অষ্টম অধ্যায় – দারাশুকোর কান্দাহার দুর্গ আক্রমণ ও পরাজয়
কান্দাহার দুর্গের অবরোধকার্যে শাহজাদা তাঁহার মীর আতিশ জাফরের প্রতি প্রথম হইতে নানা রকমে পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করিতেছিলেন। অন্যান্য সৈন্যাধ্যক্ষগণ ইহাতে জাফরের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ ও শাহজাদার প্রতি বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। শের হাজী বুরুজের সম্মুখের পরিখা হইতে জল বাহির করিয়া উহার উপর দিয়া আক্রমণের রাস্তা প্রস্তুত এবং বড় বড় কামান হইতে গোলা দাগিয়া বুরুজের দেওয়াল ভাঙিবার জন্য কাসিম খাঁ, আবদুল্লা, ইজ্জৎ খাঁ এবং জাফর যথাসাধ্য পরিশ্রম করিতে লাগিল। কিন্তু ইহাদের মধ্যে মনের মিল বা সহযোগিতার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল না। শেষোক্ত তিনজন দারার নিজ তাবিনের মনসবদার। শাহজাদার প্রিয়পাত্র হওয়ার জন্য তাহারা একজন আর একজনের বিরুদ্ধে আড়ালে নিন্দা করিতে লাগিল। অবশেষে ইহাদের ঝগড়া চরমে উঠিল। একদিন ইজ্জৎ খাঁ প্রকাশ্যে শাহজাদাকে বলিয়া ফেলিল — বান্দা- পরোবর। জাফরের মতো পাজিদের উপর ভরসা করিলে ও অতিরিক্ত মেহেরবানি দেখাইলে কাজটাই পণ্ড হইবে। আবদুল্লা ও জাফর পাশাপাশি মোর্চা হইতে সুড়ঙ্গ কাটিয়া দুর্গ-পরিখার দিকে অগ্রসর হইতেছিল। আবদুল্লা জাফরকে অনুরোধ জানাইল, যে পর্যন্ত তাহার নিজের সুড়ঙ্গ জাফরের সুড়ঙ্গের বরাবর এক লাইনে না পৌঁছে, সে পর্যন্ত জাফর যেন কাজ স্থগিত রাখে। জাফর সরল বিশ্বাসে তদনুযায়ী কাজ বন্ধ রাখিল। চার দিন পরে আবদুল্লা চুপি চুপি জাফরের সুড়ঙ্গের চেয়ে আরও বেশি অগ্রসর হইয়া শাহজাদাকে জানাইল, “হুজুর! খন্দকের কাজে আমি জাফরের চেয়ে কয়েক কদম আগেই আছি!” একথা জাফরের কানে পৌঁছামাত্র সে ক্রোধে দিশাহারা হইয়া দরবারে আবদুল্লার সাতপুরুষের বাপাত্ত করিল, “গরিব নেবাজ আমি তুরানী; পেঁচপ্যাঁচ আমরা বুঝি না। আবদুল্লা হারামজাদা রাফিজী — বেইমান শিয়া ইরানী, হাড়ে হাড়ে বজ্জাত; সে আমাকে ফাঁকি দিয়া বাহাদুরি নিতে চায়, যাহার সঙ্গে পাশাপাশি নমাজ করিলে নমাজ কবুল হয় না, তাহার সঙ্গে আমি কাজ করিব না।” স্বয়ং শাহজাদা অনেক মিষ্ট কথা বলিয়াও জাফরকে শান্ত করিতে পারিলেন না।
যাহা হউক, আগস্ট মাসের মাঝামাঝি শের হাজী বুরুজ মোটামুটি আক্রমণের যোগ্য বলিয়া মনে হইল। পরিখার জল কিছু বাহির করিয়া গাছের ডালপালা ও মাটির বস্তা ফেলিয়া উহা ভরাট করা হইয়াছিল। ৬ই আগস্ট মরিয়ম, কিলাকুশা ও কয়েক দিন পরে ফতে-মোবারক তোপ শিবিরে আসিয়া পৌঁছিল। কিন্তু ভারী লোহার গোলা সঙ্গে না থাকায় ওইগুলি কোনও কাজেই আসিল না, কিলাকুশা হইতে নিক্ষিপ্ত নরম পাথরের গোলা হাওয়াতেই ফাটিয়া নিজ পক্ষের লোকগুলি জখম করিল। পাথরের গোলা শনের দড়ি দিয়া মুড়িয়া পরীক্ষা করা হইল— ফলাফল সহজেই অনুমেয়। ফিরিঙ্গি গোলন্দাজদের কয়েকজন শত্রুদুর্গে পলাইয়াছিল; বাকি কয়েকজন ছিল হিন্দুস্থানীদের মতোই ওস্তাদ। সর্বসুদ্ধ ২৭০০০ গোলা দাগিয়াও মোগল তোপখানা দুর্গ-প্রাচীরের বিশেষ ক্ষতি করিতে পারে নাই; ইরানী তোপ সমান জোরে জবাব দিতে লাগিল। কিন্তু দরবারী রিপোর্টে লেখা হইল শাহজাদার তোপখানা শের হাজী বুরুজের তিনশত গজ দেওয়াল ধূলিসাৎ করিয়াছে। জাফর ও ইজ্জৎ খাঁ শাহজাদাকে জানাইল তাহাদের মোর্চার সামনের দেওয়াল তোপের গোলায় ভাঙিয়া পড়িয়াছে; এখন দুর্গ আক্রমণ করা যাইতে পারে।
আগস্ট মাসের ২১শে তারিখে শাহজাদা দুর্গ আক্রমণের উদ্যোগ আরম্ভ করিলেন। সরকারি সিলাহ-খানা (অস্ত্রাগার) হইতে লৌহনির্মিত বখ্তর, জিরাহ ইত্যাদি নানা রকমের বর্ম অশ্বারোহী সৈন্যদের ব্যবহারের জন্য বিতরণ করা হইল। আক্রমণের সময় কোন্ কোন্ মনসবদার কোন্ মোর্চা হইতে সৈন্য পরিচালনা করিবেন শাহজাদা কাহারও সহিত পরামর্শ না করিয়া নিজেই তাহা ঠিকঠাক করিয়া ফেলিলেন। ঢোল সহরতে ডেরায় ডেরায় জানাইয়া দেওয়া হইল দুই-এক দিনের মধ্যেই দুর্গ আক্রমণ করা হইবে। যাহারা সিপাহী নয় এবং হামলায় শরিক হওয়ার হিম্মৎ যাহাদের নাই তাহারাও ঠিক সেই সময়ে নমাজ দোওয়া পড়িবার জন্য যেন তৈয়ার থাকে। শাহজাদা সিপাহীদিগকে উৎসাহিত করিবার জন্য মোটা নগদ পুরস্কার ঘোষণা করিলেন – প্রত্যেক লাল টুপিওয়ালা কিজিলবাশ সিপাহীর কাটা মাথার দাম ৫ এবং জীবন্ত ধরিয়া আনিতে পারিলে এক আশরফি ইনাম।
সমস্ত বন্দোবস্ত নিজের বুদ্ধিতে একরকম পাকাপাকি করিয়া শাহজাদা পরদিনই সকালবেলা (২২শে আগস্ট) সলাহপরামর্শ করিবার জন্য মনসবদারগণকে নিজ তাঁবুতে উপস্থিত হইবার জন্য আদেশ করিলেন। মহাবত খাঁ (ছোট), মির্জারাজা অম্বরপতি জয়সিংহ এবং নেজাবত খাঁ যথাসময়ে হাজির হইলেন। ইঁহারা সকলেই পাঁচ হাজারী। কিলিচ খাঁ খবর দিলেন তিনি জোলাপ লইয়াছেন, বিকালবেলা আসিবেন। যাঁহারা আসিয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে পাঁচ হাজারীদের মুখ নিতান্ত গম্ভীর, দরবারী কায়দায় হাসি ও সৌজন্যের অন্তরালে অন্তরুদ্ধ রোষবহ্নি যেন ধূমায়মান। শাহজাদা প্রথমে মহাবত খাঁর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “জাফর ও ইজ্জৎ খাঁর মোর্চার বিপরীত দিকস্থ দেওয়াল জায়গায় জায়গায় ভাঙিয়াছে; আক্রমণ করা সম্বন্ধে আপনার মত কি?” এই মহাবত খাঁ সেই মহাবৎ খাঁর পুত্র––যিনি অত্যন্ত রাজভক্ত হইয়াও জাহাঙ্গীরের মুখের উপর নূরজাহান সম্বন্ধে যা-তা বলিবার সাহস রাখিতেন এবং অবশেষে জাহাঙ্গীরকে কিছুকালের জন্য নজরবন্দী করিয়াছিলেন। বাপের মতো ছেলের মুখের আড় ছিল না, ইনি পরবর্তীকালে বাদশাহ আওরঙ্গজেবের উপর মোল্লাদের মুরুব্বিয়ানাকে ইঙ্গিত করিয়া বলিয়াছিলেন, “জাঁহাপনা, কাফের শিবাকে শায়েস্তা করিবার জন্য আমাদের মতো গোলামের প্রয়োজন কি? শেখ-উল-ইসলাম সাহেব (আব্দুল ওহাব) নর্মদা পার হইয়া এক ফতোয়া জারি করিলেই কাজ হাসিল হইবে!” মহাবত খাঁ শাহজাদাকে কিছুমাত্র সমীহ না করিয়া জবাব দিলেন, “আমরা হুজুরের গোলাম; হুকুম তামিল করা ব্যতীত বান্দার আর কোনও কাজ নাই। রাজা-বাদশারাই কেবল বাদশাহকে পরামর্শ দিতে পারে।” শাহজাদা মহাবত খাঁকে বলিলেন, “আপনি দৌলতাবাদ দুর্গ বিজয়ী বীরশ্রেষ্ঠ মহাবত খাঁর পুত্র, আপনি কান্দাহার জয় করিয়া পিতার সুনাম রক্ষা করুন।” কিন্তু তোষামোদও বিফল হওয়াতে দারার ধৈর্যচ্যুতি হইল। দু-চার কথার পর তিনি উত্তেজিত ভাবে বলিয়া উঠিলেন, “কান্দাহার দখল না করিয়াই আপনি বাড়ি ফিরিবার ফিকিরে আছেন দেখিতেছি। এ-রকম বেহুদা খেয়াল ও বদ মতলবকে মনে জায়গা না দেওয়াই ভালো (বেহ্তর্)।”
ইহার পরে দারা দুর্গ আক্রমণ করা সমীচীন কিনা এ-বিষয়ে নেজাবত খাঁর মতামত জিজ্ঞাসা করিলেন। ইরানীয় রাজবংশের রক্ত ও আভিজাত্য-গৌরব নেজাবত খাঁর চরিত্র ও কার্যে তাহার বৃথা অহঙ্কার, অনুচিত ঔদ্ধত্য এবং দুঃসাহসিকতায় প্রকাশ পাইত। কান্দাহার-অভিযানের পূর্বে তিনি একবার কুমায়ুন গাড়োয়ালের নাক-কাটি রানীর রাজ্য আক্রমণ করিয়া চরম দুর্গতি ভোগ করিয়াছিলেন; তবে নাকটা কোনও রকমে রক্ষা পাইয়াছিল। কান্দাহারে আসিয়া নেজাবত খাঁ প্রথম হইতেই অবাধ্যতা প্রকাশ করিতেছিলেন; আবদোজদ দরজার সামনে তাঁহার নির্দিষ্ট স্থানে যাইতে অস্বীকৃত হওয়ায় শাহজাদা শাস্তিস্বরূপ তাঁহাকে রুস্তম খাঁ বাহাদুর ফিরোজ-জঙ্গের সৈন্যের সহিত বুস্ত দুর্গে যাইবার আদেশ দিলেন। এই আদেশও প্রথমে অমান্য করিয়া পরে অন্যান্য আমীরদের অনুরোধে তিনি সেখানে গিয়াছিলেন; পরে শাহজাদার সঙ্গে মিটমাট হওয়ায় কান্দাহারে আসিয়াছিলেন। এবার তাঁহার সুর কিছু নরম হইয়াছিল। তিনি নিবেদন করিলেন— আক্রমণ করার পূর্বে আরও তিন-চার দিন গোলাবর্ষণ করিয়া দুর্গের প্রাচীরের জমিন বরাবর করিলেই ভালো হয়। দারা ইহাতে বিষম চটিয়া গেলেন। তিনি বলিয়া উঠলেন, “তাহা হইলে আপনি বলিতে চান কেল্লার পর্দা এখনও ভাঙা হয় নাই? দেওয়াল ফুটা হউক আর নাই হউক আক্রমণ করিতেই হইবে।”
অতঃপর কচ্ছবাহ্-পতি মির্জা-রাজা জয়সিংহের পালা আসিল। জয়সিংহ নাবালক বয়স হইতে যুদ্ধ করিয়া চুল পাকাইয়াছিলেন। সাহস, বুদ্ধিমত্তা ও যুদ্ধকৌশলে তাঁহার সমকক্ষ সেনাপতি সেকালে ছিল না। পরবর্তীকালে সুচতুর সম্রাট আওরঙ্গজেব ইহাকেই ব্রহ্মাস্ত্র-স্বরূপ ব্যবহার করিয়া অদম্য শত্রু শিবাজীকে দমন করিয়াছিলেন। মানুচী লিখিয়া গিয়াছেন, শাহজাদা দারা নাকি একদিন ঠাট্টা করিয়া বলিয়াছিলেন, রাজা সাহেবকে একজন নাটুয়ার (musician) মতো দেখায়। জয়সিংহ পাতলা গড়নের লোক ছিলেন, তাঁহার লম্বাচওড়া শরীর, মুখে ভয়সঞ্চারী দাড়ি কিংবা গালপাট্টা ছিল না। সেকালের রাজপুতদের মতো তিনি দাড়ি কামাইতেন, কানে কুণ্ডল, হাতে বাজুবন্ধ ও গলায় মুক্তার মালা পরিতেন। হয়তো শাহজাদা রসিকতা করিয়া এ-কথা বলিয়া থাকিবেন। কিন্তু তাঁহার প্রতি দারার কোনও আক্রোশ ছিল না। সমসাময়িক চিঠিপত্রে দেখা যায় তিনি মির্জা রাজাকে যথেষ্ট খাতির তোয়াজ করিতেন। বালক সুলেমান শুকোর বাক্যস্ফূর্তি হওয়ার পূর্বেই একটি চিঠিতে তিনি রাজাকে লিখিয়াছিলেন, সুলেমান শুকো আপনাকে সেলাম জানাইতেছে। কিন্তু জয়সিংহ কথায় ভিজিবার পাত্র ছিলেন না। রাজপুতসুলভ সরলতা, ঔদার্য এবং ভাবের উচ্ছ্বাস জয়সিংহের চরিত্রে ছিল না। কথায় ও কাজে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাবধানী, ভিতরে টগবগ করিলেও বাহিরে একেবারে ঠাণ্ডা বরফ, তাঁহার হাতে সাপ মরিলেও লাঠি ভাঙিত না।
রাজা জয়সিংহ আওরঙ্গজেবের নেতৃত্বে ইতিপূর্বে দুইবার কান্দাহার আক্রমণ করিতে আসিয়াছিলেন। এবার শাহজাদা দারার ভাব দেখিয়া অভিযানের ফলাফল সম্বন্ধে তাঁহার সন্দেহই রহিল না। জাফর প্রভৃতির দাপট ও বাহ্বাস্ফোটে অন্যান্য প্রবীণ পাঁচ হাজারীগণের ন্যায় তিনিও নিজেকে অবজ্ঞাত ও অপমানিত বোধ করিতেছিলেন। শুনা গিয়াছিল, একবার কান্দাহারের দুর্গাধ্যক্ষ জুলফিকর খাঁ বলিয়া পাঠাইয়াছিলেন যদি রাজা জয়সিংহ, মহাবত খাঁ ও কিলিচ খাঁ কথা দেন তাহা হইলে তিনি আত্মসমর্পণ করিতে পারেন। ইহাতে নাকি বিরক্ত হইয়া শাহজাদা বলিয়াছিলেন—জুলফিকর যদি আসিতে চায় জাফর ও ইজ্জৎ খাঁর প্রতিজ্ঞার উপর নির্ভর করিয়া সে আসিতে পারে, তাহাদের কৌল ও জবান আমার প্রতিশ্রুতির সমান। ব্যাপারটা আদৌ সত্য না হইলেও নিশ্চয় পাঁচ-হাজারী মনসবদারগণ এই জনরবকে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার মতো মনে করিয়াছিলেন।
দারার সহিত কান্দাহারে আসিয়া মির্জা-রাজা জয়সিংহ অবরোধকার্যে বিশেষ উৎসাহ প্রদর্শন করেন নাই। তাঁহার মোর্চায় কাজ আশানুরূপ অগ্রসর না হওয়ায় তাগিদ দিবার জন্য শাহজাদা তাঁহার কাছে লোক পাঠাইয়াছিলেন। তিনি জবাব দিলেন, “আমরা রাজপুত। গর্ত খোঁড়া ও কেল্লা ঘের দেওয়া আমাদের কাজ নয়, বরং অন্য কাহাকে ইচ্ছা করিলে শাহজাদা এই মোর্চা সোপর্দ করিতে পারেন (২৮মে ১৬৫৩)।” ইহার পর একদিন রাজার অতি নিকটেই একটি ইরানী তোপের গোলা ফাটিয়াছিল, তিনি অল্পের জন্য রক্ষা পাইলেন। দুর্দৈব নিবারণার্থ মির্জা-রাজা সেখানে এক হাজার ব্রাহ্মণ ভোজন করাইয়াছিলেন। ৩০শে জুলাই শাহজাদা মির্জা-রাজাকে ডাকাইয়া দুর্গ আক্রমণ করিবার জন্য অনেক অনুরোধ করিয়াছিলেন। তিনি ইহাতে কোনও আগ্রহ প্রকাশ না করিয়া গা বাঁচানো গাছের কথা বলিয়া ফিরিয়া আসিয়াছিলেন। এবার শাহজাদা মির্জা-রাজার দিকে ফিরিয়া সোজাসুজি বলিলেন, “রাজাজীউ! কান্দাহারে আপনার মেহনত ও কোশিশ আশানুরূপ দেখা যায় নাই। এখন কোনও অজুহাত শুনা হইবে না। এই তিন বারের বার যদি কান্দাহার দখল না করিয়া ফিরিয়া যান, তবে কেমন করিয়া হিন্দুস্থানের জানানার কাছে মুখ দেখাইবেন? মরদ হইয়াও যাঁহারা বার-বার অকৃতকার্য হইয়া এখান হইতে ফিরিয়াছে তাহারা সত্যই আওরতের চেয়েও না-মরদ!” এবার মির্জা-রাজার মতো ঠাণ্ডা মেজাজের লোকও গরম হইয়া উঠিলেন। তাঁহার সহিত শাহজাদার অনেক কথা-কাটাকাটি হইল। শাহজাদা ক্রোধে অস্থির হইয়া রাজাকে বলিলেন, “দুর্গ আক্রমণে আপনার সম্মতি থাকুক আর নাই থাকুক, আমি আপনাকে আদেশ করিতেছি কেল্লা চড়াও করিতেই হইবে; আপনি মারা যান কি দুর্গ দখল করেন উহাতে কিছু আসে যায় না।” এই বলিয়া শাহজাদা গম্ভীরভাবে সুরা ফাতেহা পাঠ করিয়া দরবার বরখাস্ত করিলেন। উপস্থিত মনসবদারদের মধ্যে জাফর, ইজ্জৎ খাঁ ও রাজা রাজরূপ এই তিনজনই দুর্গ আক্রমণের স্বপক্ষে মত দিয়াছিল। বেচারা বৃদ্ধ কিলিচ খাঁ বৈকালে শাহজাদার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে আসিলেন। তিনি আসন গ্রহণ করিবার পূর্বেই শাহজাদা বলিলেন, “দুর্গ আক্রমণ করাই স্থির; আপনি ফাতেহা পাঠ করিয়া চলিয়া যাইতে পারেন।”
২৩শে আগস্ট সমস্ত রাত্রি মোগলবাহিনী আক্রমণের জন্য সুসজ্জিত হইয়া জাগিয়া রহিল। শাহজাদা দারা স্বয়ং বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করিয়া সৈন্যাধ্যক্ষগণ নিজ নিজ নির্দিষ্ট স্থানে প্রস্তুত আছে কিনা দেখিলেন। রাত্রি তিন ঘড়ি অবশিষ্ট থাকিতে সৈন্যদল দুই দিক হইতে যুগপৎ দুর্গ আক্রমণ করিল। ইজ্জৎ খাঁর মোর্চা হইতে জাহাঙ্গীরবেগ একহাজার অশ্বারোহী এবং দুইটি জঙ্গী হাতিসহ দেওয়ালের ভাঙা অংশের দিকে অগ্রসর হইল। প্রথমে মনে হইল ইরানীরা এ স্থান অরক্ষিত রাখিয়া চলিয়া গিয়াছে; কিন্তু অতি নিকটে পৌঁছামাত্র হঠাৎ ভীষণভাবে তিন দিক হইতে তাহাদের উপর গোলাগুলি ও তীরবর্ষণ আরম্ভ হওয়ায় তাহারা স্থির থাকিতে পারিল না। ইজ্জৎ খাঁ নাকি এ সময়ে নিজের তাঁবুতে জামা খুলিয়া গায়ে গোলাপ জল ছিটাইতেছিল। জাফরের মোর্চা হইতে কাসিম খাঁ, কিলিচ খাঁ এবং মির্জা আবদুল্লা অসম সাহসে দুর্গের সম্মুখস্থ অংশ আক্রমণ করিলেন। এস্থানে যুদ্ধ অতি ভীষণ হইয়াছিল। কিন্তু শাহজাদার প্রিয়পাত্র নাকি এ সময়ে খোশমেজাজে তাঁবুতে বসিয়া রুটি, পিঁয়াজ ও তরমুজ (হিন্দুয়ানা) খাইতেছিল। রাজা মুকুন্দ সিংহ হাড়া এবং নেজাবৎ এই মোর্চায় পাশাপাশি দাঁড়াইয়া নিশ্চেষ্টভাবে যুদ্ধ দেখিতেছিলেন। নেজাবৎ খাঁ রাজা মুকুন্দ সিংহকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘রাজাজীউ! এ কেমন কথা? আপনি যে সিপাহীদিগকে হামলা করিবার জন্য পাঠাইতেছেন না?” রাজা উত্তর দিলেন, “খাঁ-বাহাদুর! আমার সৈন্যেরা সাধারণ ভাড়াটিয়া সিপাহী নহে—আমার সগোত্র ভাই-বেরাদর। আমি নিজে স্বয়ং যে জায়গায় যাইব না সেখানে ইহাদিগকে পাঠাইতে পারি না।” নেজাবত ঠাট্টা করিয়া বলিলেন, “বাদশার কাজে ভাই কিংবা ছেলের কথা চিন্তা করা উচিত নয়।” কথাটা উগ্রপ্রকৃতি হাড়া রাজপুতের বুকে তীরের মতো বিদ্ধ হইল। নেজাবতের পুত্র মহম্মদ কুলী রাজার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল। মুকুন্দ সিংহ মহম্মদ কুলীর হাত ধরিয়া তৎক্ষণাৎ দুর্গের দিকে ধাবিত হইলেন; নেজাবত প্রথমে মনে করিয়াছিল রাজপুত শুধু তামাশা করিতেছে। কিন্তু যখন দেখিল মুকুন্দ সিংহ প্রায় বন্দুকের পাল্লার মধ্যে গিয়াছে অথচ তাঁহার ছেলেকেও ছাড়িতেছে না তখন তিনি ঊর্ধ্বশ্বাসে জুতা ফেলিয়া মোজা পায়ে ওইদিকে দৌড় দিলেন এবং অনেক কাকুতিমিনতি করিয়া রাজার হাত হইতে নিজের ছেলেকে মুক্ত করিলেন। মির্জা রাজা জয়সিংহের মোর্চা হইতে দুইজন লোক মই লইয়া দুর্গের দিকে যাইতেছিল; ইরানীদের গুলিতে দুই জনই ধরাশায়ী হইল। মির্জা-রাজা ইহাকেই যথেষ্ট নিমকহালালী মনে করিয়া চুপচাপ বসিয়া রহিলেন। মহবত খাঁ তাঁহার দমদমা হইতে আদৌ বাহির হইলেন না। তাঁহার হুকুমে লতাইফ্-উল্-আখ্ার লেখক নিকটস্থ একটি উঁচু জায়গায় দাঁড়াইয়া যুদ্ধ দেখিতে- ছিলেন এবং অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের সঞ্জয়ের মতো খাঁ সাহেবকে যুদ্ধবৃত্তান্ত শুনাইতেছিলেন।
অপর দিক হইতে কাইতুল পাহাড়ের উপর এ সময় মোগল সৈন্যের এক অংশ আক্রমণ চালাইতেছিল। বারাহ-বাসী সাহসী সৈয়দগণ এবং বাদশাহী আহদী সৈন্য প্রাণপণ যুদ্ধ করিয়াও জয়ী হইতে পারিল না। পরদিন এক প্রহর পর্যন্ত অর্থাৎ মোট চার ঘণ্টা যুদ্ধ চলিয়াছিল; এ যুদ্ধে শাহজাদার এক হাজার সৈন্য হত এবং এক হাজার আহত হইয়াছিল। মোগল বাহিনী বিফলমনোরথ হইয়া শিবিরে প্রবেশ করিল। সেদিন কান্দাহার-দুর্গে সারাদিনব্যাপী গানবাজনা ও উৎসব চলিল। ইরানীরা হিন্দুস্থানীদের মোর্চার নিকট প্রাচীরের উপর দাঁড়াইয়া নানা রকম কৌতুক ও মুখভঙ্গি করিতে লাগিল। অধিকন্তু ওইখানে দু’জন ভালো নাচওয়ালী আনাইয়া হিন্দুস্থানীদিগকে ইরানী নাচের মহড়া দেখাইল। পরের দিন ধর্মনিষ্ঠ জুলফিকর খাঁ দয়াপরবশ হইয়া অনুমতি দিলেন শত্রুপক্ষীয় মুসলমানের লাশগুলি শুধু হিন্দুস্থানীরা বিনা বাধায় উঠাইয়া লইতে পারে, কিন্তু তিনি হিন্দুদের লাশ উঠাইতে দিলেন না। তাহাদের পাঁচশত ছিন্ন মুণ্ড ইরানীরা লইয়া গেল; ধড়গুলি শকুনি-গৃধিনীর ভক্ষ্য হইল।