১৯. দারার পরাজয় ও পলায়ন

ঊনবিংশতি অধ্যায় – দারার পরাজয় ও পলায়ন

(সামুগঢ়ের যুদ্ধ, ২৯শে মে, ১৬৫৮ খ্রিঃ)

আষাঢ়ের হ্রস্বযামা যামিনী প্রভাত হইবার পূর্ব হইতেই আগ্রার অদূরে সামুগঢ় প্রান্তরে দারা ও আওরঙ্গজেবের অনীকিনী যুদ্ধার্থ ব্যূহবদ্ধ হইতেছিল। প্রায় এক প্রহর রাত্রি থাকিতে দারা স্বল্পসংখ্যক দেহরক্ষী অশ্বারোহী পরিবৃত হইয়া শিবির হইতে বাহির হইয়া পড়িলেন। শিবিরের সম্মুখে সারিবদ্ধ তোপখানা, তোপগাড়ির পিছনে তোপখানার মনসবদারগণের তাঁবুর সারি, তাঁহাদের চাকর, খালাসি ও তোপের লটবহর। শাহজাদার অশ্বারোহিগণের জন্য তাঁবু উঠাইয়া রাস্তা করিবার হুকুম হইল। তাঁবুর সঙ্গে তোপখানার নূতন অফিসার ম্যানুসী সাহেবও উঠিয়া পড়িলেন। তিনি পূর্বে কখনও লড়াই দেখেন নাই; কিছুক্ষণ পরে রাতের আঁধারে তিনিও ঘোড়ার চড়িয়া বাহিরে কি হইতেছে দেখিবার জন্য চলিলেন; এই গোলমালে আরও অনেকে অন্য মতলবে গা-ঢাকা দিয়া বাহির হইয়া পড়িল। ছাউনির বাহিরে সাস্ত্রী পাহারা নাই, গুপ্তসঙ্কেত (passward) তলব করিবার বালাই নাই। কিছুদূর ঘোড়া দৌড়াইয়া ম্যানুসী এক গ্রামে পৌঁছিলেন, গ্রামটা উজাড়-জনমানবশূন্য, পাশে টিলার মতো উঁচু জায়গা। ওই টিলার উপর বসিয়া তিনি চারিদিক দেখিতেছিলেন; তখনও ভোর হওয়ার অনেক দেরি, বিপক্ষের কোনও সাড়াশব্দ নাই, অথচ ওই স্থান অতিক্রম করিয়া এ পক্ষের ঘোড়সওয়ার যাহারা যাইতেছে তাহারা ফিরিতেছে না। ভোরের কিঞ্চিৎ পূর্বে দেখা গেল—অপর দিক হইতে স্বল্পসংখ্যক অশ্বারোহী পরিরক্ষিত একদল পদাতিক ও কয়েকটি উট দ্রুত গাঁয়ের দিকে আসিতেছে। উহারা গাঁয়ের কাছে আসিয়া থামিয়া গেল এবং ছোট ছোট দলে বিভক্ত হইয়া কিছুদূরে স্থানগ্রহণ করিল; উটগুলির পিঠে গাদাকরা “বোমা” অর্থাৎ হাউইবাজি, পটকা, “হুক্কা” (ডাবার খোলাকৃতি পোড়ামাটির খোলে বারুদ ভর্তি সেকেলে হাতবোমা)। সূর্যোদয়ের পর দিগ্বলয় রেখায় দেখা গেল বিপক্ষ সেনা পাঁচ অশ্বারোহী দলে বিভক্ত অথচ অবিচ্ছিন্ন ভাবে সচল অরণ্যানীর ন্যায় নিঃশব্দে ধীরমস্থর গতিতে অগ্রসর হইতেছে।

আরও একটু আড়াল হইয়া ম্যানুসী সাহেব মনের সুখে বেলা আটটা পর্যন্ত তামাশা দেখিতেছিলেন, এমন সময় ছাউনি হইতে হুকুম আসিল- যাহারা বাহিরে আছে তাহারা জলদি লাইনে ঢুকিয়া পড়ুক, তোপদাগা শুরু হইবে। ম্যানুসী সাহেব ঘোড়া দৌড়াইয়া কোনক্রমে ছাউনিতে ঢুকিয়া পড়িলেন; একজন মোগল সওয়ারও ম্যানুসীর পিছে পিছে আসিতেছিল, তোপের প্রথম গোলায় বেচারা উড়িয়া গেল, অথচ তখনও বিপক্ষ সেনা অন্যূন তিনমাইল দূরে।

যাত্রার প্রাক্কালে আওরঙ্গজেব সেনাধ্যক্ষগণকে ডাকাইয়া প্রয়োজনীয় উপদেশ দেওয়ার পর বলিলেন, তোমাদের দৃষ্টিপথে আগ্রা, দৌলতাবাদ বহুদূর; পশ্চাতে চম্বল-নর্মদা, দুর্গম অরণ্য ও দুর্লঙ্ঘ্য বিন্ধ্যগিরি; বাহাদুরির ইনাম হিন্দুস্থানের ধনদৌলত ও দিল্লির বাদশাহি; ভীরুতার পরিণাম মৃত্যু ও অপমান; কাফের দারার কবল হইতে সম্রাটের মুক্তি ও ইসলামের ইজ্জত রক্ষার ভার তোমাদের উপর —আল্লা তোমাদের সহায়।

আওরঙ্গজেবের সেনা সংখ্যায় বোধ হয় চল্লিশ হাজারের বেশি ছিল না, মোরাদের দশ হাজার অশ্বারোহী লইয়া তোপখানার লস্কর ও পদাতিক বাদে মোট পঞ্চাশ হাজার অশ্বারোহী। সামনে অশ্বারোহী এবং পিছনে তোপখানা ও পদাতিকগণকে রাখিয়া আওরঙ্গজেব শিবির হইতে বেলা আটটায় যাত্রা করিয়াছিলেন, ঘোড়া-হাতিও প্রায় গাড়ির বলদের মতো শম্বুক গতিতে হাঁটিয়া চলিতেছিল। চারি ঘণ্টায় অনধিক চার মাইল খোলা ময়দান অতিক্রম করিয়া বেলা বারোটার সময় প্রায় মাইলখানেক দূরে আওরঙ্গজেবের অর্ধচন্দ্র পতাকা ও লৌহগোলক-চিহ্নিত ধ্বজা দারার বাহিনীর দৃষ্টিগোচর হইল। যুদ্ধস্থলে পৌঁছিবামাত্র তোপখানা পশ্চাৎ হইতে ব্যূহের অগ্রভাগে চলিয়া আসিল; তোপখানার আড়ালে অশ্বারোহীদল পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে শৃঙ্খলার সহিত ব্যূহবদ্ধ হইল; কোথাও চাঞ্চল্য নাই, বাহ্বাস্ফোটন নেই।

আওরঙ্গজেব নিজের জ্যেষ্ঠপুত্র কুমার মহম্মদ সুলতানকে দশ হাজার অশ্বারোহীসহ রণব্যূহের “হরাবল” বা সুচীমুখে স্থাপন করিলেন। কুমারের পাশেই তাঁহার সামরিক উপদেষ্টা-স্বরূপ রহিলেন “খানখানাঁ” উপাধির দ্বারা সদ্য সম্মানিত অমিত পরাক্রম বিচক্ষণ সেনানী নেজাবত খাঁ। হরাবলের যোদ্ধৃগণ সকলেই মুসলমান, বেশির ভাগই তাতার মোগল জাতীয়।

‘ব্যূহের বাম পক্ষের (Left Wing) পরিচালক আওরঙ্গজেবের দক্ষিণহস্তস্বরূপ শাহজাদা মোরাদবশ। ভীমকর্মা মোরাদের অধীনে দশ হাজার রণকুশল অশ্বারোহী — অধিকাংশই মোগল-তাতার জাতীয় পাকা সওয়ার। দক্ষিণ পক্ষ (Right Wing) পরিচালনার জন্য মনোনীত হইয়াছিলেন বিশ্বাসী সেনানী ইসলাম খাঁ। ইঁহার অধীনে বুন্দেলা, রাজপুত ও মুসলমানের পাঁচমিশাল ফৌজের মধ্যে দারার প্রতি বিশ্বাসঘাতক মহোবার রাজা চম্পরায় বুন্দেলা, ধামদেরার রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন এবং রাও ছত্রশালের পুত্র সিংহপরাক্রম ভগবন্ত সিংহ হাড়ার নাম উল্লেখযোগ্য।

অতঃপর উভয়পক্ষের স্নায়ু-যুদ্ধ কিছুক্ষণ চলিতে লাগিল।

পূর্বদিনের স্নায়ু যুদ্ধে দৃঢ়সত্ত্ব আওরঙ্গজেবের নিকট দারা পরাজিত হইয়াছিলেন; অপ্রস্তুত অবস্থায় শত্রুকে তিনি যুদ্ধে নামাইতে পারেন নাই, নিজে প্রস্তুত থাকিয়াও শেষ পর্যন্ত আওরঙ্গজেবকে আক্রমণ করিবার সাহস তাঁহার হয় নাই।

সেই দিন তিনি মাঝরাতে অকারণে বাহির হইয়া পড়িয়াছিলেন, সিপাহী সওয়ার মনসবদার কাহাকেও নিরুপদ্রবে ঘুমাইতে দেন নাই। আওরঙ্গজেব যথারীতি ব্রাহ্মমুহূর্তে শয্যাত্যাগ করিয়া চুপচাপ তসবী জপ করিতে করিতে হয় খোদাতালা না হয় লড়াইয়ের ধ্যান করিতেছিলেন, বাদবাকি মানুষ ও জানোয়ার নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাইতেছিল। পরের দিন সকাল আটটা বাজিতেই দারার ব্যূহবদ্ধ বিরাট বাহিনীর হাত-পা খিঁচুনি আরম্ভ হইল, চারিদিকে “আসিয়া পড়িল” চিৎকার; অথচ তখনও চার-পাঁচ মাইল দূরে আওরঙ্গজেব সবেমাত্র রেকাবে পা দিয়াছেন! সেইদিন ভোরবেলা দারার ছাউনিতে হিন্দু সিপাহীর খিঁচুড়ির ভঙ্গু ও মুসলমানের ডেগ চড়িয়াছিল কিনা সন্দেহ; বলদের জল-ভুষি, ঘোড়ার ঘাসদানা, হাতির খোরাকের খবর কে রাখিবে? দুশমনের টিকির দেখা নাই; অথচ গোলা দাগিবার হুকুম, লড়াইয়ের বাজনা ও অনর্থক হই-হল্লা। ইহা অপেক্ষা স্নায়ু-বিকারের আর কি লক্ষণ থাকিতে পারে? ইহার উপর দিন বারোটা পর্যন্ত আষাঢ় মাসের রৌদ্র মাথায় করিয়া ঠায় মাঠে দাঁড়াইয়া উদ্বেগ ও অপেক্ষা করিবার যন্ত্রণা ভোগ করিলে ৫০/৬০ হাজার সিপাহী লস্করের স্নায়ুবল অক্ষুণ্ণ থাকিবার কোনও কারণ নাই।

বাবরশাহী কায়দায় বন্দুকধারী পদাতিক রক্ষিত তোপখানা লইয়া খোলা ময়দানে লড়াই করিতে হইলে দুইটি কৌশল অপরিহার্য ছিল; প্রথমত তোপখানাকে পাতলা অশ্বারোহীশ্রেণীর পর্দার আড়ালে রাখিয়া শত্রুকে প্রথম আক্রমণের জন্য প্ররোচিত এবং প্রলোভিত করা; দ্বিতীয়ত শত্রুর আক্রমণকে তোপখানার সম্মুখে প্রতিহত করিয়া নিজের দক্ষিণ ও বাম পক্ষের বাহিরে পার্ফিঘাতক সঞ্চরমাণ অশ্বসাদির দ্বারা শত্রুকে পরিবেষ্টিত ও বিব্রত করা। বাবরশাহী ব্যূহ আক্রমণাত্মক রীতির উপযুক্ত নহে। এই প্রকারের ব্যূহ স্বস্থান পরিত্যাগ করিয়া আগে পিছে সহজে নড়িবার সাধ্য নাই; অধিকন্তু, চলমান অবস্থায় আক্রান্ত হইলেই বিপদ। কুচ করিবার সময় রাস্তায় এই প্রকার আক্রমণ আশঙ্কা করিয়াই আওরঙ্গজেব অতি সন্তর্পণে বাহিনী চালিত করিতেছিলেন। ওইদিন সকালবেলা দারা যদি ফিরোজ জঙ্গ বাহাদুরের মতো সাহসী ও বিচক্ষণ সেনানীর অধিনায়কত্বে দশ হাজার অশ্বারোহী শত্রুকে রাস্তায় হঠাৎ হামলা করিবার জন্য পাঠাইয়া দিতেন কিংবা পশ্চাদ্ধাবমান শত্রুকে প্রতারিত করিয়া নিজ পক্ষের তোপখানার পাল্লার ভিতর লইয়া আসিতে পারিতেন তাহা হইলে সেদিন আওরঙ্গজেবের যাত্রাভঙ্গ হইত; কিন্তু দারার সেই সাহস ও রণপাণ্ডিত্য কোথায়? সকালবেলা সমগ্র বাহিনীর সহমরণ ব্যবস্থা না করিয়া দারা যদি কয়েকটি সংবাদ-সংগ্রাহক অশ্বারোহীদল (scouting parties) সামনে পাঠাইয়া দিতেন কিংবা তাঁহার শিবিরের নিকটস্থ পূর্বোক্ত উজাড় গ্রাম হইতে মুষ্টিমেয় শত্রুকে বিতাড়িত করিয়া দিতেন তাহা হইলে অহেতুক ত্রাসে নিজ পক্ষের মনোবল হ্রাস পাইত না।

দারা নিজ ছাউনি পিছনে রাখিয়া সৈন্যসজ্জা করিয়াছিলেন। স্থান-নির্বাচন ভালোই হইয়াছিল, পাশ কাটাইয়া শত্রুর পার্শ্ব কিংবা পশ্চাতে পৌঁছিবার উপায় ছিল না। সেনাব্যূহের সম্মুখে বালুকাভূমি, মাঝে মাঝে ফাটল, শুকনা ঝিল, উঁচু-নীচু ঢিবি; অশ্বারোহীর পক্ষে সুগম না হইলেও দুর্গম নহে। কিন্তু তোপখানা লইয়া পাল্লার ভিতরে আসা আয়াসসাধ্য ব্যাপার। এরূপ স্থানে যে পক্ষ আগুয়ান হইয়া অপর পক্ষকে আক্রমণ করিবার চেষ্টা করিবে তাহারা উক্ত অসুবিধার দরুন বেকায়দায় পড়িবে। এইজন্য আওরঙ্গজেব দারাকেই আক্রমণে টানিবার ফিকিরে ছিলেন, ময়দানে উপস্থিত হইয়া তিনি লড়াইয়ের কোনও গরজ দেখাইলেন না—দারার তোপখানার পাল্লার দ্বিগুণ দূরে থাকিয়া তাঁহার তোপখানা কয়েকটা হাউইবাজি ফাটাইয়া বাদশাহী ফৌজকে অভ্যর্থনা জানাইল। এইদিকে দারার তোপখানা পূর্বেই গোলাবর্ষণ আরম্ভ করিয়াছিল। চোখের দৃষ্টির পাল্লা ও তোপের পাল্লা সেকালে সমান ছিল না; গোলা কতদূর যাইবে, কিসের উপর নিশানা করিবে এই বিবেচনার অবকাশ দারা তোপখানার মনসবদারগণকে দিলেন না; ব্যস্তসমস্ত হইয়া তাহাদিগকে তোপ দাগিবার হুকুম পাঠাইলেন। বাদশাহী তোপখানার গোলা ময়দানের মাঝখানে ফাটিতে লাগিল, আওরঙ্গজেবের কেশাগ্রও কম্পিত হইল না। ম্যানুসী* প্রমুখ তোপখানার ফিরিঙ্গি অফিসারগণ এইরূপ বৃথা পরিশ্রমে বিরক্ত হইয়া উঠিল।

[*STORIA, i 276]

প্রায় এক ঘণ্টাকাল দারার শতাধিক কামান গর্জনে যুদ্ধভূমি কাঁপিয়া উঠিল; ধূলি ও ধূম্রজালে ভূতল আকাশ আচ্ছন্ন, উহার আড়ালে কোথায় কি ঘটিতেছে কাহারও দেখিবার সাধ্য নাই। আওরঙ্গজেবের তোপখানার আওয়াজ ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়া অবশেষে সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ হইয়া গেল, সেনাদল নিশ্চেষ্ট। দারা মনে করিলেন লড়াই আধা জিতিয়া লইয়াছেন—ইহা তাঁহার তোপখানার কেরামতি। এমন সময় বাহিনীর দক্ষিণ বাহুর অধিনায়ক ঘোড়া দৌড়াইয়া ছুটিয়া আসিলেন এবং দারাকে অভিবাদন করিয়া বলিলেন, “শাহজাদা বুলন্দ-ইকবাল’ আপনার ফতে মোবারক! দুশমন একেবারে ঠাণ্ডা হইয়া গিয়াছে; এখনই হামলা করিয়া ময়দানের মালিক হওয়ার সুযোগ।” মেসোর কথা দারার মতের সঙ্গে মিলিয়া গেল, পরামর্শ করিবার জন্য তিনি প্রধান সেনানায়কগণকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। খলিলুল্লার বক্তব্য শুনিয়া ফিরোজ জঙ্গ বাহাদুর নিবেদন করিলেন, “শত্রুপক্ষ অনেক দূর হইতে আমাদিগকে আক্রমণ করিতে আসিয়াছে; লড়াইয়ের কায়দা অনুসারে আমাদিগের উপর হামলা করা ব্যতীত তাহাদের গত্যন্তর নাই; সুতরাং তাহাদের আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করাই যুক্তিসঙ্গত। তোপখানার সামনে হামলা করিতে আসিলেই তাহারা বেকায়দায় পড়িবে, তখন আমরা আমাদের সুরক্ষিত অবস্থানের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করিয়া উহাদের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িব।”

উক্ত অবস্থায় ইহাই ছিল ফিরোজ-জঙ্গের মতো প্রবীণ সেনানী এবং দারার প্রকৃত হিতৈষীর উপযুক্ত উপদেশ; কিন্তু অসহিষ্ণু দারা স্নায়ুযুদ্ধে আবার হার মানিলেন। এই উপদেশমত কাজ করিলে এইদিন যুদ্ধ না করিয়া আওরঙ্গজেবকে ব্যর্থকাম হইয়া নিজ শিবিরে ফিরিয়া যাইতে হইত, বহু সৈন্যক্ষয় করিয়া জয়ের অনিশ্চয়তার ঝুঁকি লইবার মতো হঠকারী অপরিপক্ক যোদ্ধা তিনি নহেন; দারার বাহিনীকে পিছনে রাখিয়া আগ্রার দিকে অগ্রসর হওয়ার বিপদ তাঁহার অজানা ছিল না।

ধূর্ত খলিলুল্লা দেখিলেন ঘাটে আসিয়াই বুঝি বেইমানির ভরা ডুবিল। মহামানী ফিরোজ-জঙ্গের দুর্বলতা কোথায় তিনি জানিতেন। তিনি কৃত্রিম ক্রোধ প্রকাশপূর্বক টিটকারি দিয়া বলিলেন, “দুশমনকে আমরা প্রায় সাবাড় করিয়া আনিয়াছি, একটু হিম্মত দেখাইলেই ফতে হাসিল হইয়া যায়। এমন সুযোগে হামলা না করিয়া বুজদিলের মতো হাত-পা গুটাইয়া বসিয়া থাকিবার কথা ফিরোজ-জঙ্গ বাহাদুরের মতো নামী সিপাহসালারের মুখে শুনিয়া আমি তাজ্জব হইয়া গেলাম।”

দারা খলিলুল্লার কথায় সায় দিয়া সেনানীগণকে স্ব স্ব স্থান হইতে একযোগে বিপক্ষব্যূহ আক্রমণ করিবার সরাসরি আদেশ দিলেন, তোপদাগা বন্ধ করিয়া কামানশ্রেণীর শিকল খুলিয়া দিয়া অশ্বারোহী হাতি-উটের নির্গমপথ পরিষ্কার করিবার হুকুম হইল।

কিছুক্ষণ অশিব নিস্তব্ধতার পর রণস্থলে প্রলয়ের বিষাণ বাজিয়া উঠিল; যুগপৎ সহস্ৰ তূর্যধ্বনি, শত শত দামামা দুন্দুভির ভীষণ নির্ঘোষ, হস্তীর বৃংহিত, অশ্বের হ্রেষা ও কোষমুক্ত তরবারির ঝঞ্ঝনা যুদ্ধভূমি প্রকম্পিত করিয়া দারার সেনা সমুদ্রে রণোন্মাদনার তুফান তুলিয়াছে। গোলার ধূম্রজাল আহত বালুকাভূমি সমুখিত ধূলিরাশির দ্বারা আষাঢ়ের নির্বাত মধ্যাহ্নে উভয় সেনার মধ্যে যেন কুাটিকার পর্দা টানিয়া দিয়াছে; যোদ্ধৃগণের শাণিত অসি ও বর্শাফলক এই আঁধারে উড্ডীয়মান খদ্যোৎপুঞ্জের ন্যায় যুদ্ধহস্তীসমূহের কৃষ্ণ ছায়াকে পরিবৃত করিয়া সম্মুখে চলিয়াছে।

দক্ষিণে খলিলুল্লা, বামে ফিরোজ-জঙ্গ, মধ্যে হরাবল লইয়া রাও ছত্রশাল স্ব স্ব বাহিনীকে ঘন সন্নিবিষ্টভাবে ব্যূহবদ্ধ করিলেন; কেন্দ্রভাগ দারার অধীনে কামানশ্রেণীর পশ্চাতে রহিল, অগ্রবর্তী রিজার্ভ সেনা হরাবলের স্থান গ্রহণ করিল। দারার পৃষ্ঠরক্ষী কোনও অশ্বসাদি ছিল না, এবং শিবির রক্ষার্থ কোনও ফৌজ মোতায়েন রাখা তিনি প্রয়োজনীয় মনে করেন নাই।

অকম্মাৎ সর্বপ্রথমে ব্যূহের বামপার্শ্ব হইতে বিকট যুদ্ধধ্বনি উঠিল, তারপর রাজপুতের “মার মার” রণহুঙ্কার, শেষে তাতার অশ্বারোহীর ফার্সি “বে-কুশ, বে-কুশ” হানাহানি চিৎকার। ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হাজার ধাবমান অশ্বের ক্ষুরোখিত ধুলায় ধুম্রকুটিকা ভূতলচুম্বী মহামেঘের ন্যায় রণস্থলে দারার দৃষ্টিপথ অবরুদ্ধ করিল।

ফিরোজ-জঙ্গ বাহাদুর ও কুমার সিপহর শুকোর নেতৃত্বে দারার বামপক্ষ আওরঙ্গজেবের দক্ষিণ পক্ষকে আক্রমণ করিবার কথা; কিন্তু তাঁহারা সামনে শ্রেণীবদ্ধ শত্রুসেনা দেখিতে পাইয়া ওইদিকে সৈন্যচালনা করিলেন, দশ সহস্র উত্থিত তরবারি ঝড়ের বেগে শত্রুকে লক্ষ্য করিয়া ছুটিল। বিপরীত দিকে কোনও বাধা না পাইয়া ফিরোজ-জঙ্গের অশ্বারোহী দল অপ্রতিহত গতিতে নাগালের ভিতর পৌঁছিতেই তাহাদের রাস্তা হইতে শত্রুর অশ্বসাদি বিনাযুদ্ধে পিছু হটিয়া বামে দক্ষিণে সরিয়া গেল, হঠাৎ তোপখানার মৃত্যুবর্ষী অগ্নি জ্বলিয়া উঠিল। ঝাঁকে ঝাঁকে গোলাগুলির আঘাতে অশ্ব ও অশ্বারোহী ছিন্নাঙ্গ হইয়া ধরাশায়ী হইতে লাগিল।

ফিরোজ-জঙ্গের বাহিনী আওরঙ্গজেবের তোপখানার অধ্যক্ষ সফ-শিকন খাঁর কৌশলে মৃত্যুর মুখে আসিয়া পড়িয়াছিল। এই অবস্থার জন্য পূর্বে প্রস্তুত থাকিলে তোপখানা তাঁহাকে ঠেকাইয়া রাখিতে পারিত না। ফিরোজ-জঙ্গ দেখিলেন পতঙ্গের মতো তোপখানার সামনে মরিলে কার্যসিদ্ধি হইবে না। তিনি তোপখানার পাশ কাটাইয়া উহার পশ্চাতে কিছুদূরে আওরঙ্গজেবের হরাবলের উপর হামলা করিতে চলিলেন। আওরঙ্গজেব তোপখানা ও হরাবলের জন্য আশঙ্কান্বিত হইয়া তাঁহার দক্ষিণ পারিক্ষক বাহাদুর খাঁকে সামনে পাঠাইয়াছিলেন; মধ্যভাগে তাঁহার পাঁচ হাজার অশ্বারোহী ফিরোজ-জঙ্গের সেনার সহিত ভীষণ হাতাহাতি যুদ্ধে ব্যাপৃত হইয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ বিপক্ষের আক্রমণে পর্যুদস্ত হইল, বাহাদুর খাঁ গুরুত্ব ভাবে আহত এবং তাঁহার সাহসী সহকারী সৈয়দ দিলাবর খাঁ ও হাদিদাদ খাঁ নিহত হইলেন।

এই সুখবর পাইয়া দারার মাথা ঘুরিয়া গেল, ফিরোজ-জঙ্গ নিঃসন্দেহ যুদ্ধ জিতিয়াছেন মনে করিয়া বিজয় বাদ্য বাজাইবার হুকুম দিলেন এবং মহা উৎসাহে বাহিনীর কেন্দ্রভাগ লইয়া ফিরোজ-জঙ্গের সাহায্যার্থ বাহির হইয়া পড়িলেন, তোপখানা পিছনে পড়িয়া রহিল। দারা বামে ঘুরিয়া আওরঙ্গজেবের দক্ষিণ পক্ষ আক্রমণ করিতে চলিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তোপ দাগিবার হুকুম পাঠাইলেন। ফিরিঙ্গি গোলন্দাজ নায়ক এত বেকুব নহে, তোপ দাগিলে সামনে স্বপক্ষের লোকই মরিবে, হয়তো শাহজাদার উপরও পড়িতে পারে; সুতরাং তাহারা দারার বুদ্ধির বাহবা দিয়া চুপ করিয়া রহিল।

বুদ্ধির দোষে দারাও সফ-শিকন খাঁর তোপের পাল্লার ভিতর পড়িয়া ফিরোজ-জঙ্গ অপেক্ষা মারাত্মক সম্বর্ধনা পাইলেন, অগ্নিবর্ষণের মুখে তাঁহার বাহিনী বিব্রত ও ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল, অথচ ইহার পাল্টা জবাব দেওয়ার উপায় নাই। নিজের ভুল বুঝিতে পারিয়া দারা তাঁহার তোপখানাকে আগাইয়া আনিবার জন্য হাতির উপর হইতে ইশারা করিলেন; কিন্তু লাথি-জুতা-চাবুক ও বল্লমের খোঁচার কাজ ইশারায় হাসিল হইবার নয়। দারা হুড়মুড় করিয়া তোপখানা ফেলিয়া না আসিলে রক্ষী সেনাগণ উক্ত উপায়ে পদাতিক ও ছাউনির দশ-পনের হাজার চাকরবাকরকে দিয়া তাঁহার বিরাট তোপখানাকে টানাইয়া আওরঙ্গজেবের তোপখানার কাছাকাছি লইয়া আসিতে পারিত; শাহজাদার উপস্থিতিতে সকলেই শায়েস্তা থাকিত। দারার তোপখানা আওরঙ্গজেবের তোপখানা ঠেকাইয়া রাখিলে উভয়পক্ষের বল সাম্য হইত; জয় না হইলেও যুদ্ধের ফল অন্তত অমীমাংসিত থাকিত। স্বয়ং যুদ্ধে লাফাইয়া পড়িয়া দারা তাঁহার বুদ্ধির খেই ও লড়াইয়ের বাগ্-ডোর দুই-ই হারাইয়া বসিলেন। সেনাপতি হিসাবে ইহাই তাঁহার সর্বাপেক্ষা নিন্দনীয় ভুল এবং সর্বনাশের প্রধান কারণ।

দারার অনুপস্থিতিতে কামান, গোলন্দাজ ও তাহাদের নায়কগণকে ফেলিয়া চাকর-বাকর ছাউনির ভবঘুরে নাপিত কসাই সিপাহী সকলেই শাহজাদার তাঁবু লুঠ করিতে লাগিল। সেখানে সিন্দুক ভাঙিয়া টাকা, আশরফি ও দামী জিনিসপত্র যে যাহা পাইল লুট করিতে লাগিল এবং পরস্পরের মধ্যে খুনোখুনি করিয়া মরিল কিংবা বাড়ি পলাইয়া গেল। কামানের গাড়ির বলদ নাই, বলদ হাঁকাইবার লোক নাই, খালাসি-লস্কর নাই; এই অবস্থায় তাঁহার বিশ্বস্ত ফিরিঙ্গি অফিসারগণ কি করিবেন? তবুও তাঁহারা ঘোড়ার চড়িয়া শাহজাদার সাহায্যার্থ অগ্রসর হইলেন, ইহাদের মধ্যে ম্যানুসী সাহেবও ছিলেন।

দারা নিজ বাহিনীকে পুনঃস্থাপিত করিয়া সোজা আওরঙ্গজেবকে আক্রমণ করিতে চলিলেন। আওরঙ্গজেবের কেন্দ্রভাগ এবং হরাবলের মধ্যবর্তী স্থানে পাঁচ হাজার অশ্বারোহী লইয়া অগ্রবর্তী সংরক্ষিত, সেনার অধিনায়ক শেখ মীর দারার গতিরোধ করিলেন। এইখানে প্রচণ্ড হাতাহাতি যুদ্ধ হইল। শার্দূল বিক্রমে দারা যুদ্ধে ঝাঁপাইয়া পড়িলেন, শেখ মীরের অধিকাংশ সৈন্য হতাহত হইল, বাদবাকি পিছু হটিল। আওরঙ্গজেবের দক্ষিণপা িতখন সম্পূর্ণ অরক্ষিত, বাহাদুর খাঁ ফিরোজ-জঙ্গের সহিত যুদ্ধে আহত এবং তাঁহার অশ্বসাদি ও দক্ষিণ পক্ষের অধিনায়ক ইসলাম খাঁ বহুদূরে দারার বামপক্ষের সহিত যুদ্ধে ব্যাপৃত। দারার সামনে আওরঙ্গজেবের অল্পসংখ্যক দেহরক্ষী সেনা। আওরঙ্গজেব উচ্চস্বরে সেনামুখ্যগণের নাম ধরিয়া ডাকিতে লাগিলেন এবং সেনাকে উৎসাহিত করিতে লাগিলেন। শেখ মীরের সেনাদল ভঙ্গপ্রায় দেখিয়া আওরঙ্গজেব হাওদার ভিতর হইতে দুই হাত তুলিয়া চিৎকার ছাড়িতেছিলেন, “ইয়া খোদা! ইয়া খোদা! তুমিই ভরসা!”

শেখ মীরকে পরাজিত করিয়া দারা তৃষ্ণা, রৌদ্র এবং যুদ্ধাশ্রমে কাতর হইয়া পড়িয়াছিলেন; আওরঙ্গজেবের কেন্দ্রভাগকে আক্রমণ করিবার পূর্বে তিনি একটু দম লইতেছিলেন। এই বিশ্রাম তাঁহার সমস্ত পরিশ্রম পণ্ড করিল। এই অবসরে চারিদিক হইতে নূতন ফৌজ আনাইয়া আওরঙ্গজেব তাঁহার ভগ্নপ্রায় ব্যূহ দৃঢ়সজ্জিত করিলেন। এইদিন দারা যদি আক্রমণ স্থগিত না রাখিয়া সোজা আওরঙ্গজেবের উপর গিয়া পড়িতেন তাহা হইলে তাঁহার সংখ্যাগরিষ্ঠতা শত্রুকে পরাজয়ের মুখে ঠেলিয়া দিতে পারিত।

ইতিমধ্যে দারার কাছে সংবাদ আসিল, রাও ছত্রশাল ও রাজপুতগণ শাহজাদা মোরাদকে পরাজিত করিয়া আওরঙ্গজেবের বামপার্ফি আক্রমণ করিয়াছেন, এখন তাঁহাদিগকে অতি সত্বর সাহায্য করা প্রয়োজন। দারা ত্রস্তব্যস্ত হইয়া নিজ ব্যূহের বাম বাহুর শেষ হইতে দক্ষিণ বাহুর দিকে সেনাবাহিনী ফিরাইয়া লইলেন। আওরঙ্গজেবের তোপখানা পার্শ্ব হইতে গোলা দাগিয়া বহু অশ্বারোহীকে হতাহত করিল। হতাবশিষ্ট ক্লান্ত সেনাদলসহ তিনি রাজপুতগণের সাহায্যার্থ উপস্থিত হইয়া শুনিতে পাইলেন ডানে বামে সব শেষ হইয়া গিয়াছে, খলিলুল্লার খবর নাই; রাও ছত্রশাল ও রামসিংহ রাঠোর নিহত, ফিরোজ-জঙ্গ বহু শত্রুসেনা দ্বারা আক্রান্ত হইয়া স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করিয়াছেন, কুমার সিপ্‌হর শুকো ও মুষ্টিমেয় যোদ্ধা মাত্র রক্ষা পাইয়াছে।

দারা তাঁহার বাহিনীর প্রাথমিক জয়মণ্ডিত বামপক্ষকে সাহায্যার্থ অগ্রসর হইয়া কৃতকাৰ্য হইতে পারেন নাই, বরং নিজের সর্বনাশ ডাকিয়া আনিলেন।

বাহাদুর খাঁর ধ্বংসপ্রায় ফৌজকে ফিরোজ-জঙ্গ যখন আওরঙ্গজেবের হরাবলের দিকে ঠেলিয়া লইয়া যাইতেছিলেন তখন শেখ মীরের অধীনে আওরঙ্গজেবের অগ্রবর্তী রিজার্ভ পাঁচ হাজার অশ্বারোহী হরাবলের পিছন ঘুরিয়া হঠাৎ ফিরোজ-জঙ্গের বামপাঞ্চি আক্রমণ করিল, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম খাঁ পরিচালিত শত্রুর অটুট দক্ষিণপক্ষের দশ হাজার অশ্বারোহী হালকা তোপ ও বন্দুকধারী পদাতিক তাঁহার দক্ষিণপার্ফি ও পশ্চাৎ ভাগ পরিবেষ্টিত করিয়া ফেলিল। সংখ্যায় দ্বিগুণ নূতন শত্রুসেনার দ্বারা চতুর্দিক হইতে আক্রান্ত হইয়া ফিরোজ-জঙ্গ সাহায্যের আশায় সুকৌশলে অবিচলিত চিত্তে যুদ্ধ করিতেছিলেন।

স্থানত্যাগ না করিয়া দারাও যদি আওরঙ্গজেবের মতো মাথা ঠিক রাখিয়া কুমার রামসিংহ এবং সৈয়দ বহির খাঁর নেতৃত্বে অগ্রবর্তী দশ হাজার রিজার্ভ অশ্বারোহী সেনাকে কামানশ্রেণীর আড়ালে গা-ঢাকা দিয়া বামপক্ষের পরিত্যক্ত স্থান হইতে বাহির হইয়া সোজা যুদ্ধস্থানে পৌঁছিবার আদেশ দিতেন তাহা হইলে উভয় দিক রক্ষা পাইত––ফিরোজ-জঙ্গ শেখ মীর ও ইসলাম খাঁর ফৌজকে ধ্বংস করিয়া সম্পূর্ণ বিজয়ী হইতেন।

যাহা হউক, যুদ্ধের অবস্থা দ্রুত সঙ্গীন হইয়া উঠিল। ফিরোজ-জঙ্গ ও দারার পুত্রকে জীবন্ত বন্দী করিবার উৎসাহে শত্রুপক্ষ হামলার পর হামলা করিতে লাগিল, উভয় পক্ষের বীর-রক্তে ভিজিয়া ময়দানের বালু হোলির আবির হইয়া পড়িল। রণস্থলে অচল শিলাখণ্ডের ন্যায় প্রোথিত ফিরোজ-জঙ্গের ব্যূহের উপর যুদ্ধ তরঙ্গ বার বার প্রতিহত হইয়া যখন ভাটার মুখে চলিয়াছে, তখন একটি গুলি আসিয়া ফিরোজ-জঙ্গের এক বাহুতে বিদ্ধ হইল। তিনি বুঝিলেন এইবার শেষ পাড়ি দেওয়ার ডাক পড়িয়াছে। ফিরোজ-জঙ্গ হাতি হইতে নামিয়া হতাবশিষ্ট সেনার নিকট হইতে বিদায় লইলেন এবং কুমার সিপহর শুকোকে মধ্যে রাখিয়া পিছনের দিক হইতে শত্রুর ঘেরাজালভেদ করিবার ভার ভীমকর্মা বিশ্বস্ত সৈয়দগণের উপর ন্যস্ত করিয়া নিশ্চিন্ত হইলেন। ভাঙা হাত লইয়া শেষযাত্রার জন্য ফিরোজ-জঙ্গ ঘোড়ায় চড়িলেন, দ্বাদশ জন অশ্বারোহী স্বেচ্ছায় তাঁহার মরণের সাথী হইয়া অগ্রসর হইল। ক্ষুধার্ত সিংহযুথের ন্যায় ফিরোজ-জঙ্গের সহযাত্রী বীরগণ উপযুক্ত শিকারের সন্ধানে সম্মুখে অগণিত শত্রুর উপর ঝাপাইয়া পড়িল, অপর দিক হইতে অবশিষ্ট ফৌজ সমান তেজে যুদ্ধ করিতে করিতে কুমারকে লইয়া বাহির হইয়া গেল, ফিরোজ-জঙ্গ ও তাঁহার দ্বাদশ যোদ্ধা তরবারি দ্বারা শত্রুদলের মধ্যভাগে মৃতদেহের সমাধিস্তূপ রচনা করিয়া উহার মধ্যে চিরতরে শয্যাগ্রহণ করিলেন।

দারার হরাবল এবং দক্ষিণপক্ষ ফিরোজ-জঙ্গের সঙ্গে সঙ্গেই অন্যদিক হইতে আওরঙ্গজেবের ব্যূহ আক্রমণ করিয়াছিল। খলিলুল্লা খাঁ দক্ষিণপক্ষ লইয়া মহা দাপটে মোরাদ-চালিত আওরঙ্গজেবের বামপক্ষের সম্মুখে উপস্থিত হইলে দুই পক্ষে তীরবর্ষণ আরম্ভ হইল। কিছুক্ষণ পরে গায়ে আঁচ না লাগিতেই খলিলুল্লা তাহার দশ হাজার তাতার অশ্বারোহী লইয়া পিছু হটিতে লাগিলেন। মোরাদ নিজ সেনাদলকে আগে বাড়াইয়া যুদ্ধার্থ অগ্রসর হওয়া মাত্র খলিলুল্লা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিয়া স্বস্থানে ফিরিয়া আসিলেন। তাঁহার দলের অল্পসংখ্যক রাজপুত ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল। ধর্মাতের যুদ্ধের কাসিম খাঁর ভূমিকার প্রথম অঙ্ক সামুগঢ়ে এইভাবে অভিনয় করিয়া খলিলুল্লা অক্ষত শরীরে সরিয়া পড়িলেন।

মোরাদ এই সময়ে তাঁহার বামদিকে কিছুদূরে স্বপক্ষীয় জুলফিকর খাঁর তোপখানা পিছনে ফেলিয়া সামনে শত্রুকে তাড়া করিতেছিলেন। এই সুযোগে রাও ছত্রশাল জুলফিকর খাঁর কামানের পান্না এড়াইয়া মধ্যবর্তী ফাঁকে হরাবল চালিত করিয়া আওরঙ্গজেবের ব্যূহের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িলেন, মোরাদের বাহিনী আওরঙ্গজেব হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িল। এইখানে রাজপুতগণ মোরাদের বাহিনীর উপর শার্দূলবিক্রমে ঝাঁপাইয়া পড়িল; মরণের ময়দানে মোরাদের হস্তীকে লক্ষ্য করিয়া হাড়া গৌর রাঠোরের বাজির ঘোড়দৌড় আরম্ভ হইল। এই দৌড়ে বাহাদুরির প্রথম বাজি মারিয়া লইলেন রামসিংহ রাঠোর। পরিধানে কেশর বস্ত্র, উষ্ণীষে মোতির মালা, হস্তে করাল কৃপাণ লইয়া রামসিংহ অনুরূপ কেসর বস্ত্র পরিহিত মৃত্যুভয়শূন্য নিজ কুলের অশ্বারোহী পরিবৃত হইয়া ঘোড়ার লাগাম ছাড়িয়া মোরাদের প্রতি ধাবিত হইলেন। রামসিংহ মোরাদের তোপ অধিকার করিয়া শাহজাদার অগ্রবর্তী রক্ষীসেনাকে ছত্রভঙ্গ করিলেন। এই আক্রমণের মুখে কেহই স্থির থাকিতে পারিল না। মোরাদের বিশ্বস্ত দেহরক্ষী সেনাগণ শাহজাদার হাতিকে মধ্যে রাখিয়া রুখিয়া দাঁড়াইল; রাজপুতের শববস্ত্রে রণস্থল যেন জয়লক্ষ্মীর জাফরানের গালিচায় সজ্জিত হইয়াছে, উহার চারি কিনারায় রক্ত কর্দমের লাল সালুর আস্তরণ। অবশেষে রাঠোর রামসিংহ মোরাদের সামনে পৌঁছিয়া বিদ্রূপভরে তারস্বরে মোরাদকে শুনাইলেন, “দারার সিংহাসন কাড়িয়া লইবে তুমি?” হাওদাস্থিত মোরাদের উপর শ্রাবণের ধারার ন্যায় দৃঢ়হস্তমুক্ত তীরবৃষ্টি হইতে লাগিল। মোরাদ অসীম সাহসী বিচক্ষণ যোদ্ধা, এইরূপ সঙ্কটের মধ্যে যুদ্ধ পাইলেই তাঁহার আনন্দ। ভীমের কামুকমুক্ত গজকুন্তভেদী নারাচের ন্যায় মোরাদের প্রত্যেকটি শর এক একজন রাজপুত অশ্বারোহীকে ধরাশায়ী করিতে লাগিল। প্রতিপক্ষের তীরবিদ্ধ হইয়া তাঁহার হাওদাও শঙ্কিত সজারু-পৃষ্ঠের ন্যায় কণ্টকিত হইল। রাঠোর রামসিংহ মোরাদের মাহুতকে হুকুম দিলেন, “যদি বাঁচিতে চাও, হাতিকে হাঁটুর উপর বসাও।” শাহজাদার হাতি জানু নত করিল না, মাহুতের মৃতদেহ মাটিতে পাড়িয়া গেল।

এইবার মোরাদ ফাঁপরে পড়িলেন, হাতি সামলাইবেন, যুদ্ধ করিবেন, না নিজের শিশুপুত্রের প্রাণরক্ষা করিবেন? যুদ্ধের তামাশা দেখিবার জন্য মোরাদ তাঁহার অপোগণ্ড পুত্রকে সঙ্গে আনিয়াছিলেন, তৈমুর বংশে ইহা নূতন ব্যাপার নহে। মোরাদ উহাকে বাঁচাইবার জন্য এক জানুর দ্বারা পুত্রের দেহ আড়াল করিলেন এবং ঢাল সামনে ধরিয়া পুত্রকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতেছিলেন; এই অবস্থায় তিনটি তীর তাঁহার মুখে বিদ্ধ হইয়া লাগিয়া রহিল। রামসিংহ মোরাদকে লক্ষ্য করিয়া হস্তস্থিত ভল্ল নিক্ষেপ করিলেন; মোরাদ নিজেকে বাঁচাইয়া শত্রুর প্রতি তাগ করিলেন—এই মৃত্যুবাণে রামসিংহ বীরশয্যা গ্রহণ করিয়া স্বামী-ঋণ-মুক্ত হইলেন। রাজপুতের পিছনে দায়ুক খাঁর উপজাতীয় রণোন্মত্ত পাঠানগণ মোরাদের ভগ্নপ্রায় সেনার উপর শের-হামলা করিয়া ছুটিয়া আসিল। এই নূতন আক্রমণের মুখে মোরাদ হটিয়া যাইতে বাধ্য হইলেন, তাঁহার নির্ভীক সেনাধ্যক্ষ ইহায়া খাঁ, সরফরাজ খাঁ এবং রানা গরিবদাস নিহত হইলেন, হতাবশিষ্ট ফৌজ ইতস্তত ছত্রভঙ্গ হইয়া গেল।

১০

যুদ্ধের এই সঙ্কটমুহূর্তে আওরঙ্গজেবের সেনাপতিত্বের চরম পরীক্ষা হইয়া গেল। যোদ্ধা হিসাবে দারার উপর উচ্চ ধারণা না থাকিলেও যুদ্ধে নামিয়া প্রতিপক্ষের শক্তি ও বুদ্ধিমত্তা ছোট করিয়া দেখিবার মতো অর্বাচীনতা তাঁহার ছিল না। সে যুগের মোগল যুদ্ধরীতি অনুসারে শত্রুকে নিজ কেন্দ্রভাগ ও তোপখানার উপর আক্রমণ করিবার জন্য হয় প্রলোভিত কিংবা বাধ্য করিবার উপরই যুদ্ধের সাফল্য নির্ভর করিত। আক্রমণ করিবার সময় প্রথমে বাহিনীর পক্ষদ্বয় প্রতিপক্ষের বলাবল পরীক্ষা করিয়া সুবিধা করিতে পারিলে শত্রুর কেন্দ্রভাগকে পরিবেষ্টিত করিয়া ফেলিত এবং নিজপক্ষের কেন্দ্রভাগ ও তোপখানা অগ্রসর হওয়ার অপেক্ষায় থাকিত। শত্রুর পক্ষদ্বয় প্রবল হইলে পূর্বনির্দিষ্ট স্থানে ফিরিয়া আসিয়া স্বপক্ষের তোপখানা ও কেন্দ্রের আশ্রয়ে যুদ্ধ করাই ছিল নিয়ম। নিজপক্ষের তোপখানা ও কেন্দ্রভাগ কেবলমাত্র যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে রণক্লান্ত প্রতিপক্ষের উপর চরম আঘাত হানিবার জন্যই আগুয়ান করা হইত। দারার পক্ষদ্বয় এবং হরাবল “অপুনরাগমনায়” পণ করিয়া যুদ্ধে নামিবে, নিজের তোপখানা নিষ্ক্রিয় করিয়া দারা অসময়ে ব্যূহ ত্যাগ করিবেন এমন কাঁচা যুক্তির উপর নির্ভর করিয়া আওরঙ্গজেব সামুগঢ়ে সৈন্যচালনা করেন নাই; তাঁহার বামে দক্ষিণে যুদ্ধের এত ঝড়-ঝাপটার মধ্যেও কুমার মহম্মদ সুলতান পরিচালিত হরাবলের দশ হাজার অশ্বারোহী অপরাহু পর্যন্ত নির্দিষ্ট স্থান হইতে বিনা হুকুমে এক চুল নড়ে নাই। হরাবলের ফৌজ খরচ করা যে কথা, অশ্বারোহীর দীর্ঘ ভল্পের লোহার ফলা খুলিয়া তাহাকে ডাণ্ডাবাজি করিবার হুকুম দেওয়াও সেই কথা––ছত্রশালকে হাতছাড়া করিয়া দারা ঠিক এই কার্যই করিয়াছিলেন।

রাও ছত্রশাল মহারাজা যশোবন্ত নহেন; শৌর্য, স্থিরবুদ্ধি ও রণকৌশলে মির্জা রাজা জয়সিংহ ব্যতীত রাজপুতের মধ্যে তাঁহার সমকক্ষ সেনানী সেকালে ছিল না। তিনি যুদ্ধার্থ আদিষ্ট হইয়া অভিমানী ফিরোজ-জঙ্গের মতো সরাসরি আওরঙ্গজেবের তোপখানার উপর গিয়া পড়েন নাই; তাঁহার শ্যেনদৃষ্টি প্রতি ব্যূহের রন্ধ্র খুঁজিতেছিল। মোরাদের হঠকারিতা ও চালের ভুলের সুযোগে তিনি জুলফিকর খাঁর তোপখানাকে ফাঁকি দিয়া মোরাদ ও আওরঙ্গজেবের মধ্যস্থলে ঢুকিয়া পড়িয়াছিলেন। মোরাদের বিচ্ছিন্ন বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করিয়া রাও ছত্রশাল ভ্রাতার সাহায্যার্থ আগুয়ান আওরঙ্গজেবকে প্রচণ্ড বিক্রমে আক্রমণ করিলেন।

১১

মোগল-কুরুক্ষেত্রে এইবার ছত্রশাল পর্ব* আরম্ভ হইল। মোরাদকে আক্রমণ করিবার সময় রাও ছত্রশাল হরাবলের পৃষ্ঠভাগ রক্ষা করিতেছিলেন, শত্রু ব্যূহের মধ্যে প্রবিষ্ট তাঁহার বাহিনী ওইদিক হইতে আওরঙ্গজেবের আগমন-প্রতীক্ষায় ছিল। পলায়মান মোরাদের ফৌজকে ছাড়িয়া তিনি নবোদ্যমে শত্রুর কেন্দ্রভাগে আঘাত হানিবার জন্য চলিলেন। এইবার সর্বাগ্রে হাড়াকুল স্থাপিত হইল, রণক্লান্ত রাঠোর এবং পাঠানগণ পিছনে থাকিয়া পুনঃস্থাপিত হরাবলের পৃষ্ঠরক্ষার ভার পাইলেন।

[*বুন্দীর ঐতিহাসিক ও কবি সুরজমল রাজপুত শৌর্যের এই অপূর্ব অধ্যায় অবলম্বনে এক স্বতন্ত্র কাব্য লিখিবার সঙ্কল্প করিয়া স্বরচিত “বংশভাস্কর” মহাকাব্য হইতে এই অংশ বাদ দিয়াছিলেন, অথচ কাব্যও লেখা হয় নাই। যাঁহারা এই যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিয়াছিলেন, কিংবা গুরুতর আহত হইয়া ফিরিয়াছিলেন, তাঁহাদের নাম গ্রন্থের পরবর্তী অধ্যায়ে পাওয়া যায়। এই ময়দানের অন্যভাগে যুদ্ধে ব্যাপৃত ম্যানুসী সাহেব সমগ্র যুদ্ধের যথাযথ বর্ণনা দিতে পারেন নাই: ভুলভ্রান্তি গুজব অনেক আছে। আচার্য যদুনাথ সরকারি-বেসরকারি ইতিবৃত্ত ও দলিলাদির সাহায্যে যে বিবরণ সঙ্কলন করিয়াছেন উহাই সর্বাপেক্ষা প্রামাণ্য ও বিশদ, ছিটাফোঁটা মাত্র অন্যত্র পাওয়া যাইতে পারে।]

দিগবধূর বরসাজে সজ্জিত বৃদ্ধ ছত্রশাল সানুচর এবং স্বকুলপরিবেষ্টিত হইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে চলমান সুমেরু-শৃঙ্গের ন্যায় ক্রমশ আওরঙ্গজেবের নিকটবর্তী হইলেন। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যতীত আওরঙ্গজেব রাজপুতের তরবারির পাল্লার ভিতর পড়িতে দ্বিধাবোধ করিলেন। তাঁহার হালকা তোপ, উষ্ট্রবাহিত নালীকাস্ত্র (শোতর নাল) দেহরক্ষী বন্দুকধারী পদাতিকগণ অবিরাম গোলাবৃষ্টি করিয়া রাজপুত অশ্বারোহীর গতিবেগ শ্লথ করিল। তোপখানা ও পদাতিকের সাহায্যবঞ্চিত দারার হরাবল শুধু সাহসের জোরে ক্ষয়ক্ষতি উপেক্ষা করিয়া অসমান যুদ্ধ করিতেছিল। দূরে বিক্রান্তমূর্তি আওরঙ্গজেব হাতির উপর হইতে যুদ্ধ পরিচালনা করিতেছিলেন। তাঁহাকে দেখিতে পাইয়া অভীপ্সিত লক্ষ্যের দিকে রাও ছত্রশাল নিজের হাতি চালাইয়াছিলেন; তাঁহার হাতির উপর বিপক্ষের অগ্নিবর্ষণ কেন্দ্ৰীভূত হইল। এই অগ্নিবৃষ্টির মধ্যে অগ্রসর হইবার সময় ছত্রশালের নাবালক পুত্র ভরতসিংহ, ভ্রাতা মুহকমসিংহ, কাকা হরিসিংহ ধরাশায়ী হইলেন। তাঁহার হাওদার উপর একটা গোলা ফাটিতেই হাতি বেসামাল হইয়া পিছনের দিকে ছুটিল। রাও ছত্রশাল তৎক্ষণাৎ লাফ দিয়া মাটিতে নামিলেন এবং সিংহগর্জনে সেনাগণকে উৎসাহিত করিয়া বলিলেন, হাতি পলাইতে পারে, হাতির মালিক কিন্তু পায়ে “রণ লঙ্গর” লইয়া পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিবে না। ইহার পর হাড়াকুলের শেষযাত্রা শুরু হইল। রাজপুত প্রথা অনুযায়ী হতাবশিষ্ট জ্ঞাতিগণের সহিত “গাঁটছড়া” বাঁধিয়া আফিমের আখেরী মাত্রা পরস্পরের সহিত বিনিময় করিয়া অসিহস্তে ছত্রশাল সম্মুখে ধাবিত হইলেন।

অসুরপরাক্রম নাসিরী খাঁ এবং জুলফিকর খাঁর অপরাজেয় অশ্বসাদি কদম জমাইয়া সঘন কণ্টক-তরুশ্রেণীর ন্যায় অপ্রধৃষ্য মহামহীরুহ আওরঙ্গজেবকে বেষ্টিত করিয়া রাখিয়াছে, আফিম ও লড়াইয়ের নেশায় রাজপুতের বলাবল সাধ্য-অসাধ্য জ্ঞান নাই। রাও ছত্রশালের মরণের সাথীগণ ভৈরবমূর্তি ধারণ করিয়া শত্রুসেনার এই গহন অরণ্যের মধ্যে দুই হাতে মানুষ ঘোড়া কোপাইতে কোপাইতে পশ্চাতে স্বপক্ষীয় অশ্বারোহিগণের জন্য শবাস্তীৰ্ণ পথ প্রস্তুত করিয়া চলিল। এই বেকায়দার লড়াইয়ে পাকা জাঁহাবাজ সওয়ারও হতভম্ব হইয়া পিছু হটিতে লাগিল। প্রতি পদক্ষেপে নির্ভীক হাড়াকুল ধরাশায়ী হইতে লাগিল; কিন্তু অগ্রগতির বিরাম নাই। রাও ছত্রশালের ছত্রপতাকাবাহী, আশ্রিতচারণ, জলভাণ্ডবাহক ও শূদ্রজাতীয় পরিচারকগণ রাজপুতের ন্যায় সমান বিক্রমে যুদ্ধ করিতে করিতে প্রভুর অনুগামী হইল। রাও ছত্রশাল এইভাবে যুদ্ধ করিতে করিতে শত্রুব্যূহের মধ্যভাগে অসংখ্য শস্ত্রাঘাতে জর্জরিত হইয়া পিতামহ ভীষ্মের ন্যায় শরশয্যা গ্রহণ করিলেন।

রাও ছত্রশালের এই দুর্জয় সাহস ও আত্মবলিদান দারার হরাবলের হিন্দু-মুসলমান প্রত্যেক যোদ্ধাকে অসম্ভব সম্ভব করিবার উগ্র উদ্দীপনা জোগাইয়াছিল। সেনাপতির মৃত্যুতে কোনও হাহাকার উঠিল না, যোদ্ধার মুখমণ্ডলে বিষাদ ও নিরাশার ছায়া পড়িল না, কাহারও শস্ত্রমুষ্টি শ্লথ হইল না। যমপুরের বরযাত্রী বুন্দী হইতে যাত্রা করিয়া এইখানে নিরস্ত হইল না। এই বরাতে বুন্দীর পাঠান সামন্তগণ স্ব স্ব গোত্রের যোদ্ধাদের সহিত উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারাও ছত্রশালের পার্শ্বে যুদ্ধ করিতে করিতে প্রাণ দিলেন, হতাবশিষ্টগণের মধ্যে একাধিক অস্ত্রচিহ্ন ধারণ না করিয়া কেহ বুন্দী ফিরে নাই।

বিবাহবস্ত্রসজ্জিত সালঙ্কার শবদেহাকীর্ণ রণভূমি চামুণ্ডার রুদ্র-বাসরের ভয়াবহ রূপ ধারণ করিয়াছে, কিন্তু কাহারও হৃদয়ে শঙ্কা নাই, ছত্রশালের কৃপাণ-কর্তিত পথে পাঠান রাঠোর গৌর আওরঙ্গজেবের হাতিকে লক্ষ্য করিয়া ছুটিয়াছে। আওরঙ্গজেবের দেহরক্ষী সেনাগণ ব্যূহবদ্ধ হইয়া দানব-বিক্রমে যুদ্ধ করিতেছিল; প্রতিপক্ষের শৌর্য তরঙ্গ বার বার এই ব্যূহে প্রতিহত হইয়া মৃত্যুর ফেনা তুলিল; এই অশ্রান্ত প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে সুরধুনী-স্রোতস্পর্ধী ঐরাবতের ন্যায় আওরঙ্গজেবের ব্যূহ টলিতে লাগিল। রাও ছত্রশালের মৃত্যুর পর জিঘাংসা-দৃপ্ত দুঃশাসন-রক্তলোলুপ ভীমসেনের ন্যায় উগ্রকর্মা ভীমসিংহ গৌর, শিবরাম গৌর প্রভৃতি চমুনায়কগণ শত্রুরক্তে হাড়াকুলের জন্য তর্পণাঞ্জলি প্রদান করিয়া শিবলোকে প্রয়াণ করিলেন। এইবার রাজা রূপসিংহের সিংহপরাক্রম রাঠোরগণ মৃত্যুকে লঙ্ঘন করিয়া স্বয়ং আওরঙ্গজেবের উপর আপতিত হইল। হাতির সামনে ঘোড়া বেসামাল হইতেছে দেখিয়া রাঠোর রূপসিংহ মাটিতে লাফাইয়া পড়িলেন এবং তলোয়ার লইয়া হাতির উপর হামলা করিলেন। রক্ষিগণকে পরাভূত করিয়া তিনি হাতির পেটের নীচে গিয়া পড়িলেন এবং হাতির পেটির দড়ি কোপাইতে লাগিলেন। রামসিংহ হাওদা সহ আওরঙ্গজেবকে মাটিতে নামাইতে না পারিয়া হাতিকে বসাইবার মতলবে উহার পায়ে এক কোপ বসাইয়া দিলেন; তখন তিনি একক, নিঃসহায়, তাঁহাকে রক্ষা করিতে গিয়া সহযোদ্ধৃগণ প্রাণবিসর্জন করিয়াছেন। আওরঙ্গজেব প্রকৃত বীর, বীরের মর্যাদা তাঁহার কাছে কোনদিন ক্ষুণ্ণ হয় নাই। কাফেরের “জমঢাড়” (দীর্ঘ তরবারি) হজরত আলীর “জুলফিকর” তলোয়ারের পাল্লা লইতেছে দেখিয়া আওরঙ্গজেব স্তম্ভিত ও বিস্মিত হইলেন; কিছুমাত্র ভীত না হইয়া গুণগ্রাহী আওরঙ্গজেব হাওদা হইতে ইশারা ও আওয়াজের দ্বারা নিজের রক্ষিগণকে রূপসিংহের উপর অস্ত্রাঘাত করিতে নিষেধ করিলেন, কিন্তু রক্ষীরা উত্তেজনার মুখে জীবন্ত সিংহের উপর একযোগে ঝাঁপাইয়া পড়িল, বীরের বিদেহী আত্মা সূর্যালোক প্রাপ্ত হইল।

ভগ্নদূত এই দারুণ সংবাদ লইয়া শাহজাদা দারার সন্ধানে চলিল।

১২

যুদ্ধক্ষেত্রের বামভাগে দারা যখন আওরঙ্গজেবের অগ্রবর্তী রিজার্ভ ফৌজকে ছত্রভঙ্গ করিয়া পরবর্তী আক্রমণের জন্য একটু দম লইতেছিলেন তখন এই দুঃসংবাদ তাঁহার কাছে পৌঁছিল; দারা তাঁহার সামনে অসহায় আওরঙ্গজেব ও সুনিশ্চিত জয়ের সম্ভাবনাকে ছাড়িয়া চলিলেন। ইহাই তাঁহার কাল হইল, তিনি দুই দিকই হারাইয়া বসিলেন। তিনি যদি বিচলিত না হইয়া এই সময়ে সরাসরি আওরঙ্গজেবের ভগ্নপঞ্জর কেন্দ্রস্থ সেনার কলিজা”র (Qalb) উপর সরাসরি হামলা করিতেন তাহা হইলে সংখ্যালঘিষ্ঠ এবং বামপার্ফি হইতে রাজপুত আক্রমণে বিব্রত শত্রুসৈন্য আওরঙ্গজেবকে রক্ষা করিতে পারিত কি না সন্দেহ।

বিচারমূঢ় সেনাপতি দারা তাঁহার নিজ বাহিনীকে যুদ্ধস্থলের এক সীমান্ত হইতে অন্য সীমান্তে চালিত করিলেন। দারুণ রোদে বালুজমির উপর বামে দক্ষিণে প্রায় দেড় মাইল রাস্তা দৌড়াদৌড়ি করিতে করিতে ঘোড়াগুলি আধমরা হইল, সওয়ারের গায়ে ইস্পাতের সাঁজোয়া রোদে তাতিয়া ফোস্কা ফেলিল, জলের অভাবে তৃষ্ণায় জানোয়ার ও মানুষের ছাতি ফাটিতে লাগিল; ইহার উপর আওরঙ্গজেবের তোপখানা হইতে অগ্নিবৃষ্টি। এইভাবে শাহজাদার ক্রমশ ক্ষীয়মাণ সেনাদল অবশেষে তাঁহার হরাবলের সহিত মিলিত হইল।

দারার দক্ষিণ-পক্ষ লইয়া বিশ্বাসঘাতক খলিলুল্লা বিনাযুদ্ধে উধাও হইয়াছিল, ফিরোজ-জঙ্গের মৃত্যুর পর বামপক্ষের অস্তিত্ব রহিল না। শাহজাদার বাহিনীর তখন রামায়ণের পক্ষদ্বয় ছিন্ন জটায়ু পাখির অবস্থা; অধিকন্তু রাবণের রথ গিলিবার জন্য হরাবল-চঞ্চুও ছত্রশাল-রামসিংহ-রূপসিংহের সহিত কাটা পড়িয়াছে। ইতিমধ্যে মোরাদ আওরঙ্গজেবের বামপক্ষকে পুনঃস্থাপিত করিয়া কেন্দ্রের বামপার্ফির সহিত মিলিত হইয়াছিল এবং বিজয়ী দক্ষিণ পক্ষ ইসলাম খাঁর নেতৃত্বে পলায়মান কুমার সিপ্‌হর শুকোকে তাড়া করিতে দারার পশ্চাৎ ভাগে আসিয়া পড়িল। মুষ্টিমেয় বিশ্বস্ত অশ্বারোহী কোনপ্রকারে কুমারকে রক্ষা করিয়া দারার সহিত মিলিত হইল।

পড়ন্ত রোদে পশ্চিমমুখী হইয়া দারার বাহিনী আবার যুদ্ধ আরম্ভ করিল, বক্‌শী আস্কর খাঁর নেতৃত্বে হরাবল তখন দারার দক্ষিণ বাহুস্বরূপ হইল, দারা স্বয়ং নিজ তাবিনের তিন হাজার অশ্বারোহী লইয়া ব্যূহমূখে আক্রমণার্থ প্রস্তুত হইলেন, তাঁহার বামপা িকুমার সিপ্‌হর শুকোর সহিত মিলিতভাবে বামপক্ষের স্থান গ্রহণ করিল। কেন্দ্রের বাকি নয় হাজার বাদশাহী ফৌজ এই পর্যন্ত শাহজাদাকে ঝড়ঝাপটার মুখে ফেলিয়া তামাশা দেখিতেছিল, ইহাদের মধ্যে অনেকেই বাম দিক হইতে দক্ষিণে ফিরিবার সময় ইচ্ছা করিয়া পিছনে পড়িয়াছিল; যাহারা আসিয়াছিল তাহারা মধ্যভাগে রহিল; কুমার রামসিংহ এবং সৈয়দ বহির খাঁর অধীনে দারার অগ্রবর্তী দশ হাজার রিজার্ভ অশ্বারোহী বাদশাহী ফৌজের পিছনে ব্যূহের পৃষ্ঠরক্ষক (rearguard) রহিল। ময়দানের যেখানে খাদ ঢিবিটিলা-টক্কর ছিল, বাহাদুর বাদশাহী আহুদী রিসালা ওইগুলির আড়ালে লুকাইয়া ভাবিতেছিল, মরিয়া গেলে নয়া সরকারে চাকরি করিবে কে? পাছে দারা জিতিয়া যায় এই আশঙ্কায় শুধু তাহারা পলায়নের অপেক্ষা করিয়া রহিল।

১৩

সাহায্যার্থ দারা উপস্থিত হওয়া মাত্র হরাবলের নির্বাপিতপ্রায় বীর্যবহ্নির শেষ শিখা জ্বলিয়া উঠিল। রাজপুতগণ নায়কশূন্য হইয়াও পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে নাই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত ক্ষুধিত বৃকপালের ন্যায় প্রত্যেক বংশের যোদ্ধারা রণহুঙ্কারে যুদ্ধস্থল কাঁপাইয়া শত্রুসেনার মধ্যে শিকারের সন্ধানে চলিল, তাহাদের সামনে যাহারা পড়িল তাহারা রক্ষা পাইল না। অনিয়ন্ত্রিত শৌর্যশঙ্কার কারণ হইলেও পরিণামে ফলপ্রসূ হয় না। বহুগুণ অধিক শত্রুর দ্বারা পরিবৃত রাজপুতগণ দারুণ মার-কাট করিয়া স্বর্গের পথে চলিল। দারার বক্‌শী আস্কর খাঁ এবং দায়ুদ খাঁর কয়েক হাজার অশ্বারোহী অধিকতর শৃঙ্খলা রক্ষা করিয়া অচল শিলাখণ্ডের ন্যায় মোরাদের পাল্টা আক্রমণ প্রতিহত করিয়া শাহজাদার আগমন প্রতীক্ষা করিতেছিল, এইবার তাহারা শেষ আঘাত হানিবার জন্য অগ্রসর হইল।

দারা অসীম সাহসে আওরঙ্গজেবকে লক্ষ্য করিয়া সম্মুখে সেনাচালনা করিলেন। এই সময়ে জুলফিকর খাঁর তোপখানা ও পাঁচ হাজার অশ্বারোহী বামপার্শ্ব হইতে তাঁহার বাহিনীকে আক্রমণ করিল এবং একই সময়ে শাহজাদা মোরাদ তাঁহার দক্ষিণ পার্শ্বের উপর ভীমবেগে আপতিত হইলেন। কিছুক্ষণ তুমুল যুদ্ধ হইল, বকশী আস্কর খাঁ ও দায়ুদ খাঁ নিহত হইলেন, দারার ব্যূহের দক্ষিণ পঞ্জর ভাঙিয়া গেল; গোলাবর্ষণ ও নূতন সৈন্যের আক্রমণে -বাম পঞ্জরও নিশ্চিহ্ন হইল। কুমার সিপ্হর শুকো ক্রমশ হটিয়া গেলেন, আওরঙ্গজেবের তোপখানা দ্বিগুণ তেজে সরাসরি দারার কেন্দ্রভাগের উপর অগ্নিবৃষ্টি আরম্ভ করিল, অথচ পাল্টা জবাব দেওয়ার মতো দারার কাছে একটা হাউইবাজিও নাই—একশত কামান পরিত্যক্ত অবস্থায় বহুদূরে পড়িয়া রহিয়াছে।

ঐতিহাসিক এবং প্রত্যক্ষদর্শী শত্রু-মিত্র কেহই সামুগঢ়ের যুদ্ধে দারার বুদ্ধির তারিফ করিবার অবকাশ না পাইলেও সকলে একবাক্যে শাহজাদার বেপরোয়া সাহস ও বিপদের মুখে অসামান্য দৃঢ়তার উচ্চ প্রশংসা করিয়াছেন। যুদ্ধের শেষভাগে ময়দানের যে অংশে গোলাবৃষ্টি সর্বাপেক্ষা মারাত্মক, যেখানে শত্রুর চাপে বাহিনী ভাঙিয়া পড়িবার উপক্রম, সেইখানেই উপস্থিত হইয়া দারা সৈন্যগণকে নূতন প্রেরণা জোগাইয়াছিলেন—তাঁহার দিকে চাহিয়াই ক্লান্ত ও শত্রুবিমর্দিত যোদ্ধৃগণ প্রাণের মমতা ত্যাগ করিয়া শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত যুদ্ধ করিতেছিল। হরাবলের রাজপুত সেনা ধ্বংস ও ফিরোজ-জঙ্গ নিহত হইবার পরেও মুসলমান সেনা দারার জন্য প্রাণপণ করিয়া যুদ্ধ করিবে—আওরঙ্গজেব ইহা মনে করিতে পারেন নাই। আজীবন তিনি যাহাকে “পাগলের মুরব্বি”, অর্বাচীন ভীরু কাফের, কাছা-খোলা পণ্ডিত বলিয়া ঘৃণা ও অবজ্ঞা করিয়াছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে নিশ্চিত পরাজয় ও মৃত্যুর মুখে তাহার দুর্জয় পরাক্রম দেখিয়া আওরঙ্গজেব শঙ্কিত হইয়া পড়িলেন। তিনি বুঝিতে পারিলেন, দারা বাঁচিয়া থাকিতে বিপক্ষ সেনা রণে ভঙ্গ দিবে না; সুতরাং দেহরক্ষীবেষ্টিত দারার হাতিই তাঁহার প্রধান লক্ষ্য হইল। এইবার আওরঙ্গজেব তাঁহার ব্রহ্মাস্ত্র ছাড়িলেন। কুমার মহম্মদ সুলতান ও নেজাবত খাঁ হরাবলের দশ সহস্র অশ্বারোহী চর্মবন্ধনীমুক্ত লেলিহান শিকারী চিতাবাঘের ন্যায় দারার বিধ্বস্ত বাহিনীর উপর হামলা করিল; আওরঙ্গজেব স্বয়ং কেন্দ্রস্থ সেনা লইয়া হরাবলের পিছন হইতে আক্রমণ পরিচালনা করিতে লাগিলেন। দারার উপর যাহাদের প্রাণের টান ছিল তাহারা শাহজাদার হাতিকে মধ্যে রাখিয়া অদ্ভুত দৃঢ়তা ও সাহসের সহিত দুশমনের তাজা ঘোড়া ও সওয়ারকে ঠেকাইয়া রাখিল, কিন্তু তাঁহার হাওদাকে তোপের নিশানা হইতে বাঁচিবার উপায় নাই; আট-দশ সের ওজনের গোলা কাহারও হাত কাহারও মাথা উড়াইয়া লইয়া গেল, নক্ষত্ৰ-বৃষ্টির ন্যায় মাথার উপর জ্বলন্ত হাউইবাজি পড়িতে লাগিল। দারার দেওয়ান মহম্মদ সালেহ্, আলীমর্দান খাঁর দুই পুত্র, দায়ুদ খাঁ পাঠান, বকশী আস্কর খাঁ এবং শৌর্যে অতুলনীয় বার্হা-বাসী পাঁচজন সেনানায়ক সিংহবিক্রমে যুদ্ধ করিতে করিতে শেষের ডাকে খোদার দরবারে এত্তালা দিতে চলিলেন। চাটুকার মতলববাজ মোসাহেব বলিয়া দারার যে সমস্ত অন্তরঙ্গ কর্মচারী সাধারণের নিন্দাভাজন ছিল তাহারা অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়া প্রভুর অকপট বিশ্বাস ও দয়া-দাক্ষিণ্যের মর্যাদা রক্ষা করিল।

এই আক্রমণের মুখে দারা বিচার বুদ্ধি ও মাত্রাজ্ঞান হারাইয়াছেন, কিন্তু দুর্জয় অভিমান তাঁহাকে পাইয়া বসিয়াছে; বিপদ যতই ঘনীভূত হইতেছে, স্বকৃত ভুলের অনুশোচনায় ততই নিজের উপর কঠোরতা যেন বাড়িয়া চলিয়াছে। উজির খাঁ প্রভৃতি তাঁহার কয়েকজন আমীর দারার সম্মুখেই ভূতলশায়ী হইলেন, তবুও শাহজাদা অকুতোভয়ে আগাইয়া চলিলেন। যাঁহারা দীর্ঘকাল একনিষ্ঠ সেবার দ্বারা তাঁহার উপর জোর চালাইবার সাহস অর্জন করিয়াছিলেন তাঁহারা হাতিকে পিছনে হটাইয়া শাহজাদাকে অগ্নিবৃষ্টির মধ্যে হাওদা ছাড়িয়া নীচে নামিতে বাধ্য করিলেন।* এই তাড়াহুড়ার মধ্যে হাওদার ভিতরে তাঁহার লৌহকবচ অস্ত্রশস্ত্র (ধনু ব্যতীত?) ও পায়ের জুতা পড়িয়া রহিল। দারা শিরস্ত্রাণরক্ষিত মাথা বাঁচাইয়া খালি পায়ে ঘোড়ার উপর চড়িলেন, একজন বালকভৃত্য তাঁহার কোমরে তৃণ বাঁধিয়া দিতেছিল, গোলার আঘাতে তাহার দেহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হইয়া গেল। যাঁহারা শাহজাদাকে হাতি হইতে নীচে নামিয়া আসিবার জন্য জিদ করিয়াছিলেন, তাঁহারা কেহ পলাইয়া নিজেদের প্রাণ বাঁচাইবার মতলবে এইরূপ করেন নাই; তাঁহাদের কোনপ্রকার দুরভিসন্ধিও ছিল না; হাওদার ভিতরে নিশ্চিত মৃত্যুকে ডাকিয়া আনা অপেক্ষা ঘোড়ায় চড়িয়া যুদ্ধ চালাইয়া যাওয়া শ্রেয়স্কর বিবেচনা করা ব্যতীত অন্য কোনও অপরাধ তাঁহারা করেন নাই।

[*ম্যানুচী ইহার জন্য খলিলুল্লাকে দোষী করিয়াছেন! খলিলুল্লা বহু পূর্বেই সরিয়া পড়িয়াছিলেন। ইহা জল্পনা ব্যতীত কিছুই নয়।]

যাহা হউক, ইহার ফল বিপরীত হইল। এতক্ষণ পর্যন্ত গজারূঢ় শাহজাদার ব্যক্তিত্ব ও পৌরুষ শক্তিশালী চুম্বকখণ্ডের ন্যায় বাহিনীর খণ্ডাংশসমূহকে যুদ্ধক্ষেত্রে সংহত করিয়া রাখিয়াছিল। হাওদা খালি দেখিয়া দূরস্থ সেনাগণ ধরিয়া লইল দারা গতাসু হইয়াছেন, এখন কাহার জন্য তাহারা যুদ্ধ করিবে? বাদশাহী ফৌজ যেদিকে পারিল পলাইতে লাগিল, সর্বপশ্চাতে কুমার রামসিংহের রাজপুতগণও এই ধাক্কায় সরিয়া পড়িল, শেষ পর্যন্ত হতাবশিষ্ট দেহরক্ষী ও কয়েকশত অশ্বারোহী দারাকে রক্ষা করিবার জন্য পড়িয়া রহিল। দক্ষিণ হইতে মোরাদ, বাম দিক হইতে জুলফিকর খাঁ, পশ্চাৎভাগ হইতে ইসলাম খাঁ দারার হতাবশিষ্ট সেনাকে ঘিরিয়া ফেলিয়াছিল; সামনে কুমার মহম্মদ সুলতান ও নেজাবত খাঁর অশ্বারোহী তরঙ্গ; ভুলের চরে ঠেকিয়া ভাঙা জাহাজের আনাড়ি কাপ্তান কতক্ষণ বাঁচিবেন? এই সময়ে ভীষণ ধূলিঝঞ্ঝা ও তাপপ্রবাহ আওরঙ্গজেবের পিঠের উপর দিয়া দারার সৈন্যগণের মুখে আঘাত করিল; অপরাহ্ণে সন্ধ্যার অন্ধকার—পাঁচ হাত দূরে লোকের মুখ দেখা যায় না; যাহারা “জল, জল” করিয়া চিৎকার করিতেছিল তাহাদের মুখ ধূলায় ভর্তি, সর্বাঙ্গে গরম হাওয়ার ছেঁকা। দারার পাশে তাঁহার কচি নাবালক পুত্র সিপ্‌হর শুকো আতঙ্ক ও যন্ত্রণায় কাঁদিতে লাগিলেন। বালকের ক্রন্দন শত্রুর শস্ত্রাঘাত অপেক্ষাও তীব্রভাবে তাঁহার মর্মস্থলে আঘাত করিল, তিনি মৃত্যুর সন্ধানে সম্মুখে অশ্ব চালিত করিলেন। যাঁহারা নিজের প্রাণ অপেক্ষা দারার প্রাণের উপর অধিক মমতা রাখিতেন তাঁহারা পিতা-পুত্রের ঘোড়ার লাগাম ধরিয়া আগ্রার পথ ধরিলেন। ঝঞ্ঝার অবসানে শবাকীর্ণ রণভূমি কাঁপাইয়া আওরঙ্গজেবের বিজয়-দুন্দুভি বাজিয়া উঠিল।

১৪

মোগল-কুরুক্ষেত্রে এইভাবে ধর্মের পরাজয় হইল, ধর্মনিরপেক্ষ মহামানবতার ভিত্তির উপর জাতি, ধর্মরাষ্ট্র ও ভাষার দ্বারা কালচক্রে খণ্ডিত ভারতের অঙ্গ যোজনা করিয়া “মহাভারত” স্থাপনার আকবরশাহী স্বপ্নের এই সামুগঢ়েই শেষ সমাধি। যুগে যুগে ধর্মের উপর অসুর-বলদৃপ্ত ছলপরায়ণ অধর্ম জয়লাভ করিয়াছে; পার্থসারথির মতো কর্ণধার থাকিতেও ধর্মের তরণী কুরুক্ষেত্রে প্রায় ডুবিতে বসিয়াছিল, অধর্মের শক্তিকে উপেক্ষা করিলে ভবিষ্যতেও ধর্মের পরাজয় ঘটিতে পারে।

সামুগঢ়ের যুদ্ধে দারাকে জয়ী করা খোদাতালারও অসাধ্য ছিল। দারার পরাজয়ের কারণ আওরঙ্গজেব, খলিলুল্লা নহেন, তাঁহারা নিমিত্ত মাত্র। শাহজাহান পুত্রকে ফৌজ, তোপখানা অপরিমিত ধন দিয়াছিলেন, কিন্তু যাহা মগজে নাই উহা তিনি কেমন করিয়া দিবেন? লড়াইয়ের দাবাখেলায় আওরঙ্গজেব ও দারা যদি স্থানবিনিময় করিতেন তাহা হইলেও দারা আওরঙ্গজেবের ঘুঁটি লইয়া নিঃসন্দেহে হারিয়া যাইতেন, খলিলুল্লার বিশ্বাসঘাতকতা আওরঙ্গজেবকে কাবু করিতে পারিত না।

আওরঙ্গজেবের ব্যক্তিত্বের গুণে তাঁহার হাতে মাটি লোহা হইয়াছিল; দারার হাতে লোহাও মাটি হইয়া গেল। আওরঙ্গজেব অপেক্ষা তিনগুণ অধিক মনসব ও সুযোগসুবিধা পাইয়াও তিনি উহার সদ্ব্যবহার করিতে পারেন নাই। দারা স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে নামিয়া হুকুম না চালাইলে ফিরোজ-জঙ্গ ও রাও ছত্রশাল যুদ্ধ অন্তত অমীমাংসিত রাখিয়া বাহিনীকে নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরাইয়া আনিতে পারিতেন। দারার পরাজয়ের জন্য তিনিই সম্পূর্ণ দায়ী; এবং জয়ের বরমাল্য আওরঙ্গজেবের উপযুক্ত পুরস্কার—ইহা অস্বীকার করিলে সত্যের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়।

এই যুগের তুলনায় সেই যুগের হাতাহাতি যুদ্ধকে একটা বড় রকমের দাঙ্গা বলিলেই হয়। তিন-চারি ঘণ্টার মধ্যে সরকারি হিসাবে আওরঙ্গজেবের পক্ষে পাঁচ হাজার ও দারার পক্ষে দশ হাজার সৈন্য নিহত হইয়াছিল; বেসরকারি হিসাবে হয়তো আরও বেশি লোক মরিয়াছিল। দারার পক্ষে নামজাদা নয়জন রাজপুত এবং উনিশ জন মুসলমান সেনাধ্যক্ষ নিহত হইয়াছিলেন; আওরঙ্গজেবের পক্ষে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য দাক্ষিণাত্যের দেওয়ান মুলতাফত খাঁ গরমেই মারা গিয়াছিলেন এবং চারিজন দ্বিতীয় শ্রেণীর মনসবদার লড়াই করিয়া মরিয়াছিলেন; ইহা ব্যতীত বাহাদুর খাঁ প্রভৃতি আটজন আহত হইয়াছিলেন। সুজানসিংহ শিশোদিয়া ধর্মাতের যুদ্ধ হইতে পলায়নের পর মোরাদের পক্ষে সামুগঢ়ের যুদ্ধে নিমকহালালি করিয়াছিলেন।

১৫

দারা ও সিপ্‌হর শুকোকে লইয়া হতাবশিষ্ট দেহরক্ষিগণ ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াইয়া যুদ্ধক্ষেত্র হইতে তিন-চারি মাইল দূরে গিয়াছিল। শাহজাদা এইখানে এক গাছের ছায়ায় লৌহ-শিরস্ত্রাণ খুলিবার জন্য বসিয়া পড়িলেন; তাঁহার চোখে দুনিয়া আঁধার, সাজানো বাগান চোখের সামনে শুকাইয়া গিয়াছে। কিছুক্ষণ পরে অনুসরণকারী শত্রুর দামামাধ্বনি নিকটবর্তী হইতে লাগিল, কিন্তু অনুচরগণের অনুনয়-বিনয় সত্ত্বেও দারা উঠিলেন না। পলাইয়া কি হইবে? অবশেষে তাঁহাকে ঘোড়ায় তুলিয়া সকলে সন্ধ্যার অন্ধকারে আগ্রার কাছে উপস্থিত হইল, শাহজাদা আঁধারে মুখ ঢাকিয়া নিজ প্রাসাদে প্রবেশ করিলেন। সেই করাল সন্ধ্যায় আগ্রা শহরের প্রতি গৃহে রোদনের ধ্বনি, ব্যাপক আতঙ্ক। ম্যানুসী খলিলুল্লা খাঁর হাভেলির পাশ দিয়া যাইতেই এক বাঁদী আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, সাহেব, আমাদের খাঁ সাহেবের খবর কি? খলিলুল্লার উপর ম্যানুসী হাড়ে হাড়ে চটা, হঠাৎ দুষ্টবুদ্ধি মাথায় আসিল। তিনি খলিলুল্লার শোচনীয় মৃত্যুর এক বিশদ ও সম্পূর্ণ মিথ্যা কাহিনী বাঁদীকে শুনাইয়া তাঁহার বাড়িতেও মরা-কান্নার রোল তুলিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *