১. বাল্য ও কৈশোরের ঐতিহাসিক পটভূমিকা

প্রথম অধ্যায় – বাল্য ও কৈশোরের ঐতিহাসিক পটভূমিকা

১৬১৫ খ্রিস্টাব্দের বসন্তকাল। আকাশে-বাতাসে মোগল সাম্রাজ্যে আনন্দের অধীর স্পন্দন, জাহাঙ্গীর-রাজত্বের দশম বার্ষিক “নওরোজে”র ঈদ আগতপ্রায়––সূর্যদেবের মেষরাশিতে প্রথম সংক্রমণের মুহূর্তে উৎসবের বাদ্য বাজিয়া উঠিবে। আজমীর শহরের যে রাস্তা দিল্লি দরওয়াজা বামে রাখিয়া পুষ্কর তীর্থে চলিয়াছে উহার নিম্নভূমির উত্তর দিকে “অন্নাসাগর” সরোবরের বিপুল জলরাশি। সরোবরের পূর্বতীরে নগরীর পশ্চিম উপকণ্ঠে বাদশাহী ডেরা–একটি সুপরিকল্পিত মনোরম তাঁবুর। দার্-উল্-সুলতানত্ আগ্রা নগরী আজকাল দার্-উল্-বরকত্, আজমীরের সৌভাগ্যে ঈর্ষান্বিতা। রাজধানী ছাড়িয়া প্রায় তিন বৎসর যাবৎ শাহানশাহ্ জাহাঙ্গীর মিবার অভিযান পরিচালনার জন্য আজমীরে শিবির স্থাপন করিয়া আছেন। আজমীর শরিফের খ্বজা সাহেবের বরকতে আকবর বাদশাহ বিশাল ভারত সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হইয়াও ক্ষুদ্র মিবার রাজ্য জয় সম্পূর্ণ করিতে পারেন নাই। শাহজাদা খুর্‌রমকে মহারাণা অমরসিংহের বিরুদ্ধে প্রেরণ করিয়া জাহাঙ্গীর পীরের দরগায় পুত্রের বিজয় প্রার্থনা করিতেছিলেন। খেয়ালী বাদশাহ ভক্তির আবেগে গত বৎসর (১৬১৪ খ্রিঃ) কর্ণভেদ করিয়া চিশতী-র কান ফোঁড়া গোলাম হইয়াছিলেন। এই জন্য দরবারী মুসলমান আমীরগণের মধ্যে কান ছিদ্র করিবার হিড়িক পড়িয়া গেল। মরার উঠানে যে অতিকায় ডেগ-যুগল এখনও আকবর-জাহাঙ্গীরের পুণ্যস্মৃতি বহন করিয়া যথাস্থানে বিরাজ করিতেছে উহার মধ্যে বড় সওয়া শ’ মণী ডেগটা আগ্রায় তৈয়ার করাইয়া বিগত বৎসরে সম্রাট জাহাঙ্গীর মহাসমারোহে আজমীরে উৎসর্গ করিয়াছিলেন। ওইদিন সকালবেলা স্বয়ং নূরজাহান বেগম নিজের হাতে উনুন ধরাইয়া বড় ডেগে খিচুড়ি পাক করিয়াছিলেন। রাজরাজেশ্বরীর এই অন্নপূর্ণা রূপ জাহাঙ্গীর ব্যতীত আর কেহ দেখিতে না পাইলেও তিন বৎসর পরে স্যর টমাস রো গল্প শুনিয়াছিলেন। পাক শেষ হইবার পর মইয়ের সাহায্যে আলা হজরত সর্বপ্রথম এক থালা খিচুড়ি নামাইয়া গরিবদিগের পাতে পরিবেশন করিলেন—সেইদিন পাঁচ হাজার কাঙাল খিচুড়ি প্রসাদ পাইয়াছিল।

বিজয়ী খুর‌রম কুমার করণকে সঙ্গে লইয়া ১০২৪ হিজরী মহরম মাসের ২০ তারিখ (ফেব্রুয়ারি, ১৬১৫ খ্রিঃ) দরবারে উপস্থিত হইলেন। অপরাজেয় প্রতাপের পুত্র অমরসিংহ শাহজাদা খুর‌রমের বীরত্ব, কূটনীতি, এবং সর্বোপরি সহৃদয়তার নিকট নতিস্বীকার করিয়া দুই মাস পূর্বে কুমার করণকে সন্ধির প্রস্তাবসহ মোগল শিবিরে প্রেরণ করিয়াছিলেন। মিবারের বিজিত ভূমি চিতোর দুর্গসহ মহারাণা ফিরিয়া পাইলেন; কিন্তু শিশোদিয়া-রাজলক্ষ্মী চিরদিনের মতো বন্দিনী রহিলেন মোগল কারাগারে। এই বিজয় উৎসবের আনন্দ ও উন্মাদনার স্রোতে ভাটা না পড়িতেই ভরা বসন্তে (মার্চ, ১৬১৫) আসিল নওরোজের নূতন জোয়ার। “নওরোজ” দরবারের নয় দিন পরে অমাবস্যার রবিবারে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের ছায়ায় প্রতিবিম্বিত হইল হিন্দুকুলসূর্য শিশোদিয়া বংশের ভাগ্যবিপর্যয়। পরের দিন সোমবার রাত্রি ১২ দণ্ড ৪২ পল গতে (২৯শে সফর ১০২৪ হিঃ ২০শে মার্চ, ১৬১৫ খ্রিঃ) মমতাজমহল বেগম কন্যা জাহানারার জন্ম সম্বৎসর অতীত না হইতেই রাহুমুক্ত সূর্যের ন্যায় এক পুত্রসন্তান প্রসব করিলেন, শাহী গোলাপবাগে প্রথম কোরক প্রস্ফুটিত হইয়া সম্রাটের বসন্তোৎসব দ্বিগুণ সার্থক করিল।

খুর‌রমের প্রথম পুত্রের জন্ম-সংবাদ পাইয়া আলা হজরতের খুশির পেয়ালা বে-সামাল হইয়া পড়িল। বাদশাহ হুকুম দিলেন এইবার তিনি বাবা খুর‌রমের দৌলতখানায় “নবাগত অতিথি”র শুভকামনা করিয়া ডবল ঈদ মানাইবেন। অন্নাসাগরের তটভূমিতে শাহজাদার তাঁবু পড়িয়াছিল। সেইস্থানে পরের দিন সম্রাটের অভ্যর্থনার আয়োজন হইল। উৎসব-মণ্ডপের তোরণদ্বারে দিল্লীশ্বরের উপর প্রাচীন ভারতের “লাজবর্ষণ’ প্রথার অনুকরণে “নিসার”* বা মাঙ্গলিক রৌপ্যমুদ্রা বর্ষিত হইল। শাহানশাহ সভা অলঙ্কৃত করিবার পরেই শাহজাদা খুর‌রম হাজার আশরফি কদম মোবারকে নজর রাখিয়া শিশুর নামকরণের প্রার্থনা জানাইলেন। আলা হজরত নজর মাপ** করিয়া পৌত্রের নাম রাখিলেন সুলতান দারাশুকো।

 —

* প্রকৃতপক্ষে “নিসার” কোনও চলিত মুদ্রা নহে; “খৈ” অপেক্ষা কিঞ্চিৎ ভারী পাতলা রূপার ছোট ছোট পাত, উপরে টাঁকশালের ছাপ। মোট যত তোলা রূপা নিসারে ব্যয় হইত উহার দাম ধরিয়া হিসাব হইত এত হাজার টাকার নিসার।

** নজর মাপ করার অর্থ বাদশাহ উহা হইতে একটি আশরফি স্পর্শ করিয়া উল্টাইয়া রাখিলেন, গ্রহণ না করিয়া দাতাকে উহা বকশিশ করিলেন ইহাই অভিপ্রায়।

দারার জন্মের ত্রয়োদশ মাসে শাহজাদা খুর্রমের প্রথম সন্তান, জাহানারার জ্যেষ্ঠা ভগিনী হুরউন্নিসা আজমীর শহরে তিন বৎসর এক মাস বয়সে অকালে অন্তর্ধান করিলেন। ইহার এক মাস পরে দ্বিতীয় পুত্র শুজাকে কোলে পাইয়াও (১৩ই জুন, ১৬১৬ খ্রিঃ) মমতাজ জীবনের প্রথম শোক ভুলিতে পারেন নাই। সম্রাটের অন্তঃপুরে লালিত-পালিত শিশুপুত্র শুজাঙ্গীর জাঁহা বাদশাহ-র পিয়ারের নাতি হইয়া উঠিলেন; পিতার স্নেহের অংশ জাহানারা এবং দারা ভাগাভাগি করিয়া লইলেন। তাঁহাদের উভয়ের প্রতি পিতৃস্নেহের পক্ষপাতিতায় ঈর্ষান্বিতা হইয়াই যেন শুজার চৌদ্দ মাস পরে হাজির হইলেন কুমারী রৌশনারা (জন্ম বুরহানপুর, ২৪শে আগস্ট ১৬১৭ খ্রিঃ)। গুণ ও স্বভাবে রৌশনারার জুড়ি এবং প্রিয়তম ভ্রাতা আওরঙ্গজেব ভূমিষ্ঠ হইলেন রৌশনারার পিঠে ঠিক চৌদ্দ মাস পরে (২৪শে অক্টোবর, ১৬১৮ খ্রিঃ)। দারার জীবননাট্যের কনিষ্ঠতম প্রতিনায়ক মুরাদ-বক্‌শ পিতৃদ্রোহী খুর‌রমের চঞ্চল বিদ্রোহী রক্ত লইয়া অবতীর্ণ হইয়াছিলেন আওরঙ্গজেবের ছয় বৎসর পরে বিহারের রোহতাশ দুর্গে (২৮শে সেপ্টেম্বর, ১৬২৪ খ্রিঃ); তবে উভয়ের মধ্যে ব্যবধান স্বল্পায়ু আরও দুই ভাই এবং এক ভগ্নী।

শাহজাহানের তৃতীয় পুত্র সুলতান আওরঙ্গজেব ‘বাহাদুর” যখন মাতৃগর্ভে পূর্ণতা লাভ করিতেছিলেন, সেই সময়ে জাহাঙ্গীরের তৃতীয় পুত্র ভাগ্যবান খুর‌রম তাঁহার জ্যেষ্ঠভ্রাতা হতভাগ্য খসরু-কে হত্যা করিয়া নিজের ভবিষ্যৎ নিষ্কণ্টক করিবার জন্য মমতাজের পিতা আসফ খাঁ এবং পিসি-শাশুড়ি নূরজাহান বেগমের সহিত নিন্দনীয় ষড়যন্ত্রে গভীরভাবে লিপ্ত। অধিকন্তু ওই সময়ে সম্রাজ্ঞীর অসীম অনুগ্রহের বিনিময়ে কৃতঘ্নতা এবং পিতার অনাবিল স্নেহ ও একান্ত নির্ভরতার প্রতিদান স্বরূপ বিদ্রোহের পরিকল্পনাও তাঁহার মনের গোপন কোণে দানা বাঁধিতে শুরু করিয়াছে। খসরুর প্রতি খুর‌রমের আক্রোশ সম্বন্ধে জাহাঙ্গীর সচেতন ছিলেন এবং কিঞ্চিৎ ভয়ের সহিত এই পর্যন্ত খসরুকে নূরজাহান, আসফ খাঁ এবং খুর্রমের নাগালের বাহিরে রাখিয়াছিলেন; অনীরায় সিংহদলন নামক* সুবিশ্বাসী রাজপুত বীরের হেফাজত হইতে নজরবন্দী খসরুকে সরাইবার জন্য “নূরজাহান চক্র” অনেক কাণ্ড করিয়াছিলেন। একদিন দুপুররাত্রে বাদশাহী মোহরযুক্ত এক জরুরি হুকুমনামাসহ একজন গুজবরবার কয়েকজন সিপাহী লইয়া অনীরায়ের কাছে হাজির হইল;––বাদশাহের হুকুম তাহাদের সঙ্গে খসরুকে অবিলম্বে শাহীমহলে পাঠাইতে হইবে; গোঁয়ার রাজপুত সাফ জবাব দিয়া বসিল, সূর্যাস্তের পর শাহানশাহর হুকুমনামায় কোনও কাজ হয় না। পরের দিন সকালে অনীরায় বন্দী খসরুকে দরবারে হাজির করিয়া পূর্ব রাত্রির ঘটনা হুজুরে নিবেদন করিলেন। নূরজাহান বেগমের কড়া শাসনে দিনের বেলা সাধারণত আলা হজরত প্রকৃতিস্থ থাকিতেন; সুতরাং আসল ব্যাপারটা বুঝিতে তাঁহার বিলম্ব হইল না। তিনি অনীরায়ের কার্যের প্রশংসা করিয়া খসরুকে তাঁহার জিম্মায় থাকিবার হুকুম দিলেন।

[* রাজত্বের পঞ্চম বর্ষে অনুপরায় ব্যাঘ্রের কবল হইতে সম্রাটের প্রাণরক্ষা করিয়া “অনীরায় সিংহদলন” উপাধি পাইয়াছিলেন।

সংক্ষেপে ঘটনাটি এই–

টিলার উপর দাঁড়াইয়া জাহাঙ্গীর বাদশাহ একটি বাঘকে গুলি করিয়াছিলেন। বাঘ বাদশার উপর হামলা করিল, আলা হজরত চিৎ হইয়া পড়িয়া গেলেন, অনুচরবর্গের মধ্যে দুই-তিন জন তাঁহার বুকের উপর দিয়াই দৌড়াইল। অনুপরায় দুইহাতে বাঘের মাথায় এক ডাণ্ডা মারিলেন। বাঘ তাঁহাকে আলিঙ্গন করিয়া ডাণ্ডাসহ হাত দুইখানা কামড়াইয়া ধরিল। ইহার পর বাঘে রাজপুতে কুস্তি—মাটিতে লুটোপুটি। ইতিমধ্যে অন্যান্য কয়েকজন বাঘকে তলোয়ারের কয়েক ঘা দিতেই বাঘ অনুপরায়কে ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেছিল; রাজপুত গা-ঝাড়া দিয়া আবার বাঘের মুখে মারিল দুই-তিন ঘুষি; আবার বাঘে-মানুষে কুস্তি। কিছুক্ষণ পরে অনুপরায় তলোয়ার বাহির করিবার ফুরসত পাইয়া প্রস্থানোদ্যত বাঘকে এক কোপ মারিলেন। ওই কোপে ভুরুর উপরে চামড়া কাটিয়া বাঘের চোখ দুইটির উপর ঝুলিয়া পড়িল। ইত্যবসরে অন্যান্য বাহাদুরগণ হাজির হইয়া অন্ধপ্রায় ব্যাঘ্রকে নিপাতিত করিলেন।

জাহাঙ্গীর বাদশাহ নিজের খাসা তরবারি উক্ত উপাধির সঙ্গে অনুপরায়কে উপহার দিয়াছিলেন– মোগল ও রাজপুত ধন্য হইল (Memoirs of Jahangir i. p. 185 70 )]

রাজত্বের দ্বিতীয় বর্ষে জাহাঙ্গীর তাঁহার বিদ্রোহী জ্যেষ্ঠপুত্রের চক্ষুদ্বয়ে একপ্রকার গাছের বিষাক্ত সাদা রস (আকন্দ পাতার ক্ষীর) প্রয়োগ করিয়া অন্ধ করিবার হুকুম দিয়াছিলেন। হুকুম তামিল হওয়ার পর অনুতপ্ত হইয়া পুত্রের দৃষ্টিশক্তি পুনর্লাভের জন্য তিনি ব্যাকুল হইলেন। কিছুকাল পরে যখন জানিতে পারিলেন খসরু কিছু কিছু দেখিতে পায় তখন তাঁহার আনন্দের সীমা রহিল না। কুমার খসরু রাজা মানসিংহের ভাগিনেয়, খান্ ই-আজম্ মির্জা আজিজের জামাতা এবং ওই সূত্রে খান্থানান্ আবদুর রহিমের নাতজামাই। রাজা মানসিংহ পরলোকগত হইলেও পরাক্রান্ত কচ্ছবাহ-কুল ভাগিনেয় জ্ঞানে মনে মনে কুমার খসরুর পক্ষাবলম্বী ছিল। অপরপক্ষে কুমার খুর‌রম যোধপুরের দৌহিত্র; রাঠোরের লাখ তলওয়ার সর্বদাই কচ্ছবাহ-কুলের প্রতিস্পর্ধী। অধিকন্তু তিনি পরাজিত মহারাণাকে সম্মানজনক শর্তে দিল্লীশ্বরের সহিত সন্ধি ব্যাপারে সহায়তা করিয়া শিশোদিয়াগণের কৃতজ্ঞতাভাজন হইয়াছিলেন; মহারাণা করণের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ভীম শিশোদিয়া শিকারী চিতাবাঘের মতো তাঁহার প্রতি অনুরক্ত। জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় পুত্র শাহজাদা পরবেজকে খুর‌রম হিসাবের মধ্যেই গণ্য করিতেন না; তিনি চিররোগী, অকর্মণ্যতার জন্য পিতার অপ্রিয়ভাজন, নিজের পায়ের উপর দাঁড়াইবার শক্তি তাঁহার ছিল না। পরবেজের দাবি জাহাঙ্গীর পরোক্ষে একরকম বাতিল করিয়া দিয়াছিলেন— প্রমাণ খুর‌রমের ত্রিশ-হাজারী মনসব, “শাহ বুলন্দ ইকবাল” উপাধি, সরকার হিসারের জায়গির ইত্যাদি। সুতরাং দিল্লির মসনদের উপর বদ্ধদৃষ্টি শাহজাদা খুর‌রম, তাঁহার শ্বশুর আসফ খাঁ এবং নূরজাহান বেগম বন্দী খসরুকে যথাশীঘ্র পরলোকে প্রেরণ করিবার জন্য ষড়যন্ত্র করিতে লাগিলেন। এই সময়ে সুপ্রসিদ্ধ মালিক অম্বর বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার অর্থ ও সৈন্য সাহায্যে দাক্ষিণাত্যে মোগল অধিকার লোপ করিবার উপক্রম করিল। অম্বরকে দমন করিবার মতো বাহাদুর সিপাহসালার খুর‌রম ব্যতীত আর কেহ ছিল না। ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দের শরৎকালে শাহজাদা খুর‌রম মালিক অম্বরের বিরুদ্ধে অভিযান করিবার আদেশ পাইয়া সম্রাটকে জানাইলেন, আসফ খাঁর হাতে তাঁহার জ্যেষ্ঠভ্রাতা খসরুকে সমর্পণ না করিলে তিনি এই অভিযানের ভার গ্রহণ করিবেন না। অন্য কাহারও এইরূপ আপত্তি বিদ্রোহ বলিয়াই গণ্য হইত; কিন্তু এই ক্ষেত্রে ইহা বাবা খুর্রমের* আবদার। অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে (১৬১৬ খ্রিঃ) অনীরায়ের হেফাজত হইতে “কতিপয় কারণে” খসরুকে আসফ খাঁর হাতে তুলিয়া দিতে তিনি বাধ্য হইলেন। স্বীয় আত্মচরিতে সত্য কথা লিখিবার সৎসাহস পর্যন্ত জাহাঙ্গীরের হয় নাই; প্রথম কথা, বাদশার উপরে বাদশাহ, নূরজাহান বেগমের রোষষায়িত কটাক্ষের ভয়; দ্বিতীয় কথা, তুজুক পড়িলেই মনে হয় ওই পুস্তক (শেষ অংশ বাদ) নূরজাহান এবং বাবা খুর্রমের প্রতি বাদশাহর ভালোবাসা ও অনুগ্রহের ফিরিস্তি। সত্য ঘটনার গুপ্ত দিনচর্যা হইলে তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরির ঐতিহাসিক মূল্য তুজুক-ই-বাবরি অপেক্ষা এত কম হইত না। যাহা হউক, দুর্বলচিত্ত, অসহায় সম্রাট জানিয়া-শুনিয়া অর্ধমৃত অন্ধপুত্রকে মৃত্যুরূপী আসফ খাঁর কবলে প্রেরণ করিবার পূর্বে পিতৃস্নেহের নিদর্শন-স্বরূপ একখানা খাসা শাল খসরুকে উপহার দিয়াছিলেন। ১৬২১ খ্রিস্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারি রাত্রির অন্ধকারে বুরহানপুর শহরে খসরুর অন্তঃপুরে সাক্ষাৎ কৃতান্তের ন্যায় প্রবেশ করিয়া সিংহাসনের লোভে উন্মত্ত খুর‌রম স্বহস্তে গলা টিপিয়া জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে হত্যা করিলেন। কেহ যেন কোনও প্রকার সন্দেহ করিতে না পারে, সেই জন্য পরের দিন যথারীতি শহরের মধ্য দিয়া চলিল শবানুগমনের বিরাট মিছিল। খুর‌রম পিতার কাছে দুঃখের সহিত জানাইলেন, পিত্তশূল রোগে (ফাঃ কুলঞ্জ) ভুগিয়া ভাইসাহেব স্বর্গবাসী হইয়াছেন। জাহাঙ্গীর প্রকৃতই বিশ্বাস করিয়াছিলেন কিনা খোদাতালা জানেন, তবে “তুজুকে” তিনি উক্তরূপ সংবাদ লিখিয়া গিয়াছেন। কিন্তু ধর্মের ঢোল কিছু দেরিতে হইলেও বাতাসে একদিন বাজিয়া উঠে। আলমগীর-শাহী আমলে বৃদ্ধ ঐতিহাসিক মহম্মদ সালেহ কাম্বো তাঁহার আমল-ই-সালেহ গ্রন্থে শাহজাহানের দুষ্কার্যসমূহ সবিস্তার লিখিয়া গিয়াছেন।

[* আকবর বাদশাহ শাহজাদা সেলিমকে আদর করিয়া ডাকিতেন, ‘শেখু বাবা’। বিদ্রোহের পূর্ব পর্যন্ত জাহাঙ্গীর তৃতীয় পুত্রকে বরাবর বাবা খুর‌রম বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। অন্য কোনও পুত্রকে তিনি ‘বাবা’ বলেন নাই। আজকাল দিল্লি অঞ্চলে বাপ ও ছেলেকে ‘ভাইয়া’ এবং পিতামহকেই ‘বাবা’ বলিতে শুনা যায়।]

আধুনিক মনোবিজ্ঞানবিদগণ নাকি স্বীকার করেন, পিতামাতার কার্য, চিন্তাধারা এবং মনোভাব গর্ভস্থ সন্তানের বুদ্ধি ও স্বভাবকে প্রভাবান্বিত করিয়া থাকে। ইহা সত্য হইলে বলিতে হয় ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দ হইতে ১৬২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাহজাদা খুর্রমের যে সমস্ত সন্তান ভূমিষ্ঠ হইয়াছিল, তাহারা মাতৃগর্ভেই কূটনীতি, শাঠ্য, নৃশংসতা ও পিতৃদ্রোহের পাঠ আয়ত্ত করিয়াছিল;-পরবর্তী ইতিহাস ইহার সাক্ষী। দারার দুর্ভাগ্যকে নিয়তির হাতে ছাড়িয়া না দিয়া ঐতিহাসিক সন্দেহ করিতে পারেন “মরে পুত্র জনকের পাপে”––শুজা আরওঙ্গজেব মুরাদ শুধু নিমিত্ত মাত্র। শাহজাহান মমতাজের গর্ভে বিদ্রোহীর বীজ ক্ষেপণ করিয়া পিতৃভক্ত, রাজভক্ত, ভ্রাতৃবৎসল পুত্র কেমন করিয়া প্রত্যাশা করিতে পারেন?––‘যবাঃ প্রকীর্ণাঃ ন ভবন্তি শালয়ঃ” : ক্ষেতে যব ছিটাইয়া আমন ধানের ফসল কেহ পায় নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *