৪৬
কোথায় যেন ভোর হচ্ছে।
কোথায়? নর্মদার পারে, টিকেরিয়ায়? সাতপুরা পর্বতশ্রেণীর সুগন্ধি স্তনসন্ধির মধ্যে? কোনও ভোঁর ঘাসের শিশিরভেজা মাঠে কি?
কে জানে, কোথায় ভোর হচ্ছে!
জানে না পৃথু-উ।
বড় যন্ত্রণা! অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা, বড়ই যন্ত্রণার। জ্ঞানহীনতা থেকে জ্ঞানে ফেরা; কৃত্রিম সুস্থতা থেকে সত্য অসুস্থতায় ফেরাও বড় কষ্টের।
একদল সাইবেরিয়ান রাজহাঁস কোঁয়াক কোঁয়াক করে ডাকতে ডাকতে উড়ে আসছে নর্মদার চরে। পৃথুর বাবা পাশে বসে আছেন। গায়ে একটা অলিভ-গ্রিন ফুল হাতা সোয়েটার। পাইপ খাচ্ছেন। বন্দুকটা কোলের উপর পাথালি করে শোয়ানো। ইংলিশ ইলী-কীনক কার্টিজের পোড়া বারুদের গন্ধে নাক ভরে রয়েছে। তার সঙ্গে শীতের সকালের নদীর গন্ধ, বালির গন্ধ, ওপারের ছোলা আর সবুজাভ মটরছিম্মি ক্ষেতের গন্ধ সব মিলেমিশে গেছে। বাবা হাসছেন। বলছেন, এবার তোর টার্ন পৃথু। ফায়ার বোথ দ্যা ব্যারেলস।
আঁ-আ-আ-আ…
বড় কষ্ট!
পরিযায়ী সাইবেরিয়ান রাজহাঁসদের মতোই অনেক হাজার মাইল দ্রুত পেরিয়ে জ্ঞানে ফিরে আসছে পৃথু। কোঁয়াক! কোঁয়াক! কোঁয়াক…
কুর্চি-ই-ই-ই-ই-ই।
মিঃ ঘোষ। মিঃ ঘোষ।
কে যেন ডাকছে পৃথুকে।
সিস্টার ডাকছেন।
সিস্টার জনসন। ফর্সা, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। কালো কুচকুচে চুলের ঢল নেমেছে দু কানের পাশে। টিকোলো নাকটি। দুটি দিঘল চোখ। চশমা-পরা।
সিস্টার বললেন, মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে। মিঃ ঘোষ হু ইজ কুর্চি?
মিসেস ঘোষের নাম কি কুর্চি?
কুর্চি-ই-ই-ই-ই-ই…
মুখ বিকৃত করল পৃথু। তার অন্তরের, তার সব যন্ত্রণার গভীর থেকে, তার নাভিমূল থেকে উৎসারিত হল কুর্চির নামটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে, অজানিতে। সত্য যা, তা এমনি অমোঘভাবেই হঠাৎ প্রকাশিত হয়ে পড়ে। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ-হারানো পৃথু আবারও বলল, কুর্চি।
মিঃ ঘোষ। হাউ ডু য়্যু ফীল?
হোয়াট্? হু আর য়্যু?
হাউ ডু য়্যু ফীল?
উঃ…। কুর্চি…ই..ই…ই…ই…
অ্যানাস্থেসিয়ার ঘোর কেটে যাচ্ছে। কুয়াশা কাটছে নদীর উপর। ছাইরঙা, মাছ-মাছ জলজ-গন্ধ-ভরা রাজহাঁসের ঝাঁক উড়ে আসছে বহু দূর থেকে। সুদূর সাইবেরিয়া থেকে। শীত থেকে; উষ্ণতাতে। মৃত্যু থেকে, জীবনে।
আমার কী হয়েছে? মগনলাল কোথায়? ডাকু মগনলাল?
সে মরে গেছে। আপনিই তো মেরেছেন তাকে।
সিস্টার লাওয়ান্ডে বললেন পৃথুকে।
সত্যি? আঃ। অ্যাট লাস্ট। মাথার মধ্যে বিজ্লীর মুখটিও ভেসে উঠল এক ঝলক। না বলে বলল, আমি না, আমি না, আমি কাউকে মারিনি, চাই না মারতে। যে মেরেছে সে অন্য লোক। অন্য পৃথু।
ইয়েস মিঃ ঘোষ। ভারতবর্ষের সব খবরের কাগজে তোমার ছবি বেরিয়েছে। য়্যু আর আ হিরো। হিরো অফ দ্য নেশান।
হিরো?
পৃথু বলল।
ইয়েস। য়্যু সার্টেন্লি আর।
হিরো! মাই ফুট্! আই ওয়ান্টেড টু বি আ পোয়েট্। অ্যান আর্টিস্ট্। আ সিঙ্গার। আ নভেলিস্ট। ডাকাত-মারা হিরো! আই ডেসপাইস মাইসেলফ। আই উড লাইক টু কিক মাইসেলফ।
বলতেই, পৃথুর ডান পায়ে একটি উত্তেজনা জাগল। বিছানাতে শুয়েই। পরক্ষণেই যন্ত্রণাতে কঁকিয়ে উঠল ও—উঃ..উঃ…উ…।
বী কোয়ায়েট মিঃ ঘোষ। প্লীজ বী কাম।
কী হয়েছে আমার? আমার পায়ে? ডান পায়ে?
মিঃ ঘোষ। লিসসিন মিঃ ঘোষ…তোমাকে বাঁচাবার জন্যে তোমার ডান পাটি আমাদের কেটে ফেলতে হয়েছে।
পৃথু দু’ চোখ খুলে আরেকবার চাইল মিস জনসনের চোখে। পরমুহূর্তেই চোখ নামিয়ে নিল। মাথা ঘুরে উঠল। সিস্টারের দশানন দেখল।
কলেজের ছেলেরা হইচই করছে। জলপ্রপাতের মতো সেই শব্দে পৃথুর দু’ কান ভরে রয়েছে। কাম অন পৃথু। বিষেণ সিং পাস দিয়েছে। লং পাস্। সেন্টার ফরোয়ার্ডে খেলত ও। পৃথু রাইট উইঙ্গার। ডান পা দিয়ে খুব জোরে-আসা বলটাকে স্টপ করল পৃথু। পাথরের মতো বলটা শক্ত হয়ে পৃথুর ডান পায়ের পাতার নীচে আর ঘাসের উপরে স্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর বুটপরা ডান পায়ের পাতা দিয়ে বলটাতে প্রাণস্পর্শ করে সজীব, সচল করল আবার ও। করেই, চুনী গোস্বামীর মতো ড্রিবল করে এঁকেবেঁকে ঝড়ের মতো এগিয়ে গিয়েই শট করল গোলে। অ্যাঙ্গুলার শট।
গ্যালারি থেকে শোর উঠল গো-ও-ও-ওল।
ফুলশয্যার রাতে, রুষা, নগ্ন পৃথুকে নরম চোখ মেলে দেখল। প্রথমবার স্থলপদ্ম, যেমন করে ভোরের সূর্যকে দেখে।
রুষা বলল, তুমি খুব সুন্দর।
তোমার চেয়েও?
তোমার পা দুটি ভারী সুন্দর। তোমার পায়ের পাতা, উরু, কাফ-মাসল! এ কী! মানুষের গায়ের তিল আবার লাল হয় নাকি?
পৃথু অস্ফুট কণ্ঠে বলেছিল, হয়। হয়। রাজা-রাজড়াদের হয়।
তোমার ডান পায়ে আর ডান হাতে কত্ব কত্ব লাল তিল। কী সুন্দর, তুমি!
তোমার চেয়েও?
রুষার গেরোবাজ পায়রার মতো উদ্ধত কিন্তু মসৃণ রেশমিকোমল স্তনে হাত রেখে পৃথু বলেছিল।
রুষা বলেছিল, আমি শুনেছি, পুরুষমানুষের সব শক্তির উৎসই হচ্ছে তার পা-দুটি।
পৃথু উত্তরে কিছু বলেছিল।
রুষা লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে বলেছিল, তুমি ভীষণ অসভ্য।
পৃথু বলেছিল, এই দেশে, এই ভণ্ডামির দেশে; অসভ্যতা শুধুমাত্র পুরুষদেরই প্রেরোগেটিভ; অভদ্রতা, যেমন লোকসভার সদস্যদের।
মিঃ ঘোষ! মিঃ ঘোষ! ডোন্ট বী রেস্টলেস। হু’জ কুর্চি? মিসেস ঘোষ? ও মাই! মাই! য়্যু রিয়্যালি লাভ হার।
ইয়া। আই ডু।
কুর্চিই-ই-ই-ই…
সিস্টার, হোয়াট ডে ইজ টুডে? আজকে কী বার? কত তারিখ?
সানডে।
হোয়াট টাইম ইজ ইট? কটা বেজেছে এখন? সিস্টার?
এইট ও ক্লক। এইট পি. এম।
মান্দলার জেলে রবিবার কুর্চি ভাঁটুকে দেখতে যাবে বলেছিল। নিজের ঠিকানা না জানালেও অজানিতে তাকে ধরার হদিস দিয়েছিল পৃথুকে। অথবা, কে জানে? হয়তো ইচ্ছে করেই দিয়েছিল। এই ছিল শেষ সুযোগ। হারিয়ে গেল। হারিয়ে গেল শেষ সুযোগও। হারিয়ে গেল কুর্চি, পৃথুর জীবন থেকে।
কুর্চি-ই-ই-ই-ই-ই-ই…।
মিস্টার ঘোষ! প্লিজ বী রিল্যাক্সড। মিসেস ঘোষ অ্যান্ড ইওর কিড্স আর ওল্ ইন জাবালপুর। য়্যু উইল মিট দেম টুমরো মর্নিং। কোনও চিন্তা নেই। ওঁরা শ-ওয়ালেসের গেস্ট হাউসে আছেন।
এমন সময় ডাক্তার ঘরে ঢুকলেন।
সিস্টার যেন কী সব বললেন ওঁকে। পৃথুর জ্ঞানে তখনও অস্পষ্টতা ছিল। ধোঁয়াশা ছিল চোখে।
ডাক্তার কী একটা ইন্জেকশন দিলেন।
ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসতে লাগল পৃথুর। আর ফুটবল খেলবে না ও কোনওদিন। ডান পায়ে আর কোনওদিন জোরালো অ্যাঙ্গুলার শট নেবে না। তার ডান উরু আর পা কোনও নারীরই বাঁ উরু আর পায়ের পরশ পাবে না। জঙ্গল, পাহাড়, পাহাড়ি নদীর গেরুয়া আঁচল মাড়িয়ে মাইলের পর মাইল একা একা নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলতে বলতে আর হেঁটে বেড়াতে পারবে না কোনওদিন। পৃথু…অন্য পৃথু হয়ে গেছে; হয়ে গেল। আধখানা, পৃথু।
কুর্চি-ই-ই…। তুমিও হারিয়ে গেলে? তুমিও?
কুর্চি-ই-ই-ই-ই-ই…
সাইবেরিয়ান রাজহাঁসেদের ছাইরঙা মেঘ আবার ভোরের কুয়াশায় ঢেকে গেল। নিস্তরঙ্গ শীতার্ত জলে এখন কোনও তরঙ্গ, আলোড়ন নেই; নেই ডানা ঝটপটানি, গলা বেঁকিয়ে ঠোঁট-দিয়ে ডানা মাজাও নেই। সব চুপচাপ এখন। চাপ চাপ নিস্তব্ধতা।
পৃথু আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
না কি, অজ্ঞান হয়ে গেল!