৪. শাহজাদা দারাশুকোর কান্দাহার অভিযান

চতুর্থ অধ্যায় – শাহজাদা দারাশুকোর কান্দাহার অভিযান

কান্দাহার নামটা প্রাচীন গন্ধার শব্দের অপভ্রংশ। উহা একটি জনপদের নাম। বৌদ্ধযুগে আটকের নিম্নবর্তী সিন্ধুর উভয় তীর এবং সিন্ধু ও ঝিলাম নদীর মধ্যবর্তী স্থান গন্ধার জনপদ নামে পরিচিত ছিল। উহার তদানীন্তন রাজধানী তক্ষশিলা নগরী। বোধ হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগে মহাভারতের যুদ্ধের পূর্বে গন্ধার-বংশ বর্তমান কান্দাহার প্রদেশে বাস করিত—যাহা এখন দুরানী আফগান-বংশের আবাসস্থান। গন্ধার, পারদ (কাবুল) ও বাহ্লীক (বল্‌থ্) তখন আর্যভূমির অন্তর্গত ছিল। এই গন্ধার বোধ হয় শকুনি মামার রাজ্য। এই জনপদ স্মরণাতীত কাল হইতে দেবাসুর-দ্বন্দ্বের বিষয়ীভূত ছিল। কেননা এই গন্ধার ‘আহুরমজদা’র উপাসক ইরানীয় অসুরগণের আর্যভূমি প্রবেশের দ্বারস্বরূপ ছিল। দরায়ুস-জরকসিস বর্তমান আফগানিস্তান অধিকার করিয়া সমগ্র পঞ্জাব গ্রাস করিয়াছিলেন। মৌর্যবংশের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত হিন্দুকুশ পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করিয়া ইহার পাল্টা জবাব দিয়াছিলেন। জনপ্রবাদ এইরূপ যে, প্রাচীন কান্দাহার দুর্গ বিজয়ী আলেকজান্ডার কর্তৃক নির্মিত হইয়াছিল, _এজন্য সেকেন্দরের নাম অনুসারে কান্দাহার নামে পরিচিত। এই অনুমানের পক্ষে কোন যুক্তি নাই। কান্দাহারের বুকে সম্ভবত গন্ধার জনপদের ঐতিহাসিক স্মৃতি লুকাইয়া আছে। যে অজেয় দুর্গ ষোড়শ ও সপ্তদশ খ্রিস্টাব্দব্যাপী ইরানের সফবী শাহ ও মোগল বাদশাহগণের শক্তিপরীক্ষার রঙ্গভূমি ছিল, উহা এখন ধ্বসংস্তূপে পরিণত হইয়াছে। ইহার কিছু দূরে নাদির শাহ নাদিরাবাদ দুর্গ নির্মাণ করিয়াছিলেন। আহমদ শাহ আবদালী নাদিরাবাদ পরিত্যাগ করিয়া বর্তমান কান্দাহার স্থাপন করিয়াছিলেন। আফগানিস্তান পর্বতসঙ্কুল ও অনুর্বর হইলেও কান্দাহার প্রদেশ হেলমন্দ নদী ও উহার উপনদীসমূহের প্রসাদে সুজলা ও সুফলা। উদ্যানশ্রী অপেক্ষা কান্দাহারের বাণিজ্যসম্পদ ও ভারতবর্ষ আক্রমণের ঘাঁটি হিসাবে উহার সামরিক গুরুত্বের জন্যই এই স্থান অধিকার ও পুনরধিকার করিবার জন্য মোগল ও সফবী সম্রাটগণ মরিয়া হইয়া উঠিয়াছিলেন। কান্দাহার ও ভারতবর্ষের মধ্যে থল-চোটিয়ালী পর্বতশ্রেণী; দক্ষিণে বেলুচিস্তানের মরুভূমি, পশ্চিমে দশৎ-ই-মার্গো ও সিস্তানের বহুযোজনব্যাপী উত্তপ্ত ঊষর ভূমি; উত্তরে কাবুল ও গজনীর পাহাড়, হাজরা কালাৎ-ই-ঘিলজাই; উত্তর-পশ্চিমে হিরাত শহর। কান্দাহার শহর পারস্য, মধ্য-এশিয়া, কাবুল ও ভারতবর্ষের পণ্য বিনিময়ের বাণিজ্যকেন্দ্র। কান্দাহার শত্রুর হাতে থাকিলে কাবুল গজনী ও হিন্দুস্থানের মালিক মোগল সম্রাটগণকে সর্বদা সশঙ্ক ও সন্ত্রস্ত থাকিতে হইত। সামরিক নির্বিঘ্নতার জন্য পারস্য অপেক্ষা ভারতবর্ষ ও আফগানিস্তানের পক্ষে কান্দাহার দখলে রাখা অধিকতর প্রয়োজনীয় ছিল। ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে আকবর যখন নাবালক ছিলেন তখন পারস্য সম্রাট কান্দাহার দুর্গ অধিকার করেন। ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে কান্দাহারের শাসনকর্তা মুজঃফর হোসেন মির্জা বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া উহা স্বেচ্ছায় আকবর বাদশাহকে অর্পণ করিয়া মোগল দরবারে উচ্চ রাজপদ লাভ করিয়াছিলেন। কান্দাহার বন্ধুভাবে প্রত্যর্পণ করিবার জন্য প্রথম শাহ আব্বাস মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরকে একাধিকবার অনুরোধ করিয়াছিলেন। এই মোলায়েম ইশারার অর্থ জাহাঙ্গীর বুঝিতে পারিয়াও ভাবী বিপদের প্রতিকারের জন্য কোনও চেষ্টা করিলেন না। যিনি কয়েক পেয়ালা শরাব ও দু-বেলা রুটির বদলে সুন্দরী নূরজাহানকে হিন্দুস্থানের বাদশাহী বিকাইয়া দিয়াছিলেন এবং তৎসঙ্গে নিজের স্বতন্ত্র সত্তাকে রেহানী বন্ধক দিয়া বাকি জীবন নাবালকের ন্যায় নিরুদ্বেগ খেয়ালে কাটাইয়াছিলেন, পরাক্রান্ত পারস্যসম্রাটের লোলুপ দৃষ্টি হইতে কান্দাহার রক্ষা করা তাঁহার কর্ম ছিল না। নূরজাহান বাদশাহী ও বাদশাহকে শেষ পর্যন্ত সামলাইয়াছিলেন বটে, কিন্তু পরোক্ষত তাঁহারই বুদ্ধির দোষে ১৬২৩ খ্রিস্টাব্দে কান্দাহার হস্তচ্যুত হইল। শাহজাদা খুর‌রম ১৬১১ হইতে ১৬২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নূরজাহানের হাতে নাটাই-বাঁধা ঘুড়ির মতো সৌভাগ্যাকাশে যদৃচ্ছা উড়িতেছিলেন; দাক্ষিণাত্যের তিন সুবার মালিক হইয়া হঠাৎ তিনি পিতার উপর বাজপক্ষীর মতো ছোঁ মারিবার মতলব করিতেছিলেন। আভ্যন্তরীণ গোলমাল বাহিরেও অজানা ছিল না। সুযোগ বুঝিয়া প্রথম শাহ আব্বাস পঁয়তাল্লিশ দিন অবরোধের পর কান্দাহার অধিকার করিয়া লইলেন।

পনের বৎসর পরে ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে অপ্রত্যাশিতভাবে বিনাযুদ্ধে কান্দাহার আবার দিল্লীশ্বর শাহাজাহানের হস্তগত হইল। উহার শাসনকর্তা আলী মর্দান খাঁ নিজ প্রভুর অভিসন্ধিতে সন্দিহান হইয়া কান্দাহার প্রত্যর্পণপূর্বক মোগল দরবারে আশ্রয় গ্রহণ করেন। মোগল সম্রাট কান্দাহার ও উহার উপদুর্গ বস্ত ও জমিন্দবার অজস্র অর্থব্যয়ে সুসজ্জিত ও সুরক্ষিত করিয়া একটি স্বতন্ত্র কান্দাহার সুবা বা প্রদেশ কায়েম করিলেন। শাহজাহানের দরবারী ঐতিহাসিক আব্দুল হামিদ লাহোরী পরিহাসচ্ছলে লিখিয়াছেন, কান্দাহার হারাইয়া শাহ সফীর দিনে আরাম রাত্রে ঘুম ছিল না (“রোজ বে-তার্ ও শব্ বে খাব্”), কিন্তু স্বয়ং দিল্লীশ্বরের মনেও সদা হারাই-হারাই আশঙ্কা। কান্দাহার দুর্গ হস্তগত হওয়ার পর বৎসর গুজব রটিল, ইরানী সৈন্য আসিতেছে। সম্রাট শাহজাহান তাড়াতাড়ি লাহোর হইতে তাঁহার জ্যেষ্ঠ ও প্রিয়তম পুত্র দারার অধিনায়কত্বে সৈন্যদল প্রেরণ করিলেন ( ১৬৩৯ খ্রিঃ, ৮ই ফেব্রুয়ারি)। শাহাজাদা কাবুল হইয়া গজনী পৌঁছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যেই জানা গেল, গুজবটা মিথ্যা। প্রকৃতপক্ষে এ সময় শাহ-সফী তুর্কী সৈন্যের বিরুদ্ধে রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন। সুলতান চতুর্থ-মোরাদ এ সময় বাগদাদ দখল করেন। যাহা হউক, কিলিচ খাঁ এক দল সেনা সহ গজনী হইতে কান্দাহার পৌছিয়া ইরানীদের গতিবিধির উপর নজর রাখিবার হুকুম পাইলেন। শাহজাদা গজনী হইতে বিজয়গৌরবে কাবুলের পথে লাহোরে ফিরিয়ে আসিয়া ৯ই অক্টোবর দরবারে হাজির হইলেন। শাহজাহান যেন হারানিধি ফিরিয়া পাইলেন—দারাকে ইহার পূর্বে বাদশাহ কখনও চোখের আড়াল করেন নাই।

শাহ সফী ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে ইরাক ও আর্মিনিয়া হইতে তুর্কীদিগকে বিতাড়িত করিবার পর সত্য সত্যই কান্দাহার অধিকার করিবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। রুস্তম খাঁ জুজীর অধীনে অগ্রগামী সৈন্যদল খোরাসানের রাজধানী নিশাপুরে পৌঁছিয়া তাঁহার আগমন প্রতীক্ষার জন্য আদিষ্ট হইল। এদিকে হিন্দুস্থানেও যুদ্ধের সাড়া পড়িয়া গেল। স্বয়ং সম্রাট এ সময়ে লাহোরে ছিলেন। পূর্বের ন্যায় এবারও তিনি শাহজাদা দারাকে মোগল বাহিনীর সর্বপ্রধান সেনাপতি মনোনীত করিলেন। কিন্তু শাহজাদা পূর্বে কোনও যুদ্ধ তো করেনই নাই, লড়াইয়ের ময়দানেও উপস্থিত ছিলেন না। এজন্য তিনি সৈদ খাঁ বাহাদুর, রুস্তম খাঁ বাহাদুর ফিরোজ-জঙ্গ, আম্বেরপতি মির্জা রাজা জয়সিংহ ও যোধপুরের মহারাজা যশোবন্ত সিংহকে শাহজাদার সঙ্গে পাঠাইলেন। ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দের ১০ই এপ্রিল শাহজাদা সসৈন্যে কান্দাহার যাত্রা করিলেন। ভাগ্যলক্ষ্মী তাঁহার প্রতি সুপ্রসন্না। ইরানের শাহ সফীকে নিশাপুর পর্যন্ত পৌঁছিতে হইল না; এই বৎসরের মে মাসে পারস্যের কাশান শহরেই তাঁহার ইহলীলা সাঙ্গ হইল। তাঁহার উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় শাহ আব্বাস নাবালক শিশু; সুতরাং ইরান-সেনানীরা কান্দাহার আক্রমণের সংকল্প পরিত্যাগ করাতে দারার আশাভঙ্গজনিত ক্ষোভ উপস্থিত হইল। পারস্যের সিস্তান, ফরাহ্ ও হিরাত শহর অধিকার করিয়া কাবুল-কান্দাহার ও হিন্দুস্তানকে সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ করিবার ইহাই ছিল উপযুক্ত অবসর। কিন্তু শাহজাদার এই আগ বাড়াইয়া থাকিবার নীতি (forward policy) সম্রাটের মনঃপূত হইল না। পাছে কান্দাহার পর্যন্ত পৌঁছিলে শাহজাদা পারস্য রাজ্য আক্রমণ করিয়া অকারণ যুদ্ধ বাধাইয়া বসেন সেজন্য শাহজাদাকে গজনী হইতে ফিরিয়া আসিবার জরুরি আদেশ প্রেরিত হইল। তবে রুস্তম খাঁ বাহাদুর ও সৈদ খাঁ বাহাদুর ত্রিশ হাজার অশ্বারোহী সহ দুর্গরক্ষক মোগল-সৈন্য ও আক্রমণ-ভয়াতুর অধিবাসিগণকে আশ্বস্ত করিবার অভিপ্রায়ে কান্দাহার পর্যন্ত অগ্রসর হইবার আদেশ পাইলেন। শাহজাদা দারাশুকো (২রা সেপ্টেম্বর, ১৬৪২ খ্রিঃ) লাহোরে উপস্থিত হইলে সম্রাট যুদ্ধজয়ী সেনানীর ন্যায় তাঁহাকে পুরস্কৃত করিলেন।

শাহ সফীর মৃত্যু ও পারস্য রাজ্যের অসতর্ক অবস্থার সুযোগ অবহেলা করিয়া দিল্লীশ্বর সুবিবেচনার কাজ করিয়াছিলেন কিনা সন্দেহ। কাবুল-কান্দাহার নিরাপদ করিতে হইলে সিস্তান না হউক, অন্তত পারস্য ও খোরাসানের দিক হইতে শত্রুর সুগম প্রবেশদ্বার স্বরূপ হিরাত নগর অধিকার করা সম্রাট শাহজাহানের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। পরধন কিংবা পররাজ্যে তাঁহার যে অরুচি ছিল তাহাও নয়। ১৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যে গোলকুণ্ডা ও বিজাপুরের বিরুদ্ধে অভিযান ও পরবর্তী ব্যবহার ইহার প্রমাণ। জুঝার সিংহ বুন্দেলা চৌরাগড় লুটের ভাগ দিতে রাজি না হওয়ায় তিনি তাঁহাকে সর্বস্বান্ত করিয়াছিলেন (১৬৩৫ খ্রিস্টাব্দ)। সমগ্র ভারতে সার্বভৌমত্ব স্থাপন করিয়া ধর্মাশোকের মতো শাহজাহান যে যুদ্ধ ও রক্তপাতে বীতস্পৃহ হইয়াছিলেন, ইতিহাস এ কথা বলে না। দারার দ্বিতীয় অভিযানের মাত্র চারি বৎসর পরে সম্রাট শাহজাহান বিজিগীষা-বৃত্তি এবং বাবর-তৈমুরের জন্মভূমির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভাবাতিশয্যের প্রেরণায় শাহজাদা মুরাদ ও তৎপশ্চাৎ আওরঙ্গজেবের নেতৃত্বে বখ্-অভিযান প্রেরণ করিতে দ্বিধা বোধ করেন নাই। দশ সহস্র লোকের জীবন ও চারি কোটি টাকা নগদ—এই খরচে তিনি অনায়াসে হিরাত দখল করিয়া ভবিষ্যতের জন্য নিশ্চিত্ত হইতে পারিতেন। এ যুদ্ধে সেনাপতি পদের জন্য দারার যোগ্যতা না থাকিলেও তিনি আওরঙ্গজেবকে পাঠাইতে পারিতেন কিংবা নিজে নেতৃত্ব করিতে পারিতেন। আসল কথা, সম্রাট শাহজাহান আকবরের মতো সামরিক কিংবা রাজনৈতিক প্রতিভা লইয়া জন্মগ্রহণ করেন নাই; পুত্র আওরঙ্গজেবের মতো সামরিক দূরদৃষ্টি, মানসিক শক্তি কিংবা শ্রমসহিষ্ণুতা ও ধৈর্য শাহজাহানের ছিল না। প্রথম বয়সে তাঁহার এ সকল গুণ কিছু কিছু থাকিলেও মমতাজমহলের মৃত্যুর পর অতি দ্রুত শারীরিক বার্ধক্য ও বুদ্ধিবৃত্তির দুর্বলতা তাঁহাকে অভিভূত করিয়াছিল।

শাহজাহানের অবিবেচনার ফল হাতে হাতে ফলিল। অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু বলিয়া যে শত্রুকে তিনি অবহেলা করিয়াছিলেন, সেই দ্বিতীয় শাহ আব্বাস কৈশোরে পদার্পণ করিয়াই কান্দাহার পুনরধিকারের জন্য হিরাত শহরে যুদ্ধসম্ভার ও সৈন্য সমাবেশ করিতে লাগিলেন। মোগল সম্রাট এ সময়ে দিল্লিতে ছিলেন। তিনি প্রথমে স্থির করিয়াছিলেন স্বয়ং কাবুলে গিয়া যুদ্ধের ভার লইবেন। সুবাদারেরা সসৈন্যে দিল্লিতে হাজির হইতে আদিষ্ট হইল। কিন্তু তাঁহার আরামপ্রিয় আমীরদের মধ্যে অনেকেই দারুণ শীতে কাবুল যাইবার কথা শুনিয়া হতাশ হইয়া পড়িলেন। তাঁহারা বাদশাহকে বুঝাইলেন, ইরানীরা শীতকালে কিছুতেই লড়াই করিতে আসিবে না, আলা হজরত অনর্থক কষ্ট স্বীকার করিবেন; হিন্দুস্থানী ফৌজ অকারণ হয়রান-পেরেশান হইবে। মাস দুই পরে গেলে কোনও ক্ষতি নাই, বরং আসা-যাওয়ার আরাম ও কাবুলের দিল-ফেরেব বাহার দেখার নসিব হইবে। বাদশার মত বদলাইয়া গেল। কাবুলের সুবাদারকে কান্দাহার দুর্গে পাঁচ হাজার সিপাহী ও পাঁচ লাখ টাকা পাঠাইবার হুকুম পাঠাইয়া তিনি দিল্লির শীত উপভোগ করাই স্থির করিলেন। লেপের আরাম কিংবা শরতের জ্যোৎস্না উপভোগ বিধাতা গরিব ও বাদশাহের ভাগ্যে লিখেন নাই। রাজমুকুট ফুলের টোপর নহে।

দশ জনে যাহা যুক্তিযুক্ত মনে করে না কিংবা যে-কাজে পিছু হটে, সেই কাজ করিয়াই মানুষ সাধারণ শ্রেণী হইতে উন্নীত হইয়া অনন্যসাধারণ পদবী লাভ করিয়া থাকেন। তৎকালীন ইউরোপের গতানুগতিক নিয়ম উপেক্ষা করিয়া শীতকালে সৈন্যচালনাপূর্বক এবং শত্রু-মিত্র দুই পক্ষকে ফাঁকি দিয়া ব্লেনহিম যুদ্ধ জয় করিতে না পারিলে মালবরো বড়জোর দ্বিতীয় শ্রেণীর যোদ্ধা ও রূপসী স্ত্রীর স্বামী বলিয়াই ইতিহাসে পরিচিত হইতেন।

পারস্য-পতি দ্বিতীয় শাহ আব্বাস ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর কান্দাহার অবরোধ করিলেন। দুর্গাধ্যক্ষ দৌলত খাঁর বয়স ষাটের উপর; সাহসের অভাব না থাকিলেও তিনি ঢিলা প্রকৃতির লোক ছিলেন। কান্দাহার দুর্গের রন্ধ্রতুল্য “চেহেল জিনা” পাহাড়ের ঘাঁটি ও সান্ত্রীগৃহে অল্পসংখ্যক প্রহরী রাখিয়া তিনি অন্য সমস্ত সৈন্যসহ দুর্গপ্রাচীরের ভিতরেই হাত-পা গুটাইয়া বসিয়া রহিলেন। ইরানীরা সেখানে কামান বসাইয়া অন্দর কেল্লা ও বাজারের উপর গোলা ফেলিতে লাগিল। এদিকে দুর্গমধ্যে নবনিযুক্ত দুইজন বিশ্বাসঘাতক তাতার-সর্দার দল পাকাইয়া বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র করিল। দৌলত খাঁ সরাসরি ইহাদের মাথা না কাটিয়া তাহাদিগকে যুক্তিতর্কের দ্বারা বুঝাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্তু ক্রমশ সিপাহীরা তাঁহার হুকুমের বাহির হইয়া পড়িল। ছাপ্পান্ন দিন অবরোধের পর দৌলত খাঁ আত্মসমর্পণ করিলেন; মোগল সৈন্যেরা চিরদিনের মতো কান্দাহার হইতে শেষ বিদায় লইয়া হিন্দুস্থান অভিমুখে যাত্রা করিল (১১ই ফেব্রুয়ারি, ১৬৪৯)। ইহার পুরা তিন মাস পরে শাহজাদা আওরঙ্গজেব ও উজীর সাদুল্লা খাঁ পরিচালিত মোগল বাহিনী কান্দাহারে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, কার্য সাঙ্গ হইয়া গিয়াছে। মে হইতে আগস্ট মাস পর্যন্ত তাঁহারা কান্দাহার অবরোধ করিয়া অকৃতকার্য হইলেন, কারণ তাঁহাদের সঙ্গে ভারী তোপ ও অবরোধের সরঞ্জাম ছিল না। ইহার তিন বৎসর পরে, ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দে শাহজাদা আওরঙ্গজেব দ্বিতীয় বার কান্দাহার অভিযানে প্রেরিত হইলেন। মানুষের বুদ্ধি, সাহস ও অক্লান্ত পরিশ্রমে যাহা সম্ভব, আওরঙ্গজেব সমস্তই করিলেন। তিনি হিন্দুস্থানের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং অপরাজেয় যোদ্ধা; তবুও কান্দাহার দুর্গে তাঁহার চেষ্টা বিফল হইল। এই অকৃতকার্যতার জন্য দায়ী আওরঙ্গজেব নন; স্বয়ং দিল্লীশ্বর এজন্য সম্পূর্ণ দোষী। তিনি আওরঙ্গজেবকে যুদ্ধচালনার সর্বময় কর্তৃত্ব ছাড়িয়া দেন নাই। কাবুলে থাকিয়া উজীর সাদুল্লার মারফত চিঠিপত্র দ্বারা তিনিই এ যুদ্ধ চালাইয়াছিলেন বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। আওরঙ্গজেব সৈন্যক্ষয় অগ্রাহ্য এবং প্রাণের মমতা ত্যাগ করিয়া তলোয়ার হাতে দুর্গপ্রাচীর দখল করিবার অনুমতি চাহিলেন। ইহা অনুমোদন করা দূরে থাক, আরও কিছু দিন অবরোধ চালাইবার প্রার্থনা তিনি না-মঞ্জুর করিলেন। ইহার উপর আবার বেচারা আওরঙ্গজেবকে উল্টা গালাগালি। শাহজাদার প্রতি এক্ষেত্রে তাঁহার আচরণ পিতা ও অপক্ষপাত রাজ-রাজেশ্বরের উপযুক্ত হয় নাই। আওরঙ্গজেব শেষ ভিক্ষা চাহিলেন— পরবর্তী অভিযানে তিনি অন্যের অধীনে সাধারণ মনসবদার হিসাবে কাজ করিতে প্রস্তুত; দিল্লীশ্বর যেন তাঁহাকে আর এক বার যুদ্ধ করিবার সুযোগ দেন। কিন্তু ইহার পরিবর্তে পিতার নিকট হইতে তিনি পাইলেন শুধু মর্মচ্ছেদী বাক্যবাণ, বিদ্রূপ ও শ্লেষ এবং সুদূর দাক্ষিণাত্যে সরাসরি বদলি হওয়ার শাস্তি। এই পরাজয়ে তিনি অকর্মণ্য দারার উপহাসের পাত্র হইলেন—ইহাই আওরঙ্গজেবের বুকে শল্যস্বরূপ বিধিয়া রহিল। এই সময় হইতে আওরঙ্গজেব যদি শাহজাহানকে পিতার ন্যায় ভক্তি না দেখাইয়া থাকেন, সে দোষ পুত্রের নয়; উহা পুত্রের প্রতি পিতার অবিচারের প্রতিক্রিয়া। যে কান্দাহার দুর্গে হিন্দুস্থানের পৌরুষ ও মোগলের পুরুষকার দুই-দুই বার প্রতিহত হইল, আওরঙ্গজেব-সাদুল্লার শৌর্য ও বুদ্ধিমত্তা নিষ্ফল হইল, উহার বিরুদ্ধে শাহজাহান কোন্ বুদ্ধিতে দারাকে পরবৎসর সেনাচালনার ভার অর্পণ করিয়াছিলেন বুঝা কঠিন নয়। বাদশাহ তাঁহার দ্বিতীয় পুত্র শাহ শুজাকে সুবে বাংলা হইতে কান্দাহার-অভিযানে যোগ দেওয়ার জন্য হুজুরে তলব করিয়াছিলেন। কিন্তু শুজা সিন্ধুনদ অতিক্রম করিবার পূর্বেই তাঁহার প্রতি বাংলায় ফিরিয়া যাইবার হুকুম হইল। পাছে শুজা দারার বিরুদ্ধে আওরঙ্গজেবের সঙ্গে কোন কুপরামর্শ করে সেই জন্য শাহজাদাদ্বয়ের প্রতি হুকুম হইল, কুচ করিবার সময় বরাবর যেন দুই-তিন মঞ্জিল রাস্তা ব্যবধান থাকে। পিতা ও পুত্রদের এইরূপ পরস্পরের প্রতি সন্দিগ্ধ ভাব এই সময় হইতে স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। আওরঙ্গজেব ও শুজা সমস্ত পথ দূরে দূরে থাকিয়া অবশেষে দিল্লিতে যেন দৈবাৎ পরস্পরের সহিত মিলিত হইলেন। এ সময় (নভেম্বর, ১৬৫৪ খ্রিঃ) শুজার কন্যা গুলরুক্ বানুর সহিত আওরঙ্গজেবের পুত্র সুলতান মহম্মদের বাগ্দান সম্পন্ন হইল। দাক্ষিণাত্য যাত্রার সময়ে মালবের পথে গুজরাটের সুবাদার মোরাদ বক্শ আসিয়া দাদা আওরঙ্গজেবের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। এই ভাবে তিন ভ্রাতা তাঁহাদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচী স্থির করিয়া লইলেন; দারার ভাগ্যাকাশে কালবৈশাখীর মেঘ ঘনাইয়া উঠিল।

১৬৫২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই জুলাই হিন্দুস্থানের ফৌজ কান্দাহার হইতে কাবুল ফিরিয়া আসিল। স্থির হইল, আগামী শীতের শেষে শাহজাদা দারাশুকো কান্দাহার যাত্রা করিবেন। সুবা কাবুল ও মুলতানের শাসনভার তাঁহার উপর অর্পিত হইল। দারার নায়েব সুবাদার রূপে সুলেমান শুকো কাবুল এবং মহম্মদ আলি খাঁ মুলতানে থাকিবেন। দারা স্বয়ং লাহোরে গিয়া আগামী যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম ও সৈন্যাদির ব্যবস্থা করিবেন। এ-সময় নূতন দিল্লি শাহজাহানাবাদের নির্মাণকার্য প্রায় শেষ হইয়াছিল; সম্রাট দারাকে কাজ বুঝাইয়া দিয়া দিল্লিতে ফিরিয়া আসিলেন। শাহজাহানের ভাবী উত্তরাধিকারী দারা এত দিন পর্যন্ত সুফী ধ্যান-ধারণা, তত্ত্বজ্ঞানবোধিনী যোগপ্রদীপ ইত্যাদি ধরনের মুসলমানী সাধনতত্ত্ববিষয়ক রচনা এবং রাজ্যের সাধু-ফকির-দরবেশ লইয়া মশগুল ছিলেন। সুকুমার কলা, সঙ্গীত, সাহিত্য ও অধ্যাত্ম-বিদ্যানুরাগী বলিয়া শাহজাদা যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন; কিন্তু চল্লিশের কাছাকাছি বয়স হইলেও তিনি লড়াইয়ের ময়দানে বাহাদুরি দেখাইবার সুযোগ পান নাই; তিনি ছিলেন পিতার সুবোধ বালক; গায়ে আঁচড় লাগিবার ভয়ে শাহজাহান পুত্রকে চোখের আড়াল হইতে দেন নাই। পিতার এই দুর্বলতা দারার সহজাত ক্ষমতা ও মনুষ্যত্বের পূর্ণবিকাশের পরিপন্থী হইয়াছিল। আশৈশব যুদ্ধ ও শাসনকার্যে অসীম দক্ষতা প্রদর্শন করিয়াও আওরঙ্গজেবের মনসব বিশ হাজারীর উপরে উঠিল না। অথচ কোমরের কিরিচ না খুলিয়াই দারার মনসব সকলকে ছাড়াইয়া ত্রিশ হাজারী হইয়া গেল। এ সম্মান পিতার অন্ধ স্নেহের আত্মতৃপ্তির নিদর্শন মাত্র; যোগ্যতার পুরস্কার কিংবা তাঁহার কৃতিত্ব ও শ্রেষ্ঠতার পরিমাপ নহে—এই জ্ঞান দারার ছিল না।

শাহজাহান আজীবন পুত্রকে ঠোঁটে করিয়াই আহার জোগাইয়াছিলেন; স্বাধীনভাবে উড়িয়া বেড়াইবার শিক্ষা দেন নাই। দারাও কোনোদিন আত্মনির্ভরতার আবশ্যক বোধ করেন নাই; পিতার ডানার আড়ালে থাকিয়া শুধু পাখা ঝাড়িয়াছেন। অপ্রকৃষ্য রাজশক্তি-রক্ষিত সৌভাগ্যশৈলের উচ্চতম শৃঙ্গে সুখোপবিষ্ট শাহজাদা দারা মনে করিতেন, তিনিই হিন্দুস্থানের ভাবী ভাগ্যবিধাতা “হুমা” পাখি; বীর্য ও সাহসে তিনি শাহ-বাজ এবং জ্ঞান ও বুদ্ধিতে হীরামন তোতা।

ভ্রাতাদের তিনি অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখিতেন। কাঠ-মোল্লা কপট আওরঙ্গজেব একটা ধূর্ত দাঁড়কাক; কায়দাদোরস্ত গর্বিত আয়েসী শুজা সেই চটক-ঝুঁটিদার শাহী কাকাতুয়া; এবং সদা রক্তচক্ষু, একগুঁয়ে মোরাদ বক্শ বুনো তিতির—ইহার বেশি তাহারা আর কিছুই নয়; ইহাই ছিল তাঁহার ভাব। আওরঙ্গজেবের পরাজয়ে তিনি মনে মনে সন্তুষ্ট হইয়া নিরস্ত থাকেন নাই। তিনি এবং তাঁহার মোসাহেবগণ ততোধিক নানা রকম নিন্দা-বিদ্রূপ করিয়া আওরঙ্গজেবের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়াছিলেন।

কান্দাহার অভিযানের সেনাপতি মনোনীত হইবার পর দিন হইতেই দারা সেই দুর্গজয়ের স্বপ্ন দেখিতে লাগিলেন। একদিন রাত্রিকালে তাঁহার স্বপ্নপ্রয়াগ হইল; গন্তব্যস্থানে পৌঁছিয়া তিনি দেখিলেন, একটি বড় রকমের দুর্গ এবং সেই দুর্গ সাত দিনে দখল করিয়া তিনি কাবুল ফিরিয়াছেন। ইহার পর হইতে তাঁহার দৃঢ় বিশ্বাস হইল, কান্দাহার ফতে হইয়া গিয়াছে; সেখানে পৌঁছিতে যা কিছু বিলম্ব। কিন্তু কি ভাবে দুর্গটি এত সহজে তাঁহার হস্তগত হইবে এ-বিষয়ে “গায়েবী দুনিয়া” হইতে কোনও ইশারা মিলে কি না ইহাই তিনি চিন্তা করিতে লাগিলেন। এমন সময়ে একদিন দুইজন সুফী দরবেশ গম্ভীরভাবে সোজা শাহজাদার খাস বৈঠকখানায় ঢুকিয়া তাহাদের শতচ্ছিদ্র সহস্ৰতালিযুক্ত লম্বা জোব্বা মুড়ি দিয়া ধ্যানস্থ হইল। ইহা এক রকম শাহজাদার দৌলতখানায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সাত হাজারী মনসবদার আসিলে হয়তো প্রবেশের অনুমতির জন্য ঘড়ি দেড় ঘড়ি দাঁড়াইয়া থাকিতে হইত; কিন্তু ঠিকমত ভেক থাকিলে সাধু-ফকিরদের জন্য কোনও হুকুম আবশ্যক ছিল না। ফকিরের খবর পাইলেই শাহজাদা আনন্দে অজ্ঞান হইতেন; ছুটিয়া আসিয়া সালাম- খুশ-আমদ করিতেন। বাহ্যত মৃতকল্প গভীর ধ্যানমগ্ন হইলেও, ফকিরদ্বয় শাহজাদা কখন বৈঠকখানায় নিঃশব্দে প্রবেশ করিলেন সেটা ঠিকমত টের পাইয়াছিল। কিছুক্ষণ পরে উহাদের মধ্যে একজন হঠাৎ আনমনা ভাবে মাথা তুলিয়া বলিল, “আমি এখন ইরানে পৌঁছিয়া সেখানকার হাল প্রত্যক্ষ করিতেছি; ইরানের শাহের দুনিয়াদারী খতম!” দ্বিতীয় দরবেশ মাথা না তুলিয়াই বলিল, “হাঁ ঠিক তাই; আমি কিন্তু শাহকে কবর না দিয়া আসিতেছি না।” দারা এই কথা শুনিয়া বলিলেন, “আমিও স্বপ্নে দেখিয়াছি, সাত দিনের বেশি আমাকে কান্দাহারে থাকিতে হইবে না; শাহ আব্বাস মারা যাওয়া বিচিত্র নয়।” বৈজ্ঞানিকের টেলিস্কোপ সাধু-ফকিরদের টেলিভিশনের কাছে কোথায় লাগে? কিন্তু দুঃখের বিষয় আলাম-ই-নাসুত (প্রত্যক্ষ জগৎ) অর্থাৎ মাটির পৃথিবী ছাড়িয়া শাহজাদার ন্যায় বাস্তবতার বহু ঊর্ধ্বে আলম-ই-মালাকুৎ বা স্বপ্নজগতে ঘোরাফেরা করিবার অধিকার ঐতিহাসিকের নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *