৪৫
ঠুঠা বাইগা জবলপুরের মিলিটারী হাসপাতালের বারান্দার থামে হেলান দিয়ে বসেছিল। রাত হয়ে গেছে। ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ। গিরিশবাবু, সাবীর মিঞা, শামীম মিঞা, ভুচুবাবু, হুদা এরা সকলেই জবলপুরে এসেছেন। সাউথ সিভিল লাইনস্-এ পাচপেভিতে গিরিশদার এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছেন গিরিশদা ঠুঠাকে নিয়ে। সাবীর মিঞা, ভুচু ও হুদা উঠেছে একটি সস্তার হোটেলে। স্টেশানের কাছাকাছি। রুষা ও ছেলেমেয়েরা উঠেছে শাহ-ওয়ালেসের গেস্টহাউসে।
ঠুঠা শুনেছে যে আজ সকালেই পৃথুর ডান পাটা হাঁটুর অনেকখানি উপর থেকে কেটে বাদ দিয়ে দিয়েছে। পেটে যে গুলিটা লেগেছিল সেটা মারাত্মক হয়নি। ডানদিকের পেট আর বুকের মাঝের মাংস ছুঁয়েই চলে গেছে। শিরা, মাংসর সুতো এসব ছিঁড়ে-খুঁড়ে গেছে। ডাক্তাররা বলছেন, বেঁচে উঠবে পৃথু। ইনিশিয়াল শক-এই মৃত্যু যখন হয়নি। তবে কম করে তিন চার মাস তো হাসপাতালে থাকতে হবেই।
এখনও জ্ঞান ফেরেনি পৃথুর। পাটা কেটে বাদ দেওয়ার পর।
গিরিশদা গাড়িতে বসে ছিলেন। পিছনের দরজা খুলে নেমে এসে ঠুঠাকে বললেন, চলো, আমরা যাই ঠুঠা। মিলিটারী হাসপাতাল। এখানের আইনকানুন খুব কড়া। আর বসে থেকে করবেটাই বা কী? বলো? আমাদের করার তো কিছুই নেই।
উঁ?
ঠুঠা বলল।
তারপর বলল, কোথায় যাব?
আমার সঙ্গে। আমরা যেখানে উঠেছি, সেখানে যাব।
ঠুঠা উঠল। এতক্ষণ থামে হেলান দিয়ে বসেছিল বলে বুঝতে পারেনি। দাঁড়াতেই বুঝতে পারল যে, ওর দু পায়ে কোনও জোরই নেই।
রক্ত দিয়েছিল ওরা প্রত্যেকেই। শুধু ঠুঠাই দিতে পারেনি। ওর রক্তের সঙ্গে নাকি পৃথুর রক্তের মিল নেই। কী যে বলে এই ডাক্তারগুলো। যে, পৃথুকে কোলে পিঠে করে মানুষ করল, যার সঙ্গে শিশুকাল থেকে পৃথু সবচেয়েই বেশি পরিচিত, তার সঙ্গেই নাকি রক্তের মিল নেই! বোঝে না এ সব ব্যাপার স্যাপার। পৃথুর জন্যে ওর শরীরের সব রক্তই দিয়ে দিতে পারত ঠুঠা বাইগা অথচ এক ফোঁটা রক্তও লাগল না কাজে। ভুচু, গিরিশদা, সাবীর মিঞা, শামীম ওরা সব তো দু দিনের চিড়িয়া। কতদিন হল চেনে এরা পৃথুকে?
চলো।
বলে গিরিশদা হাত ধরে নিয়ে চললেন ঠুঠাকে। প্রবল প্রতাপান্বিত একটি কালো ধুম্সো ভারী প্যান্থারের মতো চিরযুবক ঠুঠার এইই প্রথম মনে হল যে, তারও বয়স হয়েছে। ঠুঠা এই সন্ধেবেলাতেই প্রথমবার বুঝতে পারল যে, মানুষের শরীর বুড়ো হলেই মানুষ বুড়ো হয় না। বুড়ো হয়ে যায় মনের জোর কমে গেলে। পৃথুর জীবনের ভয়টা এখন যখন কেটে গেছে তখন ঠুঠা এবারে জঙ্গলেই চলে যাবে। এবার বাকি জীবন তার গ্রামের খোঁজ করবে অনেক দূরের অচিন অচেনা-গন্ধ আকাশে ডাল-পালা-ছড়িয়ে দেওয়া একটি কালো গাছ ফিরে যাবে এবারে তার নরম, চিরচেনা-গন্ধর কোমল নিভৃত সুগন্ধি মাটিতে। যেখানে ওর জন্ম। যেখানে ওর মৃত্যু নিহিত আছে।
ভুচু হোটেলের ঘরে সাবীর মিঞা আর শামীম মিঞার সঙ্গে বসেছিল। হুদাও ছিল। সিগারেট ধরিয়ে রাম-এর বোতল খুলে বসেছিল। হুদাকেও দিয়েছিল একটু গ্লাসে ঢেলে। যা গেছে, সকলের উপর দিয়ে।
হুদা, ভুচুর সামনে না খেয়ে, বারান্দার চেয়ারে গিয়ে বসেছিল। দু রাত ঘুম হয়নি। চোখ জ্বালা করছে। এবারে ক্রীসমাস ঈভটা ভালই কাটল। মনে থাকবে সারা জীবন।
সারা দিন রিপোর্টাররা জ্বালিয়েছে। খবরের কাগজের পাহাড় টেবলের উপর। ভারতবর্ষের সব জায়গার কাগজে এই খবর বেরিয়েছে। পৃথুর ছবিতে ছবিতে ছয়লাপ। ভুচু, শামীম, ঠুঠা এবং মৌলভীর নামও বেরিয়েছে। খবরের কাগজেরই উপর দুটি কনুই রেখে হাতের তেলোর উপর মুখ রেখে বসেছিল ভুচু।
ভুচু কিন্তু একটুও খুশি হয়নি পৃথুদার প্রাণটা বেঁচে গেল বলে! একে কি বাঁচা বলে! পৃথুদার মতো একটা মানুষ, যে মানুষ এক ঝটকায় জীপে উঠত, এক ঝটকায় নামত, রাইফেল বা বন্দুক হাতে নিলে এখনও এক ঝলকে কোমর ঘুরিয়ে এমন ফ্লাইং মারতে পারত, স্কীট এবং ট্র্যাপের বড় বড় মাস্তানরা পর্যন্ত হাঁ করে থাকত দেখে। একবার ওলিম্পিক-এর ট্রায়ালে ডেকেছিল পৃথুকে দিল্লি থেকে। সফদারজাং এয়ার পোর্টের রেঞ্জ প্রাকটিস হত। সেখানেই পৃথুদার সঙ্গে গিয়ে আলাপ হয়েছিল ভুচুর মতো ফালতু একজন ছেলেরও বিকানীরের মহারাজা কার্নি সিং এর সঙ্গে। সব সময় হালকা সোনার ফ্রেমের সান গ্লাস পরে থাকতেন। ফর্সা, মোটা-সোটা মানুষটি। হাসিখুশি কোটার মহারাজার সঙ্গেও। জনপথ হোটেলের কাছেই বাড়ি ছিল ওঁর। বিরাট এয়ারকন্ডিশন্ড গীয়ার-ছাড়া গাড়ি করে দুদিন লিফট দিয়েছিলেন পৃথুকে উনি। পৃথুর সঙ্গে ছিল হাওড়ার দাশনগরের আলামোহন দাশ-এর বড় ছেলে প্রভাত দাশ। তার দু ভাই রবি আর চাঁদু। আর আসানসোলের কলিয়ারির মালিক প্রণব রায়। আরও কত সব নামী নামী মানুষ। পৃথুদা সকলেরই ভালবাসার এবং সম্মানের ছিল। অথচ মানুষটা এমনই চরিত্রর যে মান-সম্মান পিঠ-চাপড়ানি এই সবই হাঁসের গায়ে জল পড়লে যেমন তা সঙ্গে সঙ্গে গড়িয়ে পড়ে যায় তেমনিই গড়িয়ে পড়ে যেত। ফিরে তাকিয়ে পর্যন্ত দেখেনি তা কোনওদিনও, কুড়িয়ে নিতে যাওয়ার কথা ছেড়েই দিল। ভুচু জানে যে, তার পৃথুদা ঠিক কোন চরিত্রর মানুষ। কোন জাতের মানুষ। পৃথুদার দাম খুব কম মানুষই দিয়েছে। এই দেশে, এই সংসারে মানুষকে মানুষের দাম দেয় কম লোকই। টাকা পয়সা, ডিগ্রী, ক্ষমতা এইই সব। অথচ এ সবকিছুই যার হাতের মুঠোয় ছিল, সেই মানুষটার সেই সবের কিছুর প্রতিই বিন্দুমাত্র মোহ ছিল না। যখন ভোগ করত তখন প্রচণ্ড ভোগী, যখন ত্যাগ করত তখন মহাত্যাগী।
দিগা পাঁড়ে একদিন ভুচুকে বলেছিল একা পেয়ে যে, তোমাদের মধ্যে একমাত্র পিরথুবাবুর মধ্যেই মহাপুরুষের সব লক্ষণ আছে। পিরথুবাবু হচ্ছে গিয়ে ছুপা সাধক। আমরা যারা এই সব নিয়েই থাকি, আমরাও আত্মার উদারত্বর ব্যাপারে তার কাছে কিছুমাত্ৰই নই। পিরথুবাবুর হৃদয়টা হচ্ছে পানুয়ান্না টাঁড়ের মতো। চার দিক গিয়ে মিলেছে দিগন্তে। মধ্যে একটিও কাঁটা ঝোপ নেই। সবটাই সবুজ চিকন ঘাসে ভরা।
শামীম মিঞা দরজা দিয়ে বাইরে চেয়ে ট্রাক আর সাইকেল রিকশার যাওয়া আসার আওয়াজে ডুবে ছিল। রাম-এর গ্লাসে চুমুক দিয়ে হঠাৎ বলল, তখন পর্যন্ত বলার সুযোগ পাইনি ভুচু কাউকেই, নুরজেহান কথা বলছে। জানো?
কী বললে?
চমকিত ভুচু এবং ইজিচেয়ারে আধোশোয়া সাবীর মিঞা হঠাৎই উঠে পড়ে সমস্বরে বললেন।
হ্যাঁ। বলার সময় আর পেলাম কই? পিরথুদাদাকে নিয়ে এতক্ষণ যা গেল। সেদিন যেই না হুদা এসে রাত দুটোতে খবর দিল যে ডাকু মগনলাল খতম হয়েছে। পিরথুদাদাই খতম করেছে তাকে। অথচ পিরথুদাদাই বোধহয় বাঁচবে না তক্ষুনি নুরজেহানকে ধরে তার আম্মাজানকে অন্দরমেহাল থেকে নিয়ে এল। আমি আর হুদা একই সঙ্গে কথাটা বললাম নুরজেহানকে। নুরজেহান ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। তারপরই ওর ঠোঁট দুটো কাঁপতে লাগল। বলল কী জানো?
কী?
ভুচু শুধোল।
বলল, পিরথু চাচাকো…খুদাহতাল্লাকি সব দোয়া…বলেই আবার কেঁদে উঠল। তারপর ঘরে গেল পিরথুদাদার জন্যে নেমাজ পড়তে।
বাঃ বাঃ। এবার নুরজেহানের একটা শাদী দাও শামীম ভাই।
ব্যাপারটা মসজিদের মহল্লার অনেকেই জেনে গেছে। কাফির, ডাকু মগনলাল আমার মেয়ের ইজ্জৎ নিয়েছে। ওকে কোনও সাচ্চা মুসলমান বিয়ে করবে না।
ভারী গলায় কথা কটি বলেই শামীম গম্ভীর হয়ে গেল।
ভুচু বলল, করবে। আমাদের হুদা অনেকদিনই হল নুরজেহানের প্রেমে পড়ে আছে। দয়ায় নয়, ভালবাসায়ই ও বিয়ে করবে। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করো।
ও-ওতো মুসলমান। ওরও তো ধর্ম আছে। ধর্ম মানা তো সকলেরই উচিত। শামীম বলল।
দ্যাখো শামীম। তোমাদের এই সব গোঁড়ামিই কাল হল। জাত, আসলে দুটোই আছে পৃথিবীতে। ভাল আর মন্দ। ভালর দলে যারা পড়ে তাদের চেয়ে বড় আর কোনও ধর্মই নেই।
হুদা ঠিকই বিয়ে করবে নুরজেহানকে আমি জানি।
কী জানো তুমি?
শামীম অবিশ্বাসের গলায় বলল।
বলল, দেখো ভুচু ভাই। বদনসীবী-আদমীকো লেকর মজাক মত্ উড়ানা। ইয়ে ঠিক নেহী হ্যায়।
ক্যা ঠিক নেহী হ্যায়? অন্ধা কাঁহাকা।
চটে উঠল ভুচু।
এই দু’রাত আর দু’দিন যা গেছে সকলের উপর দিয়ে, মেজাজ কারওই ঠিক নেই।
গলা তুলে ডাকল ভুচু, হুদা!
সাড়া নেই। বাইরে যা আওয়াজ! বাইরে বসে থাকলে, ভিতরের ডাক শোনা যায় না। জীবনেরই মতো। ভাবল ভুচু। জীবনেও বেশি মানুষই এমনি বাইরের বারান্দায় বসে কোলাহলের মধ্যেই কাটিয়ে দেয় সময়টুকু, ভিতরের ডাক তাইই আর শোনা হয়ে ওঠে না।
বেল বাজাল ভুচু এবার।
বেয়ারা এল। বলল, বরফ্ মাঙ্গাথা, হুয়া কেয়া? ঔর কিতনা টাইম লাগেগা জারা বরফ্ লানেমে।
লায়া হুজৌর।
ঔর শুনো, বাহারমে হামলোগোঁকো সাথথী বৈঠা হুয়া হ্যায়। উন্কো সালাম দেনা।
জী!
হুদা একটু পরে এল। চোখ লাল। ওরও চোখের পাতা মেলবার সুযোগ হয়নি গত বাহান্ন ঘণ্টা। হাতে রাম-এর গ্লাস।
ভুচু বলল, বোসো। গ্লাসটা দাও। বলে, রাম ঢেলে দিল আর একটু গ্লাসে, তারপর বলল, রাতে আজ কী খাওয়া যায় হুদা? একে আমাদের বড়দিন তায় পৃথুদাকে জানে বাঁচিয়ে তোলা গেল।
হুদা বলল, বাইরে গিয়ে খাব? জবলপুর শহরে খুব ভাল মটন বিরিয়ানি আর মোরগার চাঁব কোথায় করে তা আমি জানি।
ছোড়ো বিরিয়ানীই খেতে হলে ভোপালের মদিনাতে। সাবীর সাহেব বললেন।
মদিনা কোন মহল্লাতে? সাবীর সাহেব?
ইব্র্যাহিমপুরাতে। ভাল খনা পাওয়া যায় আর এক জায়গাতেও যদিও একটু নোংরা ভিড়-ভাট্টার মধ্যে বাসস্ট্যান্ডের কাছে, ‘পাকিজা’ হোটেলে। লাল-কালো-সাদা খুসবুভরা চালের বিরিয়ানী, মধ্যে মধ্যে গোস্ত-এর টুকরো। অথবা পরোটা ও কালিজা। সঙ্গে বুরানি। ঘি-এর মধ্যে কালোজিরে সম্বার দিয়ে দইয়ের মধ্যে ঢেলে দেয়। আহাঃ। মধ্যে আবার আস্ত আস্ত পুদিনা পাতা। পাকিজা মালিকের নাম ‘মোবিন’। সকলে বলে, মোবিন, পেহলোয়ান। একটা স্কুটারের ফেলে-দেওয়া টায়ারের উপর দইয়ের এক বিরাট হাঁড়ি বসিয়ে মোবিন্ পেহ্লোয়ান বসে থাকে। চেহারাখানা পেহলোয়ানেরই মতো।
ভুচু বলল, তাহলে কি নুরজেহানের শাদীর সময় আমরা ভোপালের পাকিজা থেকেই বাওয়ার্চি আনানোর বন্দোবস্ত করব শামীম ভাই?
নুরজেহানের শাদীর কথাতেই হুদার মুখ কালো হয়ে এল।
ও বলল, আমি বাইরে গিয়ে বসি দাদা।
একটু দাঁড়াও হুদা। তোমার সঙ্গে একটু পরামর্শ আছে। এ বছরই নুরজেহানের বিয়ে দিতে চান শামীম ভাই।
শামীম অবাক হয়ে ভুচুর চোখের দিকে তাকিয়েছিল।
সাবীর মিঞা হুদার চোখের দিকে। দুষ্টুমির চোখে।
বললেন, সাবীর মিঞা বেঁচে থাকতে হাটচান্দ্রাতে ভোপালের ‘পাকিজা’ হোটেল থেকে বাবুর্চি আনতে হবে?
ভুচু বলল, হুদা, বিয়ের সবই ঠিকঠাক। একটাই মাত্র গোলমাল হচ্ছে।
কী? দাদা?
মুখ মাটির দিকে নামিয়ে হুদা বলল।
পাত্রই ঠিক করে উঠতে পারছেন না শামীম সাহেব। মানে, পছন্দ করে উঠতে পারছেন না। পাত্র, ভাল ভাল পাত্র অনেকই আছে যদিও।
আমি এ ব্যাপারে কী করতে পারি দাদা?
তুমি যা করতে পারো তা হচ্ছে ওই পাত্রদের মধ্যে একজন হতে পারো। তোমার যদি ওই বিয়েতে মত থাকে তাহলে তোমার হয়ে নুরজেহানের বাবার কাছে উমেদারীটা আমিই করব। আর অন্য কোনও পাত্র যেন ধারে কাছে না আসে, তা আমি দেখব।
হুদার কালো, কিন্তু মিষ্টি মুখটা লজ্জা আর খুশিতে বেগ্নে হয়ে গেল।
মুখ নামিয়েই বলল, আমি যা রোজগার করি তাতে এক্ষুনি বিয়ে করা কি ঠিক হবে দাদা? নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে।
সেটা তোমারই ব্যাপার। এমন সুন্দরী পাত্রী, বেহেস্তের হুরীর মতো মেয়ে তোমার মতো মোটর-মেকানিক পাত্রর জন্য বসে থাকবে না। আমরা যে লাইনের লোক, লোকে কি আমাদের মানুষ বলে মানতে চায় নাকি? মানুষই নই যেন আমরা, যেন শক-অ্যাবজর্বার।
তাহলে…
বলেই, হুদা ঘর ছেড়ে বাইরে চলে গেল।
ভুচু ও সাবীর মিঞা ওর হাবে-ভাবে হেসে উঠল ও উঠলেন। শামীম শুধু উপরে দু হাত তুলে খুদাহর কাছে কি দোয়া মাঙ্গল, তা সেইই জানে।
ভুচু বলল, শোনো শামীম ভাই, নিজে তো সারা জীবন হিরো-গিরি করলে। এমন দামাদ তোমাকে বেছে দিলাম যে, তোমার বুড়ো বয়সের জিম্মাদারী সেইই নেবে। তবে একটাই অনুরোধ দামাদের সঙ্গে কমপিটিশান দিয়ে নিজেও ছেলেমেয়ে প্যায়দা কোরো না। এবার একটা অপারেশান-টপারেশান করিয়ে ঈজ্জৎ বাঁচাও।
শামীম হেসে ফেলল। সাবীর মিঞাও।
এর আগেও একদিন বলেছিলাম সাবীর সাহেবকে। তোমরা যে-রেটে বাড়ছ তাতে তো এখানেই আবার পাকিস্তান বানিয়ে আমাদের দোবারা করে রিফুজি করে ছেড়ে দেবে। মতলব তোমাদের মোটেই ভাল নয় শামীম ভাই।
শামীম বলল, ব্যসস, করো। আভভি। হুদা না শুন লে। ক্যায়া করতা হ্যায় তু ইয়ার? ভুচু বলল, হুদা শুননেসে ক্যা, ম্যায় তো চাহতা কি খুদাহ ভি শুন্ লিজিয়েগা।
তারপর ভুচু বলল, হুদার মতো ছেলে হয় না। ওকে পরে আমি আমার পার্টনার করে নেব। গাড়ির মেকানিকের অবস্থা দিনে দিনে ভাল হতেই চলবে। গাড়ি কত বেড়ে যাচ্ছে প্রতি বছর, দেখছ না? পানওয়ালা মোমফুলি-ওয়ালারাও গাড়ি কিনছে। হুদার মতো ছেলে হয় না। স্বভাব চরিত্র, এতলাক তমদ্দুন সব একেবারে রহিস খানদানেরই মতো। নুরজেহানের মতো মেয়েও হয় না। সত্যিই বেহেস্ত্-এর হুরী-পরী। বাজে কেবল তার বাপটা। ব্যাটা বেকামকা আদমী। জিন্দগীমে স্রিফ একই কাম লিয়া—লড়কা-লড়কী প্যয়দা কর্না। ঔর চোরী করকে শিকার খেলনা। দেখো, মেয়ের বিয়ে হচ্ছে, এখন আবার প্রেম-ট্রেম কোরো না নতুন করে।
তু বড়া ফালতু বকবকাতা হ্যায়।
বলে হাসল শামীম। মেয়ের বিয়ের সম্ভাবনাতে উজ্জ্বল হয়ে।
ভুচু সিরিয়াসলী বলল, এবার বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেলো শামীম ভাই, হাটচান্দ্রাতে ফিরেই।
একটু হাসি, ঠাট্টা এবং অন্য আলোচনাতে এই দু’ দিনের অসহ্য টেনশন, চিন্তা-ভাবনা সবই কেটে যেতে লাগল।
সাবীর সাহেব বললেন, আজ জলদি শো যাও সব। সুব্বে উঠ্কর পিরথুবাবুসে মিলকে চল্ না হোগা ওয়াপস্?
হাঁ। ঔর আধা ঘণ্টেমে খা-পীকে শো যায়গা সব। খনাকে লিয়ে কহাঁ যাইয়েগা সাবীর সব?
আররে ছোড়ো ইয়ার। সব্বে থকাহুয়া হ্যায়। হিঁয়াই খানা খাকে আজ জলদি শো যাও।
হুদা।
বলে ডাকল শামীম। খাবার অর্ডার ওইই দিক।
হুদা যথারীতি শুনতে পেল না বাইরে বসে।
ভুচুর আবারও মনে হল, বাইরে বসে থাকলে ভিতরের ডাক শোনা যায় না। জীবনেরই মতো। প্রায় সব মানুষই জীবনের বাইরের বারান্দায় বসে এমনই কোলাহলের মধ্যেই কাটিয়ে দেয় দামী সময়টুকু, ভিতরের ডাক তাইই পৌঁছয় না তাদের কানে। ভুচু নিজেও এইরকমই। চেনাজানা প্রায় সকলেই। শুধু পৃথুদাই অন্য রকম।
একমাত্র পৃথুদাই।
পামেলাকে একটা ফোন বুক করেছে। কখন যে পাওয়া যাবে লাইন? ক্রীসমাসে ওকে একবার উইশ না করলে কী ভাববে বেচারি। লাইন পেলেও, ওকে পাবে কিনা সন্দেহ। চার্চ-এর ফোন তো! কোয়ার্টারে তো আর কোনও ফোন নেই।