঁড়াও, আমি নেলী খালাকে বলে দেবো।

আমাদের নেলী খালা এক চোট বকলেন–জাহেদ এতোক্ষণ বসে রইলো তোমাদের জন্যে। এই ভরদুপুরে কেউ বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়!

আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, জাহেদ মামার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছে।

নেলী খালা রাগতে গিয়ে হেসে ফেললেন–এর ভেতর আবার মামাও বানানো হয়েছে!

টুনি ফিক করে হেসে বললো, বারে, তোমার বন্ধু যে!

নেলী খালা তখন লাল-টাল হয়ে বললেন, হয়েছে। এবার খাওয়ার পর্বটা সেরে আমাকে উদ্ধার করো।

বাবু বললো, লরেল হার্ডি এসেছিলো নেলী খালা?

নেলী খালা অবাক হয়ে বললেন, ওরা কেন আসবে? ওরা টেকনাফ গেছে, তোমাদের বলি নি?

টুনি এমন সময় তড়বড় করে বললো, জানো নেলী খালা, আমরা না—

সঙ্গে সঙ্গে বাবু টুনির কনুইতে এক রাম চিমটি কাটলো। টুনি চুপসে গিয়ে মিনমিন করে বললো, আমরা যে জাহেদ মামার বাড়িতে সন্দেশ খেয়েছি, সে কথাও বুঝি কাউকে বলতে পারবো না?

আমি আর ললি একসঙ্গে হেসে উঠলাম। বাবুও হেসে ফেললো। টুনি রেগেমেগে সিঁড়িতে ধুপধাপ পা ফেলে দোতালায় উঠে গেলো।

খেয়ে উঠে আমরা আবার আলোচনায় বসলাম। আমি বললাম, নেলী খলার গেস্ট দুজন যে নিরীহ শুঁটকির ব্যাপারি নয়, এর আরেকটা প্রমাণ পাওয়া গেলো।

টুনি বললো, নিশ্চয়ই ভীষণ পাজি লোক হবে ওরা।

বাবু পরিষ্কার জানিয়ে দিলো–লরেল হার্ডি গুপ্তধন খোঁজার জন্যেই এখানে আসুক, কিম্বা সোনার খনির লোভেই আসুক আসল রহস্যটা আমরা খুঁজে বার করবোই। আমি বাপু বড়োদের সাহায্য নিয়ে কোনো কাজ করা পছন্দ করি না।

কথাটা বাবু মন্দ বলে নি। তাছাড়া সত্যি সত্যিই যদি এসব কিছু না হয়, অর্থাৎ এই পাহাড়গুলোতে যদি সোনার খনি বা গুপ্তধন জাতীয় কিছু না পাওয়া যায়, তাহলে বড়োদের বলে শেষে ভাবি লজ্জায় পড়তে হবে। তাই এ ব্যাপারে আমরা সবাই একমত হলাম যে, বড়োদের কাউকে আমাদের তদন্তের কথা বলা যাবে না। তদন্ত কথাটা আমি এতো গভীরভাবে বলেছিলাম, ঠিক যেভাবে শার্লক হোমস তাঁর সহকারী ওয়াটসনকে বলতেন। টুনি হাসবার সুযোগই পেলো না।

আমরা ঠিক করেছিলাম বিকেলে ছাতিম গাছতলা সেই পাহাড়টায় যাবো। মালীকে ওটার কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। মালী বললো, ওটা তো আন্নাকালীর পাহাড়। ছাতিমতলায় আন্নাকালীর একটা মন্দির আছে। সেই পাহাড়ে পাকড়াশী মশাইও থাকেন।

আমাদের দরকার ছাতিমতলা। আন্নাকালী বা পাকড়াশী মশাই নয়। বিকেলে যখন বেরুতে যাবো, তখনই নেলী খালা বাধা দিলেন, উঁহু। আজ বাইরে যাওয়া হবে না। আকাশের অবস্থা দেখো নি!

বাইরে এসে দেখি আকাশের পশ্চিম কোণে দূরে সমুদ্রের ওপর এক টুকরো ভারি কালো মেঘ। তাছাড়া সারা আকাশে কোথাও সামান্য মেঘের ছায়াও নেই। আমি বললাম, ওইটুক মেঘে আর কতটুকু বৃষ্টি হবে নেলী খালা?

নেলী খালা বললেন, বৃষ্টি নয়, ঝড়। তিন নম্বর ডেঞ্জার সিগন্যাল দিয়েছে। আব্দু যদি শোনেন তোমাদের এ সময় বেরুতে দিয়েছি, তাহলে আমাকে আর আস্ত রাখবেন না।

দুপুরে বাবু টুনির উৎসাহটা ছিলো সবচেয়ে বেশি। ওদের চেহারাটা সেই কালো মেঘের মতো গম্ভীর হয়ে গেলো। আমরা চারজন বাইরে লনে গিয়ে বসলাম।

নেলী খালাদের এই পাহাড়টা আশেপাশের পাহাড়গুলোর চেয়ে বেশি উঁচু। এখানে বসে সব দেখা যায়। বিরাট লনের চারপাশটা কাঠের রেলিং দিয়ে ঘেরা। মাঝে মাঝে অবশ্য এক-আধটা রেলিং ভেঙে গেছে। আমরা একেবারে পশ্চিমের রেলিংটার ধারে বসেছিলাম। রেলিং-এর ওপাশে অল্প একটু সমান জায়গা। তারপরই পাহাড়টা একগাদা বুনো ঝাউগাছ মাথায় নিয়ে একেবারে সমুদ্রে নেমে গেছে। দেড় শ ফুটের মতো খাড়া নেমেছে। তারপর অবশ্য ধাপ আছে। তবে ইচ্ছে করলেই এখান থেকে কেউ সমুদ্রে নেমে যেতে পারবে না। আমি ছাতিম গাছতলা পাহাড়টাও খুঁজে বের করলাম। ললি বললো, আবির যে বলছিলে এ বাড়ির কোথাও গুপ্তধনের নকশা আছে কিনা খুঁজে দেখবে? আমার মনে হয় ওটা আমাদের খোঁজা উচিত।

বাবু এতোক্ষণ আনমনে ঘাসের কচি ডগা ছিঁড়ে ছিঁড়ে চিবোচ্ছিলো। ও বললো, ঠিক বলেছো ললি। আমার মনে হয় লরেল হার্ডি সেই গুপ্তধনের খোঁজেও এখানে আসতে পারে।

আমি বললাম, কথাটা আমিও ভেবেছি। বিশেষ করে ওরা যে-দুটো ঘরে আছে সে-দুটো ঘরই ভালো করে খুঁজতে হবে। নইলে বাড়ি ভর্তি এতো ঘর থাকতে ওরা ও দুটো ঘরে কেন থাকতে চাইবে।

টুনি বললো, ওরা যে বললো, ওদের হাঁপানি আছে?

বাবু বললো, হাঁপানি থাকলে কেউ ওরকম তরতর করে খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে পারে না।

আমি বললাম, ওরা ফিরে এলেই আমাদের কাজ হবে সারাক্ষণ ওদের দিকে নজর রাখা। ওদের টেকনাফ তো ওই আন্নাকালীর পাহাড়ে। বলে আঙুল তুলে দেখালাম।

বাবু বললো, এখান থেকে তো মনে হয় বেশি দূরে নয়। ওরা এলে জিজ্ঞেস করবো ওরা টেকনাফ গিয়েছিলো কিনা; কী বলো তোমরা?

ললি বললো, ওরা যদি স্বীকার করে ওরা আন্নাকালীর পাহাড়ে গিয়েছিলো, তাহলে বুঝতে হবে হয় তারা খুবই বোকা নয়তো ভালো লোক।

টুনি বললো, ভালো লোক হলে কেউ ওভাবে কথা বলে নাকি। নির্ঘাত ওরা খারাপ মতলবে এসেছে।

কালো মেঘটা কিছুক্ষণের মধ্যে পশ্চিমের সারা আকাশে ছড়িয়ে পড়লো। ললি বললো, সত্যিই তাহলে ঝড় আসছে।

আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, ঝড় তো আসবেই। জাহেদ মামাও বিপদসংকেত পেয়েছেন।

দেখতে দেখতে সারা আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেলো। ঝড়ো-বাতাস বইতে শুরু করলো। সমুদ্রটা হিংস্র হয়ে প্রচণ্ড গর্জন শুরু করে দিলো। সমুদ্রকে নিজের প্রতিপক্ষ ভেবে স্ক্যাটরাও সমানে ঘেউ ঘেউ শুরু করলো। ভাবখানা এই–একবার কাছেই এসো না বাছা, টুটিটা কামড়ে ধরবো না! নেলী খালার হাঁকডাক শুনে আমরা ঘরে ফিরে গেলাম।

জানালা-দরজা সব বন্ধ করে নানুর সঙ্গে স্টাডিতে বসে চা খেলাম। নানু বললেন, কেমন লাগছে জায়গাটা?

বাবু বললো, অদ্ভুত সুন্দর জায়গা!

টুনি বললো, রূপকথার মতো!

নানু হেসে বললেন, সবাই নেলীকে এখানে আসার জন্যে বকেছে। কিন্তু আমি বকি নি। বুড়ো বয়সে সময় কাটানোর জন্যে আমি এরকম একটা নিরিবিলি, নিঝঞ্ঝাটা জায়গাই খুঁজছিলাম।

আমি মনে মনে হাসলাম। এই জায়গাটাকে ঘিরে এত সব পাজি লোকের ষড়যন্ত্র চলছে, এ বাড়িটা, এ বাড়ির মানুষরা কেউ যে সেই ষড়যন্ত্রের বাইরে নয়–নানু যদি ঘুণাক্ষরেও টের পান, তাহলে পর দিনই নেলী খালাকে বাড়ি ছেড়ে দেয়ার নোটিশ দেবেন। কোনো রকম ঝামেলাই নানু পছন্দ করেন না।

নেলী খালা বললেন, মনে হয় মিস্টার ফতে আর শ্রী গোবর্ধন আজ রাতে ফিরবে না। যা ঝড় শুরু হয়েছে!

আমি ভাবলাম, টেকনাফ গেলে হয়তো ফিরতো না, কিন্তু যায় নি যখন ফিরতেও পারে।

শেষ পর্যন্ত ওরা এলো বটে, তবে ঝড়বৃষ্টিতে একাকার হয়ে। সারা গায়ে কাদা-টাদা লেগে সে এক দেখার মতো দৃশ্য বটে। আমরা যখন রাতের খাবার শেষ করে শুতে যাচ্ছিলাম, তখনই ওরা দুজন মূর্তিমান ঝড়ো কাক এসে হাজির হলো। স্ক্যাটরা প্রথমে চিনতে পারে নি; পরে শ্রী গোবর্ধনের ভয়ের বহর দেখে বুঝলো ইনিই কাল রাতের তিনি। হুঙ্কার ছাড়তে যাবে তখনই নেলী খালা ওকে ধমক দিয়ে ভেতরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তারপর ওদের দুজনকে বললেন, একেবারে ভিজে গেছেন দেখি! এতো রাতে না ফিরলেও পারতেন। ঝড়বৃষ্টিতে পাহাড়ী রাস্তার অবস্থা ভালো থাকে না।

শ্রী গোবর্ধন হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে বললো, ওসব আমাদের অব্যেশ আছে।

মিস্টার ফতে ওর দিকে কটমট করে এক বার তাকিয়ে খুব মোলায়েম গলায় নেলী খালাকে বললো, আমরা ফিরেছি সন্ধ্যের অল্প আগে। এতোক্ষণ হাটে বসে আলাপ করছিলাম এক মহাজনের সঙ্গে। এইটুকু পথ আসতেই এই অবস্থা।

বাবু বললো, আপনারা কি সারাদিনই টেকনাফে কাটালেন? নাকি আরও কোথাও গিয়েছিলেন?

মিস্টার ফতে বাবুকে সব কটা দাঁত দেখিয়ে বললো, আর কোথায় যাবো! টেকনাফের আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলতেই দিন কেটে গেলো। দেখে এসো এক দিন; ভারি সুন্দর জায়গা।

মিস্টার ফতের মিথ্যে বলার বহর দেখে শ্রী গোবর্ধনও হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। নেলী খালা বললেন, বাথরুমে পানি আছে। হাত-মুখ ধুয়ে খেতে আসুন।

ওরা যখন খাচ্ছিলো, আমরা চার জন তখন আমাদের ঘরে। খাবার শেষ করে ঘরে ঢুকে ওরা দরজা বন্ধ করলো–শব্দ শুনে ঠিক টের পেলাম ললিদের নিচের ঘরে মিস্টার ফতে আর আমাদের নিচের ঘরে শ্রী গোবর্ধন আস্তানা গেড়েছে।

হঠাৎ ভারি একটা কিছু সরানোর শব্দ পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমি মেঝের উপর কান পাতলাম। একটু পরে ফতের গলা শোনা গেলো আমি যাচ্ছি গোবরা। আলোটা দেখাতে ভুলিস না। আবার আগের মতো ভারি কিছু সরানোর শব্দ হলো।

শ্রী গোবর্ধন গজগজ করে বলতে লাগলো, বাব্বা! ওজন বটে একখানা! উনি তো দিব্যি আলো দেখাতে বলে গেলেন। রাতে যদি কুত্তোটা ছাড়া থাকে, তবেই আমি মরেছি।

একটু পরে চটাশ করে মশা মারার শব্দ শুনলাম। তারপরই শ্রী গোবর্ধন। বললো, ধুত্তোরি ছাই, কবে যে পাওনা-গণ্ডা নিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরবো, ঈশ্বরই জানেন। তারপর কোনে শব্দ শোনা গেলো না।

বাবুও আমার মতো কান পেতে ওদের সব কথা শুনেছে। বললো, যাই বলে কোথায় গেলো ফতে! ওর ঘরে যাবার শব্দ তো পেলাম না?

আমি বললাম, তোমরা একটু বসো। আমি দেখে আসি।

পা টিপে টিপে নিচে এসে ফতের দরজায় আস্তে করে ধাক্কা দিলাম। যা ভেবেছিলাম, তা-ই। দরজা খোলা, ঘরে ফতে নেই। দরজাটা আবার টেনে দিয়ে পাশের বাথরুমেও দেখলাম। কেউ নেই। ওপরে এসে ওদের বললাম। ললি ফিসফিস করে বললো, পাশের ঘরে যায় নি তো!

আমি বললাম, ওটার তো এখনো তালাই খোলা হয় নি।

লিল বললো, সেজন্যেই তো বলছি। ভেতরের দরজা দিয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। গুপ্তধনের নকশাটা হয়তো ও ঘরেই আছে।

আমি তখন আমাদের পাশের ঘরে গিয়ে মেঝেতে কান পাতলাম। কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। ফিরে এসে বললাম, না, ওখানে নেই। গুপ্তধনের নকশা খুঁজতে গেলে ওর চলাফেরার শব্দ অন্তত শুনতে পেতাম।

টুনি গালে হাত দিয়ে বললো, তাই তো, কোথায় গেলো তাহলে?

শ্রী গোবর্ধনের আলো দেখার জন্যে আমরা বেশ রাত অব্দি জেগে রইলাম। হঠাৎ এক সময় খুট করে ছিটকিনি খোলার শব্দ হলো। বাবু আর টুনিকে ললিদের ঘরে পাঠিয়ে দিলাম, বললাম, ওদিকটায় তোমরা নজর রাখো। আমরা এদিকে দেখছি।

ওরা চলে গেলো। আমি আর ললি অন্ধকার ঘরে বসে রইলাম। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ হলো। বুঝলাম, শ্রী গোবর্ধন ওপরে উঠছে। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখি ও দোতালায় এসেও থামলো না। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেলো। আমরা জানালার কাছে গেলাম।

বাইরে ঝড়ের বেগ কিছু কমলেও জোর বাতাস বইছিলো। তবে বৃষ্টিটা থেমে গেছে। হঠাৎ দেখি সমুদ্রের ভেতর অন্ধকারে একটা ছোট্ট আলো জ্বলে উঠলো। একটু পরে আবার নিভে গেলো। আবার জুললো। কয়েক বার এরকম করে শেষে একেবারে নিভে গেলো।

কিছুক্ষণ পর সিঁড়িতে শ্রী গোবর্ধনের পায়ের শব্দ শুনলাম। সিঁড়িতে দেয়াল-বাতি জ্বলছিলো। দরজাটা একটু ফাঁক করে দেখলাম, ওর হাতে বিরাট লম্বা একটা টর্চ। টর্চ যে কখনো এতো লম্বা হতে পারে, আমার ধারণা ছিলো না। ও বিড়বিড় করে বলছিলো, ভাগ্যিস কুত্তোটা টের পায় নি। কালকের রাতটা এভাবে কাটাতে পারলে বাঁচি।

নিচের ঘরে ঢুকে শ্রী গোবর্ধন ছিটকিনি লাগিয়ে দিলো। একটু পর বাবু আর টুনি উত্তেজিত গলায় বললো, কিছু দেখেছো তোমরা?

আমি ফিসফিস করে বললাম, আস্তে। তোমরা কী দেখলে?

টুনি বললো, আলো দেখেছি।

বাবু বললো, দূরের সেই ছাতিম গাছতলা আন্নাকালীর পাহাড়ে আলো জ্বলতে দেখেছি। একটা আলো কয়েক বার জ্বললো আর নিভলো। বেশ কিছুক্ষণ এ রকম করেছিলো।

টুনি বললো, কিন্তু গোবরটা কোত্থেকে আলো দেখালো? তোমরা কিছু দেখলে?

এরপর আমি আমাদের দেখার কথা বললাম, শ্রী গোবর্ধনের হাতে বিরাট টর্চ ছিলো। ও ছাদে গিয়ে আলো দেখিয়েছে।

বাবু বললো, আমরা ছাদের দিকেও দেখেছিলাম। কই, সেখানে তো কোনো আলো দেখি নি!

আমি বললাম, সোজা আকাশের দিকে আলো দেখালে তুমি এখান থেকে দেখতে পাবে না। কিন্তু ওই পাহাড় আর সমুদ্র থেকে ঠিকই দেখা যাবে।

একটু পরে নিচের ঘরে ঘর্ঘর শব্দ হলো। মনে হলো শ্রী গোবর্ধন ভারি কিছু নিয়ে টানা-হাচড়া করছে। মেঝেতে কান পাতলাম। শ্রী গোবর্ধন বললো, কিরে ফতে, পেলি কিছু?

ফতে জবাব দিলো, না, কাল পাবো।

এরপর ছিটকিনি খোলার শব্দ হলো। বোঝা গেলো ফতে এতক্ষণে ওর নিজের ঘরে গেছে।

সে রাতে আমরা কেউ ভালোমতো ঘুমোতে পারলাম না। আমি শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম–কালও তাহলে ওরা আলো দেখাবে। মনে মনে ঠিক করলাম–কাল সকাল থেকে পুরোদমে তদন্ত শুরু করবো।

.

০৬. আমাদের তদন্ত শুরু হলো

ঘুম থেকে উঠে যখন নিচে এলাম, তখন নেলী খালা বললেন, বাব্বা, এতো ঘুমোতে পারো তোমরা! আমি দুবার ডাকতে গিয়েছিলাম তোমাদের। সবার নাস্তা খাওয়া হয়ে গেছে। তোমরা চার মূর্তিই শুধু বাকি।

বাবু বললো, খুব বেশি দেরি করেছি কি নেলী খালা?

নেলী খালা তাঁর হাত-ঘড়িটা দেখে হেসে ফেললেন–মাত্র সাড়ে নটা বাজে! খুব বেশি আর দেরি কোথায়?

টেবিলে বসে খেতে খেতে আমি বললাম, তোমার গেস্টরা কী করছে নেলী খালা?

নেলী খালা বললেন কী আর করবে! সকাল থেকে দুজন ঘরে বসে আছে। বললো, বৃষ্টিতে ভিজে নাকি ওদের গা ম্যাজম্যাজ করছে। এ বেলা আর বেরুবে না।

টুনির তখনো দুচোখ ভরা ঘুম। নেলী খালা বললেন, টুনি, আরেকটা ডিম নাও।

টুনি ঢুলঢুলু চোখে বললো, কখন গেলাম।!

নেলী খালা একটু অবাক হয়ে বললেন, তোমাকে ডিম নিতে বলছি টুনি!

টুনি বাবুর পাতে একটা ডিম তুলে দিলো। নেলী খালা তখন ললিকে বললেন, টুনি কি কাল সারা রাত ঘুমোয় নি ললি?

ললি বললো, আমি তো সারা রাতই ঘুমিয়েছি নেলী খালা।

নেলী খালা তখন রেগেমেগে লেস বুনতে শুরু করলেন। গজগজ করতে করতে বললেন, বুঝেছি, রাতে তোমরা কেউ ঘুমোও নি।

স্ক্যাটরা এমন সময় সুর করে–ঘেউ-উ বলে কাউকে অভ্যর্থনা জানালো। তাকিয়ে দেখি জাহেদ মামা। হাতে একখানা চিঠি। বললেন, সুখবর নেলী! জিওলজিক্যাল সার্ভে থেকে তোমার চিঠি এসেছে।

সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ঘুমঘুম ভাব আর নেলী খালার রাগ কর্পূরের মতো উবে গেলো। একগাল হেসে নেলী খালা বললেন, বসো, এক কাপ কোকো খাও। কী লিখেছে ওরা?

তাহলে পড়ে শোনাই? এই বলে একটা চেয়ার টেনে বসে জাহেদ মামা চিঠিটা খুললেন–শোনো সবাই, প্রিয় মহাশয়া, আপনার পত্র পাঠে অবগত হইলাম যে, আপনি অনুমান করিতেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে স্বর্ণের খনি আবিষ্কারের সমূহ সম্ভাবনা রহিয়াছে এবং ব্যাপক অনুসন্ধান করা আবশ্যক। অত্র অঞ্চলের একটি নদীর বালি হইতে আপনি কিছু পরিমাণ স্বর্ণ উদ্ধারও করিয়াছেন। স্বাধীনতার পূর্বে উক্ত অঞ্চলে কিঞ্চিৎ জরিপ হইলেও বর্তমানে উহার ব্যাপক ভূতাত্ত্বিক জরিপ কার্য চালানো আবশ্যক। এ বিষয়ে আমরা একটি পরিকল্পনাও গ্রহণ করিয়াছি। দুই-তিন দিনের মধ্যে ওই অঞ্চলে আমরা তৈল অনুসন্ধানের জন্য একদল ভূতত্ত্ববিদকে পাঠাইতেছি। তাহাদের সঙ্গে দুই জনকে স্বর্ণ অনুসন্ধানের জন্য পাঠানো হইতেছে। আপনার পরামর্শ ও সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ। আশা করি ভবিষ্যতেও আপনার মুল্যবান পরামর্শ হইতে আমরা বঞ্চিত হইব না। ভবদীয়–নামটা পড়া যাচ্ছে না, পরিচালক বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ।

চিঠি পড়া শেষ করে জাহেদ মামা নেলী খালার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমিও কি এরকম ভাষায় ওদের লিখেছিলে?

নেলী খালা সে-কথায় কান না দিয়ে একটু উত্তেজিত গলায় বললেন, তোমার কি মনে হয় জাহেদ, এখানে সোনার খনি পাওয়া যাবে?

জাহেদ মামা হেসে বললেন, সম্ভাবনাটাকে এরা একেবারে উড়িয়ে দেয় নি। আর হলে তো তোমারই লাভ। সী ভিউ প্যালেস সারা মাস গেস্ট-ভর্তি থাকবে।

নেলী খালা লজ্জায় লাল হয়ে বললেন কী যে বলো! নাও, কোকোটা ঢেলে খাও।

গত রাতে আমি স্বপ্নে দেখেছি, এখানে সত্যিই সোনার খনি আছে। আর কে যেন সেখান থেকে গোপনে সব সোনা সরিয়ে ফেলেছে। আমরা যখন খনিটা আবিষ্কার করলাম, তখন এক রত্তি সোনাও আমাদের জন্যে সেখানে পড়ে নেই। শুনলে ওরা সবাই হাসাহাসি করবে বলে স্বপ্নের কথা আমি কাউকে বলি নি। জিওলজিক্যাল সার্ভের চিঠিখানা আমি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলাম। সোনার খনি আবিষ্কার করে ফেলেছি ভেবে দারুণ উত্তেজনা হলো।

বাবু জাহেদ মামাকে বললো, কাল শিকারে কিছু পেয়েছেন?

জাহেদ মামা একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, পাখি জাল কেটে বেরিয়ে গেছে। ধরা গেলো না।

নেলী খালা সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, বার বার তো আর বেরিয়ে যেতে পারবে না। একবার ঠিকই ধরা পড়বে।

জাহেদ মামা হেসে ফেললেন–তদ্দিনে আমার পাখি ধরার চাকরিটা থাকলে হয় আর কি।

একবার ভাবলাম, গত রাতে আলো দেখার কথাটা জাহেদ মামাকে বলেই ফেলি। কিন্তু তাতে কি আসল অপরাধী ধরা পড়বে? শ্রী গোবর্ধনরা যে আসল লোক নয়, এটুকু বুঝতে আর আমাদের বকি নেই। বরং ওদেরকে কিছু করলে আসল পাখি ঠিকই উড়ে পালিয়ে যাবে। তাছাড়া যখন ঠিক করেছি বড়দের সাহায্য নেবো না, তখন দেখাই যাক না আমরা কি করতে পারি। এখনো তো তদন্তের কাজ শেষ হয় নি। আমি জাহেদ মামাকে বললাম, আপনাদের উল্টো দিকে যে ছাতিম গাছতলা একটা পাহাড় আছে, ওখানে কখনো গিয়েছিলেন আপনি? শুনলাম ওদিকে কোথায় যেন কোন এক পাকড়াশী থাকেন।

জাহেদ মামা বললেন, শিকার করতে যখন এসেছি, তখন সব জায়গাতেই যেতে হয়েছে। ওই পাহাড়েই বুড়ো পাকড়াশীর খামারবাড়ি রয়েছে। ভারি ভালো লোক। প্রচুর পয়সাও আছে। কক্সবাজারে আর হিমছড়িতে দুটো চ্যারিটেবল ডিসপেন্সারি চালাচ্ছেন। কলেজ আর হাসপাতালের জন্যেও মোটা টাকা ডোনেট করেছেন। ওঁর পোলট্রি থেকে আমাদের ডিম আর মুরগির বাচ্চা দেন; ভাবি সস্তা। কেন, নেলীও তো ওঁর পোলট্রি থেকে ডিম কেনে!

পোলট্রিও আছে বুছি! টুনি সঙ্গে সঙ্গে উৎসাহী গলায় বললো, আমার গ্রামের খামারবাড়ি দেখার ভারি সখ। নিশ্চয়ই ষাঁড়, গরু এসবও আছে।–এই বলে আড়চোখে ললির দিকে তাকালো। ললির আবার বৃষরাশি। কেউ ওর সামনে ষাঁড়-টাড়ের নাম করলে চটে যায়। ভাগ্যিস ও টুনির কথাটা খেয়াল করে নি। ও চুপচাপ নেলী খালার লেস বোনা দেখছিলো।

জাহেদ মামা হেসে বললেন, শুধু গরু কেন, ঘোড়া, গাধাও আছে। বুড়োর আবার এগুলো পোর ভারি সখ। বলে–একা থাকি। ওরাই আমার বন্ধু।

টুনি ফিক করে হেসে ফেললো–গাধার বন্ধু।

ললি চোখ তুলে তাকালো, কে গাধার বন্ধু?

টুনি বললো, তোমাকে নয়, বাবুকে বলছি।

বাবু বললো, তা তোমার বন্ধু হতে যে আমার আপত্তি নেই, একথা তো তোমাকে আগেই বলেছি।

আমি হেসে বললাম, কেমন জব্দ হলে টুনি?

টুনি বললো, আমি কখনো জব্দ হই না।

বাবু গম্ভীর হয়ে বললো, জব্দ হতে হতে টুনি একেবারে জব্দ-প্রুফ হয়ে গেছে।

টুনি এবার চটে গিয়ে বললো, দেখো বাবু, আমার সঙ্গে লাগতে এসো না। ভালো হবে না বলছি!

ললি বললো, তুমিই তো ওর সঙ্গে লাগতে গেলে টুনি!

টুনি কী যেন ওকে বলতে যাচ্ছিলো, নেলী খালা বাধা দিয়ে বললেন, খাবার টেবিলে বসে বসে আর ঝগড়া করতে হবে না। আজ তোমরা সোনার খনি খুঁজতে যাবে না?

আমি বললাম, বিকেলে যাবো। এখন আমরা ঘরে বসে চাইনিজ চেকার খেলবো।

জাহেদ মামা মৃদু হেসে বললেন, সুবোধ বালক।

ঘরে ফিরে আমরা আমাদের তদন্তের ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করলাম। শ্রী গোবর্ধন আর মিস্টার ফতে যদি সারা দিন ঘরে বসে থাকে, তাহলে তো ওদিক দিয়ে এগুনো যায় না। আমরা ভাবছিলাম ওদের দুজনের ঘর দুটো একবার সার্চ করে দেখবো। বিশেষ করে কাল রাতে, যাই গোবর–বলে ফতে যে কোথায় উধাও হয়ে গেলো টেরই পেলাম না। ললি বলছিলো, পাশের ঘরে যেতে পারে। যেখানেই যাক, সৎ উদ্দেশ্যে যে যায় নি, সেকথা তো সবাই জানি। আর ফতে যাবার পর গোবর পাহাড়ে আর সমুদ্রে কাদের কাছে কাছে আলোর সংকেত পাঠালো? রহস্যের যতো গভীরে ঢুকছি, গোটা ব্যাপারটা আরো রহস্যময় হয়ে উঠতে লাগলো।

ললি বললো, লরেল হার্ডির ওপর নজর রাখা যায় কীভাবে?

বাবু বললো, ওরা তো এমনিতেই নজরবন্দী হয়ে আছে।

আমি মাথা নাড়লাম–পুরোপুরি নেই। ঘর থেকে যখন-তখন উধাও হয়ে যেতে পারে। অন্য কোথাও গিয়ে দিব্যি গুপ্তধনের নকশা খুঁজতে পারে। আমরা তো এগুলো দেখতে পাচ্ছি না।

টুনি বললো, অন্য ঘরে ওদের যেতে না দিলেই হয়। সে-সব ঘরের দরজা যদি ভেতর থেকে বন্ধ থাকে, তাহলে যাবে কী করে?

আমি বললাম, না টুনি, সেটাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমরা তো চাই ওরা অন্য ঘরে যাক। নকশাটা কোথায়, খুঁজে বার করুক। তারপর আমাদের স্ক্যাটরাই নকশাটা ওদের হাত থেকে উদ্ধার করে আনতে পারবে। আমাদের কাজ হচ্ছে ওদের ওপর নজর রাখা।

টুনি বললো, ওরা দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকলে আপনি নজর রাখবেন কী করে?

বাবু একটু ভেবে বললো, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। নেলী খালার কাছে কাঠমিস্ত্রিদের কাজ করার জিনিসপত্র সব আছে। আমরা যদি আমাদের কাঠের মেঝে দুটো ওপর থেকে ফুটো করে ফেলতে পারি, তাহলে ঘরে বসে ওরা কী করছে, এখান থেকে সব স্বচ্ছন্দে দেখা যাবে।

বাবুর প্ল্যানটা আমাদের সবারই পছন্দ হলো। কাঠের পুতুল বানাবে বলে টুনি নেলী খালার কাছ থেকে যন্ত্রের বাক্সটা চেয়ে আনলো। নেলী খালা তখন জাহেদ মামার সঙ্গে এতো কথা বলছিলেন যে, চাওয়ামাত্র টুনিকে বাক্সটা নিতে বললেন। বাক্স আনার পর আমি বাবুকে বললাম, এবার দেখতে হবে, এই মুহূর্তে ওরা কোন ঘরে আছে।

বাবু মেঝেতে কান পেতে শুনলো। বললো, দুজনের গুজগুজ করে কথা বলা শুনে তো মনে হচ্ছে ওরা এ ঘরেই আছে।

ললি বললো, মনে হচ্ছে কি, বলো এ ঘরে আছে।

বাবু ঘাড় চুলকে বললো, কী জানি বাপু। হার্ডি তো আবার যখন-তখন উধাও হয়ে যেতে পারে। কখন হয়তো দেখবো, হঠাৎ এসে ওখানটায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে টুনি পেছন ফিরে তাকালো। তারপর ছুটে গিয়ে বাবুকে একটা চিমটি কেটে বললো, আমাকে এভাবে ভয় দেখাতে বারণ করি নি?

আমি বললাম, ওরা এ ঘরে থাকলে আমরা পরম নিশ্চিন্তে ললিদের ঘর ফুটো করতে পারি।

অসম্ভব প্যাচালো একটা তুরপুন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমি ললিদের ঘরের কাঠের মেঝের দুমাথায় দুটো আর মাঝখানে একটা ফুটো করলাম। অবশ্য তিনটে ফুটো করতেই আমাদের দুজনের ঝাড়া এক ঘন্টা সময় লাগলো। ললি টুনি ও ঘরের মেঝেতে কান পেতে শুয়েছিলো, যদি ওদের কথা শেষ হয়ে যায় আর ফতে যদি এ ঘরে ফিরে আসে সেটা শোনার জন্যে। অবশ্য এই এক ঘন্টার ভেতর টুনি পাঁচ বার এসে শুধু বলেছে, কই হলো? আর প্রত্যেক বারই আমরা ঘাবড়ে গিয়েছি, ফতে বুঝি এই এসে পড়লো। শেষে বাবু ওকে ধমক লাগালো কাজ শেষ হলে আমরাই যাবো। তুমি চুপচাপ তোমার কাজ করোগে। ফতে ঘর থেকে বেরুলেই শুধু খবর দেবে।

চমৎকার তিনটে ফুটো বানিয়ে আমরা ঘরের ভেতর উঁকি মেরে দেখলাম, দিব্যি সব দেখা যাচ্ছে। খাট, টেবিল, চেয়ার, ফুলদানি, চেয়ারের ওপর ফতের কাদামাখা মস্তো বড়ো প্যান্টটা; সবই চোখে পড়লো। আমরা যখন কাজ শেষ করে ললি টুনিকে ডাকলাম, তখনো গোবর ফতের কথা শেষ হয় নি। টুনি দেখেই হাততালি দিয়ে বললো, কী মজা, ডান পাশের এই ফুটো দিয়ে আমি দেখবো।

বাবু বললো, এবার আমাদের ঘরেও যে কটা ফুটো করা দরকার।

আমি বললাম, ওরা না বেরুলে তো আর করা যাবে না। যখন খেতে যাবে, তখনই কাজ সেরে ফেলবো।

তারপর টুনি চাইনিজ চেকারের বোর্ডটা আনলো। বললো, অনেক কাজ হয়েছে। এবার খেলা যাক।

টুনি যখন চেকারের ঘরগুলো সব সাজালো, তখনই নেলী খালা এসে উঁকি মারলেন– এখনো তোমরা খেলছে বুঝি? তোমাদের জাহেদ মামা দুপুরে আমাদের সঙ্গে খাবেন। তোমরা তৈরি হয়ে নাও। জাহেদ আবার বেরুবে।

বাবু বললো, লরেল হার্ডিও বুঝি আমাদের সঙ্গে খাবে?

নেলী খালা বললেন, ওরা পরে খাবে। আমি চাই না জাহেদের সামনে খেতে বসে শ্রী গোবর্ধন কোনো বাজে কাজ করে বসুক।

নেলী খালা দুপুরে চমৎকার পাহাড়ী মোরগ রান্না করেছিলেন। খেয়ে-দেয়ে আমরা যখন ওপরে গেলাম, তখন বডিবি ফতে আর গোবরকে ডাকতে গেলো। বুঝলাম, পুরো একটা ঘন্টার আগে ওরা কেউ খাবার টেবিল থেকে উঠবে না। আমরা পরম নিশ্চিন্তে বসে আমাদের ঘরের মেঝে ফুটো করলাম, টুনি উঁকি মেরে দেখে বললো, ঘরের সবকিছু তো দেখা যাচ্ছে না। লরেলের এ ঘর থেকে পাশের ঘরে যাবার দরজাগুলো কোথায়?

আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, পাশের দেয়ালটা ঠিকই দেখা যাচ্ছে। না। ফুটোটা একটু সরিয়ে করলে ভালো হতো। কিন্তু ততোক্ষণে এক ঘন্টা কেটে গেছে। কারণ ঠিক তখনই হেউ হেউ করে ঢেকুর তুলতে তুলতে ফতে আর গোবর ঘরে ঢুকলো।

বাবু বললো, এতেই চলবে, নইলে পরে আরো দুটো করে নেয়া যাবে। বিকেলের প্রোগ্রাম ঠিক করো।

আমি বললাম, প্রোগ্রাম আর কি! চলো সবাই মিলে আন্নাকালীর পাহাড়ে একবার ঢুঁ মেরে আসি।

সত্যি বলতে কি, সেদিন ছাতিমতলায় অস্বাভাবিক মানুষটাকে ভোজবাজির মতো মিলিয়ে যেতে দেখার পর থেকে আমি মোটেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। তারপর ফতে গোবরও সেই একই গাছের তলা থেকে উধাও হলো। ঝকড়া মাথাঅলা মস্ত বড়ো ছাতিম গাছটা যেন আমার বুকের ভেতর শেকড় গেড়ে বসেছিলো।

সোজা পথে নয়, বাঁকা পথেই আমরা এগুলাম। অর্থাৎ হাটের ওপর দিয়ে না । গিয়ে আমরা সোনাবালি নদীর তীর ধরে আন্নাকালীর পাহাড়ের দিকে এগুলাম। নদীর পানি বিকেলের সোনালি রোদে চকচক করছিলো। বাবু বললো, কবে যে এই নদীতে তাল তাল সোনা পাবো!

টুনি বললো, তারপর তোমার পিঠে পুলিসের তাল তাল কিল পড়ুক।

বাবু কোনো কথা না বলে নদীর কিনারের পানিতে হাত ডুবিয়ে এক মুঠো ভেজা বালি তুলে আনলো। বালির রঙও সোনালি। আমি বললাম, যত্ন করে রেখে দাও। ভরি খানেক সোনা নির্ঘাত পাবে।

ললি মৃদু হেসে বললো, পাহাড়ে কোন দিক দিয়ে উঠবে ঠিক করো।

বেশ খাড়া পাহাড়। অনেক খুঁজে একটা ঢালু খাঁজ বেয়ে উঠতে গিয়ে রীতিমতো খবর হয়ে গেলো। ফতে আর গোবরা এতো তাড়াতাড়ি কী করে উঠলো, ভেবেই পেলাম না। স্ক্যাটরার জিব বেরিয়ে গেলো, টুনি দুবার হোঁচট খেয়ে পড়লো, বাবুর পা চমকে গেলো আর ললি ওপরে উঠেই বললো, একটু না বসলে আমি আর হাঁটতে পারবো না। আমার বুকের ভেতর ব্যথা করছে।

ডাক্তার ললিকে ছুটোছুটি করতে বারণ করেছে। ও পাহাড়ে উঠবে জানলে নিশ্চয়ই এটাও বারণ করতো।

আমরা একটা জায়গায় বসলাম। ছাতিম গাছটা আরেক ধাপ ওপরে। এখান থেকে শুধু গাছের ঘন সবুজ মাথাটা দেখা যাচ্ছে। দু-একটা পাহাড়ী ঘুঘু ছাড়া বিকেলের আন্নাকালীর পাহাড়ে এতটুকু শব্দ ছিলো না। সামনের পাহাড়ে অনেক দূরে জাহেদ মামার লাল টালির বাংলো । নিচে সোনাবালি নদী। বিকেলের রোদে নদীটাকে মসৃণ চকচকে সোনালি সিল্কের ফিতের মতো মনে হচ্ছিলো। বাবু এক টুকরো পাথর ছুঁড়ে মারলো। কিছুক্ষণ পর টুপ করে সামান্য একটু শব্দ হলো। তারপর আবার সব কিছু চুপচাপ। বাবু আরেকটা পাথর ছুঁড়লো।

টুনি বললো, আন্নাকালীর পাহাড়েই যখন এলাম, তখন সেই গাধার বন্ধুটাকে দেখে গেলে হতো না?

বাবু বললো, গাধার বন্ধু কে?

টুনি ফিক করে হেসে বললো, আমি না, সেই বুড়ো পাকড়াশী–যার নাকি বিরাট এক খামার আছে।

আমি বললাম, আমার মনে আছে টুনি। ছাতিমতলায় আন্নাকালীর মন্দির দর্শন করেই আমরা পাকড়াশী মশাইকে দর্শন করতে যাবো।

আমার কথার ঢঙে সবাই হেসে উঠলো। কয়েকটা সবুজ টিয়ে পাখি গাছের ভেতর থেকে ঝটপট করে বেরিয়ে এসে আমাদের মুখের ওপর দিয়ে উড়ে গেলো। একটা সবুজ পালক উড়ে এসে ললির হাতের কাছে পড়লো। কচি কলার পাতার রঙের মতো হালকা নরোম পালকটা ললি তুলে নিয়ে দেখলো। তারপর ওটা আমার হাতে বুলিয়ে দিয়ে বললো, সুন্দর না!

আমি হেসে বললাম, সুন্দর। তবে সুড়সুড়ি লাগছে।

ললি লাল হয়ে গেলো। বাবু বললো, এবার ওঠা যাক। আন্নাকালীর মন্দির আর পাকড়াশীর খামার দেখে ফিরতে গেলে রাত হয়ে যাবে।

বাবুটা এত চঞ্চল হয়ে পড়েছে কেন বুঝি না। এমনিতে ও অবশ্য বেশিক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। এতোক্ষণ শুধু নদীতে পাথর ছুঁড়ছিলো, আর ঘাসের কচি ডগা চিবোচ্ছিলো। আমি ললিকে বললাম, বুকের ব্যথাটা কমেছে?

ললি মাথা নাড়লো–কমেছে। চলো, রাত হলে আবার নেলী খালার বকুনি খেতে হবে।

আমরা আরো কিছু দূর পাহাড় বেয়ে উঠলাম। একটু পরে ছাতিম গাছটা যেন আকাশ ছুঁড়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। সেই ছাতিম গাছ, যেটা আমার বুকে শেকড় গেড়ে বসেছিলো। তেমন ভয়াবহ কিছু মনে হলো না। তবে গাছের নিচে একটুখানি ছায়া ছায়া ফিরে অন্ধকার। তার ভেতর ছোট্ট একটা মন্দির। কয়েকটা বুনো লতা, মন্দির আর ছাতিম গাছের গোড়া পেঁচিয়ে ওপরের দিকে উঠে গেছে।

টুনি বললো, এতো ছোট মন্দির আমি আগে কখনো দেখি নি।

বাবু বললো, এ মন্দিরে কোনো দিন পুজো হয়েছে একথা কেউ বলতে পারবে না।

টুনি বললো, পুজো হবে যে–মূর্তি কোথায়?

ললি বললো, আমার মনে হচ্ছে কাল রাতে ঠিক এখানেই আলো জ্বলতে দেখেছি।

আমি ঘুরেফিরে সব দেখছিলাম। ছাতিম গাছটার বয়স যদি কেউ বলে পাঁচ শ–তাহলে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। হঠাৎ গাছের গায়ে এক জায়গায় আমার চোখ দুটো চুম্বকের মতো আটকে গেলো। ফিসফিস করে বাবুকে ডাকলাম, দেখে যাও।

ওরা তখনো মন্দির দেখছিলো। বাবুর সঙ্গে ললি টুনিও এলো। দেখে ওদের চোখগুলো ঠিকরে বেরিয়ে আসার মতো হলো। টুনি বাবুর একটা হাত আঁকড়ে ধরলো। গাছের গায়ে ভয়ঙ্কর দেখতে একটা কঙ্কালের খুলি আঁকা। ধারালো কিছু দিয়ে খোদাই করে এঁকেছে।

হঠাৎ স্ক্যাটরার গরগর শব্দ শুনে ফিরে তাকালাম। অচেনা কিছু দেখলে স্ক্যাটরা এরকম করে। এক জন বুড়ো বয়স আশি বছরের কম হবে না, গুটিগুটি পায়ে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে মন্দিরের দিকেই আসছিলেন। আমাদের দেখে অসম্ভব রকম অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, কাদের বাড়ির বাছা গো তোমরা? এয়েচো কী কত্তে? ওমা, এটা নেলীর সেই পাজি কুত্তোটা না? আমার খামারের হাঁসগুলো ওকে দুচোখে দেখতে পারে না। আমার কুত্তো খেদীও ওকে পছন্দ করে না।

বুড়োর কথা শুনে বুঝলাম, ইনিই সেই পাকড়াশী মশাই, ভারি দয়ালু আর ভালোমানুষ বলে এ তল্লাটে যার খুব সুনাম। স্ক্যাটরা ওঁকে পছন্দ না করলেও আমি বিনীত গলায় বললাম, আমরা নেলী খালার বাড়িতে বেড়াতে এসেছি।

একগাল হেসে বুড়ো পাকড়াশী বললেন অ, তাই বলো। আমি ভাবলাম আর কেউ বুঝি। তা নেলী আমাকে বলেছিলো বটে তোমরা আসবে। আমি হলুমগে নিকুঞ্জ পাকড়াশী।

টুনি ফিক করে হেসে বললো, আমরা আপনাকে চিনি।

ভুরু কুঁচকে চোখ দুটো পিটপিট করে বুড়ো বললেন, চেনো মানে? তোমাদের সঙ্গে তো আমার আগে কখনো আলাপ হয় নি বাপু!

আমি বললাম, জাহেদ মামার কাছে শুনেছি আপনার কথা। আপনার নাকি খুব দয়ার শরীর। নেলী খালার মালীকে দশটা টাকা দিয়েছিলেন। কক্সবাজারের কলেজ আর হাসপাতাল আপনার টাকায় চলে।

টুনি বললো, আপনার একটা সুন্দর খামার আছে, তাও শুনেছি।

বুড়োর পিটপিটে ভাবটা চলে গেলো। একগাল হেসে বললেন, তা বাপু লোকে একটু বাড়িয়েই বলে। জাহেদ ছোঁড়টা আমাকে পছন্দ করে কিনা, তাই অমন বলেছে। তোমরা আমার খামার দেখবে?

টুনি বললো, বা রে, খামার দেখার জন্যই তো আমরা এসেছি!

আমি দেখলাম বুড়ো পাকড়াশী টুনির কথা বলার মাঝখানে আড়চোখে ছাতিম গাছের গায়ে আঁকা সেই কঙ্কালের খুলিটার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, তাহলে আর এখানে দাঁড়িয়ে কেন! চল বাছারা, খামারটা তোদের বেলা থাকতে দেখিয়ে আনি। সাঁঝে আবার এদিকে ঘোরাফেরা করা ভালো নয়।

ললি এতোক্ষণে কথা বললো, কেন, ভূতের ভয় আছে নাকি!

বুড়ো পাকড়াশী হাঁটতে হাঁটতে বললেন, তা বাছা তেনাদের ভূতই বলতে পারিস। হার্মাদদের আমলে ওরা যে কতো মানুষকে এসব পাহাড়ে জ্যান্ত পুঁতে রেখেছে, তার কি কোন ইয়ত্তা আছে! তেনাদের কারো তো আর সদগতি হয় নি। তাই তেনাদের আত্মারা এখনো এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ান।

টুনি ভয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, আপনি মিছেমিছি ভয় দেখাচ্ছেন কেন? আমরা তাহলে এক্ষুনি চলে যাবো।

বুড়ো যেন জীবনে এমন হাসির কথা শোনেন নি। খিকখিক করে হাসতে হাসতে বললেন ওই দেখ, ভয় পাবার কী হলো এতে! যতোক্ষণ সুয্যির আলো আছে, ততোক্ষণ কোনো ভয় নেই। তা ছাড়া আমি সঙ্গে আছি না!

আমরা যখন পাকড়াশীর খামারে এলাম, সূর্য তখন পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে। ছাতিম গাছের উল্টো দিকে বলে খামার থেকে জাহেদ মামার বাংলো দেখা গেলো না। পাকড়াশী আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখালেন।.গাধা দেখে টুনি হেসে ফেললো। সেই সঙ্গে বাবুও।

সব দেখানোর পর পাকড়াশী বললেন, সাঁঝ হয়ে এলো। এবার তোরা বাড়ি যা বাছা। নে ধর, চাটগাঁ থেকে বেলা বিস্কুট এনেছিলাম, খেতে খেতে যা। খবদ্দার, ছাতিমতলা দিয়ে যাস নে। এতোক্ষণে তেনারা হয়তো বেরিয়ে পড়েছেন। এই বলে বুড়ো পাকড়াশী দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকালেন।

পকেট ভর্তি বিস্কুট নিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। কিছু দূর যাবার পর হঠাৎ মনে হলো অল্প দূরে সামনে থেকে কী যেন সরে গেলো। স্ক্যাটরা ঘেউঘেউ করে সে দিকে ছুটে গেলো। আর একটু পরেই শ্রী গোবর্ধন ঝোঁপের আড়াল থেকে তীরের বেগে আমাদের দিকে ছুটে এলো। পেছনে দেখি স্ক্যাটরাও মহা আনন্দে ছুটে আসছে। বাবু একটু সামনে ছিলো। গোবর্ধন এসে বাবুকেই জড়িয়ে ধরলো–তোদের পায়ে পড়ি বাপ। কুত্তোটাকে ধর।

আমি হাসি চেয়ে স্ক্যাটরাকে ধমক দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে স্ক্যাটরা মাথা নিচু করে ঘনঘন লেজ নাড়তে লাগলো।

তোকে নিয়ে হয়েছে এক জ্বালা।–এই বলে ফতেও আমাদের দিকে এগিয়ে এলোতোর লজ্জাও করে না গোবর, কুত্তোর ভয়ে তুই একরত্তি ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরেছিস!

ফতের বিশাল বপুর কাছে বাবুকে অবশ্য একরত্তিই মনে হয়। ফতে তখন আমার দিকে ফিরে মোলায়েম গলায় বললো, তোমরা বুঝি বেড়াতে এসেছো? তা বেশ করেছে। বিকেলে পাহাড়ের বাতাস গায়ে লাগানো ভালো। তবে সন্ধ্যের বাতাস ভালো নয়। সন্ধ্যেবেলা নাম নিতে নেই–তেনারা একটু পরেই বেরিয়ে পড়বেন।

আমি বললাম, আমরা পাকড়াশী মশাইকে দেখতে এসেছিলাম। আপনারা বুঝি সেখানে যাচ্ছেন?

তা না তা নয়। আমতা আমতা করে ফতে বললো, আমরাও বেড়াতে বেরিয়েছি। ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। এসে যখন পড়েছি, তখন যাই পাকড়াশী বাবুকে একটা সালাম দিয়ে আসি। চল গোবরা, পা চালিয়ে চল।

গোবরা তো যাওয়ার জন্যে এক পায়ে খাড়া। আড়চোখে স্ক্যাটরার দিকে তাকিয়ে ওর দৌড়ানোর সাহস হলো না। নইলে ওর ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছিলো, স্ক্যাটরা সামনে না থাকলে ঠিকই বাইবাই করে ছুট লাগাতো। ফতের একটা হাত খামচে ধরে গোবরা দু পা হাঁটে, এক বার পেছনে তাকায়। একটু পরে ওরা চোখের আড়ালে চলে গেলো।

বাবু বললো, কী করবে, ফিরে যাবে, না ফতেরা ফেরা পর্যন্ত দাঁড়াবে?

ললি বললো, পাকড়াশীকে সালাম দেয়ার জন্য ফতে হঠাৎ ক্ষেপে গেলো কেন বুঝলাম না।

টুনি বললো, বারে, পাকড়াশী এখানকার নামকরা লোক। ওকে তো সবাই খাতির করবে।

ললি বললো, ফতে গোবরকে আমরা খারাপ লোক বলেই জানি। পাকড়াশীর মতো ভালো লোককে ওরা কোনো বিপদেও ফেলতে পারে।

আমি বললাম, ঠিক বলেছো ললি। আমাদের উচিত ফতে গোবরাকে চোখে চোখে রাখা। ওদের প্রত্যেকটা কাজ সন্দেহজনক। চলো আবার পাকড়াশীর বাড়ির দিকে যাই।

টুনি একটু গাঁইগুই করে বললো, শেষে দেখো, দেরি করার জন্যে নেলী খালা না আবার বকা শুরু করে। বাবু তখন বললো, সে ভয় থাকলে এক্ষুনি তোমাকে রেখে আসতে পারি। টুনি কথা না বলে বাবুকে শুধু একটু ভেংচি কেটে আমাদের সঙ্গে এলো।