১৭. দারার বিদায় (সামুগঢ়ের যুদ্ধ; মে ২৯, খ্রিঃ ১৬৫৮)

সপ্তদশ অধ্যায় – দারার বিদায় (সামুগঢ়ের যুদ্ধ; মে ২৯, খ্রিঃ ১৬৫৮)

জ্যৈষ্ঠ মাস, ১৮ই মে ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ। বৃদ্ধ সম্রাট শাহজাহানের প্রৌঢ়া প্রেয়সী আগ্রানগরী উৎসবের অপূর্ব সজ্জায় অভিনব যৌবনশ্রী ধারণ করিয়া আনন্দকোলাহলে মুখর ও কর্মচঞ্চল; প্রতি গৃহচূড়ায় ছাদে অলিন্দে উড্ডীয়মান উৎসবপতাকার রূপের তরঙ্গ, বাহিরে উল্লাসের হিল্লোল, ভিতরে বিসর্জনের হর্ষ-বিষাদ।

আজ শাহজাদা দারা এবং তাঁহার সহযাত্রী সেনানী ও সামন্তবর্গের আনুষ্ঠানিক ভাবে যুদ্ধার্থে বিদায় লইবার দিন; অপরাহ্ণে আগ্রা দুর্গের প্রকাশ্য দরবারে তাঁহারা অভ্যর্থিত ও পুরস্কৃত হইবেন। কালবৈশাখী এইবার নববর্ষের “নওরোজ” উৎসব পণ্ড করিয়াছিল, ধর্মাতের যুদ্ধে দারার ভাগ্য-বিপর্যয়ই এই ঝড়ের প্রথম তাণ্ডব। নিয়তির অসিত যবনিকার অন্তরালে আশা-মরীচিকায় পুনঃপ্রলুব্ধ পিতাপুত্ৰ ইতিমধ্যেই পরাজয়ের গ্লানি ও আশঙ্কা মুক্ত হইয়াছেন। শঙ্কাকুল প্রজাগণকে আশ্বস্ত করিবার জন্য সাম্রাজ্যের পূর্ণ সামরিক শক্তি ও ঐশ্বর্যভাণ্ডার প্রিয় পুত্রের বিদায় সম্বর্ধনা উপলক্ষে লোকচক্ষুর গোচর করিবার সপ্তাহব্যাপী বিরাট আয়োজনের আজ পরিসমাপ্তি।

আগ্রা দুর্গে ভোরের নহবত বাজিয়া উঠিতেই শহরের ভিতরে বাহিরে, সেনাশিবিরে এবং গৃহস্থবাড়িতে সমানভাবে হাঁকডাক ও কাজের সাড়া পড়িয়া গিয়াছে। সিপাহী সওয়ার তল্পিতল্পা গুটাইয়া ও জিন কষিয়া যাত্রার জন্য প্রস্তুত, কেহ কেহ “পেশখানা”র লটবহরের পাহারায় দক্ষিণে ঢোলপুরের রাস্তায় চলিয়া গিয়াছে, বাদবাকি শহরে মেলা কিংবা দরবারের তামাশা দেখিবার আশায় কিংবা সফরের প্রয়োজনীয় সওদা খরিদ করিবার জন্য ধীরে-সুস্থে শহরের দিকে চলিয়াছে। বেলা চড়িবার সঙ্গে সঙ্গে শহরের অলিগলি চক-চতুষ্পথ ছায়াঘন পুরোদ্যানসমূহে সুসজ্জিত যোদ্ধা ও উৎসুক জনতার জোয়ার আরম্ভ হইয়াছে। যুদ্ধযাত্রার পূর্বে মনসবদার হইতে সিপাহী সহিস ভিত্তি পর্যন্ত সকলেই অগ্রিম বেতন ও ভাতা পাইয়াছে; হাতে কাঁচা পয়সা ও সিপাহীগিরির আমেজ, সুতরাং মরণের মুখে নিদাঘ-মধ্যাহ্ন তাহাদের কাছে শ্রাবণের ঝুলন- সন্ধ্যা। মোগলের আগ্রা সেকালে বোগদাদ কর্দোভা কাহেরাকে (Cairo) সৌন্দর্যের অতীত স্বপ্নে পরিণত করিয়াছে; ইরানের ইস্পাহান শহর আগ্রার অর্ধাঙ্গের সমান নয়। মধ্যাহ্নেও আগ্রার বড় বড় রাস্তায় ছায়ার অভাব নাই; যে শহরে ২০০ শত তুর্কীহামাম, ৭০টা বড় মসজিদ মকবরা, ১৫টা শাহীবাগ, উক্তসংখ্যক পাকা চকবাজার, মাঝে মাঝে দুই দিকে সুপ্রশস্ত রাস্তায় পাকা ছাদের নিচে পোয়া মাইল লম্বা নিরবচ্ছিন্ন ছায়া, সেখানে নিদাঘ মধ্যাহ্নে মেলা জমিবে আশ্চর্য কি? যাহারা বাহির হইতে ফৌজে ভর্তি হইয়াছে তাহাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো শহর দেখে নাই; দেখিয়া থাকিলেও রাজধানীর মোগলাই ঠাট দেখে নাই, সুতরাং রাজপথে গ্রামীণ দেহাতি সিপাহীর জঙ্গলী বে-তমিজী, বেকুব চাহনি, সর্বত্র বেপরোয়া নাসাপ্রবেশ এবং ধমক খাইয়া ভ্যাবাচ্যাকা ভাব কৌতুকপ্রিয় নাগরিকগণের হাসির খোরাক জুটাইয়া চলিয়াছে, শহরের যাহারা ধড়িবাজ তাহারা দাঁও মারিবার মতলবে বাহির হইয়া পড়িয়াছে। বড় বড় রাস্তার দুই ধারে ছাদের তলায় গাছের নীচে, কোথায়ও বা মোটা ময়লা চাঁদিনার ছায়ায় দোকানপসার ঠক-জুয়াচোর বসিয়া গিয়াছে। যেখানে মানুষ সেখানেই হই-হুল্লোড়, মেলার ভিড়, তামাশা-ঠকবাজি, বাজিকরের বাঁশ-পেটরা ডুগডুগি, বেদের ঝাঁপি ও বাঁশি, তামাশাওয়ালার দড়ি-বাঁধা মোগলাই পোশাকে বাঁদর মিয়া-বিবির আশনাই, তরমুজ খরমুজার ফালি, গরম গরম বাসি শিককাবাব, রুপালী তবকমোড়া হালুয়াইর পচা মিঠাই, লোভনীয় “দহি-বড়া”-র কাঠের থালার উপর মানুষে-মাছিতে লড়াই, হজমী “সোঁঠ-কা পানি”র মটকা ও তেলেভাজা কচুরির ঝুড়ি, পান-শরবত ও বারোয়ারি হুঁকা- চিলমচির কড়া ধোঁয়ায় আরামের অপূর্ব পরিবেশ। ইহার কাছেই তালপাতার বড় ছাতা কিংবা টাটের নীচে ত্রিকালজ্ঞ তিলক কাটা যোশীর (জ্যোতিষী) পঞ্জিকা-রাশিচক্র ও পাশা, সাদা পাগড়িওয়ালা নজুমীর (মুসলমান গণৎকার) দাড়ি দোয়া তাবিজ ও ইউনানী ছক, অথর্ব ফিরিঙ্গির সামুদ্রিক মানচিত্র ও কম্পাসের দৌলতে লোকের ভাগ্যগণনার ফিকির, কোথাও বা ভণ্ড ফকির-দরবেশের বত্রিশতালি বিচিত্রিত ময়লা খিরকা জোব্বা ও আল্লার নামে খয়রাতের চিৎকার, রাস্তার আসরে গলিত-যৌবনা নাচওয়ালীর নীল-সবুজ ঘাঘরার পেখম সোনালি “আঙ্গিয়া” কুর্তি বাসন্তী রঙের ওড়নায় জরির ঝলমল বাহার, চোখে সুরমা দাঁতে মিশি গায়ে গিল্টির গয়না, হাবভাবের অপচেষ্টা, ফাটা গলা ও পা-জেব-ঘুংঘুরুর আওয়াজ; তবুও খরিদ্দার- সমঝদারের অভাব নাই। পরকাল সর্বস্ব হিন্দু সিপাহী দুপুর রোদে মেলার ভিড়ে পথের শেষ সম্বল খুঁজিতে খুঁজিতে কুমহারের মাটির পুতুলের ঝাঁকার উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে; কিষণজী সীতারামজী ও হনুমানজীর উপর দাম-কষাকষি চলিতেছে, দাড়ি ফেলিয়া দেবতাকে ভক্তিভরে পাগড়ির ভাঁজে রাখিতেছে; হরেকরকমের মালার দোকানে ভিড় লাগিয়া গিয়াছে, মালা ছাড়া মুক্তি নাই, সুতরাং কেহ গলায় কেহ হাতে মালা ঝুলাইয়া ভাবনাহীন-চিত্তে আনন্দ-সাগরে ভাসিয়া হাতি পোলের চকে চলিয়াছে।

[* “The Moghul… delights not so much in any as Agra…it is at least twice as big as Ispahan, and it is as much as a man to ride about it on horse-back in a day…Its streets are fair and spacious, and there are some of them vaulted, which are above a quarter of a League in length…There are fifteen maidans and bazars, whereof the most spacious is that which is before the Castle. There are in the City fourscore Caravanseras…with very noble Lodgings, Stonehouses, Vaults and Stables…a great number of Metschid…among the rest seventy are great ones…

There are numbered in the city of Agra above eight hundred Baths or Hothouses…these places are frequented by an infinite number of persons…

The great Lords about the Court,…have their Houses and Palaces in the City, besides their Country-houses, all magnificent, as to structure and house- hold stuffe.

(The Travels of John Albert de Mandelslo, Second Edition, 1669, London; Book III, pp. 30-31)]

দিল্লি হইতে বাদশাহী রাস্তা আগ্রা শহরের উপর দিয়া দুর্গের উত্তর-পশ্চিমে দিল্লি তোরণ (হাতিপোল দরওয়াজা) বামে রাখিয়া অর্ধচন্দ্রাকারে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে “আকবরী- দরওয়াজা”র (বর্তমানে অমরসিংহ ফাটক)* বাহিরে দ্বিমুখী হইয়াছে। ইহার এক শাখা ক্রমশ পশ্চিমে হেলিয়া শহরের বাহিরে আজমীরের দিকে চলিয়া গিয়াছে, অপর শাখা সোজা দক্ষিণে ধোলপুর-গোয়ালিয়র হইয়া মালব ও দাক্ষিণাত্যে বহুমুখী হইয়াছে। পূর্বে যমুনা নদী এবং শহরের ভিতর এই রাজমার্গের দ্বারা বেষ্টিত লোদী দুর্গের ধ্বংসস্তূপের উপর আকবর বাদশাহ আগ্রা দুর্গ নির্মাণ করিয়াছিলেন। এই দুর্গ মধ্যযুগে ভারতীয় সামরিক স্থপতিবিদ্যা ও চারুকলার শ্রেষ্ঠতম অবদান; নির্মাণ-কৌশল, প্রশংসনীয় রুচি, অনুপম সৌন্দর্য এবং অপ্রধৃষ্য রাজসিক গাম্ভীর্যে সেকালে ইহার তুলনা ছিল না। প্রশস্ত পাষাণ পরিখারক্ষিত ‘প্রাকার-ত্রয়’ শোভিত মোগলের রক্তবসনা রাজলক্ষ্মীর ন্যায় এই রাজদুর্গ আগ্রা নগরীর উত্তমাঙ্গস্বরূপ; দুর্গমধ্যে রক্তপ্রস্তর নির্মিত আকবরীমহাল (অধুনা জাহাঙ্গীরীমহল নামে মিথ্যা পরিচিত) ইহার আরক্তিম মুখচ্ছবি; শাহজাহানের মর্মরসৌধরাজি-মোগললক্ষ্মীর পত্রকরচনা, মোতি-মসজিদ ললাটের রত্নতিলক; বাহিরে যমুনার বঙ্কিমনীলধারার কুটিল কবরীর উপর শোভমান নশ্বর-সৌন্দর্যের অম্লানমুকুটমণি তাজমহল।

[* আকবর বাদশাহ-র সময়ে ইহাই বোধ হয় আজমীর দরওয়াজা ছিল। তাঁহার মৃত্যুর পর ইহার প্রচলিত নাম “আকবরী দরওয়াজা” কাজিম-রচিত আলমগীর নামায় পাওয়া যায়। Kazim, Alamgirnama, Pers, text, p 423]

অসমভুজ অর্ধবৃত্তাকার দেড় মাইল পরিধি বিশিষ্ট আগ্রা দুর্গের পাদদেশে পাকা শান-বাঁধা বিশ হাত প্রস্থ সুগভীর পরিখা যমুনার জলে সেকালে কানায় কানায় ভরা থাকিত। এই পরিখা দুর্গকে তিনদিক সুরক্ষিত করিয়া পূর্বদিকে যমুনার সৈকতভূমি পর্যন্ত চলিয়া গিয়াছে। ইহার বাহিরে আকবরশাহী আমলের বিপুলায়তন ভীমাকৃতি উচ্চ মৃত্তিকাপ্রাচীর।* প্রাচীরের মাঝে মাঝে লাল পাথরের বুরুজ ও কামান বসাইবার প্রাকার-বেদী, শীর্ষদেশে রক্ত-প্রস্তর নির্মিত প্রাকার ফালিকা সারির অন্তরালে রক্ষীসেনার সঞ্চরণভূমি (মাচী)। ইহার উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণদিকে অন্তঃদুর্গের হাতিপোল ও আকবরী দরওয়াজার মুখোমুখি দুইটি সুদৃঢ় তোরণ ওই নামেই পরিচিত ছিল (বর্তমানে নিশ্চিহ্ন)। বাহিরের দিকে বাদশাহী সড়ক ও প্রাকারের মধ্যবর্তী স্থানে মাটির প্রশস্ত চত্বর। এই চত্বরের উপর সারি সারি তাঁবু, মনসবদারী অশ্বসাদির পালাক্রমে ‘হপ্তচৌকি”র প্রথম চৌকির কড়া পাহারা। সম্রাট শাহজাহান হাতিপোল দরওয়াজার মুখোমুখি মৃত্তিকা-প্রাকারের তোরণের বিপরীত দিকে রাস্তার পশ্চিম পার্শ্বে এক ত্রি-ফোলিয়া ফাটক এবং উহার সম্মুখে এক পাকা চক নির্মাণ করিয়াছিলেন। এই ফাটকের উপরে শাহী নহবতখানা, নীচে তিনটি সূচীমুখ খিলানের দ্বারা আবৃত ত্রিধা-বিভক্ত প্রবেশদ্বার (স্মৃতি ব্যতীত অন্য কিছুই বর্তমানে অবশিষ্ট নাই) **

* যশোবন্ত কর্তৃক বন্দী শাহজাহনকে আগ্রা দুর্গ হইতে মুক্ত করিবার বিফল চেষ্টার পর সাবধানী আওরঙ্গজেব এই মাটির রক্ষা প্রাচীরকে লাল পাথরে বাঁধাইয়া এক উপদুর্গ প্রস্তুত করিয়াছিলেন এবং উহার বাহিরে আর একটি কাঁচা পরিখা কাটিয়া উহাকে হঠাৎ আক্রমণের আশঙ্কামুক্ত করিয়াছিলেন।

(দ্রষ্টব্য — Kazim’s Alamgirnama, Pers, text p. 423 )

আসল মাটির প্রাচীর সম্ভবত মোরি-দরওয়াজা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

** District Gazetteers of U.P., Vol. VII (Agra), p. 202.]

দুর্গের, পাকা পরিখার কিনারা ঘেঁষিয়া উঠিয়াছে ৬৫ ফুট উচ্চ লাল পাথরে গাঁথা দ্বিতীয় প্রাকার বলয় (Curtain)। ইহার স্থানে স্থানে সুবৃহৎ কোট্টগুল্মক (বুরুজ), প্রাকারশীর্ষে কামান বসাইবার প্রাকার বেদিকা, প্রাচীরের গায়ে অর্ধাবৃত বাহিরের দিকে নিম্নমুখী সারি সারি প্রাকার রন্ধ্র; প্রাচীরের উপরের দণ্ডায়মান যোদ্ধৃগণকে শত্রুর লক্ষ্য হইতে আড়াল করিবার জন্য প্রাকার পালিকার ( rampart) সুরম্য রক্ষাবেষ্টনী। এই প্রাচীর পরিখা ও বাহিরের মাটির প্রাকার ছাড়াইয়া পূর্ব দিকেও দুর্গকে বেষ্টিত করিয়া বৃত্তাকারে নির্মিত হইয়াছিল। ইহার উত্তর-পশ্চিমে দিল্লিতোরণ (হাতিপোল), উত্তরে মোরি দরওয়াজা* (wicketgate), পূর্বদিকে খিজিরী দরওয়াজা (watergate), শাহবুরুজের নীচে দর্শন দরওয়াজা এবং দক্ষিণ-পূর্বদিকে আজমীরি দরওয়াজা (পরে আকবরী ও বর্তমানে অমরসিংহ ফটক নামে পরিচিত)। বাহিরে মাটির প্রাচীরের দিল্লি ও আকবরী ফটক এবং এই দ্বিতীয় প্রস্তর-প্রাকারের উক্ত নামে পরিচিত তোরণদ্বয়ের মধ্যে পরিখা অতিক্রম করিবার জন্য মজবুত মোটা তক্তার টানা সেতু (draw-bridge)। দ্বিতীয় পাকা প্রাচীরের ফটক পার হইবার পর প্রায় ৪০ ফুট শানবাঁধানো চালু রাস্তা চড়িয়া উপরে উঠিলেই আসল দিল্লি দরওয়াজা বা হাতিপোল এবং আকবরী দরওয়াজা। এই প্রাচীরের পরে দুর্গের সর্বাপেক্ষা সুদৃঢ় এবং সুমসৃণ লাল পাথরের দশ ফুট চওড়া শেষ প্রাচীর। ভূমিতল হইতে এই প্রাকারের উচ্চতা ১০৫ ফুট এবং নিম্নস্থ পাষাণ প্রাকারের শীর্ষদেশ হইতে ৪০ ফুট উচ্চ। এই দুই প্রাকারের মধ্যবর্তী অপরিসর স্থানে মাটির ঢালু এবং অসমান উপসর্পণ-পথ। দুর্গের তোরণসমূহ প্রত্যেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ উপদুর্গ (redoubt) বিশেষ। দিল্লি বা হাতিপোল দরওয়াজার দুই পার্শ্বে অতিকায় আকাশচুম্বী সুরম্য গম্বুজ ও “ছত্রী” শোভিত ভীষণ “ভীষণ রমণীয়” কোট্টগুল্ম; উহার বহির্ভাগ হইতে দুইটি আড়াআড়ি পাকা প্রাচীর নিম্নস্থ প্রাকারের ফটককে যেন সজোরে টানিয়া ধরিয়াছে। ঢালুর নিচে ও উপরের ফটকের মধ্যবর্তী সমতল চত্বরে মর্মরবেদীর উপর দুই দিকে দ্বার-প্রতিহারের ন্যায় কৃষ্ণপ্রস্তরখোদিত বিরাট বারণ-যুগল (আওরঙ্গজেব কর্তৃক ভগ্ন ও ইংরেজ আমলে স্থানান্তরিত)––তখন পর্যন্ত আকবরশাহী আমলের আর্যসংস্কার এবং পুনর্জীবন প্রাপ্ত ভারতীয় ভাস্কর্যশিল্পের মহিমার মৌন সাক্ষীরূপে দণ্ডায়মান। এই হাতিপোল দরওয়াজার উপরে শাহী “নক্কারখানা” (বাদ্যভাণ্ডাগার), “আলমখানা” (ধ্বজ পতাকাগার), বালুঘড়ি ও জলঘড়ি, রাজকীয় সময় রক্ষক জ্যোতিষী-নজুমীর কক্ষ, দুর্গপালের দপ্তর ইত্যাদি অবস্থিত; এই স্থান হইতে সময়জ্ঞাপক বড়দামামা বাজিয়া উঠিলেই ভিতরে বাহিরে প্রত্যেক ফটকের নহবতখানা হইতে বাদ্যধ্বনি হইত। এই প্রাকারের গায়ে মাঝে মাঝে উপরে উঠিবার সিঁড়ি, প্রাচীর-শীর্ষে যোদ্ধৃগণের উপসর্পণমার্গ, প্রত্যেক বাঁকে বড় বড় কামান-সজ্জিত কোট্টগুল্ম, গাত্রে প্রাকাররন্ধ্র; অনুচ্চ “মাচী”র (rampart) উপর প্রাকার ফালিকার প্রস্তর মালিকা (battlement)। এই প্রাকারে রক্ষীসেনা ও আহদী বরকন্দাজ ও ফিরিঙ্গি গোলন্দাজগণের অষ্টপ্রহর সজাগ পাহারা। দুর্গের ভিতরে হপ্তচৌকির দ্বিতীয় হইতে পঞ্চম চৌকির অশ্বসাদিগণ প্রাকারের নীচে দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ানখানা (কাছারি) ও কারখানাগুলির চারিধারে মোতায়েন হইয়াছে; দেওয়ান-ই-খাস ও অন্দরমহলের বাহিরে রাজপুত চৌকির তাঁবু।

[*এই দরওয়াজার স্পষ্ট উল্লেখ না থাকিলেও অনুমান করিয়া লইতে হইবে; কারণ দুর্গের জঞ্জাল ও ময়লার গাড়ি অন্য কোনও ফটক দিয়া বাহির করিবার সম্ভাবনা ছিল না। দিল্লি এবং অন্যান্য শহরে সেকালে ইহার জন্য একটি অপরিসর মোরি-দরজা ছিল। আওরঙ্গজেবের আমলে আগ্রা দুর্গরক্ষী কৃপণ খোজা মাতবর খাঁ বার্ষিক দশ হাজার টাকায় এই জঞ্জাল ইজারা দিত (ম্যানুসী বলেন, শুধু হাতির লাদ বিক্রি করিয়া এই টাকা লইত)।]

দিল্লি-তোরণের বাহিরে বাম দিকে দুর্গপালের বাসগৃহ, উহার পর প্রাচীর বরাবর বাদশাহী অস্ত্রাগার, মোটা-সরঞ্জামের কারখানা, শিকারখানার পশুশালা, সম্রাটের হস্তীশালা, অশ্বশালা, উট্টশালা, গোসালা ইত্যাদি পূর্ব-দক্ষিণ কোণে ক্ষুদ্র “মোরি” দরজা বা জঞ্জাল নিকাশের ফটক পর্যন্ত চলিয়া গিয়াছে; দক্ষিণ দিকে প্রাচীরের নীচে প্রহরীগণের চলাচল রাস্তা বাদে “মীনাবাজারে”র সুরম্য চত্বর। ভিতরে দিল্লি-তোরণ হইতে তরুবীথিশোভিত প্রশস্ত রাজমার্গ দুর্গকে প্রায় সমান দুই ভাগে বিভক্ত করিয়া “আকবরী” দরজা পর্যন্ত (বর্তমান অমরসিংহ ফটক) চলিয়া গিয়াছে। এই রাস্তার পূর্বদিকে শাহীমহলের বহিঃপ্রাঙ্গণ, মাঝে মাঝে উদ্যান, এক প্রান্তে ইষ্টক-প্রাচীর ও তোরণসমন্বিত লালপাথরের আকবরী মহাল (পরবর্তী জাহাঙ্গীরী মহাল); পশ্চিম দিকে মীনাবাজারের দক্ষিণ হইতে পর পর বাদশাহী পোশাক-খেলাত প্ৰস্তুত করিবার দর্জির কারখানা, নানাপ্রকার চিকনকাজ, জহুরি স্বর্ণকার ইত্যাদির “কারখানা” (সরকারি কার্যস্থান)। রাস্তার প্রায় অর্ধপথে পূর্ব দিকে দেওয়ান-ই- আমের ময়দান, বিপরীত দিকে প্রাচীরবেষ্টিত সরকারি দপ্তর বা “দেওয়ানখানা”; এইখানে এক কোমর উচ্চ আমিরি দীবানের উপর উজির-আজমের বসিবার স্থান, নিচে ফরাশের উপর দপ্তর। দেওয়ানখানার পরে প্রধান কাজীর আদালত, পরে অন্যান্য বিভাগের জন্য নির্দিষ্ট দেওয়ান বা আপিস (বর্তমানে ধূ ধূ মাঠ)। *

[*দ্রষ্টব্য –
1. Ashraf Husain. Historical guide to the Agra Fort.
2. Latif, Agra Historical and Descriptive. chapter ii.]

সম্রাট আকবরের সময় হইতে আগ্রা দুর্গের দিল্লি-দরওয়াজা বা হাতিপোল ফটকের সহিত কৃতিত্বের স্মৃতি ও সুমঙ্গলের সংস্কার জড়িত ছিল। এই তোরণ কেবলমাত্র সম্রাটের যাত্রা কিংবা কোনও শাহজাদা অথবা বৈদেশিক দূতগণকে সম্বর্ধিত করিবার জন্য উন্মুক্ত হইত, দৈনন্দিন কার্য এবং সর্বসাধারণের যাতায়াতের জন্য আকবরী দরওয়াজা (অমরসিংহ ফটক) খোলা থাকিত। বিদায়ের দিনে বিজয়-সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করিবার জন্য সম্রাট শাহজাহান আদেশ দিয়াছিলেন শাহজাদা দারা তাঁহার বিশিষ্ট সেনাধ্যক্ষগণের সহিত পূর্ণ সামরিক সজ্জায় শোভাযাত্রা সহকারে দিল্লি-তোরণ অতিক্রম করিয়া দরবারে উপস্থিত হইবেন এবং বিদায়ের পর আকবরী দরওয়াজার পথে জয়যাত্রায় বাহির হইবেন। এইজন্য দুর্গের বাহিরে ত্রি-পোলিয়া ফটকের সম্মুখে দারার অনুযাত্রী সামন্ত ও মনসবদারগণের অনুচরবর্গ শোভাযাত্রার জন্য প্রস্তুত হইতেছিল। ভোরের নহবত বাজিবার সঙ্গে সঙ্গেই আকবরী

দরওয়াজা দেওয়ানী সেরেস্তার কর্মচারী ও সরকারি অন্যান্য আমলা, অর্থী প্রত্যর্থী, দরবারী ও জনসাধারণের জন্য যথারীতি খোলা হইয়াছিল। সেকালে আম-দরবারের দিনে দুর্গে কাহারও প্রবেশ নিষেধ ছিল না; দুর্গের ভিতর শাহীরাস্তার ধারে ও ফাঁকা জায়গায় তামাশা ও কেনা-বেচার মেলা জমিয়া উঠিত। বিশিষ্ট অভিজাতবর্গের পর্দানশীন বেগমগণ দরবারের দিন সম্রাটের অন্তঃপুরে তদ্বির তদারক ও সুপারিশের মতলবে কিংবা দরবারের তামাশা দেখিবার জন্য যাইতেন, ভিতরে পুরনারীগণের দরবার বসিত; এই দরবারে সম্রাট-দুহিতা জাহানারা বেগম সম্রাজ্ঞীর স্থান গ্রহণ করিতেন, কনিষ্ঠা রৌশনারার ঈর্ষার আগুন ধূমায়িত হইত।

সম্রাট শাহজাহান শেষ বয়সে জাহানারাকে দুর্গের বাহিরে তাঁহার নিজস্ব প্রাসাদে বাস করিবার অনুমতি দিয়াছিলেন। তিনি সাধারণত অধিকাংশ সময় পিতার কাছেই থাকিতেন, কোন কোন দিন সকালবেলা নিজের প্রাসাদে গিয়া পর্দার আড়ালে দরবারে বসিতেন, বিকালবেলা সম্রাটের কাছে চলিয়া আসিতেন। এই স্বতন্ত্রাধিকার ভগ্নী রৌশনারার অন্য প্রয়োজনে অতি কাম্য হইলেও তিনি লাভ করিতে পারেন নাই; রৌশনারা আশা করিয়াছিলেন ভ্রাতা আওরঙ্গজেব শাহীতক্তে বসিলেই জাহানারার অধিকার তাঁহাকেই দিবেন, তিনিও দিনে দুই বার তাঁহার নিজ হাভেলি হইতে শাহী শান জাহির করিয়া দুর্গে যাতায়াত করিবেন। দারার বিদায় সম্বর্ধনা উপলক্ষে সম্রাটের কুটুম্বিনীগণ আমন্ত্রিত হইয়াছিলেন। তাঁহারাও বেগম সাহেবার সওয়ারীর সহিত নিজ নিজ পদমর্যাদা অনুসারে সাড়ম্বরে প্রস্তুত হইতেছিলেন। আকবরী দরওয়াজার পথেই জানানা মহলের সওয়ারী দুর্গে প্রবেশ করিবে; অথচ ওই রাস্তা অপেক্ষাকৃত জনবিরল, পথিকগণ যেন ভয়ত্রস্ত, মারাত্মক কৌতূহলের বশে মার খাওয়ার উৎসাহ কাহারও নাই।

শাহী অন্তঃপুরের সওয়ারীর হাতি পালকি রাস্তায় বাহির হইলেই লোকজন প্রহার ও অপমানের ভয়ে একশ হাত দূরে আড়াল খুঁজিত; বেগতিকে কোনও হতভাগ্য কাছে আসিয়া পড়িলে সটান মাটির উপর উপুড় হইয়া দুই হাতে মুখ না ঢাকিলে রক্ষা ছিল না। এই অবস্থায় কেহ কিছু দেখিলেও লেখা দূরের কথা, লোকের কাছে বলাও বেতমিজি। বৈদেশিক আগন্তুকগণ অনেকে না দেখিয়া এবং অল্প কয়েকজন কিছু কিছু দেখিয়া অনেক কথা এই সম্বন্ধে লিখিয়া গিয়াছেন; দেশীয় ঐতিহাসিকগণ মামুলী যাহা লিখিয়াছেন উহার অনুক্তি দোষ খণ্ডন করিতে হইলে বৈদেশিক বৃত্তান্ত ব্যতীত গত্যন্তর নাই। এই সামাজিক ইতিহাস সমসাময়িক চিত্র ও শিল্পকলার আলোকসম্পাত ব্যতীত সুষ্ঠুরূপে প্রকাশ পায় না। আওরঙ্গজেবের রাজ্যারোহণের পর নূতন “বেগম সাহেব” রৌশনারার শাহী ঠাট ম্যানুচী দেখিয়াছিলেন। সামুগঢ়ের যুদ্ধের কিছুদিন পূর্বেই তিনি সবেমাত্র দারার তোপখানায় চাকরি লইয়াছিলেন, সুতরাং বিদায়ের দিনে বেগমগণের সওয়ারীর জৌলুস দেখিবার তাঁহার অবকাশ কোথায়?

নিদাঘ মধ্যাহ্নের বেলা পশ্চিমে হেলিতেই আগ্রা দুর্গের দিল্লি-তোরণে শাহী নহবতখানা হইতে আনক-দুন্দুভি-ভেরী-পণব-বিষাণ দিগন্ত কাঁপাইয়া বজ্রনির্ঘোষে বাজিয়া উঠিল। দামামা, নাগরা, ঢোল, সানাই, শিঙ্গার এই গম্ভীর বাদ্যধ্বনি সংকেতে দুর্গের ভিতরে বাহিরে অন্যান্য শাহী নহবতখানা হইতে অনুরূপ বাদ্য আরম্ভ হইল। কিঞ্চিৎ পরেই জাহানারা ও দারার যমুনা তীরস্থ প্রাসাদ হইতে যাত্রার বাজনা শোনা গেল। সম্রাট নন্দিনী প্রিয়তম ভ্রাতাকে বিদায় দেওয়ার জন্য বিপুল আড়ম্বরে দরবারে চলিয়াছেন। তাঁহার সওয়ারীর সর্বাগ্রে বেতদণ্ডধারীসুসজ্জিত অশ্বারূঢ় প্রতিহারগণ ঘোড়া হাঁকাইয়া “দূর বাশ” অর্থাৎ “হঠ যাও” চিৎকার ছাড়িয়া রাস্তা খালি করিয়া চলিয়াছে। প্রতিহার অশ্বারোহীর পশ্চাতে সুদর্শন হস্তিপৃষ্ঠে তৈমুর বংশের সুবর্ণ-সূর্যলাঞ্ছিত রাজধ্বজ, পরে অন্যান্য পতাকা ও বাদ্যভাণ্ডবাহী হাতি, এই হস্তিযূথের পশ্চাতে সশস্ত্র খোজা দেহরক্ষী পদাতিক ব্যূহের মধ্যভাগে মাতঙ্গিনী-পৃষ্ঠে স্বয়ং জাহানারা বেগম; দূর হইতে দর্শনার্থী জনতার পিপাসু নয়ন শাহজাদীর গৌরবমদমত্তা রূপসজ্জা দেখিয়াই দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাইতেছে। সুস্নাতা তৈলমর্দনে ঘনকৃষ্ণা হস্তিনীর পৃষ্ঠে তুলাভরা মোটা “গাদেলা”; উহার উপরে উদর পর্যন্ত দোলায়মান বিচিত্র স্বর্ণতত্তখচিত লাল রুমী বনাতের প্রাবরণ। এই প্রাবরণের উপর বর্ণসমৃদ্ধ কাচসারচিত্রিত সোনার আস্মারী বা হাওদা, হাওদার সামনে ও পিছনে আকবরশাহী “চৌরাসী”* (ঝালরদার সোনালী কাজ করা বনাতের সাজ, কিনারায় উভয় পার্শ্বে ক্ষুদ্র রৌপ্য ঘণ্টিকার কিঙ্কিণী), লেজে সাদা চামর, জঘনদেশে দুই দিকে ভৈ বা গাত্রসেবকদ্বয়ের জন্য নির্দিষ্ট দুইটি রেশমী দড়ির “ঝুলা”। সৌভাগ্যবতী করিণীর কপাল হইতে শুণ্ডাগ্র পর্যন্ত সিন্দূর-রঞ্জিত, গজকুম্ভদ্বয়ে ঝালরদার “রণপিয়ালা” র** কিনারায় চমরীপুচ্ছের দোলায়মান ওড়না, কর্ণমূলে শ্বেতকৃষ্ণ চমরীপুচ্ছের কানপাশা, গলায় বিচিত্র রক্তবস্ত্রের মাল্যবেষ্টনী হইতে লম্ববান বৃহৎ রুপালী ঘণ্টা, পিছনের দুই পায়ে রূপার কড়া, কাঁধের উপর “মেঘডম্বরে”র*** ছায়ায় মুখাবৃত মাহুতের আসন। সুরম্য সুবর্ণকঞ্চুকাবৃত হাওদার মধ্যে বেগমসাহেবার খাস দীবান নাম “পীতাম্বর”****। এই পীতাম্বর একজন বসিবার মতো অনুচ্চ সুখাসন, উপরে রক্তখচিত বস্ত্রের গম্বুজাকার ঘেরা-টোপ, চারিপাশে সোনার “লেসের (Lace) চিকন ডবল পর্দা, ভিতর হইতে পর্দা খেলাপ না করিয়া আসমান জমীন সবকিছুই দেখা যায়। হাওদার বাকি অংশে পিছনে নিম্নতর ঢালু চাঁদিনার ছায়ায় ব্যজনরতা চামরধারিণী, তাম্বুলকরস্কবাহিনী, পানীয়রক্ষিকা ও সর্বপশ্চাতে পিকদানিবাহিকা ইত্যাদির বসিবার স্থান। সুরাট বন্দরের রাজস্ব পিতা যাঁহার পান-খরচের জন্য বরাদ্দ করিয়াছিলেন (Manuci, Storia, I, P. 65), তাঁহার ঐশ্বর্য সহজেই অনুমেয়। জাহানারার রূপসজ্জা দূরের কথা, তাঁহার অনাবৃত নখাগ্র পর্যন্ত প্রাকৃতজনের দৃষ্টিগোচর কিংবা শিল্পীর কল্পনার বিষয়ীভূত হয় নাই। তবে বলা যায় তাঁহার মণিবন্ধে পিতৃদত্ত উপহার অন্তত পাঁচ লাখ টাকার এক শত ত্রিশটি মুক্তাদানার “দস্তবন্দ” নিশ্চয়ই ছিল; সুতরাং ইহার সহিত আরও পঁচানব্বই লাখ টাকার জহরত শাহজাদীর অঙ্গে না থাকিলে মানাইবে কেন?

[* “Chaurasi consists of a number of bells attached to a piece of broad cloth which is tied on before and behind (the back of an elephant) with a string passed through it.”

-(Ain-i-Akbari, Eng. trans., Vol. I, P. 128).

**“Ranpiyala is a fillet for the forehead (of an elephant ), made of bro- cade or similar staffs, from the hem of which nice ribbon and qutas hang down”…qutas are Tibetan yak… white, black of pied (in colour). Ibid, pp. 128,129

*** মেঘাড়ম্বর : দ্রষ্টব্য — Ain i, p. 129। বার্নিয়ার “পীতাম্বর”-কে ভুল করিয়া Mikdanbar লিখিয়াছেন ( Storia, ii, p.72)]

**** পীতাম্বর-
“… Pitambar, which is a dome roofed throne, very brilliant, made of enam- elled gold and highly adorned…” – (storia, ii, p. 72 )]

মহাসেন-দুহিতা বাসবদত্তার সুশীলা ভদ্রবতীর ন্যায় এই বেগম- সোহাগিনী গজঘণ্টাধ্বনিদত্ততালে জঘনস্থলাস্ফালন-রসিত রত্ন-রশনা দোলাইয়া দুর্গতোরণে ক্রমশ অদৃশ্য হইল। বেগম সাহেবার হস্তিনীর পশ্চাতেই অশ্বারোহী, খোজা দেহরক্ষী অশ্বারোহী, অশ্বারূঢ় “খোজা সরা” (খোজা ভৃত্যগণের সর্বাধিনায়ক), “মহল সরা” (প্রধান খানসামা), “নাজীর” (নপুংসক ও খাসীকৃত ভৃত্যবর্গের সর্দার) ইত্যাদি পদস্থ কর্মচারীগণের দীর্ঘ শ্রেণী, দরবারী আমীরগণের ন্যায় এই শিখণ্ডী বাহিনীর ঘোড়া ও ঘোড়ার সাজেও যেন শাহী শান ও তুর্কী দেমাগের ছোঁয়াচ লাগিয়া রহিয়াছে। অশ্বারোহী দলের পিছনে নারীস্কন্ধবাহিত দুই প্রস্থ সোনার পালকি। এই শিবিকাদ্বয়ের কাচসার-রঞ্জিত সুবর্ণ কঞ্চকের রত্নপ্রভা চীনাংশুক প্রাবরণের জালমার্গে বিচ্ছুরিত হইয়া বাহিকাগণের কালো বোরখার উপর বিদ্যুৎ সঞ্চার করিয়াছে। দুর্গমধ্যে আকবরী মহালের তোরণ অতিক্রম করিয়া জাহানারা বেগম পাল্কিতে চড়িয়া “শাহ-বুরুজ” (octagonal tower) প্রাসাদে যাইবেন; এক মহল হইতে অন্য মহলে যাতায়াতেও বেগমগণের মাটিতে পা পড়িত না। প্রত্যেক পাল্কির আটজন পাল্কিবাহিকা দাসীগণের পুরাদস্তুর দামী পোশাক। ইহাদের পরিধানে গঙ্গাজলী ছিটের কষা ইজার, গায়ে “আঙ্গিয়া”, রঙ্গীন “চোলী” (bodice জাতীয়), “তসুখ” ছিট কাপড়ের জানু পর্যন্ত লম্বা সরুহাতা “কুর্তী”, উপরে তদুপরি দরবারী ডবল ভাঁজের আঙ্গরাখা এক পাশে বাঁধা; অঙ্গরাখার উপরে কোমরে জড়ানো কাশ্মীরী শাল; পায়ে চটিজুতা-মাটি হইতে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকিয়া রেশমী কালো বোরখা, কাঁধে পাল্কির রূপার ডাণ্ডা। বেগম সাহেবার খালি পাল্কির পিছনে তাঁহার সহচরী ভদ্রবংশীয়া সৌরিন্ধ্রীগণের (maids of honour) পালকির পাশে পাশে বোরখাওয়ালী চেলি।** ইহাদের পরে অন্দরমহলে “মাতৃকা”গণ নানারকমের ঘেরাটোপ ডুলিতে চড়িয়া চলিয়াছে। ডুলি বাহিকাগণের সহিত সংযোগ রক্ষা করিয়াছে ঘনসন্নিবিষ্ট দশপ্রহরণধারিণী নারী পদাতিক পত্তি; ইহাদের সঞ্চরমাণা অশরীরী কৃষ্ণছায়া দ্বিপ্রহরে নরপতি-পথে অমানিশার অন্ধকার নামাইয়া ভূতলচুম্বী আসন্নবর্ষণা মেঘমালার ন্যায় মন্দাক্রান্তা ছন্দে দুর্গাভিমুখে চলিয়াছে। গুল্ফাবলম্বী রেশমী কৃষ্ণ কঞ্জুকের মধ্যে সুন্দর কুৎসিত, কর্ষিত কাঞ্চন-গাত্রী মোগ্‌লানী, গৌরাঙ্গী তীক্ষ্ণস্বভাবা তাতারী; স্থূলোষ্ঠী, করালবদনা হাবসী, আয়তলোচনা আরক্তিমকপূরগৌরী কাবুলী খোরাসানী সব ডাকা পড়িয়াছে। পদাতিক নারী যোদ্ধৃগণের পিছনে শোভাযাত্রার আঁচলে বোরখাবৃতা পুরুষায়মানা নারী অশ্বসাদির রিসালা। ইহাদের পিঠে তৃণ, কোমরে তরবারি, এক হাতে পতাকাশোভিত দীর্ঘ ভল্ল, অন্য হাতে অদম্য তুর্কী ঘোড়ার বল্গা; এক একজন যেন অবগুণ্ঠনাবৃতা চিত্রাঙ্গদা; ইহাদের পাল্লার ভিতর পড়িলে মানুষ মাত্রই নির্ঘাত ডবল খুন! এই শোভাযাত্রার শেষভাগ আকবরী দরওয়াজার আড়াল হইবার পরেই সন্ত্রস্ত অবরুদ্ধ জনতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া দিল্লি-তোরণের দিকে চলিল।

[*বিধবা মেহেরুন্নিসা সধবা নূরজাহান হইবার পূর্বে তিন-চারি বৎসর শাহীমহলে জাহাঙ্গীরের মাতার এই শ্রেণীর সেবকা-সঙ্গিনী ছিলেন।

** মানবতার অপমান দূর করিবার জন্য আকবর বাদশাহ “গোলাম” “বাদী” শব্দের ব্যবহার নিষিদ্ধ করিয়া উহাদিগকে “চেলা”, “চেলী” বলিবার আদেশ দিয়াছিলেন। ইহা “জগদগুরু” সম্রাটের উপযুক্তই বটে। মোগল দরবার ও অন্তঃপুরে এই প্রথা শেষ পর্যন্ত বলবৎ ছিল।]

বেলা মধ্যাহ্নের পর হইতে শাহজাদা দারার যমুনাতীরস্থিত হাভেলির সম্মুখে ও বাদশাহী রাস্তার উপর দরবারী শোভাযাত্রা মিছিল ক্রমশ দীর্ঘতর হইয়া উঠিয়াছে, ফিরোজ জঙ্গ বাহাদুর, রাও ছত্রশাল হাড়া প্রমুখ রাজন্যবর্গ এবং হিন্দু ও মুসলমান মনসবদারগণ শহর কিংবা শহরের উপকণ্ঠে শিবির হইতে সুসজ্জিত দলবলসহ যাত্রা করিয়া বিভিন্ন পথে এইস্থানে উপস্থিত হইয়াছেন। দুর্গ হইতে শুভ মুহূর্তজ্ঞাপক বাদ্য-সংকেতের কিছুক্ষণ পরেই দারা তাঁহার কনিষ্ঠ নাবালক পুত্র সিপার শুকোকে সঙ্গে লইয়া বাহিরে আসিলেন। দর্শনার্থী জনতার মুহুর্মুহু জয়ধ্বনি দ্বারা সম্বর্ধিত এবং আমীর-ওমরাহ ও রাজন্যগণ কর্তৃক অভিনন্দিত হইয়া পিতা-পুত্র একই হাওদায় উপবিষ্ট হইলেন। অনুযাত্রী সামন্তবর্গের যুদ্ধদামামা এবং শাহজাদার বাদ্যভাণ্ড যুগপৎ বাজিয়া উঠিল, তরঙ্গায়িত যোদ্ধার স্রোত রাজপথ প্লাবিত করিয়া ধীরমন্থর গতিতে দিল্লি-তোরণ অভিমুখে অগ্রসর হইল।

শাহজাদা নিজ হাভেলি হইতে বাহির হইবার পরেই মানুষের চাপে শোভাযাত্রার পথ কাশীর বিশ্বনাথ গলি হইয়া পড়িয়াছিল, দুই পাশে দর্শনার্থী “গণ” দেবতা ফকির কালন্দর (সং “অশ্বৌবস্তিক”) দরবেশের ভিড়; অথচ পথ খালি করিবার জন্য ঘোড়া দাবাইয়া জনতার উপর তুর্কী জুলুম চালাইবার হুকুম নাই। আগ্রা নগরীর জনসাধারণের সহিত দারার নাড়ির টান ছিল। ফকির দরবেশ সাধু-সন্তগণ শাহজাদাকে প্রায় তাহাদেরই একজন মনে করিত। কেহই নিছক তামাশা দেখিবার জন্য কিংবা খয়রাতের আশায় আসে নাই; কেহ কেহ তাঁহার জন্য দাঁতন, তসবী উপহার লইয়া আসিয়াছিল। হস্তিপৃষ্ঠে শাহজাদা নিজের তসবী মাথায় ঠেকাইয়া সকলকে প্রত্যভিবাদন করিলেন, তাহাদের প্রদত্ত সামান্য জিনিস পরম আদরে গৃহীত হইল। শাহজাদার পিছনে তাঁহার খয়রাত ভাণ্ডারবাহী হাতির উপর হইতে তাম্রমুদ্রা ও জামা-কাপড় ইত্যাদি ফকির-মিসকিনের উপর বর্ষিত হইতে লাগিল; শাহজাদা থলি হইতে স্বয়ং রৌপ্যমুদ্রা লইয়া জনতার উদ্দেশ্যে নিসার করিয়া চলিয়াছেন। তোপখানা অপেক্ষা গরিবের আশীর্বাদ ও ফকির দরবেশের দোয়ার উপর তিনি চিরকালই অধিক ভরসা রাখিতেন। শেষরক্ষা হইল না। খোদার মর্জি, মানুষ কেমন করিয়া বুঝিবে ইহাই দাতার শেষ দান?

এই সামরিক শোভাযাত্রার সূচীমুখে শাহজাদা দারার দেহরক্ষী অশ্বারোহীর প্রথম দুই রিসালা (সংখ্যায় সাধারণত ৭৫ সওয়ার) স্থান গ্রহণ করিয়াছে। তুর্কী, ইরাকী ও পারসিক অশ্বপৃষ্ঠে প্রস্তরমূর্তির ন্যায় উপবিষ্ট যোদ্ধৃগণের চরণসংকেতে ঊর্ধ্বকর্ণ বাজিব্যূহ ধীর বল্পিত চালে চলিয়াছে। সওয়ারগণের উন্নত শূলাগ্রে উড্ডীয়মান রক্তপতাকার ঢেউ; শাণিত বর্ষাফলকে প্রতিফলিত রৌদ্রে বিনা মেঘে বিজলী খেলিতেছে। অশ্বারোহীগণের পোশাকের রং, বয়স, জাতি বিভিন্ন, তাহাদের ঘোড়াগুলির বর্ণও এক নহে; অথচ এই বৈচিত্র্যের মধ্যে অসুন্দর কোথায়ও কিছু নাই। আরোহীগণের মাথায় সাদা কালো সবুজ রঙের কলগীদার “দস্তার”, উহার উপর ভিন্ন রঙের রেশমী শিরপ্যাচের আবেষ্টনী, গায়ে গলা হইতে আজানুলম্বিত ছিট কাপড়ের রংবেরং হিন্দুস্থানী “আঙ্গরাখা”, উহার উপরে কোমরে রেশমী কাপড়ের কিংবা শালের আড়াই প্যাচ বাঁদা “পট্‌কা”র দুই প্রান্ত কোঁচার ন্যায় ঝুলিয়া পড়িয়াছে। সকলের পরিধানে সুতী “তসুখ” কিংবা লম্বা ডুরিদার ‘ডোরিয়া” থানের চোঙ্গা পায়জামা (লক্ষ্ণৌর চুড়িদার কিংবা “যোধপুরী” নহে); পায়ে মোজা, পা-তাবা” (মোজার নিচে কাপড়ের ‘মোজা” ত্রাণ); এবং সলিমশাহী নাগরা জুতা। ঘোড়ার পিঠে মোটা কাপড়ের গদির উপর অর্ধেক পিঠ ও দুই পাশ আবৃত করিয়া ঝালরদার লাল বনাতের সাজ, জিনের উপর আরোহীর এক পাশে ছয় কিংবা অষ্ট চন্দ্রশোভিত চর্মাবৃত লোহার ঢাল ও কোষবদ্ধ তরবারি, অন্য পাশে তৃণ ও জ্যামুক্ত ধনুক, কোমরে “খঞ্জর” ও “কাটার” ছুরিকা। .

এই অশ্বসাদির পশ্চাতে সুদীর্ঘ পদাতিব্যূহ-মধ্যে মনোরম দরবারী সাজে চলিয়াছে শাহজাদার বাদ্যভাণ্ডবাহী কুঞ্জরশ্রেণী এবং শাহী-পতাকাবাহী এক অতিকায় গজরাজ। এই বাদ্যভাণ্ডের* সর্বাগ্রে এক এক জোড়া বড় দামামা ও নাগারা (“নক্কারা”), মধ্যে দীর্ঘ বলয়াকৃতি রৌপ্যনির্মিত ইরানি “করানা” বা ইংরেজি বিউগল, এইগুলির জুড়ি ঐরকমের পিতলের তৈয়ারি লম্বা “শিঙ্গা”; ইরানি “সুরনা”, হিন্দুস্থানী সানাই; বাদ্যভাণ্ডের শেষভাগে ছোট দামামা বা বাংলা “দগর”, বাঁশি ও পিতলের “সান্জ”,– অর্থাৎ বাণভট্টের “ঘর্ঘরিকা” বা ইংরেজি cymbal, এই মধুর গম্ভীর বাদ্যনির্ঘোষের অনুগামী পতাকাশোভিত সচল দুর্গ বুরুজের ন্যায় ভীমদর্শন বারণ-পৃষ্ঠে মোগল সম্রাটের অনুকল্প সাম্রাজ্য-ধ্বজাসমূহের অপূর্ব সমাবেশ।

অগ্রবর্তী হাতির পিঠে তৈমুর-বংশের খাস শাহীপতাকা আকবরশাহী আমলের শমসাহ বা সূর্যধ্বজা, এবং সম্রাট শাহজাহানের নবপ্রবর্তিত অর্ধ-চন্দ্র পতাকা (crescent standard)। উজ্জ্বল লাল রেশমী বস্ত্রের উপর সুবর্ণতত্ত্ব পুষ্পিত সূর্যের প্রতীক চিহ্ন এবং রৌপ্যসূত্রচিত্রিত কৃষ্ণাপঞ্চমীর শশিকলা পতাকাদ্বয়ে শোভমান। ইহাদের পরে অন্যান্য হাতির হাওদায় সুবর্ণকেশরী চিহ্নিত “শের মরাতিব”, উচ্চধ্বজ দণ্ডলগ্ন তিব্বতদেশীয় চমরীপুচ্ছের শ্বেতকৃষ্ণ “অবচুলচামর”-স্তবক শোভিত হরজটার ন্যায় ভয়সঞ্চারী জঙ্গিসখানী “তুমান-তোঘ”, পিছনে অপেক্ষাকৃত হ্রস্ব-দণ্ডধৃত চামরকলাপের “চার-তোঘ” এবং সুবৃহৎ হিন্দুস্থানী লাল “ঝাণ্ডা”** পতাকাবাহী শেষ হাতির উপর সম্রাট-প্রদত্ত অধিকারবলে উড্ডীয়মান মনসবদারী “মাহী-মরাতিব” *** কেতন; শুভ্র মসলিন বস্ত্রের জমির উপর সূক্ষ্ম সূচীশিল্পে হরিতাভ মকর শিল্পীর জাদুস্পর্শে প্রাণবন্ত হইয়া সেনাতরঙ্গের ঊর্ধ্বে বাতাসে ভাসিয়া চলিয়াছে।

[*বিবিধ বাজনার জন্য দ্রষ্টব্য–
Ain-in-Akbari, English translations, I, pp. 50-51.
** দ্রষ্টব্য – (I) Ain, I, p. 50-51 Eng trans.
(2) Arms and Jewellery of the Indian Mughals, by Abdul Aziz, chapter 1, Lahore.
*** এই মাঙ্গলিক মকর কেতনের সহিত প্রাচীন আর্য ও ইরানীয় সংস্কার জড়িত রহিয়াছে। প্রাচীন পারসিকগণের বিশ্বাস এই মকর জাতীয় মহামৎস্য প্রলয়পয়োধি জলে নিমগ্না ধরিত্রী হইতে পোতারূঢ় জীব ও মানুষকে রক্ষা করিয়াছিল। দ্রষ্টব্য– Storia, ii, p. 71]

এই বাদ্যভাণ্ডের পশ্চাতে পতাকাবাহী হস্তিযূথের পশ্চাতে বল্লমধারী এবং বন্দুকধারী পদাতিক সেনার মধ্যভাগে যুগল পর্বতোপম মদস্রাবী যুদ্ধহস্তীদ্বয় গাত্রসেবকগণের স্তোকবাক্য-চালিত হইয়া সম্মুখে চলিয়াছে। ইহাদের বেয়াড়া মেজাজ গাত্রগন্ধে আশ্বস্ত করিবার জন্য প্রত্যেকের পাশে স্থাপিতা হইয়াছেন দরবারী সাজে সজ্জিতা তাহার প্রিয়তমা আলানসঙ্গিনী।* এই খাসা জঙ্গীহাতি দুইটি ধ্বজা পতাকাসজ্জিত সচল কোট্টগুল্মের ন্যায় শোভমান। ইহাদের পিঠে ও পার্শ্বদ্বয়ে মজবুত দড়িবাঁধা মোটা গদি বা গাদেলা; গাদেলার উপরে “পাখর” বা কড়াযুক্ত পাত-লোহার বর্ম; বর্মের উপরে তিন ভাঁজ মোটা কাপড়ের গজ-ঝাঁপ; স্কন্ধ, গজকুম্ভ ও শুণ্ডদেশ অনুরূপ বর্মাবৃত। লৌহ-বর্মাবৃত শস্ত্রকণ্টকিত হাওদার বাহিরে পিঠের বাকি অংশের অপর “চৌরাসী” নামক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রৌপ্য-ঘণ্টিকাযুক্ত বনাতের সুরম্য সাজ, গলায় লাল কাপড়ের মোটা মাল্যবেষ্টনী হইতে লম্বমান বৃহৎ বীরঘণ্টা, দুই কানের গোড়ায় সাদা ও কালো চামরের স্তবক, মাথার উপর হইতে প্রায় গণ্ডদেশ পর্যন্ত “আঁধিয়ারী”র দ্বারা আবৃত। এই “আঁধিয়ারী” মোটা চামড়ায় হাতির মাথার উপরে নিম্নমুখী পেরেক-আঁটা এবং মাহুতের পায়ের নীচে মোটা দড়ির সঙ্গে বাঁধা চোখের ঠুলি, মাহুত নীচের দড়িতে পায়ের চাপ দিলেই কাঁটার জ্বালায় হাতি শায়েস্তা হইয়া যায়।

জঙ্গী হাতির হাঁটুর উপর লোহার কড়ার ঝুমকা, দীর্ঘ দত্তদ্বয়ে সোনা-রূপার আংটা, লৌহকবচাবৃত শুণ্ডে যুদ্ধকালে ধারাল অস্ত্র বাঁধিবার কড়া; সামনের এক পা পিছনের দিকে বিপরীত পায়ের সহিত বাঁধা মোটা শিকল।

আকবরশাহী** আমল হইতে বরাদ্দ দৈনিক চারি সের ঘি, পাঁচ সের চিনি, লবঙ্গ- গোলমরিচ সহকারে আধ মণ দুধে অর্ধসিদ্ধ আধ মণ চাউলের কড়া প্রসাদ নিত্য সেবন করিয়া এবং অধিকন্তু শীতের দুই মাস প্রত্যহ তিন শত গাছি আখ চিবাইয়া যাহার দেহ সুপুষ্ট হইত, জাহাঙ্গীর যাহার জন্য কিঞ্চিৎ শরাবের বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন, শাহজাহানের আমলে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীর তাজা লাশের শুরুয়া খাওয়াইয়া যাহাকে নরমাংস-লোলুপ করা হইত সেই জঙ্গী হাতির সামনের এক পায়ের সহিত পিছনের একপা মোটা শিকলে আড়াআড়ি ভাবে না বাঁধিয়া বাহির করিবার উপায় কি?

[টোরী সাহেব লিখিয়াছেন :
“The King (Jehangir) allows everyone of his great elephant four females …they call wives” – Foster’s Early Travels, p. 307 ).
হাতির জন্যও শরিয়ত মাফিক ব্যবস্থাই বটে!
* আনুমানিক ৬৪ তোলা ওজনের কাঁচা সেরের মাপ। দ্রষ্টব্য — Ain. i, p. 130, p. 134]

এই দম্পতি-সখ যুদ্ধহস্তীর পিছনে শাহাজাদার আস্তাবলের খাসা হাতি ও ঘোড়া শোভাযাত্রার গাম্ভীর্য বর্ধন করিয়াছে। হাতিগুলির অসামরিক সাজ, পিঠে হাওদার পরিবর্তে জরদৌজী কিনারাদার বনাতের “চৌরাসী” নামক প্রাবরণ, কপালে সিন্দূর, গলায় রূপার ঘণ্টা। খাসা জঙ্গী ঘোড়ার যত্ন ও সজ্জা শাহী নজরের পরিমাপেই ছিল। যে রঙের ঘোড়া উহার গায়ে ঠিক বিপরীত রঙের মোটা ছিট কাপড়ের তুলাভরা “আরক” (horse quilt)। এই আরতকের উপরে ইস্পাত নির্মিত “বখতর” বা শিকলের তনুত্রাণ। বর্মের উপরে লেজ হইতে গলা পর্যন্ত লম্বা জরদৌজী মখমলের বর্ণভাস্বর প্রাবরণ; ইহার উপরে সোনার উপর মীনা-করা জীন-রেকাব। ঘোড়ার মাথা ও মুখ “তাজা” বা অশ্বমুখ কবচের দ্বারা আবৃত পিঠের আস্তরণের যে জঘনাবৃত অংশ ঝুলিয়া পড়িয়াছে, উহার স্থানে স্থানে সূক্ষ্ম সূচী-শিল্পে সুবর্ণতত্ত্ব-খচিত মাঙ্গলিক চিহ্ন প্রস্ফুটিত পদ্ম। জিনের দুই দিক হইতে লম্বমান উজ্জ্বল লাল রেশমী কাপড়ের ভাঁজ-করা কোঁচা হাঁটুর উপর পড়িয়াছে; সামনের হাঁটুদ্বয়ের উপরেও প্রায় এক হাত লম্বা অনুরূপ দোলায়মান কোঁচা। যুদ্ধাশ্বের গলদেশে রত্নখচিত ‘হুমা” বা অশ্বাবতংস, সম্মুখের উরুদ্বয়ে রূপার উপর মীনা-করা মোটা “তাগা” বা বীরকঙ্কণ, ঘোড়ার ঘাড়ের চুলে হয় হিন্দুস্থানী ছাঁট, না হয় দুই পাশে লম্বমান বিনুনী; ইহাতে স্ত্রী-পুরুষ ভেদ নাই, অশ্বপালের রুচি ও মর্জিমাফিক লিঙ্গনির্বিচার হুকুম। এই সমস্ত আরোহীশূন্য অশ্ব অশ্বসেবকের করধৃত বল্গা চালিত হইয়া সম্মুখে চলিয়াছে।

এই অশ্বরত্নসমূহের পশ্চাতে শাহজাদার খাস সওয়ারীর আগমন সূচনা করিয়া চলিয়াছে জমকালো পোশাকপরিহিত আশাসোঁটাধারী দরবারী শাকরেদ-পেশা বা ভৃত্যবর্গ। শাহজাদার ঐরাবততুল্য বারণমুখ্যের সুস্নাতদেহ তৈলাভিষেকে মসীচিক্কন, কর্ণমূলে এবং পুচ্ছদেশে লম্বমান শ্বেতচামর, গজকুন্তুদ্বয়ে জড়োয়া বনাতের অবগুণ্ঠন, ললাটে সিন্দূর-কুঙ্কুমের জয়-টীকা, কুত্তদ্বয়ের মধ্য উভয় পার্শ্ব হইতে শুণ্ডাগ্র পর্যন্ত সিন্দুরের ক্রম-সংকীর্ণ ত্রিপুণ্ড্রক, গলায় লাল রেশমী কাপড়ের গলবেষ্টনী ও রৌপ্য বীর-ঘণ্টা, হইতে গলদেশ পর্যন্ত পিঠজোড়া বহুমূল্য ঝালরদার বনাতের প্রাবরণ। গজরাজের নিতম্বে রৌপ্য ঘণ্টিকার কিঙ্কিণী, কুক্ষিরজ্জুপ্রলম্বিত ঘণ্টা ও চামর এবং পৃষ্ঠদেশে পতাকাসজ্জিত এই হাওদা-মধ্যে অগ্রভাগে শাহজাদার জন্য নির্দিষ্ট চতুর্দোলের ন্যায় সোনার সুখাসন; সুখাসনের উপরে বহুমূল্য জরদৌজী মখমলের ঝালদার ক্ষুদ্র চন্দ্রাতপ। হাওদার বাকি অংশের উপর সুখাসনের চন্দ্রাতপ অপেক্ষা নিম্নতর স্বতন্ত্র চাঁদিনা। সুখাসনের মধ্যে পিতার সম্মুখে উপবিষ্ট কুমার সিপহর শুকো প্রভাতের বালসূর্যের ন্যায় শোভমান। তাঁহার পরিধানে বর্ণসমৃদ্ধ মণিমুক্তাখচিত বহুমূল্য দরবারী পোশাক, গলায় মুক্তামালা, মাথায় ছোট “দস্তারে”র (দরবারী শিরোভূষণ) উপর পদ্মরাগমণিখচিত (সর-পেচ), ললাটের ঊর্ধ্বদেশে কৃষ্ণপালক শোভিত তৈমুরী “তুররা”। শাহজাদা দারার পরিধানে সাদা মসলিনের পোশাক; উহাতে কোনও আড়ম্বর নাই, সুরুচি ও সংযমের ছাপ আছে। তাঁহার মাথায় হীরকখচিত শিরবষ্টনীবদ্ধ সাদা “দস্তারে”র উপরে সাদা বকের পালকযুক্ত তুররা, গলায় মুক্তার মালা, হাতে সুবর্ণসূত্রগ্রথিত ক্ষুদ্র রত্নমালিকা বা জপের তসবী। হাতি হইতে নামিবার সময় মসলিনের লম্বা আঙ্গরাখার উপর সম্রাট প্রদত্ত সর্বশেষ জরোয়া খেলাতবস্ত্র ও কোমরে জরাউ শালের “পট্‌কা” কষিলেই পুরাদস্তুর দরবারী সাজ হইবে। সুখাসনে উপবিষ্ট পিতা-পুত্রের পিছনে হাওদা মধ্যে ব্যজনরত শ্বেত চামরধারী “চৌরী-বরদার” “খাদার” (পাদুকা-বাহক), “তর্কশ কামান- বরদার” (তৃণ ধনুরক্ষক), “তাম্বুলদার” (তাম্বুল করগুবাহক), “আতাবা-চী” (পানীয়রক্ষক), এবং “সর-খাবাস”-এর (দাস ও ভৃত্যাধিনায়ক) হেফাজতে শাহজাদার দরবারী পোশাক ও তরবারি। সামনে হাতির কাঁধের উপর “মেঘডম্বরে”র ছায়ায় উপবিষ্ট রৌপ্য অঙ্কুশধারী মাহুত।

শাহজাদার বাহনের অনুগামী কয়েকটি সুসজ্জিত হাতির পিঠে চলিয়াছে তাঁহার খাস “জিরাহ্ খানা” (বর্ম, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি যুদ্ধের সরঞ্জাম), “খয়রাখানা” (দান-ভাণ্ডারের মুদ্রা, বস্ত্র ইত্যাদি) এবং “পেশকষ-খানা”র তহবিলে শাহানশাহকে উপঢৌকনের জন্য নির্দিষ্ট বড় বড় থালায় আশরফি ও অন্যান্য বহুমূল্য সামগ্রী।

ইহাদের পিছনে চলিয়াছে পদাতিক রক্ষীবেষ্টিত শাহজাদার দরবারী সোনার পাল্কি, পোশাকে ঠাটে প্রত্যেক পালকির আটজন বাহক যেন এক এক জন হাজারী মনসবদার।

শাহজাদার সওয়ারীর পশ্চাৎভাগে তাঁহার নিজ তাবিনের মনসবদারগণ পরিচারক বেষ্টিত হইয়া চলিয়াছেন। ইহাদের পিছনে পৃষ্ঠরক্ষী অশ্বসাদি।

প্রায় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে এই শোভাযাত্রায় পর পর কুমার সিপহর শুকো, রুস্তম খাঁ বাহাদুর, রাও ছত্রশাল হাড়া, কুমার রামসিংহ কচ্ছবাহ ও অন্যান্য রাজন্যবর্গের পতাকা বাদ্যভাণ্ড, হাতি ঘোড়া পায়দল শাকরেদপেশা ও রণদুর্মদ অশ্বারোহী যোদ্ধৃগণের মিছিল চলিয়াছে। এই দীর্ঘ শোভাযাত্রায় সর্বত্র বৈচিত্র্যের রূপসম্ভার অতি প্রকট, অথচ কোথায়ও দৃষ্টিকটু অসামঞ্জস্য নাই। মধ্যযুগের ইতিহাস অশ্ব-গৌরবের ইতিহাস বলিলেই হয়––“অশ্বা যস্য জয়স্তস্য যস্যাশ্বাস্তস্যা মেদিনী।” দিল্লীশ্বর “নরপতি” কিংবা “গজপতি” নহেন, মুখ্যত তিনি ইরান-তুরান দেশাধিপতির ন্যায় হিন্দুর চোখে “অশ্বপতি”।

অশ্বশাস্ত্রে পঞ্চকল্যাণাদি লক্ষণযুক্ত ঘোড়ার জাতি বর্ণ ও বৈশিষ্ট্যের যাহা পরিচয় পাওয়া যায় মনসবদারী ফৌজে উহার একত্র সমাবেশ হইত; এইজন্য এই শোভাযাত্রায় অশ্বের জাতি বর্ণ ও সাজের বৈচিত্র্য সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় ছিল।

ইরান, ইরাক, আরব ও তুর্কীস্থান হইতে বিদেশী ঘোড়া সেকালে হিন্দুস্তানে প্রচুর আমদানি হইত; কিন্তু উহাতে ভারতবর্ষের তথা প্রাচ্যভূমির শাশ্বত রুচিবৈচিত্র ও রূপের ক্ষুধা মিটিত না। বিদেশি ঘোড়া গুণে ও আকারে শ্রেষ্ঠ হইলেও প্রায় লাল সাদা ইত্যাদি একরঙের হইত, উহাদের মধ্যে মিশ্রবর্ণ কদাচিৎ দেখা যাইত। মানবীর মধ্যে ইরান-সুন্দরীর ন্যায় অশ্বজাতির মধ্যে ইরানী অশ্বিনী সুগঠিত মস্তক, দীর্ঘগ্রীবা, উন্নত নাসিকা, কর্ণ ও নিতম্ব সৌষ্ঠবে অতুলনীয়া অথচ বায়ুগামিনী (ফাঃ বাদ-পা’) হইলেও উহাতে ইরানীর মন উঠিত না। তাহারা সাদা কিংবা ধূসরবর্ণের ঘোড়ার কেশর, পুচ্ছ এবং পায়ে লাল কিংবা কমলা রং মাখাইয়া জমকালো করিত। প্রকৃতি রূপ ও বৈচিত্র্যের ভাণ্ডার উজাড় করিয়া ভারতবর্ষকে দিয়াছিলেন; হিন্দুস্তানে ঘোড়ার রঙের কৃত্রিমতার প্রয়োজন ছিল না, ঘোড়ার জন্মগত বর্ণেই বিচিত্রতার রূপ ফুটিয়া উঠিত। যে রুচি ও মনস্তত্ত্ব এক রঙের কাপড় অপেক্ষা ছাপা ছিট কাপড়কে বাঙলার বাহিরে দেশ-বিদেশে লোকপ্রিয়তা প্রদান করিয়াছে, উহাই এই সামরিক শোভাযাত্রায় যোদ্ধৃগণের বসন ও বাহন নির্বাচনে প্রকাশ পাইয়াছে।

মোগল সরকার মনসবদারী ঘোড়ায় দাগ দেওয়ার মালিক, ঘোড়া পছন্দ করিবার অধিকার অশ্বারোহীর। হিন্দুস্থানের কচ্ছী, সিন্ধী ও মদ্রদেশীয় (পশ্চিম-পঞ্জাব) বর্ণসঙ্কর তাজী ঘোড়া আভিজাত্যে কিঞ্চিৎ ন্যূন হইলেও বর্ণ-বৈচিত্র্যে অধিকতর জনচিত্তাকর্ষক ছিল। *

[*হিন্দুস্থানে মেষচারকগণ ভেড়া ও ছাগলের গায়ে রঙের চাকা লাগাইয়া বৈচিত্র্যের ক্ষুধা মিটাইয়া থাকে।]

একালের তুলনায় সেকালে প্রাণশক্তি ও স্থূলেন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপ-রসের পিপাসা ও জাঁকজমকপ্রিয়তা অধিক ছিল, একালের বালকসুলভ রঙের মোহ সেকালের বৃদ্ধেরাও কাটাইয়া উঠিতে পারেন নাই, দাড়ি পাকিলেও মন তাজা থাকিত, রুচি একঘেয়ে হইত না; শোভাযাত্রার অশ্ব ও অশ্বারোহী ইহার প্রমাণ।

সুসজ্জিত বিবিধ বর্ণের ঘোড়া যেন রাজপথে রূপের তরঙ্গ তুলিয়া চলিয়াছে; কোথায়ও “নীলা”র (সূর্যতেজের মতো উজ্জ্বল ধবল), বামে “অম্বরী” (ধূম্রবর্ম), ডানদিকে চিকনকালো “কুমৈত” ঘোড়া; সামনে হয়তো চিত্র-ব্যাঘ্রবর্ণ “আব্রাশ”, পশ্চাতে ইতস্তত সবুজবর্ণ “হরা”, পিঙ্গলবর্ণ “জরবা”, পাটলবর্ণ “করড়া”, লাক্ষারস রক্তবর্ণ “কুলংগ”, বাদামী “সমন্দ” পাকা তালের রঙ “কিয়াই”, বোলতার বর্ণ “বোল্লাহ্” ইত্যাদি ছাড়া আরও কল্পনাতীত মিশ্রবর্ণের ঘোড়ায় চড়িয়া যোদ্ধৃগণ দরবারে চলিয়াছে।

ইহার উপর রাজপুতের ঘোড়ার মুখে লৌহনির্মিত মুখোশ, কোনটা ব্যাঘ্রমুখ, কোনটা সিংহমুখ, মুখোশের উপর গণ্ডার শৃঙ্গের ন্যায় লোহার “সনীন” (শিং)।

এইবার মানুষের পালা। রাজপুত, পাঠান, সৈয়দ, ইরানী, তুর্কী, তাতার, মোগল অশ্বারোহী প্রত্যেকেই জাতীয় বসন-ভূষণে ব্যক্তিত্ব ও বৈশিষ্ট্য রক্ষা করিয়া চলিয়াছে। সর্বাগ্রে বার্হাবাসী হিন্দুস্থানী সৈয়দগণের ভব্যতাসূচক সাদা পাগড়ির নীচে আরবের সূপর্ণনাসা, চঞ্চল তীক্ষ্ণদৃষ্টি, দৃঢ় সংযত ও বীরত্বব্যঞ্জক গাম্ভীর্য। ইঁহাদের পরে ইতস্তত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে আগুয়ান ইরানীর সুগৌর উন্নত আর্যদেহ, আভিজাত্যব্যঞ্জক ভব্য সংযত পরিচ্ছেদ, গর্বিত স্থির দৃষ্টি; তুর্কী সওয়ারের বিরাট দেহ, গোঁপ দাড়ির দৈর্ঘ্য, চামছাঁটা চুলের উপর পালকযুক্ত কলগীদার দস্তার বা পাগড়ি, দেমাগী মোরগ চাল; কোথায় বা দীর্ঘকায় তাতারী মোগলের শ্মশ্রুবিরল ভাববিকারবর্জিত মুখমণ্ডল, মিটমিটে ক্রূর চক্ষু, মুণ্ডিত মস্তকের উপর পশুলোমের কুল্লা; অসুরাকৃতি বাঘা পাঠানের আধা-কাবুলী পোশাক, অর্ধমুণ্ডিত মাথায় বাবরী ছাঁটা চুল, কুল্লা-বাঁধা সাদা কালো পাগড়ির এলায়িত-পুচ্ছ, “হামবড়া” দাপট ও বেপরোয়া ঝগড়াটে মেজাজ; হিন্দুস্থানী মুসলমানের “না ঘরকা, না বাহারকা” পোশাকের ঠাটে শেখ সৈয়দ ভ্রান্তি ঘটাইবার চেষ্টা।

বুন্দীপতি ছত্রশাল জ্ঞাতিবর্গসহ বিবাহের সাজে দরবারে চলিয়াছেন, অবশ্য চেলির জোড় পরিয়া নহে। রাজপুতগণের পরিধানে ডোরাদার ছিটের মোগলাই চোঙ্গা (ফাঃ চুত, পায়জামা, লম্বা কোর্তা ও আঙ্গাখা, কোমরে শাল কিংবা রেশমী চাদরের ‘পটকা”, গলায় দীর্ঘ হারের লহর, কানে মোতির দুল, কপালে কুঙ্কুমতিলক, বাহুতে তাগা, হাতে বলয়, পায়ে সোনার ‘কড়া”; মাথায় আস্কন্ধলম্বিত চুলের উপর জরোয়া মন্দীল, কেহ কেহ পাগড়ির উপর মোগলাই ঠাটে সাদা কালো বকের পালক চড়াইয়াছে। তখনও রাজপুতদের মধ্যে দাড়ি, গালপাট্টা রাখিবার রেওয়াজ আমদানি হয় নাই। তাহাদের ক্ষৌরকর্ম পরিচ্ছন্ন তেজোদৃপ্ত বদনমণ্ডল সুপ্তমীন হ্রদের ন্যায় প্রশান্ত, কিন্তু চোখ দেখিলে আশঙ্কা হয় ঝড় উঠিতে বিলম্ব নাই। জপ না করিলেও সকলের হাতে জপের নানারকম জপমালা মুসলমানের তসবীর প্রতিস্পর্ধীরূপে বিরাজমান। রাজপুত আফিমের নেশা ও স্বর্গের খেয়ালে বিভোর হইলেও বিলক্ষণ প্রকৃতিস্থ।

জনসমুদ্রের মধ্য দিয়া ধ্বজপতাকাশোভিত হস্তী অশ্বপাতিসঙ্কুল তরঙ্গায়িত যোদ্ধার স্রোত সর্পিল গতিতে বড় চক ও ত্রিপোলিয়া তোরণ অতিক্রম করিয়া দুর্গের মৃত্তিকা প্রাকারস্থ দিল্লি ফটকের সম্মুখে উপস্থিত হইল। এইখানে শাহী পতাকা ব্যতীত সমস্ত পতাকা অবনমিত হইল, বাদ্যভাণ্ড নিস্তব্ধ হইল, মাৰ্গ শৈলে ব্যাহতগতি শৈলস্রোতস্বিনীর ন্যায় সেনাতরঙ্গিনী অভিমানে ফুলিয়া কিয়ৎকালের জন্য ন যযৌ ন তস্থৌ হইয়া রহিল। এইখানে সম্রাটের পক্ষ হইতে শাহজাদাকে বাড়াইয়া লইবার জন্য পদস্থ আমীরগণ উপস্থিত ছিলেন, আমীর- উল-ওমারা শায়েস্তা খাঁ স্বয়ং তাঁহাকে সু-স্বাগত জানাইবার জন্য পরিখার অপর পারে হাতিপোল দরওয়াজায় অপেক্ষা করিতেছিলেন। দুর্গের প্রথম ফটকের সম্মুখে সকলেই একবার কুর্নিশ করিলেন, সম্রাটের পুত্র-পৌত্র ব্যতীত সমস্ত মনসবদার হাতি হইতে নামিয়া অশ্বপৃষ্ঠে ফটক ও পরিখা পার হইলেন। হাতিপোল দরওয়াজায় দারা এবং সিপ্‌হর শুকো দরবারী পোশাকে হাওদা হইতে নামিয়া শায়েস্তা খাঁর সহিত শিষ্টাচার বিনিময় করিলেন এবং তোপধ্বনি ও শাহী নহবতখানার বাদ্যভাণ্ড দ্বারা সম্বর্ধিত হইয়া শায়েস্তা খাঁর সহিত দরবার-ই-আম প্রাসাদের দিকে অগ্রসর হইলেন। শোভাযাত্রার অনুগামী যে সমস্ত মনসবদার পতাকা উড়াইয়া, নাগারা বাজাইয়া শাহী মহল পর্যন্ত আসিবার বিশেষ অধিকার লাভ করিয়াছিলেন, হাতিপোল দরওয়াজা পার হইবার পর তাঁহাদের নাগারা বাজিয়া উঠিল, পতাকাসমূহ আবার উত্তোলিত হইল। দেওয়ান-ই-আমের তোরণের সম্মুখে বাজনা ও পতাকা বন্ধ লইয়া গেল, শাহজাদা হইতে সামান্য সওয়ার পর্যন্ত সকলেই স্ব স্ব বাহন হইতে অবতরণ করিয়া এইখানে শাহী মসনদের উদ্দেশে দ্বিতীয়বার যথারীতি কুর্নিশ করিলেন। দেওয়ান-ই-আমের ফটকে উজির-ই-আজম জাফর খাঁ পাল্কি চড়িয়া শাহজাদাকে অভিনন্দন জানাইবার জন্য উপস্থিত ছিলেন। শাহজাদা ঘোড়া হইতে নামিয়া মেসো জাফর খাঁকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করিলেন এবং তাঁহারা স্ব-স্ব পাল্কিতে চড়িয়া অন্য ফটকের মধ্য দিয়া মুসাম্মন-বুরুজ প্রাসাদের দিকে চলিলেন।

দুর্গমধ্যে লোকে লোকারণ্য, এখানে-সেখানে মেলা ও তামাশা, সমস্ত খালি জায়গা মানুষ ও ঘোড়া হাতিতে ভরিয়া গিয়াছে, শাহানশার দৌলতে খোলা ময়দানে রাস্তায় রোদ নাই, দ্বিপদ-চতুষ্পদের জন্য পানীয়জল সরবরাহের এলাহি ব্যবস্থা। কিছুক্ষণের মধ্যেই শোভাযাত্রার আরোহীশূন্য হাতি ঘোড়া হাতিপোল দরওয়াজা হইতে দক্ষিণে আকবরী দরওয়াজা পর্যন্ত সুপ্রশস্ত ছায়াবীথিশোভিত দুর্গমধ্যস্থ রাজমার্গের উপর যথাযথভাবে স্থাপিত হইল, জানোয়ারের সইস মাহুত চৌকিদার পালা করিয়া মেলায় ভিড় জমাইতে লাগিল। দরবারে বিশেষ ভাবে আমন্ত্রিত রুস্তম খাঁ বাহাদুর ও অন্যান্য মুসলমান মনসবদারগণ এবং রাও ছত্রশালপ্রমুখ রাজন্যবর্গ সম্রাটের উচ্চপদস্থ কর্মচারীগণ কর্তৃক অভ্যর্থিত হইয়া দেওয়ান-ই-আমের সভামণ্ডপে প্রবেশ করিলেন; এবং শাহী মসনদকে একবার কুর্নিশ করিয়া যথাযোগ্য স্থান গ্রহণ করিলেন। তাঁহাদের অনুযাত্রী যোদ্ধা ও ভৃত্যগণ বস্ত্রমণ্ডপের বাহিরে শামিয়ানার ছায়ায় দণ্ডায়মান রহিল, অন্যান্য মনসবদার ও দরবারীগণের স্থান বস্ত্রমণ্ডপে নির্দিষ্ট ছিল।

দেওয়ান-ই-আমের বাহিরে দেহরক্ষী আহদী অশ্বসাদি, বন্দুকধারী পদাতিক বাহিনী, শাহী আস্তাবলের জঙ্গী হাতি, ঘোড়া, উট, বলদ দরবারী সাজে সজ্জিত হইয়া দরবারের প্রারম্ভে যথারীতি সম্রাটের দৃষ্টিপ্রসাদ লাভ করিবার জন্য (Review) শ্রেণীবদ্ধ হইতেছিল; শাহজাদার হাতি ঘোড়া ও অশ্বারোহী সেনা ইহাদের পশ্চাতে দরবার প্রাঙ্গণ পরিক্রমা করিবার জন্য প্রস্তুত রহিল। দরবার বসিবার বাজনা তখনও বাজে নাই। এই অবসরে দরবারীগণ পরস্পরের সহিত সামাজিক শিষ্টাচার বিনিময় ও কুশল জিজ্ঞাসায় এবং সমপদস্থগণের সহিত হাস্য পরিহাসে মাতিয়া উঠিলেন; বাহিরে সওয়ার খিদমতগার সকলেই গা এলাইয়া একটু বিশ্রামের অবকাশ পাইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *