পঞ্চম অধ্যায় – দারাশুকোর কান্দাহার-অভিযানের উদ্যোগ-পর্ব
শাহজাদা দারা ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসের শেষে কাবুল হইতে লাহোর চলিয়া আসিলেন। সেখানে তিন মাস ধরিয়া উদ্যোগ পর্বের ধুমধাম চলিল; দারা লেখাপড়া ছাড়িয়া যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম সংগ্রহে মনোযোগ দিলেন। সব কাজেই তাঁহার উৎসাহ, ঐকান্তিক আগ্রহ ও পরিশ্রম করিবার ক্ষমতা ছিল; তবে তিনি ঝোঁকের মাথায় কাজ করিতেন। বিচক্ষণ সেনাপতির মতো সুস্থির বুদ্ধি ও চারি দিকে কড়া নজর রাখিয়া ভবিষ্যৎ প্রয়োজনানুযায়ী ছোটখাট জিনিসের বন্দোবস্ত করিতে তিনি পটু ছিলেন না; বিশেষত লড়াইয়ের কাজে তাঁহার পূর্ব অভিজ্ঞতা কিছুই ছিল না। দরবারী ঐতিহাসিক ওয়ারেস লিখিয়াছেন, এক বৎসরে যে আয়োজন অন্য কেহ করিতে পারে নাই শাহজাদা লাহোরে থাকিয়া তিন মাস নয় দিনে তাহা সুসম্পন্ন করিয়াছিলেন।
কান্দাহার দুর্গের সুদৃঢ় প্রাচীর ধ্বংস করার জন্য সর্বপ্রথমে দরকার বড় বড় কামান, ভারী তোপখানা ও উৎকৃষ্ট গোলন্দাজ। পূর্বে দুইবারই দেখা গিয়াছে ইরানী গোলন্দাজ ও তোপখানার সামনে হিন্দুস্থানী তোপখানা জোরে পাল্টা জবাব দিতে পারে না। তুর্কীদের সহিত অবিরাম সংঘর্ষের ফলে ইরানীরা তোপের লড়াইয়ে সুনিপুণ হইয়া উঠিয়াছিল। তাহাদের কামানের পাল্লা হিন্দুস্থানী তোপখানার পাল্লার চেয়ে অনেক বেশি এবং নিশানাও প্রায় অব্যর্থ। ভারতবর্ষের লোকেরা তোপখানার কাজে বরাবরই কাঁচা। এজন্য বেশি বেতন দিয়া বাদশাহী তোপখানায় রুমী বা ইস্তাম্বুলের তুর্কী ও ফিরিঙ্গি গোলন্দাজ ভর্তি করা হইত। ঠিক জায়গায় কামান বসান, গোলাবারুদ-ভরা, সলিতায় আগুন দেওয়া, তোপ ফাটিয়া মারা যাওয়া ইত্যাদি বিপদের ঝুঁকি ও মোটা কাজ সব হিন্দুস্থানী “খালাসী”রা করিত; রুমী ও ফিরিঙ্গিরা শুধু নিশানা ঠিক ও কামান দাগিবার হুকুম দিত। শাহজাদা এবার মোটা বেতনে ফিরিঙ্গি গোলন্দাজ ও কয়েকজন তোপখানার এঞ্জিনিয়ার নিযুক্ত করিলেন। লাহোরে কামানের কারখানায় তিনটি ভারি কামান ও সাতটি হালকা তোপ (তোপ-ই-হাওয়াই) তৈয়ার করা হইল; বড়গুলির নাম “ফতে মোবারক”, “কিশোয়ার-কুশা” ও “গড়-ভঞ্জন”। প্রথম দুটি ৪৫ সের ও ৩২ সের ভারী গোলা ছুঁড়িবার মতো মজবুত ছিল, ইহার চেয়েও ভারী একটি শাহী তোপ ছিল, নাম “কিলা-কুশা”; তাকত ৫২ সেরী গোলা। কান্দাহারের ভাবী সুনিশ্চিত পতনের স্বপ্নে বিভোর শাহজাদা নিজের বাহাদুরি কামানগুলির গায়ে আগেই খোদাইয়া নিলেন।
“ফতে মোবারক” তোপের উপর ফার্সি কবিতায় লেখা হইল-
তোপ-ই-দারাশুকো শাহই-জাহান
মি-কুনদ্ “কান্দাহার-রা বৈয়রান”
“কিলা-কুশা” তোপ-এ :-
তোপ-ই-দারাশুকো “কিলা-কুশা”
সর্-ই গর্জাসপ মি-বুরদ বে হাওয়া।
এই অভিযানের জন্য মোট সাতটি ভারী কামান, সতেরটি দূর-পাল্লাবিশিষ্ট হালকা তোপ (তোপ-ই-হাওয়াই), ত্রিশটি ছোট তোপ এবং এইগুলির খোরাক বাবদ ত্রিশ হাজার গোলা এবং ইহার উপযুক্ত পরিমাণ বারুদ, চৌদ্দ হাজার “হাওয়াই” আতসবাজি এবং বন্দুকের গুলি তৈয়ার করিবার জন্য ১৫০০ মান্ (প্রত্যেক মান্ প্রায় ৩ সের; ৪০ সেরী মণ নয়*) সীসা বারুদখানায় জমা করা হইল। ইহা অবশ্য সরকারি কাগজপত্রের হিসাব; কিছু বাদসাদ দিয়া লইতে হইবে। সেকালে শক্ত পাথর গোল করিয়া কাটিয়া গোলা তৈয়ার হইত; শুধু বড় বড় কামানে লোহার গোলা ব্যবহৃত হইত। তাঁহার এক দারোগা আসিয়া বলিল, ‘হুজুর! লাহোর হইতে খামকা কান্দাহারে পাথরের গোলা বোঝা করিয়া লইয়া ফায়দা কি? ওইখানে বিস্তর শক্ত পাথর পাওয়া যায়। মিস্ত্রিরা সেখানে বসিয়া গোলা তৈয়ারি করিলে মেহনত কম হইবে।’ দারাকে চাটুকার ঠকবাজ কর্মচারীরা যাহা বুঝাইত তাহাতেই সায় দেওয়া ছিল তাঁহার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। তাহাদের দ্বারাই এই ভাবে তাঁহার সব কাজ পণ্ড হইত। এক্ষেত্রে তাহাই হইল। তোপের ঠিক মতো গোলা সঙ্গে না লইলেও শাহজাদা ৬০০০ বাঁশ পূর্বেই মজুত করিয়া রাখিয়াছিলেন; প্রত্যেকটি বাঁশ দশ গজ (৪২ আঙুলে এক গজ) লম্বা ছিল। দেওয়াল চড়াও করিবার সময় অনেক বাঁশের মই দরকার হইবে, এই জন্য বাঁশের ব্যবস্থা।
[*ফার্সি “মান্”কে আমার পূর্ববর্তী ঐতিহাসিকগণ এবং আমি স্বয়ং এ যাবৎ ৪০ সেরী মণ বলিয়া ভুল করিয়া আসিয়াছি। বিভিন্ন বস্তুর মানের ওজন যথা, সোনা ও লোহা বিভিন্ন ছিল।]
সরকারি দপ্তরের হিসাবে কান্দাহার-অভিযানের মনসবদারী ফৌজ ৭০,০০০ সওয়ার ও ১৭০টি হাতি ছিল। প্রকৃত পক্ষে এই সওয়ারের অন্তত তিন ভাগের এক ভাগ ছিল পায়দল সিপাহী। স্বয়ং শাহজাদা (ত্রিশ হাজারী মনসবদার) এবং ১১০ জন মুসলমান ও ৫৮ জন রাজপুত মনসবদারের সওয়ার একত্র করিয়া এই বাহিনী গঠিত হইয়াছিল। পাঁচ-হাজারী হইতে পাঁচ-শতী মনসবদারকেই শুধু এই হিসাবের মধ্যে ধরা হইয়াছে। এই সমস্ত মনসবদারী ফৌজ ব্যতীত হুজুর রিসালার পাঁচ হাজার বন্দুকধারী ও তিন হাজার তীরন্দাজ অশ্বারোহী আহদী সৈন্য, খাস তৈনাতী পদাতিক বাহিনীর দশ হাজার বন্দুকধারী বরকন্দাজ সিপাহী এবং বাদশাহী পিলখানার ষাটটি হাতি বাদশাহের হুকুমে এই লড়াইয়ে সামিল হওয়ার জন্য লাহোরে পৌঁছিল। পথঘাট মেরামত, বনজঙ্গল পরিষ্কার ও আশ্রয় পরিখা খননের জন্য ৬০০০ বেলদার, পাঁচ হাজার পাথর কাটা মিস্ত্রি ও পাঁচ হাজার ভিত্তি কান্দাহার যাইবার জন্য ভর্তি করা হইল।
এই সমস্ত লোকের রসদ সরবরাহ করার ব্যবস্থা শাহজাদা যথোপযুক্ত ভাবেই করিয়াছিলেন। আধুনিক সমর বিভাগের কমিসারিয়েট বাদশাহী আমলে ছিল না। এখনকার দিনে ফৌজী ঠিকাদারেরা রসদ জোগায়; টাকা সরকারি তহবিল হইতে দেওয়া হয়। সরকার প্রত্যেক সিপাহীর বেতন হইতে ছয়-সাত টাকা নির্দিষ্ট নিরিখে কাটিয়া রাখেন। প্রত্যেক কোম্পানি ও রিসালার সঙ্গে সঙ্গে পাচক, ধোপা ইত্যাদি থাকে। মাথাপিছু রসদ সরকারি ভাণ্ডার হইতে মাপিয়া দেওয়া হয়। খাওয়া এমন কি দাড়ি কামাইবার কোনও ভাবনাও সিপাহীর থাকে না; ঘোড়া, খচ্চর এবং বলদের খোরাক ও খেদমত সরকারি লোকেরাই করিয়া থাকে। সেকালের ব্যবস্থা ছিল অন্য রকম। সিপাহীরা সকলেই আপ্-খোরাকি; কাপড় পোশাক হাতিয়ার (বন্দুক গোলাগুলি বাদ) ঘোড়া জিন লাগাম সবই সিপাহীর। নিজের ও ঘোড়ার খোরাকের বন্দোবস্ত প্রত্যেককেই করিতে হইত। তবে সরকারি তরফ হইতে এই ব্যবস্থা করা হইত যে, সিপাহীরা যেখানেই থাকুক ন্যায্য দামে উর্দুবাজার হইতে সমস্ত খাদ্যদ্রব্য ঘাস-দানা প্রয়োজন অনুসারে খরিদ করিতে পারে। শহরের প্রায় সকল রকম আরাম, খাদ্যদ্রব্য ও জিনিসপত্র স্বাভাবিক অবস্থায় সফর ও লড়াইয়ের ছাউনিতে পাওয়া যাইত। যে যাহার ভড্ডু চড়াইয়া খিচুড়ি পাক করিয়া কিংবা রুটি সেঁকিয়া লইত। লোটা কম্বল বদনা পিঠে কিংবা জিনের পিছনে বাঁধিয়া পথ চলিত। পাকের সুবিধা না হইলে হয়তো ইংরেজের কনোজিয়া সিপাহীর মতো চানা চিবাইয়াই ক্ষুন্নিবৃত্তি করিত।
সে যুগে ভারতবর্ষের সর্বত্র “বন্জারা” (বণিজয়ারা) নামক এক জাতির লোক ছিল, তাহারা যুদ্ধের সময় উর্দুবাজারে এবং শহর ইত্যাদিতে সর্বদা খাদ্যশস্য জোগাইত। দলবদ্ধভাবে বনজারাগণ বলদ কিংবা খচ্চরের পিঠে যব গম ডাল চালের থলি বোঝাই করিয়া এক স্থান হইতে অন্য স্থানে যাইত; স্ত্রী-পুত্র-পরিবার সঙ্গে সঙ্গে থাকিত। এক-এক দলে হাজার দুই হাজার ব্যবসায়ী, আট-দশ হাজার বলদ ও খচ্চর থাকিত। তাহাদের সঙ্গে ভীষণ প্রকৃতির কুকুর ও যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র থাকিত। মহারাষ্ট্র ও উত্তর ভারতে ইহারা এখন ছোটখাট ব্যবসা চালাইয়া থাকে। ইহাদের অগম্য কোনও স্থান ছিল না। যুদ্ধাদিতে খাদ্য সরবরাহের ঠিকাদারি ইহারাই লইত; এবং এজন্য সরকার হইতে টাকা দাদন লইত। শাহজাদা দারাশুকো লাহোরের বনজারাদিগকে এই অভিযানে খাদ্যদ্রব্য জোগাইবার ভার দিলেন; বনজারা চৌধুরীদের পরিবারবর্গকে জামিন-স্বরূপ শহরে নজরবন্দী করিয়া রাখা হইত।
শাহজাদা দারার যুদ্ধায়োজনে একটু রকমারি ছিল। পূর্ব হইতেই তাঁহার হয়তো ধারণা ছিল এই সব সিপাহী তোপ গোলা বারুদ কিছুই দরকার হইবে না; হয়তো ফকিরেরা যেরকম বলিয়াছে কান্দাহার পৌঁছিবা মাত্রই শুনিবেন ইরানের শাহ দ্বিতীয়-আব্বাস মরিয়া গিয়াছে এবং সাত দিনের মধ্যেই কান্দাহার খালি করিয়া ইরানীরা পলাইয়াছে। যুদ্ধের আয়োজন পুরুষকারের অবলম্বন মাত্র; কিন্তু আসলে দৈবই শ্রেয়। আওরঙ্গজেবের পুরুষকার যেখানে দুইবার ব্যর্থ হইয়াছে, দুইবার দিল্লির ফৌজ ও তোপখানা যেখানে হার মানিয়াছে, সেখানে তোপের ভরসায় বসিয়া থাকা চলে না। এজন্য তিনি জটাজুটধারী এক সন্ন্যাসীকে সঙ্গে লইলেন। সন্ন্যাসীর নাম ইন্দ্রগীর গোসাই; মন্ত্রের জোরে চল্লিশটি “দেও” তাঁহার হুকুম তামিল করে। ইন্দ্রগীর শাহজাদাকে বলিয়াছিলেন, কান্দাহারে তোপের কোনও দরকারই হইবে না। তিনি নিজের চোখেই দেখিবেন তাঁহার এই “দেও”গুলি রাতারাতি কান্দাহারের দেওয়াল খন্দকের ভিতর টানিয়া ফেলিয়া শাহী ফৌজের জন্য একেবারে সিধা সরকারি রাস্তা করিয়া দিয়াছে।
অদ্ভুত ও অতিপ্রাকৃত কিছু দারা কোনোদিন অবিশ্বাস করেন নাই। ইন্দ্রগীরের জন্য দুই বেলা ভোজন ও দৈনিক এক সুরাই মদ সরকারি রসদখানা হইতে বরাদ্দ হইল। কয়েকজন জাদুকরও ফৌজের সঙ্গে কান্দাহার চলিল। ইহারা বলিয়াছিল, কান্দাহারে ইরানীরা যে-সমস্ত খাদ্যদ্রব্য জমা করিয়া রাখিয়াছে, তাহাদের তুকতাকের জোরে ওইগুলিতে পোকা কিলবিল করিবে; কমবপ্ত ইরানীরা না খাইয়া মরিবে। গুণী জ্ঞানী মোল্লা ও কোরানশরীফের উপরও দারার বিশ্বাস ছিল অসীম। খোদার ফজল ছাড়া মানুষের কাজ হাসিল হয় না, এজন্য শাহজাদা ব্যবস্থা করিলেন এক দল মোল্লা দোয়া দরুদ পড়িতে পড়িতে শাহী ফৌজের সহিত কান্দাহার যাইবে এবং সেখানে নিত্যস্বস্ত্যয়ন করিবে। যেমন প্রভু তেমনই ভৃত্য; শাহজাদার তোপখানার মীরআতশ জাফরও চুপি চুপি এই ভরসায় একজন বামমার্গী ফকির সঙ্গে লইল—যেন জাদুর সাহায্যে সেও সকলের সেরা বাহাদুরি দেখাইয়া সাত-হাজারী মনসবদার হইতে পারে।
একজন সমসাময়িক মুসলমান ঐতিহাসিক লিখিয়াছেন, একদিন লাহোরে শাহজাদার মাথায় খেয়াল চাপিল তিনি নকল কান্দাহার-দুর্গ অধিকারের কৃত্রিম অভিনয় দেখিবেন। কান্দাহার-দুর্গের নকশানুযায়ী লাহোরের বাহিরে এক নকল গড় নির্মিত হইল। নকল দুর্গের ভিতর গারদী সিপাহী কিংবা কামান ইত্যাদি কিছুই বসানো হইল না। এই দুর্গের বাহিরে দুইটি কামানের মোর্চা (battery) খাড়া করা হইল; এক মোর্চা হইতে হিন্দুস্থানী এবং অন্যটি হইতে ফিরিঙ্গি গোলন্দাজগণ তোপ দাগিয়া দেওয়াল ভাঙিবে; ঢুকিবার রাস্তা হওয়ামাত্র এক পল্টন সিপাহী দুর্গ হাতাহাতি চড়াও করিয়া দখল করিবে। কান্দাহার দুর্গ কি ভাবে আক্রমণ করা হইবে শাহজাদা ফিরিঙ্গি এঞ্জিনিয়ারগণকে ডাকাইয়া পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিলেন। তাহাদের কাছে নাকি কতকগুলি কেতাব ছিল। ওইগুলিতে যত রকম দুর্গ মানুষের কল্পনা ও বুদ্ধিতে তৈয়ারি করা সম্ভব সবগুলির নকশা আঁকা ছিল এবং কোন্ রকম দুর্গ অধিকার করিতে হইলে কি উপায়ে অগ্রসর হইতে হইবে সবই লেখা ছিল। ফিরিঙ্গিরা ওই সমস্ত নকশা দেখাইয়া শাহজাদাকে আক্রমণকৌশল হাতে-কলমে বুঝাইয়া দিল। নির্দিষ্ট দিনে কৃত্রিম যুদ্ধ দেখিবার জন্য শাহজাদা ময়দানে উপস্থিত হইলেন। অবরোধ-কার্য ও তোপ দাগা আরম্ভ হইল; কয়েক ঘড়ির মধ্যেই হাতাহাতি হামলা ও কিল্লা ফতে সবই শেষ। তিনি হিন্দুস্থানীদের তোপের মোর্চার চেয়ে ফিরিঙ্গিদের তোপের মোর্চা ভাল বলিয়া তাহাদিগকে খুব প্রশংসা করিলেন। কথাটা সত্য হইলে খোলাখুলি বলা সেনাপতির পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ হইল না। এই উপলক্ষে শাহজাদাকে মনসবদারগণ যথারীতি মোবারকবাদ জানাইল এবং এই নকল কান্দাহার বিজয়ের আক্ষরিক তারিখও (chronogram) পুরাদস্তুর উদ্ভাবিত হইল—ফতে আওয়াল-ই দারাশুকো––অর্থাৎ দারাশুকোর প্রথম বিজয়! ছেলেমানুষি আর কাহাকে বলে?
এইভাবে উদ্যোগ পর্ব শেষ হইল। দারার নিজ তাবিনের সিপাহী ও সর্দারগণের মধ্যে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা এবং ততোধিক ছিল তাহাদের বাগাড়ম্বর। কোনোদিন লড়াইয়ে মশা-মাছি না মারিলেও তাহাদের ধারণা জন্মিয়াছিল তাহারা এক-এক জন এই জমানার রুস্তম আফ্রাসিয়াব। যাঁহারা আজীবন লড়াই করিয়া চুল পাকাইয়াছেন, তাঁহারাও শাহজাদার তালপাতার সিপাহী ও নিধিরাম সর্দারদের দাপটে অস্থির হইয়া উঠিলেন। তাঁহারা বুঝিলেন, শাহজাদা যদি কোনও গতিকে এবার কান্দাহার ফতে করিতে পারেন তাহা হইলে ডিমের খোলস হইতে সদ্যোনির্গত এই মুরগীর বাচ্চাগুলিই তাঁহাদের দাড়ি ঠোকরাইবে। যাহা হউক, এবার যাত্রার শুভ মুহূর্ত গণনার ধুম পড়িয়া গেল। হজরত রসুলাল্লা মুসলমানদিগকে যোগিনী-দিকশূল মঘা অশ্লেষার পা-বন্দী হইতে আজাদ করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু খলিফা মনসুরের সময় হইতে এগুলি আবার মুসলমানদিগকে পাইয়া বসিল। দারার পিতামহ জাহাঙ্গীর লিখিয়া গিয়াছেন—জীবনে একবার মাত্র তিনি ফলিত জ্যোতিষ বিচার না করিয়া পা ফেলিয়াছিলেন। সে-বারের ফল অশুভ না হইলেও তিনি দ্বিতীয় বার ওইরূপ দুঃসাহসিক কার্য করেন নাই। গোঁড়া মুসলমান হইলেও শাহজাহান এ বিষয়ে আরও সাবধানী ছিলেন। কোন মুহূর্ত বিচারে হিন্দু জ্যোতিষী ও ইউনানী নজুমী সম্পূর্ণ একমত না হইলে বাদশাহ মুহূর্ত বা “ছায়াত” কবুল করিতেন না। দারা লাহোর হইতে লিখিয়া পাঠাইলেন দৈবজ্ঞেরা ১১ই ফেব্রুয়ারি যাত্রা এবং ২৫শে এপ্রিল কান্দাহার-অবরোধের দিন ধার্য করিয়াছে। সম্রাট উক্ত বিচার অনুমোদন করিয়া শাহজাদাকে রোখসতের ফরমান পাঠাইলেন। এই উপলক্ষে মোট পাঁচ লক্ষ টাকা মূল্যের হাতি, ঘোড়া, জহরত ও হাতিয়ার শাহজাদা বাদশার তরফ হইতে খেলাত স্বরূপ পাইয়া অনুগৃহীত হইলেন। মনসবদারগণের খেলাত ও রাহাখরচ এবং সিপাহীদিগকে অগ্রিম বেতন ও বখশিশ ইত্যাদির বাবদ আরও বিশ লক্ষ টাকা যাত্রার পূর্বেই খরচ হইল। অধিকন্তু ফৌজি তহবিলে নগদ এক লাখ আশরফি ও এক কোটি টাকা শাহজাদার সঙ্গে লওয়ার জন্য মঞ্জুর হইল। সম্রাট হুকুম দিলেন শাহী ফৌজ এবার মুলতান হইয়া থল-চোটিয়ালীর পথে অগ্রসর হইবে; এ রাস্তায় রসদ সংগ্রহের সুবিধা বেশি। এ রাস্তা দিয়া আওরঙ্গজেব দ্বিতীয়বার কান্দাহার আক্রমণ করিয়াছিলেন এবং এই রাস্তায় কান্দাহার হইতে ভূতপূর্ব আমীর আমানুল্লার সেনাপতি নাদির খাঁ (পরে যিনি নাদির শাহ হইয়াছিলেন) এই পথে সীমান্ত অতিক্রম পূর্বক তৃতীয় আফগান যুদ্ধে ইংরেজ সৈন্যকে অপদস্থ করিয়াছিলেন। এখনও এই বিজয়ের বাৎসরিক উৎসবে ইংরেজ প্রতিনিধি কাবুলের রাজপতাকায় দেখিতে পান পোষা কুকুরের মতো সিংহের গলায় শিকল লাগাইয়া এক জন কাবুলী সদম্ভে উহাকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে।
১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দের ১১ই ফেব্রুয়ারি দিবা তিন প্রহর (? ঘড়ি) গতে শাহজাদা দারা লাহোর ত্যাগ করিয়া শহরের বাহিরে তাঁবুতে পদার্পণ করিলেন। দুই দিন পরে দারাচালিত বিরাট বাহিনী সঞ্চরমাণা দিল্লি নগরীর মতো মূলতানের পথ ধরিয়া ধীর মন্থর গতিতে দক্ষিণ পশ্চিমাভিমুখে অগ্রসর হইল। ভারী তোপ গোলা লোহা-লক্কড় বোঝাই বড় বড় নৌকা রাবী নদী দিয়া সিন্ধুতীরাভিমুখে ভাঁটি চলিল।*
[* সেকালে লাহোর হইতে মুলতান হইয়া রোরী সক্কর পর্যন্ত যে বাদশাহী রাস্তা ছিল ভীমকর্মা পাঠান সম্রাট শেরশাহ উহা নির্মাণ করাইয়াছিলেন। এই রাস্তা কোন কোন স্থানে দিক পরিবর্তিত হইয়া আজও বিদ্যমান; আমিও এ রাস্তায় কিছুদূর চলিয়াছি। মন্টোগোমারী জেলার ভিতর দিয়া উহার যে অংশ গিয়াছে স্থানীয় লোকেরা উহাকে “কাক্কা-ওয়ালী সড়ক” বলে। শের শাহর আমল হইতে সরকারি হুকুম ছিল রাস্তার উভয় পার্শ্বস্থ গ্রামের বাসিন্দাগণ এই রাস্তার উপর “কাক” বা নল-খাগড়ার আঁটি বিছাইয়া রাখিবে। এই ব্যবস্থা না থাকিলে এ রাস্তায় গাড়ি, ঘোড়া, সিপাহী চলা অসম্ভব হইত। এই সরকারি রাস্তার “পরাও” বা বিশ্রাম মঞ্জিলগুলির নাম পাঠক স্যর যদুনাথ সরকারের India of Aurangzib পুস্তকে পাইবেন।]
শাহী ফৌজ ২৩শে এপ্রিল “পঞ্চমুদ্রা” গিরিসঙ্কট পার হইয়া ২৫শে এপ্রিল কান্দাহার হইতে পাঁচ ক্রোশ দূরে “মরদ-ই-কিলা” নামক স্থানে উপস্থিত হইল। রুস্তম খাঁ বাহাদুর ফিরোজ জঙ্গ অগ্রগামী সৈন্যদলসহ ইতিপূর্বেই কান্দাহার পৌছিয়াছিলেন, এবং উভয়পক্ষে গোলাগুলিও চলিয়াছিল। যে তারিখ অর্থাৎ ২৫শে এপ্রিল দৈবজ্ঞেরা অবরোধ কার্যারম্ভের দিন ধার্য করিয়াছিল, সে তারিখ গত হওয়ায় শাহজাদার মীর আতশ ও ফৌজ বকশি আবদুল্লা বেগ গোঁ ধরিল––আমাদের জন্য আর একটা শুভদিন চাই। এজন্য সৈন্যেরা পরের দিন কান্দাহার ঘেরাও না করিয়া পথে আরও দিনদুই দেরি করিল। কান্দাহারের দুর্গপরিখার কিছু দূরে সম্রাট হুমায়ুনের অকৃতজ্ঞ ভ্রাতা কামরান মির্জা এক সুবিস্তৃত মনোরম উদ্যান প্রস্তুত করাইয়াছিলেন। সেখানে শাহজাদার তাঁবু পড়িয়াছিল। তিনি বোধ হয় আর এক শুভ মুহূর্তের অপেক্ষায় অবরোধ আরম্ভের সাতদিন পরে তরা কি ৪ঠা মে বাগ-ই-কামরানে পৌঁছিলেন।