৯-১০. নবুকে খুঁজতে গিয়ে আরেক বিপদ

০৯. নবুকে খুঁজতে গিয়ে আরেক বিপদ

রবি যতোই নলুক নবুর জন্য ভাবতে হবে না, রাতুল সারারাত ওর কথা ভেবে ঘুমোতে পারে নি। শেষরাতে একটু তন্দ্ৰামতো এসেছিলো, দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে গেছে। দুঃস্বপ্নও নবুকে নিয়ে। মস্ত উঁচু এক পাহাড়ের ওপরে বিকট চেহারার–পুরোনো গোরস্থানে নবুর দাদা যেমন দেখেছিলো, ওরকম কারা যেন ঘিরে রেখেছে নবুকে। ও চিৎকার করছে–রাতুল বাঁচাও বলে। রাতুর ছুটে যাওয়ার আগেই পাহাড়ের ওপর থেকে লাফ দিয়েছে নবু।

বিছানায় উঠে বসেও রাতুল যেন নবুর আর্তচিৎকার শুনতে পাচ্ছিলো। বাইরে তাকিয়ে দেখলো, আকাশের অন্ধকার ভাব কেটে গেছে। একটু পরেই সূর্য উঠবে। একটা দুটো পাখি মাঝে মাঝে ডাকছে। রবিদের বাড়িতে আসার পর এই প্রথম পাখির ডাক শুনলো রাতুল। উঠে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো। রবি তখন গভীর ঘুমে অচেতন। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে রাতুল বললো, নবু যেখানেই থাক, ভালো থাকুক।

রবির ভোরে ওঠার অভ্যাস। সেদিন রাতুলকে আগে উঠতে দেখে অবাক হলো। নবুর কথা ভেবে খানিকটা হিংসেও হলো। ওরই জন্যে রাতুল এতো ভোরে উঠেছে। বললো, কখন উঠেছিস রাতুল?

রাতুল গম্ভীর হয়ে জবাব দিলো, এই তো কিছুক্ষণ।

রাতুলের কথার ধরন দেখে রবি আর কিছু বললো না। চুপচাপ মুখ ধুয়ে নিচে গেলো নাশতা কদুর হয়েছে দেখতে।

আধঘন্টা পর এসে রাতুলকে নাশতা খাওয়ার জন্য ডাকলো। খেতে বসে দেখা গেলো, কাল রাতের মতো রাতুল কিছু খাচ্ছে না। ভাগ্যিস নাদুখালা সামনে ছিলেন না। ওদের নাশতা বেড়ে দিয়ে পাশের বাড়ি গিয়েছেন কার যেন অসুখ করেছে–দেখতে। শুধু রবি একবার বললো, কিছুই তো খাচ্ছিস না রাতুল! শরীর খারাপ করবে যে।

রাতুল ওর কথার কোনো জবাব দিলো না। চা খেয়ে দুজন চুপচাপ ওপরে উঠে এলো ।

জানালা দিয়ে ভোরের এক টুকরো মিষ্টি রোদ ঘরের মেঝের ওপর শুয়ে আছে। রাতুল চেয়ার টেনে জানালার কাছে বসলো। তখনো কুয়াশা পুরোপুরি কাটে নি।

কিছুক্ষণ পর রবি আস্তে আস্তে বললো, নবুকে খোঁজার জন্য কোথায় যাবি বলছিলি?

রাতুল এবার রবির দিকে তাকালো। বললো, যেখানে যেখানে ও যেতে পারে সব জায়গায় খুঁজবো। গোরস্থান রাজবাড়ি কোনোটাই বাদ যাবে না।

রবি বললো, তাহলে চল বিমলদের বাড়ি থেকে শুরু করি। এ গাঁয়ে নবুর সবচে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলো বিমল।

রাতুলের মনে হলো রবি যেন ওকে খোঁচা মারার জন্য ঘনিষ্ঠ বন্ধু কথাটা বললো। রবি কি জানে পারুলের কথা? কিংবা রাতুলের সঙ্গে নবুর কি কথা হয়? রবি যে ওর সঙ্গে নবুর বন্ধুত্ব ভালোভাবে দেখছে না এটা অনেক আগেই বুঝে গেছে। নবুকে খুঁজতে ওর সঙ্গে আসছে অনেকটা দায়ে পড়ে। তবু এ নিয়ে আর কথা বাড়ালো না রাতুল।

বিমলদের বাড়ি গিয়ে রাতুল যা আশঙ্কা করেছিলো তাই শুনলো। নবু ওদের বাড়ি যায় নি। বিমল দুদিন হলো মঠবাড়িয়া গেছে ওর পিসির বাড়িতে। ওর ছোট বোন চিনু রবিকে বললো, নবুদা সেই যে বল খেলার পর একবার এসেছিলো তারপর আর আসে নি। দাদা বললো, শহর থেকে আসা নতুন বন্ধু পেয়ে নবুদা সব নাকি ভুলে গেছে। এই বলে আড়চোখে রাতুলের দিকে তাকালো।

রবি কাষ্ঠ হেসে বললো, শহরের বন্ধুর জন্যই তো নবুর এই দশা।

বিমলের মা ওদের কথা শুনে বললেন, নবুর কি কোনো ঠিক আছে? কখন কোথায় যায় কাউকে কি বলে যায় বাবা? ওর সঙ্গে থেকে আমার বিমলও হয়েছে। তেমনি। তোমরা ভেবো না। দুদিন পর দেখবে ঠিকই এসে হাজির হয়েছে। তোমরা বসো। চা খাও।

রবি একবার রাতুলের মুখের দিকে তাকালো। ওর মুখ থমথম করছে। বললো, আজ আর চা খাবো না মাসিমা, নিকেরিপাড়ায় যাবো।

রাতুল কারো সঙ্গে কোনো কথা না বলে বেরিয়ে এলো। রবি ওর সঙ্গে নিকেরিপাড়ার পথে হাঁটতে হাঁটতে বললো, ওদের ওপর রাগ করে কি লাভ। ওরা কি করেছে?

রাতুল শক্ত গলায় বললো, তোর কি ধারণা নবুর বাড়ি না ফেরার জন্য আমি দায়ী?

বারে, একথা আমি কখন বললাম?

ওই মেয়েটাকে তখন যে বললি, শহরের বন্ধুর জন্য নবুর এই দশা–এ কথার মানে কি?

আমতা আমতা করে রবি বললো, আমি তো বলছিলাম কাল রাতে তোরা প্ল্যান করে আমাকে ভয় দেখাতে না চাইলে নবুকে ওভাবে পালাতে হতো না।

ও কি আমার প্ল্যান মতো পালিয়েছে, না তোর চাচানোর জন্য?

তোরা তো ভালো করেই জানতি অমন করলে আমি ভয় পাবো। আর ভয় পেলে আমি চাঁচাবো না?

তুই যদি ভেবে থাকিস নবুর হারিয়ে যাওয়ার জন্য আমি দায়ী, তাহলে আমার সঙ্গে তোর আসার দরকার নেই। আমি একাই খুঁজবো ওকে।

কোথায় খুঁজবি?

নিকেরিপাড়ায় না পেলে পুরোনো গোরস্থানে খুঁজবো। তোদের হানাবাড়িতে খুঁজবো।

শুকনো গলায় রবি বললো, আমি জানি, আমাকে তোর ভালো লাগছে না। নবুকে খুঁজতে গিয়ে তুই যদি হারিয়ে যাস, আমার কি দশা হবে ভেবে দেখেছিস?

আমি কেন হারাববা?

তুই আমাদের গায়ে নতুন এসেছিস। কিছুই চিনিস না। তাছাড়া এ জায়গাটা আর দশটা জায়গার মতো নয়। এখানকার সব কথা তুই জানিস না। অনেক কিছু এখানে ঘটে যেতে পারে। একটু থেমে রবি বললো, ঠিক আছে নবুকে তুই-ই খুঁজবি। আমি তোকে শুধু পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবো। প্লীজ, আমার ওপর রাগ করিস না। বলতে বলতে রবির গলা বুজে এলো।

তুই অমন উল্টোপাল্টা কথা বলে মেজাজ খারাপ করে দিস কেন?

রবি দেখলো রাতুলের গলায় তখনো রাগের ঝঝ। ওর খুব কষ্ট হলো। বললো, রাতুল, তুই নবুকে বন্ধু ভাবিস, আমি কিছু বলতে যাবো না। তুই ছাড়া আমার আর কোনো বন্ধু নেই শুধু এটা মনে রাখিস।

রাতুলের মনে হলো রবির ওপর এতোটা রেগে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে বললো, তুই তো বুঝতে পারছিস আমার কি রকম খারাপ লাগছে। মাথার ভেতর মনে হচ্ছে সব তালাগোল পাকিয়ে গেছে। কি বলতে কখন যে কি বলছি নিজেও জানি না।

নবুকে নিকেরিপাড়ায় না পেয়ে রাতুল আর রবি যখন পুরোনো গোরস্থানে, এলো বেলা তখন এগারোটা বাজে। সকালের দিকে আকাশ কিছু সময়ের জন্য পরিষ্কার ছিলো। দশটার পর থেকে সূর্য মেঘের আড়ালে চলে গেছে। কোত্থেকে ছাই রঙের মেঘ এসে গোটা আকাশে ছেয়ে ফেলেছে। এলোমেলো বাতাসও বইতে শুরু করেছে।

রাতুলরা যখন গোরস্থানে ঢুকলো আবহাওয়া তখন আরো বদলে গেলো। চারদিক থেকে ঘন সাদা কুয়াশা এসে ঢুকলো গোরস্থানে, সেই সঙ্গে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস। রাতুল আর রবির গায়ে যদিও উলের মোটা পুলোভার ছিলো, শীতের কামড় এড়ানো গেলো না।

রাতুলের মনে হলো শীতের সময় দক্ষিণের সমুদ্রের কাছের আবহাওয়া বোধ হয় এমনই হয়। এ নিয়ে ও কিছু বললো না। অস্বাভাবিকতাটুকু ধরতে পারলো রবি। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে ওর হাত-পা আরো ঠাণ্ডা হয়ে গেলো।

ছোটবেলায় রবি অনেকের কাছে শুনেছে অনেক আগে ওদের গাঁয়ের একটা ফুটফুটে সুন্দরী মেয়েকে জ্বীন উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলো এই গোরস্থান থেকে। পরে ফেরতও দিয়ে গেছে। সেই মেয়ে নাকি বলেছিলো, হঠাৎ চারপাশ থেকে ঠাণ্ডা কুয়াশার মতো কি যেন ওকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর মিষ্টি একটা গন্ধ পেলো। ব্যস এইটুকুই, আর কিছু ওর মনে ছিলো না। তবে জ্বীনরা নিয়ে গিয়ে ওর সঙ্গে কোনো দুর্ব্যবহার করে নি। ভালো ভালো সব খাবার খাইয়েছে, এতো ভালো যে, জীবনে কখনো এমনটি খায় নি। সুন্দর কাপড় পরতে দিয়েছে। দুধের মতো সাদা আর বকের পালকের মতো নরোম বিছানায় শুতে দিয়েছে। বলেছে আমাদের কাছে থাকো, আমরা মানুষদের জানতে চাই। মেয়েটা থাকে নি। বাপ-মার জন্য সারাক্ষণ কান্নাকাটি করেছে। শেষে ওরা বিরক্ত হয়ে ওকে ওদের বাড়িতে রেখে গেছে। মসজিদের ইমাম সাহেব আর দুজন মুসল্লি মাগরেবের নামাজের পর দেখেছেন হঠাৎ এক ঝলক আলো আকাশ থেকে নেমে এলো। আলোর সঙ্গে সঙ্গে ঘন সাদা কুয়াশা। কুয়াশার ভেতর রূপোলি রঙের মস্ত বড় একটা তশতরি ভাসছিলো। সেই তশতরির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো মেয়েটা। সঙ্গে সঙ্গে তশতরি আর কুয়াশা মিলিয়ে গেলো। মেয়েটা ফিট হয়ে পড়ে ছিলো সেখানে। ওরা ধরাধরি করে ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে। মেয়েটা দুমাস ছিলো জ্বীনদের কাছে, এর ভেতর ওর গায়ের রঙ আরো সুন্দর হয়েছে। এতো সুন্দর যে মনে হতো গা দিয়ে আলো বেরুচ্ছে। ওই মেয়ের আর বিয়ে হয় নি। বিড়বিড় করে মাঝে মাঝে নাকি কাদের সঙ্গে কথা বলতো। আপনমনে হাসতো, গুনগুন করে গান গাইতো, শেষে একদিন পুকরে ডুবে মরে গেলো। মরার পরও নাকি মুখে হাসি লেগে ছিলো।

ছোটবেলা থেকে রবি এসব শুনে বড়ো হয়েছে। অস্বাভাবিক কোনো কিছু দেখলে সবসময় মনে হয়, এর পেছনে নিশ্চয়ই অলৌকিক কোনো শক্তি কাজ করছে। সেদিন পুরোনো গোরস্থানে চারপাশে ঘন সাদা কুয়াশা আর কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসের ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে ওর মনে হলো এভাবে রাতুলের একগুঁয়েমিকে প্রশ্রয় দেয়া মোটেই উচিত হয় নি। ক্লাসে শুভদারঞ্জন স্যার কতোদিন বলেছেন অতৃপ্ত আত্মাদের কথা, শত শত বছর ধরে যারা মুক্তির আশায় ঘুরছে, অথচ কেউ ওদের মুক্তি দিচ্ছে না। মৃত্যুর সময় মানুষ যদি সব রকমের বন্ধন–মায়া, মমতা, লোভ, হিংসা, ক্রোধ পরিত্যাগ করতে না পারে তাদের আত্মা নাকি মুক্তি পায় না। সারা পৃথিবীতে শত কোটি আত্মা রয়েছে, যারা অনবরত মুক্তির জন্য ছটফট করছে।

জ্বীনদের কথা বাদ দিলেও পুরোনো গোরস্থান যে সেই সব অতৃপ্ত আত্মাদের সবচেয়ে বড় ঘাটি, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ডাকাত পূর্বপুরুষরা কতো মানুষ মেরে এই গোরস্থানে কবর দিয়েছে কিংবা আদৌ কবর না দিয়ে শেয়াল-শকুন দিয়ে খাইয়েছে–কে তার হিসেব রেখেছে। তাদের অনেকেই প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে শত শত বছর অপেক্ষা করতে পারে! নেহাত রাজবাড়ির জ্বীনরা ওদের ওপর সদয় বলে এইসব আত্মা রবিদের বংশের কারো কোনো ক্ষতি করার সাহস পায় নি। কিন্তু কেউ যদি ওদের ঘুম ভাঙিয়ে বিরক্ত করে, তবু কি ওরা চুপচাপ কবরের ভেতর শুয়ে থাকবে? রবি মনে মনে ভাবলো, রাতুলকে এসব বলে লাভ নেই। বললেও ও তো আর এসব বিশ্বাস করে না। শুধু নিজে একা এসব ভাবতে গিয়ে বারবার ভয়ে শিউরে উঠছিলো।

হঠাৎ রবির মনে হলো কানের কাছে কে যেন ফিসফিস করে বললো, নবুর ভীষণ বিপদ। তোমরা ঘরে ফিরে যাও!

সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়ালো রবি। বুকের ভেতর ধড়াস করে উঠলো। একেবারে অচেনা গলা। কেমন যেন খসখসে ধাতব কণ্ঠস্বর। মনে হলো মানুষের নয়। চাপা গলায় রাতুলকে বললো, তুই কিছু শুনতে পেয়েছিস?

রাতুল অবাক হয়ে বললো, কি শুনবো?

কারো কোনো কথা শুনতে পাস নি?

না তো! কি কথা?

আমার মনে হলো কে যেন বললো, নবুর ভীষণ বিপদ, তোমরা ঘরে যাও। কেমন যেন গলাটা!

রাতুল কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস, গাছের পাতা দুলিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় শুধু সরসর শব্দ হচ্ছে। এছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই। বললো, নবু যে বিপদে পড়েছে, এটা আমারও মন বলছে। তুই যেতে চাস না, সেজন্য তোর ঘরে ফিরে যাওয়ার কথা মনে হচ্ছে।

রবি একটু অসহিষ্ণু গলায় বললো, আমার মনের কথা নয় এটা। আমি পরিষ্কার শুনেছি।

তুই পরিষ্কার শুনলি আর তোর পাশে থেকে আমি কিছুই শুনবো না–এটা হতে পারে?

কাল রাতেও তো তুই বলেছিলি আমড়াতলায় তুই কিছু দেখতে পাস নি।

এটা ঠাট্টা-ইয়ার্কির সময় নয় রবি। রাতুল বিরক্ত হয়ে বললো, তোকে তো বলেছি, তোর যদি ইচ্ছে না হয় আমার সঙ্গে আসিস না।

রাতুলের কথায় রবি আরো ভয় পেলো। ওর কথা শুনে মনে হচ্ছে, সত্যি সত্যি ও কিছু শোনে নি। ধাতব কণ্ঠস্বরের অদৃশ্য অধিকারী কি শুধু ওকেই ওর কথা শোনাতে চায়? রবির হঠাৎ মনে হলো বাতাসের সঙ্গে কেমন অদ্ভুত একটা গন্ধ ভেসে আসছে। গন্ধক পোড়ালে যেমন হয়, অনেকটা সেরকম কটু গন্ধ। জোরে জোরে শ্বাস টানলো। কোনো সন্দেহ নেই। বেশ তীব্র গন্ধ। রাতুলকে বললো, দাঁড়া, একটা অদ্ভুতরকম গন্ধ পাচ্ছি।

রাতুলও ওর মতো জোরে শ্বাস নিলো। এবার রবি একা নয়। বাজে রকমের একটা গন্ধ রাতুলেরও নাকে এসে লাগলো। বললো, গোরস্থানে এরকম আজেবাজে গন্ধ থাকা অস্বাভাবিক নয়। শেয়াল-টেয়াল হয়তো কোনো কবর খুঁড়ে পচা লাশ বের করেছে।

রবি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললো, রাতুল, এটা পুরোনো গোরস্থান। চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের ভেতর এখানে কাউকে কবর দেয়া হয় নি। এখনকার কবর দেয়া হয় নতুন গোরস্থানে, এখান থেকে আধ মাইল দূরে।

রাতুল চিন্তিত গলায় বললো, তাহলে গন্ধ কিসের?

সেটাই তো বলছি আমি। এখানে এমন অনেক কিছু ঘটে যার কারণে কেউ বলতে পারে না। প্লীজ রাতুল, তোর পায়ে পড়ি, যে আমার সঙ্গে কথা বলেছে সে আমাদের ভালো চায় বলেই অমন বলেছে। ঘরে ফিরে চল। বেনুদাকে গিয়ে সব খুলে বলি! এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে আমি দমবন্ধ হয়ে মরে যাবো।

জ্বীনভূত বা অলৌকিক কিছু বিশ্বাস করে না রাতুল। বড়দা-মেজদারা নানাভাবে ওদের বুঝিয়ে দিয়েছে এসব যে নেই। তবু সেদিন মেঘলা দুপুরে পুরোনো গোরস্থানের ভেতর ঘন সাদা কুয়াশার দেয়ালে ঘেরা, কটু গন্ধভরা পরিবেশটাকে ভীষণ অচেনা আর অস্বস্তিকর মনে হলো। গন্ধটা এমনই যে, গা গুলিয়ে বমি আসতে চাইছিলো। তাই রবির কথার আর প্রতিবাদ করলো না। বললো, ঠিক আছে চল, বেনুদাকে বলি গে।

ওরা গোরস্থান থেকে বেরুতে বেরুতে লক্ষ্য করলো বাজে গন্ধটা কমে আসছে আর কুয়াশা কেটে যাচ্ছে। আমবাগানের কাছে এসে দেখলো অদ্ভুত ব্যাপার-এদিকে কোনো কুয়াশা নেই, শুধু গোরস্থানটা কুয়াশায় ঢাকা। তবে আকাশে তখনো ঘন ছাই রঙের মেঘের পাহাড়।

রাতুলের মাথায় সারাক্ষণ নবুর চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিলো বলে এই ব্যাপারটা ওকে তেমন নাড়া দিলো না। ও ভাবছিলো বেনুদা শুনে কি যাচ্ছেতাই ছেলে মনে করবে ওকে। অথচ বেনুদাকে জানানো দরকার। নইলে নবুর কিছু হলে ওকে চিরদিনের জন্য অপরাধী হয়ে থাকতে হবে। মনে মনে শুধু বললো, নবুর যেন কিছু না হয়।

আমবাগান পেরিয়ে ওরা খিড়কি পুকুরের কাছে এসেছে, হঠাৎ ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। আমড়াতলায় জলজ্যান্ত নবু দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক সেখানে, যেখানে কাল রাতে রবিকে ভয় দেখানোর জন্য বসে ছিলো। নবুর মুখ শুকনো, চুল উসকোখুসকো, চোখ দুটো লাল। পরনের কাপড়-চোপড় সব ভেজা। কেমন যেন অন্যরকমভাবে তাকাচ্ছিলো। রাতুলকে বললো, ওদিকে কোথায় গিয়েছিলে?

তোমাকে খুঁজতে। সারারাত কোথায় ছিলে তুমি? উদ্বিগ্ন উত্তেজিত গলায় জানতে চাইলো রাতুল।

পরে বলবো। বেনুদা কোথায়? নবুর গলায় ব্যস্ততা।

রবি বললো, বোধ হয় চিলেকোঠার ঘরে। সকালে মিস্তিরি এসেছিলো। দেখেছি কি-সব বানাচ্ছে ওখানে।

নবু রবিকে বললো, রাতুলকে নিয়ে এক্ষুনি খেয়ে নে। বেরুতে হবে। আমি কাপড় বদলে বেনুদার সঙ্গে জরুরী কথা সেরে আসি।

নবুর কথা শুনে রাতুল আর রবি মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো । সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ না করে নবু ছুটলো চিলেকোঠার দিকে, পেছন পেছন রাতুলরাও।

নাদুখালা খাবার আয়োজন করছিলেন। রাতুলদের দেখে বললেন, এই মেঘলায় গোসল করে কাজ নেই। মুখ-হাত ধুয়ে খেয়ে নাও।

রবি ফস করে বললো, নবু এসেছে।

ভুরু কুঁচকে নাদুখালা বললেন, কোথায়?

বেনুদার সঙ্গে জরুরী কথা বলতে গেছে।

তাই বুঝি! তোমরা খেয়ে নাও। বাবুর যখন ক্ষিদে পাবে তখন ঠিকই খেতে আসবে। ওর জন্যে সবার বসে থাকতে হবে না।

রাতুল আর রবি ঝটপট মুখ-হাত ধুয়ে খেতে বসে গেলো। ওদের খাওয়া দেখে নাদুখালা বললেন, এতো তাড়া কিসের, ঘাটে লঞ্চ ছেড়ে দেবে নাকি!

রাতুল বললো, আজ আমরা বিমলদের বাড়ি বেড়াতে যাবো।

নাদুখালা বললেন, ভালোই হলো। ভাবছিলাম আমি যাবো। রবি শোন, বিমলের মাকে বলবি আমি ওর কাছে এক বয়েম জলপাইর আচার পাই। দুদিন বাদে বাড়িতে জেয়াফত। আচারটা যেন তোদের হাতে দেয়।

খাওয়া সেরে রাতুলরা ছাদে উঠতে যাবে–দেখে বেনুদা আর নবু নামছে। ওদের দেখে নবু বললো, চল বেরুই।

সিঁড়ির গোড়ায় আসতেই সবাই নাদুখালার মুখোমুখি। নবুকে দেখে নাদুখালার মেজাজ সপ্তমে উঠলো বাবুর ফেরা হয়েছে দেখছি। চেহারার ছিরি দেখো না! বলে গেলেই হয় রাতে ফেরা হবে না, সারারাত বেতো শরীর নিয়ে জাগতে হয় না। তোর পিঠে যদি আমি আস্ত খড়ম না ভাঙি, জুলপিগুলো যদি–

বেনুদা ব্যস্ত গলায় বাধা দিলো–এখন একটু থামো নাদুখালা। আমরা বেরুচ্ছি। মাকে বলে দিও রাতে আমার কয়েকজন বন্ধু খাবে। এরপর নবুর কানে কানে বললো, খুব সাবধান, কেউ টের না পায়। বলে আর ও দাঁড়ালো না।

বেনুদা পার পেলেও নাদুখালা নবুকে ঠিকই আটকালেন–আবার কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি? না খেয়ে বাড়ির বাইরে এক পা যদি রেখেছিস তবে–

ঠিক আছে খেতে দাও। বলে ঝাঁঝিয়ে উঠলো নবু। বেনুদাকে বললো, আপনি চলে যান, আমি রাতুলদের সঙ্গে বেরুবো।

নাদুখালা নবুকে খাবার বেড়ে দিয়ে চলে গেলেন। ওর খাওয়া দেখে রাতুল বুঝে ফেললো, কাল দুপুরের পর থেকে পেটে কিছু পড়ে নি। বললো, অস্তে আস্তে খাও নবু এতো তাড়া কিসের!

নবু এতক্ষণ পর একটু হাসলো–সত্যিই তাড়া আছে রাতুল। এখন আমাদের দম ফেলার সময় নেই।

.

১০. অবশেষে হানাবাড়িতে অভিযান

খেয়ে উঠে বাইরে এসে নবু যে কথাটা বললো, শুনে রবির দম আটকে যাওয়ার দশাবলিস কি, রাজবাড়ি যাবি? তোর মাথা খারাপ হলো নাকি! রাতে পাগলা শেয়াল-টেয়াল কামড়ায় নি তো?

নবু ধমক দিয়ে বললো, হ্যাঁ, রাজবাড়ি যাবো। এখনই। তুই ওভাবে তাকাচ্ছিস কেন, তোকে তো যেতে বলছি না। আমি আর রাতুল যাবো।

রবির মুখের দিকে তাকিয়ে রাতুলের মনে হলো নবুর ধমক খেয়ে ও বুঝি কেঁদে ফেলবে। নবুকে বললো, রবি আমাদের সঙ্গে আসুক না ।

নবু রবির চোখে চোখ রেখে শক্ত গলায় বললো, কাল রাতে তুই অমন করে লেজ মাড়ানো কুত্তার মতো চেঁচিয়েছিলি কেন?

রবি গাল ফুলিয়ে চুপ করে রইলো। রাতুল বললো, ওর ভয় কেটে গেছে। ওকে নিতে পারো নবু।

নবু কয়েক মুহূর্ত কি যেন ভাবলো। তারপর মুখ টিপে হেসে বললো, ঠিক আছে আসতে বলো ওকে। এবার ভয়-টয় পেলে ওকে রাজবাড়ির জ্বীনদের কাছে রেখে আসবো।

রাতুল রবির কাছে এসে ওর কাঁধে হাত রেখে নরোম গলায় বললো, রাগ করছিস কেন? তোর চাঁচানোর জন্য মনে হচ্ছে নবুর ওপর দিয়ে ধকল কম যায় নি। তাই ওর মেজাজ অমন তিরিক্ষি হয়েছে। চল যাই। এরপর রবির কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, ভয় পাওয়া একেবারেই চলবে না।

রবি কোনো কথা না বলে ওদের সঙ্গে হাঁটতে লাগলো। নবু বললো, নদীর ধার দিয়ে ঘুরে যাবো। আমবাগান দিয়ে গেলে বাড়ির কেউ দেখে ফেলতে পারে। বিশেষ করে আবেদালি দেখলে বিপদ হবে।

রাতুল বললো, কাল রাতে কোথায় ছিলে বললে না তো!

নবু এক কথায় জবাব দিলো, রাজবাড়ি।

সে কি! সারারাত ওখানে ছিলে?

রহস্য হেসে নবু মাথা নেড়ে সায় জানালো। রবি ওর সঙ্গে কথা না বললেও শোনার জন্য কান দুটো খাড়া করে রেখেছিলো।

ওখানে কি কিছু দেখেছো?

চুপ! চাপা গলায় বললো নবু–আবেদালি আসছে।

রাতুল সামনে তাকিয়ে দেখলো নদীর কিনার থেকে আবেদালি উঠে আসছে। ওদের দেখতে পেয়ে খুবই অবাক হলো সে। কাছে এসে প্রশ্ন করলো, দাদারা এই মুহি কোই যাও?

রাতুল বললো, নিকেরিপাড়ায় মাছ ধরা দেখতে যাবো।

আবেদালি অবাক হয়ে বললো, অ মোর খোদা, মাছ ধরা আবার দেহার জিনিস নিহি?

নবু মুখ টিপে হেসে বললো, ওরা শহরের মানুষ। কোনোদিন দেখেছে নাকি এসব! তা, তুমি এদিকে কোথায় গিয়েছিলে?

মুই গেছিলাম গরু টোহাইতে। মোগো ধলা গরুডা এ মুহি কই জানি গেছে। আপনেরা যাওনের কালে দেইখ্যো–।

ঠিক আছে তুমি বাড়ি যাও। বিকেলে বেনুদার মেহমানরা আসবে। তোমাকে ঘরে থাকতে বলেছে।

আবেদালি চলে যাওয়ার পর নবু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

যেতে যেতে রাতুল মুখ টিপে হেসে নবুকে বললো, সারারাত রাজবাড়িতে ছিলে, ভরদুপুরে যাদের নাম নিতে নেই–তেনাদের দেখো নি?

নবু আড়চোখে একবার রবিকে দেখলো। তারপর নিরীহ গলায় বললো, দেখবো না কেন, দেখেছি, কথা শুনেছি। তারপর গম্ভীর হয়ে বললো, ঠাট্টা নয় রাতুল, এখনো যে আমি বেঁচে আছি-নেহাত পূর্বপুরুষদের সকাজের জন্য। পরে সব বলবো। এখন পা চালিয়ে হাঁটো।

গাঁয়ের গেছো ছেলে নবু। লম্বা পা ফেলে দশ-পনেরো মাইল হাঁটা যার কাছে কিছুই না–ওর সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটতে গিয়ে রাতুল কেন, রবি পর্যন্ত হাঁপিয়ে উঠলো।

নদীর ধার দিয়ে রাজবাড়ি যেতে ওদের এক মাইলের ওপর হাঁটতে হলো। আকাশ তখনো মেঘলা, তবে কুয়াশা নেই, কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসও নেই। হাঁটতে ওদের বেশ আরাম লাগছিলো। রাজবাড়ির কাছে এসে অবশ্য রাতুল ঘাবড়ে গেলো। এখানে-সেখানে এতো ঘন কাঁটাঝোঁপ যে গা বাঁচিয়ে চলা মুশকিল। কাঁটার খোঁচা লেগে ওর হাতের কয়েক জায়গা ছড়ে গেলো। পুলোভারের উল খুলে গেলো। এর ভেতর টেরও পায় নি কখন থেকে দুটো চিনে জোক স্যাণ্ডেলের ফাঁক দিয়ে ওর পা কামড়ে পড়ে আছে। রবির চোখে পড়েতেই ও বললো, রাতুল একটু দাঁড়া।

জোঁক দেখে রাতুল রীতিমতো লাফাতে লাগলো। নবু বললো, দাঁড়াও বীরপুরুষ, তুলে দিচ্ছি।

অবলীলাক্রমে জোক দুটোকে টেনে তুলে রবারের মতো টান মেরে ছিঁড়ে ফেললো নবু। রাতুলের পায়ের যে জায়গাটায় জোঁক লেগেছিলো সেখান থেকে রক্ত বেরুতে দেখে ঘাস চিবিয়ে লাগিয়ে দিলো। বললো, রক্ত বেশি খায় নি। খেলে আপনা থেকেই ঝরে যেতো।

রাতুলের সারা শরীর অস্বস্তিতে শিরশির করছিলো। ওর মনে হচ্ছিলো প্যান্টের ভেতর একটা-দুটো ঢুকে পড়াও বিচিত্র কিছু নয়। নবু আর রবিকে দেখলো।–কোনো বিকার নেই, কায়দা করে দুহাত দিয়ে কাঁটাঝোঁপ সরিয়ে এগিয়ে চলেছে। জোঁকের ভয়ে রাতুলও পা চালালো।

কাঁটাঝোঁপ ঠেলে বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর ছোট-বড় তিনটা উঁচু ঢিবি পেরুতে হলো ওদের। রাতুল বুঝলো, এগুলো রাজবাড়ির ধ্বংসস্তূপের অংশ, গাছপালা গজিয়ে গেছে, ফাঁকে ফাঁকে ইট-সুরকি দেখা যাচ্ছিলো। রাজবাড়ির চারভাগের তিনভাগ মাটিতে মিশে গেছে। শুধু গোটা চারেক ছোট বড় মোটা থাম আর উত্তর দিকে নিচের তলার কয়েকটা ঘর এখনো পুরোপুরি ধসে পড়ে নি, যদিও দরজা-জানালার জায়গাগুলো গর্তের মতো মনে হচ্ছে। একটা অশ্বথ গাছ একপাশের দেয়াল বেয়ে উঠেছে।

অনেক দিনের চেনা জায়গার মতো এতোটুকু ইতস্তত না করে নবু একটা গর্তের ভেতর ঢুকে গেলো। রাতুল আর রবি বিস্ময় চেপে অনুসরণ করলো ওকে। ভাঙাচোরা কয়েকটা ঘর পেরিয়ে নবু একটা আস্ত ঘরে এসে বসে থামলো। রহস্যময় গলায় বললো, কি মনে হচ্ছে?

অবাক হয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখে রাতুল বললো, তুমি কি এখানে ছিলে? মনে হয় এখানে লোকজন থাকে?

নবু মুখ টিপে হাসলো, তোমার প্রথম কথার জবাব–না। দ্বিতীয় কথার জবাব–হ্যাঁ।

কারা থাকে?

আড়চোখে রবির দিকে এবার তাকিয়ে নবু বললো, কারা আবার! রবি যাদের জীন মনে করে, যখ মনে করে, তারা!

আহ্, খুলেই বলো না ছাই। রাতুল অধৈর্য হয়ে উঠলো।

রাজবাড়ি এখন ডাকাতদের ঘাঁটি।

তুমি জানলে কি করে?

আগে কিছুটা অনুমান করেছিলাম। তবে সব টের পেয়েছি কাল রাতে।

কিভাবে?

বলব। এখন নয়, পরে। বেশিক্ষণ এখানে কথা বলা ঠিক হবে না। যে-কোনো সময়ে যে-কেউ আসতে পারে। এখন এদিকে এসো।

নবু পাশের ঘরে ঢুকলো। এ ঘরটা বেশ পরিষ্কার। ধুলোবালি নেই। কয়েকটা হোগলাপাতার চাটাই বেছানো। ঘরের এক কোণে মস্ত বড় একটা সিন্দুক। নবু বললো, এটা খুলতে হবে।

তিনজনে মিলে মহাকষ্টে সিন্দুকের ভারি ঢালাটা খুললো। ঘরের ভেতরটা রীতিমতো অন্ধকার। স্পষ্ট কিছু দেখা যাচ্ছিলো না। নবু এক লাফে সিন্দুকের ভেতর ঢুকে গেলো। কোণা হাতড়ে বের করে আনলো একটা ন্যাকড়ার পুঁটলি। রাতুলের হাতে দিয়ে বললো, ধরো এটা।

তিনজনে মিলে সিন্দুকের ডালা বন্ধ করে ঘরের বাইরে খোলা জায়গায় এলো। রাতুলের হাত থেকে পুঁটলিটা নিয়ে নবু ওটা খুললো। সঙ্গে সঙ্গে রাতুল আর রবির চোখ ছানাবড়া।

এ কি! চমকে উঠে রাতুল বললো, এ যে সব সোনার গয়না। কোত্থেকে এলো?

নবু রহস্য হেসে রবিকে বললো, দ্যাখ তো, চিনতে পারিস কিনা?

রবি মাথা নাড়লো। নবু বললো, তুই না চিনলেও খালা ঠিক চিনবে। এগুলো তোদের বাড়ির চুরি যাওয়া গয়না।

গহনার ভেতর ছটা মোহরও দেখতে পেলো রাতুল। আরবীতে কি যেন। লেখা। বললো, এগুলো মনে হচ্ছে সোনার মোহর!

হ্যাঁ, মোহরই বটে। তবে কার–এখনো জানতে পারি নি।

রাতুল অধৈর্য হয়ে বললো, নবু, তুমি কি দয়া করে সব খুলে বলবে? টেনশনের চোটে আমার নার্ভ-টার্ভ সব ছিঁড়ে যাবে।

ঘরে গিয়ে বলবো। এখানে আর থাকা ঠিক হবে না, এই বলে নবু পুঁটলির ভেতর থেকে মোহরগুলো বের কের রাতুলের পকেটে ঢুকিয়ে দিলো–এগুলো আলাদা থাক।

বাড়ি ফিরে কাউকে কিছু না বলে ওরা তিনজন ওদের ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে মোড়া টেনে গোল হয়ে বসলো। নবু কিভাবে আমড়াতলা থেকে পালাতে গিয়ে সুড়ঙ্গে ঢুকলো আর ধরা পড়লো, একে একে সব বললো। এর পরের ঘটনা শুধু বিস্ময়কর নয়, রীতিমতো রোমহর্ষক।

হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নবু রোস্তমের পাহারায় থাকার সময় মনে মনে ঠিক করেছিলো যেভাবে হোক পটিয়ে না পারলে রোস্তমকে ঘায়েল করেই ও পালাবে। নিজের ছেলের কথা ভেবে নবুর ওপর রোস্তমের মায়া পড়ে গেলেও এটাও রোস্তম ভালোভাবে জানতো–নবুর পালানো মানে ওর মৃত্যু। মৃত্যু মানে বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েদেরও মৃত্যু। বাড়ির সব কথা যদিও নবুকে বলেছে, ওকে ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে নিজের অক্ষমতার কথাও রোস্তম পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে।

শেষ রাতের দিকে নবুর তন্দ্ৰামতো এসেছিলো। এমন সময় শুনলো কে যেন ফিসফিস করে বলছে, ঘুমোবে না। উঠে পড়ো। দুনম্বর ঘাঁটিতে নিয়ে তোমাকে মেরে ফেলবে। তুমি নৌকা থেকে যেভাবে হোক পালাবে।

কথা শুনে নবুর তন্দ্রার ঘোর কেটে গেলো। তাকিয়ে দেখলো–হ্যারিকেনটা জ্বলছে, দেয়ালে হেলান দিয়ে রোস্তম ঘুমোচ্ছে, ঘরে কেউ নেই। কে ওকে অমন কথা বললো? ও কি স্বপ্ন দেখছিলো? কিছুই বুঝতে পারছিলো না নবু। এ কি রকম স্বপ্ন দেখা? কিসের দুনম্বর ঘাঁটি, কোথায় নৌকা–মাথায় ওর কিছুই ঢুকছিলো না।

এমন সময় নবু শুনতে পেলো, পাশের ঘরে কারা যেন কথা বলছে। গড়িয়ে গড়িয়ে ও দরজার কাছে গেলো। সেখানেই শুনলো বড়বাড়ির গয়না চুরির বৃত্তান্ত আর নতুন করে চুরির ষড়যন্ত্র। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলো আট-দশজন লোক হারিকেনের চারপাশে বসে। ওদের ভেতর তিনজন নবুর খুবই চেনা। ওরা বলছিলো–আজ রাতে আবার তারা বড়বাড়িতে হানা দেবে। নতুন বউ এসেছে। অনেক গয়না নিয়ে। আজকের কাজ ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলে কাল থেকে কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দেবে। দুই বাড়ির কাজ একরাতেই সারতে হবে। নইলে অন্যরা সাবধান হয়ে যাবে। ওরা ঠিক করেছে আজ রাতে ওরা চৌধুরী বাড়িতেও হামলা চালাবে। এই দুই বাড়ি থেকে কি পরিমাণ সোনা পাওয়া যাবে তারও একটা হিসেব করেছে ওরা। বিলি বন্দোবস্তের কথা বলতেই একজন ওপরের ঘর থেকে সিন্দুক খুলে এই গয়নাগুলো আনলো। বড়বাড়ির গয়না চিনতে নবুর এতোটুকু ভুল হয় নি। এরপর সে দরজার কাছ থেকে সরে গিয়ে আবার আগের জায়গায় গিয়ে বসলো।

নবুর কথা শুনে রবির চোখ দুটো মনে হলো ঠিকরে বেরিয়ে যাবে। চাপা উত্তেজিত গলায় বললো, তোর কানে কানে যে কথা বলেছে–মনে আছে গলাটা কি রকম ছিলো?

একটু ভেবে নবু বললো, মনে আছে। গোরস্থানে থাকতে যে গলাটা শুনেছিলাম–আমাকে পালিয়ে যেতে বলেছিলো, ঠিক সেই গলা। কেমন যেন খসখসে, মনে হচ্ছিলো কোনো মেশিনের ভেতর থেকে বুঝি শব্দটা আসছে। কেন বল তো?

আমি আজ গোরস্থানে ঠিক সেরকম গলা শুনেছি।

রাতুল রবিকে বাধা দিয়ে নবুকে বললো, তুমি যে বললে তিনজন তোমার চেনা–ওরা কারা?

নবু একটু চুপ থেকে আস্তে আস্তে বললো, একজন আমাদের আবেদালি, একজন চৌধুরী বাড়ির রমজান, আরেকজন সরকার বাড়ির কানাই। আজ রাতে আবেদালি আর রমজান দুই বাড়ির দরজা খুলে দেবে। আগেরবার দরজা খুলতে আবেদালি দেরি করেছে বলে বকুনিও খেলো।

কি সর্বনাশ! আজ রাতেই বাড়িতে ডাকাতি হবে?

মাথা নেড়ে সায় জানালো নবু।

বেনুদা কোথায় গেছেন?

চৌধুরীদের বাড়িতে।

রবি বললো, থানায় খবর দিলে ভালো হতো না?

না। শক্ত গলায় নবু বললো, থানায় ওদের লোক আছে। সেখানে গেলেই ওরা টের পেয়ে যাবে। বেনুদার সঙ্গে আমি কথা বলেছি। ঠিক হয়েছে চৌধুরীদের আগে সাবধান করে দিতে হবে।

রাতুল বললো, তারপর কি হলো বলো না! তুমি ওখান থেকে পালালে কিভাবে?

কাষ্ঠ হেসে নবু বললো, সেটাই তো আসল রহস্য।

দরজার কাছ থেকে সরে এসে নবু আগের জায়গায় বসেছে। হঠাৎ পেছনে দরজা খোলার শব্দ পেয়ে চোখ বুজে ও ঘুমের ভান করলো। কে যেন এসে পা দিয়ে পিঠে খোঁচা মেরে বললো, এ্যাই ওঠ।

নবু তখন চমকে উঠে পেছনে তাকিয়ে দেখে ছোট সর্দার। ছোট সর্দার বললো, তরে মনে অয় বাঁচাইবার পারুম না। কাকায় কইছে তরে দুই নম্বর ডেরায় লয়া যাইতে। পায়ের বন্ধন খুইলা দিতাছি। উল্টাসিদা কাম করবি না। তয় কইলাম রাস্তার মইদ্যে তর প্যাটটা নামায়া দিমু ড্যাগার দিয়া।

এই বলে কোমরে গোঁজা ড্যাগার দিয়ে নবুর পায়ের বাধন কেটে দিলো। নবু উঠে দাঁড়ালো। ছোট সর্দার বললো, ল, যাই, ম্যালা দূর যাঅন লাগব নৌকায় কইরা।

লোকটার কথা শুনে চমকে উঠলো নবু। এতোক্ষণ যেটাকে স্বপ্ন ভেবেছিলো সেটা কি তাহলে স্বপ্ন নয়? সত্যি সত্যি তাকে নৌকায় করে দুনম্বর ডেরায় নিয়ে মেরে ফেলবে!

এ নিয়ে বেশিক্ষণ ভাববার সময় পেলো না নবু। ছোট সর্দার ওকে ধরে পাশের ঘরের ভেতর দিয়ে ওপরে উঠলো। ওপরেও ঘর, যে ঘরটায় ভারি সিন্দুকটা রাখা ছিলো সেইটা। তারপর ওকে নিয়ে লোকটা নৌকায় উঠলো।

ছইওয়ালা বেশ বড় নৌকা। একজন মাঝি হালের কাছে বসে ছিলো। ওব্রা নৌকায় উঠে বসতেই নঙ্গর তুলে মাঝি নৌকা দিলো বলেশ্বরীর ভাটির দিকে।

তখনও সূর্য ওঠে নি। আকাশের অন্ধকার ফ্যাকাসে হয়েছে মাত্র। ঘন কুয়াশা চারদিকে। ভাটার টানে নৌকা যেন তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিলো। যদিও কুয়াশার জন্য দশ হাত দূরের জিনিস ভালো দেখা যাচ্ছিলো না।

হালে ছিলো মাঝি, ছইয়ের নিচে নবু। ছোট সর্দার বৈঠা বাইছিলো। হাত দুটো যেরকম বেকায়দাভাবে পিছমোড়া করে বাঁধা, কিভাবে পালাবে কিছুই ভেবে উঠতে পারছিলো না নবু। মনে মনে চাইছিলো, একটা কিছু ঘটুক, একটা ঝড় উঠে নৌকাটা উল্টে যাক, কিংবা বাজ পড়ে গুণ্ডা লোকটা মরে যাক–এছাড়া পালাবার কোনো পথ নেই। একবার মনে হলো, স্বপ্নের সেই কণ্ঠস্বর যদি বলতো কিভাবে পালাতে হবে।

এ কথাটা নবুর মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নৌকাটা যেন জমাটবাধা কুয়াশার কোনো পাহাড়ের ভেতর ঢুকে গেলো। মাঝি, সর্দার, নৌকা সবকিছু ঢাকা পড়লো কুয়াশায়। নবুর মনে হলো, মুহূর্তের ভেতর বুঝি ও মেঘের রাজ্যে চলে গেছে। ঠিক তখনই শুনলো সেই ফিসফিসে বাতাসের মতো কণ্ঠস্বর–তোমার দাদা আমাদের অনেক উপকার করেছিলেন। তুমি এর প্রতিদান পাবে। ভয় পেও না। নৌকা ডুবিয়ে দেবো। লোক দুটো মরে যাবে।

নবু বলতে চাইলো, কিভাবে পালাবো, আমার হাত যে বাঁধা?

সেই কণ্ঠস্বর আবার বললো, তোমার হাতের দড়ির বাঁধন খুলে গেছে। তৈরি হও।

সঙ্গে সঙ্গে শোঁ শোঁ শব্দ শুনলে নবু। মনে হলো প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসছে ভীষণ ঝড়, সবকিছু যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে। বলেশ্বরী নদীতে বড়ো বড়ো ঢেউ উঠলো। নৌকা দুলতে লাগলো। আকাশে বিদ্যুৎ চমকালো, আর তার সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়া কাঁপিয়ে প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়লো। চোখ ঝলসানো বিদ্যুৎ আর কান ফাটানো সেই বাজ পড়ার শব্দের ঘোর কেটে যেতেই নবু দেখলো পেছনে হালের মাঝি ঠিকই আছে, গলুইয়ে বসা শয়তানটা শুধু নেই। আরো অবাক হয়ে দেখলো হাত থেকে দড়ির বাধন খসে পড়েছে।

এরপর এলো এক দমকা বাতাস। নৌকাটাকে মুহূর্তের ভেতর শুন্যে তুলে উত্তাল নদীতে আছাড় মারলো। ছিটকে বিশ-পঁচিশ হাত দূরে গিয়ে পড়লো নবু। বাঁচার তাগিদে প্রাণপণে তীরের দিকে সাঁতরাতে লাগলো। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড় থেমে গেলো। কুয়াশাও কিছুটা হালকা হলো। তবু ভাটির টানে উজানে সাঁতার কাটতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো নবুর। প্রায় ঘন্টাখানেক সাঁতারানোর পর তীরে এসে পৌঁছলো। পাড়ে উঠে অনেকক্ষণ চিৎ হয়ে শুয়ে ছিলো। ঘটনাটা কি ঘটলো, কিছুই ওর বোধগম্য হচ্ছিলো না। মাথাটা তখন থেকে ভার হয়ে আছে। নবু শুনছে অনেক মানুষ আছে যারা বিপদ আসার আগে নাকি আঁচ পায়। ওর ভেতর কি সেরকম কোনো ক্ষমতা আছে? নাকি সত্যি সত্যি রাজবাড়ির জ্বীনরা ওকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচালো? এ নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবারও সময় পেলো না। আজ রাতে বাড়িতে ডাকাতি হবে। যেভাবেই হোক ঠেকানো দরকার। সবার আগে কথা বলতে হবে বেনুদার সঙ্গে। এ কথা মনে হতেই ও উঠে দাঁড়ালো।

মসজিদের কাছে এসে ও পুরোনো গোরস্থানে রাতুলদের দেখতে পেয়ে বাড়িতে না ঢুকে আমড়াতলায় এসে দাঁড়িয়েছিলো।

নবুর কথা শুনে রবির মনে রাজবাড়ির জ্বীনদের ওপর শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো। ওরা সাহায্য না করলে নবুকে কেউ বাঁচাতে পারতো না।

রাতুল অবশ্য নবুর অলৌকিক ঘটনা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাচ্ছিলো না। ও ভাবছিলো আজ রাতে এ বাড়িতে ডাকাতি হবে। ডাকাতদের লোক আবেদালি এ বাড়িতেই আছে। অস্বাভাবিক কিছু দেখলে আবেদালি ডাকাতদের সাবধান করে দেবে। নবুকে বললো, আজ রাতে ডাকাতদের ধরার ব্যাপারে কিছু ভেবেছো?

নবু কিছুটা উদভ্রান্তের মতো বললো, আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না রাতুল। কিছুই ভাবতে পারছি না। ভীষণ ভার হয়ে আছে মাথার ভেতরটা।

রাতুল বুঝলো, বেচারার ওপর দিয়ে কাল রাত থেকে ধকল তো কম যায় নি। ওর জায়গায় রবি হলে এতোক্ষণ ভয়েই হার্টফেল করতো। বললো, বিপদ হচ্ছে কাউকে কিছু বলা যাবে না। আমরা তিনজন আর বেনুদা ছাড়া কেউ জানলেই বিপদ। আবেদালি নিশ্চয়ই সবার ওপর নজর রেখেছে।

নবু মাথা নেড়ে সায় জানালো–ঠিক বলেছো।

এমন সময় আবেদালি এসে ঘরে ঢুকলো। চোখ টিপটিপ করে ওদের তিনজনকে দেখে নিরীহ গলায় বললো, কি দাদারা, আইছ কুন কালে? নদীর ধারে কিছু দেখছো?

আবেদালি কিছু শুনতে পায় নি তো? ওকে দেখে নবু আর রবি দুজনেই থতমত খেলো। রাতুল বললো, দেখার সুযোগ পেলাম কই। রবিটা যা ভীতু! ও তো যেতেই দিলো না। বললো, ফিরতে ফিরতে নাকি সন্ধ্যে হয়ে যাবে। তারপর নাকি কারা সব বেরোয়! জোর করে চলে এলো। কাল তুমি যেও আমাদের সঙ্গে। রবিকে নিয়ে চলাই বিপদ।

আবেদালি হেসে আদর করে রবির পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো–রবি দাদা ঠিক হরছে। দিনমানেও ওইসব খারাপ জায়গায় থাকতে নাই। কোনকালে কার নজর পড়ে হেইয়া কওয়া যায়?

নবু বললো, আবেদালি, কাল যে বলেছিলে আমাকে ঘুড়ি আর নাটাই কিনে দেবে, আজ যাবে? পথে খাওয়ার জন্য তোমাকে একটা টাকা দেবো।

আবেদালি মাথা নাড়লো–আইজ পারুম না। সকাল থেইকা গাটা ম্যাজম্যাজ করতে আছে। অহন একটু ঘুম না দিলে কাইল ক্ষেতে কাম হরতে পারুম না। যাই গরুগুলানরে জাব কাইট্টা দেই।

আবেদালি চলে যেতেই নবু বললো, দেখলে শয়তানটার কাণ্ড! রাতে জাগতে হবে তো তাই পৌষ মাসের বিকেলে ওর না ঘুমালে চলবে না।

আহা বেচারা, কালও তো সারারাত ঘুমোয় নি! পরপর রাত জাগলে অতো বড়ো শরীরটা ভেঙে পড়বে না! রাতুলের কথা শুনে নবু আর রবি হো হো করে হেসে উঠলো।

হঠাৎ বুদ্ধিটা এলো রাতুলের মাথায়। চাপা গলায় নবুকে বললো, ঘুমোতে যখন চাইছে, বাছাধনকে এক ঘুমে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেই, কি বলো?

নবু আর রবি হুমড়ি খেয়ে পড়লো ওর ওপর। আইডিয়াটা খুলে বললো ওদের দুজনকে। শুনে ওদের চোখ জ্বলজ্বল করতে লাগলো। নবু বললো, ঠিক বলেছো এছাড়া আর কোনো পথ নেই।

.

১১. ডাকাত ধরা পড়লেও রহস্য জানা গেলো না

চৌধুরীদের বাড়িতে খবর দিয়ে বেনুদা থানা হয়ে ফিরলো শেষ বিকেলে। ওরা তিনজন তখন ছাদে বসে দেখছিলো সন্দেহজনক কিছু দেখা যায় কিনা। রবি ভাবছিলো সকালে পুরোনো গোরস্থানে এ কি দেখলো ও। যাতোবার ও রহস্যময় কণ্ঠস্বরের কথা ভাবলো, ততোবারই রোমাঞ্চিত হলো।

রাতুলের মাথায় তখন শুধু ডাকাত ধরার চিন্তা। ভীষণ উত্তেজনা বোধ করছিলো। প্ল্যানমতো সব যদি না করা যায় তখন কি হবে? চৌধুরী বাড়িতে বেনুদা খবর দিতে গেছে। সেখান থেকেও তো জানাজানি হতে পারে। ওরা যদি নবুর আসল পরিচয় জানতে পারে, ওকে কি রাখবে?

নবু কোনো কিছুই ঠিকমতো ভাবতে পারছিলো না। কখনো ভৌতিক কণ্ঠস্বর, কখনো নৌকার ঘটনা আবার কখনো ডাকাত ধরার কথা ভাবতে গিয়ে সব গুলিয়ে যাচ্ছিলো। মাথা ধরা তখনো যায় নি। রাতুল অবশ্য কি একটা মলমের মতো কপালে লাগিয়ে দিয়েছিলো, ওর বড়দা নাকি ওটা চীন থেকে এনেছিলেন। ওতে কিছুক্ষণের জন্য আরাম লাগলেও আবার মাথা ধরেছে।

বেনুদা এসে বললো, ও বাড়ির সব ব্যবস্থা ঠিক করে এলাম। এবার আমরা কি করবো সেটা নিয়ে ভাবতে হবে।

ঠিক করে ফেলেছি কি করবো। এই বলে রাতুল ওর পরিকল্পনার কথা খুলে বললো।

শুনে বেনুদা অবাক হলো–কি আশ্চর্য, আমিও তো চৌধুরীদের একই প্ল্যান দিয়ে এসেছি।

নবু বললো, আমাদের প্ল্যানটা রাতুলের মাথা থেকে এসেছে।

বেনুদা ওর পিঠ চাপড়ে বললো, আমরা হলাম গ্রেট ম্যান–কি বলো?

রাতুল গম্ভীর হয়ে বললো, আমাদের হাতে সময় বেশি নেই।

নবু উঠে দাঁড়ালো–আমি নিচে গিয়ে মাকে বলে আসি, আবেদালির হাতে আমাদের চাটা যেন ওপরে পাঠিয়ে দেয়।

বেনুদা রাতুলকে বললো, তোমার জিনিস ঠিক আছে তো?

রাতুল গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে সায় জানালো।

নবু এসে হাসতে হাসতে বললো, আবেদালি বেচারা ঘুমিয়ে পড়েছিলো। মনে হয় ওর কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছি।

রাতুল নিরীহ গলায় বললো, তাতে কি, আবার ঘুমোবে।

একটু পরে মুখ কালো করে আবেদালি চায়ের ট্রে হাতে ছাদে এলো। বেনুদা ওকে বললো, তোমার শরীর খারাপ নাকি আবেদালি? মুখটা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে!

গলায় অসুখ অসুখ ভাব এনে আবেদালি বললো, হ বেনুদাদা। গাডা ম্যাজম্যাজ হরে।

রাতুল সমবেদনা দেখিয়ে বললো, একটু চা খেয়ে নাও। ভালো লাগবে।

আবেদালি রেগেমেগে বললো, হেই চা খাইতে যাইয়াই তো মুই বহান্ডা খাইলাম। নিত্য কি খাই? আইজ এটু চাইতে গেছি–

বেনুদা হাঁ হাঁ করে উঠলো–সে কি কথা আবেদালি, চা কেন দেবে না। ক্ষেমির মা বড় বাড় বেড়েছে দেখছি। তুমি এখানে বসে এক কাপ খেয়ে নাও।

একগাল হেসে আবেদালি বললো, তা এটু খাইলে মন্দ অয় না। আপনেগো কাপে খামু নিহি?

রাতুল বললো, তাতে কি! বসো, আমিই বানিয়ে দিচ্ছি। তুমি বরং সিঁড়ির দরজাটা বন্ধ করে দাও। ক্ষেমির মা আর দেখতে পাবে না।

ক্ষেমির মারে মুই ডরাই নিহি? বলে গজগজ করতে করতে আবেদালি দরজা বন্ধ করতে গেলো। এই ফাঁকে আগে থেকে গুঁড়িয়ে রাখা গোটা দশেক ঘুমের বড়ি ওর কাপে ঢেলে চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিলো।

নবু রাতুলকে বললো, আমি চা খাবো না। আমার কাপটা আবেদালিকে দাও।

খুব আয়েশ করে চা খেলো আবেদালি। কিছুক্ষণ পর বললো, না গো বেনুদাদা, যুইত লাগে না। যাই গুরুগুলানরে ঘরে উড়াইয়া এটু কাইত হই।

আবেদালি চলে যাওয়ার পর সবাই একচোট হাসাহাসি করলো। বেনুদা বললো, বেশি হেসো না, আসল কাজ এখনো বাকি। মাকে বলতে হবে আবেদালি ফিরে এলে যেন চিলেকোঠায় ঘুমোয়।

ওরা এলো অনেক রাতে। অন্ধকারে বাইরের ঘরে বেনুদা, নবু, রবি আর রাতুল মোটা বাঁশের লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে ছিলো। কয়েকবার মহড়া দেয়া হয়ে গেছে।

টুক-টুক-টুক। দরজায় তিনটা শব্দ হলো। আস্তে বেনুদা দরজা খুলে দিলো। এক এক করে পাঁচজন ঢুকলো। সামনেরটা চাপা গলায় বললো, সব ঠিক আছে?

বেনুদা বললো, হুঁ।

তক্ষুণি সবাই মিলে সামনের লোকগুলোর ঘাড়ের ওপর লাঠি চালালো। মাথায় মারতে নিষেধ করেছিলো বেনুদা। সামনের লোকগুলো পড়তে না পড়তেই পেছনেরটাকেও বাড়ি মেরে শুইয়ে দেয়া হলো। সঙ্গে সঙ্গে আলো জ্বেলে সবাইকে ডাকা হলো। নবু আর বেনুদা মিলে সব কটাকে বেঁধে ফেললো।

চিলেকোঠার ঘরে তখন ভোস ভেঁস করে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে আবেদালি। এতো কিছু হয়ে গেলো, কিছুই টের পেলো না ও।

ভোরবেলা দারোগা এলো। কোমরে দড়ি বেঁধে সব কটাকে গাড়িতে নিয়ে তোলা হলো। নাদুখালা সুযোগ পেয়ে দারোগাকে দুকথা শুনিয়ে দিলেন। তবে দুপুরে ভরপেট না খাইয়ে ছাড়লেন না।

দারোগা আসার সময় ধলাপাগলাকে নিয়ে এসেছিলো। দশাসই আবেদালির ওপর সুটকো ধলার সে কি রাগ! অবশ্য ওর মার খেয়ে আবেদালির যে কিছুই হয় নি সে কথা বলাই বাহুল্য।

রবিদের হানাবাড়িতে রাতুলরা যে মোহর পেয়েছিলো সেগুলো দারোগাকে ফেরত দিতে হয়েছে। দারোগা দেখেই বললো, ওগুলো নাকি ছমাস আগে সরকার বাড়ি থেকে চুরি গেছে।

দারোগার যেতে যেতে বিকেল হয়ে গেলো। এরই মধ্যে খবর এসেছে চৌধুরীদের বাড়ি থেকে রমজান বাদে ধরা পড়েছে চারজন। একজন নাকি পালিয়েছে।

সন্ধেবেলা ছাদে বসে চা খেতে খেতে রাতুল বললো, বেনুদা দেখলেন তো, আপনাদের রাজবাড়িটাকে এই ডাকাতরা কিভাবে হানাবাড়ি বানিয়ে রেখেছিলো?

বেনুদা কিছু বলার আগে গম্ভীর গলায় নবু বললো, রাজবাড়িতে ডাকাতদের ঘাঁটি আমিই দেখেছি। সেই সঙ্গে আরো কারো উপস্থিতি টের পেয়েছি। তোমাদের বলেছি সে কথা।

তুমি কি বলতে চাও তোমার কানে ফিসফিস করে যারা কথা বলেছে ওরা জ্বীন ছিলো? বেপরোয়া ভঙ্গিতে জানতে চাইলো রাতুল।

হতে পারে জ্বীন। অন্য কিছুও হতে পারে। তবে কিছু–একটা তো বটেই। পুরোনো গোরস্থান আর রাজবাড়িতে চোখে দেখা যায় না এমন কেউ নিশ্চয়ই থাকে। যারা থাকে তারা ভবিষ্যতে কি ঘটবে সেটাও দেখতে পায়। নইলে আমাকে কিভাবে বললো, নৌকায় করে দুনম্বর ঘাঁটিতে নেবে?

নবু, তুমি বলেছো, তখন তুমি তন্দ্রার ঘোরে ছিলে। এমনও তো হতে পারে তখন ওদেরই কেউ বলাবলি করছিলো এ নিয়ে তোমার কানে এসেছে।

তুমি তর্ক করার জন্য এসব বলছো রাতুল। আমি পুরোনো গোরস্থানে থাকতেও ওদের কথা শুনেছি। নৌকার ভেতর যখন আমাকে হাত বেঁধে ছইয়ের নিচে ফেলে রেখেছিলো তখনও শুনেছি। তাছাড়া যেরকম ঝড়ের ভেতর পড়েছিলাম–তোমরা তো বললে কিছুই টের পাও নি।

রবি বললো, আমরা তখন অন্য কিছু টের পেয়েছি। কথা আমিও শুনেছি। এখনো আমার কানে বাজছে–নবুর ভীষণ বিপদ, তোমরা ঘরে ফিরে যাও। রাতুল সেই কথা না শুনলেও গন্ধটা তো টের পেয়েছিলে?

দ্বিধাভরা গলায় রাতুল বললো, হ্যাঁ, বাজে একটা গন্ধ আমার নাকে লেগেছিলো। কিন্তু এ থেকে কি প্রমাণ হয়?

এমন সময় একঝলক ঠাণ্ডা ভেজা বাতাস হু হু করে বয়ে গেলো। গায়ে গরম কাপড় থাকা সত্ত্বেও সবার হাড় পর্যন্ত কেঁপে উঠলো। বেনুদা বললো, চলো, নিচে গিয়ে বসি। ঝড় আসবে মনে হচ্ছে।

আগের দিন থেকেই আকাশ মেঘলা ছিলো। সেদিন সন্ধের দিকে ঘন কালো মেঘে সারা আকাশ ছেয়ে গেছে। ওরা নিচে নামতেই শুরু হলো ঝড়ের মাতম। আকাশে ঘনঘন বিদ্যুতের ঝলকানি। প্রচণ্ড শব্দে কয়েকটা বাজ পড়লো কাছাকাছি কোথাও। জানালা-দরজা বন্ধ করে ঘরে বসলেও রাতুলরা ঠিকই টের পাচ্ছিলো। বাইরে ঝড়ের কি ভয়ঙ্কর তাণ্ডবলীলা চলছে।

বেনুদা বললো, রাতুল, তোমাকে আমি আগেও বলেছি আমি জোর করে কাউকে কিছু বিশ্বাস করতে বলি না। বিজ্ঞান আমিও পড়েছি। আমরা এ গাঁয়ে ছোটবেলা থেকে এমন অনেক কিছু দেখেছি যুক্তি দিয়ে যার ব্যাখ্যা করা যাবে না। সেই মেয়েটার কথাই ধরো না। বলা হয় যাকে জ্বীন নিয়ে গিয়েছিলো। ইমামরা বলেছিলো ওরা দেখেছে আকাশের ভেতর থেকে বিরাট তশতরির মতো নেমে এসেছিলো। আজকাল তো অনেকে ফ্লাইং সসার দেখছে। এমনও তো হতে পারে সেটা একটা ফ্লাইং সসার ছিলো। জ্বীনের কথা বাদ দাও, বিজ্ঞান তো এখন মহশূন্যের গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে মানুষ বা মানুষের চেয়ে উন্নত প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াচ্ছে। হতে পারে আমাদের এখানে তাদের কেউ রয়েছে। তারা চায় না আমরা তাদের বিরক্ত করি।

নবু বললো, কোরান শরীফে জ্বীনের কথা বলা হয়েছে আগুন দিয়ে বানানো। আগুন মানে যদি এনার্জি হয় তাহলে অনেক জিনিসই আর রহস্যজনক মনে হবে না।

কথাটা ওভাবে বলা ঠিক না নবু। বেনুদা বললো, জ্বীনরা এনার্জি হয়ে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে, আমরা পারি না। বস্তুকে শক্তিতে রূপান্তরের জন্য বিজ্ঞান এখন কাজ করছে। আমরা যদি শক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারি তাহলে অনেক কিছু জানা হয়ে যাবে।

রাতুল তবু বললো, জ্বীনভূতের অস্তিত্ব স্বীকার করাটা কি খুব জরুরী হয়ে পড়েছে?

মৃদু হেসে বেনুদা বললো, তোমাকে জোর করছে কে? তবে তোমার ভেতর যদি বৈজ্ঞানিক মন থাকে, যে মন জানতে চায়, আবিষ্কার করতে চায়–তাহলে কখনোই কোনো বিশেষ ধারণা আঁকড়ে বসে থেকো না। সবসময় জানার চেষ্টা করো। একশ বছর আগে মানুষের আকাশে ওড়া বা সমুদ্রের তলায় ঘোরা সায়েন্স ফিকশনের বিষয় ছিলো, এখন তা নয়। এখন ভিন্নগ্রহে উন্নত প্রাণীর অনুসন্ধান বা তাদের পৃথিবীতে আসা সায়েন্স ফিকশনের বিষয়, একশ বছর পরে সেটা ফিকশন নাও থাকতে পারে।

রাতুলদের জমজমাট আড্ডার ভেতর নাদুখালা এসে বললেন, ঝড় বাড়ছে। অবস্থা সুবিধের মনে হচ্ছে না। তোমরা খেয়ে শুয়ে পড়ো।

বেনুদাও সায় জানালোপৌষের শেষে আমাদের দেশে এরকম ঝড়ের কথা শুনেছো রাতুল? রাতুল মাথা নাড়লো।

বেনুদা বললো, আমাদের এখানে প্রায় প্রতি বছরই এসময়ে ঝড় হয়। শুধু আমাদের গাঁয়ে, আশেপাশের আকাশ শুধু মেঘলা থাকে, ঝড় হয় না।

খেয়ে উঠে ওরা তিনজন তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো। গত দুরাতের উত্তেজনায় ওরা ভালোমতো ঘুমোতে পারে নি। তাই লেপের তলায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ওদের ঘুম এসে গেলো।

মাঝরাতে হঠাৎ বিকট এক শব্দে ওদের ঘুম ভেঙে গেলো। অনেকটা কামান দাগার মতো শব্দ। সারা বাড়ি থর থর করে কেঁপে উঠেছে সেই শব্দে। ঘরের দরজা-জানালা সব বন্ধ। বাইরে তখনো ঝড়ের তাণ্ডবলীলা চলছে।

নবু বিছানার ওপর উঠে বসে বললো, কিসের শব্দ ওটা?

রাতুল বললো, বাজ পড়েছে বোধ হয়।

না, বাজের শব্দ এরকম হয় না। বলে নবু বিছানা থেকে নামলো।

রবি ভয়ে ভয়ে বললো, তোরা কি এখন কিসের শব্দ খুঁজতে বেরুবি?

রাতুল মৃদু হেসে মাথা নাড়লো–পাগল নাকি!

নবু দক্ষিণের জানালার খড়খড়ি তুলে বাইরে তাকালো। ওইটুকু ফাঁক দিয়ে ঝড়োবাতাস ঘরে ঢুকে সবকিছু এলোমেলো করে দিলো। হঠাৎ নবু চাপা গলায় ডাকলো–রাতুল, দেখে যাও।

রাতুল আর রবি ছুটে গেলো জানালার কাছে। নবু ওদের রাজবাড়ির দিকে দেখালোওদিকের আকাশটা দেখো, কি রকম! নিচেও দেখো।

রাতুল দেখলো চারদিকের আকাশ কালো হলেও দক্ষিণের এক কোণে আকাশ অস্বাভাবিক রকম লাল। জানালা থেকে ঘন গাছপালার জন্য রাজবাড়ি দেখা যায় না। তবে দূরে গাছের ওপর দিয়ে মনে হলো নিচে বোধ হয় কোনো জোরালো আলো জ্বলছে। কালো অন্ধকার ওখানটায় ফিকে হয়ে গেছে।

রাতুল বললো বেনুদাকে ডাকবো?

না থাক। নবু মাথা নাড়লো। জানাজানি হলে মা আর খালা ধরবে আজান দেয়ার জন্য, রাত জেগে দোয়া-দরুদ পড়ার জন্য–ওসব আমার ভালো লাগে না।

রাতুল বললো, কাল সকালে গিয়ে দেখতে হবে রাজবাড়িতে নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটেছে।

সকালে যখন ওদের ঘুম ভাঙলো, বাইরে তখন নতুন রুপোর টাকার মতো চকচকে সকাল। ঝলমলে রোদ উঠেছে, আকাশে মেঘের লেশমাত্র নেই। প্রচুর পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। কে বলবে কাল রাতে এতো বড়ো একটা ঝড় হয়ে গেছে।

নাশতা খেতে নেমে শুনলো মাঝরাতে বাজ পড়ার শব্দ সবাই শুনেছে। ওরা আর কাউকে আলো দেখার কথা বললো না।

পরদিন বাড়িতে জেয়াফত হবে। বেনুদা লঞ্চঘাটে গেছেন কাকাদের আনার জন্য। বাড়িতে মহা হৈচৈ। ওরা তিনজন কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়লো।

আমবাগানের ভেতর দিয়ে পুরোনো গোরস্থানে ঢুকে ওরা অবাক হয়ে গেলো। রাজবাড়ির আশেপাশে অনেকগুলো তালগাছ ছিলো। সবগুলো গাছের মাথা পুড়ে গেছে। কালো থামের মতো ন্যাড়া তালগাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে শুধু।

কাছে গিয়ে আরো অবাক হলো। কাঁটাঝোঁপের চিহ্নমাত্র নেই। পুড়ে সব ছাই হয়ে বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে গেছে। ওদের জন্য সবচেয়ে বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো আরো সামনে।

একদিন আগেও যেখানে পুরোনো রাজবাড়ির বিশাল ধ্বংসস্তূপ ছিলো, সেখানে এক টুকরো ইটের কণাও নেই। গোটা জায়গা জুড়ে বিরাট এক পুকুর। ঘোলাটে পানিতে ভরে আছে কানায় কানায়। চারপাশে অস্বাভাবিক নীরবতা।

ওরা তিনজন কোনো কথাই বলতে পারলো না–শুধু একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো। তারপর সম্মোহিতের মতো এগিয়ে গেলো পুকুরের দিকে।

নবু পুকুরের পাড়ে বসে পানিতে হাত ডুবিয়ে ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠে সরে এলো। হাতটা নাকের কাছে এনে শুকলো। বিচ্ছিরি একটা গন্ধ।

রাতুল কাছে এসে বললো, কি হয়েছে নবু?

নবু হতভম্ব হয়ে বললো, ভীষণ গরম পানি। আর এই গন্ধটা দেখ, কি বাজে!

রাতুল নবুর হাত শুঁকে রবির দিকে তাকালো–কি আশ্চর্য, সেদিন পুরোনো গোরস্থানে যে গন্ধটা পেয়েছিলাম, ঠিক সেই গন্ধ।

ওরা টেরও পেলো না–চারপাশ থেকে ঘন কুয়াশার দেয়াল কখন এসে ওদের ঘিরে ফেলেছে।