০৯-১০. মেজদা ও তাঁর সঙ্গীরা

০৯. মেজদা ও তাঁর সঙ্গীরা

ঘরে ফিরতেই রামু আর বিজু মহা হইচই আরম্ভ করে দিলো। কী স্বার্থপর তুই। আমাদের ফেলে একা চলে গেলি! তোর সাহস তো কম নয়! পথে কিছু ঘটলে একা সামলাতে পারতি?

এরকম অনেকগুলো কথা ওদের দুজনের মুখ দিয়ে ফোয়ারার মতো বেরুতে লাগলো। আমার মনটা তখন এত বেশি প্রসন্ন ছিলো যে, ওদের কথার বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করি নি। গোলাপ ফুলটা আমি ছোট্ট একটা ডিম্পলের শিশিতে রেখে দিলাম। ডিম্পলের শিশিটা আমাকে অনেক আগে মেজদা দিয়েছিলেন। ওতে আমি তুত-মেশানো রঙিন পানি রাখতাম। মাঝে মাঝে সরকারদের বাসা থেকে ফুল চুরি করেও শিশিটায় রেখে দিতাম। সোনিয়ার দেয়া বড় গোলাপটা শিশিতে করে টেবিলের মাঝখানে রাখার পর মনে হল সারা ঘর আলো হয়ে গেছে। রামু, বিজু ওটা দেখে কিছু বললো না। ওরা হয়তো ভেবেছে আমি চুরি করে এনেছি। ভাবুকগে। আজ সকালে সোনিয়ার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা আমি কাউকে বলবো না।

কুয়াশা কেটে গিয়ে যখন নীল আকাশ, ঘন সবুজ ঝাউবন দূরের ধূসর পাহাড় হলুদ রোদে ঝলমল করে উঠলো তখন মেজদা এলেন তাঁর দলবল নিয়ে। দুটো বড় জিপে মালপত্র বোঝাই করে এনেছেন তিনি। মেজদার গাড়ি দেখার জন্যে আমরা তিনজন ছাদে বসেছিলাম। দুদ্দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে, মেজদা এসেছে–বলে একছুটে একেবারে সদর দরজায় চলে গেলাম।

আমাদের দেখে মেজদা হেসে বললেন, এই যে থ্রি মাস্কেটিয়ার্স। তোমরা সবাই ভালো আছো তো? চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে খুবই ভালো আছো।

আমরা তিনজন শুধু হাসলাম। মেজদা জিপ থেকে নামলেন। তাঁর পাশে বসা ছিলো দারুণ সাজগোজ করা এক মহিলা। চেহারাটা চেনা-চেনা মনে হলো। তিনিও মেজদার পেছন-পেছন নামলেন। বিজু আমার কানে কানে বলল, মেজদার হবু বউ নাকি রে!

আমি ততক্ষণে সেই মহিলাকে চিনতে পেরেছি। চাপা গলায় বিজুকে ধমক দিলাম–কী যা তা বলছিস! ইনিই তো মেজদার ছবির নায়িকা ঊর্মিলা। কাগজে ছবি দেখিস নি?

আমার কথা শুনে বিজুর চোখ কপালে উঠে গেলো। আসলে ছবির নায়িকা ঊর্মিলাকে এই অবস্থায় দেখবো আমি ভাবতেই পারি নি। ছবিতে ঊর্মিলা গরিবের মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন, কথায় কথায় কেঁদে বুক ভাসিয়ে দেন। সারাক্ষণ চেহারায় একটা দুঃখের ভাব ঝুলিয়ে রাখেন। সিনেমায় তাঁকে দেখলে মেয়েরা সব সময় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। মনে হয় ঊর্মিলার চেয়ে দুঃখী মেয়ে সারা পৃথিবীতে দুটো নেই। অথচ আমরা এখন যে ঊর্মিলাকে দেখছি তিনি চুমকির নকশায় বোঝাই একখানা বেগুনি রঙের জর্জেটের শাড়ি পরেছেন। গলায় নেকলেসটা নির্ঘাত আসল হিরে দিয়ে বানানো। তাঁর মুখটা ভীষণ চকচক করছিলো। চোখের পাতায় হালকা বেগুনি রঙ, তার উপর রূপোলি গুঁড়ো, গালে আপেলের রঙ, ঠোঁটে মুক্তোর রঙের লিপস্টিক মাথা, নখে বেগুনি রঙের নেলপালিশ, আঙুলে কবুতরের ডিমের মতো বড় বেগুনি রঙের পাথর বসানো আঙটি–সবকিছু মিলিয়ে রীতিমতো চোখ-ধাঁধানো ব্যাপার।

পেছনে ছিলেন বাংলা ছবির নায়কসম্রাট আব্বাস। সিনেমার এই শরৎচন্দ্রীয় নায়কটি পরেছেন সেইন্ট-এর ছাপঅলা টকটকে লাল গেঞ্জি আর ঘন নীল প্যান্ট। নায়িকা ঊর্মিলা আর নায়ক আব্বাস দুজনকেই দারুণ স্মার্ট দেখাচ্ছিলো। তবে মেজদা যদি আমাদের দুলালদাকে দেখতেন তবে সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁকে আগামী সব কটা ছবির নায়ক বানিয়ে ফেলতেন।

কমেডিয়ান আলতামাসকে দেখে আমাদের হাসি চাপা দায় হলো। গোপাল ভাঁড়ের মতো দেখতে বেঁটেখাটো, মস্ত বড় ভুড়ি, মাথা জুড়ে বিশাল টাক; চোখে এমন একটা নিরীহ ভাব যে, এই ভদ্রলোককে ছবিতে দেখে ছেলেবুড়ো সবাই হেসে গড়াগড়ি যায়। তার সঙ্গে আরো দুজন মহিলা রয়েছেন। ওঁরা বোধ হয় নায়িকার বান্ধবী-টান্ধবী হবেন।

ছোটকা ছোড়দা ঝন্টুদা সবাই এসে চেঁচিয়ে চাকর-মালি সবাইকে ডেকে হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে তুলেছেন। ছোড়দা এমনই চাচাচ্ছিলেন যে মেজদা শেষ পর্যন্ত হেসে বললেন, নাটক করে করে গলাটা কী বানিয়েছিস হাঁদু? তোর চিৎকারে আমার কানের ভিতর প্রজাপতি ওড়া শুরু করেছে।

আমাদের সদর দরজার কাছে তখন রীতিমতো ভিড় জমে গেছে। ছোটকা বললেন, পন্টু, এঁদের নিয়ে ভেতরে যা। জিনিসপত্র সব আমরা নামাচ্ছি।

তোমাদের কিছু করতে হবে না ছোটকা। প্রোডাকশনের ছেলেরা আছে। ওরাই সব করবে। এই বলে মেজদা আমাদের দিকে তাকালেন–রামু, আবু, বিজু সবাই ওপরে চলো। তোমাদের জন্যে কিছু সুন্দর উপহার এনেছি। পরীক্ষায় নিশ্চয়ই তোমাদের আগের প্লেসগুলো বহাল রয়েছে?

আমরা হেসে মাথা নাড়লাম। নায়িকা ঊর্মিলা, নায়ক আব্বাস, কমেডিয়ান আলতামাস আর সঙ্গে অচেনা একজন ভদ্রলোককে নিয়ে মেজদা ওপরে গেলেন। গলায় ভিউ ফাঁইন্ডার ঝোলানো দেখে, তাঁকে প্রথম থেকেই ভেবেছিলাম ছবির ক্যামেরাম্যান।

মেজদা আমাদের জন্যে এনেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঁধানো রচনাবলীর বারোটি খন্ড। রামুর জন্যে এনেছেন রিডার্স ডাইজেস্ট-এর মস্তবড় একটা এ্যাটলাস আর তিনখন্ড এনসাইক্লোপিডিয়া। বিজুর জন্যে এনেছেন হেমেন্দ্রকুমার রায়ের সমগ্র রচনাবলী। মেজদা কী করে যে আমাদের মনের কথা টের পান বুঝি না। মা আমার বই দেখে বললেন, ওর কি এসব বই পড়া উচিত হবে?

মেজদা হেসে বললেন, ও যে আমার আলমারির বঙ্কিম আর শরৎ রচনাবলী পড়ে শেষ করেছে সে খবর নিশ্চয়ই আপনার কানে যায় নি কাকিমা! মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সব লেখা ও অবশ্য এখন বুঝবে না। তবু ওর পড়া দরকার। এগুলো খারাপ কিছু নয়।

মাকে বললাম, আমি কবে পদ্মা নদীর মাঝি পড়েছি! ওতে না বোঝার কী আছে!

সব মায়েরাই নিজের ছেলেদের ভাবেন কম বোঝে।

রামু মেজদাকে বলেছিলো এ্যাটলাসের কথা। মেজদা যে এত সুন্দর আর দামী এ্যাটলাস আনবেন ও ভাবতেই পারেনি। ওর চেহারা দেখে মনে হল কেঁদে ফেলবে। শেষ পর্যন্ত রামু তাই করলো। বই নিয়ে চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে কেঁদেই ফেললো। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই চোখ মুছে ফেলেছিলো। আমি জানি খুব খুশি হলে বা দুঃখ পেলে রামুর মেজ জেঠুর কথা মনে পড়ে যায়। মেজ জেঠু যখন মারা যান তখন ও আর আমি ক্লাস ফোরে পড়তাম। রামুর কাছে গিয়ে ওর পিঠে হাত রেখে বললাম, তুইই কিন্তু জিতেছিস রামু। মেজদা তোকে বেশি ভালোবাসেন।

রামু হেসে বলল, বারে, আমি যে ফার্স্ট হয়েছি। গতবার মেজদা আমাকে কী সুন্দর একটা শার্ট পাঠিয়েছিলেন।

সেবার মেজদা আমাকে আর বিজুকে কিছু পাঠান নি। তবে রামুর জন্যে ড্রাগনের ছবি-আঁকা যে জামাটা পাঠিয়েছিলেন ওটা আমিও কদিন পরেছি। এমনভাবে পরেছি যাতে বাইরের লোকেরা ভাবে মেজদা আমাদের জন্যে দুটো এক রকম জামা পাঠিয়েছেন।

বিজু হঠাৎ খুশিতে চেঁচিয়ে উঠে বললো, দেখ দেখ, এখানে হিমালয়ের ভয়ংকরটা আছে।

রামু বলল, সমগ্র রচনাবলী মানে কী রে বোকা! ওতে হেমেন্দ্রকুমারের সব লেখাই পাবি।

বিজু গম্ভীর হয়ে বলল, দাঁড়া, এখনো মানুষ পিশাচটা খুঁজে পাচ্ছি না।

আমার এখন আর হেমেন্দ্রকুমার ভালো লাগে না। রামু এসব বই কখনো পড়ে না। ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনো লেখা পড়েছে বলে আমার মনে হয় না। তবে এটা ঠিক যে এনসাইক্লোপিডিয়াগুলো শেষ করতে রামুর বেশিদিন লাগবে না। ও সবসময় অন্য ধরনের বই পড়ে। গল্প, উপন্যাস ছাড়া মনে হয় ওর সবই ভালো লাগে।

রামু বললো, হারে আবু, সোনিয়াকে মেজদার স্যুটিং দেখতে বলবি না?

আমি বললাম, মেজদা যদি কাছাকাছি কোথাও স্যুটিং করেন তবে বলবো।

আজ বিকেলে কি ওদের বাসায় যাবি?

নিশ্চয়ই যাবো।

যদি মেজদার স্যুটিং থাকে?

তাহলে তোরাই স্যুটিং দেখিস। আমি ওদের বাসায় যাবো বলে কথা দিয়েছি।

রামু এরপর আর কোনো কথা বললো না। রামুর জন্যে আমার মনটা নরম হয়ে গেল। রামু বুঝতে পেরেছে কিনা জানি না, তবে আমার মনে হলো সোনিয়া আজ সকালে আমার মনে এত কাছাকাছি চলে এসেছে যে, এতদিন রামু-বিজু ছাড়া অন্য কেউ সেখানে আসতে পারে নি। একবার মনে হলো রামু সোনিয়াকে হিংসে করছে। সে যাই ভাবুক, সোনিয়া হলো সোনিয়াই। ওর জায়গাতে ও আসবেই। ও যদি আমার জন্যে ভাবে, আমি কেন ওর জন্যে ভাববো না? সোনিয়াকে রামুর হিংসে করা উচিত নয়।

একটু পরে মেজদা নারকেলের চিড়ে চিবুতে চিবুতে আমাদের ঘরে এলেন। বললেন, আজ দুপুরের পর কমলালেবুর বাগানে স্যুটিং করবো। তোমরা থেকো।

মেজদা ছাদে গিয়ে ঘুরে ঘুরে চারপাশটা দেখলেন। বললেন, একদিন পিয়াইন নদীতে যাবো স্যুটিং করতে। আমার নায়িকাটি সেই নদীতে ডুবে মরবে।

বিজুর চোখ দুটো আলুর মতো হয়ে গেলো। রামু বললো, অমন করে তাকাচ্ছিস কেন বিজু? চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে যাবে যে! ও কি সত্যি সত্যি মরবে!

বিজু বলল, আমি বুঝি তাই বলেছি! আমি ভাবছি অত উঁচু থেকে নদীতে লাফ দেবে কী করে?

মেজদা বললেন, আসলে কি আর লাফ দেবে! লাফ দেয়ার মুহূর্তে আমি ওকে কাটবো। কেটেই ক্যামেরায় নদীর স্রোত ধরবো। আমার ক্যামেরামান অবশ্য বলেছিলো ডামি দিয়ে পড়ার শটটা নিতে। আমি রাজি হই নি। আমি ওখানে একটা মন্টাজ এফেক্ট রাখবো। এখন কি আর ছবিতে সব কিছু রিয়ালিষ্টিক দেখায়!

মেজদার কথা শোনার সময় বিজু হা করে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়েছিলো। আমি আর রামু না বুঝেও গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ছিলাম। মেজদার ধারণা ওঁর ভাই বলে মন্টাজ ফন্টাজ সবই যেন আমরা বুঝি।

পাহাড়ি ঝর্নার দিকে তাকিয়ে মেজদা বললেন, কী চমৎকার জায়গা। আমাদের দেশের যে এরকম স্যুটিং স্পষ্ট আছে কেউ ভাবতেও পারবে না। পাহাড় আর ঝর্নায় আমার নায়ক ভিলেনের চেযিংটা ভালো জমবে। আমাদের ফাঁইট ডিরেক্টর অবশ্য দুদিন পরে আসবে। বেচারা এক আনাড়ি এক্সট্রাকে সোর্ড ফাঁইট শেখাতে গিয়েছিলো। তারপর নিজেই কাঠের তলোয়ারের খোঁচা খেয়ে জখম হয়ে হাসপাতালে পড়ে আছে।

আমি বললাম, আপনার ভিলেনকে তো দেখলাম না মেজদা।

মেজদা বললেন, আমাদের প্রোডাকশনের বাবুর্চিটা ভিলেনের পার্ট করবে। ওর ডায়ালগ বেশি নেই। সবই প্রায় এ্যাকশন। সবাই কাজ দেখে বলছে, ওর কপাল খুলে গেছে। ওকে আর বাবুর্চিগিরি করতে হবে না। নামকরা স্টার হয়ে যাবে। তবে আলাদিন আমাকে বলেছে, ওর ইচ্ছে নাকি ডিরেক্টর হওয়া।

আমি হেসে বললাম, ডিরেক্টর হওয়া বুঝি খুব সোজা ব্যাপার মেজদা?

মেজদা বললেন, আমাদের দেশে এ আর এমন কঠিন কী! আমার বন্ধু স্যালকে মনে আছে তোদের? ও তো দুটো সিরিয়াস ছবি করতে গিয়ে মার খেয়ে পথে বসেছে। আর ওর ইউনিটের টি-বয় ছিল আক্কাস আলী। সে এখন দুটো রূপকথা বানিয়ে দারুণ হিট ডিরেক্টর। শুনছি ওর ছবি নাকি বিদেশেও যাচ্ছে। ছবি বানানো আমাদের দেশে এত সোজা কাজ যে কোনোদিন যদি শুনি আমাদের বনমালী সুপার হিট ডিরেক্টর হয়ে গেছে, তখন আমি এতটুকু অবাক হবো না।

আমাদের বুড়ো বনমালী–যে এখনো বলে পৃথিবীটা একটা মস্তবড় গরুর শিঙের ওপর রাখা আছে, গরু শিং বদল করার সময় পৃথিবীতে ভূমিকম্প হয়; যার ধারণা আমাদের বাড়িটার চেয়ে বড় বাড়ি পৃথিবীতে আর নেই–ও হবে ফিল্ম ডিরেক্টর! আমরা তিনজন হেসে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে গেলাম। মেজদা দারুণ মজার কথা বলতে পারেন! আমাদের হাসি দেখে মেজদা ভুরু কুঁচকে বললেন, হাসছিস কেন, ঢাকায় গেলে তোদের দেখিয়ে দেবো ওখানে এখন কারা ছবি বানাচ্ছে। জাহাঙ্গীরদের গাড়ির ড্রাইভারটাও যে দুটো ছবি বানিয়েছে সে খবর রাখিস? সেই ছবির নায়কও ছিলো ও নিজে। ছবি দুটো অবশ্য ভালো চলে নি। কালো টাকার দাপটে গোটা দেশটা একেবারে রসাতলে গেছে।

মেজদা একসময় দু-তিনটা ভালো ছবি বানিয়ে দারুণ নাম করেছিলেন। তবে সে ছবি বানাবার জন্যে আমাদের বাড়িটি বন্ধক রাখতে হয়েছিলো। আজকাল মেজদাও ধুম-ধাড়াক্কার জবরদস্ত ফাঁইটিং ছবি বানাচ্ছেন। এখন যেটার স্যুটিং করছেন সেটার নাম রাজকন্যা কঙ্কাবতী। কাহিনীটি অবশ্য রূপকথার। তবে সোর্ড ফাঁইটের সঙ্গে জুডো, কারাত, গান-ফাইট সবই নাকি আছে। মেজদার গত ছবিটা ছিলো এক ডাকাতের জীবনী নিয়ে। দিদা ওই ছবি দেখে হাসতে হাসতে খুন হয়ে গেছেন। যদিও ছবিটা আগাগোড়া ছিল করুণ রসে ভরপুর। নায়িকা ঊর্মিলার করুণ অভিনয় দেখে কত মহিলা যে হলে বসে হাউমাউ করে কেঁদেছেন তার ইয়ত্তা নেই। দিদা ছবি দেখে বলেছেন, পন্টুর বুদ্ধি-সুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে নাকি! লোক হাসানোর জন্য এসব বানাবার কোনো মানে হয়! তবে ছোট কাকিমা আড়ালে বলেছেন, মার সবটাতেই বাড়াবাড়ি। আমার কাছে তো ছবিটা ভালোই লেগেছে।

দুপুরে খাওয়ার পর মেজদা দলবল নিয়ে কমলাবাগানে চলে গেলেন। বললেন, যতক্ষণ রোদ থাকবে ততক্ষণ স্যুটিং করব। দেখি নায়ক-নায়িকার ডুয়েট গানটা পুরো পিকচারাইজ করা যায় কিনা।

রামু আর বিজু মেজদার সঙ্গে গেলো। আমি চলে গেলাম সোজা সোনিয়াদের বাড়িতে। সোনিয়াকে গিয়ে বললাম, মেজদা স্যুটিং করবেন কমলালেবুর বাগানে। যাবি স্যুটিং দেখতে?

হাসি খালা বললেন, পন্টু কবে এসেছে আবু?

আমি বললাম, আজ সকালে। সোনিয়াকে নিয়ে স্যুটিং দেখতে যাবো হাসি খালা?

হাসি খালা উল বুনতে বুনতে বললেন, যাও। তবে বিকেলে এখানে চা খেতে ভুলে যেও না।

নুড়ি-বিছানো পথে আমি আর সোনিয়া হাত ধরাধরি করে হাঁটছিলাম। শীতের শেষ দুপুরের নরম রোদের ভেতর মনে হলো, আমরা যেন দুটো রঙিন প্রজাপতি হয়ে স্বর্গের বাগানে উড়ছি।

কমলালেবুর বাগানে মেজদা একটা গানের দৃশ্য ক্যামেরায় তুলছিলেন। গানের কথাগুলো ভারি করুণ। পেছনে টেপরেকর্ডারে গানটা গাইছিলেন দুজন গায়ক-গায়িকা। নায়ক আব্বাস আর নায়িকা ঊর্মিলা চোখে গ্লিসারিন দিয়ে কাপড় আলুথালু করে অত্যন্ত হাস্যকর কথাঅলা সেই গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলাচ্ছিলেন। এমন দুঃখের দিনেও নায়িকা সবুজ বেনারসি শাড়ি পরেছেন। গায়ের সব অলঙ্কার ওজন করলে সের খানেকের কম হবে না। নায়কের গায়ে জরির কাজ-করা সিল্কের পাঞ্জাবি-পায়জামা আর প্ল্যাটফর্ম হিল স্যান্ডেল। স্যান্ডেলের হিল কম করে হলেও চার ইঞ্চি উঁচু। আমি একজন অল্পবয়সী এ্যাসিস্টেন্টকে বললাম, রূপকথার রাজারা কি প্ল্যাটফর্ম হিল স্যান্ডেল পরতো?

প্রায় আমাদের বয়সী এ্যাসিস্টেন্টটি বলল, নায়ক একটু বেঁটে বলে সব সময় ওকে প্ল্যাটফর্ম হিল পরতে হয়। রূপকথার ছবিতে ওঁর ফুলশট কখনো নেয়া হয় না। এমনিতে উনি ম্যাডামের চেয়ে একটু বেঁটে।

ছবির এ্যাসিস্টেন্ট বা প্রোডাকশনের লোকেরা নায়িকা ঊর্মিলাকে ডাকে ম্যাডাম। মেজদা শুধু ঊর্মিলা ডাকেন। মেজদার পুঁচকে এ্যাসিস্টেন্টটি আমাকে চোখ মটকে ফিস ফিস করে বললো, পন্টু ভাইর সঙ্গে ম্যাডামের বিয়ে হচ্ছে খুব শিগগিরই।

আমি ভীষণ অবাক হলাম। কথাটা সোনিয়াকে না বলে পারলাম না। সোনিয়া শুধু বলল, ভালোই তো। তোদের চমৎকার সুন্দর একটা ভাবী হবে।

স্যুটিং-এর সময় একবার দারুণ এক মজার ব্যাপার ঘটে গেলো। নায়ক আব্বাস করুণ সুরে গানটি গেয়ে নায়িকার পেছন-পেছন দৌড়োচ্ছেন ঠিক তখনই তিনি পা মচকে পড়ে গেলেন। দুঃখের গান থামিয়ে বাবারে বলে নায়কম্রাট আব্বাস পা চেপে ধরে ঘাসের উপর বসে রইলেন। ইউনিটের সবাই দারুণ ব্যস্ত হয়ে শুকনো মুখে সেদিকে ছুটে গেলো। সোনিয়া আর আমি তখন হাসি চাপতে গিয়ে বারবার কেঁপে উঠছিলাম। পরে থাকতে না পেরে আমরা দুজন বাগানের বাইরে এসে হাসতে হাসতে খুন হয়ে গেলাম। আমার মনে হয় স্যুটিং-এর সময় বা ঘটে সেসব কথা নিয়ে যদি একটা ছবি বানানো যায়, তাহলে সেটা পৃথিবীর সেরা হাসির ছবি হবে। সোনিয়াকে বললাম, রাজকন্যা কঙ্কাবতী একটা দারুণ হাসির ছবি হবে।

সোনিয়া হাসতে হাসতে বললো, হাসির নয় বরং হাস্যকর ছবি। উঁহু, দুঃখের দিনেও নায়িকা টকটকে লিপস্টিক আর নেলপলিশ লাগাতে ভোলে নি। সারামুখে কত রকমের রঙই না মেখেছে। অবশ্য রাজকন্যাদের ব্যাপার-স্যাপারই অন্যরকম।

আমি বললাম, মেজদার পুঁচকে এ্যাসিস্টেন্টটা বলেছে এ তো আর সাধারণ মানুষের দুঃখ নয়। রাজকন্যার রাজকীয় দুঃখ। রাজকন্যারা সবসময় বেনারসি পরেন যে।

সোনিয়া বললো, কেন শহুরে মেয়েরা পরে না? সেদিন একটা বাংলা ছবি দেখেছি। ওতে শহুরে নায়িকাটির শাড়ি আর গয়নাপত্তর এই রাজকন্যার চেয়ে কম ছিলো না।

আহা বুঝিস না কেন? বেচারাদের যে একসেট গয়নাই আছে। চাষীর মেয়ের পার্ট করলেও ওটাই পরতে হয়।

আমার কথা বলার ধরন দেখে সোনিয়া হেসে গড়িয়ে পড়লো।

.

১০. কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত

সোনিয়ার হাত ধরে যখন ওদের বাসায় গেলাম, হাসি খালা তখনো লনে বসে উল বুনছিলেন। আমাদের দুজনকে দেখে বললেন, আর দুজন কোথায়?

আমি বললাম, ওরা স্যুটিং শেষ না করে আসবে না।

স্যুটিং-এর সময় রামু-বিজু সোনিয়াকে আমার সঙ্গে দেখে একটা কথাও বলে নি। এমনভাবে ওরা স্যুটিং দেখছিলো যে আমাদের দেখতেই পায় নি। আমি শুধু আসার আগে বলে এসেছি, বাড়ি ফেরার পথে হাসি খালাদের বাসা হয়ে যাস।

হাসি খালা বললেন, ঠিক আছে। ততক্ষণে আমরা এক কাপ চা খেতে পারি।

সোনিয়া চায়ের কথা বলার জন্যে ভেতরে চলে গেলো। আমি বললাম, দুলালদাকে আপনার কথা বলেছি হাসি খালা। শুনে তিনি খুব খুশি হয়েছেন। বলেছেন, আপনার কথা সবসময় ওঁর মনে থাকবে। কয়েকদিন পরে তিনি আপনার সঙ্গে দেখা করবেন।

হাসি খালা উল বুনতে বুনতে বললেন, ওদের কোনো কাজে লাগতে পারলে আমি খুবই খুশি হবো। অয়নকে ওর বাবা জোর করে কানাডা পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি চেয়েছিলাম অয়ন দেশে থাকুক।

হাসি খালা দুলালদাকে নিয়ে তার ছেলের দুঃখ ভুলতে চাইছেন। হাসি খালা হয়তো জানেন না দুলালদারা অন্যরকম ছেলে। দিদা তো দুলালদাকেই বলেছেন, তোদের বেঁধে রাখা যায় না। আমার কেন যেন মনে হলো দুলালদার জন্যেও হাসি খালা দুঃখ পাবেন। অনেক মানুষ আছে যাদে গোটা জীবনটাই দুঃখে ভরা থাকে। হাসি খালা ঠিক সেরকম একজন।

সোনিয়া চা নিয়ে এলো। হাসি খালা সোনিয়া আর আমি চুপচাপ বসে চা খেলাম। হাসি খালার উল বোনার ভঙ্গিটি ভারি সুন্দর। তার আঙুলগুলো দেখে মনে হল একটা সোনালি প্রজাপতি বুঝি এক ছন্দের গতি নিয়ে সবুজ ঝোঁপের ভেতর উড়ে বেড়াচ্ছে।

লনের উপর থেকে শেষ বিকেলের মিষ্টি রোদ সরে গিয়ে ইউক্যালিপটাসের পাতা জড়িয়ে কিছুক্ষণ পড়ে রইল। আমি ইউক্যালিপটাসের পাতায় রোদের খেলা দেখছিলাম। আরো কিছুক্ষণ পর রামু আর বিজু এলো। দুজনের মুখে চাপা উত্তেজনা আর আনন্দ। বিজুর চোখ দুটো রীতিমতো জ্বলজ্বল করছে। হাসি খালা ওদের দেখে মৃদু হেসে বললেন, স্যুটিং দেখাটা ভারি মজার তাই না?

বিজু বলল, দারুণ মজার! হাসি খালা, কাল যাবেন দেখতে?

হাসি খালা মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন–আমাদের মতো বুড়োরা কি স্যুটিং দেখে!

রামু আমার কানে ফিসফিস করে বললো, ঊর্মিলা আমাদের সঙ্গে কথা বলেছে। দুপ্যাকেট চুইংগাম দিয়েছে।

রামুর চুইংগামের ব্যাপারে আমি বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখালাম না। ওরা যখন ঊর্মিলার সঙ্গে কথা বলছে তখন আমি সোনিয়ার সঙ্গে বসেছিলাম। ঊর্মিলা যে ওঁদের সঙ্গে কী কথা বলতে পারেন সেটা আমার জানা আছে। কোন্ ক্লাশে পড়, বড় হলে কী করবে কিংবা মেজদার ছবি দেখ কিনা–এসব কথা ছাড়া ঊর্মিলার সঙ্গে ওদের অন্য কোনো কথা হতে পারে না।

সন্ধ্যের পর আমরা বাড়ি ফিরে গেলাম। কমেডিয়ান আলতামাস, ছোড়দাদের নাটকের সংলাপ শিখিয়ে দিচ্ছিলেন। মেয়েদের সংলাপ বলার সময় আলতামাস গলাটাকে একেবারে মেয়েদের মতো করে ফেলছিলেন। আবার লুঙ্কার গলা একরকম, আলেয়ার গলা আরেকরকম। আমরা তিনজন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সেই অভূতপূর্ব সংলাপ শুনলাম। নবাব সিরাজউদ্দৌলা, আলেয়া আর লুঙ্কার ভূমিকায় আলতামাসকে একসঙ্গে কল্পনা করে আমরা হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খেলাম।

সন্ধ্যের পর থেকেই আকাশে মেঘ জমছিলো। দুলালদার ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে বিজু খেয়েদের ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি আর রামু ছাদে পায়চারি করছিলাম। এলোমেলো ঝড়ো বাতাসে ঝাউবনের ভেতর থেকে শনশন শব্দ ভেসে আসছিলো। দুলালদা এলেন অনেক রাতে। বললেন, বাড়িতে সবাই আজ জেগে রয়েছে দেখছি।

রামু বললো, মেজদা এসেছেন যে। কত কী মজা করলাম আমরা!

আমি বললাম, চলুন দুলালদা আগে খেয়ে নি। পরে গল্প করা যাবে।

দুলালদা বললেন, তাই ভালো। তোমাদের সঙ্গে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।

খাবারের আয়োজন দেখে দুলালদা ভারি খুশি। বললেন, দুপুরে শুধু পোড়া শুঁটকি মাছ আর একটু মদ খেয়েছি।

রামু বললো, আপনি মদ খান দুলালদা?

দুলালদা হাসলেন–সখ করে খাই না। মদ খাসিয়াদের কাছে খুবই পবিত্র এবং প্রিয় পানীয়। একেবারে যে গরিব, যার একবেলা ভাত জোটে না, তার ঘরেও যবের তৈরি মদ থাকে। একবার সাঁওতালদের এলাকায় মদ খেতে রাজি হই নি বলে ওরা খুব বিরক্ত হয়েছিলো।

আমি বললাম, কী মজা দুলালদা তাই না? আমি কোথায় যেন পড়েছি সাঁওতালরা মহুয়ার রস দিয়ে যে মদ বানায় ওটা খেতে নাকি দারুণ লাগে।

দুলালদা বললেন, কোনো মাতাল লিখেছে হয়তো। মদ খেলে দুর্গন্ধে আমার বমি আসতে চায়।

খেয়ে উঠে সিগারেট ধরিয়ে দুলালদা বললেন, তোমাদের মেজদা আবার এদিকে ঢু মারবেন না তো?

রামু হেলে বললো, দিদা আছেন কী করতে।

দুলালদা বললেন, তোমাদের তো দুমাস বন্ধ আছে। পড়াশোনার চাপও নেই। আমি একটা কাজ দিতে চাই তোমাদের।

রামু ব্যস্ত গলায় বললো, কী কাজ দুলালদা?

দুলালদা বললেন, আমি ভাবছি পিয়াইন নদীর তীরে খাসিয়াদের যে গ্রামগুলো আছে, সেখানে তোমরা একটা স্কুলে চালাবে। আগে খ্রিস্টান মিশানারিরা ওদের কিছু লেখাপড়া শিখিয়েছিলো। আমি কথা বলে দেখেছি, শেখার জন্যে ওদের আগ্রহও আছে। ছেলেবুড়ো সবাই তোমাদের ছাত্র হবে। আসলে ব্যাপারটা কী জানো, লেখাপড়া না জানার জন্যে ওদের ওপর অত্যাচার। করাটা এত সহজ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কল্পনাও করতে পারবে না। ধরো, ওরা মহাজনের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিলো কিংবা একটা কিছু বন্ধক রাখলো। মহাজন এমন একখানা অঙ্কের হিসেব ওদের বুঝিয়ে দিয়ে ঘরবাড়ি-জমি জিনিসপত্র সব কিছু নিজে পরম নিশ্চিন্তে হজম করে ফেলে যে, এরা কিছুই বুঝতে পারে না। শুধু বোঝে এরকম হওয়া ঠিক নয়। গত বন্যার সময় বহু কৃষক পরিবার সর্বস্বান্ত হয়েছে, অনেকে না খেয়ে মরেছে। একবার ওরা মহাজনের ধানের গোলা লুট করতে গিয়েছিলো বলে মহাজনটি এখন আর গোলায় ধান রাখে না। বর্ডারের ওপারে পাচার করে দেয়। ওখানে তোমাদের স্কুল থাকলে আমাদের কাজের সুবিধে হবে।

রামু বললো, স্কুলে না হয় আমরা পড়াতে পারবো। কিন্তু জিনিসপত্র কোথায় পাবো? শহীদ মামা আমাদের স্মাগলিং-এর কথা বলেছেন। আমি ভাবছি–

এমন সময় দিদা একটা প্লেট হাতে করে ঘরে ঢুকলেন। দুলালদাকে দেখে হেসে বললেন, পন্টুর জন্যে পুডিং বেঁধেছিলাম। দেখৃ তো কেমন হয়েছে? ছাতক থেকে আবুর বাপ কমলা পাঠিয়েছে। অনেকদিন কমলার পুডিং করি না।

আমি হেসে বললাম, সবগুলো পুডিং দুলালদা একা খাবে নাকি দিদা? আমাদের খেতে বলবে না?

তোদের না বললেও খাবি। এই বলে দিদা টেবিলের ওপর প্লেটটি নামিয়ে খাটের ওপর উঠে বসলেন। বাইরে দমকা বাতাসের শব্দ শুনে তিনি বললেন, আজ রাতে ঝড় আসতে পারে। সাবধানে থাকিস।

আমরা সবাই পুডিং শেষ করে এসে দিদাকে ঘিরে বসলাম। দুলালদা বললেন, খাসিয়াদের গ্রামে একটা স্কুল খোলার কথা ওদের বলছিলাম। ওরা যদি ছুটির এই দুমাস সন্ধ্যেবেলা দুতিন ঘন্টা করে পড়াতো, তাহলে গ্রামের মানুষগুলোর খুব উপকার হতো।

দিদা মুখ টিপে হেসে বললেন, গলা কাটা বাদ দিয়ে এখন বুঝি মিশনারি ফাদার হয়েছে দুলাল? কদিন আগেও মিশনারিরা খাসিয়াদের গ্রামে গিয়ে বলতো, আইস ভ্রান্ত মেষশাবকের দল। যিশুকে ভজনা কর, পরিত্রাণ মিলিবে। খাসিয়া বেচারারা ওদের কথাবার্তা কিছু বুঝতো না, শুধু হা করে থাকতো।

দুলালদা হেসে বললেন, আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী দিদা। আমি গ্রামের এসব স্থানীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে গরিব কৃষকদের একজোট করতে চাই। আমি চাই ওদের সমস্যা ওরা নিজেরা বোঝার চেষ্টা করুক। সমাধানের পথও নিজেরা খুঁজে বের করুক। আমি শুধু ওদের সঙ্গে থাকবো। ওদের কাছ থেকে শিখবো। ওদের ভুলভ্রান্তি হলে দেখিয়ে দেবো। আমাদের দেশের শতকরা আশিভাগ মানুষের অক্ষরজ্ঞান নেই। যে-জন্যে ইচ্ছেমতো ওদেরকে শোষণ করা যায়। আজ যদি এরা সবাই একসঙ্গে জোট বেঁধে সরকারের টাউট-নেতা আর ওপার থেকে আসা মাড়োয়ারিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতো, তাহলে একদানা চালও ইন্ডিয়া যেতে পারতো না, আর এদেশের মানুষ এভাবে না খেয়ে মরতো না। সময় অনেক বদলে গেছে দিদা। আমরা যাদের সর্বাহারা শ্রেণী বলি, যাদের জন্যে আমরা লড়ছি; তাদের চেতনার স্তর যদি বাড়াতে না পারি যত গাল ভরা তত্ত্ব কথাই ওদের বলি না কেন, কোনো লাভ হবে না।

দিদা গম্ভীর হয়ে বললেন, কথাটা আমিও বহুবার ভেবেছি দুলাল। একবার কুটুকে বলেছিলাম, তোদের কর্মীরা গ্রামে কাজ করে। কী করে তোরাই জানিস। তবে আমার মনে হয় গ্রামের মানুষদের কিছু লেখাপড়া শেখালে ওদের উপকার হতো। তোরা তো একটা গ্রামে চিরকাল পড়ে থাকিস না। শুনে কুটুই বললো, দিদা তুমি কি আমাদের মিশনারি ভেবেছো নাকি? আমি বিপ্লবকে করে নিই। তারপর একবছরেই দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করে ফেলব। এখন ভাবি কোথায় গেলো কুটু আর কোথায় গেলো ওদের বিপ্লব! দেশের মানুষ এখনো সেই অন্ধকারেই পড়ে আছে।

দুলালদা বললেন, একেবারেই যে অন্ধকারে পড়ে আছে তা কিন্তু নয় দিদা। একবার যেখানে আমরা কাজ করেছি সেখানে কৃষকরা কিছুটা হলেও সচেতন হয়েছে। তবে আমরা খুব কম কৃষক-শ্রমিককেই সচেতন করতে পেরেছি। স্কুল খোলার ব্যাপারে আপনি কিছু পরামর্শ দিন দিদা। স্কুলে শুধু ক খ শেখানো হবে না। ওটা হবে আমাদের স্কুল।

দিদা বললেন, আমি আর কী বলবো! কিছু টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। শীত এসে গেছে। ওদের জন্যে কিছু কাপড়চোপড়ও ঘুরেফিরে জোগাড় করতে পারবো। সেদিন আমাদের মালি দারুভূই বলছিল শীতে ওরা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায়। আগুন জ্বেলে আর কতক্ষণ শীত তাড়ানো যায়! গেল বছরও শীতে আর অনাহারে খাসিয়াদের গ্রামে আশিজন মানুষ মরেছে।

দুলালদা গম্ভীর গলায় বললেন, আপনি একজন সত্যিকারের বিপ্লবী হতে পারবেন দিদা।

আমাদের বুড়ো দিদা লজ্জায় লাল হয়ে বললেন, থাক থাক, এ-বয়েসে আমাকে বিপ্লবী বানিয়ে কোনো কাজ হবে না। আমি বাছা বন্দুক-টন্দুক চালাতে জানি না। বরং ইশকুলের হেডমাস্টারনি বানাতে পারো আমাকে। আমি ভালো চালাতে পারবো।

আমরা সবাই দিদার কথা শুনে হেসে ফেললাম। রামু বলল, দিদাকে আমরা আমাদের নেতা বানাবো?

দিদাও বললেন, বাজে বকিসনে ছোঁড়া!

দুলালদা মৃদু হেসে বললেন, আমরা তো এখন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্যে লড়ছি না। আমরা লড়ছি জাতীয় মুক্তি আর গণতন্ত্রের জন্যে। শুধু কমিউনিস্টরা কখনো এই বিপ্লব করতে পারে না। দেশকে যারা ভালোবাসেন, যারা মানুষের ভালো চান, স্বাধীনতা চান, তাঁদের সবাইকে নিয়ে এই বিপ্লব করতে হবে। আপনি আপাতত স্কুল নিয়েই থাকুন। তারপর লড়াই যখন শুরু হবে তখন ঠিকই আপনি লড়াই করবেন। তবে এখানে আপনারা অনায়াসে মহিলা সমিতি জাতীয় কিছু করতে পারেন। আপনি জাফলং-এর মানুষদের জন্যে যা করছেন, সেটা সবাইকে নিয়ে একটা সাংগঠনিক কাঠামোর ভেতর দিয়ে করলে, কাজ অনেক ভালোভাবে করা যায়।

দিদা একগাল হেসে বললেন, ওটা আমি যে-কোনো সময় শুরু করতে পারবো। মহিলা সমিতি করলে তোমাদেরও কাজের সুবিধে হবে। আমাদের ইশকুলটাও ভালোমতো চালানো যাবে। আমার ছেলেরা যখন আমার নাতিদের বয়সী ছিলো তখন আমি মহিলা সমিতি করেছি।

সেই রাতে আমরা দিদাকে নিয়ে বহুক্ষণ স্কুল আর মহিলা সমিতির বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলাম। স্কুলের পড়ানোর কথা শুনে আমি আর রামু যে কী পরিমাণ উত্তেজিত হয়েছিলাম সে কথা আর বলার নয়। মহিলা সমিতি সম্পর্কেও আমাদের উৎসাহ কম ছিলো না, কারণ সেখানে হাসি খালাও থাকবেন। সোনিয়া তো থাকবেই।

দুলালদা আর দিদা কথা বলছিলেন। আমরা তিনজন লেপ মুড়ি দিয়ে চুপচাপ শুনছিলাম। বাইরে তখন ঝড়ো বাতাস ঝাউবনে অবিরাম হুইসেলের শব্দ তুলে বয়ে যাচ্ছিলো।