২৫
ঠুঠা বাইগা আর দেবী সিং মস্ত একটি ঝাঁকড়া কদম গাছের নীচে বসেছিল।
গাছটি পাহাড়ের একেবারে পায়ের কাছে। পাহাড়ে কিছুটা উঠলেই একটি গুহা। ভেবেছিল, রাতটা সেই গুহাতেই কাটাবে। কিন্তু সূর্য ডোবার কিছু আগে সেখানে পৌঁছে আবিষ্কার করেছিল যে, এক ভালুক পরিবারের আস্তানা সেটা। খামোখা ঝামেলা বাড়াবে না ঠিক করেই নেমে এসে ওই গাছের নীচেই আগুন করেছিল দুজনে মিলে। বন্দুকদুটো সঙ্গে আছে বটে কিন্তু শিকারে তো আসেনি। তাই নেহাত দরকার অথবা দায়ে না ঠেকলে ব্যবহার করবে না। বিকেলে ঠুঠার গাদা বন্দুক দেগে একটি বড় ময়ূর মেরেছিল। পালক-টালক ছাড়িয়ে নিয়েছে। আগুনে ঝলসে নিয়ে খাবে পাথুরে নুন আর সঙ্গে নিয়ে আসা কাঁচা লঙ্কা দিয়ে। এইই ওদের রাতের খাবার আজ।
জায়গাটা যে ঠিক কোথায় তা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি ওরা। এমন বড় একটা হয় না। জঙ্গলের পোকা যারা, তাদের পথভুল হয় না সচরাচর জঙ্গলে। কিন্তু আজ দুপুর থেকেই মেঘ করে এসেছিল। তারপর ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকের সঙ্গে বৃষ্টি। থেমেছে সামান্য আগেই। গাছের পাতা থেকে এখনও জল চুঁইয়ে পড়ছে। বিকেল থেকে জলে ভিজে, দুজনেরই ঝোড়ো কাকের মতো অবস্থা।
দেবী সিং বলল, আজ একটু মহুয়া থাকলে খুব ভাল হত। জ্বর-জারি না হয়ে যায়! শরীরের জওয়ানী তো আর নেই। আগের মতো সয় না আর অত!
জওয়ানীর কমই বা কী আছে? বুড়ো ভাবলেই বুড়ো। আমার তো মনে হয় সেই আগের মতোই আছি।
মনে করছ তাই। আসলে কি আর আছ! বিয়ে-শাদী তো করোনি। জওয়ানীর পরীক্ষাও দিতে হয় না তোমাকে।
কথাটা, হাঃ করে এক পক্কড় হেসে, উড়িয়ে দিল ঠুঠা। কথা ঘুরিয়ে বলল, একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম কাল রাতে। বুঝলে, দেবী সিং।
কী স্বপ্ন?
অদ্ভুত স্বপ্ন একটা।
কী?
নাঙ্গা বাইগীন একেবারে আমার সামনে দাঁড়িয়ে। বললেন, পাবিরে ঠুঠা বাইগা, পাবি ফিরে তোর গ্রামকে। যে এমন করে চায় তাকে আমি সবই দিই। সব।
কবে?
বোকার মতো জিজ্ঞেস করলাম আমি নাঙ্গা বাইগীনকে।
সময় হলেই পাবি। তোকে পেতেই হবে। যখন পাবি; তখন তোকে কিন্তু একটা কাজ করতে হবে আমার জন্যে।
কী কাজ?
বলব। সময় হলেই বলব। আবারও আসব আমি। কবে?
সময় যখন হবে। যখন আসব, তখন ফেরাবি না তো আমাকে। যদি ফেরাস, তাহলে…।
তাহলে?
দেবী সিং চুট্টায় টান দেওয়া থামিয়ে চোখ চোখ বড় বড় করে শুধোল।
“তাহলে”, বলেই, চোখেমুখে ভয়াবহ এক ভঙ্গি করেই মিলিয়ে গেলেন বাইগীন।
সে কী?
হ্যাঁ। আমার নিস্তার নেই দেবী সিং।
মুখ নিচু করে বসে আগুনের দিকে চেয়ে ঠুঠা ভাবছিল মনে মনে, যখন প্রথম হারিয়ে-যাওয়া গ্রামের খোঁজ করতে শুরু করি তখন তাগিদটা ছিল আমার। আমারই একার। ইদানীং লক্ষ করি, কে যেন ভিতর থেকে তাড়া লাগায় সবসময়। কে যেন বলে, কী করছিস তুই ঠুঠা, এই কারখানায় বসে? জঙ্গলে যা। ফিরে যা। যেখানে তোর জন্ম, যে ধুলোয় তোর ছেলেবেলা, যে নদীতে তোর ঝাঁপাঝাঁপি, যে ফুলের মালা গেঁথে তোর জীবনের প্রথম নারী তোকে নরম ঘাসের বিছানাতে বরণ করেছিল, ফিরে যা সেই ফুলের বনে। সেই শিশির ভেজা ভোরে, তিতির-ডাকা বিকেলে, সেই আলো-ছায়ার মেঘ-মেদুরের বনে। যা। যারে ঠুঠা, যা।
দেবী সিং আগুনটাকে নাড়া-চাড়া দিয়ে জোর করল একটু। উবু হয়ে ফুঁ দিল দুবার। নিভে-যাওয়া চুট্টাটাকে ধরিয়ে নিল একটি ঘাস আগুনে ধরিয়ে নিয়ে। তারপর গাছে হেলান দিয়ে পা দুটি লম্বা করে মেলে দিল আগুনের দিকে। জমি ভিজে ছিল তখনও। ত্রিপলের টুকরোটুকু বিছিয়ে পাশাপাশিই বসেছে দুজনে। রাতেও পাশাপাশিই শোবে।
কাল রাতেও ওরা ছিল একটি গুহাতে। সেই গুহার গায়ে ফিকে লাল আর হলুদ রঙে আঁকা ছবি ছিল অনেক। খুব বড় বড় মৌচাক ছিল গুহাটার চারপাশে। দাঁতাল মস্ত বড় বুনো শুয়োরটাকে শিকার করেছে একদল মানুষ তীর-ধনুক আর বল্লম দিয়ে, এইই আঁকা ছিল সে ছবিতে। কে জানে? কত হাজার বছর আগে তাদেরই পূর্ব পুরুষরা এইসব গুহাতে বাস করত! কেমন দেখতে ছিল তাদের তাই-ই বা কে জানে? কী তারা খেত? কী পরত? কেমন ছিল তাদের জীবনযাত্রা? তাও জানে না ওরা। কী রঙ দিয়ে এঁকেছিল এই সব ছবি পাহাড়ের গায়ে তাও জানা নেই। কত গ্রীষ্মের ঝিম-ধরা মরীচিকা-ওড়ানো তাপ, কত বর্ষার উথাল-পাথাল ঝোড়ো তাণ্ডব, কত শীতের শান্ত মন-খারাপ-করা আর্তি বুকে মুখে চোখে, শরীরের অণুতে অণুতে ধরে রেখেছে সেইসব গুহা-ছবি, তাইই বা কে জানে? গুহা তবু একটুও ম্লান হয়নি, মোছেনি ছবিগুলি। রাতে সেই গুহাতে শুয়ে মনে হচ্ছিল দেবী সিং-এর, যেন ও কয়েক হাজার বছর পেছনে হেঁটে গেছে।
কাল বেশ ভাল কেটেছিল রাতটা। কী বলো?
হঠাৎই দেবী সিং-এর ভাবনার রেশ কেটে দিয়ে ঠুঠা বলল।
হুঁ। নিশ্চয়ই!
অনেকদিন পর নাচগানও হল একটু। গুহা থেকে নেমে, নদীপারে বানজার-বামনি বস্তিতে না গেলে মজাই হত না কিন্তু। তবে, গাওয়ান বুড়োকে দেখে কষ্ট হচ্ছিল বড়। এখনও কী সুন্দর চেহারা তার। দু কানে পেতলের মাকড়ি। আগুনের আভায়, সোনার মতো চকচক করছিল। সত্যি সোনা বোধহয় ওই রকমই দেখতে হয়। গায়ে, গুহার গায়ের ছবিরই মতো নানারঙা সুতোয় নকশা-তোলা লেপের জামা। টানটান হয়ে জোড়াসনে বসে থাকার ভঙ্গিটি। গাওয়ানও তো রাজাই হল। রাজাদের কিন্তু দেখলেই বোঝা যায়। রাজত্ব থাক আর নাইই থাক। রাজার ভাবভঙ্গি কিছু থাকেই।
তা বটে। তবে হলে কী হয়! গাওয়ান-এর ছেলেটা একটা অমানুষ হয়েছে। বুড়ো হয়েও, বেঁচে থাকার এই এক মস্ত কষ্ট। ছেলেমেয়ে যদি মানুষ না হয়, তাহলে একজন মানুষ জীবনভর যাইই গড়ে তুলুক না কেন তার দু হাতের মেহনতে, তা বালির প্রাসাদের মতোই ভেঙে পড়ে।
যা বলেছ! ঠুঠা বাইগা বলল। এই জন্যেই তো বিয়ে করিনি। নিজের কৃতকর্মের জন্যে নিজে দায়ী থাকতে রাজি আছি। রাজি, নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতেও। কিন্তু যে পাপ-পুণ্যের উপরে আমার নিজের বিন্দুমাত্র হাত নেই সেই পাপের বোঝা আর পুণ্যের আনন্দে আমার মোট্টে দরকার নেই। অবশ্য মানুষ হওয়া বলতে তুমি বা গাওয়ান কী বোঝো জানি না। গাওয়ানের ছেলেটা টাকা রোজগার করে না বটে কিন্তু ভারী সুন্দর বাঁশি বাজায়। শুনলে না কাল? যাইই হোক, বিয়ে-টিয়ে না করাই ভাল।
তুমি বলছ বটে। কিন্তু বিয়ে করে না কটা লোক?
না দেবী সিং। তুমি যাইই বলো, আমি বলব, মানুষও কেন ভেড়ার দলেরই মতো হবে?
সবাইই যা করে, আমার তা করতে কখনওই ইচ্ছে করেনি। অন্যের হাতের শালের দোনা থেকে জীবনের মহুয়া আমি খেতে চাইনি দেবী সিং। বাঘের মড়ি দেখে যেমন কোথায় মাচা বাঁধব, বাঘের শরীরের কোথায় গুলি করব, ঠিক সাদা আর কালো ডোরার কাটাকুটির জায়গায়, তাও যেমন ঠাণ্ডা মাথায় ঠিক করেছি, তেমনই জীবনের বেলাতেও না ভেবেচিন্তে কোনও কিছুই করিনি আমি।
দেবী সিং-এর দু চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেই নিবে গেল। ওর চোখে একটু বিব্রত ভাবও খেলে গেল। তারপরই ওর দরাজ হাসি হেসে প্রসঙ্গান্তরে গেল দেবী সিং। বলল, যা হবার তা তো হয়েই গেছে ঠুঠা এ জন্মের মতো। তোমার জীবন তোমার, আমার জীবন আমার। একটু হালকা কথা বল। মজার কথা বল। মহুয়া খাও, গান গাও। দুদিনের জীবন। কালকের গানগুলোই বরং আরেকবার গেয়ে শোনাও। যে গানগুলো বানজার-বামনির ছেলেমেয়েরা নেচে নেচে গাইছিল। ঠুঠা, তোমার গলা কিন্তু এখনও খুব ভাল আছে। বানজার-বামনির জওয়ান মেয়েগুলো তোমার দিকে এমন চোখে চাইছিল যে, আমার হিংসেই হচ্ছিল। সত্যি!
হাঃ।
হাসল ঠুঠা। চুট্টা ধরাল একটা।
বলল, তাকাচ্ছিল না আরও কিছু। আসলে তুমি কাল বেশি মহুয়া খেয়েছিলে।
তাইই? হবে হয়তো। মহুয়াই যেদিন খাব, সেদিন কম খাব কেন? কিন্তু যা আমি বললাম, তাইই ঠিক। কুকুরীদের মতো যুবতীরাও যৌবনের গন্ধ পায়। এ সবই ভগবানের বন্দোবস্ত। আমরা আর বুঝি কতটুকু!
হাসতে হাসতে বলল দেবী সিং।
তারপর বলল, গানগুলো শোনাও না! মনে নেই নাকি?
বা-রে! ও সব তো কার্মা নাচের গান। মনে না থাকার কী? এখন তুমি গান শুনবে? ময়ূরটাকে ঝলসাবে না?
আরে হবেখন। রাত তো পড়েই আছে। বৃষ্টির জন্যে অনেক আগেই অন্ধকার হয়ে গেছে না আজ!
তা ঠিক।
গলাটা, দুবার খাঁকরে পরিষ্কার করে নিল ঠুঠা। তারপর শুরু করল :
ছেলে বলছে মেয়েকে | : | চলো, সাজা-তেরিকা ডাবারি ছিছেলা যাব। |
পরশা ভাদারি মারে হুদারি লাগোদারি | ||
চলো টুরী কর্মা নাচালে খারানা যাবওও। |
চল মেয়ে, সাজা গাছের নিচের ঝর্ণায় মাছ ধরতে যাব। তোকে নিয়ে। তাড়াতাড়ি চলরে মেয়ে পা চালিয়ে। জঙ্গলে পেরিয়েই নাচের জায়গা খারানাতে গিয়ে পৌঁছব।
মেয়ে বলছে | : | রাত ভরা কর্মা নাচাইলে |
দিনাকে উগতমোলা ছট্টি দেই দেরি | ||
হাম’যাব, ঘরা ভাগি যাবওওওও… | ||
ছেলে | : | রাতভরা করামা নাচায়োঁ |
দিনাকে উগত টুরী ঘর লায়ি যাওওও…। | ||
মেয়ে | : | দাদা মোরা গালি দেহি, দাই মোলা মারহি |
নেহী যাউ টুরা তেরা সঙ্গা, ঘর নেহী যাউ টুরা | ||
বড়া ভারী কোমিটি ঘর বৈধ যাহিইই। | ||
ছেলে | : | আরে দাদালা দারু পিয়ারে, দাইলা দারু পিয়ারে |
যাবা সঙ্গত করকে খুশিয়ালিসে শাদী বানাবওওও… |
বাঃ! বাঃ!
বলে উঠল দেবী সিং। সত্যি! তারপর বলল, এসব গান শুনলে নিজেদের ছেলেবেলাতেই চলে যাই। তবে, আমাদের সময়কার নাচগানে ‘কেমিটি’র মতো ইংরিজি কথা-টথা থাকত না, এইই যা।
ঠুঠা বিজ্ঞর মতো বলল, ইণ্ডিপিণ্ডিরির পর দেশের লোক সবাই ইংরিশ বলাবলি শুরু করল। বলো দেবী সিং! শিকারের মওকায় সত্যিকারের কত্ব সাহেব-মেম আমরা গুলে খেলাম। এই দিশি ইংরিশ সাহেব-মেমদের হ্যাঁদাহেঁদি দেখে ওদের মুখে হিসি করে দিতে ইচ্ছে করে।
দেবী সিং বলল, এই তো কেমন মজার মজার কথা বলছ এখন ঠুঠা। তোমার মতো কথা। মাঝে মাঝে তোমার যে কী হয়। এতক্ষণ যে কী সব মাথা-ধরানো কথাবার্তা বলছিলে। ভাল লাগছিল না একেবারেই আমার। কী যে সব চিন্তা করো তুমি!
ঠুঠা হাসল একটু, আগুনের আলো দেবী সিং-এর চকচক করা চোখে চেয়ে। তারপর দিগা পাঁড়ের মুখে শোনা তুলসীদাসের শ্লোক আউড়ে দিল কড়াক করে। বলল, মানুষমাত্ররই চিন্তা থাকে দেবী সিং। “চিন্তা সাপিন কো নহি খায়া?”
মানে কী হল?
চমকে উঠে, দেবী সিং বলল, আবারও জ্ঞান দিচ্ছে ঠুঠা। জীবনের শেষে এসে এত জ্ঞানট্যান ভাল লাগে না আর।
চিন্তার সঙ্গে সাপের উপমা দিয়েছেন তুলসীদাস। চিন্তারূপী সাপ, কামড়ায়নি কোন মানুষকে? মানুষ হয়ে জন্মালেই এই সাপের কামড় খেতে হয়।
তা হয়তো হয়। কিন্তু, থাক থাক। রাত-বিরেতে আর সাপ সাপ করে কাজ নেই। একমাত্র ওই জিনিসকেই ভয় আমার জঙ্গলে। শঙ্খচূড়ের জবরদস্ত আড্ডা এ সব জায়গায়। তার উপর আবার বৃষ্টিও হল। শুতেও তো হবে মাটিতেই। এই গাছের নীচে।
আনো এবার ময়ূরটা। হঠাৎ বলল ঠুঠা। শালাকে বানাই। কত শঙ্খচূড় খেয়েছে এ ব্যাটা তা কে জানে!
দেবী সিং একটা বাঁশ কেটে টাঙ্গি দিয়ে চেঁচে সরু শিকের মতো করেই রেখেছিল। সেটা পালকছাড়ানো ময়ূরের সামনে থেকে পেছন অবধি সেঁধিয়ে দিল শক্ত হাতে। তারপর সেই ছুঁচোলো বাঁশের দুদিক দুজনে ধরে আগুনের উপর আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে ময়ূরটাকে সেঁকতে লাগল।
একটু ঘি থাকলে জমে যেত।
ঠুঠা বলল।
থাক। অনেক হয়েছে। খিদের সময় মাংস জুটছে জঙ্গলে এইই ঢের, তার আবার ঘি! যেন কতই রোজ ঘি খাওয়ার অভ্যেস দুজনের!
দুজনেই হেসে উঠল। দেবী সিং-এর কথায়।
ময়ূরের সাদাটে মাংস, অনেকটা মুরগির মাংসর মতো আগুনে পুড়ে প্রথমে লাল তারপর কালো হয়ে উঠতে লাগল। মাংস-পোড়া গন্ধও বেরুতে লাগল। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ঠুঠার মনে হল ওকেও একদিন এমনি করে পুড়ে যেতে হবে। তার নিজের গায়ের পোড়া মাংসর গন্ধ বেরুবে একদিন কোনও গভীর বনের ধারের নির্জন নদীপারের শ্মশানে! গা ছমছম করে উঠল ঠুঠার। ইদানীং এরকম হচ্ছে ওর প্রায়ই। কারা যেন ওর সঙ্গে কথা বলে জঙ্গলে এলেই, দিনে বা রাতে। একা নদীতে যেতে, বা জঙ্গলে হাঁটতেও অন্ধকারে ভয় করে আজকাল। ঠুঠা বাইগারও! যে একদিন দিনের এবং রাতের যে-কোনও প্রহরেই মাটিতে দাঁড়িয়ে বড় বাঘের মোকাবিলা করেছে আকছার। কেন যেন ঠুঠার মনে হচ্ছে, আজও রাতে নাঙ্গা-বাইগীন স্বপ্ন দেবে তাকে। নাঙ্গা-বাইগীন! আবারও গা ছমছম করে উঠল ওর।
ভাবছটা কী অত?
হঠাৎই বলল, দেবী সিং?
ঠুঠা চমকে চোখ তুলে চাইল। ওর হাতে-ধরা ছুঁচোলো বাঁশ-বেঁধা ময়ূরটা দুলে উঠল হঠাৎ হাত কেঁপে যাওয়ায়।
বলল, নাঃ। কী ভাবব, তাইই ভাবছি!
এমন সময় ওদের পেছনের পাহাড়ের উপর থেকে বাঘ ডাকল দুবার। বড় বাঘ। তার ডাক বৃষ্টি ভেজা জঙ্গলের দূর-দূরান্তরে ছড়িয়ে গেল। প্রস্তরময় পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে প্রতিধ্বনিত হল কিছুক্ষণ।
দেবী সিং বলল, যাঃ শালা। ইণ্ডিপিণ্ডিরির পর যত ফেমিলি-প্লেনিং সব আমাদেরই বেলায়। আর তোদের বংশবৃদ্ধি করতে সরকার বাহাদুরের কালঘাম ছুটে যাচ্ছে। যাঃ! বেঁচে গেলি। আমি আর ঠুঠা বাইগা এখন রিটিয়ার করেছি। সব রকম মারামারির সঙ্গেই ছাড়াছাড়ি এখন আমাদের।
ল্যাক ফ্যাক্টরির ক্যান্টিনে একজন মাঝবয়সী ওড়িয়া আছে। কালাহাণ্ডির ভবানী-পাটনা থেকে এক ওড়িয়া শিকারির ক্যাম্পের রাঁধুনি হয়ে এসেছিল বছর কুড়ি আগে। ছত্তিশগড়িয়া একটি মেয়েকে বিয়ে করে থেকে গেছে সে হাটচান্দ্রাতেই। এই মস্ত কদম গাছটির তলাতে বৃষ্টি ভেজা রাতে বসে তার কথা এবং তার গাওয়া একটি গানের কথা হঠাৎই মনে পড়ে গেল ঠুঠার। লোকটির নাম হল দুগগা মহান্তি। দুগগা মাঝে মাঝেই রাতের বেলা সুর করে ওড়িয়া রামায়ণ পড়ে আর গান গায়। ভারী ভক্ত মানুষ সে। এই গানটি তার বড়ই প্রিয়। গত কয়েক বছরে এতবারই শুনেছে যে, শুনে শুনে মুখস্থই হয়ে গেছে ঠুঠার।
“কদম্বমুলে কী এ পশিছি গো
নন্দনন্দনপরি কী এ দিশুথিব
সে যেরে রামহন্তা সঙ্গে সীতয়াথান্থা
লক্ষ্মণপরি মুখ দিশস্তা গো ও-ও-ও-ও-ও…
সে যে বেহরবন্তা সঙ্গে পার্বতী থান্তা
ডিবিডিবি ডম্বরু বাজন্তা
সে যে রে মেঘহন্তা গরজি বরষন্তা
চিকিচিকি বিজলী মারস্তা গো ও-ও-ও-ও…
দেবী সিং বলল, আবার কী ভাবতে বসলে ঠুঠা?
নাঃ। কিছু না। কী ভাবব, তাইই ভাবছি।
ঠুঠা ভাবছিল, নিজের সব ভাবনার কথা অন্যকে বলতেই নেই। লাভ হয় না কোনও। প্রত্যেক মানুষে মানুষেই নাঙ্গা বাইগা বড়ই তফাৎ করে রেখেছেন। এক একজন মানুষের ভাবনা একেক স্তরে চলে, একই আকাশে নানান জাতের পাখি যেমন নানা উচ্চতাতে ওড়ে। তেমনই।
খাওয়া দাওয়ার পর ওরা দু’জনে চুট্টা টেনে শুয়ে পড়েছিল। চারধার থেকে ঝরনার শব্দর মতো ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। একটানা।
দেবী সিং অঘোরে ঘুমোচ্ছে। কাৎ হয়ে। সুখী লোকদের ঘুমোতে দেরি হয় না। দু’ হাতের পাতা জোড়া করে ঘুমের মধ্যে যেন ক্ষমা ভিক্ষা করছে সে বড়হা দেবের কাছে। খেতি-জমিন, বউ, গাই-বয়েল, বোদে, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিতে ঘর ভরা দেবী সিং-এর। একটা মস্ত প্রাচীন, ঝাঁকড়া ঝুরি-নামানো অশ্বত্থাগাছের মতো মনে হয় ঠুঠার, দেবী সিংকে। সে না থাকলেও তার শিকড় সব থেকে যাবেই। সে যখন মারা যাবে, কাঁদবে তার আত্মীয় পরিজনরা। মুখে আগুন দেবে তার ছেলেরা।
আর ঠুঠার? না আছে তার শিকড়। না, থাকবে। যে-শিকড় ছিল একদিন তারই খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। পাবে কি? কে জানে? ঠুঠা ওর হারিয়ে-যাওয়া গ্রামের একলা শিমুলেরই মতোই একা। চলেও যাবে একা একাই।
রাত আস্তে আস্তে গভীর হচ্ছে। শেষ কার্তিকের বিকেলের অসময়ের বৃষ্টির পর আকাশ থম মেরে আছে। পেছনের কাছিম-পেঠা পাহাড়টা কিচুল রাজার মতো অন্ধকারের বালিশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে এখন অঘোরে। ঝিঁঝিঁ ডাকছে একটানা। সেই ডাক মাঝে মাঝে ছিদ্রিত হচ্ছে। বারবার একটি কুটরা হরিণের ভয়-পাওয়া, ঝাঁকি-দেওয়া, সংক্ষিপ্ত ডাকে। সেই গমগমে ডাকে বৃষ্টি শেষের নিথর মৌনী জঙ্গল চমকে চমকে উঠছে।
এখন জঙ্গলের অন্য রূপ। আরও কিছুদিন পর শীতের বেলা এলে হঠাৎ সদ্য বিধবার রুখু, বিষন্ন, উদাস রূপ নেবে এই জঙ্গল। গুড়িসুড়ি-মারা বুড়ি পাতারা এক দমকে দলবেঁধে দৌড়ে যাবে আগাছাশুন্য শুকনো মরা-খুসকির মতো মাটিতে। দৌড়ে যাবে কালো-সাদা পাথরে, শুকিয়ে যাওয়া পাহাড়ি নালাতে, বিছিয়ে থাকা সাদা প্রান্তরে। এক একবার থমকে থামবে, যেন কোনও অদৃশ্য দেবতার আঙুলেরই নির্দেশে। পরমুহূর্তেই আবার দৌড়ে যাবে। বনের বুকের মধ্যে থেকে ফিসফিস করে চাপা গলায় অদৃশ্য কারা যেন কথা বলবে। মৌটুসকি পাখি ডাকবে কিসকিস করে। কুঁচফুলের থোকা ফেটে লাল-কালো কুঁচফল ঝরে পড়বে মাটিতে। কোনও অদৃশ্য, হলুদ-বরণ সোনার বেণে সেই কুঁচফলগুলো তুলে নিয়ে শীতের শেষ বিকেলের পেতল-রঙা দাঁড়িপাল্লায় পশ্চিমাকাশের সোনা, ওর কৃপণ হাতে ওজন করবে।
ভর দুপুরের আলো-ছায়ার সাদা-কালো ডোরা-কাটা সতরঞ্জিতে এক্কা-দোক্কা খেলবে লাফিয়ে লাফিয়ে চিংকারা, কৃষ্ণসার আর চিতল হরিণীরা আমলকি বনের নীচে ঝরে-পড়া আমলকি খেতে খেতে। উদোম নীল আকাশে, উদলা বাতাসে ভেসে দিগন্তে উধাও হবে টিয়ার ঝাঁক চকিত-চাবুকের মতো ডাক ডাকতে ডাকতে। দিনান্তবেলায় একটি অতিকায় নরম লাল গোল বলের মতো সূর্যর রহস্য উন্মোচনের দুরন্ত দুর্মর আশায় তার লম্বা নড়বড়ে দুটি উড়ন্ত পা দোলাতে দোলাতে, কোনও অভিযাত্রী উৎসুক যুবক টি-টি পাখি সেই দিকে উড়ে যাবে হুট্টিটি-টি-টি হুট-টি-টি-টি-টি-হুট করে ডাকতে ডাকতে। তারপর একসময় সেই গলন্ত বিলীয়মান সূর্য কপ করে গিলে নেবে তাকে।
চাকরিতে ইস্তফাই দেবে ঠিক করেছে ও। কোম্পানির ম্যাটেরিয়াল ম্যানেজার, পিরথবাবুর বউ রুষা মেমসাব, ঠিকাদার ইদুরকার সাহেব এদের জীবনযাত্রা, রাহান-সাহান ভাল লাগে না ঠুঠার। পিরথুবাবু অবশ্য একটা অন্য জাতের মানুষ। সে যেন ওদেরই একজন। জঙ্গলে যখন থাকে তখন তাই-ই মনে হয়। ইংরিজি লেখা-পড়া, বিলেতের ডিগ্রি, বড় চাকরি, বাড়ি-গাড়ি টাকা-পয়সা এসবের কিছুই মানুষটাকে ছুঁতে পারেনি।
ঘুম আসে না ঠুঠার। এ পাশ ও পাশ করে। পাশ ফেরে। তারপর উঠে বসে রাতের বনের শব্দ শোনে। গন্ধ নেয় নাকে। নাভি থেকে টেনে। এই গন্ধ, তাকে চিরদিন যুবতীর গায়ের গন্ধর চেয়েও বেশি আকৃষ্ট করেছে।
উপরের গুহা থেকে ভালুক পরিবার নামল। এই শালাদেরই বিশ্বাস নেই। বনে জঙ্গলে মাত্র এই শালারা আর শুয়োরেরা বিনা কারণে হামলা করে দেয় মানুষের উপর। বন্দুকটা টেনে নেয় ঠুঠা হাতের কাছে।
চারদিকে নানারকম গাছ। নীরব প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে ওদের ঘিরে। সার সার। এদিকে শাল নেইই বলতে গেলে। বাঁশের ঝাড়, ধাওয়া (গঁদ), হাররা, বহেড়া, কাসসী, কুহমি, চাঁর বা চিরাহীদানার মস্ত মস্ত সব গাছ। শিমুল, কদম, আর জামুনও আছে। শীতের বৃষ্টির পর মাঝ রাতে সুগন্ধ ছড়িয়েছে বন-বনানী। রাতচরা পেঁচা আর নাইটদারের ডাকের সঙ্গে হায়নার হাসি মিশে যাচ্ছে। চিতল হরিণের ঝাঁক থেকে শিঙালগুলো ডাকছে টাঁউ! টাঁউ টাঁউ! করে। রাত জেগে উঠেছে। মধ্যরাতের ছাই-রঙা অন্ধকারে, সপ্তমীর চাঁদের আলোর সঙ্গে বনের মধ্যের শিশির আর কুয়াশা মিশে এক স্বপ্ন-রাজ্য তৈরি হয়েছে যেন। দেব-দেবীরা বোধহয় এই সময়েই জেগে ওঠেন। হারাই, ধারওয়া, সাইআম, ইয়াম, উইক্কে, কুসরে। ঠাকুর দেও। ঘামসেন, মাসওয়াসি, সাইয়াম দেও, ঠাকুর দেওর সব ছেলেরা। আরও কত দেব-দেবী! বড়াহদেব তো আছেই।
একটা চুট্টা ধরাল ঠুঠা। ভাবনায় পেয়েছে এখন ওকে। জঙ্গলে একা থাকলেই ওকে ভাবনাতে পায়। এই পৃথিবী কতদিনের পুরনো কে জানে? ওর ঠাকুর্দার কাছে গল্প শুনেছিল এই পৃথিবীর জন্মর কথা। নাঙ্গা বাইগা আর নাঙ্গা বাইগীনের জন্মবৃত্তান্তও।
হুঁকো খেতে খেতে ঠাকুর্দা, বানজার-বামনির সেই বুড়ো গাওয়ানেরই মতো : কানে পেতলের মাকড়ি পরে, লেপের জামা গায়ে দিয়ে শীতের রাতে আগুনের পাশে বসে লাউয়ের খোল থেকে মহুয়া ঢেলে খেতে খেতে নাতি-নাতনিদের গল্প শোনাত। অনেক সময় ছিল তখন মানুষের হাতে, শান্তি ছিল অনেক। এত ব্যস্ত এস্ত ছিল না প্রত্যেকে। আজকের সব ব্যস্ততাই টাকার জন্যে অথচ টাকা দিয়ে কেনা যায় না যা ওরা ফেলে এসেছে পিছনে। সেই সব দিন অনেক সুখের ছিল। শহরের মানুষরা, কল-কারখানার মানুষরা আরামের সঙ্গে সুখকে গুলিয়ে ফেলেছে।
ঠাকুর্দা বলেছিলেন, ভগয়ান নাঙ্গা বাইগাকে সৃষ্টি করার আগে বারো বছর ধরে উপোস করেছিলেন। শুধু উপোসই নয়। সেই বারো বছর তরল কিছুও খাননি। জলও না চানও করেননি। বারো বছর চান না করায় ভগয়ান ভারী নোংরা হয়ে গেছিলেন। গা-ময় ময়লা। বারো বছর পেরুনোর পর তেরো বছরের মাথায় ভগয়ান তাঁর বুক এবং বগলতলা থেকে ঘষে ঘষে অনেকই ময়লা বের করলেন। দু হাতের পাতাতে ওই ময়লার কিছুটা নিয়ে বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে রগড়ে রগড়ে দুটি মানুষের মতো দেখতে মূর্তি বানালেন তিনি। সেই মূর্তি দুটিকে বাড়িতে নিয়ে রেখে দিয়ে বললেন : কোনও একদিন কাজে আসবে এ দুটি।
তারপর একদিন ভগয়ান তার হাতের কড়ে আঙুল কেটে সেই মূর্তিদুটির উপর রক্ত ঢেলে দিয়ে তাদের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন।
নাঙ্গা বাইগা আর নাঙ্গা বাইগীন দুজনেই উলঙ্গ ছিলেন। তাই প্রাণ পেয়েই তাঁদের বড় লজ্জা হল। তাঁরা সিঙ্গার দ্বীপে গিয়ে সমুদ্রে গা-ডুবিয়ে বসে থাকলেন লজ্জা থেকে বাঁচতে। সিঙ্গার দ্বীপ আমাদের পৃথিবীর আদি, তখন শুধুই পাথর-ভরা ছিল। আর সমুদ্র ঘেরা।
বুড়হা নাঙ্গাকে দেখতে ছিল মানুষেরই মতো। কিন্তু তাঁর সাপের মতো একটি লেজ ছিল। মুখটাও ছিল সাপেরই মতো। সাপের মতো লম্বা মুখ এবং নাক। দাঁতগুলো কিন্তু মানুষেরই মতো ছিল। উচাইতে তিনি সাধারণ মানুষেরই সমান ছিলেন কিন্তু লেজটা ছিল মস্ত লম্বা। হাত পা সবই মানুষেরই মতো ছিল। অথচ সাপের মতোই ল্যাংটা থাকতেন তিনি। জামা-কাপড় পরতেন না কিছু। উত্তরাখণ্ডে ফিকে বাদামি-রঙা বুড়হা নাঙ্গ তাঁর ফর্সা বউরাণী দুধ-নাঙ্গ-এর সঙ্গে থাকতেন। আর থাকত বুড়হা নাঙ্গ-এর ঝি এবং উপপত্নী মালহিন। মালহিন অন্য সব কাজ তো করতই তাছাড়া বুড়হা নাঙ্গ-এর গা মালিশ করত এবং বুড়হা নাঙ্গ-এর সঙ্গে দুধ নাঙ্গ-এর ঝগড়া বাধলে সেই ঝগড়া মিটিয়ে দিত। বুড়হা নাঙ্গ-এর খাদ্য ছিল শজারু। রোজ একটি করে শজারু খেতেন তিনি। শজারুই ছিল বুড়হা নাঙ্গ-এর শুয়োর।
সিঙ্গার দ্বীপ থেকে উত্তরাখণ্ডে যাওয়ার কোনও পথই ছিল না। কিচলু রাজা ছিলেন এক পেল্লায় কচ্ছপ। তিনি থাকতেন সিঙ্গার দ্বীপের এক পাহাড়ের মস্ত গুহায়। গায়ে ভীষণ জোর ছিল কিচলু রাজার। পাণ্ডবরা তাঁকে গিয়েই ধরলেন। বললেন যে, উত্তরাখণ্ডে গিয়ে তাঁদের জন্যে ধরিত্রী মাকে নিয়ে আসতে হবে। ধরতি-মাকে। কিচলু রাজা পাণ্ডবদের অনুরোধে সেই পাহাড়ের মধ্যের গুহাতে এক ফাটল ধরিয়ে সেই ফাটল বেয়ে উত্তরাখণ্ডে নেমে গিয়ে কী করে উত্তরাখণ্ডের মাটি গিলে ফেলে পেটের মধ্যে করে তা শেষমেষ সিঙ্গার দ্বীপে নিয়ে এলেন এবং ধরতি-মাতা থেকেই কী করে পৃথিবীতে মাটি এল এবং কী করে পৃথিবী ধান, জওয়ার, বাজরা, কাড়ুয়া সরগুজা, তামাকু এবং বন-বনানী আর ফুলে, ফলে ভরে উঠল সে অনেক লম্বা গল্প।
ধরতি মাতা পৃথিবীতে আসার পর সিঙ্গার দ্বীপের সমুদ্রে গা-ডুবিয়ে বসে-থাকা নাঙ্গা বাইগার তলব পড়ল। নাঙ্গা বাইগার স্ত্রী নাঙ্গা বাইগীন থাকা সত্ত্বেও নাঙ্গা বাইগার প্রকাণ্ড পুরুষালী চেহারাতে মুগ্ধ হয়ে ধরতি-মাতাও তাঁর স্ত্রী হবার বাসনা দেখালেন। তারপর থেকে সিঙ্গার দ্বীপে থেকেই গেলেন ধরতি-মাতা নাঙ্গা বাইগারই সঙ্গে, স্বামী-স্ত্রী হিসেবে। নাঙ্গা বাইগীনও থাকলেন আগেরই মতো। দুধবরণ নাঙ্গ-রাণী।
এসব গল্প ঠুঠা বাইগা প্রায় ভুলতেই বসেছে। হাটচান্দ্রার পরিবেশে ও ভুলেই যায় যে ওরও একটা আলাদা জগৎ কখনও ছিল।
রাত এখন কত কে জানে?
নদীর কাছের কোনও বড় গাছের ডালপালা ঝাঁকিয়ে হনুমানেরা রাতের ঝিঁঝিঁর ডাকের একঘেয়েমি ছিঁড়ে দিয়ে হঠাৎ হুটোপুটি করে ডেকে উঠল। বাঘটা এখন নিশ্চয়ই ওদিক দিয়ে চলেছে। হয়তো নদী পেরোবে। কখন যে ঠুঠা আর দেবী সিংকে অলক্ষ্যে দেখে সে চলে গেছে তার পথে, বুঝতেই পারেনি ঠুঠা। যদিও জেগে বসে, গাছে হেলান দিয়ে চুট্টা খাচ্ছে।