পুবের সূর্য – শাহরিয়ার কবির
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলো বাবু। বিশাল গোলাপ বাগানের আকাশে রুপোলি থালার মতো ঠান্ডা ভেজা ভেজা চাঁদটা ঝুলছে। সরল ইউক্যালিপ্টাস গাছগুলো শ্বেত পাথরের থামের মতো বাড়িটাকে ঘিরে রেখেছে। অজস্র লাল গোলাপে ছেয়ে আছে সারা বাগান। জ্যোৎস্নার বাগানে গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তগোলাপ। চারদিক নরম কুয়াশার চাঁদরে ঢাকা।
বাবুর স্বপ্ন আরো গম্ভীর হলো। তার ইচ্ছাগুলো এক-একটি গোলাপে পরিণত হয়ে ছড়িয়ে পড়লো জ্যোৎস্নার কুয়াশায়। দূরে কুয়াশা জমাট বেঁধে বরফ হয়ে আছে। গোলাপেরা সেই বরফের গায়ে গেঁথে রইলো। ধবধবে সাদা বরফের গায়ে জ্বলজ্বল করতে লাগলো পদ্মরাগ পাথর হয়ে। তারপর হঠাৎ পাথরগুলো জীবন্ত হয়ে কাছে আসতে লাগলো।
সবিস্ময়ে বাবু লক্ষ্য করলো তার স্বপ্নের পাথরগুলো নেকড়ের চোখে রূপান্তরিত হয়েছে। কুয়াশার জমাট সাদা বরফে ধারালো থাবার ছাপ রেখে নেকড়ের দল এগিয়ে আসতে লাগলো নিঃশব্দে। পদ্মরাগ চোখগুলোতে গোলাপের ভালোবাসার বদলে একরাশ হিংস্রতার ছায়া দেখলো সে।
অসম্ভব আতঙ্কে বাবু আরো দেখলো, কতগুলো কালো মেঘ রুপোলি চাঁদটাকে ঢেকে দিয়েছে। মাইলের পর মাইল অতল অন্ধকার। কালো আলকাতরার মতো অন্ধকারের ঢেউগুলো ওকে ডুবিয়ে দিতে চাইলো। বাবু কোন শব্দ করতে পারলো না।
ঠিক তখনই আকাশে বিদ্যুৎ চমকালো। গোলাপ বাগানে ঝড় এলো। একদল বুনো মোষের মতো ক্ষিপ্ত বাতাস অন্ধকারের পর্দা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে ছুটে গেলো। এক মুহূর্তে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। শান্ত ইউক্যালিপ্টাস গাছগুলো অশান্ত হয়ে উঠলো। আর গোলাপের পাপড়িগুলো শাঁ শাঁ বাতাসে উড়ে যেতে লাগলো।
আবার বিদ্যুৎ চমকালো। আকাশ চিরে চাবুকের মতো নেমে এলো জানালার কাঁচে। বাজ পড়লো পৃথিবী কাঁপিয়ে। জানালার কাঁচগুলো ঝনঝন করে বুঝি গুঁড়ো হয়ে গেলো। আবার বাজ পড়লো। তারপর একটার পর একটা শব্দের গর্জন হতেই থাকলো। থরথর করে কাঁপতে লাগলো বাবুর ঘরটা, গোলাপ বাগানে হিমানী নামের ছোট্ট বাড়িটা।
কে যেন ওর নাম ধরে ডাকছে। বাবু চমকে উঠলো। কী ভীষণ দুঃস্বপ্ন! ঘরে নীল বাতির নরম আলো ছড়িয়ে আছে। দেয়ালজোড়া জানালাগুলো ভারী পর্দা দিয়ে ঢাকা, মাথার উপর শাঁ শাঁ করে ফ্যান ঘুরছে। অথচ বাবুর জামাটা ঘামে ভিজে গায়ের সাথে লেগে আছে।
দরজায় আবার শব্দ হলো। বাবা ডাকছেন, বাবু দরজা খোল শিগগির।
বাইরে ঘন কালো অন্ধকার। আবার বাজের শব্দ হলো। ঘুমের ঘোরে উঠে। দরজা খুললো বাবু। বাবা ওর হাত চেপে ধরলেন। টেনে ড্রইংরুমে নিয়ে এলেন। চাপা গলায় বললেন, শুনতে পাচ্ছো না বাইরে কী হচ্ছে?
বাইরে তাকিয়ে দেখলো বাবু। আকাশে অসংখ্য তারার মিছিল। এতটুকু মেঘ নেই। বাবা বললেন, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
ড্রইংরুমে অন্ধকারে বসে আছে ভাইয়া, ভাবী আর ওদের ছোট্ট মেয়ে হিমি।
কেউ কোন কথা বলছে না। তখনও বাবু স্বপ্নের ঘোরে আচ্ছন্ন। বুঝতে পারলো না বাবা কী বললেন।
আবার বাজের ভয়ঙ্কর শব্দে জানালার কাঁচগুলো ঝনঝন করে কেঁপে উঠলো। ভাইয়া বললো, কামানের শব্দ।
তারপর অবিরাম মেশিনগানের গুলির শব্দ। মাঝে মাঝে রাইফেলের শব্দ। বৃষ্টির মতো মেশিনগানের শব্দের নিচে রাইফেলের শব্দ হারিয়ে গেলো। সবকিছু ছাপিয়ে কামানের গর্জন শোনা গেলো বারবার।
বাইরের জমাট অন্ধকারে সবকিছু হারিয়ে গেছে। শ্বেতপাথরের থামের মতো ইউক্যালিপ্টাস, গোলাপের বিশাল বাগান, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সারা শহর অন্ধকারের ঘন কালো চাঁদরের নিচে ঢাকা পড়ে গেছে। শুধু দক্ষিণের আকাশে কামান গর্জনের আগের মুহূর্তে বিদ্যুতের মতো আলোর রেখা ঝলসে উঠছিলো।
ভাবী বললো, আরো দক্ষিণে সরে এসেছে।
এমন সময় বাইরে পাঁচিলের ধার থেকে কে যেন চাপা গলায় বাবাকে ডাকলো, সিদ্দিক সাহেব, একবার বাইরে আসুন।
বাবা ব্যস্ত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ভাইয়া আর বাবু সঙ্গে গেলো। অন্ধকারে গলা শুনে বুঝলো, বনানীর জামান সাহেব। আওয়ামী লীগের একজন স্থানীয় নেতা। উত্তেজিত গলায় বাবাকে বলছেন, অবস্থা খুব খারাপের দিকে মোড় নিয়েছে। পাঞ্জাবি সৈন্যরা রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার আক্রমণ করেছে। ভয়ানক যুদ্ধ চলছে সেখানে।
আপনাদের সংগ্রাম পরিষদের খবর কী? জানতে চাইলেন বাবা।
আমরা এখনো কোন নির্দেশ পাইনি। জামান সাহেব আগের মতো উত্তেজিত–রাতে ব্যারিকেড দিতে বলেছিলো। শেষ নির্দেশ পেয়েছিলাম রাত নটায়। তারপর থেকে আর যোগাযোগ করতে পারছি না। বঙ্গবন্ধু সম্ভবত বেতার ভাষণ দেবেন।
আপনারা কী করবেন ঠিক করেছেন?
আমরা তৈরি হয়ে আছি। ঘর থেকে কেউ বেরুবেন না। সকালে সব খবর পাওয়া যাবে। এই বলে অন্ধকার পথে চলে গেলেন জামান সাহেব। ঘরে ফিরে বাবাকে খুব উদ্বিগ্ন মনে হলো–বন্দুক ছাড়া পুলিশের কাছে কোন অস্ত্রই নেই। কী দিয়ে ওরা লড়ছে?
ভাইয়া বললো, সংগ্রাম পরিষদ থেকে ওদের নিশ্চয়ই অস্ত্র দেওয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে রাইফেলের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
মেশিনগানের একটানা কর্কশ শব্দ ভীষণ বৃষ্টির মতো হাড় ফুটো করে বুকের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিলো। বিরামহীন সেই ভয়াবহ শব্দের ভেতর আরো ভয়াবহ কামানগুলো গর্জন করছিলো। রাইফেলের প্রতিরোধের শব্দ একেবারেই স্তিমিত। মেশিনগানের শব্দ আরো জোরালো হলো। এরপর দক্ষিণের আকাশটা ধীরে ধীরে লাল হতে লাগলো।
ঘরের সবাই সেদিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। দক্ষিণ থেকে পশ্চিমের সারা আকাশ লাল হয়ে গেছে। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে।
ভাইয়া উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে বললো, ওরা ইউনিভার্সিটিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
ভাবী বললো, ইপিআরদের হেডকোয়ার্টার ওদিকে। প্রথম গুলির শব্দ আমি ওদিক থেকেই শুনেছিলাম।
ভাইয়া বললো, হলের ছাত্ররাও গুলি করতে পারে। মার্চের দুতারিখে ওরা কারফিউ ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলো…।
বাবা হঠাৎ ওদের থামিয়ে দিলেন–চুপ, কান পেতে শোনো। দূরে মনে হচ্ছে কেউ শ্লোগান দিচ্ছে।
মেশিনগানের প্রচন্ড কর্কশ শব্দের জন্যে কিছুই শোনা যাচ্ছে না–তবু ওরা সবাই কান পেতে রইলো। বিকট শব্দের মুহূর্তের বিরতিতে ওরা শুনলো সেই শ্লোগানের শব্দ। বহু দূরে পুরোনো ঢাকা থেকে একটা অস্পষ্ট কোলাহলের মতো ভেসে আসছে।
বাবু কাঁপা উত্তেজিত গলায় বললো, জয় বাংলা বলছে!
বাতাসে টুকরো টুকরো হয়ে বহুদূর থেকে শ্লোগানের সেই শব্দগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিলো। বিচ্ছিন্ন কিছু শ্লোগান, কিছু প্রতিরোধের শব্দ শুনলো ওরা। শ্রমিক কৃষক অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা–এই ধরনের টুকরো টুকরো শ্লোগানের শব্দ সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতো থেকে থেকে গর্জে উঠছিলো, আবার কামান আর
মেশিনগানের নারকীয় শব্দে তলিয়ে যাচ্ছিলো। মুহূর্তের জন্য বিরতি নেই সেই দানবিক শব্দের। পৃথিবীর সকল প্রতিবাদের শব্দকে গলা টিপে ধরার দুরন্ত স্পর্ধা নিয়ে গর্জন করছিলো কতগুলো মেশিনগান। তারপর একসময় শ্লোগানের শব্দ থেমে গেলো।
বাবা বললেন, রেডিয়োতে ঢাকা ধরো। কিছু বলতে পারে।
ভাবী রেডিয়োর চাবিটা ঘুরিয়ে দিলো। কোনো শব্দ নেই কোথাও। ভাইয়া ওয়েভ বদল করে বার বার চাবি ঘোরালো। বিদেশী কোন স্টেশনে গান হচ্ছে। কোথাও আনন্দের সঙ্গীত বাজছে। ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে কোন সাড়াশব্দ নেই। ভাইয়া আপন মনে বললো, এখানে এ রকম একটা ভয়াবহ ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে অথচ পৃথিবীর কেউ জানতেও পারছে না।
ভাবী বললো, আর্মি বোধহয় রেডিয়ো স্টেশন দখল করে নিয়েছে! তবু রেডিয়োটা খুলে রাখো। শান্ত গলায় বললেন বাবা।
মেশিনগানের একটানা শব্দটা কিছু কমেছে। কিছুক্ষণ পরে বাবা বিড়বিড় করে বললেন, শ্লোগানের শব্দ একেবারেই থেমে গেছে।
বাবু বললো, সবাই ছাদে উঠে শ্লোগান দিলে কেমন হয়? প্রত্যেক বাড়ি থেকে শ্লোগান দিলে ওরা ভয় পেয়ে যাবে।
বাবা ওকে ধমক দিলেন–পাগলামো কোরো না।
বাবু চুপ করে গেলো। ভাবীর কোলের কাছে চার বছরের হিমি ঘুমিয়ে পড়েছে। ভাইয়া বললো, বড়দারা এ রকম শ্লোগান দিয়েছিলো চুয়ান্ন সালে। যখন বলা হলো একুশে ফেব্রুয়ারিতে মিছিল করতে দেবে না, প্রত্যেকটা ছাদ থেকে সেই রাতে শ্লোগানে সবাই ফেটে পড়েছিলো–রাষ্ট্রভাষা বাঙলা চাই বলে।
বাবু বড়দার কথা ভাবলো। যিনি ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক, কমিউনিস্ট পার্টির একজন নেতা; থাকেন পুরোনো ঢাকায়। বললো, বড়দাকে একটা টেলিফোন করলে হয়।
কেউ ওর কথার জবাব দিলো না। কিছুক্ষণ পর ভাবী শুধু বললো, টেলিফোন ডেড।
রাত বাড়তে লাগলো। মেশিনগানের শব্দ দূরে সরে গেছে। রাইফেলের শব্দ একেবারেই শোনা যাচ্ছে না। হঠাৎ ধপ করে একটা শব্দ হলো। সবাই একসঙ্গে চমকে উঠলো। বাইরের পাঁচিল টপকে কেউ ভেতরে ঢুকেছে। বাবা ইশারায় সবাইকে থামিয়ে দিলেন।
কোথাও এতটুকু শব্দ নেই। মনে হলো কেউ হাঁটছে বাগানে। বাবা ভাইয়াকে যেতে ইশারা করলেন। চাপা গলায় বললেন, সাবধানে যাও।
বাবুও সঙ্গে যেতে চাইলো। বাবা আবার চাপা গলায় ধমক দিলেন, তুমি কোথায় যাচ্ছো?
একটু পরে একজন লোককে সঙ্গে নিয়ে ভাইয়া ঘরে ঢুকলো। নিচু গলায় বললো, ইপিআর-এর লোক গুলিতে জখম হয়েছেন।
বাবা উঠে দাঁড়ালেন। বাবুকে বললেন, জানালার সবগুলো পর্দা টেনে দাও।
বাবু পর্দা টেনে জানালাগুলো আগাগোড়া ঢেকে দিলো। বাবা লাইটের সুইচ টিপলেন। একরাশ আলোয় ঘর ভরে গেলো। সেই আলোতে ওরা সবাই দেখলো ইপিআর-এর লোকটাকে। পরনে পায়জামা, গায়ে বুশ সার্ট, খালি পা। ডান কাঁধে রাইফেল ঝোলানো। বাঁ-হাত রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সাদা জামাটা লাল জবজবে হয়ে উঠেছে। খুব মারাত্মক নয়। একটু ড্রেসিং দরকার। আমার নাম জাহেদ আহমেদ, ইপিআর-এর একজন ক্যাপ্টেন। নিজের পরিচয় দিলেন তিনি।
বাবা ব্যস্ত গলায় বললেন, আপনি বসুন। এক্ষুনি ব্যবস্থা করছি। বৌমা একটু গরম পানি আনন।
ভাবী চলে গেলো। বাবা উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলেন, খবর বলুন।
ক্লান্ত গলায় ক্যাপ্টেন বললেন, রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ আর্মি হঠাৎ চড়াও হয়ে আমাদের পিলখানার ব্যারাক ঘিরে ফেলে। তারপর মেশিনগান দিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি করেছে। আমাদের লোকেরা সবাই ঘুমিয়ে ছিলো। ক্যাপ্টেন একটু থেমে বললেন, এক গ্লাস পানি খাবো।
বাবু ফ্রিজ খুলে একটা কোকাকোলার বোতল বের করে গ্লাসে ঢেলে এগিয়ে দিলো। কয়েক চুমুকে গ্লাসটা শেষ করে ক্যাপ্টেন বললেন, খুব কম লোকই পালাতে পেরেছে। বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। শেষে দেখলাম কয়েকটা রাইফেল দিয়ে ওদের মেশিনগানের মুখোমুখি হওয়া বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।
ভাবী একটা বাটিতে করে গরম পানি আনলো। বরিক পাউডার ছিটিয়ে ওতে তুলো ভিজিয়ে ক্যাপ্টেনের হাতের জখমটা আস্তে আস্তে ধুয়ে দিলো। তারপর ব্রান্ডেজ এনে বেঁধে দিলো ভালো করে। আপনি একটু বসুন। এই বলে ভাবী ভেতরে গিয়ে এক গ্লাস দুধ আর কিছু জ্যাম মাখানো বিস্কিট এসে ক্যাপ্টেনের সামনে রাখলো।
বাবা বললেন, আপনি এখন কোথায় যাবেন?
বিস্কিট চিবুতে চিবুতে ক্যাপ্টেন বললেন, চট্টগ্রাম। সেখানে বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর সঙ্গে যোগ দেবো।
বাবা বললেন, ঢাকা ক্যান্ট-এর বেঙ্গল রেজিমেন্ট যারা ছিলো তাদের কোন খবর জানেন?
ক্যাপ্টেন একটু ভেবে বললেন, ওদের সম্ভবত আন-আর্মড করে রাখা হয়েছে।
বাবাকে বিচলিত মনে হলো–ওদের কেউ কি পালাতে পারেনি?
ক্যাপ্টেন বললেন, এ মুহূর্তে বলতে পারছি না। আপনার পরিচিত কেউ আছে নাকি সেখানে?
আমার ছোট ছেলে। টেনথ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে রয়েছে।
ভাবী বললো, সেদিন বাবলুকে এত করে বললাম যেয়ো না। বললো পালিয়ে কেন আসবো। বেরুতে হলে অস্ত্র নিয়েই বেরুবো।
ক্যাপ্টেন ম্লান হাসলেন–ছেলেমানুষ! কত বয়স ওর?
বাবা বললেন, সতেরো।
নিশ্চয়ই ট্রেনিং-এ ছিলো? জানতে চাইলেন ক্যাপ্টেন।
ভাইয়া জবাব দিলো, ন্যাশনাল সার্ভিস কোরের ট্রেনিং-এ গিয়েছিলো। ওদের ব্যাচে ছশ ছেলে আছে।
বাবা ক্যাপ্টেনকে বললেন, আপনি চাটগাঁ যাচ্ছেন কীভাবে?
ক্যাপ্টেন একটু ভেবে বললেন, ব্রাক্ষণবাড়িয়া হয়ে ইন্ডিয়ার ওপর দিয়ে যেতে হবে। কুমিল্লা ক্যান্ট সম্ভবত আর্মির দখলে।
বাবা অবাক হলেন–ইন্ডিয়ার ওপর দিয়ে যেতে দেবে?
ওদের সিকুরিটি ফোর্সের সঙ্গে আলাপ করে নেবো।
দেয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে চারটার ঘন্টা বাজলো।
ক্যাপ্টেন বললেন, চলি তাহলে। অনেক দূর যেতে হবে।
বাবা মাথা নাড়লেন–আসুন। দাঁড়িয়ে হাত মেলালেন। তারপর ক্যাপ্টেনের পিঠে হাত রেখে বললেন, ভালো থাকুন।
ক্যাপ্টেন বেরিয়ে গেলেন। বহুক্ষণ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন বাবা।
বাগানের অন্ধকার পথে ক্যাপ্টেন হারিয়ে গেলেন।
ভাইয়া ভাবীকে জিজ্ঞেস করলো, বাবলু তো গত রোববারের আগের রোববারে এসেছিলো, তাই না?
ভাবী একটু ভেবে মাথা নাড়লো–হ্যাঁ।
বাবু বললো, ও বলেছিলো, গত রোববার যদি না আসে ধরে নিতে হবে ওদের খুব অসুবিধে হচ্ছে!
শেষ রাতে মেশিনগানের তান্ডব আগের চেয়ে অনেক কমে গিয়েছিলো। তবু সে রাতে ওরা কেউ ঘুমোতে পারেনি। ছোট্ট হিমিও বার বার জেগে উঠেছে। পোষা কুকুর কেটি আর টম সোফার কাছে গুটিসুটি মেরে বসেছিলো। ওদের চোখেও ভয়ের ছায়া। কেউ বুঝতে পারছে না অন্ধকার শহরে কি ঘটছে! বাবু শুধু বার বার ভাবলো বাবলুর কথা। আর মিনুর কথা। বাবলু সম্ভবত ক্যান্টনমেন্ট। মিনু রাজারবাগ। ওদের জন্যে ভীষণ ভয় হলো বাবুর।
.
০২.
সে রাতে বাবলু ছিলো ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। টেনথ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নতুন রিক্রুট–ওরা ছশ ছেলে। সারা রাত ওদের চোখেও ঘুম ছিলো না।
ওদের সবার বয়স সতেরো থেকে আঠারোর ভেতর। কলেজে ওরা ইন্টারমিডিয়েট পড়তো। গত জানুয়ারিতে সবাই এখানে এক বছরের সামরিক
প্রশিক্ষণ নিতে এসেছে। তিনটি কোম্পানিতে ভাগ করা ছশ ছেলে। ট্রেনিং-এর কোর্স অনেকটা এগিয়ে গেছে। রাইফেল, স্টেনগান, মেশিনগান, গ্রেনেড আর মর্টারের ব্যবহার শেখা শেষ। ম্যাপিং-এর ক্লাশ সবে শুরু হয়েছে। সেদিন হঠাৎ হাবিলদার মেজর সুলতান আহমদ বললেন, তোমাদের ক্লাশ কিছুদিনের জন্য বন্ধ থাকবে।
জিওসি সায়েবজাদা ইয়াকুব খান কদিন আগে রিজাইন করেছেন। সারা ক্যান্টনমেন্টে চাপা গুঞ্জন। শহরের গায়ে লাগানো হলেও ভেতরে বসে বোঝার উপায় নেই বাইরে কী ঘটছে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মার্চের এক তারিখে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করেছেন। বাবলুরা সে খবর শুনেছে রেডিওতে। তিন তারিখে অধিবেশন হবার কথা ছিলো। আরো খবর পেয়েছে সারা শহর বিক্ষুব্ধ। প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণ কেউ সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। দশ তারিখে প্রেসিডেন্ট গোল টেবিল বৈঠক ডেকেছেন।
আওয়ামী লীগ আর ন্যাপ সারা দেশ জুড়ে হরতাল ডেকেছে। শহরে কারফিউ জারি করা হয়েছে। পাঞ্জাবি সৈন্যরা টহল দিচ্ছে। তারপর খবর শুনলো ছাত্ররা কারফিউ ভেঙে রাস্তায় মিছিলে নেমেছে। সৈন্যরা মিছিলের ওপর গুলি করেছে। অনেক ছাত্র মারা গেছে। এ সমস্ত ঘটনা ঘটেছে মার্চের দুতারিখে।
এর পরের ঘটনাগুলো খুব তাড়াতাড়ি বদলে যেতে লাগলো, যার জন্যে আগে থেকে কেউ প্রস্তুত ছিলো না। তিন তারিখে ছাত্ররা পল্টন ময়দানে সভা করলো। তারা বললো, এখন থেকে পূর্ব বাংলা স্বাধীন। এ দেশের নাম এখন বাংলাদেশ। তারপর ওরা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ালো। সবুজ পতাকা। মাঝখানে সূর্য, যার ভেতর বাংলাদেশের সোনালি মানচিত্র আঁকা! ছাত্ররা জাতীয় সঙ্গীত ঘোষণা করলো আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।
রাতে রিফ্রেশমেন্ট রুমের টেলিভিশনে বাবলুরা সেই মিটিং-এর ছবি দেখেছে। পল্টনের ময়দান লোকে লোকারণ্য। যখন শেখ মুজিব বক্তৃতা দিতে উঠলেন, সারা মিটিং শ্লোগানে ফেটে পড়লো–জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু!
শেখ মুজিব বক্তৃতা দিলেন। বললেন, শান্তিপূর্ণ হরতাল চালিয়ে যেতে। কঠোর ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হতে। সাত তারিখে রমনার মাঠে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেবেন।
বাবলুদের রাত দশটা পর্যন্ত টেলিভিশন দেখতে দেয়া হয় তারপর ঘুমোতে যেতে হবে। ঘুম কি আসে! উত্তেজনায় সবাই দপদপ করে জ্বলছে। কেউ বললো, এবার সত্যিই স্বাধীনতা আসছে। একজন বললো, ক্যাপ্টেন করিমের কথা শুনেছিস! পাজিটা বাঙালি হয়েও বলে কিনা ও-সব আওয়ামী লীগের স্বপ্নমাত্র। আর্মি পাকিস্তানকে কিছুতেই ভাঙতে দেবে না।
কয়েকজন একসঙ্গে বললো, বেইমান!
বাবলু সবই শুনতো। ভাবতো কীভাবে স্বাধীনতা আসবে। এখানে ওর অনেক বন্ধু। সবাই ওরা স্বাধীনতা চায়। পশ্চিমাদের সঙ্গে এক থাকা আর কিছুতেই সম্ভব নয়। এই সেনাবাহিনীতেই তো ওরা দেখেছে বাঙালি অফিসার হাতে গোনা যায়। তাও একেক জনের প্রমোশন আটকে থাকে বছরের পর বছর।
জিওসি সায়েবজাদা ইয়াকুবকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি নাকি এই অপারেশনের বিরুদ্ধে ছিলেন। তার জায়গায় এসেছেন খাদেম হোসেন রাজা। পাঁচ তারিখে আবার প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণ শোনা গেলো। আওয়ামী লীগ আর শেখ মুজিবের ওপর যথেষ্ট ক্ষুব্ধ মনে হলো ইয়াহিয়াকে। পঁচিশ তারিখ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। তিনি যে কোন দিন ঢাকা আসছেন।
বাবলুরা দেখলো, রেজিমেন্ট-এর পর রেজিমেন্ট সৈন্য আসছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। উড়োজাহাজ বোঝাই করে অস্ত্র আসছে। ওদের ট্রেনিং বন্ধ হয়ে গেলো। কাজ হলো অস্ত্র গুদামে নেয়া আর ট্রেঞ্চ খোঁড়া। শহরে ভীষণ উত্তেজনা। অসহযোগ আন্দোলন চলছে। স্কুল কলেজ অফিস আদালত সব বন্ধ, সারাদিন শুধু মিছিল আর বিক্ষোভ। বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে সারা বাংলাদেশ। রাতে শহরে কারফিউ থাকে। কেউ সেই কারফিউ মানে না। কারফিউ ভেঙে মিছিল বেরোয়। মিছিলের ওপর গুলি চলে নির্বিচারে। রক্তে ভেসে যায় শহরের রাস্তা। তবু মিছিল চলে অবিরাম।
সাত তারিখ মিটিং-এর দিন বাবলুরা ভয়ানক একটা কিছু ঘটবার জন্যে তৈরি হয়ে থাকলো। ভোর না হতে দেখলো দূর দূরান্তের গ্রাম থেকে সবাই মিটিং-এ যোগ দেয়ার জন্য আসছে, ট্রাকে বাসে বোঝাই হয়ে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো শুধু মানুষের মিছিল। সবার মুখে একই শ্লোগান জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
ক্যান্টনমেন্টের জাঁদরেল পশ্চিমা অফিসাররা ভয় পেয়ে গেলো। জেনারেলদের জরুরি বৈঠক বসলো। বাঙালি সৈন্যদের ওরা রীতিমতো সন্দেহের চোখে দেখছে। ওদের কোন কাজের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে না। সেদিন কিছু অবাঙালি সৈন্যকে পাঠানো হলো শহরে। বেশির ভাগ রইলো ক্যান্টনমেন্টের পাহারায়।
খবরের পর খবর আসতে লাগলো। রমনার ময়দানে পাঁচ লাখ মানুষ জমা হয়েছে শেখ মুজিবের ভাষণ শোনার জন্য। সবার হাতে লম্বা বাঁশের লাঠি। অনেকের লাঠির মাথায় বর্শার ফলক বসানো। পাঞ্জাবি অফিসাররা ভয় পেলো–ওরা ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করবে নাতো!
ব্যারাকে বসে গভীর উত্তেজনায় সময় কাটছিলো বাবলুদের। দুএকজন বাইরে থেকে টুকরো টুকরো খবর আনছিলো। বাবলু বললো, ওরা যদি ক্যান্টমেন্ট ঘেরাও করে তাহলে বাধা দেওয়া অসম্ভব।
রশিদ বললো, ওরা পাঁচ লাখ, কত মারবে?
বাবলু জোর গলায় বললো, মারলেই হলো? আমরা কি চুপচাপ এভাবে বসে থাকবো? এমনেশন ডাম্প উড়িয়ে দেবো না!
হাসান বললো, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের পতন মানে বাংলাদেশ আমাদের দখলে।
ওরা সবাই বারুদের মতো জ্বলছিলো। সবাই উদগ্রীব হয়ে বসেছিলো ভীষণ একটা কিছু ঘটবার অপেক্ষায়। শেষ অবধি ওরা যা ভেবেছিলো তার কিছুই হলো না। ট্রাকে বাসে গ্রামের সবাই আবার–জয় বাংলা শ্লোগান দিতে দিতে ফিরে গেলো। রাতে রেডিয়োর খবর শুনলো। শেখ মুজিব সামরিক সরকারকে চার দফা প্রস্তাব দিয়েছেন, যেগুলো না মানলে তিনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বসবেন না।
রশিদ ক্ষুব্ধ হয়ে বললো, বয়ে গেছে প্রস্তাব মানতে। দেখো, আমি বলে দিলাম শেখ মুজিব শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়ার সাথে আপোস করবেন।
অসম্ভব! রেগে গেলো বাবলু–আপোসই যদি করবেন তাহলে গোলটেবিলে বসতে রাজি হলেন না কেন?
হাসান এদের ভেতর অনেকটা ধীর স্থির। বললো, আমার মনে হয় শেখ মুজিব আপোস করে মিনিস্ট্রি ফর্ম করলেই ভালো করতেন। আগে ক্ষমতায় বসে পরে ইচ্ছেমতো যা খুশি করা যেতো। নইলে দেখো প্রতিদিন মানুষ মরছে। আর এটা চলতেই থাকবে।
শফি বললো, খুব বুঝেছো। ক্ষমতা ওরা মুজিবকে কোন অবস্থাতেই দেবে
না। সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না করলেও মুজিব বলে দিয়েছেন এটা স্বাধীনতার সগ্রাম।
সেদিন রাতেই হাবিলদার মেজর সুলতান আহমেদ এলেন ওদের কাছে। বললেন, চট্টগ্রাম থেকে ব্রিগেডিয়ার মজুমদার নির্দেশ পাঠিয়েছেন। যে কোন মুহূর্তে বিদ্রোহ ঘোষণার জন্যে সবাই যেন প্রস্তুত থাকে।
আবার সবাই উদ্দীপ্ত হলো। একজন বললো, এখানকার বাঙালি অফিসাররা সবাই কি জানেন?
না। বুড়ো হাবিলদার মেজর সাবধান করে দিলেন কমিশনড অফিসারদের অনেকেই আমাদের দলে নেই। ক্যাপ্টেন করিমকে তো তোমরা দেখেছো। ওর মতো অনেক আছে। তবে এটা মনে রেখো বেইমানদের আমরা কখনো ক্ষমা করবো না।
তখন থেকে এক ভীষণ উত্তেজনার সময় কাটতে লাগলো ওদের। শেখ মুজিবের ডাকে অসহযোগ আন্দোলন চলছে সারা দেশ জুড়ে। চিফ সেক্রেটারি, চিফ জাস্টিস থেকে শুরু করে সবাই সে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। গভর্নর হয়ে এসেছিলেন টিক্কা খান। চিফ জাস্টিস টিক্কা খানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে অস্বীকার করলেন।
হাবিলদার মেজর বললেন, টিক্কা খানের মতো ভয়ানক লোক আর্মিতে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না। একে যখন পাঠিয়েছে তখন বুঝতে হবে দাবার ছকে এটাই ইয়াহিয়ার শেষ চাল।
গভীর আগ্রহ নিয়ে সবাই অপেক্ষা করতে লাগলো। যে কোন সময়ে নির্দেশ আসবে বিদ্রোহের। সবাই সেই বিদ্রোহের অপেক্ষা করছে।
বাবলু চোদ্দ তারিখে লুকিয়ে বাড়ি গিয়েছিলো। অন্য সময়ে রোববারে ওদের ছুটি থাকে। অথচ সেদিন চারদিকে কড়া পাহারা। নোটিশ দেয়া হয়েছে কেউ ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যেতে পারবে না।
যাবার সময় ট্রেনার হাবিলদার রহমান বাবলুকে সাবধান করে দিয়েছেন–ধরা পড়া মানে কোর্ট মার্শাল।
বাড়িতে সবাই বাবলুকে বললো, থেকে যেতে। বাবা বললেন, খুব খারাপ সময় আসছে। বাবলু কারো কথা শোনেনি। ও নিজেও জানে খারাপ সময়টা কি। বাবুকে সব খুলে বলেছিলো। দুবছরের বড়ো ভাইটির কাছে বাবলু বন্ধুর মতো অন্তরঙ্গ।
চোদ্দ তারিখের পর বাবলু আর বাড়ি যেতে পারেনি। পনেরো তারিখে প্রেসিডেন্ট ঢাকা এলেন। মুজিবের সাথে আলোচনায় বসলেন। অসহযোগ আগের মতো চলতে থাকলো। সৈন্যরাও নির্বিচারে গুলি চালিয়ে যেতে লাগলো। শহরে বিক্ষেভের পর বিক্ষোভ। শিল্পী সাহিত্যিকরা সংগ্রাম শিবির গঠন করলেন। সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীরা সগ্রাম কমিটি করলেন। তেইশে মার্চে ইসলামী প্রজাতন্ত্র দিবস পালনের বদলে সব জায়গায় প্রতিরোধ দিবস পালন করা হলো। পাকিস্তানের তেইশ বছরের ইতিহাসে সেদিন প্রথম সকল সরকারি আর বেসরকারি ভবনে পাকিস্তানি পতাকার বদলে বাংলাদেশের পতাকা উড়লো।
তেইশ তারিখে বাবলুরা একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার লক্ষ্য করলো। অবাঙালি অফিসারদের মধ্যে কেমন যেন একটা চাপা উল্লাস। অসহযোগের দীর্ঘ সময় ক্যান্টনমেন্টের সৈন্যদের শুধু ডাল রুটি খেয়ে থাকতে হয়েছে। স্টোরের জমানো মাংসে অল্প কদিন চলেছিলো। মাছ, তরকারি একেবারেই জোটেনি। ডাল, রুটি, আর আলু সেদ্ধ–বাবলুরা তাই খেয়েছে। অবাঙালি সৈন্য অফিসার সবাই বিরক্ত, কিছুটা বিষণও বটে। এই প্রথম ওদের উল্লসিত হতে দেখে বুড়ো হাবিলদার মেজর বললেন, বদমাইশরা নিশ্চয়ই কোন ষড়যন্ত্র করছে।
আরো এক খবর পেলো ওরা। চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র বোঝাই হয়ে যুদ্ধ জাহাজ সোয়াত এসেছে। চট্টগ্রামের মানুষ সেই অস্ত্র নামাতে দিচ্ছে না। বন্দর থেকে আগ্রাবাদ পর্যন্ত সারা পথে শুধু ব্যারিকেডের পর ব্যারিকেড, সৈন্যরা ভাঙতে পারেনি।
টান টান উত্তেজনার ভেতর দিয়ে চব্বিশ তারিখ কাটলো। পঁচিশ তারিখ সবখানে চাপা গুজব। ইয়াহিয়া-মুজিবের বৈঠক ব্যর্থ হয়েছে। সন্ধ্যেয় সামরিক বিমান ঘাঁটি থেকে গোপনে প্রেসিডেন্ট করাচি চলে গেছেন।
টেলিভিশনে রাত নয়টার খবর শুনে বাবলুরা শুতে যাবে, হঠাৎ লক্ষ্য করলো ওদের ব্যারাক ঘিরে রেখেছে অসংখ্য অবাঙালি সৈন্য। এমনেশন ডাম্প-এ কড়া পাহারা বসেছে। ওদের একজন জিজ্ঞেস করলো, কী ব্যাপার।
প্রচন্ড ধমক খেলো–শুতে যাও।
তারপরই ওরা চমকে উঠলো। ওদের ব্যারাক থেকে কনভয়ের পর কনভয় সৈন্য শহরের দিকে যাচ্ছে। গুনতে গুনতে দিশেহারা হয়ে গেলো বাবলু। সবার চোখে মুখে একরাশ ভয় আর বিস্ময়ের ছাপ এত সৈন্য কোথায় যাচ্ছে? ব্যারাকে ফিরে লাইট নিবিয়ে ওরা বসে রইলো। রশিদ বললো, নিশ্চয়ই সগ্রাম পরিষদের লোকেরা ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করার জন্য এসে গেছে।
গভীর উদ্বেগ আর উত্তেজনায় সময় কাটতে লাগলো। প্রথমেই ওরা শুনলো মর্টারের শব্দ। খুব কাছেই হলো শব্দটা। বাবলু বললো, বনানী। তারপর আর কোন শব্দ নেই। রাত তখন সোয়া এগারোটা। কিছুক্ষণ পরই মেশিনগান আর মর্টারের গোলার অবিরাম শব্দে সবাই চমকে উঠলো। ট্যাঙ্ক, মেশিনগান আর মর্টারের সম্মিলিত গর্জন ওদের ভীষণ এক যুদ্ধক্ষেত্রের কথা মনে করিয়ে দিলো।
একটা ঘরের ভেতর ওরা তিরিশজন বসেছিলো। বাইরে টহল দিচ্ছে পাঞ্জাবি সৈন্য। তখনও সৈন্য বোঝাই করে ট্রাকগুলো একের পর এক বেরিয়ে যাচ্ছে।
শফি বললো, শব্দটা লক্ষ্য করো। এতক্ষণ একতরফা হচ্ছিলো। এখন মনে হয় পাল্টা আক্রমণ শুরু হয়েছে।
সবাই কান পেতে শুনলো। রাইফেলের শব্দ না?
শফি বললো, রাইফেল আছে। বন্দুকও আছে বলে মনে হচ্ছে।
ওরা আরো মনোযোগ দিয়ে শুনলো। একটানা মেশিনগানের গর্জনের ফাঁকে ফাঁকে বন্দুক আর রাইফেলও গর্জে উঠছে। তবে সেই শব্দের সংখ্যা খুবই কম। মেশিনগানগুলো সব কটা যেন পাল্লা দিয়ে গোলাবর্ষণ করছে।
বাবলু বললো, হেভি মেশিনগান।
শফি বললো, সব মাটির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে।
হাসান বললো, শব্দটা আমার মনে হয়ে রাজারবাগের দিক থেকে আসছে। পুলিশ বোধ হয় বিদ্রোহ করেছে।
চারপাশে আতঙ্কের অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। সারা শহর অন্ধকার। দক্ষিণের আকাশ থেকে কখনও শুধু বিদ্যুতের ঝলকের মতো আলো দেখা যাচ্ছে। ওরা যুদ্ধের ছবি দেখেছে টেলিভিশনে। মনে হলো তেমনি একটা যুদ্ধক্ষেত্রের নিরব দর্শক ওরা, দর্শকও নয়–শ্রোতা। শুধু শুনছে আর অনুভব করছে তার ভয়াবহতা।
.
০৩.
যুদ্ধ চলছিলো রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বিরাট মাঠ। ঢুকতে গেলে একপাশে বড়ো একটা পুকুর। নারকেল গাছের সারি তার চারপাশে। পুকুরের পরই বিশাল প্যারেড গ্রাউন্ড, ডান পাশে ব্যারাক।
ব্যারাকের পুলিশেরা অতর্কিত আক্রমণের জন্যে এতটুকু প্রস্তুত ছিলো না। রাত এগোরোটা নাগাদ আর্মির একদল গিয়েছে ইপিআর হেডকোয়ার্টার আর ইউনিভার্সিটির দিকে, অপর দল এসেছে রাজারবাগ। ওরা যখন একেবারে গায়ের ওপর এসে পড়েছে তখনই ব্যারাকের পুলিশে খবর পেলো। সন্ধ্যে থেকে অবশ্য একটা চাপা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিলো–রাতে আর্মি এ্যাটাক করতে পারে, কেউ তখন গুরুত্ব দেয়নি। কোন কারণ খুঁজে পায়নি–আর্মি হঠাৎ কেন ওদের আক্রমণ করবে!
ওরা তৈরি হলো শেষ মুহূর্তে। তখন ইউনির্ভাসিটির দিকে প্রচন্ড শেলিং হচ্ছে, মগবাজারের ওদিকে সাঁজোয়া গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে। হাতের কাছে বন্দুক আর রাইফেল ছাড়া কিছুই ছিলো না। তাই নিয়ে বাঙালি পুলিসরা প্রতিরোধের জন্যে প্রস্তুত হলো।
ব্যারাকের সঙ্গে প্রায় লাগানো রাস্তার ওধারে তেতালা বাড়িটা ছিলো মিনুদের। ও আর বাবু ইউনিভার্সিটিতে একই ক্লাশে পড়ে। দুজন চমৎকার বন্ধু।
তখনও মিনুদের বাড়ির কেউ ঘুমোয়নি। রাত সাড়ে দশটা। মিনু বাবুর কথা ভাবছিলো। কাল রানার পত্রিকার অফিসে ও দেখা করতে বলেছে। ওরা দুজন সাপ্তাহিক রানার-এর সহকারী সম্পাদক।
মিনু ভাবছিলো বাবুকে বলবে ওর ডায়েরিটা পড়তে দিতে। দেখবে বাবু ওর কথা কতখানি ভাবে। ঠিক তখনই তীক্ষ্ণ শব্দে নিচের তলার কলিং বেলটা বেজে উঠলো।
মিনুর মা আর বাবা পাশের ঘরে বসে কথা বলছিলেন। ওর বড় ভাই শওকত এখনও ফেরেনি। কদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকাতে ও রাত করে বাড়ি ফিরছে।
কলিং বেলটা একটানা বেজেই চললো। বাবা নিচে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে কতগুলো লোক ঘরে ঢুকলো। কারো পরনে পায়জামা গেঞ্জি। কারো লুঙ্গি শার্ট। সবার হাতে বন্দুক আর রাইফেল। একজন ব্যস্ত গলায় বললেন, আমরা পুলিস হেডকোয়ার্টার থেকে আসছি। আপনাদের তেতালায় কে থাকে?
মিনুর বাবা অবাক হয়ে বললেন, কেউ না। ভাড়াটে চলে যাওয়াতে মাসখানেক খালি পড়ে আছে।
ভদ্রলোক বললেন, ঠিক আছে। আপনারা সবাই নিচে চলে যান। আজ রাতে এখানে আর্মি এ্যাটাক করবে।
মিনুর বাবা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন–আর্মি এ্যাটার্ক! কেন?
জানি না। ভদ্রলোক একটু অসহিষ্ণু হলেন–ওরা বেরিয়ে পড়েছে। এক্ষুণি এলো বলে। আমরা কজন এখান থেকে ডিফেন্স দেবো।
আমাদের বেসমেন্টে হলরুম আছে একটা। ওখানে যাবো?
তাহলে আরও ভালো। ঝটপট ঢুকে পড়ন। দ্রলোক ব্যস্ত হয়ে তেতালায় উঠে গেলেন।
দরজার কাছে অবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো মিনু। পেছনে মা। মায়ের মুখটা কাগজের মতো সাদা হয়ে উঠেছে। বাবা বললেন, কিছু খাবার নিয়ে এক্ষুনি নিচের কামরায় চলে যাও!
মা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটুও নড়লেন না। শুধু বললেন, আমার শুকু!
বাবা থমকে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, এদিকে গন্ডগোল শুনলে শওকত নিশ্চয়ই ওর কোন বন্ধুর বাড়িতে থেকে যাবে।
মিনু ঘরে ঢুকে ফ্রিজ খুলে হাতের কাছে যা পেলো, নিয়ে নিচে নেমে এলো। শওকত তার বন্ধুদের নিয়ে মাঝে মাঝে এ ঘরে টেবিল টেনিস খেলে। লম্বা টেবিল আর কয়েকখানা চেয়ার রয়েছে একদিকের দেয়ালে।
মাকে নিয়ে একটু পরে মিনুর বাবা এলেন। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে চেয়ারে এসে বসলেন। আপন মনে বললেন, কিছুই বুঝতে পারছি না। আর্মি কেন অ্যাটাক করতে আসবে!
টেবিলে খাবারগুলো রাখতে রাখতে মিনু বললো, বাবু সেদিন বলছিলো, বেঙ্গল রেজিমেন্ট নাকি যে কোন সময়ে বিদ্রোহ করতে পারে।
ওর বাবা বিড়বিড় করে বললেন, কিছুই বুঝতে পারছি না।
তখনও ওদের খাওয়া হয়নি। মা পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে বসেছিলেন। মিনু জোর করে বাবা মাকে কিছু খাওয়ালো। নিজেও খেলো। ওর কাছে পুরো ব্যাপারটা ভীষণ অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিলো। ও ভাবছিলো, কাল রানার-এর বাবুর সঙ্গে দেখা করবে। আগামী সংখ্যার লেখাগুলো এখনো ঠিক করা হয়নি। আর্ট কলেজে গিয়ে নবী ভাইকে দিয়ে কটা কার্টুন আঁকিয়ে নিতে হবে। রানার-এর ব্যাপারে নবী ভাইর আগ্রহ কম নয়।
হঠাৎ শুনলো দূরে কামানের গর্জন। ওরা সবাই একসঙ্গে চমকে উঠলো। মা আরো ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন। বাবা বিভ্রান্ত। তারপর আবার সব কিছু শান্ত। অস্বাভাবিক রকম শান্ত। রাত এগারোটার পরও ওদের সামনের রাস্তা দিয়ে বাস, স্কুটার, আর গাড়ি অবিরাম শব্দ করে চলে। দূরে চায়ের দোকানে লাউড স্পিকারে হিন্দি ছবির গান বাজে। আরো দূরে আলো ঝলমল কমলাপুর স্টেশন। সারারাত দিনের মতো ব্যস্ত, আলোতে উজ্জ্বল হয়ে থাকে। আজ সমস্ত শব্দ আর কোলাহল এক অস্বাভাবিক আতঙ্কে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।
কামানের শব্দের পর মিনিট পনেরোর মতো কাটলো। তারপরই শুরু হলো মেশিনগানের ভয়াবহ শব্দ। অবিরাম একটানা গুলিবৃষ্টি হতে লাগলো। ওপরের তলায় ঝনঝন করে জানালার কাঁচ ভাঙার শব্দ হলো। ভারী কিছু পড়ার শব্দ শোনা গেলো। সেই সঙ্গে রাইফেলের শব্দ। তেতালা থেকে পুলিসের লোকেরা পাল্টা গুলি চালালো।
তারপর শুধু মেশিনগান আর রাইফেলের অবিরাম গর্জন। থেকে থেকে মর্টারের বিস্ফোরণে পুরো বাড়িটা থরথর করে কেঁপে উঠছিলো। কিছুক্ষণ আগের অস্বাভাবিক নিরবতা প্রচন্ড আক্রোশের শব্দে ফেটে পড়লো।
মাটির নিচের ঘরটায় ওরা তিনজন তিনটে পাথরের মূর্তি হয়ে বসেছিলো। কারো মুখে কোন কথা নেই। দেখলে মনে হবে বহু বছর ধরে ওরা ঠিক এভাবে বসে আছে।
হঠাৎ মিনুর মা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন–আমার শওকত! ও বাড়ি ফিরবে কী করে?
মিনুর বাবা চাপা গলায় বললেন, চুপ করো। বললাম তো ও এখন ফিরবে । ওদিকে কোথাও থেকে যাবে।
মিনু মার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ওর গলা কাঁপছিলো–ছেলেমানুষি করছো কেন মা! ভাইয়া যেখানে থাকুক ভালো আছে। তুমি চুপ করো।
মা চুপ করলেন। কিন্তু তার কান্না থামলো না। শব্দ না করে তিনি অঝোরে কেঁদে চললেন।
রাত আরো গম্ভীর হলো। রাইফেলের শব্দ কমে আসছিলো। আর মেশিনগানের শব্দ জোরালো হচ্ছিলো। শব্দের এতটুকু বিরাম নেই। ওপর তলায় রাইফেলের শব্দ এক সময়ে একেবারেই থেমে গেলো। অন্য কোন জায়গা থেকে একটা দুটো রাইফেল কিছুক্ষণ পর পর শব্দ করছিলো। মেশিনগানের প্রচন্ড হিংস্র শব্দ সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোকে থামিয়ে দিলো।
শেষ রাতে দরজায় কে যেন ধাক্কা দিলো। উঠে দরজা খুললো মিনু। রাতের সেই দ্রলোক। সারা জামা রক্তে লাল। দরজা ধরে দাঁড়ালেন। বললেন, আমরা আর পারলাম না। চলে যাচ্ছি। দোতালার ঘরে কিছু বন্দুক আছে। ওগুলো সরিয়ে ফেলুন।
কথা শেষ করে ভদ্রলোক আর দাঁড়ালেন না। দরজায় রক্তাক্ত হাতের ছাপ রেখে চলে গেলেন। বাইরে তখনও মেশিনগানের শব্দ হচ্ছে।
মা তেমনি নিশ্চল বসে রইলেন। বাবার সঙ্গে দোতালার ঘরে এলো মিনু। বাবা দেয়াশলাই জ্বাললেন। তাঁর হাত কাঁপছিলো। প্রত্যেকটা ঘর বিধ্বস্ত। কিছুক্ষণ আগের পরিচিত ঘরগুলোর সঙ্গে এ ঘরগুলোর কোনো মিল নেই। সারা
দেয়াল গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। জানালার একটাতেও কাঁচ নেই। ড্রেসিং টেবিলের বড়ো আয়নাটা গুঁড়ো গুড়ো হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে। ঘরময় শুধু ভাঙা কাঁচ।
পায়ের নিচে ঠান্ডা চটচটে কী যেন মনে হলো। আলো নিচু করে ধরলেন মিনুর বাবা। দেখলেন কাঁচা রক্ত ছড়িয়ে আছে মেঝেতে, জানালার গ্রিল-এ, দেয়ালের গায়ে। পর্দার মাঝে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ।
বাবা কাঁপা গলায় বললেন, সাবধানে পা ফেলো।
বন্দুক আর রাইফেলগুলো জানালার কাছে পড়েছিলো। রাইফেলের গায়েও রক্তের দাগ। মিনু বললো, এতগুলো রাখবো কোথায় বাবা?
বাবা একটু ভাবলেন। বললেন, ছাদের পানির ট্যাংকে ডুবিয়ে রাখবো।
মিনু গুনলো। বাবা পনেরোটা রাইফেল আর বন্দুক নিয়ে ছাদে গেলেন।
অন্ধকারে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেলেন। মিনু বললো, আলোটা জ্বালবো বাবা?
না। বাবার গলা কাঁপছিলো–অন্ধকারই থাকুক। আলো মানে বিপদ ডেকে আনা।
কি অস্বাভাবিক পরিবর্তন, মিনু ভাবলো। অন্ধকারই এখন পরম বন্ধু। আলো মানে ভয়, আলো মানে মৃত্যু!
আবার ওরা নিচের ঘরে এলো। ভোর হয়ে গেছে। ঘড়িতে ছটার ঘন্টা বাজলো। কোথাও এতটুকু শব্দ নেই। মিনুর মনে হলো ভোরের পাখিগুলো সব মরে গেছে। নয়তো ডাকতে ভুলে গেছে।
বাবা বললেন, এ বাড়ি ছেড়ে আমাদের চলে যাওয়া উচিত।
না। মার গলা শুনে মিনু চমকে উঠলো। ভীষণ শান্ত গলায় মা বললেন, শওকত ফিরে না আসা পর্যন্ত এ বাড়ি ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না।
বাবার দিকে তাকালো মিনু। বাবা মাথা নিচু করলেন। বিড়বিড় করে কী যেন বললেন।
.
০৪.
অনেকগুলো মৃতদেহের ভিড়ে শওকত নিজেও একটা মৃতদেহ হয়ে পড়ে ছিলো। স্কোয়াশ স্পোর্টিং ক্লাবের জানালা দিয়ে ভোরের আলো গড়িয়ে পড়েছে। রোদের আঁচ লাগলো ওর মুখে। চোখ মেলে তাকালো। কেমন যেন ঝাঁপসা মনে হলো। ভালো করে চোখ রগড়ে আবার তাকালো। সবকিছু দেখে চমকে উঠলো শওকত।
তাহলে সে বেঁচে আছে! এই বিস্ময়টাই সবচেয়ে বড় হয়ে তাকে আঘাত করলো। নিজেকে দেখলো বার বার। না স্বপ্ন নয়। স্কোয়াশ ক্লাবের সেই ঘরটাই–কাল রাতে ওরা যেখানে ছিলো। কাঁধের কাছে চিনচিনে একটা যন্ত্রণা অনুভব করলো শওকত। চেয়ে দেখলো রক্ত জমে আছে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে। অল্প অল্প রক্ত এখনও বেরুচ্ছে।
আবার তাকালো চারপাশে। সবাই যেন ঘুমিয়ে আছে। নাসিম, কামাল, ইরফান আর বিপ্লব। ওদের এ ঘুম আর কোনদিন ভাঙবে না। কামালের গায়ে হাত দিয়ে দেখলো। সারা শরীর শক্ত হয়ে গেছে ।
পুরো ব্যাপারটা শুরু থেকে ভাবাবার চেষ্টা করল শওকত। রোজকার মতো ওরা সবাই স্কোয়াশ ক্লাবে সন্ধ্যেটা কাটাতে এসেছিলো। সারাক্ষণ হৈ চৈ করে কাটিয়েছে। দশটার দিকে ক্লাবের দারোয়ান এসে বললো, শহরের অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না। ক্লাব বন্ধ করে দেবো।
ওরা বেরিয়ে পড়লো। সারা শহরে অস্বাভাবিক নিরবতা। হাঁটতে হাঁটতে ওরা গুলিস্তানের সামনে এলো। থমকে দাঁড়ালো চৌরাস্তার মোড়টায়। রাস্তায় কোন লোকজন নেই। দোকানের আলো ঝলসানো বিজ্ঞাপনগুলো অন্ধকার। রাত বারোটা একটা অবধি ব্যস্ত জিন্না এভিন্যুতে দশটার ভেতরই মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। বেশিরভাগ লাইটপোস্টে আলো নেই। প্রায় অন্ধকার সামনের রাস্তাগুলো খাঁ খাঁ করছে। কোথাও কোন মানুষের সাড়া শব্দ নেই।
ওরা ভীষণ অবাক হলো। ঠিক সেই মুহূর্তে সৈন্যভর্তি একটা লরি সাঁ করে ওদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। চমকে উঠলো সবাই। ইরফান বললো, ব্যাপারটা কেমন যেন গোলমেলে মনে হচ্ছে আমার।
কামাল বললো, আমি বাড়ি যাবো কীভাবে? বাস বন্ধ। একটা স্কুটার পর্যন্ত নেই।
বিপ্লব বললো, এমন তো হবার কথা নয়। কোথাও হয়তো কোন গন্ডগোল হয়েছে।
নাসিম বললো, আমার মনে হয় এখন আমাদের না যাওয়াই উচিত। চলো, আজ রাতের মতো ক্লাবে থেকে যাই।
শওকত বললো, সেই ভালো। চলো ক্লাবে ফিরে যাই।
ওরা ফিরে এলো। দারোয়ান তখন সামনের দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। নাসিম বললো, তালা বন্ধ করো না। আমরা আজ রাতটা এখানেই। কাটাবো।
দারোয়ান মাথা নেড়ে সায় জানালো–শহরের অবস্থা আমারও ভালো মনে হচ্ছে না।
ভেতরে গিয়ে দরজা খুলে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে দারোয়ান বললো, আমি কাল সকালেই আসবো।
আবার ওরা আগের জায়গায় গিয়ে বসলো। কামাল বললো, তাসের প্যাকেট দুটো নামাও। রামি খেলে দিব্যি রাতটুকু কাটিয়ে দেয়া যাবে।
নাসিম তাস বের করে আনলো। সবাই খেলায় বসলো। অথচ খেলাতে ওদের কারোই মন ছিলো না। খেলতে গিয়ে সবাই বার বার ভুল করলো। বিপ্লব বললো, কামাল, তখন গন্ডগোলের কথা কী বলছিলে?
কামাল কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, কোথাও গুলিগোলা হয়েছে হয়তো।
ইরফান বললো, তাই বলে জিন্না এভিন্যুর মতো জায়গায় একটা স্কুটার পাওয়া যাবে না, এটা কেমন কথা! রাত দুটোর পরও এখান থেকে স্কুটার নিয়ে বাড়ি ফিরেছি।
বিপ্লব বললো, ভুলে যাচ্ছো কেন, এখন অসহযোগ আন্দালন চলছে। সিনেমা টিনেমা সব বন্ধ। কদিন ধরে দশটার পর এমনিতেই রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়।
নাসিম বললো, তাই বলে আজকের মতো নয়। কাল আমি সাড়ে দশটায় বাসে করে বাড়ি ফিরেছি।
ইরফান বললো, আজ সত্যিই একটু অন্য রকম মনে হচ্ছে। যাকগে ও সব। এক রাত বাইরে কাটানো এমন কোন ব্যাপার নয়। তাছাড়া আমরা কেউ বাচ্চা ছেলে নই যে, বাড়ি না ফিরলে একেবারে কান্নাকাটি পড়ে যাবে।
শওকত বললো, কী হলো নাসিম? জোকার কেন ফেলে দিলে?
নাসিম একটু বিব্রত হলো আমার ভাই খেলতে ইচ্ছে করছে না।
ইরফান হাতের তাস টেবিলে ছড়িয়ে দিলো–আমারও ভালো লাগছে না।
শওকত বললো, বাদ দাও তাহলে। চলো শুয়ে পড়ি।
কনফারেন্স রুমের টেবিলটা একপাশে সরিয়ে ওরা পাঁচজন কার্পেটের ওপর শুয়ে পড়লো।
কামাল বললো, লাইট অফ করে দেবো?
থাক না, যদি কারো অসুবিধে না হয়!
ইরফান বললো, আমি আলো জ্বেলে ঘুমাই।
ঘড়িতে এগারোটা বাজলো। তখনও কেউ ঘুমোয়নি। শওকত আর বিপ্লবের আঙুলের ফাঁকে সিগারেট জ্বলছে। একটা চাপা অস্বস্তি সবাইকে ঘিরে রেখেছে। সাড়ে এগারোটায় শহরের প্রত্যেকটা মানুষের মতো ওরাও চমকে উঠলো। বিস্মিত হলো। তারপর শুধু শুনে গেলো অবিরাম এক ভীষণ যুদ্ধের শব্দ।
বাইরে তাকিয়ে দেখলো শহরের কোথাও এতটুকু আলো নেই। থমথম করছে প্রেতায়িত অন্ধকার। শহরে এত অন্ধকার আগে কোনদিন ওরা দেখেনি।
ইরফান উঠে ঘরের আলো নিভিয়ে দিলো। কেউ কিছু বললো না। অন্ধকার ঘরে ওরা পাঁচজন চুপচাপ বসে রইলো। একটার পর একটা আতঙ্কের মুহূর্ত কাটতে লাগলো। মুহূর্তগুলো বড় হয়ে ঘন্টা হলো । ঘন্টার পর ঘন্টা ওরা জেগে বসে রইলো। তবু ওদের বিশ্বাস ছিলো ভোর হলে সবাই বাড়ি ফিরে যেতে পারবে। ভোরের কাগজে হেডলাইনে দেখবে কি এমন বিপর্যয় ঘটলো। অথচ সেই ভোেরই ছিলো ওদের জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ ভোর। কয়েকজনের জীবনের শেষ সূর্যোদয়।
পুরোনো ঢাকার দিকে ওরা মাঝরাতে শ্লোগানের শব্দ শুনেছিলো–সংগ্রাম সংগ্রাম, চলবে চলবে। জয় বাংলা। রক্তের প্রতি কণায় শ্লোগানের সেই শব্দ অসম্ভব উত্তেজনা ছড়িয়ে দিয়েছিলো। মেশিনগানগুলো সেই শ্লোগানের শব্দে আরো হিংস্র, আরো উন্মত্ত, আরো প্রচন্ড হলো। শেষ অবধি সেই নারকীয় শব্দের নিচে সমস্ত শ্লোগান চাপা পড়ে গেলো।
ভোরের দিকে দূরের মেশিনগানের শব্দ কমে এলো। খুব কাছে থেকে একটা রাইফেল কিছুক্ষণ পর পর গর্জে উঠছে। ওদের মনে হলো স্টেডিয়ামের ওদিক থেকে শব্দটা আসছে। তখনো সূর্য ওঠেনি। আকাশে শুধু রঙ ধরেছে। বাইরে ঘোলাটে অন্ধকার। তখনই ওরা শুনলো ট্যাঙ্কের শব্দ। একটানা অবিরাম কর্কশ ধাতব শব্দ ক্রমশ ওদের কাছে এলো। বন্ধ জানালাটা সামান্য ফাঁক করে ওরা চেয়ে দেখলো, জিন্না এভিন্যু থেকে একটা ট্যাঙ্ক ঘড় ঘড় শব্দ করে অতিকায় দৈত্যের মতো এগিয়ে আসছে। তার ঠিক পেছনেই একটা জিপ।
ট্যাঙ্কটা মোড় ঘুরে ডিআইটির দিকে চলে গেলো। জিপটাও সঙ্গে যাচ্ছিলো। হঠাৎ মোড়ের মাথায় এসেই থেমে গেলো। চারজন সৈন্য লাফ দিয়ে নামলো। প্রত্যেকের হাতে হালকা মেশিনগান। চোখে আবিষ্কারের হিংস্র উল্লাস। ক্লাবে ওরা বাংলাদেশের পতাকা দেখেছে। বুটের শব্দগুলো তালে তালে এগিয়ে আসতে।–লাগলো। দরজা বন্ধ। ভেতরে শওকতদের ভয় আর উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। চারজোড়া বুটের শব্দে ওরা অবধারিত মৃত্যুর পদধ্বনি শুনলো। ভারী শব্দগুলো ওদের বুকের ভেতর কাঁপন ধরালো। দরজার কাছে এসে বুটের শব্দ থেমে গেলো। একটা কর্কশ কণ্ঠস্বর ওদের হাড়ের ভেতর বিধে গেলো–দরওয়াজা। খোলো!
ওরা কেঁপে উঠলো সেই বিজাতীয় কণ্ঠস্বরে। আবার শুনলো, তবু ওরা কেউ দরজার কাছে যেতে পারলো না। তারপর শুনলো নির্দেশের কণ্ঠ–দাগো।
চারটা মেশিনগান একসঙ্গে গর্জে উঠলো। হলঘরে ওরা প্রলয়ের শব্দ শুনলো। বন্ধ দরজা ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে গেলো। তারপর নিজেদের ওরা আবিষ্কার করলো চারটা উদ্যত মেশিনগানের সামনে। চারটা কালো চকচকে নল ওদের পাঁচজনকে লক্ষ্য করে স্থির হয়ে আছে। একজন কর্কশ কণ্ঠে বললো, লাইনে দাঁড়াও।
পাঁচটা দম দেয়া পুতুলের মতো ওরা লাইন করে দাঁড়ালো। হিংস্র নেকড়ের আক্রোশে অবাঙালি সৈন্যগুলোর চোখ ওদের দেখলো ভালো করে। পাশাপাশি লাইনের প্রথমে নাসিম। তার পাশে শওকত, বিপ্লব, ইরফান, কামাল। সৈন্যদের অবস্থান দেখে মনে হলো প্রথম গুলি করবে নাসিমকে। তারপর শওকত, বিপ্লব এবং অন্যদের। পর পর পাঁচজনকেই হত্যা করা হবে।
শওকতের মনে আছে সেই নারকীয় নির্দেশ–দাগো। শোনার সঙ্গে সঙ্গে মেশিনগান থেকে একঝলক আগুনের মতো গুলি বেরিয়ে এসে নাসিমকে ঝাঁঝরা করে দিলো। পড়ে গেলো নাসিম। সঙ্গে সঙ্গে শওকত, বিপ্লব, ইরফান আর কামাল। একটানা গুলির শব্দ। কিছু আর্তনাদ, ধোঁয়া আর অন্ধকার। তারপর শওকতের আর কিছুই মনে নেই।
বেশ কিছুক্ষণ হলো সূর্য উঠেছে। সময়ের কথা মনে হলো শওকতের। হাতঘড়িটার দিকে তাকাতে গিয়ে দেখলো ওটা হাতে নেই। সারা ঘর বিধ্বস্ত । আলমারি, শোকেস আর জানালার কাঁচ ছড়িয়ে রয়েছে সারা মেঝেতে। দেয়ালগুলো ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। চেয়ার, টেবিল সব কিছু ভেঙে এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে চারদিকে। মনে হলো, যুদ্ধক্ষেত্রের এক ধ্বংস্তূপের ভেতর পড়ে আছে সে।
হঠাৎ চমকে উঠলো শওকত। ঢং ঢং ঢং-দেয়ালঘড়িতে দশটার ঘন্টা বাজলো। তাকিয়ে দেখলো দেয়াল ঘড়িটা আগের জায়গাতেই আছে। অক্ষত। তখন থেকেই চলছিলো। সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে শওকত অনুভব করলো ঘড়ির শব্দ।
আবার চমকে উঠলো শওকত। একটা অস্কুট গোঙানির শব্দ! উঠে বসে চারপাশে তাকালো। কামালকে দেখলো। ছিন্ন-ছিন্ন শরীর। নাসিমের পুরো শরীরটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। ইরফানের বুকে গুলি লেগেছে। কপালের কাছেও গভীর ক্ষত। রক্তে ডুবে আছে বিপ্লব। কোথায় শব্দ হলো? হয়তো মনের ভুল–ভাবলো শওকত।
ওকে সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে নিজের বেঁচে থাকাটা। বুঝতে পারলো, গায়ে গুলি লাগার আগেই সে পড়ে গিয়েছিলো। শুধু কাঁধের পাশটায় খানিকটা চামড়া ছিঁড়ে গুলি বেরিয়ে গেছে। মনে হলো, মৃত্যু নয়–বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড়ো বিস্ময়!
আবার সেই শব্দ শুনলো শওকত। খুব কাছে। অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ। ভালো করে চেয়ে দেখলো। তবে কি বিপ্লব? ওকে ধরে দেখলো। চমকে উঠলো। শরীরে এখনো জীবনের উত্তাপ। বিপ্লব তাহলে মরেনি! দুহাতে ধরে ওকে বসিয়ে দিলো শওকত, দেখলো দুজায়গায় গুলি লেগেছে। পায়ে আর কাঁধের নিচে। অস্পষ্ট একটা গোঙানির মতো শব্দ বেরুচ্ছে গলা দিয়ে।
ফিসফিস করে শওকত বললো–বিপ্লব তুই বেঁচে আছিস?
ধীরে ধীরে অতি কষ্টে চোখ মেলে তাকালো বিপ্লব। আবার চোখ দুটো বুজে গেলো। এখনো অল্প অল্প রক্ত বেরোচ্ছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে পায়ে বেঁধে দিলো। অস্ফুট কণ্ঠে বিপ্লব বললো, বাড়ি যাবো।
শওকত বাইরে তাকিয়ে দেখলো। শহরে কোন মানুষ নেই। আকাশে একটা পাখি নেই। গাছের পাতায় কোন কাঁপন নেই। কোথাও এতটুকু প্রাণের সাড়া নেই। স্টেডিয়ামের কাছে কিছুক্ষণ পর পর একটা মেশিনগানের শব্দ হচ্ছে। আবার থেমে যাচ্ছে।
শওকতের মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো। বিড় বিড় করে বললো, কোথায় বাড়ি!
ও মনে করতে পারলো না এ শহরের কোথাও ওর বাড়ি আছে। ওর পরিচিত শহরের সঙ্গে এই মুহূর্তের শহরটার কোন মিল নেই। চারদিকে থমথম করছে ভৌতিক নিরবতা। সম্পূর্ণ অচেনা পরিবেশ।
বিপ্লব আবার বললো, বাড়ি যাবো। গোঙানোর মতো শব্দ হলো।
শওকত ফিসফিস করে বললো, বাইরে এখনো মেশিনগানের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওটা না থামা পর্যন্ত বেরোনো যাবে না।
বিপ্লব কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বললো জল, একটু জল দাও আমাকে।
শওকত বললো, এক্ষুনি আনছি। ছুটে গেলো পাশের ঘরে। সেখানে পানির সোরাই ছিলো। দেখলো সোরাইটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। সবটুকু পানি গড়িয়ে গেছে। ফিরে এলো খালি হাতে। বললো বাড়ি গিয়ে খেও বিপ্লব। আমরা একটু পরেই বেরুবো।
বিপ্লবের চোখ দুটো আবার বন্ধ হয়ে গেলো। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো শওকত। এক টুকরো রাস্তা দেখা যাচ্ছে। অন্য দিন ঢাকার সবচেয়ে ব্যস্ত রাস্তা এটা। মানুষ আর গাড়ির ভিড়ে সব সময় প্রাণোচ্ছল হয়ে থাকতো এই রাস্তা। অথচ আজ মনে হচ্ছে এটা ঢাকা শহরই নয়। ছবিতে দেখা যুদ্ধে বিধ্বস্ত অচেনা কোন শহর।
সৈন্যরা স্টেনগান আর হালকা মেশিনগান নিয়ে রাস্তায় টহল দিচ্ছে। হঠাৎ শওকত দেখলো দুটো সৈন্য ওদের ক্লাবটার দিকে এগিয়ে আসছে।
আবার নিজেকে ভীষণ এক ভয়ের জগতে আবিষ্কার করলো শওকত। নিশ্চিত মৃত্যুর মতো দুটো সৈন্য এগিয়ে আসছিলো। এবারের পদক্ষেপ অনেক বেশি ভয়াবহ। আগে ওরা পাঁচজন ছিলো। এবার ও সম্পূর্ণ একা। বিপ্লবের অবস্থা বেঁচে থাকার মতো নয়। তবু কিছুটা আশা হলো। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে মানুষ অনেক অসম্ভব কল্পনার ছবি আঁকে। বিপ্লবকে বললো, একেবারে মরার মতো শুয়ে থাকো। ওরা আবার আসছে। বিপ্লবকে ধরে শুইয়ে দিলো শওকত। তারপর সে নিজেও একটা মৃতদেহ হয়ে গেলো। বুটের শব্দ বুকের ভেতর আঘাতের পর আঘাত করে এগিয়ে এলো।
সিঁড়ি থেকে হলঘর পেরিয়ে ওদের দরজার কাছে এসে ঘাতক শব্দ থমকে দাঁড়ালো। আবার সেই বিজাতীয় কণ্ঠস্বর। হাড় শিরশির করে উঠলো–কেউ যদি বেঁচে থাকো উঠে দাঁড়াও। নয়তো গুলি করবো।
শওকত আবার সম্ভবনার আলো দেখলো। ওদের অসহায়তার কথা যদি খুলে বলে তাহলে বেঁচেও যেতে পারে। উঠে বসলো। বিপ্লবকেও ধরে বসালো। বললো, আমরা দুজন বেঁচে আছি। ওর জখমটা খুব বেশি।
সৈন্য দুটোর হাতে দুটো স্টেনগান। একজন আগের মতো রুক্ষ কণ্ঠে বললো, উঠে দাঁড়াও।
ঠিক আগের মতো মৃত্যুর কণ্ঠস্বর। শওকত উঠে দাঁড়ালো। সামনের দৃশ্যগুলো ঝাঁপসা হয়ে এলো। একজন স্টেনগান উঁচিয়ে গুলি করার জন্যে প্রস্তুত হলো। মৃত্যুকে এবার মনে হলো অনেক বেশি অমোঘ।
ঘড়ির শব্দ শুনলো শওকত। ঢং, ঢং, ঢং–ঘন্টাগুলো অবিরাম বেজে চলেছে। শব্দগুলো থরে থরে জমতে লাগলো তার চারপাশে। তখন ভয় নয়, অদ্ভুত এক শূন্যতা ওকে ঘিরে ধরলো। ঢং, ঢং, ঢং, ঢং,–মন্থর গতিতে একের পর এক ঘন্টা বাজছে। পলকহীন শূন্যদৃষ্টিতে স্টেনগানের নলটার দিকে তাকিয়ে রইলো সে! একজন সৈন্যের আঙুল ট্রিগারের ওপর শক্ত হয়ে বসে যাচ্ছে। শওকত নির্বিকার। ঠিক তখনই পাশের সৈন্যটা স্টেনগানের নলটা হাত দিয়ে একপাশে সরিয়ে নিলো। উর্দু নয় পশতুতে বললো, এদের ক্যাপ্টেনের কাছে নিয়ে চলো।
শওকতের চোখে তখনও শূন্যতা। সৈন্যটা ওকে পরিষ্কার উর্দুতে বললো, ওকে নিয়ে আমাদের সঙ্গে এসো।
আবার জীবন। এবারও তাহলে বেঁচে গেলো শওকত! জীবন আর মৃত্যুর এক অদ্ভুত খেলা অনুভব করলো সে। বাঁচার ইচ্ছেটা আবার তীব্র হয়ে উঠলো। বিপ্লবকে তুলে দাঁড় করালো। ওর এক হাত নিজের কাঁধে তুলে নিলো। বাঁ হাতে সেই হাত চেপে ধরে ডান হাতে বিপ্লবের কোমর জড়িয়ে ধরলো। বললো, হাঁটতে হবে বিপ্লব।
বিপ্লব মাথা নাড়লো। সৈন্য দুটোর নির্দেশ মতো ওদের আগে আগে এগিয়ে চললো শওকত আর বিপ্লব। নিজের দেহটাই তার কাছে অসম্ভব ভারী মনে হচ্ছিলো। বিপ্লবকে নিয়ে বার বার সে হোঁচট খেলো। একবার হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো। অমনি পেছনে একজন বুটের লাথি মারলো। কর্কশ কণ্ঠস্বর–জলদি চলো।
উঠে দাঁড়ালো শওকত। পল্টনের মাঠের ভেতর দিয়ে ওদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। স্টেডিয়ামের গেটের কাছে সৈন্যরা ছাউনি করেছে।
সৈন্য দুটো শওকত আর বিপ্লবকে ছাউনির ভেতর ক্যাপ্টেনের কাছে নিয়ে গেলো। ক্যাপ্টেন ওদের দেখলো ভালো করে। বললো, তোমরা বাঙালি?
শওকত মাথা নেড়ে সায় জানালো। ক্যাপ্টেন আবার প্রশ্ন করলো, ওখানে কেন ছিলে?
সব কথা খুলে বললো শওকত। ক্যাপ্টেন বললো, বাঙালিরা অনেক বেশি স্বপ্ন দেখে। সে জন্যে আজ তোমাদের এ অবস্থা! স্বাধীনতা চেয়েছিলে তোমরা, তাই না? জানো, স্বাধীনতা কাকে বলে?
রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়লো ক্যাপ্টেন। কখনো উর্দুতে কখনো ইংরেজিতে অনর্গল বলে গেলো তার ক্ষোভের কথা। শওকত চুপ করে রইলো। অদ্ভুত একটা বিষণ্ণতা ওকে ঘিরে রেখেছিলো। ক্যাপ্টেনের কিছু কথা কানে গেলো, কিছু গেলো না। ক্যাপ্টেন সবশেষে বললো, জানো, তোমাদের আমি এ মুহূর্তে গুলি করে মারতে পারি।
শওকত বললো, কেন জানবো না?
ক্যাপ্টেন বললো, তবু তোমাদের আমি মারবো না। মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে তোমরা বেঁচে থাকবে। যাও, তোমরা বাড়ি যাও।
অদ্ভুত হাসলো শওকত আপনি যেতে বলছেন! রাস্তায় বেরুলে আমাদের কুকুরের মতো গুলি করে মারা হবে। এ কথা আপনি ভালোভাবেই জানেন। তার চেয়ে এখানেই মারুন। বাইরে যাবার কী দরকার!
ক্যাপ্টেন কিছুক্ষণ অপলক চেয়ে রইলো শওকতের দিকে। এই ছেলের সঙ্গে রাজনীতির কোন সম্পর্ক আছে বলে পাঠান ক্যাপ্টেনের মনে হলো না। বললো, তোমরা যাও। আমি বলে দিচ্ছি।
ক্যাপ্টেন অয়ারলেসে কথা বললো, ডিআইটি আর স্টেডিয়ামের রাস্তায় দুটো লোক যাচ্ছে, একজন আহত। আরেকজন তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ওদের মারার দরকার নেই।
শওকত আর বিপ্লব বেরুলো মৃত্যুর ছাউনি থেকে। আরামবাগের ওদিকে আবাসিক এলাকা। এদিকে সব অফিস আর বাণিজ্যিক ভবন। আশ্রয়ের জন্যে ওদের আরামবাগ অবধি যেতে হবে। হাঁটতে শুরু করলো ওরা।
স্টেডিয়ামের শেষ মাথা পর্যন্ত যেতে যেতে হাঁপিয়ে গেলো শওকত। বিপ্লব একেবারেই বিপর্যস্ত। ক্লান্ত কণ্ঠে বললো, শওকত, জল না খেলে আমি এক পাও এগুতে পারবো না। আমাকে বরং রেখে চলে যাও।
অসহায়ের মতো চারিদিকে তাকালো শওকত। অল্প দূরে একটা নতুন বাড়ি উঠছে। পাশে একটা চৌবাচ্চার মতো। ইট ভেজানোর জন্যে পানি রাখা হয়েছে সেখানে। শওকত ছুটে গেলো সেখানে। আঁজলা ভরে সেই নোংরা পানি এনে বিপ্লবের মুখে তুলে দিলো। তারপর দুজন এগিয়ে গেলো মতিঝিলের পথ ধরে।
সৈন্যদের দুটো দল ডিআইটি আর স্টেডিয়ামের ওপর থেকে পাহারা দিচ্ছিলো। থেকে থেকে ইচ্ছেমতো গুলি ছুঁড়ছিলো। ক্যাপ্টেন বলে দেয়াতে শওকত আর বিপ্লব নির্বিঘ্নে ওদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। বিপদ হলো পথের শেষ মাথায় এসে। স্টেট ব্যাঙ্কের উঁচু দালানের ওপর আরো একটা দল রয়েছে। ওরাও ইচ্ছে মতো গুলি ছুঁড়ছে। স্টেটব্যাঙ্কের সামনে থেকে সোজা রাস্তা চলে গেছে পুরানা পল্টনের দিকে। আশি ফুট চওড়া রাস্তা। খাঁ খাঁ করছে। সৈন্যদের নিশানা সোজা রাস্তা বরাবর।
এ রাস্তা পেরোনো রীতিমত অসম্ভব বলে মনে হলো শওকতের। এবারে সে একেবারেই ভেঙে পড়লো । তবু শেষ চেষ্টাটুকু করতে হবে। বিপ্লবকে বললো, দৌড়োতে পারবে? এই যে রাস্তা দেখছো সামনে, এটা দৌড়ে পার হতে হবে। যতো জোরে পারো ছুটবে। রাস্তা পেরোলে কিছুটা নিশ্চিন্ত হতে পারবো।
বিপ্লব সামনে চেয়ে দেখলো। ক্লান্ত গলায় বললো, পারবো।
শক্ত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ালো বিপ্লব। তীব্র ব্যথায় সারা শরীর কেঁপে উঠলো। সমস্ত ইচ্ছাশক্তি একত্রিত করে দুজন একসঙ্গে ছুটলো। চোখ বুজে, দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে। এর চেয়ে জোরে দৌড়ানোর কথা কোনদিন ওরা কখনো কল্পনাও করেনি।
রাস্তা পার হয়েই ওরা হুমড়ি খেয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে মেশিনগানের গুলি বৃষ্টির ধারার মতো নেমে এলো চওড়া কালো রাস্তার বুকে।
দম বন্ধ হয়ে আসছিলো ওদের। বিপ্লবকে তুলে ধরে সামনের সরু গলির পথে আরো এগিয়ে গেলো শওকত। অবশেষে ওরা আরামবাগের কাছে পৌঁছলো। সামনে যে বাড়িটা ছিলো তার নিচু পাঁচিল টপকে বাগানে ঢুকলো। হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো বাগানের ঘাসের বুকে। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওরা জ্ঞান হারালো।
.
০৫.
বাইরের পৃথিবীতে এখন শান্ত সুন্দর সকাল। ঝকঝকে নীল আকাশে সূর্য উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। প্রতিদিনের মতো একটি অনুপম সকাল। রোদের শান্ত নরম আলোতে ছিন্নভিন্ন ঢাকা শহরটা শুধু থমথম করছে। মেশিনগানের দুএকটা বিক্ষিপ্ত গর্জন ছাড়া দ্বিতীয় কোন শব্দ নেই। বাইরের পৃথিবীর কোন কোলাহল এখানে এসে পৌঁছোচ্ছে না। আকাশে একটা পাখি নেই। রাস্তার কুকুরগুলোও সব যেন কোন যাদুকরের মন্ত্রবলে অদৃশ্য হয়ে গেছে। সবাই ঘরের ভেতর বসে আছে। চোখে মুখে উদ্বেগের ছাপ, শহরে কী ঘটছে কেউ জানে না। শুধু এইটুকু জানে–কাল রাত ছিলো প্রলয়ের রাত, যার জের এখনো চলছে।
মিনুর বাবা কিছুক্ষণের জন্যে ওপরের ঘরে গিয়েছিলেন। বুঝতে পারছেন না কী করবেন। শওকত না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাবেন ভাবছিলেন। সেটাও এখন তার কাছে অসম্ভব মনে হচ্ছে। রাস্তায় বিকট চেহারার পাঞ্জাবি সৈন্যরা টহল দিচ্ছে।
হঠাৎ একটা গুলি এসে তেতালার ঘরে লাগলো। ঝনঝন করে জানালার কাঁচ ভাঙলো। নিচে বসে মিনুরা সবাই সেই শব্দ শুনলো। বাবা দরজা খুলে দোতালার ঘরে গেলেন।
শহরে কারফিউ কিনা বোঝা যাচ্ছে না। ট্রানজিস্টারটা দেখলেন, ঠিক আছে। ঢাকা রেডিয়ো ধরলেন। কোনো সাড়াশব্দ নেই। ট্রানজিস্টারটা হাতে করে তিনি
আবার নিচের ঘরে নেমে এলেন।
মা তখন থেকেই অস্বাভাবিক রকম শান্ত। মিনু অনেক চেষ্টা করেও কিছু খাওয়াতে পারেনি। বাবা বললেন, মিনু, একটু চা করো। ওপরে যেও না।
গুলির শব্দ মিনুও শুনেছে। কথা না বলে বেরিয়ে গেলো। মা অসম্ভব শান্ত গলায় বললেন, শওকত কি আসবে না?
বাবা বিব্রত হলেন–এ অবস্থায় ও যেখানে আছে সেখানেই থাকা উচিত। বাড়ি ফেরার চেষ্টা না করলেই ভালো করবে।
মা বললেন, তুমি জানো ও কোথায় আছে?
বাবা একটু চুপ করে কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, হয়তো কোন বন্ধুর বাসায়। যেখানেই থাকুক আমার মন বলছে ও নিরাপদ। তুমি দেখো শওকত ঠিকই ফিরে আসবে।
মা বিড়বিড় করে কী যেন বললেন।
কিছুক্ষণ পর মিনু ব্যস্ত পায়ে চায়ের ট্রে এনে টেবিলে রাখলো। ভীষণ উত্তেজিত মনে হলো ওকে। বললো, আর্মির কয়েকজন লোক রাস্তার মোড় থেকে আমাদের বাড়ির দিকে কী যেন দেখাচ্ছে।
বাবা চমকে উঠলেন–তুমি কোত্থেকে দেখলে? মি
নু বললো দোতালার জানালা দিয়ে দেখেছি।
মা কাঁপা গলায় চেঁচিয়ে বললেন, দোতালায় কেন গিয়েছিলি?
মিনু মাথা নিচু করে রইলো। একটু থতিয়ে বললো, এমনি দেখতে।
মা তেমনি রাগের গলায় বললেন, কী এমন দেখার জিনিস ছিলো ওখানে? যদি গুলি করতো? বারণ করেছিলো, কানে যায়নি?
বাবা বললেন, আহ্, তুমি থামবে! মিনু কী বলছিলে বলো।
মিনু থেমে থেমে বললো, বেশ কয়েকজন আর্মির লোক, দুএকটা অফিসারও হবে। আমাদের বাড়ির দিকে বার বার আঙুল উঁচিয়ে কী যেন দেখাচ্ছিলো।
বাবা একটু ভেবে বললেন, আমাদের বাড়িটায় প্রচুর গোলাগুলি লেগেছে। তাই হয়তো দেখাচ্ছিলো। ঠিক আছে। ওপরে গিয়ে কাজ নেই! ওরা এখনও এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়ছে।
বাবা আবার ট্রানজিস্টার অন করলেন। ঢাকা স্টেশন ধরতে চাইলেন। কোথাও ধরা গেলো না। আকাশবাণীর খবর শুনলেন। এখানকার কোন খবর নেই। চিন্তিত গলায় বললেন, আটটা বেজে গেছে। এখনো স্টেশন বন্ধ।
মিনু বললো, সৈন্যরা হয়তো স্টেশনের কোন ক্ষতি করেছে।
বাবা কোন কথা বললেন না। অসম্ভব উদ্বিগ্ন মনে হলো তাকে। মা আগের মতো শান্ত স্থির। অথচ তার বুকের ভেতর উত্তাল ঝড়।
একটু পরে সবাই একসঙ্গে চমকে উঠলো। কে যেন খুব জোরে দরজা ধাক্কাচ্ছে। মা বললেন, শুকু! নিশ্চয়ই শুকু এসেছে।
বাবা কান পেতে শব্দটা শুনলেন। অস্বাভাবিক রকম জোরে হচ্ছে শব্দটা। একটু ভেবে বললেন, তোমরা বসো। আমি দেখছি।
বাবা চলে গেলেন। গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে মিনুরা বসে রইলো। একটু পরেই শুনলো দরজা খোলার শব্দ। আর সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো ভারী বুটের শব্দ, মা চমকে উঠলেন। শুকুর কিছু হয়নি তো! বলেই উঠে দাঁড়ালেন। মিনু মার সঙ্গে ওপরে এলো।
কানের পর্দায় কর্কশ কণ্ঠস্বর আছড়ে পড়লো। কে যেন চিৎকার করে বললো, কাঁহা হ্যাঁয় সব বদমাস লোগ। ওদের বের কর জলদি। কোথায় সেই শয়তানের দল?
ওরা বাবার শান্ত গলা শুনলো– আপনি কাদের কথা বলছেন? আমার ঘরে বাইরের কেউ নেই।
মা শক্ত করে মিনুর হাত ধরে আছেন। ঠক ঠক করে কাঁপছেন। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলেন, পাশের ঘরে বেশ কয়েকজন অবাঙালি সৈন্য। একজন মেজরও রয়েছে। বাবার কথা শুনে মেজরটা চিৎকার করে বললো, তাহলে তোমরাই কাল সারারাত এ বাড়ি থেকে গুলি ছুঁড়েছিলে? কোথায় তোমার লোকজন? সব কটাকে কুকুরের মতো গুলি করে মারবো।
মিনুর বাবা আগের মতো শান্ত গলায় বললেন, বাড়িতে শুধু আমি, আমার স্ত্রী আর আমার মেয়ে রয়েছে। আমরা কেউ বন্দুক ছুঁড়তে জানি না।
মেজর আবার চিৎকার করে উঠলো, খামোশ। আমি এক্ষুণি বাড়ি সার্চ করবো।
দুজন সৈন্যকে মেজর বললো, তোমরা এখানে দাঁড়াও।
অন্য তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে মেজর প্রথমে মিনুদের ঘরে ঢুকলো। পেছনে বাবাও এলেন। মা আর মিনুকে দেখে মেজর থমকে দাঁড়াল-এরা কে? তোমার স্ত্রী আর মেয়ে?
বাবা মাথা নাড়লেন। মেজর বললো, তোমরা সবাই এ ঘরে দাঁড়িয়ে থাকো।
দুজন সৈন্য মেশিনগান তাক করে দাঁড়িয়ে পড়লো। মেজর বেরিয়ে গেলো।
বাবাকে দেখলে মিনু। কেমন যেন উদাস মনে হচ্ছে। ঘরের দেয়ালে ঝোলানো ওদের গ্রুপ ফটোটার দিকে আনমনে তাকিয়ে আছেন। মার চোখে মুখে নিদারুণ আতঙ্ক। শক্ত করে মিনুর হাত চেপে ধরেছেন। সৈন্য দুটো ওর দিকে বিচ্ছিরি দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে বার বার। মিনুর সারা শরীর ঘৃণায় শিউরে উঠলো।
একটু পরে মেজর নেমে এলো। সঙ্গে যে সৈন্যটা গিয়েছিলো তার হাতে দুটো খাকি শার্ট আর একটা রক্তমাখা রাইফেল। ওগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে কর্কশ গলায় মেজর বললো, নিজের বাড়িটাকে চমৎকার যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়েছিলে। কাল রাতে শয়তানরা তোমার বাড়িতে আস্তানা গেড়েছিলো।
বাবা শান্ত গলায় বললেন, ওরা পুলিসের লোক ছিলো।
মেজর মুখটা বিকৃত করে বললো, পুলিসের লোক! সব কটা এক একটা শয়তান। কেন ওদের ঢুকতে দিয়েছিলে?
বাবা বললেন, পুলিসের কাজে বাধা দেয়া বেআইনি। সে জন্যেই ওদের বাধা দিইনি।
মেজর আবার চেঁচিয়ে উঠলো–কিসের পুলিস! ওরা সব বিশ্বাসঘাতক! বেইমান, গাদ্দার।
বাবা আরো শান্ত গলায় বললেন, আমি কী করে বুঝবো কে বিশ্বাসঘাতক!
মেজর ভুরু কুঁচকে বললো, তুমি কি আওয়ামী লীগের লোক!
না, তবে আমি ওদের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সমর্থন করি।
একজন পাকিস্তানি হয়ে তুমি জয় বাঙলাকে সমর্থন করো?
আমি প্রথমে একজন বাঙালি। পরে পাকিস্তানি।
মেজর গলা চড়িয়ে বললেন, আসল শয়তান হচ্ছো তুমি। তোমাকে এর শাস্তি পেতে হবে।
বাবা কোন কথা বললেন না। মেজর হাতের স্টেনগান উঁচিয়ে বললো, ঘরের ওই কোণে গিয়ে দাঁড়াও।
বাবা ঘরের কোণে সরে গেলেন। মেজরের আঙুল ট্রিগারের ওপর। তখনও বাবাকে আশ্চর্যরকম নির্লিপ্ত মনে হচ্ছিলো। ট্রিগারে চাপ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মা। ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে চিৎকার করে উঠলেন–না।
পর পর চারটা গুলির শব্দ হলো। ঘরের ভেতর মুহূর্তের মধ্যে যেন প্রলয় কান্ড ঘটে গেলো। সারা বাড়ি থরথর করে কেঁপে উঠলো। বাবা মা দুজনেই মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়েছেন। মিনুর বিস্ফোরিত চোখের সামনে ওর বাবা আর মার শরীর একটু কেঁপে উঠে স্থির হয়ে গেলো। রক্তের অনর্গল ধারা নেমে এলো মেঝের উপর দিয়ে। সমস্ত ঘর দুলে উঠলো মিনুর চোখের সামনে। চিৎকার করে বাবা মার স্থির শরীরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো। উচ্ছ্বসিত কান্নায় সে গুঁড়িয়ে গেলো।
মেজর কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে দেখলো। পাশের সৈন্য দুটোকে বললো, মেয়েটাকে জিপে তুলে নাও।
না–চিৎকার করে উঠলো মিনু। সৈন্য দুটো দুপাশ থেকে ওকে টেনে তুললো। সারা শরীর রক্তে লাল, মুখে রক্তের ছাপ, পাগলের মতো চিৎকার করলো মিনু না, না, না।
দুপাশ থেকে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরে ওরা নিয়ে গেলো মিনুকে। শুধু ওর তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ ঘরের দেয়ালে অনেকগুলো প্রতিধ্বনি তুললো–না! না! না!