০৫-৬. দিদা আর পচার মার আবিষ্কার

০৫. দিদা আর পচার মার আবিষ্কার

দুলালদা যখন রামুকে ডাকলেন, তখন আমারও ঘুম ভেঙে গেলো। তাকিয়ে দেখি দুলালদা যাওয়ার জন্যে তৈরি, আর রামু খাটে বসে চোখ কচলাচ্ছে। আমাকে দেখে দুলালদা বললেন, তুমিও উঠে গেছো নাকি! অনেক দেরি হয়ে গেলো। আমি ভেবেছিলাম রাত থাকতে বেরিয়ে পড়ব।

দুলালদা জানালা খুলে দিয়েছেন। বাইরে তখন ভোর হয়ে গেছে। ঘন কুয়াশায় সবকিছু ঢাকা পড়েছে। আমি বললাম, এই কুয়াশায় কেউ রাস্তায় বেরোয় না দুলালদা। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন।

রামু বললো, বিজু ঘুমোক। আবু, তুই আমাদের সঙ্গে চল্। ফেরার পথে আমি একা আসবো নাকি!

আমি গরম মুজো পরতে পরতে বললাম, তুই না বললেও আমি যেতাম।

দুলালদা বললেন, আমার ব্যাগটা তাহলে এখানে থাক। রাতে যখন ফিরবো তখন সঙ্গে বয়ে কী লাভ।

তিনজন পা টিপে টিপে পেছনের ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলাম। নোংরা আবর্জনা মাড়িয়ে নাকে রুমাল-চাপা দিয়ে রাস্তায় এসে উঠলাম। কোথাও কোনো লোকজন নেই। শীতে আমাদের দাঁতে দাঁত লেগে ঠকঠক শব্দ হচ্ছিলো। রাতে দেখেছি দুলালদার গায়ের নীল জ্যাকেটটার নিচে শুধু একটা শার্ট রয়েছে। পোড়খাওয়া শরীর একেই বলে। আমরা জামা, সোয়েটার, চাদর গায়ে দিয়েও রীতিমতো কাঁপছিলাম।

সোনিয়াদের বাড়ির চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। বুঝলাম ওদের নেপালি চাকরটার ঘুম ভেঙেছে। সোনিয়াদের বাঙলোটা কোনো এক সাদা চামড়ার সায়েব বানিয়েছিলেন। ভদ্রলোকের দুটো চা-বাগান ছিলো। গরমের সময় এখানে থাকতেন। সোনিয়ার বাবা জয়ন্তিয়াপুরের এক বিশাল চা-বাগানের ম্যানেজার। সেজ কাকিমা সোনিয়াদের বাসায় মাঝেমাঝে বেড়াতে যান। সোনিয়ার মা হাসি খালার সঙ্গে তার ভারি ভাব। একদিন সেজ কাকিমাকে বলতে শুনেছি, সোনিয়ার বাবা নাকি মেম বিয়ে করেছেন, নতুন বৌ নিয়ে তিনি বাগানে থাকেন। মাঝে মাঝে এসে সোনিয়াদের দেখে যান। আমাদের এক রত্তি শহরে হাসি খালা সবসময় এই কারণটির জন্যেই নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। সেজ কাকিমারা পাড়ার মহিলাদের সঙ্গে এ-নিয়ে হাসাহাসিও করেন।

সোনিয়ার কথা দুলালদাকে কালই বলেছিলাম। ওদের বাড়িটা তাঁকে দেখিয়ে বললাম, এখানেই সোনিয়া থাকে ওর মায়ের সঙ্গে।

সোনিয়াদের বাড়ি পেরিয়ে আমরা কমলা বাগানে ঢুকলাম। রামু হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে দুলালদাকে বলল, জানেন দুলালদা, এই কমলা বাগানটা পুরোটাই আমাদের। কদিন পরে আপনাকে চমৎকার কমলা খাওয়াতে পারবো।

দুলালদা বললেন, ততদিন যদি থাকি নিশ্চয়ই খাবো।

গাছের কমলাগুলো এখনো সবুজ। কিছুদিন পর রঙ ধরবে। তখন সারা বাগান আলো হয়ে যাবে। গাছ থেকে কমলা পাড়াটা তো রীতিমতো উৎসবের ব্যাপার। অনেক দূরে থেকে কমলার পাইকাররা আসে। দাদু বাগান বিক্রি করেন না।

বাগানের এক কোণে পাহারাদাররা আগুন পোহাচ্ছিলো। বুড়ো বনমালী চেঁচিয়ে বললো, কে যায়?

রামুও চেঁচিয়ে জবাব দিলো আমরা।

দুলালদা মৃদু হেসে বললেন, এটা কি কোনো জবাব হলো! আমরা তো সবাই বলতে পারে।

রামু বলল, বনমালী, আমাদের চেনে।

আমি বললাম, এখন আহ্লাদ দেখাবার জন্যে ও ছুটে না এলেই বাঁচি।

বনমালী বলল, বেড়াতে বেরিয়েছো বুঝি। ভালো করেছে। ভোরবেলার বাতাস খুব তাজা থাকে।

আমরা গতকাল যে জায়গাটায় বসেছিলাম সেখানে এসে দুলালদা বললেন, তোমাদের আর আসতে হবে না। বনমালীর হাত থেকে বেঁচে গেছি। একা এলে কী যে বিপদ হত!

আমি হেসে বললাম, ওকে ধমক লাগালেই গুটিয়ে যেতো। তাছাড়া কখনো দেখা হলে আমাদের কথা বলবেন। ও আমাদের খুব ভালোবাসে।

দুলালদা আমাদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললেন, চলি তাহলে। রাতে দেখা হবে।

আমরা শুধু হাসলাম। দুলালদা লম্বা লম্বা পা ফেলে, কিছুক্ষণের মধ্যেই সামনের ঘন কুয়াশার সমুদ্রে ডুবে গেলেন। আমরা আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ির পথে পা বাড়ালাম।

সোনিয়ার বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তাকিয়ে দেখি সোনিয়া আর হাসি খালা জানালার ধারে বসে আছেন। হাসি খালা অন্যদিকে তাকিয়ে কী যেন করছিলেন।

সোনিয়া আমাদের দেখতে পেয়ে হেতে হাত নাড়লো। রামু অবাক হয়ে একবার সোনিয়ার দিকে, আরেকবার আমার দিকে তাকালো। খুশিতে আটখানা হয়ে আমিও হাত নাড়লাম।

রামু দারুণ উত্তেজিত হয়ে বললো, ও কি তো-তোকে হাত দেখালো?

আমি মুখ টিপে হেসে নিস্পৃহ গলায় বললাম, নয়তো কি তোকে?

রামু বললো, আমি কি তাই বলেছি! তুই লুকিয়ে ওর সঙ্গে ভাব জমিয়েছিস একথা তো আমাকে বলিস নি?

আমি বললাম, তুই ওদের বাসায় গিয়েছিলি সে-কথাও তো আমাকে বলিস নি।

রামু গোমড়া মুখে বললো, বারে আমাকে তো মেজ কাকিমা পাঠিয়েছিল হাসি খালার কাছে। আমি ওর সঙ্গে কথা বলেছি নাকি!

আমি হেসে ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম, তুই অত মুখ কালো করছিস কেন? তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবো।

রামু মনে মনে খুশি হলেও মুখে বললো, থাক আমার জন্যে কাউকে বলতে হবে না। আমি নিজেই আলাপ করতে পারি।

আমি বললাম, বেশ তাই করিস।

রামু তক্ষুণি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, সত্যি বলছিস, আমার সঙ্গে ওর আলাপ করিয়ে দিবি?

আমি হেসে বললাম, তাহলে আর বলছি কী! এখন ছাড় আমাকে। সুড়সুড়ি লাগছে।

রামু আর কোনো কথা বললো না। ও বোধহয় এখন থেকেই ভাবতে শুরু করেছে, সোনিয়াকে কী বলবে। অচেনা মেয়ের সঙ্গে কথা বলার সময় রামুর কান-টান লাল হয়ে এমন এক অবস্থা হয় যে, সে দেখার মতো।

পাঁচিলের পাশ দিয়ে আমরা যখন খিড়কি দরজার দিকে যাচ্ছি তখন ঝপাৎ করে আমাদের গায়ে কী যেন পড়লো। চমকে উঠে তাকিয়ে দেখি একগাদা শুকনো পাতা, ছেঁড়া কাগজ আর তরকারির খোসা। বুঝলাম পচার মার কান্ড । দুজন একসঙ্গে পাঁচিলের ওপাশে পচার মাকে ধমক দিতে গিয়ে সামলে নিলাম। ময়লা ঝেড়ে দৌড়ে উপরে উঠে হেসে বিছানায় গড়িয়ে পড়লাম।

আমাদের ওরকম হাসতে দেখে বিজু আবক হয়ে বললো, কী হলো তোদের? এরকম হাসছিস কেন?

হাসতে হাসতে রামু পচার মার শুকনো রসিকতার কথা বিজুকে বললো। আমি বললাম, কীরকম চোরের মতো অবস্থা আমাদের দেখ। একফোঁটা চ্যাচানোর জো নেই। পাতার বদলে ও তো এক গামলা ঠাণ্ডা পানিও ঢেলে দিতে পারতো!

আমরা যখন পচার মাকে নিয়ে হাসাহাসি করছি, ও তখন নিচে এক তুলকালাম কাণ্ড শুরু করে দিয়েছে। মুখ ধোয়ার জন্যে আমরা নিচে এসে শুনি কাল রাতে নাকি বাড়িতে চোর এসেছিলো। ভোর রাতে ও পাচিলের পাশে চোরের শব্দ শুনেছে। রাত থাকতে ও নাকি উঠোন ঝাড় দিয়েছে। ময়লা ফেলতে গিয়ে মনে হলো কারা যেন ধুপধাপ করে পালিয়ে যাচ্ছে। ও বাইরে এসে দেখে খিড়কি দরজা হা করে খোলা। পচার মার বানানো গল্প শুনে আমাদের মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেলো। ও যে এভাবে আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে আমরা ভাবতেই পারি নি। এতদিন যে পচাকে এতকিছু খাইয়েছি সবই বিফলে গেলো!

পচার মা হাত-পা নেড়ে গল্প করছিলো। জেঠিমা, মা, সেজ কাকিমা, ছোট কাকিমা সবশেষে দিদা প্রত্যেককে আলাদাভাবে গল্প শোনালো। প্রত্যেকবারই গল্পের সঙ্গে নতুন কিছু যোগ করলো। দিদাকে বলার সময় বললো, চোর নয় মা, ডাকাত। যে রকম ধুপধাপ পায়ের শব্দ শুনলাম মনে হল দল বেঁধে এসেছে। চোর কি কখনো দল বেঁধে আসে? আমি বেরুতে না বেরুতে আমার চোখের সামনে দিয়ে সব কটা কর্পূরের মতো উবে গেলো। মা তো জানেনই, রাতে আমি চোখে ভালো ঠাহর করতে পারি না। নইলে ঠিকই পিছু নিতাম।

যে পচার মা আরশোলা দেখলে হুলস্থুল কাণ্ড ঘটায় সে ডাকাতের পিছু নেবে, এরকম একটা হাসির কথা শুনেও জেঠিমা, মা, কাকিমার কেউ হাসলেন না। হাসবেন কি, তাঁরা যে পচার মার সব কথা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করে বসে আছেন! ওঁদের সবার গুরুগম্ভীর মুখ দেখে আমরাও হাসতে পারছিলাম না। বুকের ভেতর ঢিবঢিব করা সত্ত্বেও হাসিতে আমাদের পেট ফুলে ঢাক হয়ে গিয়েছিলো।

দিদা বললেন, তুই রাতকানা বলেই তো তোকে সন্দেহ হচ্ছে পচার মা। রাতের বেলা কুকুর না ভাম দেখেছিস, তাই নিয়ে গোটা বাড়ি মাথার তুলেছিস। যা বাছা, চুলোয় আগুন ধরাগে।

পচার মার ওঠার নাম নেই। হাত নেড়ে বললো, সে কি মা, রাত কোথায়! তখন যে ফরসা হয়ে গেছে। আমি নিজ কানে পায়ের শব্দ শুনেছি। কুকুর কি খিড়কি দরজা খুলতে পারে?

দিদা বিরক্ত হয়ে বললেন, মুরুব্বিদের সামনে হাত নেড়ে কথা বলতে তোকে বারণ করি নি? খিড়কি দরজা বন্ধ ছিলো এ-কথাই বা তোকে কে বললো? কবে কে ছিটকিনি লাগাতে ভুলে গেছে, এদ্দিন চোখে পড়ে নি। এই কথা বলে দিদা আড়চোখে আমাদের দিকে তাকালেন।

আমি ঢোক গিলে রামুর দিকে তাকালাম। ও দেখি একবারে সাদা হয়ে গেছে।

দিদা মুখ টিপে হেসে বললেন, তোকেও বলি পচার মা, বানিয়ে গপ্পো বলার সময় তোর কোনো হুশ থাকে না। আমাকে একবার বললি তখন ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, আবার এখন বলছিস ফরসা হয়ে গেছে। এত উল্টো-পাল্টা বলে কি গপ্পো বানানো যায়। নে ওঠ, অনেক হয়েছে।

বাড়িতে ডাকাত পড়ার দারুণ উত্তেজনাময় গরম গল্পটির ওপর দিদা যেভাবে ঠান্ডা পানি ঢেলে দিলেন, পচার মা তাতে চুপসে গিয়ে ভেজা বেড়ালটির মতো রান্নাঘরে ঢুকলো। ওর এরকম চুপসে যাওয়াটা জেঠিমারা পছন্দ করেন নি। রামুর ওপর চোখ পড়তে আমাদেরকে নিয়ে পড়লেন–তোরা ছাড়া আর কে খিড়কি দরজা খুলতে যাবে হতচ্ছাড়ার দল। চোর আসে নি, আসতে কতক্ষণ, এরকম দরজা খোলা দেখলে চুরি করার জন্যে সবার হাতই চুলবুল করবে।

দিদা বললেন, মুখ না ধুয়ে তোরা বুঝি মুরুব্বিদের কথা গিলছিস? শিগগির পালা সামনে থেকে।

বুঝলাম দিদা এবারও আমাদের জেঠিমার বকুনির হাত থেকে বাঁচিয়ে দিলেন। দিদার জন্যে ঠিক এজন্যই আমাদের মন সারাক্ষণ কৃতজ্ঞতায় ভরে থাকে। গরম পানির জন্যে অপেক্ষা না করে ঠাণ্ডা পানিতে মুখ ধুয়ে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে আমরা উপরে চলে গেলাম। পচার মা এমন এক অভাবনীয় আবিষ্কারের উত্তেজনায় আমাদের মুখ ধোয়ার পানি গরম করতেও ভুলে গিয়েছিলো। ঘরে ঢুকে তিনজন আবার দম ফাটানো হাসিতে বিছানায় গড়িয়ে পড়লাম।

সকালে আমরা যখন নাস্তা খাওয়ার জন্যে নিচে নামলাম তখন দেখি পচার মা সেজ কাকিমাকে রান্নাঘরে একা পেয়ে তাকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কাকিমাও পরম নিশ্চিন্তে খোলাজাই পিঠে বানাতে বানাতে পচার মার আজগুবি গল্প গোগ্রাসে গিলছিলেন। খেতে বসে আমি বললাম, দিদা তো পচার মার কথা হেসেই উড়িয়ে দিলো। ডাকাত না আসুক চোর আসাটা তো অসম্ভব কিছু নয়। কিছু নেয় নি বলেই যে ধরে নিতে হবে চোর আসে নি এটা তো হতে পারে না। চোর সাধারণত শেষ রাতেই আসে। পচার মা টের পেয়েছিলো বলেই চুরির করতে পারে নি।

আমার কথা শুনে রামু মুখ টিপে হাসলো। বিজু হাসি চাপতে গিয়ে খুক করে কাশলো। পচার মা আহ্লাদে আটখানা হয়ে পান-খাওয়া কালো দাঁত সব কটা বের করে বললো, তবেই দেখ। সাধেই কি তোমরা পরীক্ষায় ফাস সেকেন হও! তোমাদের মাথা কী পরিষ্কার! অথচ মা বলেন কিনা সব আমার বানানো গপ্পো। অ সেজদিদিমণি, ছেলেরা শুধু চিনি দিয়ে পিঠে খাচ্ছে যে, ওদের একটু নারকোল কুরে দেব?

সেজ কাকিমা হাসি চেপে বললেন, দাও! তখন যে বললে নারকোল কোরাতে পারবে না, তোমার কুনুই ব্যথা করছে?

পচার মা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো, আহা তাই বলে বাড়িসুদ্ধ সবার জন্যে নারকোল কোরাতে বসলে তো কুনুইয়ে ব্যথা করবেই। তুমি হুকুম করো তো ব্যথা নিয়েই কুরে দেই।

সেজ কাকিমা বললেন, বাবা আর বড়দার খাওয়া হয়ে গেছে। এখন আর সবাইকে দিয়ে কাজ নেই। তুমি বরং এদেরই দাও।

দিদা এসে আমাদের নারকেল খেতে দেখে একগাল হেসে বললেন, তোদের নারকোল দিল কে রে? আমিই তো বলতে এসেছিলাম।

পচার মা সঙ্গে সঙ্গে বললো, আপনিই তো বলেন, মা, উঠতি বয়সের ছেলেদের একটু ভালো খেতে দিতে হয়। তাই আমি সেজদিদিমণিকে বলতেই তিনি কুরে দিতে বললেন।

দিদা হেসে বললেন, ভালো করেছিস। যা তোকে মিথ্যে গপ্পো বলার জন্যে মাপ করে দিলাম। বৌমা, তোমার শ্বশুরকে আদা দিয়ে চা দিও। ওঁর ঠাণ্ডা লেগেছে।

খেয়ে উঠে বিছানায় গড়ানো ছাড়া আমাদের কোনো কাজ ছিলো না। দুলালদাকে কীভাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এ-সম্পর্কে বিজু রামুর কাছ থেকে সব জেনে নিলো। আমি বললাম, দুলালদা এতক্ষণে খাসিয়াদের গ্রামে পৌঁছে গেছেন।

রামু হঠাৎ জিভ কামড়ে বললো, কী রকম এক ভুল করে বসেছি দেখেছিস?

আমি অবাক হয়ে বললাম, কী ভুল?

দুলালদা সকালে নাস্তা করবে কী দিয়ে? তাঁকে কিছু খাবার সঙ্গে দেয়া উচিত ছিলো। জয়ন্তিয়া পাহাড়ে নিশ্চয়ই ওঁর জন্যে কেউ রেস্টুরেন্ট খোলে নি।

আমি হেসে বললাম, তাতে কী? জয়ন্তিয়া পাহাড়ে তো খাসিয়ারা আছে। দারুভূই বলেছে ওঁদের গ্রামে কোনো অতিথি গেলে নাকি ওরা খুব যত্ন করে। দুলালদার কোনো অসুবিধা হবে না।

এমন সময়–কার অসুবিধা হবে না বললি? বলে দিদা ঘরে ঢুকলেন। ঘরের ভিতরে যেন বাজ পড়লো। আমরা তিনজন দারুণ রকম চমকে উঠে ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম। দিদা নিঘাত আমাদের সব কথা শুনে ফেলেছেন।

আমাদের বিছানায় এককোণে বসে পান চিবোতে চিবোতে দিদা মুচকি হেসে বললেন, হ্যাঁরে আবু, রামু! সাতসকালে তোরা খিড়কি দরজা দিয়ে কাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলি?

রামু একবার আমার দিকে তাকালো। আমি রামুর দিকে তাকালাম। দিদা বললেন, তোরা আমার কাছে কিছু লুকোবি না। দুপুরে হাঁড়ি-কাবাব খেতে চাইলে এক্ষুণি সব বলে ফেল্। আমি দোতলার জানালা দিয়ে সব দেখেছি।

দিদা এমনভাবে কথাগুলো বললেন যে তাঁর কাছ কিছু লুকোতে মোটেই ইচ্ছে হলো না। গত সন্ধ্যের পর থেকে যা যা ঘটেছে সব তাঁকে খুলে বললাম। দুলালদার মা মারা যাওয়ার কথা শুনে দিদার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। বললেন, অত ফেনিয়ে বলছিস কেন? তাড়াতাড়ি শেষ কর। তারপর আমি একটু কাঁদব। তোরা আমাকে কুটুর কথা মনে করিয়ে দিলি। হারামজাদাকে আমি কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি।

কুটু মানে আমাদের বড়দা। তার জন্যে যে দিদা সবচেয়ে বেশি ভাবেন এটা বাড়ির কারো অজানা নয়। তবে দিদার মতো দারুণ রাগী একজন, যাঁকে বাড়ির সবাই সমীহ করে, তিনি একজন অচেনা ছেলের জন্যে কাঁদছেন–আমরা ছাড়া তাঁর এই ফুলের মতো নরম মনটির কথা কেউ জানবে না।

দিদা সব শুনে বললেন, ভালো করেছিস। আমি জানি এ বাড়িতে শুধু তোরাই আমার মতো হয়েছিস। আর সব কটা হচ্ছে চামার, পয়সা ছাড়া কিছুই চেনে না। তবে যাই বলিস বাছা, তোরা আগুন নিয়ে খেলছিস। একটু অসাবধান হলে সবাইকে মারবি। ওই ছোঁড়া যদি আজ রাতে আসে আমাকে খবর দিস। ওর চেহারা দেখেই আমার কুটুর কথা মনে হয়েছে। যেজন্যে পচার মাকে হাঙ্গামা করতে দেই নি। তোদের দাদুর কানে গেলে তিনি থানা-পুলিশ করে একাকার করতেন।

দিদা উঠে যাওয়ার সময় মুচকি হেসে বলে গেলেন, তবে তোদের জন্যেও আমার কপালে দুঃখ আছে, এ কথা তোরা লিখে রাখতে পারিস।

আমাদের মস্ত বড় পরিবারে যেখানে দাদু, জেঠু, কাকা সবার সঙ্গে আমরা একত্রে থাকি সেখানে কেউ কারো দিকে সেরকম মনোযোগ দিতে পারে না। একমাত্র দিদাই সবার ভালোমন্দের খোঁজ নেন। সবাইকে ধমক দেন। আবার সবার জন্যে ভাবেনও। দিদা শুধু এবাড়ির লোকদের জন্যেই ভাবেন না। জাফলং-এর সবার সঙ্গেই দিদা ভাব জমিয়ে ফেলেছেন। কারো কোনো অসুবিধা হলে দিদার পরামর্শ নিতেই হবে। শুধু হাসি খালার সঙ্গে কেন জানি না দিদা এখনো আলাপ করেন নি। দিদা যদি ওঁকে এড়িয়ে না চলতেন তাহলে সোনিয়ার সঙ্গে অনেক আগেই ভাব জমাতে পারতাম। আমরা জানি এ নিয়ে দিদাকে কোনো প্রশ্ন করলে তিনি বিরক্ত হবেন। তার পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারে কারো নাক গলানো তিনি মোটেই ভালোবাসেন না।

বাবা, সেজকা আর মেজদা তাদের কাজের জন্যে বাইরে থাকেন। বাবা কাজ করেন ছাতকের সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে, সেজকা সুনামগঞ্জের এক কলেজে পড়ান। আর মেজদা ঢাকায় বসে ছবি বানান। সিনেমা হলে মেজদার ছবি এলে আমরা সিলেটে গিয়ে দেখি। আমাদের জেঠিমা, মা আর কাকিমারা সারাদিন সংসারের কাজে এত ব্যস্ত থাকেন যে তাদের সঙ্গে বহুদিন কথাও হয় না। দিদা না থাকলে নয়নতারা কুটিরটা আমাদের কাছে মরুভূমি হতে যেতো।

.

০৬. সোনিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব

বিকেল পর্যন্ত আমরা চিলেকোঠার ঘরে দুলালদাকে নিয়ে গল্প করে কাটিয়ে দিলাম। মাঝখানে শুধু হাঁড়ি-কাবাব খাবার জন্য একবার নিচে নেমেছিলাম। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম দুলালদা একদিনে আমাদের বয়স আর অভিজ্ঞতা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন। মনে হলো আমরা আর ছোট্টটি নেই, যাদের যখন তখন কান টানা যায়, চোখ পাকিয়ে ধমক দেওয়া যায় কিংবা চুলের ঝুঁটি ধরা যায়। বিজু পর্যন্ত এমন সব কথা বলেছিলো যা আগে কখনো ওর মুখে শুনি নি। তেরো-চৌদ্দ বছর বয়সে হঠাৎ কেন সবাই বড় হয়ে যায় কথাটা এদ্দিনে আমার বোধগম্য হলো। যে কথা রামু বিজুকে আগে কখনো বলি নি, অকপটে সব বলে ফেললাম। রামু এমন অনেক কথা বললো, যা শুনে কখনো রোমাঞ্চিত হলাম কখনো বা বিস্মিত হলাম।

বিকালে কমলালেবুর বাগানে বসে আমরা অনর্গল কথা বলছিলাম। এত কথা আমাদের বুকের ভিতর জমেছিলো যে ভেবে রীতিমতো অবাক হলাম। সব কথা বলার পর নিজেদের খুব পবিত্র মনে হলো। আমি চিৎ হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়েছিলাম। আমরা চাদর না এনে শুধু সুয়েটার পরেছি। দুলালদা একটা জ্যাকেট পরে যদি শীত কাটাতে পারেন, আমরা কেন এতগুলো পরব ভেবে পেলাম না। দুলালদা আমাদের সাহস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন।

বিজু বললো, কাল এতক্ষণে এখানে বসে হারিয়ে যাওয়ার জন্যে কী দুঃখটাই না করছিলাম!

রামু বললো, ওসব কথা ভাবতেও আমার হাসি পাচ্ছে। দুলালদার সঙ্গে কী কাজ করা যায় আবু কিছু ভেবেছিস?

আমি বললাম, ভাববার কী আছে। দুলালদা আমাদের যা বলবেন তাই করবো।

বিজু একটু পরে বললো, আমার মনে হচ্ছে আমি দারুণ একটা কিছু করে ফেলতে পারবো।

রামু বললো, ওরকম ইচ্ছে সবারই হয়। এ আর নতুন কী!

রামুর কথা শুনে আমি একটুও অবাক হলাম না। অথচ কাল যদি ওর মুখে এ ধরনের কথা শুনতাম তাহলে আমি নির্ঘাত হেসে খুন হতাম।

কিছুক্ষণ পর বিজু বললো, রামু তুই বড় হলে কী হবি?

রামু শান্ত গলায় বললো, বড়দা আর দুলালদার মতো হবো।

বিজু আস্তেআস্তে বললো, আমিও তাই ভাবছিলাম।

আমি ওদের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম। বললাম, অত ভাববার কিছুই নেই। আমরা তিনজনই বিপ্লবী হবো।

এমন সময় এই যে ত্রিরত্ন –বলে সোনিয়া এসে আমাদের সামনে দাঁড়ালো। ঠিক যা ভেবেছিলাম তাই।

আমি হেসে বললাম, কী ভেবেছিলি?

তোদের তিনজনকেই এখানে পাবো। আমার ধারণা অবশ্য ভুলও হতে পারত।

আমি হেসে বললাম, তুই তাহলে বসে পড়।

রামু আর বিজু অবাক হয়ে একবার সোনিয়া আরেকবার আমাকে দেখছিলো। বিজু আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলো, তুই কি ওকে তুই বলিস নাকি!

সোনিয়া হেসে গুড়ো হয়ে গেলো। বললো, তবে কি আপনি বলবো! বিজুকে অবশ্য দেখতে যেরকম বাচ্চা মনে হয় তাতে ও যদি আমাকে আপনি বলে আমি কিছু মনে করবো না। অবশ্য এখানে ইশকুলে ভর্তি হলে আমাকে ওর এক ক্লাশে ওপরে পড়তে হত।

সোনিয়ার কথাগুলো পাহাড়ি ঝর্নার মতো সুন্দর আর মিষ্টি। আমি সারাজীবন কান পেতে ওর কথা শুনতে রাজি আছি। সোনিয়া আমার পাশে ঘাসের ওপর বসে পড়লো–মা বলেছে আজ বিকেলে তোমাদের তিনজনকে আমাদের বাড়িতে চা খেতে। অবশ্য এর মধ্যে যদি চা খাওয়া না হয়ে থাকে।

আমি আগেও লক্ষ্য করেছি সোনিয়া বলার মাঝখানে একটা অবশ্য জুড়ে দেবে। যে জন্যে ওর বাক্যগুলো একটু লম্বা হয়ে যায়। ঝর্নার মিষ্টি শব্দ শোনার জন্য আমি তো চাই ও কথা বলার সময় আরো লম্বা বাক্য ব্যবহার করুক। সোনিয়াকে বললাম, নেমন্তন্ন করতে এলি যখন একটু বসে যা। এখানে আর তোকে কী খেতে দেব বল! কমলা পাকলে না হয় কটা পেড়ে দিতাম।

সোনিয়া বললো, সত্যি বলছি! আমি কতদিন ভেবেছি কমলায় রঙ ধরলে তোদের বাগানে আসবো। অবশ্য তোদের যদি আপত্তি না থাকে।

রামু বললো, আপত্তি থাকবে কেন। তুই যদি রোজ এখানে বেড়াতে আসিস, তাহলে আমরা আরো খুশি হবো।

সোনিয়া হেসে বললো, যাক, শেষ পর্যন্ত আমার সঙ্গে রামু কথা বললো। তো উঁট দেখে তো ভেবেছিলাম আমার সঙ্গে বুঝি কথাই বলবি না। অবশ্য ফার্স্ট হলে সবাই একটু উঁট দেখায়।

মোটেই না। রামু তড়বড় করে বললো, তুই আবুকে জিজ্ঞেস কর। আমি কক্ষনো উঁট দেখাই না।

আমি বললাম, ও ঠিকই বলেছে সোনিয়া। রামু ধরেই নিয়েছে ও বরাবর ফার্স্ট হবে, যেহেতু আমি সেকেন্ড হবো। সেজন্যে ফার্স্ট হওয়াটাকে খুবই মামুলি কিছু মনে করে।

সোনিয়া বললো, ওটা তো আরো বেশি অহংকারের কথা হলো। ইশকুলে অবশ্য আমিও ফার্স্ট হতাম। তবে রামুর মতো সবসময় ফাস্ট প্লেসটাকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকতাম না। মাঝে মাঝে সেকেন্ডও হতাম।

রামু বললো, তোদের ওখানে নিশ্চয়ই কম্পিটিশন ছিলো। আমি কী কবর বল্। আবু যে কখনো ফার্স্ট হতে চাইবে না।

আমি রামুকে বললাম, স্বীকার করছিস তাহলে আমারই জন্যে তুই ফার্স্ট হচ্ছিস। যাক, তুই ফাস্ট হলেই আমি খুশি। আমি চাই না খালেদ কিংবা পরেশ তোর জায়গাটা দখল করুক।

সোনিয়া হেসে বললো, তোরা তিনজন আছিস বেশ। দেখলেও হিংসে হয়। আগে আমরা যেখানে থাকতাম সেখানে অবশ্য আমার অনেক বন্ধু ছিলো।

আমি বললাম, এখানে আমরাই তোর বন্ধু! অন্য কারো সঙ্গে তোর বন্ধুত্ব হলে এক হাত দেখে নেবো।

সোনিয়া চোখ কপালে তুলে বললো, ইংরেজি ছবির মতো ডুয়েল লড়বি নাকি! তাহলে অবশ্য তোদের একটা পুরোনো দিনের পিস্তল থাকতে হবে।

আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, দরকার হলে পুরোনো দিনের একটা পিস্তল খুঁজে বের করা কঠিন হবে না।

সোনিয়া পাহাড়ি ঝর্নার মতো হাসলো। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, চল দেরি হয়ে যাচ্ছে। মা চা নিয়ে বসে আছেন। মা অবশ্য তোদের সঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলাপ করবেন। না না, আমার কাছে জানতে চাসনে। মার কাছ থেকেই শুনিস।

আমরা তিনজনই একটু অবাক হলাম। আমাদের সঙ্গে হাসি খালার কী গুরুত্বপূর্ণ কথা থাকতে পারে ভেবে পেলাম না। কথাটার গুরুত্ব কমে যাবে বলে সোনিয়াকেও এ-প্রসঙ্গে আর কোনো প্রশ্ন করলাম না। সোনিয়াদের বাড়ি যাওয়ার পথে কেউ কোনো কথা না বলে সবাই চুপচাপ হাঁটলাম।

হাসি খালা বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন। গেট দিয়ে আমাদের ঢুকতে দেখে নেমে এলেন। ঘাসের কার্পেটে ঢাকা সবুজ লনে সাদা রং-করা বেতের চেয়ার টেবিল পাতা ছিলো। হাসি খালা বললেন, তোমাদের এত দেরি হলো যে? চলো লনে বসি।

রামু একবার সোনিয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, আমরা বাগানে বসে গল্প করছিলাম।

হাসি খালাকে আমাদের মা, কাকিমা, জেঠিমা কারো সঙ্গে মেলানো যাবে না। তাকে বাড়ির কোনো কাজ করতে হয় না। সবসময় সাদা সুতোর কাজ করা ধবধবে সাদা শাড়ি পরে থাকেন। চোখে তারের মতো সরু কালো ফ্রেমের চশমা। কাঁচ দুটো বেশ ভারি। মেজ জেঠিমার চেয়েও তাঁর বয়স বেশি হবে। তার চেহারায় সারাক্ষণ একটা কোমল দুঃখের ছায়া ভেসে বেড়ায়। চুলে রুপোলি রঙের ছোঁয়া লাগলেও হাসি খালাকে এখনো অপরূপ সুন্দরী মনে হয়। সোনিয়া ওঁর মতো অতটা ফর্সা নয়। স্বভাব পেয়েছে মার একেবারে উল্টোটি। সোনিয়া যেমন বেশি কথা বলে, হাসি খালা কথাই বলেন না।

হাসি খালা ড্রাগনের নকশাকাটা চায়ের পেয়ালার সবুজ চা ঢাললেন। মিষ্টি গন্ধে যেন সারা লন ভরে গেল। রামু চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললো, এত সুন্দর চা আমি জীবনেও খাই নি।

হাসি খালা মৃদু হেসে বললেন, আমাদের বাগানের চা।

সোনিয়া বললো, তোদের আমি কিছু সবুজ চায়ের পাতা উপহার দিতে পারি। অবশ্য নিতে যদি তোদের আপত্তি না থাকে।

আমি বললাম, কমলার বদলে নাকি!

সোনিয়া লজ্জা পেয়ে বললো, বারে তা কেন—

লজ্জা পেলে কাউকে যে সুন্দর দেখায়–এতদিন কথাটা শুধু বাংলা উপন্যাসেই পড়েছি। সোনিয়া এত লজ্জা পেলো যে, কথা বলা শেষ করতে পারলো না।

নরম ঘাসের সবুজ কার্পেটে তখন কমলা রঙের হালকা রোদ এখানে-সেখানে ছড়িয়েছিলো। সরল ইউক্যালিপ্টাস গাছের ধূসর ছায়া সবুজের ভেতর নকশার মতো শুয়ে আছে। শীতের শেষ বিকেলের রোদের চেয়ে মিষ্টি আর কিছু হয় না। সারা শরীর দিয়ে রোদের কোমল তাপ শুষে নিতে ইচ্ছে করে। সোনিয়ার মতো মেয়ে যদি পাশে থাকে তাহলে তো ইচ্ছে হয় মনের সুখে মরেই যাই!

হাসি খালা সোয়েটার বুনছিলেন। তাঁর কোলের ওপর জলপাই রঙের উলের বল আর একটুখানি বোনা সোয়েটার আলতোভাবে পড়েছিলো। হাসি খালা উল বুনতে বুনতে উদাস হয়ে যাচ্ছিলেন। উলের কাঁটা ধরা তার হাতের সুন্দর আঙুলগুলো নাচের মুদ্রায় কখনো থেমে যাচ্ছিলো। হাসি খালা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আজ সকালে তুমি আর রামু এদিক দিয়ে কাকে নিয়ে যাচ্ছিলে?

আমি চমকে উঠলাম। হাসি খালা কী করে টের পেলেন? আমার চোখে প্রশ্ন দেখে হাসি খালা মৃদু হেসে বললেন, সকালে তোমাদের আমি যেতে দেখেছি। তোমরা হয়তো ঘরের ভেতর আমাকে দেখতে পাও নি।

রামু বললো, ওঁর কথা কাউকে বলতে তিনি বারণ করে গেছেন।

রামুর কথা শুনে হাসি খালা দুঃখ পেলেন। চশমার ভারি কাঁচের ভেতর তাঁর চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। আস্তে আস্তে বললেন, ওকে দেখে আমার ছেলে অয়নের কথা মনে পড়ে গিয়েছিলো। একটু থেমে হাসি খালা আবার বললেন, অয়নের শেষ চিঠি পেয়েছি তিনমাস আগে।

আমি বললাম, হাসি খালা, আপনাকে কথা দিতে হবে দুলালদার কথা আপনি কাউকে বলবেন না।

হাসি খালা মৃদু হেসে বললেন, আমাকে কি সেরকম ছেলেমানুষ মনে হয়!

ঠিক তা নয় হাসি খালা। কথাটা আমরা মা, কাকিমা, জেঠিমা কাউকেই বলি নি।

আমি বললাম, দুলালদার সঙ্গে গতকাল ঠিক এরকম সময়ে আমাদের দেখা হয়েছিলো।

আমার কেন যেন মনে হয়েছিলো, দুলালদার কথা শুনতে পেলে হাসি খালা কিছুটা হালকা বোধ করবেন। রাজনীতির তত্ত্বকথায় বেশি না গিয়ে দুলালদার সব কথা তাঁকে খুলে বললাম।

হাসি খালাকে কাঁদতে দেখে আমি একটুও অবাক হই নি। দুলালদার মতো হাসি খালার একটি ছেলে আছে, যে অনেক দূরে থাকে। দুলালদা মাকে ভালোবাসতেন বলেই দেশের জন্যে সব কিছু ত্যাগ করতে পেরেছেন। সব শোনার পর হাসি খালা না কাঁদলেই বরং আমি কিছুটা অবাক হতাম। দুলালদার বাবা তার মাকে কষ্ট দিয়েছেন। আমি জানি সোনিয়ার বাবার জন্যে হাসি খালার দুঃখ এতটুকু কম নয়।

আমরা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। হাসি খালা চশমা খুলে হাল্কা সাদা রুমাল দিয়ে চোখ মুছলেন। সোনিয়াও খুব গম্ভীর হয়ে বসেছিলো। হাসি খালা আবার উল বোনা শুরু করলেন। অনেকক্ষণ পরে বললেন, দুলাল যদি কিছু মনে না করে তাহলে ওকে আমার এখানে থাকতে বলতে পারো।

আমি বললাম, ঠিক আছে হাসি খালা, দুলালদা এলে বলবো খন।

হাসি খালা যে দুলালদার কথা কাউকে বলবেন না এ বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম। একবার মনে হল দুলালদার কথা সোনিয়ার সামনে বলা উচিত হয় নি। ও ছেলেমানুষ, কখন কার সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে বলে ফেলবে, তখন আমাদের বারোটা বাজবে। হাসি খালাকে বললাম, সোনিয়া আবার এসব কথা কাউকে বলে দেবে না তো!

কথাটা শুনে সোনিয়া আমার দিকে এমনভাবে তাকালো দেখে মনে হল এক্ষুণি বুঝি ও কেঁদে ফেলবে। হাসি খালা মৃদু হেসে সোনিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, সোনিয়া আমার মেয়ে।

সোনিয়াদের সবুজ লনে ধীরে ধীরে অন্ধকার নামলো। পশ্চিমের আকাশে তখন গোলাপি, কমলা আর বেগুনি রঙের মেঘ বিশাল প্রজাপতি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাখিদের এলোমেলো ডাক শুনে মনে হলো কোথায় যেন জলতরঙ্গ বাজছে।

হাসি খালা বললেন, তোমরা আমাদের বাসায় আসো না কেন? মাঝে মাঝে শুধু বিজুর মা আসেন বেড়াতে।

রামু বললো, এবার আর আসতে ভুল হবে না। রোজ বিকেলে আপনার কাছে এসে সবুজ চা খেয়ে যাবো।

মৃদু হেসে হাসি খালা বললেন, তোমরা এলে আমার ভালো লাগবে। সোনিয়া বেচারী সারাদিন একা সময় কাটায়।

আমি মনে মনে বললাম, আপনি কিছু মনে না করলে সোনিয়ার সঙ্গে সারাদিন কাটাতে আমার একটুও আপত্তি হবে না।

বিজু বলল, বাসায় যাবি না? সন্ধ্যে হয়ে গেছে।

আমি হাসি খালাকে বললাম, আজ তাহলে উঠি। কাল আবার আসবো।

হাসি খালা বললেন, এসো।

সোনিয়া আমাদের সঙ্গে গেট পর্যন্ত এলো। রামু আর বিজু একটু সামনে হাঁটছিলো। সোনিয়া আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো, তুই কেন মাকে এরকম কথা বললি? আমাকে কি তুই বিশ্বাস করিস না? আমার তখন কী যে কান্না পাচ্ছিলো!

সোনিয়ার কথা বলার সময় আমার মুখে ওর রেশমের মতো নরোম চুলের ছোঁয়া লেগেছিলো। মনে হল আমি যেন গোলাপের পাপড়িতে পা ডুবিয়ে হাঁটছি। ফিসফিস্ করে বললাম, তুই আমাকে বিশ্বাস করিস তো সোনিয়া? তাহলে আর কখনো খারাপ লাগবে না।

গোলাপের মিষ্টি গন্ধে আমার বুকটা ভরে গেলো।