অষ্টাদশ অধ্যায় – শাহজাহানের শেষ দরবার
(১৮ই মে ১৬৫৮ খ্রি:)
সামুগঢ় যুদ্ধের মাত্র এগার দিন পূর্বে শাহজাদা দারার বিদায় সম্বর্ধনার জন্য আগ্রা দুর্গের দরবার-ই-আমে আহূত অনন্যসাধারণ আড়ম্বরপূর্ণ দরবারই সম্রাট শাহজাহানের শেষ দরবার, দারার এই “রুত” (প্রস্থানের অনুমতি) পিতা ও ভগ্নী জাহানারার নিকট হইতে শেষ বিদায়। এই দরবার উপলক্ষ্য করিয়া সুবিলাসী দিল্লীশ্বরের অপরিমেয় ঐশ্বর্য ও সাম্রাজ্যাভিমানের অচিরাংশুবিলাস,—এই যুগে অতীতের রঙিন স্বপ্ন, অর্বাচীনের কল্পনাবিলাস।
জাঠ-মারাঠা-ইংরেজ দানব মর্দিত মোগলের এই ইন্দ্রপুরীর দরবার গৃহ ও রাজান্তঃপুরের বর্তমান শোকাবহ কঙ্কালকে বাস্তব রূপ প্রদান ঐতিহাসিকের অতি সীমাবদ্ধজ্ঞান ও নজির প্রমাণের গণ্ডির মধ্যে সম্ভব নয়। ধ্যানধারণায় ঐতিহাসিক হয়তো উহার ছায়া দর্শনলাভ করিতে পারে, কিন্তু ওই অস্থিপঞ্জরে প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করিতে পারিবে না।
মধ্যযুগের সাহিত্য, ইতিহাস, বিদেশীয়গণের ভ্রমণবৃত্তান্ত, মোগলচিত্রকলা, পুরাতত্ত্ব এবং দিল্লি-আগ্নার ধূলিধূসর ও বিলুপ্তপ্রায় অলিখিত লোক-কাহিনীর মধ্যে যাহা কিছু সুন্দর এবং হয়তো সত্য—উহা তিল তিল সংগ্রহ করিয়া মোগল ইতিহাসে তিলোত্তমা সৃষ্টির প্রয়াস গরিবের পক্ষে ছেঁড়া চাটাইয়ের উপর শুইয়া সোনার ইটে কাফুরের খামিরায় গাঁথা সাত-মহল রাজবাড়ির মধ্যে সালঙ্কারা ঘুমন্ত রাজকন্যার কাহিনী শুনাইবার বাতিক নিরাপদ নয়; তবে বিস্মৃতি অপেক্ষা বাস্তবতার কাছাকাছি স্বপ্ন হয়তো ভবিষ্যতে সত্যের স্বরূপ নির্ণয়ের সহায়ক হইতে পারে। ঐতিহাসিকের কিন্তু স্বপ্নেও সোয়াস্তি নাই, কারণ সে তাহার সংশয়াত্মক বিচারবুদ্ধিকে ঘুম পাড়াইবার চেষ্টা করিলে উহাই দুঃস্বপ্নের মতো বুকের উপর চাপিয়া বসে।
২
আগ্রা দুর্গে শাহজাহানের দেওয়ান-ই-আম দালানে তাজমহলের অম্লান রূপসজ্জা নাই, সুকুমার শিল্পকলার রত্ন-দুকূল নাই, মোতিমসজিদের বিবিধ প্রস্তরসমাবেশে বর্ণ-বৈচিত্র্য নাই; এমন কি মসনদ-ঝরোকা ব্যতীত অন্যত্র সাধারণ সাদা মার্বেল পাথরও বিশেষ নাই। মসনদ-ঝরোকায় যাহা কিছু মর্মর পাথরের কাজ আছে উহাও ফতেপুর সিক্রির মসজিদ প্রাঙ্গণস্থ সেলিম চিশতীর মকবরার তুলনায় কিছুই নয়। সুবিলাসী সুরুচিসম্পন্ন সম্রাটের প্রকাশ্য দরবার গৃহের এই দৈন্য কেন? শাহানশাহ্ এই ক্ষেত্রে কিছু সস্তায় কাজ সারিয়াছেন, লাল বেলেপাথরের উপর মর্মর পাথরের চুন খামিরার মোটা আস্তর লাগাইয়া ঠাট বজায় রাখা হইয়াছে মাত্র; এইখানে সৌন্দর্যের মালমশলার অভাব স্থপতিকারের সুরুচি ও নৈপুণ্যগুণে হয়তো লোকের চোখে পড়ে না। যিনি তাজের সমাধির মসৃণ মর্মর পাথরের গায়ে রংবেরঙ পাথরের ফুল ফুটাইয়াছেন (Pietra dura), দিল্লির শাহীমহলে স্বর্গ-নদীর (নহর্-ই-বিহিত) খাতে পাথরের বৈচিত্র্যময় ঢেউ তুলিয়াছেন, দরবার-ই আমে তিনি প্রস্তরের সজ্জায় উদাসীন হইলেন কেন?
আসল কথা, দেওয়ান-ই-আমে যাহা স্থায়ী কিছু ছিল এবং এখনও আছে উহা ইহার আসল দরবারী চেহারা নহে, বড়লোকের বাড়িতে যাত্রার ভাঙা আসর, বাঁশখুঁটির মানানসই কাঠামো—অথচ মোগলের দরবার-ই-আমে আসিলেই রুচিবাগীশ ঐশ্বর্যস্পর্ধী ইরানের ইন্চীর (রাজদূত) চক্ষু চড়কগাছ হইত, ইউরোপীয় পর্যটকগণ হতভম্ব হইতেন, দরবারী ঐতিহাসিকের কবি-কবি ভাব হইত, মোল্লারা কেতাবী নজরে দেখিত এই দরবার হজরত সুলেমান নবীর * তখগাহ্ -জাদু এবং “জিন-দেও”র কাণ্ডকারখানা।
[* হজরত সুলেমান নবী (Bib. Solomon, son of David) খোদার বরকতে শয়তান, জিন ও ‘দেও’গুলির উপর হুকুম চালাইতেন। যে গালিচার উপর তাঁহার দরবার বসিত সেই গালিচা জাদুবলে তাঁহার পুরা ফৌজকে লইয়া সকালবেলা বায়েত উল্ মোকদ্দস জিরুসালেম (সিরিয়ার রাজধানী) হইতে উড়িয়া সন্ধ্যাবেলা আফগানিস্থানের তখত্-ই-সুলেমান পাহাড়ের উপর নামিত। দুনিয়ার সমস্ত পাখি আকাশ জুড়িয়া তাহার ভ্রাম্যমাণ গালিচায় রোদ লাগিতে দিত না!]
শাহজাহানের বাপ-পিতামহের আমলে খোলা ময়দানে “বার-গাহ্ “ তাঁবুর (recep- tion tent) ছায়ায় আম বা প্রকাশ্য দরবার বসিত। তিনিই সর্বপ্রথম দিল্লি-আগ্রায় দেওয়ান-ই-আম প্রাসাদ প্রস্তুত করান। সেকালে খোলা ময়দানের এক অংশে লাল কাপড়-মোড়া কাঠের ঘেরার (red railing) মধ্যে সিংহাসনের সম্মুখে উচ্চপদস্থ মনসবদার, উজির, মীরবকশী প্রভৃতি অভিজাতবর্গের দাঁড়াইবার স্থান ছিল, বাদবাকি এই লাল বেষ্টনীর বাহিরে। শাহজাহানের নবনির্মিত সভাগৃহে লাল বেষ্টনীর পর ক্রমশ ক্ষুদ্রতর এবং সিংহাসনের অধিকতর নিকটবর্তী পর পর আরও দুইটি রূপা ও সোনার বেষ্টনী ছিল। বাহিরের প্রাচীরবেষ্টিত ময়দানে পূর্ববৎ “বার্গাহ্” কিংবা “গুলালবার” তাঁবু ও সামিয়ানার নীচে নয় শতী এবং ইহার নিম্নতর মনসবদারবর্গ, অর্থী, প্রত্যর্থী এবং দর্শকগণের দাঁড়াইবার নিয়ম ছিল। এই দেওয়ান-ই-আম দরবার ব্যতীত অন্য সময়ে বাহিরের ফটকে তালাচাবি বন্ধ হইয়া থাকিত; সুতরাং অন্দরহমলের ফরাশ্ (বস্ত্রাগারের ভৃত্য), ভিস্তি প্রভৃতি ব্যতীত বাহিরের কোনও লোকের নজর এই স্থানে পড়িত না। শাহজাহান এইজন্যই অস্থানে অপব্যয় করেন নাই; এই সভাগৃহ সোনার ইটে তৈয়ারি হইলেও উহার নীচে উপরে দামী গালিচা ও মখমল-বনাতে দরবারের সময় ঢাকা পড়িত, সোনা কোথায়ও হয়তো নজরে পড়িত না। তাঁবুকে প্রাসাদোপম এবং পাকা দালানকে গালিচা বনাতে জমকালো তাঁবু করিতে না পারিলে বাদশাহী শান কোথায়?
৩
দেওয়ান-ই-আম তিনদিকে খোলা তিন সারি যুগ্মস্তম্ভের উপরে ছাদবিশিষ্ট এবং মাল্যানুকারী (foliated) খিলানবীথিত্রয়-শোভিত শাহী “বারাদরী”। এই দালানকে অন্তঃপুরস্থ মচ্ছীভবন চকের দ্বিতল বারান্দার পশ্চিম পিঠে উহার সমান উচ্চ একতলা বাহির-বারান্দা বলা যাইতে পারে। দৈর্ঘ্যে প্রায় ৬৭ গজ, প্রস্থ ২২ গজ এক ইঞ্চি এবং সম্মুখস্থ ভূমিতল হইতে ৪ ফুট উচ্চ ভিত্তির উপর এই সভাগৃহ নির্মিত হইয়াছে। সভাগৃহের মধ্যভাগে পশ্চিমাংশে মচ্ছীভবনের দোতলা হাওয়ামহলের সহিত সংলগ্ন এবং সংযোগদ্বারযুক্ত অনতি পরিসর সিংহাসন-অলিন্দ বা মসনদ-ঝরোকা। মর্মর পাথরের তিনটি (পিছনে পর পর) খিলানের উপর শাহানশাহ্র তপ্ত গাহ অর্থাৎ ময়ূর সিংহাসনের এই পাদপীঠ অবস্থিত; উপরে পুরুষপ্রমাণ উচ্চ মর্মর প্রস্তর নির্মিত সুকুমার ক্ষুদ্র স্তম্ভসারিধৃত খিলানযুক্ত বৃত্তাকার ঢালু (curvilinear) ছাদ, পিছনে ডানদিকে একজন লোক (ভিতর হইতে) যাতায়াতের উপযুক্ত একটি ছোট দরজা, বামদিকে প্রায় ওই মাপের দ্বার-রক্ষিত সিঁড়ি নীচে সভাগৃহতল পর্যন্ত নামিয়া গিয়াছে। উচ্চতায় এই সিংহাসন-মণ্ডপ নিম্নস্থিত উদ্বাহু মানবেরও সুখলভ্য নহে; এইজন্য সিংহাসনের সামনে নীচে চারপায়াযুক্ত প্রায় দেড়হাত উচ্চ মর্মর পাথরের ছোট চৌকি। লোকে এই আসনকে “বৈঠক” বা উজির-আজমের বসিবার স্থান বলে; আসলে কিন্তু উজিরেরও দরবারে বসিবার হুকুম ছিল না; ইহার উপর দাঁড়াইয়া তিনি আরজি পেশ করিতেন, কিংবা সম্রাটকে জ্ঞাতব্য বিষয় নিবেদন করিতেন। সিংহাসনমণ্ডপের নীচে সম্মুখস্থ খিলান ও সিঁড়ির মধ্যবর্তী স্থানে তিনদিকে চলাচলের পথ ছাড়িয়া ছোট লাল বেষ্টনীর মধ্যে কুনিশ-গাহ্, অর্থাৎ কুর্নিশ করিয়া সম্রাটের দৃষ্টিপথে আহৃত ব্যক্তির দাঁড়াইবার স্থান। ইহার দুই দিকে সোনার আবেষ্টনীর (railing) মধ্যে উম্দাত-উল্-মুল্ক অর্থাৎ পাঁচ হাজারী ও তদূর্ধ্ব মনসধারী অভিজাতবর্গের স্থান। স্বর্ণবেষ্টনীর কিঞ্চিৎ পিছনে অনুরূপ দীর্ঘতর এবং প্রশস্ততর রৌপ্যবেষ্টনী (railing), উহার পিছনে কিঞ্চিৎ ব্যবধানে পশ্চিম বারান্দায় সভাগৃহের সম্মুখভাগ জুড়িয়া বহুমূল্য বস্ত্রসজ্জিত দারু বেষ্টনী। রৌপ্যবেষ্টনীর মধ্যে সারিবদ্ধভাবে “জাত-সওয়ার” পদমর্যাদা (seniority of rank and status) অনুসারে বামে দক্ষিণে, সম্মুখে পিছনে নির্দিষ্ট তিন হাজারী হইতে সাড়ে চার হাজারী মনসবদারগণের, এবং কাষ্ঠ-বেষ্টনীর মধ্যে হাজারী হইতে আড়াই হাজারীগণের স্থান।
সম্রাট এবং দরবার-সভার দৃষ্টির অন্তরালে দেওয়ান-ই-আমের দক্ষিণ বারান্দায় যাঁহাদের নাম মনসব প্রাপ্তির জন্য কিংবা খেলাত প্রাপ্তির জন্য নির্বাচিত বিশিষ্ট ব্যক্তি (যথা রাও ছত্রশাল হাড়ার সন্তান ও জ্ঞাতিপ্রধানগণ), অথচ মনসবদার নহেন – তাঁহারা অপেক্ষা করিতেন। এই স্থান আমীরগণের আরাম-গাহ্ বা কার্পেটসজ্জিত সেকালের lounge বলা যাইতে পারে। দরবার বসিবার পূর্বে তাঁহারা এইখানে বসিয়া আলাপাদি করিতেন। এই দিকের সিঁড়ির নীচে উচ্চপদস্থ আমীরগণের পরিচারকবর্গের অপেক্ষা করিবার জায়গা। উত্তর বারান্দায় পটগৃহের এক অংশে দরবারের দানসামগ্রী –যথা তাম্রমুদ্রার (দাম) হাজারী তোড়ার স্তূপ, এক শত সিক্কা টাকা ভর্তি থলিয়ার গাদা, আশরফি ভরা থালা ও রেশমী খারিতা (bag) নয়, সাত, পাঁচ ও তিন প্রস্ত (parcha) খিলাতের স্তূপ, রত্নখচিত তরবারি কাটার (dagger) জমধার ( broad sword) ও অন্যান্য দ্রব্য। এইখানে সংশ্লিষ্ট বিভাগের দারোগা, মুস্তৌফী ও কেরানীগণের ছোটখাটো অস্থায়ী দপ্তর। সম্রাট যাহাদিগকে যাহা দিবেন উহাদের নাম ও দ্রব্যাদির ফিরিস্তি পূর্বেই প্রস্তুত হইত এবং প্রত্যেক জিনিসের উপর প্রাপকের নামের কাগজ আঁটা থাকিত। সম্রাট নজরস্বরূপ যে সমস্ত জিনিস, টাকা, আশরফি গ্রহণ করিতেন ওইগুলি নজর-তহবিলের খ্বজাঞ্চির অধীনস্থ কর্মচারীগণ এইখানে জমা করিয়া লইত। এই বারান্দায় পর্দায় ঘেরা পোশাক পরিবার কামরা। সম্রাটের হুকুম হইলে দরবারে অনুগৃহীত ব্যক্তিগণ এইখানে নূতন খেলাত বস্ত্র পরিধান কিংবা অস্ত্রাদি ধারণ করিয়া দরবারে সম্রাটকে “তসলিম” করিতেন।
দেওয়ান-ই-আমের সম্মুখে ইষ্টক-প্রাচীর রক্ষিত ৫০০ ফুট দীর্ঘ ৩৭০ ফুট প্রস্থ সুরম্য দরবার প্রাঙ্গণ। এই ময়দানের পশ্চিম সীমায় কাঠের পাল্লাযুক্ত বিরাট ত্রিপোলিয়া তোরণ। এই তিন দরজাযুক্ত ফটকের মধ্য দরজা সর্বাপেক্ষা প্রশস্ত ও উচ্চ, কিন্তু পাশের ছোট দরজা দুইটির মধ্য দিয়াও হাতি যাতায়াত করিতে পারিত। এই ফটকের উপরে দরবারী নহবতখানা। শাহজাদা হইতে সাধারণ প্রজা পর্যন্ত সকলের জন্য ইহাই একমাত্র প্রবেশ ও নির্গম পথ (বর্তমানে নিশ্চিহ্ন) দরবার ছাড়া অন্য দিন ইহা তালাবদ্ধ থাকিত। এই ময়দানের চারিদিকে চার রশি অর্থাৎ প্রায় ৩২/৩৩ হাত জায়গা, ছাড়িয়া মধ্যস্থলে আকবরশাহী বারগাহ্ (reception tent) খাটাইয়া উহার ভিতরে সিংহাসনের মুখোমুখি পটমণ্ডপের মধ্যে নয়শতী হইতে বিশতি (বিশজনের নায়ক) পর্যন্ত মনসবদারগণের স্থান করা হইত। এই বারগাহ্ এবং ফটকের মধ্যবর্তী স্থানে বারগাহ্-সংলগ্ন শামিয়ানার ছায়ায় মোটা শতরঞ্জির উপর রঙিন মাদুর বিছাইয়া দর্শক এবং অর্থী-প্রত্যর্থীগণের দাঁড়াইবার স্থান করা হইত।
৪
সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বে ভারতবর্ষে ঐশ্বর্যের ভরা জোয়ার। হিন্দুস্থান তখন ধনসম্পদে একালের মার্কিন মুলুক––সোনারূপা হীরাজহরত পৃথিবী ঘুরিয়া আসিয়া যে দেশে শেষ সমাধি লাভ করিত, দুনিয়ার প্রায় একচেটিয়া বাজারে যে দেশের বেচিবার কাঁচা-পাকা মাল ছিল অফুরন্ত ও অসংখ্য রকমের, বাহির হইতে শুধু আমদানি হইত হীরা-জহরত, ইরান-তুরানের ঘোড়া, রুমী বনাত, ইরানী গালিচা, বিলাতী আয়না-পিস্তল এবং কয়েকটি চটকদার অপ্রয়োজনীয় শখের জিনিস।
মোগল দরবার ছিল মধ্যযুগে দেশ-বিদেশের রত্ন আকর্ষণকারী শক্তিমান চুম্বকপ্রস্তর; মোগল সাম্রাজ্যে প্রজার ঘরে জহুরির চোরাবাজারে দুর্লভ হীরা, মণিমুক্তা কিংবা রাজাদের সভায় মনুষ্য-রত্ন আত্মগোপন করিবার উপায় ছিল না। আকবরের আমলে বাদশাহী চরের শ্যেনচক্ষু প্রাচীন বিদ্যার পুঁথি, অনাদৃত বিদ্যা এবং গুণীজ্ঞানী মনুষ্যরত্ন খুঁজিয়া বেড়াইত। জাহাঙ্গীর ছিলেন স্ত্রী-রত্ন, সুপেয় শরাব, সুনিপুণ চিত্র ও চিত্রশিল্পী, দুনিয়ার আজব জানোয়ার পশু-পক্ষীর সন্ধানে। জাহাঙ্গীর বাদশাহ “রত্নে”র খবর পাইলে ন্যায়-অন্যায় বিচার হারাইয়া ফেলিতেন, স্থান-অস্থান বিবেচনা করিতেন না। *
[* লাভের আশায় হীরানন্দ জহুরি এক লাখ টাকায় এক খণ্ড হীরা গোপনে কিনিয়াছিল। জাহাঙ্গীর এই খবর পাইয়া তাহার কাছে কৈফিয়ত তলব করিলেন। প্রাণ বাঁচাইবার জন্য হীরানন্দ জামাইল, হুজুর, খবর ঠিক; তবে কোনদিন যদি গরিবের বাড়িতে জাঁহাপনার কদম মোবারকের মেহেরবাণীর ধুলা গোলামের মাথায় পড়ে তাহা হইলে গরিবের হেসিয়ত্মাফিক কিছু নজর দাখিল করিবার জন্যই এই সামান্য জিনিস জোগাড় করা হইয়াছে।
বলা বাহুল্য, আলা হজরত দেরি করিলেন না, হীরানন্দের বাড়িতে নিমন্ত্রণ খাইয়া দক্ষিণাস্বরূপ ওই হীরকখণ্ড লইয়া আসিলেন; বাদশাহী চেলাচামুণ্ডা দলকে সন্তুষ্ট করিতে কৃপণের বোধ হয় আরও পঞ্চাশ হাজার বাহির হইয়া গেল। [Forster, Early Travels, (Hawkins). ]]
পিতৃপিতামহের এই লোভ সম্রাট শাহজাহানের মধ্যে তৃপ্তির অতীত রত্নলালসায় পরিণত হইয়াছিল। শাহজাহানের ঐশ্বর্যের পরিমাপ ময়ূর সিংহাসন নহে। ময়ূর সিংহাসনের উপযুক্ত সভামণ্ডপে, দরবার সজ্জার গালিচা বনাত এবং সম্রাটের দরবারী পোশাক- আভরণে আরও এক রত্ন-সিংহাসনের ধন প্রোথিত ছিল।
শাহজাহানের দরবার মজলিশ, ঈদ, শাহজাদাগণের বিবাহ উৎসব ও শোভাযাত্রার সর্বাপেক্ষা বিশদ ও চিত্তাকর্ষক বর্ণনা মহম্মদ সালেহ কাম্বো-লিখিত ইতিহাসে পাওয়া যায়; কিন্তু তিনি অলকার যক্ষ-অলকপুরী ছাড়িয়া রামগিরিতে আসিবার দুর্ভাগ্য তাঁহার হয় নাই; সুতরাং প্রবাসী কিংবা পর্যটকের চোখে দিল্লি দরবারের ঐশ্বর্যচ্ছটা ও খুঁটিনাটি ব্যাপার বর্ণনা করিবার তাঁহার প্রয়োজন হয় নাই—কিম্পুরুষ বর্ষের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কিন্নরের মুখে ভাষা পায় না। এতদ্দেশীয় ঐতিহাসিকের অনুক্তি ও অস্পষ্টতা দোষ বিদেশীয় পর্যটকগণের ভ্রমণকাহিনীর সাহায্যে কথঞ্চিৎ দূর করা যায়; কিন্তু ইঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ বাজার-গুজব শুনিয়াছেন, কেহ কেহ বর্ণান্ধ, কেহ চোখে দেখিয়াও উল্টা দেখিয়াছেন—যথা টেরী সাহেব কর্তৃক হাতির কপালের কাছাকাছি উহার লম্বমান অণ্ডকোষ-দর্শন। *
[* টেরী সাহেব (১৬১৬-১৯ খ্রিঃ) লিখিয়াছেন, “…the males testicles lye about their forehead and females (female’s) teats are betwixt her forelegs…” (Forster, Early Travels in India, p. 307 )]
শাহজাহানের রাজত্বকালে এই আসুরিক ঐশ্বর্যের আড়ালে এদেশে দুঃখ-দৈন্য, ধনী ও শাসকের শোষণ, গরিবের অনশন-অর্ধাশন সবই ছিল, অথচ শহরে দরবারে মধ্যবিত্ত, এমন কি ছাপোষা গরিবের চালচলন ও কাপড়-চোপড়ে অঢেল ঠাট, দরবারীগণের আমিরী শানের কথাই নাই। দেশীয় বিদেশীয় সমস্ত লেখক রাজদ্বারে, দরবারে অন্দরমহলে প্রায় সব বস্তুই “রত্নজড়িত” (ফাঃ মোরাচ্ছা) কিংবা “studed with jewels” লিখিয়াছেন; সোনা ছাড়া কথাই নাই, রূপা কদাচিৎ; সেগুলি আবার “মিনা”র চটক ছাড়া নজরেই পড়ে না। বেগম-বাদশাহ ও ভারিক্কি আমীরের পোশাকে ঢাকাই ও বুরহানপুরী মসলিন ছাড়া কোৱা সাদা অপাঙ্ক্তেয়, সাদা থান সেকালেও বাঙালি বিধবা ও পাকাদাড়ি কাজী মোল্লা ছাড়া অন্য কেহ কদাচিৎ ব্যবহার করিত। সাদার কদর থাকিলে হিন্দুস্থানে “রং-রেজ” ব্যবসা জাঁকিয়া বসিত না। মসলিনের সুবিধা তিন প্রস্ত পোশাক ** পরিলেও গায়ের রং, জহরতের ঝলক ঢাকা পড়ে না, অথচ আরামের হানি হয় না।
[**কথিত আছে, কন্যা জেবউন্নিসা তিন পরত মসলিনের পুরা পোশাক পরিয়া একদিন আওরঙ্গজেবের নিকট উপস্থিত হইলে তিনি বিরক্তির সহিত মুখ ফিরাইয়া বলিয়াছিলেন- আরও ভব্যভাবে তোমাদের পোশাক পরা উচিত।]
যখন বয়স ছিল তখন বাদশাহ আহমদাবাদের উজ্জ্বল রঙিন মলমল পছন্দ করিতেন, বৈচিত্র্যের মোহে তিনি মর্মরের শুভ্র আভিজাত্য বিবিধ বর্ণভাস্বর প্রস্তরের পুষ্পিত-পট দ্বারা (pictra dura) সজ্জিত করিয়া চিত্র-বস্ত্রানুকারী করিয়াছিলেন।
যাহা হউক, শাহী ঝাণ্ডা ও পালকির ডাণ্ডা, শায়েস্তা খাঁর ওজুর বদনা, জাফর খাঁর হুক্কা, বেগম সাহেবার দাসীর গায়ে, খলিউল্লা খাঁর বিবির পায়ে লাখ টাকার চটিজুতায়, বড়লোকের ঘরে সেকালে সোনা মুক্তা চুনির ছড়াছড়ি— পড়িলেই মনে হয় ইহা যেন রাজা ভোজের সভাপণ্ডিতের বাড়িতে জঞ্জালের গাদা হইতে ডালিমের দানা ভ্রমে চুনির টুকরা গিলিয়া পোষা টিয়া পাখির মরিবার অবস্থা! রাজা-বাদশাহ, উজির-আমীর, জমিদার- মনসবদারের জীবনযাত্রার ব্যাপারে শাহী ঠাট না হয় মানিয়া লওয়া গেল, কিন্তু মামুলি মনসবদারের আমিরি ভড়ং, মুচ্ছদ্দীর দেওয়ানজী-চাল, বিশ টাকা মাহিনার সওয়ারের গায়ে আকবরী সিক্কায় ১০০ গজের বাক্তার লম্বা আঙ্গরাখা এবং ঘরে বিবির জন্য কমপক্ষে ছয় টাকা গজের আকবরশাহী ঝলমল “ডোরিয়া” (বাং–ডুরে) ছিটের ইজার-সালোয়ার, জরদৌজী ফুলদার আঙ্গিয়া, কাশ্মীরী শালের ওড়নী বা দোপট্টা (সাধু-রুহ পট্টা), নাকে হীরার নথ, কানে মোতির দুল, গলায় চুনি মুক্তার হার, পায়ে জড়োয়া মখমলের চটি কেমন করিয়া সম্ভব হয়?
অবিশ্বাস করিবার কোনও কারণ নাই। এই যুগের মতো সেকালেও সমাজে ভড়ং বজায় রাখিবার তাগিদে সস্তায় আমিরি করিবার অনুকল্প ব্যবস্থা ছিল—যথা, বারো রকমের হীরা, বোল রকমের মুক্তা, বারো কিসিমের চুনিপান্না। আকবরশাহী আমলে সর্ব নিকৃষ্ট শ্রেণীর হীরার রতির দাম ১ টাকা ১২ আনা হইতে ৪ আনা, মুক্তা দশ দাম অর্থাৎ ৪ আনা হইতে ২ আনা, চুনি ও অন্যান্য পাথর পৌনে মোহর (“ইলাহী” = ১০ টাকা) হইতে চার আনা। গরিবের জন্য ইহা অপেক্ষা নিকৃষ্ট শ্রেণীর হীরা-চুনি-মুক্তা আরও সস্তায় বাজারে পাওয়া যাইত, তবে আবুল ফজল দাম লিখেন নাই।* এই দেশে ছোট চাকুরিয়া এবং খানদানী গরিবের চিরকালই সেই এক অবস্থা— যাহাকে বলে “ঘরে ঠোঁট-গামছা, বাহিরে জামা-জোড়া।” পাঠান খাঁ সাহেব যখন দরবারে যাইতেন তখন পোশাকে তিনি একজন হোমরা-চোমরা বাহাদুর, দামী ঘোড়ার উপর সওয়ার,, আগে পিছে ওইদিনের জন্য দোস্তের নিকট হইতে ধার-করা, না হয় ভাড়াটে চাকর-নোকর। দরবার হইতে ফিরিয়া ঘরের চৌকাঠ পার হইলেই তাঁহার কোমরে লুঙ্গি, মাথায় ছেঁড়া কাপড়ের রুমালে বাঁধা বাবরি চুল এবং চাটাইয়ের উপর বসিয়া সস্তা বাসি গোমাংসের কালিয়া সহযোগে চাপাটি-চর্বণ কিংবা অগত্যা নিরামিষ খিচুড়ি ভক্ষণ। ** বোধ হয় এই শ্রেণীর শেখ সৈয়দেরও প্রায় এইরকম অবস্থা, বেচারা পাঠানের খামকা বদনাম। ইহাতে অবাক হওয়ার কিছুই নাই; লেপাফা দুরস্ত না রাখিলে কোনও কালেই চলে না। কলিকাতার মেসের “কার্তিক” বাবুর ঘরে পায়খানায় সকাল সন্ধ্যায় লাল গামছা, দ্বিপ্রহরে আপিসের ধুতি জামা, দিনান্তে গিলা-কোঁচানো শান্তিপুরী; কিংবা বড়বাজারের বাটপাড়িয়ার ঘরে ময়লা ধুতি কাটা ফতুয়া আহারে আচারসহ শুকনো রুটি এবং আড়তে যাওয়ার সময় মাথায় জয়পুরী “চীরা”; হাতে পেঁচদার মোটা তাগা, গলায় হার, গোঁপে চবচবে কাঁচা ঘি। মির্জাই ভড়ঙ-এ লক্ষ্ণৌর জুড়ি এখনও নাই। কাশ্মীরী মহল্লায়, চকে এবং হালে হজরতগঞ্জে দেখিতে পাইবেন মির্জা সাহেবের গায়ে সন্ধ্যাবেলা ধোপাবাড়ির ভাড়া করা ধবধবে চুড়িদার পায়জামা; মিহি চিকন দৌজী আঙ্গরাখার ঝুল, মাথায় মলমলের টুপি কিংবা পাগড়ি; জামার এক জেবে ছোলাভাজা, অন্য জেবে গুটিকয়েক এলাচ; চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি; পরিচিত লোক কেহ নজরে পড়িলেই তাড়াতাড়ি ছোলাভাজা গিলিয়া মুখে এলাচী অর্পণ এবং নিতান্ত সপ্রতিভ ভাবে বিনয়-নম্র সম্ভাষণ ও দুই-চারিটা এলাচী রুমালের উপর রাখিয়া “ইলায়চী কবুল ফরমাইয়ে, জনাব!” আসে যাহাই হউক, লক্ষ্ণৌর অবস্থা-বিপর্যয়গ্রস্ত খানদানী মুসলমান পুরাতনের ধারা এখনও বজায় রাখিয়াছে—মুখে বড় বড় কথা, “হাঁ” ছাড়া “না” নাই; ঘরে মোটা চালের হলদে রং করা ভাত খাইয়া বাহিরে “চৌগুণী” (উৎকৃষ্ট পোলাও) ও খাসা “বালাই”র (বাং-মালাই) গল্প ও ঢেঁকুর তোলা তাঁহার স্বভাব। মির্জা পারতপক্ষে ডাহা মিথ্যা কথা বলিবেন না, তবে বাজে নান্-রুটি খাইলে বলিবেন, “নাসিরী পরওয়াটা”, ঢাকা মুলাভাজা তাঁহার শায়েস্তা জবানে “মুলীকা কাবাব”, বেগুনপোড়া “বাইগন কা কোপ্তা”; সুতরাং এ-কাল ও সেকালে হিন্দুস্থানীর রুচি ও মনোবৃত্তির মধ্যে বিশেষ বিপর্যয় এই যাবৎ দেখা যায় না।
যাহা হউক, ঐতিহাসিক এই ক্ষেত্রে অসহায়, পূর্ববর্তীরা মোগল দরবার যে দৃষ্টিতে দেখিয়াছেন, তাহাকে সেই দৃষ্টিভঙ্গি লইয়া দেখিতে হইবে––বাদবাকি পাঠকের মর্জি।
৫
শাহ-বুরুজ প্রাসাদের দ্বিতল অলিন্দে অষ্টকোণাকৃতি সুরম্য গম্বুজাকৃতি ছত্রীর সম্মুখে সম্রাট শাহজাহান অপরাহ্ণে অন্দরমহলের দরবারে বসিয়া আছেন। মোগল বাদশাহের অন্তঃপুর একটি স্বয়ং-সম্পূর্ণ সুশৃঙ্খল ব্যবস্থায় পরিচালিত নারী-রাজ্য, যেখানে শাহানশাহ্ একমাত্র পূর্ণাঙ্গ পুরুষ। এইখানে সিপাহী শাস্ত্রী, চাবুক-হাজত-ফাঁসি, দেওয়ানী দপ্তর, মালখানা (trea- sury), দলিল-দস্তাবেজের মুহাফিজখানা (archives), বকশী, আরজবেগী, মীরসামান ইত্যাদি কর্মচারী, মক্তব, নাচওয়ালী, নটগুরু সকলই ছিল। ভৃত্য ও পদাধিকারিগণ সকলেই ক্রীত দাসদাসী; অল্পসংখ্যক বিবাহিত স্ত্রীলোক দিনে কাজ করিয়া সন্ধ্যার পূর্বে শহরে চলিয়া যাইত। মোগল সম্রাটের সদরে অন্দরে গৌরী সেনের কারবার নাই– কড়া-ক্রান্তি, হীরা জহরত, জামা-জুতা, কার্পেট-সুজনী প্রত্যেক জিনিসের কড়াকড়ি হিসাব -শাসনব্যবস্থা ভিতরে বাহিরে “কাগজী-রাজ” (red tapism)। রাজধানী কিংবা সফরে অবসর সময়ে সম্রাট স্বয়ং অন্তঃপুরের এবং পুরবাসিনীগণের অভাব-অভিযোগ শুনিতেন, বেগমগণের নারী-দেওয়ান ও মুস্তৌফী হুজুরে হিসাব দাখিল করিত। এই সমস্ত কাজের পর সম্রাট আত্মীয়া-কুটুম্বিনীগণকে দর্শন দিতেন। গুপ্ত রাজনৈতিক বৈঠক ও দরবার ছাড়া অন্য দিনে শাহবুরুজে গল্পের মজলিশ ও নাচের মহড়া হইত। মমতাজের মৃত্যুর পর হইতে তিনি বেগমমহলে কদাচিৎ পদার্পণ করিতেন, তাঁহার অধিকাংশ সময় এই অলিন্দেই কাটিয়া যাইত-নিয়তির নিয়মে এইখানেই তাঁহার কারাবাস ও অন্তিমদশার আঁধার ঘনাইয়া আসিতেছিল।
দারার বিদায়-সম্বর্ধনার উৎসব অন্তপুরেও তরঙ্গ তুলিয়াছে, সম্রাটের শ্যালিকাদ্বয় এবং শ্যালক শায়েস্তা খাঁর বেগম তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছেন। কিছুক্ষণ পরে প্রধানা প্রতিহারিণী কুর্নিশ করিয়া নিবেদন করিল, জাঁহাপনা সলাম! “দীন” দুনিয়ার রৌশন দৌলত-মদার শাহ বুলন্দ-ইকবাল এবং মদার্-উল্-মহাম্ উজির-আজম বাহাদুরের সওয়ারী “গোসল-খানা”-র বাহিরে বান্দাগান্-ই-আলা হজরতের (অর্থ-স্বয়ং সম্রাট) হুকুমের অপেক্ষা করিতেছে।* সম্রাট তাঁহাদিগকে যথোচিত অভ্যর্থনা করিয়া শাহ-বুরুজে উপস্থিত করিবার আদেশ দিলেন। অতঃপর দৃশ্যপট পরিবর্তিত হইল। সম্রাট তাঁহার শয়নকক্ষে এবং বেগমগণ নীচে অন্দরমহলে প্রস্থান করিলেন, নারী-প্রতিহারিণী, শাস্ত্রী, ছত্রচামরধারিণী ও ব্যজনরতা পরিচালিকা (“পাখোয়া”––হাতপাখা দিয়া বাতাস দেওয়ার জন্য) সকলেই স্ব স্ব স্থান ত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল। প্রভুর সমপদস্থ কিংবা তাঁহার উপরিস্থ ব্যতীত অন্য পুরুষের সামনে অন্দরমহলের বাঁদী-চেড়ির উপস্থিত থাকিবার নিয়ম ছিল না; এইজন্য শাহীমহলে এবং অভিজাতবর্গের ঘরে একপ্রস্থ নারী এবং একপ্রস্থ খোজা ভৃত্য রাখিবার রেওয়াজ ছিল। ইতিমধ্যে খোজাগণ দাসীদের স্থানে কর্তব্যরত হইল,ফরাসের গালিচা ইত্যাদি বদলাইয়া এবং চারিদিকে কানাতের পর্দার ঘের লাগাইয়া উহাকে গুপ্ত-মন্ত্রণাকক্ষে রূপান্তরিত করা হইল।
[* শব্দার্থ–
‘দীন” = ধৰ্ম, শাহ বুলন্দ-ইকবাল = দারার পিতৃদত্ত উপাধি
দৌলত-মদার = (abode of felicity) সৌভাগ্যের আশ্রয়
মদার্-উল্-মহাম্― (centre of important affairs) প্রধান উজিরের সম্মানসূচক উপাধি, গোসল খানা, স্নানাগার নহে, দেওয়ান-ই-খাস।]
৬
ভ্রাতৃবিগ্রহ আরম্ভ হওয়ার কিছুদিন পরে পদচ্যুত মীরজুমলার স্থানে দারার সুপারিশে সম্রাট জাফর খাঁকে প্রধান মন্ত্রীর পদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। খলিলুল্লা খাঁ এবং শায়েস্তা খাঁর সহিত দারার বিরোধ দূর করিবার জন্যও সম্রাট প্রথম হইতেই ব্যগ্র ছিলেন, অবশেষে তাঁহাদের সহিত একটা আপোসরফা হইয়াছিল। ইহাদের মনসব বাড়াইয়া খলিলুল্লা খাঁ-কে “মীর-বকশী” (সামরিক দপ্তরের সর্বোচ্চ মন্ত্রী) এবং শায়েস্তা খাঁ-কে “আমীর-উল-ওমরা” উপাধির দ্বার সম্মানিত করা হয়। জাফর খাঁ ভালোমানুষ, অপর দুইটি গভীর জলের মাছ। পূর্বে দারার সহিত কিঞ্চিৎ মনোমালিন্য থাকিলেও প্রধানমন্ত্রী হইয়া জাফর খাঁ দারার শুভচিন্তক হইয়াছিলেন, ভাগ্যবিপর্যয়ের পরেও শেষ পর্যন্ত নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সহিত সম্রাটের সেবা করিয়াছিলেন। পূর্ব শত্রুর সহিত মিত্রতার ব্যাপারে চাণক্য ও চাচা সাদীর সাবধানবাণী ভুলিয়া দারা তাঁহার প্রিয়ভাষী মাতুল শায়েস্তা খাঁ ও মেসো খলিলুল্লাকে হিতাকাঙ্ক্ষীরূপে মাত্রার অধিক বিশ্বাস করিয়া বসিলেন। খলিলুল্লার দাপট ও বড় বড় কথায় ভুলিয়া সম্রাট তাঁহাকে বাদশাহী ফৌজ ও তোপখানা সহ ঢোলপুরের ঘাঁটি আগলাইবার জন্য ইহার সপ্তাহ পূর্বেই ওইখানে প্রেরণ করিয়াছিলেন। খলিলুল্লা খাঁ ঝানু দরবারী, অভিজ্ঞ এবং বিচক্ষণ যোদ্ধা; এইজন্য সম্রাটের ভরসা ছিল দারার কাঁচা বুদ্ধি ও হঠকারিতার রাশ টানিয়া রাখিবার জন্য তিনিই সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি-বিশেষত রক্তপাত ঘটাইয়া আওরঙ্গজেবের সঙ্গে আপোসের রাস্তা তিনি পারতপক্ষে বন্ধ করিবেন না; বিদ্রোহী শাহজাদাগণ তাঁহাকে সমীহ করিয়া হয়তো যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত হইবে– এক কথায় সম্রাট তাঁহাকে নামত না হইলেও কার্যত এই অভিযানে শাহজাদার আতালিকের ক্ষমতা অর্পণ করিয়া কিছু নিশ্চিন্ত হইয়াছিলেন।
শাহী গুরজ বরদারগণ সসম্ভ্রমে অভিবাদন করিয়া শাহজাদা ও উজির-আজমকে সম্রাটের আদেশ জ্ঞাপন করিল। তাঁহারা পালকি হইতে নামিয়া পদব্রজে শাহবুরুজে চলিলেন। সম্রাটের আসন দূর হইতে দৃষ্টিগোচর হওয়া মাত্র তাঁহারা জুতা ছাড়িয়া নগ্নপদে (অবশ্য মৌজা ও পাতাবা পায়ে ছিল) অগ্রসর হইলেন এবং দুইজনেই শাহানশাহ-র কদম-বোসী (পদচুম্বন) করিয়া তাঁহার অনুমতিক্রমে কিছু দূরে আসন গ্রহণ করিলেন। কিছুক্ষণ প্রয়োজনীয় কথাবার্তার পর স্থির হইল শাহজাদার অনুপস্থিতি সময়ে জাফর খাঁ দুর্গরক্ষার ভার গ্রহণ করিবেন এবং শায়েস্তা খাঁ নিজ তাবিনের ফৌজ লইয়া শহর রক্ষার জন্য মোতায়েন থাকিবেন, অবশিষ্ট বাদশাহী ফৌজ শাহজাদার সহিত ঢোলপুরে কুচ করিবে এবং সুলেমান শুকোর প্রত্যাগমন পর্যন্ত আত্মরক্ষামূলক কৌশল অবলম্বন করা হইবে। ইহার পর জাফর খাঁ বিদায়ের অনুমতি লইয়া দেওয়ান-ই-আমে চলিয়া গেলেন।
পিতা-পুত্রের এই শেষ একান্ত সাক্ষাৎকার সময় শাহজাহান ধৈর্য হারাইয়া ফেলিলেন, কাতরকণ্ঠে বার বার সেই এক কথা—পারতপক্ষে যুদ্ধে নামিও না; মীরবকশী এবং প্রধান সেনাধ্যক্ষগণের মতের বিরুদ্ধে কাজ করিবে না; আক্রান্ত না হইলে সংঘর্ষ এড়াইয়া যাইবে, দিনের খবর দিনে পাঠাইবে ইত্যাদি। এই সময়ে দরবার-ই আমে পূর্বনির্দিষ্ট সময়মত সম্রাটের যাত্রার বাজনা বাজিয়া উঠিল। জাফর খাঁ-র প্রস্থানের পর ওইখানে ভগ্নী জাহানারা ও শাহজাদার মাসিদ্বয় দারার সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য উপস্থিত হইয়াছিলেন। দারা পিতার পদচুম্বন এবং বেগমগণকে যথাযোগ্য অভিবাদন করিয়া বিদায় প্রার্থনা করিলেন। বিদায়ের সময় খলিলুল্লা খাঁর স্ত্রী নাকি কানে কানে দারাকে কিছু বলিয়াছিলেন, তিনি তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ দিলদরিয়া মেজাজে মাসির আশঙ্কা হাসিয়া উড়াইয়া দিলেন।
দারা বিদায় লইবার পর শাহীমহলে যাত্রার সাড়া পড়িল।
৭
সোনার “সুখপাল” চতুর্দোলে বসিয়া সম্রাট মচ্ছীভবনের পথে দরবারে চলিলেন। সর্বাগ্রে সুবর্ণ ও রৌপ্য দণ্ডধারী ভৃত্যবর্গ; “সুখপালে”র পুরোভাগে রাজদণ্ডের প্রতীক রত্নজড়িত “ত্রিশির” (with three knobs at the head), সুবর্ণ গদা (গুরজ) স্কন্ধে সম্রাটের মহাপ্রতিহার এবং পশ্চাতে ভীমদর্শনা দশপ্রহরণধারিণী নারী দেহরক্ষী* পদাতির পত্তি; হজরত সুলেমান নবীর হুকুমে অজানা দেশের পরী-রানিগণ যেন শাহানশাহকে লইয়া আকাশমার্গে চলিয়াছে। সুখপাল-বাহিকাগণ সংখ্যায় আটজন, প্রত্যেকেই উদ্ভিন্ন যৌবনা তন্বী, পরিধানে ইরানী পোশাক, গায়ে হিন্দুস্থানী জড়োয়া অলঙ্কারের বহর, কেবল নাকে নথ-বেসর নাই। সম্রাটের নিকট কোনও স্ত্রীলোকের পর্দা বাধ্যতামূলক নহে; সুতরাং অন্দরমহলে বোরখার বিভীষিকা নাই।
[*পরবর্তীকালে এই শ্রেণীর একজন চামুণ্ডাকে বিশেষ সাহস ও বিশ্বস্ততার পুরস্কার স্বরূপ সম্রাট মহম্মদ শাহ “রঙ্গিলা” “রুস্তম-ই-হিন্দ” খেতাব দিয়াছিলেন।]
শাহানশাহর সওয়ারীর পশ্চাতে বেগমগণের সোনারূপার পালকি এবং অনবগুণ্ঠিতা কিঙ্করীবৃন্দ রূপের ঝলক তুলিয়া দরবার দেখিবার জন্য চলিয়াছে। মচ্ছীভবনের সরন্ধ্রপ্রস্তর বাতায়ন শোভিত পশ্চিম বারান্দার সমস্ত স্থান ফরাস জাজিম গালিচায় আবৃত, ডানদিকে সম্রাট-কুমারীগণ এবং অন্যান্য বেগমগণের জন্য পদমর্যাদা অনুসারে সংরক্ষিত সুরম্য মখমলের দীবান” (বসিবার আসন); প্রাচীরের গায়ে ভিতর বাহিরে সূক্ষ্ম জরির ডবল পর্দা। এই বারান্দা হইতে সিংহাসনমণ্ডপে সিংহাসন পর্যন্ত সম্রাটের জন্য পদার্পণ-বস্ত্র পাতা হইয়াছে। এইখানেই সুখপাল হইতে তাঁহার অবতরণ স্থান।
৮
পিতামহ আকবরের কীর্তি এবং ঐশ্বর্যস্পর্ধী সম্রাট শাহজাহানের দরবার-ই-আম সাম্রাজ্যের রত্নভাণ্ডার ও শাহী ফরাসখানা (রস্ত্রাগার) উজাড় করিয়া মায়াপুরীর ন্যায় সজ্জিত হইয়াছে। সভাগৃহের সম্মুখস্থ বিরাট ময়দানের মধ্যভাগে উহার তিন-চতুর্থাংশ স্থান ব্যাপিয়া আকবরশাহী ‘বারগাহ্”* তাঁবুর নীচে বস্ত্রমণ্ডপের উপরিভাগে জাহাঙ্গীরশাহী আমলের মাঙ্গলিক “দল-বাদল”** সামিয়ানা। খুঁটিগুলি সব রূপার পাতে মোড়া। লাল সামিয়ানার কেন্দ্রস্থলে সোনার তারে সূর্যের প্রতীক, চতুর্দিকে নানা বর্ণে নবগ্রহ এবং দ্বাদশ রাশির জ্যোতিষ-সম্মত নকশা। নীচে দেওয়ান-ই-আমের বহিরঙ্গ স্বরূপ সুবৃহৎ বস্ত্রমণ্ডপ। ইহার ফরাসের উপর লাল শালু কাপড়ের দীর্ঘ প্রাবরণ রাজমার্গের ন্যায় এই মণ্ডপকে দ্বিধাবিভক্ত করিয়া পশ্চিমে ইষ্টক প্রাচীরস্থ তোরণ পথ হইতে পূর্বদিকে দেওয়ান-ই-আমের সিঁড়ি পর্যন্ত চলিয়া গিয়াছে। পশ্চিম দিক হইতে বস্ত্রমণ্ডপের প্রবেশপথে চিত্রবস্ত্র সজ্জিত তোরণদ্বার, উপরে রত্নজড়িত সুবর্ণদণ্ড-লগ্ন শ্বেতকৃষ্ণ চামর। কলাপ-শোভিত শাহী “তুমান্-তোষ”“ পতাকা। এই তোরণ দ্বার ছাড়িয়া মণ্ডপের পশ্চাৎ ও উভয় পার্শ্বে কাতানের ঘের, পূর্বদিকে খোলা; কানাতের বাহিরে চতুর্দিকে সীমা-নির্দেশক বস্ত্র কঞ্চুকাবৃত দারুবেষ্টনী। শালুর রাস্তার উভয় পার্শ্বে মণ্ডপের খুঁটিগুলির কোমরের সহিত আড়াআড়ি বাঁধা ছিটকাপড়ের দড়ি দিয়া ইহাকে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা খণ্ডশঃ বিভক্ত করা হইয়াছে। এই বন্ধনীগুলির মধ্যে সর্বপ্রথম সারিতে নয়-শতী এবং পশ্চাতে ক্রমশ নিম্নতর মনসবদারগণের দাঁড়াইবার স্থান- সর্বপশ্চাতে অর্থী-প্রত্যর্থী ও দর্শকগণ। বস্ত্রমণ্ডপের নীচে মোটা শতরঞ্জির উপর ছিটকাপড়ের ফরাশ, উহার উপরে সম্মুখভাগের কয়েক সারিতে গালিচা জাজিম, পরে সুজনী; সর্বপশ্চাতে রঙিন মাদুর। মণ্ডপ তোরণের বাহিরে মোটা ফরাসের উপর সাধারণ মাদুর পাতা; এইখানে জুতা ছাড়িয়া মণ্ডপে প্রবেশ করিতে হয়।
[*The Bargah, when large, is able to contain more than ten thousand people. It takes a thousand farrashes a weak to erect it with the help of machines…If plain (i.e, without brocade, velvet or gold ornaments), a bargah costs 10,000 rupees and upwards, whilst the price of one full of ornaments is unlimited – ( Ain i, p. 53 )
একজন আধুনিক গ্রন্থকার লিখিয়াছেন—
“The enclosure outside the pillared hall, like the Gulal Bari (Red Enclo- sure) of the Delhi Fort… – Ashraf Hussain: Guide to Agra Fort, p. 13 )
Gulal Bari বোধ হয় ইহা আকবরশাহী “Gulabar” তাঁবুর বিকৃত নাম। ইহার জন্য নিতান্ত কমপক্ষে ১০০ গজ সমচতুষ্কোণ জমির দরকার হইত। ( Aini, p. 45 ) দরবারের জন্য Gulabar ব্যবহৃত হইত না; ইহা ছিল একটি বস্ত্রনির্মিত চলমান শাহীমহল বিশেষ।
** দলবাদল জহ অম্বর ছাবা, সসি সুরজ তেহি মই বনাবা
পহিলে বারহ রাসি বনাএ (য়ে), তৌ সব নখত তঁহা লিখিলাএ (য়ে)
কবি ওসমানকৃত “চিত্রাবলী” পৃ. ৮ ]
দেওয়ান-ই-আমের প্রাঙ্গণ মধ্যস্থিত এই বস্ত্রমণ্ডপ এবং প্রাসাদের উঠিবার সিঁড়ির মধ্যে তিন “রশি” অর্থাৎ প্রায় ২৪ হাত প্রস্থ খোলা রাস্তা, এই রাস্তার উপরে অন্য একটি সামিয়ানা বস্ত্রমণ্ডপ এবং দরবার গৃহের ছাদকে সংযুক্ত করিয়াছে, রাস্তার উপরও মোটা ফরাস পাতা হইয়াছে। প্রাসাদের সিঁড়ির প্রত্যেক ধাপের উপর গালিচার আস্তরণ এবং দুই পাশে সুগন্ধ দ্রব্য জ্বালাইবার স্বর্ণমণ্ডিত বড় বড় “আতশকদাহ্” বা অগ্নিভাণ্ড। উপরে উঠিয়া সিংহাসন-ঝরোকার পাদদেশে গালিচাবৃত “কুর্নিশ-গাহ” অর্থাৎ সম্রাটকে কুর্নিশ তসলিম* প্রণিপাত করিবার নির্দিষ্ট স্থান (ভক্তি-গদগদ হইয়া মফস্বলের প্রাচীন হিন্দুদের মধ্যে কেহ কেহ এইখানে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিত)। ইহার দুই দিকে খোলা বারান্দায় পর পর স্বর্ণ রৌপ্য ও বস্ত্র সজ্জিত দারুবেষ্টনীর মধ্যে বিশিষ্ট অভিজাতবর্গের গালিচা বিছানো দাঁড়াইবার স্থান “জাত” (rank) হিসাবে পায়ের নীচে গালিচার দাম।
[* “His Majesty (Akbar) has commanded the palm of the right hand to be placed on the forehead, and the head to be bent downwards. This mode of sa- luting in the language of the present age, is called kornish, and signifies that the saluter has placed his head…as a present, and has made himself in obedi- ence ready for any service that may be required of him.
The salutation, called taslim in placing the back of the right hand on the ground, and then raising it gently till the person stands erect, when he puts the palm of his hand upon the crown of his head, which pleasing manner of salut- ing signifies that he is ready to give himself as an offering….
… Upon taking leave, or presentation, or upon receiving a mansab, a jagir or a dress of honour, or an elephant, or a horse, the rule is make three taslims; but only one on oll other occasions, when salaries are paid or presents are made … ( Ain-i- Akbari, Blochmannl Ain 74, p 158 )]
দরবার গৃহের স্তম্ভবীথিসমূহের প্রস্তরদেহ স্বর্ণতত্ত্ব পুষ্পিত তুর্কী বনাতের রক্ত- নিচোলাবৃত গলদেশে রেশমী বন্ধনমালিকা হইতে রেশমগুচ্ছের দোলায়মান বেণী, শিরোদেশে (capital of pillars) রত্নানুকারী স্ফটিকের মালা উষ্ণীষের “শিরপ্যাচের” ন্যায় শোভমান। খিলানগুলির [তিন সারি, প্রত্যেক সারিতে নয়টি খুপী (bay)?] মাথার উপরে শালের সাজ, শালের জরিদার চওড়া কিনারা “মুখের” উপর (স্তস্তদ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানের উপরাংশ) ওড়নার ন্যায় ঝুলিয়া পড়িয়াছে, উপরে স্তম্ভধৃত ছাদে (ceiling, not roof) ফিরিঙ্গি বনাতের প্রাবরণ (tapestry), প্রাচীর গাত্রে সুবৃহৎ কাশ্মীরী “নামদা”র (ফাঃ নামদ? ) উপরাবরণের ( hangings) উপর সূচীশিল্পে চেনার গাছ, ফলনমিত আঙুরের লতা ও নানাবিধ ফুল।
এই প্রাসাদের মধ্যবর্তী শাহানশাহ্-র “তখগাহ্” বা সিংহাসনের পাদপীঠ যেন এই বিদায় অভিনন্দন উপলক্ষে হজরত সুলেমান নবীর অশরীরী “জিন”-(Spirit) গণ সাজাইয়া রাখিয়াছে। দরবারের দিনে উহার ঢালু (curvilinear) ছাদ বুটিদার জরির কাপড় (cloth of gold) দ্বারা আবৃত করা হইয়াছে; উহার কিনারায় মুক্তাচুনির ঝালর। এই মণ্ডপের নিম্নভাগেও জরদৌজী বনাতের ঘের ভূমিতলস্থ গালিচার উপর পড়িয়া রঙের ঢেউ তুলিয়াছে। মণ্ডপের মর্মরস্তম্ভ চতুষ্টয়ও বহুবিধ মণি-খচিত চীনাংশুকের উত্তরীয় দ্বারা সজ্জিত হইয়া রক্তস্তম্ভের ন্যায় প্রতীয়মান হইতেছে; স্তম্ভের শিরোভাগে তিনদিকে (পূর্ব ব্যতীত) সুবর্ণদণ্ডের রক্ষাবেষ্টনী, সম্মুখে দুইটি রত্নমণ্ডিত সোনার ধূপদানি (ফাঃ—”উদ্-সোজ”), উপরে ছাদের নীচে সোনালি কাপড়ের ঝালদার ক্ষুদ্র চন্দ্রাতপ। উহার ছায়ায় সম্রাটের ময়ূর-সিংহাসন শাহী জহরৎ খানার কয়েদমুক্ত হইয়া এই চন্দ্রাতপে তাঁহার কদমমোবারকের অপেক্ষা করিতেছে।
শাহী দরবারের “কবি সম্রাট” মোল্লা কুদ্সী এই তখত্-ই-তাউসের শান্ এবং শাহজাহানী সৌকৎ বর্ণনা করিয়া এক মসনবী (ফার্সি কবিতালহরী) লিখিয়াছিলেন এবং উহা এই সিংহাসনগাত্রে সম্রাটের আদেশে উৎকীর্ণ হইয়াছিল। ইরানী কবির ভাষা ঐতিহাসিক কোথায় পাইবে? সুতরাং কাব্যরসিকগণ দরবারী ইতিহাস বাদশাহ-নামায় ছাপার অক্ষরে উহা পড়িতে পারেন।
সাদা কথায় এই ময়ূর সিংহাসন* সোনার পায়া ও কাঠামের উপর সোনার তক্তার ছাউনি খাট বিশেষ, অনেকাংশে বিষ্ণুমণ্ডপে ঠাকুরের সিংহাসনের মতো। এই সিংহাসন প্রস্তুত করিবার জন্য প্রথম দফায় একলক্ষ তোলা সোনা এবং আড়াই সের হীরা চুনি পান্না ইত্যাদি দেওয়া হইয়াছিল। এই খাট বা মসনদের উপরে দরবারের সময় তিনপ্রস্থ গালিচা ও জড়োয়া মখমলের আস্তরণ বিছাইয়া পিছনে বড় শাহী তাকিয়া এবং সামনে ছোট দুইটি তাকিয়া বসানো হইত; এই তাকিয়াগুলির উপর কাবুল-ইরানে প্রস্তুত জড়োয়া “তাকিয়া-নামদ” (coverlet)। বড় শাহী তাকিয়ার পশ্চাৎদেশে সুবর্ণদণ্ডের মাথায় মুক্তার ঝালরদার রত্নমণ্ডিত শাহী শ্বেতছত্র। সামনে ছোট তাকিয়াদ্বয়কে আড়াল করিয়া স্থাপিত হইত দুই দিকে মুখোমুখি দুইটি রত্নময়ূর। আম-দরবারে নাচের মহড়া নাই; সুতরাং ময়ূরও পেখম ধরে নাই। খোদাতালা ময়ূরকে মোরগের মতো পায়ের উপর খাড়া করিয়া অবিচার করিয়াছিলেন, শাহানশার ইনসাফে ময়ূরের পা, মায় নখাগ্র পর্যন্ত “মোরাচ্ছা” বা রত্নমণ্ডিত হইয়া গিয়াছে। রঙের বাহার থাকিলেও আসল ময়ূরের গলায় মালার মতো কিছুই খোদাতালা বখশিশ করেন নাই; কিন্তু মোহনমালা না হইলে বাদশাহী ময়ূরকে মানাইবে কেন? এইজন্য এই ময়ূরযুগলের গলায় বসানো (inlay) বদশানী চুনি, পেগুর নীলা, মিশরের সবুজ পান্না, (yokut) তুতীকরণ (Tuticonri মাদ্রাজ) ও বাহেরিন উপসাগরের মুক্তা ইত্যাদি রত্নসমুচ্চয়শোভিত হার খোদার কুদরতকে হার মানাইয়াছে। ইহার মধ্যে একটি ময়ূরের হারের ধুগধুগীর শেষ মুক্তাদানা ** –যাহা বুকের উপর পড়িয়াছে—উহার দামই প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা, ইহার জুড়ি আর একটি মুক্তা অন্য ময়ূরের জন্য বহু চেষ্টা করিয়াও খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই—আলা হজরতের জপমালার (তসবী) চল্লিশ হাজারের মধ্যেও বেশি দামের মুক্তাফল ছিল না।
[* ময়ূর সিংহাসনের তক্তা পায়া ময়ূর ইত্যাদি বিভিন্ন অংশ বাক্সবন্দী হইয়া অন্দরমহলের রত্নভাণ্ডারে রক্ষিত হইত। কেবলমাত্র বিশেষ বিশেষ ব্যাপারে ও নওরোজের উৎসব-দরবারে শিল্পীগণ এই সমস্ত অংশ জোড়া লাগাইয়া সিংহাসন খাড়া করিত।
** Tavernier, edited by Ball; ii, 103 “…which…is suspended from the neck of a peacock made of precious stones and rests on the brest…”
– Abdul Aziz, Imperial Treasury of the Indian Mughuls, p. 360]
যাহা হউক, এই সমস্ত মণি-মাণিক্য হজরত সুলেমান নবীর তাঁবেদার “শয়তান” কোনও স্থান হইতে চুরি করে নাই, কিংবা “জিন” ডুবুরী বাহেরিন উপসাগরে ডুব দিয়া মুক্তা উঠাইয়া আনে নাই। হিন্দুস্থানের মাটি মানুষের পরিশ্রমেই সোনা ফলাইয়াছে, এই দেশে বংশানুক্রমিক চর্চায় উন্নততর শিল্পকলার জাদু দেশ-বিদেশ হইতে দুষ্প্রাপ্য রত্নরাজি আকর্ষণ করিয়া যুগে যুগে এইভাবে রাজদরবার সাজাইয়াছে, কিন্তু প্রজার দুর্গতি ঘুচে নাই।
প্রধানমন্ত্রী জাফর খাঁ ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ আমীরগণ সম্রাটের পক্ষ হইতে দারাকে অভ্যর্থনা করিবার জন্য দেওয়ান-ই-আমের ফটকে অপেক্ষা করিতেছিলেন, ভিতরে গোধূলির স্নিগ্ধতা নামিয়া আসিয়াছে, বিরাট ময়দানের মধ্যভাগে বস্ত্রমণ্ডপ হস্তী ও অশ্বতরঙ্গ বিক্ষুব্ধ জনসমুদ্রে পতাকাশোভিত অর্ণবপোতের ন্যায় শোভমান। ফটকের সামনে পালকি হইতে নামিয়া সানুচর শাহজাদা প্রধানমন্ত্রীর পশ্চাতে পদব্রজে চলিলেন এবং বস্ত্রমণ্ডপের তোরণের বাহিরে সকলেই জুতা খুলিয়া মণ্ডপ মধ্যবর্তী পথে সিংহাসন-অলিন্দের দিকে অগ্রসর হইলেন, জনতার জয়ধ্বনি ও সেনানীগণের মোবারকবাদে দরবার প্রাঙ্গণ কাঁপিয়া উঠিল।
অল্পক্ষণ পরেই গম্ভীরতর বাদ্যধ্বনি সম্রাটের আগমন ঘোষণা করিল। মহাপ্রতিহার- পুরঃসর স্বয়ং সম্রাট কোষবদ্ধ রাজতরবারির উপর ভর করিয়া জরাকম্পিত পাদক্ষেপে মসনদ-ঝরোকায় প্রবেশ করিবামাত্র “বাদশাহ সালাম”, “জাঁহাপনা সালাম” ধ্বনিতে শাহীমহল প্রতিধ্বনিত হইল, সঙ্গে সঙ্গে প্রধান নকীব সিংহাসনের নিম্নদেশ হইতে তীক্ষ্ণ মোরগকণ্ঠে শাহানশার-কুলজী ও প্রশস্তি পাঠ আরম্ভ করিল এবং আমীর ও রাজন্যবর্গ সকলেই স্ব স্ব স্থানে দণ্ডায়মান থাকিয়া আনতমস্তকে হিন্দুস্থানী প্রথায় হাতজোড় করিয়া “জোহার” জানাইলেন। অপূর্ব রাজন্যপ্রভায় উদ্ভাসিত দরবারগৃহ ও চত্বরের দিকে দিল্লীশ্বর ঋজুদেহে ও স্থিরনেত্রে দৃষ্টিপাত করিয়া প্রত্যভিবাদনচ্ছলে দক্ষিণহস্তের রত্নজপমালা উঠাইয়া প্রজাবর্গকে বরাভয় দান করিলেন। অতপর দেহরক্ষীর* হাতে রাজতরবারি অর্পণপূর্বক সবিতৃমণ্ডলস্থিত নারায়ণের ন্যায় তিনি সিংহাসনে উপবিষ্ট হইলেন।
[* বাদশাহ-নামায় দেখা যায় শাহজাহানের রাজত্বের প্রথম ভাগে রাজা বিঠলদাস গৌর এই সম্মানের অধিকারী ছিলেন। অন্দরমহল হইতে সিংহাসনমণ্ডপে প্রবেশ করিয়া সম্রাট ইঁহার হাতে রাজতরবারি রাখিয়া চটিজুতা ছাড়িয়া শাহী গালিচায় সুখাসনে (cross-legged) উপবিষ্ট হইতেন। সম্রাটের তরবারি ও পাদুকা রাজার হেপাজতে থাকিত।
বিঠলদাসের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র অর্জুনসিংহ গৌর সম্ভবত এই পদে নিযুক্ত ছিলেন। ধর্মাতের যুদ্ধে অর্জুনসিংহের মৃত্যুর পর কাহাকে ওই স্থান দেওয়া হইয়াছিল জানা যায় না। আকবরের আমল হইতে সম্রাটগণের দেহরক্ষী রাজপুতই ছিল।]
সম্রাটের পরিধানে মসলিনের সাদা হিন্দুস্থানী পোশাক, মাথায় সাদা “দস্তার” (পাগড়ি), শির-প্যাচের (উষ্ণীষবন্ধনী) উপর সাদা বকের পালকযুক্ত তুরা, গলায় মুক্তার প্রালম্বিকা “মোহনমালা”, ডান হাতে তসবী, অঙ্গুলীসমূহের অঙ্গুরীয়প্রভা সম্মুখস্থ রত্নময়ূরের পৃষ্ঠে বিদ্যুৎচমক ভ্রম জন্মাইয়াছে। তাঁহার পরিচ্ছদ ও অভূষণ আড়ম্বর ও বাহুল্যবর্জিত, অথচ উহার মধ্যে মোগল-ভাণ্ডারের শ্রেষ্ঠতম রত্নরাজি দেদীপ্যমান। শাহশাহ্-র শিরপ্যাচ বা উষ্ণীষ-বেষ্টনীর মধ্যেই চব্বিশটা মুক্তাদানা ও পাঁচখণ্ড চুনি (ruby); এই সমস্ত চুনির মধ্যমণিখণ্ড ললাটের উপর অগ্নিগর্ভ হরনেত্রের ন্যায় ধকধক করিয়া জ্বলিতেছে। ইহা ওজনে ২৮৮ রতি, সরকারি হিসাবে দাম মাত্র দুই লাখ টাকা ( Badshahnama ii 391 )।
মোগল সম্রাটের উষ্ণীষে পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত একাধিক বৃহৎ হীরকখণ্ড ছিল, কিন্তু এইগুলির মধ্যে কোন্ হীরক শাহজাহানের রাজ্যচ্যুতির একাশি বৎসর পরে নাদিরশাহকে মোহিত করিয়া তাঁহার নিকট হইতে “কোহিনূর” আখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছিল— উহা কেহ সঠিক বলিতে পারে না।* এই উষ্ণীষের উপরিভাগে “তুরা”য় (উষ্ণীষ-মণ্ডন) রাজলক্ষ্মীর শুভ্র কীর্তিবিন্দুর ন্যায় শোভমান ছোট পেয়ারার আকৃতি (guava-shaped) একটি বৃহৎ মুক্তাদানা (ওজন ৪৭ রতি; দাম ৫০,০০০––( Badshahnama)।
[*হিন্দুর পরবর্তী রূপকথা অনুসারে এই “কোহিনুর” যদুবংশের সেই বিবদমান “সামস্তক” মণি, কিংবা শ্রীকৃষ্ণের গলার হারের “ধুগধুগী” কৌস্তভ রত্নও হইতে পারে! উহা কোথা হইতে কেমন করিয়া দিল্লির ভাণ্ডারে আসিয়া পড়িল—এই প্রশ্ন নিতান্ত অরসিক না হইলে কেহ তুলিবেন না। রত্নের গতিবিধি মানুষের অদৃষ্টের ন্যায় বিচিত্র ও দুর্ব্বেয়। মহীশূরের কোনও অজ্ঞাত মন্দিরে লুক্কায়িত সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকে কানা করিয়া কোনও চোর রুশ সম্রাটের রাজদণ্ডের জন্য Orloff Dia- mond জোগাড় করিয়াছিল কে বলিতে পারে?
যাহা হউক, Prof. Maskelyne বলেন, বাবর বাদশাহ আগ্রায় ইব্রাহিম লোদীর রাজকোষে ২২১.৬ রতি ওজনের যে হীরা পাইয়াছিলেন, এবং যাহার দাম “দুনিয়ায় আড়াই দিনের খাইখরচা” বলিয়া জনপ্রবাদে পরিণত হইয়াছিল––উহাই ইতিহাস- বিস্তৃত “কোহিনূর” (Natare, 1891, p. 556)। এক লাখ দেড় লাখ টাকার হীরাকে শাহজাহান আমলই দিতেন না। এক লাখ টাকা দামের একটুকরা হীরা তিনি দারাকে দিয়াছিলেন, দেড় লাখ টাকার আর এক খণ্ড কাবাশরীফে মোমবাতি জ্বালাইবার জন্য এক “খন্দিল” বা candlestick-এ লাগাইয়া মক্কা পাঠাইয়াছিলেন। দরবারী ঐতিহাসিক ওয়ারেস লিখিয়াছেন, উজীর-আজম মোয়াজ্জম খাঁ (মীরজুমলা) ২১৬ রতি ওজনের একখণ্ড হীরক “পেশকশ” হিসাবে উপহার দিয়াছিলেন। (১৭ই ডিসেম্বর ১৬৫৫ খ্রিঃ )। সম্রাটের আদেশে উহার দাম দুই লক্ষ ষোল হাজার টাকা বহিতে লেখা হইয়াছে (Badshah- nama, part III MS.) এই মীরজুমলা হীরককে কেহ কেহ পরবর্তীকালের “কোহিনুর” হীরক বলিয়া অনুমান করেন।
Tavernier গোলকুণ্ডার সুলতান আবদুল্লা কুতবশাহর কাছে একখণ্ড হীরা চারি লক্ষ টাকা দামেও কিনিতে পারেন নাই। গোলকুণ্ডা বিজয়ের পর ইহা আওরঙ্গজেবের হাতে পড়িয়াছিল। Prof. Maskelyne বলেন, ইহাই নাদিরশাহর কবলে পড়িয়া দরিয়া নূর (জ্যোতি – সমুদ্র) নামে পরিচিত হইয়াছিল। আওরঙ্গজেবের নিকট প্রেরিত (ওজন আড়াই আউন্স?) প্রায় হাজার পাউণ্ড দামের একখণ্ড হীরা মারাঠা দস্যুগণ লুঠ করিয়াছিল। (Forster, Eng. Factory Records 1661. 64, p. 119 )]
সম্রাটের গলায় কোমর পর্যন্ত লম্বমান কয়েক লহর মোহনমালায় কয় শত মুক্তার দানা ছিল সে হিসাব কেহ রাখিয়া যায় নাই। মুক্তার কাঠামোর মধ্যে শাহজাহান নিজের এক ছবি আবদুল্লা কুতবশাহকে উপহার পাঠাইবার সময় উহা টাঙাইবার জন্য মুক্তা গাঁথা সরু দড়িও দিয়াছিলেন, ইহা হইতে সম্রাটের গলায় মুক্তার সংখ্যা ও দাম অনুমান করিতে হয়। দরবারী ইতিহাসে দেখা যায়, সম্রাটের দুইটি জপমালা বা তসবী ছিল। প্রত্যেক দুই খণ্ড ইয়াকুতের (সবুজ পাথর, কচুরি পানার রং) মধ্যে এক এক দানা মুক্তা এই তসবীর মধ্যে ছিল। দুইটি তসবীতে দরবারী ইতিহাস অনুসারে ১২০ দানা মুক্তা ছিল এবং পাথর সমেত মোট দাম বিশ লক্ষ টাকা, জপমালার “সুমেরু” বা মধ্য-মুক্তার ওজন ৩২ রতি, দাম ৪০,০০০। এই দুইটি পছন্দ না হওয়ায় শাহজাহান পাঁচখণ্ড চুনি ও ত্রিশ দানা দামী মুক্তার ছোট তসবী প্রস্তুত করাইয়াছিলেন, দাম ৮ লক্ষ টাকা। ইহাই তিনি সাধারণত জপ করিতেন অন্তত পোশাকের অঙ্গস্বরূপ ডান করে রাখিতেন।
মোগল যুগে তুর্কী পশমী লম্বা কোট “চারকোর্” জামা (বর্তমান সংস্করণে লক্ষ্ণৌ শিরওয়ানী) ব্যতীত অন্য কোনও জামায় “কলার” কিংবা বোতাম থাকিত না। সুতি কাপড়ের জামা আঙ্গরাখায় কাপড়ের টানা (Strings) ব্যবহার হইত। জাহাঙ্গীর বাদশাহর বোতামদার নাদিরীজামা দরবারে প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছিল–এই জামায় মুক্তার দানার “তুমা” (বোতাম) ব্যবহৃত হইত। আকবর ও জাহাঙ্গীর চিশতীপীরের কান ফোঁড়া বান্দা ছিলেন এবং দুই কানে রাজপুত রাজাদের ন্যায় মোতির কুণ্ডল পরিতেন, দুইটি দামী চুনীর মাঝখানে মুক্তার একটি বড় দানা এই কুণ্ডলে থাকিত। শাহজাহান গোঁড়া মুসলমান, কুণ্ডল ধারণ করিবার লোভে তিনি শরিয়ত উপেক্ষা করিয়া কান ফোঁড়াইতে রাজি হইবার ব্যক্তি নহেন।
যাহা হউক, শাহজাহানের চটিজুতায় কয়শত মুক্তা ও কয় টুকরা দামী পাথর ছিল এবং উহার কত দাম ইতিহাসে লেখা নাই। যাঁহার ছোট শালীর পায়ে লাখ টাকার চটি ছিল বলিয়া জানা যায়, তাঁহার দরবারী পাদুকায় হয়তো ইহার দ্বিগুণ দামের হীরা-জহরত ছিল। সেই কালে দরবারে “heel” ছাড়া চটি জুতাই ফ্যাশন ছিল, এই মোগলাই চটি* হয়তো শাহশুজার সহিত সরাসরি ঢাকা গিয়াছিল, কিংবা পরে লক্ষ্ণৌর নবাবী দরবার হইয়া মুর্শিদাবাদ-কলিকাতা পৌঁছিয়াছিল। সে যুগে আট আনায় সাধারণ গরিব ভদ্রলোকের ব্যবহার্য এই ধরনের চটি পাওয়া যাইত, আওরঙ্গজেব বন্দী পিতাকে মরিবার পূর্বে এই দামের একজোড়া চটি খোজা এতেবার খাঁর মারফত কিনিয়া পাঠাইয়াছিলেন।
[* বেগম-বাদশাহর পোশাকি চটির তলি — যাহাতে মাটি লাগিবার কথা নয়– অত্যন্ত হালকা এবং আগাগোড়া সমান হইত; অর্থাৎ গালিচার পক্ষে ক্ষতিকর heel থাকিত না; উপরে কার্পেটের গায়ে জরির কাজ, এবং দামী পাথর বসানো হইত। পুরনো ফ্যাশনের চটির ন্যায় বেগমদের চটির মাথা চেপ্টা হইত; কিন্তু পুরুষের চটি তলার ডগায় এক অতিরিক্ত পুরু ও দীর্ঘতর পট্টির উপর ভর করিয়া মাথা চাড়া দিয়া উঠিত, এবং সাপের মাথায় উল্টা ফণা কিংবা নৌকার পালের মতো মাথা পিছনে হেলাইয়া সদর্পে পুরুষত্ব জাহির করিত।
পুরুষের জন্য বাহিরে ব্যবহার্য নাগরা জুতার গড়নেও ওইপ্রকার উদ্ধত ভাব ছিল, পরে পরে উহার মাথায় “তুরার” মতো চামড়ার সরু ফালির দীর্ঘ শিং লাগাইয়া চেহারা করা হইত। আজকাল হিন্দুস্থানী, পাঞ্জাবীর আমিরি জুতায়, পাঠানের পেরেক বছল চারি সের ওজনের জাহাজী নাগ্রায়—যাহা সফরে মালিকের মাথার নীচে বালিশের কাজও করে- উহার রকমারি দেখা যায়।]
১১
সম্রাট আসন গ্রহণ করিবার পর পূর্ব নির্ধারিত কার্যক্রম অনুসারে দরবার আরম্ভ হইল। সর্বপ্রথমে প্রধানমন্ত্রী জাফর খাঁ দারাকে সঙ্গে লইয়া কুর্নিশ করিবার জায়গায় উপস্থিত হইলেন, নকীব তারস্বরে শাহজাদার খেতাব মনসব ইত্যাদি যথারীতি ঘোষণা করিল। জাফর খাঁ কুর্নিশ করিয়া পিছনে সরিয়া গেলেন। বড় বড় রেকাবে জরির কাপড়ে ঢাকা নজর-সামগ্রী লইয়া দারার ভৃত্যগণ সারিবদ্ধ হইয়া দণ্ডায়মান ছিল। দারা তসলিম করিয়া নজর পেশ করিলেন, খান-ই-সামান দারার হাত হইতে নজরের থালা গ্রহণ করিয়া গুরুজ বরদারের হাতে সম্রাটের সামনে পেশ করিলেন। শাহানশাহ ওই সমস্ত থালার এক-একটি মাত্র জিনিস স্পর্শ ও দৃষ্টিপূত করিয়া শাহজাদার নজর “মাপ” করিলেন—অর্থাৎ কিছুমাত্র গ্রহণ না করিয়া ওইগুলি যিনি দিয়াছেন তাঁহাকেই পরোক্ষে বকশিশ করিলেন। এই অনুগ্রহের জন্য দারা দ্বিতীয়বার তসলিম করিয়া অনুমতিক্রমে পিতার কদমবোসী (পদচুম্বন ) করিলেন। সম্রাট তাঁহাকে মোবারক বাদ জানাইয়া আসন গ্রহণ করিবার হুকুম দিলেন। সিংহাসনের ডানদিকে মসনদ অপেক্ষা নীচু ছোট সোনার চৌকি শাহজাদার জন্য নির্দিষ্ট ছিল। তিনি আবার জমিন বোস (ভূমি চুম্বন) করিয়া উহার গালিচায় “দোজানু” (হাঁটু গাড়িয়া “উষ্ট্রাসনে”) হইয়া উপবেশন করিলেন।
ইহার পরে কুমার সিপহর শুকোর নজর পেশ হইল; তিনি সম্রাটের আদেশে মসনদের বামদিকে দণ্ডায়মান রহিলেন। এইভাবে সামন্ত রাজবর্গ ও উচ্চপদস্থ আমীরগণের নজর পেশ হইল, শাহানশাহ সকলের নজর “মাপ” করিলেন—আজ তিনি গ্রহীতা নহেন।
নজরের পালা সাঙ্গ হইবার পর দেহরক্ষী সেনা এবং শাহী পশুশালার চতুষ্পদদিগের মুজা বা অভিবাদন। প্রথমে কবচাবৃত জমকালো পোশাক পরিহিত দেহরক্ষী আহলী অশ্বসাদি চত্বর পরিক্রমা করিয়া সম্রাটকে অভিবাদনপূর্বক ফটকের পথে বাহির হইয়া গেল। ইহাদের পরে দুই শত আড়াই শত খাসা ঘোড়া, সবগুলির গায়ে জড়োয়া সোনার সাজ। ঘোড়ার পরে শতাধিক খাসা (royal) হাতি; এগুলির মধ্যে পাট-হাতি (আওরঙ্গগজ) মনসব হিসাবে সর্বপ্রধান। মনসবদারী পদমর্যাদা অনুসারে ইহাদের গায়ে জড়োয়া কিংবা সোনা-রুপার সাজ (harness); এবং প্রত্যেকটা খাসা হাতির সঙ্গে আগে পিছে আট-দশটা ঝকঝকে পিতলের সাজে চাকর-হাতি; কোনও কোনও রাজহস্তী বিশেষ অধিকারবলে সপরিবারে দরবারে আসিয়াছেন। দেওয়ান-ই-আমের নীচে চলাচলের পথে মাহুতের সঙ্কেতে বিশিষ্ট হাতিগুলি পাকা দরবারীর মতো আলা হজরতকে শুঁড় মাটিতে ঠেকাইয়া আবার বক্রভাবে মাথার উপর রাখিয়া “তসলিম” জানাইল। হাতির পরে উট্টশালার ক্ষুদ্র নালিকাস্ত্রবাহী (শোতর-নাল) জঙ্গী উটের কাতার মুজরায় উপস্থিত হইল।
ইহার পরে শাহজাদা দারার নিজ তাবিনের সেনাবাহিনী ও হাতি ঘোড়ার মহড়ার (review) হুকুম হইল; অধিকন্তু সম্রাট ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন দেওয়ান-ই-আম হইতে : শাহজাদা এবং তাঁহার অনুগামী রাজা ও মনসবদারগণের সওয়ারী পতাকা বাদ্যসমেত বিজয় যাত্রা করিবেন। এইরূপ সম্মান আকবর-জাহাঙ্গীরের আমলে কোনও শাহজাদার ভাগ্যে ঘটে নাই; সুতরাং ইহা নিতান্ত অপ্রত্যাশিত ব্যাপার। যাহা হউক, কিছুক্ষণ পরে বাহির হইতে বিদায়ী শোভাযাত্রার অপেক্ষমাণ মিছিল মোড় ঘুরিয়া চত্বরে প্রবেশ করিল। দারা আসন ত্যাগ করিয়া সম্রাটকে অভিবাদনপূর্বক দণ্ডায়মান রহিলেন, তাঁহার নিজ তাবিন মহড়ায় উপস্থিত হইল। অশ্বারোহী, হস্তী ও পদাতিবর্গ সুশৃঙ্খল ভাবে দেওয়ান-ই-আমের সম্মুখস্থ দরবারী রাস্তা হইতে সম্রাটকে অভিবাদন করিয়া চলিয়া যাইতে লাগিল, চত্বরে কিছুক্ষণের জন্য যুদ্ধের আবর্ত সৃষ্টি হইল।
১২
অতপর সম্রাট খেলাত বিতরণের হুকুম দিলেন। ক্রমানুসারে অনুগৃহীত ব্যক্তিগণের নাম ডাকা আরম্ভ হইল। দারা নীচে নামিয়া “তসলিম”* করিলেন এবং খেলাতের খাসা হাতি ঘোড়া, বস্ত্র, রত্নখচিত তরবারি ইত্যাদি প্রত্যেক সামগ্রীর নাম উল্লেখের সঙ্গে হাত জোড় করিয়া মাথা নোয়াইয়া নিঃশব্দে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিলেন। ইহার পরে উজির-আজম, মীরসামান ও গুর্জ্ বরদারগণ শাহজাদাকে খেলাত পরিধানের তাঁবুতে লইয়া গেলেন এবং আমীর-উল্-ওমরা শায়েস্তা খাঁ প্রধান মন্ত্রীর পরিবর্তে নাম ডাকিয়া খেলাত ঘোষণা করতে লাগিলেন; দারার পরে কুমার সিপ্হর শুকো, রুস্তম খাঁ, রাও ছত্রশাল ইত্যাদির নাম ডাকা হইল। খেলাতের পোশাক ও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হইয়া এবং Token delivery জ্ঞাপক হাতির অঙ্কুশ ও ঘোড়ার লাগাম, রথের সারথির চাবুক হাতে লইয়া দারা পুনরায় সিংহাসনের নীচে দাঁড়াইয়া তিনবার তসলিম করিলেন এবং উপরে গিয়া সম্রাটের পদচুম্বন করিলেন। অন্যান্য যাঁহারা খেলাত পাইলেন তাঁহারাও পর পর খেলাত পরিধান করিয়া তিন-তিনবার তসলিম করিবার পর স্ব স্ব স্থানে দণ্ডায়মান রহিলেন। এই দিনের ন্যায় এত বেশি সংখ্যক খেলাত কোনও দরবারে বিতরণ করা হয় নাই। যাঁহারা দামী খেলাত পান নাই তাঁহারাও নগদ এক হাজার হইতে এক শত টাকার তোড়া উপহার পাইয়াছিলেন।
রাও ছত্রশাল এই দরবারে বিশেষভাবে সম্মানিত হইয়াছিলেন। তাঁহাকে দামী খেলাত, খাসা হাতি-ঘোড়া এবং রত্নমণ্ডিত অস্ত্রশস্ত্র ব্যতীত মনসব ও জায়গীরে ইজাফা (বৃদ্ধি) দেওয়া হইয়াছিল। বুন্দী কবির উক্তি অনুসারে সম্রাট রাও ছত্রশালকে নিজের কাছে ডাকাইয়া দারাকে তাঁহার হাতে সমর্পণ করিয়াছিলেন। তাঁহার ভ্রাতা পুত্র পৌত্র ও জ্ঞাতিগণের ষোলজনের খেলাত মঞ্জুর হইয়াছিল। প্রথমে তাঁহার পুত্র কুমার ভগবন্ত সিংহের** ডাক পড়িল। তিনি তসলিম করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন, অথচ খেলাত লইলেন না। এই বেয়াদবির দরুণ একটা হই-চই পড়িয়া গেল, বাদশাহী খেলাত প্রত্যাখ্যান একটা অচিন্তনীয় ব্যাপার। বেগতিক দেখিয়া রাও ছত্রশাল আগাইয়া আসিয়া নিবেদন করিলেন, এই হতভাগা শাহজাদা আওরঙ্গজেবের চাকরি গ্রহণ করিয়া শুধু আমার কথায় দরবারে আসিয়াছে; সে আমাদের শত্রু, সুতরাং খেলাত পাইতে পারে না। শাহজাহান রাজপুতকে বিলক্ষণ চিনিতেন। তিনি ঈষৎ হাসিয়া রাও ছত্রশালকে বলিলেন, উহাতে দোষ কি? আওরঙ্গজেবও আমার পুত্র। ভগবন্ত সিংহ কিছুতেই রাজি না হওয়ায় সম্রাট অগত্যা তাঁহাকে দরবার হইতে প্রস্থানের অনুমতি দিলেন। ইহার পর দরবারে উপস্থিত নাবালক কনিষ্ঠকুমার (চতুর্থ) ভারতসিংহ এবং বুন্দীরাজের কনিষ্ঠ ভ্রাতা খুল্লতাত ইত্যাদি পনের জন সেনানায়ক খেলাত ও পুরস্কার গ্রহণ করিলেন।
[* আকবর কুর্নিশ ও তসলিম করিবার কায়দা উদ্ভাবন এবং প্রবর্তন করিয়াছিলেন। তসলিমের নিয়ম : মাথা আস্তে আস্তে নীচু করিয়া ডান হাতের পিঠ মাটিতে রাখিবে; অতপর সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া ওই তালের তালু মাথায় রাখিবে।
খেলাত জায়গীর ইত্যাদি বকশিশ হইলে গ্রহীতা তিনবার তসলিম করিবে, বেতনাদি গ্রহণের সময় একবার ( দ্রষ্টব্য Ain i, p. 158 )।
** কুমার ভগবন্ত সিংহ বুদীর উত্তরাধিকারী হইয়া জন্মগ্রহণ করেন নাই। এইজন্য তিনি স্বতন্ত্র ঠিকানা (জায়গীর) স্থাপন করিবার জন্য কৃতসংকল্প ছিলেন। ধর্মাতের যুদ্ধের পর তিনি আওরঙ্গজেবের নিকট উপস্থিত হইয়া চাকরি গ্রহণ করেন। রাও ছত্রশাল তাঁহাকে বুন্দী আসিবার জন্য আদেশ দেওয়ায় ভগবত্ত সিংহ আওরঙ্গজেবের নিকট কথা দিয়াছিলেন তিনি অন্য কাহারও চাকরি স্বীকার করিবেন না; এইজন্য তিনি দৃঢ়তার সহিত সম্রাটের খেলাত প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন। সামুগঢ়ের যুদ্ধে তিনি আওরঙ্গজেবের পক্ষে অসীম শৌর্য প্রদর্শন করেন। রাজ্যারোহণের পর তিনি কুমারকে পুরস্কারস্বরূপ বুঁদীর গদি দিতে চাহিয়াছিলেন। ভগবন্ত সিংহ এই প্রস্তাব ঘৃণার সহিত প্রত্যাখ্যান করিয়া বলিয়াছিলেন, পিতা যাঁহাকে বুঁদীর গদি দিয়াছেন তাঁহাকে যদি রাজচ্যুত করিবার কেহ চেষ্টা করে তিনি বুঁদীর পক্ষ হইয়া লড়িবেন। তিনি বারা ও মৌ স্বতন্ত্র জায়গীর লাভ করিয়া সন্তুষ্ট ছিলেন (বংশ ভাস্কর; পৃ. ২৬৭৯)। ইহাই সে কালের আদর্শ ক্ষত্রিয় চরিত্র। চতুর মুসলমান প্রথম হইতে রাজপুত চরিত্রের ন্যায়ান্যায়-নিরপেক্ষ স্বামিধর্মের দুর্বলতা পূর্ণভাবে কাজে লাগাইয়াছিল। ]
১৩
দেওয়ান-ই-আমের চত্বরে যাত্রার বিজয়-দুন্দুভি বাজিয়া উঠিল, সম্রাট-প্রদত্ত সুসজ্জিত (সপ্তাশ্ববাহিত?) “রথ”* দরবার গৃহের পাদদেশে শাহজাদাকে লইয়া প্রস্থান করিবার জন্য প্রস্তুত। শাহজাহান এতক্ষণ লোকচক্ষুর গোচরে পুত্রের প্রতিও প্রজানির্বিশেষ রাজধর্মের দূরত্ব রক্ষা করিয়া আসিতেছিলেন; কিন্তু বিদায় প্রার্থনা করিয়া দারা তাহার পদস্পর্শ করিবামাত্র তিনি এবারে ভাঙিয়া পড়িলেন। সিংহাসন হইতে উঠিয়া নিতান্ত প্রাকৃতজনের ন্যায় আকুলভাবে পুত্রকে বুকে চাপিয়া ধরিলেন, কিছুক্ষণ পরে আত্মসংবরণ করিয়া পুত্রের বিজয় কামার্থ “সুরা-পাতেহা” আবৃত্তি করিলেন, চারিদিকে তুমুল হর্ষ ও জয়ধ্বনি উত্থিত হইল। সম্রাট আদেশ দিলেন, দেওয়ান-ই-আমের সিঁড়ি হইতেই শাহজাদা রথে পদার্পণ করিবেন, সেনানীগণ অশ্বারূঢ় এবং সৈন্যগণ সামরিক কায়দায় ব্যূহবদ্ধ হইয়া তাঁহার অনুগমন করিবে, শাহজাদার বাদ্যভাণ্ড কোথাও নিস্তব্ধ হইবে না, পতাকা অবনমিত হইবে না।
[*“রথ” শব্দ এখনও অপ্রচলিত নয়। কাম্বোর Amal-i-salih ও লাহোরী ওয়ারসের Badsha-nama গ্রন্থে একাধিক বার রথের উল্লেখ পাওয়া যায়। দিল্লি অঞ্চলে এক্কা গাড়িকে “রথ” বলা হয়; অন্যত্র সাধারণত ছপ্পরওয়ালা গরুর গাড়িকেও রথ বলে। প্রাচীন রথের নমুনা রাজপুতানার জায়গীরদারগণের চারি ঘোড়ার জুড়ি গাড়িতে দেখা যায়। হিন্দু সংস্কার অনুসারে দক্ষিণ দিকে বিজয়-যাত্রার রথই শুভ। শাহজাহান গোঁড়া মুসলমান হইলেও আপৎকালে হিন্দু সংস্কার মানিয়া চলিতেন; এই জন্যই তিনি রথের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। এই রথে কয়টি ঘোড়া ছিল জানা যায় না। সপ্তখণ্ড পৃথিবীর বিজয়-সূচক সাতটা ঘোড়া থাকাই সম্ভব।]
দারা পিতার আশীর্বাদ লইয়া দক্ষিণমুখী হইয়া রথে উপবেশন করিলেন। তখন দেওয়ান-ই-আমের চত্বরে গোধুলির আবছায়ার উপর অন্ধকার নামিয়া আসিতেছে; তাঁবুর বাহিরে চতুর্দিকে অনতিপরিসর সঞ্চরণ মার্গে দারার পথ মধ্যস্থলে রাখিয়া সামন্তবর্গ ও যোদ্ধৃগণ পরিচালিত অশ্বারোহী, ভল্লধারী পদাতিক, বন্দুকচী ও হস্তিযূথ ঠাসাঠাসি হইয়া বিরাট অজগরের মতো মন্থরগতিতে ফটকের দিকে চলিয়াছে। সিংহাসনমণ্ডপ হইতে দারার রথ দৃষ্টির ঈষৎ বাহির হওয়া মাত্র বৃদ্ধ সম্রাট রাজদণ্ডের উপর ভর করিয়া নিচে নামিয়া সিঁড়ির উপর দাঁড়াইয়া রহিলেন। সেখান হইতে তিনি উদাসচিত্তে আকুল নয়নে চত্বর হইতে শেষ যোদ্ধার নিষ্ক্রমণ পর্যন্ত চাহিয়াই রহিলেন; আজ যেন দুনিয়ায় তিনি নিতান্ত নিঃসঙ্গ।
শাহজাহানের ওই শীর্ণ জরাকুজ রত্নদণ্ডাশ্রিত শুভ্র দেহযষ্টি বাহ্যজ্ঞানরহিত চিত্রপুত্তলিকাবৎ স্থাণু হইলেও তাঁহার মন আশা-নিরাশার ঘূর্ণাবর্তে, ভবিতব্যের গোলকধাঁধায় খেই-হারা হইয়া ঘুরিতেছিল। যাহারা চলিয়া গেল তাহারা কি আবার ফিরিবে? ইহা কি শেষ বিসর্জন, না বিজয়ী হইয়া পুনরাগমনের জন্য পুত্রের সাময়িক বিদায়? পিতার প্রাণের এই আকুল জিজ্ঞাসার কে উত্তর দিবে? মহাকাল নীরব, আড়ালে নিয়তির নিষ্ঠুর ভ্রূকুটি।
১৪
দরবারের বহুাড়ম্বরে সেই দিন দারার যাত্রাই পণ্ড হইল। তিনি দেওয়ান-ই-আমের ফটক পার হইয়া কিছু দূরে নিজের হাতিতে চড়িলেন। সেদিন যাত্রা স্থগিত রহিল, সকলেই বিশ্রামার্থ স্ব স্ব স্থানে ফিরিয়া গেলেন। জাহানারা বেগমের নিজ প্রাসাদে ফিরিয়া যাওয়ার অবকাশ বাকি জীবনে আর হইল না।
ইতিমধ্যে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনাইয়া আসিয়াছিল। এই সন্ধ্যায় হিন্দু-মুসলমানের মিলন-স্বপ্ন, মোগল সাম্রাজ্যের দৃপ্ত গৌরবচ্ছটা সবই আঁধারে মিলাইয়া গেল, দারা-শাহজাহান ও জাহানারার জীবন-নাট্যের বিয়োগান্ত শেষ অঙ্ক কালরাত্রির আঁধারেই অভিনীত হইল। দরবার-ই-আম হইতে ইহাই পিতা-পুত্রের—তথা ঐতিহাসিকের শেষ বিদায়।