1 of 2

৪১. ভুচুর গারাজে বসেছিল পৃথু

ভুচুর গারাজে বসেছিল পৃথু।

গারাজ, বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভুচুর এক আত্মীয় মারা গেছেন মান্দলাতে এই মিথ্যে নোটিশ টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সকলকে ছুটিও দেওয়া হয়ে গেছে। গারাজের সকলেই জানে যে ভুচু আর পৃথু একটু পর মান্দলা রওয়ানা হয়ে যাবে।

ইন্দারজিৎ লাল মানুষটির মতো পুলিশ অফিসার এ দেশে আরও অনেক থাকলে ভাল হত। এত অল্প সময়ের মধ্যে পুরো ব্যাপারটা সম্বন্ধে ডিসিশান নিয়ে স্ট্যাটেজি ঠিক করে দিলেন, যে, পৃথু সত্যি অবাক। চাকরি করার জন্যেই শুধু চাকরি করেন না এই ধরনের লোক, পুরোপুরি ইনভলভড হয়ে পড়তে জানেন কাজে। এবং সেই কারণেই এই ধরনের মানুষরাই বোধহয় নিজের নিজের কাজের মধ্যে জব-স্যাটিসফেকশান খুঁজে পান।

লাল সাহেবও বলেছিলেন থানাকে এখন কিছুই বলবেন না।

পৃথু বলল, আমার ইচ্ছে, পুলিশ খুব শোরগোল তুলে মৌলভী ওরফে ডাকু মোটেলালের ডেডবডি ওখান থেকে নিয়ে আসুক সন্ধের মুখে মুখে। মগনলালের দল সম্বন্ধে ওদের কোনওরকম ইনফরমেশান দিতেও চাই না। তবে যে সময়ে এই সব হল্লাগুল্লা হবে সেই সময়েই আমার দল নিয়ে আমি মগনলালের ক্যাম্পের চার পাশ ঘিরে ফেলতে চাই। কিন্তু আমাকে অন্তত জনা ছয়েক সাহসী ও ভাল মার্কসম্যান পুলিশ দিলে ভাল হত। আমার লোকজন তো সীমিত। তার উপর মৌলভী তো চলেই গেল। ক্যাম্পের অন্যদিকে, মানে, নইনদীয়ার উল্টোদিকে সামারিয়া বলে একটা গ্রাম আছে। তার সামনে দিয়ে যে পথটা হাটচান্দ্রাতে এসেছে আটবারোঁয়া বস্তি ছুঁয়ে সেই পথ দিয়েই মনে হয় আমাদের তাড়া খেয়ে ওরা পালাবার চেষ্টা করবে। ওদের খানা-পিনার রসদ-সদ সব ওই পথ দিয়েই আসছে মনে হয়। নেহাৎ নিরুপায় না হলে অথবা কোনওভাবে পোভোক না করতে পারলে ওরা কনফ্রনটেশান এড়িয়ে যাবে বলেই আমার ধারণা।

লালসাহেব কী একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, কটা নাগাদ দরকার ওদের? মানে ছজন পুলিশকে?

সন্ধে লাগতে না লাগতেই আটবাঁরোয়া আর সামারিয়ার পথের মাঝের আধমাইল পথটুকু কভার করে ফেলা দরকার। এল এম জি থাকলে সুবিধে হয়।

এল এম জি তো নেই হাটচান্দ্রা পি. এস.-এ.।

আরও একটু ভেবে লালসাহেব বললেন, ঠিক আছে মোগাঁও-এ এবং মালাগঞ্জখণ্ড-এ আমি বলে দিচ্ছি। একজন হেড কনস্টবলকে পাঠাব। তার নাম দৌলত সিং। তার সঙ্গে আমি নিজেই কথা বলছি এক্ষুণি। সে আরও পাঁচজনকে নিয়ে বিকেল পাঁচটার আগেই সাদা পোশাকে একটি সাদা অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে হাটচান্দ্রার জলের ট্যাংকের নীচে মাছ কিনবে। আপনার কোনও লোককে সেখানে পাঠাবেন লাল-পাগড়ী মাথায় বেঁধে। সে গিয়ে, জোরে জোরে বলবে মাছের দোকানিদের যে, ডাকু মগনলাল এর দল ডাকু শের সিং এর দলের মোটেলালকে খতম করে দিয়েছে। সব ঘর ভাগ যাও, কওন জানে আজ কেয়া না কেয়া খাতরা বনেগা। সেই কথা শুনে দৌলত সিং আপনার লোককে গাড়িতে তুলে দেবে। দৌলতের বড় বড় গোঁফ আছে। কাঁচা গোঁফ। সবুজ খদ্দরের পাঞ্জাবির ওপর কালো আলোয়ান গায়ে দিয়ে থাকবে সে। সকলের পরনেই খদ্দরের পায়জামা পাঞ্জাবি পায়ে নাগরা জুতো।

পৃথু ভাল করে শুনল।

বলল, ওক্কে।

দৌলতের দল আপনার লোকের কথা মতোই কাজ করবে। তারা সকলেই স্মল-আর্মস নিয়ে যাবে। প্রত্যেকেই নির্ভুল মারে। সার্ভিস রিভলভার দিয়ে অন্ধকারেও পটাপট লোক ফেলে দেবে।

তারপর লালহসেব শুধোলেন মগনলালের দলে কজন আছে বলে মনে হয় আপনার?

জনা ছয়েক। বেশিও হতে পারে। তাদের আমি দেখিনি।

ওক্কে! আর কিছু? মিঃ ঘোষ? উই ওল উইল বী গ্রেটফুল টুড্য ওল। আমি নিজেও কাল সকালে বম্বে থেকে যে হপিং-ফ্লাইট ইন্দোর ও ভোপাল হয়ে জবলপুর যায় তাতে জবলপুরে আসছি। আশা করি, সন্ধে নাগাদ ভুচুবাবুর গারাজে পৌঁছে যাব, কনগ্রাচুলেট করতে আপনাদের। কালকের পর থেকে মনে হয়, আপনাদের আর এই ঝামেলাতে জড়িয়ে রাখব না। মগনলালের দল কালই একস্টিংগুইশড হয়ে যাবে। আপনাদের হাত-যশে। যে দু একজন থাকবে, তাদের আমি ও আমার লোকেরাই জিম্মা নিয়ে নেব। ওকে। বেস্ট অফ লাক। গুড হান্টি। আই অ্যাম অফুলী সরী ফর মোটেলাল। গভর্নমেন্ট অ্যাম্পলী কমপেনসেট করবেন ফ্যামিলীকে। আমাদের আই জি অলরেডি হোম মিনিস্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং হোম মিনিস্টারও চিফ মিনিস্টারের সঙ্গে। দিল্লিতে ডি জি কেও জানানো হয়েছে। এভরীওয়ান উইল বী এক্সপেকট্যান্ট টু নাইট। এন্ড উইল বী প্রেয়িং ফর উ্য অল।

হুদাকে ভুচুর জীপ দিয়ে পাঠানো হয়েছে ঠুঠাকে তার কোয়ার্টার থেকে তুলে আনাবার জন্যে। শামীমকে খাইয়ে-দাইয়ে ভুচুর ঘরেই ঘুমোতে বলা হয়েছে। তাকে ডাকু মগনলালের কথা এবং মৌলভীর মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্যে দায়ী যে মগনলালই এ কথাও জানানো হয়েছে। এবং বলা হয়েছে বলেই, ছেড়ে দেওয়া যায়নি। শামীমের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে মৌলভীকে ওই অবস্থায় দেখার পর থেকেই। ও বলেছে, খুদাহকি কসম, আমাকে এই ফয়সালায় তোমরা যদি না নাও, সুযোগ না। দাও আমাকে, আমার মেয়ের বেঈজ্জতীর বদলা না নেবার, মৌলভীর মওত-এর বদলা না নেবার; তাহলে আমি আত্মহত্যা করব!

পুলিশ যখন গিয়ে পৌঁছবে তখন শকুনেরা মৌলভীর কিছু বাকি রাখবে কি না তা কে জানে? গুনাহ হল বড়। কিন্তু উপায় নেই কোনও। পুলিশ আগে গিয়ে ব্যাপারটকে মেস-আপ করে দিলে মগনলাল পুরো দল নিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে।

পৃথু ভুচুর কাছ থেকে একটা সিগারেট চেয়ে নিয়ে ভাবছিল ধুয়োর রিং পাকাতে পাকাতে। ভাবার অনেক কিছুই আছে। এখন মাথা ঠাণ্ডা রাখা দরকার। চঞ্চলতার বা উত্তেজনার সময় এখন নয়। ঠুঠা এলে, ঠুঠাকে লালপাগড়ি পরিয়ে হুদাকে দিয়ে ভুচুর জীপে করে জলের ট্যাঙ্কের নীচে পাঠাবে। সব বলে, বুঝিয়ে। দৌলত সিং-এর দলকে পেলে ঠুঠা তাদের গাড়িতে হুদার জীপের পেছন পেছন যেতে বলে সামারিয়া আর আটবাঁরোয়ার দিকে হাটচান্দ্রা থেকে কাঁচা পথটা যেখানে বেরিয়েছে সেই অবধি যাবে। তারপর সাদা অ্যাম্বাসাডর সেখানেই রেখে জীপে করে হুদা ওদের আর কিছুটা এগিয়ে দিয়েই ফিরে আসবে। ফিরে এসে, মোড়ের কাছেই যে চায়ের দোকানটা আছে তার সামনে থাকবে জীপ নিয়ে।

হুদা ঠুঠাকে ধরে নিয়ে এল। শীতের দুপুরের ছুটির দিনে রোদে চৌপাই লাগিয়ে সুখনিদ্রা দিচ্ছিল ঠুঠা বাইগা।

হুদা কিছুটা আন্দাজ করেছিল। হয়তো এত আগেও করেছে।

পৃথু বলল, হান্নানের দোকানের রুটি আর ব্রেইনকারি আছে। খেয়ে নাও হুদা। তোমাকে আজ আমাদের একটু সাহায্য করতে হবে।

হুদা বলল, আমার বাড়িতে একটা ভাল ছোরা আছে, নিয়ে আসব দাদা?

না। তার দরকার নেই। তুমি জীপটা চালালেই অনেক করা হবে। কাউকে মারতেই যদি হয়, তাহলে জীপ দিয়ে চাপা দিয়ে মারতেও তো পারবে। তুমি মারবে বললে প্রাণ নিয়ে পালাবে কে? জীপ নিয়ে তুমি তো সাকাসের তাঁবুতে ভেলকি দেখাও। কী?

তা দেখাই দাদা! আপনার আশীর্বাদে। একজন কেন? জীপের স্টিয়ারিং হাতে থাকলে পাঁচ দশ জনকেও আমি একাই নিতে পারব।

আশা করি, নিতে হবে না।

হুদা বলল, জী। শামীম ভাইয়ের মেয়েকে তো এরাই বেঈজ্জত করেছিল না? আমাকে একবার সুযোগ দিন দাদা। নুরজেহানের জন্যে আমি জানও দিতে পারি।

ওর চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক হল পৃথু। নতুন কিছু পড়ল ওর চোখে। ছেলেটা ভালবাসে নুরজেহানকে নিশ্চয়ই। ভালবাসার মতো মেয়েও বটে। অমন রূপ সচরাচর দেখা যায় না।

ঠুঠাকে ডেকে সব বলল পৃথু। ঠুঠা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। ওর ঘুম ভাল করে ভাঙেনি এখনও মনে হল। একটা হাই তুলে তুড়ি দিয়ে বলল “হে বড়হা দেও। আজ তুমহারা পুজা হোগা।”

বলেই, পৃথুকে বলল, এসবের মধ্যে সংসারী লোক তুমি ফাঁসলে কেন? বউ-ছেলে-মেয়ে আছে, তোমার কি ঘরের খেয়ে বনের মোষ না তাড়ালেই নয়? গিরিশবাবুকে খবর দিলে না কেন? আমি, ভুচু, গিরিশবাবুই এই তিনজনেই বেগর-শাদী-শুদা আদমী! শামীমকেও না জড়ালেই ভাল করতে।

পৃথু বলল, শামীমের হক্ক আছে এই মামলায় নিজেকে জড়ানোর। “না” করা যায় না ওকে।

আমরা কি শামীমের কেউই নই? না মৌলভীরও কেউ নই? জঙ্গলের দোস্ত, এক বন্দুক আর এক বোতলের দোস্তিতে তফাৎ কী? জান কবুল।

হুদাকে বলল, পৃথু। এইবার সময় হয়ে এল কিন্তু হুদা সকলেরই। ভাল করে কষে আদা দিয়ে ফারস্ট ক্লাস চা বানিয়ে আনো তো দেখি কেটলি ভরে। আর আমার পান। এ জীবনে আর খাওয়া হয় না হয়! ভুচুও এসে যাবে এক্ষুণি। আর যাওয়ার আগে শামীমকে তুলে দিয়ে যাও। আর সময় নেই।

সে ঘুমোচ্ছে থোড়ী। বড় বড় চোখ চেয়ে চেয়ারে বসে আছে।

হুদা বলল।

আর সময় নেই। যখন শিকার করত, পৃথু, বাঘের মড়িতে গিয়ে বসার সময় হত, অথবা ছুলোয়াতে জখম করা বাঘকে ফলো-আপ করতে যাওয়ার সময় হত তখনও এমনই মনে হত। একটা চাপা উত্তেজনা বোধ করত ভিতরে ভিতরে। হঠাৎই মনে হত, পৃথিবীটা কী সুন্দর! এই আলো-ছায়া, মেঘ-রোদুর, পাখির ডাক, ঘাসের গন্ধ, আকাশের নীল, টিয়ার সবুজ, সরই কী সুন্দর! মনে হত, আর হয়ত দেখা নাও হতে পারে এইসব! সময় নেই।

তখন তো ব্যাচেলার ছিল।

আর এখন! তার বউ রুষা, ছেলে, মেয়ে। কী করছে এখন রুষা ইদুরকারের সঙ্গে কে জানে? খুউব মজা করছে নিশ্চয়ই। হাসি, মজা, খেলা, খাওয়া দাওয়া। আহা! করুক করুক। একটাই

তো জীবন। পৃথু তো কিছুই দিতে পারল না।

আনন্দম। আনন্দম। আনন্দম।

কুর্চি-ই-ই-ই।

ও কুর্চি।

কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি? কোন অভিমানে? আমার উপরও কেউ অভিমান করে? . তুমি ছাড়া কেউই নেই; সেও? যাকগে যাকগে। “বুঝবে সেদিন বুঝবে, আমি যেদিন হারিয়ে যাব, অস্তরবির সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে। গাইতে বসে কণ্ঠ ছিঁড়ে আসবে যখন কান্না, বলবে সবাই সেই যে পথিক, তার শেখানো গান না?”

নজরুলের গানটি মনে পড়ে গেল পৃথুর।

ভুচু জোরে জীপ চালিয়ে ঢুকল গারাজে। ধুলো উড়িয়ে। উত্তেজিত হয়ে। বলল, পুলিশের একটা গাড়ি আর একটা জীপকে যেতে দেখলাম নইনদীয়ার দিকে।

পৃথু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, তা তো যাবেই। সময় তো হল।

সকলের চা খাওয়া হয়ে গেল। আকাশের দিকে চাইল পৃথু। বেলা পড়ে এসেছে। আর দেরি করার উপায় নেই। হুদা ভুচুর জীপে ঠুঠাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। অন্য জীপে উঠল, পৃথু শামীম, আর ভুচু। স্টিয়ারিং-এ বসল পৃথু এবার। ঠুঠা লালসাহেবের লোকেদের সঙ্গে থাকবে।

হুদা যাবার আগে পানের ঠোঙা দিয়ে গেছিল পৃথুকে।

পৃথু ভুচুকে দিয়ে বলল, খোলো।

আমিও একটা খাই। ভুচু বলল।

পৃথুকে পান-জদা দিয়ে বলল, কি ঠুঠা? তুমিও খাবে না কি একটা।

ঠুঠা কোনওদিনও পান খায় না। বলল, দাও দুটো। তাড়াতাড়িতে খৈনিটাও নিয়ে আসতে পারলাম কি? ঘুমের মধ্যে গোঁত্তা মেরে তুলে দিয়ে জীপে বসিয়ে উড়িয়ে নিয়ে এল হুদা! পিরথু বাবুর হুকুম। যমেও এমন ব্যবহার করে না।

পৃথু আর ভুচু হেসে উঠল।

সকলের মনেই একটা চাপা উত্তেজনা। কিন্তু প্রকাশ নেই কারওই। এরকম পরিস্থিতিতে ওরা বহুবারই পড়েছে। বন-জঙ্গল, বন্দুক রাইফেল, বিপদ-আপদে ওরা অভ্যস্তই। জানোয়ারদের ওরা সামলে নিয়েছে চিরদিনই। কিন্তু জানোয়ার-হওয়া-মানুষদের পারবে, কি না; সেই চিন্তাই সকলের মনে।

অশ্বত্থ গাছটার বেশ কিছুটা আগেই, একটা নালার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল পৃথু জীপটাকে। কিছুটা গিয়েই একটা বাঁক নিয়েছে নালাটা। সেই বাঁকটা পেরিয়েই এঞ্জিন বন্ধ করে দিল। তখন সন্ধে হব-হব।

জীপ থেকে নেমেই পৃথু বলল, ভুচু আরেকটা পান খাওয়াও। ভুচুও জীপ থেকে নামছিল। পৃথু হাত তুলে বারণ করল।

ভুচু অবাক চোখে তাকাল পৃথুর দিকে।

পানটা মুখে দিয়ে একমুঠো জদা ফেলে পৃথু বলল, পামেলাকে আমি তোমার মতো করে ভাল না বাসলেও দাদার মতোই ভালবাসি। অনেক কষ্ট করে জীবনে পায়ে দাঁড়িয়েছ তুমি! তোমার সামনে মস্ত জীবন পড়ে আছে। পামেলারও অনেক স্বপ্ন আছে তোমাকে ঘিরে। তুমি জীপেই থাকবে। যদি আমার এবং শামীমের মধ্যে একজন না ফিরি অথবা দুজনেই না ফিরি তখন তুমি ও ঠুঠা থেকে যাবে। আমাদের মৃত্যুর বদলা নেবার জন্যে। মগনলালের কাছে হারলে আমাদের চলবে না। তাছাড়া, লালসাহেবের বিশ্বাসও তো ভাঙা যায় না। বিশ্বাস যে করে, তার চেয়ে অনেক বড় দায় বিশ্বাস যে রাখে তার।

পৃথুদা! এটা কী হল? আমাকে তোমাদের ক্রেডিটের ভাগ দেবে না? আমি একাই বাদ পড়ব?

ডিসক্রেডিটেরও নয় ভুচু। তুমি একা রইলে বলে বিপদও কম নয় তোমার। সবচেয়ে বেশি বিপদ বোধহয় তোমারই। খুবই সাবধানে থাকবে।

কোড ওয়ার্ড?

ভাল বলেছ। ভুলেই গেছিলাম। ঠুঠাকেও বলে দিয়েছে অবশ্য। আজকের কোডওয়ার্ড, নুরজেহান।

নুরজেহানের নামেই শামীমের গলার মোটা শিরাটা দপদপ করে ফুলে উঠল। আশ্চর্য এক গভীর জ্ঞতার চোখে চাইল সে পৃথুর দিকে।

ফস ফিস করে বলল পৃথু, চল শামীম ভাই। বলে শামীমের হাত ধরে নিয়ে এগোল।

ভুচু ফিসফিস করে বলল, মে গড় বী উইথ ড্য!

পৃথু জবাব দিল না। গুলিতে পকেট ভারী। শামীমেরও তাই। একটি করে শটগান; একটি করে রাইফেল। রাতে শর্টরেঞ্জে, শটগান রাইফেলের চেয়েও অনেক বেশি এফেকটিভ। এ ব্যাপারে মানুষ মারা আর শুয়োর মারার মধ্যে কোনওই তফাৎ নেই।

কুড়ি-পঁচিশ গজ এসেছে ওরা সাবধানে; নিঃশব্দে। হঠাৎ পেছনে পায়ের শব্দ শুনেয়ই এক ঝটকায় ঘুরে গেল পৃথু। ভাল লাগল। এখনও রিফ্লেক্স অ্যাকশান এরকম সজাগ আছে দেখে। ঢলে-ঢালা হয়নি একটুও।

কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েই অবাক হয়ে দেখল, ভুচু। ভুচু, পৃথুর হিপ পকেটে এবং শামীমের ফ্ল্যানেলের পাঞ্জাবীর পকেটে একটি করে থ্রী-এক্স রাম এর পাঁইট ঢুকিয়ে দিল।

কথা না বলে, হাসল পৃথু। রাইফেল সুদ্ধ হাত তুলল পৃথু। ধন্যবাদের হাত। শামীম বিড়বিড় করে বলল, অজীব লড়কা। পৃথু ঠোঁটে হাত দিয়ে কথা বলতে বারণ করল ওকে। তারপর শামীমকে ইশারাতে ওর পিছনে আসতে বলে এগিয়ে চলল।

মিনিট পনেরো যেতে অন্ধকার হয়ে গেল চারপাশ। নইনদীয়ার নদী রেখার পাশে কতগুলো বড় বড় পাথরের আড়ালে চুপ করে বসল ওরা দুজন কান খাড়া করে।

সামনে, দূরে, ডানদিকে মানুষের গলার স্বর কানে আসছিল। পুলিশের গাড়ি ব্যাক করার আওয়াজও পেল। মৌলভী গিয়াসুদ্দিনের মৃতদেহ নামাচ্ছে ওরা বোধহয় গাছ থেকে।

দ্রুত সবদিকের কথা চিন্তা করে পৃথু ঠিক করল যে পুলিশরা থাকতে থাকতেই মগনলালের দলের সমস্ত মনোযোগ স্বাভাবিকভাবেই ওদিকেই থাকবে। পুলিশের দলের কেউ নদী পেরিয়ে বাঁ দিকে তাদের আস্তানার দিকে আসছে কি না তা দেখাই এখন তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। এই সময়টুকুতেই, নদীর বাঁদিকে, যেদিকে ওদের আস্তানা; সেই পারে নিশ্চয়ই নজর তীক্ষ্ণ রাখবে না ওরা। এই শোরগোল থাকতে থাকতেই, পৃথু ঠিক করল; যতখানি এগিয়ে যাওয়া যায় তাইই যাবে। ওদের পায়ের শব্দ আড়াল পাবে পুলিশের দলের হৈ-হল্লায়। হঠাৎ উঠে পড়েই শামীমকে নিয়ে আড়াআড়ি নদী-রেখাটা পেরিয়ে গেল ও। যত কম সময়ে পারে। নদীর সাদা বালিতে কিছু নড়াচড়া করলে সহজেই চোখে পড়ে অন্ধকারেও। তাইই যত কম সময়ে পারে নদী পেরিয়ে অতি সাবধানে এক পা এক পা করে যেখানে মগলালের আস্তানা দেখেছিল, সেদিকে আন্দাজে এগোতে লাগল। নদীর উল্টোদিকে পুলিশের দলের আওয়াজ এখন বেশ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। বোেঝা যাচ্ছে কথা। এবারে থেমে গেল ওরা দুজনে। একটা মস্ত শিমুল গাছের গুঁড়ির আড়ালে গিয়ে দুজনে দুদিকে মুখ করে রাইফেল রেডি পজিশানে ধরে বসল। নইনদীয়ার অন্য পারে। বড় শিমুলের গুঁড়িতে অনেকগুলো পাটিশান থাকে। লুকিয়ে থাকলে, তিনদিক দিয়েই দেখা যায় না। যেতে পারে শুধু পিছন দিক থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শোরগোল, টর্চের জোরালো আলো থেমে এবং নিভে গেল। ভ্যান ও জীপ স্টার্ট করার শব্দ এল এবং হেডলাইট জ্বলে উঠল অন্ধকার বনকে আলোয় ভরে দিয়ে। তারপর ব্যাডলি মেইনটেইনড ভ্যান ও জীপ ঘড়ঘড় ধড়ফর শব্দ করে উঁচু নিচু রাস্তায় আলো নাচাতে নাচাতে পেট্রলের গন্ধে জঙ্গল ভরে দিয়ে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *