১১-১৫. হাসপাতাল থেকে

পাঁচ দিন পর হাসপাতাল থেকে বেরুলো শওকত আর বিপ্লব। আহত হয়ে ওরা যে বাড়িতে ঢুকেছিলো, তারাই সাতাশ তারিখে ওদের দুজনকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছে। দুএকজন ডাক্তার নার্স ছাড়া হাসপাতাল একেবারে ফাঁকা। বিপ্লবের জখমটাই বেশি ছিলো। ডাক্তার ওকে আরো দুদিন থাকতে বলেছিলো। তবু ওরা বেরিয়ে এসেছে। বাড়ির জন্যে ওরা দুজনই উদ্বিগ্ন। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে গুলির শব্দ শুনছে আর ছটফট করেছে কখন বেরুতে পারবে।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে দুজন দুজনের বাড়ির দিকে গেলো। বিপ্লব গেলো ফরাশগঞ্জ, শওকত এলো ওদের রাজারবাগে। বাড়িতে ওদের দুজনের জন্যেই প্রচণ্ড বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো। ওরা দুজনেই বাড়ির চেহারা দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েছিলো। পাড়ার একজন শওকতকে পুরো ঘটনাটা বললো। ওর মা বাবাকে ওরাই কবর দিয়েছেন। মিনুর কোন খবর এখনো পাওয়া যায়নি।

পাগলের মতো বাড়ির ভেতর ঢুকলো শওকত। মস্ত বড়ো বাড়িটায় বিশাল এক কবরের নিস্তব্ধতা। এ বাড়িতে কোনদিন কোন প্রাণের অস্তিত্ব ছিলো তার কোন চিহ্ন নেই। সারা দেয়াল বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। আসবাবপত্র কিছুই অক্ষত নেই। ঘরময় ভাঙা জিনিসপত্র। জানালার কাঁচ গুঁড়ো গুড়ো হয়ে সবখানে ছড়িয়ে রয়েছে। দেয়ালে ঝোলানো ওদের ছবিটার গায়েও বুলেটের দাগ, এক পাশে কাত হয়ে ঝুলে আছে। ঘরের পর ঘর পেরিয়ে গেলো শওকত। প্রত্যেকটা ঘরেরই আলাদা একটা চেহারা ছিলো। এখন সবগুলো এক রকম দেখতে। প্রত্যেকটা ঘরই সমান বিধ্বস্ত ।

সবশেষে হলঘরে ঢুকলো শওকত। সামনে দেখলো রক্তের দাগ। ঘরের দেয়ালে দেয়ালে রক্তের দাগ। ঘরের মেঝেতে রক্তের দাগ। শুকিয়ে কালচে হয়ে গেছে। তবু চেনা যায়, শওকতকে কেউ চিনিয়ে দিলো না। তবু সে চিনে নিলো। ওর বাবার রক্ত। ওর মায়ের রক্ত। হলঘরের মেঝেতে দেয়ালে মিশে একাকার হয়ে গেছে। বুকের ভেতরটা অসহনীয় এক যন্ত্রণায় দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে। গেলো। কী যেন বললো সে, নিজেই বুঝলো না। সময় গড়িয়ে চললো। মুহূর্তগুলো ঘন্টায় পরিণত হলো। ঘন্টাগুলো বড় হলো। অপলক দৃষ্টিতে সেই জমানো রক্তের দিকে তাকিয়ে রইলো শওকত।

হঠাৎ একসঙ্গে অনেকগুলো ঘন্টার শব্দ শুনে চমকে উঠলো শওকত। হল ঘরের বড় দেয়াল ঘড়িটায় ঘন্টাগুলি বাজলো। ঘড়িটা চলছে। আগে লক্ষ্য করেনি। সারা ঘরে ঘড়িটাই শুধু অক্ষত রয়েছে। শব্দহীন হলঘরে ঘন্টার শব্দ এক ভৌতিক প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে দিয়েছে।

শওকত ভীষণ ভয় পেলো। মনে হলো ওর আর কেউ নেই। ভয়াবহ শূন্যতা ওকে আচ্ছন্ন করলো। অসম্ভব নিঃসঙ্গ মনে হলো নিজেকে। বুকের ভেতর চেপে বসে গেলো সেই শূন্যতা। পুরো পৃথিবীটা ওর কাছে ফাঁকা মনে হলো। ওর কেউ সেই। আর থাকতে পারলো না শওকত। রক্তের দাগে মুখ গুঁজে অসহ্য কান্নায় ভেঙে গুঁড়িয়ে গেলো।

কতক্ষণ কেঁদেছিলো শওকতের মনে নেই। শুনলো কে যেন নাম ধরে ডাকছে। চেয়ে দেখলো সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিপ্লব। বিপ্লবেরও চোখ দুটো ভেজা। শওকত উঠে বসলো। বিপ্লব ওর পাশে বসলো। পিঠে হাত রাখলো।–আমি সব শুনেছি শওকত। কারো অবস্থাই আমাদের চেয়ে ভালো নয়।

শওকত বিপ্লবের মুখের দিকে তাকালো। অদ্ভুত এক হাসি ফুটে উঠলো বিপ্লবের ঠোঁটের ফাঁকে। বললো, আমাদের বাড়িটা পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে।

শওকত আর্তস্বরে বললো, তোমার বাবা মা?

বিপ্লব মাথা নাড়লো–কেউ বেঁচে নেই। বাবা মা দুজনেই পুজোর ঘরে ছিলেন।

শওকত আর কোন কথা বলতে পারলো না। দুজন চুপচাপ বসে রইলো।

কে কাকে সান্ত্বনা দেবে? সময় গড়িয়ে চললো। বহুক্ষণ পর বিপ্লব বললো, কি করবে কিছু ঠিক করেছো?

শূন্য দৃষ্টিতে বিপ্লবের দিকে তাকালো শওকত–কী করবো!

এখানে থাকা তো সম্ভব নয় শওকত।

কোথায় যাবো?

যেখানে নিরাপদ। অদ্ভুত এক প্রত্যয়ের সঙ্গে নিরাপদ শব্দটা উচ্চারণ করলো বিপ্লব।

কোথায় নিরাপদ?

এ মুহূর্তে যুদ্ধক্ষেত্রে।

শওকত চোখ তুলে তাকালো।

নিরাপদ পৃথিবীর কোন জায়গাই নয়। শান্ত গলায় বিপ্লব বললো, মানুষের নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে হবে। এর জন্যই যুদ্ধ করতে হবে।

শওকত অসহায় গলায় বললো, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না বিপ্লব। কী করবো কিছুই ভাবতে পারছি না।

তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। বিপ্লব গভীর স্বরে কথাগুলো উচ্চারণ করলো।

শওকত কোন কথা বললো না। বিপ্লবের হাতে হাত রাখলো। কিছুক্ষণ পর বললো, ঢাকা থেকে কীভাবে বেরুবে?

বিপ্লব বললো, কোনো রকমে বুড়িগঙ্গা পার হতে পারলে কিছুটা নিরাপদ। জিঞ্জিরা দিয়ে ধলেশ্বরী পার হয়ে বেরিয়ে চলে যাবো।

শওকত চুপ করে রইলো। বিপ্লব বললো, কী ভাবছো শুকু?

মিনু যদি ফিরে আসে?

বিপ্লব ম্লান হাসলো। বেঁচে আছে এটা এখনো ভাবছো কী করে! মিনু মরে গেছে। ওর মতো যাদের ধরে নিয়ে গেছে কেউ বেঁচে নেই।

বিপ্লবের কথাগুলো শওকত বিশ্বাস করতে চাইলো না। বিড়বিড় করে বললো, মিনু বেঁচে আছে। ওকে বাঁচতে হবে।

বিপ্লব বললো, কিছু বলছে শুকু?

শওকত মাথা নাড়ালো–কিছু নয়। একটু পরে বললো, কখন যাবে?

বিপ্লব বললো, আমাদের এক্ষুণি বেরিয়ে পড়তে হবে। দেরি করলে কারফিউ শুরু হয়ে যাবে।

শওকত ইতস্তত করলো–এভাবেই বেরুবো?

বিপ্লব হাসলো–এভাবেই বেরুতে হবে শওকত । সবই তো রইলো। দুএকটা দরকারি জিনিস ছোট একটা ব্যাগে গুছিয়ে নাও। অনেকটা পথ যেতে হবে। বোঝা বাড়িয়ে কী লাভ!

শওকত উঠে দাঁড়ালো। ঘরে গিয়ে এয়ার ব্যাগটা খুঁজে বের করলো। কী নেবে! এ ঘরের যে কোন জিনিসের ভগ্নাবশেষ ওর প্রিয়, প্রত্যেকটা জিনিসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসংখ্য স্মৃতি। বহুদিনের স্মৃতি। বিপ্লব তাড়া দিলো–কী হলো শওকত! কী নেবে নাও।

বুক ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। কিছুই নেবে না শওকত। সকল স্মৃতি খণ্ডিত হয়ে পড়ে থাক এভাবে। আলনার ওপর থেকে কটা প্যান্ট শার্ট ব্যাগে ঢোকালো। আলমারি খুললো। ড্রয়ারে কিছু টাকা ছিলো, সেগুলো পকেটে নিলো। এক কোণে চোখে পড়লো ছবির এ্যালবাম। নামিয়ে আনলো। ওদের সকলের একসঙ্গে তোলা ছবিটা খুলে ব্যাগে রাখলো । চেইন টেনে ব্যাগ বন্ধ করে বললো, চলো।

বিপ্লব বললো, আর কিছু নেবে?

শওকত মাথা নাড়লো। বিপ্লব বললো, চলো।

হলঘরে এলো ওরা। ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে পেছন ফিরে তাকালো। চেয়ে দেখলো, যেখানে ওর মা বাবার রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে আছে। বুকের ভেতর কান্নার উত্তাল ঢেউ। বিপ্লব আবার বললো, চলো শওকত।

.

১২.

সদর দরজায় একটা তালা ঝুলিয়ে ওরা পথে নামলো। ঘড়িতে তখন দেড়টা বাজে। চারটা থেকে আবার কারফিউ। যারা পথে বেরিয়ে ছিলো ব্যস্ত ভয়ার্ত পায়ে ঘরে ফিরে যাচ্ছে। বেশির ভাগই ওদের মতো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। সবাই একসঙ্গে হাঁটছে। দূর থেকে মিছিল মনে হয়। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে না। মায়ের কোলে ছোট্ট ছেলেটাও কান্না ভুলে গেছে। সবার চোখে মুখে সীমাহীন আতঙ্কের ছায়া।

সেগুন বাগানের মোড়ে বাবুর সঙ্গে দেখা হলো শওকতের। প্রথম দেখলো বাবু, ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো–তুমি বেঁচে আছো শওকত ভাই?

শওকত ম্লান হাসলো–তোমরা কেমন আছো?

বাবু বললো, এখনো বেঁচে আছি। তবে বাবলুর কথা জানি না। বেঁচে আছে। কিনা তাও জানি না।

শওকত বললো ও তো ক্যান্টনমেন্টে ছিলো?

বাবু মাথা নাড়লো–ছিলো। এখন কোথায় জানি না। চোদ্দ তারিখে ওর সাথে শেষ দেখা হয়েছিলো।

শওকত কোন কথা বললো না। বাবু ওদের সঙ্গে হাঁটলো। বললো, আমি তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। শওকত কোন কথা বললো না। বাবু আবার বললো, কোথায় যাচ্ছো শওকত ভাই?

শওকত বললো, জানি না।

বাবু চমকে উঠলো। যতবার যতজনকে প্রশ্ন করেছে সবার কাছে একটাই উত্তর পেয়েছে– জানি না। কেউ জানে না ওরা কোথায় যাচ্ছে। কারণ সকলের মনে সংশয় গন্তব্যে ওরা পৌঁছতে পারবে কিনা। পাটকলের শ্রমিক বজুর বাপ থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের শেষ বছরের ছাত্র শওকত–কেউ জানে না ওরা কোথায় যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ওরা চুপচাপ হাঁটলো। তারপর এক সময় শওকত বললো, তুমি আমাদের সঙ্গে কেন আসছো, বাবু? ঘরে ফিরে যাও। কারফিউ শুরু হয়ে যাবে।

ওরা দাঁড়ালো। বাবু কী যেন বলতে চাইলো। বার বার কথা কথাটা গলার কাছে আটকে গেলো। শওকত বললো, কিছু বলবে বাবু?

বাবু মাথা নাড়লো। শওকত চেয়ে দেখলো বাবুকে। দুজনেই কিছু যেন বলতে চাইলো। বিপ্লব বললো, কোন কথা থাকলে বলে নাও শওকত। দেরি হয়ে যাচ্ছে।

শওকত আস্তে আস্তে বললো, ওরা মিনুকে ধরে নিয়ে গেছে। যদি কোনদিন ওকে খুঁজে পাও তোমাদের কাছে রেখো। ও আমার বড়ো আদরের বোন। কথা দাও বাবু, তুমি ওকে দেখবে?

বলতে বলতে শওকতের গলা বুজে এলো। বাবুর দুচোখ ঝাঁপসা হয়ে উঠলো। শওকতের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো, আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে পারো শওকত ভাই। মিনুকে আমি খুঁজে বের করবোই।

শওকত বললো, আমাকে তুমি বাঁচালে বাবু। ওর কথা ভেবে বার বার থমকে যাচ্ছিলাম। চলি ভাই। যদি বেঁচে থাকি, দেখা হবে!

বাবু ম্লান হাসলো–দেখা হবে, যদি বেঁচে থাকি।

শওকত আর বিপ্লব চলে গেলো। বাবু দাঁড়িয়ে রইলো বহুক্ষণ। ওরা মিছিলের সাথে এক হয়ে হাঁটছে। মিছিল চলছে শান্তির সন্ধানে। দূরে কৃষ্ণচূড়া গাছের আড়ালে রাস্তা মোড় নিয়েছে। বিধ্বস্ত কৃষ্ণচূড়ার সারি ওদের ঢেকে দিলো।

বাবু আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর বাড়ির পথে পা বাড়ালো।

বুড়িগঙ্গার তীরে এসে থমকে দাঁড়ালো শওকত আর বিপ্লব। সামনে এক অভাবনীয় দৃশ্য! নদীতে লঞ্চ নৌকো কিছুই নেই। তবু মানুষ পার হচ্ছে। দলে দলে ওরা সাঁতার কেটে নদী পাড়ি দিচ্ছে। বিপুল বিস্ময়ে ওরা শুধু চেয়ে দেখলো । একের পর এক বিস্ময়ের মুহূর্তগুলো গড়িয়ে গেলো। সবাই সাঁতার কাটছে। যাদের অত দূরে সাঁতার কাটার শক্তি নেই, ওরা অসহায় ভঙ্গিতে নদীর তীরে বসে পড়ছে। ওদের হু হু কান্না নদী হয়ে যাচ্ছে।

শওকত আর বিপ্লবের সে ভয় নেই। বিপ্লব বললো, নেমে পড়ো। দাঁড়িয়ে থেকে কি লাভ!

বিপ্লবের দিকে তাকালো শওকত। বিপ্লবের হাতের ব্যাণ্ডেজ এখনো খোলা হয়নি। বললো, পারবে বিপ্লব?

বিপ্লব ম্লান হাসলো–পারতে হবে।

ব্যাগটাকে পিঠে বেঁধে ওরা দুজন নেমে পড়লো নদীতে। পুরো পঁচিশ মিনিট সাঁতার কাটার পর ওরা তীরের মাটি স্পর্শ করলো। মাঝ নদীতে স্রোতের বেশ টান। দুজনেই ক্লান্ত। ভেজা কাপড় বদলে ওরা বিশ্রাম নেয়ার জন্যে তীরের কাশ বনের ধারে বসে পড়লো।

হঠাৎ মাঝ নদীতে চিৎকার শুনে ওরা চমকে উঠলো। তাকিয়ে দেখলো একটা মেয়ের পিঠে বাঁধা এক বছরের একটা বাচ্চা। হাতের কাছে আট-ন বছরের একটা ছেলে। ছেলেটা মার সঙ্গে সাঁতার কেটে আসছিলো। মাঝ নদীর স্রোতের টান সামলাতে পারে নি। হাবুডুবু খাচ্ছে ছেলেটা। মেয়েটা ধরতে গেলো ছেলেটাকে। স্রোতের টানে দুজনই পুবদিকে সরে যাচ্ছে। ছেলেটা দুহাতে জাপটে ধরলো মেয়েটাকে। এবার ওরা তিনজনই ডোবার পথে। বার দুই ডুবে আবার ওরা আলাদাভাবে ভেসে উঠলো। স্রোতের টানে ছেলেটা আরো দূরে সরে যাচ্ছে। একবার ডুবছে, একবার ভাসছে। একটা আর্ত চিৎকার শোনা গেলো ছেলেটার গলায়–মাগো।

চিৎকার করে উঠলো মেয়েটা–আমার বাজান রে! ডুবতে ডুবতে মেয়েটা ছেলেটার কাছে যেতে চেষ্টা করলো। আরো কয়েকজন ওদের দিকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। স্রোতের তোড়ে কেউ কাছাকাছি হতে পারছে না। শেষবারের মতো একটা আর্ত চিৎকার শোনা গেলো। –মা!

নদীর তীরে ঢেউয়ের সঙ্গে আছড়ে পড়লো সেই চিৎকার। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার আর্তনাদ–না।

তারপর ওরা তিনজনই স্রোতের আবর্তে তলিয়ে গেলো।

পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে বসেছিলো বিপ্লব আর শওকত। মাথার ওপর প্লেনের শব্দ শুনে ওদের চমক ভাঙলো। চেয়ে দেখলো, দুটো স্যাবর জেট চক্রাকারে উড়ছে। আরো নিচে দিয়ে উড়ছে দুটো হেলিকপ্টার।

বিপ্লব বললো, শওকত উঠে এসো। মনে হচ্ছে এয়ার রেইড হতে পারে।

প্লেনের শব্দ এক নিদারুণ আতঙ্ক ছড়িয়ে দিলো নদীর দুই তীরে। আতঙ্কগ্রস্ত লোকগুলো ছুটোছুটি করতে লাগলো। জায়গাটা একেবারে ফাঁকা। সবাই বাজারের দিকে ছুটলো। সেখানে আরেক দৃশ্য। কম করে হলেও হাজার পাঁচেক লোক জড়ো হয়েছে বাজারে। প্রায় সবাই শহর থেকে এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছে। বিপ্লব বললো, রাতটা এখানেই কাটাতে হবে। কাল ভোরে উঠে আবার হাঁটবো। আজ বড়ো ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।

শওকতেরও হাঁটার ইচ্ছে ছিলো না। শরীর তার এমনিতেই দুর্বল। সাঁতার কাটার পর সারা শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে। একটা টিনের চালার নিচে বসে পড়লো। বিপ্লব ঘুরে ঘুরে কোত্থেকে মুড়ি আর গুড় নিয়ে এলো। বললো, অন্য কোন খাবার নেই। এগুলো অনেক কষ্টে যোগাড় করেছি।

দুজনেরই অসম্ভব ক্ষিদে পেয়েছিলো। শুকনো সেই মুড়িগুলো গোগ্রাসে গিলে খেলো ওরা। টিউবঅয়েলে গিয়ে পেট ভরে পানি খেলো। তারপর আবার আগের জায়গায় গিয়ে বসলো।

হেলিকপ্টার দুটো তখন থেকেই খুব নিচু হয়ে ঘুরছিলো। বাজারে সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। বিপ্লব বললো, হয়তো ওরা মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি খুঁজছে।

শওকত বললো, বম্বিং করতে পারে।

স্যাবর জেটগুলোকে তো দেখছি না। বিপ্লব বললো, হেলিকপ্টার দিয়ে কিভাবে বম্বিং করবে?

শওকত চুপ করে বসে রইলো। সন্ধ্যে নাগাদ একটানা উড়লো হেলিকপ্টার দুটো। তারপর শহরের দিকে চলে গেলো। তখনও শহর থেকে দলে দলে সবাই নদী পার হচ্ছে। যারা বাড়তি কাপড় আনতে পারেনি ভেজা কাপড়েই গুটিসুটি মেরে বসে পড়েছে।

প্লেনগুলো যে অকারণে ওড়েনি কিছুক্ষণ পরই সেটা বোঝা গেলো। সন্ধ্যের আলোটুকু তখনো পশ্চিমের আকাশে কিছুটা লেগেছিলো। দূরে নদী দেখা যাচ্ছে। আগের মতো না হলেও এখনো কেউ কেউ সাঁতার কেটে নদী পার হচ্ছে। যারা বাজারে বসেছিলো ওদের কিছুটা নিশ্চিন্ত মনে হচ্ছিলো। সকলের ধারণা সৈন্যরা নদী পার হবে না।

বিদ্যুৎ চমকানোর মতো এক ঝলক আলোর সঙ্গে সঙ্গে ওদের সকল স্বস্তির ধারণা মিথ্যে হয়ে গেলো! প্রচণ্ড শব্দে কামান গর্জে উঠলো। সারা মাটি থরথর করে কেঁপে উঠলো। গোলাটা কোথায় পড়লো কেউ বুঝতে পারলো না। তারপরই শুরু হলো গর্জনের পর গর্জন। বিদ্যুতের মতো আলো আকাশ ঝলসে দিলো। প্রতিটি গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ঘর সব থরথর করে কাঁপতে লাগলো।

দিশেহারা হয়ে সবাই ছুটোছুটি শুরু করে দিলো। ছোট ছেলেমেয়েদের কান্না, নদীর তীরে মরণ আর্তনাদ মুহূর্তের ভেতর জিঞ্জিরার শান্ত পরিবেশ ভয়াবহ শব্দে ভরিয়ে দিলো।

অল্প দূরে ভীষণ শব্দে একটা মর্টারের গোলা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লব আর শওকত মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছিলো। বাজারের একপাশে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো। অসংখ্য মানুষের আর্তনাদে বাতাস ভারি হলো।

ওরা দুজন ছুটলো নদীর তীর ঘেঁষে। মেশিনগান থেকে অবিরাম গুলিবৃষ্টি হচ্ছে। একটানা ধাতব শব্দ কানে তালা লাগিয়ে দেয়।

বোঝা গেলো বাজারটাই আক্রমণের লক্ষ্য। বাজারটাকে পেছনে ফেলে ওরা দুজন সোজা দক্ষিণে ছুটলো। এখানে সেখানে গোলা ফাটছে। আগুন জ্বলছে। আশেপাশে লোকগুলো গুলি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছে। কেউ কামানের গোলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। সব কিছু মিলিয়ে এক ভয়াবহ যুদ্ধক্ষেত্র। ব্যতিক্রম শুধু এখানে কোন বাধা নেই, কোন প্রতিরোধ নেই। একপক্ষ আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত সুনিপুণ হত্যাকারী সৈন্য, অপর পক্ষ অসহায় কিছু মানুষ। যাদের ভেতর নারী আর শিশুর সংখ্যাই বেশি।

শওকত আর বিপ্লব প্রাণপণে ছুটছিলো। কোন দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। বেশ কিছু দূর এগিয়ে গিয়েছিলো ওরা। হঠাৎ ওরা বাধা পেলো। সামনে থেকে গ্রামের লোকগুলো ছুটে আসছে ওদের দিকে। ওরা বললো, গ্রামে মিলিটারি ঢুকে পড়েছে। ঘরের ভেতর আগুন লাগিয়ে বেরিয়ে আসা লোকগুলোকে মেশিনগান দিয়ে গুলি করে মারছে।

শওকত আর বিপ্লব কান পেতে শুনলো সামনে আর্তনাদ, মেশিনগানের শব্দ। দাউদাউ করে গ্রামগুলো জ্বলছে।

পালাবার কোন পথ নেই। পেছনে মৃত্যু তাড়া করছে। সামনে এগিয়ে আসছে মৃত্যু। ওরা পাশের ধানক্ষেতে নামে পড়লো।

বিশাল ধানক্ষেত। এদিকে এখনো কামানোর গোলা পড়েনি। হাত দুয়েক উঁচু ধানগাছগুলো দুপাশে সরিয়ে ওরা পুবদিকে যেতে লাগলো। এঁটেল কাদামাটিতে বার বার পা আটকে যাচ্ছিলো। বিপ্লব কয়েকবার হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো। শওকত ওকে টেনে তুললো। শেষে এক সময় বিপ্লব বললো, আমি আর পারছি না। শওকত, তুমি এগিয়ে যাও।

এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ালো শওকত–তুমি কি ক্ষেপেছো বিপ্লব? এখানে থাকা মানে নির্ঘাৎ মরণ বুঝতে পারছো না? আর একটু এগিয়ে চল ভাই।

ধানক্ষেতের কাদামাটির ওপর বসে পড়লো বিপ্লব। ভারী বুলেটগুলো বাতাস কেটে তীব্র শিস দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। দুএকটা গোলা ছিটকে এসে পেছনের ধানক্ষেতেও পড়ছিলো। প্রচণ্ড শব্দে কানের পর্দা ফেটে যেতে চাইছে! অসংখ্য মানুষের আর্তনাদ চারপাশের বাতাসে জমাট বেঁধে আছে। শওকত মরিয়া হয়ে বললো, তোমাকে আমি এভাবে রেখে যেতে পারি না বিপ্লব। আমার হাত ধরো। নদীর ধারে কোন লোকালয় নেই। এই সামান্য পথটুকু পেরুতেই হবে।

বিপ্লব করুণ হাসলো। ওদের কাছেই গোলা পড়লো। বিপ্লবকে জড়িয়ে কাদার ভেতর উপুড় হয়ে পড়লো শওকত। বিপ্লব বললো, আমার জন্যে এটাই নিরাপদ।

বারুদের গন্ধ ভাসছে বাতাসে। রক্তের গন্ধ পাচ্ছে শওকত। বিপ্লব আবার বললো, পৃথিবীর কোথাও কি তুমি এ মুহূর্তে এতটুকু নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাবে শওকত?

শওকত চমকে উঠলো। যেন কথাগুলো বিপ্লবের নয়, বহু দূর থেকে ভেসে আসছে–পৃথিবীর কোথাও কি এতটুকু নিরাপদ আশ্রয় আছে? শওকত কেঁপে উঠলো।

অস্পষ্ট স্বরে বিপ্লব বললো, ভিয়েৎনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা, প্যালেস্টাইন, বাংলাদেশ।

বিপ্লবের মাথাটা কোলে তুলে নিলো শওকত। অস্পষ্ট শব্দগুলো শওকতের বুকের ভেতর গেঁথে গেলো–তবু ভালো এই বাংলাদেশ। এদেশের মাটি, এদেশের আকাশ, এদেশের জল।

শেষের দিকে বিপ্লবের কথাগুলো আরো জড়িয়ে গেলো। শওকত ডাকলো–বিপ্লব?

আকাশে আলোর হাউই জ্বললো। ফসফরাস বোমার তীব্র আলোর ছটায় আলোময় হয়ে উঠলো সবকিছু। শওকত দেখলো, রক্তে ভেসে যাচ্ছে বিপ্লবের সারা শরীর। ওর গায়েও রক্তের দাগ। চোখ দুটো পরম শান্তিতে বুজে আছে। মুহূর্তের জন্যে পাথর হয়ে গেলো শওকত। বিপ্লবের বুকে গুলি লেগেছে।

প্রচণ্ড শব্দে বোমা ফাটলো। এবার আরো কাছে। বুকের ভেতর ভীষণ যন্ত্রণা অনুভব করলো শওকত। চোখ দুটো জ্বালা করতে লাগলো। শূন্যতা আর সেই সঙ্গে ব্যর্থতার জ্বালা ওকে ক্ষত-বিক্ষত করতে লাগলো।

বিপ্লবের মাথাটা তখনো ওর কোলে। নিশ্চল বসে রইলো। শওকতের তখন অন্য কোন বোধ নেই। মর্টার আর মেশিনগানের তীক্ষ্ণ শব্দ ওর কাছে ক্রমশঃ অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। হাউই-এর তীব্র আলোয় সব কিছু ঝাঁপসা দেখছে। দুপাশে ছপ ছপ পায়ের শব্দ। দিশেহারা মানুষ ধানক্ষেতে নেমে পড়েছে।

একটু পরেই মানুষের ভিড় শওকতকে ঢেকে দিলো। কে যেন তার কাঁধে হাত রাখলো। তাকিয়ে দেখলো। অন্ধকারে ভালো দেখতে পেলো না। মনে হলো ওরই মতো একজন। অচেনা গলায় বললো, এখানে এভাবে বসে কেন ভাই। ওরা যে এদিকে আসছে।

শওকত কোন কথা বললো না। অপরিচিত কণ্ঠস্বর আবার বললো, তুমি এভাবে কেন মরবে? সবাইকে বাঁচতে হবে। এসো ভাই। উঠে এসো।

অচেনা কণ্ঠস্বর ওকে সম্মোহিত করলো। উঠে দাঁড়ালো শওকত। বললো, আপনি কে?

অচেনা কণ্ঠ উচ্চারণ করল, বিপ্লব।

অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলো শওকত–কী বললে?

বিপ্লব। আবার সেই কণ্ঠস্বর–চমকালে কেন?

শওকত এলোমেলো ভাবে বললো–আমার বন্ধু বিপ্লব। এইমাত্র বিপ্লব যে মরে গেলো।

না। চমকে উঠলো শওকত।

বিপ্লব মরেনি। তোমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। এসো আমার সঙ্গে।

শওকত আচ্ছন্নের মতো বিপ্লব নামের অচেনা লোকটির হাত ধরে এগিয়ে চললো।

সে বললো–বিপ্লবের মৃত্যু নেই!

শওকত এবার আর চমকালো না! ও কিছুই ভাবতে পারছিলো না। অচেনা বিপ্লবের হাত ধরে শুধু হেঁটে চললো।

বিশাল ধানক্ষেত পেরিয়ে গ্রামের মেঠোপথ। মেশিনগানের শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না। কয়েকটা কুঁড়েঘরে প্রদীপের আলো দেখা যাচ্ছে। ঝিঁঝি পোকা ডেকে চলেছে একটানা। কোথাও তক্ষক ডাকছে। আকাশে তারার আলো। শওকত বললো, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

বিপ্লব হাসলো। আবৃত্তির সুরে বললো, কৃষক মজুর! আজকে তোমার পাশাপাশি/অভিন্ন দল আমরা। বন্ধু আগে চল–সবাই আমরা নিজবাসভূমে পরবাসী।

শওকত বিস্মিত হলো। অচেনা বিপ্লবের সমস্ত আচরণই ওর কাছে অদ্ভুত মনে হচ্ছিলো। সারা পথ সে গুনগুন করে কবিতা আবৃত্তি করছিলো। শওকত প্রশ্ন করলো আপনি কি কবি?

না। বিপ্লব হাসলো–কবিতা ভালোবাসি।

শওকতের হাত তখনো বিপ্লবের হাতের মুঠোয়। ওরা দুজন এগিয়ে চললো মেঠো পথ ধরে। মেশিনগানের অবিরাম শব্দ, নদীতে অসহায় মায়ের মুখ, কতগুলো আর্তনাদ, দাউ দাউ আগুন, বিপ্লবের রক্তমাখা শরীর, প্রতিটি দৃশ্য কখনো বিচ্ছিন্নভাবে কখনো অবিচ্ছিন্ন হয়ে ওর চোখের সামনে ঘুরতে লাগলো। তারপর দৃশ্যগুলো আরো গাঢ় হয়ে চেতনার গভীরে প্রবেশ করলো। রক্তের ভেতর তোলপাড় তুললো। মুঠোর ভেতর বিপ্লবের হাত চেপে ধরলো। পরম নির্ভরতা খুঁজে পেলো সেই হাতে।

বিপ্লবের মুখে অস্পষ্ট হাসি। আপন মনে আবৃত্তি করে করে চলেছে–শরীরে সঙ্গীন ফোটে/রক্তের ফোয়ারা ছোটে/আকাশের নিচে ওঠে প্রতিধ্বনি/এদেশ আমার। শয়তানের দম্ভ ভাঙে;/দিকে দিকে শাসানো তর্জনী/দুর্জয় প্রাকার।

আকাশের কোণে এক টুকরো ভাঙা চাঁদ ঝুলছে। পথের দুপাশে বন্ধ ডোবা, গাছের পাতা, খড়ের ছাউনি, চকচক করছে সেই আবছা ঠাণ্ডা রুপোলি আলোয়। বিপ্লবের হাতে হাত রেখে শওকত এগিয়ে চললো এক অচেনা গন্তব্যে।

.

১৩.

ক্যান্টনমেন্টে বাবলুদের দিনগুলো এক অস্থির উত্তেজনার ভেতর কাটছিলো। এখন আর শহরে অবিরাম রাইফেল অথবা মেশিনগানের গর্জন শোনা যায় না। তবে আর্মি এয়ারপোর্ট থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে প্লেন উড়ে যায়। সবগুলো স্যার জেট আর বহুবার। বুঝতে এতটুকু অসুবিধে হয় না কোন স্নিগ্ধ গ্রাম অথবা শান্ত শহর এ মুহূর্তে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে। প্রতিদিন একই নিয়মে ধ্বংসের কাজগুলো সম্পন্ন হয়।

লরি ড্রাইভার কেরামত আলী, হাবিলদার মেজর সুলতান আহমেদকে খবর দিয়েছে রশিদ আর শফি মধুপুরের গড়ে আছে। সেদিন জয়দেবপুর থেকে যাবার পথে ওরা একটা পুল উড়িয়ে দিয়েছে। ময়মনসিংহের পথে দুই লরি পাঞ্জাবি সৈন্য শেষ করেছে। তার পর ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে মধুপুরের গড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ওরা খবর পাঠিয়েছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের এরা যেভাবে পারে যেন পালাবার বন্দোবস্ত করে।

প্রথম দলের ব্যর্থতার পর একটা মাত্র দল গতরাতে আগের মতো বেরিয়ে গেছে। কোন গুলির শব্দ বাবলুরা শুনতে পায়নি। তবে ড্রাইভার কেরামতের খবরটা ভয় পাইয়ে দিয়েছে। সাভার থেকে ফিরছিলো। দশটা ছেলেকে দেখেছে চোখে কালো কাপড় বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

ওরা আমাদের ছেলে? বুড়ো হাবিলদার মেজর ভালো করে যাচাই করে নিয়েছেন–তুমি কি করে বুঝলে কেরামত, ওরা যে আমাদের ছেলে?

কেরামত জবাব দিয়েছে–ওদের চুল কাটার ধরন দেখে বুঝেছি আমাদের ছেলে। কয়েকটা মুখ এখানে আগেও দেখেছি বলে মনে হলো।

হাবিলদার মেজর আর কোন কথা বলেননি। সকাল থেকে তাঁকে বড়ো বেশি বিষণ্ণ মনে হচ্ছিলো। দুপুরে ক্যাপ্টেন করিম তাঁকে ডেকেছিলেন। প্যারেড গ্রাউন্ডে পায়চারি করছিলেন ক্যাপ্টেন। কাছে ডেকে খুব আস্তে করে বললেন, আমাদের নতুন ছেলেরা কিছু কিছু পালাচ্ছে, সে সম্পর্কে কিছু জানেন? শুনে বুড়ো হাবিলদার মেজর প্রথমটায় চমকে উঠেছিলেন। ব্যাপারটা ক্যাপ্টেন জানলেন কী করে? ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন ক্যাপ্টেনকে। মুখটা কেমন যেন ম্লান আর ফ্যাকাশে। একবার মনে হচ্ছে কোন ফাঁদ নয়তো? মুহূর্তের ভেতর নিজেকে সামলে নিলেন হাবিলদার মেজর। উদাস স্বরে বললেন, আমি ভেবেছিলাম আপনি বোধ হয় ঘটনাটা জানেন।

ক্যাপ্টেনের গলার স্বর বড় বেশি করুণ শোনালো। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, রাতে খাবার সময় আমার সাথে একবার দেখা করার চেষ্টা করবেন। সম্ভব হলে নতুন ছেলেদের ভেতর থেকে দুএকজনকে সঙ্গে আনবেন।

বুড়ো ভালো করে জরিপ করলেন ক্যাপ্টেনকে–খুব গোপন কিছু কি?

ক্যাপ্টেন একটু থতিয়ে বললেন, হ্যাঁ, মানে–খুব গুরুতর কিছু নয়। তবু একটু সাবধানেই আসবেন।

আর কোনো কথা বলেননি ক্যাপ্টেন। হাত দুটো পকেটে খুঁজে কী যেন ভাবতে ভাবতে চলে গেলেন। কটা পাঞ্জাবি সৈন্য হল্লা করতে করতে ক্যাপ্টেনের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলো। ওরা কেউ ক্যাপ্টেনকে সেলুট দিলো না। বরং পেছনে এসে ক্যাপ্টেনকে দেখিয়ে কি যেন ইঙ্গিত করলো। ক্যাপ্টেন আগের মতো মাথা নিচু করে চলে গেলেন। দূর থেকে হাবিলদার মেজর সবই দেখতে পেলেন।

আজকাল কোনো বাঙালি অফিসারকেই সম্মান দেখানো হয় না। ওঁদের শুনিয়ে শুনিয়েই সাধারণ সৈন্যগুলো আজে বাজে মন্তব্য করে। সামরিক বাহিনীর অফিসারদের জন্য এটা যে কতখানি মর্মান্তিক ঘটনা, যারা জানেন শুধু তারাই বুঝতে পারবেন। নতুন অর্ডার এসেছে, কমিশন আর নন-কমিশন র‍্যাঙ্কে যত বাঙালি অফিসার আছেন, তাঁরা যেন তৈরি থাকেন। চব্বিশ ঘন্টার নোটিসে তাঁদের ওয়েস্ট পাকিস্তান পাঠানো হবে। কয়েকজনকে এর ভেতরই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ক্যান্টনমেন্টের কোয়ার্টারে সুলতান আহমেদের স্ত্রী আর ছেলে মেয়েরা রয়েছে। ওদের কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন আফতাব গুলকে গিয়ে বলেছিলেন, একদিনের ছুটি পেলে ওদের গ্রামের বাড়িতে রেখে আসতে পারি।

তরুণ পাঞ্জাবি অফিসার আফতাব গুল মুখের ওপর জবাব ছুঁড়ে মেরেছে–একঘন্টার ছুটিও নয়।

বুড়ো সেই থেকে ভীষণ উদ্বিগ্ন। ক্যাপ্টেন করিম ওদের চর হয়ে কাজ করছে তো? সেদিন পর্যন্ত সে ক্যাপ্টেন দম্ভ করে বলতেন, পাকিস্তান এক থাকবেই। পাকিস্তানকে ভাঙার চেষ্টা আমরা কিছুতেই সহ্য করবো না –তাঁর এ ধরনের পরিবর্তন একটু অস্বাভাবিক বৈকি! তবু হাবিলদার মেজর ভাবতে চেষ্টা করলেন, তখনকার সময় আর এখনকার সময়ের ভেতর অনেক ব্যবধান। সময় এবং পরিস্থিতি মানুষের পরিবর্তন ঘটায়, বিশ্বাস পাল্টে দেয়। ক্যাপ্টেন এখন যে অবস্থায় আছেন, পাকিস্তানের স্বপ্ন সেখানে সম্পূর্ণ অবাস্তব। পুরো ব্যাপারটা বাবলু হাবিলদার মেজরের কাছে শুনলো। শুনে ও নিজেও কিছুটা অবাক হয়েছিলো। বুড়ো বললেন, দেখা যাক কী হয়। রাতে তৈরি থেকো। তোমাকেই নিয়ে যাবো।

অসম্ভব অস্থিরতার ভেতর দিয়ে সময়গুলো কাটছিলো। বার বার বাবলুর মনে হচ্ছিলো, একটা কিছু করা দরকার। হাবিলদার মেজরকে ও সুইসাইডাল স্কোয়াড করার কথাও বলছিলো। তিনি ভীষণ আপত্তি করেছেন। বলেছেন, এ সময়ে মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করতে হবে। ঝোঁকের মাথায় কিছু করতে যেও না।

উত্তেজনা বাইরে প্রকাশ না করলেও বুকের ভেতর ঝড় তুলছিলো। শুধু অস্থিরতা। একটা দেশ। দেশের মানুষ। মানুষের অধিকার। অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ। প্রতিটি শাণিত সত্য তার অসহায়তাকে রক্তাক্ত করছিলো। বার বার ঘুরে ফিরে একটা প্রতিজ্ঞায় বাবলু স্থির হলো–এদেশের স্বাধীনতার জন্যে সবাইকে যুদ্ধ করতে হবে।

রাতে ও হাবিলদার মেজরের সাথে ক্যাপ্টেনের কোয়ার্টারে গেলো। ক্যাপ্টেন ওদের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। কীভাবে কথাটা শুরু করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ক্যাপ্টেন বললেন, আমাদের কয়েকজন অফিসার বেরিয়ে গেছেন।

হাবিলদার মেজর প্রশ্ন করলেন, আমাদের অফিসার মানে?

ক্যাপ্টেন স্থির দৃষ্টিতে বুড়োর দিকে তাকিয়ে বললেন, সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গলের কয়েকজন অফিসার ছিলেন। পঁচিশ তারিখ রাতেই ওঁরা সবাই বেরিয়ে গেছেন।

হাবিলদার মেজর মাথা নাড়লেন, –আমি জানি।

ক্যাপ্টেন বললেন, আমি একজন লেফট্যানেন্ট-এর ম্যাসেজ পেয়েছি। ওয়েস্ট পাকিস্তানে আমাদের কোন অবস্থাতেই যাওয়া যাবে না। এখানেই থাকতে হবে। যদি এর ভেতর নোটিস এসে যায়, তাহলে পালাবার চেষ্টা করতে হবে।

হাবিলদার মেজর বললেন, এখানে থাকা আর বেরুবার চেষ্টা দুটোই সমান বিপদজনক। আমাদের ছেলেরা দুবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে।

ক্যাপ্টেন ভুরু কুঁচকে বললেন, আমি জানি, তবে ওদের ওভাবে প্ল্যান করে যাবার চেষ্টা করা ঠিক হয়নি। তাছাড়া রাতে পালাতে গিয়ে বেশি বোকামি হয়েছে।

হাবিলদার মেজর বিস্মিত হলেন–অন্য কোন পথ ছিলো না স্যার!

ক্যাপ্টেন মাথা নাড়লেন–ভুল করছেন। এখান থেকে বেরুতে হবে দিনে। ওদের নাকের ডগা দিয়ে। আর ওভাবে দল বেঁধে নয়। যে যখন সুযোগ পাবে তখনই বেরিয়ে পড়বে।

বুড়োর বিস্ময় আরো বেড়ে গেলো–আপনি কি এ সম্পর্কে কিছু ভেবেছেন।

ভেবেছি। ক্যাপ্টেন ধীরে ধীরে বললেন, আপনাদের লক্ষ্য করা উচিত ছিলো রাতে ক্যান্টনমেন্টের পাহারাটা অনেক বেশি হয়। দিনে শুধু চেকপোেস্ট রয়েছে কয়েকটা। রাতের মতো দিনে অসংখ্য গার্ড পজিশন নিয়ে বসে থাকে না। দিনে ওদের অতখানি সতর্কতার দরকার নেই।

মেজর বললেন, কিন্তু চেকপোস্ট তো রয়েছে, বেরুবে কীভাবে?

ক্যাপ্টেন মাথা নাড়লেন–তাই বলছি। মন দিয়ে শুনুন। কয়েক দিন ধরে আমি লক্ষ্য করেছি ক্যান্টনমেন্টে কারা নিয়মিত যাতায়াত করে। বাঙালি সিভিলিয়ান যারা ছিলো, তারা কেউ এখন নেই। অবাঙালিরা আছে। ওদের পরিচিতরা যাওয়া-আসা করে নিয়মিত। আর আসে ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের লোকজন। ওদের চেকিং হয় ঢোকার সময়। বেরুবার সময় অতটা লক্ষ্য করা হয় না। আমার মনে হয় ছেলেরা যদি ওদের ভেতর কোন রকমে ঢুকে যেতে পারে তাহলে বেরুতে অসুবিধে হবে না।

বুড়ো হাবিলদার মেজরকে যথেষ্ট চিন্তিত মনে হলো–ওদের ভেতর সবাই কি বিশ্বাসযোগ্য হবে?

ক্যাপ্টেন বললেন, হয়তো হবে না। তবু বিশ্বাস করতে হবে। একজনের সঙ্গে আমি আলাপ করেছি। নির্ভরযোগ্য মনে হলো। বললো, সাধ্যমতো যা কিছু করার করবে।

বুড়ো বললেন, খুবই রিস্কের ব্যাপার!

বাবলু এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলো। ভেবে দেখলো ক্যাপ্টেনের প্রস্তাব মন্দ নয়। বললো, এটুকু ঝুঁকি না নিলে কোন দিনই আমরা এখান থেকে বেরুতে পারবো না।

ক্যাপ্টেন ওর পিঠে হাত রাখলেন–ঠিক বলেছো। এ ঝুঁকিটুকু নিতে হবে। সকাল দশটায় কাশ্মীর পয়েন্টে থেকো, ইলেকট্রিক সাপ্লায়ের লোকেরা ওই পথ দিয়েই যাবে।

সুলতান আহমেদ মাথা নেড়ে সায় জানালেন। ক্যাপ্টেন বললেন, আপনারা তাহলে আসুন। ওই কথাই রইলো। কাল দশটা।

ক্যাপ্টেনের কোয়ার্টার থেকে ওরা বেরিয়ে এলো। একটু উত্তেজিত মনে হলো বাবলুকে। বললো, আমি যাচ্ছি তাহলে!

মাথা নেড়ে সায় জানালেন হাবিলদার মেজর তুমিই যাও। প্রথমে একটা বিভ্রাট বাঁধলে অন্য সবাই নার্ভাস হয়ে পড়বে। আমি মনে করি তুমি ঠিকমতো যেতে পারবে।

বাবলু বললো, অন্য সবার সাথে কিভাবে যোগাযোগ করবো?

হাবিলদার মেজর একটু ভেবে বললেন, তুমি নরসিংদী চলে যেও। ড্রাইভার কেরামত মিথ্যে খবর দেবে না। সেখানে তুমি ক্যাপ্টেন সামাদের দেখা পাবে।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন বুড়ো হাবিলদার মেজর। কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, একটা খবর পাঠাবার চেষ্টা করো।

এরপর তাঁর সঙ্গে বাবলুর আর কোন কথা হয়নি। হাসানকে শুধু শোবার আগে বললো, আমি কাল যাচ্ছি। যত তাড়াতাড়ি পারো বেরিয়ে এসো।

সকালে বাবলু লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে, কাঁধে তোয়ালে ফেলে কাশ্মীর পয়েন্ট চলে গেলো। ব্যারাকের পাহারাদার সৈন্যরা মনে করলো পুকুরে যাচ্ছে। অনেকেই যায়। কেউ কিছু বললে বাবলু তাই জবাব দিতো। কিছুটা উত্তেজনা অবশ্যই

অনুভব করছিলো। তবে মুখে তার প্রকাশ নেই।

সাপ্লাইয়ের লোকদের সঙ্গে দেখা হলো বাবলুর। সব মিলিয়ে পনেরো জন। কারো হাতে ব্যাগ, কারো কাঁধে মই। ওদের সঙ্গে পথ চলতে চলতে বাবলু এক সময়ে ভেতরে ঢুকে গেলো, কেউ খুব একটা লক্ষ্য করলো না। একজন বুড়ো শুধু পেছন থেকে সামনে এগিয়ে এলেন। বললেন, ক্যাপ্টেন করিম বুঝি তোমাকে পাঠিয়েছেন?

বাবলু মাথা নাড়লো। দেখলো একজন সাধারণ মিস্ত্রি। বেশ বয়েস হয়েছে। গায়ের চাদরটা খুলে বললেন, এটা গায়ে জড়িয়ে নাও। আর আমার তারের কয়েলটাও নাও।

তারের বোঝা কাঁধে ফেলে বাবলু একমনে হাঁটতে লাগলো। শেষ চেকপোস্ট পর্যন্ত প্রায় এক মাইল পথ। অফিসারদের কোয়ার্টারের কাছে ক্যাপ্টেন করিম দাঁড়িয়েছিলেন। বাবলুকে দেখে মুহূর্তের জন্য তার ঠোঁটের ফাঁকে হাসি ফুটে উঠলো। ইশারায় ওকে মাথাটা একটু নিচু করে যেতে বললেন। বড়ো বেশি ম্লান আর বিষণ্ণ দেখাচ্ছিলো ক্যাপ্টেনকে।

বাবলু তার আসল দ্বন্দ্বটা বুঝতে পারলো। তবু ভালো ক্যাপ্টেন তার ভুল বুঝতে পেরেছেন।

.

১৪.

বাবলু যখন এলো বাবু তখন বাড়িতে ছিলো না। বাবা, ভাইয়া, ভাবী আর হিমি বারান্দায় বসেছিলো। হিমিই প্রথম দেখতে পেলো। চেঁচিয়ে উঠলো–দিদা, দেখ কে এসেছে।

সবাই চমকে উঠলো। লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা বাবলু। খালি পা। হিমির দিকে তাকিয়ে বাবলু হাসলো। ভাইয়া বললো, কোত্থেকে এলি?

বাবলু জবাব দিলো, ক্যান্টনমেন্ট থেকে।

বেরুলি কীভাবে? ভাইয়ার গলায় অসম্ভব ব্যস্ততা।

বাবলু একটু হাসলো–পালিয়ে এসেছি।

পালিয়ে এসেছিস, কীভাবে?

বাবা বাধা দিলেন–এখানে এভাবে চেঁচিয়ে পাড়া মাত কোরো না। ঘরে যাও।

হিমি বাবলুর হাত ধরলো। ওকে কোলে তুলে চুমু খেলো বাবলু। হিমির ভয় হচ্ছিলো ছোটকা এক্ষুণি হয়তো চলে যাবে। ভাইয়ার সঙ্গে ওরা ঘরে ঢুকলো। সব কথা খুলে বললো বাবলু। শুনে সবাই চুপ করে রইলো। শুধু হিমি বললো, তুমি আর কোথাও যেতে পারবে না। আমার কাছে থাকবে।

বাবলু হিমিকে আদর করে বললো, কেন হিমি?

হিমি বললো, আমার সাথে কেউ খেলে না। কাকু সারাদিন শুধু বাইরে থাকে। কারো সাথে কথা বলে না।

বাবা কিছুক্ষণ পর ভাইয়াকে বললেন, এখানে থাকা ওর জন্যে আদৌ নিরাপদ নয়।

ভাইয়া বললো, নিউ ইস্কাটনে আমার বন্ধু জাহাঙ্গীরদের বাড়ি গিয়ে থাকতে পারে। ওর এই বন্ধুর বাবা একসময় মুসলিম লীগের মন্ত্রী ছিলো।

বাবলু চমকে উঠলো। এই ভয়টাই করছিলো সে। বাবা হয়তো তাকে যেতে দেবেন না। ভাইয়া ওকে প্রশ্ন করলো–বাবলু কি বলিস?

বাবলু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর শান্ত স্থির গলায় বললো, আমি এখানে কোথাও থাকতে পারবো না। যুদ্ধে যেতে হবে আমাকে।

বাবা কোন কথা বললেন না। ভাইয়া একটু অবাক হলো–সে কী! তোর যে এখনো ট্রেনিং শেষ হয়নি?

আগের মতো শান্ত গলায় বাবলু বললো, আর্টিলারী ট্রেনিং আমাদের হয়ে গেছে। ভারী মেশিনগানও চালাতে জানি আমি। শুধু চালানো নয়, মেকানিজমও জানি। আমার মনে হয় এখনকার মতো এটাই যথেষ্ট।

ভাইয়া বাবার দিকে তাকালো। বাবা কী যেন ভাবছিলেন। সবাই চুপ করে বসে রইলো। বাবা কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে বললেন, আমার ছেলে স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করবে এটা আমার জন্যে গর্বের কথা।

এই বলে বাবা থামলেন। তারপর স্বাভাবিক গলায় বাবলুকে বললেন, তুই যাবি কীভাবে? ঢাকা থেকে বেরোতে গেলেই ধরা পড়ে যাবি। পালানোর সংবাদ তোর ছবি সুদ্ধো নিশ্চয়ই প্রত্যেকটা চেকপোস্টে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। তোর চেহারা দেখে বোঝা যায় তুই আর্মিতে ছিলি। আর তাছাড়া কোন ঠিকানা না নিয়ে কোথায় যাবি? যুদ্ধ হচ্ছে বিক্ষিপ্তভাবে, আমার তো মনে হয় চট্টগ্রামও এরা দখল করে নিয়েছে।

বাবলু উৎসাহের সঙ্গে বললো, ওদের সব খবরই আমার জানা আছে। আমি নরসিংদী যাব প্রথমে। ক্যাপ্টেন সামাদ আছেন ওখানে। ঢাকা থেকে বেরোনো এমন কোন কঠিন কাজ হবে না। বাঘের গুহা থেকে বেরিয়ে এসেছি। চেকপোস্ট দেখেই যাবো। আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারো।

বাবা বললেন, তোমাদের কাউকে নিয়ে ভয় করি না। ভয় শুধু বাবুকে নিয়ে। ছেলেটা দিন দিন যেন বদলে যাচ্ছে।

ভাবী বললো, সেদিন বলছিলো ওর বন্ধুরা নাকি কেউ বেঁচে নেই। বাবলু বললো, ওসব ঠিক হয়ে যাবে। আমি ওর সঙ্গে কথা বলবো।

বাবু এলো বিকেলে। ওর চোখে মুখে চাপা উত্তেজনা। বাবলুকে দেখে জড়িয়ে ধরলো–কখন এলি বাবলু? কীভাবে এলি?

বাবলু হাসলো–দুপুরের অল্প আগে এসেছি। পালিয়ে এসেছি বুঝতেই পারছো।

কীভাবে পালালি তাই বল না?

ভাইয়া আর ভাবী একটু অবাক হলো। সেদিনের পর থেকে বাবুকে এই প্রথম হাসতে দেখা গেলো। ওরা ভাবলো, বাবলুকে পেয়েই হয়তো ওর ভালো লাগছে। বাবলুকে নিয়ে বাবু ওর ঘরে গেলো। বললো, তোদের যুদ্ধের খবর বল বাবলু। আদৌ কিছু হচ্ছে কি?

বাবলু বললো, জোর যুদ্ধ চলছে সবখানে। উত্তরবঙ্গের বিরাট একটা অঞ্চল আমাদের দখলে।

কিন্তু এভাবে কদিন চলবে বলতো? বাবুকে একটু অধৈর্য মনে হলো।

বাবলু বললো, গেরিলা যুদ্ধে অনেক সময় দরকার। ভিয়েতনামে ক বছর ধরে যুদ্ধ চলছে, হিসেব রাখো? ওসব পরে বলছি। তুমি কী করছো? তোমাদের লেখক সগ্রাম শিবিরের খবর কি? কিছু করছো কি?

বাবু বললো, সংগ্রাম শিবিরের পক্ষ থেকে আমাদের লেখক শিল্পী সবাই পৃথিবীর সকল দেশের বুদ্ধিজীবীদের কাছে আবেদন জানাবেন, আমাদের দেশে যে গণহত্যা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে আর স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্যে তাদের নিজ নিজ সরকারকে চাপ দিতে। এটা কোন খবরই নয়। আসল খবর শোন। আজ সেজদির সঙ্গে দেখা হয়েছিলো।

বাবলু চমকে উঠলো। সেজদি গোপন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী। সব সময় তাকে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকতে হয়। বললো, কোথায় দেখা হলো? সেজদি বাইরে ঘোরাফেরা করছে কীভাবে?

বাবু বললো, সেটাই তো বলছি। পুরানা পল্টন মোড়ে বোরখাপরা সেজদিকে দেখে আমিও অবাক হয়েছিলাম। সেজদি বললো, এখন আর আই বির টিকটিকিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে না। সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। চলাফেরা এখনই নিরাপদ, যদিও সৈন্যদের মেশিনগান রাস্তার প্রতি মোড়ে নল উঁচিয়ে পাহারা দিচ্ছে। ওদের গোপন কর্মসূচীর কথা অবশ্য আমাকে কিছু বলেনি। তবে এটুকু বললো, নোয়াখালীতে ওরা ট্রেনিং ক্যাম্প খুলেছে। আওয়ামী লীগ এর ট্রেনিং ক্যাম্পে নাকি ওদের জায়গা হবে না। নিজেদের ফ্রন্টে ওরা নিজেরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। সেজদি আরো বললো, শহরের ভেতর গেরিলা তৎপরতা চালানো দরকার। পাঞ্জাবি সৈন্যরা শহরগুলোকে খুব নিরাপদ ভাবছে। ওদের জানানো দরকার মুক্তিবাহিনী সবখানেই আছে। আরো অনেক কথা বললো সেজদি। আসল কথা হলো আমি ওদের জন্যে কাজ করবো।

বাবলু অবাক হলো–তুমি ওদের পার্টির জন্যে কাজ করবে? ওদের পার্টি তোমাকে নেবে কেন?

বাবু একটু বিরক্ত হলো, পার্টির জন্যে কিনা জানি না। আমি কাজ করবো দেশের জন্যে।

কাজটা কী? যুদ্ধ করবে? নির্দিষ্টভাবে জানতে চাইলো বাবলু।

বাবুকে একটু উত্তেজিত মনে হলো–যুদ্ধে নিশ্চয়ই যাবো, তবে আমাকে এখন অন্য কাজ করতে হবে। কাজটাকে গুপ্তচরের কাজ বলতে পারিস। ক্যান্টনমেন্ট থেকে কিছু খবর সংগ্রহ করতে হবে।

উত্তেজনায় বাবু রীতিমতো কাঁপছিলো। বাবলু আরো অবাক হলো–সে কী? তুমি গুপ্তচরের কাজ করবে কী?

বাবু রেগে গেলো–অতটা অকর্মা ভাবছিস কেন? সেজদির সঙ্গে সব কথাই হয়েছে। আমিও প্রথমে একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম। স্পাইদের যা গল্প শুনেছি সব টাফ ব্যাপার। বললাম, আমি কি পারবো? সেজদির সঙ্গে দাড়িওয়ালা মাওলানা টাইপের এক ভদ্রলোক ছিলেন। তিনি বললেন, কেন পারবে না। তোমার বুদ্ধি আছে, বিচক্ষণতা আছে, আর সব চেয়ে বড় কথা হলো তোমার চেহারা। তোমাকে এত ইনোসেন্ট মনে হয়, এত ভালো উর্দু জানো, কেউ কল্পনাই করতে পারবে না তুমি এ ধরনের কাজ করতে পারো। আর কাজটাও ভয়ানক কিছু নয়।

বাবলু বললো, কাজটা কী তাই বললো না।

বাবলু বললো, ক্যান্টনমেন্টের কয়েকটা জায়গার নকশা আমাকে এঁকে দিতে হবে। কোথায় জেনারেলদের বাড়ি, কোথায় এনেশন ডাম্প, কোথায় সৈন্যদের ব্যারাক, কোথায় হ্যাঁঙ্গার সব কিছু। আর কিছু লোকেশনের খবর। সেটা অফিসারদের কথা থেকে জানতে হবে।

বাবলু বললো, এটাকে এত সাধারণ কাজ ভাবছো কেন? ক্যান্টনমেন্টে তুমি যাবে কীভাবে? তাছাড়া শুধু গেলেই তো চলবে না, ওখানে দিনের পর দিন থাকতে হবে।

ওসব ব্যবস্থাও করা হয়েছে। বাবু বললো, সেজদি অবশ্য কাজটা গুছিয়ে দিয়ে কেটে পড়েছেন। বলেছেন কোন পরিচিত আর্মি অফিসার খুঁজে ওর বাড়িতে থাকতে। আমি মামুনের সাথে আলাপ করেছি। ওকে সব বলেছি। ওর বাবার এক বন্ধু আছেন মেজর মুস্তফা। ইউ পির লোক। মামুনের বাবাকে কিছুদিন আগে বলেছিলেন শহরে নিরাপদ মনে করলে ক্যান্টনমেন্টে ওর কোয়ার্টারে গিয়ে থাকতে। ফ্যামিলি এবটাবাদ পাঠিয়ে দিয়েছেন, পুরো কোয়ার্টার খালি পড়ে আছে। মামুন আগে বলেছিলো ওর বাবার ইচ্ছে ও মেজর মুস্তফার কাছে থাকুক। ভয়ানক আদর্শবাদী বলেই ও যেতে রাজি হয়নি। আমি সেজদির ব্যাপারটা খুলে বলতে ও খুব উৎসাহিত হলো। বললো, সব ব্যবস্থা করে দেবে। পরে সেজদিও বললো, এর চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না।

একনাগাড়ে অনেকক্ষণ কথা বললো বাবু। বাবলু সব শুনলো। বাবুর জন্য ভয় হলো, তবু মাথা নেড়ে সায় জানালো–ব্যবস্থাটা মন্দ নয়। কিন্তু তুমি বাঙালি, এটা ভুলে যেও না। প্রত্যেকটা বাঙালিকেই ওরা সন্দেহের চোখে দেখে।

বাবু হাসলো–আমি বাঙালি বটে। তবে পরিচয় দেবো রিফুজি। যাদের ওরা বলে মোহাজের। যাদের জন্যে ওদের দরদের অন্ত নেই। এটা তো জানিস, রিফুজিরা সবসময় ওদের সঙ্গে সহযোগিতা করছে। তাছাড়া আমি উর্দু বলতে আর লিখতে ওদের চেয়ে কম জানি না।

বাবলুর দ্বিধা তবু যায় না–যদি ধরা পড়ো–।

বাবু বাধা দিলো–কক্ষণো ধরা পড়বে না। আমি মোহাজের। ভারতীয়দের অত্যাচারে দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছি। ভারতীয়দের ওপর আমার প্রচণ্ড ঘৃণা। আদি বাড়ি ছিলো বিহারে। বঙ্গাল মুলুকে থেকে বঙ্গাল জবানটা

ভালোই রপ্ত করেছি। বঙ্গালদের দুচোখে দেখতে পারি না। শহরটা নিরাপদ নয় বলেই কদিন ক্যান্টনমেন্টে থাকবে। এর পরও কি বলিস ধরা পড়বো?

বাবলু ম্লান হাসলো–কি নোংরা পরিচয়!

ভুরু দুটো কুচকে গেলো বাবুর–বাবলু তোর জানা দরকার, দেশের জন্যে স্পাইদের অনেক জঘন্য কাজ করতে হয়। এটা একটা ত্যাগ স্বীকার, এটা ভুলে যেও না। আমিও জানি কী পরিচয়ে ওদের ওখানে থাকছি।

বাবলু বললো, তুমি রাগছো কেন? আমি সবই জানি। তোমাকে আমি এ ব্যাপারে কিছু সাহায্য করতে পারি।

বাবু এবার অবাক হলো–কী রকম?

বাবলু বললো, ওখানে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন বাঙালি ক্যাপ্টেন আছেন! নাম হলো ক্যাপ্টেন করিম। তাঁকে অবশ্য আন-আর্মড করে রাখা হয়েছে। যে কোনো সময় ওয়েস্ট পাকিস্তানেও পাঠিয়ে দিতে পারে। তার সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করতে পারো। কারণ বাঙালিদের ওখানে যথেষ্ট সন্দেহের চোখে দেখা হয়।

বাবু বললো, তিনি কি মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করেন?

বাবলু বললো, নিশ্চয়ই করেন।

তাহলে তিনি বেরিয়ে আসেননি কেন? আমি তো জানি বেশ কয়েকজন অফিসার বেরিয়ে আসতে পেরেছেন।

গোড়ার দিকে তিনি বেরিয়ে আসার বিপক্ষে ছিলেন। এখন অবশ্য নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। তিনি তোমার কোন অসুবিধার কারণ হবেন না।

বাবু বললো, তুই যাচ্ছিস কবে?

কালই যাবো। তুমি কবে যাচ্ছো?

আমিও কাল বিকেলে যাচ্ছি।

বাবলুর সঙ্গে বাবুর অনেক কথা হলো। সেজদির কথা বললো বাবলুকে। ওর কথাগুলো বাবুকে আলোড়িত করেছে। যে বাবু নিজেকে সব কিছু থেকে দূরে সরিয়ে নিতে চেয়েছিলো, সে বাবু জীবনের এত কাছাকাছি এসে যাবে, এভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে এটা বাবু নিজেও কোনোদিন ভাবেনি। যে কাজ সে করতে যাচ্ছে মনে হলো ওর জীবনের সবচেয়ে গৌরবের কাজ। প্রতিপদে ওকে বিপদের চরম সীমায় বিচরণ করতে হবে।

বাড়িতে বাবু কাউকে কিছু বললো না। রাতে শুধু খাবার টেবিলে বললো, আমি কদিন মামুনদের বাড়িতে থাকবো।

বাবা ওর পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলেন। বললেন, বেশ তো। যাচ্ছো কবে?

খেতে খেতে বাবু বললো, কাল বিকেলে।

মেজদা রাতে ফেরেননি। কোলকাতা যাওয়ার ব্যবস্থা করছেন। হিমি বাবলুর সাথে ওর ছোট বোনটিকে নিয়ে গল্প করছিলো। বাবার মনে হলো, অনেকদিন পর সবাই একসঙ্গে বসে খাচ্ছি। কাল এরা চলে যাবে। কতদিন পর সবাই একত্রিত হবো কে জানে! হয়তো কোনদিনও নয়। তাঁর ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছে। একই সঙ্গে গর্ববোধ করলেন এবং এক ধরনের শূন্যতাও। ওদের মা মারা যাওয়ার সময় বাবলু ছিল এক বছরের। এই ছেলেটিকে তিনি কোনদিন মায়ের

অভাব বুঝতে দেননি।

খাবার পর বাবা, ভাইয়া আর ভাবী আকাশবাণীর খবর শুনতে বসলো। বাবলু বাবুর সঙ্গে ওর ঘরে বসে কথা বলছিলো। কথা ফুরোতে চায় না। বাবুও ভাবছিলো হয়তো কোনদিনই আর দেখা হবে না। এ সময়টুকু যতটা পারি ধরে রাখি।

রাতে বিছানায় শুয়ে বাবু অনেক রাত অবধি অনেক কথা বললো। নিজের দেশ, দেশের মানুষ আর মানুষের স্বাধীনতার কথা। স্বপ্নের কথাও মনে হলো। বাবু আজও খুঁজে পেলো না সেই দুঃস্বপ্নের অর্থ কী। তারপর একসময় ও ঘুমিয়ে পড়লো । বহুদিন পর বাবু শান্তিতে ঘুমোলো।

.

১৫.

শহরের সাধারণ মানুষের জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এলাকা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। শহরে এতো উত্তেজনা, এতো আতঙ্ক, অথচ এখানে তার এতোটুকু ছায়া পড়েনি। অফিসারদের কাজের চাপ বেড়েছে। উত্তেজনা হয়তো সেখানেও আছে। তবে তার চেহারা আলাদা। সেখানে প্রতি মুহূর্তে পরিকল্পনা আর প্রস্তুতি চলছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য। তবে বাইরে থেকে কেউ সেটা অনুভব করতে পারবে না।

মেজর মুস্তফার বাড়িতে চমৎকার অভ্যর্থনা পেলো বাবু আর মামুন। লনে বসে একজন কমবয়সী ক্যাপ্টেনের সঙ্গে চা খাচ্ছিলেন মেজর মুস্তফা। ওদের দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, এসো, এসো। এত দেরি হলো কেন?

ইউ পির লোক বলেই চমৎকার উর্দু বলেন মেজর। মামুন উর্দুতেই জবাব দিলো–স্কুটার এদিকে আসতে চাইছিলো না। এয়ারপোর্ট থেকে হেঁটে আসতে হয়েছে।

গলা ফাটিয়ে হাসলেন মেজর মুস্তফা–তাই বলো, এ বুঝি তোমার সেই বন্ধু বাবু? তোমার বাবার সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়েছে।

বাবু হেসে সালাম করলো। মেজর বললেন–ও কি দাঁড়িয়ে কেন, বোসো। তারপর চেঁচিয়ে ডাকলেন, রইস, আরো দুকাপ চা দিয়ে যাও। চা খাবে তো? নাকি কফি?

মামুন বললো–চা খাবো।

মোটাসোটা হাসিখুশি সরল মানুষ মেজর মুস্তফা। দেখে মনেই হয় না আর্মি অফিসার। প্রচুর কথা বলেন। এদের চুপচাপ বসে থাকতে দেখে বললেন, তারপর খবর টবর বলো। কথ বলো! চুপ থাকা গোমড়া মানুষ আমি পছন্দ করি না।

মামুন বললো–খবর তো আপনাদের কাছে চাচা।

মেজর আবার হাসলেন–তা বটে। এখন আমরাই খবরের কাগজের হেড লাইন! তোমার বাবাকে বলেছিলাম করাচী চলে যেতে, যে কদিন গণ্ডগোল চলছে সে কদিন করাচী থাকতে। তোমার বাবা বললেন করাচীতেও গণ্ডগোল লাগবে। আমি তো শুনে হেসেই বাঁচি না। সারা পাকিস্তানে গণ্ডগোল লাগলেও করাচীর রেস্টুরেন্টে একটা খদ্দের কমবে না। সিনেমায় টিকেটও আগের মতো বিক্রি হবে। বেগম সাহেবদের শপিং-এ এতটুকু অসুবিধে হবে না। ব্যাস, আর কি চাই!

হা হা করে হাসলেন মেজর। বাবুকে বললেন, তুমি বাপু বড়ো গম্ভীর ছেলে। কিছু মনে করো না। আমি একটু বেশি বকি। এ নিয়ে গিন্নি আমাকে কম জ্বালায় না।

বাবু হেসে বললো, আমি শুনতে ভালোবাসি।

তাই নাকি! মেজরের হাসি আর থামতে চায় না। আজকালকার দুনিয়ায় কেউ শুনতে চায় নাকি? সবাই তো চায় বলতে। বলতে বলতেই জীবন কেটে যায়।

মামুন বললো, ব্যতিক্রম সব সময় থাকে।

হাসতে হাসতে মেজর বললেন, তা ঠিক বলেছো। আমিও তাই বলতে চাইছি, বাবু ব্যতিক্রমদের দলে পড়ছে।

বাবু মৃদু হাসলো। মামুন বললো, আপনি চমৎকার বলতে পারেন চাচা।

তাই নাকি। যাক এদ্দিনে তাহলে কথা বলার মতো মানুষ পেলাম। গিন্নি চলে যাবার পর থেকে বড়ো হাঁপিয়ে পড়েছিলাম।

রইস এসে চা দিয়ে গেলো। একেবারে সীমান্তের লোক। সাড়ে ছফুট লম্বা। দৈত্যের মতো চেহারা। মেজর বললেন, রইস, এঁরা আমাদের মেহমান। তোমাদের যখন যা দরকার মামুন, রইসকে বলবে।

ক্যাপ্টেন এতক্ষণ চুপচাপ বসে খবরের কাগজ পড়ছিলো। ঘড়ি দেখে বললো, স্যার, কনফারেন্সের সময় হয়ে গেছে।

মেজর মুখ ভার করলেন–শুধু কনফারেন্স আর কনফারেন্স। যাই বলো ক্যাপ্টেন, আমি হাঁপিয়ে পড়েছি। এক্ষুণি যেতে হবে?

ক্যাপ্টন বললো, জিপ দাঁড়িয়ে আছে।

মেজর উঠে দাঁড়ালেন। মামুনদের বললেন, দেখলে তো! রাতে আলাপ করবো।

বাবু আর মামুন মাথা নাড়লো। মেজর আর ক্যাপ্টেন জিপ নিয়ে চলে গেলো।

মামুন বললো, চমৎকার লোক।

বাবু বললো, ভালোই হলো।

জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। বড়ো রাস্তা থেকে একটু ভেতরে। পশ্চিম দিকটা একেবারে খোলা। বহুদূর অবধি মাঠ। মাঠের শেষে ধানক্ষেতে শুরু হয়েছে। ধানক্ষেত শেষ হয়েছে মিরপুরের কাছে। দূরে মিরপুরের ঘরগুলো দেখাচ্ছিলো কালো ছায়ার মতো।

সূর্য ডুবছে। এক টুকরো বিষণ্ণ লাল ছায়া গায়ে মেখে পশ্চিমের দিগন্তে নেমে যাচ্ছে। মাটি ছোঁয়ার আগেই লালটুকু ফ্যাকাশে হয়ে হারিয়ে গেলো। পুব আকাশে মেঘ জমেছে। মেঘের গায়ে বিষণ্ণ লালটুকু লেগে রইলো আরো কিছুক্ষণ। সুন্দর একটা শান্ত পরিবেশ এখানে। বাবুর মনে হলো সকল সুন্দরের ভেতরই অসুন্দর বাস করে।

রাত নটার দিকে মেজর ফিরলেন। সঙ্গে সেই ক্যাপ্টেনও। বিষণ্ণ সময়টাকে মেজর আবার মাতিয়ে তুললেন–ওকি তোমরা এখনো খাওনি? ভারী অন্যায়! আমার তো আরো দেরি হতে পারতো। কক্ষনো আমার জন্যে অপেক্ষা করো না। আমি তো বাইরেও খেয়ে নিতে পারি।

খাবার টেবিলে বসে মেজরের কথা আর ফুরোতে চায় না। ক্যাপ্টেনকে বললেন, বুঝলে ক্যাপ্টেন, আমাদের জোয়ানদের কাণ্ড কারখানা দেখে আমি হেসে বাঁচি না। প্লেন থেকে যখন ওরা নামে এখন সকলের সে কি বীরমূর্তি। যেন একাই একশ। কাফেরদের খতম করার জন্যে সারাক্ষণ হাত নিশপিশ করছে। যেই বেচারাদের বুটের তলাটা কাদা পানি লেগে একটু ভিজলো, তখনই সব চুপসে এতোটুকু। আর বৃষ্টিতে একবার ভিজলে তো কথাই নেই। জিভে ন্যাকড়ার মতো নেতিয়ে যায়।

ক্যাপ্টেন হাসলো–সেদিন কি কেলেঙ্কারি হলো শোনেন নি? ব্যারাকে জায়গা নেই বলে নুতন ফ্রন্টইয়ার ফোর্সকে বলা হলো পশ্চিমের খোলা মাঠটায় তাবু গেড়ে থাকতে। রাতে জোরে বৃষ্টি নামলো। সবাই ভিজে ভয়ে জড়োসড়ো। বিদ্যুৎ চমকালো। প্রচণ্ড শব্দে সামনের তালগাছে একটা বাজ পড়লো। অমনি কয়েকজন উঠে ফায়ারিং শুরু করে দিলো। সে এক বিচ্ছিরি কাণ্ড। শেষে সবাই সুড় সুড় করে ব্যারাকে এসে ঢুকলো। বললো, ওরা ক্যাম্পে থাকবে না।

মেজর হেসে গড়িয়ে পড়লেন–আহা ওদের কী দোষ বলো। বেচারারা কোনদিন কী এমন পানি দেখেছে?

মামুন বললো, কেন, জওয়ানদের এ ধরনের আবহাওয়ার উপযোগী করে কি ট্রেনিং দেয়া হয় না?

কী করে হবে বলো? মেজর বললেন, ওয়েস্টে এই ওয়েদার কোথায় পাবে? যারা অনেক দিন ধরে এখানে আছে, তারা কিছুটা অভ্যস্ত হয় বটে। তবে এখন যারা আসছে সবাই আনকোরা নতুন। অনেকে জীবনে নদীই দেখেনি।

ক্যাপ্টেন বললো, নদীকে ওরা সবচেয়ে বেশি ভয় করে।

মেজর হাসলেন। হঠাৎ যেন একটা কথা মনে পড়লো–আচ্ছা ক্যাপ্টেন, ইমতিয়াজ কবে আসছে জানো কিছু?

ক্যাপ্টেন বললেন, মেজর ইমতিয়াজ বেগ তো? সম্ভবত কালই আসছেন। বড় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন আসার জন্যে।

আহা, তা তো হবেই। সমবেদনার ভঙ্গীতে মেজর মুস্তফা বললেন, বেচারার ওপর কি কম ধকল গেছে! আমি চেষ্টা করছি তাড়াতাড়ি যাতে ওয়েস্ট পাকিস্তান যেতে পারে। মামুনদের বললেন, আমার এক বন্ধু আসছেন চিটাগাং থেকে। কদিন থাকবেন এখানে। অনেক দিনের পুরনো বন্ধু।

বাবু বলল, কদ্দিন চিটাগাং আছেন?

হিসেব করে মেজর বললেন, বছর চারেক হবে। আগে হায়দ্রাবাদে ছিলেন।

খাবার পর ক্যাপ্টেন বিদায় নিয়ে চলে গেলো। ড্রইংরুমে বসে পাইপ টানতে টানতে মেজর তার ছোট বেলার গল্প করছিলেন। টেলিভিশনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছবি হচ্ছে। বাবু টেলিভিশন দেখছিলো। মামুন মেজরের সাথে গল্প করছিলো। বাবু ভাবলো, কাল থেকে কাজে নেমে পড়তে হবে। সেজদির সঙ্গে দেখা করতে হবে। তার আগে বাবলুর সেই ক্যাপ্টেন করিমকেও খুঁজে বের করতে হবে।

এগারোটা যখন বাজলো মেজর বললেন, তোমরা তাহলে শুয়ে পড়ো। আমিও একটু গড়িয়ে নিই। হয়তো মাঝরাতেই আবার ডাক পড়বে। কী যে কনফারেন্স হচ্ছে–জ্বালিয়ে খেলো।

বাবু খুব সাবধানে জানতে চাইলো, কনফারেন্সটা কিসের?

আর বলো না! মেজর বিরক্ত হয়ে বললেন, জেনারেল হামিদ আসছেন। রিপোর্ট তৈরি করতে হবে। আমাদের হয়েছে বিপদ। যা ঘটেছে জেনারেলকে তা জানানো যাবে না। যা ঘটা উচিত ছিলো তাই বলতে হবে। প্রেস রিলিজও তাই যাবে। ভারী জটিল ব্যাপার। তুমি ওসব বুঝবে না।

বাবু মৃদু হেসে বললো, জটিল ব্যাপার বুঝে কাজ নেই।

মেজর হাসলেন–এসো তাহলে। গুড নাইট।

.

রাতে ভালো ঘুম হয়েছিলো তো? সকালে খাবার টেবিলে মেজর মুস্তফা বাবুকে জিজ্ঞেস করলেন।

চমৎকার ঘুমিয়েছি। বাবু শান্ত গলায় জবাব দিলো।

রাতে কি চাচা ফায়ারিং-এর শব্দ শুনেছিলেন? মামুনকে একটু উত্তেজিত মনে হলো–তিনটে, সাড়ে তিনটে নাগাদ মেশিনগানের কয়েক রাউন্ড ফায়ারিং-এর শব্দ শুনেছি।

রুটিতে পুরু মাখন লাগিয়ে মুখে দিয়ে মেজর বললেন, ওটা কিছু নয়। ও রকম প্রত্যেক রাতেই শুনতে পাবে।

বাবু অবাক হলো–প্রত্যেক রাতে?

মেজর খেতে খেতে বললেন, রাতের দিকে ওরা প্রায়ই ক্যান্টনমেন্টের দিকে হামলা চালায়। আমাদের জওয়ানদের তৈরি থাকতে হয়। হামলা না হলেও কয়েক রাউন্ড গুলি খরচ করে জানাতে হয় আমরা জেগে আছি।

মেজর হাসলেন। বাবু বলতে যাচ্ছিলো, ওদের সম্পর্কে তাঁর কী ধারণা। চেপে গেলো। সেজদি বলে দিয়েছেন, কখনো অহেতুক উৎসাহ দেখিও না। সব সময় শুধু শুনে যাবো। প্রত্যেকটা কথা মনে রাখবে। কারণ অনেক কথা তোমার কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও আমাদের কাছে অসম্ভব মূল্যবান হতে পারে।

খেয়ে উঠে মেজর বললেন, যাচ্ছি। তোমরা ঘরে বসে চেকার খেলতে পারো। নইলে বাইরেও ঘুরে আসতে পারো। এখানে ভয়ের কিছু নেই। কারণ এটা ঢাকা শহর নয়। মেজর হাসলেন। রইসকে ডেকে বললেন, মেহমানদের দুপুরে খাইয়ে দিও। আমার জন্যে অপেক্ষা করো না।

জিপ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন মেজর। মামুন জিজ্ঞেস করলো, ঘরে থাকবে না বেরুবে?

বাবু বললো, বেরুতে হবে। তুমি নিশ্চয়ই সঙ্গে আসছো?

ওরা দুজন বেরিয়ে এলো। অফিসারদের কোয়ার্টার পেরিয়ে সদর রাস্তা। জীবনযাত্রা স্বাভাবিক গতিতে চলছে। বাজারে কেনাকাটা হচ্ছে। গাড়ি চলেছে। হোটেলে উর্দু গান বাজছে। কোথাও এতোটুকু ছন্দ পতন নেই। মেজর বলছিলেন, এটা ঢাকা শহর নয়। আসলেই তাই। শহরের এখনকার জীবনের সঙ্গে এর কোন মিল নেই। শহরের এই জীবন মার্চ মাসের পঁচিশ তারিখের রাত থেকে হারিয়ে গেছে।

জেনারেলদের কোয়ার্টারের গা ঘেঁষে একটা ত্রিভুজাকৃতি পার্ক। বাবু আর মামুন এসে পার্কটায় বসলো। ক্যান্টনমেন্টে বাবু আগেও কয়েকবার এসেছে বাবলুর সঙ্গে দেখা করার জন্যে। কোথায় কি আছে সে সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা তার রয়েছে।

মামুন বললো, তোমার কাজ কিভাবে শুরু করবে?

বাবু হাসলো–কাজ কাল থেকেই শুরু হয়ে গেছে। মাপিং-এর আগে ক্যাপ্টেন করিমের সঙ্গে আলাপ করবো।

পার্কে বসে মামুনের সাথে কথা বলতে বলতে জেনারেলদের কোয়ার্টারগুলো ভালো করে লক্ষ্য করলো। পার্কের গায়ের সাথে লাগানো জেনারেল টিক্কা খানের বাড়ির পাঁচিল। নিরাপত্তার জন্যে গভর্ণর টিক্কা খান এখন ক্যান্টনমেন্টে থাকছেন। নইলে তার গভর্নর হাউসে থাকার কথা। তার পাশের বাড়িটা হচ্ছে জেনারেল ফরমান আলীর।

পার্কে পায়চারি করলো ওরা। কোন অফিসারের চাকর কুকুর নিয়ে পার্কে ঘুরছে। দুজন কম বয়েসী ছেলে এক কোণে বাদাম খেতে খেতে গল্প করছে। বাবু আর মামুন সারাক্ষণ উর্দুতে কথা বলছিলো।

জেনারেলদের বাড়িতে কড়া পাহারা দেয়া হচ্ছে। প্রতি দশ হাত পর পর হালকা মেশিনগান হাতে পাহারাদার সৈন্য। প্রধান প্রবেশ পথের দুপাশে দুটো কামান। ফটকের দুধারে ভারী মেশিনগানের পাহারা।

ঝোঁপঝাড়ে ভরা পার্কটার একটা খসড়া নকশার কথা ভাবলো বাবু। সদর রাস্তা থেকে দূরত্ব, বড়ো বড়ো ঝোঁপগুলোর প্রসঙ্গ উল্লেখ থাকা দরকার।

দুঘন্টার মতো সময় ওরা পার্কে কাটালো। তারপর ক্যাপ্টেন করিমের খোঁজে বেরুলো। কেউ সন্দেহ করছে বলে মনে হলো না। কয়েকজন টহলদার সৈন্য অবশ্য লক্ষ্য করেছে। ওরা সারাক্ষণ উর্দু ছবি নিয়ে উর্দুতে কথা বলছিলো, অফিসারদের বখে যাওয়া ছেলেদের মতো। তবু বেশিক্ষণ জেনারেলদের বাড়ির কাছে থাকা উচিত নয়।

বাবুল ক্যাপ্টেন করিমের ঠিকানা দিয়েছিলো। খুঁজে বের করতে অসুবিধে হলো না। বাড়িতেই ছিলেন ক্যাপ্টেন। বারান্দায় মাথা নিচু করে পায়চারী করছিলেন। বয়স খুব বেশি হবে না। বড়ো জোর আটাশ কি ঊনত্রিশ। চমৎকার লম্বা চওড়া শরীর। খুব অসহায় মনে হচ্ছিলো তাকে।

বাবু গিয়ে পরিচয় দিলো। ক্যাপ্টেন একটু চমকে উঠলেন। ভেতরে নিয়ে বসালেন। বললেন, বাবলু ঠিকমতো যেতে পেরেছিলো?

বাবু মাথা নেড়ে সায় জানালো–কালই ও নরসিংদী চলে গেছে।

ক্যাপ্টেন বললেন, তোমরা কী জন্যে এসেছে এখানে?

বাবু একটু ইতস্তত করলো। তারপর পুরো ব্যাপারটাই খুলে বললো।

ক্যাপ্টেন ওর সব কথা শুনে চমকে উঠলেন–খুবই বিপজ্জনক কাজ।

বাবু মৃদু হাসলো–তবু এ কাজ আমাকে করতে হবে।

ক্যাপ্টেন কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপর বললেন, তোমরা উঠেছো কোথায়?

মেজর মুস্তফার বাড়িতে।

ভালো লোক। ক্যাপ্টেন মাথা নেড়ে সায় জানালেন–কোন অসুবিধে নিশ্চয়ই হচ্ছে না?

না। খুবই ভালো লোক তিনি।

মেজর মুস্তফার বাড়িতে আছে এক হিসেবে ভালোই হলো। তিনি এয়ারপোর্টের চার্জে আছেন। ওঁর বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের অফিসার যাতায়াত করেন। সবার কথাই ভালোমতো খেয়াল করে শুনবে। অনেক বেশি খবর পাবে। এইটুকু বলে ক্যাপ্টেন থামলেন। একটু ভেবে বললেন, আমার কাছে ক্যান্টনমেন্টের একটা ম্যাপ আছে। বছর খানেক আগের আঁকা। ট্রেনিং-এর ছেলেদের ম্যাপ রিডিং-এর জন্যে রেখেছিলাম। ওটা তোমার কাজে লাগতে পারে। তবে ইমার্জেন্সি ডাম্পগুলোর লোকেশন ওতে নেই। ওগুলো শুধু তোমাকে বসিয়ে নিতে হবে। ম্যাপ সম্পর্কে আইডিয়া আছে তো?

বাবু মাথা নাড়লো–ইমার্জেন্সী ডাম্প কোনগুলো?

ক্যাপ্টেন বললো, আগে যেখানে কোন ডাম্প ছিলো না। এখন জরুরি অবস্থার জন্যে করতে হয়েছে। যেমন ধরো অফিসার্স কোয়ার্টার থেকে সোজা দক্ষিণে যদি যাও, তাহলে হাতের বাম দিকে দেখবে কয়েকটা তাঁবু। জায়গাটা ফাঁকা কিন্তু ওপরে জাল টাঙানো রয়েছে। যেখানে এরকম দেখবে সেখানেই বুঝবে অস্ত্র মজুদ রয়েছে। এ রকম অনেক দেখতে পাবে।

মাথা নেড়ে সায় জানালো বাবু–বুঝেছি। ও সব জায়গার রিডিং নেয়া একটু কঠিন ব্যাপার হবে।

ক্যাপ্টেন বললেন, বড়ো অসুবিধে হচ্ছে তোমাকে শুধু স্টেপিং থেকে ক্যালকুলেট করতে হবে। অন্য কিছু ব্যবহার করতে পারবে না। বাজারের লোকেশন আমার ম্যাপে রয়েছে। বাজারকে কেন্দ্র ধরে চারিদিকের রিডিংগুলো স্টেপিং মেপ নিতে হবে। এতে চুলচেরা একুইরিটি হয়তো থাকবে না। তবু মোটামুটি লোকেশনটা মাপে বসাতে পারবে।

ক্যাপ্টেন উঠে গিয়ে ম্যাপটা আনলেন। ওদের সামনে মেলে ধরলেন। কয়েকটা বিশেষ জায়গা দেখিয়ে বললেন, এখানে ইমার্জেন্সী ডাম্প রয়েছে। রিজার্ভ ডাম্পগুলো হচ্ছে ব্যারাকের পাশের এই আম বাগানে। ওর ডিটেলস পাওয়া অসম্ভব। প্রত্যেকটা গাছের সঙ্গে গা লাগিয়ে একজন করে সৈন্য পাহারা দিচ্ছে। দূর থেকে কিছু বোঝা যাবে না। কিন্তু বাগানে যেই মাত্র ঢুকেছো সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ে যাবে। ধরা মানে কি, দেখামাত্র গুলি করার অর্ডার রয়েছে ওদের ওপর। আমার মনে হয় তোমাদের যে মিশন তাতে রিজার্ভ ডাম্প অতখানি গুরুত্বপূর্ণ হবে না। তবে কয়েকটা উইক এন্ট্রি পয়েন্ট জেনে রাখো। মিরপুরের উত্তর পূর্ব দিকে আর টঙ্গির দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ওদের পাহারাটা একটু কম। কারণ ওদিকে কোন রাস্তাঘাট নেই। সবচেয়ে বেশি সতর্কতা যেখানে সেগুলো মার্ক করে দিচ্ছি।

মানুষ বললো, ম্যাপটা কি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারি?

না। মাথা নাড়লেন ক্যাপ্টেন–তোমাদের সঙ্গে এ মুহূর্তে ম্যাপ থাকাটা খুবই বিপজ্জনক। এটা আমার কাছেই থাকবে। তোমরা রোজকার মতো ঘুরবে। রিডিং নেবে। ঘুরতে ঘুরতে আমার বাড়ি চলে আসবে। তারপর ম্যাপে তোমাদের রিডিংগুলো বসিয়ে দেবে। আমার এখানে আসার সময় সাবধানে আসবে।

ওরা সায় জানালো। ম্যাপটা দেখলো ভালো করে। তারপর ফিরে গেলো মেজর মুস্তফার বাড়িতে। বার বার লক্ষ্য করছিলো, কেউ তাদের দেখতে পেলো কিনা।

একজন মেজরের সঙ্গে কথা বলছিলেন মুস্তফা। বাবু আর মামুনকে দেখে বললেন, কোথায় কোথায় ঘুরলে? অনেক্ষণ বেড়িয়েছে মনে হচ্ছে?

বাবু একটু বিব্রত হয়ে বললো, এই তো পার্কেই ছিলাম। আপনি কখন এসেছেন?

মুস্তফা ঘড়ি দেখে বললেন, তা ঘন্টাখানেক তো হয়েছে। এসো, পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি হচ্ছেন মেজর ইমতিয়াজ বেগ। কাল যার কথা তোমাদের বলেছিলাম।

তারপর মেজর বেগের দিকে তাকালেন–এদের কথা তো তোমাকে এইমাত্র বললাম।

বেগ একটু হাসলেন। রোগাটে শরীর। মেজর মুস্তফার তুলনায় যথেষ্ট গম্ভীর। বয়সটাও একটু বেশি মনে হলো। বললেন, ক্যান্টনমেন্টে কেমন লাগছে আপনাদের।

কথার মাঝখানে মেজর মুস্তফা হা হা করে উঠলেন, ওকি বেগ? ওদের আবার আপনি বলছো কেন? ওরা তোমার ছেলের বয়সী।

বেগ গম্ভীর হেসে বললেন, আর ছেলে! আজকালকার ছেলেরা বাপের নাম ভুলিয়ে দেয়।

উঁহু। মাথা নাড়লেন মেজর মুস্তফা–আমি ভালো করে বাজিয়ে দেখেছি। বেগ। এরা সে রকম ছেলেই নয়।

বাবু একটু হেসে বললো, আমাদের আপনি তুমিই বলবেন বেগ চাচা।

মাথা নেড়ে কি যেন বিড়বিড় করে বললেন মেজর ইমতিয়াজ বেগ। মেজর মুস্তফা বললেন, সিএনসি কালই আসছে। তুমি কাল দিনটা থেকে যাও বেগ।

চোখ তুলে তাকালেন মেজর বেগ–কাল কখন আসছে?

মুস্তফা বললেন, আমি আশা করছি বিকেল সাড়ে চারটা কি পাঁচটা নাগাদ।

মেজর বেগ কি যেন ভাবলেন। তারপর যেন আপন মনেই বললেন, সিএনসি-র কাছে আমার তো কোন প্রয়োজন নেই মুস্তফা। আমি কোন রকমে ওয়েস্ট পাকিস্তান যেতে পারলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচি।

মেজর মুস্তফা হাসলেন–তুমি বড়ো বেশি হতাশ হয়ে পড়েছো বেগ।

বেগ বললেন, কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে এসব দৃশ্য দেখার পর স্বাভাবিক থাকা সম্ভব নয়। ভাবতে পারো তুমি–?

বাধা দিয়ে মুস্তফা বললেন, আপাতত ওসব ভেবে কাজ নেই। যত কম ভাবা যায় ততই মঙ্গল। তুমি ভাবছো বলে কষ্ট পাচ্ছো বেগ। আমাকে দেখো, সব ভুলে যাচ্ছি। সে জন্যে এখনো আমি হাসতে পারছি। বলতে বলতে মেজর মুস্তফা গম্ভীর হয়ে গেলেন। বাবু দেখে অবাক হলো। এই প্রথম তাঁকে গম্ভীর হতে দেখলো।

মেজর বেগ চুপচাপ বসে রইলেন। রইস এসে বললো, টেবিলে খাবার দিয়েছি।

সবাই খাবার টেবিলে গেলো। বেগ খাবার টেবিলেও চুপচাপ বসেছিলেন। মুস্তফা আবার উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। কথা জমাতে চাইলেন। অথচ বেগ এড়িয়ে গেলেন।

শেষ বিকেলে বাবু আর মামুন লনে বসেছিলো। মেজর বেগও রয়েছেন ওদের সঙ্গে। মামুন বললো, বেগ চাচা কি আগে কখনো ঢাকা আসেননি?

না। মাথা নাড়লেন বেগ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপর মামুনকে বললেন, আচ্ছা, তুমি কি বলতে পারবে ঢাকায় ক্ষতির পরিমাণ কত হবে?

ওরা দুজনেই অবাক হলো।

মামুন বললো, চোখে না দেখলে বলে বোঝানো সম্ভব নয় বেগ চাচা।

কত লোক মারা গেছে বলে মনে হয় তোমার? খুব ধীরে ধীরে জানতে চাইলেন বেগ।

তারপরও মামুন স্বাভাবিক গলায় বললো, ঢাকাতে চোদ্দ পনেরো হাজার হতে পারে।

মাথা নেড়ে সায় জানালেন বেগ–আমি ভেবেছিলাম বেশি। কী যেন ভাবলেন। আবার বললেন, তোমরা কি কেউ কাল আমার সঙ্গে শহরে যাবে?

মামুন অবাক হলো–কেন বেগ চাচা? বেগ বললেন, আমি শহরে ঘুরে দেখতে চাই কোথায় কি ক্ষতি হয়েছে।

মামুন বললো, নিশ্চয়ই যাবো।

আকাশে সন্ধ্যার রঙটুকু মুছে গিয়ে ঘোলাটে অন্ধকার নেমে এলো। বাবুর মনে হলো পৃথিবীর সকল বিষণ্ণতা যেন সন্ধ্যার পৃথিবীতে জমাট বেঁধে পড়ে আছে।

মেজর বেগ-এর চেহারায় দুঃখ আর ক্লান্তির ছাপ, বিষণ্ণ সন্ধ্যার রঙে মিশে একাকার হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে বললেন, জানো, পরশু চট্টগ্রামের রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়ে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। একবার ভাবো, যে রাস্তায় কোনদিন ফার্স্ট গিয়ারের বেশি স্পীড দিতে পারিনি, সে রাস্তায় আমি থার্ড গিয়ারে গাড়ি চালিয়ে এসেছি। শহরে একটা মানুষ নেই। কয়েকটা পচা লাস দেখলাম এখানে সেখানে পড়ে আছে। আর সেই কুৎসিত পাখিগুলো শহরের সারা আকাশ জুড়ে উড়ছে। অসংখ্য শকুন। আশি মাইল স্পিডে আমি সেই ডেড সিটিতে গাড়ি চালিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। মনে হচ্ছিলো লাসগুলো যেন আমাকে তাড়া করছে।

মেজরের সারা মুখে অব্যক্ত যন্ত্রণার ঢেউ বয়ে গেলো–সেই থেকে ওরা আমার চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে। গলে যাওয়া, শকুন আর কুকুরে ছিঁড়ে খাওয়া সেই ডেড বডিগুলো তখন থেকে আমাকে হন্ট করছে।

কথা বলতে বলতে উদাস হয়ে গেলেন মেজর। বহুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। বাবু আর মামুনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। গভীর বিস্ময়ের সাথে ওরা দেখছিলো মেজর বেগকে। বিব্রত হয়ে মেজর ম্লান হাসলেন–এটা বাংলাদেশ হোক, কি ইণ্ডিয়াই নিয়ে যাক, আমি এখানে আর থাকছি না। বাড়ি গিয়ে লম্বা ছুটি চেয়ে বসে থাকব। চাকরির ওপর ঘেন্না ধরে গেছে।

মেজর মুস্তফা এলেন কিছুক্ষণ পর। বিকেলে তিনি বেরিয়েছিলেন। ওরা তখনও অন্ধকার লনে চুপচাপ বসেছিলো। ওদের দেখে হইচই করে উঠলেন মুস্তফা-তোমরা তিন-তিনজন মানুষ আমার কোয়ার্টারটাকে কবর বানিয়ে রেখেছো কেন? ঘরে আলো নেই। জলজ্যান্ত মানুষগুলো সব মুর্দা হয়ে বসে আছে। যাই বলো, তোমরা বাপু আদৌ সুবিধের লোক নও।

মামুন হেসে বললো, মসনবীর একটা গল্পে পড়েছিলাম, মরার আগে যে মরতে পারে সে পরমজ্ঞান লাভ করেছে।

চোখ দুটো গোল গোল করে মুস্তফা বললেন, কী বললে–মরার আগে মরা? এ আবার কেমন কথা হলো? থাকগে ওসব আধ্যাত্মিক ব্যাপার। একটা জাগতিক গল্প শোন। গল্প নয় ঘটনা। এই বিকেলেই ঘটলো। তোমাদের একজন নেতা আছেন না, মৌলভী কি যেন নাম?

ঘৃণায় বাবুর মুখটা বিকৃত হলো। অন্ধকারে কেউ লক্ষ্য করলো না। বললো, মৌলভী ফরিদ আহমেদের কথা বলছেন?

মাথা নাড়লেন মুস্তফা–ঠিক বলেছো। মৌলভীই বটে, তার কথা শোন। বিকেলে অফিসে বসে আছি। তিনি এলেন। খুব তেল টেল দিলেন। তারপর বললেন, প্লেনে ওয়েস্ট পাকিস্তান যাবার এগারোটা টিকিট চাই। শুনে চমকে উঠলাম। গত একমাসে এতো টিকিট কাউকে কোন দিন দেয়া হয়নি। দেয়াটা এ মুহূর্তে সম্ভবও নয়। বললাম, এতগুলো টিকিট দিয়ে কি হবে? বিনয়ে গলে গিয়ে তিনি বললেন, গরমের শুরুতে সপরিবারে মারী যাবার অভ্যেস তার বহু বছরের। তাই আর কি। আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। লোকটা বলে কি! পাগল নাকি? বললাম, মৌলভী সাহেব, এদেশের একজন বিখ্যাত নেতা আপনি। দেশের এই দুর্দিনে আপনি মারী যাচ্ছেন হওয়া খেতে! লোকটা জবাব দিলো, আমি এক্ষুণি যাচ্ছি না। আপাতত ফ্যামেলী পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওর মুখের ওপর আমি সোজা বলে দিলাম, দুঃখিত, কোন অবস্থাতেই দুটোর বেশি টিকিট দেয়া সম্ভব নয়। আর গরমে মারী গিয়ে সময় কাটানোর জন্যে আমি একটা টিকিটও খরচ করতে রাজী নই। কিছুতেই ছাড়বে না সে লোক। বললো, টিকিট না দিলে আমি এখান থেকে আর নড়ছি না। বললাম, আমার এয়ার কণ্ডিশণ্ড দফতর যদি আপনার পছন্দ হয় কিছুক্ষণ বসতে পারেন। তবে টিকিট পাচ্ছেন না।

মেজর বেগ বললেন, এদের ঘাটাতে যাও কেন? আমি তো চিটাগাং ছিলাম। চার বছর ধরে ওকে দেখছি। সাপের চেয়েও ভয়ানক লোক এরা। নিজেদের জাতের সঙ্গে যারা বেইমানি করতে পারে, তাদের কখনো বিশ্বাস

করবে না।

মুস্তফা বললেন, তা না হয় মানলাম। এও জানি ফরমান আলী নয়তো টিক্কা খানকে ধরে সে টিকিট-এর ব্যবস্থা ঠিকই করে নেবে। তবু ভাবো, দেশের এমন দুর্দিনে তিনি হাওয়া খাবার লোভটুকু সামলাতে পারছেন না। কেমন নেতা তিনি!

বেগ হাসলেন–নেতা যে তিনি নন, তাঁর আচরণ থেকেই আশা করি সেটা বুঝে নিয়েছে। দেশের দুর্দিন বলতে তুমি যা বোঝাতে চাইছো, ওদের কাছে তা পরম সুদিন। এই সুদিনের অপেক্ষায় ছিলো তারা বহুদিন ধরে। এখন সে সময়। এসেছে।

বিস্মিত মেজর একটা শব্দই উচ্চারণ করলেন–স্ট্রেঞ্জ!

ঠিক সেই সময় বাবুর মনে হলো বাঙালিদের ভেতর যেমন ফরিদ আহমেদ আছে, তেমনি অবাঙালিদের ভেতরও মেজর বেগ আর মেজর মুস্তফারা রয়েছে। এ ধরনের ব্যতিক্রম সব সময়ই থাকে।