ত্রয়োদশ অধ্যায় – গৃহযুদ্ধের কারণ ও দায়িত্ব
১
মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে দারার দুর্ভাগ্য, শাহজাহানের বন্দীদশা, শুজা ও মোরাদের শোচনীয় পরিণাম—ইহার জন্য দায়ী কে? এই প্রশ্ন নিতান্ত সহজ নহে। ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে একতরফা রায় দেওয়া সেকালের কাজীর বিচার, একালে ওইজাতীয় ঐতিহাসিক বিচার গবেষণার নামে ওকালতি। বোধ হয়, আওরঙ্গজেবের মনে সন্দেহ হইয়াছিল খোদাতালা ছাড়া পাপিষ্ঠ মানুষও হয়তো কোনদিন তাঁহার কাজের বিচার করিবে। এইজন্য প্রাথমিক সাবধানতাস্বরূপ তিনি দরবারী ইতিহাস রচনা এক রকম বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন; দ্বিতীয়ত গৃহযুদ্ধে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য পিতার সহিত শাসনসংক্রান্ত ও পারিবারিক ব্যাপারে যে সমস্ত চিঠি লেখালেখি হইয়াছিল এবং শাহী দরবারে দারার চক্রান্তে বিপন্ন
ইসলামের স্বার্থরক্ষার নিমিত্ত নিজে কিরূপ প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছিলেন, তৎসমুদয় দলিল দস্তাবেজে প্রস্তুত রাখিয়া গিয়াছেন। যুদ্ধের ছয় মাস পূর্ব পর্যন্ত দারা তাঁহার দিল্লিস্থ “নিগমবোধ-মঞ্জিল” প্রাসাদে উপনিষদের ফার্সি অনুবাদকার্যে মহা ব্যস্ত ছিলেন; ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধপ্রস্তুতি কিংবা মোকদ্দমা সাজাইবার তাঁহার সময় কোথায়? দারা মানুষকে বড় বিশ্বাস করিতেন; বিশ্বাস করিয়া ঠকিয়াছিলেন, বিচারের ভার মানুষের উপরই ছাড়িয়া গিয়াছেন। নিরপেক্ষ সত্য অনুসন্ধিৎসায় যাহা সম্ভব, এই প্রশ্ন মীমাংসায় আচার্য যদুনাথ চূড়ান্ত রায় দিয়াছেন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিসমূহের উপর গৃহযুদ্ধে দায়িত্বের অংশ ন্যায্যমত বণ্টন করিয়াছেন।* সম্প্রতি আমরা সংক্ষেপে শাহজাহান এবং তাঁহার পুত্র চতুষ্টয়ের অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ আলোচনা করিব।
[*বর্তমানে কয়েকজন লেখক ইতিহাসের নামে ‘অজুহাত নামা” (Apologia) লিখিয়াছেন, যথা—মৌলানা শিবলী নুমানী (উর্দু); কোরেশী – History of Aurangzib.]
২
পুত্রের পিতা এবং সম্রাট হিসাবে শাহজাহানের বিরুদ্ধে আওরঙ্গজেবের প্রধান অভিযোগ—
ক) স্নেহ ও অনুগ্রহ বণ্টনে দারার প্রতি অযৌক্তিক পক্ষপাতিত্ব।
খ) দারার ষড়যন্ত্রে আওরঙ্গজেবের কার্যে বাধাদান ও তাঁহাকে অপমান।
গ) আওরঙ্গজেবের প্রতি বিদ্বেষ ও অযথা সন্দেহ। ইহার সহিত ইতিহাসের দুইটি অতিরিক্ত ধারা-
ঘ) সম্রাটের দোষ ত্রুটি পুত্রগণের বিদ্রোহের প্রকৃত কারণ কি না।
ঙ) আসন্ন গৃহযুদ্ধ নিবারণের জন্য সম্রাট সমস্ত সম্ভাব্য উপায় অবলম্বন করিয়াছিলেন কি না।
শাহজাহান পুত্র চতুষ্টয়ের প্রতি বিশেষ স্নেহাসক্ত ছিলেন, কিন্তু অনুগ্রহ সমান ভাবে বণ্টিত হয় নাই—ইহা ঐতিহাসিক সত্য। তিনি আওরঙ্গজেবকে শাসনকার্যে দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার জন্য যথোচিত প্রশংসা করিতেন এবং কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্য সুযোগ দানে কার্পণ্য করেন নাই। “প্রশংসা” শত্রুমিত্র সকলের নিকট হইতে জবরদস্তি করিয়া আদায় করা যায়, কিন্তু “ভালোবাসা”র উপর আবদার চলিতে পারে, জবরদস্তি চলে না। আওরঙ্গজেবকে ভালোবাসার পাত্র হইবার মতো, কিংবা দুনিয়ায় স্ত্রী পুত্র মিত্রকে বিশ্বাস ও ভালোবাসিবার ক্ষমতা খোদাতালা দেন নাই। নিজের পুত্রগণের প্রতি আওরঙ্গজেবের নির্মম কঠোরতা এবং সতর্ক দৃষ্টি যদি শাহজাহানের থাকিত তাহা হইলে পুত্রের মতো তিনিও গৃহযুদ্ধ নিবারণ করিতে পারিতেন, বন্দীদশায় তাঁহার মৃত্যু হইত না। গুণ ও কার্যের অনুপাতে দারা অপেক্ষা আওরঙ্গজেব কম জায়গীর ও মনসব পাইয়াছিলেন; কিন্তু বিচার্য বিষয়, দারা অপেক্ষা বেশি পাইলে তিনি কি করিতেন? জাহাঙ্গীর তাঁহার প্রিয়তম এবং যোগ্যতম তৃতীয় পুত্র শাহজাদা খুররমকে (পরে সম্রাট শাহজাহান) ত্রিশ হাজারী মনসবদারী প্রদান করেন এবং প্রথম ও দ্বিতীয় পুত্রকে বাদ দিয়া তাঁহাকেই যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করিয়াছিলেন—এইরূপ সুবিচারে খুর্রমের পিতৃদ্রোহ নিবারিত হইল না কেন? আসল কথা, শাহজাহান পুত্রকে চিনিয়াছিলেন।
আওরঙ্গজেব যে “সুবিচার” দাবি করিতেন, দিল্লিসাম্রাজ্য এবং অন্যান্য পুত্রের জীবন বিপন্ন করিয়া উহা পূর্ণ করিলে শাহজাহান রাজধর্মচ্যুত হইতেন, মাতা মমতাজ বাঁচিয়া থাকিলেও আওরঙ্গজেব ময়দান সাফ করিয়া ফেলিতেন। অন্যান্য পক্ষপাতিত্বের নমুনা :-
১। সুবা মুলতান এবং সুবা লাহোরের সীমামুখে ইসমাইল হুত নামক এক বেলুচ জমিদার মুলতান-সুবাদার আওরঙ্গজেবের আদেশ অমান্য করিয়া লিখিয়াছিল, সে লাহোরের সুবাদার শাহজাদা দারার প্রজা এবং অজুহাত স্বরূপ দারার চিঠিও দাখিল করে। আওরঙ্গজেব দারার বিরুদ্ধে নালিশ করিলেন। সম্রাট স্বয়ং দুই সুবার সীমা নির্দেশ করিয়া আওরঙ্গজেবের সপক্ষে রায় দিয়াছিলেন।
২। ইহার দুই বৎসর পরে আওরঙ্গজেব যখন দ্বিতীয়বার দাক্ষিণাত্যের সুবাদার নিযুক্ত হইয়া বদলি হইলেন তখন মুলতান সুবা দারাকে দেওয়া হইয়াছিল। সুবাদার বদলি হওয়া সুবার প্রজাগণের পক্ষে এক মহা উৎপাত। যিনি বদলি হইতেন তাঁহার কর্মচারীগণ জবরদস্তি করিয়া কিস্তির খাজনা আগাম উসুল করিত; তখন সুবার অবস্থা যেন পররাজ্যে দখলকারী ফৌজের পশ্চাদপসরণের আনুষঙ্গিক অরাজকতা। অপর পক্ষে, নূতন সুবাদারের পাইক বরকন্দাজ দেওয়ান ফৌজদার দখল কায়েম করিবার জন্য সুবার অবস্থা নববিজিত দেশের ন্যায় করিয়া তুলিত। মুলতানে দারার কর্মচারীগণ অভিযোগ করিল, পূর্ববর্তী সুবাদারের আমলারা মুলতান শহরে সরকারি ইমারতগুলি ভাঙিয়া কড়িবরগা ও চৌকাঠ পর্যন্ত বিক্রি করিয়া গিয়াছে। দারা কিছুমাত্র সন্দেহ না করিয়া সরাসরি ওই অভিযোগ দরবারে পেশ করিলেন। আওরঙ্গজেবের কাছে কৈফিয়ত তলব হইল। আওরঙ্গজেব এইরূপ কাঁচা কাজ করিবার লোক ছিলেন না; বিচারে দারার কর্মচারীগণও দোষী সাব্যস্ত হইল।
৩
আওরঙ্গজেবের প্রতি শাহজাহানের সন্দেহ ও অবিশ্বাস অধিকাংশ স্থলেই অমূলক ছিল না। তবে একটি ব্যাপারে আওরঙ্গজেবের প্রতি তিনি নিঃসন্দেহ অবিচার এবং অশোভন সন্দেহ করিয়াছিলেন যাহা “যাটি বুদ্ধি নাটি” ছাড়া কিছুই নহে।
বুরহানপুরের শাহীবাগে একটা আমগাছ ছিল— নাম বাদশাপছন্দ। ওই আমগাছের জন্য দাক্ষিণাত্যের সুবাদারকে শাহী খেদমতের ব্যবস্থা করিতে হইত এবং আম পাকিলে কিস্তি করিয়া জরুরি ডাকচৌকি মারফত দিল্লি আগ্রা পৌঁছাইবার ব্যবস্থা করিতে হইত, আমের ঝুড়ি কোথায়ও মাটিতে রাখিবার হুকুম ছিল না। দ্বিতীয়বার আওরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্যে বদলি করিবার সময় শাহজাহান পুত্রকে এই আমগাছের কথা বিশেষভাবে বলিয়া দিয়াছিলেন। ওই গাছের তদারক করিবার জন্য নূতন সুবাদার এক অতি বিশ্বস্ত কর্মচারীকে বুরহানপুরে রাখিয়া গিয়াছিলেন। আমের প্রথম ঝুড়ি দরবারে পৌঁছিবার পর আম খাইয়া আলা হজরত বলিলেন, এইবার আম ঠিক সময়ে তোলা হয় নাই। দ্বিতীয় ঝুড়ির উপর মন্তব্য হইল, আম বোধ হয় আসিবার সময় মাটিতে রাখা হইয়াছিল। তৃতীয় ঝুড়ি দেখিয়া সম্রাট বলিলেন, আম এই বৎসর যেন সংখ্যায় কম; জাহানারা ভাইকে এই কথা জানাইয়া দিলেন। আওরঙ্গজেব প্রমাণাদিসহ কৈফিয়ত দিলেন ঝড়ে একটা বড় ডাল ভাঙিয়া গিয়াছে এবং আমও কম ফলিয়াছে। ইহাতেও নিস্তার নাই। পরের কিস্তি পৌঁছিবার পর আলা হজরত বলিলেন, আমের ঝুড়ি বোধ হয় বুরহানপুর হইতে দৌলতাবাদ ঘুরিয়া আসে!
এইরূপ উক্তি সম্রাটের সমাগত দ্বিতীয় শৈশবের ছায়া।
আওরঙ্গজেবের চিঠিপত্র হইতে দেখা যায়, দ্বিতীয়বার দাক্ষিণাত্যে আগমনের পর হইতেই শাহজাহান এবং দারার বিরুদ্ধে তাঁহার বেশির ভাগ অভিযোগ। এই সমস্ত অভিযোগ সত্য হইলেও ওইগুলিকে গৃহযুদ্ধের কারণ বলিয়া গ্রহণ করা যায় না। ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসেই শুজার সহিত দিল্লিতে এবং মোরাদের সহিত মালবে দেখাসাক্ষাৎ করিয়া আওরঙ্গজেব দারার বিরুদ্ধে একযোগে যুদ্ধ করিবার পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা স্থির করিয়া ফেলিয়াছিলেন এবং ইহার পর হইতে এই গুপ্ত “ত্রিবর্গ” মিত্রশক্তির তিনিই সেক্রেটারি এবং পোস্টআপিস স্বরূপ কাজ করিতেছিলেন, সুতরাং দাক্ষিণাত্যের ব্যাপার আওরঙ্গজেবের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি––উহাকে “কার্য” বলা যাইতে পারে, “কারণ” নহে। দাক্ষিণাত্যের ব্যাপার সংক্ষেপে এইরূপ :
ইরান দেশের ইস্পাহান শহর হইতে এক তেলীর ছেলে (তবুও সৈয়দ!) গোলকুণ্ডায় আসিয়া ক্রমে হীরা-জহরত-ব্যবসায়ী এবং পরে সুলতান আবদুল্লা কুতব শাহের উজির- আজম হইয়াছিলেন—ইহার ইতিহাসবিখ্যাত নাম মীরজুমলা। অতঃপর তেলী-নন্দনের কোথায়ও একজন স্বাধীন সুলতান হইবার বাসনা হইল। তিনি পুত্র মহম্মদ আমিনকে গোলকুণ্ডায় নায়েব-উজির রাখিয়া গোলকুণ্ডার সৈন্য ও অর্থবলের সাহায্যে কুতবশাহের নামে পূর্বকর্ণাটক অঞ্চল জয় করিয়াছিলেন এবং ওইখানেই স্বাধীনভাবে বাস করিতে লাগিলেন। এদিকে মহম্মদ আমিন কুতবশাহের জীবন অতিষ্ঠ করিয়া তুলিয়াছিল। কুতবশাহ দিলদরিয়া লোক; সঙ্গীত ও সুফীতত্ত্ব লইয়াই থাকিতেন। একদিন নায়েব-উজির মহম্মদ আমিন পানোন্মত্ত অবস্থায় মসনদের উপর শাহী গালিচায় শুইয়া কুতবশাহের জন্য অপেক্ষা করিতে করিতে গালিচার উপর শরাব বমি করিয়া ফেলিলেন। ভালোমানুষ কুতবশাহ হঠাৎ রাগিয়া নায়েব-উজিরকে কারারুদ্ধ করিলেন এবং কর্ণাটক হইতে মীরজুমলাকে প্রত্যাবর্তনের আদেশ দিলেন। আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে আসিয়াই মীরজুমলার সহিত কুতবশাহের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইয়াছিলেন এবং গোলকুণ্ডা আক্রমণের অছিলা খুঁজিতেছিলেন। আমিনকে মুক্তি দিবার জন্য শাহজাহান যে ফরমান আওরঙ্গজেবের সঙ্গে লিখিত চিঠির সহিত পাঠাইয়াছিলেন, তিনি উহা জঘন্য ভাবে চাপা দিয়া সম্রাটের আদেশ অমান্যের অজুহাতে গোলকুণ্ডা রাজ্য আক্রমণ করিলেন, আসল ব্যাপার কুতবশাহ বা সম্রাট কাহাকেও জানিতে দিলেন না (১০ই জানুয়ারি ১৬৫৬)। কুতবশাহের দূত অনন্যোপায় হইয়া প্রভুকে এই অন্যায় আক্রমণ হইতে রক্ষার জন্য দারার শরণাপন্ন হইলেন। দারার নিকট হইতে প্রকৃত অবস্থা জানিতে পারিয়া কুতবশাহকে ক্ষমা করিয়া সম্রাট এক ফরমান পাঠাইয়াছিলেন (৮ই ফেব্রুয়ারি ১৬৫৬)। আওরঙ্গজেব উহাও চাপা দিয়া যুদ্ধ চালাইতে লাগিলেন। দারা ও জাহানারা উভয়েই এইবার কুতবশাহকে রক্ষা করিবার জন্য আবেদন জানাইলেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া কড়া আদেশ পাঠাইলেন, যুদ্ধ তৎক্ষণাৎ বন্ধ করিয়া বাদশাহী ফৌজকে গোলকুণ্ডা রাজ্য হইতে সরিয়া আসিতে হইবে (৩০শে মার্চ, ১৬৫৬)।
আওরঙ্গজেব মনে করিলেন ইহা দারার ষড়যন্ত্র, পিতার অবিচার।
বাঘের মুখ হইতে শিকার কাড়িয়া লওয়া বিপজ্জনক হইতে পারে; কিন্তু এইরূপ কার্যকে কেহ বাঘের প্রতি অবিচার বলিবেন কি? দুই দুই খানা শাহী ফরমান বেমালুম গায়েব করিয়া ফেলিবার অপরাধের জন্য আওরঙ্গজেবকে বদলি করিলেই সুবিচার হইত।
৪
সম্রাট শাহজাহানের লোভে পাপ এবং পাপে যাহা হইয়া থাকে তাহাই হইয়াছিল। এই লোভের বশেই তিনি পুনরায় আওরঙ্গজেবের ফাঁদে পড়িলেন। পুত্রের চিঠিতে গোলকুণ্ডার প্রতি বিশ্বাসঘাতক মীরজুমলার গুণরাশি শুনিয়া তিনি তাঁহাকে দিল্লিতে আমন্ত্রণ করিলেন এবং মৃত উজির সাদুল্লার স্থলে প্রধান মন্ত্রিপদে নিযুক্ত করিলেন (জুলাই ১৬৫৬ ইং)। সম্রাট কিছুদিন তাঁহার পরামর্শ অনুসারে চলিতে লাগিলেন; দারার কথায়ও আমল দিতেন না। ওই বৎসর (৪ঠা নভেম্বর, ১৬৫৬) বিজাপুরের পরাক্রান্ত এবং শাহজাহানের বন্ধুস্থানীয় সুলতান মহম্মদ আদিল শাহের মৃত্যু হওয়ার পর ওই রাজ্যে গোলযোগ দেখা দিয়াছিল। আওরঙ্গজেব এই সুযোগে বিজাপুর জয় করিবার আয়োজন করিতে লাগিলেন এবং সম্রাটের কাছে লিখিলেন, আদিল শাহের উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় আদিল শাহ তাঁহার আসল পুত্র নহে। মীরজুমলা সম্রাটকে বুঝাইলেন বিজাপুর অতি সহজে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করিবার ইহাই সুবর্ণ সুযোগ। শাহজাহান এই লোভ সংবরণ করিতে পারিলেন না; বিজাপুরের বিরুদ্ধে এই “অধর্ম” যুদ্ধে আওরঙ্গজেবের কাছে একেবারে সাদা চেক পাঠাইয়া দিলেন। মালব এবং অন্যান্য সুবার বাদশাহী ফৌজ লইয়া মীরজুমলা আওরঙ্গজেবের সাহায্যার্থ ১৬৫৭ খ্রিঃ জানুয়ারি মাসে শাহজাদার সহিত মিলিত হইলেন। আওরঙ্গজেবের উদ্দেশ্য সফল হইল।
আলা হজরত জহরত ভালো চিনিতেন; কিন্তু এই ইরানী শিয়া জহুরি তাঁহাকে ঠকাইয়া গেল। আট মাস পরে বিজাপুরের রাজদূত শাহজাদা দারার মারফত সন্ধিপ্রার্থী হইলেন। ইতিমধ্যে মোহগ্রস্ত সম্রাট চৈতন্যলাভ করিয়াছিলেন। আওরঙ্গজেবের কুমতলব আশঙ্কা করিয়া তিনি হুকুম পাঠাইলেন, তাঁহার নির্দিষ্ট শর্তে সন্ধি করিয়া ফরমান পাওয়া মাত্ৰ যেন যুদ্ধ বন্ধ করা হয়, অধিকন্তু হিন্দুস্থানের বাদশাহী মনসবদারগণের কাছে সোজাসুজি ফরমান প্রেরিত হইল তাঁহারা যেন অবিলম্বে ফৌজসহ দরবারে ফিরিয়া আসেন (সেপ্টেম্বর, ১৬৫৭)। দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধ জিয়াইয়া রাখিয়া হিন্দুস্থানের বাদশাহী ফৌজ তাঁহার অধীনে যুদ্ধে ব্যাপৃত থাকিলে দারা আত্মরক্ষার উপায় হইতে বঞ্চিত হইবে– এই মতলবেই আওরঙ্গজেব বিজাপুর-গোলকুণ্ডার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অন্যায় যুদ্ধপঙ্কে সম্রাটকে প্রলোভিত করিয়াছিলেন।
সম্রাট এই অন্যায় কার্যে অসঙ্গত দৃঢ়তা অবলম্বন করিয়া আওরঙ্গজেবের হাতে ক্রীড়নক হইলেও অনিবার্য গৃহযুদ্ধ তিনি নিবারণ করিতে পারিতেন না।
৫
গৃহযুদ্ধের জন্য কোনও কোনও ঐতিহাসিক শাহজাহানের উপর প্রধান দায়িত্ব চাপাইয়া গিয়াছেন। তাঁহাদের প্রথম অভিযোগ, পুত্রগণের ধর্ম-শিক্ষায় সম্রাট উদাসীন ছিলেন, দারাকে পাকা সুন্নি বানাইলেই মুসলমানেরা ধর্মের নামে আওরঙ্গজেব কর্তৃক প্রতারিত হইত না। ইহা অতি স্থূল যুক্তি। ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায়, পুণ্যাত্মা খলিফা হজরত আলীর পক্ষ ত্যাগ করিয়া প্রসিদ্ধ মুসলমান অভিজাতবর্গর কপটী মুনাফেক মাবিয়ার সহিত যোগ দিয়াছিলেন; ইহাদের মধ্যে আলীর চাচা আব্বাসও ছিলেন। দারা সুন্নি হইলে তাঁহার পথ কিঞ্চিৎ সুগম হইত, কিন্তু দারা ও আওরঙ্গজেবের মধ্যে সদ্ভাব হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। শাহজাহান পুত্রগণের মধ্যে সাম্রাজ্য ভাগাভাগির পরিকল্পনাও করিয়াছিলেন; কিন্তু উহাতেও শান্তির আশা ছিল না। ভাগের কম্বলে সাতজন ফকির নাক ডাকিয়া ঘুমাইতে পারে; কিন্তু সসাগরা সপ্তদ্বীপ পৃথিবীর আধিপত্য একজন বাদশাহের মাটির ক্ষুধা মিটাইতে পারে না। শাহানশাহ দিল্লির বাদশাহী নিক্তির ওজনে চারি পুত্রের মধ্যে ভাগ করিয়া দিলেও গৃহযুদ্ধ বন্ধ হইত না। শাহজাহানের মতো অবস্থায় পড়িয়া খলিফা হারুন-অল-রসিদ পর্যন্ত ওইরূপ ভাগাভাগি করিয়া ব্যর্থকাম হইয়াছিলেন—”অন্যে পরে কা কথা”।
একমাত্র রুমী কায়দা ব্যতীত বংশানুক্রমিক সাম্রাজ্যে গৃহযুদ্ধ বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। তুর্কী সুলতানগণ তাঁহাদের জীবদ্দশায় পুত্রগণের মধ্য হইতে একজনকে উত্তরাধিকারী নির্বাচন করিয়া বাদবাকির জন্য আজীবন কারাগারেই আরামের ব্যবস্থা করিতেন। আওরঙ্গজেবকে প্রথম বয়সে পদচ্যুতির পর সরাসরি মক্কাশরীফে পাঠাইয়া দিলে গৃহযুদ্ধের বীজ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হইত। মমতাজের মৃত্যুর পর পিতার শাসন অপেক্ষা মাতার স্নেহ সন্তানগণ শাহজাহানের নিকট হইতে পাইয়াছিলেন। অন্তর হইতে মমতাজের স্মৃতিকে বিসর্জন দিয়া, পার্শ্বে তাঁহারই ছায়া জননীর প্রতিচ্ছবি কন্যা জাহানারার মর্মে আঘাত করিয়া এইরূপ কার্য শাহজাহান করিলে তাঁহারই হৃদয়ের মর্মগ্রন্থি ছিন্ন হইয়া যাইত। পুত্রগণ বিদ্রোহী হওয়ার পরে এই স্নেহ তাঁহার করধৃত রাজদণ্ডের শক্তিকে দুর্বল করিয়াছিল।
৬
গৃহযুদ্ধের জন্য দায়ী না হইলেও দারার দুর্ভাগ্যের জন্য পিতা ভ্রাতা কিংবা জগৎপিতা কেহই দায়ী নহেন। তিনি পিতৃদত্ত সুযোগের যথোচিত ব্যবহার করেন নাই, যুবরাজের বিপদ ও দায়িত্ব সম্বন্ধে তিনি সচেতন ছিলেন না–অতি বিলম্বে তাঁহার “ যোগনিদ্রা” ভঙ্গ হইয়াছিল। ছয় সুবার বিপুল অর্থ এবং সেনাবাহিনী তিন ভ্রাতার সম্ভাব্য বিরোধিতা ব্যাহত করিবার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকিলে অবস্থা অন্য রকম হইত; অবহেলা করিয়া তিনি নিজে ডুবিলেন বৃদ্ধ পিতাকেও ডুবাইলেন। দল গঠনে আওরঙ্গজেবের মতো দক্ষতা শাহজাদা দারার ছিল না; অথচ তিনি দলের ঊর্ধ্বে থাকিতে পারেন নাই––যাহারা প্রকৃত কাজের লোক তাঁহাদিগকে চটাইয়াছেন। এই হিসাবে প্রতিপক্ষকে সুযোগ দেওয়ার দোষ এবং গৃহযুদ্ধের জন্য পরোক্ষ দায়িত্ব হইতে দারা সম্পূর্ণ অব্যাহতি পাইতে পারেন না।
আকবরের উদার নীতি অনুসরণ করিয়া শাহজাদা দারা রাজনীতিক্ষেত্রে দৃষ্টির প্রসার ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়াছিলেন সন্দেহ নাই; কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীর মুসলমান সমাজে ক্রমবর্ধমান ধর্মান্ধতার জোয়ারে ভাঁটি সাঁতরাইবার মতো প্রপিতামহের অনন্যসাধারণ শক্তি তাঁহার ছিল না – আওরঙ্গজেব এই জোয়ারে গা ভাসাইয়া তাঁহাকে পাশ কাটাইয়া অভীষ্ট লক্ষ্যে অল্পায়াসে পৌঁছিয়াছিলেন।
৭
“রাজতন্ত্র”-মতে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে বিপরীত সাধনায় নিমগ্ন কুমার আওরঙ্গজেবের মধ্যে ঐতিহাসিক “মহা”-পুরুষের সমস্ত লক্ষণ দেখিতে পাওয়া যায়। রাজধর্মের প্রথম সূত্র, “মনস্যন্যদ্ বচস্যন্যদ্ কর্মণ্যন্যৎ—” তাঁহার চরিত্রে সুপরিস্ফুট। তিনি চিরকাল মনে এক, কথায় অন্য এবং কাজে আর কিছু। তৎকালীন সমাজে কিংবা মোগলদরবারে বুদ্ধিমান ব্যক্তিগণের দৃষ্টিতে এই নীতি দোষাবহ কিংবা নিন্দনীয় ছিল না। বর্তমান যুগেও বিশ্বের দরবারে কার্যোদ্ধারের জন্য এই নীতি কেহ কেহ অপরিহার্য বিবেচনা করিয়া থাকেন।
আওরঙ্গজেব স্থির করিয়া ফেলিয়াছিলেন তিনি কাহারও হাতে “কোরবানে”র উট হইবেন না; তাঁহার ভাগ্যে হয় দরবেশী, না হয় বাদশাহী। তিনি জানিতেন আল্লা তাঁহার একমাত্র প্রকৃত সহায়, শুজা-মোরাদ ভগ্নী রোশনারা, মাতুল শায়েস্তা খাঁ কিংবা মেসো জাফর-খলিল উল্লা নহে; জীবনে যদি ঈদ কখনও আসে উহাতে আল্লার নামে উৎসর্গীকৃত তাঁহার ঈদের উট ছাগল হইবে দারা শুজা ও মোরাদ। সরল জীবনযাত্রা, সরলতা বর্জিত সৌজন্য ও প্রিয়ভাষিতা এবং শরিয়তে সুবিধাবাদী নিষ্ঠায় কুমার আওরঙ্গজেব প্রথম হইতেই উদীয়মান “জিন্দাপীর”—মুখে ফকিরি ছাপ ও দরবেশী বুলি, ইসলামের জন্য প্রচারমূলক আশঙ্কা, পিতার প্রতি ভক্তির বাণী এবং শুজা ও মোরাদের প্রতি নিঃস্বার্থ প্রেম ও হিতচিন্তার ফোয়ারা। কার্যে তাঁহার অতি প্রশংসনীয় শাস্ত্রোক্ত “আফল-কর্মোদয়” নীতি ফলপ্রসূ না হইলে তিনি কি করিবেন তাহারও সন্দেহ কিংবা অনুমান করিবার সাধ্য ছিল না—ফলপ্রসূ হইবার পূর্বে কেহ জানিতে পারিত না। শাহজাহানের রাজত্বে অভিনীত বীভৎস-বিয়োগান্ত গৃহযুদ্ধ নাটিকার নটগুরু কিন্তু স্বয়ং আওরঙ্গজেব। তিনিই প্রযোজক, তিনিই প্রথম অঙ্কে শুজা ও মোরাদের উপদেষ্টা সাজিয়া তাঁহাদের দুরাকাঙ্ক্ষাবহ্নিতে ইন্ধন যোগাইয়াছিলেন— এই অভিয়োগ অস্বীকার করিবার উপায় নাই। পিতার বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম বিদ্রোহী হইলেও শুজা ও মোরাদের দায়িত্ব আওরঙ্গজেব অপেক্ষা অনেক কম।
শাহজাহানের পুত্র চতুষ্টয়ের মধ্যে প্রত্যেকেই নিজেকে অপর অপেক্ষা বেশি “লায়েক” মনে করিতেন। ইহাদের মধ্যে কনিষ্ঠ মোরাদ ছিলেন চরিত্রে আওরঙ্গজেবের ঠিক বিপরীত। চিন্তা-ভাবনা ভয়-কপটতা সংযম-ধর্মনিষ্ঠা মোরাদের ছিল না। “বলং বলং বাহুবলম্” বলিয়া সর্বদা বাহ্বাস্ফোটন––শাহীপরিবারে তিনি যেন “বলভদ্রে”র তুর্কী অবতার-বুদ্ধিতে হলধর, পান-ভূমিতে মদিরালোলাক্ষ স্খলিতপ্রয়াত কাদম্বরী পানোদ্ধত-পৃথুশ্রী রেবতীরমণ, যুদ্ধক্ষেত্রে এবং বিক্রমে সঙ্কর্ষণ। তিনি প্রায় প্রকৃতিস্থ থাকিতেন না, হয় রক্তপাত না হয় শরাব ও সুন্দরী তাঁহাকে অপ্রকৃতিস্থ করিয়া রাখিত। দাদা আওরঙ্গজেব বলিয়াছিলেন, তিনি তাঁহাকে দিল্লির তক্তে বসাইয়া মক্কাযাত্রা করিবেন। তাঁহার কথায় বিশ্বাস করিয়া এবং ষড়যন্ত্র জালে আবদ্ধ হইয়া মোরাদ প্রথমেই যুদ্ধে নামিয়া পড়িয়াছিলেন। মোরাদের অসুর-বিক্রম আওরঙ্গজেবের ইঙ্গিতে চালিত হইয়া দারার শক্তি ধূলিসাৎ করিয়াছিল, দিল্লীশ্বর ও দিল্লিসাম্রাজ্যকে আওরঙ্গজেবের হাতে তুলিয়া দিয়াছিল। দাদাকে তিনি সরল মনে নিজের মাথায় কাঁঠাল ভাঙিতে দিয়া মাথাটাই হারাইয়াছিলেন। গৃহযুদ্ধে আওরঙ্গজেব মুখ্য এবং মোরাদ গৌণ অপরাধী; শুজা ও আওরঙ্গজেবের মধ্যে প্রায় সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি।
সুলতান শাহশুজা শাহজাদা দারার তেরো মাস পরে ভূমিষ্ঠ হইয়াছিলেন। বারো বৎসর বয়স পর্যন্ত পিতামহ জাহাঙ্গীরের আদরে লালিত-পালিত হইয়া তাঁহার দোষ গুণ অনেক কিছু তিনি পাইয়াছিলেন; কোন নূরজাহানের হাতে পড়িলে বোধ হয় নাতি-ঠাকুরদার মধ্যে ইতিহাসে কোন তফাত থাকিত না। নির্বিবাদে দিল্লির সিংহাসনে বসিতে পারিলে সম্রাটের পুত্র-চতুষ্টয়ের মধ্যে শুজাই যোগ্যতম উত্তরাধিকারী হইতেন। দারার দাক্ষিণ্য, উদারতা ও চরিত্রমাধুর্য এবং আওরঙ্গজেবের বাস্তব দৃষ্টি, মাত্রাজ্ঞান, ব্যবহারিক বুদ্ধি, নীতিপ্রয়োগ, শৌর্য ও শাসনক্ষমতার একত্র সমাবেশ তাঁহার মধ্যেই ছিল; অথচ কোন প্রকার ভাবের পাগলামি, ছেলেমানুষি, গোঁড়ামি, ভণ্ডামি কিংবা সহজাত দুষ্টবুদ্ধি ছিল না। বয়সে ছোট হইলেও তিনি দারার পূর্বেই প্রথম মনসবদার ও সুবাদার হইয়াছিলেন। আওরঙ্গজেবের মতো একটানা কঠোর পরিশ্রমে উৎসাহ ও দৃঢ়তা, প্রারব্ধ কার্যে একাগ্রতা ও ধৈর্য কিংবা ব্যসন-সংযম তাঁহার ছিল না। বাল্যাবধি কূটনীতি চর্চা, শাসনকার্য ও যুদ্ধে আওরঙ্গজেবের প্রশংসনীয় গুণসমূহ পূর্ণভাবে বিকশিত হইয়াছিল; কিন্তু সুযোগের সদ্ব্যবহার না হওয়ায় শুজার রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিভা বাংলা দেশে পঙ্গু ও মলিন হইয়া পড়িয়াছিল, তাঁহার কোষবদ্ধ তরবারি শান ও পান দুইটাই হারাইল।
প্রায় একটানা সতেরো বৎসর সুবা বাংলার নিরুপদ্রব সুবাদারি শুজার পক্ষে শুভ হয় নাই। বাংলার দোজখে ভালো ভালো ভোগের জিনিসের অভাব ছিল না; আকাশে-বাতাসে আরাম-আয়েস ভাসিয়া বেড়াইত। আওরঙ্গজেবের মতো পদে পদে খোদাকে ভয় কিংবা শরিয়তের পা-বন্দী হইয়া তিনি চলিতেন না। তিনি অতি মার্জিত রুচি, সঙ্গীতপ্রিয় এবং কাব্যরসিক ছিলেন; শিয়া-সুন্নির সঙ্কীর্ণতা তাঁহার ছিল না। তাঁহার শাসনকালে দিল্লি আগ্রা হইতে অনেক বিশিষ্ট শিয়া পরিবার ঢাকায় স্থায়ী উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছিল। তাঁর দরবারী বিশ্বস্ত অনুচরগণের মধ্যে অধিকাংশই ছিল ইরানী শিয়া। লোকে আওরঙ্গজেবকে একটা “ভয়স্থান” মনে করিত; শুজাকে রাজোচিত গাম্ভীর্যের জন্য সমীহ করিত, মানুষ হিসাবে বিশ্বাস করিত এবং ভালোবাসিত। শুজা দারাকে ঈর্ষা করিতেন, হিংসা কিংবা অসৌজন্য তাঁহার প্রতি কখনও প্রকাশ করেন নাই। ছোট ভাই আওরঙ্গজেবকে পিতা তাঁহার সমান মনসব দিয়াছিলেন এইজন্য তিনি কখনও অভিযোগ করেন নাই, জাহানারা এবং পিতার উপর অভিমান তাঁহার থাকিলেও আক্রোশ ছিল না। দারার বিরুদ্ধে এক পথের যাত্রী হইয়াও শাহশুজা “শুভচিন্তক” আওরঙ্গজেবকে বিশ্বাস করিতেন না, মোরাদের লম্ফঝম্প দেখিয়া হাসিতেন।
শাহশুজার চরিত্রে “একোহি দোষো গুণরাশিনাশী” হইয়াছিল। এই দোষ তাঁহার মজ্জাগত আলস্য এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য ব্যসন। সেকালে বাংলা দেশে যদি কোনও কালিদাস থাকিতেন তাহা হইলে রঘুরাজ অগ্নিবর্ণের ভোগবিলাসের ছায়া ঢাকা-রাজমহলে শাহশুজার অন্তঃপুরে দেখিতে পাইতেন। মহারাজ অগ্নিবর্ণের মতো এই মোগলরাজকুমার ছিলেন “রাত্রিজাগরো দিবাশয়ঃ” অর্থাৎ :
“বামাস্পর্শ সুখে যাপিয়া যামিনী
হতেন নিদ্রিত দিনে নরমণি।”
(নবীনচন্দ্র দাস)
শাহশুজার হারেম ছিল একটি নিত্যনূতন ভ্রাম্যমাণ বেহেশত; অন্দরমহলে পালে পালে হুর-পরীর নাচগান, শরাবের নহর। ঢাকা ও রাজমহলের অলস অপরাহ্ণ তিনি বুড়িগঙ্গা কিংবা জাহ্নবীর ঢেউ গণিয়া কাটাইয়াছেন, হয়তো দেখিয়াছেন অদূরে নর্তকীর বিলসিতানুকারিণী তন্বী তরঙ্গ-নীবিবদ্ধা সঞ্চারিণী বলাহকমালা-বিলম্বী বেলাভূমির নিতম্বভঙ্গি। নাচওয়ালীর রূপের হাটে তিনি রাত্রি প্রভাত করিয়া দিনকে রাত করিতেন; ভোগের ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করিবার জন্য কয়েকদিন শাসনসংক্রান্ত বকেয়া ও হালের যাবতীয় কার্য ঊর্ধ্বশ্বাসে অথচ নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করিয়া আবার কিছুদিন আরাম-আয়েসে ডুবিয়া থাকিতেন। ইহার ফলে তিনি অকালে জরাগ্রস্ত হইয়া চল্লিশের এপারেই চামেলি ফুল অপেক্ষা কোনও ছোট জিনিস চোখে দেখিতেন না। সুশাসন ও দানশীলতার গুণে বাংলার লোক তাঁহাকে প্রাণ ভরিয়া ভালোবাসিত, পূর্ববঙ্গ “নকল শুজার” জন্য আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়াছিল। শুজার শোচনীয় পরিণামের জন্য দায়ী তাঁহার ব্যসনপ্রবণ স্বভাব-বাংলার মাটি নহে। সুযোগের অভাব প্রায় ক্ষেত্রে অলস ব্যক্তির অজুহাত। শুজার পরিবর্তে সম্রাট যদি আওরঙ্গজেবকে বাংলা দেশে রাখিতেন তবুও তাঁহার অদম্য ইচ্ছাশক্তি, আক্রমণাত্মক স্বভাব এবং ময়ূরসিংহাসনের স্বপ্ন নিশ্চয়ই অনুকূল কর্মক্ষেত্র প্রস্তুত করিয়া লইতে পারিত। গোলকুণ্ডা-বিজাপুরের মতো সমৃদ্ধিশালী রাজ্য বাংলার সীমান্তে না থাকিলেও অবিজিত আসাম, ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম, মগ-পর্তুগীজ ছিল; সুতরাং বাংলার সুবাদারের তলোয়ারে মরিচা ধরার কোন সঙ্গত কারণ ছিল না।
৮
পিতৃসিংহাসনের আশা আলস্যপরায়ণ শাহশুজার ধ্যানে বহু বৎসর “আচ্ছন্ন” অবস্থার স্তরে ছিল। তিনি চাহিয়াছিলেন সম্রাটের জীবদ্দশায় তিক্ততার সৃষ্টি না করিয়া সুবা উড়িষ্যা এবং বিহার যেন বাংলার সহিত তাঁহার অংশস্বরূপ নির্দিষ্ট করা হয়; পরে কাড়াকাড়িতে গোটা বাদশাহী পাওয়া না গেলে অন্তত তিনি “উড়িষ্যা মগধবঙ্গ ত্রিদেশ-ঈশ্বর” থাকিয়া স্বাধীনভাবে রাজত্ব করিবেন। কয়েক বৎসর পরে উড়িষ্যা তিনি পাইয়াছিলেন, কিন্তু সুবা বিহার এবং তাঁহার মধ্যে ব্যবধানস্বরূপ হইয়া রহিলেন দারা। মনের এই অবস্থা লইয়া ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দে শুজা লাহোর গিয়াছিলেন, পথশ্রম ও কান্দাহার অভিযানে সেনাপতিত্ব লাভের আশাভঙ্গজনিত অপমান ব্যতীত তাঁহার কোনও লাভ হইল না। ফিরিবার পথে সম্রাট আদেশ দিয়াছিলেন তিনি ও আওরঙ্গজেব যেন এক মাইল আগে পিছে লাহোর হইতে দিল্লি পর্যন্ত পথ অতিক্রম করেন, অর্থাৎ কেহ কাহারও সহিত দেখা সাক্ষাৎ না করেন। এই দুই পুত্রের প্রতি সমান আচরণ এবং সমান অবিশ্বাস তাঁহাদিগকে দারার বিরুদ্ধে একজোট হইবার প্রেরণাই জোগাইয়াছিল। ইহার পূর্ণ সুযোগ লইলেন আওরঙ্গজেব। রাস্তায় না হইলেও দিল্লিতে পিতার আদেশ উপেক্ষা করিয়া তাঁহারা কয়েকদিন পরস্পরকে ভোজে আপ্যায়িত করিয়া ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা স্থির করিয়া ফেলিলেন। পিতার অনুমতির অপেক্ষা না করিয়াই শুজার কন্যা গুলরুখ বানুর সহিত আওরঙ্গজেবের জ্যেষ্ঠপুত্র মহম্মদ সুলতানের “সগাই” (বাগদান) পাকাপাকিভাবে সম্পন্ন হইয়া গেল। পরে এই ব্যাপার লইয়া আওরঙ্গজেব এবং সম্রাটের মধ্যে কড়া চিঠিপত্র লেখালেখি হয়। শাহজাহান শুজাকে স্বপক্ষে আনিবার জন্য তাঁহার কাছে আওরঙ্গজেবের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করিয়া চিঠি লিখিলেন, এবং জানাইলেন আওরঙ্গজেবকে সরাইয়া তিনি দক্ষিণের পাঁচ সুবা বাংলা ও উড়িষ্যার পরিবর্তে তাঁহাকে দিতে প্রস্তুত আছেন। আওরঙ্গজেবের সঙ্গে সাক্ষাৎকার এবং গুপ্ত সন্ধি হওয়ার পূর্বে হয়তো সম্রাটের এই অনুগ্রহ তিনি প্রত্যাখ্যান করিতেন না; কিন্তু পরে শাহশুজা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছিলেন।
শুজার দিল্লির সিংহাসনের আশা “আচ্ছন্ন অবস্থা” হইতে ভাই আওরঙ্গজেব একেবারে “কূটস্থচৈতন্য” অবস্থায় উঠাইয়া দিয়াছিলেন; কোহিনূরখচিত মুকুট তাঁহার কাছে তখন হস্তামলকবৎ। আওরঙ্গজেব তাঁহাকে বুঝাইয়াছিলেন রাজ্যে তাঁহার স্পৃহা নাই, পুত্রের ভবিষ্যৎ দাদার হাতে তুলিয়া দিয়া নিশ্চিন্ত; তবে বেয়াড়া মোরাদকে বাগ মানাইতে হইবে এবং সেই ব্যবস্থাও সম্পূর্ণ করিয়া তিনি নর্মদা অতিক্রম করিবেন। মালবের পথে দো-রাহা নামক স্থানে কয়েকদিন পরে (২৩শে ডিসেম্বর ১৬৫৭ ইং) গুজরাট হইতে আসিয়া মোরাদ আওরঙ্গজেবের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন—ইহা কাকতালীয়বৎ ঘটনা নহে। শুজা আওরঙ্গজেব এবং মোরাদের মধ্যে পিতার অজ্ঞাতসারে একযোগে দারাকে আক্রমণ করিবার পরিকল্পনা গৃহীত হইয়াছিল; আওরঙ্গজেবের মারফত কিংবা তাঁহার সুবার মধ্য দিয়া তেলেঙ্গানার পথে শুজা ও মোরাদের মধ্যে গুপ্ত ডাকের ব্যবস্থা, সংকেতলিপির কোড আওরঙ্গজেবের মাথা হইতে বাহির হইয়াছিল। শুজা আওরঙ্গজেবকে বিশ্বাস করিতেন না; কিন্তু উপায় কি? দারার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা এবং স্বার্থসাধনের জন্য আওরঙ্গজেবের সাহায্য আপাতত তাঁহার প্রয়োজন; তিনি শাহীতক্তে বসিতে পারিলে হয় নিজ নিজ সুবা লইয়া আওরঙ্গজেব ও মোরাদকে সন্তুষ্ট থাকিতে হইবে, না হয় তাহাদের বরাতে যাহা আছে তাহাই হইবে।
মোটামুটি বলা যাইতে পারে, গৃহযুদ্ধের দায়িত্ব আওরঙ্গজেব হইতে শুজার কিছু কম। তিনি নিরপেক্ষ থাকিলে আওরঙ্গজেব ও মোরাদ এত সহসা হয়তো যুদ্ধ বাধাইতেন না, বাধাইলে পরাজিত হইতেন—দারার নিকট হইতে তিনি স্বাধীনতা না পাইলেও সুবিধাজনক শর্ত পাইতেন, নির্বাসনে শোচনীয় দশাপ্রাপ্ত হইতেন না।