০৬-১০. যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

শহরের সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কোথায় কী ঘটছে বোঝার বিন্দুমাত্র উপায় নেই। দশটার দিকে রেডিয়োতে এক ভৌতিক কণ্ঠস্বর শোনা গেলো। বাবু রেডিয়ো অন করে বসেছিলো। চিৎকার করে বাবাকে ডাকলো, বাবা, রেডিয়োতে কী বলছে শুনে যান।

বাবা বারান্দায় বসেছিলেন। ছুটে এলেন ঘরে। একজন কর্কশভাষী অবাঙালি ভাঙা বাঙলায় মার্শাল ল রেগুলেশন পড়ছে। রেডিয়োতে তার কণ্ঠস্বর রীতিমতো ভয়াবহ মনে হচ্ছিলো। শহরে কারফিউ জারির কথা বললো। যাদের কাছে অস্ত্র আছে, বন্দুক রাইফেল সব সামরিক বাহিনীর কাছে জমা দিতে হবে। অয়ারলেস ট্রান্সমিটার, সাইক্লোস্টাইল মেশিন সবকিছু কারফিউ তুলে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে জমা দিতে হবে। ঘোষকের অশরীরী কণ্ঠস্বর সবাইকে আতঙ্কিত করলো। প্রথমে বাংলায় বলা হলো। তারপর উর্দুতে।

বাবা কাঁপা গলায় চিৎকার করে উঠলেন, বন্ধ করো।

ভাইয়া বললো, মনে হচ্ছে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়েছে।

সবাই পাথরের মতো শব্দহীন হয়ে গেলো। তখন বাইরে কিছুক্ষণ পর পর মেশিনগান ছাড়া অন্য কোন শব্দ নেই। মেশিনগানের গর্জন থামার সঙ্গে সঙ্গে একটা থমথমে ভৌতিক পরিবেশ ছড়িয়ে পড়ছিলো সকলের চারপাশে। সকালের রোদ ভীষণ আতঙ্কে গাছগুলোকে জড়িয়ে রেখেছে।

ওরা কেউ সারারাত ঘুমোয়নি। ভাবী শুয়ে আছে। তার ব্যথা উঠেছে। গতকালই তাকে হাসপাতাল নেয়ার কথা ছিলো। ছোট্ট হিমি বিমর্ষ হয়ে কার্পেটের এক কোণে বসে রয়েছে। ওর পাশে চুপচাপ শুয়ে আছে টম আর কেটি। কুকুর দুটো আজ অস্বাভাবিক রকম শান্ত।

গতরাতের জামান সাহেব এলেন। বাবাকে ডেকে বললেন, শহরের সবখানে মিলিটারীরা ঘাটি করেছে। ভারী ভারী অস্ত্র হাতে পজিশন নিয়ে বসে আছে।

বাবা উদ্বিগ্নকণ্ঠে বললেন, শেখ সাহেবের কোন খবর জানেন? ওঁকে কি এ্যারেস্ট করেছে?

জামান সাহেব বললেন, না, উনি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছেন। আমরা খুব শিগগিরই তাঁর নির্দেশ পাবো।

রাতে এতো গোলাগুলি কোথায় হলো জানেন?

মাথা নাড়লেন জামান সাহেব–রাজারবাগ। সেখানকার পুলিস হেডকোয়ার্টার মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। পুলিসের সাথে আর্মির তুমুল যুদ্ধ হয়েছিলো। অনেক পুলিস মারা গেছে।

রাজারবাগের কথা শুনে বাবু চমকে উঠলো। মিনুদের কথা মনে হলো। জামান সাহেবকে বললো, আপনি কি রাজারবাগ গিয়েছিলেন?

জামান সাহেব বললেন, আমি যাইনি। তবে খবর নিয়ে আমাদের লোক এসেছে। আমি একটু পরে বেরুবো।

ভাইয়া বললো, কী করে বেরুবেন? কারফিউ জারি করেছে, শোনেননি?

ম্লান হাসলেন জামান সাহেব–আমাকে যেতেই হবে। যত কারফিউ দিক, আমাদের নিজেদের যোগাযোগ ঠিকই রাখবো। আপনারা সাহস হারাবেন না।

বাবাকে দূরে ডেকে নিয়ে জামান সাহেব ফিসফিস করে কী যেন বললেন। তারপর চলে গেলেন।

ভাইয়া বাবাকে বললো, বিলুর অবস্থা যে রীতিমতো সিরিয়াস হয়ে উঠেছে। কী করা যায় বলুন তো বাবা?

বাবা মাথা নাড়লেন–কী করবে! বাইরে যাবার কোন উপায় নেই। টেলিফোনও তো ডেড!

ভাইয়া চুপ করে বসে রইলো। হিমি এসে বললো, আব্ব, আম্মু তোমাকে ডাকছে।

ভাইয়া চলে গেলো। সিঁড়ির ওপর হিমি বসে রইলো একা। ওর চার বছরের উচ্ছল জীবনটাও হঠাৎ যেন থমকে দাঁড়িয়েছে। সবকিছু ওর কাছে অদ্ভুত মনে হচ্ছে। ও জানে ওদের বাড়িতে নতুন মানুষ আসছে। কাল ও বাবুকে বলেছে, কাকু আমার একটা ভাই আসবে।

বাবু হেসেছিলো–কোত্থেকে আসবে?

হিমি জবাব দিয়েছে, হাসপাতাল থেকে। আম্মু বলেছে হাসপাতালে গিয়ে নিয়ে আসবে।

বাবু বলেছে, ভাই কেন হিমি? তোমার যদি বোন হয়?

হিমি মাথা নেড়ে বলেছে, না, ভাই হবে। আমি ভাইয়ের বোন হবো।

বাবা শুনে হেসে ফেলেছিলেন। ভাবীকে ডেকে বলেছিলেন, তোমার মেয়ের কথা শোনো। ভীষণ পাকা হয়ে গেছে। আসছে বছর ওকে স্কুলে না পাঠালেই নয়।

সেই হাসি-খুশি হিমি, যে সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখতো, আজ শুধু বার বার অবাক হয়ে সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। সবার অদ্ভুত কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করছে।

জামান সাহেবের কাছে রাজারবাগের কথা শুনে বাবুর মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলো। আগামীকাল মিনুর জন্মদিন। কাল রানার অফিসে ওকে বলেছিলো, আমার জন্মদিনে আসছো তো! জন্মদিনে বাবুর কাছে লাল গোলাপ চেয়েছিলো মিনু।

অনার্সের প্রথম বছর থেকে মিনুর সঙ্গে বাবুর পরিচয়। দুবছর হয়ে গেলো। ওরা দুজনেই কবিতা লেখে, গল্প লেখে। বন্ধু হতে দেরি হয়নি। এবারের মিছিলে সে পরিচয় আরও গম্ভীর হয়েছে। থার্ড ইয়ারের বেবী আপা সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করবেন, এ নিয়ে ওদের সঙ্গে আলাপ করেছেন। সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি ইত্যাদি প্রসঙ্গে ছাত্রছাত্রীরা কি ভাবছে এ পত্রিকায় শুধু তাই থাকবে। ওরা সবাই মিলে নাম ঠিক করেছিলো সুকান্তের কবিতা থেকে। একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে রানার বেরুবে। বেবী আপা বললেন, তোমরা দুজন রানার-এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে থাকবে।

ওরা কেউ আপত্তি করেনি। ইচ্ছে মতো পত্রিকায় কাজ করার মতো উত্তেজনা আর কিছুতে নেই। ওরা দুজন শুধু রানার নিয়েই মেতে রইলো। কখনো অফিসে কখনো মিছিলে শুধু রানার নিয়ে আলোচনা। সে আলোচনায় বার বার রাজনীতি চলে আসে। সেদিন বাবু মিনুকে বলছিলো, তোমার কি মনে হয় শেখ মুজিব মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারবেন?

বাবুর চেয়ে মিনু বেশি রাজনীতি সচেতন। বললো, অসম্ভব। ভুট্টোর সঙ্গে আপোস না করলে একা মুজিবকে কখনো মন্ত্রিসভা গঠন করতে দেয়া হবে না।

আমার তো মনে হয় না শেখ মুজিব কখনো আপোস করবেন।

আপোস হয়তো করবেন না। তবে সংগ্রাম সম্পর্কে তার কোনও প্রত্যক্ষ বক্তব্য নেই।

কেন, সাতই মার্চের মিটিঙে তো তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরি করতে বলেছেন।

এটা আবেগের কথা। তার উচিত এ মুহূর্তে স্বাধীনতার কর্মসূচী দেয়া।

শেষ পর্যন্ত নিশ্চয়ই দেবেন। এখনো দেখছেন পাকিস্তানকে না ভেঙে কিছু করা যায় কিনা।

মিনু একটু উত্তেজিত হলো–পাকিস্তান! অসম্ভব। পাকিস্তানের অস্তিত্বকে ভুলে যাও বাবু। ভাষা নয়, সংস্কৃতি নয়, শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস দিয়ে দুটো জাতিকে কখনো এক রাখা যায় না। এটা একটা প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।

কথা বলতে বলতে মিনু রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়লো। পাবলিক লাইব্রেরির রাধাচূড়ার পাতা গলিয়ে শেষ বিকেলের লাল রোদের ছায়া ওর মুখে কাঁপছিলো। বাবুর মনে হলো আগুন জ্বলছে সেখানে। মিনু থামলো। তারপর প্রত্যয়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে বললো, বক্তব্য আমাদের একটাই। স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ।

বাবু সেই প্রত্যয়ের ধ্বনি বুকের গভীরে অনুভব করে। তবু একদিন সে বলে ফেলেছিলো, মিছিলের পর শুধু মিছিল। বিক্ষোভ আর বিক্ষোভ। আর কত দেরি? আমি কিন্তু হতাশ হয়ে পড়ছি।

মিনু আশাবাদী হলেও বাবু শেষ অবধি একরকম হতাশ হয়ে পড়েছিলো। অহরহ মৃত্যুর সংবাদ আসছে। সৈন্যরা মিছিলের ওপর নির্বিচারে গুলি করছে। জয়দেবপুরে, চট্টগ্রামে মানুষ অসহায়ের মতো মরছে। চব্বিশ তারিখে ও পরম ক্ষোভে ডায়রিতে লিখেছিলো–শেখ মুজিব এখনো কি পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখছেন? প্রতিদিনের এতগুলো অসহায় মৃত্যু কি তাকে একটুকু আলোড়িত করে না?

গতরাতের সেই ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের কথা ভাবলো বাবু। মিনুর প্রিয় লাল গোলাপ, জমাট কুয়াশার নদী, অতিকায় নেকড়ের দল, অন্ধকারের অতলান্তিক সমুদ্র এবং ভয়ঙ্কর ঝড়ের দৃশ্যাবলী বার বার তাকে ক্ষত বিক্ষত করতে লাগলো। বাবু সেই অসম্পূর্ণ দুঃস্বপ্নের একটা অর্থ খোঁজার চেষ্টা করলো। যতবার ভাবলো ততবার রক্তাক্ত হলো।

জানালার বাইরে দুপুরের রোদে ইউক্যালিপ্টাস গাছগুলো বড়ো বেশি শান্ত। এতটুকু শব্দ নেই কোথাও। এতটুকু বাতাস নেই। গাছের পাতাগুলো পাথরের মতো জমে আছে। চারপাশে ভয়াবহ শূন্যতা থমথম করছে।

জানালা দিয়ে মাথা উঁচু করে হিমি ডাকলো, কাকু, আব্দু আর দিদা তোমাকে ডাকছে। শিগগির এসো।

বাবু উঠে ড্রইংরুমে এলো। বাবা আর ভাইয়া রেডিয়ো শুনছেন। রেডিয়োতে গান হচ্ছে–আমার সোনার বাংলা।

বাবু চমকে উঠলো। ঢাকা রেডিয়ো কি তাহলে আমাদের দখলে এলো?

ভাইয়া বললো–আকাশবাণী। শোন কী বলছে!

বাবু শুনলো। একটি আবেগের কণ্ঠ–পূর্ব বাঙলায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে।

রোমাঞ্চিত হলো বাবু। রেডিয়োর সামনে বসে পড়লো। খবর শুনলো–পূর্ব বাংলার সর্বত্র গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন শহরে সৈন্যদের সাথে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ চলছে …

স্টেশন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত সবাই আকাশবাণী শুনলো। বার বার বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজাচ্ছে ওরা আমার সোনার বাংলা…।

রাতে ঢাকা রেডিয়োতে ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণ শোনা গেলো। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হলো। শেখ মুজিবকে বলা হলো দেশদ্রোহী। শুনতে শুনতে আকণ্ঠ ঘৃণায় শিউরে উঠলো সবাই। প্রচন্ড আক্রোশে ফেটে পড়লেন বাবা–জঘন্য! বন্ধ করো এ সব নোংরামি। আমার শুনতে ইচ্ছে করছে না।

অনেক রাতে বাবু শুতে গেলো। সারা শহর অন্ধকার। চারদিক থমথম করছে। থেকে থেকে গুলির শব্দ। আকাশের কালো অন্ধকার কোথাও কোথাও আগুনের ছোঁয়া লেগে লাল হয়ে উঠেছে।

রাত আরো গম্ভীর হলো। হঠাৎ শুনলো একটানা ঘরঘর শব্দ। সারা বাড়ি থরথর করে কেঁপে উঠলো। ছুটে এলেন জামান সাহেব। বললেন, শহরের পথে ট্যাঙ্ক নামিয়েছে ওরা। গুণে দেখেছি আঠারোটা ট্যাঙ্ক বেরিয়েছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে।

.

০৭.

ক্যান্টনমেন্টে সারাদিন গভীর উত্তেজনার ভেতর কাটলো বাবলুদের। ওদের ব্যারাক ছেড়ে বাইরে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যান্য দিনের মতো আজ প্যারেডও হয়নি। ব্যারাকের চারপাশে পাঞ্জাবি সৈন্যরা টহল দিচ্ছে। থেকে থেকে অকথ্য ভাষায় বাঙালিদের গাল দিচ্ছে।

ব্যারাকের ভেতর বাবলুরা শুধু ফুসছিলো। ওরা প্রত্যেকে যেন এক একটা বারুদের স্তূপ, যেখানে সামান্য আগুনের ছোঁয়া লাগলে প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটবে। কথা হয় চুপি চুপি। সেই কথার ভেতর চাপা আগুন ছটফট করে। নিঃশ্বাসে বারুদের গন্ধ। এক সময় অস্থির হয়ে শফি বললো, কিছুই বুঝতে পারছি না। এখনো কি সময় হয়নি?

বাবলুও বিরক্তির চরমে পৌঁছে গেছে–এভাবে সময় নষ্ট করার কোন মানেই হয় না।

হাসান বললো, হাবিলদার মেজর সুলতান আহমেদ কোথায়? আজ সারাদিন ওঁকে দেখা যায়নি।

রশিদ বললো, ওঁকে হয়তো এ্যারেস্ট করেছে।

উদ্বেগ, অস্থিরতা আর উত্তেজনায় ভরা সময়গুলো ওদের কাছে অসম্ভব অসহনীয় হয়ে উঠলো। বুড়ো হাবিলদার মেজর এলেন অনেক রাতে। রাত তখন প্রায় বারোটা। ওরা সবাই অন্ধকার ঘরে জেগে ছিলো।

তাকে দেখে ঘিরে ধরলো সবাই। বুড়ো চুপি চুপি বললেন, খবর খুব খারাপ। আমাদের এখান থেকে পালাতে হবে। ঢাকা শহর পুরোটা আর্মি দখল করে ফেলেছে।

হাসান বললো, কিন্তু পালাবো কেন?

বুড়ো আরও নিচু গলায় বললেন, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, যশোর আর রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করেছে। আমরা ওদের সঙ্গে যোগ দেবো।

রশিদ বললো, কিন্তু বেরুবো কী করে? তাছাড়া এভাবে খালি হাতে যাওয়াটা কি ভালো হবে?

কুমিল্লা থেকে আমি খবর পেয়েছি যে কোন ভাবে বেরিয়ে যাওয়াটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। অস্ত্রের জন্য অযথা অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। বুড়ো হাবিলদার মেজর একটু থামলেন। চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন। গলাটা আরও নামিয়ে বললেন, কীভাবে পালাবে তাই বলছি। আমাদের এখন প্যারেড হচ্ছে না। খাবার কিউতেও এই গন্ডগোলে কে আছে কে নেই কেউ অতটা লক্ষ্য করে না। আমরা প্রতিরাতেই কয়েকজন করে বেরিয়ে যাবো। একসঙ্গে বেশি বেরুনো যাবে না। পরে অবস্থা বুঝে অন্য ব্যবস্থা নেবো।

তারপর তিনি ওদের বললেন কীভাবে পালাতে হবে। পাহারা সব জায়গাতেই আছে। কড়া পাহারা। তবু এর ভেতর দিয়েই পালাতে হবে। প্রথম দলে কে যাবে ঠিক করো। বাবলু আর শফি এখন থাকবে। তোমাদের অন্য কাজ দেবো।

মৃদু গুঞ্জন শুরু হলো। বাবলু, শফি আর হাসান ঠিক করলো কে কে যাবে। দশজনকে নিয়ে প্রথম দল তৈরি হলো। বুড়ো বললেন, তোমাদের বেশির ভাগ পথ ক্রলিং করে যেতে হবে। এখান থেকে ক্রলিং করে যাবে সি কোম্পানির ব্যারাকে। তারপর রাস্তায় বেরুবে সাবধানে। রাস্তা পেরিয়েই আমবাগানে ঢুকে পড়বে। গাছের সাথে গা মিলিয়ে হাঁটবে। বাগানটা যদি নিরাপদে যেতে পারো বেড়া পেরিয়ে একেবারে টঙ্গির রাস্তা। সেখানে তেমন পাহারা নেই। তবু বড় রাস্তা দিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। তোমরা যাবে রাস্তার নিচে ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে। দেরি করো না। এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ো।

ওরা দশজন বেরিয়ে পড়লো। অন্ধকারে ব্যারাকের কামরা থেকে বুড়ো হাবিলদার মেজর আর অন্য ছেলেরা তাকিয়ে রইলো জানালা দিয়ে। অজানা

আশঙ্কায় সবার বুক কাঁপছিলো। বুড়ো বিড়বিড় করে দোয়া পড়লেন।

বাবলু মনে মনে হিসেব করলো, তারের বেড়া পর্যন্ত পৌঁছতে ওদের এক ঘন্টার কিছু বেশি সময় লাগবে। এর ভেতর গুলির শব্দ না হলে বুঝতে হবে ওরা নিরাপদ। অবশ্য যদি ধরা পড়ে তাহলে গুলির শব্দ শোনা যাবে না। বুড়ো বললেন, তোমরা শুয়ে পড়ো। কোনো অবস্থাতেই কেউ বলতে পারবে না ওরা কোথায়।

হাবিলদার মেজর চলে গেলেন। ওরা সবাই বিছানায় শুয়ে পড়লো। অথচ কেউ ঘুমোলো না। সবাই গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে সময় গুণতে লাগলো। শফি বাবলুকে ফিসফিস করে ডেকে বললো, কিছু কি বুঝতে পারলি, ওস্তাদ কেন

আমাদের থাকতে বললেন?

বাবলু একটু ভেবে বললো, হয়তো আমাদের ম্যাপিং-এর কাজ দেবেন। তোর আর আমার ম্যাপিং-এর রেজাল্ট সবচেয়ে একুরেট হয়।

কিছুক্ষণ পর শফি বললো ওরা কি সি, কোম্পানি পেরিয়ে গেছে?

বাবলু বিড়বিড় করে বললো, মাত্র এক ঘন্টা। এক ঘন্টা পরই ওরা নিরাপদ।

শফি বললো, পথে যদি কোন বিপদ হয়? তখন তো ওরা কিছুক্ষণের জন্যে থামতেও পারে!

বাবলু বললো, বিপদ হবে না। ওরা সতর্ক থাকলে কিছুই হবে না।

রশিদ বললো, আগামীকাল যে ব্যাচটা যাবে, তাতে আমিও যাবো। অসহ্য মনে হচ্ছে এখানে।

হাসান আপন মনে বললো, কত দিনে যে আমাদের হাতে অস্ত্র আসবে! কত দিনে আমরা খোলা আকাশের নিচে ওদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবো!

বাবলু বললো, ওস্তাদের কথা শুনে তো মনে হয় খুব শিগগিরই সমস্ত বেঙ্গল রেজিমেন্ট একত্রিত হতে যাচ্ছে। পুলিশ আর ইপিআরও সঙ্গে থাকছে।

হাসান বললো, আমরা কোথায় যাবো তিনি কিছু বলেছেন?

বলেছেন, আপাতত জয়দেবপুর। ওখান থেকে প্ল্যান করে অন্য কোথাও। জবাব দিলো বাবলু।

শফি বললো, যাবার আগে দেখিস, আমি ঠিক ওদের এনেশন ডাম্পটা উড়িয়ে দিয়ে যাবো। শুধু কিছু ডিনামাইট দরকার।

বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে রইলো ওরা। এক সময় বাবলু বললো, রাস্তা পেরিয়ে ওরা এতক্ষণে আমবাগানে ঢুকেছে।

শফি বললো, আমবাগানে ওদের গোপন ডাম্পগুলো রয়েছে। নিশ্চয়ই সেখানে পাহারাও খুব কড়া।

বাবলু একটু চমকে উঠলো। এ খবর শফি আর বাবলু ছাড়া এখানকার অন্য কোন ছেলে জানে না। হয়তো বুড়ো হাবিলদার মেজর নিজেও জানেন না। ওদের সতর্ক করে দেয়া উচিত ছিলো।

হঠাৎ সবাই ট্যাঙ্ক চলার শব্দ শুনলো। পাশে শহরে যাবার রাস্তা দিয়ে একটানা ঘরঘর শব্দ। সবাই উঠে বসলো। একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। একটা অসম্ভব অস্বস্তিকর ধাতব শব্দ ওদের বুকের ভেতর ঢুকে যেতে লাগলো। বাইরে আলো জ্বলছে। শফি গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ালো। চাপ, গলায় বাবলুকে ডাকলো দেখে যা বাবলু। ট্যাঙ্ক এখান থেকে দেখা যাচ্ছে।

বাবলু হুমড়ি খেয়ে পড়লো জানালার ওপর। তাকিয়ে দেখলো একটার পর একটা ট্যাঙ্ক ভীষণ শব্দে এগিয়ে চলেছে শহরের পথে। সামনের কালো নলগুলো ভয়াবহ মনে হচ্ছে। হাসান বললো, মনে হচ্ছে পুরো ঢাকা শহরটাই ওরা মাটিতে মিশিয়ে দেবে।

রশিদ বললো, কিন্তু ট্যাঙ্ক কেন নামাবে? সাধারণ মানুষকে মারার জন্যে রাইফেলই তো যথেষ্ট।

শফি উত্তেজিত হয়ে বললো, ঠিক বলেছিস। মনে হয় অন্য কিছু ঘটেছে। ঢাকার দিকে হয়তো গ্রামের মানুষরা এগিয়ে আসছে। ঢাকার পতন–

শফির কথা ছাপিয়ে দুটো মেশিনগান তীব্র শব্দে গর্জন করে উঠলো। সবাই একসঙ্গে চমকে উঠলো। বেশি দূরে নয়। শব্দটা বড়ো রাস্তার কাছাকাছি কোথাও হবে। প্রায় এক মিনিট ধরে চললো সেই প্রলয়ের শব্দ। একটা প্রশ্ন সবার গলার কাছে কাটা মুরগির মত ছটফট করতে লাগলো। ওরা গভীর উৎকণ্ঠা আর আশঙ্কায় বার বার কেঁপে উঠলো। সবার মনে একটাই প্রশ্ন। ওদের দশজন সঙ্গীর মুখ চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। কেউ কিছু বলতে পারলো না।

আরো পরে শহরের দিকে শোনা গেলো ট্যাঙ্কের গর্জন। ট্যাঙ্কগুলো একটার পর একটা সমানে গর্জে চলেছে। ফাঁকে ফাঁকে মেশিনগানের অবিশ্রান্ত গুলির শব্দ। মনে হলো পুরো শহরটাই যেন গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। রাত গম্ভীর হলো। শব্দের এতটুকু বিরাম নেই।

গভীর উদ্বেগের ভেতর রাত কাটলো। ওরা কেউ ঘুমোতে পারেনি। ভোর না হতেই জরুরি হুইসেলের ডাক শোনা গেলো। যে যেভাবে ছিলো ছুটে এলো প্যারেড গ্রাউন্ডে। সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালো।

সামনে সাদা কাপড়ে ঢাকা কতগুলো মৃতদেহ। পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন ক্রুর হেসে বললো, চেয়ে দেখো।

কাপড় সরিয়ে দেয়া হলো। ওরা দেখলো। ওদের পরিচিত দশটা মুখ।

অসম্ভব যন্ত্রণার এক বিশাল ঢেউ ওদের বুকের ভেতরটাকে দুমড়ে মুচড়ে একাকার করে বয়ে গেলো।

.

০৮.

পরদিন সকাল দশটায় কারফিউ তুলে নেয়ার পর ভাইয়া আর ভাবী গাড়ি নিয়ে বেরুলো। রাতে ভাবী আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। বাবা বললেন, হাসপাতালে সুবিধে না হলে ওকে কোন নার্সিং হোমে নিয়ে যেও।

ভাইয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবুও বেরিয়ে পড়লো। গেটটা পেরোতেই পর পর দুটো রাইফেলের গুলির শব্দ শুনলো। মনে হলো খুব কাছে কোথাও, সম্ভবত রেল ক্রসিংটার ওখানে। বাবা বললেন, তুমি আবার কোথায় যাচ্ছো?

বাবু দরজা খুলে বেরুতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। বাবার দিকে একবার তাকালো শূন্য দৃষ্টিতে। কিছু না বলে বেরিয়ে গেলো।

রাস্তায় প্রচুর লোক। সকলের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। দুএকটা গাড়ি ঝড়ের বেগে পাশ কাটিয়ে ছুটে যাচ্ছে। বাস, স্কুটার, রিকশা কিছুই চলছে না। এক মনে হাঁটতে লাগলো বাবু।

রেল গেট-এর কাছে এসে বাবু থমকে দাঁড়ালো। মহাখালীর মোড় থেকে তেজগাঁ স্টেশন পর্যন্ত সোজা লাইন চলে গেছে। যত দূর চোখ যায় দুপাশে শুধু ছাইয়ের স্তূপ। তেজগার কারখানাগুলোর বেশির ভাগ শ্রমিক থাকতো এই রেল লাইনের ধারে। কোনটা ছিলো টিনের ঘর, কোনটা বাঁশের বেড়ার। একটা ঘরেরও অস্তিত্ব নেই। কেউ বলতে পারবে না কোন দিন এখানে ঘন বসতি ছিলো।

অল্প দুরে কয়েকটা লোক জড়ো হয়ে কী যেন দেখছিলো। বাবু এগিয়ে গেলো। দুজন লোক পড়ে আছে মাটিতে, বুকে গুলির দাগ। একটু আগে এদেরই গুলি করা হয়েছে। ওদের গায়ে নীল ইউনিফর্ম। সম্ভবত কোন কারখানার শ্রমিক। বুকের রক্ত রেল লাইনের পাশ থেকে গড়িয়ে পাথরের নুড়ি লাল করে বয়ে গেছে। এখনো রক্ত বেরুচ্ছে। হয়তো এখনো বেঁচে আছে।

লাস ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো সীমাহীন আতঙ্কে শুধু চেয়ে দেখলো। কেউ কিছু করতে পারলো না। একজন বললো, এখানে দাঁড়ানো ঠিক হবে না। সারাক্ষণ আর্মির লরি যাতায়াত করছে।

অসহায় লোকগুলো এক এক করে চলে গেলো। দুজন শ্রমিকের গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত দেহ তেমনি পড়ে রইলো।

হাঁটতে হাঁটতে বাবুর মনে হলো মাত্র একদিনের ব্যবধান। অথচ কি অসম্ভব পরিবর্তন। মানুষ কেন এত অসহায় হয়? কেন মানুষ এত নিষ্ঠুর হয়? কেন কয়েকটি মানুষের উন্মাদনার জন্য হাজার হাজার মানুষকে এভাবে অসহায় মরতে হবে? কেন সবাই মুখ বুজে সহ্য করবে? একটার পর একটা প্রশ্ন অনেকগুলো প্রশ্ন বাবুকে ক্ষত-বিক্ষত করলো।

এয়ারপোর্টের মোড়ে ভারী মেশিনগান বসিয়ে পাঞ্জাবি সৈন্যরা পাহারা দিচ্ছে। দ্বিতীয়বার সেদিকে তাকাতে ইচ্ছে হলো না বাবুর। ওদের দুচোখে পাশবিক হিংস্রতা। মনে হলো যে কোন মুহূর্তে এক ঝাঁক গুলি যে কারো গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

পথের দুপাশে নেকড়ের অসংখ্য ধারালো থাবার হিংস্র ছাপ! আওলাদ হোসেন মার্কেটের মতো জমজমাট বাজারটা একটা ছাইয়ের স্তূপ হয়ে পড়ে আছে। গাছগুলো পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। তার কিছু দূরে বালির বস্তার আড়ালে বসে আছে নেকড়ের দল। ওদের সামনে পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে। একদিন এই পতাকাকে শ্রদ্ধা করতো বাবু, বহু আগে, যখন স্কুলে পড়তো। তারপর শ্রদ্ধাটা কেটে গিয়েছিলো। কিন্তু ঘৃণাও করেনি। আজ সে বুকের ভেতর প্রচণ্ড ঘৃণা অনুভব করলো। ওই পতাকাটা যে বিজয় উল্লাসে উড়ছে এক বিশাল কবর প্রান্তরে, যে কোন সভ্য মানুষ ওটাকে ঘৃণা করবে। পাঞ্জাবি সৈন্যদের চোখের হিংস্র উল্লাসের ছায়া সেই পতাকায়। বাবু পা চালিয়ে সরে এলো।

ফার্মগেটের মোড়ে অসংখ্য ব্যারিকেড দেখতে পেলো বাবু। কোথাও ইটের স্তূপ দিয়ে, কোথাও গাড়ি উল্টে, কোথও আস্ত গাছ উপড়ে ব্যারিকেড দেয়া হয়েছিলো। পঁচিশের সন্ধ্যেবেলাও এই ব্যারিকেড বাবু দেখেনি। হাতের কাছে যে যা পেয়েছে তাই দিয়ে ব্যারিকেড দিয়েছিলো। মার্চের দুতারিখে এখানে সৈন্যদের সঙ্গে জনতার একটা খণ্ডযুদ্ধ হয়েছিলো। অসহযোগ শুরু হয়েছে এক তারিখে। দুতারিখে সাধারণ মানুষ কারফিউ ভেঙেছিলো। এখানে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময়ও কয়েকবার সংঘর্ষ হয়েছে। একটা কালো শহীদ মিনার ছিলো কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর ভেতর। ওটাকেও ভেঙে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে।

কাওরান বাজারেও একই দৃশ্য। একটা ঘরের চিহ্ন কোথাও নেই। টিনের চালগুলো দুমড়ানো কালো রাঙতার মতো। অঙ্গার হয়ে যাওয়া গাছগুলোর ডালে কয়েকটা শকুন বসে আছে। এ ছাড়া বাজারের সব কটি প্রাণী মৃত। উকট একটা গন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে আছে। কতগুলো শকুন নিঃশব্দে উড়ছে।

আরেকটু এগিয়ে যেতেই এক অকল্পনীয় দৃশ্য দেখলো বাবু। অসংখ্য মানুষের মিছিল চলেছে। রাস্তার দুধার দিয়ে, পিঁপড়ের মতো সারি বেঁধে, এতটুকু শব্দ না করে, সেই নিরব মিছিল এগিয়ে চলেছে। ফাঁকা রাস্তাটার সামনে যত দূর চোখ যায় শুধু মানুষ। ছেলে, বুড়ো, মেয়ে, শিশু। সব রকমের, সব বয়সের মানুষ। সবার চোখে মুখে নিদারুণ আতঙ্ক। সবাই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ওদের সকলেই ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। ওরা কবর থেকে পালিয়ে যাচ্ছে।

সেই আতঙ্কের মিছিলে বাবুও হাঁটলো। চেনা একজনকে প্রশ্ন করলো, বজুর বাপ, কোথায় যাচ্ছো?

মাঝবয়সী লোকটা তাকালো বাবুর দিকে। শব্দ না করে কাঁদছিলো। বাবুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললো–অগরে আর কই পামু মিয়া ভাই! আমার চক্ষের সামনে গুলি কইরা মারলো। কই পামু আমার বজু,

মাণিক আর লক্ষ্মীরে! জনমের মতো অগরে কাইড়া লইয়া গেছে জালিমেরা!

লোকটা হু-হুঁ করে উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়লো। পাশের লোকটা চাপা গলায় বললো, চুপ করো ভাই, চুপ করো। এই হগল কতা কইয়া কইলজায় আগুন জ্বালাইয়া দিও না। সান্ত্বনা দিতে গিয়ে সেই লোকটাও কেঁদে ফেললো। বাবু দেখলো সবাই কাঁদছে। সকলের বুকে আগুন জ্বলছে।

সব কিছু হারিয়ে ওরা পথে নেমেছে। বাবু বললো, তোমরা কোথায় যাবে?

লোকটা মাথা নাড়লো। চোখ মুছে বললো, জানি না।

বাবু অবাক হলো–তাহলে?

লোকটা জবাব দিলো না। তার পাশের লোকটা বললো, যেইহানে এমুন শয়তানের রাজত্বি নাই, হেইহানে যামু। শহরে শয়তানের রাজত্বি চলতাছে।

বাবু বিড়বিড় করে বললো, কোথায় শয়তানের রাজত্ব নেই! যেখানে যাবে সেখানেই শয়তানরা তাড়া করে ফিরবে। পালিয়ে নয়, রুখে দাঁড়াতে হবে।

হেঁটে হেঁটে বাবু বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এলো। ওর বন্ধুদের কথা ভাবছিলো। রাজ আর লাকি থাকে মহসীন হলে। ইকবাল হলে আশরাফ, সেলিম আর কাজল। আরো অনেক পরিচিত ছেলে রয়েছে। কাল রাতে এদিকে আগুন জুলছিলো।

পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধ। কোথাও কোন লোকজন নেই। রাস্তায় দেখলো ট্যাঙ্কের চাকার দাগ। কালো রাস্তার মসৃণ বুক কেটে লাল দগদগে ক্ষত তৈরি করেছে। মহসীন হলের দরজায় মস্ত বড়ো তালা ঝুলছে। সারা হলে কারো সাড়াশব্দ নেই। বাবু অবাক হলো। একদিনের ভেতর সবাই কোথায় গেলো? বাইরে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলো বাবু। পাশে একটা গাড়ি এসে থামতেই চমকে উঠলো। চেয়ে দেখলো হাউস টিউটর গিয়াস স্যার। বাবু এগিয়ে গেলো। বললো, হলের সব ছেলেরা কোথায় গেছে স্যার?

গিয়াস স্যার বললেন, জানি না। পঁচিশ তারিখ রাতে ওরা ইকবাল হলে গিয়েছিলো আর্মি এ্যাটাকের খবর পেয়ে। তারপর কেউ আর ফিরে আসেনি।

আর্মি কি এ হলে আসেনি? প্রশ্ন করলো বাবু।

না। গিয়াস স্যার বললেন, দুএকটা গুলি লেগেছে বটে। তবে সারারাত ওরা ইকবাল হল আর জগন্নাথ হল নিয়ে ব্যস্ত ছিলো।

বাবু চুপ করে রইলো। গিয়াস স্যার বললেন, তুমি এখানে কী করছো?

রাজ আর লাকিকে খুঁজতে এসেছিলাম। ধীরে ধীরে জবাব দিলো বাবু।

ওরা যদি বেঁচে থাকে তবে নিশ্চয়ই দেখা পাবে। কিন্তু এখানে এভাবে ঘোরাঘুরি করা তোমার একেবারেই উচিত নয়! আর্মির লোকেরা ছাত্র পেলেই মারছে। গিয়াস স্যারকে ভীষণ উদ্বিগ্ন মনে হলো।

বাবু ইকবাল হলের দিকে হাঁটলো। পথের ওপরই মৃতদেহ পড়ে আছে। একটা দুটো মৃতদেহ পেরিয়ে ইকবাল হলের চত্বরে ঢুকেই শিউরে উঠলো। সারা মাঠ জুড়ে লাসের মিছিল। এক জায়গায় কতগুলো লাস সার বেঁধে পড়ে আছে। পচে ফুলে উঠেছে। কারো গায়ে গুলির দাগ, কারো গায়ে বেয়নেটের।

দুজন লোক মাঠের ভেতর ঘুরে ঘুরে পরিচিত মুখ খুঁজছে। প্রায় সব কটা লাসই ছাত্রদের। দুএকটা পুলিসের মৃতদেহও রয়েছে। ছাত্রদের অনেকেই বাবুর পরিচিত। বহুবার এদের দেখেছে । কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায়, কখনো ক্যান্টিনে, কখনো বটতলার মিটিঙে, আবার কখনো কোন বিক্ষোভের মিছিলে।

আরো পরিচিত চেহারা দেখলো বাবু। আশরাফকে দেখলো। যাকে কমনরুমে গেলেই দেখা যেতো দাবার বোর্ড সামনে নিয়ে বসে আছে। শাহেদকে দেখলো বুকে গুলি লেগেছে। ছাত্রদের বহু অনুষ্ঠানে বাবু শাহেদের কবিতা শুনেছে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে ওর সাথে আলাপ হয়েছিলো বাবুর। বেয়নেট দিয়ে যাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে, তার নাম সালাম, বহুবার বটতলায় বক্তৃতা দিতে দেখেছে ওকে।

বুকের ভেতর বার বার বেয়নেটের আঘাত অনুভব করলো বাবু। মনে হলো, ও নিজেও এমনি একটা লাস হতে পারতো। এমনি পড়ে থাকতো রক্ত-কালো ঘাসের ওপর খোলা আকাশের নিচে। কবর দেয়ার জন্যে কেউ নেই। আকাশে শকুন উড়ছে। দূরে কয়েকটা কুকুর বসে আছে লোলুপ দৃষ্টিতে। শকুন আর কুকুররা এদের ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করবে। কেউ কোনদিন এদের কথা জানবে না। এদের মা বাবা ভাই বোন সবাই অপেক্ষা করছে কবে এরা ঘরে ফিরে যাবে।

বাবু আর ভাবতে পারলো না। ওর মনে হলো এক্ষুণি ও পড়ে যাবে। মাথাটা ঘুরছে! পায়ের নিচে মাটি, সামনের গাছ আর দূরের আকাশ সব কিছু থেকে থেকে কেঁপে উঠছে।

কে যেন কাঁধের ওপর হাত রাখলো। তাকিয়ে দেখলো ওর বন্ধু মামুন। বাবু শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। মামুন বললো, এখানে কি করছো বাবু?

বাবু ওর কথার জবাব দিতে পারলো না। মামুন আবার বললো, লাকির কোন খবর জানোনা?

বাবু অসহায় ভাবে মাথা নাড়লো।

মামুন ওর হাত ধরলো। বললো, চলো ওপরে যাই।

ইকবাল হলের সিঁড়ি বেয়ে ভেতরে ঢুকলো ওরা। ঘরগুলো দেখলো। গুলি লেগে দেয়ালগুলো ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। দেয়ালে দেয়ালে রক্তের ছাপ।

আগুনের ছাপ সারা ঘরে। পোড়া কাগজের স্তূপ। প্রত্যেকটা ঘরের চেহারা এক রকম।

দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে ওরা থমকে দাঁড়ালো। সিঁড়িতে লাস টেনে নামানোর দাগ। প্রত্যেকটা সিঁড়ি রক্তে আগাগোড়া লাল হয়ে আছে। ঠিক লাল নয়, কালচে লাল। সিঁড়ির পাশে দেয়ালেও রক্তের দাগ। আহত কেউ হয়তো টেনে নামানোর সময় ফাঁকা দেয়ালটা ধরতে চেয়েছিলো। দেয়ালে রক্তমাখা আঙুলের ছাপ। সব কিছু রক্তে একাকার।

বাবু আর মামুন সিঁড়ির নিচে পাথরের মূর্তি হয়ে গেলো। এক ঝলক দমকা বাতাস ফাঁকা বারান্দা দিয়ে হু হু করে বয়ে গেলো। ছাত্রাবাসের শূন্য ঘরে হু হু প্রতিধ্বনি। আধ পোড়া কাগজগুলো এলোমেলো উড়তে লাগলো।

বাবুর বুকের ভেতর প্রতিধ্বনি তুললো সেই ভয়াবহ শূন্যতা। আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো মামুনের হাত ধরে।

মামুন চলে গেলো। সব কিছু ফাঁকা মনে হলো বাবুর। রাস্তা দিয়ে উদভ্রান্তের মতো হাঁটলো। দুপুরের গনগনে সূর্য তখন ঠিক মাথার ওপর। বাবুর মনে হলো রাস্তার দুধারে বাড়ি ঘর কিছুই নেই। কোন মানুষ নেই। গাছপালা নেই। এক বিশাল মরুভূমির মাঝখান দিয়ে সে হেঁটে যাচ্ছে। সামনে ধূ ধূ করছে রোদে ঝলসানো এক শূন্য ক্যানভাস। কোথায় যাবে তার কোন ঠিকানা নেই।

তীব্র শব্দে একটা নীল টয়োটা গাড়ি তার পাশে ব্রেক কষে দাঁড়ালো। বাবু তাকিয়ে দেখলো ছোড়দা, ওর জেঠতুতো ভাই। ধমকের গলায় ছোড়দা ওকে বললো, এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস?

বাবু মাথা নাড়লো–কিছু নয়।

ভেতর থেকে ছোড়দা গাড়ির দরজা খুলে দিলো–উঠে আয়।

বাবু কোন কথা না বলে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো। ছোড়দা বললো বাড়ি থেকে কখন বেরিয়েছিস?

রমনার মাঠের মাঝখানে কালী মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ দেখছিলো বাবু। বললো, বেশ কিছুক্ষণ।

এ সময়ে এভাবে বাড়ি থেকে বেরুতে গেলি কেন?

ক্যাম্পাসে গিয়েছিলাম।

ছোড়দা রেগে বললো, দয়া করে এখন বাড়ি থেকে বেরিও না। ছাত্রদের ওরা কিভাবে মারছে সে খবর নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়।

বাড়ির দরজায় বাবুকে নামিয়ে দিয়ে ছোড়দা বাবার সঙ্গে দেখা করে চলে গেলো।

দুপুরের পর থেকে বাবু একা ওর ঘরে বসেছিলো। একটার পর একটা শূন্যতার দেয়াল ওর চারপাশে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিলো। বাবুর মনে হলো কোনদিন এই শূন্যতার দেয়াল থেকে সে মুক্ত হতে পারবে না।

রাতে সারা বাড়ির বাতি নিবিয়ে সবাই রেডিয়ো শুনলো। ভাইয়া বহুক্ষণ চেষ্টা করে স্টেশনটা ধরেছিলো। ঘোষকের কণ্ঠ শুনে সবাই ভীষণ চমকে উঠলো–আপনারা স্বাধীন বাঙলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনেছেন। বার বার ওরা শুনলো। যতবার শুনলো রোমাঞ্চিত হলো। মেজর জিয়ার বেতার ভাষণ শুনলো। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিফৌজ যুদ্ধ করছে।

বাবা উত্তেজিত গলায় বললেন, মনে হচ্ছে ঢাকা ছাড়া বাকি সব মুক্তিফৌজের দখলে।

ভাইয়া আরো উত্তেজিত–শিগগিরই ওরা ঢাকা অবরোধ করবে। হঠাৎ করে আক্রমণ করেছিলো বলেই আর্মি ঢাকা দখল করতে পেরেছিলো। ঢাকার দিকে মার্চ করতে মুক্তিফৌজের আর বেশি দেরি নেই।

স্বাধীন বাঙলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের পর আকাশবাণী। মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সেখানেও। অনবরত দেশাত্মবোধক গান বেজে চলেছে। বাংলাদেশের গান। সারা শরীর বার বার শির শির করে উঠলো।

ঢাকা রেডিওতে ধর্ম প্রচার করা হচ্ছে। ভাইয়া ওদের খবর শুনছিলো।

বাবা পাগলের মতো চেঁচিয়ে বললেন, বন্ধ করো ওদের নোংরামি!

বিছানায় শুয়ে ঘুমোতে পারলো না বাবু। চোখের পাতা বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে সারি সারি লাশের মিছিল। ঘাসের বুকে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য অসহায় মৃতদেহ। সবুজ ঘাস কালো হয়ে গেছে। দেয়ালে বারান্দায় সিঁড়িতে সবখানে শুধু চাপ চাপ রক্ত। দুঃখ, হতাশা, রাগ আর ঘৃণার মিশ্র অনুভূতি বাবুকে সারারাত ক্ষত-বিক্ষত করলো।

বাইরে মাঝে মাঝে গুলির শব্দ হচ্ছে। আগুন জ্বলছে কালো আকাশের গায়ে। পঁচিশের রাত এখনো শেষ হয়নি। বাবু বুঝতে পারলো না আর কতদিন এভাবে রাত কাটবে।

শেষ রাতে কিছুক্ষণের জন্যে ঘুমিয়েছিলো বাবু। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলো–সেই ভয়াবহ স্বপ্ন। ঝড়ের রাত। অশান্ত ইউক্যালিপ্টাস গাছ। বিধ্বস্ত গোলাপ বাগান। তারপর নেকড়ের চোখে সবুজ হিংস্রতা। সাদা বরফের বুকে রক্তের দাগ।

বাবুর ঘুম ভেঙে গেলো। জেগে ওঠার পরও দুঃস্বপ্নের ছায়া দেখলো। ভীষণ ভয় পেলো বাবু। বাইরে দেখলো বাবা আর ভাইয়া অন্ধকারে বারান্দায় বসে আছেন।

সারা শহর নিকষ কালো অন্ধকারের চাঁদরে ঢাকা। আদিম পৃথিবীর অন্ধকার। আদিম হিংস্রতার রাজত্ব সেই অন্ধকারে। পাঞ্জাবি সৈন্যরা অন্ধকারে হানা দেয় শহরের প্রতিটি বাড়িতে। নির্বিচারে মানুষদের গুলি করে মারে। লুট করে নিয়ে যায় মানুষের আজীবনের সঞ্চয়। তারপর আগুন ধরিয়ে দেয়। কালো অন্ধকারের ক্যানভাসে শয়তানের জিভের মতো লকলক করে আগুনের লাল শিখা। আকাশে তার ছায়া পড়ে। সারারাত জ্বলে সেই আগুন। কোথাও রাইফেলের শব্দ শোনা যায়। মানুষের আর্তনাদ রাতের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি শব্দ এক একটি মৃত্যুর স্বাক্ষর।

বাবা আর ভাইয়া ঘুমোতে পারেনি। সারাক্ষণ পায়চারি করছিলেন বাবা। ভাইয়া বসেছিলো বারান্দার সিঁড়ির ওপর। একসময় বললো, আমার মনে হয় শহর ছেড়ে আমাদের গ্রামে চলে যাওয়া উচিত।

বাবা বেতের চেয়ারে বসলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, ওরা গ্রামেও যেতে পারে।

গ্রামে ওরা ঢুকতে পারবে না, পথঘাট নেই। তার ওপর সব কিছু অচেনা।

বাবা একটু বিরক্ত হলেন–ওরা প্যারাট্রুপার্স নামাতে পারে।

বাবার কথা ভাইয়ার ভালো লাগলো না। খুব তাড়াতাড়ি হতাশ হয়ে পড়েছেন বাবা। ভাইয়া একটু পরে বললো, মুক্তিফৌজের কাছে নিশ্চয়ই এন্টি এয়ারক্র্যাফট গান রয়েছে।

তাতে কী হলো?

এয়ার এ্যাটাক বা প্যারট্রুপার্স নামানো অতো সহজ হবে না।

বাবা ভাবলেন, ওদের মতো বয়স হলে আমিও ওভাবে ভাবতাম। শেষ মুহূর্তেও এ বয়সটা হতাশ হয় না। বললেন, মুক্তিফৌজের শক্তি কতটুকু? ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট আর কিছু পুলিশ। সব মিলিয়ে হাজার বিশেকও হবে না। তার ওপর অস্ত্র বলতে কিছুই নেই!

মুক্তিফৌজের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়বে। ঘরে ঘরে মুক্তিযোদ্ধা তৈরি হবে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলতে বলতে ভাইয়া উত্তেজিত হয়ে উঠলো–কেন সবাই যুদ্ধ করবে না বলুন? আজ আপনার কোন ছেলে যদি যুদ্ধে যেতে চায় আপনি কি পারবেন বাধা দিতে?

বাবা একটু চমকে উঠলেন। তিনি এভাবে ভাবেননি। তাঁর ছেলেদেরও যুদ্ধে যাবার প্রয়োজন হতে পারে।

বিড়বিড় করে বললেন, আমার ছেলেরা যদি যুদ্ধে যেতে চায় তাহলে আমি খুশিই হবো। তোমরা আমার চোখের সামনে অসহায় পাখির মতো গুলি খেয়ে মরো, আমি তা চাই না।

ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বললো, আমার মনে হয় বাবলুরা ক্যান্টনমেন্টে থেকে বেরিয়ে গেছে। ওরা নিশ্চয়ই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে।

বাবা বললেন, অসম্ভব নয়। তবে একবার দেখা করে গেলে পারতো।

হয়তো ভেবেছে আপনি যেতে দেবেন না।

কেন এ রকম ভাববে? বাবা বিষণ্ণ গলায় বললেন, তোমাদের কোন কাজে আমি কোনদিন বাধা দিইনি।

ভাইয়া চুপ করে রইলো। বাবা ওদের সবাইকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছেন। আসলে মা মারা যাবার পর থেকেই বাবা কোন কিছুতে জড়াতে চান না। সরকারী চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর নিজেকে আরো বেশি গুটিয়ে নিয়েছেন।

বাবা বারান্দায় পায়চারী করছিলেন।

ভাইয়া বললো, বাবুকে আজ খুব বিষণ্ণ মনে হলো। ও কি বেরিয়েছিলো কোথাও?

বাবা বললেন, বেরিয়েছিলো। তোমরা যখন হাসপাতালে গেলে তারপরই বেরিয়ে গেলো। এসে বললো হলে গিয়েছিলো।

ভাইয়া বললেন, ওর হলের বন্ধুরা কোথায়?

বললো ইকবাল হলে ওর পরিচিত অনেকের লাস দেখেছে। বন্ধুদের কথা কিছু বলেনি।

ভাইয়া চুপ করে বসে রইলো। বাইরে মাঝে মাঝে গুলির শব্দ হচ্ছে। অন্ধকারটা ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে। ভাবী হাসপাতালে কী অবস্থায় আছে কে জানে। বাবা ভাইয়াকে বললেন, শুতে যাও। রাত ভোর হয়ে এসেছে।

ভাইয়া উঠে ওর ঘরে চলে গেলো। বাবা বারান্দায় একা পায়চারি করতে লাগলেন।

.

০৯.

হাবিলদার মেজর সুলতান একেবারে মুষড়ে পড়েছেন। বার বার বললেন, আমার জন্যে দশটা ছেলেকে মরতে হলো। আমিই ওদের মৃত্যুর জন্যে দায়ী।

বাবলু বললো, ক্যান্টনমেন্টে থাকলে একদিন আমাদের সবাইকে মরতে হবে। গর্তেচাপা ইঁদুরের মতো মরার চেয়ে ওভাবে মরাটা অনেক ভালো। আমরা সবাই এখান থেকে পালিয়ে যাবো।

রশিদ বললো, আপনি যেভাবে বলেছেন ওটাই বেরুবার একমাত্র পথ। আমার মনে হয় ওরা ওদের নিজেদের বোকামির জন্যে ধরা পড়েছে।

বাবলু বললো, আমারও তাই মনে হয়। নইলে ধরা পড়ার কোন কারণই তো দেখছি না।

বুড়ো হাবিলদার মেজর সব শুনলেন। বললেন, তোমরা একেবারেই ছেলেমানুষ। তোমাদের কাছে এ ধরনের সতর্কতা আশা করা অন্যায়। আজ রাতে কেউ বেরিয়ো না। অপেক্ষা করো, কাল রাতে আবার চেষ্টা চালানো যাবে।

রাতে ওরা সবাই হাবিলদার মেজরের অপেক্ষা করছিলো। যদি কোন বিশেষ সংবাদ থাকে, তিনি রাতে আসবেন বলেছিলেন। প্রতি মুহূর্তেই ওরা কোন বিশেষ সংবাদ শোনার অপেক্ষা করছে। অন্ধকার ব্যারাকে সবাই চুপচাপ বসে আছে। বাইরে পাঞ্জাবি সৈন্যরা টহল দিচ্ছে। এমুনেশন ড্যাম্পের দিকে পাহারাটা বেড়েছে মনে হলো। জিপ লরি ছুটোছুটি করছে সন্ধ্যের পর থেকে।

বাড়ির কথা ভাবছিলো বাবলু। বাবা নিশ্চয়ই ওর জন্যে খুব চিন্তা করছেন। হিমির কথা মনে হলো। হিমি কি এখনো আগের মতো হাসিখুশি আছে? থাকার কথা নয়। যে বিপর্যয় এ দেশের ওপর দিয়ে সর্বনাশা ঝড়ের চেয়েও প্রলয়ঙ্কর

অবয়ব নিয়ে বয়ে গেলো, এরপর কেউ স্বাভাবিক থাকতে পারে না।

হঠাৎ চমকে উঠলো বাবলু। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বুড়ো হাবিলদার মেজর ইশারায় ওদের ডাকছেন। সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলো বাবলু। রশিদ আর হাসানও উঠে জানালার কাছে এলো। বুড়ো চাপা গলায় বললেন, ভীষণ একটা ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে। আজ রাতে এরা জয়দেবপুরে যে বেঙ্গল রেজিমেন্ট আছে ওদের আক্রমণ করবে। একশ আশিজনকে নিয়ে একটা কনভয় তৈরি হচ্ছে। মর্টার ভারী মেশিনগান সবই থাকছে এদের সঙ্গে। আমাদের পুরো রেজিমেন্ট রয়েছে। জয়দেবপুরে। সতর্ক না করে দিলে সবাই মারা পড়বে।

কথাটা শুনে সবাই পাথরের মতো চুপ হয়ে বসে রইলো। ক্যান্টনমেন্ট থেকে কম করে হলেও বিশ মাইল দূরে জয়দেবপুর। তিন ঘন্টা লেগে যাবে ওখানে যেতে।

বাবলু বললো, ওরা কখন যাবে কিছু বুঝতে পেরেছেন?

বুড়ো বললেন, বালুচি হাবিলদার আফতাব খানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ও বললো রাত দুটো নাগাদ ওরা আক্রমণ করবে। হঠাৎ করে আক্রমণ করতে চায় বলেই মাঝ রাতে যাচ্ছে।

রশিদ ঘড়ি দেখলো, এগারোটা বাজতে দশ মিনিট বাকি আছে। বললো, আমি যাবো ওদের খবর দিতে। এক্ষুণি রওনা হলে দেড়টার ভেতর পৌঁছে যাবো।

বুড়ো মেজর একটু ভেবে বললেন, যেতে পারবে জানি। তবু তোমাদের কজনকে আমি সঙ্গে রাখতে চেয়েছিলাম।

শফি এক কোণে চুপ করে বসেছিলো। বললো, রশিদের চেয়ে আমি কম দৌড়োতে পারি না। আপনি যদি বলেন, ওর সঙ্গে আমিও যেতে পারি।

রশিদ বললো, তুই যদি আসিস তাহলে খুবই ভালো হবে।

বুড়ো বললেন, তোমরা দুজনই যেতে চাইছো?

বাবলু বললো, আমিও যেতে পারি। আমি–।

বুড়ো ওকে বাধা দিলেন–না, তুমি থাকো। ওরা দুজনেই যাক। তোমরা এক্ষুণি বেরিয়ে পড়ো। ওখানে ক্যাপ্টেন সামাদ আছেন। ওঁকে আমার সালাম জানিয়ে বলল, ওঁরা যেন আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেন। পাঞ্জাবিদের ওঁরা যদি বাধা দেন তাহলে ওঁদের নিশ্চয়ই ওখান থেকে সরে যেতে হবে। যোগাযোগ না রাখলে আমরা একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এখানে আমাদের সাধ্যমতো যা পারি করবো। কোন বিশেষ নির্দেশ থাকলে জেনে নিও। আর যদি সুবিধে বোঝো, তাহলে একজন ফিরে এসে খবরটা দিয়ে যেও। নইলে দুজনই ওদের সঙ্গে চলে যেও।

রশিদ আর শফির পিঠে হাত রেখে বুড়ো হাবিলদার মেজর ধরা গলায় বললেন, বাবা মার সঙ্গে তোমাদের দেখা হলো না। আমি বাড়িতে খবর পাঠাবার চেষ্টা করবো। এসো তাহলে। খোদা হাফেজ।

শফি আর রশিদ বেরিয়ে গেলো। অন্ধকার ঘরের জানালা দিয়ে বুড়ো তাকিয়ে রইলেন ওদের পথের দিকে। বার বার বিড়বিড় করে বললেন, আল্লাহ্ তোমাদের সহায় হোন।

বুকে হেঁটে ক্রলিং করে ওরা দুজন সি কোম্পানি আর বি কোম্পানির ব্যারাক পেরিয়ে গেলো। কোথাও এতটুকু শব্দ হলো না। ক্রলিং করে রাস্তাও পেরিয়ে গেলো। রাস্তার পর আমবাগান। বাগানে ঢুকতে গিয়ে ওরা চমকে উঠলো। দেখলো দূরের গাছগুলোর সাথে গা মিলিয়ে পাঞ্জাবি সৈন্যরা পাহারা দিচ্ছে। ভালো করে লক্ষ্য না করলে বোঝার কোন উপায় নেই। ওরা থমকে দাঁড়ালো। রশিদ ফিসফিস করে বললো, বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া যাবে না। এখানে যে কিছু গোপন এমুনেশন ডাম্প আছে, ওস্তাদও জানেন না। ভিমরুলের চাকের মতো এখানে পাহারা দেয়া হয়। কাকপক্ষিও ঢুকতে পারে না।

শফি মাথা নাড়লো। নিচু গলায় বললো, ওরা কাল এখানেই গুলি খেয়েছিলো।

রশিদ বললো, রাস্তার পাশের নালা দিয়ে যাবো আমরা। একটু ঘুরতে হবে। সেটা বড়ো রাস্তায় গিয়ে পুষিয়ে নেয়া যাবে।

রাস্তা থেকে ওরা নালায় নেমে পড়লো। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হলো ওদের। কাদার ভেতর অতি সন্তর্পণে এতটুকু শব্দ না করে ওরা এগিয়ে চললো। একটানা পনেরো মিনিট হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটলো শিকারী বেড়ালের মতো। তারপর এক সময় ওরা নালাও পেরিয়ে গেলো। নালার মুখেই কাঁটাতারের বেড়া। বেড়া ডিঙিয়ে ওরা ছুটতে আরম্ভ করলো। ঠিক বড়ো রাস্তার ওপর দিয়ে যাওয়া যাবে না। বড়ো রাস্তায় জিপ চলার শব্দ হচ্ছে। রাস্তার নিচের ধানক্ষেত ধরেই ওরা দৌড়ালো।

আকাশে চাঁদ নেই। ওদের সুবিধেই হলো। তারার ফ্যাকাশে আলোতে অস্পষ্ট পথের রেখা দেখা যাচ্ছিলো। কোন কথা না বলে ওরা দুজন ছুটে চললো অবিরাম।

রাত যখন সোয়া একটার মতো ওরা জয়দেবপুর পৌঁছলো। ছাউনিতে ঢুকতেই বাধা পেলো। অন্ধকারে ভারী কণ্ঠস্বর শুনলো–হল্ট।

ওরা চমকে উঠলো। পাঞ্জাবি সৈন্য নয়তো? ওরা জানতে এখানে কিছু পাঞ্জাবি সৈন্য রয়েছে। এ মুহূর্তে পালানো সম্ভব নয়। হাত তুলে ওরা দাঁড়িয়ে বললো–ফ্রেন্ডস।

অন্ধকার কুঁড়ে একজন সৈন্য বেরিয়ে এলো। টর্চের আলো ফেলে বললো–আপনারা কোথায় যাবেন?

ওরা আশ্বস্ত হলো। পাঞ্জাবি সৈন্য নয়, বাঙালি। রশিদ বললো, আমরা টেন্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে আসছি। হাবিলদার মেজর সুলতান আহমেদের একটা জরুরি সংবাদ আছে ক্যাপ্টেন সামাদের জন্যে।

টহলদার সৈন্যটি বললো, আমার সঙ্গে আসুন।

জয়দেবপুর রাজবাড়ির ভেতর সৈন্যদের ছাউনি। ক্যাপ্টেন সামাদের দপ্তর সেখানে। একটা টেবিলে পাঁচজন কমিশন অফিসারকে নিয়ে ক্যাপ্টেন সামাদ কী যেন পরামর্শ করছিলেন। রশিদ সব কথা খুলে বললো ক্যাপ্টেনকে।

রশিদের কথা শুনে চমকে উঠলেন ক্যাপ্টেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন দেড়টার মতো বাজে। সবাইকে ডেকে পাঠালেন কনফারেন্স রুমে।

রশিদ আর শফি বসলো। অফিসাররা সবাই এলেন। ক্যাপ্টেন বললেন, পাঞ্জাবি সৈন্যরা আমাদের আক্রমণ করার জন্য ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে রওনা হচ্ছে। আমরা ওদের পথে বাধা দেবো। এখান থেকে দুমাইল এগিয়ে ব্রিজের কাছে যাবো। পথের দুপাশে পজিশন নিয়ে ওদের জন্যে অপেক্ষা করবো। সবাই ঝটপট তৈরি হয়ে যান।

শফি আর রশিদও এলো এদের সঙ্গে। দুমাইল এগিয়ে এসে সবাই পজিশন নিয়ে বসে পড়লো। রশিদের সঙ্গে একটা হালকা মেশিনগান। চারদিকে থমথমে অন্ধকার। নিজের শরীরও দেখা যাচ্ছে না সেই অন্ধকারে। ওরা সবাই প্রতীক্ষার মুহূর্ত গুণে চললো। উত্তেজনায় সবার বুকের ভেতরটা ঢিবঢিব করছিলো। সময় গড়িয়ে চললো।

অবশেষে ওরা এলো। প্রথমে একটানা মৃদু শব্দ শোনা গেলো। দূর থেকে ভারী লরি আর জিপ আসার শব্দ। সকলের আঙুল ট্রিগারের ওপর স্থির হলো।

লরির পজিশন ওদের বলে দেয়া হয়েছে। বিশেষ জায়গাটায় আসা মাত্র সবাই গুলি ছুঁড়বে।

শব্দ আরো কাছে এলো। রাস্তার ওপর ঘরঘর শব্দ। প্রথম লরির হেড লাইটের নিচের ছোট লাইট দুটো জ্বালানো। অন্যগুলোতে কোন আলো নেই। বেশি জোরেও চলছে না। যতটুকু পারা যায় শব্দ কমানোর চেষ্টা করছে।

প্রথম লরিটা দেবদারু গাছের নিচে এলো। বাকিগুলো তার পেছনে। শেষটা ব্রিজের ওপর। দেবদারু গাছটা পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একসঙ্গে আটটা মেশিনগান গর্জে উঠল ভীষণ শব্দে। এক মুহূর্তের বিরতি না দিয়ে কট-কট-কট-কট করে গুলি বৃষ্টি করে চললো মেশিনগানগুলো। পুরো কনভয়টা যেন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। দুএকটা পাল্টা গুলির চেষ্টা চললেও পরমুহূর্তে সেটা থেমে গেলো।

প্রায় পনেরো মিনিট পরে এদের মেশিনগান থামলো। সঙ্গে সঙ্গে একটা ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা পুরো পরিবেশকে জড়িয়ে ধরলো। একটু পরে ওরা রাস্তায় উঠে এলো। টর্চের আলো ফেললো। লরিগুলো ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। পাঞ্জাবি সৈন্যদের লাসগুলো টেনে নামানো হলো। মোট একশ আশিজন, একজনও বেঁচে নেই। অস্ত্রগুলো সব জড়ো করা হলো। বারোটা হালকা মেশিনগান, তিনটা ভারী মেশিনগান, তিন ইঞ্চি মর্টার, পঁচিশ রাউন্ড মর্টার শেল আর চাইনীজ রাইফেল একশ দশটা।

লাসগুলো ফেলে দিয়ে লরিগুলো পরিষ্কার করা হলো। একটা লরি শুধু অকেজো হয়ে গেছে। ক্যাপ্টেন বললেন, আমরা প্রথমে ঘাঁটিতে যাবো। যতটুকু সম্ভব অস্ত্র আর রসদপত্র নিয়ে একদল মধুপুরের গড়ের দিকে যাবে, অপর দল যাবে নরসিংদীর দিকে। তার আগে কাঠের ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করো।

রশিদ আর শফিককে ক্যাপ্টেন বললেন, তোমাদের ফিরে কাজ নেই। আমাদের সঙ্গে থেকে যাও।

শফির মুখে বিজয়ের হাসি। রশিদকে বললো, আমাদের মিশন সাকসেসফুল। ওরা যখন একশ আশিটা লাস দেখবে তখন নিশ্চয়ই আমাদের দশজনের শোক কিছুটা ভুলতে পারবে।

একটা বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে কাঠের ব্রিজটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। লরিগুলো উত্তরের রাস্তায় এগিয়ে চললো। রশিদ পেছনে তাকিয়ে দেখলো। মনে মনে বললো, বিদায় বন্ধুরা।

বাবলুরা মেশিনগানের অস্পষ্ট শব্দ শুনেছিলো। বুঝতে পেরেছিলো পাঞ্জাবিরা পৌঁছে গেছে। ওরা উদ্বিগ্ন ছিলো রশিদ আর শফির জন্যে। ওরা যদি আগে পৌঁছোয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট জিতবে, নইলে সবাই মারা পড়বে। হাসান বললো, ওরা হয়তো খবর পায়নি। পেলে নিশ্চয়ই সরে যেতো জয়দেবপুর থেকে।

বাবলু বললো, গুলির শব্দটা ওদেরও হতে পারে।

এক ঘন্টা পরে সব যখন আগের মতো নিশ্ৰুপ, তখন ওরা ট্যাঙ্ক বেরোতে দেখলো। একটা ট্যাঙ্ক আর তার পেছনে কয়েকটা লরি জয়দেবপুরের দিকে বেরিয়ে গেলো।

বুড়ো হাবিলদার মেজর এলেন কিছু পরে। চুপিচুপি বললেন, ওরা সম্ভবত মার খেয়েছে। এইমাত্র বিশ লরি সৈন্য আর ট্যাঙ্ক নিয়ে ওরা জয়দেবপুর গেলো। কামানও নিয়েছে সঙ্গে।

ট্যাঙ্ক ব্রিজ পর্যন্ত গিয়ে আর এগুতে পারলো না। এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়লো বহুক্ষণ। বাবলুরা সেই শব্দ শুনলো। কেউ বুঝতে পারলো না ওরা জয়দেবপুরে কি ঘটছে। সবাই ভোর হওয়া পর্যন্ত জেগে রইলো। সবার মনে গভীর উৎকণ্ঠা।

পাঁচটার সময় প্যারেড গ্রাউন্ডে ডাক পড়লো। ওরা দেখলো কালকের মতো সারি সারি লাস। রক্তাক্ত শরীর। সবাই পাঞ্জাব রেজিমেন্টের। বাবলু গুনলো। গুনে আশ্চর্য হলো, একশ আশিটা লাস। একজনও বাঁচতে পারেনি। গত দিনের কথা মনে হলো বাবলুর। চোয়ালটা শক্ত হয়ে গেলো।

.

১০.

প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে বাবু শুধু মৃত্যুর পর মৃত্যু দেখে যাচ্ছিলো। ঘর থেকে পথে বেরুলেই মৃত্যুর মহড়া। যেখানে সেখানে মৃত্যুর দৃশ্য। ঘরে থাকলে মৃত্যুর শব্দ। অসংখ্য মৃত্যুর দৃশ্য আর শব্দ বাবুকে সারাক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখলো। বাবু কিছুই ভাবতে পারছিলো না। প্রতিদিনের এই অসংখ্য মৃত্যু আমাদের সময়কে কোন ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নিচ্ছে? কত দিন চলবে ধ্বংস আর মৃত্যুর এই নারকীয় তাণ্ডব? কবে আসবে সেই মুক্তি স্বাধীনতা যার নাম?

প্রশ্নের পর প্রশ্নের চাবুক ওকে রক্তাক্ত করলো। কোন জবাব খুঁজে পেলো না। ওর চিন্তা করার শক্তিও ধীরে ধীরে কমে যেতে লাগলো। বাবুর মনে হলো এভাবে চলতে থাকলে ও ঠিক মরে যাবে।

রোজ কারফিউ তুলে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে পথে বেরিয়ে পড়ে বাবু। দুএকটা গাড়ি চোখে পড়ে, বেশির ভাগই বিদেশীদের। মানুষ যারা পথ চলছে তারা সবাই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ওদের সকলের চোখে মৃত্যুর ছায়া। বাড়িগুলোতে ধ্বংসের ছাপ। মর্টারের আর ট্যাঙ্কের গোলায় ক্ষত-বিক্ষত। কতগুলো ছাইয়ের স্থূপে পরিণত হয়েছে। পোড়ামাটির বুকে ঝলসানো গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে কঙ্কালের মতো।

প্রতিদিন একই দৃশ্য। হাঁটতে হাঁটতে বাবু কখনও চলে যায় টিকাটুলির দিকে। কখনও শাজাহানপুর, কখনও ধানমণ্ডির দিকে। বন্ধুদের খুঁজে বেড়ায়। সবখানে হতাশার তালা ঝুলছে। রাজারবাগ মিনুদের বাড়ি গিয়ে বাবু আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলো। সারা বাড়ি জুড়ে ধ্বংস আর মৃত্যুর ছাপ। ভেতরটা গুঁড়ো হয়ে গেছে। বন্ধুরা কেউ নেই। এভাবেই সে নিঃসঙ্গ হয়ে গেলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো অথবা রানার-এর সুন্দর সময়গুলো ফ্যাকাশে হয়ে হারিয়ে যেতে লাগলো। মনে হলো কখনও বহুযুগ আগে তার জীবনে এমন কোন সুন্দর সময়ের অস্তিত্ব ছিলো। যাকে আর কোনদিন ছোঁয়া যাবে না। ধরা ছোঁয়ার বহুদূরে চলে গেছে সেই সুন্দর দিনগুলো।

ভাবী হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে। অথচ বাড়িতে এতটুকু আনন্দ নেই। বাবা শুধু চেয়ে দেখেন। বাচ্চাটা গলা ফাটিয়ে কাঁদে। এতটুকু গুলির শব্দ হলেই চিৎকার করে কাঁদে। বাবু ভেবে পায় না ছোট্ট বাচ্চাটা গলায় এত জোর কোথায় পেলো। বাবুর মনে হয় ও এক ভীষণ দুঃসময়ের জাতক, যে প্রতি মুহূর্তে সেই সময়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে চলেছে। বাবা ওর নাম রেখেছেন বহ্নি।

বাবু ভাবে বহ্নি যে দিন বড় হবে ও কি মনে রাখবে, কি এক দুঃসময়ে ও জন্মেছিলো? ওদের কাছে সব গল্পের মতো মনে হবে।

পঁচিশে মার্চের পর আরো সাত দিন কেটে গেছে। এখনো সময় এতটুকু বদলায় নি। বরং আরো ছড়িয়ে পড়েছে। শহর থেকে শহরতলিতে, সেখান থেকে মফস্বল শহরে। যেখানেই পাঞ্জাবি সৈন্যরা হানা দিয়েছে সেখানেই ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা। স্থানীয় অবাঙালিরা মহা উল্লাসে বাঙালিদের হত্যা করছে। ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে জামাতে ইসলামী আর মুসলিম লীগের লোকেরা। বাঙালি মাত্রই ওদের কাছে অধার্মিক, কাফের। এদের হত্যা করাটাকে ওরা সওয়াবের কাজ বলে মনে করছে।

ধর্মকে বাবু কোনদিন সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। মামুনকে বলেছে, যতদিন মানুষ এ ধরনের কুসংস্কারের দেয়াল ভেঙে বাইরে না আসতে পারবে, ততদিন ওরা এমনিভাবে অসহায়ের মতো মরতে থাকবে।

মামুনদের পল্লবীর বাড়ি বিহারী মোহাজেররা লুট করে নিয়েছে। কোন রকমে ওরা প্রাণে বেঁচে উঠেছে কলাবাগানের স্টাফ কোয়ার্টারে, এক আত্মীয়ের ফ্ল্যাটে ।

সেদিন মামুনের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালো বাবু। মামুন রীতিমতো উদ্দীপ্ত। বিভিন্ন জায়গায় মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যের যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের খবর শোনালো মামুন। বললো, সুযোগ পেলেই আমি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবো। শুধু যোগাযোগের অপেক্ষা করছি।

দুপুরের পর বাড়ি ফিরলো বাবু। এসে দেখে মেজদা ওর ঘরে বসে আছেন। বাবুকে দেখে বললেন, চলে এলাম বাবু। কদিন তোমাদের এখানে আত্মগোপন করে থাকতে হবে।

বাবু একটু অবাক হলো! বড়দার মতো মেজদাও কমিউনিস্ট পার্টি করেন। বাবু বললো, বড়দা কোথায় মেজদা?

মেজদা ওর দিকে তাকালেন–বড়দার খবর শোননি? ওঁদের পত্রিকা অফিস পুড়িয়ে দিয়েছে। বড়দা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছেন।

বাবু আর কোন কথা বললো না। লেখার টেবিলে চুপচাপ বসে রইলো। মেজদা ওর বইয়ের আলমারি থেকে বই বাছছিলেন। বললেন, এ সব বই সরিয়ে ফেলল। ওরা বাড়ি বাড়ি সার্চ করছে। এ ধরনের বই পেলে বিপদ হবে।

ভাবী ডাইনিং রুম থেকে ডাকলো–বাবু, খেয়ে এসেছো?

বাবু বললো, না।

তাহলে মেজদাকে নিয়ে খেতে এসো।

মেজদা বললেন, চল বাবু।

ডাইনিংরুমে বাবা, ভাইয়া, হিমি আর ভাবী খেতে বসেছে। বাবা বাবুকে বললেন, কোথায় ঘুরিস বলতো? কোনদিন কোথায় মরে পড়ে থাকবি। কেউ জানতেও পারবে না।

বাবু ভাবলো, আমিতো মরেই গেছি। এর নাম কি বেঁচে থাকা? বেঁচে থাকার মানে কি এই ভয়াবহ শূন্যতা। যেদিন ওরা মিনুদের বাড়িটাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে, যেদিন মিনুর মতো অসংখ্য মানুষ হারিয়ে গেছে, সেদিন থেকেই আমি মরে গেছি। মরে আছি বলেই আমি প্রতিশোধ নিতে পারিনি।

মেজদা বললেন, বাবু অত ভেঙে পড়বে চলবে কেন? আমাদের আরো কঠিন সময়ের জন্যে তৈরি হতে হবে।

বাবা খেতে খেতে মেজদাকে বললেন, তাহলে তুই বলছিস, শেখ মুজিবকে ওরা সত্যিই এ্যারেস্ট করেছে?

মেজদা মাথা নেড়ে সায় জানালেন–প্রথম রাতেই এ্যারেস্ট করেছে।

তবে যাই বলিস, এভাবে ধরা দেয়াটা মুজিবের আদৌ উচিত হয়নি। বাবা নিজের মত প্রকাশ করলেন–মুজিব ছাড়া আওয়ামী লীগ একেবারেই অচল।

ভাইয়া বলল, কাল আমাকে জামান সাহেব বললেন, শেখ মুজিব ধরা না দিলে আর্মি গোটা ঢাকা শহর একেবারে ধ্বংস করে দেবে বলেছিলো।

ধ্বংসের আর বাকি রইলো কী? বাবা উত্তেজিত হলেন–কি ছিলো শহরটা, কি হয়ে গেলো। ভাবতেই আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। এতোদিন খবরের কাগজে পড়েছি ভিয়েৎনাম আর কম্বোডিয়ার কথা। এর চেয়ে ভয়াবহ। কিছু যে আমাদের দেশে ঘটবে, কোনদিন কি ভাবতে পেরেছিলাম?

ভাবী বললো, ওরা যে এতটা করবে শেখ মুজিব সেটা বুঝতে পারেননি।

বাবা ক্ষুব্ধ গলায় বললেন, ইয়াহিয়াকে তিনি কি করে এতটা বিশ্বাস করতে পারলেন, আমি ভাবতেই পারছি না। তিন তারিখে অনায়াসে তিনি এ্যাসেম্বলির সেশন ডেকে শাসনতন্ত্র পাশ করতে পারতেন। সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা তার দলের ছিল। অনায়াসে স্বাধীনতা ঘোষণা করে প্রস্তুতি নিতে পারতেন।

ভাবী বললো, আসলে শেখ মুজিব বড়ো বেশি ভালোমানুষ। এতো ভালোমানুষ দিয়ে পলিটিক্স হয় না।

ন্যাপ-এর খবর কী? মেজদার কাছে জানতে চাইলেন বাবা।

মেজদা বললেন, নেতারা তেইশ তারিখেই আন্ডারগ্রাউন্ড চলে গেছেন। তবে মওলানা ভাসানীর কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। কাজী জাফরদের এক ছেলে বললো তিনি নাকি টাঙ্গাইলেও নেই।

বাবা বললেন, ন্যাপ কি মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগে সঙ্গে সহযোগিতা করবে?

কেন করবে না? মেজদা বললেন, ন্যাপ অসহযোগের সময় থেকেই আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে আসছে। এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা ভাবা ঠিকও হবে না। এই যুদ্ধকে, আমাদের উচিত হবে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে টেনে নেয়া। আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক বিপ্লব ছাড়া সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলা ভুল হবে।

ভাইয়া বললো, মেজদা কী করবেন, কিছু ঠিক করেছেন?

মেজদা বললেন, একবার কোলকাতা যাবো ভাবছি। বাইরের দেশগুলোর অবস্থা জানা দরকার। ভারতের মনোভাব জানাটা বেশি দরকার।

খাবার পর সবাই ড্রইংরুমে গিয়ে বসলো। ভাবী রেডিও ঘোরাতে ঘোরাতে বললো, ঢাকার রেডিয়ো স্টেশনে অসম্ভব ডিসটার্ব হচ্ছে।

ভাইয়া বললো, স্বাধীন বাঙলা বেতার থেকে বলেছে সাভারে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাক সৈন্যের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছে। আমার মনে হয় সাভারে অয়ারলেস সেন্টারের কোন ক্ষতি হয়েছে।

মেজদা বললেন, আমার কী মনে হয় জানো? বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইপিআর এরা যে যুদ্ধ করছে তা সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে। নেতাদের কোন নির্দেশ এরা পায়নি। পঁচিশে মার্চেও যদি ওরা খবর পেতো তাহলে এভাবে অন্তত ঢাকার পতন ঘটতো না।

ভাইয়া ভুরু কুঁচকে বললো, পঁচিশ তারিখে কি করে সম্ভব হতো! অবশ্য সাত তারিখে যদি রমনার মিটিঙের পাঁচ লাখ লোক ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতো, তাহলে হয়তো একটা কিছু হতো। সেদিন বাবলুও তাই বলছিলো।

মেজদা বললেন, কি করে হতো বলছি। আওয়ামী লীগ আর ন্যাপ-এর মুক্তি সংগ্রাম কমিটির স্বেচ্ছাসেবক কত হবে বলে মনে করো? শুধু ঢাকা আর তার আশেপাশে?

ভাইয়া একটু ভেবে বললো, ষাট সত্তর হাজারের মতো হবে।

মেজদা বললেন, পঞ্চাশ হাজারই ধরো। ক্যান্টনমেন্ট থেকে সে রাতে ট্যাঙ্ক নামবে এ কথা নেতারা জানতেন। যে জন্যে ব্যারিকেডও দিতে বলা হয়েছিলো। সেই সঙ্গে কি পাল্টা আক্রমণের ব্যবস্থা নেয়া যেতো না? সারাদিন পঞ্চাশ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে একত্রিত করে এয়ারপোর্ট রোড থেকে শুরু করে শহরের প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কোথাও দুই কোথাও পাঁচ হাজার করে ছড়িয়ে রাখা যেতো। জয়দেবপুরে যে বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর এক কোম্পানি সৈন্য ছিলো, ওরাই ঢাকার যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারতো। বেরুবার মুখেই ওরা বাধা পেতো। এমনিভাবে প্রতিপদে ওদের যদি বাধা ডিঙিয়ে এগুতে হতো, তাহলে ভাবো, শেষ পর্যন্ত ওদের শক্তি কতখানি অবশিষ্ট থাকতো! জয়দেবপুরে মর্টার রকেট লাঞ্চার সবই ছিলো। ক্যান্টনমেন্ট উড়িয়ে দেয়ার জন্যে সে সব যথেষ্ট। দক্ষিণে থেকে ইপিআর উত্তর থেকে বেঙ্গল রেজিমেন্ট যৌথ আক্রমণ চালালে ওদের অবস্থা কি হত একবার ভাবো। কয়েকটা ট্যাঙ্ক উড়িয়ে দিলেই ওরা অচল হয়ে যেতো। যুদ্ধ চলার সময় রেডিয়োতে শুধু একটা ঘোষণা দিলেই হতো সবাই ঢাকার দিকে মার্চ করো। এরপরও কি ঢাকা পাঞ্জাবি সেনাদের দখলে থাকতে পারতো? প্রত্যেকটা ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি সৈন্যরা উদগ্রীব হয়ে নির্দেশের অপেক্ষা করছিলো। শেষে ওদের নিরস্ত্র হয়ে পালিয়ে বাঁচতে হলো। এর জন্যে কি নেতারা দায়ী নন?

কথা বলতে বলতে মেজদা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বাবু এক কোণে বসে শুনছিলো। মেজদার কথা শুনে মনে হয় না আমাদের ক্ষমতা সীমিত। মেজদার সঙ্গে কথা বললে মনোবল অনেকখানি বেড়ে যায়। আবার যখন রাতে অন্ধকার নামে, বিছানায় শুয়ে যখন রাইফেলের গর্জন আর মৃত্যুর আর্তনাদে আহত হয়, তখন ও হতাশায় ভেঙে পড়ে। এখনও শহরে আগুন জ্বলে। রাতের অন্ধকারে শয়তানরা হিংস্র থাবা মেলে অসহায় শহরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যন্ত্রণার চাবুক বাবুর সমস্ত চেতনাকে অবিরাম রক্তাক্ত করে।