1 of 2

১৯. শুধু দুঃখই পেতে এসেছিল

১৯

এই পৃথিবীতে ও কি শুধু দুঃখই পেতে এসেছিল?

দুঃখ কি ওর একারই? দুঃখী নয় কে? সকলেরই দুঃখ আছে কম বেশি।

জাগতিক দুঃখ না মিটলে অন্য দুঃখ নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রশ্নই ওঠে না। এইরকম একটা কথা অনেকেই বলেন। সে কথা বিশ্বাস করে না ও। কিছু কিছু দুঃখ থাকে, দুঃখবোধ থাকে তা কেবল মানুষেরই জন্যে। মনুষ্যপদবাচ্য মানুষ! শুধুই মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্পন্ন জীবদের জন্যে নয়। তবু এই দুঃখময়তার মধ্যেও পৃথু নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেয়। নিজের দুঃখটাকেই একমাত্র দুঃখ বলে কখনওই মনে করে না। সক্রেটিস বলেছিলেন খুব সম্ভব প্লুটার্ক-এর “অ্যাড অ্যাপোলোনিয়াম দ্য কনসোলেশান”-এ “ইফ ওল মিস ফরচুনস ওয়্যার লেইড ইন ওয়ান কমোন হীপ, হোয়েন্স এভরী ওয়ান মাস্ট টেক অ্যান ইকুয়াল পোর্শান, মোস্ট পীপল উড বী কনটেন্ট টু টেক দেয়ার ওওন এণ্ড ডিপার্ট।”…ওর মনে হয় আর দশজন বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ, প্র্যাকটিক্যাল, প্র্যাগমেটিক মানুষের মতোও ও সর্বার্থে সুখী হবে, রুষার বাধ্য স্বামী হবে।

কিন্তু পারল কই?

বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের লেখায় পড়েছিল, “যেসব মানুষ সামান্য সময়ের জন্যে অস্থায়ী নিরাপত্তা কিনতে গিয়ে মূল ও অত্যাবশ্যক স্বাধীনতা দিয়ে দিতে রাজি থাকেন, তাঁরা না স্বাধীনতার যোগ্য; না-নিরাপত্তার।”

কথাটা রাষ্ট্রনীতিতে যতখানি সত্যি, ব্যক্তিনীতিতেও ঠিক ততখানি সত্যি বলে মনে হয় ওর। মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলি নিশ্চয়ই যুদ্ধের বা বৈরিতার নয়। তবু “এসেনসীয়াল লিবার্টি” অন্যের হাতে তুলে দিতে রাজি নয় সে আদৌ। এমনকী স্ত্রী-পুত্র-কন্যার হাতেও নয়। “এসেনসীয়াল লিবার্টি” দেবে না ও কাউকেই। হ্যাঁ বলতে বলতে একটা প্রান্তিক সীমানাতে পৌঁছেও “না” বলতে যাঁরা তবুও অপারগ, জীবনের কোনও ক্ষেত্রে স্বাধীনতাই তাঁদের জন্যে নয়।

বেরিয়ে পড়ল ও। সকলে এখনও ঘুমাচ্ছে। অনেকদিন জঙ্গলে হাঁটে না একা একা।

পথে বেরিয়েই, কোম্পানির একটা ট্রাক পেয়ে গেল।

ড্রাইভার ওকে দেখে, গাড়ি থামিয়েই বলল, সেলাম সাহাব।

পৃথু সংক্ষেপে শুধোল, কিধার?

ড্রাইভারও সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল বাইহার।

আমাকে একটু এগিয়ে দাও তো।

কাঁহা যাইয়েগা সাহাব?

কোথাও যাব না। এই জঙ্গলেই। একটু হাঁটব। ভাঁদো নদীটা পেরিয়েই আমাকে নামিয়ে দাও। নদীর পারে পারে জঙ্গলের দিকে হেঁটে যাব।

ড্রাইভার ইফতিকার বলল, জিন্দগীভর জঙ্গলমে রহকেভি আপকি জঙ্গলসে ইতনা পেয়ার? হামলোগোঁনেত জঙ্গলসে বিলকুলই থকা হুয়া হ্যা। হিঁয়া কোঈ আদমী রহতা হ্যায়? আদমীকা লায়েক জায়গা হি নহী ঈ!

পৃথু জবাব দিল না। পৃথুকে সযত্নে পাশে বসিয়ে নিয়ে মিনিট দশেক ট্রাক চালিয়ে, ভাঁদোর কজওয়ের উপর নাবিয়ে দিল ইফতিকার।

ট্রাকটা যখন চলে গেল, তখন পৃথু দিব্যচোখে দেখতে পেল ইফতিকার আর ক্লিনার হাসাহাসি করছে ওকে নিয়ে। বলছে, এইসীই ক্যা সবহি উনকো পাগলা কহঁতে হ্যায়?

ট্রাকের ডিজেলের গন্ধে ভ্রষ্ট হয়ে রইল কিছুক্ষণ, শীতের সকালের তিরতির করে কাঁপা শিশিরের তাজা গন্ধ। হঠাৎ একটা হলুদ বসন্ত পাখি ডেকে উঠেই উড়ে গেল একটা মরা হলদু গাছের ডাল ছেড়ে, ভাঁদো নদীর রেখা ধরে, গভীর জঙ্গলের দিকে। উঠতে-নামতে, নামতে-উঠতে। সকালের অকলঙ্ক নীল-আকাশে হলুদ লেগে গেল। পৃথু চেয়ে রইল সেদিকে। পাখিটাকে অনুসরণ করল চোখ দিয়ে, যতক্ষণ তাকে দেখা যায়। তারপর পাখি যে দিকে গেছে, সেই দিকেই পা বাড়াল।

কী ভাল যে লাগে! কত গন্ধ, শব্দ, দৃশ্য। অনাঘ্রাতা, অশ্রুত; অদেখা। এই অনাবিল শীতের সকাল। জঙ্গল রোজই দেখে, এতবার করে, এতরকম করে, বছরের বিভিন্ন ঋতুতে দেখে, তবুও আশ মেটে না চোখের কানের অথবা মনের। নানা কথা ভাবতে ভাবতে হাঁটে। সব ভুলে যায় তখন। ওর কী নাম, কী জীবিকা, ওর স্ত্রী ছেলেমেয়ের নাম, সমস্ত পরিচিতদের নাম, এমনকী কুর্চিরও। এ জঙ্গলে এলে কাউকেই ওর মনে থাকে না, কোনও দুঃখই দুঃখিত করে না, কোনও আনন্দে আনন্দিতও নয়। এক আশ্চর্য নির্লিপ্তিতে ছেয়ে থাকে ওর সমস্ত সত্তা তখন।

জঙ্গলের গভীরে এলেই হেলেন কেলারের ক’টি কথা বারে বারেই মনে পড়ে পৃথুর। যে মহিলা অন্ধ হয়ে গেলেন, তাঁর মতো দেখার চোখ নিয়ে বোধহয় কম মানুষই জন্মেছিল এ পৃথিবীতে। ওর “থ্রী ডেজ টু সী” বইতে আছে “আমি নিজে তো অন্ধ, কিন্তু যাঁরা, দেখতে পান, তাঁদের আমি একটি সুত্র দিতে পারি—একটি উপদেশও। তাঁরা যেন চক্ষুম্মানতার দানের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন। তাঁরা প্রতেকে যেন ভাবেন যে, কাল তাঁরা চিরদিনের মতোই অন্ধ হয়ে যাবেন। এই ভেবে, আজ চোখ দুটিকে ব্যবহার করুন।

“একথা অন্যান্য অনুভূতির বেলাতেও প্রযোজ্য। আগামিকাল চিরদিনের মতো বদ্ধ কালা হয়ে যাবেন এই মনে করে মানুষের গলার স্বর শুনুন, পাখির গানে কান পাতুন, অর্কেস্ট্রার ঝরনার মতো মত্ততায় সম্পৃক্ত হোন। প্রতিটি জিনিসই, আপনার আঙুল দিয়ে পরশ করুন এই ভেবে যে, আগামিকাল আপনার স্পর্শানুভূতি চিরদিনের মতোই নষ্ট হয়ে যাবে। ফুলের সুগন্ধ নাক ভরে নিন, প্রতিটি গরাস পূর্ণ আনন্দে খান, এইই ভেবে যে; আগামিকাল আপনার নাক আর রসনা চিরদিনের মতোই স্তব্ধ হয়ে যাবে।”

তাই-ই করে পৃথু। তাই-ই করে বলেই তো ওকে সকলেই পাগল বলে। তাই-ই তো ও কুর্চিকে মনে মনে বলে, “অ্যায় হুসন, জী খোলকর আজ সাতাঁলে মুঝকো। কাল, মেরা ইস্ককা আন্দাজ বদল যায়ে গা।”

মানে, “ওহে সুন্দরী! আজ প্রাণ খুলে আমাকে দুঃখ দিয়ে নাও, আমায় নিয়ে খেলা করো, আমার সঙ্গে আজ তোমার ‘প্রাণের খেলার’ সময়। আহা! তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা। কারণ কাল, আগামিকাল, আমার প্রেমের পাত্রী অন্য কেউও হয়ে যেতেও পারে।”

আগামিকাল তো অনেক কিছুই হতে পারে। প্রেমের ক্ষেত্রে তো পারেই! সেই পুরাতনী গান আছে না, একটা, “প্রণয় পরম রত্ন, যত্ন করে রেখো তারে, বিচ্ছেদ তস্করে আসি, যেন কোনওরূপে নাহি হরে। অনেক প্রতিবাদী তার, হারালে আর পাওয়া ভার, কখন যে সে হয় কার, কে বা তা বলিতে পারে?”

কাল, আগামিকালকে, মনে হয় রাত পোহালেই হাতের কাছে। কিন্তু আগামিকাল, আসলে থাকে অনেকই দূরে। কত কী ঘটে যেতে পারে, সম্ভবকে অসম্ভব করে, অসম্ভবকে সম্ভব; কত পাঁচিল ওঠে রাতারাতি, শরীর মনের ন্যায়, অন্যায়ের লাঠালাঠি, জবরদখল একটি রাতের মধ্যে। ক’জন বোঝে এই গভীর সত্য?

আজ আর কালে যে অনেকই তফাত!

পৃথুর কর্ডরয়ের প্যান্টটা ভিজে গেছিল শিশিরে। নদীর পাশের বালি ও ঘাসে ভরা মাটি এখনও ভিজে। সোজা হেঁটে গেল নদীর পারে পারে জঙ্গলের গভীরে। একদল শম্বর নদী পার হল ওর সামনে দিয়ে। দুটি শিঙাল, পাঁচটি মাদীন। তখনও তাদের ঘন খয়েরি গায়ে শিশির আর ঘাসের গন্ধ লেগে ছিল। সকালের রোদ তাদের গা থেকে ইরেজার-এর মতো সেই গন্ধকে বাষ্প করে তুলে দিচ্ছিল।

একটা খুব বড় দাঁতাল শুয়োর রাতভর দাঁত দিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি করে মূল খুঁড়ে ক্লান্ত হয়ে জঙ্গলের গভীরে তার দলের নালায় ফিরছিল। পৃথুকে আচমকা নদীর বাঁকে দেখে নাক দিয়ে একটা বিদঘুটে আওয়াজ করে পায়ের খুরে খুরে মাটি ছিটকিয়ে উধাও হয়ে গেল নদী পেরিয়ে, জল ছিটিয়ে। ছিটকে-ওঠা জলকণা রোদ লেগে, লক্ষ লক্ষ হিরে হয়েই ঝরে গেল বালির উপর। মিলিয়ে গেল।

এবার পৃথু ফিরল। আজকে ও ওর নতুন লেখাটাতে হাত দেবে। ওর জীবনের প্রথম উপন্যাস। এবং হয়তো শেষও। অনেকদিন থেকেই বুকের মধ্যে একটা চাপা কষ্ট। কী নিয়ে লিখবে? কেমন করে লিখবে? কাল সারা রাত ঘুমোতে পারেনি। লেখা-টেখা এত কষ্টের, তাহলে মানুষে লেখালেখি করে কেন? লাভ কী? এমনিতেই তো সব মানুষেরই অনেক কষ্ট! কে জানে? লেখাও বোধহয় শিকারেরই মতো একরকম অসুখ। হান্টিং-বাগ এ কামড়ানোর মতোই ‘রাইটিং-বাগ এ কামড়ালে বোধহয় না-লিখে উপায় থাকে না। আজ বাড়ি ফিরে, চান করে, ব্রেকফাস্ট খেয়ে, লিখতে বসবে পৃথু।

বাড়ি ফিরে, চান করে, নিজের ঘরে বসেছিল ও।

জানালা দিয়ে দেখল পৃথু, এস. ডি. ও খাণ্ডেলওয়ালা সাহেবের কালো কুচকুচে যুবতী আয়া সাদা ধবধবে জোয়ান অ্যালসেসিয়ান কুকুরটিকে প্রকৃতির মধ্যে নিয়ে গেল। রোজই যায়। সকালে এবং বিকেলে। প্রথমে আদেশ ছিল, এখন অভ্যেস।

ইয়েস। অভ্যেস।

ডিমের কী? স্যার? কটা ডিম স্যার? টোস্ট কটা স্যার?

মেরীর প্রাত্যহিক প্রশ্ন, প্রায়ই পৃথুকে মার্ক টোয়াইনের সেই প্রসিদ্ধ, উক্তির কথা মনে পড়িয়ে দেয়। নিজের জন্যে দুঃখ যেমন হয়, তেমন হাসিও পায়। নিজেকে নিয়ে এখনও হাসতে পারে দেখে মনে মনে নিজের উপর অত্যন্ত প্রসন্নও হয়। যে মানুষের চোখে, সে নিজেও কখনও কখনও হাস্যোদ্দীপক নয়, তার কপালে, মনে হয়, অশেষই দুঃখ। যদি নিজেকে নিয়ে নিজে হাসতে না পারে তাহলে জানতে হবে যে, তার মনের গড়ন এখনও সম্পূর্ণতা পায়নি, অথবা সে মেগালোম্যানিয়াক হয়ে গেছে। অনেক, অনেকই বছর আগে মার্ক টোয়াইন বলেছিলেন মার্ক টোয়াইনেরই মতো করে : “হ্যাবিট ইজ হ্যাবিট। এণ্ড নট টু বী ফ্লাঙ্গ আউট অফ দ্যা উইণ্ডো বাই এনি ম্যান, বাট কোক্সড ডাউনস্টেয়ারস আ স্টেন অ্যাট আ টাইম।”

নো। ডিমের কিছুই না ম্যাডাম। একটাও টোস্ট নয়।

পৃথিবীতে টোস্ট ডিম ছাড়াও অনেক সুখাদ্য ছিল, যা ব্রেকফাস্টে খাওয়া যেতে পারত। যেমন, ফুলকো লুচি, একটু হলুদ কালোজিরে-কাঁচালঙ্কা দিয়ে প্রায় সেদ্ধ করে রাঁধা গা-মাখা গা-মাখা আলুর তরকারির সঙ্গে। অথবা, টাটকা কড়াইশুঁটির কচুরি। অথবা কড়াইশুঁটির চপ। পুরটা বানাবার সময় একটু কড়া করে ভেজে নিতে হবে আর আলুটা মাখবার সময় সামান্য গোলমরিচ ছিটিয়ে নিতে হবে তাতে। আঃ কী স্বাদ! অথবা চিঁড়ের পোলাউ। কড়াইশুঁটি, ধনেপাতা, গাজর কুচি, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে। অথবা, মুড়ি ভাজা। তেল-ছাড়া। সঙ্গে নারকোল-কুচি, কিসমিস, কড়াইশুঁটি, আদার-কুচি। বসন্তের শেষে এঁচড়ের চপ। আরও কত কত কী!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *