১১. ভ্রাতৃ-বিরোধের পূর্বাভাস

একাদশ অধ্যায় – ভ্রাতৃ-বিরোধের পূর্বাভাস

১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দ, ২৮শে মে। আগ্রা দুর্গের পাদচুম্বিনী ক্ষীণতোয়া যমুনার প্রশস্ত বালুকা- সৈকতে নগরীর উৎসুক জনতার বিপুল সমাবেশ ও অস্ফুট উল্লাসগুঞ্জন। অশ্বপৃষ্ঠে স্বয়ং সম্রাট শাহজাহান কুমার দারা, শুজা, আওরঙ্গজেব, কচ্ছবাহপতি মির্জা রাজা জয়সিংহ প্রমুখ সেনানীমণ্ডল পরিবেষ্টিত হইয়া দুর্গপ্রাচীরের ছায়ায় স্থানগ্রহণ করিয়াছেন। দলিল না থাকিলেও অনুমান হয়, বাদশাহের অনুপস্থিতিতে অন্তঃপুরচারিণীগণ অবগুণ্ঠনাবৃতা হইয়া অন্তরালে ছিলেন; শাহীমহলের পূর্ব দিকের অলিন্দ হইতে মর্মর জালমার্গ-বিচ্ছুরিত কান্তা-মুখশ্রী নিম্নস্থ রঙ্গভূমিকে উদ্ভাসিত করিয়াছিল।

যথাসময়ে চলমান পর্বতসদৃশ সুধাকর এবং সুরতসুন্দর নামক হস্তিযুগল শাহী দর্শনঝরোকার নিচে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইল। কিছুক্ষণ শুণ্ডে শুণ্ডে জড়াজড়ি ঠেলাঠেলি করিয়া মত্ত মাতঙ্গদ্বয় কিঞ্চিৎ পিছনে হটিয়া গেল, জনসমুদ্র চঞ্চল তরঙ্গায়িত, সর্বত্র প্রবল উত্তেজনা। অজাতশ্মশ্রু কুমার আওরঙ্গজেব যুদ্ধের দ্বিতীয় দফা ভালো করিয়া দেখিবার জন্য ঘোড়া দাবাইয়া সুধাকর হাতির খুব নিকটে আসিলেন। ক্রোধান্ধ সুধাকর সুরতসুন্দরকে সামনে না পাইয়া শাহজাদার উপর হামলা করিল, চারিদিকে হায় হায় পড়িয়া গেল। শোরগোল চিৎকার ও আতসবাজির আগুন উপেক্ষা করিয়া সুধাকর আওরঙ্গজেবের ঘোড়াকে ধরিবার উপক্রম করিল। ষোল বৎসর বয়সেই কুমার পাকা সওয়ার; ঘোড়া সামলাইয়া তিনি হাতিকে বর্শা ছুঁড়িয়া মারিলেন। হাতি হার না মানিয়া ঘোড়াকে শুঁড়ে জড়াইয়া ধরিতেই কুমার ভূমিতে লাফাইয়া পড়িয়া খোলা তলোয়ার হাতে রুখিয়া দাঁড়াইলেন। পলায়মান ছত্রভঙ্গ জনতার ভিড় ঠেলিয়া সম্রাট কিংবা অন্য কেহ সহসা সাহায্যার্থ অগ্রসর হইতে পারিলেন না। এই সময় কুমার শুজা এবং মির্জা রাজা জয়সিংহ দ্রুত ঘোড়া ছুটাইয়া সুধাকরের প্রতি বর্শা নিক্ষেপ করিলেন। ইত্যবসরে সৌভাগ্যক্রমে সুরতসুন্দর পুনরায় যুদ্ধার্থ উপস্থিত হইল। মানুষ ও প্রতিস্পর্ধী সুরতসুন্দরের সহিত একাকী যুদ্ধে ভরসা না পাইয়া সুধাকর শুঁড় তুলিয়া ছুটিয়া পলাইল। শাহজাদা রক্ষা পাইলেন — গরিবের খবর ইতিহাসে নাই।

এই বাহাদুরির জন্য সম্রাট ওইদিন আওরঙ্গজেবকে “বাহাদুর” উপাধি ও বহুমূল্য উপহার প্রদান করিলেন; সারাদিন তাঁহাকে কাছছাড়া করেন নাই। আওরঙ্গজেবের অসীম সৌভাগ্যে ভ্রাতাদের মন সেদিন ঈর্ষায় ব্যথিত হইয়াছিল, কিংবা পিতার প্রিয়তম পুত্র দারার মুখে বিষাদের ছায়া পড়িয়াছিল—এমন কথা ইতিহাসে লেখা নাই; তবুও আওরঙ্গজেব সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি বাপকে শুনাইয়া দিলেন — খোদাতালার হাতে মানুষের জান; আমি শুধু ভাইসাহেবদের আচরণে ব্যথিত ও লজ্জিত। তাঁহার শেষের একমাত্র লক্ষ্য দারা; ইহা দারার প্রতি তাঁহার জন্মগত বিদ্বেষ ও ঈর্যার ভাবী অমঙ্গলসূচক ঝাঁজ, সপশিশুর প্রথম বিষোদ্গার, শাহজাহানের আশঙ্কা আওরঙ্গজেবের পরবর্তী আচরণে আরও ঘনাইয়া উঠিল।

জাহানারা বেগমের ঠিক বারো মাস পরে কুমার দারা এবং কন্যা রোশনারার জন্মের চৌদ্দ মাস পরে (২৪শে আগস্ট ১৬১৭) আওরঙ্গজেব ভূমিষ্ঠ হইয়াছিলেন। এই কারণে কিংবা অন্য কোন কারণে জাহানারা দারা এবং রোশনারা- আওরঙ্গজেবের ন্যায় পাল্টা জুড়ি ইতিহাসে বড় বেশি খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। লোকের ধারণা ছিল শাহজাহান জাহানারা-দারাকে এক মাপে এবং রোশনারা-আওরঙ্গজেবকে অন্য মাপে ভালোবাসিতেন ও বিশ্বাস করিতেন। শাহী পরিবারে এই “যোগ্যং যোগ্যেন যোজয়েৎ” ব্যাপার গতানুগতিক কিংবা অস্বাভাবিক নহে; কারণ জাহানারা এবং দারার স্বভাব ও জীবনাদর্শের যে রকম মিল দেখা যায়, রোশনারা এবং আওরঙ্গজেবের স্বার্থবুদ্ধি ও চরিত্রে তদ্রূপ সামঞ্জস্য ছিল। দারা এবং আওরঙ্গজেব শাহজাহান-চরিত্রের এপিঠ ওপিঠ; এইজন্য তিনি পুত্রদ্বয়কে লইয়া দোটানা স্রোতে পড়িয়াছিলেন। শাহজাহানের সংসারে এই সন্তান চতুষ্টয়কে আশ্রয় করিয়া ধর্মবুদ্ধি-পাপবুদ্ধি এবং লক্ষ্মী-অলক্ষ্মীর যুগপৎ সমাবেশ যেন একটি সুপরিকল্পিত বিয়োগান্ত নাটকের ভূমিকা।

মাতা মমতাজমহলের মৃত্যুর পর জাহানারা বেগম সমস্ত ভ্রাতা-ভগিনীগণকে স্নেহের সমান অংশই দিয়াছিলেন, চরিত্রগুণে এবং নিত্য সাহচর্যের জন্য হয়তো দারার প্রতি টান একটু বেশি ছিল। তিনি দারার ইষ্ট কামনা করিলেও অন্য কাহারও অনিষ্ট চিন্তা করিতেন না; সকলের নালিশ এবং পিতার কাছে সুপারিশ করিবার তাগিদ তাঁহার নিকটেই আসিত। আওরঙ্গজেব ভ্রাতা-ভগিনীদের মধ্যে একমাত্র জাহানারাকে শ্রদ্ধা করিতেন, কিঞ্চিৎ বিশ্বাসও করিতেন।

জাহানারা সাম্রাজ্যের সর্বপূজ্যা “বেগম সাহেবা”। অন্দরমহলে এবং দরবারের আড়ালে শাহী তক্তের ছায়ায়, পুত্রী হইয়াও তিনি সম্রাটের মাতার মর্যাদা ও ক্ষমতালাভ করিয়াছিলেন। গোলকুণ্ডা-বিজাপুরের রাজদূত, অর্থী-প্রত্যর্থী ও অভিজাতবর্গ ‘বেগম সাহেবা’র দরবারে কুর্নিশ করিতে আসিতেন, অভাব-অভিযোগ জানাইতেন। সেকালেও ঘুষ, নজর, তদ্বির এবং সুপারিশ ব্যতীত কাজ হাসিল হইত না। লোকে মনে করিত, বাদশাহের মর্জির চাবিকাঠি উজির সাদুল্লার হাতে নয়, দারা ও জাহানারার হেফাজতে। রোশনারা বেগম জ্যেষ্ঠ ভগিনীর সৌভাগ্যে হিংসায় জ্বলিয়া উঠিলেন; কিন্তু পিতা ও শাহজাদা দারা বাঁচিয়া থাকিতে জাহানারাকে স্থানচ্যুত করা দুঃসাধ্য, এইজন্যই আওরঙ্গজেব ও তাঁহার ভাগ্য একই সূত্রে গ্রথিত হইয়া পড়িল।

আওরঙ্গজেব, সুজা, মোরাদ– কেহই জাহানারার প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন ছিলেন না; তাঁহারা অভিমান করিতেন, অনিষ্ট কিংবা প্রতিহিংসার চেষ্টা করেন নাই। ইহার কারণ, জাহানারা কাহারও ন্যায্য দাবি এবং অধিকারের বিরোধিতা করেন নাই। দারার প্রতি তাঁহার অন্তরের টান কোনও ইহলৌকিক স্বার্থদুষ্ট ছিল না। রোশনারা জাহানারাকে ঈর্ষা নয়, দস্তুরমত হিংসা করিতেন। নারীর দুর্দমনীয় ক্ষমতাস্পৃহা অতি প্রলয়ঙ্করী, ক্ষমতার নেশা শরাবের নেশা হইতে শত গুণ মারাত্মক। মুসলমান ইতিহাসে নারী-চরিত্রের উল্টা পিঠ দেখিতে গেলে রক্ত জমাট হইয়া যায়, যেমন আবু সুফিয়ানের পত্নী এবং মারিয়ার মতো “হিন্দা” প্রথম যৌবনে প্রেম প্রত্যাখ্যানের প্রতিহিংসা পূর্ণ করিবার জন্য রণক্ষেত্রে শায়িত হজরত মহম্মদের খুল্লতাত বৃদ্ধ হামজার কলিজা চর্বণ করিয়াছিলেন। হারুণ-অল-রশিদের মাতা খাইজুরান স্বামীকে ভেড়া বানাইয়া সাম্রাজ্য শাসন করিতেন; পুত্র হাদি খলিফা হইয়া মাতাকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়াছিলেন—এই দোষে হাদিকে তিনি দাসীগণের দ্বারা হত্যা করাইয়া হারুণকে খলিফা করিয়াছিলেন। শাহজাহানের কন্যা রোশনারা এই জাতীয় স্ত্রী-চরিত্র, মূর্তিমতী অসূয়া ও লালসা জড়িত বিজীগিষা।

পুণ্যশীলা জাহানারা বেগম মহিমময়ী নারী,––সম্রাট পরিবারের পারিজাত প্রসূন। রোশনারা অশিব শ্মশানকুসুম, পঙ্কিল সরোবরে নলিনী নহেন; জ্যেষ্ঠা রাজকুমারী ধর্ম ও জ্ঞান চর্চায়, ত্যাগ ও সেবায় জীবন-মরুর মধ্যে অমৃতের সন্ধান পাইয়াছিলেন। রোশনারার ভোগমুখী চিত্তবৃত্তি অনীপ্সিত কৌমার্যে ব্যাহত হইয়া বিপ্লব ও ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে তৃপ্তি খুঁজিতেছিল। তত্ত্ববাদিনী হইয়াও জাহানারা দারার মতো শরিয়তের অনুশাসন লঙ্ঘন করেন নাই। তিনি রোজা নমাজে নিষ্ঠাবতী ছিলেন, অবসর সময়ে ধ্যানধারণা করিতেন, কিংবা গ্রন্থ রচনা করিতেন। যথা খ্বজা মুইনউদ্দীন চিশতীর ফারসি জীবন-চরিত Munis ul Aruwah (com- forter of souls) দ্রষ্টব্য। এইরূপ খেয়ালে সময় নষ্ট করিবার ফুরসত চঞ্চলা রোশনারার ছিল না। দারা সম্রাট হইলে পিতার অবর্তমানেও জাহানারা কর্তৃত্ব করিবেন–এই দুশ্চিন্তা রোশনারাকে নিরন্তর দগ্ধ করিত। বিধাতার তথা পিতার সঙ্কল্প বিফল করিবেন, —ইহাই যেন তাঁহার দুর্জয় প্রতিজ্ঞা। এইজন্য সমস্বার্থে আবদ্ধ সমানধর্মী ভ্রাতা আওরঙ্গজেব রোশনারার নির্বাচিত ভাবী দিল্লীশ্বর। রোশনারা শাহীমহলের সংবাদ নিয়মিত ভাবে গুপ্তচরের মারফত বাহিরে প্রেরণ করিতেন, ষড়যন্ত্রের জাল বুনিতেন।

ইতিহাসে রোশনারা দুই বার ছিন্নমস্তা রূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছেন; প্রথম বার বন্দী ভ্রাতা দারার বিচার প্রহসনের সময়, দ্বিতীয় বার আওরঙ্গজেবের রোগশয্যায়। সম্রাট একবার ৪৪ দিন শয্যাশায়ী ছিলেন (১২ই মে হইতে ২৪শে জুন ১৬৬২)। রোগের সঙ্কট সময়ে তাঁহার জীবনের আশা সকলেই ত্যাগ করিয়াছিল, তখন সম্রাটের প্রকোষ্ঠে নূতন “বেগম সাহেবা” রোশনারার কড়া পাহারা, স্ত্রীপুত্রগণের পর্যন্ত প্রবেশ করিবার হুকুম নাই। একদিন সম্রাটের অন্যতমা পত্নী নবাববাঈ মরীয়া হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে হঠাৎ ছুটিয়া আসিয়া মুমূর্ষু স্বামীর বিছানার উপর আলুথালু বেশে ঝাঁপাইয়া পড়িলেন; রোশনারা চামুণ্ডা মূর্তি ধারণ করিয়া হতভাগিনীকে চুল ধরিয়া টানিতে টানিতে ঘরের বাহির করিয়া দিলেন।

আরোগ্যের পর চতুর আওরঙ্গজেবের বুঝিতে বিলম্ব হইল না ভগ্নী তাঁহার পরেও নিজের ভবিষ্যৎ রচনা করিতেছেন। রোশনারার স্বপ্ন টুটিয়া গেল; সম্রাটের কন্যা জেবউন্নিসা অন্দরমহলে সর্বেসর্বা হইলেন। নিজের জন্য উদ্যান-পরিবেষ্টিত সুরম্য সমাধি (বর্তমান রোশনারাবাগ) প্রস্তুত ব্যতীত রোশনারার অন্য প্রয়োজন ফুরাইয়া গেল।

শাহজাহান দুঃখ করিতেন, পুত্র আওরঙ্গজেব বুদ্ধিমান ও বাহাদুর বটে, তবে বড় রোগা; কিন্তু পুত্রের রোগের কারণ তিনি বুঝিয়াও বুঝিলেন না। পেটে কুবুদ্ধির ভুটভাট, মগজে কূটনীতির দাবাখেলা অষ্টপ্রহর চলিতে থাকিলে হেকেমি চুরনে শুরুয়াও হজম হয় না। কোনকালে আওরঙ্গজেবের প্রাণে শান্তি ও তৃপ্তি এবং চিত্তে প্রফুল্লতা ছিল না। কৃতকার্যতার প্রশংসায় তাঁহার মুখ কঠোর ও গম্ভীর হইয়া উঠিত, কেহ তাঁহার নিন্দা করিয়াছে শুনিলে কিংবা পরের অনিষ্টসংবাদ পাইলে কদাচিৎ মুচকি হাসিতেন। শাহজাহান তাঁহার প্রিয়তম পুত্র দারাকে অনেক কিছু দিয়াছিলেন। তিনি জানিতেন কিছু না পাইলেও এই পুত্র তাঁহার বিরুদ্ধাচরণ করিবে না; কিন্তু আওরঙ্গজেব? দারাকে বঞ্চিত করিয়া শাহজাহান যদি স্বহস্তে রাজমুকুট আওরঙ্গজেবের মাথায় পরাইয়া দিতেন তবুও তাঁহার দুশ্চিন্তার অবসান হইত না; বিনা দ্বিধায় হয়তো পিতাকে বলিতেন, “বাপজান! আপনি এখন মক্কা শরীফে বাস করিলে সুবিধা হয়; জাহানারা বেগম আগ্রায় থাকিয়া যাইতে পারেন।”

শাহজাদাগণের মধ্যে শুজা সর্বপ্রথমে মনসব পাইয়াছিলেন এবং আওরঙ্গজেব সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে কর্তৃত্ব ও সুবাদারি পদে নিযুক্ত হইয়াছিলেন। ১৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজেব বুন্দেলা বিদ্রোহ দমন করেন। ইহার পর তিনি আট বৎসর দাক্ষিণাত্যের সুবাদারি পদে অধিষ্ঠিত থাকিয়া (১৬৩৬-১৬৪৪ খ্রিঃ) বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা রাজ্যের সহিত যুদ্ধে অসীম কৃতিত্ব দেখান। ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে মার্চ রাত্রিতে সিঁড়ির উপর মোমবাতির শিখায় অনবধানতাবশত জাহানারা বেগমের কাপড়ে আগুন ধরিয়া গিয়াছিল, সর্বাঙ্গ দগ্ধ হইয়া তিনি মরণাপন্ন হইলেন। ভগ্নীকে দেখিবার জন্য আওরঙ্গজেব ২রা মে আগ্রা পৌঁছিলেন। ইহার তিন সপ্তাহ পরে এমন কিছু ঘটিয়াছিল যাহার জন্য তিনি হঠাৎ তাঁহার সুবাদারি হইতে বরখাস্ত হইলেন এবং মনসব পর্যন্ত হারাইলেন। মনের দুঃখে আওরঙ্গজেব ফকির হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন; কিন্তু শাহজাহানের কঠোর মনোভাব অনমনীয় রহিল। ইতিমধ্যে জাহানারা বেগম আরোগ্যলাভ করিলেন। তিনি সম্রাটের কাছে আওরঙ্গজেবের অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কন্যাকে অদেয় কিছু শাহজাহানের ছিল না, আওরঙ্গজেব গুজরাটের সুবাদারি এবং নিজের পূর্ব মনসব ফিরিয়া পাইলেন।

দাক্ষিণাত্য হইতে একটা বড় রকমের মতলব আঁটিয়া আওরঙ্গজেব আগ্রায় আসিয়াছিলেন। পিতার সৌভাগ্যের পীঠস্থান দাক্ষিণাত্যের সুবাদার হইয়া বিজাপুর- গোলকুণ্ডাকে পদানত করিয়া তিনি হয়তো দিল্লির সিংহাসনে বসিবার আশা প্রায় ফলপ্রসূ মনে করিয়াছিলেন, অন্তত যোগ্যতার পুরস্কারস্বরূপ দারার উপরে একটা ত্রিশ হাজারী মনসব ন্যায্য প্রাপ্য বলিয়া তাঁহার মনে হইয়াছিল। দরবারে আসিয়া তিনি কেবল দাদার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করিতেছিলেন; শাহজাহান জাহাঙ্গীর নহেন, পুত্রের আসল মতলব বুঝিতে তাঁহার বিলম্ব হইল না। এইজন্যই তিনি পুত্রের ক্ষমতা ও দুরাকাঙ্ক্ষা অঙ্কুরে বিনষ্ট করিবার জন্য দৃঢ়তা অবলম্বন করিয়াছিলেন; কিন্তু কন্যার সকরুণ প্রার্থনায় তিনি গলিয়া জল হইয়া গেলেন।

এই ঘটনার সম্ভবত কিছুদিন পরে দারা তাঁহার নবনির্মিত প্রাসাদে সম্রাট ও ভ্রাতাদের আমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। শাহজাহান আওরঙ্গজেবকে সঙ্গে লইয়া দারার প্রাসাদে উপস্থিত হইলেন। যথারীতি অভ্যর্থনা এবং আপ্যায়নাদির পর দারা স্বয়ং পিতা ও নিমন্ত্রিতবর্গকে প্রাসাদের বিভিন্ন অংশ দেখাইতে লইয়া গেলেন। সকল জায়গা ঘুরিয়া তাঁহারা তায়খানা, অর্থাৎ ভিত্তিনিম্নস্থ শীতল প্রকোষ্ঠ দেখিবার জন্য নিচে নামিয়া গেলেন, অন্যের অলক্ষ্যে উহার প্রবেশ পথে একাকী কুমার আওরঙ্গজেব সশস্ত্র দাঁড়াইয়া রহিলেন। উপরে উঠিয়া পুত্রকে ওই অবস্থায় দেখিয়া সম্রাট অত্যন্ত বিস্মিত ও রুষ্ট হইলেন। কারণ জিজ্ঞাসিত হইয়া আওরঙ্গজেব নিবেদন করিলেন, কেহ যদি উপর হইতে সিঁড়ির মুখ বন্ধ করিয়া সম্রাটের জীবন বিপন্ন করে এই আশঙ্কায় আমি পাহারায় ছিলাম।

পুত্রের বুদ্ধিচাতুর্য দেখিয়া সম্রাট প্রমাদ গণিলেন; কোন্ খাতে আওরঙ্গজেবের সর্পিল চিন্তাধারা চলিয়াছে, বুঝিতে বাকি রহিল না। দারার পেটে এতখানি কুবুদ্ধি, এক ঢিলে দুই পাখি মারিবার কৌশল জানা থাকিলে হিন্দুস্থানের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়া যাইত।

বাপের ‘আলালের ঘরের দুলাল’, ভগ্নী জাহানারার ‘নয়নমণি শাহজাদা দারা পিতার জীবদ্দশায় কোনও কৃতিত্বের পরিচয় না দিয়াও অর্ধেক সাম্রাজ্যের অধীশ্বর, ছয় সুবার অনুপস্থিত সুবাদার। তাঁহার মনসব অন্য তিন ভ্রাতার মোট মনসবের প্রায় সমান। দরবারে সম্রাটের ময়ূর সিংহাসনের পার্শ্বে সোনার চৌকি একমাত্র তাঁহার জন্য নির্দিষ্ট—উভয়ের মধ্যে ব্যবধান পিতার পরমায়ু। সম্রাটের পৌত্রগণের মধ্যে দারার পুত্রদ্বয় তাঁহার সর্বাপেক্ষা অধিক স্নেহ ও অনুগ্রহভাজন, এমন কি তাঁহার কর্মচারীগণও অনুরূপ সৌভাগ্যের পাত্র। কেন পিতার, ন্যায়নিষ্ঠ গুণগ্রাহী সম্রাটের এই দুর্বলতা ও অবিচার?

দারাকে শাহানশাহ আদুরে বড় খোকাটির মতো গায়ে আঁচড় লাগিবার ভয়ে সর্বদা চোখে চোখে রাখিতেন, পারতপক্ষে যুদ্ধবিগ্রহে পাঠাইতেন না। যে বয়সে আওরঙ্গজেব বুন্দেলখণ্ড ও দাক্ষিণাত্য জয় করিয়া গুজরাটের সুবাদারি করিতেছিলেন সে বয়সে দারা দূর হইতেও লড়াই দেখেন নাই। ২৪ বৎসর বয়সে দুই ছেলের বাপ হওয়ার পর দারা কান্দাহার সুবা রক্ষা করিবার জন্য প্রথম অভিযানে প্রেরিত হইয়াছিলেন। শাহজাদা ময়দানে দুশমন খুঁজিয়া পাইলেন না, ফাঁকা মাঠে খেলা জিতিয়া বাহবা লইলেন। তিন বৎসর পরে আবার গুজব শুনা গেল, ইরানের শাহসফী বিরাট ফৌজ লইয়া কান্দাহারের দিকে কুচ করিতেছেন। তাঁহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবার জন্য দিল্লীশ্বর দারাকে দ্বিতীয় বার মোগলবাহিনীর অধিনায়ক করিয়া পাঠাইলেন। বুলন্দ-ইকবাল শাহজাদার উঁচু কপাল; শাহসফী নিশাপুরের পথে বহুদূরে কাশান শহরেই কবরস্থ হইলেন। বিজয়-দামামা বাজাইয়া দারা লাহোরে ফিরিয়া আসিলেন, এবং পিতা কর্তৃক এমন বিপুলভাবে সম্বর্ধিত ও পুরস্কৃত হইলেন যেন তিনি গোটা ইরান-তুরান ফতে করিয়া ফিরিয়াছেন। সবই বরাতের জোর!

পাকা মুসলমান ও কাজের লোকের নজরে দারা হইলেন কুঁড়ের বাদশা; কোনও ঝকমারি নাই; দিলখোলা হাসি লইয়া আনন্দসাগরে গা ভাসাইয়া চলিয়াছেন। তাঁহার রোজা নাই; শুক্রবার ব্যতীত অন্যদিনে নমাজ নাই, আছে কেবল কোরান শরীফ লইয়া বেইমানী গবেষণা, ‘নাপাক হিন্দুয়ানী’র সহিত পবিত্র ইসলামের তুলনামূলক উদ্ভট বিচার। সকাল-সন্ধ্যা শাহজাদার মজলিশে যত রাজ্যের পাগলের আনাগোনা, অর্ধ উলঙ্গ কাফের যোগী সন্ন্যাসীর ভিড়। সেখানে মাঝে মাঝে পণ্ডিতরাজ জগন্নাথ সংস্কৃত প্রশস্তি পাঠ কিংবা কর্ণাটক ভাষায় গান শুনাইতেন; নিভৃতে চলিত তাঁহার হিন্দুগুরু কবীন্দ্রাচার্য সরস্বতীর সহিত দর্শন উপনিষদ আলোচনা। কবি, গায়ক, গুণী, চিত্রকর, শিল্পী, গরিব ফকিরদের নিকট তাঁহার দ্বার ও ভাণ্ডার সর্বদা উন্মুক্ত; যাহারা দশ দুয়ারে তাড়া খাইয়া ফিরে তাহাদের ফটক পার হইতে আপত্তি নাই,––তাহাদের কাছে তিনি মাটির মানুষ। শাহী দরবারে বড় বড় মনসবদার এমন কি উজির-ই-আজম সাদুল্লা খাঁর সহিত ব্যবহারে কিন্তু তিনি দ্বিতীয় ফরায়ুন (Pharoah)। ঈর্ষামূলক হইলেও এই চিত্র দারার চরিত্রের এক দিক সন্দেহ নাই।

পিতা শাহজাহান আওরঙ্গজেবের মতো পাকা নমাজী; সুতরাং দারা হয়তো ভয়ে শুক্রবারের জুম্মা নমাজ খেলাফ করিতেন না। ওইদিন তিনি দরাজ হাতে ফকির গরিবকে দানখয়রাত করিতেন; তাঁহার সুফিয়ানা ব্যাখ্যায় দান এবং ক্ষমাই হইল খোদাতালার আসল ইবাদৎ। ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে শাহজাদা সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত ছিলেন; কেননা রাজজ্যোতিষী ভবানীপ্রসাদ কোষ্ঠী বিচার করিয়া বলিয়াছেন দারা নিশ্চয়ই বাদশাহ হইবেন; তাঁহার অন্যতম গুরু সুফী সরমদ বলিয়াছিলেন দারা দুনিয়ার মালিক হইয়া জন্মিয়াছেন। জ্যোতিষী ভবানীপ্রসাদকে তাঁহার এক বন্ধু সাবধান করিয়া বলিয়াছিল দারা বাদশাহ না হইলে তোমার মাথাটাই আগে যাইবে। ধূর্ত ভবানীপ্রসাদ বলিল, তোমার যেমন বুদ্ধি! বাদশাহ না হইলে নিজের মাথা বাঁচাইতেই শাহজাদা ফাঁপরে পড়িবেন, আমার মাথা লওয়ার ফুরসত কোথায়? আওরঙ্গজেবের হুকুমে শিরশ্ছেদ করিবার পূর্বে এক মোল্লা সাধু সরমদকে টিটকারি দিয়া বলিয়াছিল, দারার বাদশাহী গেল কোথায়? সরমদ নিতান্ত সপ্রতিভ ভাবে জবাব দিলেন, তিনি বেহেশতের বাদশাহ হইয়া গিয়াছেন!

সন্ধ্যাবেলা শাহীমহলে ডাক না পড়িলে দারা তত্ত্বজ্ঞানী সুফী সাধকগণের জীবনী সঙ্কলন, উপনিষদ এবং যোগবাশিষ্ট গ্রন্থের ফার্সি অনুবাদ প্রভৃতি কাজে ব্যস্ত থাকিতেন, কিংবা শাহমুহবীবুল্লা এলাহাবাদী, সরমদ এবং অন্যান্য ছোট বড় সাধু ফকিরগণের কাছে বস্তা বস্তা চিঠি লিখিতেন, সৃষ্টিছাড়া প্রশ্ন করিতেন। নিশীথ রাত্রে তিনি কাদেরিয়া কীর্তন পদ্ধতি অনুসারে দিলের উপর জেকের-ফেকেরের “জবর” (জপে “ধ্বনির” আঘাত) মারিতেন; কখনও প্রাণায়াম করিতে করিতে “গায়েবী আওয়াজ” (“অনাহত” ধ্বনি) শুনিতেন। ঘুমাইয়া পড়িলেও তিনি রাজযোগ সম্বন্ধে পুস্তিকা (যথা স্বরচিত রিসালা-ই-হক্‌মা) লিখিবার জন্য ফেরেশতার মারফত খোদার হুকুম পাইতেন। কোন কোন রাত্রিতে তাঁহার স্বপ্নপ্রয়াণ হইত, জঙ্গলে বশিষ্ঠ ঋষি ও রামচন্দ্রের সাক্ষাৎলাভ করিয়া জাগিয়া উঠিতেন।

এই সমস্ত ব্যাপারের উপর আরও ছিল শাহজাদার কুণ্ডলিনী ভেদ প্রক্রিয়া। লাহোরের হজরত মিঞা মীরের মুরীদ হজরতশাহ বদশী দারার মন্ত্রগুরু। তাঁহার কৃপায় নিজের কুণ্ডলিনী ছাড়াইয়া তিনি পরের কুণ্ডলিনী ভেদ করাইবার ক্ষমতা লাভ করিয়াছিলেন। ধর্মচর্চায় তিনি সাধিকা জাহানারার অন্যতম গুরুস্থানীয়। কাশ্মীর সফরের সময় জাহানারা গুরু বদশীর কাছে বসিয়া তিন দিন এই সাধনা (untying the knot) করিয়া সফলতা লাভ করিয়াছিলেন। দারা পরের মুখে স্তোকবাক্য শুনিতে শুনিতে নিজেও বিশ্বাস করিতেন তিনি বাস্তবিক একজন দৈবানুগৃহীত “ইসান-ই-কামিল বা “পূর্ণপুরুষ”।

দারা ও আওরঙ্গজেব পরোক্ষে পরস্পরের প্রতি বাছা বাছা বিশেষণ প্রয়োগ করিতেন। দারা বলিতেন ভাই আওরঙ্গজেব নমাজী বকধার্মিক; আওরঙ্গজেব বলিতেন কাফের শাহজাদা দরবারী মোসাহেব, মতলববাজ পাগল। আওরঙ্গজেবের অষ্টপ্রহর দুশ্চিন্তা ইসলাম ও মোগলসাম্রাজ্য; ইসলাম বিপন্ন করিয়া ভগ্নী জাহানারার সহায়তায় তৈমুরের শাহীতক্তে বসিবেন দারা? আর আওরঙ্গজেব?

প্রথম বয়স হইতেই দারা দৈবে দারুণ বিশ্বাসী, সাংসারিক ব্যাপারে বাস্তবদৃষ্টি ও দৃঢ়তাশূন্য; উপায়-অপায় নির্ণয়ে অপারগ, লেখাপড়া ব্যতীত অন্য কার্যে পরমুখাপেক্ষী; পরের মুখে ঝাল খাওয়া তাঁহার স্বভাব। আওরঙ্গজেব ছিলেন ধর্মনিষ্ঠ এবং স্বভাব-চরিত্র, বুদ্ধি ও জীবনযাত্রায় দারার সম্পূর্ণ বিপরীত। বাল্যকাল হইতে তিনি বাপের বাড়া পাকা সুন্নি, ইমাম আবুহানিফার মতানুগামী। লড়াইয়ের ময়দান কিংবা সফরেও তাঁহার রোজা নমাজ আমরণ বাদ পড়ে নাই। ইসলামীয় ধর্মশাস্ত্র ও ব্যবহারশাস্ত্রে তিনি সুপণ্ডিত ছিলেন, সর্বদা হরাম-হালাল জায়েজ-নাজায়েজ, বিধি-নিষেধ বিচার করিয়া চলিতেন। এই বিচারের ফাঁকিও তিনি জানিতেন এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে প্রয়োগ করিতেন। আওরঙ্গজেব শিকার ব্যতীত সর্ববিধ ব্যসন বর্জন করিয়াছিলেন, তাঁহার জীবনে ছন্দ ও প্রাণে সঙ্গীত ছিল না, কঠোর সংযম ও নিয়মানুবর্তিতা ছিল। তাঁহার দাড়ির দৈর্ঘ্য, পায়জামার ঝুল, জামার সুতা ও রং শরিয়তের অনুমোদনসাপেক্ষ ছিল। বাদশাহ হইয়াও তিনি ফকির, হিন্দুস্থানের জিন্দাপীর খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন। রাজকোষের অর্থ তিনি হারাম মনে করিতেন। রুজি (উপার্জন) হালাল করিবার জন্য তিনি নিজে কোরানশরীফ লিখিয়া বিক্রয় করিতেন। কফনের কাপড় ও দফনের খরচের জন্য ওই টাকা জমাইয়া রাখিতেন। সারা জীবনে শরাবের পেয়ালা তিনি দুই বার স্পর্শ করিয়াছিলেন, গলাধঃকরণ করেন নাই—একবার সুন্দরী হীরাবাঈয়ের নিকট প্রেমের পরীক্ষায়, এবং দ্বিতীয় বার মথুরায় নৈশ ভোজের পর পেয়ালার পর পেয়ালা ভাই মোরাদের মুখে তুলিয়া দিয়া অচৈতন্য অবস্থায় তাঁহাকে বন্দী করিবার অভিপ্রায়ে। বাদশাহ হইয়া তিনি শাহীমহল ও রাজধানী হইতে নৃত্যকলা ও সঙ্গীতকে নির্বাসিত করিয়াছিলেন, পাপ-ব্যবসায় দমন করিবার জন্য নাচওয়ালী ও রূপোপজীবিনীগণকে শরিয়ত মতে স্বামী গ্রহণে বাধ্য করিয়াছিলেন।

ইতিহাসে আওরঙ্গজেব মূর্তিমান পুরুষকার। দারার সহায়কারী দৈব এবং মানবীয় শক্তিকে পরাজিত করিবার জন্য তিনি ক্ষেত্র প্রস্তুত করিতেছিলেন। জাহাঙ্গীরের তৃতীয় পুত্রের পক্ষে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে ডিঙাইয়া সিংহাসন লাভ যদি পাপকার্য না হয়, শাহজাহানের বীরত্ব ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারী তাঁহার তৃতীয় পুত্র কেন ওই সিংহাসন হইতে সরিয়া দাঁড়াইবেন?

মুখে সর্বদা আল্লা ভরসা আওড়াইলেও আওরঙ্গজেব সম্পূর্ণ নিজের উপর ভরসা রাখিয়া চলিতেন। আল্লার উপর অটুট বিশ্বাস থাকিলেও আল্লার সৃষ্ট জীবের প্রতি কোনোপ্রকার মমতা কিংবা বিশ্বাস তাঁহার প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল। আওরঙ্গজেব মাটির পৃথিবীর উপর দিয়া চলিতেন। এক পা ফেলিয়া আগে কি আছে আর এক পা দিয়া দেখিতেন; দারার ন্যায় ভাবের ডানায় ভর করিয়া কল্পনাপরীর রাজ্যে উড়িয়া বেড়াইতেন না। মানুষ হিসাবে দারার সদর-অন্দর প্রায় এক ছিল; কিন্তু আওরঙ্গজেব যেন দৌলতাবাদ দুর্গ। মনের দুয়ার মানুষ দূরের কথা, খোদাতালার কাছে খুলিয়াছিলেন কিনা তিনিই জানেন। স্বার্থ, বিবেক ও ধর্ম তাঁহার মধ্যে গোল পাকাইয়া এমন এক গোলকধাঁধার সৃষ্টি করিয়াছিল যাহার মধ্যে ঐতিহাসিক খেই খুঁজিয়া পায় না।

ধর্মের দিক দিয়া দেখা যায় দারা এবং আওরঙ্গজেবের “আল্লা” বিপরীতধর্মী দুইটি বিভিন্ন সত্তা। আওরঙ্গজেবের আল্লা একমাত্র মুসলমানের আশ্রয় ও সহায়। মুসলমানের ভোগের জন্য আল্লা দুনিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন। কাফেরগুলি ইহকালে মুসলমানের গোলামি ও খোদার গজব বরদাস্ত করিয়া মরণের পর অনন্তকাল দোজখের আগুনে পুড়িবার জন্যই সৃষ্ট হইয়াছে। কাফেরগণকে আঁধার হইতে গলায় শিকল দিয়া আলোকে আনিবার ভার, এমন কি বেহেশতে উঠাইবার অধিকার আল্লাতাল্লা ইমানদারকে সোপর্দ করিয়াছেন।

অপর পক্ষে দারা আল্লাকে সচ্চিদানন্দ স্বরূপ, বাক্যমনের অগোচর পরব্রহ্ম রূপে উপলব্ধি করিবার দাবি করিতেন; চিঠিপত্রে শিরোনামার উপরে (যথা মির্জা রাজা জয়সিংহের কাছে লিখিত পত্র) ফার্সি অক্ষরে “সচ্চিদানন্দ” লিখিতেন। সুফীভাবে বিভোর হইয়া দারা “মাশুক” অর্থাৎ অশরীরী আল্লার চেহারা বর্ণনা করিতে গিয়া লিখিয়াছেন- জ্যোতিস্বরূপ আল্লার মুখমণ্ডলের শোভাবর্ধন করিয়া দুইটি অলকগুচ্ছ বা জুলফি ঝুলিয়া রহিয়াছে : উহার একটি ইসলাম, অপরটি হিন্দুর ধর্ম—মূর্তি ও বহু দেব উপাসনা।

মোট কথা, আওরঙ্গজেবের আল্লা তৌরীত (Old Testament) এবং উহার আরবীয় সংস্করণ কোরানশরীফের “সেমেটিক” কুলপতিধর্মী “আল্লা” (tribal god); দারার আল্লাকে আর্য বা হিন্দুস্থানী আল্লা বলা যাইতে পারে। ভ্রাতৃদ্বয়ের “আল্লা”র স্বরূপ এবং উঁহার কোন কোন “সিপৎ” বা গুণ আসল এবং কোনটি প্রক্ষিপ্ত—ইহা তর্ক অপেক্ষা তলোয়ারের ধারে পরীক্ষা করিবার পক্ষপাতী ছিলেন আওরঙ্গজেব এবং যুযুৎসু মোল্লাসমাজ।

ইতিহাসে দেখা যায় শাহজাহান মনেপ্রাণে, নীতি ও ধর্মানুশাসনে, মন্দির মূর্তি ধ্বংসসাধনে, হিন্দুকে মুসলমান করিবার উৎসাহে এবং আদর্শ মুসলমান হিসাবে কেবল আওরঙ্গজেব অপেক্ষা এক ধাপ নিচে ছিলেন। পনেরো বৎসর বয়স হইতে প্রৌঢ়ত্বের অবসান পর্যন্ত ইসলামের খেদমত করিয়া এহেন পিতার নিকট হইতে তাঁহার যোগ্যতম পুত্র আওরঙ্গজেব পুরস্কার তেমন কিছু পান নাই, অধিকন্তু পাইয়াছেন সকল কার্যে বাধা ও তিরস্কার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *