২২
মেয়ে তো আর কম দেখলাম না। ও সব মেয়েকে আমার বুঝতে বাকি নেই।
রুষা বলল।
কার কথা বলছ?
পৃথু কলম থামিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলল।
কার কথা আবার! তোমার প্রেমিকার কথা। এই নাও চিঠি। ডাক-বাক্সের মধ্যে একটা বিচ্ছিরি টিকটিকির সঙ্গে জড়াজড়ি করে ছিল।
চিঠিটি ছুঁড়ে দিল রুষা। পৃথুর প্রায় মুখেরই উপর।
পৃথু ব্যথিত চোখে চেয়ে বলল, এ কী! খুলল কে?
আমি।
সার্জেন্ট মেজরের মতো বলল রুষা।
পরের চিঠি খোলা অভদ্রতা!
তুমি আমার পর নও! দ্বিতীয়ত…
কী? দ্বিতীয়ত কী?
তা আমি বলব না। প্রেম না ছাই! বিয়ে করেছে একটা অপোগণ্ড গুড ফর নাথিং-কে। এখন তোমার টাকা পয়সার উপর লোভ। তুমি কি মনে করো, কুর্চি তোমাকে ভালবাসে? ও সব দেখানো ভালবাসা। কিছু শাড়ি গয়না বাগিয়ে নেওয়ার মতলব! কোনদিন কোম্পানির শেয়ার-টেয়ারও লিখিয়ে নেবে তোমাকে দিয়ে। মেয়েদের তুমি কতটুকু চেনো? খবর্দার বলে দিলাম। আমার একটা সম্মান আছে। এই ধরনের ক্যারাক্টারলেস মেয়ের সঙ্গে, স্পেশ্যাল স্ট্যাটাসহীনের সঙ্গে হরদম যদি হবনব করো তো আমি ডিভোর্স চাইব। তোমার কোন গুণটা আছে বলতে পারো? কোথায় কেরিয়ারিস্ট হবে, তাড়াতাড়ি ডিরেক্টর হবার চেষ্টা করবে, তা না নিজের কাজ নষ্ট করে কবিতা লেখা নিয়ে পড়ে থাকো। কবি সাহিত্যিকরাও আজকাল কেরিয়ারিস্ট, তাঁরাও নিজেদের বৈষয়িক ভালটা কিছু কম বোঝেন না। তুমিই যেন একমাত্র কবি এসেছ, আর্টিস্ট এসেছ ভ্যান গো! হাসি পায়। তোমাকে পরিষ্কার বলে রাখছি কবি-সাহিত্যিক হওয়ার ধান্দা তোমার ছাড়তে হবে। আমি একজন ফরেন কোয়ালিফায়েড এঞ্জিনীয়ারকে বিয়ে করেছিলাম, ভোলে-ভালা কবিকে নয়। এনাফ ইজ এনাফ। তাছাড়া, সংসারের কোন কাজে তুমি লাগো! আমি, এই একা মানুষটা, ছেলেমেয়ে, নিজের সংসারের যাবতীয় দায়দায়িত্ব নিয়ে হিমসিম খেয়ে যাই চব্বিশ ঘণ্টা আর তুমি? বসে বসে প্রেম কর। আনথিংকেবল। ফাউডালিটি ছাড়া, আর কোনও গুণই ছিলও না অবশিষ্ট। এখন দেখছি, সেটাও গেছে। সেখানেই তো সব টাকা ঢেলে আসছ। তোমাকে আর দেবে কী? এই কটা টাকাতে আমি সংসার চালাতে পারব না বলে দিচ্ছি। এভাবে মানুষ বাঁচতে পারে? কোনও মানুষ এভাবে বাঁচে না। বিয়ে করেছিলে কেন তুমি? কী রাইট ছিল তোমার, আমার জীবনটা এমন ভাবে নষ্ট করবার? আমার বাবা, সারেঙ্গী বাজিয়ে আর বড়লোকের মোসাহেবি করে ফ্যামিলি মেইনটেইন করতেন না, কুর্চির বাবার মতো। কুর্চি! রিয়্যালী! কী টেস্ট হতে পারে এক একজন মানুষের।
ভাবনার বাইরে।
রুষা!
থমথম করে উঠল পৃথুর গলা।
মনে হল, বাঘ ডেকে উঠল জঙ্গলের মধ্যে, সন্ধের মুখে।
থমকে গেল রুষা।
পৃথুর এমন গলা বেশি শোনেনি রুষা।
পৃথু বলল, কুর্চির বাবা নিমুকাকা সম্বন্ধে তুমি কিছুই জানো না। স্যুট না পরলে, ইংরিজিতে পণ্ডিত না হলে কি সিভিল সার্ভিসের অফিসার না হলেই মানুষ কিছু অমানুষ হয়ে যান না। তোমার কথাবার্তা তোমার বংশ পরিচয়ের আদৌ যোগ্য নয় রুষা। ভবিষ্যতে কখনও এমনভাবে কথা বোলো না কারও সম্বন্ধেই। অন্যকে সম্মান দিও; তবে নিজেও সম্মান পাবে।
সম্মান কী করে পেতে হয়, তা তোমার কাছে শিখব না আমি!
শুধু আমার কাছে কেন? সকলের কাছেই সকলের শেখার আছে। শেখার কি শেষ আছে রুষা? মৃত্যুর দিন অবধি মানুষ শেখে, অবশ্য শিখতে যে চায়। অন্য প্রত্যেক মানুষের কাছেই তার কিছু না কিছু শেখার আছে। বড় ছোট, গরিব বড়লোক, শিক্ষিত অশিক্ষিত।
তোমার বক্তৃতা শোনার সময় আমার নেই। আমি চললাম। দাঁড়াও। আমার চিঠি, কোনও চিঠিই ভবিষ্যতে তুমি খুলো না। শিক্ষিত মানুষমাত্ররই কিছু ব্যক্তিগত ব্যাপার থাকেই। সেই ব্যক্তিসত্তা তার নিজের। নিজেরই একার। সেখানে তার স্ত্রী, স্বামী, ছেলে মেয়ে, অফিসের বস কারওই প্রবেশাধিকার নেই। এটা গোপনীয়তার ব্যাপার নয় রুষা, এটা আধুনিক মানুষের বেঁচে থাকার একটি অত্যন্ত জরুরি শর্ত। তোমার ব্যক্তিসত্তা তোমার, আমারটা আমার। আমার ব্যক্তিগত জগতে তোমার প্রবেশাধিকার নেই কোনও।
বড় বড় বাংলা বোলো না। আমি বাংলা ভাল বুঝি না। তবে যা বললে, তা পুরোপুরিই রেসিপ্রোকাল সবসময়ই কথাটা মনে রেখো। উ কান্ট হ্যাভ দ্যা কেক এণ্ড ঈট ইট টু…। আরও একটা কথা। উ্যু মাস্টজেটিসান কুর্চি। শী ডাজনট বিলঙ টু আওয়ার ক্রীড আওয়ার কালচার, আওয়ার ক্লাস। শী ইজ আ নন-এনটিটি। আর তার বর! মাই গুডনেস। কোনও দিক দিয়েই কুর্চি তোমার যোগ্য নয়। তুমি মিসেস চ্যাটার্জির সঙ্গে কি আমার স্কুলের চুমকির সঙ্গে অথবা মহিলা সমিতির রাণি বা শান্তার সঙ্গে প্রেম করলেও আমার কিছুই বলার ছিল না। অফ ওল পার্সনস; কুর্চি!
পৃথু, এক টিপ নস্যি নিল মাথা পরিষ্কার করতে। হয়তো রুষাকে রাগাতেও।
সেদিন নীলিমাদি জিগগেস করছিলেন ক্লাবে, বাই এনী চান্স রায়নাতে যে ভাঁটু এবং কুর্চি বলে একটি কাপল এসেছে তারা কি মিঃ ঘোষের রিলেশান? আমিই এড়িয়ে গেছিলাম। বলেছিলাম, সকলেই ওয়েলপ্লেসড বা ফেমাস লোকের রিলেশানস বলে নিজেকে দাবি করেন। উ্যু নো। বুঝতেই পারেন!
নীলিমাদি হেসেছিলেন।
বলেছিলেন তা যা বলেছ ভাই! তোমার সামুদা এতবড় কোম্পানির নাম্বার টু বলেই হেঁদিপেঁচি সকলেই তার কাজিন বলে ক্লেইম করে। বরিশালে বাড়ি হলেই হয়ে গেল। ওল বরিশালিয়াজ ক্লেইম টু বী হিজ কাজিনস।
পৃথু বলল, আমি সামান্য লোক। সামুদার মতো বড় চাকরি করি না, অত বড় কম্পানিতে তো নয়ই। ওঁর সঙ্গে আমার কোনওদিক দিয়েই তুলনা হয় না।
কথা ঘুরিও না। একটা উদাহরণ দিলাম। প্লীজ পৃথু। প্লীজ! লেন্ড. মী ইওর ইয়ারস। এ ব্যাপারে আমি স্টাবর্ন। এবং স্টাবর্ন থাকব। এসব ইন্ডিয়াটিক সিলী ব্যাপার আমি স্ট্যান্ড করব না। তোমাকে পরিষ্কার বলে দিচ্ছি। আমার কথা যদি না শোনো, তাহলে উ্য হ্যাভ টু রিপেন্ট ফর দ্যা কনসীকোয়েন্সেস।
ওক্কে। থ্যাঙ্ক উ্য।
পৃথুর মুখ দিয়েও হঠাৎ ইংরিজি বেরিয়ে গেল। সঙ্গগুণে কত কীই-ই ঘটে, কত অবিশ্বাস্য উন্নতি।
রুষা চলে গেলে অনেকক্ষণ পৃথু চেয়ারে গা এলিয়ে বসে রইল। পৃথু ভাবছিল, এই জন্যেই এদেশের কিছু হল না। হবে না। সব ব্যাপারে জাতপাত। স্ট্যাটাস। ক্লাস-কনশাসনেস। এমনকী ভালবাসার ব্যাপারেও। ভাবা যায় না!
বেচারি কুর্চি! কনভেন্ট-এ পড়াশুনো করেনি। বাবা বড়লোক ছিলেন না। অতএব সে একটি মানুষই নয়। রুষার অ্যাপ্রুভড স্ট্যাটাসের অন্য যে-কোনও মহিলার সঙ্গে পৃথুর কোনও মিষ্টি সম্পর্ক থাকলে, সেটা রুষা সহ্য করত। কিন্তু কুর্চির সঙ্গে সম্পর্ক। নো। নেভার। ভাবাই যায় না।
কান দুটি গরমে ঝাঁ ঝাঁ করছিল পৃথুর। কুর্চির পাঠানো খামটি খুলেই নিরস্ত হয়নি রুষা। চিঠিটি পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করেছিল। কিছুটা ছিঁড়েওছিল। পরে হয়তো কী মনে হওয়াতে, এনে দিয়েছিল।
পৃথুদা,
আজ ভাঁটু জবলপুর গেছে সকালে। এখানে বুধবার একাই আছি। দাঈ যদিও আছে, কিন্তু আমার ভয় করে। আপনি এলে, বেশ আমাকে পাহারা দিতে পারতেন।
এইটুকু পড়েই পৃথুর মনে হল, বাঃ। কুর্চি তো বেশ লিখেছে!
কুর্চিকে পাহারা সে নিশ্চয়ই দিত কিন্তু পৃথুকে পাহারা দিত কে? ভয় কি শুধু চোর-ডাকাত-আর জংলি জানোয়ারকেই? মানুষের নিজের মনের মধ্যে শরীরের মধ্যে যেসব ভয়াবহ জন্তু-জানোয়ার চোর-ডাকাত বাস করে তাদের হাত নিজেকে পাহারা দেওয়া যে কত কঠিন কাজ তা কি কুর্চি জানে?
আবার মনোনিবেশ করল চিঠিতে।
“সাড়ে সাতটাতেই খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লাম। আজ বায়গনভাত্তা করেছিলাম, পেঁয়াজকুঁচি কাঁচালঙ্কা টম্যাটো ধনেপাতা দিয়ে। ঠিক আপনি যেরকম পছন্দ করেন। খেতে বসে আপনার কথা খুবই মনে পড়ছিল।
তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার কারণও ছিল। কানহা ন্যাশনাল পার্কএ জন্তু জানোয়ার অনেক বেড়ে যাওয়ায় এদিকে সন্ধের পর নানা জানোয়ারই চলে আসে। বুনোশুয়োর, ভালুক, খরগোশ, হরিণ এসব তো অনেকই; মাঝে মাঝে ফেউ-এর ডাকও শুনি।
গত সপ্তাহে তো এক কাণ্ডই ঘটে গেল! বিকেলে চা খেয়ে বাড়ির পেছনের সবজি বাগানে গেছি সালগম আর লেটুস গাছেদের তদারকি করতে। হঠাৎই অদ্ভুত ডাক শুনে চমকে চেয়ে দেখি একদল ঢোল জঙ্গল থেকে একটি হরিণকে ধাওয়া করে নিয়ে যাচ্ছে মুখে, চাপা, সংক্ষিপ্ত, কিন্তু উত্তেজিত সম্মেলক ডাক ডাকতে ডাকতে। আমাদের বাড়ির পেছনের টাঁড়ে ঝাঁটিজঙ্গল এবং অনেকই নালা আছে। খোয়াই। আপনি হয়তো লক্ষ করে থাকবেন। হরিণটা একটি নালার মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল হঠাৎই হোঁচট খেয়ে। অথবা কী জানি, এক লাফে পেরোতে পারল না বোধহয়। এবং সঙ্গে সঙ্গে ঢোলগুলো এসে পড়ল তার উপরে।
কী বলব পৃথুদা পনেরো মিনিটের মধ্যে হরিণটাকে নিশ্চিহ্ন করে খেয়ে চলে গেল ওরা আবারও জঙ্গলে। টাঁড়, খোয়াই এবং ঝাঁটিজঙ্গল পেরিয়ে, পড়ে থাকল শুধু হরিণের শিংটা। ওদের চোখে শুধু খিদেই ছিল না বীভৎসতাও ছিল; প্রতিহিংসার আগুন, বেহড়ের ডাকাতদের চোখে যেসব থাকে।
দেখে, গা গোলাতে লাগল আমার। তাও তো হরিণটা পুরুষ, তাই-ই তার কিছু স্মৃতি রয়ে গেল। পড়ে-থাকা শিং-এর মধ্যে। মেয়ে হরিণ হলে তার কিছু মাত্রই অবশিষ্ট থাকত না। এদেশে মেয়ে জাতীয়রা খাদ্য হলে, উচ্ছিষ্ট হয়ে থাকার গ্লানি থেকে তারা মুক্ত হয়। তাদের মৃত্যুতে কোনও ফাঁক-ফোকর থাকে না। এইটুকুই আনন্দ।
এ তো জঙ্গলের কথা। জঙ্গলের ঘটনা। মানুষের জঙ্গলেও এমন কত ঘটছে রোজই। তা দেখার চোখ কজনেরই বা আছে বলুন?
আজ বোধহয় অমাবস্যা। বাইরের ঘন অন্ধকার এবং দাঈয়ের কোমরের বাতের ব্যথা বাড়ার কারণে আজ যে অবশ্যই সে বিষয়ে নিশ্চিতই হচ্ছি একরকম। শোওয়ার ঘরে খাটে শুয়ে আপনাকে চিঠি লিখছি। খাওয়ার পর বাতি নিবিয়ে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে একটু দাঁড়িয়েছিলাম। আকাশ ভরা তারা। জ্বলজ্বল করছে। হেমন্তের আকাশে।
কতদিন আপনার সঙ্গে জঙ্গলে যাই না, না? বারে বারেই মনে হয়, সেই বহু-উচ্চারিত তবু-না-পুরনো রবীন্দ্রনাথের গানটি।
আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি?
তারপরই মনে হয়, রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।
বানিয়ে বলিনি কিন্তু। আছেই যে, তা আমার মতো সত্যি করে আর কেউই জানে না।
পৃথুদা, মনে পড়ে, একদিন আপনিই বলেছিলেন যে, আপনি অগ্নিদেবের মতো একা। তাঁর পরিবার পরিজন কেউই নেই।
তা শুনে আমি বলেছিলাম মোটেই নয়। আপনি চন্দ্র। যার সাতাশ জন পরমাসুন্দরী স্ত্রী। আপনি হেসেছিলেন শুনে। বলেছিলেন, চন্দ্রদেব খুবই রূপবান। শুধুমাত্র এই কারণেই আমি চন্দ্ৰত্বর পরীক্ষাতে ডিসকোয়ালিফায়েড।
অগ্নিদেবের কথা আপনি বলেছিলেন। অগ্নিদেব একা একা আকাশে ঘুরে বেড়াতেন। নিজের মনে। এমনিই ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই একদিন সপ্তর্ষির সাত স্ত্রীকে দেখতে পেলেন। রূপের ছটায় জ্বলজ্বল করছিলেন তাঁরা। তিনি তাঁদের পেতে ইচ্ছা করলেন। এবং সেইমতো প্রস্তাবও পাঠালেন। তাঁদের কাছে। কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হলেন। এই অপমানে অগ্নিদেব গভীর জঙ্গলে বসে ধ্যান করতে লাগলেন। লজ্জায় তিনি প্রাণ ত্যাগ করতে চাইলেন। তখন দক্ষ কন্যা স্বাহা অগ্নিদেবের মতো দেবতার এমন কাণ্ড দেখে বড় দুঃখ পেয়ে নিজের রূপ পরিবর্তন করে অঙ্গিরার স্ত্রী শিবার রূপ ধারণ করে অগ্নিদেবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। অগ্নিদেব স্বাহাকে গ্রহণ করলেন এবং স্বাহাই হয়ে গেলেন অগ্নিদেবের স্ত্রী।
কিন্তু আকাশের স্বর্গের অগ্নিদেবও তো পুরুষ এই ধরাধামের পুরুষদেরই মতো! একই নারীতে চিরজীবন আসক্ত থাকা বোধহয় পুরুষের ধর্ম নয়। মানুষ, পিশাচ, দেবতা, যাইই সে হোক না কেন পুরুষ হলেই বোধহয় এ নিয়ম খাটে!
স্বাহা থাকতেও সপ্তর্ষির সপ্ত স্ত্রীদের পাবার ইচ্ছা অগ্নিদেবের গেল না। স্বাহা বেচারি পড়লেন অন্তর্দ্বন্দ্বে। একবার অঙ্গিরার স্ত্রী শিবার রূপ গ্রহণ করে শিবাকে, অগ্নিদেবকেও এবং নিজেকেও মিথ্যাচারের শিকার করেছেন তাইই আবারও ঋষিদের স্ত্রীদের রূপ ধরতে তাঁর আর ইচ্ছে গেল না। স্বাহা, অন্য অনেক মানুষীরই মতো ভাবলেন, পাখি হয়ে এই অনল-বনের বাইরে উড়ে গিয়ে শান্ত হবেন। শুধু ভাবাই নয়। যেহেতু তিনি মানুষী নন, সেইহেতু তা করতেও পারলেন। পাখি হয়ে উড়ে এক পাহাড়ের চূড়োতে গিয়ে আশ্রয় নিলেন।
কিন্তু হলে কী হয়। জাতে তো নারীই! অগ্নিদেব নিজের একমাত্র স্ত্রী, যাঁকে ইচ্ছেমতো কাছে পাওয়া যেত, যার উপর সবরকম দাবিদাওয়া আদর-অত্যাচার চলত, তাঁকে কাছে না পেয়ে দিশাহারা হয়ে উঠলেন। বউ-পালানো যে-কোনও পুরুষ মানুষেরই মতো। পাহাড় চূড়ো ছেড়ে উড়ে এলেন স্বাহা। আগে তো তিনি শিবার রূপ ধরেইছিলেন এখন সপ্তর্ষির ছয় ঋষির স্ত্রীদের রূপ ধরে অগ্নিদেবকে নিত্যনতুন নারী হয়ে সন্তুষ্ট করতে লাগলেন। কিন্তু পারলেন না শুধু তেজবান বশিষ্ঠর তেজবতী স্ত্রী অরুন্ধতীর রূপ ধরতে। সাহসে কুলোল না। আমার যেমন কখনও সাহসে কুলোবে না রুষা বৌদির রূপ ধরতে, আপনি যদি কোনওদিন অগ্নিদেব হয়ে এই স্বাহার কাছে আসেনও। থুরি এই স্বাহা যদি কখনও…
এদিকে স্বাহা গর্ভবতী হলেন। একটি পুত্রর জন্ম দিলেন। অদ্ভুতদর্শন হল ছেলেটি। ছেলেটিকে কিন্তু তিনি অগ্নিদেবের কাছে রাখলেন না। যে সন্তান, ছলার মধ্যে দিয়ে আসে তাকে হয়তো কোনও নারীর পক্ষেই তার সহবাসের পুরুষের কাছে রাখতে ভয় হয়। পুরুষমাত্রই বাঘের মতো। নিজ ঔরসজাত শিশুকে ছিন্নভিন্ন করতে তাদের বিন্দুমাত্রও বাজে না।
দেখুন কী লিখতে বসে কত কীই লিখে ফেললাম। অপ্রাসঙ্গিক। বাচালতা। হচ্ছিল, তারা দেখার কথা! যেখান থেকে কত কথায়ই এসে গেলাম।
হেমন্তের নির্মেঘ উজ্জ্বল কালো আকাশে চেয়ে সেই গানটির কথা মনে পড়ে গেল পৃথুদা। আমার গলায় যে গানটি শুনতে খুব ভালবাসতেন আপনি। “হিমের রাতে ঐ গগনের দীপগুলিরে হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে।…
দেবতারা আজ আছে চেয়ে, জাগো ধরার ছেলে মেয়ে, আলোয় জাগাও যামিনীরে। এল আঁধার দিন ফুরালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো, জ্বালাও আলো আপন আলো জয় করো তামসীর”।
পৃথুদা, অল্পবয়সের অনেক বিশ্বাস, আশা এবং কল্পনায় ভরপুর হয়ে যখন এই গান গাইতাম তখন মনে হত খুব সহজ বুঝি। আলো জ্বালিয়ে তামসীকে দূর করা খুবই সহজ। এখন বুঝি, কত কঠিন। কী সীমিত আমার ক্ষমতা, কী ক্ষুদ্র আমার এই মুঠি; মুঠির জোর। আমার হাতে যে জোনাকির আলোটুকুও নেই।
ভাবলেও খারাপ লাগে বড়।
ঘুম এল না বলেই চিঠি লিখতে বসেছিলাম। কিছুতেই ঘুম আসছিল না। কত কথাই যে মনে আসে এলোমেলো। জানি না, ভগবানের কী ইচ্ছা! বেশ তো ছিলাম দূরে গিয়ে। কেন যে আবার আপনার এত কাছে ফিরে এলাম। কী যে হবে আমার! ভাবলেও, ভয় করে।
অনেক বড় হয়ে গেল চিঠি। তার দোষ আপনার। চিঠি লেখা আপনার কাছ থেকেই শেখা। তখন বুঝতাম না, এখন বুঝি, আপনার কথা। আপনি বলতেন, চিঠির মধ্যে দিয়ে আমরা একে অন্যকে এত আগল-হীন, স্পষ্ট, এবং কাছাকাছি করে পেতে পারি যে, তেমন করে মুখের কথাতে কখনওই পাই না।
যার পাওয়া, শুধু মুখের কথা অথবা চিঠিতেই সীমাবদ্ধ থাকে সারাজীবন তার কাছে অবশ্য চিঠিই ভাল। স্বাহারা চিরদিন স্বাহাই থাকে পৃথুদা। অন্য নারীর রূপ ধরে ছলনা করে অন্য নারীর সঙ্গে সঙ্গমেচ্ছু পুরুষের সঙ্গে সহবাস করে। এবং তার সন্তানকে নির্বাসন দেয় পাহাড়ে জঙ্গলে। স্বাহার আনন্দ বলতে মাঝে মাঝে পাখি হয়ে বনে বা পাহাড়চূড়োয় উড়ে যাওয়া। তাও, তা আকাশপথের স্বাহারাই পারে একমাত্র। মর্তর স্বাহাদের ওড়াউড়ি, পাখি হয়ে পালিয়ে যাওয়া শুধু মনে মনেই।
বাইরে টি-টি পাখি ডাকছে ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে। খুব জোরে জোরে। ঘুরে ঘুরে। কোনও জানোয়ার দেখেছে কি? খোলা জানালা দিয়ে হেমন্তর বনের আর আকাশের আর তারাদের আর পাখিদের গন্ধ ভেসে আসছে। বড় শান্ত মন-খারাপ করা গন্ধ এ। হেমন্তর হিমের রাতের অন্ধকারের অ্যানোডাইজ-করা জড়ি-মোড়া জরায়ুর গন্ধ এ।
এখন কী করছেন পৃথুদা? এখন রাত দশটা। আমি যখনই একা থাকি তখনই আপনার কথা ভাবি। আপনি কি কখনও আমার কথা ভাবেন? একবারও? খুব জানতে ইচ্ছে করে।
টেলিপ্যাথি বলে কি সত্যিই কিছু আছে? আছে কি নেই এরপর যেদিন দেখা হবে তখনই বুঝতে পারব। সুখে থাকবেন সবসময়।
—ইতি আপনার কুর্চি।
—চিঠিটা পড়া শেষ করে অনেকক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকল পৃথু। পৃথু ভাবছিল, স্বাহা তাহলে আসলে শিবা নয়। অঙ্গিরার স্ত্রী শিবা আসলে জানেই না যে, স্বাহা তাকে…।
আশ্চর্য! এই সব কথা একদিন ও নিজেই নাকি বলেছিল কুর্চিকে! ওইই ভুলে গেছে। কিন্তু কুর্চি মনে করে রেখেছে।
বড় বেশি মনে রাখে মেয়েটা। মনে রাখার মতো পাপ, মূর্খামি এ সংসারের আর দুটি নেই। যে ভুলতে না পারে, তার মৃত্যু অবধারিত!
দুখী এসে বলল, খনা লগা দিয়া সাহাব!
হঠাৎ দুখী! মেরী কোথায়?
ভাবল পৃথু।
বলেও ফেলল দুখীকে।
দুখী বলল, ঘর চলা গ্যয়া।
ঘর? কাহে?
কাল সুব্বে রায়না যায়েগী মেরী বহিন।
রায়না? কাহে?
মেমসাব এক খাত ভেজিন মেরী বহিন সে। মেমসাবকা কোঈ রিস্তেদার হ্যায় না হুঁয়া? উও মোটে বাবু, ভাঁটুবাবু। আয়া থা না উসদিন? উনহিকা পাস।
শংকিত হল পৃথু মনে মনে। কোন নিউক্লিয়ার বোমা পাঠাল রুষা কে জানে? বেচারি কুর্চি।
আইয়ে সাব।
দুখী আবার বলল।
ক্যা খনা বনায়া লছমার সিংনে আজ?
অ্যাসপারাগাস স্যুপ। ফ্রায়েড চিকেন। স্যালাড ঔর সুফলে।
ধুসসস…স…।
স্বগতোক্তি করল পৃথু।
ক্যা সাব? আপ নারাজ হ্যায়?
আমি খাব না রে। মেমসাহেবকে বলে দিস।
কাহে সাব?
কী জ্বালা! এও দেখি, মেরীরই ভাই।
পালা। পালা। যা! বলছি, পালা।
দুখী চলে গেলে, দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল পৃথু।
আজ রাতে হাতে-গড়া গরম গরম পাতলা মুচমুচে রুটি, তার সঙ্গে কুর্চি যেমন করে বানায় তেমন করে বানানো বায়গনভাত্তা। সঙ্গে আঁওলার আচার আর ক্ষীরার রাইতা। বেশ হত তা হলে।
আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ল ও। রাতের দ্বিতীয় প্রহরেই।
জানালা দিয়ে আকাশে চেয়ে ছিল পৃথু। খানা-কামরা থেকে স্যুপ-প্লেটে স্যুপ-স্পুনের ঠোকাঠুকির আওয়াজ আসছে তখন। একটি শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত, নিয়মবদ্ধ, সুধন্য সাহেবি পরিবার ডাইনিং-টেবলে বসে। ন্যাপ্কিন সাজানো, যেখানে যেটি থাকার কথা। মাছ এবং মাংস খাওয়ার আলাদা আলাদা ফর্ক। কোথাওই কোনও অমিল নেই। নেই ছন্দপতন।
তার ছেলে এবং মেয়ে নিখুঁত টেবলম্যানার্স-এর পরাকাষ্ঠার সঙ্গে মায়ের সঙ্গে ডিনারে বসেছে।
জানালা দিয়ে হেমন্তর উজ্জ্বল তারাভরা স্নিগ্ধ কালো আকাশ দেখা যায়। পেঁচারা ঝগড়া করে পিছনের টাঁড়ের উপরে উড়ে উড়ে। ঘুরে ঘুরে। কিম্ভুতকিমাকার বেসুরে। কিঁচি-কিঁচি-কিঁচর কিঁচি-কিঁচির র্…
কোথাও প্রেম নেই, কারওই নেই। বড়ই ঝগড়া চারদিকে। ভাল লাগে না পৃথুর। পৃথু বড়ই কাঙাল একটু ভালবাসার, আদর যত্নর; তাইই বোধহয় ওর জীবনে এমনটি হল।
ওর খুবই ইচ্ছে হয় এমন অন্ধকারে উদ্বেল আকাশে পাখি হয়ে উড়ে যায়। তারপর আঁশটে-গন্ধ ডানায় তারাকুচি মেখে, শিশিরে এবং ভিজে ধুলোর গন্ধ মেখে পৌঁছে যায় সেই পাহাড়চূড়োয়, যেখানে অন্য এক নরম সাধের পাখি, সুখের পাখি দুখের পাখি হয়ে স্বাহা উড়ে আসবে। অন্ধকারের মধ্যে, অন্ধকারতর একটি কালো বিন্দুর মতো।
ঘর অন্ধকার। বাইরে অন্ধকার। আকাশে অন্ধকার। সব অন্ধকার। মানুষ-মানুষীর যা-কিছু সুন্দর অনুভূতি, পাওয়া, যা কিছু আশ্লেষে চাওয়া সব তো অন্ধকারেই! ভাল খুবই ভাল তুমি! কালো, নরম, তারাকুচি আর শিশির-ধোওয়া হেমন্তর এই হিমেল অন্ধকার! তুমি আলোর চেয়েও ভাল গো! হতভাগা, এই সংসারের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত পৃথুর না-বওয়া চোখের জল তারাদের গায়ে বিন্দু বিন্দু আলো হয়ে স্পন্দিত হতে থাকে। হতে থাকবে সারা রাত। দেবতারা সব আছে চেয়ে। গাছেরা, পাহাড়েরা, নদীরাও সব চেয়ে থাকে। পৃথু তো ওদের মধ্যেই বেঁচে আছে, বেঁচে থাকবে একটা অসভ্য অশিক্ষিত জঙ্গুলে মানুষ।