৫০
বিজ্লীর পিঠের উপর দুটি হাত রাখল পৃথু।
বিজ্লী তখনও কাঁদছিল। পৃথু ওর দু’ কাঁধ ধরে একবার তোলবার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। অপারগতার যন্ত্রণাই বাড়ল শুধু।
বিজ্লী ওকে আবার একবার আদর করে খাটের পাশের চেয়ারে বসল। বেচারির চোখের সুর্মা লেপটে গেছে। বিনুনী করে চুল বেঁধেছে। একটি লাল-কালো ফুল ফুল ছাপা শাড়ি পরেছে, সিল্কের। দুটি চোখে নিঃশর্ত সমর্পণের নীরব মুচলেকা।
বিনুনী-করা কাছে-বসা, সমর্পিতা বিজ্লীকে দেখে হঠাৎই কুর্চির কথা মনে পড়ে গেল পৃথুর। কতদিন দেখেনি কুর্চিকে। বিজ্লী যখন প্রথমে ঘরে ঢুকল তখন ওকে দেখে একবার রুষার কথাও মনে হয়েছিল। বিজ্লীর মধ্যে বোধ হয় সামান্য রুষা, সামান্য কুর্চি এবং অনেকখানি বিজ্লী আছে। ওর মধ্যে এক টুকরো কুর্চিকে দেখতে পায় বলে, না-পাওয়া কুর্চিকে পায় বলেই কি এত ভাল লাগে ওকে? কে জানে? এই সুন্দর সকালে ভাললাগার ব্যবচ্ছেদ করতে ইচ্ছে করল না পৃথুর।…
বিজ্লী অনেকক্ষণ পৃথুর চোখে চেয়ে থেকে বলল, আমাকে বাঁচাতে গিয়েই তো আপনার এই হাল।
হাসল পৃথু।
বলল, না, না, তা কেন? তা ঠিক নয়।
নিজেকে বলল, তোমাকে কি বাঁচাতে গেছিল পৃথু? রাণ্ডী বিজ্লীকে? পৃথু ঘোষ তোমাকে বাঁচাতে যায়নি সেই রাতে। আধুনিক, শিক্ষিত মানুষেরা অন্য কাউকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণ বিপন্ন করার শিক্ষা পায় না। বাহাদুরী নিয়ে দলের সমস্ত কৃতিত্ব একা একাই আত্মসাৎ করার জন্যেই কি গেছিল ও? ফোটোগ্রাফার আর রিপোর্টারদের সব হাততালিই একাই পাবে বলে? একা একাই মাল্যবান হবে বলে? ফুলে এবং শ্লাঘায়? বিজ্লী, বোকা গানেওয়ালি, তুমি জানো না যে-সমাজে আমার বাস সেখানে নিজের স্বার্থ না থাকলে কেউই কাউকে বাঁচাতে যায় না দৌড়ে গিয়ে। বরং পারলে, বিষ খাইয়ে মারতেই চায়। সামনে দাঁত বের করে হাসে আর পেছন থেকে ছুরি মারে সব সারল্য ও আন্তরিকতাকে।
কে জানে কেন গেছিল আসলে? মগনলালের সঙ্গে টক্কর দিতে? ওর মধ্যের ক্রমশ ঘনীভূত এবং লুকিয়ে-রাখা হীনমন্যতাকে একটা সামান্য ইঁদুর বা শুয়োরের কাছে একটা বড় বাঘের পরাজয়ের গ্লানিকে পিস্তলের সশব্দ পৌনঃপুনিক গুলিতে মুছে দিতেই গেছিল হয়তো আসলে। অবচেতন কি যে চায়, তা কি চেতন জানে?
বিজ্লী ওকে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে বলল, কথা বলছেন না কেন? আপনি?
তোমার টাকাটা আজও দেওয়া হল না। এখানে তো টাকা নেই…
বিজ্লী একবার তাকাল দুই ভুরু তুলে; পৃথুর দিকে। মুখে কিছু বলল না। তবে ঠোঁট দুটি কাঁপল একটু। অভিমানে।
ওর দুটি চোখ নীরবে বলল পৃথুকে, কামিনা!
পৃথু নিজেকেও বলল, কামিনা।
খুবই ঘেন্না হল পৃথুর নিজের উপর। শুধু বিজ্লীকে ছোট করার জন্যেই নয়, নানা মিশ্র কারণেও। সেই মুহূর্তে ওর হঠাৎই মনে হল যে, একজন আধুনিক মানুষের বুকে নিজের প্রতি যতখানি মমত্ব এবং গর্ব থাকে, ঠিক ততখানিই বোধ হয় থাকে ঘৃণাও। নিজেকে সে মানুষ যতখানি ঘৃণা করে ততখানি বোধ হয় আর কাউকেই করে না। ভাঁটুকেও নয়। হয়ত এতখানি ঘৃণা হাটচান্দ্রা শেলাক কোম্পানীর ইম্ম্যাটেরিয়াল ম্যানেজার শর্মাকেও করে না।
বিজ্লী কথা ঘুরিয়ে পৃথুর চোখে চোখ রেখে বলল, কবে ভাল হয়ে আমার কাছে যাবেন? এবারে কিন্তু…
সিস্টার লাওয়ান্ডে ঘরে ঢুকলেন।
বিজ্লী বলল, খুব ভাল লাগছে আমার। কতদিন পর দেখলাম আপনাকে!
পৃথু বলল, আমারও।
ওকে দিনের বেলায় এমন করে এত আলোর মধ্যে কখনও দেখেনি পৃথু। বিজ্লীর ঘরে এত আলো ছিল না। কেমন যেন নতুন নতুন লাগছে! চান করে এসেছে বিজ্লী। ওর গায়ের শামামা ঈত্বর-এর গন্ধ উড়ছে হাওয়ায়।
পৃথু বলল, হাসপাতালের কম্পাউন্ডের এক কোণায় ভীমরুলের চাক আছে কিন্তু প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড। ওই দিকে এমন খুশবু নিয়ে যেও না। একেবারে মরেই যাবে কামড়ে।
বিজ্লী হাসল। আশ্চর্য এক বিষণ্ণ হাসি। বলল, যেখানে খুশবু, কামড় তো সেখানে থাকবেই। ভয় করে কী হবে?
পৃথু চমকে তাকাল ওর দিকে।
ডিমের মতো সুডৌল মুখ বিজ্লীর। বড় সুন্দর। রুষা কি কুর্চির মতো নয়। অন্য রকম সুন্দর। এক-একজন নারীর সৌন্দর্য এক-এক রকম। চুলের রঙ একটু কটা। কে জানে, কোন বেদুইনের রক্ত আছে ওর শরীরে। অনেকই রঙের পিচকিরি লেগেছে ওর মা-দিদিমার রক্তে, যাদের কাছ থেকে নাচ শিখেছে, গান শিখেছে বিজ্লী, শিখেছে ভালবাসা—ভালবাসা খেলা, ছেনালী; ঢং-ঢং।
বিজ্লী শব্দ না করে হাসছিল। ওর গলাতে, আর ঠোঁটেও তিল আছে অনেকগুলো কালো রঙা। পৃথু কার কাছে যেন শুনেছিল যে, ঠোঁটে যাদের তিল থাকে সেই মেয়েরা খুব মুখর হয়। কথাটা হয়ত মিথ্যে নয়।
চুপ করে গেলেন যে আবার?
বিজ্লী বলল। কথা বলুন। সময় তো চলে যাচ্ছে। যেতে হবে না বুঝি?
যেতে তো হবেই।
তবে?
তবে কী?
কথা বলুন।
পৃথু হেসে আবারও ওর পিঠে হাত রেখে বলল, কথা, না-বললে বুঝি কথা বলা হয় না?
যায় হয়তো। কিন্তু আমি যে এতদূর থেকে আপনার মুখের কথা শুনব বলেই এলাম এত কষ্ট করে।
কথা সব ফুরিয়ে গেছে বিজ্লী। আবার জমে উঠুক বলব। এখন তুমি বল, আমি শুনি।
আমাদের মুলক্-এ যাবেন? সেরে উঠে?
মুলক্! তোমার মুলক্? কোথায় সে?
উজ্জ্বয়িন্-এর কাছে। শিপ্রা নদীর ধারেই আমাদের বাড়ি।
বাঃ। তবে তো মান্ডুর কাছাকাছিই।
হ্যাঁ। তবে খুব কাছে তো নয়। মাণ্ডুতে তো যেতে হয় ধার্ হয়ে। ছোটবেলায় একবার গেছিলাম মায়ের সঙ্গে। আর বড় হওয়ার পর ভোপালের এক রহিস্ বাবুর সঙ্গে। রূপমতী মেহাল্-এ পূর্ণিমার রাতে আমার গান শুনেছিলেন তিনি। খুব রসিক, বড়া খানদান-এর বাবু। মিল আছে অনেকই আপনার সঙ্গে।
বাড়িতে কে কে আছেন তোমার?
মা আছেন। আর ছোট বোন। দিদিমাও ছিলেন, মারা গেছেন মাস ছয়েক হল। মা কিন্তু ছোট বোনকে গানেওয়ালি হতে দেননি, যদিও গান সে গায় আমার চেয়ে অনেক গুণ ভাল।
তাহলে? বিয়ে দেবে না বোনের?
দেব তো। সেই জন্যেই তো হাটচান্দ্রাতে এলাম। শহর বাজার জায়গা, অথচ বেশি বাইজী নেই। কামাইও অন্য জায়গা থেকে বেশি। আর এক বছরেই যে টাকা জমাবো তাতে হয়ে যাবে বোনের বিয়ে। ছেলেও দেখে রেখেছি আমরা।
কী করে সে?
সে?
একটু চুপ করে থেকে বলল, তার প্রধান পরিচয় সে ডাকু ভিনোদ সিং-এর ছোট ভাই। এখন ভোপালে থাকে। বাড়ি ছিল গোয়ালিয়রে।
ডাকুর ভাইয়ের সঙ্গে…
আহা। দাদাই না হয় ডাকু, সে নিজে তো নয়। ওদের লেপ-তোশকের ব্যবসা আছে। ভাল ব্যবসা।
তবু, দাদা ডাকাত!
দাদার সঙ্গে ভাইয়ের কি? কুত্তা বিল্লীর বাচ্চারাই কি সব এক রকম হয়? হয় না। না চেহারায়, না স্বভাবে। তা আবার মানুষের বাচ্চা! এক একজন এক এক রকমভাবে বেড়ে ওঠে। মিল কি খুবই দেখেন ভাইয়ে ভাইয়ে?
তা হয়তো ঠিক। তবে, আমি তো একমাত্র ছেলে মা-বাবার। তোমার কথা ঠিক কি না তা বলতে পারব না।
তোমার বোনের নাম কী?
রোওশ্নী। কি যাবেন তো? থাকতে পারেন সেখানে যতদিন খুশি।
পৃথু মনে মনে বলল, পুরুষমানুষকে বিশ্বাস কোরো না। আগুন আর ঘি একসঙ্গে থাকলেই বিপদ।
মুখে কিছু না বলে, হাসল একটু।
ডাকুর ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হবে শুনেই ঘাবড়ে গেলেন?
না, ঠিক তা নয়…তবে।
ডাকু মগনলালের ভাই কে তা জানেন?
চমকে উঠল পৃথু।
বলল, কে? জানি না তো।
হাটচান্দ্রায় আমাদের মহল্লার ভিস্তিওয়ালা। রোজ পাহাড়ের উপরের পিলাকুঁইয়া থেকে যে খাওয়ার জল বয়ে নিয়ে আসে ভিস্তি করে আমাদের জন্যে। সেরাই প্রতি, পঁচিশ নয়া করে নেয় ওই উমদা পানির দাম হিসেবে।
কি বলছ তুমি বিজ্লী? ভিস্তিওয়ালা, ডাকু মগনলালের ভাই? আমি তার ভাইকে জান-এ মেরে দিলাম বলে রাগ নেই তার আমার উপর? পুলিস কি একথা জানে?
না না রাগ নেই। কোনওই রাগ নেই। উলটে সে বলেছে কারখানার সাহেব আমার বড়ে ভাইয়াকে মুক্তি দিয়েছেন। এবারে ওর আত্মা মুক্ত হয়ে যাবে। আগের আগের জন্মে অনেক পুণ্য না করে এলে মানুষের এত পাপ সয় না এক জীবনে। মুক্ত সে হবে, নিশ্চয়ই।
আপনারা, হিন্দুরা তো আত্মার মুক্তিতে বিশ্বাস করেন, তাই না?
পৃথু চুপ করে থাকল।
ভিস্তিওয়ালা মানুষটা কিন্তু সন্ত। গরীব, কিন্তু কোনও লোভ নেই। বিয়ে করেনি। মাঝে মাঝে পাহাড় থেকে ফুল নিয়ে আসে আমার জন্যে।
দেখো, আবার ভালটাল না-বেসে ফেলে তোমায়।
আমাকে কে ভালবাসবে? আমি তো ঝুটা-বিজ্লী। আমার শরীরকে অনেকেই ভালবাসে। কিন্তু মনের কাছে আসার সাধ নেই কারওরই। হয়তো, সাধ্যও নেই।
সিস্টার ঘরে ঢুকলেন আবার। ভ্রুকুটি করলেন পৃথুর দিকে চেয়ে। বড় রাগ হয়ে গেল পৃথুর। বুনো-পৃথু জেগে উঠল হঠাৎ। এই ভলান্টিয়ারী-করা বিবেকরূপী মহিলাকে একটু শিক্ষা দিতে ইচ্ছে হল ওর। এক ঝটকাতে দু’ হাত দিয়ে বিজ্লীকে নিজের দিকে টেনে নিয়েই তার বুকের উপরে বিজ্লীর ইচ্ছুক মুখখানিকে ফেলে, চেপে ধরে নিঃশেষে ভিজে ঠোঁট দুটিকে শুষে নিতে লাগল নিজের ঠোঁটে। এই হঠাৎই আলোড়নে পৃথুর শরীরের ব্যথা এবং কাম দুইই ছড়িয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে বিজ্লীর ঠোঁটে, শরীরের আনাচে-কানাচে।
কিছুক্ষণ পরই ওকে ছেড়ে দিয়ে, সিস্টারের দিকে তাকাল কামরাঙা-লাল চোখে।
সিস্টার চোখ নামিয়ে নিলেন।
বিজলীর শারীরিক সান্নিধ্য পৃথুর শরীরের মধ্যে অনেকদিন হল ঘুমিয়ে থাকা জড়াজড়ি-করা কাম-কাঁকড়াগুলোর মধ্যে হইরই তুলে দিয়েছিল। তারা শরীরময় হুড়োহুড়ি, দৌড়োদৌড়ি করতে লাগল। খুব ভাল লাগতে লাগল ওর। শরীরের অসংখ্য ধমনীতে তার প্রিয় রক্তর দপদপানি অনুভব করল। একজন মানুষের বেঁচে থাকার সঙ্গে তার কামবোধের বোধ হয় এক ধরনের সরাসরি এবং গভীর যোগাযোগ আছে। কামহীনতা মানেই হয়তো এক ধরনের মৃত্যুও। নীতিবাগীশ আর উন্নাসিকেরা যাইই বলুন না কেন। তীব্র কাম; তীব্রভাবে বেঁচে থাকারই অন্য নাম। জীবনীশক্তিরই অন্যতর লক্ষণ।
দুঃখের বিষয় এইই যে, পৃথুর স্ত্রী অথবা প্রেমিকা এই সরল সত্যটি কোনওদিনই বুঝতে পারল না । হয়তো খুব কম পুরুষের স্ত্রী এবং প্রেমিকারাই বোঝেন। তাইই, পৃথুরই মতো অন্য অনেক পুরুষকেই তাদের যার যার রুষাকে না পেয়ে যার যার কুর্চির দোরে গিয়ে ভিক্ষা চাইতে হয়। এবং সেখানেও ভিক্ষা না পেয়ে, আবারও বিজ্লীদের কাছে যেতে হয় টাকা ঝ্নঝনিয়ে।
নগ্ন আদম যেদিন জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে প্রথমবার নগ্না ঈভের পুষ্পদলন করেছিল, সেই প্রথম দিনেই এই পরম সত্যটি স্থাপিত হয়ে গেছে। স্থিরিকৃত হয়ে গেছে নারী ও পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক।
বিজ্লী বলল, নীচে ইমরানকে দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছি। শুধু আপনাকে দেখবার জন্যেই কাল দশটার বাস ধরে এখানে এসেছিলাম। আজই ফিরে যাব।
উঠেছিলে কোথায়? রাতে?
পৃথু শুধোল।
সব্জি-মণ্ডিতে। এক দোস্ত থাকে সেখানে, ইমরানের। তারই বাড়িতে।
সব্জি-মণ্ডি!
হাটচান্দ্রাতেও সব্জি-মণ্ডির কাছেই বিজ্লীর বাড়ি। বার্নার্ড শ’র পিগমেলিয়নের প্রফেসর হিগিনস লান্ডানের ফুল-মণ্ডির অক্ষর পরিচয়হীন এক সরলা বালা এলাইজা ডুলিটলকে যেভাবে শিক্ষিত করে তুলেছিলেন; তেমন করে বিজ্লীকেও শিক্ষিত করে তুলতে ইচ্ছে হয় পৃথুর।
কিন্তু সময় নেই।
সেই সময়ও নেই। যুগও তো পালটে গেছে। আজকের এই পৃথিবীতে প্রফেসর হিগিনস আর মিস ডুলিটলদের আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। “উও জমানা চলে গ্যয়ে যব খলীল খাঁনে ফাকতা উড়াহ্তে থে”।
কবে বাড়ি যাবেন?
বাড়ি?
চমকে উঠল পৃথু। বাড়ি তারও একটা আছে? আছে বুঝি?
বলল, আরও দু-আড়াই মাস।
কাঠের পা লাগাবেন?
নাঃ।
কেন?
কোনও নকল জিনিস ভাল লাগে না। যা আমার নেই; তা আছে বলে লোককে ধোঁকা দেওয়ার কী দরকার?
বাঃ। কত কাজে লাগে কাঠের পা। তার উপরে প্যান্ট পরবেন, পাজামা পরবেন, কেউ বুঝতেই পারবে না। গাড়ি চালাতে পারবেন। না, কেন? অদ্ভুত আপনার যুক্তি সব।
নাঃ। ও তুমি বুঝবে না। আমি ক্রাচই নেব।
মহল্লার ছেলেগুলো ল্যাংড়া ল্যাংড়া বলে খ্যাপাবে।
যে সত্যিই ল্যাংড়া তার এই সত্যি কথাতে রাগ করার কোনও কারণ তো দেখি না।
তবু, ভেবে দেখবেন, মন ঠিক করার আগে।
দেখেছি। পুনেতে আর্টিফিসিয়াল লিম্বসের দারুণ ফ্যাক্টরি করেছে, ইন্ডিয়ান আর্মির উদ্যোগে। শুনেছি, সুন্দর সুন্দর পা পাওয়া যায়, হাতও। কিন্তু আমি লাগাব না।
জানি না, কেন এমন জিদ করছেন।
সেই সব পা যত সুন্দরই হোক না কেন, আমার নিজের পায়ের মতো সুন্দর পা কোথায় পাব?
বিজ্লী পৃথুর বাঁ পায়ে হাত বুলিয়ে বলল, তা ঠিক। অনেকগুলো লাল তিল ছিল আপনার পায়ে। মনে আছে। একদিনই দেখেছিলাম। আগুনের মতো।
বিজ্লী পৃথুর উরুতে হাত ছোঁওয়াতেই কে যেন আবার ওর কামের মেইন-সুইচ অন্ করে দিল। শরীরের ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠল, ঘণ্টা বেজে উঠল পুজোর, সানাই বাজতে লাগল শরীরের রোশনচৌকি থেকে।
বিজ্লীর হাতটা আস্তে করে সরিয়ে দিল পৃথু। চোখে কষ্টর ছায়া ফুটে উঠল, কালো হয়ে এল পৃথুর চোখ। কর্তিত ডান পায়ের সম্মুখভাগেও রক্ত এসে দাপাদাপি করছিল। মনে হচ্ছিল, এক্ষুণি ছিঁড়ে দেবে সব সেলাইগুলো।
এখন আবার শান্ত হয়ে আসছে আস্তে আস্তে দপদপানিটা। আলো নিবে যাচ্ছে এক এক করে শরীরের ঘরে ঘরে।
সৌন্দর্যর যেমন আলাদা এক আকর্ষণ আছে, মনের গভীরতার, অর্থর, প্রাচুর্যেরও যেমন আছে, তেমনই নিছক কামেরও আছে; বুঝল, পৃথু। সত্যি! রূপ-গুণ-মানসিকতা-বিবর্জিত নিছক কামেরও! পুরুষের সবচেয়ে কাছের দেবতা কি মদনদেবই? গণেশ বা লক্ষ্মী বা সরস্বতী নয়? বড়ই লজ্জার কথা। কিন্তু, সত্যি।
একটা গান শোনাবে বিজ্লী?
এখানে?
সিস্টার লাওয়ান্ডে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে চেয়েছিলেন। তিনি যে খুবই বিরক্ত হয়েছেন তা বোঝাবার জন্যে।
সেই গানটা গাও। “রস্কে ভরে তোরে নয়না, এরি সাঁবারিয়া, আয়েযা সাঁবারিয়া/তোঁহে দরোমাঁ লাগালুঁ/রস্কে ভরে তোরে নয়না…।”
পৃথু বলল।
নাঃ।
কেন? না কেন? এখানে গান হয় না?
পৃথু বলল, বিজ্লীকে।
কোনও বাজনা নেই, তবলা নেই; কী করে হবে?
তারপর সিস্টারের দিকে চেয়েই; গলা নামিয়ে বলল, ভাল হয়ে আমার কাছে আসবেন, অনেক গান শোনাব রাতভর। বলেই আঙুল দিয়ে পৃথুর মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে লাগল বিজ্লী।
বড় ভাল লাগতে লাগল পৃথুর। কী যে দেখেছে এই পাগ্লী অভাগী মেয়েটা ওর মধ্যে। কে যে কী দেখে কার মধ্যে কখন? এসব লীলা বোঝা ভার। কোনও যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা হয় না এসবের। হৃদয়ের কোনও প্রশ্নরই উত্তর কি নেই মস্তিষ্কর কাছে?
বিজ্লী বলল।
থাকবেন? আমার কাছে? বাকি জীবন?
সিস্টার লাওয়ান্ডে এবার হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বিজ্লীর মুখের দিকে ঘৃণার দৃষ্টি হানলেন।
পৃথু ভ্রুক্ষেপ না করেই বলল, বাকি জীবন? এক-পায়ের জীবন? আমি তোমার তো কোনও কাজে লাগব না। শুধু তোমারই কেন, কারওরই আর কাজে লাগব না। যে মানুষের কাছে পাহাড়, বন, নদী জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে ছিল তার কাছে এই অঙ্গহানির ব্যাপারটা যে কতখানি তা হয়তো তুমি ঠিক বুঝবে না বিজ্লী। তোমার কাছে তোমার পালঙ্কটি যতখানি, যতখানি তোমার গান; আমার কাছেও বনজঙ্গলও ততখানিই! কতখানি যে হারাল আমার, হারিয়েছে; তা তোমাদের কাউকেই বোঝাতে পারব না। ঠুঠা বাইগা, ভুচু, সাবির সাহেব বা শামীমরা হয়তো বুঝলেও বুঝবে কিছুটা।
আপনাকে তো আমার কাজের জন্যে ডাকছি না। আপনার কাজে আমি যদি লাগি, কোনওরকম কাজে; সে জন্যেই ডাকছি। আমি সব কিছুই করব আপনার জন্যে। রোজগার করে খাওয়াব আপনাকে। শুধু কথা দিন যে, আসবেন।
রোজগার করে?
পৃথু হাসল। শব্দ করে।
হাসছেন যে!
তুমি রহিস্দের নিয়ে পালঙ্কে শুয়ে রোজগার করবে আর সেই রোজগারেই খেয়ে তোমার সেই পালঙ্কেই শুয়ে থাকব আমি তোমাকে নিয়ে? বলেছ ভাল। তুমি একটি…
বিজ্লীর মুখ কালো হয়ে এল।
মুখ নামিয়ে বলল, ছিঃ ছিঃ। কী করে ভাবলেন এমন কথা? দেখবেন আপনি! শুধু গানই গাইব বাকি জীবন। আর যতদিন বাঁচি; বাজাব না কখনও।
মনে মনে বলল, শুধু আপনাকে ছাড়া।
আর আমি? আমি তো না জানি তবলার ঠেকা, না পারি বাজাতে সারেঙ্গী, শুধু তানপুরা ছেড়েই রোজগার করব। রাজি? সেটা কি ভাল দেখাবে?
আপনি আমাকে কষ্ট দিয়ে খুব আনন্দ পান, না সাহাব? আপনি শুধু আমাকে বাজাবেন। একজন আওরাতের কাছে একজন মরদের কী দাম তা আপনি কী করে বুঝবেন? মরদ ছাড়া আওরাত কি বাঁচে? আপনি কাছে থাকাটাই তো আমার কাছে বড় একটা ব্যাপার। আপনার সেবা করেই কাটিয়ে দেব সারা জীবন। আপনার গান শুনব। কী ভাল গাইতে পারেন আপনি। শুনেছিলাম না গিরিশবাবুর বাড়ি।
পৃথু হাসল। বলল, সিনেমার ডায়ালগের মতো শোনাচ্ছে তোমার কথা। তবু হয়তো তুমিই আমার জীবনে একমাত্র মানুষ যে, বদলে কিছুমাত্র না—চেয়েই…
একটু চুপ করে থেকে স্বগতোক্তির মতো বলল পৃথু, একদিন নিজে হাতে খিচুড়ি রেঁধে খাওয়াবে বলেছিলে না বিজ্লী? মনে আছে?
খিচ্ড়ি!
প্রথমে ও চমকে উঠল। তারপরই হেসে বলল, খিচ্ড়ি আপকি বহত্ই পসন্দ কি খনা? পইলেভি আপনে এক মরতবে বোলেথেঁ। খিচ্ড়ি পকানা কওন্সী বড়ী বাত?
বহত্ই বড়ী বাত্। বহত্ই বড়ী বাত্।
রুষা যে জীবনে একদিনও নিজে হাতে খিঁচুড়িও বেঁধে খাওয়ায়নি পৃথুকে। বিজ্লী কী করে জানবে, কোথায় ব্যথা পৃথুর, কত জায়গায় ব্যথা? কার শূন্যতা যে কোথায় তা অন্যে জানবেই বা কী করে? বিশেষ করে সেই শূন্যতা যখন সব সময়ই আড়াল করেই বেড়াতে হয়। পাছে অন্যে জানে। পাছে রুষা কষ্ট পায়।
হাসছিল পৃথু। অনাবিল প্রসন্নতার হাসি। ও জানে কিন্তু বিজ্লী হয়তো জানে না যে, একজন শিক্ষিত মানুষের কাছে একটি উদগ্রীব্ নারী শরীর, সুরেলা গলার গান; অথবা উপাদেয় খিচুড়ির চেয়েও বড় আরও অনেক কিছু চাইবার আছে; থাকে। শিক্ষার এইই অভিশাপ। শিক্ষা; পুরুষ কিংবা নারী, সকলকেই বড় গোলমেলে, বক্র করে দেয়। যা সে সহজে পায়, পেতে পারে তাকেই সস্তা বলে ভাবতে থাকে সেই মানুষরা। আর যা পায় না, তাইই দামী মনে হয় তাদের কাছে। রুষা তাকে যা দেয়, তা কুর্চি কখনও দিতে পারবে না। চাইলেও না। আবার কুর্চি যা দিতে পারত, তা বিজ্লী কখনও দিতে পারবে না। চাইলেও না। অথচ পৃথুর তিনজনকেই প্রয়োজন; তিনটি সম্পূর্ণ বিভিন্ন কারণে। ও যে অনেকগুলো মানুষ। একজন নারীতে, একই ধরনের নারীতে যে ও আঁটেনি। আঁটবেও না কোনওদিন। পৃথুর দুঃখ খণ্ডাবে কে?
চুপ করেই রইল ও। বিজ্লীর প্রতি এক গভীর কৃতজ্ঞতায়; সে চেয়ে রইল নীরবে বিজ্লীর চোখে।
ওয়াক্ত্ কিতনা হুয়া সাহাব?
হঠাৎই শুধোল, বিজ্লী।
পৃথু সিস্টারকে জিগ্যেস করল, কটা বাজে সিস্টার এখন?
ভিজিটিং আওয়ার্স ওভার হয়ে গেছে। সাড়ে নটা বেজে গেছে।
সিস্টার বললেন; মুখ না ফিরিয়েই। বিরক্ত গলায়।
ওঃ বাবাঃ। এবার তাহলে উঠি। হাটচান্দ্রার বাস যে দশটায় ছাড়বে। ইমরান নীচে দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণে ছটফট করছে বোধ হয় দেরি দেখে।
উঠবে? নিয়ে এলে না কেন ইমরানকে উপরে?
ও এলে, আমি তো এমন একা পেতাম না আপনাকে।
পৃথু সিস্টারের দিকে তাকাল।
বিজ্লী ফিসফিস করে বলল সিস্টারের উদ্দেশ্যে, উনি তো চেনা নন। ওঁর সামনে লজ্জা কিসের? আনজান আওরত।
বলেই বলল, আর কিন্তু আসতে পারব না আমি। যাব এবার। বলুন, আপনি আসবেন তো? কথা দিন।
যাব।
পৃথু বলল।
চলি।
বলেই উঠে দাঁড়িয়ে বিজ্লী আবারও একবার পৃথুর গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে চোখে চোখ রেখে, হাতে হাতটি এক মুহূর্ত নিয়েই আবার নামিয়ে রেখে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ভাল থেকো।
পৃথু বলল। গলা তুলে।
কথা দিলেন তো?
দরজায় দাঁড়িয়ে পড়ে বলল বিজ্লী।
মাথা নাড়ল পৃথু।
পর্দার আড়ালে মিলিয়ে গেল ওর শাড়ি। পর্দাটা হাতের ছোঁয়ায় অনেকক্ষণ ধরে কাঁপতে লাগল। যতক্ষণ কাঁপতে থাকল, ওইদিকেই চেয়ে থাকল পৃথু।
কথাও দিল, কিন্তু খুব সম্ভব কথা রাখা হবে না। জীবনে, কটা কথাই বা রাখা যায়? মিথ্যার বেসাতিরই আর এক নামই তো জীবন। তবু, আশ্চর্য! কথা দিতে হয় কতজনকেই কতবার। আর কথা দিলেই যদি কেউ খুশি হয়, তাহলে না দিয়েই বা কী করা যায়? ভবিষ্যতের দুঃখর কথা ভেবে আজকের খুশি নষ্ট করার তো মানে নেই কোনও।
সিস্টার বললেন, হু ইজ দ্যাট লেডি?
চমকে উঠল পৃথু।
বিজ্লীর কথা ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল। কত দূর থেকে বাসে করে এসেছে সে ধুলো মেখে পেত্নী হয়ে শুধু ওকে একটু দেখতে। কত ঋণই যে জমছে, কত জনের কাছে।
হু ও’জ দ্যাট লেডি?
আবারও শুধোলেন সিস্টার লাওয়ান্ডে। রীতিমত সার্জেন্ট মেজরের গলায়।
য়্যু আর ভেরি মাচ ইনকুইজিটিভ সিস্টার। লিমিট্লেসলি ইনকুইজিটিভ্।
অ্যাম আই? ওয়েল…লজ্জিত হয়ে বললেন সিস্টার।
পৃথু ভাবল, বলে, দ্যাটস নান অফ ইওর বিজনেস।
কিন্তু তা না বলে, বলল, শী ইজ আ হোর! আ প্রস্টিট্যুট।
হোয়াট?
হেঁচকি তুললেন সিস্টার।
ইয়েস। শী ইজ। আ বাইজী, হু ওলসো গিভস হার বডি ফর মানি।
মাই! মাই! য়্যু শুড বি অ্যাশেমড অফ ইওরসেলফ মিঃ ঘোষ।
পৃথু সিস্টারের চোখে চোখ রেখে বলল, আই নীড নট বী।
বাট হোয়াই? হোয়াই মিঃ ঘোষ?
বিকজ শী ইজ পিওরার দ্যান মেনি উইমেন আই নো অফ। ওর মধ্যে কোনও মিথ্যা নেই। বড় পবিত্র মেয়ে এই বিজ্লী। মানুষ অনেকই দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু একজন খাঁটি মানুষের দেখা এক জীবনে খুব কমই মেলে।
য়্যু আর আ স্ট্রেঞ্জ জেন্টেলম্যান মিঃ ঘোষ।
আই ডু নট ক্লেইম মাইসেলফ টু বি আ জেন্টেলম্যান। অন দ্যা কন্ন্ট্রারি, আই ডেসপাইস্ ওল্।
য়্যু আর রিয়্যালি স্ট্রেঞ্জ। য়্যু হ্যাভ সাচ্ আ ওয়াইফ্, সাচ্ চিলড্রেন্ অ্যান্ড য়্যু হ্যাভ ইওর এডুকেশান ইন ইংল্যান্ড; মাই! মাই!
কী জানেন এই মহিলা? জীবনের কতটুকু জানেন? বিরক্তি লাগছিল পৃথুর। ক্লান্তিতে ও দু’ চোখই বন্ধ করে ফেলল। মাথা ধরে আসছিল। কথাও বলেছে অনেকক্ষণ। তারপর শারীরিক উত্তেজনা।
সিস্টার লাওয়ান্ডে আবারও স্বগতোক্তি করলেন, হোয়াট আ স্ট্রেঞ্জ পার্সন্ য়্যু রিয়্যালি আর মিঃ ঘোষ।
ও জানে। ও জানে তা। একজন অজীব আদ্মি হচ্ছে এই পৃথু ঘোষ। সকলেই জানে।