২১. এক বিয়োগান্ত ইতিহাসের পরিসমাপ্তি

শেষ অধ্যায়- শাহজাদা দারাশুকো : এক বিয়োগান্ত ইতিহাসের পরিসমাপ্তি

সামুগঢ়ের প্রাতিকূল্য পরাজয়ের পর, প্রায় ছয় মাইল দূরবর্তী এক ছায়াঘন বৃক্ষতলে হয়রানি ও হতাশায় অশ্বারূঢ় শাহজাদা দারা ‘পাগ’ খুলিয়া বসিয়া পড়িলেন। সংবিত্তি প্রায় অস্তমিত। দূর হইতে ভাসিয়া আসিতেছে বিজয়োল্লাসে নচ্ছার আওরঙ্গজেবের নিক্কারা’র ধ্বনি। সানয়নে বলিয়া উঠিলেন : এখন তো আমি সর্বনাশা নৈরাজ্যের এক্তিয়ারে। ইতর- ‘বদতবারে’র সম্মার্জনী-সম্পাত এইখানেই হইয়া যাক না কেন? কিন্তু সশঙ্ক সঙ্গীগণ তাঁহাকে স্বকীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করিতে তখনও উন্মুখ। রাত্রি নয় ঘটিকায় দারা আগ্রায় ফিরিয়া আসিলেন; পরাজয়ের গ্লানি ও অপমানে নিজ প্রাসাদ-প্রকোষ্ঠে আত্মগোপন করিয়া রহিলেন। কেবল আগ্রা দুর্গ ও বিভিন্ন মহল্লায় ‘গুমঘুম’– নিস্তরঙ্গতা — ভঙ্গ হইয়াছিল। সর্বত্র ‘হায় আল্লাহ্’-র বিলাপধ্বনি। শাহজাহান পুত্রকে ডাকিয়া পাঠাইলেন; কিন্তু দারার মনের অবস্থা তখন বিবাগী ‘দিওয়ানা’র মতো। পিতাকে লিখিলেন : এই পোড়াকপালের কলঙ্কিত চেহারা দেখিয়া লাভ কি? কেবল ‘দোআ’ ভিক্ষা করিতেছি—সম্মুখে এক অজানা দীর্ঘপথ—মুক্তিপথের মানচিত্রটি আঁকিয়া চলিয়া যাই।

শেষরাত্রি তিন ঘটিকায় অন্যান্যদের মধ্যে বেগম নাদিরা বানু, পুত্র সিহর ও পিষ্ট পরিশ্রান্ত দশহাজারের একদল রিশলাহ্ – অশ্বারোহী সৈন্য––তাঁহার সহিত দিল্লির পথ ধরিলেন। আগ্রা দুর্গে যবনিকা পতনের সংবাদও আসিল সাতদিনের মধ্যে—বৃদ্ধ শাহজাহান মুসম্মন বুর্জ-এ নজরবন্দী (৮ জুন, ১৬৫৮)। প্রথমে এই বেইমান পুত্রটিকে আগ্রাদুর্গের ফাটক বন্ধ করিয়া ফাঁদ পাতিবার উপায় খুঁজিয়াছিলেন। কিন্তু উহা সীমিত প্রয়াস মাত্র। আওরঙ্গজেবী দাওয়াই ছিল, যমুনা হইতে পানীয় জল সরবরাহ ব্যবস্থা বানচাল করিয়া দেওয়া। বৃদ্ধ পিতা তিন দিন জল না খাইয়া ছিলেন। পরে পুত্রকে লিখিয়াছিলেন : হিন্দুরা মরণোন্মুখ ব্যক্তির মুখেও পানীয়রূপ শান্তিবারি দেয় আর তুমি পুত্র হইয়াও তৃষিত বৃদ্ধ পিতার প্রাণান্ত পরিচ্ছেদ টানিয়া আনিতেছ। আওরঙ্গজেবের ঔদ্ধত্য জবাব দিল : ‘ইহা আপনারই কৃতকর্মের সন্তাপ বলিয়া মনে করুন’।

পশ্চিমে, বাস্তুচ্যুত দারা বার বার এই জীবনখেলায় প্রবঞ্চিত হইয়াও জম্মু পর্বতমালার রাজা রাজরূপ-এর সহায়তার আশ্বাস পাইলেন। নাদিরা নিজ স্তনাগ্র হইতে দুগ্ধ মন্থন করিয়া রাজরূপকে পাঠাইয়া দিলেন— পুত্রজ্ঞানে স্নেহ সম্ভাষণ জানাইতে; দারার উদ্ধারে তিনি যেন সহায় হন। কিন্তু নিছক কয়েক লক্ষ টাকার অপব্যয়ও অযৌক্তিক আসক্তি। বিপ্রতীপ মতের পরিচয় পাইতে বিলম্ব হইল না। আওরঙ্গজেব রাজরূপের নিহিত অনুরাগের বিলুপ্তি ঘটাইল, আরও মোটা অঙ্কের মুখ দেখাইবার প্রতিশ্রুতি দিয়া। আজমীরের নিকট (সাড়ে চার মাইল দক্ষিণে) দেওরাইর যুদ্ধে রাজরূপের মুখোশ খুলিয়া পড়িয়াছিল। দারাকে যখন বিশ্বস্ত শাহনওয়াজ খাঁ ও ইয়োরোপীয় গোলন্দাজ বাহিনী ব্যূহ রচনা করিয়া অবস্থা আয়ত্তে আনিবার চেষ্টা করিতেছেন তখন রণপণ্ডিত আওরঙ্গজেবের উপস্থিতিতে রাজরূপ নাদিরার দুগ্ধ চাখিয়াও খোক্‌মা পর্বতের পশ্চাদবর্তী এক অরক্ষিত পথ ধরিয়া উঠিয়া গেল, শাহনওয়াজের নিপাতনের পথ প্রশস্ত করিতে। এক কামানের গোলাতে শাহনওয়াজের মৃত্যু হয়। একমাত্র সেনাপতি ফিরোজ মেওয়াতি ছাড়া দেওরাইর যুদ্ধে দারার সমব্যথী সমর-কুশলীদের মধ্যে আর কেহ রক্ষা পায় নাই।

১৪ই মার্চ, ১৬৫৯ দেওরাইর ধকলের পর সারারাত একনাগাড়ে অশ্বারূঢ় হইয়া দারা তাঁহার আশংসিত দুঃখের ভাগীদারদের লইয়া যোধপুরের কাছাকাছি আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কিন্তু পিছনে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হইতেছিল জয়সিংহ ও যশোবন্তসিংহ–মতলবী আওরঙ্গজেবের স্নেহবৃত্ত দুই রাজপুত। পনের দিনে দারা আহমদাবাদের কাছাকাছি পৌঁছিতে পারিয়াছিলেন বটে; কিন্তু তাঁহাকে বন্দী করিবার ও পরিব্রাজন রোধ করিবার নির্দেশপত্র প্রায় সমগ্র কচ্ছ, গুজরাট ও রাজস্থান এলাকাতেও পাঠাইয়াছিল জয়সিংহ। ফরাসী চিকিৎসক বার্নিয়ে এই সময়ে তিনদিন দারার সহিত ছিলেন — জনৈকা মহিলার পায়ের দুষ্ট ক্ষত সারাইবার জন্য তাঁহার এই অনুব্রজা। কিন্তু তাঁহারা আহমদাবাদে প্রবেশ করিতে অসমর্থ হইলেন। সুবেদার সৈয়দ আহমদ বোখারী ওইস্থানে বন্দী, এই দুঃসংবাদে দারা হতোদ্যম—তাঁহার হিতাহিত জ্ঞান একেবারে লোপ পাইয়াছিল। ‘কি করণীয়, কোন্ পথ প্রশস্ত’, ইহা লইয়া একজন সাধারণ সৈনিকের সানুবন্ধ মন্ত্রণাও গ্রহণ করিতেছিলেন! ওই অঞ্চলে কৌনি ডাকাতের দলও সক্রিয় জানিতে পারিয়া দারা তাঁহার কারওয়া সরাইখানাতে বার্নিয়েকে রাত্রিবাস করিতে অনুরোধ করিয়াছিলেন। তাঁহার তাঁবু পর্যন্ত ছিল না, মহিলাদের পর্দা রক্ষা করিবার জন্য একখানি কনাত্‌ গাড়ির চাকার সহিত বাঁধিয়া দেওয়া হইয়াছিল। উহারই এক পার্শ্বে বার্নিয়ের এক বিভাবিত বিভাবরী; তাঁহার জন্য একটি অতিরিক্ত উট বা ঘোড়া সংগ্রহ করাও দারার সামর্থ্যের বাহিরে ছিল।

আহমদাবাদের পথ অবরুদ্ধ দেখিয়া দারা স্বপারিষদ পশ্চিমে করী অঞ্চলের কোনি ডাকাতদলের ‘রবিনহুড’ কনহৌজির নির্ভেজাল সাহচর্যে কচ্ছের সীমান্তে উপস্থিত হইতে পারিয়াছিলেন। এই তস্কর যেন জয়সিংহ, যশোবন্তের রাজপুত ‘বীরধর্ম’ উপহাস করিয়া ছিন্নমূল এক শাহজাদার বিপত্তারণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। দারার পরিধেয় বস্ত্র তখন একখানি পলকা ‘নীম’ (নিমা) ও এক জোড়া আধুলি মূল্যের পয়জার! কচ্ছের রাওয়ের রাজধানী ভূজ-এ দারা দুই দিনের অধিক অবস্থান করিতে পারিলেন না, কারণ রাও, জয়সিংহের পত্রে যে ভীতিপ্রদর্শন ছিল, উহাতে এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সামিল হইতে চাহেন নাই। অতপর দারার একমাত্র গন্তব্যস্থল মনে হইয়াছিল কান্দাহার হইয়া পারস্য দেশ। কিন্তু প্রগমনে যেমন বাধা, পশ্চাতে জয়সিংহের জমাট আক্রমণ রচনা। দারাকে ধরিবার জন্য এক অদম্য উৎসাহে জয়সিংহ কচ্ছের ‘রান’-এর লোনা বিল অতিক্রম করিয়া ছুটিয়া আসিতেছিল। দুর্বার গতিতে এই অবিশ্রান্ত অগ্রগমন আশি মাইল–চন্দ্র অস্তমিত হইবার পরও মশালচী তাহাকে পথ দেখাইয়াছে। সিন্ধু নদের পূর্বপ্রান্তে আসিয়া দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত ফিরোজ মৌওয়াতীও বিভ্রান্তি কামনা করিয়া বিদায় নিল। একমাত্র গুল মুহম্মদ ছিল দারার শেষ ভরসা––যিনি সামীপ্য রক্ষা করিয়া চলিয়াছিলেন।

বালুচিস্তানে উপস্থিত হইবার পর ওই অঞ্চলের ময়অসি উপজাতিরা এই উদ্বাস্তুর দলটিকে কান্দাহারে পৌঁছাইয়া দিবার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল। কিন্তু হারেমের মহিলারা––বিশেষ করিয়া নাদিরা, এই প্রস্তাবে প্রমাদ গণিয়াছিলেন। আত্যন্তিক আশঙ্কায়, বে-ইমানের রূপ ধরিয়া ওই বালুচরা যদি লাম্পট্যে অদ্বিতীয় শাহ-র হারেমে তাহাদের ঢুকাইয়া ইজ্জত হানি করে! অবশেষে দারা সীমান্ত প্রদেশের দাদর-এ (বোলান গিরিবর্তের নয় মাইল পূর্বে) উপস্থিত হইলেন। হতাদর হতচেতন শাহজাদা দুর্গাধ্যক্ষ পাঠান মালিক জীওনের নিকট আশ্রয়প্রার্থনা করিয়াছিলেন। ভাগ্যবিধাতা তাঁহার বিবৃত্তির অবসান ঘটাইলেন এক বিবেকহীন বিভীষণের সম্প্রাপ্তিতে। এই পাঠানের রক্তে ছিল তুর্কি আর ইহুদির চারিত্রিক তমঃগুণ—অহংভাব, আসুরিক হিংস্রতা ও কামান্ধতা। জীবনের স্বাগত সম্ভাষণ ও সহাস্য বদনের অন্তরালে আদৌ কোনও আপীড়নের সম্ভাবনা থাকিতে পারে, দারা তাঁহার সহজ বুদ্ধিতে উহা বুঝিয়া উঠিতে পারেন নাই।

কিন্তু মেঘাড়ম্বর আঁধির রূপ নিল। দাদরে উপস্থিত হইবার পূর্বেই নাদিরা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিলেন (৬ই জুন, ১৬৫৯)। দারার ভগ্ন সংসারের সারটুকুই সেদিন যেন উবিয়া গেল। প্রায় নিরন্ন, নির্বস্ত্র, নির্গ্রহ দারার নিকট নাদিরা ছিলেন দুর্দিনের দীর্ঘিকা। সীমাহীন দুঃখে সান্ত্বনা জোগাইয়াছিলেন এই মহীয়সী মহিলা। হিন্দুস্থানের মাটিতেই কবরস্থ হইবার নাদিরার শেষ ইচ্ছাটুকু দারা পূর্ণ করিয়াছিলেন। লাহোরে পীর মিয়া মীরের পবিত্র সমাধি প্রাঙ্গণে দেহটি প্রোথিত। এই বিচ্ছেদবেদনায় শাহজাদা অন্যান্যদের বলিয়াছিলেন, তাঁহার দুঃখে হিস্যাদার না হইয়া, আওরঙ্গজেবের ‘তুহফাহ্’ হিন্দুস্থানেই তাহারা অবস্থান করিতে পারে। তিনি স্বেচ্ছায় পারস্যদেশে নির্বাসন দণ্ড ভোগ করিবেন, আজ্ঞাবহ হইবার আর কাহারও প্রয়োজন নাই। শেষ পর্যন্ত পুত্র সিপহর ও কয়েকজন প্রভুভক্ত পরিচালক ছাড়া অন্যান্য সকলেই স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করাই যুক্তিযুক্ত মনে করিয়াছিল। নিরবলম্ব দারা তখনও মালিক জীওনের জিম্মায় সান্ত্বনা খুঁজিতেছিলেন––বিশ্বাস ছিল, সে বদ-তবারী- ইতরের ভূমিকায় নামিবে না। উহার কারণও ছিল। একদা এক ঘৃণ্য অপরাধে অভিযুক্ত ওই মালিককে হাতির পায়ের তলায় ফেলিয়া দিবার হুকুম দিয়াছিলেন শাহজাহান; কিন্তু পুত্রস্নেহে সম্রাট তাঁহার দস্তানা-রূপী দারার মনোবেদনার ওকালতি উপেক্ষা করিতে পারিলেন না। জীওন হস্তিপৃষ্ঠে আরূঢ় হইয়া নিরাপদে গৃহাভিমুখে যাত্রা করিয়াছিল। সেই সম্প্রাপ্তি বিস্মৃত হইয়া জীওন ‘শিরিন্ গার্’– মুখে মধু লইয়া, লৌকিকতার ভণ্ডামির ভিরকুটি প্রদর্শন করিয়া, কান্দাহারের পথে তাহার পাঠান দানব-গোষ্ঠীকে লইয়া দারাকে ঘিরিয়া ফেলিল। সাধ, সাধ্য, রুটি— যাঁহার কোনটাই ছিল না, সেই শাহজাদা দারার দেশান্তরী হইবার স্বপ্নটুকুও মুছাইয়া দিল বিগত রজনীর ওই মুসাহির -চাটুকার মালিক। পুত্র সিপরকে যখন হাতবেড়ি পরানো হইতেছে তখন সন্তপ্ত দারা সখেদে বলিয়া উঠিয়াছিলেন, ‘এইবার কতল করিলেই তো হয়, দুশমন! কোনও শাহজাদার হাতে এই অশ্রদ্ধেয় অলঙ্কার কে কবে দেখিয়াছে? আজ তোমার এই বে-ইমানির প্রতিভাস! একদিন তোমারই জাল রিহাঈ-এর ওকালতি করিয়াছিল কে, স্মরণ করিতে পার?’ কিন্তু ওই পাথর ভ্রুকুটিভঙ্গে মর্দিত হইবার ‘মালিক’ নহে। মোহমদে সে তখন সদ্যধৃত শাহজাদাকে ‘জিন্দা পীর” আওরঙ্গজেবের নিকট পাঠাইয়া, উপাধিবৃষ্টির অতিরিক্ত, নূতন ‘মউরূস’-ই পাট্টার স্বপ্নও দেখিতেছে। দুই মাসের মধ্যেই তিন দুরাত্মা জয়সিংহ, বাহাদুর খাঁ ও বক্তিয়ার (জীওনের নবলব্ধ উপাধি), অব্যর্থ আওরঙ্গজেবী দাওয়াই প্রয়োগ করিবার জন্য দারা ও সিপরকে দিল্লি লইয়া আসিল।

তড়িঘড়ি মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা না করিয়া, আওরঙ্গজেব তাহার বিশ্বস্ত চেলা – আর এক মহাপাতক—নজরবেগকে বন্দীদের ‘তজবীজ’— তদারকির ভার দিয়াছিলেন। ২৯শে আগস্ট দিল্লির বর্তমান চাঁদনিচৌক ধরিয়া এক ‘শোভাযাত্রা’ বাহির হইল এক স্থূল রসিকতায়। উদ্দেশ্য, দিল্লির আবাসিকগণ নিঃসংশয় হউক, দ্রোহিতার দ্যুতি নিভিয়াছে। ওই আদাড়ের হাঁড়ির – দারার শেষ আদলটুকু তাহারা দেখিয়া যাক! ‘জিন্দা পীর’ বলিয়া ভক্তরা যাহার উপর দেবত্ব আরোপ করিয়াছিল, তাহার কি রসবোধ! হাওদা-হীন কর্দমলিপ্ত হ্রস্বকায় একটা মাদীন হাতিতে দারা ও সিপহর সমারূঢ়, পশ্চাতে খোলা তরওয়াল উচাইয়া রহিয়াছে নজরবেগ। ঝোড়ো হাওয়ায় বেতস দণ্ডের ন্যায় দারার আনত শির, মস্তকোপরি ভাদ্রের খররৌদ্র। বার্নিয়ে তাঁহার ‘আঁখো দেখা হাল’-এ এক হৃদয়বিদারক চিত্র তুলিয়া ধরিয়াছেন : কর্ণকুহরে কেবল ভাসিয়া আসিতেছিল উত্তাল ক্রন্দনধ্বনি, বিলোড়িত বিলাপোক্তি। দারার নসিবের এই নিকৃতিতে পুরুষ, মহিলা, শিশুর নয়নোপ্রান্ত হইতে অবিরল অশ্রুধারা। তাআর্জুর বলিয়া এক ভিক্ষুক হঠাৎ চেঁচাইয়া উঠিয়াছিল—’একদিন তোমার নিকট হইতে মুঠি ভরিয়া ভিক্ষান্ন লইয়া আসিয়াছি, সেই তোমারই আজ অপারগ, সম্বলহীনের সুরৎ! ভিখারি সাজাইয়া এই রঙ্গ!’ মর্মান্তিক বেদনায় বিচলিত অশ্রুসিক্ত দারা উত্তরীয়খানি উন্মোচন করিয়া ওই ভিখারিকে ছুঁড়িয়া দিয়াছিলেন। অথচ এই রাজর্ষিকেই ছোবল মারিতে উদ্যত এক রাগান্ধ রাজসর্প।

ওইদিনই সন্ধ্যায় আওরঙ্গজেব দিওয়ান-ই-খাসে আসর বসাইলেন। আলোচ্য বিষয় : আসামির প্রাণদণ্ড না গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দীদশায় পোস্ত-ভিজানো জল খাওয়াইয়া বিষক্রিয়ায় বিলম্বিত কিন্তু অব্যর্থ প্রাণনাশ। দনিশমন্দ খাঁ গোয়লিয়র দুর্গ ব্যবস্থা সমর্থন করিলেও আওরঙ্গজেবের আহ্লাদী ভগিনী রৌশনারার যেন একটা তাৎক্ষণিক তাগিদ ছিল––দারাকে ‘জাহান্নাম’-এ পাঠাইবার জঘন্য প্রস্তাব।

পরদিন ৩০শে আগস্ট আর একটি শোভাযাত্রায় বাহির হইয়াছিল ‘বক্তিয়ার’–ওই মালিক জীওন। বজ্জাতি ও বকবৃত্তির খেতাব লইয়া, দারার গ্রেফতারির সম্মানে আদাব আদায় করিবার সঙ্কল্পে। কিন্তু এই নীচতাকে ক্ষমা করিবে কে? বাধিয়া গেল দাঙ্গা। ভ্ৰাম্যমাণ জীওনের ভাগ্যে জুটিয়াছিল ‘সাবাশ’ ধ্বনি নহে, মুর্দাবাদের উদ্যত মুষ্টি। উপরন্তু লোষ্ট্রাঘাত, ছাদের উপর হইতে মহিলারা ছাই, কুজাভর্তি মূত্র, এমন কি ‘মালিক’-এর মস্তকোপরি মল নিক্ষেপ করিয়া ক্রোধ প্রকাশের উপায় খুঁজিতেছিলেন। শেষ পর্যন্ত কোতোয়ালের প্রহরায়, বিমূঢ় জীওন মাথার উপর ঢালখানি ধরিয়া মস্তকাভিষেক’ পর্বের ইতি টানিয়াছিলেন। পরে এই দাঙ্গার উস্কানিতে যাহার মুখ্য ভূমিকা ছিল, আওরঙ্গজেবের নির্দেশে ওই বেতমীজ ধৈবত-এর দেহখানি আড়ি দ্বারা দ্বিখণ্ডিত করা হইয়াছিল। এই অপমানকর ঘটনাটি ছিল দারার ভাগ্য আবর্তনীয় যতি-চিহ্ন।

অনতিকাল পরেই নজরবেগ কতিপয় কুপোষ্যসহ দারা ও সিপহর-এর কারাকক্ষে উপস্থিত হইল। বিষদিগ্ধ খাদ্যে ভ্রাতা তাহার ‘তদ্বীর’ করিবে এই শঙ্কায় দারা স্বপাক আহার করিতেন। যখন নজরবেগ উপস্থিত, তখন তিনি ডাল সিদ্ধ করিতে বাসিয়াছেন! উন্মুক্ত তরবারিসহ ওই তস্করদের দেখিয়া সিপ্‌হর আর্তনাদ করিয়া উঠিল। পিতা পুত্রকে বুকে ধরিয়া সশঙ্কচিত্তে প্রশ্ন করিলেন, ‘খুনের হুকুমনামা পাইয়াছ কি?’ কুব্জদেহী নজর সিপহরের প্রতি গর্জিয়া উঠিল, তফাত যাও! অশ্রুবিপ্লুত দারার শেষ মিনতি ছিল : ভ্রাতাকে একবার শুধু নিবেদন কর যেন এই নির্দোষ ভতিজাটিকে রেহাই দেয়। নজরের ঔদ্ধত্য জবাব : আমরা কোনও বাতুলের বার্তাবহ নহি! বাদশাহর হুকুমই তামিল করিয়া যাইব। ইহা বলিয়া আলিঙ্গনাবদ্ধ ওই আত্মজটিকে পিতার বুক হইতে টানিয়া তুলিল। হিংস্র পশু থাবা মারিবার আগে মানুষ মরিয়া হইয়া যেমন একবার রুখিয়া দাঁড়ায় সেই সংযতাত্মা দারা তকীআ-র ভিতরে রক্ষিত একখানি ক্ষুদ্র জেব-ছুরিকা বাহির করিয়া ছুটিয়া আসা এক বান্দার শরীরে সান্ধাইয়া দিলেন। মুহূর্তে ওই কতলগোষ্ঠী দারার উপর ঝাঁপাইয়া পড়িল। অতঃপর শিরশ্ছেদ। পার্শ্ববর্তী কক্ষে তখনও সিপহরের কাতরোক্তি ভাসিয়া আসিতেছিল। ছিন্ন মুণ্ডটি আওরঙ্গজেবের নিকট উপস্থিত করা হইলে শ্রদ্ধাহীনের ঔদ্ধত্য লইয়া ওই ‘জিন্দাপীর’ বলিয়াছিল : ‘হায়, বঢ়ে ভকত্ (হিন্দু-ঘেঁষা বড় ভক্ত)! এই স্বধর্মত্যাগীর জীবদ্দশায় তাহার মুখদর্শন করি নাই, এখনও করিব না।’ দারার দৌমনস্য ও প্রহর্তার ভূমিকায় আওরঙ্গজেবের ইতিহাস এষণার পরিসমাপ্তি এইখানেই হইতে পারিত। কিন্তু সমসাময়িক ফার্সি গ্রন্থে অনুল্লেখ থাকিলেও, ম্যানুসি তাঁহার ‘Storia Do Mogor’ এ যে হৃদয়মর্দিত দিনান্তের শেষ রাগিণী শুনাইয়াছেন তাহা উল্লেখ করিতে হয়। পরিহাসপ্রিয়তায় নহে, চরম নিষ্ঠুরতায়, ওই ‘অতিমানব’ বলিয়া চিহ্নিত আওরঙ্গজেব ছিন্ন মুণ্ডটি একটি পেটিকায় পুরিয়া বাদশাহ শাহজাহানের জন্য আগ্রায় পাঠাইয়াছিলেন! এই রগরগে প্রস্তাবটি আসিয়াছিল রোষাবিষ্টা রৌশনারার নিকট হইতে। Kipling -এর ওই মন্তব্যটি — The female of the species is more deadly than the male’ একেবারে নির্ভেজাল না হইলেও ক্ষেত্রবিশেষে যৌক্তিকতা হারায় নাই। যাহা হউক, অবসাদগ্রস্ত শাহজাহান পুত্রের নিকট হইতে এই ভেট প্রাপ্তির আনন্দে উল্লসিত হইয়া বলিয়াছিলেন, ‘পুত্র পিতাকে কি একেবারে বিস্মৃত হয়? খুলিয়া দেখ।’ কিন্তু স্মৃতিপটে যাহার মুখ, তাহারই এক অরুন্তুদ ছিন্ন মুণ্ড! মুহ্যমানে পিতার সংজ্ঞালোপ-প্রাপ্তি, কন্যা জাহানারার চিত্তবিক্ষোভে ও ক্ষুব্ধ ক্রন্দনে মুসম্মন্ বুর্জ নিনাদিত। যাহার নিদ্রায় রাত্রি ছিল না, অরুণোদয়ও ছিল না, সেই শোকসন্তপ্ত শাহজাহানের সরফরাজির বিলুপ্তি ঘটাইল জ্বলন্ত অঙ্গাররূপী আর এক পুত্র আপ্তগরজী আওরঙ্গজেব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *