৩. দারার মনসব ও সুবাদারি

তৃতীয় অধ্যায় – দারার মনসব ও সুবাদারি

দারার মনসব ও সুবাদারি আলোচনা করিবার পূর্বে মোগল সাম্রাজ্যে অভিজাত শ্রেণী সম্বন্ধে কয়েকটি গোড়ার কথা বলা আবশ্যক। মোগল সাম্রাজ্যে অভিজাত শ্রেণী দুই ভাগে বিভক্ত ছিল; পুরুষানুক্রমিক ভূস্বামীবর্গ এবং সম্রাট দরবারের উপাধিপ্রাপ্ত সামরিক অসামরিক উচ্চশ্রেণীর রাজপুরুষগণ। প্রথমোক্ত অভিজাতবর্গের মধ্যে সাধারণত হিন্দু সামন্তরাজগণই ছিলেন প্রধান। মুসলমান আমলে মুসলমানদিগের মধ্যে পুরুষপরম্পরা জন্মগত অধিকারে সৃষ্ট কোনও জমিদার-শ্রেণী ছিল না। মোগল সাম্রাজ্যে স্বয়ং সম্রাটই একমাত্র প্রভু, যুবরাজ হইতে দীনতম ব্যক্তি সকলেই প্রজা এবং আজ্ঞাবহ ভৃত্য। তিনি অন্নদাতা, নিমকের মালিক, প্রজার ধন-মান-ইজ্জত এবং ধর্মের রক্ষক। প্রজাগণের মধ্যেই গুণ কর্ম এবং স্বভাব অনুযায়ী শ্রেণীসংস্থাপনে তাঁহারই একমাত্র অধিকার, রাজসেবা ছিল আভিজাত্য লাভের প্রশস্ত পথ, এবং রাজার নিকটতম অতি বিশ্বস্ত অনুচরবর্গকে রাজসংসারে এক-একটি “পোশাকী” পদ ও কার্যভার প্রদান করা হইত। ইয়োরোপের মধ্যযুগের সামন্ত দরবার এবং মিশরের ফাতেমী খলিফার দরবারের ন্যায় হিন্দুস্থানে সুলতানী আমলে সুলতানের খাস ভৃত্যগণ অভিজাত শ্রেণীর মুখপাত্র ছিলেন, পদবীও প্রায় অনুরূপ ছিল। সুলতানী দস্তার খানের (আধুনিক খানার টেবিল) চাশনীগীর (যিনি প্রত্যেক পেয়ালা বা থালি পরিবেশনের পূর্বে চাখিয়া দেখিতেন), সর্-দোয়াতদার (প্রধান মস্যাধার রক্ষক), হস্তী ও অশ্বশালার রক্ষকের পদ অতি সম্মানজনক ছিল। সম্রাট প্রথম চার্লস শিকার হইতে ফিরিবার পর তাঁহার ডান পায়ের এবং বাঁ পায়ের বুটজুতা খুলিবার পুরুষানুক্রমিক অধিকার (Grand Jack boot of the Empire) যেমন আভিজাত্যসূচক ছিল, সুলতানী আমলে সুলতানের ঘোড়ার অস্থায়ী সহিসের পদও (মীর আখৌর) তদ্রূপ একটি বিশেষ অধিকার এবং শ্লাঘনীয় পদ বিবেচিত হইত। মোগল আমলে সম্রাটই ছিলেন সাম্রাজ্য, বাদশাহী দরবার শাহীমহলের প্রতিচ্ছবি এবং বিরাট সংস্করণ মাত্র। মোগল দরবারের মীর-সামান পদে নিযুক্ত হইতেন একজন অতি উচ্চপদস্থ আমীর; কাগজে-কলমে শাহীমহলের যাবতীয় সরঞ্জাম — বাদশাহী “তোষাখানা”র (Ward- robe) সকল জিনিসের তত্ত্বাবধায়ক। অতীতকে উপহাস করিয়া “মীর সামান” বা “খান-ই-সামান” “খানসামাত্ব” প্রাপ্ত হইয়া কলিযুগে বড়লোক সাহেব-সুবার অনুরূপ পরিচর্যা করিতেছে। প্রাক্-মোগল যুগের “সরবত-দার” পানীয় পরিবেশক ইত্যাদি খেতাব মোগল যুগে না থাকিলেও বিশেষ বিশেষ ব্যাপারে উচ্চপদস্থ আমীরগণ ওই কাজ করিতেন।

সম্রাট আকবর সর্বপ্রথম সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবে অভিজাতবর্গের মধ্যে “শ্রেণী” বা “জাত” এবং প্রত্যেক শ্রেণীর মধ্যে লঘিষ্ঠ গরিষ্ঠ স্থান নির্ণয় এবং বেতন নির্ধারণের জন্য সওয়ার নির্দিষ্ট করিয়া মনসবদারি প্রথা প্রবর্তিত করেন। মনসবদারির বাহিরে অন্য অন্য কোনও শ্রেণীর পদের অস্তিত্ব ছিল না। সরকারি বেতনভুক অসামরিক এবং সামরিক উভয় শ্রেণীর কর্মাধ্যক্ষ, এমন কি খ্যাতনামা কবি, চিকিৎসক, চিত্রশিল্পী, রাজস্ব বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মচারীবর্গ, কবুতরখানার ভৃত্যবর্গ পর্যন্ত সকলেই ক্রমশ এই মনসবদারি ব্যবস্থার আওতায় আসিয়া পড়িল। সামরিক বিভাগে অশ্বারোহী যোদ্ধার অধিনায়কগণ আকবরশাহী “দহ-বাসী” হইতে ‘দহ-হাজারী” পর্যন্ত ছেষট্টি ভাগে বিভক্ত ছিল, কিন্তু সাধারণত কোনও সামন্ত কিংবা সেনানায়ককে “পাঁচ-হাজারী”র ঊর্ধ্বে মনসব প্রদান করা হইত না। জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের আমলে মনসব ক্রমশ ফাঁপিয়া ষাট-হাজারী পর্যন্ত হইল, কিন্তু সাত-হাজারীর ঊর্ধ্বতন মনসব সম্রাটের পুত্র, পৌত্র, শ্যালক, শ্বশুর কিংবা সম্রাজ্ঞী ভিন্ন প্রজাসাধারণকে দেওয়া হইত না। সামরিক বিভাগের প্রত্যেক শ্রেণীর মনসবদারকে কোন্ শ্রেণীর কয়টা ঘোড়া, হাতি, উট, খচ্চর এবং গরুর গাড়ি রাখিতে হইবে নির্দিষ্ট ছিল; কিন্তু কয় জন অশ্বারোহী সৈন্য কোন্ শ্রেণীর মনসবদার প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁহার “তাবিন” (Con- tingent) অনুযায়ী রাখিতেন উহার হিসাব আজ পর্যন্ত কোনও ঐতিহাসিক সঠিক ভাবে নির্ণয় করিতে পারেন নাই। মোটামুটি বলা যাইতে পারে “সদী” (একশতী মনসবদার) হইতে ঊর্ধ্বতন প্রত্যেক মনসব বা Command একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সামরিক ইউনিট ছিল। নমুনাস্বরূপ আইন-ই-আকবরী হইতে আমরা “সদী”, “হাজারী” এবং “দহ-হাজারী” মনসবদারের বিবরণ উদ্ধৃত করিতেছি।

(১) “সদী”––ঘোড়ার সংখ্যা ও শ্রেণী—

ইরাকী ২ + মুজন্নস 2 + তুর্কী ২ + ইয়াবু ২ + তাজী ২ = ১০টি

ঘোড়া হাতি বিভিন্ন শ্রেণীর ৪টি

উট ২টি

গরুর গাড়ি ৫টি

মাসিক বেতন–

প্রথম শ্রেণী––৭০০ টাকা

দ্বিতীয় শ্ৰেণী–৬০০ টাকা

 তৃতীয় শ্রেণী–৫০০ টাকা

(২) “হাজারী” 

ঘোড়া––(ইরাকী ১০ + মুজান্নস ১০+ তুর্কী ২১ + ইয়াবু ২১ + তাজী ২১ + জঙ্গলা (২১) = মোট ১০৪

হাতি––(শেরগীর ৭ + সাদা (শ্বেতবর্ণ নয়) ৮ + মঞ্জোলা ৭ + করাহা ৭ + কাণ্ডুরকিয়া ২) = মোট ৩১

উট— ২১ কাতার অর্থাৎ ২১টা

খচ্চর-৪.২০ – কাতার (বোধ হয় ৫টিতে এক কাতার) অর্থাৎ ২১টা

গরুর গাড়ি— ৪২

মাসিক বেতন-

প্ৰথম শ্ৰেণী–৮২০০ টাকা

দ্বিতীয় শ্রেণী–৮১০০ টাকা

তৃতীয় শ্রেণী—৮০০০ টাকা

(৩) দহ বা “দশ-হাজারী”

ঘোড়া—ইরাকী ৬৮ + মুজন্নস ৬৮ + তুর্কী ১৩৬ + ইয়াবু ১৩৬ + জঙ্গলা ১৩৬ ) = মোট ৫৪৪

হাতি — (শেরগীর ৪০ + সাদা ৬০ + মঞ্জোলা ৪০ + করাহা ৪০ + কাণ্ডুর কিয়া ২০) = মোট ২০০

উট—১৬০ (কাতার)

খচ্চর–৪০ কাতার অর্থাৎ আনুমানিক ২০০

গরুর গাড়ি — 320

মাসিক বেতন––৬০,০০০ টাকা

আকবরনামার “পরিশিষ্ট” আইন-ই-আকবরী পুস্তকের সরকারি হিসাব অনুযায়ী এক-একজন মনসবদারের আনুমানিক মাসিক ব্যয় : –

(ক) ঘোড়া

একটি ইরাকী (অর্থাৎ আরব দেশজাত কিংবা তাদৃশ গুণসম্পন্ন) ঘোড়ার মাসিক খাদ্য-ব্যয়- ৭২০ দাম বা ১৮ টাকা

[যথা দৈনিক ৬ সের দানা ২.৫ দাম; ঘি ২ দাম; চিনি ১৭.৫ এবং ৫ সের ঘাস ৩ দাম। ইহা ছাড়া “জীন” খরচ (ঘোড়ার চিরুনি, নাল, গামছা ইত্যাদি বাবদ মোট) ৭০ দাম বা এক টাকা বারো আনা]

।একটি মুজন্নস (ইরানী-তুর্কী দো-আঁশলা) ঘোড়ার মাসিক ব্যয় ১৪ টাকা (৫৬০ দাম)

একটি তুর্কী (তুরান দেশ হইতে আমদানি) ঘোড়ার মাসিক ব্যয় ১২ টাকা।

একটি ইয়াবু (তুর্কী এবং হিন্দুস্তানী দো-আঁশলা) ঘোড়ার মাসিক ব্যয় ১০ টাকা।

একটি তাজী (মদ্রজন্তু ভবেত্তাজী) মদ্র অর্থাৎ পশ্চিম পঞ্চনদ দেশজাত উৎকৃষ্ট ঘোটকী ৮ টাকা।

একটি জঙ্গলা (দেশী মাঝারি) ৬ টাকা

(খ) হাতি

শেরগীর শ্রেণী— মাসিক ব্যয় ৩০ টাকা চার আনা (১২১০ দাম )

সাদা (সাধারণ) — মাসিক ব্যয় ২০ টাকা

মঙ্গোলা–মাসিক ব্যয় ১৫ টাকা

করাহা–মাসিক ব্যয় ১৩ টাকা

কাণ্ডুর কিয়া — মাসিক ব্যয় ৭ টাকা আট আনা

(গ) উট

একটির মাসিক ব্যয় ৮ টাকা

(ঘ) গরুর গাড়ি

প্রত্যেক গাড়ির জন্য বরাদ্দ ১৫ টাকা ( ৪টি বলদের খোরাকি ১২ টাকা, চাকার চর্বি, মেরামত ইত্যাদি ৩ টাকা)।

উল্লিখিত খরচবাদ ঘোড়সওয়ার, চাকর-বাকর ইত্যাদির বেতন ও মজুরি মোটামুটি নিম্নে লিখিত হইল :-

(১) অশ্বারোহী, ইরানী-তুরানী মাসিক ২৫ টাকা, হিন্দুস্থানী ২০ টাকা।

(২) একটি শেরগীর অর্থাৎ দ্বিতীয় শ্রেণীর হাতির মাহুত, “ভৈ”, মেঠ ইত্যাদি পাঁচজন চাকর। মাহুতের মাসিক বেতন চার টাকা আট আনা; “ভৈ” মাসিক বেতন ২ টাকা নয় আনা, মেঠ দৈনিক মজুরি চারি দাম।

(৩) প্রত্যেক দুইটি ঘোড়ার জন্য একজন সহিস, মাসিক বেতন সাড়ে তিন টাকা

আস্তাবলের ভিত্তি (১৫ ঘোড়ার আস্তাবল), মাসিক বেতন আড়াই টাকা

আস্তাবলের ফাশ (সরঞ্জাম-রক্ষক), মাসিক বেতন সওয়া তিন টাকা

আস্তাবলের ঝাড়ুদার, মাসিক বেতন এক টাকা সাড়ে চৌদ্দ আনা

কুলীর মজুরি দৈনিক ২ দাম আনুমানিক সাড়ে তিন পয়সা (৪০ দামে এক টাকা, ১ টাকা = পুরাতন ৬৪ পয়সা হিসাবে)

(৪) প্রত্যেক ৫০টি উটের জন্য একজন ‘সর্‌বান্’, এবং উহার অধীনে পাঁচজন চাকর।

“সর্‌বানে”র বেতন মাসিক ৫ টাকা

প্রত্যেক চাকর দৈনিক ২ দাম বা দুই পয়সা

খরচপত্র বাদ দিয়া মনসবদারগণের লাভ বিশেষ কিছুই থাকিত না। এ জন্য প্রথম প্রথম মনসবদারগণ মিলিটারি ঠিকাদারগণের ন্যায় সরকারকে ঠকাইবার জন্য অনেক কাণ্ড করিতেন, বদায়ুনীর ইতিহাসে উহার সবিস্তার উল্লেখ আছে। পরবর্তীকালে সামরিক বিভাগে দুর্নীতি দমন করিবার উদ্দেশ্যে আকবর বাদশাহ সুলতানী আমলের “দাগ” (ঘোড়ার গায়ে সরকারি মার্কা) এবং “চেহারা” (সিপাহীর অঙ্গাবয়ব বর্ণনা বা হুলিয়া) পুনঃপ্রবর্তিত করেন। একজন পাঁচ-হাজারী মনসবদার সাধারণত এক হাজার অশ্বারোহী নিজ তাবিনে রাখিলেই বোধ হয় পাঁচ হাজারীর বেতন পাইতেন। ছোট বড় সকল মনসবদার একমাত্র সম্রাটের আজ্ঞাধীন। প্রয়োজনমত কোনও অভিযানে দশ হাজারী মনসবদারের অধীনে এক হাজারী, সাত হাজারীর অধীনে সাত-শতী মনসবদারকে কাজ করিবার হুকুম সম্রাট দিতে পারিতেন, কখনও কখনও এক জন উচ্চপদস্থ সর্বাধিনায়কের নির্দেশ অনুসারে কাজ করিবার জন্য দুই বা ততোধিক কিঞ্চিৎ নিম্নপদস্থ (যথা একজন সাত হাজারীর অধীনে “চার হাজারী” হইতে ‘হাজারী” ‘পর্যন্ত) মনসবদার যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরিত হইলে এই অধীনস্থ মনসবদারগণকে “কৌমকী” বা সাহায্যকারী সেনানায়ক বলা হইত। প্রধান সেনাপতি সাধারণত এইরূপ “কৌমকী” মনসবদারের কোনরূপ গুরুতর শাস্তিবিধান করিতে পারিতেন না, সম্রাটের কাছে তাঁহাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করিতে পারিতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা শান্তির সময়ে প্রত্যেক মনসবদারকে তাঁহার অধীনস্থ সৈন্যগণের যানবাহন, রসদ এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করিতে হইত। বাদশাহ হুকুমজারি করিয়াই প্রায় খালাস। এইজন্যই পাঁচ হাজারী মনসবদারকে এক হাজার যোদ্ধার জন্য পাঁচ হাজারীর বেতন দেওয়া হইত।

বাদশাহী আমলে সরকারি কোষাগার হইতে উপযুক্ত ব্যক্তিগণের জন্য দুই রকম বৃত্তি এবং বেতনের ব্যবস্থা ছিল। কেহ কেহ প্রথমে দৈনিক ভাতা পাইতেন (যথা উজীর সাদুল্লা খাঁ), পরে তাঁহারা মনসবদার পদে উন্নীত হইতেন। যাঁহারা ভাতা পাইতেন তাঁহাদিগকে “রোজিনাদার” বলা হইত। মনসব প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত শাহাজাদাগণ দৈনিক ভাতা পাইতেন।

১৬২৮ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে ফেব্রুয়ারি হইতে ১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা অক্টোবর পর্যন্ত শাহজাদা দারা দৈনিক এক হাজার টাকা ভাতার “রোজিনাদার” ছিলেন। কিছুদিন পূর্বে তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা শুজাকে শাহ্জাদাগণের মধ্যে সর্বপ্রথম দশ হাজারী মনসব প্রদান করিয়া দাক্ষিণাত্য অভিযানে প্রেরণ করা হইয়াছিল। ওই বৎসরের ৫ই অক্টোবর শাহজাহানের চান্দ্র মাসানুযায়ী জন্মদিনের দরবারে দারা প্রথম মনসব লাভ করিলেন— বারো-হাজারী (“জাত”) ছয় হাজার “সওয়ার”। এই উচ্চতম পদমর্যাদার সহিত দিল্লি সাম্রাজ্যের ভাবী উত্তরাধিকারী শাহজাদাকে সরকার হিসারের (বর্তমান পঞ্জাব প্রদেশের অন্তর্গত) ফৌজদারী প্রদত্ত হইল। হুমায়ু বাদশাহ হইতে শাহজাহান পর্যন্ত সম্রাটগণ রাজ্যারোহণের পূর্বে স্ব স্ব পিতার নিকট হইতে সরকার হিসাব জায়গীরস্বরূপ পাইয়া আসিতেছিলেন। এইজন্য “ফৌজদার-ই- হিসার” যেন শাহী আমলের প্রিন্স অব ওয়েলস অর্থাৎ সম্রাটের মনোনীত যুবরাজ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে নিউ ইয়ার্স ডে এবং সম্রাটের জন্মদিন গেজেটের ন্যায় সম্রাট আকবরের সময় হইতে নওরোজদরবার, এবং সৌর ও চান্দ্র মাস অনুসারে গণিত সম্রাটের জন্মতিথিদ্বয় উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত “ওজন-ই-শসী” এবং “ওজন-ই-কমরী”—এই তিনবার প্রতি বৎসরে মনসব, খেতাব ও ইজাফার (মনসবদারগণের পদবৃদ্ধি) তালিকা বাহির হইত। জন্মতিথিদ্বয়ে “ওজন” বা তুলাপুরুষ দানের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান আকবর বাদশাহ প্রথম প্রবর্তন করিয়াছিলেন,* এবং উহা আলমগীরশাহী আমলের প্রথম কয়েক বর্ষ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। এই জন্মতিথিদ্বয়ের প্রকাশ্য দরবারে “নওরোজ” দরবারের ন্যায় অভিজাতবর্গ এবং প্রত্যর্থীগণের নিকট হইতে বাদশাহ নজর গ্রহণ করিয়া তাহাদিগকে খেলাত প্রদান করিতেন, এবং “ওজনের দ্রব্যটি দীনদুঃখী ফকিরকে খয়রাত এবং সাধারণের হিতার্থে চিকিৎসক ও আলেমগণকে দান করা হইত। রাজস্ব এবং বিজয়লব্ধ ধনের এক অংশ দিল্লীশ্বর এইভাবে প্রজাগণকে পুনঃপ্রদান করিতেন — “সহস্রগুণমুত্রষ্টুমাদত্তে হি রসং রবিঃ।”

[* সৌর জন্মতিথিতে সম্রাট আকবরকে নিম্নলিখিত দ্রব্যের দ্বারা ওজন করা হইত-যথা স্বর্ণ, পারদ, রেশম, গন্ধদ্রব্য, ভেষজ ঔষধি, ঘি, লৌহ, পায়সান্ন, সাতপ্রকার খাদ্যশস্য, লবণ, তুতিয়া (Ruh-i-tutiya?) ইত্যাদি। এইদিনে সম্রাটের যত বৎসর বয়স পূর্ণ হইত তত সংখ্যক ভেড়া ছাগল ও পাখি—যাহারা এই সমস্ত প্রতিপালন করে তাহাদিগকে দান করা হইত এবং বহুসংখ্যক ছোট জানোয়ারকে বন্ধনমুক্তি দেওয়া হইত। চান্দ্র জন্মতিথিতে সম্রাটকে রৌপ্য, বঙ্গ (tin), বস্ত্র, সীসা ফল, তরি-তরকারি এবং সরিষা তৈলের দ্বারা ওজন করা হইত। উভয় পর্বেই সালগিরা উৎসব হইত। অন্দরমহলে রক্ষিত একটি রজ্জুতে প্রতি বৎসর সৌর-চান্দ্র বৎসর হিসাবে এক-একটি গ্রন্থি যোগ করিয়া বয়সের হিসাব রাখা হইত। আকবরের সময় দানসামগ্রীর অধিকাংশ ব্রাহ্মণগণ পাইতেন। জাহাঙ্গীরের রাজত্বে ব্রাহ্মণের ভাগ ক্রমশ কম হইতে হইতে শাহজাহানের রাজত্বে শূন্যে পরিণত হইল (লাহোরী, বাদশাহনামা)। (ওজনের জন্য দ্রষ্টব্য Ain, ii – Blochmann, p. 266-67, footnote.)]

ইহার পর শাহজাদা দারার মনসব অস্বাভাবিক রকম দ্রুতগতিতে বাড়িয়া কয়েকটি ইজাফা বা প্রমোশনের পর পাঁচ বৎসর পরে দাঁড়াইল বিশ হাজারী জাত ও দশ হাজার সওয়ার। এই পাঁচ বৎসরের পরবর্তী দশ বৎসর অর্থাৎ ১৬৩৮ হইতে ১৬৪৮ পর্যন্ত যুবরাজের ‘জাত’ বাড়ে কমে নাই বটে, কিন্তু “সওয়ার” কয়েকবার বাড়িয়াছিল, এবং এই “সওয়ার”-এর মধ্যে ছিল কয়েক হাজার “দো-আসপাহ”, “সে-আস্পাহ”। মনসবের শ্রেণী বা ‘জাত” না বাড়াইয়া অনুগৃহীত কিংবা সুদক্ষ মনসবদারের বেতন ও জায়গীর বৃদ্ধি করিয়া পুরস্কৃত করিবার ইহাই ছিল ব্যবস্থা। ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে দারার ‘জাত’ বিশ হাজারী হইতে ত্রিশ-হাজারী এবং আট বৎসর পরে ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ত্রিশ-হাজারী হইতে চল্লিশ হাজারী হইয়া গেল। এই সময়ে শুজা ও আওরঙ্গজেবের মনসব একুনে দারার মনসব অপেক্ষা কম ছিল। কনিষ্ঠ হইলেও দাক্ষিণাত্য এবং মধ্য এশিয়া অভিযানে কৃতিত্ব প্রদর্শন করিয়া আওরঙ্গজেব অপেক্ষাকৃত অলসস্বভাব শুজার সহিত সমান পদমর্যাদা লাভ করিয়াছিলেন। দারাকে সর্ববিষয়ে সম্রাট কনিষ্ঠ কুমারগণের নাগালের বাহিরে, প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঊর্ধ্বে রাখিয়াছিলেন। ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে সম্রাট শাহজাহানের ভাগ্য বিপর্যয়ের অশুভ সূচনাস্বরূপ রোগশয্যা গ্রহণের কয়েক দিন পরে “পিতৃভক্তি ও শুশ্রূষা”র পুরস্কারস্বরূপ শাহজাদা দারা পিতার নিকট হইতে পঞ্চাশ-হাজারী মনসব এবং ভ্রাতৃবিরোধের প্রাক্কালে ষাট হাজারী “জাত”, চল্লিশ হাজার “সওয়ার” (উহার মধ্যে ত্রিশ হাজার “দো-আস্পাহ”, “সে-আস্পাহ”) লাভ করিয়াছিলেন।

দারার মনসবের হিসাব-নিকাশ হইতেই বুঝা যায় বাদশাহী আমলের ইতিহাস এই যুগে কি প্রকার দুর্বোধ্য হইয়া পড়িয়াছে। মনসবদারী প্রথার “জাত”, “সওয়ার”, “দো-আস্পাহ”, “সে-আস্পাহ” ইত্যাদি মারপ্যাঁচ বুঝিবার মতো কাগজপত্র বোধ হয় উজীর সাদুল্লা খাঁর পেশদস্ত বা পেশকার রাজা রঘুনাথের বংশধরগণ* আগুন পোহাইয়া নিঃশেষ করিয়াছেন। জয়পুরে শেষ পর্যন্ত যাহা ছিল তাহাও নষ্ট হইয়া গিয়াছে। এখন নিজাম বাহাদুরের অজ্ঞাত পুরাতন দপ্তর একমাত্র ভরসা। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ব্লকম্যান এবং ডাঃ পল হর্ন হইতে আধুনিক কাল পর্যন্ত গবেষকগণ “জাত”, “সওয়ার”, “দো-আস্পাহ (দুই ঘোড়া), “সে-আস্পাহ” (তিন ঘোড়া) ইত্যাদির বেতন, প্রত্যেক মনসব অনুযায়ী ঘোড়সওয়ার এবং ঘোড়ার সংখ্যা নিরূপণ করিতে গিয়া বিব্রত হইয়া পড়িয়াছেন। আমাদের ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিকগণের গবেষণায় অধিক আলোকপাত হইবে কিনা ভবিতব্যই বলিতে পারেন।

[* কটক শহরে সার যদুনাথের প্রতিবেশী ছিলেন রাজা রঘুনাথের অন্যতম বংশধর লালা ব্রিজনারায়ণ। রঘুনাথের পরিবারের এক শাখা নিজাম-উল-মুলুকের সহিত দাক্ষিণাত্য চলিয়া গিয়াছিলেন। এই শাখার শেষ খ্যাতনামা পুরুষ ছিলেন পরলোকগত মহারাজ সার কিষণপ্রসাদজী। ব্রিজনারায়ণজীর কাছে তাঁহার পূর্বজগণের এক বংশতালিকা দেখিয়াছি। তিনি বলিয়াছিলেন, তাঁহার পিতার আমল পর্যন্ত ঘরবোঝাই বাদশাহী সেরেস্তার কাগজপত্র তাঁহাদের বাড়িতে ছিল। তাঁহারা ছোটকালে নষ্টপ্রায় ওই সমস্ত কাগজ পোড়াইয়া অগ্নিসেবা করিয়াছেন।]

সম্রাট শাহজাহানের ৬৬তম চান্দ্র জন্মতিথি (শনিবার, ৩রা ফেব্রুয়ারি ১৬৫৫ খ্রিস্টাব্দ) শাহজাদা দারার জীবনে একটি স্মরণীয় দিন। মহারানা রাজসিংহের বিরুদ্ধে অভিযান হইতে ফিরিয়া আসিয়া শাহানশাহ তাঁহার নবনির্মিত রাজধানী দিল্লি-শাহজাহানাবাদের দেওয়ান-ই- আম প্রাসাদে এই জন্মতিথি উৎসবের দরবারে শাহজাদা দারাকে “শাহ-বুলন্দ-ইকবাল” উপাধি দান করিয়াছিলেন। দরবার বসিবার পূর্বে শাহী “জাম্দারখানা”* বা বসনাগার হইতে আড়াই লক্ষ টাকা মূল্যের মণিমুক্তাখচিত বাদশাহী পোশাক দারার নিকট পাঠাইয়াছিলেন। এই পরিচ্ছদে ভূষিত হইয়া শাহজাদা সম্রাটের তুলাপুরুষ-দান অনুষ্ঠানে উপস্থিত হইলেন। “ওজন” ব্যাপার সমাপ্ত হওয়ার পর শাহানশাহ তাঁহার উষ্ণীষ হইতে “সবন্দ” (উষ্ণীষ-বন্ধনী) খুলিয়া নিজ হস্তে পুত্রের পাগড়িতে বাঁধিয়া দিলেন। দুই লহর দামী মুক্তার মালা এবং গোলাপী রঙের একটি বড় বৈদুর্যমণি (রুবি) এই সরবন্দে ছিল—মূল্য সাড়ে চার লক্ষ টাকা। উক্ত খেলাত এবং “সর্বন্দ” ব্যতীত নগদ ত্রিশ লক্ষ টাকা শাহজাদাকে ‘ইনাম’ দেওয়া হইল। মসনদ-ঝরোকা বা সিংহাসন-অলিন্দে সেইদিন ময়ূর সিংহাসনের** পার্শ্বে শাহানশাহর হুকুমে একটি সুবর্ণনির্মিত রাজপীঠ স্থাপিত হইয়াছিল। শাহানশাহ পুত্রকে “শাহ-বুলন্দ ইকবাল” উপাধি দ্বারা অভিহিত করিয়া উক্ত সুবর্ণপীঠে উপবেশন করিবার আদেশ দিলেন। স্বভাবনম্র যুবরাজ সম্রাটের সম্মুখে আসন পরিগ্রহ করিতে বিলক্ষণ ইতস্তত করিয়া আপত্তি জানাইলেন; কিন্তু পিতার একান্ত ইচ্ছা ও অনুরোধে তাঁহাকে বসিতেই হইল। ঐতিহাসিক ওয়ারেস লিখিত বাদশাহনামায় এই ঘটনার যেরূপ বর্ণনা আছে, শাহজাদার পীর মোল্লা শাহ বখশীর নিকট লিখিত দারার এক চিঠিতে উহাই সঠিক এবং বিস্তারিত ভাবে পাওয়া যায়। দারা গুরুকে জানাইতেছেন—

(দরবারে খেলাত বিতরণ, পদোন্নতি ইত্যাদির পর) আলা হজরত বলিলেন, “বৎস! আমি সঙ্কল্প করিয়াছি আজ হইতে কোনও গুরুত্বপূর্ণ কার্যে তোমার সঙ্গে পরামর্শ না করিয়া হাত দেওয়া হইবে না। খোদাতালার অসীম অনুগ্রহে তোমার মতো পুত্র পাইয়াছি, ইহার জন্য তাঁহাকে যথেষ্ট ধন্যবাদ।” দরবারের পর শাহানশাহ ওমরাহ এবং দরবারীগণকে হুকুম দিলেন তাঁহারা শাহজাদাকে এই নূতন সম্মানপ্রাপ্তির জন্য মোবারকবাদ জানাইতে পারেন। বিশ দিন পরে (২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৬৫৫ ইং) স্বয়ং সপরিষদ সম্রাট শাহজাদা দারার দৌলতখানায় পদার্পণ করিয়া পুত্রকে অভিনন্দিত করিয়াছিলেন। (সেকালের) নূতন দিল্লিতে যমুনাতীরে যে অনুপম প্রসাদে শাহজাদা বাস করিতেন, তিনি উহার নাম রাখিয়াছিলেন “নিগমবোধ মঞ্জিল”। এইখানে তিনি এই সময় উপস্থিত অর্থ এবং ভাবী অনর্থকে উপেক্ষা করিয়া পরমার্থ চিন্তায় নিমগ্ন থাকিতেন, অবশ্যম্ভাবী ভ্রাতৃবিরোধের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার আয়োজন না করিয়া শাহজাদা তখন যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ, ভগবদ্‌গীতা এবং প্রবোধচন্দ্রোদয় নাটক অনুবাদে ব্যস্ত ছিলেন।

[* “জামদারখানা তু বসনাগারং”- রাজব্যবহারকোষ

** ময়ূর সিংহাসন কিংবা মুসলমান আমলের কোন মসনদের পায়ায় সিংহমূর্তি ছিল না এবং উহার গঠনও চেয়ারের মতো নহে (Vide Sarkar, Studies in Mughal India.)]

শাহজাদা দারাশুকোর সুবাদারি-

১। ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই জুন তারিখে রাজশ্যালক শায়েস্তা খাঁর স্থলে যুবরাজ দারা সুবে এলাহাবাদের সুবাদার নিযুক্ত হইলেন। আকবরশাহী আমলে সুবে এলাহাবাদের পূর্ব সীমা সুবে বিহার, পশ্চিমে সুবে আগ্রা, উত্তরে সুবে আউধ বা অযোধ্যা, দক্ষিণে “বন্ধু” বা বর্তমান বান্দা জিলা। সুবে এলাহাবাদ দশটি সরকার এবং ১৭৭ পরগণায় বিভক্ত। ইহার রাজস্ব ২১ কোটি ২৪ লক্ষ ২৭,৪১৯ দাম বা আনুমানিক টাকা ৫৩,১০,৬৯৫ টাকা ৭ আনা ৬ পাই*। চুনার, কাশী, গাজীপুর, জৌনপুর, কালঞ্জর, কারা-মাণিকপুর কোরা (ফতেপুর) প্রভৃতি এই সুবার অন্তর্গত। পিতা শাহজাহান প্রিয়তম পুত্র দারাকে দরবারে রাখিয়া নায়েব-সুবেদার দ্বারা সুবার শাসনকার্য চালাইবার অনুমতি দিয়াছিলেন। তদনুসারে শাহজাদা তাঁহার অন্তঃপুররক্ষী বিশ্বস্ত খোজা বাকী বেগকে সুবে এলাহাবাদের নায়েব-সুবেদার নিযুক্ত করিলেন। অর্থনৈতিক কিংবা সামরিক দৃষ্টিতে শাহজাদা তাঁহার অধীনস্থ কোনও প্রদেশের মূল্য যাচাই করিতেন না। এলাহাবাদের সুবাদারি লাভ করিয়া তিনি সুপ্রসিদ্ধ উদার মতাবলম্বী সূফী সাধক শেখ মুহিবুল্লা এলাহাবাদীকে এক পত্র লিখিয়া সম্বৰ্ধনা জানাইয়াছিলেন। পরে দারা ইঁহাকে উপ-গুরুরূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন। দারা-মুহিবুল্লার তত্ত্ব- বিচার-বিষয়ক পত্রাবলী অত্যন্ত উপদেশপূর্ণ। এই সুবার অন্যতম আকর্ষণ ছিল কাশীধাম** এবং তথাকার পণ্ডিতমণ্ডলী। ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতগণের প্রতি দারার শ্রদ্ধা ও দাক্ষিণ্য দ্বারা আকৃষ্ট হইয়া কবীন্দ্রাচার্য সরস্বতী এবং পণ্ডিতরাজ জগন্নাথ (তৈলঙ্গবাসী) বাদশাহী দরবারে গমন করিয়াছিলেন।

[*Ain-i-Akbari, Blochmann & Jernett, part ii, pp 157-168

*কাশীতে জনশ্রুতি প্রচলিত আছে, তথাকার “দারানগর” মহল্লায় বসিয়া দারাশুকো ১৩৮ জন পণ্ডিতের সাহায্যে উপনিষদের ফার্সি তর্জমা করিয়াছিলেন (Benares District Gaz. p. 196)। সুপণ্ডিত মহেশ দাস তাঁহার এক প্রবন্ধে অকাট্য প্রমাণ দিয়াছেন, “উপনিষদ” দিল্লিতেই অনূদিত হইয়াছিল, কাশীতে নহে (Vide Modi Memorial Volume, pp. 622-638; Bombay 1930 )। আমি সমসাময়িক কোন ইতিহাসে দারার কাশীযাত্রার হদিস পাই নাই, কিন্তু এই বিষয়ে নেভিল সাহেবের জনশ্রুতি গ্রহণ করিয়া ভুল করিয়াছিলাম; পরে সংশোধন করিয়াছি (Vide Dara Shukoh p. 22. footnote, p. 150)]

২। এলাহাবাদের সুবাদারির দুই বৎসর পরে (মার্চ ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে) সুবে লাহোর অর্থাৎ পঞ্চনদ প্রদেশ শাহজাদা দারাকে দেওয়া হইল। এই প্রদেশের পশ্চিমে মুলতানের প্রবেশদ্বার ভীম্বর গিরিবর্ত্র, দক্ষিণে বিকানীর ও রাজপুতানার মরুভূমি। আকবরশাহী আমলে ইহার আয়তন কিঞ্চিৎ বড় ছিল।

এই সময়ে শাহজাদা আওরঙ্গজেব প্রধান সেনাপতিরূপে মধ্য-এশিয়ার বলখ রাজ্য জয়ে নিযুক্ত ছিলেন। কুমার দারাকে লাহোরে রাখিয়া আওরঙ্গজেবকে সাহায্য করিবার নিমিত্ত সম্রাট কাবুল শহরে বৎসরাধিককাল ডেরা করিয়াছিলেন। রণসম্ভার, খাদ্যদ্রব্যাদি সরবরাহ করিবার ভার ছিল লাহোরের সুবাদারের উপর। ভাগ্য বিপর্যয়ের পূর্ব পর্যন্ত এলাহাবাদের ন্যায় পঞ্চনদ প্রদেশও দারার অধীনে ছিল। লাহারের উপকণ্ঠে অধুনাতম মিয়ামীর স্টেশনের নিকট ছিল শাহজাদার “দাদাপীর” মিয়া-মীরের আস্তানা। ইহার শিষ্য মৌলানা শাহ বখশী দারার দীক্ষাগুরু। লাহোর শহরে নিয়ুলো নৌলাখা মহল্লায় যোগসিদ্ধ তত্ত্বজ্ঞানী বাবা লালের সহিত হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে রায় চন্দ্রভান ব্রাহ্মণের বাড়িতে শাহজাদার নয় দিন ব্যাপী তর্ক চলিয়াছিল। রায় মাধবদাস কর্তৃক উভয় পক্ষের প্রশ্নোত্তর নাদির-উল-নুকাত নামক পুস্তিকায় ফার্সি ভাষায় লিপিবদ্ধ আছে। নানা কারণে লাহোরের সহিত দারার বহু স্মৃতি বিজড়িত। শহরের উন্নতিকল্পে তিনি কয়েকটি “চক” (একাধিক রাস্তার সংযোগস্থলে নির্মিত সুপরিসর বাজার) নির্মাণ করিয়াছিলেন। লাহোরবাসীগণ উদারহৃদয় দানশীল দারাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসিত। সাম্রাজ্য লাভ করিবার পর “কাফের” দারার স্মৃতি লাহোরবাসীর মন হইতে মুছিয়া ফেলিবার জন্য আওরঙ্গজেব বহু লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়া বিরাট “বাদশাহী মসজিদ” নির্মাণ করিয়াছিলেন। কথিত আছে, লাহোরবাসী মুসলমানগণের নিকট এই মসজিদ “আক্কেল-দমা” নামে কুখ্যাতি লাভ করিয়াছিল। শিখগণের কবল হইতে উদ্ধার করিয়া ইংরেজ সরকার মুসলমানদিগকে এই মসজিদের অধিকার দান করিবার পরেও আক্কেল গুড়ুম হইবার ভয়ে কুসংস্কারাবদ্ধ কোন কোন মুসলমান এইখানে নমাজ করিতে আপত্তি করিত* বলিয়া এক সাহেব লিখিয়া গিয়াছেন।

[* Lahore Gazetteer, 1883 pp. 24, 176]

৩। সুবে গুজরাট—

১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে পূর্বোক্ত দুই সুবার সহিত সুবে গুজরাটের শাসনভার যুবরাজ দারার উপর অর্পিত হইয়াছিল। সুবে গুজরাটের আয়তন বুরহানপুর হইতে দ্বারকা পর্যন্ত দৈর্ঘ্যে ৩০২ ক্রোশ; বিস্তৃতি রাজপুতানার জালোর হইতে কাম্বে উপসাগরের তীরবর্তী বন্দর “দামন” (পরে পর্তুগীজ অধিকার) পর্যন্ত ২৬০ ক্রোশ এবং “ইডর” রাজ্য হইতে কাম্বে পর্যন্ত ৭০ ক্রোশ। আকবরশাহী আমলে ইহার রাজস্ব ছিল এক কোটি নয় লক্ষ বিশ হাজার পাঁচ শত সাতান্ন টাকা আট আনা (কাফি খান)। গুজরাটের নিতান্ত বিশৃঙ্খল শাসন-ব্যবস্থা সুব্যবস্থিত করিবার উদ্দেশ্যে শাহজাদা দারা তাঁহার সুদক্ষ নায়েব সুবাদার বাকী বেগকে সুবে এলাহাবাদ হইতে গুজরাটে বদলি করিলেন। শাহজাদার সুপারিশ অনুসারে শাহানশাহ বাকী বেগকে বাহাদুর খাঁ খেতাব দান করিয়াছিলেন। দারা স্বয়ং গুজরাটে পদার্পণ করেন নাই। ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দে শায়েস্তা খাঁ এবং দুই বৎসর পরে কনিষ্ঠ শাহজাদা মুরাদবখ্শ গুজরাটের সুবাদার নিযুক্ত হইয়াছিলেন। ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই জুলাই সুবে গুজরাটের বদলে সুবে মুলতান এবং কাবুল দারাকে দেওয়া হইল।

আকবরশাহী আমলে সিন্ধুপ্রদেশ জয়ের পূর্বে মুলতান স্বতন্ত্র সুবা ছিল না; লাহোরের অধীনে উহা একটি “সরকার” বা জিলা হিসাবে গণ্য হইত। সিন্ধুর স্বাধীন নরপতি মির্জা জানী বেগ রাজ্যচ্যুত হইবার পর সিন্ধু এবং মুলতানকে লইয়া সুবে মুলতান গঠিত হইয়াছিল। পাঞ্জাবের অন্তর্গত ফিরোজপুর হইতে কচ্ছগাণ্ডবা (বেলুচিস্তান) এবং মকরানের পশ্চিম সীমা পর্যন্ত এই সুবার দৈর্ঘ্য ৬৬০ ক্রোশ, এবং মুলতানের নিকটবর্তী খটপুর হইতে জয়শমীর রাজ্যের সীমা পর্যন্ত বিস্তৃতি ১০৮ ক্রোশ। এই প্রদেশের রাজস্ব তিন লক্ষ আটাত্তর হাজার পাঁচ শত নব্বই টাকা আট আনা।

আকবরশাহী আমলে কাশ্মীর ও কান্দাহার কাবুল সুবার অন্তর্গত ছিল। শাহজাহানের সময়ে কাশ্মীর একটি স্বতন্ত্র সুবা হইয়াছিল। শাহজাহানের সময় অচিরস্থায়ী সুবে কান্দাহার হস্তচ্যুত হওয়ার পর কাবুল, গজনী, পেশাওয়ার, সওয়াত উপত্যকা এবং বন্নু জিলা লইয়াই সুবে কাবুল বহাল রহিল। দারার কান্দাহার অভিযানের সময় তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র সুলেমান শুকো কাবুলের নায়েব সুবাদার ছিলেন। ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে কান্দাহার অভিযানে ব্যর্থকাম হইয়া ফিরিবার সময় দারা সুলেমান শুকোর স্থলে বাহাদুর খাঁকে কাবুলের শাসনকর্তা নিযুক্ত করিলেন। ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বাহাদুর খাঁ লাহোরে বদলি হওয়ায় তাঁহার স্থানে রুস্তম খাঁ বাহাদুর ফিরোজ-জঙ্গ কাবুলের নায়েব সুবাদার নিযুক্ত হইলেন।

বাংলা এবং উড়িষ্যার সুবাদার শাহ শুজা দীর্ঘকাল পর্যন্ত সুবে বিহার পাইবার জন্য লালায়িত ছিলেন। তিন সুবা হাতে পাইলে শাহ শুজা প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হইতে পারে এই আশঙ্কায় ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে পিতার নিকট হইতে বিহার প্রদেশ দারা নিজের নামে লিখাইয়া লইলেন। কিন্তু ইহার পূর্বেই শাহ শুজা বিদ্রোহী হইয়া বলপূর্বক বিহার প্রদেশ অধিকার করিয়া বসিলেন।

উপরিকথিত সুবাসমূহ ব্যতীত সম্রাট যুবরাজ দারাকে আরও দুইটি লাভজনক পদ প্রদান করিয়াছিলেন। কোয়েল (বর্তমান আলিগড়) সরকারের ফৌজদারি এবং আগ্রা-দিল্লির মধ্যবর্তী বাদশাহী রাস্তার “রাহদারী” বা পথরক্ষক পদের আয় ছিল মোট সাড়ে বাইশ লক্ষ টাকা। এই দুইটি গুরুত্বপূর্ণ পথ দারাকে অর্পণ করিয়া শাহজাহান পরোক্ষভাবে রাজধানী দিল্লি ও আগ্রার কর্তৃত্ব তাঁহাকেই ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। কোয়েল (আলিগড়) সরকারের ফৌজদার ছিল প্রকৃতপক্ষে যমুনার অপরপারে আগ্রা ও দিল্লির পূর্বদিকবর্তী দোয়াব-জিলার সর্বময় কর্তা। চম্বল নদীর তীরবর্তী আগ্রার অনতিদূরে ঢোলপুর ঘাট হইতে বাদলী (দিল্লির ছয় মাইল উত্তরে) পর্যন্ত বাদশাহী রাস্তার “রাহদার” উত্তর এবং দক্ষিণ দিক হইতে রাজধানীদ্বয়ের প্রবেশ পথে প্রহরীস্বরূপ। সুবে এলাহাবাদ, মালব, আজমীর লাহোর হইতে কোনও শত্রুর পক্ষে বর্তমান আলিগড় জিলার ফৌজদার এবং উক্ত বাদশাহী সড়কের প্রহরীকে এড়াইয়া দিল্লি-আগ্রা প্রবেশ করা অসাধ্য ব্যাপার। সরকারি ডাক চলাচলের ইহাই ছিল প্রধান রাস্তা। সম্রাট শাহজাহান কুমার চতুষ্টয়ের স্বভাব এবং মতিগতি লক্ষ্য করিয়া যেন ভাবী অনর্থের আশঙ্কায় শাহজাদা দারাকে এই উভয় পদে নিয়োগ করিয়াছিলেন। পুত্রগণের মধ্যে এই কার্যের জন্য দারা যোগ্যতম না হইলেও সর্বাপেক্ষা নিরাপদ ব্যক্তি। যোদ্ধা এবং শাসক হিসাবে দারার জীবন ঘটনাবহুল কিংবা বৈচিত্র্যপূর্ণ নহে। আকবরশাহী আমলের শাসনতন্ত্র একটি স্বয়ংক্রিয় বিরাট যন্ত্রে পরিণত হইয়াছিল বলিয়া দারার অনুপস্থিতি এবং অমনোযোগ সত্ত্বেও সাম্রাজ্যের প্রধান সুবাসমূহ তাঁহার নামে নায়েব সুবাদারগণ নির্বিঘ্নে শাসন করিতে সক্ষম হইয়াছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *