৯. দারাশুকোর পাণ্ডিত্য ও তত্ত্বজ্ঞান

নবম অধ্যায় – দারাশুকোর পাণ্ডিত্য ও তত্ত্বজ্ঞান

শাহজাহান স্বয়ং বিদ্যোৎসাহী ও পাকা মুসলমান ছিলেন; পুত্র-চতুষ্টয়ের সুশিক্ষা ও শরিয়ত-অনুযায়ী নৈতিক ও ধর্মজীবন গঠনের জন্য তিনি শাস্ত্রজ্ঞ ও নিষ্ঠাবান মোল্লাদিগকে তাঁহাদের শিক্ষক নিযুক্ত করিয়াছিলেন। মোল্লা আবদুল লতিফ সুলতানপুরীর নিকট শাহজাদা দারার বিদ্যাশিক্ষা আরম্ভ এবং সম্ভবত তাঁহার কাছেই সমাপ্ত হইয়াছিল––অন্তত তাঁহার অন্য কোন শিক্ষকের নামোল্লেখ দরবারী ইতিহাসে নাই। দারা অসাধারণ মেধাবী ও মনীষাসম্পন্ন ছিলেন এবং জ্ঞানচর্চায় তাঁহার ঐকান্তিক আগ্রহ ও অসীম উৎসাহ ছিল। খেলাধূলা, কবুতরবাজী, শিকার কিংবা বয়ঃপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে আয়েস ও শরাব তাঁহার মনের উপর স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করিতে পারে নাই; লেখাপড়ার নেশা ও তত্ত্বজ্ঞানের তৃষ্ণা বরং বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বাড়িয়া চলিয়াছিল। তিনি মুসলমানের অবশ্য পঠিতব্য বিষয়গুলি, যথা—কোরান হদিস তফসীর বিশেষভাবে আয়ত্ত করিয়াছিলেন। ব্যাকরণ ও মুসলমানী আইন (ফেকা) অধ্যয়নে তাঁহার বিশেষ অনুরাগ ছিল বলিয়া মনে হয় না, গণিত অপেক্ষা ফলিত জ্যোতিষে তাঁহারা আগ্রহ ছিল অধিক। তর্কশাস্ত্র হয়তো তিনি পড়িয়াছিলেন; আরিস্ত (অ্যারিস্টটল) ও আফলাতুনের (প্লেটোর) সহিত তাঁহার মোটামুটি পরিচয় ছিল। বিধিনির্দিষ্ট সুনিশ্চিত উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, পিতার অপার স্নেহ, মোগল দরবারে তৎকালীন বিবিধ বিদ্যাপারগ হিন্দু ও মুসলমান পণ্ডিতমণ্ডলীর অপূর্ব সমাবেশ ও তাঁহাদের সাহচর্য এবং নিজের সুদীর্ঘ অখণ্ড অবসর দারার জ্ঞানচর্চার পক্ষে বিশেষ অনুকূল ছিল। মুসলমান রাজাদের মধ্যে বিদ্বান ও বিদ্যোৎসাহী বহু ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করিয়াছেন; কিন্তু আব্বাসী খলিফা মামুন ও তৈমুর বংশে শাহজাদা দারা ব্যতীত অন্য কেহ প্রকৃত পণ্ডিত ও দার্শনিক বলিয়া প্রসিদ্ধিলাভ করিতে পারেন নাই।

জগতের জ্ঞানভাণ্ডারে মামুনের সর্বশ্রেষ্ঠ দান—আরিস্ত-প্রমুখ যবন-মনীষীগণের লুপ্তপ্রায় দর্শন ও তর্ক-শাস্ত্রসমূহের সংগ্রহ ও আরবী ভাষায় অনুবাদ। কিন্তু শাহজাদা দারাই সর্বপ্রথমে উপনিষদের অনুবাদ করাইয়া সভ্য জগৎকে হিন্দুর ব্রহ্মবিদ্যার সন্ধান দিয়াছিলেন। খলিফা মনসুর, হারুন ও মামুনের সময় ভারতীয় আয়ুর্বেদ, পাটীগণিত, বীজগণিত, জ্যোতিষ, পশুচিকিৎসা ও রসায়ন গ্রন্থের অনুবাদ ও আলোচনা আরম্ভ হইয়াছিল। ইহার পর খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে অলবেরুনী তাঁহার তহকিক-ই-হিন্দ গ্রন্থে ভারতীয় সংস্কৃতি ও চিন্তাধারার সহিত মুসলমান সমাজকে পরিচিত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীর পূর্বে দিল্লি সম্রাটগণ হিন্দুর জ্ঞানভাণ্ডার ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবান ছিলেন না; বরং উহা নিশ্চিহ্ন করিয়া হিন্দুজাতির মেরুদণ্ড ভঙ্গ করিবার জন্য অশেষ চেষ্টা করিয়াছেন। সম্রাট আকবরের সময় হইতে এক নূতন যুগের সূচনা হইয়াছিল। তাঁহার রাজত্ব ভারতীয় সংস্কৃতির পুনরভ্যুদয়ের যুগ। হিন্দুর ধর্মসাহিত্য ও গণিতসম্বন্ধীয় পুস্তকসমূহ সংস্কৃত হইতে পারস্য ভাষায় অনুবাদ কিংবা ওইগুলির সারসঙ্কলন করিয়া মুসলমানের জ্ঞানভাণ্ডার স্থায়ীভাবে সুসমৃদ্ধ করিবার আয়োজন তিনিই করিয়াছিলেন।

আকবরের রাজত্বে মহাভারত, রামায়ণ, অথর্ববেদ, লীলাবতী (বীজগণিত), দ্বাত্রিংশৎ পুত্তলিকা (বত্রিশ সিংহাসন) ইত্যাদির ভাবমূলক অনুবাদ হইয়াছিল। হিন্দুর ষড়দর্শন, জ্যোতিষ, পুরাণ ইত্যাদির অনুবাদ কিংবা সংক্ষিপ্তসারের সহায়তা ব্যতীত আবুল ফজলের পক্ষে ‘আইন-ই-আকবরী’ পুস্তকে উক্ত বিষয়সমূহের আলোচনা নিশ্চয়ই সম্ভবপর হয় নাই। কিন্তু শেষোক্ত পুস্তকগুলির ফার্সি অনুবাদের অস্তিত্ব এখন অনুমানের বিষয় হইয়াছে। পুণ্যশ্লোক সম্রাট আকবরের রাজনীতি, ধর্মমীমাংসা, শিক্ষানীতি, সমাজ-সংস্কার এবং জ্ঞানচর্চায় উৎসাহ প্রভৃতি সমস্ত ব্যাপারের একটি প্রশংসনীয় মূলনীতি ছিল—হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণের পরস্পরের ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি সুলতানী আমলের ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যভাব দূর করিয়া অভিনব সশ্রদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টির প্রয়াস। জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের রাজত্বে রাজনীতিক্ষেত্রে আকবরের নীতি কথঞ্চিৎ বাধাপ্রাপ্ত হইলেও ইসলাম ও আর্য সংস্কৃতির ভাবধারাপুষ্ট যথার্থ ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতার নবরোপিত অক্ষয়বট তাঁহাদের সযত্ন-সিঞ্চিত দাক্ষিণ্য-বারি দ্বারা পরিবর্ধিত হইতেছিল। শাহজাহানের পুত্র-চতুষ্টয়ের মধ্যে দারাশুকো প্রপিতামহ আকবরের স্বপ্ন সফল করিবার মহান উদ্দেশ্যে আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন। দারার পারিবারিক জীবনের সহিত তাঁহার শাস্ত্রালোচনা, ধর্মজীবন ও জ্ঞানচর্চার এবং ধর্মমতের সহিত তাঁহার রাজনীতির ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ রহিয়াছে। এইজন্য প্রথমে উহার কিঞ্চিৎ আলোচনা আবশ্যক।

১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দের ১লা ফেব্রুয়ারি শুক্রবার শাহজাদা দারার সহিত তাঁহার জ্যেষ্ঠতাতপুত্রী নাদিরা বেগমের বিবাহ হইয়াছিল। ইহার এক বৎসর পরে তাঁহার একটি কন্যা জন্মিয়াছিল (১৯ জানুয়ারি, ১৬৩৪ খ্রিঃ); কিন্তু মাত্র তিন মাস পরে ওই বৎসর দিল্লি হইতে লাহোরে যাইবার সময় রমজানের ঈদের (ঈদ-উল-ফিতর) দিন মহাকাল নাদিরার ক্রোড় শূন্য করিয়া দারার প্রথম সন্তানকে হরণ করিল। উনিশ বৎসর বয়সে এই নিদারুণ শোকে শাহজাদার দেহ ও মন ভাঙিয়া পড়িয়াছিল। তিনি প্রবল জ্বর ও হৃৎকম্পে আক্রান্ত হইলেন। এই সময়ে শাহজাদা পিতার সহিত লাহোরে যাইতেছিলেন। সম্রাট অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইয়া লাহোর হইতে হেকিম উজীর খাঁকে আনাইলেন এবং শাহজাদার শুশ্রূষার সুবিধার জন্য জাহানারা বেগমের তাঁবু দারার তাঁবুর কাছে খাটাইবার হুকুম দিলেন।

জননীর প্রতিনিধি ভগ্নী জাহানারার স্নেহে তাঁহার ছোট ভাই-বোনেরা মায়ের শোক ভুলিয়াছিল। সকলের প্রতি সমান স্নেহশীলা হইলেও দারার প্রতি তাঁহার টান একটু বেশি ছিল। যৌবনে পদার্পণ করিলেও ভাই-বোন যাহাতে নিঃসঙ্কোচে মিলামিশা করিতে পারে, সেজন্য সম্রাট শাহজাহান দারাকে জাহানারার স্তন ধোয়া জল (স্তন্যের অভাবে) পান করাইয়া উভয়ের মধ্যে সে-যুগের প্রথানুযায়ী ধর্মের মাতা-পুত্র সম্বন্ধ স্থাপন করিয়াছিলেন। জাহানারার সান্ত্বনা-বাক্যে দারা শোকে শান্তি ও স্নেহস্পর্শে রোগমুক্ত হইলেন। মৃত্যু ও শোকের মহাশিক্ষায় উভয়ের জীবনের গতি পরিবর্তিত হইল; চিত্ত ভোগবিমুখ হইয়া বৈরাগ্যকে আশ্রয় করিল। সম্রাট শাহজাহান লাহোরে পৌঁছিয়া ৭ই এপ্রিল ও ৯ই এপ্রিল (১৬৩৪ খ্রিঃ) প্রসিদ্ধ সুফী-সাধক মিয়াঁ মীরের আস্তানায় পদার্পণ করিয়াছিলেন। এই সময় হইত মিয়াঁ মীরের প্রতি শাহজাদা ও জাহানারা অত্যন্ত আকৃষ্ট হইয়া পড়িলেন; তাঁহাদের শ্মশান বৈরাগ্য মোহমুক্ত সন্ন্যাসে পরিণত হইল। অসামান্যা রূপবতী বিদুষী জাহানারা যৌবনে যোগিনী সাজিয়া সেবাধর্ম অবলম্বন করিলেন; দারার চক্ষে বাদশাহী অপেক্ষা ফকিরিই স্থায়ী সম্পদ বলিয়া প্রতিভাত হইল। কাশ্মীর হইতে ফিরিয়া আসিয়া শাহজাহান ১৮ই ডিসেম্বর তৃতীয় বার মিয়াঁ মীরের সাক্ষাৎকার লাভ করিয়াছেন। পর বৎসর শীতকালে দারা সম্রাটের সঙ্গে লাহোরে ছিলেন; এই সময়ে (১৬৩৫ খ্রিঃ) মিয়াঁ মীর ও তাঁহার শিষ্য সম্প্রদায়ের সহিত দারার ঘনিষ্ঠতা আরও বৃদ্ধি পায়। মিয়াঁ মীরের নিকট হইতে দারা ও জাহানারার দীক্ষালাভ করিবার সৌভাগ্য ঘটে নাই। দারার পত্নী নাদিরা বেগমও মিয়াঁ মীরের প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন। এবং বোধ হয় মনে মনে তাঁহাকেই গুরুরূপে বরণ করিয়াছিলেন; স্বামীর কাছে তাঁহার শেষ প্রার্থনা ছিল, যেন মিয়াঁ মীরের কবরের পার্শ্বে তাঁহার মৃতদেহ সমাহিত করা হয়। ১৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে মিয়াঁ মীর দেহরক্ষা করেন। শাহজাদা দারার আধ্যাত্মিক জীবনের বিভিন্ন স্তরে তিনি অনেকগুলি পুস্তক ও পুস্তিকা লিখিয়াছিলেন। তাঁহার ধর্মমত ও সাধন পদ্ধতি তাঁহার রচনাবলী হইতেই সঠিক জানা যায়। অতঃপর আমরা এগুলির আলোচনা করিব।

সফিনাৎ-উল-আউলিয়া। ——ইহা দারাশুকোর প্রথম পুস্তক। ইহার পাণ্ডুলিপি ইংলন্ড ও ভারতবর্ষের অনেক প্রসিদ্ধ পুস্তাকাগারে রক্ষিত আছে এবং নওলকিশোর প্রেস হইতে এই পুস্তকের একটি লিথো-সংস্করণ বহু বৎসর পূর্বে ছাপা হইয়াছিল। Ethe-সঙ্কলিত তালিকায় ( Catalogue of Persian Manuscripts, Vol 1, p. 274; No 647 ) উল্লিখিত পাণ্ডুলিপি অনুসারে শাহজাদার ২৫ বৎসর বয়সে ১০৪৯ হিজরীর ২৭শে রমজান তারিখে (২১ জানুয়ারি ১৬৪০ খ্রিঃ) এই পুস্তক রচনা সমাপ্ত হইয়াছিল।* হজরত মহম্মদ, চারি খলিফা এবং দ্বাদশ ইমাম হইতে আরম্ভ করিয়া শাহজাদার সমকালীন মিয়া মীর পর্যন্ত ৪১১ জন প্রসিদ্ধ ধর্মগুরু ও সুফী সাধক-সাধিকার অতি সংক্ষিপ্ত পরিচয়––অধিকাংশ স্থলে কেবল জন্ম-মৃত্যুর তারিখ—এই পুস্তকে নিবদ্ধ হইয়াছে। ফরিদউদ্দীন আক্তর রচিত তজকিরাৎ- উল-আউলিয়া এবং অন্যান্য আউলিয়া জীবনী সংগ্রহ এবং হজরত ও খলিফাগণের সমকালীন ইতিহাস হইতে শাহজাদা তাঁহার পুস্তকের উপাদান সংগ্রহ করিয়াছেন। ইহা একাধারে দারাশুকোর ঐতিহাসিক গবেষণা এবং নিজের অধ্যাত্মজীবনের প্রাথমিক ইতিবৃত্ত। তারিখ অনুসারে জীবনীসমূহ পর পর সাজানো হইয়াছে। এই পুস্তকের বিশেষ সার্থকতা ও বৈশিষ্ট্য—যেখানে তারিখ সম্বন্ধে মতভেদ আছে, সেখানে মতান্তরে অমুক তারিখ যথারীতি সন্নিবিষ্ট করা হইয়াছে। হজরতের জন্ম তারিখ সম্বন্ধে মতভেদ উল্লেখ করিয়া তিনি সাহস ও ঐতিহাসিক সত্যনিষ্ঠার পরিচয় দিয়াছেন। সুফী সাধিকাগণের জীবনী আলোচনায় তাঁহাদের কৃচ্ছ্রসাধনার উল্লেখ পাওয়া যায়। মিশরের একজন নারী-উপাসিকা নাকি এক জায়গায় শীতগ্রীষ্মে অবিচলিত ভাবে এক স্থানে ত্রিশ বৎসর দাঁড়াইয়া ছিলেন এবং পঁচিশ বৎসর পর্যন্ত আহার-নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া ছিলেন। এই গ্রন্থ রচনার সময় মিয়া মীরের ভগ্নী বিবি জামাল খাতুন সিবিস্তানে (সিন্ধুনদের পশ্চিমে) একজন পুণ্যশীলা সাধিকা হিসাবে প্রসিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন; তখন তাঁহার বয়স ৬০ বৎসর। ‘সফিনাৎ-উল-আউলিয়া’র ভূমিকাই** ইহার সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় ও মনোরম অংশ। শাহজাদা লিখিয়া গিয়াছেন, এই গ্রন্থ আরম্ভ করিবার পূর্বে যখন তিনি সুফী মহাপুরুষগণের জীবনীধ্যানে তন্ময় ছিলেন, তখন একদিন তাঁহার স্বপ্নপ্রয়াণ হইয়াছিল। তিনি দেখিলেন, এক উচ্চ স্থানে হজরত রসুলাল্লা দাঁড়াইয়া আছেন; ঠিক তাঁহার নীচে প্রথম চারি খলিফা––আবু বকর, ওমর, ওসমান ও আলী সমব্যবধানে দণ্ডায়মান। ‘সফিনাৎ-উল-আউলিয়া’ রচনার সময় পর্যন্ত তিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে সুফী সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রবেশ করেন নাই; সত্যানুসন্ধানের পরিশ্রম ও কষ্টের মধ্যে এ গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল; তখনও তাঁহার তত্ত্বজ্ঞান লাভ হয় নাই। সৎসঙ্গের মাহাত্ম্য, ফকিরদের বিভিন্ন সাধনার ধারা, আদর্শ ও উপদেশ, কোন্ অবস্থায় এবং কি ভাবে মহাপুরুষগণকে চেনা যায় এবং তাঁহাদের সাক্ষাৎকার লাভ হইলে কথোপকথনের সময় কোন্ কোন্ বিষয়ে সাবধান হওয়া উচিত—এ সমস্ত বিষয়ের চমৎকার আলোচনা এই পুস্তকের ভূমিকায় আমরা দেখিতে পাই। এই ভূমিকায় মুসলমান সাধকগণের যে সমস্ত উপদেশ শাহজাদা সংগ্রহ করিয়াছেন উহার প্রভাব তাঁহার দৈনন্দিন জীবনে বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। দারা পাগল খুঁজিয়া বেড়াইতেন এবং তাঁহাদের সাহচর্য ভালোবাসিতেন— এইগুলি অবশ্য ভাবের পাগল; কেননা মহাপুরুষেরা অনেক সময় স্বেচ্ছায় পাগল সাজিয়া জনসমাজে আত্মগোপন করিয়া থাকেন। তিনি প্রার্থী ও ভিক্ষুককে কোনোদিন বিমুখ করে নাই; কারণ কৃপণ কোনোদিন নির্মল ভগবৎপ্রেম কিংবা তত্ত্বজ্ঞানের অধিকারী হইতে পারে না। প্রাণদণ্ডের পূর্বে অত্যন্ত দীনবেশে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় যখন শোভাযাত্রা সহকারে দিল্লির রাজপথ দিয়া তাঁহাকে লইয়া যাওয়া হইতেছিল, ফকিরদের চিৎকারে স্থির থাকিতে না পারিয়া শাহজাদা নিজের ছোঁড়া ময়লা শালখানা তাহাদিগকে দান করিয়াছিলেন। দুনিয়াদারি কাহাকে বলে এ সম্বন্ধে তিনি একটি চমৎকার কথা এই পুস্তকের ভূমিকায় উদ্ধৃত করিয়াছেন—

Chist duniya az Khuda ghafil shudan;
Ne lebas wa naqra wa farzand wa zan.

—সংসারাসক্তি কি? পোশাক, ধনদৌলত কিংবা স্ত্রীপুত্র নয়; খোদার এবাদতে গাফেলী করাই দুনিয়াদারি।

এখানে ফকিরি ও আমিরির সামঞ্জস্য-সমস্যার সমাধান করা হইয়াছে। অবশিষ্ট জীবনে শাহজাদা এই পন্থাই অনুসরণ করিয়াছিলেন।

[* আমার ইংরেজি Dara Shukoh পুস্তকে (পৃ. ১৪০ ) সফিনাৎ-উল-আউলিয়া’র সমাপ্তিকাল ১৬৩৯ খ্রিঃ বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। আমার পুস্তকের অন্যত্র (পৃ. ১০৩) ‘সফিনাৎ ‘ রচনার তারিখ ১১ই জানুয়ারি ১৬৪০ খ্রিঃ দেওয়া হইয়াছে। মুসলমানী তারিখ ২৭শে রমজান ১০৬৯ হিজরী। নিউ স্টাইল এবং ওল্ড স্টাইলে ইংরেজি তারিখ গণনা করিলে কিছু তফাত হয়। সার যদুনাথের History of Aurangzib (i. 271, 2nd ed.) পুস্তকে ২১ স্থলে ১১ই জানুয়ারি লিখিত হইয়াছে।

** ইহার কিয়দংশ রায় বাহাদুর শ্রীশচন্দ্র বসু কর্তৃক অনূদিত (পাণিনি আপিস হইতে প্রকাশিত) দারাশুকোর ‘রিসালা-ই-হকমা’র পরিশিষ্ট হিসাবে ইংরেজিতে মোটামুটি অনুবাদ করা হইয়াছে।]

সকিনাৎ-উল-আউলিয়া। -এই পুস্তকের ভূমিকায় প্রকাশ, শাহজাদা দারাশুকো পঁচিশ বৎসর বয়সে (অর্থাৎ যে বৎসর তিনি প্রথমোক্ত গ্রন্থ রচনা সমাপ্ত করেন) পরলোকগত পীর মিয়াঁ মীরের অন্যতম শিষ্য মহম্মদ শাহ লিসান্-উল্লার কাছে দীক্ষাগ্রহণ করিয়া কাদেরিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত হইয়াছিলেন। দারার গুরু সাধারণত মৌলানা বদর্শী (বদশান নিবাসী) নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁহার উপাধি ছিল ‘লিসান্ উল্লা’ অর্থাৎ খোদাতালার জিহ্বা—পণ্ডিতদের ‘সরস্বতী’ উপাধির তুল্য। মৌলানা শাহ কাশ্মীরেই তাঁহার খাকা বা মঠ স্থাপন করিয়াছিলেন। দরবারী ইতিহাস ‘বাদশা-নামা’ হইতে আমরা জানিতে পারি, সম্রাটের সঙ্গে শাহজাদা ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাস হইতে ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত লাহোরে এবং ২২শে মার্চ হইতে ১৪ই সেপ্টেম্বর (১৬৪০ খ্রিঃ) পর্যন্ত কাশ্মীরে ছিলেন। সুতরাং লাহোরেই তাঁহার প্রথম পুস্তক সমাপ্ত হয় এবং কাশ্মীরে অবস্থানকালে তিনি দীক্ষাগ্রহণ করেন। ভূমিকায় শাহজাদা লিখিয়াছেন, ক্ষমতা ও অতুল পার্থিব ঐশ্বর্যের অধিকারী হইয়াও গুরুর কৃপায় তাঁহার মন ও মেজাজ খাঁটি দরবেশের মতো হইয়াছে। ১০৫২ হিজরী, অর্থাৎ ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই গ্রন্থ রচনা সমাপ্ত করেন।

‘সকিনাৎ-উল-আউলিয়া’র হস্তলিখিত পুথি ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি (Ethe, Vol I, No. Or, 223 ) এবং খুদা বখ্শ ওরিয়েন্টাল পাবলিক লাইব্রেরিতে রক্ষিত আছে। এই পুস্তকের এ-যাবৎ কোনও ইংরেজি বা বাংলা অনুবাদ হয় নাই। শাহজাদা দারাশুকোর দাদা-পীর (গুরুর গুরু) মিয়াঁ মীরের জীবন বৃত্তান্ত এবং তাঁহার মুরীদ (শিষ্য)-গণের সংক্ষিপ্ত পরিচয় এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। গ্রন্থকার প্রথমে তাঁহার স্ব সম্প্রদায় কাদেরিয়া পন্থীদের “সিলসিলা” (গুরুপরম্পরা কুলজী), চিন্তিয়া নকশবন্দীয়া ইত্যাদি সম্প্রদায়ের সিলসিলা হইতে যে শ্রেষ্ঠতর, ইহাই প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। মিয়াঁ মীরের আসল নাম মীর মহম্মদ; তিনি ৯৩৮ হিজরীতে সিন্ধু দেশের অন্তর্গত সিবিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতার নাম কাজী সৈন্দতা (স্বামীদত্ত?), প্রপিতামহ কাজী কালন্দর। শাহজাদা ইতিহাসকে জবাই করিয়া স্বামীদত্তের পুত্র মিয়া মীরের কুলজী একেবারে খলিফা ওমর পর্যন্ত টানিয়া তুলিয়াছেন। আমাদের মনে হয়, তিনি মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত কোনও হিন্দু পরিবারের সন্তান; নামের শেষে “ফরুকী” থাকিলেই ওমরের অওলাদ হয় না। বেচারাম কিংবা ছেদিলালের বংশধরেরাও উদার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিয়া সিদ্দিকী (প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক) কিংবা ফরুকী হইতে পারে; শেখ সৈয়দের তো কথাই উঠে না। মিয়াঁ মীরের শিষ্যদিগকে গ্রন্থকার দুই ভাগে (ফিরকা) বিভক্ত করিয়াছেন, যাঁহারা ‘সকিনাৎ- উল-আউলিয়া’ রচনার পূর্বে মারা গিয়াছেন এবং যাঁহারা সমাপ্তির তারিখ পর্যন্ত বাঁচিয়া ছিলেন। প্রথম ফিরকার সর্বপ্রথম স্থান সুফী নিয়ামৎ-উল্লা সরহিন্দিকে (সরহিন্দ শহরবাসী) দেওয়া হইয়াছে; দ্বিতীয় ফিরকার প্রথম স্থানে আছেন মৌলানা শাহ লিসান্-উল্লা।

‘সকিনাৎ-উল-আউলিয়া’ পুস্তকে তাঁহার নিজ গুরু-সম্প্রদায় অর্থাৎ কাদেরিয়া শেখদের অলৌকিক কার্যাবলী, তাঁহাদের ধ্যানধারণা, সাধনার বিভিন্ন স্তর বা মোকামের বিষয় আলোচনা করিয়াছেন। পুস্তকখানির কোনও ইংরেজি, উর্দু কিংবা বাংলা অনুবাদ হয় নাই। বাংলাদেশে কাদেরিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত মুসলমান সংখ্যায় সর্বাপেক্ষা বেশি। দারার এই পুস্তকখানির বঙ্গানুবাদ হইলে ‘খোদা-প্রাপ্তিতত্ত্ব’ ইত্যাদি পুস্তকের ন্যায় মুসলমান সমাজে বিশেষ সমাদৃত হইবে।

রিসালা-ই-হমা (The Compass of Truth) শাহজাদা দারা ধর্মজীবনের সোপান অতিক্রম করিবার পর এই পুস্তিকা রচনা করিয়াছিলেন। ইহার ভূমিকায় তিনি লিখিয়াছেন—১০৫৫ হিজরীর ১৭ই* রজব শুক্রবার রাত্রিকালে তিনি এই পুস্তক লিখিবার জন্য খোদার হুকুম পাইয়াছিলেন। নিম্নলিখিত কবিতা দ্বারা তিনি পুস্তকের সমাপ্তি এবং পুস্তক রচনায় তাঁহার নিজ অভিপ্রায় নিবেদন করিয়াছেন–

ঈ / রিসালা-ই-হকমা / বাশদ্ / তামাম্;
দর্ / হাজার ওয়া পঞ্জা ওয়া যশ্ / শুদ্ / তামাম।
হস্ত / আজ / কাদের। মদাঁ / আজ / কাদেরী;
আঁচে / মা / গোপ্তেম্ / ফাফেহেম্ / ওয়া / আস্ সালাম্।

—১০৫৬ হিজরীতে সত্য-স্বরূপ খোদাতালার পথে দিকনির্ণয় যন্ত্রস্বরূপ এই পুস্তিকা- রিসালা-ই-হনুমা রচনা সমাপ্ত হইল। ইহার রচয়িতা একজন সামান্য কাদেরী বলিয়া মনে করিও না; বস্তুতপক্ষে স্বয়ং যিনি কাদের, সর্বশক্তিমান আল্লা, এই পুস্তকে তাঁহারই অনুপ্রেরিত বাণী (এল্হাম) বলিয়া জানিবে।

[* নওলকিশোর প্রেস হইতে প্রকাশিত সংস্করণে ৮ই রজব লেখা আছে। কিন্তু ওই তারিখ বুধবার ছিল; সুতরাং সম্ভবত ১৭ই রজব হইবে।]

কাদেরিয়া তরিকা বা সাধনা পদ্ধতিকে শাহজাদা কেন সর্বাপেক্ষা সুগম ও শ্রেষ্ঠ মনে করেন, তাহা তিনি বিশদভাবে বুঝাইয়া দিয়াছেন। কাদেরিয়ার রাস্তা “বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি”র পথ নয়; এই পথে কঠোর সন্ন্যাসের অগ্নিপরীক্ষা নাই; প্রেম-প্রীতি, দিলদারি ও আয়েস, অনাবিল ও অখণ্ড আনন্দ এই মার্গাবলম্বীর নিত্যসম্পদ। মৌলানা জালালউদ্দিন রুমী বলিয়াছেন-খোদাতালা তোমাকে এই পথ দিয়া আনিয়াছেন, অপরাধীর মতো তোমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য নয়; পরন্তু অতিথির মতো তোমার উপর মেহেমানির মেহেরবানি বর্ষণ করাই তাঁহার অভিপ্রায়। এই পুস্তকের চারি অধ্যায়ে সুফীদিগের কল্পিত নাসুৎ (স্থূল), মালাকুত্ (স্বপ্নময়), জাবরুৎ বা স্থির নির্বিকল্প, এই তিন আলম বা জগৎ এবং সাধকের অবস্থাত্রয়, মুসলমানী প্রাণায়াম (রেচন-পূরক), শরীরস্থ ত্রিচক্র (ষট্‌চক্র নয়) ইত্যাদি আলোচনা করিয়াছেন।

বস্তুতপক্ষে শাহজাদা দারার জীবনাদর্শ, মন ও চিন্তাধারা, সংস্কার ও বিশ্বাসপ্রবণতা, অসংযত উৎসাহ ও আশাবাদিতা (optimism), সদ্য যোগরহস্য -প্রাপ্তিতে বালকের নূতন জামা কিংবা সুন্দর খেলনা প্রাপ্তির মতো অধীরতা ও আনন্দের আতিশয্য ইত্যাদি দোষগুণ এই ক্ষুদ্র পুস্তিকায় সঠিক প্রতিবিম্বিত হইয়াছে। তিনি মহম্মদের সশরীরে নিমেষের মধ্যে সপ্তম স্বর্গে আরোহণ, খোদাতালার সহিত সাক্ষাৎ এবং পুনরায় নিজের গরম লেপের ভিতর প্রবেশ — যাহাকে মুসলমানেরা “মিরাজ-ই-জিমানী” বলে, উহার এক অভিনব ব্যাখ্যা ‘রিসালা-ই-হনুমা’ পুস্তকে দিয়াছেন। হজরত স্থূল শরীরে, কি সূক্ষ্ম শরীরে এই কার্য করিয়াছিলেন, ইহা লইয়া মুসলমান শাস্ত্রে বিস্তর তর্কবিতর্ক আছে। মোল্লাদের মতে “মিহরাজ্-ই-জিস্‌মানী” অক্ষরে অক্ষরে সত্য; ইহা মানিয়া চলা ইমানের অঙ্গস্বরূপ; যাহারা অন্যরূপ বিশ্বাস করে, তাহার নাস্তিক তার্কিক (জিন্দিক) কিংবা ধর্মদ্রোহী স্বাধীনচিন্তাপন্থী মোতাজেলা। একদিন আকবরের দরবারে এই লইয়া পণ্ডিতগণের মধ্যে মহাতর্ক চলিতেছিল; এমন সময় বাদশা এক পায়ের উপর খাড়া হইয়া বলিলেন, এ অবস্থায় আমি আমার অন্য পা-খানি মাটি হইতে উঠাইতে পারি না; তবে কেমন করিয়া হজরত বেমালুম নিজের দেহখানি হাওয়ায় উড়াইয়া মিরাজ করিলেন। বাদশা ভুলিয়া গিয়াছিলেন, তিনি হিন্দুস্থানের মালিক হইলেও হজরত রসুলাল্লার সমপর্যায়ে উঠিতে পারেন নাই। সেইজন্য তাঁহারই প্রপৌত্র হজরতের পক্ষে এ কাজ করা যে সম্ভব ছিল, সে কথা প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। দারা লিখিয়াছেন, হজরত হারার গুহায় বসিয়া যোগাভ্যাস ও প্রাণায়াম করার দরুন তাঁহার শরীরের ধর্মই অন্য রকম হইয়াছিল; প্রমাণ––হজরত রসুলাল্লার দেহের উপর কখনও মাছি বসে নাই কিংবা মাটিতে তাঁহার ছায়া পড়ে নাই। ইহার কারণ––মাটি, জল, আগুন ও হাওয়া (মুসলমানেরা আকাশকে স্বীকার করে না), এই চারি উপাদানে প্রত্যেক জীবের দেহ গঠিত হইলেও যোগাভ্যাসের দ্বারা মহাপুরুষগণ স্থূল দেহকে পরিবর্তিত করিয়া বায়ুধর্মী অথচ পরিদৃশ্যমান শরীর লাভ করিতে পারেন। দারাকে অনেকে পাগল মনে করিবেন, কিন্তু সেকালের পক্ষে দারার যুক্তি আজকালকার একাদশী কিংবা টিকির বৈজ্ঞানিক ভাষ্যকারগণের যুক্তি অপেক্ষা দৃঢ়তর বলিয়া গৃহীত হইবার যোগ্য।

এই পুস্তিকায় দারা একরকম ধ্যানযোগের উল্লেখ করিয়াছেন; ইহাকে সুলতান- উল্-আজাকের অর্থাৎ “জেকেরের সুলতান” বা শ্রেষ্ঠ বলা হইয়াছে। এই যোগের দ্বারা মানুষ অলৌকিক শক্তি লাভ করে; সে অনাহত ধ্বনি শুনিতে পায়; বাজারের গোলমালের মধ্যেও সাধকের কানে ইহা ভ্রমরগুঞ্জন কিংবা পিপীলিকাশ্রেণীর চলাচলের শব্দের ন্যায় ধ্বনিত হয়। শাহজাদা লিখিয়াছেন, মিয়াজী (মিয়া মীর) খোলাখুলি ভাবে এই যোগের রহস্য তাঁহার অতি অন্তরঙ্গ মুরীদ (শিষ্য)-গণের কাছেও ব্যক্ত করেন নাই। হজরত আখুন্দ (দারার গুরু মৌলানা শাহ লিসানুল্লা) মিয়াঁ মীরের নিকট হইতে ইহার ইশারা পাইয়া এক বৎসর অভ্যাসের পর সফলতা লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহার গুরুও দারাকে উপদেশ মূলক গল্পচ্ছলে এই যোগের রহস্য ব্যক্ত করিয়াছিলেন। কিন্তু শাহজাদা ছয় মাসের মধ্যেই ইহার গুপ্ত তত্ত্ব আয়ত্ত করিয়াছিলেন। তিনি লিখিয়াছেন, “আমি (আমার গুরু অপেক্ষা) ইহা অধিকতর সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করিয়াছি; এমন কি যাহাদের কাছে আমি ইহার কথা বলিয়াছি, তাহারা তিন-চারি দিনের মধ্যেই ফল পাইয়াছে। ইহার কারণ, আমার পীর এবং দাদাপীর যাহা গল্প কিংবা ইশারার ছলে শিক্ষা দিয়াছিলেন, আমি তাহা পরিষ্কারভাবে কোনও প্রকার অস্পষ্টতার পর্দায় কিছু গোপন না করিয়া বলিয়াছি।

.

আমরা শাহজাদার সত্য ও সরলতা এবং প্রাপ্ত বিদ্যা অকুণ্ঠিতভাবে মনুষ্য সমাজকে দান করিবার প্রশংসা করিলেও তাঁহার লোকচরিত্রজ্ঞান ও সহজাত সাংসারিক বুদ্ধি এবং অধিকারী-অনধিকারী বিচারের উপেক্ষাকে প্রশংসা করিতে পারি না। উদ্দেশ্য সাধু হইলেও তিনি বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেন নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *