ষোড়শ অধ্যায় – গৃহযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়
সামুগঢ়ের যুদ্ধ (২৯শে মে, ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ)
আগ্রায় দুর্যোগের ঘনঘটায় বৃদ্ধ সম্রাট শাহজাহানের ভগ্নস্বাস্থ্য পূর্বাপেক্ষা আরও ভাঙিয়া পড়িল। চিকিৎসকগণের পরামর্শে আগ্রা হইতে সম্রাট দিল্লি যাওয়াই স্থির করিলেন (এপ্রিল ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ)। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মোরাদ ও আওরঙ্গজেবের কোনও সংবাদ দরবারে পৌঁছে নাই, বিদ্রোহী শুজা বাহাদুরপুরের যুদ্ধে পরাজিত হইয়া মুঙ্গের দুর্গে অবরুদ্ধ; সুতরাং সম্রাট ভাবিলেন মেঘ কাটিয়া গিয়াছে। এপ্রিল মাসের ১১ তারিখে সম্রাটের সহিত শাহজাদা দারা দিল্লির দিকে যাত্রা করিয়া দিল্লির কাছাকাছি বেলোচপুরে পৌঁছিলেন। এইখানে পঁয়ত্রিশ বৎসর পূর্বে এপ্রিল মাসে পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী শাহজাদা খুররম (শাহজাহান) জীবনের প্রথম পরাজয় স্বীকার করিয়া পলাতক হইয়াছিলেন। এই বেলোচপুরেই ধর্মাতের যুদ্ধের দশ দিন পরে মালববাহিনীর ভগ্নদূত সংবাদ লইয়া আসিল মহারাজা যশোবন্তের রাজপুত-বাহিনী সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, কাসিম খাঁ বিশ্বাসঘাতক, যোধপুররাজ আহত অবস্থায় যুদ্ধস্থল ত্যাগ করিয়াছেন। সম্রাট শিবিরে হাহাকার পড়িয়া গেল, সকলেই কিংকতর্ব্যবিমূঢ়; শাহানশাহর মন তখনও কিন্তু দ্বিধাগ্রস্ত, দোটানা স্রোতে পড়িয়া বিচার বুদ্ধির খেই হারাইয়াছে। তিনি দারাকে বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন যুদ্ধে নিবৃত্ত হওয়াই শ্রেয়, দিল্লি পৌছিয়াই তিনি মোরাদ ও আওরঙ্গজেবকে শান্ত করিবেন; কিন্তু দারার কাকুতিমিনতি ও পীড়াপীড়িতে তিনি আগ্রায় ফিরিয়া আসিতে বাধ্য হইলেন (২রা মে, ১৬৫৮ )।
২
দারা যুদ্ধার্থে কৃতনিশ্চয় হইয়া দ্রুত সমরায়োজনে ব্যাপৃত হইলেন; কিন্তু সৈন্য কোথায়? তিনি আশা করিয়াছিলেন, কুমার সুলেমানের বাহাদুরপুর-যুদ্ধজয়ী বাহিনী শাহশুজাকে মুঙ্গের দুর্গ হইতে বিতাড়িত করিয়া সহসা আগ্রায় ফিরিয়া আসিবে। মির্জা রাজা জয়সিংহ বাহাদুরপুর হইতে শুজাকে শুধু পলায়নের সুযোগ দেন নাই; ছত্রভঙ্গ শত্রুসেনার পশ্চাদ্ধাবনেও সন্দেহজনক শৈথিল্য প্রকাশ করিয়াছিলেন। বাদশাহী ফৌজ ধীরেসুস্থে মুঙ্গের পৌঁছিবার পূর্বেই শুজা কিউল-নদীর তীরে মুঙ্গের হইতে পনের মাইল দক্ষিণ-পশ্চিম সুরজগড় উপদুর্গকে কেন্দ্র করিয়া রক্ষাব্যূহ স্থাপিত করিলেন। সম্মুখে অপ্রশস্ত খরস্রোতা নদী, নদীর তীর ধরিয়া উত্তরে গঙ্গার পার হইতে দক্ষিণে খড়্গপুর পর্বতমালার পাদদেশে গভীর অরণ্যানী পর্যন্ত বিস্তৃত উচ্চ মাটির দেয়াল; উহার উপর কামানশ্রেণী এবং বাংলার পদাতিক সৈন্যের ঘাঁটি। এইস্থানে বাদশাহী ফৌজের অগ্রগতি প্রায় এক মাস ব্যাহত হইয়া পড়িয়াছিল; বাহাদুরপুরের মতো এইস্থানে জঙ্গল না কাটিয়া শত্রুর নাগাল পাওয়ার উপায় ছিল না। মির্জা রাজার ঠিক এক বৎসর পরে এই স্থানে আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীরজুমলা শুজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে আসিয়া এইভাবে আটক হইয়া পড়িয়াছিলেন। মীরজুমলা কিন্তু এই স্থানে নিশ্চেষ্টভাবে কালক্ষেপ না করিয়া খড়্গপুর পর্বতমালার মধ্য দিয়া সোজা রাজমহলের দিকে বাহির হইয়া গিয়া শুজাকে মুঙ্গের ত্যাগ করিতে বাধ্য করিয়াছিলেন। যুদ্ধবিদ্যায় ও বিক্রমে মির্জা রাজা মীরজুমলা অপেক্ষা ন্যূন ছিলেন না এবং আওরঙ্গজেবের জন্য যুদ্ধ করিতে আসিলে এই কৌশল তাঁহাকে কেহ বলিয়া দেওয়ার অপেক্ষাও তিনি করিতেন না। আসল কথা, দারার জন্য স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হইয়া লড়াই করিবার গরজ তাঁহার ছিল না। মুঙ্গের হইতে অকৃতকার্য হইয়া ফিরিবার এগার মাস পরে আওরঙ্গজেবের হুকুমে আজমীর হইতে পলায়মান হতভাগ্য দারাকে বন্দী করিবার জন্য মির্জা রাজা যেমন রাতকে দিন করিয়াছিলেন, উহার শতাংশের একাংশ উৎসাহ, বুদ্ধিমত্তা এবং রণকৌশল যদি তিনি শুজার বিরুদ্ধে প্রকাশ করিতেন তাহা হইলে এই গৃহযুদ্ধের পরিণাম ও হিন্দুর ভবিষ্যৎ হয়তো অন্যরকম হইত।
যাহা হউক, আওরঙ্গজেবের জন্য কালহরণ করাই ছিল শুজার মুখ্য উদ্দেশ্য এবং মির্জা রাজার গৌণ অভিপ্রায়। কুমার সুলেমান এইভাবে মূল্যবান সময় নষ্ট হইতেছে দেখিয়া অসহিষ্ণু হইয়া পড়িলেন, কিন্তু মির্জা রাজার অমতে কিছু করিবার ভরসা পাইলেন না। কিছুদিন জঙ্গল কাটিবার পর বাদশাহী ফৌজ অবশেষে জিৎপুর হইয়া গুপ্তপথে সুরজগড় রক্ষাব্যূহের পার্শ্বভাগ বিপর্যস্ত করিল; কিন্তু ইহাতে কোনও সুবিধা হইল না। ইতিমধ্যে শুজা পশ্চিমে গঙ্গার বাঁক হইতে পূর্বে খড়্গপুরের পাহাড় পর্যন্ত এক নূতন দুর্ভেদ্য প্রাচীর খাড়া করিয়া ফেলিয়াছিলেন, সুতরাং বাদশাহী ফৌজের আবার ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা। এই সময়ে ধর্মাতের যুদ্ধে যশোবন্তের শোচনীয় পরাজয়ের পর দরবার হইতে জরুরি হুকুম আসিল শুজার সহিত অবিলম্বে সন্ধিস্থাপন করিয়া কুমার সুলেমান মির্জা রাজা যেন দ্রুত কুচ করিয়া আগ্রায় ফিরিয়া আসেন। মে মাসের ৭ তারিখে উভয়পক্ষে স্থিতাবস্থা শর্তে সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হইল, যুদ্ধে জয়ী হইয়া পরাজিতের ন্যায় দারার প্রাচ্যবাহিনী অর্ধবিজিত শত্রুর নিকট পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিতে বাধ্য হইল।
৩
শাহজাদা দারা আগ্রায় নূতন সেনাবাহিনী গঠন করিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তাঁহার বিশ্বাসী মনসবদারগণের মধ্যে অধিকাংশই লাহোর, মুলতান ও কাবুল সুবায় শাসন ও সামরিক কার্যে ব্যাপৃত ছিলেন; সুতরাং নূতন অনভিজ্ঞ ও অর্ধবিশ্বাসী সেনাধ্যক্ষগণের উপর তাঁহাকে নির্ভর করিতে হইল। সুবা দিল্লি আগ্রা ও সরকার সম্ভল (মোরাদাবাদ) প্রভৃতি অপেক্ষাকৃত নিকটবর্তী স্থানের ফৌজদারগণকে সেনা সংগ্রহ করিয়া আগ্রায় আসিবার জন্য সম্রাট হুকুমজারি করিলেন, রাজকোষ দারার সৈন্যসজ্জার জন্য উন্মুক্ত হইল। এই সময়ে বাছবিচারের সময় ছিল না, ঠকবাজ নূতন মনসবদারগণ আগ্রা শহরের ভবঘুরে মুসলমান, ধোপা, নাপিত, সইস, বাসার চাকর সকলকেই সিপাহীগিরিতে ভর্তি করিয়া দল ভারী করিল। তোপখানার জন্য দারা মোটা বেতনে ফিরিঙ্গি গোলন্দাজ ভর্তি করিতে লাগিলেন, উহাদের মধ্যে একজন ছিলেন তরুণ ইটালীয় চিকিৎসক ম্যানুসী। আগ্রা ও নিকটবর্তী অন্যান্য দুর্গ হইতে বড় বড় শাহী তোপ দারার তোপখানার সামিল করা হইল, কিন্তু তাঁহার তোপখানার মীর আতস ছিলেন কাশিম খাঁর প্রতিস্পর্ধী চাটুকার বাক্যবাগীশ বরকন্দাজ খাঁ ওরফে মিঞা জাফর। জাফর জাতিতে ইরানী, তোপের নিশানা ঠিক না থাকিলেও কথায় মানুষকে ঘায়েল করিতে ওস্তাদ, তুরানী তাঁহার দুই চোখের দুশমন। দারা মনে করিতেন, জাফর বড় কাজের লোক, রুস্তম আফ্রাসিয়াবের মতো বেনজির বাহাদুর; তাঁহার আশকারা পাইয়াই জাফর উচ্চপদস্থ আমীরদিগকে সমীহ করিত না। ইহার ফলে তুরানী যোদ্ধারা অধিকাংশই দারার প্রতি ক্রমশ বিমুখ হইয়া উঠিয়াছিল, আওরঙ্গজেব ইসলামের দোহাই দিয়া ইহাদিগকে হাত করিবার সুযোগ পাইলেন। ভাবী ভ্রাতৃবিদ্রোহে দারার প্রধান ভরসাস্থল ছিল রাজপুতের শৌর্য ও প্রভুভক্তি। দারার মুখে সর্বদা রাজপুতের প্রশংসা এবং তাহাদের প্রতি প্রকাশ্য পক্ষপাতিত্ব তুরানীগণের ঈর্ষা ও বিদ্বেষের অন্যতম কারণ।
দারার আবেদন ও বিভিন্ন রাজপুত-কুলপতিগণের আহ্বানে রাজপুতানায় সাজ সাজ রব পড়িয়া গেল। কিন্তু ধর্মাতের যুদ্ধে রাজপুত ক্ষত্রশক্তি অর্ধেক ধ্বংস হইয়া গিয়াছে; অপর অর্ধাংশ বিক্ষিপ্ত ও দ্বিধাগ্রস্ত। ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থ ও গৃহকলহ ভুলিয়া হিন্দুজাতি কোনদিন জাতি ও ধর্মের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য একতাবদ্ধ হইতে পারে নাই, রাজনৈতিক চেতনার অভাবে বিধর্মী ও বিজাতীয়গণের মধ্যে জাতির শত্রু-মিত্র চিনিয়া লইতে পারে নাই; এইজন্য আওরঙ্গজেব ও দারার পক্ষ হইয়া রাঠোরের বিরুদ্ধে রাঠোর, চৌহানের বিরুদ্ধে চৌহান, হিন্দুর বিরুদ্ধে হিন্দু প্রাণ খুলিয়া লড়াই করিয়াছিল। হয়তো ইচ্ছা থাকিলে দ্বিতীয় বার দারার জন্য যুদ্ধ করিবার সময় ও সামর্থ্য মহারাজা যশোবন্তের ছিল না, তাঁহার দুই হাজার শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ধর্মাতের যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করিয়াছে। যাঁহারা লাভ-ক্ষতি জয়-পরাজয় বিবেচনা না করিয়া আর্য যোদ্ধার “যুদ্ধায় যুধ্যস্ব” আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া দারার সাহায্যার্থে বদ্ধপরিকর হইয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে কোটা বুন্দীর হাড়া, বিকানীরের রাঠোর এবং চম্বল উপত্যকার গৌর রাজপুত সংখ্যায় প্রধান ছিলেন।
“হিন্দুকুলসূর্য” মহারাণা রাজসিংহ হিন্দুর ভবিষ্যৎ না ভাবিয়া তাঁহার বিদ্রোহের দণ্ডস্বরূপ সম্রাট কর্তৃক বাজেয়াপ্ত পুর-মণ্ডল ইত্যাদি কয়েকটি পরগণা আওরঙ্গজেবের কৃপায় ফিরিয়া পাইবার কথাই ভাবিতেছিলেন। তিনি ঘুণাক্ষরেও স্মরণ করিতে পারিলেন না যে, ওই ব্যাপারে শাহজাদা দারা মাঝখানে না পড়িলে তিনি চিতোর-উদয়পুরও হারাইয়া বসিতেন। আসন্ন যুদ্ধে মহারাণা নির্লিপ্ত থাকিলেও শিশোদিয়া দারার বিপক্ষেই যুদ্ধ করিয়াছিল। মোগলসংসর্গে রাজপুত আদর্শভ্রষ্ট হইয়াছিল, পরার্থ অপেক্ষা স্বার্থকেই বড় করিয়া দেখিত—ইহার প্রমাণ কচ্ছবাহপতি মির্জা রাজা জয়সিংহ। তাঁহার পুত্র কুমার রামসিংহ বাদশাহী মনসবদার হিসাবে দারার পক্ষে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়াছিলেন; কিন্তু কচ্ছবাহগণ রাঠোর-চৌহানের মতো জান কবুল করিয়া লড়াই করে নাই। বুন্দেলাগণ রাজপুত হইলেও তাহারা রাজপুত চরিত্রের প্রশংসনীয় গুণসমূহ হারাইয়াছিল; পৃথ্বীরাজের যশঃস্পর্ধী “আল্হা-উদন্” মহোবাওয়ালের বীর গাথা বুন্দেলা চরিত্রকে স্থায়ীভাবে প্রভাবিত করিতে পারে নাই; মোগল আমলে বুন্দেলাগণ নিকৃষ্টশ্রেণীর রাজপুত বলিয়া গণ্য হইত। দস্যুবৃত্তি, বিদ্রোহ, কৃতঘ্নতা বুন্দেলার চরিত্রে সমধিক প্রকট, ধর্মাধর্মজ্ঞান বিসর্জন দিয়া অর্থ ও জায়গীরের লোভে জঘন্যতম গুপ্তহত্যায় বুন্দেলার জুড়ি ছিল না। সম্রাট শাহজাহান বুন্দেলখণ্ড জয় করিয়া বুন্দেলা সামন্ত রাজগণকে প্রায় ধ্বংস করিবার উপক্রম করিয়াছিলেন, যাঁহারা শাহজাদা দারার আশ্রয়ভিক্ষা করিয়া সম্রাটের কোপ হইতে রক্ষা পাইয়াছিলেন তাঁহাদের অন্যতম ছিলেন সরকারি নজরে কুখ্যাত দস্যু ও বিদ্রোহী, কিংবা মতান্তরে স্বাধীনতার পূজারী অদম্য দেশপ্রেমিক চম্মাত্রায় বুন্দেলা। চম্মত্রায় দারার অধীনে কান্দাহারে যুদ্ধ করিতে গিয়াছিলেন, কিন্তু আশানুরূপ কোনও কৃতিত্ব দেখাইতে না পারিলেও ফিরিয়া আসিয়া মোটারকম জায়গীর মনসবের দাবি করিয়া বসিলেন। কোনও সুবিধা করিতে না পারিয়া চম্মত্রায় মোগল সরকারে চাকুরি অপেক্ষা পূর্বপুরুষের পেশা ডাকাতি অধিক লাভজনক বিবেচনা করিয়া বিদ্রোহী হইয়াছিলেন। ধর্মাতের যুদ্ধের পরনীতিনিপুণ আওরঙ্গজেব যে সমস্ত কাজের লোককে হাত করিয়াছিলেন তাহাদের মধ্যে চম্মত্রায় বুন্দেলা উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি। বুন্দেলখণ্ডের রাজপুত সম্বন্ধে শত্রু মিত্র নিরপেক্ষ কেহই নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিতে পারিত না, সুযোগ পাইলে নির্বিচারে সকলের অনিষ্ট করাই ছিল তাহাদের মজ্জাগত প্রবৃত্তি।
শৌর্য ও নির্ভরযোগ্যতায় মধ্যযুগে হিন্দুস্থানের মুসলমান সেনানায়কগণের মধ্যে রাজপুতের সমকক্ষ ছিলেন উত্তরপ্রদেশের অন্তর্গত মুজাফফরনগর জেলার বারহাবাসী সৈয়দ; ইহাদের পরেই পাঠান। সৈয়দ ও পাঠান পাকা মুসলমান হইলেও, দারাকে ইসলামের শত্রু বলিয়া আওরঙ্গজেবের প্রচারকার্য ইঁহাদিগকে বিভ্রান্ত করিতে পারে নাই। দারার এই সঙ্কটে বারহাবাসী সৈয়দ এবং সম্ভল-মোরাদাবাদের পাঠান উপনিবেশ হইতে দলে দলে যোদ্ধা রাজপুতের পাশে দাঁড়াইয়া তাঁহার জন্য যুদ্ধ করিতে উপস্থিত হইল। দারার নূতন বাহিনীতে রাজপুতের তুলনায় মুসলমান সংখ্যায় প্রায় চারিগুণ ছিল, বিশ্বাসঘাতকের অনুপাত কিন্তু মালববাহিনীর অনুপাত অপেক্ষা অনেক কম।
৪
রাজপুত রাজন্যবর্গের মধ্যে বুন্দীরাজ ছত্রশাল হাড়া বয়সে ও শৌর্যে ভীষ্মপ্রতিম ছিলেন। তিনি দশ বৎসর বয়স হইতে বৃদ্ধাবস্থা পর্যন্ত কেবল যুদ্ধই করিয়াছেন, স্বয়ং সম্রাটের নিকটও কোনোদিন অনুগ্রহ যাঞা করেন নাই। তিনি জাহাঙ্গীরের রাজত্বে বিদ্রোহী কুমার খুররমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়াছিলেন; খুররমের (সম্রাট শাহজাহান) রাজ্যারোহণের পর বুন্দীরাজ ত্রিশ বৎসর মোগলসম্রাটের সেবা করিয়াও প্রথম শ্রেণীর মনসব লাভ করিতে পারেন নাই, বরং ইহার প্রতিদানে পাইয়াছিলেন মনস্তাপ ও অপমান; অখণ্ড বুন্দীরাজ্যের অঙ্গহানি করিয়া সম্রাট শাহজাহান কোটারাজ্য সৃষ্টি এবং নূতন রাজ্যের কনিষ্ঠ শাখাকে বুন্দী হইতে স্বাধীন করিয়াছিলেন। ইহার কারণ বুন্দীরাজ ছত্রশালের উদ্ধত আত্মাভিমান। তাঁহার পূর্বপুরুষ রাও সুর্জনের সঙ্গে আকবরের যে সন্ধি হইয়াছিল উহার মধ্যে শর্ত ছিল, মোগলসম্রাট কোনদিন বুন্দীর রাজকন্যাকে বধূরূপে প্রার্থনা করিবেন না, বুন্দীর সেনা স্বয়ং সম্রাট কিংবা শাহাজাদাগণের সেনাপতিত্ব ব্যতীত অন্য কোনও হিন্দুরাজা কিংবা মুসলমান সেনাধ্যক্ষের অধীনে যুদ্ধ করিবে না, বুন্দীসওয়ারের ঘোড়ার গায়ে মনসবদারী দাগ দেওয়া হইবে না, চৌহান-নারী নওরোজের উৎসবে মোগল অন্তঃপুরে আমন্ত্রণ গ্রহণ করিবেন না, বুন্দীর রাও সিন্ধুনদী পার হইয়া কোথায়ও যুদ্ধ করিবে না; বুন্দীর নজরানা কোষমুক্ত তরবারি ও যুদ্ধক্ষেত্রে শস্ত্রপূত শবদেহ।
প্রাচীনপন্থী ছত্রশাল সিন্ধুনদী সম্বন্ধে কুসংস্কারমুক্ত হইতে পারেন নাই। সিন্ধুর পশ্চিম তীর রাক্ষসভূমি, ওইখানে শ্রাদ্ধাদি ধর্মকর্ম নিষিদ্ধ, মরিলে মুক্তি নাই। এই জন্য বুন্দীসেনা সম্রাটের ইচ্ছা সত্ত্বেও বল্ল্খ কান্দাহার অভিযানে অংশগ্রহণ করিতে আপত্তি করিয়াছিল; কিন্তু কোটা শাখার রাও মাধবসিংহ, মুকুন্দসিংহ হাড়া প্রভৃতি হাড়া চৌহানগণ যুদ্ধ করিতে গিয়াছিলেন। এই অপরাধে সম্রাট বুন্দীর গৌরব খর্ব করিবার জন্য ছত্রশালের জায়গীর বারা ও মৌ পরগণা বাজেয়াপ্ত এবং উহা কোটাপতিকে প্রধান করিয়া ছত্রশালের বুকে শল্য প্রবিষ্ট করাইলেন। দিল্লীশ্বরের এই অবিচার বুন্দীপতিকে স্বামীধর্ম-ভ্রষ্ট করে নাই; তিনি সম্রাটের আদেশে আওরঙ্গজেবের অধীনে আবার দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধ করিতে গিয়াছিলেন এবং তাঁহারা হুকুমে আওরঙ্গজেবের অনুমতি না লইয়াই হিন্দুস্থানে ফিরিয়া আসিয়াছিলেন। ছত্রশালের তৃতীয় পুত্র কুমার ভগবত্ত সিংহ বুন্দীর অঙ্গহানির নিমিত্ত দারা ও শাহজাহানের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করিবার জন্য আওরঙ্গজেবের পক্ষ অবলম্বন করিয়াছিলেন। দ্বিতীয় পুত্র ভীম সিংহ শাহজাদা দারার অধীনে মনসবদার হিসাবে শাহশুজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে গিয়াছিলেন। ধর্মাতের যুদ্ধের কিছুদিন পূর্বে ভীম সিংহের মৃত্যুসংবাদে বুন্দীরাজ্যে হাহাকার পড়িল; ইহার অব্যবহিত পরে আসিল সাহায্যের জন্য হতপ্রভ শাহজাদা দারার করুণ আবেদন ও দিল্লীশ্বরের সনির্বন্ধ অনুরোধ — গতানুগতিক চাকরির ডাক নহে।
৫
বুন্দীর রণদামামা আবার বাজিয়া উঠিল, বৃদ্ধ রাও পুত্রশোক ভুলিয়া রণরঙ্গে মাতিয়া উঠিলেন। আওরঙ্গজেবের প্রতি কোনও আক্রোশ কিংবা দারার নিকট বাধ্যবাধকতা না থাকিলেও সঙ্কট হইতে দিল্লীশ্বরকে উদ্ধার এবং ন্যায় ও ধর্মের মর্যাদা রক্ষার নিমিত্ত বুন্দীরাজ শেষ যুদ্ধ করিবার সঙ্কল্প করিলেন; লাভ-ক্ষতি জয়-পরাজয়ের আশা ও আশঙ্কার আলোছায়া তাঁহাকে কোনদিন যুদ্ধে প্রবৃত্ত কিংবা নিবৃত্ত করিতে পারে নাই। দান, পৌরুষ, ত্যাগ ও ভোগে সামসময়িক রাজন্যবর্গের মধ্যে কেহ বুন্দীশ্বরকে* অতিক্রম করে নাই; বুন্দীর দরবারে কাব্যলক্ষ্মীর সাবলীল ছন্দ চারণের অগ্নিবীণা ও গুণীজনের কণ্ঠে সঙ্গীত-মূর্ছনা অসির ঝনঝনার সহিত তাল মিলাইয়াছে, এইবার দুনিয়ার সহিত তাঁহার শেষ হিসাব- নিকাশের পালা।
[*ছত্রশালের বিভিন্ন রাজপুত-বংশীয়া বারোজন বিবাহিতা রানি ব্যতীত শতাধিক উপপত্নী ও অনুগৃহীতা দাসী ছিল। ইহাদের মধ্যে নয় জন রানি এবং ৪৪ জন উপপত্নী ও দাসী তাঁহার মৃত্যুর পর “সতী” হইয়াছিল। তিনি কবি চারণ ও গুণীগণের আশ্রয়দাতা ছিলেন। তাঁহার দরবারী কবি বিশ্বনাথ সংস্কৃত ভাষায় শত্রুশল্য-চরিতম্ নামক কাব্য রচনা করিয়াছিলেন। কথিত আছে এই কাব্যে পুরস্কার-স্বরূপ’ তিনি কবিকে চারিখানা গ্রাম এবং নগদ এক লক্ষ টাকা দান করিয়াছিলেন। বুন্দীর “মহিয়ারিয়া” শাখার চারণ কবি দেবাকে তিনি একটি হাতি ও এক কোটি দাম (৪০ দাম-এক টাকা) দান করিয়াছিলেন। দাতার ন্যায় দানগ্রহীতারও বুকের পাটা এবং দরাজ হাত ছিল। চারণ দেবা ওই হাতি ও সম্পূর্ণ মুদ্রা তাঁহার দ্বারস্থ যাচকগণকে দান দিয়াছিলেন। এইজন্য আজ পর্যন্ত দেবার বংশধরগণকে “হস্তী-বরীস” ও “কৌড়-বরীস” (ক্রোর বখ্শ) আখ্যায় অভিনন্দিত করা হয়। একদিন কবিতার আসর ভাঙিবার পর রাও ছত্রশাল চারণ দেবা-র দুই পাটি জুতা নিজে উঠাইয়া কবির সামনে রাখিয়াছিলেন। চারণ আবার গাহিলেন :
পাণা গহ পৈজার, সুকবি অগ্ন ধরতা সতা।
হিক হিক বার হাজার, পহ সুমা মাথৈ পড়ী।
অর্থাৎ ছত্রশাল হস্ত দ্বারা উপানৎ গ্রহণ করিয়া সুকবির সম্মুখে রাখিলেন; এক-একবার প্রভু ছত্রশালের মস্তকে দ্বাদশ সহস্র পুষ্প (দেবতাগণ কর্তৃক) বর্ষিত হইল।
এই দোহা রাজস্থানে আজ পর্যন্ত লোকের মুখে শুনা যায়। শৌর্য, গুণানুরাগ, ভাবপ্রবণতা ও দাক্ষিণ্যের এই সমাবেশে ছত্রশাল ব্যতীত অন্য রাজপুত নৃপতির চরিত্রে কদাচৎ দেখা যায়। সুরজমল কৃত “বংশভাস্কর, খণ্ড ৩, পৃ ২৬২২-২৩ ও পাদটীকা)
** অব দুনী রণ আপনাঁ, পড়িয়াঁ সুজস প্রকাশ ॥
প্রকটে বুন্দী পট্ট পণ, ন কটে নাম বিনাস।
(বংশভাস্কর, খণ্ড ৩; পৃ. ২৬৭৪)
অক্ষত শরীরে যুদ্ধে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিয়া যে যোদ্ধা গৃহ প্রত্যাবর্তন করে রাজপুতনায় তাহাকে “নকাটা” (নাক-কাটা) বলা হইত।]
দশ বৎসর বয়স পূর্ণ না হইতে যে পিতৃহীন বালক পিতামহ রতন সিংহের জীবদ্দশায় বুন্দীর যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হইয়াছিলেন, অর্ধ-শতাব্দীকাল পরে সেই গুরুভার পুত্র ভাও সিংহকে যথাবিধি সমৰ্পণ করিয়া যুদ্ধযাত্রার প্রাক্কালে বৃদ্ধ রাও ছত্রশাল সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হইলেন; পুত্রের প্রতি তাঁহার শেষ উপদেশ ছিল—শত্রুর নিকট কখনও বিনম্র হইয়া নতিস্বীকার করিবে না। ইহার পর তিনি নিকট ও দূর-সম্পর্কীয় সগোত্র অসগোত্র আত্মীয়-বান্ধবগণকে যুদ্ধার্থ আমন্ত্রণ করিলেন; বুন্দী হাড়াবংশের জননী; কোটার চারিজন রাজপুত্র ধর্মাতের যুদ্ধে প্রাণ দিয়াছে; পঞ্চম কুমার দেহে অস্ত্রচিহ্ন ধারণ করিয়া অপার যশের অধিকারী হইয়াছে; ইহার দ্বিগুণ ত্যাগ ও বিক্রম দেখাইতে না পারিলে বুন্দীর নাক কাটা যাইবে। খুড়া * খুড়তুতো ভাই, ভাইপো-ঘরের নাতি, আপন ভাই ও পুত্র বুন্দীরাজ বংশের এই চারি পুরুষ যুদ্ধে ছত্রশালের অনুগামী হওয়ার জন্য প্রস্তুত হইলেন; কুমার ভগবন্ত সিংহ পিতার আদেশে আওরঙ্গজেবের নিকট হইতে বিদায় লইয়া বুন্দী চলিয়া আসিলেন।
কাকা হরিসিংহ, কাকা মহাসিংহ প্রমুখ অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ জ্ঞাতিবন্ধুগণের সহিত বিবাহের সাজে সজ্জিত হইয়া রাও ছত্রশাল আবার যেন নবযৌবনের উন্মাদনায় আত্মহারা হইয়াছেন। ইঁহাদের সকলের হাতে বিবাহের মঙ্গলসূত্র; পরিধানে কেসর-বস্ত্র, গায়ে ঝলমল জড়োয়া পোশাক, মাথায় টোপর; টোপরের নীচে কাঁধ পর্যন্ত সাদা চুলের বাহার। বিবাহের বরসজ্জায় সে যুগেও বৃদ্ধেরা নীলের রঙে প্রস্তুত চুলের কলপ লাগাইয়া বয়স চুরি করিত; কিন্তু এইবার কেহ কলপ মাখেন নাই; কারণ উহা অপবিত্র, মরণের সময় নীলের রঙ স্পর্শ করিতে নাই। বিবাহসজ্জার দ্বিতীয় ব্যতিক্রম হইল যোদ্ধৃগণের পায়ে সোনার কড়া বা রাজপুতের “রণলংগর”; ইহা যুদ্ধক্ষেত্র হইতে পিছপা না হইবার প্রতিজ্ঞাসূচক চিহ্ন—আভরণ নহে। বালক, বৃদ্ধ, তরুণ সকলের গায়ে বরের পোশাক, আতরের সুগন্ধ, সর্বত্র আনন্দের হিল্লোল, কোথায়ও ভয় কিংবা বিষাদের চিহ্ন নাই, পুরনারীগণ মঙ্গল-উৎসবে গা ঢালিয়া দিয়াছে। যাত্রার পূর্বরাত্রিতে প্রিয়তমা রানি সুরজকুমারী স্বর্গে পতিকে প্রত্যুদ্গমন করিবার জন্য পূর্বেই চিতারোহণের অনুমতি প্রার্থনা করিলেন—ইহা শোক বা অভিমান নহে, অতি বাস্তব জ্বলন্ত বিশ্বাস, নচেৎ হিন্দু নারী সজ্ঞানে হাসিমুখে চিতায় পুড়িয়া মরিবার শক্তি পাইবে কোথায়? রাও ছত্রশাল রানিকে নিরস্ত করিয়া বলিলেন, “আগে আমি, পশ্চাতে তুমি; ইহার ব্যতিক্রম হইলে অপযশ হইবে।”
বুন্দীর জনবল এবং রাজভাণ্ডার প্রায় নিঃশেষ করিয়া রাও ছত্রশাল যুদ্ধের আয়োজন করিতেছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে হতাহতের তালিকায় দেখা যায় এই অভিযানে রাজপুত, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূদ্র, পাঠান, সকল জাতি ও বর্ণ অংশগ্রহণ করিয়াছিল। তাঁহার দ্বাদশ শ্বশুরকুলের কুটুম্বগণ, রাঠোর, শিশোদিয়া, গৌর, বড়গুজর, সোনিগরা, ভাটী কচ্ছবাহ অখণ্ড যশ ও স্বর্গলাভের আকাঙ্ক্ষায় বুন্দী বাহিনীর সহিত সোৎসাহে যোগদান করিলেন। সোলাঙ্কী সুরজমল (ছত্রশালের শ্যালক), খিচী গোবর্ধন দাস, ভাটী জৈত সিংহ ও মালদেব চন্দ্ৰাবত (শিশোদিয়া), মুহুকম সিংহ, রাঠোর চন্দ্রসিংহ ও রূপসিংহ, চালুক্য লালসিংহ, ঝালা শ্যামসিংহ ও বিহারী দাস, মোহিমুকুন্দসিংহ, পুরীহর (প্রতিহার) পরশুরাম, বড়গুজর কনক সিংহ, কচ্ছবাহ কিশনসিংহ ও আজরসিংহ, তোমর প্রতাপসিংহ, পরমার জয়সিংহ, বাঘেলা ভীমসেন, দেবরা দলেলসিংহ, গৌর সদানন্দ শিবরাম ও ভীমসিংহ, দহিয়া বিজয়সিংহ ও রামসিংহ, ছত্রশাল-মুকুন্দ প্রমুখ তেরো জন ভাদোরিয়া, সোনিগরা হরিসিংহ, জাদব বিজয়পাল প্রভৃতি বীরগণ সানুচর বুন্দীর পতাকাতলে সমবেত হইলেন; ইহারা শুধু নাম নহেন, চারণগীতির উল্কাপুঞ্জ নির্বাণের পথে চলিয়াছেন। পাঠান সামন্ত দলেল খাঁ, আলী খাঁ, দায়ুদ খাঁ, মীর খাঁ, করীম খাঁ, তুর্কী রহিমবেগ, পালোয়ান শেখ কাদের প্রভৃতি তেরোজন খ্যাতনামা মুসলমান জায়গীরদার বুন্দীর মানরক্ষার জন্য শয়তানের সহিত লড়াইয়ে হাটবার পাত্র নয়—ইহাদের মধ্যে কেহই ফিরিয়া আসে নাই।
বুন্দীর পুরোহিত, ভাট, কায়স্থ, শূদ্র অসি চালনায় অপটু নহে, মরণকে তাহারাও রাজপুতের মতো তুচ্ছ করে; আজীবন যাহারা বিশ্বস্তভাবে বুন্দীর সেবা করিয়াছে তাহারা রণক্ষেত্রে প্রভুর সান্নিধ্য ত্যাগ করিতে অসম্মত হইয়া মৃত্যুর পরপারেও বুন্দীপতির অনুগমন করিবার জন্য উৎসাহী হইল। ব্রাহ্মণ যোগীরাম ও বলরাম; বৈশ্যলাল, হরি, রত্ন ও ক্ষেম; জলধারী (পানীয় রক্ষক) ব্রাহ্মণ সদানন্দ, উদাগুজর (চৌকিদার?), খেমা মালী, নাথু ইত্যাদি পাঁচ জন শূদ্র পরিচারক, সাত শত দরবারী খিদমতগার (আঁটা-সোটা ধারী, চামর ছত্রবাহক ইত্যাদি) সঙ্গে চলিল—ইহারাও ক্ষত্রিয় বিক্রমে যুদ্ধ করিয়া স্বামিঋণ মুক্ত হইয়াছিল, বুন্দীর চারণ কবি শ্রদ্ধার সহিত ইহাদের স্মৃতি রক্ষা করিয়াছেন। হিন্দুজাতি তখনও আত্মার অমরত্ব ও স্বর্গলাভে বিশ্বাস হারায় নাই, গীতার “হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম্”—বাণী ভুলিয়া দেহ-সৰ্বস্ববাদী হয় নাই।
৬
যাত্রার দিন সমুপস্থিত। ওইদিন অস্ত্রশস্ত্র ও বাহনসমূহ যথারীতি পূজিত হইল, যোদ্ধৃগণ পুরস্কৃত হইয়া সৎকার লাভ করিল। প্রথমেই তোপখানার প্রত্যেকটি কামানের সম্মুখে ছাগ বলি দিয়া ও তোপের মুখে শরাব ঢালিয়া* সুরা মাংস বলিপ্রিয়া চণ্ডিকারূপিণী কালানলবর্ষী নালিকাস্ত্রের বিশ্রামজনিত ক্রোধ শান্ত করা হইল। পতাকাসজ্জিত কামানের গাড়ির বলদ এবং হাতির কপালে ও গায়ে তেলসিঁদুরে সিদ্ধিদাতা গণেশের ছাপ, গলায় মাল্যঘণ্টা। তোপখানার পশ্চাতে ছোট কামান (সোতর নাল) বাহী কাতারে কাতারে উটের সারি। ইহাদের পশ্চাদভাগে তোপখানারক্ষী বন্দুকধারী যোদ্ধা ও পদাতিক সেনারক্ষিত তাঁবু ও যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম। বাহিনীর মধ্যভাগে চলমান পর্বতসদৃশ বিবিধ সজ্জায় সুসজ্জিত বর্মাবৃত রণহস্তী; ইহাদের সর্বাঙ্গ তৈলচিক্কণ, মাথায় সিঁদুর, গলায় লাল শালুর সাজ ও বীরঘণ্টা, পৃষ্ঠে ঝালরদার আস্তরণের উপর মনোরম হাওদা; কোনও কোনও হাওদার মধ্যে রণদামামা ও বিবিধ বাদ্যভাণ্ড, সমস্তগুলিতে যোদ্ধার আসন ও ঝোলা।
[* বংশভাস্কর, খণ্ড ৩, পৃ. ২৬৭৯, সেকালের বিশ্বাস এইরূপ না হইলে কামানের স্তব্ধতাজনিত ক্ষোভ দূর হয় না, কামানের গাড়ি রাস্তায় অচল হইয়া পড়ে।]
বাহিনীর প্রধান অংশ অশ্বারোহী সেনা লইয়া গঠিত, জীবনে-মরণে প্রিয়তমা অপেক্ষাও প্রিয়তর রাজপুত যোদ্ধার যুদ্ধাশ্ব— যাহার সেবায় তাহার অপমান নাই, ক্লান্তি নাই, সজ্জায় কার্পণ্য নাই। পদস্থ যোদ্ধৃবৃন্দের অশ্ব ও অশ্বারোহী উভয়ই লৌহ কবচাবৃত, ঘোড়ার পায়ে ঘুঙুর, কোমরে কিঙ্কিণী, গায়ে ঝালরদার বিচিত্রবর্ণের সাজ, সোনালী-মীনার জিন-রেকাব, মুখে রেশমী লাগাম। শাপভ্রষ্টা অপ্সরাগণ অশ্বিনী-রূপ পরিগ্রহ করিয়া চঞ্চল পদক্ষেপে যেন স্বর্গের পথে চলিয়াছেন। বিভিন্ন কুলের অশ্বারোহী যোদ্ধৃগণ নিজ নিজ বংশের পতাকার নীচে কুলপতিকে মধ্যে রাখিয়া যাত্রার জন্য ব্যূহবদ্ধ হইল; চারণগণের যশোগান, স্বস্তিবাচন ও জয়ধ্বনিতে চলমান রঙ্গভূমি মুখরিত হইয়া উঠিল; স্বয়ম্বরাভিলাষিণী মোগল রাজলক্ষ্মীর চরণসঞ্চার সহসা অর্ধপথে স্তব্ধ হইয়া গেল।
যাত্রার প্রাথমিক কৃত্যস্বরূপ রাও ছত্রশাল চৌহানের কুলদেবী আশাপূর্ণা এবং নারায়ণের পূজা করিয়া উভয় দেবতার প্রসাদ গ্রহণ করিলেন। বিদায়ের বাজনা বাজিয়া উঠিতেই বয়োবৃদ্ধগণকে প্রণাম করিয়া বুন্দীপতি রেকাবে পা রাখিলেন, তরঙ্গায়িত চতুরঙ্গবাহিনী নগরীর উপকণ্ঠ প্লাবিত করিয়া আগ্রার পথে অগ্রসর হইল। তিন দিন পরে বুন্দীর সীমান্ত হইতে রাও ছত্রশাল যুবরাজ ভাওসিংহকে বিদায় দিলেন; কনিষ্ঠ অপ্রাপ্তবয়স্ক ভারুসিংহ কিছুতেই পিতার সঙ্গ ত্যাগ করিল না। পথিমধ্যে উদয়পুরের চারণ হরিদাস এবং ছত্রশালের প্রিয় চারণ কবি দোলা বুন্দীশিবিরে উপস্থিত হইয়া যোদ্ধৃগণের মনে বিপুল উদ্দীপনা সৃষ্টি করিলেন। এই মহাযাত্রায় শেষ গীত গাহিতে গাহিতে চারণদ্বয় ইন্দ্রলোক-প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। রাও ছত্রশাল মথুরার পথে আগ্রার দিকে অগ্রসর হইলেন। মথুরায় তিনি মুণ্ডন, স্নান, তুলাদান ও শ্রাদ্ধাদি যথাবিধি সম্পন্ন করিলেন এবং অষ্টোত্তর শতসংখ্যক গাভীর শৃঙ্গদ্বয় সুবর্ণে এবং ক্ষুরচতুষ্টয় রৌপ্যে ভূষিত করিয়া দ্বিজ-শ্রেষ্ঠগণকে দক্ষিণা প্রদান করিলেন।
রাও ছত্রশালের আগমনে দারা ধর্মাতের যুদ্ধে যশোবত্তের পরাজয় -গ্লানি ভুলিয়া গেলেন, দিল্লীশ্বর নিরাশার আঁধারের কোলে কুহকিনী আশার মুহূর্তরাগ দেখিয়া আশ্বস্ত হইলেন; আওরঙ্গজেব আশঙ্কামুক্ত হইয়া মালবে সম্রাটের শেষ অধিকার গোয়ালিয়র দুর্গের দিকে দ্রুত অগ্রসর হইলেন।
৭
শুধু মালব-বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়, শত্রুর হস্তে পতিত বিপুল রণসম্ভার বাদশাহী -ক্ষতির তোপখানা এবং সিন্দুকভরা টাকা ও আশরফির দ্বারা ধর্মাতের যুদ্ধে দারার ক্ষয়- সম্যক পরিমাপ হয় না। এই পরাজয়ের সামরিক অপেক্ষা নৈতিক প্রতিক্রিয়া দিল্লি সাম্রাজ্যে দারা ও আওরঙ্গজেবের স্থান সম্পূর্ণ অদল-বদল করিয়া দিয়াছিল। আওরঙ্গজেব আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতে সংশয়াকুল বিদ্রোহী নহেন। বাহাদুরপুরে সুলেমান শুকোর জয়লাভ ব্যর্থতায় পর্যবসিত; ভারতের ভাগ্যাকাশে আওরঙ্গজেবের তেজোদ্ভাসিত সৌভাগ্যসূর্যের অরুণোদয়ে লোকচক্ষে ব্যসনগ্রস্ত দারা পূর্ণিমা-প্রভাতে অস্তমান ওষধিপতি।
শাহজাদা আওরঙ্গজেব ও মোরাদ বিজিত যুদ্ধক্ষেত্রে উল্লাসমুখর নিশাযাপন করিয়া পরের দিন (১৬ই এপ্রিল ১৬৫৮) মালবের রাজধানী উজ্জয়িনী নগরী বিনা বাধায় অধিকার করিলেন। এইখানে তাঁহার রণক্লান্ত সেনা তিন দিন পূর্ণ বিশ্রাম করিল। বুদ্ধি ও বাহুবলে অর্ধসাম্রাজ্য অধিকার করিয়া নীতিপ্রয়োগে অপরার্ধ জয় করিবার উদ্যোগপর্ব এইখানেই আওরঙ্গজেব সুসম্পন্ন করিলেন। এই বিরাট রাষ্ট্র বিপ্লবের আনুষঙ্গিক অরাজকতা ও অত্যাচার আওরঙ্গজেবের দৃঢ়তায় মালব-সুবার কোথায়ও মাথা তুলিতে পারে নাই, শাসনব্যবস্থা পূর্বের শৈথিল্যমুক্ত হইয়া বরং অধিকতর সুষ্ঠুভাবে চলিতে লাগিল, সর্বশ্রেণীর প্রজাগণ ভয়মুক্ত হইয়া তাঁহাকে অভিনন্দিত করিল। তিনি কাহারও অধিকার হরণ করিয়া নিজের অনুচরবর্গকে পুরস্কৃত করিলেন না, যাহারা দারার পক্ষ হইয়া যুদ্ধ করিয়াছিল তাহাদিগকে ক্ষমা করিয়া দানের দ্বারা বশীভূত করিলেন এবং ধর্মাতের যুদ্ধে দারার প্রতি বিশ্বাসঘাতক সেনা ও সেনাধ্যক্ষগণকে পুরস্কার ও পদোন্নতি দ্বারা বিনা দ্বিধায় নিজ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করিয়া লইলেন। তাঁহার ক্ষমায় দুর্বলতা, অনুগ্রহ বিতরণে পক্ষপাতিত্ব ও দানে অহমিকার ছায়া পড়ে নাই; বস্তুতপক্ষে এই ক্ষেত্রে রাজোচিত গুণের উচ্চতম প্রশংসা সর্বাংশে আওরঙ্গজেবের প্রাপ্য––ইতিহাসের এই অধ্যায়ে আওরঙ্গজেব চরিত্রকে কবি ভারবির বনেচর বর্ণিত সুযোধনের প্রতিচ্ছায়া বলিলে অত্যুক্তি হয় না; দুই জনই কপটাচারী “জিহ্ম”; কিন্তু যে সমস্ত গুণ* না থাকিলে দুর্যোধন কুরুক্ষেত্রে ন্যায় এবং ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবার জন্য একাদশ অক্ষৌহিণী সেনা একত্র করিতে পারিতেন না, সেই সমস্ত গুণ ব্যতীত দেড় মাসের মধ্যে ধর্মাতের যুদ্ধে নিজ বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা পূরণ করিয়া আওরঙ্গজেবও তাঁহার সৈন্যসংখ্যা দ্বিগুণিত করিতে পারিতেন না।
[*আওরঙ্গজেব সম্বন্ধে কিরাতাৰ্জ্জুনীয়ম্ কাব্যের নিম্নলিখিত শ্লোকগুলির ঐতিহাসিক সার্থকতা আছে; দারা কিন্তু “যুধিষ্ঠির” ছিলেন না, কোন “চক্রধারী ও তাঁহাকে চালিত করেন নাই; সুতরাং আওরঙ্গজেবের গুণের কাছেই দারাকে দুনিয়াদারির মামলায় হার মানিতেও হইয়াছিল।
১। “উপায়-কৌশল”
“নিরত্ময়ং সাম ন দানবর্জিতং, ন ভূরি দানং বিরহষ্য সৎক্রিয়াম্।
প্রবর্ততে তস্য বিশেষশালিনী গুণানুরোধেন বিনা ন সৎক্রিয়া।”
২। “মিত্রবল”
“মহৌজসো মানধন্য ধনার্চিতা ধনুর্ভূতঃ সংয়তি লব্ধকীৰ্তয়ঃ।
ন সংহতাস্তস্য নভিন্নবৃত্তয়ঃ প্রিয়াণি বাঞ্চণ্ড্যসুভিঃ সমীহিতুম্।।”
৩। “স্বপক্ষ-পরপক্ষ বৃত্তান্ত জ্ঞান”
“মহীভূতাং যচ্চরিতৈশ্চরৈঃ ক্রিয়া স বেদ নিঃশেষমশেষিত ক্রিয়ঃ।
মহোদয়ৈস্তস্য হিতানুবুদ্ধিতিঃ প্রতীয়তে ধাতুরিবেহিতং কলৈঃ।।”]
চর নিয়োগ, মন্ত্রগুপ্তি, প্রয়োজনানুসারে দান সৎকার ও আচরণে অমায়িকতার মুখোশধারণে আওরঙ্গজেব নীতিশাস্ত্রকারগণের আদর্শ রাজপুত ছিলেন; ভ্রাতা মোরাদের নিকটও তিনি একটা হেঁয়ালি, তাঁর কার্যের আদি-অন্ত কাহারও অনুমান করিবার সাধ্য ছিল না। গোপনে দুই জনের কাছে এক কথা তিনি কদাচিৎ বলিতেন, অধীন হিন্দুসামন্তগণের নিকট এই সময়ে দারা অপেক্ষাও তিনি অধিক উদার ন্যায়নিষ্ঠ এবং অনুগ্রহ বিতরণে মুক্ত- হস্ত, অথচ মুসলমানের নিকট আদর্শ মুসলমান, কেবল ইসলামের স্বার্থে কিছুদিন কাফেরের খাতির তোয়াজ, আখেরে তাহাদের কি গতি হইবে সে বিষয়ে মোল্লাদল নিশ্চিন্ত; সুতরাং তাঁহার সজাগ দৃষ্টির নীচে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে মনোমালিন্য ও রেষারেষির অবকাশ ছিল না। আওরঙ্গজেবের নীতিপ্রয়োগ এবং হিন্দুসমাজে রাজনৈতিক চেতনার অভাবে সঙ্কটের সময়ে রাজপুতশক্তি দারার পক্ষে সংহত ও কেন্দ্রীভূত হইতে পারে নাই। রাজপুত চরিত্রের দুর্বলতাসমূহ এবং অর্থনৈতিক অসহায় অবস্থার সুযোগ আওরঙ্গজেব পূর্ণভাবে গ্রহণ করিয়াছিলেন।
সুবা মালব বৃহত্তর রাজপুতানার অংশবিশেষ; উহার অভিজাত সম্প্রদায় রাজপুত, অধিকাংশ খিচী চৌহান; রাজপুতানার শিশোদীয়, রাঠোর ও হাড়া বংশের কনিষ্ঠ রাজপুতগণও মোগল সরকারে চাকরি করিয়া এইখানে নূতন জায়গীর লাভ করিয়াছিল। যুদ্ধই রাজপুতের উপজীবিকা; হয় সৈনিকবৃত্তি, না-হয় ডাকাতি ছাড়া সেকালে রাজপুতের ধাতে কিছুই সহ্য হইত না, দোয়াত-কলম লাঙল দাঁড়িপাল্লা কায়স্থ বৈশ্য শূদ্রাদির হীনবৃত্তি অবলম্বন তাহার পক্ষে নিন্দনীয় সামাজিক মৃত্যু। এই অর্থনৈতিক অবস্থার সংঘাতে রাজপুতের কুলাভিমান, দেশাত্মবোধ ও স্বধর্মপ্রীতি সপ্তদশ শতাব্দীতে নিস্তেজ হইয়া পড়িয়াছিল। এই কারণে “পেটকে ওয়াস্তে” তাহারা সাম্রাজ্যবাদের ভেদনীতির উত্তম শিকার হইয়া শাহাজাহানের রাজত্বে হিন্দুবিদ্রোহ দমনে, হিন্দুমন্দিরবিগ্রহ ধ্বংসে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অংশগ্রহণ করিতে ইতস্তত করে নাই। কুলক্রমাগত বৈর ও স্পর্ধা রাজপুতানার ঐক্যের পথে ছিল এক দুর্লঙ্ঘ্য বাধা; রাঠোর চৌহান শিশোদিয়া গৌর কচ্ছবাহের মধ্যে আপোস নাই, কেবল বিবাহ ব্যাপারে কোলাকুলি, অন্য সময় সুযোগ পাইলেই গলা কাটাকাটি। বিবেকবুদ্ধিবর্জিত, জীবিকার জন্য পরাশ্রয়ী, রাজনৈতিক মহানিদ্রায় অভিভূত ভূতিভুক ক্ষাত্রশক্তি দেশ ও জাতির পক্ষে বিপজ্জনক, পরাধীনতার লৌহনিগড়; শাস্ত্রজীবীর “স্বামিধর্ম” বা নিমকহালালি এইরূপ অধর্মের সেবায় পর্যবসিত হয়। মালবের রাজপুতগণের মধ্যে কেহ কেহ স্বার্থ বিপন্ন হইবার ভয়ে এবং অধিকাংশই মোটা জায়গীরের লোভে আওরঙ্গজেবের সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়াছিল, মোরাদের সৈন্যদলেও রাজপুত ছিল। এইভাবে বিভিন্ন কুলের রাজপুতগণ যুধ্যমান পক্ষদ্বয়ে বিভক্ত হইয়া পিতার বিরুদ্ধে পুত্র—(যথা রাও ছত্রশাল ও তৎপুত্র ভগবন্ত সিংহ), জ্ঞাতির বিরুদ্ধে জ্ঞাতি যুদ্ধার্থ সজ্জিত হইল। বিজয়ী আওরঙ্গজেব বেতোয়া তীর পর্যন্ত অগ্রসর হইয়া এক দল সৈন্যসহ বাহাদুর খাঁকে বুন্দেলখণ্ডের দিকে প্রেরণ করিয়াছিলেন; ইহা সামরিক অভিযান নহে, কূটনৈতিক পরিক্রমা। কে সর্বাগ্রে আওরঙ্গজেবের বশ্যতা স্বীকার করিয়া প্রতিবেশীর উপর টেক্কা দিবে—ইহা লইয়া বুন্দেলখণ্ডের সামন্ত রাজাদের মধ্যে হুড়াহুড়ি পড়িয়া গেল; বিদ্রোহী চম্পরায় বুন্দেলাকে হাত করিবার জন্য বাহাদুর খাঁ বন্ধুভাবে তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলেন। দারা চম্পায়ের দাবি মিটাইতে পারেন নাই, সুতরাং তিনি এককালে তাঁহাকে সম্রাটের কোপ হইতে রক্ষা করিলেও এখন শত্রু এই বিবেচনায় চম্পরায় কয়েক হাজার সেনা লইয়া আওরঙ্গজেবের দরবারে কুর্নিশ করিতে চলিলেন।
৮
২০শে এপ্রিল (১৬৫৮) উজ্জয়িনী ত্যাগ করিয়া আওরঙ্গজেব পূর্বদিকে দোরাহা (ভূপালের কয়েক মাইল উত্তরে) পর্যন্ত অগ্রসর হইয়া উত্তরমুখী গোয়ালিয়রের রাস্তা ধরিয়া ধীরগতিতে অগ্রসর হইতে লাগিলেন এবং এক মাস পরে (২১ মে) গোয়ালিয়র পৌঁছিলেন। আওরঙ্গজেবের এই মন্থর গতির কূটনৈতিক কারণ ছিল। গোয়ালিয়র অত্যন্ত সুদৃঢ় ও সুরক্ষিত বাদশাহী দুর্গ, দুর্গরক্ষক নাসিরী খাঁ বিখ্যাত যোদ্ধা এবং সম্রাটের বিশ্বস্ত আমীর; অথচ অবিজিত গোয়ালিয়র পশ্চাতে রাখিয়া আগ্রার পথে ধোলপুর ঘাটে চম্বল নদী পার হওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং প্রায় অসম্ভব। দারা আশা করিয়াছিলেন গোয়ালিয়র অবরোধ করিয়া হস্তগত করিতেই বিদ্রোহী ভ্রাতাদ্বয়ের কয়েক মাস লাগিয়া যাইবে, ইতিমধ্যে বর্ষা নামিবে এবং পুত্র সুলেমান মুঙ্গের হইতে আগ্রায় ফিরিবার অবকাশ পাইবে; কিন্তু আওরঙ্গজেবের কূটনীতি নিতান্ত অপ্রত্যাশিত ভাবে বাদশাহী হিসাব বানচাল করিয়া দিল, গোয়ালিয়র পৌঁছিবার পূর্বেই তাঁহার জন্য দুর্গদ্বার উন্মুক্ত হইয়া রহিল। পথে আওরঙ্গজেব নাসিরী খাঁর কাছে বিশ্বাসী দূত মারফত চিঠি লিখিয়া জানাইলেন তাঁহার পরলোকগত পিতার “খান-দৌরাঁ” খেতাবসহ পাঁচ হাজারী মনসব তাঁহারই জন্য অপেক্ষা করিতেছে। উভয়পক্ষে সংবাদ বিনিময় ও কথাবার্তা পাকা হইতে কিছু সময় লাগিয়াছিল, না-হয় ইচ্ছা করিলে তিনি দশ দিনেই উজ্জয়িনী হইতে ঝড়ের বেগে গোয়ালিয়র পৌঁছিতে পারিতেন। নাসিরী খাঁ গোড়া মুসলমান, শাহজাহানের প্রতি অনুরক্ত হইলেও দারাকে তিনি আওরঙ্গজেবের নজরেই দেখিতেন। আওরঙ্গজেব উপস্থিত হওয়া মাত্র তাঁহার হাতে দুর্গ সমর্পণ করিয়া নাসিরী খাঁ বাদশাহী ফৌজ লইয়া দারার বিরুদ্ধে যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হইলেন।
অন্য কারণ, সম্রাটের মনের উপর ধর্মাত যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া আগত হওয়ার জন্য আওরঙ্গজেব ধীর-গতিতে সৈন্যচালনা করিতেছিলেন। তাঁর “পঞ্চমবাহিনী” পূর্ব হইতেই সম্রাটের দরবারে অনুপ্রবিষ্ট ছিল; উহার মারফত যুদ্ধের পর শাহজাহানের সংশয়াচ্ছন্ন দ্বৈধীভাব এবং কোন কোন সময় দারার যুদ্ধচেষ্টায় বিরক্তি ও স্পষ্ট অনিচ্ছাপ্রকাশ ইত্যাদি সংবাদ তিনি অবিলম্বে জানিতে পারিলেন, পিতার নাড়ির গতি লক্ষ্য করিয়া ভ্রাতার যুদ্ধায়োজন শিথিল করিবার জন্য আওরঙ্গজেব পিতার কাছে লিখিলেন, দারাই শাস্তির বিরোধী, তাঁহার কোনও দোষ নাই। ধর্মাতের যুদ্ধের পর ভগ্নী জাহানারা আওরঙ্গজেবকে লিখিলেন, “আর অগ্রসর হইও না, দরবারে তোমার দাবি পেশ কর”; শাহজাহান নিজের হাতে ফরমান লিখিয়া পাঠাইলেন “দাক্ষিণাত্যে ফিরিয়া যাও, উহার পাঁচসুবা তোমার।” আওরঙ্গজেব পিতার দুর্বলতা বুঝিতে পারিয়া প্রত্যুত্তরে জানাইলেন, “কদমবোসী করিবার জন্য এত কাছে আসিয়া ফিরিয়া যাওয়ার প্রশ্ন উঠিতে পারে না; দাদাভাই দীর্ঘকাল দরবারে খেদমত করিয়াছেন, তাঁহাকে নিজ-সুবা লাহোরে পাঠাইয়া আমাকে ও ভাই মোরাদকে কিছুকাল আপনার সেবার অধিকার দিলেই বিরোধ চুকিয়া যায়।”
ছন্নমতি সম্রাট ইহাতে আরও বিভ্রান্ত হইয়া আপোসমীমাংসার জন্য উদ্গ্রীব হইলেন; একবার ভাবিলেন, উত্তম প্রস্তাব – পুত্রদ্বয়কে আগ্রার রাস্তা ছাড়িয়া দিলে ক্ষতি কি? ছেলেরা আমার অবাধ্য হইবে না, আমি হুকুম করিলে দারাকে পূর্ববৎ আমার কাছে রাখিয়া তাহারা নিশ্চয়ই কয়েকদিন পরে নিজ-নিজ সুবায় চলিয়া যাইবে; কখনও বলিতেছিলেন স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে যাইয়া পুত্রগণকে অস্ত্রত্যাগ করিতে বাধ্য করিবেন। যুদ্ধক্ষেত্রে গেলে তিনি কিনা যুদ্ধেই মহাবত খাঁর হস্তে সম্রাট জাহাঙ্গীরের দশাই প্রাপ্ত হইতেন; আওরঙ্গজেব মহাবত খাঁ নহেন, কোহিনূরের বদলে তিনি পিতার পদধূলি লইয়া নিশ্চয়ই দৌলতাবাদে ফিরিয়া যাইতেন না। দরবারে বসিয়া দিল্লীশ্বর যখন এইরূপ প্রলাপ বকিতেছিলেন, তখন দারার অগ্রগামী সেনা বড়বড় শাহীতোপ লইয়া আগ্রা হইতে আনুমানিক ত্রিশ মাইল দক্ষিণে, গোয়ালিয়র হইতে চল্লিশ মাইল উত্তরে ধোলপুরে যুদ্ধার্থ প্রস্তুত, দারা পিতার নিকট হইতে বিদায় লইবার জন্য অস্থির। অবশেষে সম্রাট একদিন মন্ত্রকক্ষে তাঁহার মানিকজোড় ভায়রাভাই খলিল-উল্লা খাঁ ও জাফর খাঁ, রাজশ্যালক শায়েস্তা খাঁ এবং উচ্চপদস্থ ইরানী ও তুরানী আমীরগণকে তলব করিলেন, রাও ছত্রশাল তখনও সম্ভবত আগ্রা পৌঁছেন নাই। বিরুদ্ধমুখী চিন্তাধারার সংঘাতে সম্রাটের বুদ্ধি প্রায় লোপ পাইয়াছিল; আসন্ন যুদ্ধের মুখে তিনি আওরঙ্গজেবের চিঠির দ্বারা প্রতারিত হইয়া এই সমস্ত নিমকহারামের সহিত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব উত্থাপন করিলেন; তাঁহারা আলাহজরতের মুখে এই শান্তির বাণী শুনিয়া প্রশংসায় পঞ্চমুখ হইলেন, এই সর্বনাশা জল্পনা যাঁহাদের মনঃপুত হইল না তাঁহারা চুপ করিয়া রহিলেন; মুখের উপর বাদশাহী মর্জির খেলাপ কিছু বলিবার সাহস কাহারও হইল না। কিছুক্ষণ বাগবিতণ্ডার পর কথার মারপ্যাচে দারার মাথা গরম হইয়া উঠিল; মেজাজ ও জিহ্বার উপর রাশ টানিয়া ধরিতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না; রাগে হিতাহিতজ্ঞান হারাইয়া দারা বলিয়া ফেলিলেন, লড়াই করিবার যদি কাহারও হিম্মত না হয়, রাও ছত্রশাল হাড়া ও মীর আতস জাফর আওরঙ্গজেব মোরাদকে একজোড়া খরগোশের মতো নর্মদা নদীর অপর পারে তাড়াইয়া যাইবে! ইরানী তুরানীর বুকে এই শ্লেষ তীরের ন্যায় বিধিয়া রহিল, আওরঙ্গজেবের কূটনীতি দারাকে পঙ্কে পাতিত করিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করিল।