১২. দোটানা স্রোতে দিল্লীশ্বর তথা মোগল সাম্রাজ্য

দ্বাদশ অধ্যায় – দোটানা স্রোতে দিল্লীশ্বর তথা মোগল সাম্রাজ্য

সম্রাট শাহজাহান শুধু পুত্রকন্যাদিগকে লইয়া নয়, মোগল সাম্রাজ্যের শাসননীতি নির্ধারণ করিতে গিয়া প্রবল দোটানা স্রোতের মুখে পড়িয়াছিলেন। তিনি মনে করিতেন পিতামহ হইতে তাঁহার কৃতিত্ব কোনও অংশে কম নহে; আবুল ফজলের মতো একজন ঐতিহাসিক পাওয়া গেলে তাঁহার কীর্তিগাথা পিতামহের গৌরবকে ম্লান করিয়া দিত। রাজ্যবিস্তার, গুণীর সমাদর, সাম্রাজ্যের রূপসজ্জা, শাসনকার্যে পরিশ্রম ইত্যাদি সর্ববিষয়ে পিতামহের সহিত প্রশংসনীয় প্রতিস্পর্ধা-ভাব শাহজাহানকে উৎসাহ ও উদ্দীপনা জোগাইয়াছে সন্দেহ নাই। এই প্রতিযোগিতায় তিনি কোন কোন ক্ষেত্রে আকবরকে হার মানাইয়াছেন বলিয়া কোনও কোন ঐতিহাসিক মত প্রকাশ করিয়াছিলেন। আকবর বাদশা হুমায়ু-শেরশাহের ভাঙা দিল্লিতেই পঞ্চাশ বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন। সামিয়ানা খাটাইয়া দরবার-ই-আমে হিন্দুর দেবতার খাটের মতো লাল পাথরের চতুর্দোলের মধ্যে মসনদের উপর গালিচা পাতিয়া বসিয়াছেন, সহজলভ্য লাল পাথর দিয়া রাজধানী ফতেপুর সিক্রি নির্মাণ করিয়াছেন, মর্মর পাথরের নামগন্ধ নাই। তাঁর মৃত্যুর পর ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বৎসরের মধ্যে শাহজাহানের হাতে আগ্রার চেহারা ফিরিয়া গেল, যমুনাতীরে দিল্লি-শাহজাহানাবাদ নির্মিত হইল, গৌরবদৃপ্তা সাম্রাজ্যলক্ষ্মীর অভিনব রূপসজ্জায় মর্মর-প্রস্তর শিল্পীর বিচিত্র বর্ণসম্ভারসমৃদ্ধ রত্ন-আলিপনার নিচে যেন আমাদের মাটির প্রলেপ। আকবরের চিত্রশিল্পী সিক্রির মহলে তুর্কী-হামামের গায়ে যে রূপরেখা রাখিয়া গিয়াছিল, শাহজাহানের শিল্পী ও সাঙ্গসাজ (খোদাইকর) বাটালি ও এক ঝুড়ি দেশি-বিদেশি নানা রঙের দামি পাথর লইয়া মর্মরের চত্বরে-প্রাচীরে, সম্রাটের ইন্দ্রপুরীর অলকানন্দা নহর-ই-বেহেশতে, সেই ছবির খেলা এবং রঙের জাদু দেখাইয়াছে। তাজমহলের ইরানী শান্-এ ও মুখর লাস্যে হিন্দুস্থানে মুসলমান স্থাপত্য সৌন্দর্যসৃষ্টির পরিসমাপ্তি হইল। হিন্দু ললিতকলাখচিত রক্তাম্বর-পরিহিতা সিক্রি পূর্বেই অরণ্যবাসিনী হইয়াছিলেন। শাহজাহান মনে করিতেন যে, হিন্দুস্থাপত্য, শিল্পকলাকে মুসলমানরা উত্তর ভারতে তিন শতাব্দী ধরিয়া কবরস্থ করিতেছিল, আকবর ফতেপুর সিক্রিতে ওইগুলির পুনঃ প্রাণপ্রতিষ্ঠা করিয়া ইসলামের অবমাননা করিয়াছিলেন।

লোকপ্রসিদ্ধ ফতেপুর সিক্রির নবরত্নের মধ্যমণি আকবর ছিলেন বহুশ্রুত নিরক্ষর বিক্রমাদিত্য; তাঁহার পৌত্র প্রকৃত বিদ্বান, আরবী-ফার্সিতে আলিম, হিন্দি লেখাপড়ায় পাকা কায়স্থ। শাহজাহানের দরবারে পুরুষরত্নের অভাব ছিল না। উহাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম রত্ন উজির-ই-আজম সাদুল্লা খাঁ, মুসলমানের চোখে “দজ্জাল” (Anti-Christ) আকবর বাদশার ‘নওরতন”, নয়টি দুর্গ্রহ। মোল্লা বদায়ুনী দরবারী হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবগুলিকে বলিয়াছেন “লুচ্চা”- যাহাদের কথা লিখিলে কলম নাপাক হইয়া যায়।* সাদুল্লা খাঁকে আওরঙ্গজেব বিশেষ হিতৈষী জ্ঞানে শ্রদ্ধা করিতেন। দারার সহিত উজিরের প্রায়ই টক্কর লাগিত, সম্রাট এইজন্য দারাকে শাসাইতেন, শাহজাদার উপর বিরক্তি প্রকাশ করিতেন।

[* Muntekhab-ut-tawarikh, Eng. trans. Vol. III, p. 1.]

মোগল সাম্রাজ্যে দ্বিতীয় টোডরমল কিংবা দ্বিতীয় সাদুল্লা জন্মগ্রহণ করেন নাই। রাজা মানসিংহের পৌত্র মির্জা রাজা জয়সিংহ মোগলদরবারে পিতামহের স্থান পূর্ণ করিয়াছিলেন। মিঞা তানসেনের নাতি লাল খাঁ দাদাসাহেবের নাম বজায় রাখিয়াছিলেন। শাহজাহান কিঞ্চিৎ হিন্দুবিদ্বেষী হইলেও সংস্কৃত এবং হিন্দির উপর সদয় ছিলেন, দরবারী খেতাব, নাম ইত্যাদি নির্বাচনে তিনি পণ্ডিতী সংস্কৃত পছন্দ করিতেন। দরবারের “গুণী”-শ্রেষ্ঠ লাল খাঁকে তিনি “গুণসমুদ্র” উপাধি দিয়াছিলেন। ফার্সি কবি মোল্লা কুসী শাহজাহানের দরবারে- আকবরশাহী দরবারে শেখ ফৈজীর স্থান পূর্ণ করিয়া “কবিসম্রাট” (মালিক-উশশৌরা) উপাধি পাইয়াছিলেন, ময়ূরতক্তের তক্তায় তাঁহার রচিত মসনবী খোদাই করা হইয়াছিল। ফৈজী এবং কুদসীর মধ্যে আশমান জমীন তফাত। সম্রাট কবিতা ভালোবাসিতেন, কিন্তু ভালোমন্দ বুঝিতেন না, কাজের কথা, পদের মিল থাকিলেই হইত। তাঁহার কাছে ভালো কবিতাপাঠ “অরসিকেষু রসস্য নিবেদনম” অনেক সময় বিপদ ডাকিয়া লওয়ার মতো। দারা একবার তাঁহার বন্ধু প্রসিদ্ধ ফার্সি কবি ও সাহসী যোদ্ধা চন্দ্রভান “ব্রাহ্মণ”কে পুরস্কৃত করিবার জন্য পিতার কাছে লইয়া গিয়াছিলেন। সম্রাটের অনুমতি পাইয়া কবি স্বরচিত একটি সুফিয়ানী কবিতা আবৃত্তি করিলেন—ইহার স্থূলার্থ :

“আমি বহুদিন “কাবা” এবং বুতখানার (দেবমন্দির) মধ্যে সংশয়াকুলভাবে আনাগোনা করিতে করিতে অবশেষে ভূতখানায় ঢুকিয়া পড়িলাম।’

কবিতা শুনিয়াই শাহনশাহ্ চটিয়া আগুন হইলেন,—এমন বেইমানকে তাঁহার পুত্র হাজির করিয়াছে; এই কবিতায় ইসলামের অপমান করা হইয়াছে, এই কাফের কাবা শরীফ হইতে বাহির হইয়া আসিয়া ভূতখানায় ঢুকিয়া পড়িল?—এই কবিতায় আসলে চন্দ্রভানের মৌলিকতা ছিল না, ইহা পূর্ববর্তী মুসলমান সুফীগণের ভাব লইয়া রচিত। এই কথা পিতাকে বুঝাইতে দারা এবং বিশিষ্ট বিদ্বান ব্যক্তিগণ গলদঘর্ম হইলেন। আর একজন কবি শাহজাহানকে কবিতা শুনাইতে গিয়া গুরুতর বিপদে পড়িয়াছিলেন। এই কবি সেলিম চিশতীর বংশধর ফতেপুর সিক্রির শেখজাদা পাগলা সৈইদা, খাঁটি সুফী ও ভাবের পাগল। তিনি আবৃত্তি করিয়াছিলেন :

Chi-st dani bada-i-gulgun musaffa-i-Jauhri :
Husn-ra parawar-digar wa ishq-ra Paigambari.

অর্থাৎ গোলাপের মতো রক্তিমাভ পদ্মরাগ মণির নির্মল রক্তিমচ্ছটার ন্যায় সমুজ্জ্বল সুরা কি বস্তু জানা আছে কি? এই সুরা সৌন্দর্যের পরবর-দিগর (প্রতিপোষক) এবং ইশকের (প্রেমের) বার্তাবাহক পয়গম্বর।

হারাম শরাবের সহিত পবিত্র পরবর-দিগর আল্লা এবং আল্লার রসুল হজরত পয়গম্বরের নাম-সংযোগ শুনিয়া শাহজাহানের ভিতরের আসল মানুষটি বাহির হইয়া পড়িল—যাহার প্রতিচ্ছবি তাঁহার পুত্র আওরঙ্গজেব। কবি গোস্তাকী মাফ চাহিয়া অনেক কষ্টে তাঁহাকে বুঝাইলেন এই শরাব সাধারণ নেশা নয়, দিলের পেয়ালায় ইশ্বক-ই-হকিকি অর্থাৎ ভগবৎ প্রেম।

শাহজাহান স্বয়ং “দ্বিতীয়” তৈমুর উপাধি গ্রহণ করিয়াছিলেন, বুন্দেলা-বিদ্রোহের সময় নৃশংস ধর্মান্ধতা ও রক্তস্নাত বর্বরতায় তাঁহার তৈমুরত্ব প্রকট হইয়াছিল। ধর্মপ্রাণ মোল্লাগণ তাঁহার ধর্মনিষ্ঠার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হইয়া প্রচার করিলেন শাহানশাহ এই জমানার ইমাম মেহদী, ইসলামকে রক্ষা করিবার জন্য অবতীর্ণ হইয়াছেন। আকবর-প্রবর্তিত ইলাহী সাল বাতিল করিয়া শাহজাহান শাহী দপ্তরে ইসলামী হিজরী সাল পুনঃপ্রবর্তিত করিয়াছিলেন। কাশ্মীরের অন্তর্গত ভিম্বরের জমিদার নিজের জমিদারির মধ্যে ধর্মত্যাগ না করিয়া হিন্দুনারীর মুসলমান পতিগ্রহণ এবং মুসলমান স্ত্রীলোকের হিন্দুর সহিত বিবাহপ্রথা প্রচলিত করিয়াছিলেন। কাশ্মীরের পথে মোল্লার এই বিষয় তাঁহার কানে পৌছাইল। তিনি হুকুম দিলেন, যে সমস্ত হিন্দু মুসলমান স্ত্রী লইয়াছে তাহাদিগকে স্ত্রী কিংবা ধর্ম দুইটার একটা ত্যাগ করিতে হইবে। বেচারা যোগু ভয়ে মুসলমান হইয়া গেল, প্রজাদেরও ওই অবস্থা। মুসলমানের দেওয়ানখানায় হিন্দু পদস্থ কর্মচারীগণকে সম্মান প্রদর্শন করিতে হয়—এই অভিযোগে তিনি দেওয়ান-ই-তন দপ্তর হইতে রাজা মণিদাসকে অন্যত্র সরাইয়াছিলেন। সুদক্ষ রাজস্ব কর্মচারী রাজা রঘুনাথ আজীবন উজির সাদুল্লার “পেশদস্ত” বা হেড অ্যাসিস্টান্ট রহিয়া গেলেন, টোডরমলের ভাগ্য কোনও হিন্দুর হয় নাই। হিন্দু মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করিলে সর্ববিধ সুবিধা জায়গীর ও নগদ পুরস্কার পাইত; বাগলানার হিন্দু রাজার পুত্র প্রেমজী মুসলমান হওয়ায় কুমার আওরঙ্গজেবের সুপারিশে সম্রাটের নিকট হইতে দেড় হাজারী মনসব পাইয়াছিল; রাজা বখতাবর কচ্ছবাহ ধর্মত্যাগের জন্য ইনাম পাইলেন নগদ দুই হাজার টাকা।

হিন্দুর মন্দির ধ্বংসকার্যে পুণ্য অর্জনের বাতিক জাহাঙ্গীরের সময় হইতে কিছু কিছু আরম্ভ হইয়াছিল। জাহাঙ্গীর বাদশাহ খেয়ালী মানুষ, ধর্মোন্মাদনা বিষমাশ্রিত জ্বরের মতো সময় সময় তাঁহাকে অপ্রকৃতিস্থ করিত। প্রকৃতিস্থ অবস্থায় তিনি হিন্দুদিগকে মন্দির নির্মাণে বাধা দিতেন না। শেষ বয়সে ধর্মের রোগ প্রবল হওয়ায় তিনি হুকুম দিলেন নূতন মন্দির যেগুলি সম্পূর্ণ হয় নাই ওইগুলি ওই অবস্থায় থাকিবে। কাশীতে হিন্দুরা নূতন বাদশাহের কাছে ওই সমস্ত মন্দির সম্পূর্ণ করিবার আর্জি পেশ করিল। শাহজাদা আদেশ করিলেন, যে অংশ পূর্বে তৈয়ার হইয়া গিয়াছে উহাও ভাঙিয়া ফেলিতে হইবে। দরবারী ঐতিহাসিক আবুল হামিদ লাহোরীর বাদশাহনামায় কাশী হইতে ছিয়াত্তরটা হিন্দুমন্দির ধ্বংসের খবর কোনদিন দরবারে পৌঁছিল— সন তারিখসহ লেখা আছে। বিদ্রোহী পর্তুগীজ ফিরিঙ্গিগণের হুগলীর গির্জা ধ্বংস করিয়া উহার মূর্তি (Icon) গুলি দরবারে প্রেরিত হইয়াছিল। শাহজাহান ওইগুলি চুরমার করিয়া কেবল আস্ত দুইটি মাত্র যমুনার জলে বিসর্জন দিয়াছিলেন।

জাহাঙ্গীর বাদশাহ হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীকে শ্রদ্ধা করিতেন, মহাজ্ঞানী সন্ন্যাসী চিরূপের (অশুদ্ধ পাঠ ‘যরূপ’) সহিত দুই বার সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন––একবার রাওয়ালপিণ্ডির নিকটবর্তী বালনাথ যোগীর টিলায় সাধুদিগের বাৎসরিক মেলা দেখিতে গিয়াছিলেন। আকবরের ন্যায় তিনিও পণ্ডিতগণের সঙ্গে বাদানুবাদ করিতেন; অবশ্য হিন্দুধর্ম বুঝিবার মতলবে নয়, উহার মুণ্ডপাত করিবার জন্য। দীন-ই-ইলাহীর গুরু হিসাবে তিনি শিষ্যগণকে দীক্ষা দান করিয়া তাহাদিগকে ধ্যানের প্রতীক শাশ্বত প্রদান করিতেন। আকবরশাহী আমলের এই ধারা শাহজাহান লোপ করিয়াছিলেন। তিনি মুসলমান পীর ফকিরগণের (যথা লাহোরের মিঞা মীর) সঙ্গ করিতেন; দরবারে আমন্ত্রণ করিয়া সুফীর কেরামতি দেখিতেন। ১৬৫২ সনের পূর্বে কোন এক দিন শেখ নাজীর নামক নামজাদা সুফীর হঠাৎ শাহী দরবারে বৈষ্ণবী “দশা” হইয়া গেল। ওই অবস্থায় তিনি এক গেলাস জল চাহিলেন; এক চুমুক পান করিবার পর তিনি উহা উপস্থিত ব্যক্তিগণকে চাখিয়া দেখিতে বলিলেন, সকলেই অবাক হইয়া বলিতে লাগিল—মধু! টাটকা খালিস মধু! নাজীরের এই বেনজির কেরামতির পক্ষে সাক্ষ্য দিবার জন্য ওইখানে উপস্থিত ছিলেন শাহাজাদা দারা, সত্যবাদী কাজী মহম্মদ আসলম এবং রাজা বিক্রমজিৎ (বিলোচপুরের যুদ্ধে নিহত বীর বিক্রমজিৎ নহেন)। শাহজাদা ও কাজী বাদশাহকে নিবেদন করিলেন তাঁহারা স্বচক্ষে দেখিয়াছেন পীর সাহেব একবার একটি বদনা এবং আর একবার একখানা রুমালকে কবুতর করিয়া উড়াইয়া দিয়াছিলেন। রাজা বিক্রমজিৎ বলিলেন, একবার শেখ নাজীর নমাজ করিবার সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন। তিনি দেখিলেন নমাজের অবস্থায় শেখজীর কাঁচা গালপাট্টা সাদা হইয়া গেল এবং এক দিকে মাথা ও অন্য দিকে ধড় পড়িয়া রহিল! কিছুক্ষণ পরেই আবার দুইটা জোড়া লাগিয়া গেল।

বুদ্ধিমান ব্যক্তি বলিবেন শাহী দরবার লক্ষ্ণৌয়ের গুলিখোরের আড্ডা; কিন্তু বিক্রমজিৎ কাফের হইলেও মিথ্যাবাদী ছিলেন না––এই সম্বন্ধে সাক্ষ্য দিয়াছেন সমসাময়িক দরবারী ঐতিহাসিক লাহোরী। এইরকম ব্যাপারে শাহজাহান এবং আওরঙ্গজেবের বিশ্বাসের কিছু মাত্রা ছিল;; কিন্তু বিশ্বাসপ্রবণ দারার মাত্রাজ্ঞান ছিল না।

আকবর ও জাহাঙ্গীর হিন্দু প্রজার উৎসবের আনন্দে অংশগ্রহণ করিতেন। বিজয়া দশমী, রাখীবন্ধন মানাইতেন, দীপালীর রাত্রিতে শাহী মহলে আলোকসজ্জা হইত। শাহজাহান হিন্দুয়ানীর প্রশ্রয় পাপকার্য জ্ঞানে এই সমস্ত ত্যাগ করিয়াছিলেন। দীপালীর পরিবর্তে “সবে বরাত”, মুসলমানের গণ্ডির মধ্যে মিলন ও ভ্রাতৃভাব সৃষ্টি এবং পুণ্য অর্জনের জন্য বাৎসরিক “মিলাদ শরীফ” কে সম্রাট জাতীয় উৎসবের মধ্যে স্থান দিয়াছিলেন। লাহোরে সবে বরাত রাত্রির (১১ই শাবান ১০৪৯ হিঃ) বর্ণনা বাদশাহনামায় লিখিত আছে। আলীমদান খাঁ দরবার-ই-আমের বিস্তৃত প্রাঙ্গণে অপূর্ব আলোকসজ্জা করিয়াছিলেন। ওইখানে এবং বাহিরে দর্শনঝরোকার নীচে আতসবাজি পোড়ানো হইয়াছিল। ওই রাত্রিতে শাহানশাহ মোল্লা ফাজিল এবং শিয়ালকোটবাসী মোল্লা আবুল হাকিমকে জন্মতিথির তুলাদানের সোনা হইতে দুই শত আসরফি প্রত্যেককে দান করিয়াছিলেন এবং দশ হাজার টাকা গরিব-ফকিরদিগকে দানখয়রাতে খরচ করিয়াছিলেন।

মহা ধুমধামের সঙ্গে আগ্রা দুর্গে একবার মিলাদ শরীফের উৎসব হইয়াছিল (১২ই রবিয়ুল আউয়াল ১০৪৩ হিঃ)। মিলাদের মজলিশে অনেক বিদ্বান, কোরান পাঠক এবং ধর্মাত্মা ব্যক্তি নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন। হজরত মহম্মদের জন্মতিথির এই অনুষ্ঠানে স্বয়ং সম্রাট সিংহাসন ছাড়িয়া সাধারণভাবে মজলিশের গালিচায় বসিলেন। হজরত রসুলাল্লার পবিত্র জীবনী এবং গুণাবলীর আলোচনার সময়ে গোলাপজল বর্ষণ এবং আতর বিতরণ করা হইল, ইহার পরে বড় বড় থালায় ভোজনসামগ্রী মিঠাই এবং হালুয়া সকলকে পরিবেশন। এই রাত্রির উৎসবে ফকিরদিগকে শাল ও ফরজী দান করা হইয়াছিল; গরিব-দুঃখীদিগকে খয়রাতের খরচ হইয়াছিল মোট বিশ হাজার টাকা।

আকবরশাহী আমলের “তুলাদান” হিন্দু অনুষ্ঠান হইলেও অমঙ্গলের আশঙ্কায় সম্রাট শাহজাহান বৎসরে দুই বার সৌর ও চান্দ্র জন্মতিথিতে যথারীতি “তুলাদান” করিতেন। যে সমস্ত দ্রব্যের সহিত সম্রাটের ওজন হইত ওইগুলি আকবর হিন্দু ও মুসলমান উভয় সমাজের পণ্ডিত এবং আলেমগণকে দান করিতেন। কখনও কখনও বা তুলাদানের দ্রব্য একটি ভাণ্ডারে জমা রাখিতেন এবং মুসলমান পর্ব উপলক্ষে সুফী মোল্লা ইত্যাদিকে দান করিতেন।

শাহজাহানের রাজত্বকালে আকবরের উদারনীতি ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হইয়া আসিলেও বাহ্যদৃষ্টিতে উহা ধরা পড়ে নাই। দরবারে সংস্কৃত ও হিন্দি কবিগণ যথেষ্ট সমাদর লাভ করিতেন; হিন্দুদর্শন ও জ্যোতিষচর্চা হইত, সংস্কৃত পুস্তকের ফার্সি অনুবাদও হইত।

পণ্ডিতরাজ জগন্নাথ শাহী দরবারে সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ হিন্দু পণ্ডিত ছিলেন। আবদুল হামিদ লাহোরী লিখিয়াছেন, জগন্নাথ ওই যুগের “গ্রন্থকারগণের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়” (সরামদ্-ই মুসন্নিফান্) এবং শ্রেষ্ঠ গায়ক; কিন্তু তিনি কর্ণাটক ভাষায় গান করেন। লাহোরী কোন গ্রন্থের নাম না করিলেও সংস্কৃত কাব্যরসিকগণের নিকট জগন্নাথ রচিত “রসগঙ্গাধর”, মল্লিনাথের টীকা, “মনোরমা”র “মনোরমা কুচমদন”, “ভামিনী-বিলাস” প্রভৃতি গ্রন্থ সুপরিচিত। টলেমির প্রসিদ্ধ জ্যোতিষ গ্রন্থের আরবী অনুবাদ “অলমাজিস্ট” নামক পুস্তক অবলম্বনে জগন্নাথ “সিদ্ধান্তসার কৌস্তুভ” এবং আর একখানা জ্যোতিষগ্রন্থ “সম্রাট সিদ্ধান্ত” লিখিয়া গিয়াছেন।

প্রশস্তিরচনা জগন্নাথ পণ্ডিতের আয়ের প্রশস্ত পথ ছিল, শাহজাহানের শ্বশুর এবং প্রধানমন্ত্রী আসফ খাঁর নামে “আসফ-লহরী” লিখিয়াছেন, আরও অনেক “লহরী” হয়তো লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। সম্ভবত এমন এক ‘লহরী” উপহার লইয়াই জগন্নাথ “কলাবন্ত” ১০৪৪ হিজরীর ২২শে বরিউস্-সানী তারিখে কাশ্মীরের পথে ভীম্বর নামক স্থানে সম্রাটের সম্বর্ধনা করিয়াছেন। তাঁহার কবিতার চমৎকারিত্বে মুগ্ধ হইয়া বাদশা সমান ওজনের টাকা বকশিশ দিলেন। জগন্নাথ পণ্ডিতের ওজন হইয়াছিল ৪৫০০ সিক্ক টাকা অর্থাৎ এক মণ সওয়া ষোল সের; তাঁহার সৌভাগ্যের প্রতিস্পর্ধী মোল্লা কবি কুসী ওজনে এক হাজার তোলা বেশি। জগন্নাথকৃত এ লুপ্ত লহরীর একটি মাত্র শ্লোক মুখে মুখে চলিয়া আসিয়াছে :

দিল্লীশ্বরো বা জগদীশ্বরো বা মনোরথান পুরয়িতুং সমর্থঃ।
অনৈর্ভূপালৈঃ পরিদীয়মানঃ শাকায় স্যাৎ লবণায় স্যাৎ বা।

দরবারী ইতিহাসে জগন্নাথ পণ্ডিতকে পণ্ডিত বা কবি না বলিয়া কলাবত্ত বলা হইয়াছে। জগন্নাথ শাহশার নামে গান রচনা করিয়াছিলেন, “লেকিন্ কর্ণাটক’ ভাষায় (লাহোরী)। পাকা মুসলমান হইলেও শাহজাহান গানবাজনার আওয়াজ শুনিলে কানে আঙুল দিতেন না। সঙ্গীতে তাঁহার অনুরাগ আকবর হইতে ন্যূন ছিল না। দরবারে লাল খাঁ এবং তাঁহার দুই পুত্র খুশহাল এবং বিশ্রাম খাঁ ব্যতীত আর একজন গুণী ছিলেন দরাঙ্গ খাঁ। দরাঙ্গ খাঁ পুরস্কারস্বরূপ সমান ওজনে ৪৫০০ টাকা পাইয়াছিলেন (লাহোরী)।

শাহজাহান জগন্নাথকে প্রথমে কবি রায় এবং পরে মহাকবি রায় খেতাব দিয়াছিলেন। জগন্নাথ শাহজাদা দারার অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। তিনি দারার জীবনীমূলক এক মহাকাব্য লিখিয়াছিলেন, নাম ‘জগদাভরণম্’। আওরঙ্গজেবের রাজ্যারোহণের পর জগন্নাথ কোচবিহারের রাজা প্রাণনারায়ণের আশ্রয়প্রার্থী হন। ওইখানে তিনি উক্ত মহাকাব্যে দারার নামের স্থানে রাজার নাম বসাইয়া প্রাণাভরণম্ খাড়া করিয়াছিলেন। শেষবয়সে ভোগে বিতৃষ্ণ হইয়া কবি রাজশেখরের ন্যায় পাপের বোঝা নামাইবার জন্য তিনিও বারাণসী “অন্বেষণ” করিয়াছিলেন।

শাহজাদা দারার সন্ন্যাসীগুরু কবীন্দ্রাচার্য সরস্বতী ভারতের সমস্ত পণ্ডিতমণ্ডলীর মুখপাত্র রূপে তীর্থকর রহিত করিবার আবেদন লইয়া সম্রাটের দরবারে গিয়াছিলেন। আকবরের পর দ্বিতীয় বার সম্রাটের কৃপায় তীর্থকর হইতে হিন্দুগণ রক্ষা পাইল। কবীন্দ্রাচার্য এই কৃতিত্বের জন্য নবদ্বীপের পণ্ডিত সমাজের নিকট হইতেও অভিনন্দন লাভ করিয়াছিলেন। কবীন্দ্রাচার্য স্বরচিত “কবীন্দ্ৰকল্পলতা” নামক হিন্দি কবিতায় শাহজাহানের স্তুতিগান করিয়াছেন। লাহোরী লিখিয়াছেন––১০৬২ হিজরীর ২রা জিলকাদ তারিখে কবিন্দর সম্রাটের সহিত (লাহোরে) দেখা করিয়া ১৫০০ টাকা ইনাম পান। উজির-আজম আসফ খাঁর প্রচ্ছন্ন হিন্দুবিদ্বেষ থাকিলেও উহা সামরিক এবং রাজনীতির গণ্ডি ছাড়াইয়া যায় নাই। তিনি এক দিন (১৪ই সেপ্টেম্বর ১৬২৯) সম্রাটের দরবারে ত্রিহুতবাসী (দারবঙ্গ ও মুজাফরপুর) দুইজন ব্রাহ্মণকে শ্রুতিধর এবং কাব্য ও অলঙ্কারশাস্ত্রে পারদর্শী বলিয়া নিবেদন করিলেন। সভাস্থ পণ্ডিতগণ ইঁহাদের পাণ্ডিত্য পরীক্ষা করিবার জন্য আদিষ্ট হইয়া দশজন পণ্ডিত ক্রমানুসারে মুখে মুখে রচিত এক একটি শ্লোক একবার মাত্র আবৃত্তি করিয়া গেলেন। উক্ত ব্রাহ্মণ দুইজন ঠিক ওই ক্রম অনুসারে প্রত্যেক শ্লোক পুনরাবৃত্তি করিলেন; অধিকন্তু উঁহারা প্রত্যেকেই পণ্ডিতগণের দশটি শ্লোকের বিষয়বস্তুর উপর ঠিক ওই সমস্ত শ্লোকের ছন্দে আরও দশটি পাল্টা শ্লোক শুনাইয়া দেন। সম্রাট এই দু-জনকে খেলাত এবং নগদ এক হাজার টাকা করিয়া পুরস্কার দিলেন।*

[*বাদশাহনামা, প্রথম খণ্ড, পৃ. ২৬৮-৬৯]

সুলতান মামুদের মজলিশে নবাগত কবি ফিরদৌসীকে সভাকবিগণ ইহা অপেক্ষা অল্পেই রেহাই দিয়াছিলেন।

সম্রাট শাহজাহানের ত্রিশ বর্ষব্যাপী রাজত্বকালে মধ্যযুগের ইতিহাসে ভারতীয় সংস্কৃতি ও শিল্পকলা, হিন্দুর প্রতিপত্তি এবং হিন্দি সাহিত্যের জোয়ার কানায় কানায় ভরিয়াছে— ভাটার বিলম্ব নাই।

আকবর বাদশাহ মুখে মুখে হিন্দি দোহা রচনা করিয়াছেন; শাহজাহান হাতেকলমে আওরঙ্গজেবের অবোধ্য হিন্দি ভাষায় চিঠিপত্র লিখিতেন, কায়েতী হিসাব পরীক্ষা করিতেন। উদারচিত্ত শাহজাদা দারা আরও ঊর্ধ্বে উঠিয়াছিলেন, হাতের আংটিতে পবিত্র আরবী হরফে “আল্লাহ” খোদাই না করিয়া মোল্লাটা মুসলমানের চক্ষুশূল দেবনাগরী অক্ষরে “পরভু” খোদাই করাইয়া ভাবী অমঙ্গল ডাকিয়া আনিয়াছিলেন। তিনি মনে করিতেন আল্লা অক্ষরাতীত; হিব্রু, আরবী, দেবনাগরী প্রভৃতি মানুষের সৃষ্ট বর্ণমালা সবই তাঁহার অশরীরী দৃষ্টিতে এক সমান, ইতরবিশেষ নাই। একমাত্র আরবী খোদাতালার ভাষা, আদমসন্তানকে কোন ভাষা না শিখাইলে আল্লার প্রিয়তম জবান আরবী আপনা হইতেই তাহার নিষ্পাপ জিহ্বায় আসিয়া পড়িবে- মোল্লাদের এই দাবি তাঁহার প্রপিতামহ আকবর বুংগামহলের নৃশংস পরীক্ষার দ্বারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করিয়াছিলেন। সুতরাং আরবী অল-রৌব্ এবং হিন্দি পরভুর মধ্যে ধার্মিকের দৃষ্টিতে কোন প্রভেদ নাই; যিনি স্বয়ং নামরূপবর্জিত তাঁহাকে যে-কোন নামে ডাকিলেই তিনি সাড়া দিয়া থাকেন। শাহজাহান ও আওরঙ্গজেব ইসলামে সনাতনপন্থী, তাঁহারা আল্লা ব্যতীত God, পভু কিংবা পরব্রহ্মকে আমল দেওয়ার পাত্র নহেন। স্নেহের দৌর্বল্যবশত হাল ছাড়িয়া শাহজাহান পুত্র দারার শরিয়ত-বিরুদ্ধ ভাবের পাগলামি, শুজার শিয়া-প্রীতি, মোরাদের জাহেলী (ধর্মবিমুখতা) সবই সহ্য করিতেন। আওরঙ্গজেব “আল্লা-আল্লা” করিয়া সুযোগের প্রতীক্ষা করিতেছিলেন, পাইলেই খোদাতালার নামে প্রথমেই বেইমান দারার মাথা হাতে লইবেন।

সম্রাট শাহজাহানের দরবারে অনেক হিন্দি কবি রাজানুগ্রহ লাভ করিয়াছিলেন। তখন সুরদাস, তুলসীদাস ও কেশবদাসের যুগ অতীত হইয়াছে। বিহারীলালের প্রতিভা স্ফুটনোন্মুখ, হিন্দি সাহিত্যের অগ্রগতির স্রোতে ভাটা পড়ে নাই। সে যুগের হিন্দি সাহিত্যাচার্যগণ ঈর্ষা করিয়াই যেন দরবারী হিন্দি কবিদিগকে বিশেষ আমল দেন নাই; দুঃখ করিয়া বলিয়াছেন :

সুর সুর, তুলসী সমী, উডুগণ কেশবদাস।
অব্ কে কবি খদ্যোৎ সম, জঁহ তঁহ করে প্রকাশ।।

অর্থাৎ, সুরদাস (কাব্যগগনের) সূর্য, তুলসীদাস চন্দ্রমাতুল্য, এবং কেশবদাস (সপ্তর্ষিমণ্ডল), আজকালকার কবি জোনাকি পোকা, যেখান সেখানে ঝিকমিক করেন।

দরবারী ইতিহাসে দুইজন হিন্দি কবির নাম পাওয়া যায়। ইহাদের মধ্যে আদিরসাত্মক সুন্দর-শৃঙ্গার কাব্য-প্রণেতা কবি সুন্দর সম্রাটের নিকট হইতে প্রথমে “কবিরায়” এবং পরে শ্রেষ্ঠ সম্মান “মহাকবি রায়” উপাধি পাইয়াছিলেন। আকবরী দরবারের হিন্দি কবি নরহরি মহাপাত্রের বংশজগণ মোগল দরবারে বংশানুক্রমে রাজকবি ছিলেন। নরহরি-পুত্র* কিংবা পৌত্র হরিনাথ ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে জানুয়ারি সম্রাটের নিকট হইতে একটি ঘোড়া, একটা হাতি এবং নগদ এক লক্ষ দাম (২৫০০ টাকা) পুরস্কার লাভ করিয়াছিলেন। বিক্রমাদিত্য কিংবা রাজা ভোজের দরবারেও হাতি-ঘোড়া ইনাম কোন কবি পাইয়াছিলেন কিনা জনশ্রুতিতেও জানা যায় না। সম্রাট শাহজাহান সুপাত্রেই দান করিয়াছিলেন। কথিত আছে, হরিনাথ মহাপাত্র যখন ভারী ইনাম লইয়া দরবার হইতে ফিরিতেছিলেন, তখন এক ভিক্ষুক ব্রাহ্মণ ভিক্ষাপ্রার্থনা করিয়া একটি দোহা মহাপাত্রকে শুনাইয়াছিল; তিনি এক লক্ষ দাম পথিমধ্যে দান করিয়া শূন্য হাতে ফিরিলেন, বাদশাহী হাতি ও ঘোড়ার কি গতি হইল জানা নাই।

শাহজাদা দারা হিন্দি ভাষার সমাদর করিতেন, স্বয়ং চর্চাও করিতেন। তাঁহার লিখিত দুইখানি হিন্দি পুস্তিকার পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়াছে। এইগুলির নাম দোহাস্তব সংগ্রহ এবং সারসংগ্রহ। দরবারের বাহিরে সামন্ত নৃপতি এবং মনসবদারগণ হিন্দি কবিগণের পৃষ্ঠপোষকতা করিতেন, কয়েকজন মুসলমান হিন্দি কবিতা লিখিয়াছেন। মির্জা-রাজা জয়সিংহ, মহারাজা যশোবন্ত সিংহ রাঠোর, যশোবন্তের নির্বাসিত জ্যেষ্ঠভ্রাতা ভীমকর্মা অমর্ষপরায়ণ রাও অমরসিংহ রাঠোর** কাব্যরসিক এবং হিন্দি কবিগণের আশ্রয়দাতা ছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথমে ইতস্তত লিপিবদ্ধ এবং চারণ ভাটের মুখে মুখে প্রচলিত পৃথ্বীরাজ-রাসো মহাকাব্য সংগ্রহ এবং সঙ্কলিত করিয়াছিলেন (নাগরী প্রচারিণী সভা সংস্করণ)।

[*হিন্দি সাহিত্যের ইতিহাস লেখকগণের সমসাময়িক ইতিহাসের সহিত পরিচয় আছে কিনা বলা যায় না। “মিশ্ৰবন্ধুবিনোদ” অনুসারে হরিনাথ নরহরির পুত্র; দুই পুরুষে প্রায় এক শত বৎসর পার হওয়া সম্ভব বলিয়া মনে হয় না। “কবিতা-কৌমুদী” সঙ্কলয়িতা শ্রীরামনরেণ ত্রিপাঠী দোহা উদ্ধৃত করিয়া প্রমাণ করিয়াছেন, লাখ টাকাটা কবি রাজা মানসিংহের নিকট হইতে পাইয়াছিলেন। এই শ্রেণীর হিন্দিপ্রেমীগণের কাছে দোহা, কিংবদন্তি আবদুল হামিদ লাহোরী অপেক্ষা অধিক নির্ভরযোগ্য।

** অমরসিংহ নাগোরের রাও এবং উচ্চ মনসবদার ছিলেন। আগ্রা শহরে দারার প্রাসাদে সম্রাটের সম্মুখে প্রকাশ্য দরবারে মীর বকসী সলাবৎ খাঁকে একটি অর্ধ উচ্চারিত শব্দের জন্য জমঢাড়ের এক কোপে দ্বিখণ্ডিত করিয়া যুদ্ধ করিতে করিতে এই রাঠোর শার্দুল বীরগতি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। অমরসিংহের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্রী এবং মির্জারাজা জয়সিংহের ভাগিনেয়ীর সহিত দারার জ্যেষ্ঠ পুত্র কুমার সুলেমান শুকোর বিবাহ হইয়াছিল।]

কবিতার গুণাগুণ অপেক্ষা কাব্যে স্তুতি প্রশংসা এবং নামপ্রচারের আশা সম্রাটের বদান্যতার পরিমাণ নির্ধারিত করিত। ইহাই সেকালে এবং একালেও বড়লোকদের দানের রীতি, মানুষের স্বাভাবিক দুর্বলতাও বটে। নিজের এবং পূর্বপুরুষের সত্যমিথ্যা যশোগান নিত্য চারণের মুখে শুনিবার জন্যই রাজপুত আধপেটা খাইয়া চারণকে আধা রুটি দিত। ইউনানী ফলিত জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ জুলকরনাইন ফিরিঙ্গি (আর্মানী খ্রিস্টান) সম্রাটের নামে এমন কিছু লিখিয়াছিলেন যাহার জন্য তিনি পাঁচ শতী মনসব পাইয়াছিলেন (লাহোরী)।

এইরূপ দানে এবং গুণগ্রাহিতায় সম্রাট জাতি ধর্ম কিংবা দেশ বিচার করিতেন না। ইহা আকবরশাহী আমলের ধারা।

দুনিয়া যেমন আজকাল একটা পোশাকী pose বা ঢঙে আসলকে চাপা দিয়া সোয়াস্তি লাভ, মতলব হাসিল কিংবা দেমাক জাহির করিয়া চলিয়াছে পূর্বে বিশেষত মোগলাই আমলে খোদ বাদশাহ বইতে ঝাড়ুদার পর্যন্ত কেহই লোকচক্ষুর সম্মুখে একটা পোজ বা চেহারা না করিয়া চলিত না। দরবারী ইতিহাসে এইজন্যই সে যুগের সহজ মানুষ বিচক্ষণ ঐতিহাসিকের নজরেও সহজে ধরা পড়ে না। আত্মজীবনী (তজুক) মধ্যে তবুও একটা মাত্র পোজ; কিন্তু যে সমস্ত ইতিহাসের (যথা, আকবরনামা এবং বাদশাহনামা) প্রত্যেক পৃষ্ঠা আকবর কানে শুনিতেন কিংবা শাহজাহান নিজে পড়িয়া উহার উপর কলম চালাইতেন সেখানে আমরা উক্ত সম্রাটদ্বয়কে উভয় ‘পোজেই’ দেখিতে পাই—একটি ঐতিহাসিকের মনোবৃত্তির পোজ, অন্যটি মানব কিংবা মুসলমানসুলভ সম্রাটের অহমিকার পোজ। শাহজাহানের দরবারী পোজ আরও জটিল, ইহার মধ্যে “আসল” তিনি আছেন এবং তদুপরি একটা গতানুগতিক ইমাম মেহদী বা কল্কি অবতারের পোজও রহিয়াছে।

বাদশাহনামা পড়িয়া মনে হয়, সম্রাট শাহজাহান ছিলেন প্রতাপে সোলেমান বাদশা, বুদ্ধিতে বুজুগ মেহের, ন্যায়বিচার ও ইসলামের প্রতি অখণ্ড নিষ্ঠায় হজরত ওমর এবং কাফের নিধন ও মূর্তি ধ্বংসে মামুদ গজনভী। লাহোরী কেবল মন্দির ধূলিসাৎ ইত্যাদি হিন্দুধর্ম-নির্যাতনের কথাই বলিয়াছেন; কিন্তু হিন্দুদের কাছে “পাথুরে প্রমাণ”* রহিয়াছে- পশ্চিম ভারতে জৈন সম্প্রদায় শাহজাহানের রাজত্বকালেই একাধিক মন্দির প্রস্তুত করিয়াছিলেন। গোকুলস্থ বল্লভাচার্য গোসাঁইগণ আকবরের সময় হইতে শাহজাহানের রাজত্বের অবসান পর্যন্ত গোকুলে গোবর্ধন এবং সাহার পরগণায় বিশেষ অধিকার পুরুষানুক্রমে ভোগ করিয়া আসিতেছিলেন। তাঁহাদের কাছে যে সমস্ত বাদশাহী ফরমান ও নিশান (সরকারি চিঠি) আছে সেগুলি হইতে জানা যায় তাঁহাদের ভূমির উপর রাজস্ব ও অতিরিক্ত কর, মাশুল ইত্যাদি মাপ ছিল, গোকুল গোবর্ধনে অবাধ গোচারণের অধিকার দেওয়া হইয়াছিল, ময়ূর ও অন্যান্য প্রাণী শিকার মুঠসমূহের সম্পত্তির এলাকায় নিষিদ্ধ করা হইয়াছিল। **

[* Jaina Inscriptions, শ্রীপূরণচাঁদ নাহার কৃত

**দাতার নাম – সংখ্যা
সম্রাট আকবর – ৪
হামিদা বানু (আকবরের মাতা) – ১
খান-খানান আবদুর রহিম (আকবরের সেনাপতি) – ১
জাহাঙ্গীর – ০
শাহজাহান (সম্রাট) – ২
দারাশুকো – ৪
মোয়াক্রামত খাঁ (শাহজাহানের কর্মচারী) – ১
ইসহাক খা (ঐ) – ১
আওরঙ্গজেব – ০
প্রথম শাহ আলম – ১
মির্জা নজক খাঁ (দ্বিতীয় শাহ আলমের সেনাপতি) – ১

দ্রষ্টব্য- Imperial Farmans by K. M. Jhaveri, Bombay.]

১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসেই বাদশাহী শিলমোহরযুক্ত এইরূপ দুইখানা ফরমান বল্লভাচার্য সম্প্রদায়কে দেওয়া হইয়াছিল। অথচ তিন বৎসর পরে মুর্শিদকুলি খাঁকে মথুরার ফৌজদার নিযুক্ত করিয়া শাহজাহান হুকুম দিলেন ওই অঞ্চলে বিদ্রোহ এবং মূর্তিপূজা যেন কঠোর হস্তে দমন করা হয়। মুর্শিদকুলি খাঁর মৃত্যুর পরেও দেখা যায় গোসাঁইগণের অধিকার স্বীকার করিয়া শাহজাদা দারা চার খানা ও অন্য দুইজন স্থানীয় ফৌজদার সম্রাটের অনুমোদিত দুইখানা নিশান জারি করিয়াছিলেন।

এই পরস্পরবিরোধী অস্থির নীতির মূলসূত্র কোথায়? অজ্ঞাতসারে কোনও দোটানা- স্রোতে না পড়িলে শাহজাহানের রাষ্ট্র ও ধর্মনীতি পালন ও দমন, মতসহিষ্ণুতা ও নির্যাতন স্পৃহার মধ্যে এমন ঘুরপাক খাইত না। মোগলসাম্রাজ্যে সম্রাটকে মধ্যবিন্দু করিয়া দারা এবং আওরঙ্গজেবের মধ্যে প্রথম হইতেই যেন একটা দড়ি টানাটানি চলিয়াছিল; দারা মোগল সাম্রাজ্যের পূর্বস্মৃতি এবং আওরঙ্গজেব উহার ভাবী নিয়তির অঙ্গুলি-সঙ্কেত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *