সকালে মেজর বেগকে নিয়ে মামুন শহরে বেরুলো। সেগুন বাগানের মোড়ে এসে বাবু জিপ থেকে নেমে গেলো।
সেজদি পুরানা পল্টনের একা বাড়িতে ঠিকানা দিয়েছিলো। নম্বর মিলিয়ে একটা গলির ভেতর আবিষ্কার করলো বাড়িটাকে। পুরনো আমলের রঙওঠা একতলা বাড়িটা। ভেতরে কেউ আছে কি না বাইরে থেকে বোঝার বিন্দুমাত্র উপায় নেই।
সেজদির কথা মতো বাবু দরজায় কলিং বেল প্রথমে দুবার তারপর তিনবার টিপলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। কাঠের দরজার শাটার্স খুলে একজন তাকে দেখলো। ভেতরে খবর দিতে গেলো। একটু পরে সেজদি এসে দরজা খুললো। বাবুকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে আবার দরজা বন্ধ করে দিলো।
প্রায় অন্ধকার ছোট্ট একটা ঘরে ওকে নিয়ে সেজদি বসলো। বললো, খবর বল।
বাবু পকেট থেকে নকশাটা বের করে দিলো। কাল সারারাত জেগে তৈরি করেছে সেটা। কাঠামোটা ক্যাপ্টেন বেগ-এর ম্যাপ থেকে নকল করেছে। দক্ষিণে কিছু নতুন এনেশন ডাম্প চিহ্নিত করা আছে ওতে। বাবু বললো, উত্তর আর উত্তর-পশ্চিমের ডাম্পগুলো পরে দিচ্ছি।
সেজদি উত্তেজিত গলায় বললো, স্কেল ঠিক আছে তো?
বাবু হাসলোওদের নিজেদের ম্যাপ থেকে ট্রেস করেছি। ভুল হওয়া উচিত নয়।
নকশাটা দেখতে দেখতে সেজদির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বললো, খুব প্রম্পট কাজ করেছিস। অন্য কোন খবর আছে?
বাবু বললো, সিএনসি হামিদ খান আজ বিকেলে সাড়ে চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে এসে যাবে। গোপন সফর এটা। কাগজে কয়েক দিন পরে জানানো হবে।
সেজদির ভুরু দুটো কুঁচকে গেলো–কি জন্যে আসছে সে সম্পর্কে কিছু জানিস?
বাবু বললো, সরেজমিন তদন্ত করার জন্যেই আসছে। তবে অপারেশনটা এরা যে ভাবে চালিয়েছিলো, সিএনসি সেটা পছন্দ করবে না এটা বোঝা গেলো। তাই নতুন করে কাগজ-পত্র তৈরি করা হচ্ছে। জেনারেলকে ওরা দেখাতে চাইছে, ঢাকা শহর শান্ত আর স্বাভাবিক রয়েছে। গণ্ডগোল কিছু হচ্ছে, তবে সে সব বর্ডারে। ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী আর তার দালালরা সেখানে গণ্ডগোল বাঁধিয়ে রেখেছে।
সেজদি গম্ভীর হয়ে গেলো –তোর এ খবর কতখানি নির্ভরযোগ্য?
বাবু বললো, কাল রাতে বহুক্ষণ মেজর মুস্তফা আর মেজর বেগ এ নিয়ে আলাপ করছিলেন। আমি আর মামুন পাশের ঘরে শুয়েছিলাম।
ছোড়দি মাথা নেড়ে জানালো–এ ধরনের সোর্স অবশ্য রিলায়বল। কত দিন ওরা জেনারেলের ঢাকা থাকা গোপন রাখবে?
বাবু হিসেব করে বললো–অন্তত চার দিন। প্রোগ্রাম থেকে তাই বুঝেছি। বুধবারের আগে কাউকে জানাবে না।
কী যেন ভাবলো সেজদি। তারপর বললো–তুই মঙ্গলবার এগারোটার সময় একবার আয়। আমি এক্ষুণি বেরুচ্ছি।
সেজদির সঙ্গে বেরিয়ে এলো বাবু। বাড়িতে লোকজন আরো অনেকেই ছিলো। বাবু ওদের কাউকে দেখতে পেলো না। শুধু চলাফেরা থেকে বুঝলো এ বাড়ির সবাই অত্যন্ত সন্তর্পণে চলাফেরা করে।
পল্টনের মোড় পর্যন্ত ওরা একসঙ্গে এলো। তারপর সেজদি গেলো পুরনো ঢাকার দিকে। বাবু দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। সেজদিকে দেখলো। পরনে আধময়লা একটা মিলের শাড়ি। কাঁধে ঝোলানো একটা কাপড়ের ব্যাগ। তেল না দেয়া চুলগুলো এলোমেলো বাতাসে উড়ছে। দ্রুতপায়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে সেজদি।
বাবু আগে প্রায়ই ভাবতো–সেজদি অমন হয়ে গেলো কেন? স্কুল কলেজে খেলার মাঠে, নাটকের মঞ্চে যে সেজদির নাম সবার মুখে মুখে ফিরতো, তার সঙ্গে এই মাত্র চলে যাওয়া সেজদির কোন মিল নেই। হঠাৎ করেই, সেজদি ওদের কাছে কেমন একটা কুয়াশার মতো হয়ে উঠেছিলো।
পার্টি নিষিদ্ধ বলে বড়দা ন্যাপ-এর হয়ে কাজ করেন। আগে বড়দা বহুবার জেল খেটেছিলেন। বড়দার মতো না হলেও ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে মেজদাও কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িত। তারপর লেখা আর ছবি বানানোতে ব্যস্ত রইলেন। ইদানিং আবার রাজনীতিতে উৎসাহিত হয়েছেন। ওদের কারো সঙ্গে সেজদির মিল নেই। বড়দার কাছে একদিন শুনেছিলো, সেজদিরা নাকি চরমপন্থী, বড়দা ওদের লাইন ঠিক মনে করেন না।
ক্যান্টনমেন্ট ফেরার পথে দুটো চেকপোস্টে বাবুকে আটকালো। জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাবে। মেজর মুস্তফার নাম শুনে ছেড়ে দিলো। ঘরে না গিয়ে বাবু সোজা ক্যাপ্টেন করিমের কোয়ার্টারে চলে এলো।
ড্রইংরুমে বসে কি যেন ভাবছিলেন ক্যাপ্টেন। হাতে সিগারেট ধরা। এ্যাশট্রেতে আধাপোড়া সিগারেটের স্তূপ। রেডিয়োতে অত্যন্ত মৃদুশব্দে আকাশবাণীর দেশাত্মবোধক গান বাজছে। বাবুকে দেখে একটু হাসলেন–এসো। খবর ভালো তো?
বাবু ভেতরে গিয়ে বসলো। বললো–সিএনসি আসছে খবরটা এরা গোপন রাখছে কেন?
আধপোড়া সিগারেটটা এ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে ক্যাপ্টেন বললেন, সাডেন ভিজিটে আসছেন। এরা এখনো তৈরি হয়ে ওঠেনি। জেনারেলের নিরাপত্তার জন্যেই এটা করা। তাছাড়া খবরটা গোপন থাকলে জেনারেল অনেক ফ্রি চলাফেরা করতে পারবেন।
বাবু একটু অবাক হলো–ক্যান্টনমেন্টেও তার নিরাপত্তার অভাব! এখানে সবই তো ওদের লোক?
ক্যাপ্টেন মৃদু হাসলেন–কে বললে সব ওদের লোক। বেলুচ রেজিমেন্ট রীতিমতো অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। ওরা এ ধরনের অপারেশন চালাতে চাইছে । কোথাও কোথাও পাঞ্জাবিদের সঙ্গে ওদের ছোটখাটো সংঘর্ষও হয়ে গেছে।
বাবু চমকে উঠলো–বেলুচরা বিদ্রোহ করেছে?
ক্যাপ্টেন বললেন, ঠিক বিদ্রোহ এখনো ঘোষণা করেনি। পাকিস্তানের প্রতি ওদের আনুগত্য আছে। তাদের বক্তব্য, নিজের দেশের অসহায় মেয়ে পুরুষ শিশুদের মারা চলবে না। তারা বলছে সৈন্য হচ্ছে বিদেশী শত্রুকে মোকাবেলা করার জন্যে। নিজের দেশের মানুষ মারার জন্যে নয়।
বাবু বললো, আদেশ অমান্য করলে কোর্ট মার্শাল হবে না?
ক্যাপ্টেন বললেন, অসন্তোষ সকলের ভেতরে। সবার তো কোর্ট মার্শাল সম্ভব নয়। পরে হয়তো কারো কারো হবে।
বাবু চুপ করে রইলো। ক্যাপ্টেন কিছুক্ষণ পর নিচু গলায় বললেন, তোমার ইনফরমেশনের জন্যে একটা কথা বলছি। সিএনসিকে ওরা দেখাতে চায় সব কিছু শান্ত আর স্বাভাবিক আছে। বুধবার পর্যন্ত ওরা শান্তি রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। এর ভেতর ক্যান্টনমেন্টের আশে পাশে যে কোন এ্যাকশনই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হবে। সিএনসি তাহলে বুঝবে অবস্থাটা যত স্বাভাবিক দেখানো হচ্ছে আসলে তা নয়।
বাবু মাথা নেড়ে সায় জানালো–সেজদিকে বলবো।
ক্যাপ্টেন-এর কোয়ার্টার থেকে বাবু মেজর মুস্তফার বাড়িতে এলো। দেখলো মেজর বেগ শহর থেকে ফিরেছেন। তাকে আরো বেশি বিষণ্ণ মনে হলো। চুপচাপ সোফায় বসে আছেন। হাতের চুরুটটা কখন নিভে গেছে খেয়াল নেই। বাবুর দিকে তাকালেন নিবর দৃষ্টিতে। বাবু বললো, ঢাকা কেমন দেখলেন?
ম্লান হাসলেন মেজর-না দেখলেই ভালো হতো। আমি এমন দৃশ্য দেখবো কল্পনাও করিনি। একটু থেমে আপন মনে বললেন, আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও দেখেছিলাম।
বাবু কিছুক্ষণ কোন কথা বলতে পারলো না। মামুন বললো, টেবিলে তোমার খাবার দেয়া আছে। খেয়ে নাও। আমরা মুস্তফা চাচার সঙ্গে খেয়ে নিয়েছি।
বাবু প্রশ্ন করল, মুস্তফা চাচা কোথায়?
ডিউটিতে গেছেন। মৃদু গলায় জবাব দিলেন মেজর বেগ–আজ সিএনসি আসবেন। সেজন্যে তিনি খুব ব্যস্ত।
বাবু লক্ষ্য করলো শুধু মেজর মুস্তফা নয়। সবাই ব্যস্ত। রাস্তায় ব্যস্ত গাড়ির আনাগোনা। অফিসারদের ব্যস্ততা। টিক্কা খানের নির্দেশ সিএনসিকে সব স্বাভাবিক দেখাতে হবে। সিএনসি যেন বুঝতে পারেন, ইণ্ডিয়ান রেডিয়ো মিথ্যে ছাড়া সত্য কিছুই বলে না।
.
১৭.
অথচ শহরে কিছুই স্বাভাবিক ছিলো না। সারা ঢাকা এক আতঙ্কের শহর। মুক্তিবাহিনী শহরে হ্যান্ডবিল ছড়িয়েছে, ক্যান্টনমেন্ট, এয়ারপোর্ট, রেডিয়ো সেন্টার, গভর্নর হাউস এবং অন্যান্য সামরিক ছাউনি থেকে সবাই যথাসাধ্য নিরাপদ দূরত্বে থাকুন। মুক্তিযোদ্ধা আপনার আশে পাশেই আছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ট্রেন চলাচল একেবারে বন্ধ। খবর এলো লঞ্চও বন্ধ হয়ে গেছে। চলতি লঞ্চের ওপর পাঞ্জাবিরা গুলি ছুঁড়েছে। কেউ লঞ্চ স্টীমারকে নিরাপদ মনে করছে না।
সবচেয়ে অনিরাপদ হচ্ছে কোচ সার্ভিসের বাসগুলো। বাস থেকে যাত্রীদের নামিয়ে ধরে জোর করে রক্ত নিয়ে যাচ্ছে। শরীরের সমস্ত রক্ত শুষে নিয়ে জ্ঞানহীন দেহটাকে নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছে। রক্ত ওদের ভীষণ দরকার। কমবাইন্ড মিলিটারী হসপিটালে এতোটুকু জায়গা নেই। শহরের হাসাতালগুলো আহত পাঞ্জাবি সৈন্যে ভরে আছে। সাধারণ হাসপাতালেও কোন জায়গা নেই। আহতদের এখন পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কে এক ফোঁটা রক্ত নেই। আহত সৈন্যদের দিতে দিতে বহু আগেই সব শেষ হয়ে গেছে। রক্তের জন্যে ওরা ব্লাড হাউন্ডের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ইমার্জেন্সি মেডিকেল স্টেশন। যাকে হাতের কাছে পাচ্ছে তারই রক্ত নিচ্ছে। রক্ত নেয়ার কোন সীমা নেই। ইচ্ছে মতো নিচ্ছে। সারা শহরে রক্তলোলুপ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
সিএনসি হামিদ খানের এ সব জানার কথা নয়। তাঁর কানে যাতে এ সব না যায়, ঢাকার সামরিক কর্তৃপক্ষের সে জন্যে চেষ্টার অন্ত নেই। জেনারেল টিক্কা খানের ব্যর্থতা আগেই ধরা পড়ে গেছে। জেনারেলদের কনফারেন্সে টিক্কা খান কথা দিয়েছিলেন, বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে অবস্থা আয়ত্তে নিয়ে আসবেন। বাহাত্তর ঘন্টায় কিছুই হলো না। তারপরে বললেন সাত দিন। তারও পরে বললেন একুশ দিন। অবস্থা শুধু দিনের পর দিন খারাপের দিকে যেতে লাগলো। টিক্কা খানের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত–খুব শিগগিরই হবে। কারণ এর চেয়েও ভয়াবহ অপারেশন চালাতে তিনি প্রস্তুত আছেন। যে ভাবেই হোক অবস্থা আয়ত্তে আনতেই হবে।
প্রেসিডেস্টের শেষ নির্দেশ টিক্কা খানের পরিষ্কার মনে আছে। পাঁচিশে মার্চ ঢাকা থেকে যাবার আগে প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন–আই ওয়ান্ট নো ম্যান অন দিস ল্যান্ড। আই ওয়ান্ট অনলি দা ল্যাণ্ড। যে কোন মূল্যেই হোক বাংলাদেশের মাটিটুকু হাতছাড়া করা যাবে না। টিক্কা খান সবে মাত্র সি অপারেশন চালিয়েছেন। এর চেয়ে ভয়াবহ বি অপারেশনের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বি অপারেশন যদি ব্যর্থ হয়, এ অপারেশন চালাবেন। প্রেসিডেন্টের তাই নির্দেশ।
বাইরের দেশগুলোকে অবশ্য বলা হচ্ছে–একটু বেশিই হয়ে গেছে। এ ছাড়া উপায় ছিলো না। হিন্দুস্থানের গুপ্তচরে দেশটা ছেয়ে গেছে। অবস্থা এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। সকাল থেকে রাত অবধি সারাক্ষণ তারস্বরে চেঁচিয়ে ঢাকা রেডিয়ো টিক্কা খানের বাণী প্রচার করছে।
অবস্থা যে কতখানি খারাপ, সবচেয়ে ভালো জানেন টিক্কা খান নিজে। কনফারেন্স রুমের এয়ার কণ্ডিশনড় হলে বসে ঠাণ্ডা মাথায় তিনি নতুন অপারেশনের কথা ভাবছেন। সঙ্গে রয়েছেন জেনারেল ওমর আর জেনারেল মিটঠা খান। সিএনসিকে বাঝানো হচ্ছে, যে কোন মূল্যে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী আর এদেশী দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে দেশটাকে রক্ষা করতে হবে। দেরি না করে বি অপারেশন চালানো দরকার, এ কথা প্রত্যেক জেনারেলই ভাবছেন।
অফিসারদের ছুটোছুটির অন্ত নেই। মেজর মুস্তফা খাবার সময়টুকুও পাচ্ছেন না। ইমার্জেন্সির জন্যে মেজর বেগ-এর বদলির হুকুম বাতিল হয়ে গেছে। তাঁকে বলা হয়েছে চট্টগ্রাম ফিরে যেতে। একবারে ভেঙে পড়ছেন মেজর বেগ। যুদ্ধের ওপর তার ভীষণ ঘৃণা। মামুনকে বলছিলেন, অফিসারদের ডেডবডিগুলো পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমাকে লাস হয়েই সেখানে যেতে হবে। জীবিত অবস্থায় ফিরে যাবার কোন সম্ভাবনাই নেই। কখনো তিনি বেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপরও ক্ষেপে যান–কেন ওরা এমন করলো বলতে পারো। মেজর জিয়াকে তো আমি দেখেছি। যে সব অফিসারদের জুতোর ফিতে বাঁধার জন্যেও আলাদা এ্যাটেন্ডেন্টস ছিল সারাক্ষণ, খাবার টেবিলে দশ বারোটা আইটেমের কম থাকলে যারা বিরক্ত হতেন, সে সব অফিসার বনে জঙ্গলে কাদাপানিতে ঘুরছেন পলাতকের মতো। কতদিন খেতে পাচ্ছেন না কে জানে। আমি একজন সৈন্যকে দেখেছি, জামা কাপড় ছিঁড়ে ফালা ফালা হয়ে গেছে। মুখে দাড়ি গজিয়েছে। খেতে পায়নি অনেক দিন। তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না, দেখে আমার কি খারাপ লেগেছিলো। আবার যখন একেবারে অসহিষ্ণু হয়ে পড়েন তখন রীতিমতো ক্ষেপে যান–আমাদের জেনারেলরা যা করছেন, যা ভাবছেন, সভ্যতার ইতিহাসে এর নজির নেই। আমি জানি এ সব বলা ঠিক নয়! তবু তোমার কি মনে হয় এর শাস্তি থেকে এরা বাঁচাতে পারবেন? এ দুনিয়ায় না পেলে আল্লার দরবারে ওদের বিচার হবে। একদিন সেখানে জবাবদিহি করতে হবে, কেন অকারণে এতোগুলো মানুষকে মারা হয়েছিলো।
মেজর বেগ-এর বিষণ্ণতা মামুনকে প্রভবিত করে। ওর মনে হয় লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের মূল্যে স্বাধীনতা আসছে। শুধু কি স্বাধীনতার জন্যে সাড়ে সাত কোটি মানুষ লড়াই করছে? শুধু স্বাধীনতা নয়। পুরো সমাজব্যবস্থাটাই পাল্টাতে হবে। স্বাধীনতার পর আবার আগের অন্ধকারে ফিরে যেতে চাই না। যে শোষণের কারণে মানুষ হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে, সেই শোষণমুক্ত সমাজ প্রয়োজন আমাদের। যদিও এর জন্যে অনেক বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে। তবু মামুন আশাবাদী–এ দেশের সাধারণ মানুষ অস্ত্রের ব্যবহার শিখেছে।
বাবু সেজদির সঙ্গে দেখা করার জন্যে গিয়েছিলো পুরানা পল্টনের সেই বাড়িটায়। দরজায় আগের মতো শব্দ করলো। সেজদি ওকে আগের মতো ভেতরে নিয়ে বসালো। ক্যাপ্টেনের কথাগুলো সেজদিকে খুলে বললো বাবু।
সব শুনে সেজদি মৃদু হাসলোভদ্রলোককে যথেষ্ট বিচক্ষণ মনে হচ্ছে। তিনি ওখানে পড়ে রয়েছেন কেন?
বাবু বললো, বেরোতে পারছেন না বলে।
সেজদি কি যেন ভাবলো। তারপর বললো, আমরাও তাই ভেবেছি। আজ রাতেই আমাদের ছেলেরা ক্যান্টনমেন্টে অপারেশনে যাবে। ক্যাপ্টেনকে বলিস, তিনি যদি আসতে চান সন্ধ্যে সাড়ে ছয়টায় বাজারের কাছে বাস স্ট্যান্ডে যেন পায়চারি করেন। হাতে সিগারেট থাকবে। কখনো সেটা টানবেন না। তাহলেই আমাদের ছেলে তাকে চিনে নেবে। যা বলার বলে দেবে।
আবু অবাক হয়ে বললো, সেজদি সেটা একেবারেই অসম্ভব। ওদের ওপর কড়া নজর রাখা হয়েছে।
মাথা নাড়লো সেজদি–জানি। ক্যান্টনমেন্টে তুই আমাদের একটা চ্যানেল বটে। তবে এ রকম আরো চ্যানেল আছে। সে ব্যবস্থা আমিই করবো। তুই ওঁকে খবরটা পৌঁছে দিস।সেজদির কথা বাবুর বিশ্বাস হচ্ছিলো না। তবু ক্যাপ্টেনকে এসে বললো। কথাটা শুনে ক্যাপ্টেন বহুক্ষণ ভাবলেন। শেষে বললেন, বিপদের যথেষ্ট ঝুঁকি আছে। তবু আমাকে এ ঝুঁকি নিতেই হবে।
সারা রাত বাবু ঘুমোতে পারেনি। শুয়ে শুয়ে একটার পর একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনলো। তারপর মেশিনগানের একটানা গুলিবৃষ্টি। মুহূর্তের বিরতি না দিয়ে চার পাঁচটা মেশিনগান একনাগাড়ে গুলি বর্ষণ করলো। তারই ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটা বিস্ফোরণের শব্দ। একটা বেশ দূরে। সঙ্গে সঙ্গে সারা ক্যান্টনমেন্ট অন্ধকার হয়ে গেলো। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে।
মেজর বেগ আর মেজর মুস্তফা বারান্দায় বসেছিলেন। অন্ধকারে এক হাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। শেষে এক সময় বিস্ফোরণের শব্দ থামলো। কিছুক্ষণ কট কট করে মেশিনগানগুলোও থেমে গেলো। সারা ক্যান্টনমেন্টের ভৌতিক অন্ধকারের ভেতর শুধু কয়েকটা গাড়ি অনবরত ছুটোছুটি করতে লাগলো।
.
১৮.
সকালে অনেক দেরিতে বাবুর ঘুম ভাঙলো। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো দশটা। মুখ হাত ধুয়ে খাবার টেবিলে গেলো। ড্রইংরুমে মেজর মুস্তফা, মামুন, আর মেজর বেগ বসেছিলেন। মেজর মুস্তফার পরনে ইউনিফর্ম। বোধ হয় বাইরে যাবেন।
রইস বললো, স্যার সকালে কয়েকবার আপনার খোঁজ করেছিলেন।
বাবু ভুরু কুঁচকে তাকালো–চাচা কি বাইরে বেরোচ্ছেন?
রইস মাথা নাড়লো–বেরিয়েছিলেন। খুব সকালে কে একজন টেলিফোন করলো, সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন। ঘন্টাখানেক হলো ফিরেছেন।
বাবুর কথা শুনে মেজর মুস্তাফা খাবার ঘরে এলেন। বাবুকে বললেন, খাবার পর আমার বেডরুমে একবার এসো।
বাবু একটু অবাক হলো। মেজর মুস্তফার মুখটা বেশ গম্ভীর মনে হচ্ছে। কথাটা বলে মেজর আর দাঁড়ালেন না। বাবুও হাতটা মুছে তার সঙ্গে ঘরে ঢুকলো।
শুধু গম্ভীর নয়, অস্বাভাবিক রকম গম্ভীর মনে হলো মেজরকে। বাবু দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়ালো। বুকের ভেতর অজানা একটা ভয় ঢিবঢিব করতে লাগলো।
মেজর ওকে দেখলেন কিছুক্ষণ। মেজরের এ দৃষ্টির সঙ্গে বাবুর কিছুমাত্র পরিচয় নেই। অনেকগুলো প্রশ্নের ভেতর যে প্রশ্নটা ওর মনে সবচেয়ে বড় হয়ে আঘাত করলো–মেজর কি কিছু টের পেয়েছেন?
ইশারায় ওকে বসতে বললেন মেজর। আবার ওর দিকে তাকালেন। চোখে চোখ রেখে বললেন, ক্যাপ্টেন করিমকে তুমি চেনো কীভাবে?
বাবু ভীষণ রকম চমকে উঠলো–কোন ক্যাপ্টেন করিম? নিজেকে সামলানো জন্য ও সময় নিচ্ছিলো।
মেজর আগের মতো পূর্ণদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, যদি পরিচিত হয়, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট একজনই বাঙালি ক্যাপ্টেন করিম আছেন। তিনি তোমার পরিচিত।
না। নিজেকে সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিয়েছে বাবু–ক্যাপ্টেন করিম বলে কাউকে আমি চিনি না।
যেন একটা ধাক্কা খেলেন মেজর মুস্তফা–সত্যিই কি চেনো না? প্লীজ, আমাকে মিথ্যে বলো না।
বাবু আবার বললো, আমি তাকে চিনি না।
কিন্তু আমাদের লোক তোমাকে কাপ্টেন করিমের কোয়ার্টারে যেতে দেখেছে। মেজরের গলার স্বর কঠিন মনে হলো।
কক্ষণো নয়। বাবু প্রতিবাদ করলো–আমি কোন ক্যাপ্টেন করিমের কোয়ার্টার চিনি না।
মেজর সমান উত্তাপে বলে চললেন, মঙ্গলবার তুমি ট্রায়াঙ্গাল পার্কে চার ঘন্টা সময় কাটিয়েছে। সে সময় আমাদের লোক তোমাকে সন্দেহজনকভাবে জেনারেলদের পাচিলের কাছে ঘুরতে দেখেছে। এতো সময় ওখানে কাটানোর কারণটা কি?
নিজেকে বড়ো অসহায় মনে হলো বাবুর। গলাটা বার বার শুকিয়ে যাচ্ছে। বুকের ভেতর একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি ক্রামগত পাক খেতে লাগলো। বললো, পার্কে তো আমি প্রত্যেক দিন বেড়াতে যাই।
মেজর আরো কঠিন স্বরে বললেন, তোমার গতিবিধি সেদিন অত্যন্ত সন্দেহজনক ছিলো।
নিজেকে আর সামলাতে পারছিলো না বাবু। অসহায়ের মতো বললো, পার্কে আমি শুধু বেড়াতেই যাই । কিন্ত আপনি আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছেন কেন?
মেজর চোখে চোখ রেখে বললেন, কাল রাতে জেনারেলদের কোয়ার্টারের কাছে বোমা ফেটেছে। কয়েকজন নাইট গার্ড মারা গেছে। আমরা অনুমান করছি ক্যাপ্টেন করিম এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
বাবু বললো, আমাকে জড়াতে চাইছেন কেন?
মেজর বললেন, আজ সকালে ইনভেস্টিগেশন কমিটির জরুরি বৈঠক ছিলো। আমাকে ডেকেছিলো ওরা। তোমার সম্পর্কে যে রিপোর্ট সিকুরিটি গার্ড দিয়েছে, তা থেকে ওদের ধারণা জন্মেছে তুমিও এর সাথে জড়িত আছে। ওদের রিপোর্টে তোমার গতিবিধি অত্যন্ত সন্দেহজনক বলা হয়েছে।
আপনার কি ধারণা আমি এ ধরনের ঘৃণ্য কাজের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারি?
অন্যভাবে ভাবতে পারলে আমি খুশি হতাম। কিন্তু সন্দেহটা আমারও। ওদের রিপোর্টে ভুল তথ্য থাকতে পারে না।
আমাকে আপনার অবিশ্বাস কেন?
বিশ্বাস করার স্বপক্ষে আমার কোন যুক্তি নেই।
আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, যে যারা এ কাজ করুক, তারা নিশ্চয়ই ভারতীয় চর। কথাটা বলতে গিয়ে বাবলুর গলা এতোটুকু কাঁপলো না। শান্ত স্থির গলায় বাবু বলে গেলো–এটা আশা করি আপনার জানা আছে, পাকিস্তানকে এ মুহূর্তে তারাই বেশি করে চাইছে, যারা ভারতের অত্যাচারে দেশ ছেড়ে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে। আমি মোহাজেরদের কথা বলছি। প্রত্যক্ষভাবে আপনাদের সাহায্যের জন্যে কোন কাজ না করলেও আমি ওদেরই একজন, এ কথা ভুলে যাবেন না। পাকিস্তানের স্বার্থের জন্যে মোহাজেররা নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছে।
এ কথাগুলো বলার সময় অপরিসীম একটা ঘৃণা বাবুকে আচ্ছন্ন করে রাখলো। সে ঘৃণা তার সারা চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিলো। প্রত্যেকটি কথা, যার চেয়ে ঘৃণ্য কথা সে এ মুহূর্তে আর কিছু ভাবতে পারছিলো না, তাই তাকে বলতে হলো।
বাবুর এই ঘৃণা মেজরকে অন্যভাবে প্রভাবিত করলো। মেজর শান্ত গলায় বললেন, আমি জানি ভারতীয়দের তুমি ঘৃণা করো। এতোটা ঘৃণা হয়তো আমিও করি না। একটু বেশি ইমোশনাল বলেই তুমি ওদের এতো ঘৃণা করো। এখন মনে হচ্ছে, ক্যাপ্টেন করিমকে কোন রকমের সহযোগিতা তুমি করতে পারো না। ওরা তোমাকে সন্দেহ করেছিলো। আমি শুধু ওদের সন্দেহের কথাটাই তোমাকে বলেছিলাম। তোমার কথা ওদের বলবো। হয়তো তোমাকে তদন্ত কমিশনের মিটিং-এ ডাকতে পারে।
হাঁপ ছাড়তে গিয়েও বাবু পারলো না। বললো, ওদের মিটিং কখন?
মুস্তফা বললেন, তোমাকে বলবো কখন যেতে হবে। আমি এক্ষুণি বেরোচ্ছি।
মেজর মুস্তফা চলে গেলেন। মনের ভেতর উদ্বেগ থাকলেও বাবু এক অদ্ভুত ধরনের তৃপ্তি পেয়েছে মেজরের কথা থেকে। ওর কাজ তাহলে ও ঠিক মতোই করতে পেরেছে। সেজদি বলেছিলেন, যদি কখনো ধরা পড়িস মনে করিস তোর নিজের দোষেই ধরা পড়েছিস। কাদের সঙ্গে যোগোযোগ রাখিস ঘুণাক্ষরেও বলতে পারবি না।
ওদের অপারেশন তাহলে পুরোপুরি সফল হয়েছে। কমিশনের মিটিং-এ বাবু কি বলবে মনে মনে ভেবে রাখলো। নাটকটা আরো জমাতে হবে। মামুন সব শুনে কিছুটা ভয় পেয়ে গেছে। বললো, আমরা তাহলে আজই চলে যাই।
বাবু মাথা নাড়লো–এ মুহূর্তে যাওয়া ঠিক হবে না। ওরা সন্দেহ করবে। মেজর মুস্তফা কী বলে আগে দেখো।
বিকেলে মেজর মুস্তফা বললেন, তোমাদের কাল চলে যেতে হবে। কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোন সিভিলিয়ান এখানে থাকতে পারবে না।
ওরা একটু চমকালো। তবু বাবুর মনে হলো, এটাই ভালো। বললো, কখন যাবো?
মেজর ম্লান গলায় বললেন, যদি এক্ষুণি যেতে চাও আমি আপত্তি করবো না।
মামুন বললো, যেতেই যখন হবে দেরি করে লাভ কী?
মেজর হাসলেন। এ হাসির সঙ্গে তাঁর আগের হাসির বিন্দুমাত্র মিল নেই। বাবুর পিঠে হাত রেখে মুস্তফা বললেন, তোমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার জন্যে আমি খুবই দুঃখিত। কমিশন আমাকে অভিযুক্ত করেছিলো বলেই ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। এভাবে চলে যেতে হলো বলে কিছু মনে করো না। মামুনকে বললেন, বাবাকে বুঝিয়ে বোলো।
বাবু ম্লান হাসলো। মেজর মুস্তফা বললেন চলো, এয়ারপোর্ট অব্দি পৌঁছে দিই। একটু পরে আবার মিটিং আছে।
বাবু আর মামুন সেদিন সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরে গেলো। মামুন বললো, তোমাকে যদি ঢাকা থেকে চলে যেতে হয় আমাকে জানিও। তোমার জন্যে আমি গর্বিত।
সন্ধ্যার শেষ আলোতে বাবু বাড়ি ফিরলো। তখনও ওদের বাড়িতে আলো জ্বলেনি। বাবা বারান্দায় মার্বেল পিলারের গায়ে ঠেস দিয়ে বসেছিলেন। হিমি বসে আছে সিঁড়ির ওপর। সন্ধ্যার বিষণ্ণতা ওদের দুজনের মুখে ছায়া ফেলেছে। অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠলো বাবুর। কিছুক্ষণ কোন কথা বলতে পারলো না। বাবার কাছে এসে দাঁড়ালো নিঃশব্দে।
বাবু হিমির দিকে তাকিয়ে হাসতে চেষ্টা করলো। হিমি হাসলো না। বললো, আব্দু চলে গেছে।
কোথায় গেছে? জানতে চাইলো বাবু।
হিমি মাথা নাড়লো–জানি না।
ভাইয়া কোথায় গেছে বাবা?
বাবা শান্ত গলায় বললেন, ও তো বলে গেলো মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবে।
বাবু কিছুই বুঝতে পারলো না। বললো, সব খুলে বলুন বাবা। ভাইয়া হঠাৎ কেন চলে গেলো? ওর তো যাবার কথা ছিলো না।
বাবা আরো শান্ত গলায় বললেন, বিপদ যখন আসে হঠাৎ করেই আসে। আমাদের বাড়ি যে পাঞ্জাবি সৈন্যরা লুট করেছে সে খবর তো তুমি জানো না। তুমি যেদিন গেলে সেদিন সন্ধ্যের দিকে তিনটে পাঞ্জাবি সেন্য এসেছিলো। একটা বাইরে গেটের কাছে দাঁড়িয়েছিলো। বাকি দুটো স্টেনগান উঁচিয়ে সোজা ওর ঘরে ঢুকে গেলো। আমরা ওর ঘরে বসেছিলাম। সৈন্য দুটো ঘরে ঢুকেই বললো, সবাই দেয়ালের কাছে লাইন করে দাঁড়াও। আমি বললাম, তোমরা কে? কেন এসেছো? একজন জবাব দিলো, আপনাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যোগাযোগ ছিলো। এখনো আছে! ওদের লোকজন এ বাড়িতে আসতো। আপনারা তেইশে মার্চ পাড়ায় আওয়ামী লীগ-এর পতাকা বিলিয়েছেন। আমরা এ বাড়ি সার্চ করবো। আমি বললাম, তোমরা ভুল করেছে। কেউ তোমাদের ভুল খবর দিয়েছে। আমি কোনদিন আওয়ামী লীগ করিনি। আমি ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোতে কাজ করতাম। আরেকজন সৈন্য নির্লজ্জের মতো হাসলো। বললো, আপনাকে আমরা চিনি। আমাদের অভিযোগ আপনার ছেলের বিরুদ্ধে। সঙ্গের সৈন্যটা এর ভেতরই সার্চ শুরু করে দিয়েছে। আমি বললাম, তোমাদের সার্চ ওয়ারেন্ট আছে? ওরা জবাব দিলো, দরকার নেই। সব কিছু ওরা তছনছ করে ফেললো। একজন তোর ভাইয়ার ঠিক বুকের ওপর স্টেনগান ধরেছিলো। ওয়ার্ডরোব খুলে টাকা বের করলো লোকটা। কদিন আগে বিলু ব্যাঙ্ক থেকে সমস্ত টাকা তুলে ঘরে রেখেছিলো। সৈন্যটা বললো, এগুলো আওয়ামী লীগের টাকা। সিজ করলাম। বলে বিলুর বড়ো ব্যাগটায় টাকাগুলো ঢুকিয়ে নিলো। ওয়ার্ডরোবের ড্রয়ারে বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ ছিলো একটা প্যাকেটে। সবশেষে সৈন্যটা সেই প্যাকেটটা বের করলো। বললো এটা কী? যে সৈন্য স্টেনগান উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছিলো সেও তাকালো। ঠিক তখনই তোর ভাইয়া এক ঝটকায় দরজা খুলে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো। দুটো সৈন্যই চমকে উঠে সামনের দরজা দিয়ে ছুটে গেলো। আমিও গেলাম ওদের সঙ্গে। ওরা আর ওকে খুঁজে পেলো না। যাবার সময় টাকার ব্যাগটা নিয়ে চলে গেলো। বললো, আমাদের হাত থেকে পালিয়ে কখনো বাঁচতে পারবে না। আমরা আবার আসবো। তোর ভাইয়া সারারাত আর ফেরেনি। ফজরের সময় চুপি চুপি এসে হাতব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে চলে গেছে। বললো, চুয়াডাঙ্গার দিকে যাচ্ছে। ওর পার্টনার দুজনও নাকি সঙ্গে যাবে।
বাবু অবাক হয়ে শুনছিলো সব। এদিকে এতো ওলট-পালট হয়ে গেছে কিছই সে জানে না। বললো, মার্শাল ল হেড কোয়ার্টারে কমপ্লেন করেন নি?
বাবা ম্লান হাসলো করেছিলাম। একজন ক্যাপ্টেন এসেছিলো তদন্ত করতে। সব দেখে শুনে বললো, এগুলো বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সৈন্যদের কাজ। ওরাই সবখানে লুটপাট করে বেড়াচ্ছে। বলার কিছুই ছিলো না। তাই চুপ করে রইলাম। এই বলে বাবা থামলেন।
হিমি বললো, দিদা, আব্দু আর আসবে না?
বাবা বললেন, কেন আসবে না? নিশ্চয়ই আসবে।
বাবু হিমির দিকে তাকালো। বললো, হিমি তখন কি করছিলো?
বাবা বললেন, কাঁদছিলো। বার বার বলছিলো, আব্বকে তোমরা মেরো না। একটু থেমে বাবা বললেন, ফ্ল্যাগগুলো যদি ওরা দেখতে পেতো তাহলে নির্ঘাত ওকে গুলি করতো। ওরা একটা অজুহাত খুঁজছিলো মারার জন্যে।
বাবু বিড়বিড় করে বললো, ফ্ল্যাগগুলো ও ভাবে না রাখলেও চলতো।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন বাবা। তরপর মৃদু গলায় বললেন, এক রাতের মধ্যেই ও অসম্ভব বদলে গিয়েছে। যাবার আগে আমাকে সালাম করে বললো, বাবা দোয়া করবেন। বিলু কাঁদছিলো। হিমি ঘুমিয়েছিলো। ওর ভেতর এতটুকু দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখতে পেলাম না। হিমির কপালে চুমু খেলো। বিলুকে বললো, দেশ স্বাধীন করে ফিরবো।
হিমি বাবুর হাত ধরে বললো, কাকু, তুমি কি বাবাকে খুঁজে আনবে?
বাবু ওকে কোলে টেনে নিয়ে বললো, নিশ্চয়ই আনবো মামণি। কালই তোমার আব্দুকে খুঁজতে যাবো।
বাবা বললেন, তুই এতদিন কি করছিলি? বিলু বললো, সেদিন তোরা যে টি ভি প্রোগ্রাম করলি তার জন্যে একজনকে এ্যারেস্ট করেছে। একটা খবরও তো পাঠালে পারতি।
বাবু তখন বাবাকে সব কথা বললো। সেজদির সঙ্গে দেখা হওয়া থেকে মেজর মুস্তফার পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত। বাবা পাথরের মতো বসে রইলেন। অনেকক্ষণ পর বললেন, এখন কি করবি, কিছু ঠিক করেছিস?
বাবা বললো, এখানে থাকা আমার জন্যে নিরাপদ নয়।
বাবা চোখ তুলে তাকালেন–কোথায় যাবি?
বাবু একটু ইতস্তত করলো। তারপর স্বাভাবিক গলায় জবাব দিলো–ফ্রন্টে যাবো।
মানে!–বাবা অস্ফুট আর্তনা করে উঠলেন।
বাবু শান্ত গলায় বললো, যুদ্ধ যাবো বাবা। এখানে থাকলে অসহায়ের মতো মরতে হবে। আপনি সেটা আটকাতে পারবেন না। তার চেয়ে যুদ্ধে গিয়ে মরাটা অনেক ভালো। যদিও যুদ্ধে গেলেই মরতে হবে তার কোন মানে নেই। হয়তো ফিরেও আসতে পারি। সবচেয়ে বড়ো কথা, আমাকে কিছু করতে হবে। আমি ঠিক করে ফেলেছি বাবা এটুকু যদি না করি নিজের বিবেকের কাছে কি জবাব দেবো?
বাবা বললেন, যখন ঠিকই করে ফেলেছো, তখন বাধা দেয়ার কোন কথা ওঠে না। জানি দিলেও তুমি শুনবে না। আমি ভাবছি আমার তিনটি ছেলেকেই হারাতে হচ্ছে।
বাবু শান্ত গলায় বাবাকে বোঝালোবাবা, দেশের কথা একবার ভাবুন। এদশের মানুষদের কথাও ভাবুন। স্বাধীনতা আমাদের চাই। প্রয়োজন হলে আমাদের পুরো জেনারেশনটা শেষ হয়ে যাবে। হিমিরা রইলো। ওদের দিয়ে নতুন জেনারেশন শুরু হবে। আমাদের বংশধরদের জন্যে আমারা একটা সুন্দর দেশ রেখে যাবো। ওরা সুন্দর হয়ে বাঁচবে। এটাই কি ভালো নয় বাবা?
বাবা বিড়বিড় করে বললেন, আমি খারাপ বলিনি। বলছিলাম, আমার ছেলেরা, তোমাদের মৃত্যুর সময় আমি পাশে থাকবো না। আমার এ বুড়ো বয়সটা কতখানি অভিশপ্ত দেখো। এ বয়সে অক্ষম আমাকে শুনতে হবে আমার তরুণ ছেলেদের মৃত্যুসংবাদ।
বাবু নরম গলায় বললো, এটাই আপনার গর্ব বাবা। এর চেয়ে বড় গর্ব আর কি হতে পারে!
আকাশে সন্ধ্যার আলো হারিয়ে গেলো। রাত নামলো। অন্ধকারে ঢেকে গেলো বাংলাদেশের একটি শহর। যে শহরের নাম ঢাকা। সেই শহরের একটা ছোট্ট বাড়ি। যাকে ঘিরে এক সময় অসংখ্যা গোলাপ ফুটতো চারপাশের বাগানে। সে বাগান বিধ্বস্ত হয়েছে, পঁচিশে মার্চের রাতে। সারা শহরটাই বিধ্বস্ত। মানুষগুলোও বিধ্বস্ত।
বাবার সঙ্গে অনেক রাত অবধি বাবু বসে রইলো। বিধ্বস্ত বাগানে এখনো একটা দুটো ফুল ফোটে। বাতাসের গন্ধ ছাড়ায়। একসময় পাপড়িগুলো উড়ে যায়। সরল ইউক্যালিপ্টাসের ভেজা পাতার ফাঁকে সুগন্ধ ঘনায়। নরম বাতাসে সেই গন্ধ ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়ে। তবু গাছগুলো বিষণ্ণ। গোলাপেরা বিষণ্ণ। অন্ধকারে অসহায় বিষণ্ণতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বিদ্ধস্ত শহরের প্রায় বিধ্বস্ত বাড়িটা।
জানালার কাঁচ গুলিয়ে ভোরের আলো এসে মেঝের ওপর পড়লো। এক টুকরো নরম রোদ দেয়ালে কমলা রঙের ছায়া ফেললো। বাবু শুয়ে শুয়ে দেখলো । মায়ের ছবিটা এখনো জানালার কাছে পড়ে আছে। দিন দিন ছবিটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে।
বাবা মৃদু পায়ে ঘরে ঢুকলেন। মায়ের ধুলোজমা ছবিটার চেয়েও বেশি বিবর্ণ মনে হলো বাবাকে। সারারাত জেগেছিলেন বাবা। চোখের পাতার নিচে রাতজাগার ছায়া। বাবুকে বললেন, শুয়ে রয়েছে কেন? উঠে পড়ো।
বাবু উঠে বসলো। মায়ের ছবির ওপর বাবার চোখ পড়লো। বাবু বললো, মার ছবিটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বাবা।
বাবা ম্লান হাসলেন। বাবু উঠে পড়লো। বাথরুমের বড়ো আয়নায় নিজেকে দেখলো। আয়নায় ধুলো জমেছে। বাবুর মনে হলো সব কিছু বর্ণহীন হয়ে যাচ্ছে। টিসু কাগজ দিয়ে আয়নাটা ঘষে ঘষে পরিষ্কার করলো। ভারী বেলজিয়াম কাঁচের আয়নাটা আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বাবু ভাবলো, মার ছবিটা কি কখনো এমন উজ্জ্বল হবে, অথবা বাবার বিষণ্ণ মুখ!
খাবার টেবিলে গিয়ে দেখলো বাবা ওর জন্যে অপেক্ষা করছেন। চকোলেট মেশানো হরলিকস-এর গ্লাস থেকে ধোঁয়া উড়ছে। একটু আগে বাবা বানিয়েছেন।
বাবু বললো, আপনি বসে আছেন কেন বাবা?
বাবা কোন কথা বললেন না। পাউরুটিতে মাখন লাগিয়ে প্লেটটা ওর দিকে এগিয়ে বললেন, পরিজ খাবে?
পরিজ খেতে বাবুর ভালো লাগে না। তবু বললো, অল্প দিন।
বাটিতে রাখা সেদ্ধ কোয়েকারোটস খানিকটা তুলে নিয়ে বাবা ওতে দুধ মেশালেন। চিনি মেশালেন। সুপের চামচটা ধুয়ে টেবিলে রাখলেন।
অদ্ভুত এক ধরনের অস্বস্তিতে ভুগছিলো বাবু। বাবাকে মানা করতে পারলো না–কেন এসব করছেন। তাঁর এ আন্তরিকতা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারছিলো না। তাঁর মতো একজন সংসার উদাসীন মানুষের পক্ষে এ ধরনের আচরণ খুবই অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিলো। তিনি কি ওকে এভাবে শেষ বিদায় জানাচ্ছেন? অসম্ভব চাপা স্বভাবের বাবাকে কোন দিন এতো কাছে পায়নি বাবু।
বাবা শান্ত গলায় জানতে চাইলেন, তুমি কোন্দিকে যাবে ঠিক করেছো?
বাবু বললো, কুমিল্লার দিকে। সেজদিদের পার্টির ভালো সংগঠন রয়েছে ওখানে।
দূরে কোথাও মেশিনগানের শব্দ শোনা গেলো। এক নাগাড়ে বেশ কিছুক্ষণ সেই শব্দ বাবুকে অনড় করে রাখলো। বাবা আরো শান্ত গলায় বললেন, ঠিকামতো যেতে পারবে?
বাবু বললো, পার্টির একজন আমার সঙ্গে থাকবে। তাছাড়া ছোড়দাও কিছুটা পথ এগিয়ে দেবে।
বাবা আর কোন কথা বললেন না। বাবু বললো, হিমিরা কোথায় বাবা?
ইশারায় বাবা ভাইয়ার ঘরটা দেখিয়ে দিলেন। বাবু ডাকলো, হিমি শুনে যাও।
হিমি এলো। বাসি গোলাপের মতো বিষণ্ণ মনে হলো হিমিকে। কাছে এসে বললো, কেন ডেকেছো কাকু?
হিমির চলাফেরা কথার ভঙ্গি সব কিছুতে বয়স্ক মানুষের গাম্ভীর্য। এ কদিনের ঘটনা ওর চার বছর বয়সের সীমানা অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। বাবুর মনে হলো, হিমি কি আবার কোনদিন আগের মতো হতে পারবে? বললো, বহ্নি কি করছে হিমি?
ঘুমিয়েছে। হিমি ছোট্ট জবাব দিলো।
বাবু ওকে পাশে বসালো। বললো, একটু চকোলেট খাও।
হিমি চুপ করে রইলো। বাবু কাপে চকোলেট ঢেলে এগিয়ে দিলো। হিমি শান্ত গলায় আস্তে আস্তে বললো, তুমি কখন যাবে কাকু?
একটু পরেই যাবো মামণি।
হিমি আরো শান্ত গলায় বললো, তুমি কি আব্বকে নিয়ে আসবে?
নিশ্চয়ই আনবো হিমি। খুব শিগগিরই তোমার আব্দুকে আর বাবলু কাকাকে নিয়ে আসবো। তখন আমাদের আর কোন ভয় থাকবে না।
তখন আমাদের বাড়িতে আর মিলিটারী আসবে না?
না মামণি। তখন আর কোন মিলিটারী আসবে না। তুমি ভয় পেয়ো না।
আমি আর ভয় পাবো না। মাথা নেড়ে বললো হিমি।
বাবা বললেন, তোমার কি টাকার দরকার হবে?
বাবু বললো, শ খানেকের মতো আছে।
খাবার টেবিলে আর কোন কথা হলো না। উঠে ব্যাগটা গুছিয়ে নিলো। তেমন কোন ব্যাগ নয়। বাজার করার সাধারণ একটা চটের থলে। সেদিন সেজদি বলে দিয়েছিলেন, তুমি বাইরে কোথাও যাচ্ছো এটা যেন কেউ বুঝতে না পারে। কিছুটা পথ অবশ্য ছোড়দা পৌঁছে দেবে। কিন্তু বাকি রাস্তাটুকু পার্টির সেই লোকটির সঙ্গে ওকে একাই যেতে হবে।
বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন বাবা। থলেটা হাতে করে বাবু এসে তার সামনে দাঁড়ালো। বললো, যাচ্ছি বাবা।
বাবা বললেন, এসো। ওর হাতের ভেতর পঞ্চাশ টাকার কয়েকটা নোট গুঁজে দিলেন,–এগুলো রাখো। দরকার হতে পারে।
অনেক কথা গলার কাছে কাটা মুরগির মতো ছটফট করছিলো। কিছুই বলতে পারলো না। চোখ দুটো কেমন যেন জ্বালা করছে। চারপাশটা ঝাঁপসা হয়ে আসছে। ভাবীকে বললো, চলি ভাবী।
হিমির কপালে চুমু খেলো বাবু। বললো, যাই মামণি।
বাবা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। তার পা ছুঁয়ে সালাম করলো বাবু। পিঠের ওপর হাতে রাখলেন বাবা। বিড়বিড় করে বললেন, ভালো থেকো।
লোহার গেটটা খুলে বাবু বাইরে এলো। হিমি হাতটা সামান্য নেড়ে বিদায় জানালো। বাবুও হাত তুললো। মনে মনে বললো, বিদায় বাবা, যদি বেঁচে থাকি আবার দেখা হবে। যদি বেঁচে থাকো আবার দেখা হবে।
.
১৯.
বাবু বাইরে এসে দেখলো, সারা রাস্তা খাঁ খাঁ করছে। আতঙ্কগ্রস্ত দুএকটা মানুষ ভয়ে ভয়ে কোথাও যাচ্ছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে পাঞ্জাবি সৈন্যরা টহল দিচ্ছে। হাতে স্টেন কারবাইন। ইচ্ছে মতো যাকে তাকে যেখানে সেখানে গুলি ছুঁড়ছে। এসবের ভেতর দিয়েই যেতে হবে। যারা রাস্তায় এখনো জীবিত অবস্থায় চলাফেরা করছে সকলেই জানে, তারা যে কোন সময়ে রাস্তার দুপাশে ইতস্তত ছড়ানো কুকুর আর মানুষের শবদেহের একটা হয়ে যেতে পারে। তবু রাস্তায় বেরোতে হয়। কেউ একেবারেই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কেউ খাবারের সন্ধানে যাচ্ছে, যদি কোথাও কিছু খাবার পেয়ে যায় সেই আশায়।
সারা শহর ভীষণ রকম শব্দহীন। মাঝে মাঝে কয়েকটা গুলির শব্দ ছাড়া মনেই হয় না এ শহরের কোন প্রাণ আছে। ছায়াছবিতে দেখা যেন কোন যুদ্ধ বিধ্বস্ত মৃতের শহর। তার চেয়েও বেশি ভয়াবহ। কারণ এ শহরের জীবন্ত মানুষগুলোও মৃত।
হেঁটে হেঁটে জ্যাঠাইমাদের বাড়ি আসতে বাবুর পুরো এক ঘন্টা সময় লাগলো। ছোড়দা ওর জন্যে অপেক্ষা করছিলো। বললো, তোর গাইড অনেকক্ষণ বসে আছে।
পকেট থেকে একটা চিঠি বের করলো ছোড়দা। বাবু বললো, মেজদা কোথায়?
ছোড়দা বললো, কাল রাতে চলে গেছেন। তোর জন্যে একটা চিঠি দিয়েছেন।
চিঠি খুললো বাবু। মেজদা লিখছেন–
আমি আপাতত কোলকাতা যাবো। বাইরের দেশগুলোতে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে জানা দরকার। নেতারা প্রায় সবাই এখন কোলকাতার পথে। বড়দা কোথাও যাবেন না। তিনি বলেছেন, আমাদের যে ভাবেই হোক দেশের ভেতরে থাকতে হবে। আমাদের যুদ্ধ আমাদেরই করতে হবে। কখনো ভেবো না, অন্য কেউ আমাদের হয়ে যুদ্ধ করে দেবে। তুমি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে যাচ্ছে জেনে আনন্দিত হলাম। শুনেছি আওয়ামী লীগের ট্রেনিং ক্যাম্পে অন্য কোন দলের ছেলেদের ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে না। যদি নিজেরা ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করতে পারো ভালো। নইলে বাইরে ঘুণাক্ষরেও কখনো জানতে দিয়ো না কোন বিশেষ দলের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক আছে। সবচেয়ে বড়ো কথা এটা এক ভয়াবহ বিভ্রান্তির সময়। প্রতিমুহূর্তে বিভ্রান্ত হতে পারো। মতাদর্শে অটল থাকলেই বিভ্রান্তি কাটিয়ে উঠতে পারবে। মনে রেখো বিপ্লবকে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে নিতে হবে।
পড়া শেষ হলে বাবু চিঠিটা ছিঁড়ে ফেললো। ছোড়দাকে বললো, বড়দার খবর কী? ওঁদের পার্টির অনেকে তো চলে গেছেন।
ছোড়দা মাথা নেড়ে সায় জানালো। বললেন, জানি। বড়দাকে ঢাকাতেই থাকতে হবে। পার্টির নির্দেশ।
বাবু ভেতরে গিয়ে জ্যাঠাইমার সঙ্গে দেখা করলো। বললো, যাচ্ছি জ্যাঠাইমা। বাবা একা রইলেন।
জ্যাঠাইমা বললেন, তোর বাবাকে আমার এখানে এনে রাখবো। ওর শরীর একেবারেই ভেঙে গেছে।
ছোড়দা গাড়ি বের করে ওকে ডাকলো। বাবু আর ওর সঙ্গী গাড়িতে উঠে বসলো। ছোড়দা বললো, সব ঠিক আছে তো?
বাবু মাথা নাড়লো। বললো, যাবার পথে লেক সার্কাস হয়ে যাবেন।
মামুনকে লেক সার্কার্স-এর স্টাফ কোয়ার্টার থেকে ডেকে বাবু বললো, ফ্রন্টে যাচ্ছি। যদি পারো তুমিও চলে এসো।
মামুন বললো, কয়েক দিনের ভেতরেই যাচ্ছি।
বাবু বললো, কুমিল্লা অথবা নোয়াখলির দিকে থাকবো। পারলে যোগাযোগ কোরো।
মামুন ওকে বিদায় জানালো।
দুপাশে ধ্বংসের স্তূপ, পেছনে বিধ্বস্ত ঢাকাকে রেখে বাবুদের গাড়ি কুমিল্লার পথে এগিয়ে গেলো।
রাস্তার দুপাশে কৃষ্ণচূড়ার গাছগুলো অজস্র ফুলে ছেয়ে আছে। ফুল নয়, মনে হয় গনগনে ফার্নেসে আগুন জ্বলছে। কালো পিচঢালা পথে কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো ছড়িয়ে রয়েছে। ছোট ছোট বাতাসের ঘূর্ণিতে পাপড়িগুলো এলোমেলা উড়ে যায়। ঝাঁ ঝাঁ করে দুপুরের রোদ।
ছোড়দা বললো, কৃষ্ণচূড়ার রঙটা কি দগদগে দেখেছিস! ফুলগুলো মনে হয় লক্ষ মানুষের রক্তে ভিজে এত লাল হয়ে ফুটেছে।
বাবু মনে মনে বললো, এখন সে ফুল বিপ্লবের আগুন ছড়াচ্ছে। বিপ্লবের রঙ লাল হয় ছোড়দা।
বাবার কথা মনে হলো বাবুর। তিনি এখন এক ধূসর জগতে বাস করছেন। সকল রঙ সেখানে ফ্যাকাশে। বড়ো বেশি একা হয়ে গেলেন বাবা। মায়ের ধুলোজমা ছবিটার মতো একা। সেই ধূসর জগৎ বাবু পেছনে ফেলে এসেছে।
পুব দিকের সড়কটার সবখানে কৃষ্ণচূড়ার আগুন জ্বলছে। সে আগুন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বলছে পথ একটাই সামনে। এগিয়ে চলো। অনেকটা পথ যেতে হবে। দুঘন্টা একটানা যাওয়ার পর পথে বাধা পেলো ওরা। এলিয়টগঞ্জের বড় পুলটা মুক্তিবাহিনী উড়িয়ে দিয়েছে। পাঞ্জাবি সৈন্যরা পাশের পুরোনো পুলটা মেরামত করছে। বললো, এ পথে আর্মির গাড়ি ছাড়া অন্য কোন গাড়ি যেতে পারবে না।
বাবুর সঙ্গী বললো, আমরা তাহলে এখানেই নেমে যাই। বাকি পথ হেঁটে যেতে হবে।
বড়ো রাস্তা থেকে ওরা ধানক্ষেতে নেমে পড়লো। দুজনের হাতে দুটো চটের থলে। পরনে লুঙ্গি। গায়ে জামা। সাধারণ গ্রামের লোকের মতো দেখাচ্ছিলো ওদের। বাবুর থলের চেয়ে ওর সঙ্গীর থলেটা বেশ বড়ো। কিছুটা ভারীও। ওর জানতে ইচ্ছে হলো থলের ভেতর কি আছে। পরমুহূর্তে নিজেকে সংযত করলো সেজদির কথা ভেবে। সেজদি বলে দিয়েছিলেন, ওর কোন আচরণে অহেতুক উৎসাহ দেখিও না। এমনকি ওর নামটাও সেজদি বলেননি। অথচ বয়সে বাবুর চেয়ে বেশি হলে তিন চার বছরের বড়ো হবে। নিতান্ত গ্রাম্য চেহারা। গ্রামের লোকদের মতো মাথাটা তেলে জবজব করছে। লুঙ্গিটাও অনেকখানি উপরে তুলে পরা।
বাবু বললো, পথে কি কোথাও আমরা বিশ্রাম নেবো?
অত্যন্ত নির্লিপ্ত গলায় সঙ্গী জবাব দিলো, কি দরকার মিছেমিছি সময় নষ্ট করে।
বাবুর মনে হলো, একনাগাড়ে পঁচিশ তিরিশ মাইল হাঁটা ওর সঙ্গীর জন্য এমন কোন উল্লেখযোগ্য ব্যাপার নয়। নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো।
সূর্যটা এখন পশ্চিমের আকাশে। এদিকের গ্রামগুলোতে কোন প্রাণের সাড়া নেই। পাঞ্জাবি সৈন্যরা যেদিকেই গিয়েছে পথের দুপাশে গাছ পাল ঘর-বসতি সব কিছু জ্বালিয়ে দিয়েছে। বাবু দেখলো ধানক্ষেতেও ওরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। বাবু ওর সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করলো ধানক্ষেত ওরা পোড়ালো কি ভাবে?
সঙ্গী জবাব দিলো, ওরা প্রথম এক ধরনের পাউডার ছড়িয়ে দেয়। তারপর আগুন লাগায়। চোখের পলকে সব দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে।
কী ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা! সবখানে বাবু এই নিষ্ঠুরতার ছাপ দেখতে গেলো। বাবুর সঙ্গী প্রথমবারের মতো স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে কথা বললো, ওরা গ্রামে আগুন ছড়িয়েছে। এ আগুন ওদেরই পুড়িয়ে মারবে। নিজেদের ধ্বংস ওরা নিজেরাই ডেকেছে।
গ্রামের মানুষগুলো কোথায়? জনশূন্য গ্রামগুলোর দিকে তাকিয়ে বাবু প্রশ্ন করলো।
তৈরি হচ্ছে। কঠিন প্রত্যয়ের সঙ্গে ওর সঙ্গী উচ্চারণ করলো। এবারই দেখবে যুদ্ধ কাকে বলে।
ঘন্টা দুয়েক একটানা হাঁটার পর বাবু লক্ষ্য করলো, পাঞ্জাবি সৈন্যরা এদিকে আর আসেনি। তবে গ্রামে কোন সাড়া শব্দও নেই। ধানক্ষেতের আলপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাবু প্রশ্ন করলো এ সব গ্রামে কি কোনো মানুষ নেই?
আছে। সঙ্গী ছোট্ট জবাব দিলো।
সুর্য যখন আরো পশ্চিমে নেমে এলো–আকাশ রঙের মেলা বসলো, তখন ওরা বহুদূরে রাইফেলে শব্দ শুনলো।
বাবু অবাক হয়ে সঙ্গীর দিকে তাকালো। দেখলো, তার ভুরু দুটো কুঁচকে গেছে। বাবু কিছু বলার আগে ওর সঙ্গী বললো, মনে হচ্ছে আমাদের আজ রাতে আবিদপুরে থাকতে হবে।
বাবু বললো, শব্দটা লক্ষ্য করেছেন? পাঞ্জাবি সৈন্যদের নিশ্চয়ই নয়। সম্ভবত গ্রামের কেউ করেছে।
সঙ্গী অদ্ভুত হাসলো। বললো, তুমি কি পাঞ্জাবি সৈন্যদেরই একমাত্র শত্রু ভেবেছো? ওদের চরিত্রের কেউ তো আমাদের ভেতর থাকতে পারে।
বাবু কথাটা ঠিক বুঝতে পারলো না আমাদের ভেতর ওদের চরিত্র? আপনি কাদের কথা বলছেন।?
সঙ্গী শান্ত অথচ কঠিন গলায় জবাব দিলো, আমাদের যুদ্ধ শুধু পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে নয়। বাঙালিদের ভেতরও ওদের মতো শোষক আছে, ওদের দালালরা আছে। এ কথা কখনো ভুলে যেও না।
কথার ভঙ্গিতে মনে হলো না বাবুর এ ধরনের প্রশ্ন তার ভালো লেগেছে। বাবু চুপ করে রইলো। ওর মনে পড়লো মৌলভী ফরিদ আহমেদের কথা। আকাশে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। অন্ধকারের কালো ছায়া গাছের পাতার ফাঁকে, পথের পাশে ছড়ানো বুনো ঝোঁপের নিচে, ছোট ছোট ডোবার পাশে কচুরি পানার মতো থরে থরে জমতে লাগলো। তারপর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়লো।
আরো পরে ফ্যাকাশে কালো আকাশে এক টুকরো চাঁদ দেখা গেলো। বাবুরা তখন আবিদপুর পৌঁছে গিয়েছে।
.
২০.
যে বাড়িতে ওরা উঠলো সেটা সাধারণ এক কৃষকের বাড়ি। একটা ঘরের চালে টিন রয়েছে, বাকি দুটো খড়ের। ওরা সবাই খড়ের একটা ঘরে বসেছিলো। অত্যন্ত নিরাভরণ বাঁশের বেড়ার ঘর। ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে অনেকখানি আকাশ দেখা যাচ্ছে। কিছুটা চাঁদের আলোও সেই ফাঁকে ঘরে ঢুকেছে। ঘরের এককোণে একটা কেরোসিনের বাতি জ্বলছিলো।
বাবু আর ওর সঙ্গী ছাড়াও ঘরে আরো দশ আট জন লোক বসেছিলো। বেশির ভাগ যুবক, দুএকজন মধ্যবয়সীও আছে। গ্রামের সাধারণ কৃষকের সরলতা সকলের মুখে। সরল হলেও চেহারাগুলো যথেষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত মনে হলো বাবুর। ওর সঙ্গী বললো, এরা সবাই আমাদের বিশিষ্ট কর্মী। বিভিন্ন গ্রাম থেকে এসেছেন।
সবাই নিজেরা নিচু গলায় আলোচনা করছিলো। মনে হলো কারো জন্যে যেন অপেক্ষা করছে। বেশ কিছুক্ষণ পর আরো একজন এসে ঘরে ঢুকলেন। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। লুঙ্গি আর শার্ট পরা। তাঁকে ঢুকতে দেখে সবাই কথা বন্ধ করলো। বোঝা গেলো এরই জন্যে সবাই অপেক্ষা করছিলো।
তিনি বাবুর সঙ্গীকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। নিচু গলায় কি যেন বললেন।
সঙ্গী জবাবে কিছু বললো, যা কেউ শুনতে পেলো না। তারপর তিনি বাবুকে ডাকলেন। বাবু উঠে গেলো।
কাছে যেতে বাবুকে সেজদির কথা বললেন, তোমার কথা ঢাকা থেকে আমাদের জানিয়েছে। তুমি আমাদের জন্যে কী ধরনের কাজ করতে পারবে কিছু ভেবেছো? অবশ্য কিছু কাজ এর ভেতরই করেছে। আমি ভবিষ্যতের কথা জানতে চাইছি।
বাবু বললো, আমি যুদ্ধ করার জন্যে এসেছি।
তিনি মৃদু হাসলেন। বাবুর পিঠে হাত রেখে বললেন, আমাদের নীতি বা কাজের ধারা সম্পর্কে তোমার কোন প্রশ্ন আছে?
বাবু মাথা নাড়লো–না।
তিনি আবার বললেন, পুরোপুরি আস্থা আছে?
বাবু শান্ত গলায় প্রত্যয়ের সঙ্গে বললো, নিশ্চয়ই আছে।
তারপর তিনি বললেন, দুটো গ্রাম পরে বর্ডারের ওপারে ঢাকার ছেলেদের একটা ট্রেনিং ক্যাম্প আছে। অবশ্য ওরা আমাদের দলের নয়। আমাদের কেন, কোন দলেরই নয়। তুমি ওদের সঙ্গেই থাকবে। পরে যখন দরকার হবে ডেকে নেবো। তুমি ওদের রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন করবে। এই বলে তিনি থামলেন। বাবু গভীর আগ্রহ নিয়ে তাঁর কথা শুনছিলো। তিনি আবার মৃদু হাসলেন। বললেন, আজ রাতে বিশ্রাম নাও। অনেক পথ হেঁটেছে।
বাবুর সঙ্গী বললো, তুমি কি এক্ষুণি ঘুমোবে?
বাবু মাথা নেড়ে জানালো–না।
তিনি তখন বললেন, তুমি আমাদের কাছে বসতে পারো।
একজনকে তিনি বললেন, মনু মিয়া, আপনাদের এলাকার খবর কিছু বলেন।
একজন মাঝ বয়সী চাষী মন্তু মিয়া বললেন, একটা দুইটা মুসলিম লীগ আর জামাতের জোতদার খতম না করলে ওইবো না। মিলিটারির জুলুমে হিন্দুরা ঘর বাড়ি থুইয়া চইলা যাইতাছে। গেদু মোল্লা আর আরজত মহাজনের পোলারা সমানে লুট করতাছে। হ্যারা ধমকও দিছে, কয় মেলেটারিরে খবর দিবো।
মন্তু মিয়ার বয়সী আরেকজন চাষী বললেন, খতমের লাইগা বইয়া রইছেন ক্যান মন্তু মিয়া। আর কিছু না থাক ঘরে তো দাও আছে। কল্লাডা নামাইয়া ফালাইলে কি হয়। গেদু মোল্লা আরজত আলীর কুখ্যাতি দশ গ্যারামের মাইনষে জানে। কম ওইত্যাচার করছে নিহি আমাগো উপরে!
অন্য একজন বললেন, আমাগো পোলাগোরে কওন লাগে নাই। গ্যারামে যত জোতদার মহাজন আছিল ব্যাবাকটিরে খতম কইরা ফালাইছে। আমাগো এলাকার কোন দালাল বদমাইশ জামাত, মুসলিম লীগ পাইবেন না।
তিনি চুপ করে সব শুনছিলেন। তাঁর মুখে মৃদু হাসি। বাবুর মনে হলো, তার এ হাসিটুকু অদ্ভুত সুন্দর। তিনি বললেন, আক্কাস আলী বা নিতাই খুড়া যা বললেন তাই করতে হবে মন্তু মিয়া। এদিকের গ্রামে এখনো মিলিটারী আসেনি। তবে আসতে পারে। কারা আনবে জানেন? আনবে ওই জোতদার আর মহাজনের জাতেরা। গেদু মোল্লারা ঠিকই বলেছে। ওরা মিলিটারীকে পুষবে। এখন থেকেই আমাদের গ্রামগুলোকে মুক্ত এলাকা করে তাকে রক্ষা করার জন্যে তৈরি থাকতে হবে।
একজন তরুণ বললো, আমরা সব সময় তৈরি আছি।
বাবু অবাক বিস্ময়ে প্রত্যেকের কথা শুনছিলো। ওর মনে হলো এ যেন তার পরিচিত পৃথিবীর কোন সংলাপ নয়। কিছুটা বইয়ে পড়া কিছুটা কল্পনায় গড়া একটা ধূসর কুয়াশার জগৎ ধীরে ধীরে স্বচ্ছ হয়ে যাচ্ছে তার চোখের সামনে। চোখের সামনে যাদের দেখতে পাচ্ছে তারা বাস্তব জগতেরই মানুষ। বেশির ভাগ কৃষক, কিছু শ্রমিক, সবাই তার নিজের দেশের। নিজেকে নব আবিষ্কৃত এই জগতে দেখতে পেয়ে বাবুর সাহস বহুগুণ বেড়ে গেলো। নিজের ওর বিরক্তি জন্মালো। কী ভীষণ হতাশায় সে ভুগতো। ভাবতে বঞ্চিত মানুষের মুক্তি বুঝি কোনদিন আসবে না। অথচ আজ মনে হচ্ছে মুক্তি তার হাতের মুঠোয়। শুধু এগিয়ে যেতে হবে সামনে।
সবাই যখন ফিরে গেলো তখন তিনি বাবুকে ডাকলেন। অনেক কথা বললেন। তাঁর কথা শুনতে শুনতে বাবুর মনে হলো, সে তার উনিশ বছর বয়সের সীমানা ছাড়িয়ে বহুদূর অবধি চলে এসেছে। আর ফিরে যাওয়া নয়। উনিশ বছরের অতীত মরে গেছে। মৃতের কাছে বাবু কোনদিন ফিরে যাবে না! তার সামনে ভোরের সূর্যের মতো টকটকে লাল নিশ্চিত ভবিষ্যৎ। যে ভবিষ্যৎ তাকে স্বাগত জানাচ্ছে।
ভোর বেলা সূর্য ওঠার কিছু আগে ছুটতে ছুটতে এসে একজন খবর জানালোপাক সৈন্যরা গ্রামে ঢুকেছে। নদী প্রায় পার হয়ে গেছে।
বাবু তার সঙ্গী আর তিনজন মেঝেতে মাদুর পেতে এক ঘরে শুয়েছিলো। কাল রাতে আসা নেতা শুয়েছিলেন পাশের ঘরে। কথা শুনে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বাবুদের ঘরে আরো কয়েকজন এসে ঢুকলো। বাবু এই প্রথম দেখলো পাকিস্তানি সৈন্যের নামে কারো মুখে এতোটুকু আতঙ্কের ছায়া নেই। যেন একটা দুর্জয় অস্থিরতা। সবাই কোন নির্দেশের অপেক্ষা করছিলো।
তিনি বললেন, তোমরা সবাই এসেছো?
একজন উঠোনে নেমে গেলো। বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাবু দেখলো উঠানে অনেক মানুষের ভিড়। সবাই গ্রামের মানুষ। প্রায় সবারই খালি গা। পরনে লুঙ্গি। কোমরে গামছা বাঁধা। বারো তের বছরের ছেলে থেকে ষাট বছরের বুড়ো সবাইকে সেই ভিড়ের ভেতর দেখতে পেলো বাবু। সিদ্ধান্ত নিতে তার কয়েক মিনিট সময় লাগলো। একটা ম্যাপ খুলে তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন দেখলেন। বাবু দেখলো সেই এলাকার ম্যাপ। নদীর তীরে একটা গ্রাম। তারপরই আবিদপুর। তিনি বললেন, যত সামনে ডিফেন্স দিতে পারো ততো ভালো। তিনটা মেশিনগান আর পাঁচটা রাইফেল তোমাদের। আমরা পেছনে তৈরি হচ্ছি।
অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে বাবুর সঙ্গী তৈরি হয়ে গেলো। একজন ভেতরের ঘর থেকে মেশিনগান আর রাইফেল বের করে আনলো। বাবু ওর সঙ্গীকে বললো, আমি আপনার সঙ্গে থাকবো।
সঙ্গী তাঁর দিকে তাকালো। তিনি মৃদু হেসে বললেন, সাবধানে থেকো।
হাতে রাইফেল আর মেশিনগান কাঁধে ফেলে ওরা ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে ছুটলো। পুবর আকাশটা ফর্সা হয়ে এসেছে। এখনো গাছের তলায় ঝোঁপের কাছে অন্ধকার। আকাশে শুকতারা তখনো জ্বলছিলো। ওরা বহুদূর একনাগাড়ে ছুটতে ছুটতে বারুইদীঘির পাড়ে এসে থামলো। সামনে কয়েকটা গাছ, কিছু ঝোঁপঝাড়। তারপর বিরাট চর। ফাঁকা জায়গা। নদী অনেক দূরে। দুটো গানবোট তীরে থেমে আছে।
দীঘির পাড়ে ওরা পজিশন নিয়ে বসলো। আকাশটা আরো ফর্সা হলো। বাবু দেখলোলা দশ বারোজন সৈন্য গানবোট থেকে নেমেছে। একটু ছড়িয়ে ওরা গ্রামের দিকে এলো। বাবুর সঙ্গীরা ট্রিগারে আঙ্গুল চেপে অপেক্ষা করতে লাগলো।
রেঞ্জের ভেতর আসতেই বাবুর সঙ্গী বললো, ফায়ার।
সঙ্গে সঙ্গে রাইফেল আর ভারি মেশিনগান একসঙ্গে গর্জে উঠলো। কয়েক মুহূর্তে পাঞ্জাবি সৈন্যদের হতভম্ব মনে হলো। তিনজন পড়েও গেলো। সঙ্গে সঙ্গে ওরা মাটিতে শুয়ে পড়লো। কোন পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা না করে পাঞ্জাবি সৈন্যরা বুকে হেঁটে ক্রল করে গানবোটের দিকে সরে গেলো। বাবুদের মেশিনগান থামলো।
পাঁচটা মৃতদেহ নদীর চরে রেখে সৈন্যরা গানবোটে উঠে পড়লো। বাবুর সঙ্গীদের চোখে জয়ের উল্লাস একজন বললো, দ্যাখছো হাফেজ! হারামজাদারা ক্যামন ডরাইয়া গ্যাছে।
আরেকজন বললো, দুইডা গানবোট কইরা দশ বারোটা আইবো ক্যান? মনে হয় ফির্যা এ্যাটাক করবার পারে।
বাবুর সঙ্গী বললো, এ্যাটাক তো করবেই। তৈরি থাক।
আক্রমণের জন্যে ওরা প্রস্তুত থাকলেও সৈন্যরা কিভাবে আক্রমণ করবে ওরা বুঝতে পারলো না। প্রচণ্ড শব্দে কিছু দূরে একটা মর্টারের শেল পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই কিছুটা চমকে উঠলো। পর পর আরো কয়েকটা পড়লো। কোনটা পেছনে। কোনটা সামনে। বাবুর সঙ্গী বললো, সবাই আরো পাড়ের দিকে সরে এসো। আমাদের রিট্রিট করতে হবে।
কয়েকটা শেল দিঘির পানিতে পড়লো। সারা দীঘিতে প্রচণ্ড কোলাহল। গাছ থেকে পাখিরা ঝাঁক বেঁধে ডাকতে ডাকতে উড়ে গেলো। আকাশটা আরো ফর্সা হয়েছে। বাবুর সঙ্গী বললো, ওরা আমাদের দেখতে পেয়েছে। ওদের কাছে আমি বায়নোকুলার দেখছি। বাবু তোমার জামাটা খুলে ফেলো। এই বলে সে নিজের জামাটাও খুলে ফেললো।
বাবু অবাক হয়ে জামাটা খুললো। আরো কয়েকজন যাদের গায়ে জামা ছিলো খুলে ফেললো। বাবুর সঙ্গী তখন দীঘিতে নেমে আঁজলা ভরে কচুরীপানা তুলে আনলো। বাবু অবাক হয়ে তাকে দেখছিলো। সঙ্গী একজনকে বললো, এগুলোকে মানুষ বানাও।
হেসে কয়েকজন জামার ভেতর কচুরিপানা ভরে ফুলিয়ে দিলো। মাথার কাছে কচুরিপানার কালো শেকড়গুলো বের করে দিলো ।
তখনো ইতস্তত মর্টারের শেল পড়ছিলো। বাবু দেখলো, এ রকম এক ভয়াবহ যুদ্ধক্ষেত্রে যেখানে যে কেউ প্রতি মুহূর্তে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে, সেখানে মৃত্যুকে এ ধরনের উপহাস বুকের সাহস অনেক বাড়িয়ে দেয়।
বাবু হাসছিলো। আধখানা মানুষদের কয়েকখানা দীঘির পারে মাথা উঁচিয়ে আর কয়েকটা গাছের আড়ালে রেখে ওরা পেছনে ছুটলো। দীঘির উঁচু পাড়ের জন্য নদী থেকে দেখার কোন সম্ভাবনা নেই।
যখন গ্রামে ফিরলো পুবের আকাশ তখন আগুনের মতো লাল। তিনি কয়েকজনকে নিয়ে ঘরে বসেছিলেন। বাবুর সঙ্গী বললো, দু তিন ঘন্টার আগে ওরা গ্রামে ঢুকবে না। দীঘির ধারে মানুষগুলো যে সত্যিকারের মানুষ নয়। এটা বুঝতে ওদের বেশ কিছুটা সময় লাগবে।
তিনি বললেন, গ্রামের সবাইকে তৈরি হতে বলছি। রাইফেল আমাদের খুবই কম। তবু আমাদের মানুষ আছ। অনেক মানুষ আছে। অনেক মানুষ। মানুষেরাই ওদের অস্ত্রের জবাব দেবে।
কাল রাতের মন্তু মিয়া, আক্কাস আলী, আর নিতাই খুড়োও এসে পড়লেন।
তিনি বললেন খবর কি নিতাই খুড়ো?
মন্তু মিয়া একগাল হেসে বললেন, ব্যাবাকতে তৈরি হইয়া বইসা রইছে।
তখনো রকেটের গোলার শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। তিনি বললেন, যতক্ষণ মর্টারের গোলার শব্দ শোনা যাচ্ছে ততোক্ষণ আমরা চুপ থাকবো। যখন ওরা থামবে তার কিছুক্ষণ পর আমাদের আক্রমণ শুরু হবে।
আক্রমণের ধরনটা কী দুঘন্টা পরে বাবু টের পেলো। আবিদপুরের সীমানায় ওরা দাঁড়িয়েছিলো। কিছুক্ষণ হলো রকেট ছোঁড়া ওরা বন্ধ করেছে। বাবুর সঙ্গী কোমরের রিভালবারটা বের করে পর পর তিনবার গুলি ছুঁড়লো।
তারপরই শুরু হলো সম্মিলিত আক্রমণ। চারপাশ থেকে এবং বহুদূর থেকে পর পর অনেকগুলো রাইফেল গর্জে উঠলো, সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে শ্লোগান। একটা দুটো নয়, একশ দুশ নয়; গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ শ্লোগানের শব্দে বাবু বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলো। শ্লোগানের ফাঁকে ফাঁকে গর্জে উঠছে রাইফেলগুলো।
একজন গাছের ওপর থেকে সৈন্যদের গতিবিধি লক্ষ্য করছিলো। সৈন্যরা প্রথমে হতচকিত হয়ে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে শুরু করলো। অনেকে পজিশন নিয়ে শুয়ে গেলো।
শ্লোগানের শব্দে এতটুকু বিরাম নেই। সমুদ্রের গর্জনের মতো সেই শব্দ ভীষণ অবয়বে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছিলো। বাবুর মনে হলো, গাছের ভেতের থেকে, মাটির ভেতর থেকে, আকাশের ভেতর থেকে, সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসছে। কয়েকটা রাইফেলের শব্দকে সেই গর্জনের ঢেউয়ে কয়েকশ মনে হলো।
পাঞ্জাবি সৈন্যরা লক্ষ্যহীন কিছু গুলি ছুঁড়লো। ওদের মেশিনগানের কটকট শব্দ সেই বিশাল গর্জনের নিচে তলিয়ে গেলো। বহুক্ষণ ওরা চেষ্টা করলো সেই অলৌকিক শব্দের উৎস বন্ধ করা যায় কি না। ওরা ব্যর্থ হলো। ঘন গাছপালা আর গ্রাম দিয়ে ঘেরা ফাঁকা চরের ওপর সৈন্যগুলোকে খুবই অসহায় মনে হলো। রাইফেলে শুধু ফাঁকা আওয়াজ হচ্ছিলো না। কয়েকটা সৈন্য গুলি খেয়ে পড়েও গেলো।
দুপুর নাগাদ গ্রামে ঢোকার ব্যর্থ চেষ্টা করে সৈন্যগুলো ফিরে গেলো। গানবোট নিয়ে যাবার সময় নদীর তীরে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়ছিলো। শেষে এক সময় ওদের গুলির শব্দ মিলিয়ে গেলো। সমুদ্রের গর্জনও শান্ত হলো।
সন্ধ্যেবেলা সবাই উঠোনে বসেছিলো। ওরা সবাই হাসছিলো। ওদের গায়ে মাটির তাজা গন্ধ। হাসিতে গাছের সবুজ সজীবতা। তিনি একপাশে বসেছিলেন। বাবুকে বললেন, পাকসৈন্যরা আর এদিকে আসতে সাহস করবে না! একটু থেমে আবার বললেন, এভাবে প্রত্যেক গ্রামে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
বাবু বললো, আমি কি কাল যাচ্ছি?
তিনি বললেন, নিশ্চয়ই! ওখানে তোমার পরিচিত অনেককে পাবে। ওরা সবাই ঢাকার ছেলে।
বাবুর সঙ্গী বললো, ওদের ক্যাম্পটা বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের পরিচিত। বেশ কিছু সাহসী ছেলে আছে ওখানে।
অনেক রাত অবধি ওরা জেগেছিলো। মেজদার চিঠির কথা মনে পড়লো বাবুর–বিপ্লবকে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে নিতে হবে।
.
২১.
অবশেষে বাবু মুক্তিবাহিনীর সেই শিবিরে এসে পৌঁছলো। চারপাশে আম আর সুপুরি গাছের সারি। একটা ছায়াময় শান্ত পরিবেশ। মাঝখানে একটা বড়ো টিনের ঘর। তার ডানপাশে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। কতগুলো তাঁবু রয়েছে সেখানে। সামনের খোলা জায়গায় একটা লম্বা বাঁশের গায়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। গাছের পাতার মতো সবুজ, ধানের শীষের মতো সোনালি আর সূর্যের মতো লাল পতাকা।
দূরে কোথাও একটা নাম-না জানা পাখি শিষ দিচ্ছিলো মিষ্টি সুরে। আমের গাছে এখনো মুকুলের ছোঁয়া লেগে আছে। একটা লেবু গাছে অজস্র সাদা ফুল ফুটে রয়েছে। বুক ভরে গন্ধ নিলো বাবু, গভীর প্রশান্তিতে মনটা ভরে গেলো।
সঙ্গী বললো, এটাই সেই শিবির।
বিশ একুশ বছরের একজন তরুণ স্টেনগান হাতে পাহারা দিচ্ছিলো। তার পরনে জলপাই সবুজ জিনসের প্যান্ট। গায়ে সাদা গেঞ্জি। বড়ো তাঁবুর ভেতর কয়েকজন বসে আছেন। কারো পরনে লুঙ্গি শার্ট, কারো পায়জামা।
সঙ্গী আবার বললো, এ ক্যাম্পে বেশির ভাগই ছাত্র। কয়েকজন বেঙ্গল রেজিমেন্ট আর ইপিআরও রয়েছেন। আমাদের ক্যাপ্টেন সেকেন্ড বেঙ্গলে ছিলেন।
বাবুকে দেখে হাসিমুখে তাঁবু থেকে একজন বেরিয়ে এলো। বাবুর চেয়ে বয়সে কিছু কম হবে। বললো, আসুন, আপনার অপেক্ষা করছিলাম। আমার নাম রফিক হাসান।
বাবু হাত মেলালো। নিজের নাম বললো। হাসান মাথা নেড়ে সায় জানালো–আপনার নাম শুনেছি। কোথাও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।
হাসানের হাতে ব্যান্ডেজ। বাবু ওদিকে তাকাতেই হাসান বললো, এ সব কিছু নয়। কথা বের করার জন্যে পাক ফৌজেরা কিঞ্চিৎ আপ্যায়ন করেছিলো।
ওরা দুজন টিনের ঘরটায় গেলো। ঘরের ভেতর কয়েকজন গল্প করছিলো। একজন বাবুকে দেখেই লাফিয়ে উঠলো। বাবু চমকে উঠলো। চিৎকার করে বললো, শওকত ভাই, তুমি!
হাসান অবাক চোখে তাকালো। বললো, চেনেন নাকি?
চিনি না মানে! শওকত ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো বাবুকে–তুমিও তাহলে এসে গেছো!
বাবু কয়েক মুহূর্ত কোন কথা বলতে পারলো না। হাসান বললো, যোগাযোগটা ভালোই হলো তাহলে। শওকত ভাই সত্যিই ভাগ্যবান।
শওকত বললো, ভাগ্যবানের বেশি কোন বিশেষণ থাকলে তাই বলো। বাবু জানো, মিনু আমাদের সঙ্গে আছে!
বাবু অসম্ভব চমকে উঠলো–মিনু!
হ্যাঁ হ্যাঁ মিনু। আমার আগেই ও চলে এসেছিলো। উদ্ধারকর্তা হচ্ছে হাসান। তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে শুনে মিনু বললো, নিয়ে এলাম কেন।
বাবু বললো, মিনু এখন কোথায়?
হাসান বললো, এখানেই আছে, ডেকে দিচ্ছি।
অনেকগুলো বেলুনের ভিড়ে একটা রঙিন বেলুনের মতো বাতাসে ভাসছিলো বাবু। মনে হলো একটা স্বপ্নকে সে ছুঁয়ে ফেলতে যাচ্ছে, যাকে মনে হতো বহু দূর সমুদ্রের বাতিঘরের মতো। মিনু এলো। সেই মিনু, যে স্বপ্নের মতো অথবা কুয়াশার সমুদ্রের সেই বাতিঘর।
মিনু হাসলো–জানতাম তুমি আসবে।
জবাবে বাবু শুধু হাসলো । মিনু বললো, বাবা কোথায়? তোমার ছোট ভাই যে আর্মিতে ছিলো, সে কোথায়?
বাবু বললো, বাবা বাড়িতেই রয়েছেন। ছোট ভাই সম্ভবত কুমিল্লার কোন ফ্রন্টে আছে।
হাসান প্রশ্ন করলো, আপনার ছোট ভাই কোন রেজিমেন্টে ছিলো? টেনথ ইস্ট বেঙ্গলে। বাবু জবাব দিলো।
হাসান অবাক হয়ে বললো, আমিও যে ওখানে ছিলাম ট্রেনিংয়ে। আপনার ছোট ভাইর নাম বলুন তো?
বাবলু।
বাবলু? বিস্ময়ে হাসান হতবাক হয়ে গেলো। আপনিই বাবলুর ভাই?
এবার বাবুর বিস্ময়ের পালা–বাবলুকে চেনেন নাকি?
বারে! বাবলুকে কেন চিনবো না? আমরা যে একসঙ্গেই ছিলাম। ও তো এখন নোয়াখালির ফ্রন্টে। কাল রাতেও ওর সঙ্গে কথা বলেছি। নোয়াখালিতে আমাদের শক্ত ঘাঁটি রয়েছে।
মিনু হেসে বললো, সবাই দেখি মুক্তিযোদ্ধা!
শওকত আবেগের সঙ্গে বললো, আমার সবচেয়ে আনন্দের দিন এটা।
বাবু বললো, সে আনন্দ আমারও।
হাসান বললো, চলুন সেলিব্রেট করি। আমাদের খাবার তৈরি। আজ আমরা আমবাগানে খাবো।
সবাই বাইরে জড়ো হয়েছে। কেউ খাচ্ছে। কেউ খাবার নিচ্ছে। দুজন দুটো বড়ো পাত্র থেকে খাবার তুলে দিচ্ছে। ওরা প্লেট হাতে এগিয়ে গেলো। ডাল ভাত একসঙ্গে খিচুড়ির মতো রান্না। বাবু, মিনু আর হাসান গিয়ে একটা গাছের নিচে বসলো। খুবই সাধারণ খাবার। বাবুর অদ্ভুত লাগলো খেতে। হাসান বললো, গ্রামের লোকেরাই আমাদের খাওয়াচ্ছে। কেউ চাল দেয়! কেউ ক্ষেতের তরকারি দেয়। কখনো জেলেরা মাছ দিয়ে যায়। এদের সহযোগিতা না পেলে মরে ভূত হয়ে যেতাম।
মিনু বললো, জানো বাবু, এদের আমি যত দেখছি তত মুগ্ধ হচ্ছি।
হাসান বললো, সাধারণ মানুষের বিশ্বাস আর ভালোবাসার চেয়ে বড়ো শক্তি আর কিছুই হতে পারে না। ভালোবাসা এক আশ্চর্য শক্তি।
বাবু মৃদু হেসে বললো, কবিতা লেখো নাকি!
হাসান লাল হলো–না, কবিতা ভালোবাসি। সেদিন টেলিভিশনে আপনাকে কবিতা পড়তে দেখছিলাম।
মিনু বললো, আমাকে বাদ দিচ্ছেন কেন হাসান। ওর সঙ্গে আমিও পড়েছিলাম।
হাসান হাসলো–দুজনের কবিতাই আমার ভালো লেগেছিলো।
শওকত শব্দ করে হাসলো–হাসান কখনও কাউকে চটাবে না।
বাবু বললো, টিভিতে আমাদের শেষ অনুষ্ঠানটার কথা মনে আছে মিনু? সেই সিরিজে বলেছিলো ইকবাল। তোমার সঙ্গে কি ওর পরিচয় ছিলো?
মিনু অবাক হয়ে বললো, কেন ইকবালের কি হয়েছে?
বাবু বললো, ইকবালকে ধরে নিয়ে গেছে। অকথ্য অত্যাচার করেছে। বাঁচবে বলে মনে হয় না।
মিনু চুপ করে রইলো। হাসান বললো, আমাদের বেঁচে থাকাটাই হচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিস্ময়।
বিকেলে ওরা পুকুরের ধারে এসে বসলো। চারপাশে কলাগাছ দিয়ে ঘেরা পেছনে সুপুরি গাছের ঘন সারি। অল্প দূরে মস্ত বড় একট বাঁশঝাড়। দুএকটা পাখি ডাকছিলো ঝোঁপের ভিতর। শান্ত বাতাস পুকুরের এক কোণে ঝিরিঝিরি ঢেউ তুলেছে। পুকুরের আরেক দিকে আয়নার মতো স্থির। অদ্ভুত শান্ত একটা সৌন্দর্য ছড়িয়ে ছিলো ওদের চারপাশে। মিনু গুনগুন করে গাইলো, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি। মাটির সাথে পুকুরের ঢেউয়ের সাথে আর ঘন গাছের দেয়ালে মিশে গেলো সেই গান।
আমগাছের আড়ালে দূরে ধানক্ষেত দেখা যাচ্ছিলো। সবুজ গাছের ফ্রেমে সন্ধ্যার লাল সুর্য ধানের সোনালি শিষের সাথে মিশে অপরূপ হয়ে ছড়িয়ে আছে। ফসল তোলার সময় এগিয়ে আসছে। বাংলাদেশের চিরকালের রূপ। অতি পরিচিত দৃশ্য। শত দুর্যোগের ভেতরও যে রূপ অম্লান।
সন্ধ্যা গম্ভীর হলো। রাতের কালো ছায়া থরে থরে জমতে লাগলো। প্রথমে বাঁশের ঝোপে। তারপর আমের বনে, পুকুরের পাড়ের নিচে।
সে ছায়া আরো বড়ো হলো। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়লো। অন্ধকারে ওদের অবয়ব অস্পষ্ট হয়ে গেলো। আলাদাভাবে কাউকে চেনা গেলো না। একজন এসে বললো, কী ব্যাপার। তোমরা সব দেখি এখানে বসে আছো? আমি ঘরে খুঁজলাম।
শওকত বললো, এসো বিপ্লব। বাবু এসেছে।
বিপ্লব বললো, শুনেছি।
হাসান বললো, কেমন এ্যাকশন হলো বিপ্লবদা? সবাই কি ফিরেছে?
বিপ্লব বসলো। বললো, সবাই ফিরেছে। আমাদের আরো গ্রেনেড দরকার। বেশ কয়েকটা গ্রেনেড আজ ফাটেনি।
হাসান বললো, আজ রাতে মেজর জিয়া আসতে পারেন। একজন এসে খবর দিয়ে গেছে।
মেজর জিয়ার কথা শুনে বাবু রোমাঞ্চিত হলো। সাতাশে মার্চের কথা মনে হলো–যেদিন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম ওঁর ভাষণ শোনা গিয়েছিলো। বাবু বললো, হাসান কি স্বাধীন বাংলা বেতারে মেজর জিয়ার ঘোষণা শুনেছিলে?
হাসান বললো, সাতাশ তারিখেই আমরা খবর পেয়েছিলাম। মেজর জিয়ার গলা শুনেছিলাম সেদিন রাতে। একটু থেমে হাসান বললো, চট্টগ্রামের বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি যদি সেই ভাষণ না দিতেন, আমরা অনেকেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতাম। অন্তত বাঙালি সৈন্য যারা ছিলাম তারা তো বটেই। তার ভাষণ শুনেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কি করতে হবে। আমাদের সঙ্গে অন্য কারো যোগাযোগ ছিলো না।
শওকত বললো, বিপ্লব, ওই কবিতাটা পড়েছিলে–একটি কবিতার জন্যে?
বিপ্লব বললো–একটি কবিতা লেখা হবে।
তার জন্যে আগুনের শিখার মতন আকাশ
রাগে রী-রী করে, সমুদ্রে ডানা ঝাড়ে
দুরন্ত ঝড়, মেঘের ধূম্র জটা
খুলে খুলে পড়ে বজ্রে হাঁকডাকে
অরণ্যে সাড়া, শিকড়ে শিকড়ে
পতনের ভয় মাথা খুঁড়ে মরে
বিদ্যুৎ ফিরে তাকায়
সে আলোয় সারা তল্লাট জুড়ে
রক্তের লাল দর্পণে মুখ দেখে
ভষ্মলোচন।
একটি কবিতা লেখা হয় তার জন্যে।
অন্ধকারে একজন এসে হাসানকে নিচু গলায় কী যেন বললো। হাসান সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেলো।
মিনু বললো, বিপ্লবদা এতো কবিতা যে কী করে মনে রাখো ভেবে অবাক
বিপ্লব হাসলো–এ সব কি কখনো ভোলা যায়! মনে হয় না সব আমাদের জন্যে লেখা? নাজিম হিকমতের সেই কবিতাটা শুনেছো–
কেঁদে কেঁদে চোখে আর কান্না নেই।
আমাদের খানিক বিষণ্ণ, খানিক রুক্ষ করে রেখে
চোখের জল শুকিয়েছে।
তাই আমরা ভুলেই গিয়েছি
কেমন করে ক্ষমা করতে হয়।
রক্তের নদী উজিয়ে
আমাদের নিশানা
দাঁত আর নখ দিয়ে
ছিনিয়ে নিতে হবে জয়–
কিছুই আমরা ক্ষমা করবো না।
সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলো সেই কবিতা। মিনু এক সময় বললো, পৃথিবীর সকল মুক্তিকামী নিপীড়িত মানুষের জন্যে এ কবিতা। হাসান ফিরে এলো। বললো, কিছুক্ষণের ভেতর মেজর জিয়া আসছেন। গ্রেনেড তাঁর সঙ্গে আসছে। বিপ্লবদাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
আকাশে চাঁদ উঠলো। অন্ধকারটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর আমগাছের নিচে একটা জিপ থেকে মেজর জিয়া নামলেন। চাঁদের আলো আমগাছের তলায় আলোছায়ার আল্পনা এঁকেছে। সেই আল্পনার ওপর পা। রাখলেন মেজর জিয়া। হাসান বাবুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো–এর কথাই আপনাকে বলেছিলাম।
মেজর বাবুর সঙ্গে হাত মেলালেন। বললেন, তুমি আমাদের জন্যে যা করেছো আমি সব খবরই পেয়েছি। কগ্র্যাচুলেশন মাই বয়। বিপ্লবকে বললেন, তোমার অপারেশন চমৎকার হয়েছে। আমি স্পটে গিয়েছিলাম। মিনুকে। বললেন, শিবিরের জীবন কেমন লাগছে?
মিনু শুধু বললো, চমৎকার।
শওকতের পিঠ চাপড়ে বললেন, তুমি কদিন বিশ্রাম নেবে। ওষুধ খাবে ঠিকমতো।
শওকত হাসলো। মেজর বললেন, আমি যাচ্ছি। তোমাদের জন্যে আমার শুভেচ্ছা রইলো। এক সপ্তাহ পরে আবার আসবো।
মেজর জিয়া জিপে উঠলেন। হাত নাড়লেন। ওরা সবাই হাত নাড়লো।
জিপটা চলে গেলো আমবাগানের ভেতর দিয়ে। ওরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর আবার পুকুরের ধারে গিয়ে বসলো।
চাঁদের আলোয় দূরে কুয়াশার ফিকে চাদর ঝুলছে। শেষ বসন্ত এখন। রাতে কিছুটা শীতের আমেজ এখনো আছে। বাবু ভাবলো, পৃথিবীটা কেন এই বসন্তের রাতের মতো সুন্দর হয় না। চৈত্রের আকাশে ঘুরে বেড়ানো লোভী শকুনরা কেন। বসন্তের পৃথিবীতে ছায়া ফেলে?
দূরে কোথাও কোকিল ডাকছিলো। মিনু বললো, এখন তো বসন্তকাল, তাই না বাবু?
বাবু মাথা নাড়লো–এখনও বসন্ত।
বিপ্লব বললো, বুর্জোয়া শিল্পীরা বিলাসী জীবনের উপমা খোঁজে বসন্তের সাথে। অথচ দেখো এ বসন্তের রূপ কত আলাদা! কোকিলের শিস যেন কোন মুক্তিযোদ্ধার ব্যালাড। কৃষ্ণচূড়ায় রক্তের ছায়া কাঁপে। পলাশের গাছ আগুন ছড়ায়। চৈত্রের বাতাসে বারুদের গন্ধ ভাসে। তেরোশ সাতাত্তরের এই বসন্ত দেখো, কত স্বতন্ত্র! কত উজ্জ্বল। আগামী বছরের জন্যে রেখে যাচ্ছে সংগ্রামের ডাক।
স্বতন্ত্র সেই চৈত্র শেষের রাত আরো গম্ভীর হলো। ওরা সে রাতে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলো বসন্তের এক উজ্জ্বল গ্রামে। যেখানে কৃষ্ণচূড়ায় রক্তের ছায়া, পলাশে আগুনের স্পর্শ, বাতাসে বারুদের গন্ধ।
শেষ রাতে ওরা ক্যাম্পে ফিরে গেলো। বহুরাত অবধি জেগেছিলো বাবু। ঘুমিয়েছিলো শেষ রাতে।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলো বাবু। সেই স্বপ্নটাই দেখলো, একদিন যে স্বপ্ন ওকে আতঙ্কের রাজ্যে ছুঁড়ে দিয়েছিলো। এবার একই স্বপ্ন দেখলো–তবে অন্য ভাবে।
বিশাল আকাশে ঝুলছে রুপোলি চাঁদ। একটা কালো মেঘ আগের মতো ঢেকে দিলো শান্ত চাঁদটাকে। নরম রুপোলি চাঁদটা হারিয়ে গিয়ে সব কিছু আগের মতো অন্ধকার হয়ে গেলো। তারপর ঝড় উঠলো। গোলাপ বাগানে ইউক্যালিপটাসের সারিতে, সারি সারি সুপুরি গাছে, পুকুরের শান্ত পানিতে ঝড়ো বাতাসে উদ্দাম হয়ে বয়ে গেলো।
তারপর বিধ্বস্ত পৃথিবীতে পাতা ঝরা গাছগুলো দাঁড়িয়ে রইলো সারি সারি সাজানো ধারালো বর্শার মতো। আরো বাতাস এলো। মেঘগুলোকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললো।
সবশেষে সূর্য উঠলো। জ্বলন্ত ইস্পাতের গোলকের মতো টকটকে লাল সূর্য। অসম্ভব লাল সুর্য। সে লাল গলে পড়লো সবুজ গাছের ভিড়ে, ফসলের সোনালি মাঠে।
বাবু এতদিনে স্বপ্নের অর্থ খুঁজে পেলো।