৬. দারাশুকোর কান্দাহার-অবরোধের প্রথম পর্ব

ষষ্ঠ অধ্যায় – দারাশুকোর কান্দাহার-অবরোধের প্রথম পর্ব

প্রমাণ-পঞ্জী

দারার কান্দাহার অভিযান ও অবরোধের বিবরণ আমরা মোটামুটি তিনটি প্রামাণিক ফার্সি ইতিহাস হইতে সবিস্তার জানিতে পারি। শাহজাহানের দরবারী ইতিবৃত্ত ‘বাদশাহ-নামা’র তৃতীয় খণ্ডে (জুলুসী সন ২০ হইতে ৩০ বর্ষ পর্যন্ত) মোল্লা ওয়ারেস এই অভিযানের কথা লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। বাদশাহ-নামা সরকারি দলিলপত্র ও সংবাদ-তালিকা দৃষ্টে লিখিত; স্বয়ং বাদশাহকে ইহা পড়িয়া শুনানো হইত এবং তাঁহার নির্দেশক্রমে আবশ্যক মতো সংশোধন করা হইত। সুতরাং ইহাতে তারিখ, মানুষের নাম, মোটামুটি ঘটনা নির্ভুল দেওয়া হইয়াছে ধরিয়া লইতে হইবে। কিন্তু সঠিক এবং নিরপেক্ষ ইতিহাস বলিতে যাহা বুঝায়, তাহা কদাচিৎ সরকারি ইতিবৃত্তে পাওয়া যায়। আজকালকার দিনে যেমন কোনও গুরুতর ঘটনার সরকারি ও বে-সরকারি সংবাদে মাঝে মাঝে পার্থক্য দৃষ্ট হয়, সেকালেও তাহাই ছিল। সরকারি সাফাই ও বে-সরকারি অভিযোগগুলিকে বিচারকের সূক্ষ্মদৃষ্টি, নিরপেক্ষতা ও সাক্ষ্য-আইনের মূলসূত্রসমূহের কষ্টিপাথরে পরীক্ষা করিয়া লওয়া ঐতিহাসিকের প্রধান কর্তব্য; কিন্তু বাদশাহী আমলে––তথা যথেচ্ছাচার রাজতন্ত্র-শাসিত পৃথিবীর সর্বত্র- বেসরকারি সংবাদ কিংবা বিরুদ্ধ সমালোচনা বলিয়া কিছুই ছিল না। রাজা, রাজপুত্র, বা সুবাদারের বিরুদ্ধে অতি সত্য হইলেও কেহ কিছু প্রকাশ্যভাবে লিখিতে সাহস করিত না। শত বাধা সত্ত্বেও এখনকার বে-সরকারি কাগজে সরকারের বিরুদ্ধে যাহা প্রকাশ করা সম্ভব, মধ্যযুগে উহা ছিল কল্পনার অতীত-মোগল সরকারের বিরুদ্ধে কেহ টু শব্দ করিলে তাহার রক্ষা ছিল না।

সৌভাগ্যক্রমে কান্দাহার অভিযানের বে-সরকারি বিবরণ একজন বেনামী লেখক মোগল-শিবিরে বসিয়াই লিখিয়া গিয়াছেন। তাঁহার লিখিত পুস্তকের নাম ‘লতাইফ-উল- আখার’; উহার ভূমিকায় তিনি লিখিয়াছেন:

আমি দরবারের বিশেষ অনুগ্রহভাজন অন্তরঙ্গ আমীর-উমরা কিংবা দরবারী মোসাহেব নই। সরকারি দপ্তরের কেরানি, রাজদূত কিম্বা ওয়াকীয়া নবিস (সংবাদ প্রেরক) হিসাবে চাকরি আমি করি না; সুতরাং মিথ্যা কথা বলিবার আমার প্রয়োজন হয় না; মিথ্যা সংবাদ সরবরাহ করা আমার উপজীব্য নহে। প্রকৃত ঘটনা গোপন, যাহা ঘটে নাই উহা ঘটিয়াছে বলিয়া সাক্ষ্য প্রমাণ দেওয়া কিংবা কান্দাহারের খবর শুনিবার জন্য হিন্দুস্থানে যাহারা কান খাড়া করিয়া আছে তাহাদের জন্য ‘মজার খবর লেখা আমার উদ্দেশ্য নহে। যে ক্ষেত্রে কোনও মতলব নাই কিংবা কাহারও অনুগ্রহলাভের উপর নজর নাই, সে ক্ষেত্রে মানুষ সত্য হইতে বিচলিত হওয়ার কিংবা স্পষ্টবাদী না হওয়ার হেতু থাকিতে পারে না। লোকের কাছে অপরিচিত সামান্য ব্যক্তি হইলেও আমি বলিতে পারি খোদার কসম––এই সফরে আমি যাহা দেখিয়াছি, অন্য কেহ তাহা দেখে নাই; কেহ যদি দেখিয়া থাকে সে দুনিয়াদারির মতলবে উহা গোপন করিয়াছে; কিছু যদি বলিয়া থাকে সে উল্টাই বলিয়াছে। যাহারা গোশা-নশীন, লোকচক্ষুর অন্তরালে যাহারা এক কোণে পড়িয়া আছে, এই জমানার হাল তাহারাই বরং ভালো জানে।

এই বেনামী লেখকের পরিচয় সর্বপ্রথম দিয়াছেন ঐতিহাসিক মহম্মদ হাশিম খাপি খাঁ। রিউ সাহেব ঠিক অনুমান করিয়াছেন ‘লতাইফ্-উল্-আখ্টার’ ও খাপি খাঁ কর্তৃক উদ্ধৃত ‘তারিখ-ই-কান্দাহার’ একই পুস্তক––ইহার লেখক মহম্মদ বদী, পুরা নাম রসীদ খাঁ ওরফে বদীউজ্জমা-মহাবত-খানী। আওরঙ্গজেব-রাজত্বের চতুর্বিংশ বর্ষে তিনি দেওয়ান-ই-খালিশা পদ লাভ করিয়াছিলেন এবং উহার একচল্লিশ বৎসরে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছিল। প্রথম মহাবত খাঁর পুত্র মির্জা লোহারস্প—যিনি পিতার মহাবত খাঁ উপাধি লাভ করিয়াছিলেন— কান্দাহার অভিযানে মহম্মদ বদীকে সম্ভবত কোন অসামরিক কর্মচারী হিসাবে সঙ্গে লইয়াছিলেন। ‘লতাইফ্-উল্-আখার’ পড়িলে প্রথমে সন্দেহ নয়, লেখক দারার দরবারে একজন অনাদৃত এবং শাহজাদার প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন ব্যক্তি— যেমন আকবরী দরবারের মোল্লা বদায়ুনী। এই বেনামী লেখক যাহা স্বচক্ষে দেখিয়াছেন এবং অন্যের কাছে শুনিয়াছেন, উহাই দৈনিক বিবরণ হিসাবে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। গল্পগুজব কিছু কিছু থাকিলেও তাঁহার লিখিত যে সমস্ত ঘটনা দারার সর্বজনবিদিত দোষগুণ ও দুর্বলতার উদাহরণ স্বরূপ গ্রহণযোগ্য, ঐতিহাসিক ওইগুলি উপেক্ষা করিতে পারে না। সম্রাট মহম্মদ শাহর রাজত্বকালে সুপণ্ডিত ও নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক মহম্মদ হাশিম-প্রচলিত নাম খাপি খাঁ তাঁহার ‘মুস্তাখাব উল-লুবাব’ নামক ইতিহাসগ্রন্থে দারার কান্দাহার অভিযানে বর্ণনায় পূর্বোক্ত বেনামী লেখকের ‘লতাইফ্-উল্-আথ্রার’ সর্বপ্রথমে উদ্ধৃত করিতে সাহসী হইয়াছিলেন, কেননা তিনি দরবারী ইতিহাস লেখক ছিলেন না; বিশেষত তখন শাহজাহান-দারা- আওরঙ্গজেব জনশ্রুতিতে পরিণত হইয়াছেন। খাপি খাঁ আওরঙ্গজেবকেও রেহাই দেন নাই; বাদশাহর শত্রুকে ইসলামের শত্রুজ্ঞানে হিন্দুদের উপর অযথা গালিবর্ষণ করিয়া ধর্মান্ধতার পরিচয়ও তিনি দেন নাই। সুতরাং দারার প্রতি কোন আক্রোশ না থাকিলেও খাপি খাঁ যাহা সত্য বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন, উহা কখনও ভিত্তিহীন হইতে পারে না।

বাদশাহী ফৌজের মোর্চাবন্দী ও থানা কায়েম

২৮শে এপ্রিল বৃহস্পতিবার বাদশাহী ফৌজের বিভিন্ন মনসবদারগণ তাঁহাদের নির্দিষ্ট স্থান গ্রহণ করিয়া কান্দাহার-দুর্গের অবরোধ-বেষ্টনী সম্পূর্ণ করিলেন। কান্দাহার দুর্গের উত্তর-পূর্ব কোণ হইতে আরম্ভ করিয়া বিভিন্ন দরওয়াজার সামনে সেনাধ্যক্ষগণ নিম্নলিখিত ক্রমে তাঁবু গাড়িয়া বসিলেন-

বাবা ওয়ালী দরওয়াজা–মহাবত খাঁ (পাঁচ হাজারী)

ওয়েস্ করন দরওয়াজা–কিলিচ খাঁ (পাঁজ হাজারী)

ওয়েস্ করণ ও খ্বজা খিজির দরওয়াজার মধ্যবর্তী স্থান––মির্জাফর (দারার তোপখানার মীর-অতিশ)

খ্বজা খিজির দরওয়াজা––পদাতিক বাহিনী সহ শাহজাদার মীর বকশী আবদুল্লা

খ্বজা খিজির দরওয়াজা এবং মাশুরী দরওয়াজার মধ্যবর্তী স্থান—বাদশাহী তোপখানার মীর অতিশ কাসিম খাঁ (চার হাজারী)

মাশুরী দরওয়াজা—মির্জা রাজা জয়সিংহ (পাঁচ হাজারী)

চেহেল-জিনা বুরু––ইখলাস্ খাঁ (তিন হাজারী)

লাখা উপদুর্গ––বাকী খাঁ চম্পৎ রায় বুন্দেলা, সৈয়দ মির্জা ও অন্যান্য মনসবদারগণ।

.

কান্দাহার দুর্গের তিনদিকে পরিখা; অন্যদিকে উচ্চ সুরক্ষিত পাহাড়, পরিখার পরে কোথাও প্রস্তর নির্মিত প্রাচীর; কোন কোন স্থানে খড় ও পাথর মিশানো মাটির তৈয়ারি দশ গজ চওড়া পর্দা। পরিখা জলশূন্য করিয়া ভরাট না করিলে প্রাচীরের নিকটবর্তী হওয়া অসম্ভব, এজন্য শাহজাদা দারার মীর-সামান মোল্লা ফাজিল পরিখার জল নিষ্কাশনের কার্যে নিযুক্ত হইলেন। ১০৭০ খনক (sapper) এবং একদল রক্ষী সৈন্যসহ সৈয়দ মামুদ (বারাহ্ সৈয়দ) তাঁহাকে সাহায্য করিবার জন্য আদিষ্ট হইলেন। ৪ঠা মে শাহজাদা দারা কামরান মির্জার উদ্যানে নিজ তাঁবুতে পদার্পণ করিলেন। বুস্ত হইতে কান্দাহার আসিবার রাস্তায় পারস্যবাহিনীকে প্রতিরোধ করিবার জন্য রুস্তম খাঁ বাহাদুর ফিরোজ-জঙ্গ এক ভারী ফৌজ লইয়া মাটি আগলাইয়া বসিলেন। অন্যান্য থানাগুলির ভারও সুযোগ্য মনসবদারগণের উপর অর্পিত হইল।

দুর্গরক্ষীগণ কর্তৃক অতর্কিত আক্রমণ ও ছোটখাটো সংঘর্ষ

অবরোধের প্রথম দিনই হঠাৎ একদল ইরানী সৈন্য খিজিরী দরওয়াজা খুলিয়া হিন্দুস্থানীদিগকে যুদ্ধার্থ আহ্বান করিল। খ্বজা খাঁ (ইয়ুজবেগ) তাহাদিগকে পরিখা পর্যন্ত তাড়া করিল, কিন্তু দুর্গ প্রাচীর হইতে বর্ষিত গুলির ঘায়ে তাহার ঘোড়াটি ধরাশায়ী হইল; নিজেও আহত হইল। ফিরিবার সময় পলাতক ইরানীরা তাহাকে পাল্টা তাড়া করিয়া বধ করিবার উপক্রম করিল। এমন সময় তাহাদের সর্দার বলিয়া উঠিলেন, “ছি! উহাকে ছাড়িয়া দাও।” এই খবর শুনিয়া শাহজাদা খ্বজা খাঁকে একটি ঘোড়া ও খাসা খেলাত বকশিশ করিলেন এবং তাহার মনসবে দুই শত সওয়ার বৃদ্ধি করিয়া দিলেন। ইরানীরা রাত্রির অন্ধকারে হিন্দুস্থানীদের আশ্রয় সুড়ঙ্গের ভিতর প্রবেশ করিয়া সিপাহী ও বেলদার (কোদালিয়া) গুলির মাথা কাটিয়া লইয়া যাইত। একদিন সন্ধ্যার সময় বেলদার দারোগা ফতে মহম্মদ কালাল (শুঁড়ি) চারিজন লোক লইয়া বাদশাহী মীর-অতিশ কাসিম খাঁর আশ্রয়-পরিখার মাথায় কাজ করিতে গিয়াছিল। পরদিন সকালে দেখা গেল, ওই জায়গায় তাহাদের ছিন্নমুণ্ড দেহগুলি পড়িয়া আছে। ওই রাত্রিতেই ইরানীরা মহাবত খাঁ ও কিলিচ খাঁর থানার মধ্যবর্তী স্থান অতিক্রম পূর্বক লাইনের পিছনে গিয়া তিনজন লোককে খুন ও চারিটা ঘোড়ার পায়ের রগ কাটিয়া দিয়া বেমালুম পলাইয়া গেল (২৪শে মে), এমন কি চুরি-ডাকাতিতে পাকা ওস্তাদ বুন্দেলা রাজপুতগণও ইরানীদের অতর্কিত আক্রমণ হইতে রেহাই পায় নাই; একদিন দুপুরবেলা পাহাড় সিং বুন্দেলার সিপাহীরা একটু অসাবধান ছিল। ইরানীরা হঠাৎ চড়াও করিয়া তাঁহার ৬০ জন লোককে হত্যা করিল। ইহাদিগকে তাড়া করিতে গিয়া দুর্গপ্রাচীর হইতে নিক্ষিপ্ত গোলাগুলির ঘায়ে তাঁহার আরও বিশজন সিপাহী মারা গেল। আর একদিন লাখা পাহাড়ের উপদুর্গ হইতে ত্রিশ জন ইরানী বন্দুকচী চুপচাপ পাহাড় সিং বুন্দেলা ও বাকী খাঁর মোর্চার মধ্যবর্তী স্থান দিয়া অগ্রসর হইল। সেখানে কয়েকটি উট ও গরু চরিতেছিল। ইরানীরা চারিটা উট ও পাঁচটা গরু জবাই করিয়া মাংসগুলি লইয়া পলাইতেছিল, এমন সময় হিন্দুস্থানীরা তাহাদিগকে তাড়া করিল; অন্য দিক হইতে ইরানীরাও তাহাদের দলকে সাহায্যার্থ অগ্রসর হওয়াতে উভয় পক্ষে গুলি চলিল; কিন্তু ইরানীরা ঘায়েল হইয়াও হালালের গোত ছাড়িল না (১৮ই জুলাই)। ইহার পূর্ব দিন ইরানীদের সঙ্গে একটি বড় রকমের সংঘর্ষ হইয়াছিল। ২রা রমজান ইজ্জৎ খাঁর সিপাহীরা ফজরের নমাজ পড়িতেছিল; এমন সময় তিনশত ইরানী হঠাৎ তাঁহার মোর্চার উপর হামলা করিয়া অনেক লোককে হতাহত করিল। নজর বাহাদুর খাঁ খেশগীর পুত্রদ্বয় কুতব খাঁ ও শমস খাঁ ইজ্জৎ খাঁকে প্রাণপণ সাহায্য না করিলে তাঁহার রক্ষা ছিল না। ইরানীরা পিছু হটিবার সময় মহাবত খাঁ তাহাদিগকে আক্রমণ করিলেন। মোটের উপর এই সংঘর্ষে ইজ্জৎ খাঁর ৯০ জন, কুতব খাঁ ও শমস খাঁর ৩১ জন এবং মহাবত খাঁর ১৪ জন সিপাহী হত ও ৩১ জন আহত হইয়াছিল। ইজ্জৎ খাঁ বুঝিলেন, সত্য ঘটনা প্রকাশ হইলে শাহজাদার দরবারে তাঁহার ইজ্জৎ আর থাকিবে না; জাফরও টিটকারি দিবে। তিনি তাড়াতাড়ি এক ফন্দী আঁটিলেন। তাঁহার যত সিপাহী মরিয়াছিল, তিনি তাহাদের লাশগুলি সরাসরি গায়েব করিলেন। তাঁহার লোকেরা মহাবত খাঁর মোর্চার কাছ হইতে ইরানীদের দুটা লাশ নিজেদের পরিখার কাছে টানিয়া লইয়া আসিল। সেদিন এত বড় একটা ব্যাপার ঘটিলেও শাহজাদা স্বয়ং কিছু তদন্ত করিতে আসিলেন না; উর্দুবেগী আসিয়া ইজ্জৎ খাঁর কাছে যাহা শুনিল এবং তাঁহার বাহাদুরির নিশান ইরানী লাশ দুটি দেখিয়া যাহা সিদ্ধান্ত করিল, উহাই লিখিয়া লইল। দারা ওই রিপোর্ট অবলম্বনে বা কায়দা আরদস্ত লিখিয়া দরবারে পাঠাইলেন। সে-যুগে এ ধরনের মিলিটারি ডেসপ্যাচও গোপন থাকিত না। সংবাদ তালিকা হিসাবে ওইগুলি প্রায়ই প্রকাশ্য দরবারে পঠিত হইত; পরে সরকারি দপ্তরখানায় রক্ষিত সমস্ত আখারাত সমূহের সাহায্যে দরবারী ঐতিহাসিক ইতিহাস রচনা করিতেন। ওয়ারেস-লিখিত বাদশাহ-নামায় দারার কান্দাহার-অভিযানের বর্ণনায় লিখিত আছে :-

‘দুর্গরক্ষীদের হানা খুব কম এবং প্রায়ই বিফল হইত। কিন্তু একবার মহাবত খাঁর সিপাহীদের অসতর্কতার দরুণ ইরানীদের অতর্কিত আক্রমণে তাঁহার কয়েক জন লোক হতাহত হইয়াছিল। যখন ইরানীরা দুর্গাভিমুখ ফিরিতেছিল, ইজ্জৎ খাঁর মোর্চার সিপাহীরা কয়েকজনকে বধ করিয়া তাহাদিগকে সমুচিত শিক্ষা দিয়াছিল।‘

বাদশাহী দরবারে প্রত্যেক বড় বড় আমীরের একজন করিয়া “উকিল” বা প্রতিনিধি থাকিত; দরবারের সমস্ত প্রয়োজনীয় সংবাদ উকিলেরা নিজ নিজ মনিবের কাছে লিখিয়া পাঠাইত। সুতরাং দারা যে মিথ্যা রিপোর্ট বাদশাহের কাছে পাঠাইয়াছেন, কয়েক দিন পরে কান্দাহার-শিবিরে উহা মুখে মুখে প্রচারিত হইল। এ সম্বন্ধে ‘লতাইফ্-উল্‌-আখার’ রচয়িতা লিখিয়া গিয়াছেন–

‘এই অভিযানের প্রথম হইতে ইহা সুস্পষ্ট বুঝা গেল শাহজাদার অভিপ্রায় ছিল দুর্গজয়ের চেষ্টার সমস্ত প্রশংসাটুকু যেন তাঁহার নিজ তারিনের অফিসারগণ বিশেষত জাফর ও ইজ্জৎ খাঁর ভাগেই পড়ে। …মহাবত খাঁর সিপাহীরা ইরানীদিগকে তাড়া করিয়া তাহাদের মৃত সঙ্গীদের লাশ লওয়ার অবসর দেয় নাই। অথচ বাদশাহর কাছে রিপোর্ট গেল ইজ্জৎ‍ খাঁই যাহা কিছু বাহাদুরি দেখাইয়াছেন— প্রমাণ তাঁহার মোর্চার কাছে দুটা ইরানীদের লাশ পড়িয়াছিল, যদিও আসলে এই মড়াগুলি মোর্চার কাছ হইতে তিনি উঠাইয়া লইয়াছিলেন। …এই রিপোর্টের কোথাও কুতব খাঁ ও শমস্ খাঁর নামটুকুও উল্লেখ করা হয় নাই।‘

একটি ঘটনার সরকারি ও বেসরকারি বর্ণনায় কি আশমান-জমিন তফাত ইহাই তাহার অন্যতম প্রমাণ। ইহাও অবশ্য অসম্ভব নয়, মহাবত খাঁর আশ্রিত এই বেনামী লেখক মহাবত খাঁর বিরুদ্ধে দারার অভিযোগ খণ্ডন করিবার জন্য সাফাই গাহিয়াছেন। “সত্য মিথ্যা একমাত্র খোদাতালাই জানেন”– ঐতিহাসিক ইহার অধিক কিছু বলিবার স্পর্ধা রাখিতে পারেন না এবং ইহাই চরম গবেষণা।

চেহেল-জিনা পাহাড় আক্রমণ

যে পর্বতশ্রেণীর ক্রোড়ে কান্দাহারের অন্তদুর্গ আত্মগোপন করিয়া আছে, তাহার উত্তর পার্শ্বে সিকি মাইল দূরে সুকঠিন প্রস্তরময় একটি খাড়া পাহাড় কান্দাহারের রন্ধ্রপথ রুদ্ধ করিয়া দণ্ডায়মান। এই পাহাড়ের গায়ে চল্লিশটি ধাপ কাটিয়া উপরে উঠিবার একটি সংকীর্ণ পথ ছিল। এইজন্য এই পাহাড়ের ফার্সি নাম ‘চেহেল-জিনা’। অর্ধেক পথে যেখানে ধাপ শেষ হইয়াছে, সেখানে ছিল একটি গুহা; গুহার ভিতরে ধনুকাকৃতি গম্বুজওয়ালা একটি ঘর। শত্রু যদি চেহেল-জিনার পাহাড়ে তোপ টানিয়া উঠাইতে পারে তবে কান্দাহারের আশা ছাড়িতে হয়। ইহার দুই দিকে দুইটি টিলা শহরের মণ্ডী (বাজার) ও অন্তদুর্গের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। কান্দাহার যখন মোগল-অধিকারে ছিল, তখন চেহেল-জিনা পাহাড়কে সুরক্ষিত করিবার জন্য এই দুটি টিলার উপর উন্নত ও সুদৃঢ় সান্ত্রী-গৃহ নির্মিত হইয়াছিল। পারস্য সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আব্বাস ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে এই স্থান অধিকার করিয়া শহরের উপর তোপ দাগিয়াছিলেন। কিন্তু এ স্থান দখল করা সোজা নয়; মুষ্টিমেয় সৈন্য অসংখ্য শত্রুকে এখানে অনায়াসে বাধা দিতে পারে; অথচ হাতাহাতি যুদ্ধ না করিয়া উপায়ান্তর নাই। শাহজাদা ‘চেহেল-জিনা’ দখল করিবার জন্য সচেষ্ট হইলেন। যুদ্ধবিদ্যায় অনভিজ্ঞতাবশত তিনি মনে করিলেন, পাহাড়ের নীচে হইতেই “হাওয়াই” ছুঁড়িলেই ইরানীরা চেহেল-জিনা ছাড়িয়া পলাইবে। ৭ই ও ৮ই মে ক্রমাগত দুই রাত্রি কয়েক হাজার হাওয়াই-বাজির অগ্নিবৃষ্টি হইল। ইহাতে ইরানীরা ভয় পাওয়া দূরের কথা বরং আতশবাজির তামাশা বেশ উপভোগ করিতেছিল। এই সুযোগে উপযুক্ত সেনাধ্যক্ষের অধীনে যদি একদল পার্বত্য সৈন্য সন্তর্পণে চেহেল-জিনায় উঠিতে পারিত, তাহা হইলে ইরানীদের আনন্দ হয়তো নিরানন্দে পরিণত হইত। কিন্তু লড়াইয়ের ফিকিরের চেয়ে সুফীয়ানা “জিকির” (নামকীর্তন) শাহজাদা দারা ভালো বুঝিতেন। তিনি এই প্রকার যুগপৎ আক্রমণের কথা ভাবিতেও পারেন নাই। যাহা হউক, যাহারা হাওয়াই ছুঁড়িয়াছিল, তাহাদের প্রত্যেককে শাহজাদা বিশ টাকা হিসাবে ইনাম দিলেন এবং তাহাদের মনসবদারদ্বয়কে এক-শতী ইজাফা মঞ্জুর করা হইল।

হাওয়াই ব্যর্থ হওয়ায় শাহজাদা চেহেল-জিনার দুর্গবুরুজ লক্ষ্য করিয়া তোপখানার মোর্চা কায়েম করিলেন। প্রথমে জাফর এবং পরে কাঙ্গড়ার পাহাড়ি অঞ্চলের ডোগরা রাজপুত-সামন্ত রাজা রাজরূপকে এই মোর্চার ভার দেওয়া হইয়াছিল (৬ই জুন)। শাহজাদা রাজরূপকে পাঁচ-শতী ও পাঁচ শত সওয়ার ইজাফা দিলেন। তিনি প্রথম প্রথম তাঁহার খুব প্রশংসা করিতেন; কিন্তু দারার একটি দোষ ছিল—তিনি লোক চিনিতেন না; অধিকন্তু চাটুকারদের কানভাঙানি বেশি শুনিতেন। রাজরূপের কাজ অনেকখানি অগ্রসর হইয়াছে দেখিয়া তাঁহার প্রতিবেশী জন্মশত্রু রাজা মান্ গোয়ালিয়ারী কোন্ মতলবে শাহজাদার কান ভারী করিয়া দিলেন। এই মোর্চায় রাজরূপের ৪৬ জন সিপাহী হত ও ১৪৬ জন আহত হইয়াছিল বটে, কিন্তু কাজও অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছিল। তিনি শাহজাদার ভাবপরিবর্তন লক্ষ্য করিয়া স্থির করিলেন, কপালে যাহা থাকে একবার চেহেল-জিনা আক্রমণ করিবেন। তাঁহার ডান ও বাঁ দিকের মোর্চার সেনাধ্যক্ষগণকে জানাইলেন ২০শে জুন দিন ৫ ঘড়ি গতে হামলা শুরু হইবে। অনুমতি পাওয়ার জন্য তিনি একথা শাহজাদাকেও জানাইলেন। শাহজাদা জ্যোতিষীগণকে ডাকাইয়া মুহূর্ত বিচার করিতে বসিলেন। জ্যোতিষীরা কান্দাহারে আসিয়া কান্দাহার ও তৎসংলগ্ন স্থানসমূহের রাশিচক্র ও কোষ্ঠীবিচারে তৎপর ছিল। তাহারা শাহজাদাকে বলিল, ৫ ঘড়ির পর ওইদিন চেহেল-জিনার কর্কটরাশিতে সূর্য অবস্থিত আছেন; সুতরাং ওইসময় আক্রমণকারীদের পক্ষে অশুভ; ১৮ ঘড়ির (৮ ঘড়ি?) পর সময় ভালো আছে। রাজরূপ ও অন্যান্য সেনাধ্যক্ষগণকে সংবাদ দেওয়া গেল, আক্রমণ ৫ ঘড়ি গতে না হইয়া ১৮ ঘড়ি (৮ ঘড়ি?) গতে হইবে; সে সময় সকলেই যেন প্রস্তুত থাকেন। কিন্তু ওইদিনই শাহজাদার প্রিয়পাত্র জাফরের এক ভাই অনেক দিন রোগে ভুগিয়া মারা গেল। কুসংস্কারাচ্ছন্ন দারা এই সামান্য ঘটনাকে অতি অশুভ লক্ষণ মনে করিয়া আক্রমণের হুকুম সম্পূর্ণ বাতিল করিয়া দিলেন। অগ্রগামী দলকে ফিরাইয়া আনিতে রাজরূপের আরও পাঁচজন লোক হত ও কুড়িজন আহত হইল।

তিনদিন পরে শাহজাদার খাস মজলিসে রাজরূপের কথা উঠিতেই তিনি বিষম চটিয়া গেলেন––নিমকহারাম বুজদিল খেঁকশিয়াল: রাজা মান্ গোয়ালিয়ারীকে উহার মোর্চা সোপর্দ কর। লইয়া যাও উহাকে জাফরের মোর্চায়; খেদমত কাহাকে বলে জাফর তাহাকে ভালোরকম শিখাইবে। কাজী আফজল দৃঢ়ভাবে রাজরূপের পক্ষ সমর্থন করাতে বেচারা দারুণ অপমান হইতে এ যাত্রা রক্ষা পাইল। ক্ষণে তুষ্ট, ক্ষণে রুষ্ট শাহজাদা একবার কান মলিয়া আবার লোকের পিঠ চাপড়াইতেন, মাসখানেক পরে রাজরূপ জাফরের সহকারিরূপে অন্য মোর্চায় বদলি হইলেন, তাঁহাকে নগদ ৫০০০ টাকা ইনাম দিলেন এবং “শের হাজী” বুরুজের তলদেশ পর্যন্ত সুড়ঙ্গ খুঁড়িতে পারিলে আরও ৫০০০ টাকা পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিলেন। বল্লভ চৌহান নামক রাজপুত মনসবদারকে চেহেল-জিনার মোর্চায় যাইবার জন্য আদেশ করাতে সে সিধা জবাব দিল- আমরা ময়দানের লোক; পাহাড়ি নই; পাহাড়ের লড়াইয়ের কায়দা আমরা জানি না। শাহজাদা ক্রোধে অধীর হইয়া হুকুম দিলেন, “নিয়ে যাও বেটা বেতমীজকে জাফরের মোর্চায়।” চোবদার বল্লভ চৌহানকে জাফরের কাছে লইয়া চলিল; কিন্তু অল্পদূর যাইতে-না-যাইতেই শাহজাদার রাগ পড়িয়া গেল। ফিরাইয়া আনিয়া তাহাকে তিনি দেবী সিংহ বুন্দেলার থানার ভার দিলেন এবং দেবী সিংহ রাজরূপের স্থানে চেহেল-জিনা মোর্চায় নিযুক্ত হইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *