১৪. গৃহযুদ্ধের প্রথম পর্যায়

চতুর্দশ অধ্যায় – গৃহযুদ্ধের প্রথম পর্যায়

১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ই সেপ্টেম্বর সম্রাট শাহজাহান দিল্লির শাহীমহলে রোগশয্যা গ্রহণ করিলেন। সাত দিন পর্যন্ত তাঁহার সঙ্কটাপন্ন অবস্থা, দারা ও জাহানারা পিতার শুশ্রূষা করিতেছিলেন; দারার বিশ্বস্ত কয়েকজন আমীর ব্যতীত কাহারও সম্রাটকে দেখিবার অনুমতি ছিল না। ইহার ফলে ভিতরে বাহিরে লোকের মনে ধারণা হইল সম্রাট স্বর্গবাসী হইয়াছেন, সংবাদ চাপা দিয়া ভিতরে কিছু একটা কাণ্ড চলিয়াছে। অন্দরমহলে রোশেনারা বেগম এবং মোরাদের পক্ষে সর্বকনিষ্ঠা গোহরারা পূর্ব হইতেই স্ব স্ব মনোনীত ভাবী দিল্লীশ্বরের নিকট গুপ্ত সংবাদ সরবরাহ করিতেন এবং পিতার নাভিশ্বাসের অপেক্ষায় ছিলেন; তাঁহারা এই সুযোগ ছাড়িবেন কেন? দরবারে শহরে দারার শত্রপক্ষীয় গুপ্তচরের বেড়াজাল; সত্যের অপেক্ষায় কালক্ষেপ না করিয়া দুষ্টবুদ্ধি-প্রণোদিত মিথ্যা গুজবের ফোয়ারা জুম্মামসজিদ- ফতেপুরী ভাসাইয়া রাজমহল দৌলতাবাদ ও আহমদনগরের দিকে ছুটিয়াছে। দর্শন- ঝরোকায় সূর্যোদয়ে যথারীতি সম্রাটের মুখ না দেখিয়া ভালোমানুষের মনেও সন্দেহ হইল তিনি জীবিত নাই। আশঙ্কায় উদ্ভ্রান্ত উদ্বেল জনমতকে শান্ত করিবার জন্য সাত দিন পরে শয্যাশায়ী সম্রাট নিচে যমুনা-সৈকতে দর্শনার্থী প্রজাগণের অভিবাদন গ্রহণ করিলেন; তবুও লোকে বলাবলি করিতে লাগিল ওই মূর্তি আর কেহ, শাহানশাহ নহেন। অন্দরমহল হইতেই “সঠিক খবর” বাহির হইল, সম্রাট শাহজাহান পূর্বেই গতাসু হইয়াছেন, শাহজাদা দারা নিজের মতলবে অন্তঃপুরের একটি সুশ্রী বৃদ্ধা খোজা নপুংসককে শাহজাহান সাজাইয়া ধাপ্পাবাজি খেলিতেছেন। এই কানাঘুষা দারা ও সম্রাটের কানে পৌঁছিল।

অসুস্থ শরীর লইয়া ১৪ই সেপ্টেম্বর সম্রাট প্রকাশ্য দরবারে উপস্থিত হইয়া শুশ্রূষার পুরস্কার-স্বরূপ শাহজাদা দারার মনসব বাড়াইয়া পঞ্চাশ হাজারী করিলেন এবং তাঁহাকে আড়াই লক্ষ টাকা ইনাম দিলেন। ইহার পরে সম্রাট উচ্চপদস্থ আমীর মনসবদারগণকে তাঁহাদের সম্মুখে অছিয়ত-নামা সম্পাদন করিলেন এবং আদেশ দিলেন, আজ হইতে সমস্ত বিষয়ে সর্বসময়ে এবং সাম্রাজ্যের সর্বত্র শাহজাদা দারার হুকুম মানিয়া চলিতে হইবে। প্রায় এক মাস পরে সম্রাট স্বাস্থ্যলাভের আশায় দিল্লি হইতে আগ্রা চলিয়া আসিলেন এবং সমস্ত সুবায় তাঁহার আরোগ্য-সংবাদ প্রেরিত হইল; কিন্তু তবুও আগ্রার বাহিরে অধিকাংশ লোকেরই ধারণা—আসল বাদশাহ মারা গিয়াছেন, বাদশাহী এখন বে-ওয়ারিশ। ইহার ফলে প্রজারা খরিফ (বর্ষার ফসল) কিস্তির খ্বজানা বন্ধ করিল, ফৌজদার আমীন আমলা দিশাহারা হইয়া পড়িল; শান্তি ও আইন শৃঙ্খলা বলিয়া কিছু রহিল না। সেকালে দিল্লি সিংহাসন হস্তান্তর হওয়ার প্রাক্কালে প্রায়ই এই রকম অর্ধ অরাজকতা দেখা দিত।

আকবর বাদশাহের মৃত্যুর খবর সুদূর জৌনপুরে যে আতঙ্ক সৃষ্টি করিয়াছিল উহা হইতে আমরা শাহজাহানের মৃত্যুর মিথ্যা গুজবে রাজ্যের কি অবস্থা ঘটাইয়াছিল তাহা অনুমান করিতে পারি— সমসাময়িক ইতিহাসেও ইহার ছায়া পড়িয়াছে। এক প্রত্যক্ষদর্শী হিন্দি কবি লিখিয়াছেন, (আকবরের মৃত্যু সংবাদ পৌঁছিতেই) শহরে শোরগোল উঠিল; চারিদিকে খলমল (উদংগল ) পড়িয়া গেল। ঘরে ঘরে দরজা দরজায় কপাট, হাটে হাটুরিয়া নাই। ভালো ভালো কাপড়চোপড় গহনাগাঁটি সকলেই মাটির নিচে গাড়িয়া ফেলিতে লাগিল। প্রত্যেক বাড়িতে লোকজন হাতিয়ার জোগাড় করিতেছে; পুরুষের মোটা কাপড়, স্ত্রীলোকেরা কম্বল কিংবা খেস জড়াইয়া মোটা পোশাক পরিয়া আছে। উচ্চ নীচ বর্ণ চিনিবার জো নাই; ধনী দরিদ্র এক সমান: এমন কি শহরে চুরিধারি পর্যন্ত নাই;—এমনই অপভয় লোকদের পাইয়া বসিল। *

ইংরেজ আমলে রাজা মরিলে ছেলেরাও খুশি—দুই দফা ছুটি; দুই কিস্তি মিঠাই। সেকালে আকবর বাদশাহের রামরাজ্যের যখন উক্ত অবস্থা––আসন্ন গৃহযুদ্ধের আতঙ্ক শাহজাহানের রাজত্বে নিশ্চয়ই চতুর্গুণ হইয়াছিল।

[*জৌনপুরবাসী এক হিন্দি কবি আকবরের মৃত্যুসংবাদ শহরে পৌঁছিবামাত্র লোকের কি অবস্থা হইয়াছিল উহার প্রত্যক্ষ বর্ণনা দিয়াছেন।]

“ইসহি বীচ নগর মেঁ সোর।  ভয়ে উদংগল চারিহ ওর।।
ঘর ঘর দর দর দিয়ে কপাট।  হাটবাণী নহি বৈঠে হাট।।
ভলে বস্ত্র অরু ভূষণ ভলে।  তে সব গাড়ে ধরতী তলে।।
ঘর ঘর সব বিসাহে সস্ত।  লোগন পহিরে মোটে বস্ত্ৰ।।
ঠাঢ়ৌ কম্বল অথবা খেস।  নারিন পহিরে মোটে বেস।।
উঁচ নীচ কেউ ন পহিচান।  ধনী দরিদ্র ভয়ে সমান।।
চোরি ধারি দিখে কঁহু নাঁহি।  য়োঁহি হি অপভয় লোগ ডরাহি।।

—শ্রীরামনরেশ ত্রিপাঠীকৃত কবিতা- কৌমুদী, পৃ. ৪০]

রোগশয্যা গ্রহণ করিবার পর প্রায় তিন চারি মাস পর্যন্ত সম্রাট শাহজাহান দারার হাতেই যাবতীয় কাজ ছাড়িয়া দিয়াছিলেন, শাহজাদাকে পরামর্শ দেওয়া কিংবা তাঁহার কার্যে হস্তক্ষেপ করিবার মতো মানসিক স্বাস্থ্য তিনি তখনও লাভ করেন নাই; সুতরাং এই সময়ে দরবারে যাহা ঘটিয়াছিল উহার জন্য শাহজাদাই দায়ী। তাঁহাকে উচিত পরামর্শ দেওয়ার মতো জাহানারা ব্যতীত আর কেহ ছিল না; থাকিলেও কিছু বলিবার ভরসা পাইতেন না। তাঁহার প্রথম ভুল, সম্রাটের অবস্থা গোপন রাখিবার জন্য অতিরিক্ত কড়াকড়ি ও সাবধানতা; প্রধান দোষ ছিল অপরের দৃষ্টিভঙ্গি লইয়া তিনি কোনও কার্যের ফলাফল বিবেচনা করিতেন না, করিবার শক্তিও ছিল না। ইহার ফলে ভিতরে বাহিরে মিথ্যা গুজব ও অনর্থ সৃষ্টি হইয়াছিল। ভগিনী রোশেনারা-গোহরারা, মেসো জাফর-খলিল উল্লা এবং দরবারে নিযুক্ত আওরঙ্গজেব-শুজা-মোরাদের প্রতিনিধিগণকে যদি তিনি প্রথম অবস্থায় স্বচক্ষে পীড়িত সম্রাটকে দেখিবার সুযোগ দিতেন, তাহা হইলে ইহারা জ্যান্ত লোককে গুজবে মারিয়া ফেলিতে অন্তত ইতস্তত করিতেন, বুদ্ধি ও সৎসাহস থাকিলে অন্য কাজ ছাড়িয়া তিনি নিজের হাতে চিঠি লিখিয়া দূরস্থ ভ্রাতাদের আশ্বস্ত করিতেন, তাঁহার মনে পাপ ছিল না বলিয়াই লোকে তাঁহাকে নিষ্পাপ মনে করিবে এমন কোন কথা নাই।

দরবারে ভ্রাতাদের দূতগণকে দারা কয়েক মাস প্রায় নজরবন্দী করিয়া রাখিয়াছিলেন, ধোলপুরে এবং অন্যান্য স্থানে অনভিপ্রেত সংবাদ আটকাইবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন; সত্য মিথ্যা সংবাদ কিন্তু চিরকাল মাটি চুয়াইয়া কিংবা আকাশে উড়িয়া সরকারি শ্যেনদৃষ্টি এড়াইয়া গন্তব্যস্থানে চলিয়া যায়। ইহার ফল দাঁড়াইল, লোকে পরবর্তী সত্য সংবাদ বিশ্বাস করিল না, শাহজাদাগণ পাঞ্জামারা বাদশাহী ফরমান জাল বলিয়া উড়াইয়া দিলেন; কেননা দারার হস্তাক্ষর অবিকল শাহজাহানের হাতের লেখার মতো ছিল, বাদশাহী গোপনীয় দারার হাতে।

শাহজাদাগণের মন তখন সত্যগ্রহণে বিমুখ, যেহেতু তাঁহারা তিনজন যুদ্ধার্থে সম্পূর্ণ প্রস্তুত, দারাকে প্রস্তুত হইবার সময় না দেওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর। ভ্রাতারা দোষী; তাঁহারা দারার নিকট হইতে কিছুই প্রত্যাশা করিত না—এই কথা সত্য; তবুও তাঁহাদের প্রতি ব্যবহারে জ্যেষ্ঠভ্রাতার কর্তব্য হইতে বিচ্যুত হওয়া দারার পক্ষে অশোভন হইয়াছিল। যেদিন প্রকাশ্য দরবারে শাহজাহান রাজদণ্ড এক প্রকার দারার হাতে তুলিয়া দিয়াছিলেন, সেদিন হইতে রাজদণ্ডের মর্যাদা রক্ষার জন্য পূর্ব শত্রুতা ভুলিয়া ভ্রাতাদের প্রতি পিতার দায়িত্ব গ্রহণ করিতে পারিলে দারার মহান চরিত্র মহত্তর হইত, অনেক দ্বিধাগ্রস্ত ব্যক্তি তাঁহার পক্ষ অবলম্বন করিত। সম্রাটের লিখিত চিঠিতে শূজার কাছে বাংলা-উড়িষ্যার পরিবর্তে দাক্ষিণাত্যের পাঁচ সুবা গ্রহণ করিবার প্রস্তাব এবং মোরাদকে গুজরাট হইতে সরাইয়া আওরঙ্গজেবের বেরার সুবায় বদলি ইত্যাদি দারার প্ররোচনায় লেখা হইয়াছিল মনে করা অসঙ্গত নয়; ইহা কিন্তু নিতান্ত কাঁচা চাল ও ছেলেমানুষি। শাহজাহান একসময়ে সাম্রাজ্যের যে ভাগাভাগি করিয়াছিলেন, ক্ষমতা ও সুযোগ হাতে পাইয়া দারা উহা করিলে প্রশংসিত হইতেন। ভ্রাতাদের স্ব স্ব সুবায় বহাল রাখিবার আশ্বাস, শুজাকে বিহার, মোরাদকে গুজরাটসহ সিন্ধু মুলতান ছাড়িয়া দিলে গৃহযুদ্ধ হয়তো বন্ধ হইত না; কিন্তু কিছু বিলম্ব হইত, দারার আত্মরক্ষার আয়োজন কেহ আক্রমণাত্মক বলিয়া মিথ্যা প্রচারের সুযোগ পাইত না।

যাহা হউক, নিয়তি নিজের গতি অনুসরণ করিল। ভ্রাতৃগণকে বিবাদ হইতে নিরস্ত করিবার চেষ্টায় সম্রাট ও জাহানারা দুইজনেই অকৃতকার্য হইলেন। পুত্রগণ পিতার জন্য “ফাতেহা” পাঠ পূর্বেই সমাপ্ত করিয়াছিল; সুতরাং বাঁচিয়া উঠিয়াও সম্রাট জীবনৃত, ভগিনী জাহানারা মিথ্যাবাদিনী।

মোগল সাম্রাজ্যে তখন প্রলয়ের ঝড়ের পূর্বে তমোময়ী প্রকৃতির অশুভ নিস্তব্ধতা। প্রজাদের দীর্ঘকালের বিষাদ ও আশঙ্কা ঘনীভূত হইয়া মহামেঘের মতো হিন্দুস্থানের বুকে নামিয়া আসিতেছে, সুদূর পূর্ব এবং পশ্চিম দিশার কোলে বিদ্রোহের যুগপৎ বিদ্যুৎচমক। সম্রাট শাহজাহানের করধৃত রাজদণ্ড জরা এবং শোকে কম্পমান, যৌবনের বজ্রমুষ্টি শিথিল, সতেজ চিন্তাধারার গতি মন্থর হইয়া পড়িয়াছে; উপস্থিত উভয়সঙ্কটে তাঁহার বুদ্ধি মলিনীভূত, নীতি অন্ধস্নেহ ও আত্মরক্ষার চিন্তার সংঘাতে দোদুল্যমান। অথচ বিপন্ন দিল্লি সিংহাসনের তিনিই অধীশ্বর, পুত্রগণ সকলেই মমতাজের মাতৃহারা সন্তান, শুক্তির স্নেহগর্ভে কর্কটাণ্ডজ জন্মগ্রহণ করিতে পারে না।

১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে আগ্রায় সংবাদ পৌঁছিল শাহজাদা শুজা রাজমহলে সাড়ম্বরে সিংহাসনে আরোহণ করিয়া, সম্রাট আবুলফৌজ নাসিরউদ্দীন মহম্মদ তৃতীয় তৈমুর, দ্বিতীয় সিকেন্দর শাহ শুজা গাজী উপাধি ধারণ করিয়াছেন। তাঁহার বিরাট সৈন্যবাহিনী এবং বাঙলার রণতরী বহর মুঙ্গের দুর্গে উপস্থিত, সুবা বিহার দারার হাতছাড়া হইয়া গিয়াছে। গুজরাট হইতে সংবাদ পাওয়া গেল, শাহজাদা মোরাদ সম্রাটের প্রেরিত উপদেষ্টা নির্দোষ আলী নকীকে হত্যা করিয়া নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করিয়াছেন (৫ই ডিসেম্বর, ১৬৫৭) এবং সুরাট বন্দর অধিকার করিবার জন্য সৈন্য প্রেরণ করিয়াছেন। দাক্ষিণাত্য হইতে সংবাদ দরবারে পৌঁছিবার পথ আওরঙ্গজেব দুই মাস পূর্বেই বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন, নর্মদা নদীর সমস্ত ঘাটে কড়া পাহারা। অসহিষ্ণু মোরাদকে তাড়াহুড়া না করিবার জন্য তিনি পরামর্শ দিয়াছিলেন। এবং নিজেও হাতের তাস ফেলেন নাই।

বিদ্রোহী ভ্রাতাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্য দারা উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন; কিন্তু তাঁহাদিগকে বাধা দিবার মতো উপযুক্ত সৈন্যবল নাই। দাক্ষিণাত্যে প্রেরিত বাদশাহী ফৌজের রাজপুত মনসবদারগণ এবং সেনানী মহাবত খাঁ হিন্দুস্থানে ফিরিয়া আসিয়াছিলেন; অন্যান্য মুসলমান মনসবদারগণকে আওরঙ্গজেব নিজের দলে ভিড়াইয়া লইয়াছিলেন। গুজরাট সুবা তখন “লস্কর-খেজ” বা যোদ্ধাবহুল দেশ বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিল, মোরাদ ওইখান হইতে বহু অশ্বারোহী সৈন্য সংগ্রহ করিলেন। আওরঙ্গজেবের তোপখানা শাহী তোপখানা হইতেও অধিক শক্তিশালী ছিল। তিনি নানা দেশীয় ফিরিঙ্গি গোলন্দাজ তোপখানায় ভর্তি করিয়াছিলেন। আওরঙ্গজেব ও মোরাদ শুধু পিতৃদ্রোহী এবং ভ্রাতৃদ্বেষী নহেন; তাঁহারা মোগলের প্রবল শত্রু ইরানের দ্বিতীয় শাহ আব্বাসের হাতে হিন্দুস্থান তুলিয়া দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। বস্তুত তাঁহারা শাহ-আব্বাসকে এই সুযোগে দারার অধীনস্থ কাবুল সুবা অধিকার করিবার জন্য পত্র লিখিয়াছিলেন। সম্রাট শাহজাহান বিশ্বস্ত সেনাপতি মহাবত খাঁকে কাবুল সুবার নায়েব সুবাদার হিসাবে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত রক্ষার ভার দিলেন; কিন্তু পুত্র তিনজনের বিরুদ্ধে সৈন্যপ্রেরণ করিতে ইতস্তত করিতে লাগিলেন। সম্রাট তখনও আশা করিতেছিলেন, বাদশাহী ফরমান দ্বারা তিনি গোলমাল মিটাইয়া ফেলিতে পারিবেন; ইহার কিছু কারণও ছিল।

বিহার অধিকার করিয়া সুচতুর শাহশুজা পিতার নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করিয়া লিখিলেন, অনেকদিন হইতে তিনি সুবা বিহার তাঁহার কাছে ইনাম চাহিতেছেন, “দাদাভাই’ উক্ত সুবা ইনায়ৎ করিলে আর কিছু অভিযোগ থাকিবে না। সম্রাট গলিয়া জল হইয়া গেলেন; অগত্যা শাহজাদা দারা দুইটি শর্তে সুজাকে বিহার সুবা ছাড়িয়া দিতে রাজি হইলেন; প্রথম শর্ত মুঙ্গের দুর্গের নূতন রক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস করিয়া ফেলিতে হইবে; দ্বিতীয়ত শুজা কিংবা তাঁহার পুত্রপরিজন দুর্গে বাস করিতে পারিবে না। এই মর্মে সম্রাটের আদেশ পাইয়া শুজা ভাবিলেন, দারা যুদ্ধে ভয় পাইয়াছেন; মুঙ্গের হইতে আর কিছু আগাইয়া বেনারস দখল করিতে পারিলে এলাহাবাদ অযোধ্যা “ফাউ” পাওয়া যাইতেও পারে। তিনি সময়ক্ষেপ করিবার জন্য সম্রাটের কাছে উত্তর লিখিতে বিলম্ব করিলেন। বিজাপুরের সহিত বুঝাপড়া এবং দাক্ষিণাত্যের শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ করিবার জন্য আওরঙ্গজেবেরও কিঞ্চিৎ সময়ের প্রয়োজন ছিল। জাহানারার কাছে তিনি লিখিলেন, পিতা জীবিত আছেন শুনিয়া সুখী হইয়াছেন; কিন্তু শুনা যায় বৃদ্ধ বয়সে তিনি শাহাজাদা দারার হস্তে বন্দী; তাঁহার দুঃখকষ্টের সীমা নাই। সম্রাট মনে করিলেন ইহা সুলক্ষণ।

দরবারে উপস্থিত সেনানীমণ্ডলের মধ্যে দারার মিত্র অপেক্ষা গুপ্ত শত্রুই ছিল বেশি। শাহজাহান তাঁহার শ্বশুর ইতমাউদ্দৌলার প্রাসাদ এবং বাজেয়াপ্ত সম্পত্তির এক অংশ শাহজাদা দারাকে দিয়াছিলেন। এইজন্য রাজশ্যালক শায়েস্তা খাঁ প্রথম হইতে সম্রাট এবং তাঁহার প্রিয় পুত্রের উপর ইহার শোধ লইবার জন্য আওরঙ্গজেবের পক্ষ লইয়াছিলেন। দাক্ষিণাত্য এবং গুজরাটের সংযোগস্থল সুবা মালবা এই সময়ে মাতুল শায়েস্তা খাঁর হাতে নিরাপদ নহে মনে করিয়া, দারার অনুরোধে সম্রাট তাঁহাকে দরবারে তলব করিয়াছিলেন। শাহজাদা দারা মেসো খলিলউল্লা খাঁ এবং জাফর খাঁর কোনও অনিষ্ট করেন নাই; কিন্তু শাহানশাহের ভায়রাভাই হইয়াও তাঁহারা সুখী ছিলেন না। সম্রাটের শ্যালিকাদ্বয়ের শাহী মেজাজ, উহার উপর বাদশাহী আশকারা মস্কারা*; সম্রাটের প্রতি সন্দেহ ও আক্রোশ অন্য কোনও পথ না পাইয়া তাঁহার প্রিয়তম পুত্রের প্রতি হয়তো অহেতুকী ঈর্ষার খাতে প্রবাহিত হইয়াছিল। বাদশাহী তোপখানা বিভাগের অধ্যক্ষ “মীর আতস” কাসিম খাঁ বকধার্মিক দরবারী; তাঁহার ভয় ছিল শাহজাদা দারা বাদশাহ হইলে শাহজাদার তোপখানার মীর আতস অপদার্থ জাফর তাঁহাকে ডিঙাইয়া যাইবে; এইজন্য তিনি আওরঙ্গজেবের জয় কামনা করিতেন। প্রবীণ সেনাধ্যক্ষ রুস্তম খাঁ বাহাদুর দলাদলির মধ্যে ছিলেন না, ভালোমন্দ সম্রাটের উপর ছাড়িয়া দিয়া হুকুম তামিল করিবার জন্য সর্বদা প্রস্তুত। দারা তাঁহার সদ্গুণের শ্রদ্ধা করিতেন, তাঁহাকে বিশ্বাস করিতেন।

[*মানুচী লিখিয়াছেন, লোকে কানাঘুষা করিত এবং বেয়াদব ফকিরেরা নাকি বলিত – শ্যালিকাদের একজন বাদশাহী “ছোট হাজারী”, অন্যজন দুপুরের “বড় নাস্তা”। সত্যমিথ্যা খোদাতালাই জানেন, “দুর্জনের হাত হইতে কাহারও রেহাই নাই।]

শাহজাদা আজীবন হিন্দুর উপকার ব্যতীত কোনও অনিষ্ট করেন নাই, শাহী দরবারে আকবরের মৃত্যুর পর হইতে স্তিমিত রাজপুত গৌরব তাঁহারই সহৃদয়তা এবং পৃষ্ঠপোষকতায় শাহজাহানের রাজত্বের শেষভাগে শেষবারের মতো জ্বলিয়া উঠিয়াছিল। দারার প্রধান ভরসা ছিলেন সাম্রাজ্যের রাজপুত সামস্তগোষ্ঠী। রাঠোরকুল সম্রাট শাহজাহানের মাতুলবংশ, কচ্ছবাহগণ আকবরশাহী আমল হইতে শাহী পরিবারের সহিত বিবাহ সম্পর্কে আবদ্ধ; ইঁহারাই ছিলেন দরবারে হিন্দুর মুখপাত্র। স্বাতন্ত্র্যাভিমানী শিশোদিয়া কোটা-বুন্দীর ভীমকর্মা হাড়াবংশ, অমিতবিক্রম গোর রাজনীতি সম্পর্কে উদাসীন, রাঠোর-কচ্ছবাহ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিরপেক্ষ। মহারাণা রাজসিংহ সন্ধি ভঙ্গ করিয়া চিতোর দুর্গের সংস্কারসাধন করিয়াছিলেন। এই অপরাধ এবং অন্যান্য ব্যাপারের জন্য সম্রাট শাহজাহান মেবারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করিয়া ত্রিশ হাজার সৈন্যসহ আওরঙ্গজেবের বন্ধু উজির সাদুল্লা খাঁকে মহারাণার বিরুদ্ধে প্রেরণ করিয়াছিলেন (১৬৫৪ ইং)। যুদ্ধ করিয়া রাজ্য ও মানরক্ষার জন্য হঠকারিতাবশে মহারাণা চিতোর রক্ষার্থ প্রস্তুত হইলেন; কিন্তু ধর্মোন্মাদনায় প্রতিহিংসাপরায়ণ সাদুল্লা খাঁ ও মুজাহিদগণ (ধর্মযোদ্ধা) আরাবল্লীর পাদদেশস্থ সমগ্র সমতলভূমি দখল করিয়া ছারখার করিল। সম্রাট স্বয়ং আজমীরে উপস্থিত হইলেন। মহারাণার সাহস টুটিয়া গেল। জয়সিংহের কাছে দারার লিখিত পত্রে মহারাণার জন্য দারার দুর্ভাবনা ও সহানুভূতি বিশেষভাবে প্রকাশ পাইয়াছে। কিন্তু তখন আলাহজরতের জেহাদী মেজাজ। অবশেষে মহারাণা সাদুল্লার শত্রু দারার শরণাপন্ন হইয়া বশ্যতা স্বীকারের অভিপ্রায় জানাইয়াছিলেন। দারা অনেক কষ্টে সম্রাটের ক্রোধ শান্ত করিয়া সন্ধিস্থাপন করাইলেন; কিন্তু সাদুল্লা খাঁকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য মহারাণার পুর মাণ্ডল প্রভৃতি কয়েকটি পরগণা (বর্তমান মুসলমান রিয়াসৎ জাওরা) বাজেয়াপ্ত করিয়া লইলেন; সাদুল্লা গাজী হইয়া চিতোরকে পুনরায় ধ্বংস করিলেন। দারার পক্ষে ইহার ফল হইল বিপরীত। দারার প্রতি মহারাণার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা দূরে থাকুক, তিনি উদয়করণ চৌহান এবং শঙ্করভট নামক দুইজন দূতকে গোপনীয় কূটনৈতিক প্রস্তাব লইয়া দাক্ষিণাত্যে আওরঙ্গজেবের নিকট প্রেরণ করিয়াছিলেন এবং বন্ধুত্বের উপঢৌকন স্বরূপ শাহজাদার নিকট হইতে তাঁহার অতি বিশ্বস্ত দূত ইন্দ্ৰভট এং ফিদাই খোজা মারফত একপ্রস্ত খেলাত, একটা হাতি এবং একটি হীরকাঙ্গুরীয়ক পাইয়া ধন্য হইলেন ও সুদিনের (?) প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। এইভাবে “হিন্দুকুল-সূর্য” মহারাণা রাজসিংহ হিন্দুজাতির ভাগ্যাকাশে উদিত হইয়াছিলেন

মোগল সিংহাসনের দুই মহাসিংহ জয়সিংহ-যশোবন্তকে লইয়া এই সঙ্কটে সম্রাট এবং শাহজাদা দারা কিঞ্চিৎ বিব্রত হইয়া পড়িয়াছিলেন। বয়সে এবং সামরিক অভিজ্ঞতায় মির্জা রাজা জয়সিংহের সমান না হইলেও যশোবন্ত তাঁহার এক মাস পূর্বেই ছয় হাজারী মনসবদার হইয়াছিলেন এবং আরও কিছু আগে “রাজা” হইতে উন্নীত বংশানুক্রমিক “মহারাজা” উপাধি পাইয়াছেন। ইহাতে মির্জা রাজা নিজেকে উপেক্ষিত এবং কচ্ছবাহ কুলকে অপমানিত মনে করিলেন এবং বহু শতাব্দীর পুরাতন অথচ বর্তমানকাল পর্যন্ত অনির্বাণ রাঠোর কচ্ছবাহ বৈরাগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়িল।

মারোড়ারের মরদ (“মারোড়ারী” নহে), বিকানীরের উট, জয়শলমীরের স্ত্রীলোকের রাজস্থানে জুড়ি নাই বলিয়া আজও প্রসিদ্ধি আছে। সেকালে জাঁদরেল চেহারা, বেপরোয়া হিম্মত ও হমবড়া দেমাকে শাহী দরবারে পাঠান ব্যতীত রাঠোরের জুড়ি ছিল না। রাঠোরের নজরে যোধপুরের বাহিরে “মরদ” কোথায়? কচ্ছবাহ? তাঁহার তিন হাত দেহে সাড়ে তিন শত প্যাচ, তলোয়ারের ধারে চামড়া কাটে তো হাড় কাটে না। কচ্ছবাহের কাছে রাঠোর আর যাহাই হউক অন্তত “ভদ্রলোক” নহে; বাজরার রুটি খায়, আদবকায়দা মানে না; অকারণে ঝগড়া বাধাইয়া বসে; মাথায় গোঁ আছে, মগজ নাই; হুজুর “হাঁ” মুখে আনিতেই রাঠোর হামলা করিয়া বসে, কচ্ছবাহ “হাতরাস”* ঘুরিয়া যাইবার ঈশারা বুঝিয়া থাকে।

[*এন-আর-এল জংশন।]

শাহজাহানের দরবারে উক্ত দুই প্রতিস্পর্ধী রাজপুত-সিংহের মনোভাব ইহা অপেক্ষা ভালো ছিল না, সমানতালে পিঠ না চাপড়াইলে মালিকের বিপদ।

শাহজাহান যশোবন্তকে স্নেহ করিতেন, মির্জা রাজাকে শ্রদ্ধা ও সমীহ করিতেন; দুইজনের উপরই তাঁহার সমান বিশ্বাস––তবে মির্জা রাজাকে বেশি কাজের লোক মনে করিতেন। যশোবন্তকে দূরে রাখিয়া আওরঙ্গজেব জয়সিংহকে তাঁহার পক্ষে টানিবার চেষ্টায় ছিলেন; কিন্তু রাজপুত হইলেও মির্জা রাজা গভীর জলের মাছ, বুদ্ধি ও নীতিনৈপুণ্যে আওরঙ্গজেবের টক্কর লইবার মতো পাকা খানদানী “মোগল”। চরিত্র হিসাবে দারা এবং আওরঙ্গজেব যাদৃশ বিপরীত, দারার প্রিয়তম বন্ধু মহারাজা যশোবন্ত এবং জয়সিংহের মধ্যেও হুবহু ওইরূপ বৈপরীত্য লোকচক্ষুর আগোচর ছিল না। মির্জা রাজা দাক্ষিণাত্যে বলখ-বদকশানে কান্দাহারে আওরঙ্গজেবের অধীনে যুদ্ধ করিয়াছিলেন, কান্দাহারের তৃতীয় অভিযানে যোদ্ধা, লোকনায়ক এবং মানুষ হিসাবে শাহজাদা দারাকে যাচাই করিবার সুযোগও তিনি পাইয়াছিলেন, সুতরাং ঘোড়া সওয়ার চিনিয়া ফেলিয়াছিল। মির্জা রাজা মহারাজা যশোবন্ত নহেন, এক পা ফেলিয়া আর এক পায়ে সামনের মাটি হাতড়াইয়া দেখা তাঁহার চিরকালের অভ্যাস; আকবরশাহী আমলের প্রাণে মায়াহীন, স্বার্থে উদাসীন মজবুত “রাজপুত” তিনি নহেন; বন্ধুত্বের খাতিরে মিথ্যা অভিমানে ঔদার্যের প্রেরণায় বিপদ ডাকিয়া আনিয়া নিজের ভবিষ্যৎ স্বার্থকে বিপন্ন করিতে পারে নির্বোধ রাঠোর, কচ্ছবাহ নহে। মির্জা রাজা দরবারে কার্যহানি হইবার ভয়ে দারাকে বাহিরে খোশামোদ করিতেন, অথচ ভিতরে অবিশ্বাস ও বিদ্বেষের ভাব।

সম্রাট শাহজাহান আম্বের যোধপুরের সহিত কোনও পুত্রের বিবাহ-সম্বন্ধ করেন নাই; এক ডোগরা রাজপুত রাজা-রাজ্ঞীর এক অপূর্ব সুন্দরী কন্যার সহিত আওরঙ্গজেবের বিবাহ দিয়াছিলেন। শাহজাদা দারা মির্জা রাজা জয়সিংহের সহিত মিত্রতা ঘনিষ্ঠতর এবং রাঠোর ও কচ্ছবাহ উভয় কুল রক্ষা করিবার উদ্দেশ্যে নাগোরের পরলোকগত রাজা অমরসিংহের কন্যা এবং মির্জা রাজা জয়সিংহের ভাগিনেয়ীর সহিত পুত্র সুলেমান শুকোর বিবাহ দিয়াছিলেন। পিতা কর্তৃক যোধপুরের গদি হইতে বঞ্চিত অমরসিংহ ছিলেন যশোবন্তের বৈমাত্রেয় জ্যেষ্ঠভ্রাতা। ১৬৫৩ হইতে ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লিখিত পত্রাবলী হইতে জানা যায়, মির্জা রাজাকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য অনেক কিছু করিয়াছিলেন, এমন কি খোশামোদ পর্যন্ত করিয়াছেন; কিন্তু ফাটা বাঁশ ও ভাঙা মন জোড়া লাগিবার নহে। মির্জা রাজা মালা জপ করিতেন, ব্রাহ্মণভোজন করাইতেন; বোধহয় এইজন্য তাঁহাকে “হিন্দু” মনে করিয়া শাহজাদা তাঁহার কাছে চিঠির শিরোনামায় “সচ্চিদানন্দ” লিখিতেন। হিন্দুত্বের নামে ভিজিবার মতো মন যশোবত্তের ছিল, মির্জা রাজার নয়। তিনি হিন্দুর ভবিষ্যৎ বলিয়া কোনও বস্তুর কল্পনাও করিতে পারিতেন না; তাঁহার সঙ্গীর্ণ বাস্তবধর্মী মন নিজের স্বার্থ ও আম্বেরের ভবিষ্যতের গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ ছিল।

হিন্দুর উপকার ও ভারতীয় সংস্কৃতির উদ্ধার করিতে বসিয়াই দারা গোঁড়া মুসলমান সমাজকে শত্রুভাবাপন্ন করিয়াছিলেন, আওরঙ্গজেবকে “ইসলাম বিপন্ন” মিথ্যা চিৎকারে মুসলমানকে বিভ্রান্ত করিবার সুযোগ দিয়াছিলেন; অথচ হিন্দুর মোহনিদ্রা ভাঙিল না।

১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে অবস্থা চরমে উঠিল। মুঙ্গের হইতে শাহশুজা পূর্বমুখী না হইয়া সুবা এলাহাবাদের সীমান্ত অতিক্রম করিয়াছেন এবং শাহজাদা মোরাদ ও আওরঙ্গজেব মালবের দিকে সৈন্য চালনা করিতেছেন—এই সংবাদ পাইয়া সম্রাট অবশেষে বিদ্রোহী পুত্রগণের বিরুদ্ধে সৈন্য-সজ্জার আদেশ দিলেন। শাহজাদা দারার সর্বাপেক্ষা সুশিক্ষিত এবং বিশ্বস্ত যোদ্ধা লইয়া গঠিত বাইশ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী শাহশুজার বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য প্রস্তুত হইল। কুমার সুলেমান শুকো এই বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হইলেন। সুলেমানের বয়স তখন বাইশ বৎসর, পূর্বে কোনও গুরুত্বপূর্ণ অভিযান পরিচালনা করেন নাই; এই জন্য সম্রাট তাঁহার বিশ্বাসপাত্র প্রবীণ সেনানী সুচতুর মির্জা রাজাকে কুমার সুলেমানের “আতালিক” (উপদেষ্টা এবং অভিভাবক) নিযুক্ত করিয়া যুদ্ধ চালনার সম্পূর্ণ ভার তাঁহার উপরেই ন্যস্ত করিলেন। রাজা মানসিংহের পরে কোনও শাহাজাদার “আতালিক” হওয়ার সম্মান কোনও হিন্দুর ভাগ্যে ঘটে নাই। মহারাজা যশোবন্ত শায়েস্তা খাঁর স্থলে মালবের সুবাদার এবং শাহজাদা মোরাদকে বেরার সুবায় বদলি করিয়া মীর আতস কাসিম খাঁকে গুজরাটের সুবাদার নিযুক্ত করিলেন। রাঠোর, শিশোদিয়া, হাড়া, গৌর প্রভৃতি রাজপুত মনসবদারগণের সেনা লইয়া গঠিত এক বাহিনীর অধিনায়ক মনোনীত হইলেন সিংহবিক্রম মহারাজা যশোবন্ত সিংহ। মহারাজার সঙ্গে মীর আতস কাসিম খাঁ বাদশাহী মুসলমান লইয়া মালবে যাইবার আদেশ পাইলেন। ডিসেম্বর মাসের (১৬৫৭ ইং) শেষ সপ্তাহে দরবার হইতে উভয় বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ বিদায় লইয়া বিদ্রোহী শাহজাদাগণের অগ্রগতি রোধ করিবার জন্য যাত্রা করিলেন। বিদায় দেওয়ার সময় পর্যন্ত সম্রাটের মন দ্বিধাগ্রস্ত; সৈন্য প্রেরণ করিয়াও রক্তপাত নিবারণের জন্য তিনি উদ্বিগ্ন, পরিণাম ভাবিয়া শঙ্কাগ্রস্ত। আওরঙ্গজেব এবং মোরাদকে বলপ্রয়োগে নর্মদার অপর তীরে রাখিবার ভার যশোবন্তের উপর ন্যস্ত করিয়া তিনি পুত্রদ্বয়ের জন্য দুর্ভাবনায় পড়িয়াছিলেন; তাঁহার ভয় ছিল অমর্যপরায়ণ যশোবন্ত সুযোগ পাইলেই যুদ্ধ বাধাইবে, দারার পথ নিষ্কণ্টক করিবার জন্য পুত্রদ্বয়কে প্রাণে রেহাই দিবে না। এইজন্যই তিনি সিংহের লেজ টানিয়া ধরিবার জন্য বিশ্বাসঘাতক কাসিম খাঁকে সঙ্গে পাঠাইয়াছিলেন, কাসিম খাঁ মহারাজার হুকুমের অধীন না হইলেও যশোবত্তের সঙ্গে মিলিতভাবে কার্য করিবেন, আক্রান্ত না হইলে কিংবা মালব সুবা হাতছাড়া হইবার উপক্রম না হইলে বাদশাহী ফৌজ প্রথম আক্রমণ করিবে না ইহাই ছিল সেনাপতিদ্বয়ের উপর সম্রাটের আদেশ।

শুজার বিরুদ্ধে প্রিয়তম পৌত্র সুলেমান শুকোকে পাঠাইয়া সম্রাট অনুরূপ আশঙ্কায় অস্থির হইয়াছিলেন। সুলেমান নির্বিঘ্নে তাঁহার কাছে ফিরিয়া আসুক এবং শুজা অক্ষত শরীরে বাংলায় প্রত্যাবর্তন করুক ইহাই ছিল স্নেহাতুর বৃদ্ধ সম্রাটের আন্তরিক কামনা। ইহা চাপিয়া রাখিবার মতো মানসিক স্বাস্থ্য সম্রাটের তখন ছিল না। এই উভয় সঙ্কট হইতে একমাত্র স্থিরবুদ্ধি ও যুদ্ধকৌশল পরায়ণ মির্জা রাজাই মাথা ঠাণ্ডা রাখিয়া হাসিল করিতে সক্ষম। এই বিবেচনায় তিনি কুমার সুলেমানের রাশ টানিয়া ধরিবার জন্য মির্জা রাজাকে সঙ্গে পাঠাইয়াছিলেন এবং প্রয়োজনীয় মৌখিক উপদেশ তাঁহাকেই দিয়াছিলেন। দারার কার্যোদ্ধারের জন্য তিনি চলিয়াছেন; কিন্তু দারার উপর তাঁহার বিশ্বাস নাই। পাছে সম্রাটের নামে কোন আদেশ পাঠাইয়া শাহজাদা তাঁহাকে বিব্রত বিভ্রান্ত করেন এই আশঙ্কায় মির্জা রাজা তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র রামসিংহকে দরবারের হালচালের উপর নজর রাখিয়া সঠিক সংবাদ সরবরাহ করিবার জন্য আগ্রায় রাখিয়া গিয়াছিলেন। শাহজাহান পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়াছিলেন, বড় বড় যুদ্ধও করিয়াছিলেন। সুতরাং যোদ্ধা—বিদ্রোহী পুত্রের পিতার প্রতি মনোভাব তিনি হয়তো জানিতেন; তবুও এই দুর্বলতা কেন? বড় বড় সেনাপতিকে তিনি যুদ্ধ করিবার জন্য নয়, যেন লাঠি উঁচাইয়া সাপ তাড়াইবার জন্য পাঠাইয়াছিলেন। লড়াইয়ের ময়দানে সাপের মাথা ও লাঠি দুইটার জন্য সমান দরদ নিতান্তই বুদ্ধিভ্রংশের লক্ষণ। দারা নিরুপায়, বাদশাহী ফৌজ জয়সিংহ-কাসিম খাঁর আনুগত্য তাঁহার প্রতি নয়, তাঁহার হুকুম সম্রাটের জীবদ্দশায় তামিল করিতে তাঁহারা বাধ্য নহেন। যশোবন্তের উপর কাসিম খাঁ, তেজস্বী সুলেমানের উপর জয়সিংহ দুই জগদ্দল পাষাণ লইয়া সম্রাটের সৈন্যদল ডিসেম্বর মাসের (১৬৫৭ ইং) শেষ সপ্তাহে বিজয়োল্লাসে আগ্রা হইতে যাত্রা করিল।

কুমার সুলেমান শুকো দারার পুত্র হইলেও বাইশ বৎসর বয়সে সাহস, বুদ্ধিমত্তা ও কর্মতৎপরতায় উদীয়মান শাহজাদা আওরঙ্গজেব। তাঁহার নিজের মনসবদারী ফৌজ এবং তাঁহার পিতার বিশ্বস্ত সৈন্যবাহিনী জয়সিংহের অধীনে বাদশাহী ফৌজ অপেক্ষা সংখ্যাগরিষ্ঠ ও অধিক শক্তিশালী ছিল। তিনি দ্রুত লম্বা লম্বা মঞ্জিলে অগ্রসর হইয়া যুদ্ধে ঝাঁপাইয়া পড়িবার জন্য অস্থির হইলেন, “সহসা ন বিদধীত ক্রিয়াম্‌” উপদেশে তাঁহাকে নিরস্ত করা জয়সিংহের পক্ষে কঠিন ব্যাপার হইয়া উঠিল। মির্জা রাজা স্থির করিয়াছিলেন, সম্রাটের ইচ্ছানুরূপ তিনি শাহশুজাকে চালেই হঠাইবেন, অসতর্ক অবস্থায় বাদশাহী ফৌজের কোন অংশকে আক্রমণ করিয়া অবকাশ শত্রুকে দেওয়া হইবে না। যমুনা পার হইয়া মির্জা রাজা এই ব্যূহ রচনা করিবার মামুলি কায়দামতো কুচ করিতে লাগিলেন যেন শাহজা ইটাবা-ফতেপুর দখল করিয়া বসিয়া আছেন! এইরূপ অনর্থক বিলম্ব সুলেমানের পক্ষে অসহনীয় হইয়া উঠিল, মির্জা রাজাও ফাঁপরে পড়িলেন। কুমার সুলেমান বাপের মতো সকলকেই ভালোমানুষ মনে করিতেন না; পিতামহের স্নেহাবিল দুর্বল নীতিও তাঁহার মনঃপূত ছিল না; কিন্তু মির্জা রাজার সহায়তার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে তিনি খুল্লতাত আওরঙ্গজেবের মতই সজাগ ছিলেন। এই অভিযানের সময় সুলেমান অগ্রগামী সেনাদল লইয়া কিঞ্চিৎ দ্রুত অগ্রসর হইতেছিলেন, মির্জা রাজার অধীনে মূল বাহিনী পিছনে থাকিত; এইজন্য দুইজনেই পরস্পরের প্রতি পরোক্ষে দোষারোপ করিয়া দরবারে চিঠি লিখিয়াছিলেন। জয়পুর দরবারে রক্ষিত এই সমস্ত “আখবরাত” বা দৈনন্দিন সংবাদ তালিকাভুক্ত চিঠির নকল পড়িলে বুঝা যায়, দারা ও সম্রাট যেন জয়সিংহের কাছে তটস্থ; তাঁহাদের নিশান ফরমানে হুকুম অপেক্ষা তোয়াজ অনেক বেশি—কিঞ্চিৎ তাড়াতাড়ি করিবার জন্য রাজার কাছে “অনুরোধ”, কুমার সুলেমানকে রাজার উপদেশমত কার্য করিবার কড়া নির্দেশ।

শীতকাল, ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ। চুনার দুর্গকে প্রদক্ষিণ পূর্বক উত্তরবাহিনী গঙ্গা কাশীযাত্রা সমাপ্ত করিয়া নগরীর অদূরে যেখানে আবার পূর্বগামিনী হইয়াছেন উহার বাঁকে কয়েক মাইল ভাটিতে সুবা বাংলার রণতরীবহর নদীবক্ষ অবরুদ্ধ করিয়া নঙ্গর ফেলিয়াছে; দক্ষিণ তীরে বালুকাভূমিতে গঙ্গার উচ্চ সুপ্রশস্ত পাড়ের উপর বহুদূর ব্যাপী শিবিরশ্রেণী রণকোলাহলে মুখর; বাংলার হস্তী অশ্ব ও পদাতিক বাহিনী এইখানে ছাউনি ফেলিয়া যুদ্ধের প্রতীক্ষা করিতেছিল। বারাণসীর ঘাটে গঙ্গার বুকে নবনির্মিত নৌসেতু; এই পুল পার হইয়া বাদশাহী ফৌজ বর্তমান রেলপুলের পূর্বমুখ হইতে আড়াই মাইল আন্দাজ উত্তর-পূর্বে বাহাদুরপুরে ছাউনি ফেলিয়াছিল; শাহশুজা অল্পের জন্যে ভ্রাতুষ্পুত্রের সঙ্গে বেনারসকে লক্ষ্য করিয়া ঘোড়দৌড়ের বাজিতে হারিয়া গেলেন। আগ্রা হইতে বেনারসের দূরত্ব সেকালের মাপেও প্রায় ৪০০ মাইল, এবং মুঙ্গের হইতে বেনারস অন্যূন ১৫০ মাইল। প্রায় একই সময়ে জানুয়ারির প্রথমে (১৬৫৮ ইং) বাদশাহী ফৌজ পশ্চিম হইতে বেনারসের দিকে অগ্রসর হইতেছিল। সাধারণত দিনে গড়পড়তা ৫ মাইলের বেশি রাস্তা চলা কোনও বড় ফৌজের পক্ষে সম্ভব ছিল না; বোধ হয় মির্জা রাজার ফৌজও এই হারে চলিয়াছিল। কেবল পায়ে হাঁটিলে কিংবা ঘোড়া দৌড়াইলে যুদ্ধযাত্রা হয় না; বাইশ হাজার মোগল ফৌজের কুচ বরযাত্রীর হাঁটা কিংবা বিরাট মিছিল আগাইয়া যাওয়ার তুলনায় শম্বুক গতিই বটে। প্রত্যেক মনসবদারের দুই প্রস্থ তাঁবু ও সরঞ্জাম; ভোরবেলা একটি চলমান নগর গুটাইয়া সন্ধ্যাবেলা পূর্বসজ্জিত আর একটি তাঁবুর শহরে রাত্রিযাপন––এই ব্যবস্থা না থাকিলে কুচ হয় না; মানুষের গরজ থাকিলে দৌড়াইতে পারে, কিন্তু কামানের গাড়ির বলদ নিজের চাল ছাড়িবার নহে। শাহশুজার সেনাবাহিনী গঙ্গার কূল ধরিয়া এবং তাঁহার নানা রকমের ছোটবড় জঙ্গী নৌকার বহর গুণ টানিয়া গঙ্গার উজানে কাশীর দিকে আসিতেছিল; এইজন্য তিনিও বাদশাহী ফৌজ অপেক্ষা দ্রুততর অগ্রসর হইতে পারেন নাই। সুতরাং মামুলি হিসাবে মুঙ্গের হইতে শাহশুজা ২৫ দিনে এবং মির্জা রাজার আগ্রা হইতে আশি দিনে বেনারস পৌঁছিবার কথা; কিন্তু সুলেমান শুকো চাচার হিসাব বানচাল করিয়া দিয়াছিলেন।

রাস্তায় কোন জায়গায় এবং কয় তারিখ কাশীর দিকে শাহশুজার সৈন্যচালনার সংবাদ বাদশাহী শিবিরে পৌঁছিয়াছিল জানা যায় না। শুজা বেনারস পৌঁছিতে পারিলে চুনার এবং এলাহাবাদ হাতছাড়া হইবে, এই কথা জানিয়াও মির্জা রাজা বিচলিত হইলেন না, শাহী ফৌজের মন্থর গতি দ্রুততর হইল না; কিন্তু যাযাবর তাতার রক্ত মোগলের ধমনীতে তখনও ঠাণ্ডা হয় নাই। কুমার সুলেমান শুকো জয়সিংহের হিন্দুস্থানী চাল ছাড়িয়া আদিম জঙ্গীসখানী কায়দায় ঘোড়ার জিন ও নিজের পিঠে গাঁটরী-কম্বল বাঁধা কয়েক হাজার অশ্বারোহী লইয়া ঝড়ের বেগে বেনারসের দিকে ছুটিলেন এবং দশ দিন প্রায় একটানা ঘোড়া দৌড়াইয়া জানুয়ারি মাসের ১৯/২০ তারিখে শহরে প্রবেশ করিলেন, মানের দায়ে মির্জা রাজা পিছে পিছে হাঁফাইতে লাগিলেন। যাহারা পিছনে পড়িয়াছিল তাহাদিগের জন্য কাশীতে তিন দিন অপেক্ষা করিয়া ত্বরিতকর্মা কুমার সুলেমান চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে প্রশস্ত নৌসেতু নির্মাণ করিয়া ফেলিলেন। গঙ্গার এই পারে থাকিয়া নৌ-বলে বলীয়ান খুল্লতাতকে বাধা দেওয়া অসম্ভব বিবেচনা করিয়া সম্ভবত ২৩শে জানুয়ারি (১৬৫৮ ইং) সুলেমান গঙ্গা পার হইয়া বাহাদুরপুরে ছাউনি ফেলিয়াছিলেন। ২৪শে জানুয়ারি বাহাদুরপুরের কাছাকাছি পৌঁছিয়া শাহশুজা সংবাদ পাইলেন ভ্রাতুষ্পুত্র কাশী ও চুনারের পথ আগলাইয়া সেনা সন্নিবেশ করিয়াছেন, সুতরাং এই যাত্রা কাশীপ্রাপ্তির আশা ভঙ্গ হওয়ায় বাহাদুরপুরের ২/৩ মাইল উত্তর-পূর্বে গঙ্গার ধারে উচ্চভূমির উপর শিবির সন্নিবেশ করিয়া আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছিলেন।

মির্জা রাজার ভাবগতিক দেখিয়া বাদশাহী ফৌজ নিরুৎসাহ হইয়া পড়িয়াছিল। কিন্তু বাহাদুরপুরের শিবিরে কনৌজের ফৌজদার বিখ্যাত যোদ্ধা দেলের খাঁ রোহিলা কয়েক হাজার দুর্ধর্ষ পাঠান সৈন্য লইয়া কুমার সুলেমানের সাহায্যার্থ মিলিত হওয়ায় তাহারা জয়ের আশায় আবার উৎফুল্ল হইয়া উঠিল; জয়সিংহ কিন্তু একাধিক কারণে অসোয়াস্তি বোধ করিতে লাগিলেন। দেলের খাঁর সহিত বয়সের কম পার্থক্য এবং পাঠানের সাহস ও সরলতার গুণে কুমার সুলেমান তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়িলেন, মির্জা রাজার সহিত কুমারের মনের ব্যবধান আরও দূরতর হইয়া গেল। বাহাদুরপুরে যুদ্ধ অচল অবস্থায় পৌঁছিয়াছিল, কোনও পক্ষের হাতেই যুদ্ধোদ্যম রহিল না। উভয় সেনার মধ্যে স্বল্প অথচ দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান। শাহশুজার শিবির একটি সুরক্ষিত বন-দুর্গ; উত্তরে গঙ্গা, দক্ষিণ-পশ্চিম হইতে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব ঘিরিয়া বহুদূর দীর্ঘ এবং অন্যূন আড়াই মাইল প্রস্থ অর্ধচন্দ্রাকৃতি অননুপ্রবেশ্য অরণ্যভূমি। বর্ষায় গঙ্গার প্লাবনে পাড় ভাঙিয়া এই জঙ্গল জলে ভরিয়া যায়, কাঁটা বাবুলগুলির মাথা শুধু দেখা যায়। বাহাদুরপুর হইতে বর্তমান আলীনগর ছাউনি এবং মোগলসরাই ছাড়াইয়া আরও পূর্ব পর্যন্ত গঙ্গার দক্ষিণে এই অনূপ ভূমি এখনও অনাবাদী কাঁটা বাবুল ও ঝোপে ভরা জঙ্গল। শীতকালে টানের সময় জঙ্গলের মাটিতে মাঝে মাঝে বড় বড় ফাটল ১০/১২ হাত গভীর স্বাভাবিক পরিখা সৃষ্টি করিয়া থাকে। জঙ্গল কাটিয়া নালা খাদ সমান করিয়া তোপখানা ও অশ্বারোহীর চলাচলের উপযুক্ত রাস্তা প্রস্তুত করিলেও শুজার বাহিনীকে নাগাল পাওয়া অসম্ভব; বাংলার নৌবহর অনায়াসে শুজার সৈন্যকে গঙ্গার অপর পারে সরাইয়া লইতে পারে। শুজার রসদের ভাবনাও নাই, নদীপথ সম্পূর্ণরূপে উন্মুক্ত, বেনারস জেলা হইতে বাদশাহী ফৌজ রসদ সংগ্রহ বন্ধ করিলে গাজীপুর বালিয়া জেলা হইতে নৌকায় রসদ আসিয়া পড়িবে। সুতরাং শাহশুজাকে বেকায়দায় যুদ্ধে নামাইবার সাধ্য বাদশাহী ফৌজের নাই; লড়াই করা না করা অপর পক্ষের মর্জি। আপাতত জঙ্গল কাটা ছাড়া উপায় না দেখিয়া মির্জা রাজা গোকুল উঝাইয়া নামক স্থানীয় এক ভোজপুরিয়া জমিদারকে বাদশাহী মনসবের লোভ দেখাইলেন, জমিদারের লোকজন জঙ্গল কাটিতে লাগিল; কিন্তু ইহা “বাইশ মণ তেল” পোড়াইবার ব্যাপার।

বাহাদুরপুরে এইভাবে সময়ক্ষেপ হইতেছে দেখিয়া সম্রাট ও দারা অত্যন্ত বিচলিত হইয়া পড়িয়াছিলেন। দক্ষিণ হইতে সংবাদ আসিল যশোবন্ত নর্মদাতীরে পৌঁছিবার পূর্বেই আওরঙ্গজেব সসৈন্য নদী পার হইয়া শাহজাদা মোরাদের আগমন প্রতীক্ষা করিতেছেন। বিহার সুবা পাইয়াও শাহশুজা বেইমানী করিল দেখিয়া সম্রাট আগুন হইয়াছিলেন। আগ্রার দরবার-ই-আমে তিনি কুমার রামসিংহকে বলিলেন, রাজার কাছে লিখিয়া দাও, ওই “বেয়াদবে”র মাথাটা আমি চাই। দারা এক চিঠিতে এই কথা মির্জা রাজাকে জানাইয়া লিখিলেন—আমার কথায় বিশ্বাস না হয় আপনি কুমার রামসিংহের নিকট লিখিতে পারেন। যুদ্ধ পরিচালনা লইয়া পূর্ববৎ কুমার সুলেমান এবং রাজার অভিযোগ ও পালটা অভিযোগ দরবারে পৌঁছিতেছিল। সেখান হইতে কুমার সুলেমান পাইলেন মৃদু তিরস্কার; রাজার উপর বর্ষিত হইল প্রশংসা ও খোশামোদের গোলাপজল। এক চিঠিতে দারা লিখিলেন, শাহানশার মুখে দৈববাণী হইয়াছে, রাজা মানসিংহ যেমন অল্প সময়ে মির্জা হাকিমকে দমন করিয়াছিলেন সেইরূপ মির্জা রাজাও এই “বেয়াদব বখত”কে নাস্তানাবুদ করিবেন। উহার পরের দিন শাহজাদা আর এক চিঠি ডাকা চৌকি মারফৎ ছাড়িয়া জানাইলেন—গত রাত্রিতে আমি সুফী-তরিকায় ধ্যানে বসিয়া জানিয়াছি এবং নজুমী কেতাবে পাইয়াছি, একটা বড় রকমের জয়লাভ আপনার ভাগ্যে আছে; এই প্রকার গায়েবী ব্যাপার আল্লার হেদায়তে (নির্দেশে) আমি সত্য বলিয়া দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

দারার অন্যান্য চিঠি পড়িয়া মনে হয়, এই সময়ে আলাহজরতের মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছিল; আগ্রায় বসিয়া একদিন বলিতেছেন রাজা হতভাগার (শুজার) মুণ্ড কাটিয়া ফেলিয়াছেন; পরের দিন বলিতেছেন কাটা মাথা দরবারে রওনা হইয়া গিয়াছে! দারা রাজাকে জানাইলেন, শাহানশাহ্ আদেশ করিয়াছেন যদি শত্রুকে স্থানচ্যুত করিবার কোনও উপায় সম্বন্ধে আপনি মনস্থির না করিয়া থাকেন, ওইখানকার অবস্থা বিশদভাবে লিখিবেন, দরবার হইতে শাহানশাহ একটা পরিকল্পনা পাঠাইয়া দিবেন। আর এক চিঠিতে মির্জা রাজাকে জরুরি আদেশ প্রেরিত হইল––সামনে তোপখানা রাখিয়া যেন অবিলম্বে জঙ্গলবেষ্টিত আশ্রয়স্থানের উপর আক্রমণ করা হয়।

কচ্ছবাহপতি যুদ্ধ করিয়া চুল পাকাইয়াছেন। তিনি জানিতেন––বাংলার ফৌজ টিয়া পাখির ঝাঁক নহে, ফাঁকা আওয়াজে পলাইবে না। মালা জপ করিলেও ধূর্ততা এবং স্বার্থবুদ্ধিতে মির্জা রাজা পাকা মোগল; তাঁহার এক চোখ সামনে শুজার উপর, অন্য চোখ মালবে যশোবন্ত-আওরঙ্গজেবের উপর। কুমার সুলেমান বুঝিতে পারিলেন যুদ্ধের গরজ তাঁহার পিতার, মির্জা রাজার নহে।

শাহশুজা বাহাদুরপুরের নিকট গঙ্গাতীরে ২৫শে জানুয়ারি হইতে একুশ দিন নিজের সুরক্ষিত শিবিরে নিশ্চিন্ত মনে অভ্যস্ত আরামেই দিন কাটাইতেছিলেন। তিনি বাংলা দেশ হইতে মশারি (পশাদান) লইয়া গিয়াছিলেন; তাঁহার আমীর ওমরাহ সিপাহী বরকন্দাজ কেহই বোধ হয় সফরে মশারি ফেলিয়া যায় নাই। মশারির ভিতর নাকি পাঞ্জাবী হিন্দুস্থানীর দম আটকাইয়া যায়; কিন্তু মোটা কম্বলে নাক মুখ গুঁজিয়া থাকিলে শ্বাসকষ্ট হয় না। শাহশুজার ফৌজে মোগল পাঠান খোট্টা বাংলা মুলুকে সতের বৎসর মশার কামড় খাইলে বাহাদুরপুরে যুদ্ধ করিতে আসিতে হইত না। বাংলার মাটির গুণে পেশওয়ারী পাঠান, দুবে চোবে খোট্টা ভোজপুরিয়া সাত বৎসরেই মোলায়েম “বঙ্গালী” হইয়া যায়, সতের বৎসরে শুজার সিপাহী নিশ্চয়ই “বাঙালি” হইয়া গিয়াছিল, বাঙালির “মশার মশারি” কি বস্তু তাহারা বুঝিয়াছিল; বিলাসী ও দরদী শাহজাদার দৌলতে তাঁহার অনুযাত্রীবর্গের কাছে ঢাকা-রাজমহল এবং লড়াইয়ের ডেরার মধ্যে গঙ্গাপারের কনকনে শীত ছাড়া আর কোনও তফাত মালুম হইবার কথা নয়। কয়েক দিন পরেই যুদ্ধের গরমে ঠাণ্ডা পড়িয়া গিয়াছিল, জঙ্গল কাটার আওয়াজ কান সহা হইয়া গেল। পাহারার ব্যবস্থায় শুজা কোনও ত্রুটি করেন নাই; জঙ্গলের আড়ালে তাঁহার অগ্রবর্তী ঘাঁটি হইতে সিপাহীগুলি শত্রুর গতিবিধির উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখিত, রাত জাগিয়া পাহারা দিত, যদিও কোনও নৈশ আক্রমণ সম্ভব ছিল না। যে স্থানে এখনও দিনের বেলায় ছাগল ছাড়া কোনও জন্তু পথ পায় না সেখানে রাতের মানুষ কি করিবে? শাহশুজা যুদ্ধ করিবার জন্য আদৌ ব্যস্ত ছিলেন না; সময় ও স্থান দুই তাঁহার অনুকূল। জঙ্গলের মধ্যে বাংলার পায়দল সিপাহী ও হাতি, জলে বিরাট রণতরী বহরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবার শক্তি বাদশাহী ফৌজের ছিল না; সুতরাং জঙ্গল সাফ করিতে করিতে হয় বর্ষা নামিয়া আসিবে, না হয় আওরঙ্গজেব-মোরাদকে ঠেকাইবার জন্য জয়সিংহের ডাক পড়িবে—এই জন্য কোনও রকমে কালহরণ করাই ছিল শুজার উদ্দেশ্য; কিন্তু সময়ের সহিত না দৌড়াইয়া বিপক্ষের উপায় নাই।

বৃদ্ধ মির্জা রাজার অপেক্ষা করিয়া বসিয়া থাকিবার কায়দা কুমার সুলেমানের আদৌ মনঃপূত ছিল না, অথচ তাঁহার অমতে কিছু করিবার উপায় নাই। এত দিন সুলেমান নিশ্চেষ্ট বসিয়া থাকেন নাই। তিনি বিশ্বাসী গুপ্তচরসমূহ শাহশুজার শিবিরে নিযুক্ত করিলেন এবং স্বয়ং তাঁহার অনুচরণগণকে লইয়া জঙ্গলের মধ্যে চোরা রাস্তা বাহির করিবার উদ্দেশ্যে ওই এলাকায় এখানে-সেখানে ঘুরিয়া বেড়াইতেন। জঙ্গলে অসমসাহসিক চোরা হামলায় রোহিলা পাঠান ময়দানের হিন্দুস্থানী সওয়ার অপেক্ষা বেশি ওস্তাদ; এবং দেলের খাঁ রাজা অপেক্ষা বেশি নির্ভরযোগ্য—এইজন্য সুলেমানের যাহা কিছু পরামর্শ তাহা খুব সম্ভব দেলের খাঁর সঙ্গেই চলিত। সুলেমানের গুপ্তচর সংবাদ আনিল দিনদুপুর পর্যন্ত ঘুমাইয়া থাকাই শাহশুজার অভ্যাস, রাত্রে চৌকি পাহারার বন্দোবস্ত থাকিলেও কোনও উপরিস্থ সেনানী সান্ত্রী-সিপাহীর থানা ঘুরিয়া দেখেন না; প্রহরীরা ভোর হইলেই ঘুমাইয়া পড়ে।

বাদবাকি সহজেই অনুমেয়। শুজার সেনানায়ক ও দরবারী বাহাদুরগণ বোধ হয় হুজুরের সহিত তাল রাখিয়া ঘুমাইতেন; সিপাহীরা চব্বিশ ঘণ্টা কোমর বাঁধিয়া মশার সহিত যুদ্ধ করা বুদ্ধির কাজ মনে করিত না। বাহাদুরপুরের আশপাশ হইতে শুজার শিবির পর্যন্ত পায়ে হাঁটিয়া যাইবার পথ ছিল না; কয়েক মাইল পূর্বদিকে যেখানে জঙ্গল প্রায় শেষ এবং গঙ্গার গতি কিঞ্চিৎ উত্তরমুখী হইয়া বাঁক সৃষ্টি করিয়াছে ইহাই বোধ হয় শুজার শিবিরের পশ্চাদভাগের খিড়কি-দরজার মতো ছিল। দরবারের তাগিদ ও কুমার সুলেমানের অনুরোধে মির্জা রাজা বাহাদুরপুর হইতে আসন গুটাইয়া অন্যত্র ছাউনি করিতে রাজি হইলেন। ১৩ই ফেব্রুয়ারি (১৬৫৮ ইং) সন্ধ্যাবেলা বাদশাহী শিবিরে ঘোষণা করা হইল দিনভোরে সকলকে ডেরা উঠাইয়া কুচ করিবার জন্য প্রস্তুত থাকিতে হইবে।

১০

১৩ই ফেব্রুয়ারির রাত্রি শত্রু-মিত্র উভয় পক্ষের জন্যই “অদ্য রজনী”। ভোরের আঁধারে তল্পি-তল্লা বাঁধিয়া ঘোড়ার জিন, হাতির হাওদা কষিয়া, কামানবাহী গাড়িতে বলদ জুড়িয়া হাতিয়ার-বন্দ বাদশাহী ফৌজ যাত্রার জন্য প্রস্তুত; এমন সময়ে দূরে গঙ্গার তীর হইতে যুদ্ধধ্বনি ও কোলাহল জঙ্গল ভেদ করিয়া তাহাদিগকে সন্ত্রস্ত করিয়া তুলিল। ভিতরের ব্যাপার সম্ভবত মির্জা রাজাও জানিতেন না, জানিলে হয় বাধা দিতেন, না হয় সুলেমান ও দেলের খাঁর প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হইয়া, এমন কি শুজাকে সাবধান করিয়া দিতেও ইতস্তত করিতেন না। এইরূপ কার্য মোগল শিবিরে প্রায়ই হইত।

কুমার সুলেমান শুকো এবং দেলের খাঁ নিজ নিজ তাবিনের ফৌজ লইয়া কুয়াশার পর্দায় শুজার নিদ্রিত প্রহরীগণকে পাশ কাটাইয়া পশ্চাদভাগ হইতে হঠাৎ অপ্রস্তুত শত্রুকে আক্রমণ করিয়াছিলেন; যাহাদের ঘুম ভাঙিয়াছিল, জামা হাতিয়ার হাতড়াইতে হাতড়াইতে তাহারা বাধা দিবার অবকাশ পাইল না।

আক্রমণের লক্ষ্য ছিল শিবিরের মধ্যস্থলে শাহশুজার তাঁবুর খাসমহল। আয়েসী হইলেও শুজা বঙ্গাধিপতি লক্ষ্মণসেন নহেন। অকাল-জাগ্রত ব্যাগ্রের ন্যায় মুষ্টিমেয় বিশ্বস্ত যোদ্ধা পরিবৃত হইয়া তিনি সুলেমান ও দেলের খাঁর সম্মুখীন হইলেন, কিছুক্ষণ যুদ্ধ হইল। শুজাকে বন্দী করিবার উদ্দেশ্যে একজন যোদ্ধা মৃত্যুভয় তুচ্ছ করিয়া তাঁহার হাতির পায়ে আঘাত করিল; কিন্তু নির্ভীক আরোহী কিংবা আহত হস্তী পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিল না। ইতিমধ্যে মির্জা রাজা জয়সিংহ, অনিরুদ্ধ গৌর প্রভৃতি রাজপুত বীরগণ আসিয়া পড়িলেন। শুজার মাহুত প্রভুকে রক্ষা করিবার কোনও উপায় না দেখিয়া অঙ্কুশাঘাতে হাতিকে নদীর দিকে তাড়না করিল, খোঁড়া হাতি বাদশাহী বাহাদুরগণের ব্যূহ গলাইয়া চলিয়া গেল। হাতি গঙ্গায় ঝাঁপাইয়া পড়িতেই নৌবহর শাহশুজাকে তুলিয়া ভাটির দিকে ছুটিল; স্থলসৈন্যের বাদবাকি যে যেদিকে পারে পলাইয়া গেল; যাহারা নদীর ধারে ধারে নৌকায় উঠিবার জন্য কাতর চিৎকার করিতেছিল তাহাদিগকে বাঁচাইবার জন্য কোনও নৌকা কূলে ভিড়িল না। দুশমনের জান অপেক্ষা মালের উপর লোভ বেশি; সুতরাং লোকক্ষয় খুব বেশি হইয়াছিল মনে হয় না। শাহশুজার নগদে আসবাবে দুই কোটি টাকার সম্পত্তি বাদশাহী ফৌজের হাতে পড়িল। এইভাবে বাহাদুরপুরে বক্তিয়ার খিলজীর বঙ্গবিজয় পুনরায় অভিনীত হইয়াছিল।

১১

শাহশুজার পলায়নের ঘটনা লইয়া যুদ্ধ শিবিরে এবং পরে আগ্রা দরবারে অনেক জল্পনা ও কানাঘুষা চলিয়াছিল। জয়সিংহ সন্দেহ করিলেন কুমার সুলেমান তাঁহার সম্বন্ধে অপবাদ (?) রটাইয়াছেন, শাহজাদা দারা উহা শাহানশাহের কানে তুলিয়াছেন। এই কথা কোনও ব্যক্তি-বিশেষের নাম উল্লেখ না করিয়া সম্রাটের কাছে তিনি জানাইয়াছিলেন এবং উম্মা প্রকাশ করিয়াছিলেন। সত্য যাহাই হউক, মির্জা রাজাকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য অভিযোগের জবাবে সম্রাট লিখিয়াছিলেন—এই রকম কথা আমাকে কেহ জানায় নাই; আপনার প্রভুভক্তির উপর আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস এবং নির্ভরতার কথা সকলে এতই ভালো রকম জানে যে, আমার কাছে এমন বেয়াদবি কথা বলিবার দুঃসাহস কাহারও হইতে পারে না।

সরকারি মুনশীয়ানাকে সম্পূর্ণ সত্য বলিয়া নির্বিচারে গ্রহণ করিলে ইতিহাস হয় না, অবস্থার ফেরে পড়িয়া সরকারকে “অশ্বত্থামা হত-ইতি-গজ” করিতে হয়। বার্নিয়ার লিখিয়াছেন, “বাহাদুরপুরে যুদ্ধ না বাধাইবার চেষ্টা করিতে গিয়া জয়সিংহ অকৃতকার্য হইলেন…নিশ্চিতভাবে বলা যাইতে পারে যদি জয়সিংহ ও তাঁহার বুকের বন্ধু (?) দেলের খাঁ ইচ্ছা করিয়া হাত না গুটাইতেন, শত্রু-সৈন্য অধিকভাবে ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িত এবং সম্ভবত তাহাদের সেনাপতি (শাহশূজা) বন্দী হইতেন।” বানিয়ারের এই উক্তির মধ্যে কেবল দেলের খাঁর অংশটুকু মিথ্যা––যাহার জন্য দোষী সম্ভবত মির্জা রাজা স্বয়ং। সুলেমানের সহিত দেলের খাঁর ঘনিষ্ঠতা ভঙ্গ করিয়া পাঠানের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করিবার জন্য জয়সিংহের প্ররোচনায় তাঁহার চরগণ মন্দের ভালো হিসাবে দেলের খাঁর নামও এই অপবাদের সহিত জুড়িয়া দিয়াছিল। বার্নিয়ারের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত রচনার সময়ে পরে দেলের খাঁ রাজার অন্তরঙ্গ বন্ধু হইয়াছিলেন সত্য; কিন্তু বাহাদুরপুরে তাঁহারা মনে মনে অন্য রকম ছিলেন।

যাহা হউক, বাহাদুরপুর যুদ্ধের সরকারি ফতেহনামা বা বিজয়-পত্রিকায় জয়সিংহের জয়জয়কার, দারা ও শাহজাহান চিঠিপত্রে রাঠোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ; সুনাম এবং পুরস্কারের মোটা অংশ তাঁহার ভাগেই পড়িয়াছিল। এক হাজার “জাত” ও পাঁচ শত “সওয়ার” মনসবে ইজাপা পাইয়া মির্জা রাজা মহারাজা যশোবন্তের উপর টেক্কা মারিয়া “হপ্ত হাজারী” (সাত হাজারী) বা বাংলা কথায় “বড়লাট” হইয়া গেলেন। শাহজাদা দারা মির্জা রাজাকে সর্বাগ্রে অভিনন্দন জানাইয়া লিখিলেন, “এই যুদ্ধে আপনি যাহা ‘নিমকহালালি’, দানাই (বুদ্ধিমত্তা) এবং ‘সিপাই-গিরী’ (শৌর্য) জাহির করিয়াছেন, আমার বিশ্বাস স্বয়ং রাজা মানসিংহ উহা করিতে পারেন নাই; গত এক শত বৎসরের মধ্যে হিন্দুস্থানে এই রকম বিজয়লাভের সৌভাগ্য কাহারও হয় নাই।” বিপরীত অর্থে দারার কথাই ঠিক। রাজা মানসিংহ যদি আকবরশাহী আমলে এই প্রকার নিমকহালালি ও বাহাদুরি দেখাইতেন তাহা হইলে কাবুল বিহার বাংলা উড়িষ্যা মোগল সম্রাটের পদানত হইত না।

দেলের খাঁর ভাগ্যে জুটিল মির্জা রাজার অর্ধেক সম্মান পাঁচশতী প্রমোশন––যাহা মির্জা রাজার অধীনস্থ তৃতীয় শ্রেণীর মনসবদার রাজা অনিরুদ্ধ গৌরকেও দেওয়া হইয়াছিল। ইহাকেই বলে “ইতিহাস”––কে বা মারে মশা, কে বা “মারে” (খায়) যৌসা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *