বিংশতি অধ্যায় – পিতা-পুত্রের ভাগ্যবিপর্যয়
১
সামুগঢ়ে সূর্যাস্তের পর মোগল সাম্রাজ্য তথা ভারতবর্ষের বুকে যে কালরাত্রির সূচনা হইয়াছিল, পূর্ণ দুই শতাব্দী পরে ‘সিপাহী’ যুদ্ধের প্রলয়ঙ্করী ঝঞ্ঝা লইয়াই উহার অবসান এবং নবভারতের প্রথম প্রভাত-ঐতিহাসিকগণ এইরূপ কালগণনা করিয়া থাকেন। এই মহানিশার প্রথম প্রহরে দারা শাহজাহান, দ্বিতীয় প্রহরে আওরঙ্গজেব, তৃতীয়ে সিরাজ-বালাজী বাজীরাও এবং শেষ প্রহরে দ্বিতীয় শাহ আলম ও দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের বিয়োগান্ত জীবন-নাট্যের যবনিকাপাত হইয়াছিল। এই দীর্ঘ দুর্যোগময়ী রজনীতে ভারতের ভাগ্যাকাশে তখন শিবাজী-বাজীরাও, আলীবর্দী হায়দর, নানাফড়নবীশ মাহাজী এবং রণজিৎ সিংহের কীর্তিপুঞ্জ-সমুজ্জ্বল দ্বিতীয় সপ্তর্ষিমণ্ডল দিশাহারা ভারত-সন্তানকে পথ দেখাইয়া চলিয়াছে, কিন্তু কেহ ঊর্ধ্ব দিকে চাহিয়া দেখে নাই, কালচক্রে ঘুরিয়া মরিয়াছে, আলেয়ার পশ্চাতে ছুটিয়াছে।
২
(১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ, ২৯শে মে, রাত্রি আনুমানিক ১০। ১১টা)
আগ্রা শহরে আমীর গরিব কাহারও চোখে ঘুম নাই; লড়াই হইতে সিপাহী সওয়ার যাহারা পলাইয়া আসিয়াছে তাহারাই কেবল মড়ার মতো পড়িয়া আছে। দুর্গে শাহীমহলে বাহিরে অলিগলিতে কান্নার রোল। যে বাড়িতে কেহ মরে নাই সেখানেও রাত্রি প্রভাতের আশঙ্কায় স্ত্রী-পুরুষ মাথায় হাত দিয়া কাঁদিতেছে, কাঁধের উপর মাথা ও স্ত্রী-কন্যার ইজ্জত কতক্ষণ থাকিবে নিশ্চয়তা নাই। এই সময়ে আগ্রা দুর্গ হইতে সম্রাটের বিশ্বস্ত খোজা ফাহিম প্রভুর জরুরি আদেশ বহন করিয়া দারার হাভেলির দিকে গোপনে চলিয়াছে।
ঘোড়া হইতে নামিয়াই আধমরা অবস্থায় দারা ফরাশের উপর শয্যা লইয়াছিলেন, সাধ্য থাকিলে যেন মাটির নীচেই মুখ লুকাইতেন। কোমর ভাঙা অজগরের মতো অপমান ও অনুশোচনায় এপাশ-ওপাশ করিতে করিতে তিনি ক্রমশ অসাড় হইয়া পড়িতেছিলেন, এমন সময় খোজা ফাহিম আসিয়া অভিবাদনপূর্বক সম্রাটের মৌখিক সংবাদ পুনরাবৃত্তি করিল— “যাহা ঘটিয়াছে উহা তকদিরের ফের। আমাকে একবার দেখা দিয়া এবং আমার বক্তব্য শুনিয়া তুমি যেখানে ইচ্ছা যাইতে পার, নিরাশ হওয়ার কারণ নাই।” দারা ইহাতে আরও অভিভূত হইয়া পড়িলেন, অনেকক্ষণ তাঁহার মুখ দিয়া কোনও কথা বাহির হইল না; দুর্গে যাইবার জন্য ফাহিমের অনুনয়-বিনয় বিফল হইল। অবশেষে তিনি পিতাকে বলিয়া পাঠাইলেন, “শাহশাহকে মুখ দেখাইবার সাহস আমার নাই; আমার সামনে লম্বা সফর, হতভাগা মুসাফিরকে দোয়া করিয়া ফাতেহা পাঠ করিবেন।”
আগ্রায় সম্রাট শাহজাহান সারাদিন দারার বিজয় অথচ মোরাদ- আওরঙ্গজেবের অক্ষত শরীরে পলায়নের সংবাদ শুনিবার জন্য জুয়াড়ির উৎকণ্ঠা লইয়া কালক্ষেপ করিতেছিলেন; সন্ধ্যার পূর্বে দারার পরাজয়ের কানাঘুষা শুনিয়াও তিনি উহা বিশ্বাস করিতে পারেন নাই। এইজন্য দুঃসংবাদের প্রথম ধাক্কায় তিনিও মুহ্যমান হইয়াছিলেন। দারার দুর্ভাগ্য এবং আওরঙ্গজেবের জয়লাভ, ভালো মন্দ উভয়ই খোদার মর্জি কিংবা নিয়তির বিধান বলিয়া স্থিরচিত্তে গ্রহণ করিবার মতো কন্যা জাহানারার অপক্ষপাত ঈশ্বর-নির্ভরতা ও আধ্যাত্মিক শক্তি শাহজাহানের ছিল না। জাহানারার সান্ত্বনাবাক্যে তিনি কথঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হইয়াও দারাকে শুধু আর একবার দেখিবার জন্য ব্যাকুল হইয়াছিলেন, দারার এই প্রত্যাখ্যান ও শোচনীয় দশা তাঁহার প্রাণের দ্বিগুণ আঘাত হানিল, তাঁহাকে ছাড়িয়া অসহায় দারা কোথায় যাইবে? এই ভাবনায় ক্রমশ কঠোর হইয়া সম্রাটের সুপ্ত পুরুষকার জাগিয়া উঠিল, বুদ্ধি মোহমুক্ত হইল। তিনি বুঝিলেন তাঁহার কপালে যাহাই থাকুক, দারাকে বাঁচাইতে হইবে, আগ্রায় আর একদণ্ড অপেক্ষা করা তাঁহার পক্ষে নিরাপদ নয়। মনকে শক্ত করিয়া সম্রাট ও জাহানারা হতভাগ্য দারার পথের সম্বল জোগাইবার জন্য কর্মতৎপর হইলেন, দুর্গের গুপ্ত ধনভাণ্ডার উন্মুক্ত হইল, আশরফি ও দামি জহরত বোঝাই কাতারে কাতারে খচ্চর দারার হাভেলির দিকে চলিল। নিজ তহবিলে নগদ যাহা কিছু ছিল এবং অলঙ্কারাদির প্রাপ্য অংশ হইতে অন্যান্য ভ্রাতাকে বঞ্চিত না করিয়া দারাকে যাহা দিবার ছিল জাহানারা বেগম উহা দারার কাছে পাঠাইয়া দিলেন। সম্রাট দারাকে লিখিলেন, “অবিলম্বে তুমি আগ্রা ত্যাগ কর, দিল্লিতে সুলেমানের ফৌজের জন্য অপেক্ষা করিবে, দিল্লির দুর্গ তোমাকে সমর্পণ করিবার জন্য শাহী ফরমান যাইতেছে।” সেই রাত্রে সম্রাটের কলম বোধ হয় চিঠি লিখিয়াই চলিয়াছিল, ভোরের পূর্বেই বিশ্বস্ত খোজাগণ সুবা আগ্রা-দিল্লির ফৌজদার, জমিদার জায়গীরদারগণের নামে শাহী ফরমান লইয়া শহর হইতে বাহির হইয়া পড়িল।
৩
পিতার নির্দেশ অনুসারে দারা পলায়নের জন্য প্রস্তুত হইলেন; পত্নী নাদিরা বানু মূর্তিমতী প্রজ্ঞার ন্যায় তখন তাঁহার বিভ্রান্তচিত্তের একমাত্র আশ্রয়, আঁধারের মধ্যে আশার প্রদীপ। পুত্রকন্যা, পুত্রবধূ ও পৌত্র-পৌত্রী (সুলেমানের পরিবার) লইয়া নাদিরা বানু হাতির পিঠে অবগুণ্ঠনাবৃত হাওদার মধ্যে স্থানগ্রহণ করিলেন, তাঁহাদের সঙ্গে মাত্র কয়েকজন মুখ্যা ক্রীতদাসী চলিল; বাদবাকি পরিচালিকা ও ভৃত্যগণ আশ্রয়ার্থ দুর্গে প্রেরিত হইল। উটের পিঠে নগদ টাকা আশরফি; বহনযোগ্য দামি কয়েকটি জিনিস দারার পাথেয় হিসাবে সঙ্গে চলিল। হস্তীপৃষ্ঠে দারা ও সিপহর শুকো রাত্রি ৩টার সময় গৃহ হইতে চিরবিদায় লইলেন, শাহজাদার বিরাট সংসারের বিলাসোপকরণ যেখানে সাজানো ছিল সেইখানে পড়িয়া রহিল; কিন্তু মালিক অদৃশ্য হইতে-না-হইতে রাতারাতি হাতিঘোড়া সাজ-সরঞ্জাম সব লুঠ হইয়া গেল। চব্বিশ ঘণ্টা পূর্বে অর্ধলক্ষ অশ্বারোহী যাঁহার আদেশের অপেক্ষা করিতেছিল এখন তাঁহার শেষযাত্রার সাথী হইল মাত্র বারোজন সওয়ার।
৩০শে মে সূর্যোদয়ের পূর্বে দারা বাদশাহী রাস্তা ধরিয়া আগ্রা হইতে অনেকদূর আসিয়া পড়িলেন। ইতিমধ্যে শহরে তাঁহার পলায়নের সংবাদ প্রচারিত হইবামাত্র শুধু প্রাণের টানে কয়েকশত অনুচর আগ্রা হইতে দারার সঙ্গ লইবার জন্য ছুটিয়া পড়িল। বেলা ১টার সময় ম্যানুসী সাহেবও তল্পিতল্পা লইয়া বাহির হইয়াছিলেন, তখন শত্রুসেনা শহরের বাহিরে দিল্লির রাস্তায় মোতায়েন হইয়াছে; উহাদের সেনাধ্যক্ষের কৃপায় কোনোরকমে রক্ষা পাইয়া তিনি ভগ্নহৃদয়ে ফিরিয়া আসিলেন।
যাহা হউক, দুই-একজন করিয়া বিভিন্ন দিক হইতে পাঁচ শত অশ্বারোহী এক মঞ্জিল পার হইবার পূর্বেই দারার দলে আসিয়া জুটিল – অন্তত ডাকাতের হাতে সর্বস্ব লুঠ হইবার আশঙ্কা রহিল না। দুই দিন পর্যন্ত ছোটখাটো দলে বিভক্ত হইয়া দারার অনুচরবর্গ আগ্রা হইতে কোনোক্রমে পলাইতেছিল, বাদশাহী ভৃত্যগণ শত্রুর দৃষ্টি এড়াইয়া আরও কিছু অর্থ দারার কাছে পৌঁছাইল; শত্রুসৈন্য তখন পর্যন্ত দারাকে ধরিবার জন্য ধাবিত হয় নাই। এইভাবে দিল্লি পৌঁছবার পূর্বে দারার সৈন্যসংখ্যা বারোজন হইতে বাড়িয়া পাঁচ হাজার হইল। পাঁচ দিন কুচ করিয়া দারা ৫ই জুন (১৬৫৮ খ্রিঃ) দিল্লি পৌঁছিয়া শাহজাহানাবাদ দিল্লির বাহিরে পুরাতন দিল্লিতে (যাহার বর্তমান নিদর্শন শেরশাহ নির্মিত অন্তদুর্গ, শেরমঞ্জিল ও শেরশাহী মসজিদ) তাঁবু ফেলিলেন। এইখানে নূতন ফৌজ ভর্তি আরম্ভ হইল এবং সাত দিনে সাত হাজার নূতন অশ্বারোহী সংগৃহীত হইল। যুদ্ধের প্রয়োজনে তিনি শাহী খাজনাখানা, হাতি, ঘোড়া ইত্যাদি দখল করিলেন এবং কোনও কোনও আমীরের ব্যক্তিগত সম্পত্তির উপরও হস্তক্ষেপ করিতে ইতস্তত করিলেন না। কুমার সুলেমানকে আগ্রার পথ ছাড়িয়া যমুনার পূর্বতীরের পথে দিল্লি আসিবার জন্য দারা জরুরি চিঠি লিখিয়াছিলেন। তাঁহার ভরসা ছিল আওরঙ্গজেব সহজে আগ্রা দুর্গ অধিকার করিতে পারিবেন না এবং ইতিমধ্যে সুলেমানের ফৌজ নিশ্চয়ই আসিয়া পড়িবে।
৪
সামুগঢ়ে দারার পৃষ্ঠপ্রদর্শনের পর বিজয়ী আওরঙ্গজেব দুই-দুই বার হাতি হইতে নামিয়া পরম ভক্তিভরে মাটিতে মাথা ঠেকাইয়া খোদাতালাকেই জয়ের কৃতিত্ব নিবেদন করিলেন। উহার পর দারার শিবির অধিকার করিয়া শাহজাদার সাজানো তাঁবুতেই রাত্রিবাস করিবার অভিপ্রায় করিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাহস করিলেন না। কোথায়ও মাটির নীচে চোরা সুড়ঙ্গে বারুদ পুরিয়া তাঁহাকে উড়াইয়া দিবার জন্য হয়তো কোনও ফাঁদ রাখিয়া গিয়াছে সন্দেহ করিয়া মাটি খুঁড়িবার হুকুম দিলেন। এত বুদ্ধি মগজে থাকিলে দারার তাজ ও মাথা দুইটাই কি এইভাবে বিপন্ন হইত?
অতঃপর ওইখানে নিজ তাঁবুর নীচেই তিনি সেনাধ্যক্ষগণের মোবারকবাদ গ্রহণ করিলেন। মোরাদ বকশ্ “হজরত-জীউ”-কে বিজয়-সম্বর্ধনা জানাইবার জন্য উপস্থিত হইলে আওরঙ্গজেব প্রথমেই ‘বাদশাহজীউ! ফতে মোবারকবাদ!” বলিয়া তাঁহাকে অভিনন্দিত করিলেন এবং দরবারে ঘোষণা করিলেন, “অদ্য তারিখ হইতে মোরাদশাহী হুকুম হিন্দুস্থানে কায়েম হইল আপনারা জানিবেন।” মোরাদের বুকের ছাতি কথাতেই পাঁচ হাত চওড়া হইয়া গেল: মোরাদের শরীরের অবস্থা দেখিয়া আওরঙ্গজেব ভাইকে ভিতরে লইয়া গেলেন এবং শল্যচিকিৎসকগণকে তলব করিলেন। মোরাদের মুখে গায়ে বহু আহত স্থান হইতে তখনও রক্ত পড়িতেছিল, তাঁহার মাথা নিজের কোলে রাখিয়া আওরঙ্গজেব হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন এবং নিজের জামার আস্তিন দিয়া রক্ত মুছিতে লাগিলেন; বাহিরে ধন্য ধন্য পড়িয়া গেল, সকলেই ভাবিল শাহজাদা ভ্রাতৃপ্রেমে দ্বিতীয় রামচন্দ্র।
যাহা হউক, বিজেতা শিবিরে সারারাত্রি আওরঙ্গজেব ব্যতীত বাদবাকি মুসলমান আমীর সিপাহী খিদমতগার স্থানে স্থানে মজলিশ জমাইয়া বিজয়লব্ধ নাচওয়ালীগণের নাচগান ও শরাবে মশগুল হইয়া রহিল; হিন্দুরা কেবল মড়া পোড়াইয়া মরিতেছিল—কেননা মুসলমানের মুর্দা বাসি হইলে জাঁকজমক বেশি হয়, কিন্তু বাসি মড়া হইলে হিন্দুর ঠিক সদ্গতি হয় না। রাজপুত মারাঠা বুন্দেলা স্বপক্ষ-বিপক্ষ নির্বিচারে স্ব স্ব গোত্রের নিহত যোদ্ধাদের মৃতদেহ যথাসাধ্য একত্র করিয়া শবদাহ করিতে লাগিল, দূরে প্রজ্জ্বলিত অসংখ্য চিতার অগ্নিশিখায় যুদ্ধভূমি মহাশ্মশানের উদাস-গম্ভীর মূর্তি ধারণ করিল। রাও ছত্রশাল হাড়ার পুত্র ভগবন্ত সিংহ সারাদিন আওরঙ্গজেবের পক্ষে যুদ্ধ করিয়া রাত্রিতে পিতার মুখাগ্নি এবং নিহত হাড়াগণের অগ্নি-সৎকার সমাধা করিলেন—এইভাবে বিজয়ী পক্ষের রাঠোর গৌর কচ্ছবাহ স্ব স্ব কুলের শেষকৃত্য সম্পন্ন করিয়া জ্ঞাতিঋণমুক্ত হইলেন। মৃত শত্রুর শবের উপর জঘন্য প্রতিশোধ লইবার একাধিক বিশদ বিবরণ মধ্যযুগে মুসলমান ও খ্রিস্টানের ইতিহাসে পাওয়া যায় যাহা হিন্দুর পক্ষে কল্পনার অতীত। হিন্দুর জ্ঞাতিবাৎসল্য, স্বজাতি-প্রেম জীবিত অপেক্ষা মৃতের উপরই বেশি প্রকট; * শ্মশানে, পিতৃপক্ষের তর্পণ-স্নানে উদার আর্যসন্তানের মনের দুয়ার আদিকাল হইতেই খোলা ছিল, সম্প্রতি মাত্র বন্ধ হওয়ার উপক্রম হইয়াছে।
[* গোসাঁই ওমরাহগীর ও অনুপগীর নবাব শুজাউদ্দৌলার অধীনে নাগাফৌজ লইয়া পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে আবদালীর পক্ষে লড়াই করিয়াছিলেন। যুদ্ধের পর আবদালীর নিকট হইতে তাঁহারা অন্য অনুগ্রহ প্রত্যাখ্যান করিয়া কেবলমাত্র যুদ্ধস্থলে নিহত মারাঠাগণের শব অগ্নিসাৎ করিবার অনুমতি প্রার্থনা করিয়াছিলেন।]
৫
অতপর আগ্রায় পবিত্র রমজান মাসে পিতাপুত্রের শেষ বুঝাপড়া আরম্ভ হইল; আওরঙ্গজেব রোজা ও কূটনৈতিক মিথ্যার বেসাতি একসঙ্গেই চালাইলেন। চম্বল নদী পার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত চিঠিপত্রে দারার শাঠ্য, তাঁহার একনিষ্ঠ পিতৃভক্তি ও শ্রীচরণচুম্বনের প্রার্থনা ব্যতীত আওরঙ্গজেবের অন্য কোনও মতলব ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ পায় নাই। শাহজাহান এই সমস্ত সরল প্রাণে বিশ্বাস করিয়া আপোস-মীমাংসার আশায় পিছন হইতে যথাসাধ্য দারার রাশ টানিয়া রাখিয়াছিলেন। যুদ্ধের পর ৩০শে মে (১৬৫৮ খ্রিঃ) তিনি পিতার কাছে স্বকৃত কার্যের জন্য ক্ষমা চাহিয়া এক চিঠি লিখিলেন। ইহার উত্তরে ১লা জুন সম্রাট নিজের হাতে একখানা চিঠি লিখিয়া আওরঙ্গজেবকে দুর্গে আসিবার জন্য সাগ্রহ আমন্ত্রণ জানাইলেন এবং সম্রাটের দূত মারফৎ তিনিও সম্মতি জানাইলেন। উহার পরের দিন (২রা জুন) সম্রাট অত্যন্ত আশান্বিত হইয়া প্রধান কাজী সৈয়দ হিদায়েৎ উল্লা এবং বৃদ্ধ ফাজেল খাঁকে তাঁহার “আলমগীর” (ভুবনবিজয়ী) তরবারি এবং অন্যান্য বহুমূল্য রত্ন উপহারসহ পুত্রের কাছে পাঠাইলেন। আওরঙ্গজেব উপহার গ্রহণ করিয়া আলমগিরি মেজাজে কড়া জবাব দিলেন, সম্রাট এখনও দারার পক্ষে কারসাজি করিতেছেন; এই আমন্ত্রণ আমাকে সরাইবার কপট ষড়যন্ত্র ব্যতীত আর কিছুই নয়। আওরঙ্গজেবের এইরূপ মত পরিবর্তনের কারণ সম্রাটের দূতদ্বয় বুঝিতে পারিলেন না।
বকধর্মী শায়েস্তা খাঁ ও খলিলুল্লা খাঁ তখন পর্যন্ত স্ব স্ব পদে বহাল থাকিয়া সম্রাটের নিতান্ত অনুগত শুভচিন্তক ও শান্তির দূত সাজিয়া দু’দিকেই আনাগোনা করিতেছিলেন। ১লা জুন সন্ধ্যাবেলা মাতুল শায়েস্তা খাঁ আসিয়া বলিলেন, “ভাগিনা! সাবধান! ফাঁদে পা দিও না, শাহানশাহর মতলব ভালো নয়।” ভাগিনা মামাকে তিন হাটে বেচিবার বুদ্ধি রাখিতেন, তিনি এই সংবাদে বিস্মিত হইলেন না। পিতার সঙ্গে দেখা করিবার ইচ্ছা তাঁহার আদৌ ছিল না, চিঠিপত্র, মৌখিক কথা শুধু ভাঁওতা মাত্র। যাহা হউক, এই রকম সাক্ষী পাইয়া বাহিরে দশজনের কাছে পিতার দুরভিসন্ধি পাকাপাকি সাব্যস্ত করিবার পক্ষে তাঁহার খুব সুবিধা হইল। পুত্রের এই অভিযোগ শুনিয়া শাহজাহান হতভম্ব হইলেন, কি করিবেন দুই দিন পর্যন্ত স্থির করিতে পারিলেন না, উভয় পক্ষে মনকষাকষি চলিল। শেষবারের মতো পুত্রকে বুঝাইবার জন্য তিনি ৫ই জুন ফাজেল খাঁর সহিত তাঁহার পরমপ্রিয় ভায়রাভাই খলিলুল্লা খাঁকে পাঠাইয়া দিলেন; কারণ খলিলুল্লা দুই পক্ষেরই বিশ্বাসভাজন, মেসোর কথা হয়তো আওরঙ্গজেব অবিশ্বাস করিবে না। ফাজেল খাঁর ধর্মের কাহিনী শাহজাদা কানেই লইলেন না, কিছুক্ষণ পরে খলিলুল্লাকে ভিতরে লইয়া গেলেন। কয়েকটি কথার পর তিনি বাহিরে আসিয়া ফাজেল খাঁকে সরাসরি জবাব দিলেন, বকশী-উল-মুলুক মহামান্য খলিলুল্লা খাঁ আপাতত এইখানেই বন্দী, আপনি ফিরিয়া যাইতে পারেন।
ইহা আগাগোড়া নাটকীয় ব্যাপার; খলিলুল্লার খেলা শাহীমহলে শেষ হইয়াছিল।
৬
ওই রাত্রিতে (৫ই জুন, ১৬৫৮ খ্রিঃ) আওরঙ্গজেবের মুখোশ খুলিল; শত্রুতায় তখন শাহজাহান মুখ্য, দারা গৌণ ইহা তাঁহার নিকট অজানা ছিল না। তিনি সসৈন্যে আগ্রা শহরে প্রবেশ করিয়া দুর্গ অবরোধ করিলেন, সম্রাটও উহার জন্য অপ্রস্তুত ছিলেন না। দুর্গের ফিরিঙ্গি গোলন্দাজ, সম্রাটের দেহরক্ষী বন্দুকধারী পদাতিক এবং পনেরো হাজার হাবসী, রুমী ও জর্জীয় দৃঢ়যোদ্ধা (কসাক) ক্রীতদাসের পল্টন আসদ খাঁর (?) নেতৃত্বে শত্রুপক্ষের আক্রমণ ব্যর্থ করিয়া দিল। কোনও পক্ষের তোপখানা বিশেষ কার্যকরী হইল না, দুর্গপ্রাচীর হইতে তোপ দাগিলে আধা শহর উজাড় হইয়া যায়, দুর্গপ্রাচীরের তিন দিকে অতি নিকটে বড় বড় বাড়ি, তোপের গোলা ওইগুলির আড়ালে লুক্কায়িত শত্রুর কোনও ক্ষতি করিতে পারিল না; অপর পক্ষে দুর্গের উপর গোলা দাগিয়া আওরঙ্গজেবও কোনও সুবিধা করিতে পারিলেন না, কামান বসাইয়া শুধু জুম্মা মসজিদ (বর্তমান Jahanera Mosque) অপবিত্র করিলেন মাত্র, তবে কামানের পাল্লার ভিতর মসজিদ ও পাকাবাড়ি উঠাইবার অনুমতি দেওয়াই বাদশাহী বেকুবি।
যাহা হউক, আওরঙ্গজেবের নৃশংস সামরিক প্রতিভা সম্রাটের আয়োজন ও দুর্গরক্ষীগণের বীরত্ব তিন দিনেই পণ্ড করিয়া দিল। যমুনার উপর ভরসা করিয়া আকবর বাদশাহ দুর্গের পূর্বদিক কিঞ্চিৎ কম মজবুত করিয়াছিলেন। এই দিকেই হঠাৎ আক্রমণ করিয়া আওরঙ্গজেবের ফৌজ খিজরী দরওয়াজার বহির্ভাগ দখল করিয়া বসিল, দুর্গে প্রবেশ অসাধ্য হইলেও যমুনা হইতে দুর্গের পানীয় জল সরবরাহ বন্ধ হইল। দুর্গের ভিতরে যে সমস্ত কুয়া ছিল ওইগুলির নোনতা জল পানীয় হিসাবে কেহ ব্যবহার করিত না, যমুনা হইতে জল আনিবার ব্যবস্থা ছিল। নদীর জলের অভাবে দুর্গবাসীদের জীবন একদিনেই অতিষ্ঠ হইয়া উঠিল। যিনি রাজধানীতে যমুনার জল, সফরে উষ্ট্রবাহিত মটকা-ভরা গড়মুক্তেশ্বরের গঙ্গাম্বু, গ্রীষ্মে হিমাচল হইতে যমুনার স্রোতে ভেলাবাহিত বরফে ঠাণ্ডা করা জল ব্যতীত ত্রিশ বৎসর অন্য জল মুখে দেন নাই তাঁহার কাছে অবস্থার ফেরে কুয়ার দুর্গন্ধ খারা পানি (brackish water) “স্বাদু সুগন্ধি স্বদতে তুষারা” মনে হইল। সম্রাটের দৃঢ়তা পানীয় জলের কষ্টে দুই দিন পরেই টুটিয়া গেল, তিনি পুত্রের কাছে তিতিক্ষা ও তৃষ্ণায় জল ভিক্ষা করিয়া চিঠিতে লিখিলেন-”হিন্দু মরা বাপের জন্য পানি খয়রাত করে। আর মোছলমানের ছাওয়াল তুমি, বুড়াবাপ জিন্দা থাকিতে সাঁঝের বেলা রোজা “এপ্তার” (breaking the day’s fast) করিবার জন্য এক চুমুক মিঠা পানি তোমার কাছে পাইবে না?” পুত্র জবাবে লিখিলেন, “যেমন কর্ম তেমনই ফল। যিনি আপনার আধা বড়ভাই খসরুর গলা টিপিয়া মারিয়াছেন, দাওয়ার বখশ (খসরুর পুত্র) প্রভৃতি সাতাশ জন শাহাজাদাকে কোরবানি করিয়া খুনরেজ (bloody) তক্তে বসিয়াছেন তিনি ধর্মের দোহাই দিয়া পুত্রের নিকট কি প্রত্যাশা করিতে পারেন?”
সন্তানের মুখে সাম্রাজ্যলালসা-দৃপ্ত যৌবনের দুষ্কর্ম ব্যাখ্যা শুনিয়া শাহজাহানের জল ও জীবনের তৃষ্ণা মিটিয়া গেল, তবুও দুর্জয়পণ—প্রাণ থাকিতে পাষণ্ডকে দুর্গে প্রবেশ করিতে দিবেন না। এইদিকে আওরঙ্গজেবও অস্থির হইয়া উঠিলেন; ভাই মোরাদের মতিগতি ভালো নয়, দিল্লিতে দারা আবার মাথাচাড়া দিয়া উঠিতেছে। সুলেমান যে কোনও মুহূর্তে হয়তো পলাইয়া বাপের কাছে পৌঁছিবে; এই দিকে দুর্গে খাদ্যের অভাব নাই, নোনতা জল খাইয়া শাহানশাহর কাবু হওয়ার লক্ষণও বিশেষ দেখা যাইতেছে না; সুতরাং কৌশলে কার্যোদ্ধার ছাড়া উপায় নাই। তিনি সম্রাটকে লিখিলেন, “পূর্বকৃত অপরাধের জন্য আমি হাজির হইয়া ক্ষমাপ্রার্থনা করিবার ইচ্ছা করিয়াছিলাম; কিন্তু অসুখে পড়িয়াছি। আপনার হুকুম পাইলে কুমার মহম্মদ সুলতান কদমবোসী করিবার জন্য দরবারে উপস্থিত হইতে পারে।” পিঁপড়ার পেটকামড়ি সম্রাট ঠিক ধরিয়া ফেলিয়াছিলেন, তবুও মোহ কাটিল না। পুত্রের হয়তো সুমতি হইয়াছে ভাবিয়া সম্রাট শান্তির আশায় উৎফুল্ল হইয়া উঠিলেন, কোনোপ্রকার সন্দেহ না করিয়া কুমার মহম্মদ সুলতানকে শাহী মহলে আসিবার হুকুম দিলেন। আওরঙ্গজেব বিশ্বস্ত ও বেপরোয়া জঙ্গী ফৌজ বাছিয়া বাছিয়া পুত্রের সঙ্গে দেহরক্ষী হিসাবে প্রেরণ করিলেন এবং গোপনে তাহাকে প্রয়োজনীয় উপদেশ দিলেন। বিরাট সমারোহে কুমার দুর্গে অভ্যর্থিত হইলেন, দুর্গরক্ষীগণ যুদ্ধ শেষ হইয়াছে মনে করিয়া অসতর্ক হইয়া পড়িয়াছিল; কেবল শাহীমহলে যথারীতি কড়া পাহারা। দুর্গের শেষ ফটক পার হইয়াই কুমারের দেহরক্ষীগণ ভিতর হইতে প্রাচীররক্ষী সেনাগণকে হঠাৎ আক্রমণ করিল, বাহির হইতে তাঁহার সাহায্যার্থ আরও ফৌজ ঢুকিয়া পড়িল, শাহী মহলে সম্রাট শাহজাহান অবরুদ্ধ হইলেন (৮ই জুন, ১৬৫৮)।
দুই দিন পরে জাহানারা বেগম সন্ধিপ্রার্থিনী হইয়া আওরঙ্গজেবের নিকট উপস্থিত হইলেন। আওরঙ্গজেব প্রথমে পরিষ্কার জবাব দিলেন, “ইসলামের পরম শত্রু দারাকে শেষ না করিয়া সম্রাটের সহিত আমি দেখা করিব না।” পরে সুর কিঞ্চিৎ নরম হইল, জাহানারাকে কথা দিলেন পরদিন তিনি শাহ বুরুজে পিতার পদবন্দনা করিবেন।
৭
জাহানারার সহিত সাক্ষাতের পূর্বে ১০ই জুন আওরঙ্গজেব আগ্রার উপকণ্ঠে মহাধুমধামে প্রকাশ্য দরবারে সিংহাসনে বসিয়া সাম্রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করিয়াছিলেন; পরের দিন রাজধানীতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবেশ করিয়া তিনি পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। শহরে তাঁহার অভ্যর্থনার আয়োজন হইল, সর্বত্র গতানুগতিক লোকারণ্য ও উৎসব। আওরঙ্গজেবের বিরাট সামরিক মিছিল দুর্গ তোরণের দিকে চলিল, মোরাদ ও তাঁহার অনুচরবর্গ কেহই আওরঙ্গজেবের অনুগামী হয় নাই। আওরঙ্গজেব প্রায় ফটকে প্রবেশ করিবেন এমন সময়ে ভিড় ঠেলিয়া সেনাধ্যক্ষ শেখ মীর ও শায়েস্তা খাঁ জরুরি সংবাদ লইয়া আসিলেন — ভীষণ ষড়যন্ত্র। শায়েস্তা খাঁর মুখে শুনা গেল শাহবুরুজে প্রবেশ করিবার সময় তাঁহাকে হত্যা করিবার জন্য অতি হিংস্র বলিষ্ঠা তাতার ক্রীতদাসীগণ সম্রাট কর্তৃক গুপ্তস্থানে স্থাপিত হইয়াছে। আওরঙ্গজেব আর অগ্রসর হইলেন না; ওইখানেই প্ৰায় একই সময়ে শাহী অন্দরমহলের নাহর দিল নামক খোজা সম্রাটের এক গুপ্ত লিপি দারার নিকট পৌঁছাইবার জন্য বাহিরে যাইতেছিল, সামনে আওরঙ্গজেবকে দেখিয়া যে-কোনও কারণে সে ওই চিঠি তাঁহার হাতেই দিল, চিঠি পড়িয়াই আওরঙ্গজেবের চক্ষু স্থির। উহাতে নাকি লেখা ছিল—
‘দারাশুকো! তুমি দিল্লিতেই কদম জমাইয়া থাক; ওইখানে টাকা ও সিপাহীর অভাব নাই। সাবধান! ওই স্থান ছাড়িয়া এক পা-ও দূরে যাইও না; আমি স্বয়ং এই জায়গার মামলা খতম করিব।’
সকলেই বুঝিল মতিচ্ছন্ন সম্রাট দারার নিমিত্ত আওরঙ্গজেবকেই খতম করিবার জন্য বসিয়া আছেন। আওরঙ্গজেবের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ সিদ্ধ হইল; তিনি পিতাকে কড়াকড়ি জেলে পুরিবার যে অজুহাত খুঁজিতেছিলেন উহাই নাটকীয়ভাবে প্রকাশ্য সদর রাস্তায় তাঁহাকেই খুঁজিয়া লইল, অধিকন্তু ভগ্নী জাহানারার কাছে পূর্বসন্ধ্যায় যে অঙ্গীকার করিয়াছিলেন উহার মর্যাদাও রক্ষা করা হইল।
শাহজাহানের পক্ষে কোনও ওকালতনামা না লইয়াও বলা যাইতে পারে ওই ধরনের চিঠি এবং রাশি রাশি টাকা আগ্রা দুর্গ হইতে দিল্লি পৌঁছিয়াছিল—এই বিষয়ে সন্দেহ নাই; কিন্তু নহর দিল বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া যে চিঠি আওরঙ্গজেবের কাছে সন্দেহজনক পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে উপস্থিত করিয়াছিল, সে চিঠির সঙ্গে শাহজাহানের কোনও সম্বন্ধ ছিল কিনা বলা যায় না। ওই চিঠি আসল কি জাল উহা একমাত্র আওরঙ্গজেব এবং তাঁহার দরবারী স্তাবকগই জানিতেন। যে বাজারে আওরঙ্গজেব বড় বড় আমীর রাজা মহারাজাকে কিনিয়া লইয়াছিলেন সে বাজারে একটি ক্রীতদাসের সততা ও প্রভুভক্তি অতি সামান্য জিনিস; তাহার মতো একটা পুলিশি “রাজসাক্ষী” হাজির করার মতো আওরঙ্গজেবের হিতৈষী ১০ই জুন তারিখে আগ্রা দুর্গে অনেক ছিল। ইহাও সত্য, ভারতবর্ষের ইতিহাসে আওরঙ্গজেব সর্বপ্রথম রাজনৈতিক ব্যাপারে প্রচারকার্যের কদর বুঝিয়াছিলেন।
৮
এক খাসীকৃত বাঙালি মুসলমানকে “এতেবার খাঁ” উপাধির দ্বারা সম্মানিত করিয়া আওরঙ্গজেব আগ্রা দুর্গে বৃদ্ধ শাহজাহানের প্রহরী নিযুক্ত করিলেন। এতদিন তিনি দারা ও সুলেমান শুকোর বিরুদ্ধে কোনও সেনা পাঠাইতে পারেন নাই, চিঠিপত্র লিখিয়া রাজা জয়সিংহ ও দেলের খাঁকে হাত করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন। ১৩ই জুন আগ্রায় একদল সৈন্য মোতায়েন রাখিয়া অবশিষ্ট ফৌজসহ আওরঙ্গজেব দিল্লির দিকে অগ্রসর হইলেন—ম্যানুসী সাহেবও ছোকরা দরবেশ সাজিয়া দারার কাছে পৌঁছবার জন্য সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন। ৫০/৬০ মাইল দূরে মথুরা পৌঁছিতে আওরঙ্গজেবের দশ দিন লাগিয়া গেল। ইহার কারণ সামনে দারা অপেক্ষা পিছনে মোরাদই তাঁহার পক্ষে তখন অধিক বিপজ্জনক হইয়া উঠিয়াছিলেন।
সামুগঢ়ের ঘা শুকাইবার সঙ্গে সঙ্গে ভাই মোরাদের উপর আওরঙ্গজেবের দরদ কমিতে কমিতে দারুণ বিদ্বেষ ও দুশ্চিন্তায় পরিণত হইয়াছিল। মোরাদের উচ্ছৃঙ্খল সেনাদল আগ্রা শহরে লুঠতরাজ আরম্ভ করিয়াছিল। এইজন্য আওরঙ্গজেব রাজধানী রক্ষার ভার কুমার মহম্মদ সুলতানকে দিয়াছিলেন এবং পরে সম্রাটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বনে মোরাদের সঙ্গে কোনও পরামর্শ করেন নাই। মোরাদকে সিংহাসনে বসাইবার জন্য আগ্রা পর্যন্ত আনিয়া ১১ই জুন তিনিই মহাসমারোহে তক্তে বসিয়া পড়িলেন। ভাইদের মধ্যে সর্বপ্রথম মোরাদ আহমেদাবাদে সিংহাসনে আরোহণ ও রাজছত্র ধারণ করিয়াছিলেন, পরে আওরঙ্গজেবের কথা শুনিয়া ওই ছাতা গুটাইয়া বাক্সবন্দী করিয়াছিলেন এবং শাহীতক্ত উটের উপর চাপাইয়া ভবিষ্যতের আশায় আগ্রা পর্যন্ত আনিয়াছিলেন। মোরাদের মোসাহেবগণ সুযোগ পাইয়া আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে তাঁহাকে উস্কানি দিতে লাগিল, কিন্তু দাদার কথা শুনিলেই তিনি গলিয়া যাইতেন। আওরঙ্গজেব বোধ হয় তাঁহাকে বুঝাইয়াছিলেন যে, তিনি কেবল শাসনব্যবস্থা দৃঢ় করিবার জন্য দরবার-ই-আম ডাকিয়াছিলেন, ১১ই জুনের ব্যাপারটা কিছুই নহে; আসল দার-উল্-খেলা-কত্ হইল দিল্লি; দারাকে তাড়াইয়া ওইখানেই তিনি তাঁহাকে তক্তে বসাইয়া তবে বিদায় লইবেন। দোটানা স্রোতে পড়িয়া মোরাদ দারার কাছে যাওয়াই বন্ধ করিলেন, নূতন সৈন্য সংগ্রহ করিয়া নিজের সেনাবল দ্বিগুণ করিলেন; আওরঙ্গজেব টের পাইলেন কথায় চিঁড়া আর ভিজিবে না।
আওরঙ্গজেব পিতার যে দুর্দশা করিয়াছেন সুযোগ পাইলে তাঁহারও ওই দশা করিতে ইতস্তত করিবেন না—এই আশঙ্কা মোরাদের মনে ক্রমে বদ্ধমূল হইল। তাঁহার রণদুর্মদ বিশহাজার অশ্বারোহী আওরঙ্গজেবের সহিত বল পরীক্ষার জন্য উৎসুক, পরামর্শদাতারা বুঝাইলেন সিধা আঙুলে ঘি উঠিবার নয়। ১৩ই জুন আওরঙ্গজেবের দিল্লি যাত্রার সময় মোরাদ অছিলা করিয়া আগ্রাতেই থাকিয়া গেলেন, আওরঙ্গজেবের দুর্ভাবনা চরমে উঠিল। এক দিন পরে মোরাদের ভাবনা হইল দাদা যদি একাই দিল্লি দখল করিয়া ওইখানেও তত্ত্বে বসিয়া পড়েন তাহা হইলে উপায় কি? তিনিও সমস্ত ফৌজ লইয়া মথুরার দিকে চলিলেন, কিন্তু দুই ভাইয়ের ফৌজের মধ্যে বরাবর এক মঞ্জিল ব্যবধান। আগ্রা হইতে দুই মঞ্জিল কুচ করিবার পর আওরঙ্গজেব মোরাদকে সৈন্যগণের ব্যয় নির্বাহের জন্য নগদ বিশ লাখ টাকা পাঠাইলেন এবং পরে লুঠের এক-তৃতীয়াংশ দেওয়া হইবে বলিয়া জানাইলেন। ২৩শে জুন আওরঙ্গজেব মথুরা পৌঁছিলেন, মোরাদের তাঁবু পড়িল শহরের বাহিরে। মোরাদের আরোগ্যলাভ উপলক্ষে ভোজের আয়োজন করিয়া আওরঙ্গজেব ভাইকে দুই দিন নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইলেন, কিন্তু মোরাদ আসিলেন না। ইতিমধ্যে আওরঙ্গজেব মোরাদের বিশ্বস্ত খাবাস (গোলাম) নূরউদ্দীন এবং আরও কয়েক জনকে নানা প্রলোভন দেখাইয়া হাত করিয়াছিলেন। ২৫শে তারিখ সন্ধ্যেবেলা শিকার হইতে ফিরিবার সময় নূরউদ্দীন কৌশল করিয়া আওরঙ্গজেবের শিবিরে মোরাদকে লইয়া আসিল। আওরঙ্গজেব আহ্লাদে আটখানা হইয়া এক সর্বজনীন ভোজের আয়োজন করিলেন এবং তাঁহার সেনাধ্যক্ষগণ প্রত্যেকেই সমপদস্থ মোরাদের এক এক অফিসারকে নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইলেন। সেই রাত্রিতে আওরঙ্গজেবের শিবির নাচ-গান ও শরাবে মশগুল, কেহ ফিরিবার গরজ দেখাইবার ফাঁকও পাইল না।
এই দিকে নিজ তাঁবুতে দস্তার-খানে বসিয়া আওরঙ্গজেব পরম স্নেহে মোরাদকে ‘এটা খাও, সেটা খাও’ বলিয়া আপ্যায়িত করিতেছিলেন। খানার পরে সেরা শিরাজী আসিল, মোরাদ তকল্লুক (সৌজন্যসূচক সঙ্কোচ) করিয়া মাথা নিচু করিয়া ভাবিলেন, “হজরতজী”-র দস্তার-খানে হারাম? মোরাদের সঙ্কোচ কাটাইবার জন্য আওরঙ্গজেব বলিলেন, এতে আর দোষ কি? মেহেনতের পর জঙ্গী জোয়ানের এটা না হইলে চলে না। এই বলিয়া তিনি নিজ হাতে পেয়ালা তুলিয়া ভাইকে দিলেন; অগত্যা মোরাদ সেলাম ঠুকিয়া পরম কৃতজ্ঞতাভরে দাদার দত্ত-মোবারক হইতে মহব্বতের পিয়ালা লইয়া এক চুমুকে নিঃশেষ করিলেন, আগুনে ঘৃতাহুতি পড়িল। শরাবির পেটে এক পেয়ালা গেলেই ‘আবার খাবো” অবস্থাটুকু অন্তত আওরঙ্গজেবের অজানা ছিল না। তিনি পেয়ালার পর পেয়ালা ভরিয়া দিতে লাগিলেন। প্রথম যৌবনে একবার তিনি প্রেমের তুফানে নর্তকী হীরাবাঈয়ের আবদারে এক পেয়ালা মুখের কাছে তুলিয়াছিলেন বটে, কিন্তু চটুলা প্রেয়সী হাত চাপিয়া ধরিয়া সেইবার তাঁহার ইমান বাঁচাইয়াছিল। এইবার মনে মনে খোদাতালার কাছে গুনাহগারি মাফ চাহিয়া তিনি গোঁয়ার মোরাদের নাচার সাকী সাজিলেন, কি করিবেন? দুনিয়াদারির জরুরত বড় পাজি!
ভরা পেটে আকণ্ঠ পান করিয়া মোরাদের যখন হাই তুলিয়া দস্তার খানের উপর ঢলিয়া পড়িবার অবস্থা, তখন আওরঙ্গজেব পাশের কামরায় মোরাদকে একটু ঘুমাইয়া লইতে অনুরোধ করিলেন এবং বলিয়া দিলেন পরে দারার বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার শলা-পরমার্শ হইবে। মোরাদের গায়ে তখনও শিকারের পোশাক, কোমরে তলোয়ার খঞ্জর (dagger) বাঁধা। ওইগুলি বালিশের নীচে রাখিয়া তিনি বিছানার উপর লম্বা হইয়া পড়িলেন, প্রহরীস্বরূপ বিশ্বস্ত খাবাস বশরত জাগিয়া রহিল এবং প্রভুর হাত-পা টিপিতে লাগিল। মোরাদের যখন একটু তন্দ্রার ভাব তখন এক সুন্দরী ক্রীতদাসী শাহজাদার সেবার জন্য শয়নকক্ষে প্রবেশ করিল, বশরত কায়দামাফিক মাথা নীচু করিয়া নিঃশব্দে বাহিরে আসিল। বাহিরে পা দেওয়া মাত্র কয়েকজন যণ্ডাকৃতি লোক চিলের মতো ছোঁ মারিয়া শ্বাসরুদ্ধ বশতকে ভবপারে লইয়া গেল। ভিতরে সুন্দরীর কোমল অঙ্গসংবাহনে মোরাদের ঘুম দারুন গম্ভীর হইতে লাগিল, সময় বুঝিয়া মায়াবিনী ত্বরিত পদক্ষেপে অন্তর্হিতা হইল।
মুহূর্তমধ্যে আওরঙ্গজেবের ক্ষিপ্রকর্মা সেনানী শেখ মীর দশ-বারোজন সশস্ত্র ঘাতকসহ ঘরে ঢুকিয়া মোরাদকে ঘিরিয়া ফেলিল, তবুও তাঁহার ঘুম ভাঙিল না, অবশেষে তলোয়ারের ঝনঝনানি হাতকড়ি-পা-বেড়ির টকটকানি শুইয়া মোরাদ জাগিয়া উঠিলেন, বালিশ হাতড়াইয়া দেখিলেন অস্ত্র নাই।
শত্রুগণের উপর তীব্র ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া সিংহবিক্রান্ত মোরাদ স্থিরভাবে বন্ধনদশা স্বীকার করিলেন। বাহিরে তাঁহার পানোন্মত্ত সেনাধ্যক্ষগণও অনুরূপ অতিথিসৎকার লাভ করিলেন। ভোরের দিকে সুরক্ষিত হাওদাবাহী এক-একটা হাতি পাঁচ শত অশ্বারোহী পরিবেষ্টিত হইয়া শিবিরের উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিম দিকে অজ্ঞাতস্থান অভিমুখে যাত্রা করিল। নায়কশূন্য মোরাদের বিশ হাজার অশ্বারোহীর অর্ধাংশ ছত্রভঙ্গ হইয়া গেল, অর্ধেক আওরঙ্গজেবের চাকরি গ্রহণ করিল।