1 of 2

৪৮. এখন দুপুরবেলা

৪৮

এখন দুপুরবেলা। বাইরের পথে হুহু করে ট্রাক যাওয়ার আওয়াজ। ঘরের মধ্যে জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে রোদ এসে পড়েছে।

জানালা দিয়ে একটি মস্ত অশ্বত্থাগাছ চোখে পড়ে। শীত-দুপুরের রোদে হাওয়ায়-ওড়া পাতারা ঝিলমিল করছে। এক ঝাঁক শালিক কিচিরমিচির করছে পাতার আড়ালে আড়ালে। তাদের দেখা যাচ্ছে না কিন্তু বোঝা যাচ্ছে যে, তারা অসংখ্য। মনে হচ্ছে, প্রত্যেকটি পাতাই যেন কথা বলছে, শীৎকারের সঙ্গে। রোদের রঙ আর তাপ ঠিকরে বেরুচ্ছে তাদের শিরা-উপশিরা থেকে।

সিস্টার বসে আছেন ঘরের এক কোণায়। ওঁর নাম মিসেস্ লাওয়ান্ডে। মারাঠি। বয়স্কা। মা-মা ভাব মহিলার। চেয়ারে বসে একটি মারাঠি নভেল পড়ছেন।

চোখে চোখ পড়তেই বললেন, এবার ইনজেকশনটা নিতে হবে।

পৃথু চোখ দিয়ে বলল, দিন।

মুখে কথা বেশি বলতে ইচ্ছে করে না। ঘরের বাইরে দুজন আর্মড গার্ড বসে আছে সাদা পোশাকে। হাসপাতালের বাইরেও সাদা পোশাকে আছে কিছু লোক। যদি মগনলালের দলের কেউ বেঁচে থাকে এবং সে পৃথুর উপরে বদলা নিতে আসে, তাই-ই এই বন্দোবস্ত। পৃথুর মাথার বালিশের নীচেও গুলি-ভরা পিস্তলটা আছে। ইন্দারজিৎ লাল সাহেব আর কোনও ঝুঁকি নিতেই রাজি নন। তাঁকে এমনিতেই এই রকম আনকন্‌ভেনশনাল অ্যাকশানের জন্যে অ্যাসেমব্লীতে অনেকই কটূক্তি শুনতে হয়েছে। অবশ্য দায়িত্ব যা, তা সব হোম মিনিস্টার এবং হোম সেক্রেটারি নিজেরাই মাথা পেতে নিয়েছেন।

জেন্টামাইসিন প্রথম থেকেই দেওয়া হয়েছে। অ্যামপুটেশনের পর যাতে নিউরাইটিস না হয় সে জন্যে বি-ওয়ান বি-সিক্স বি-টুয়েলভের ইনজেকশন নিউরোবিয়ান দেওয়া হচ্ছে। ডঃ জয়াকার বেভিডক্স দেওয়ারই পক্ষপাতী ছিলেন কিন্তু ফুল-কর্নেল ডঃ সিং, যিনি অপারেশান করেছিলেন তিনি নিউরোবিয়ানই দিতে বলেছেন। পৃথু শুনেছে যে টেটভ্যাকও দেওয়া হয়েছিল।

এই সবের ও বোঝে না কিছুই। বুঝতে চায়ও না। ও শুধু একটু আকাশ আর ওই অশ্বত্থগাছটাতে রোদের ঝিলিমিলিই দেখতে চায়। আর ভাবতে চায়…

এরকম মারাত্মক শারীরিক দুর্ঘটনার পর অনেকেই মানসিক রোগের শিকার হন। সাইকোসোম্যাটিক ডিসঅর্ডারের ভয় থাকে। সিজোফ্রেনিয়ার বা ন্যুরোস্ফেনিয়ার।

কী হবে? এই জীবন, এই পরমুখাপেক্ষী, পরাশ্রিত জীবনটা রেখে লাভই বা কী? ইচ্ছে করে যে, পিস্তলটাকে বালিশের তলা থেকে বের করে নিয়ে বাঁদিকের জুলপির একটু উপরে ঠেকিয়ে টেনে দেয় ট্রিগারটা। সিস্টার ঘরে না থাকলে, মাঝেমাঝেই পিস্তলটা হাতের মধ্যে নেয় ও। পিস্তলের বাটটা হাতের মুঠোয় ধরলেই, কুর্চির অদেখা ভরা-মুঠি স্তন ধরারই অনুভূতি হয় যেন। আশ্চর্য!

সিস্টার লাওয়ান্ডে ইনজেকশন দেবার পর দু’ রকমের ওষুধ দিয়ে আবার নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, জানালার পর্দাটা কি সরিয়ে দেব?

নাঃ। থাক।

ও বলল। সিস্টার আবারও ডুবে গেলেন তাঁর বইয়ে।

এই ওষুধটা কিসের, তা জানা নেই পৃথুর। তবে খেলে, ঘুম-ঘুমই পায়। একটানা প্রচণ্ড ব্যথাটা আর হঠাৎ-হঠাৎ চিড়বিড়ানি একটু কম মনে হয়। শরীরের ব্যথাটাই! কিছুক্ষণের জন্যে। মনের ব্যথাটা সারতে সময় লাগবে অনেক।

হাটচান্দ্রাতেই কি থাকবে পৃথু? চাকরিও কি আর করতে পারবে? এই ঘটনার আগে চাকরি তো ছেড়ে দেবে বলেই এসেছিল। অতখানি উঁচু-নিচু এলাকা জুড়ে কারখানার মধ্যে সব সময় ঘোরাঘুরির কাজ। এ তো চেয়ারে-বসা কাজ নয়। চাকরি, এখন আর ইচ্ছে করলেও হয়তো করতে পারবে না। করার ইচ্ছেও নেই।

কী করে জীপ চালাবে পৃথু? কোন পা দিয়ে অ্যাকসিলারেটরে চাপ দেবে? লাফিয়ে নামবে কী করে জীপ থেকে? জঙ্গলে পাহাড়ে আর কি…?

না, না, এসব এখন না-ভাবাই ভাল।

আজ কী বার সিস্টার লাওয়ান্ডে?

রবিবার।

আজও রবিবার? এক মাসের উপর হয়ে গেল। জানুয়ারির শেষে প্রতি বছরই ঝড়বৃষ্টি হয়। পাতা ঝরে যায়। পাখি মরে পড়ে থাকে বিবর্ণ-হলুদ অথবা কমলা বা কালো ঠোঁট নিয়ে বনের গভীরের গাছতলায়। তাদের বন্ধ-চোখে কী এক গভীর অভিমান আঁকা থাকে। প্রতি বছরই লক্ষ করে পৃথু।

ওই ঝড়বৃষ্টির পরই শীত কমতে থাকে। ক্রমশঃ।

আজও রবিবার!

চমকে উঠল পৃথু।

তার মানে, কুর্চি মান্দলাতে এসেছিল চার সপ্তাহ আগে। অজাইব সিংও অবাক করল। তারও অসাধ্য কোনও কাজ আছে বলে জানা ছিল না পৃথুর। সেও পারল না কুর্চির ঠিকানা নিয়ে আসতে! পৃথু এখন জানে মনে মনে, কুর্চি হারিয়ে গেছে তার জীবন থেকে চিরদিনেরই মতো।

মিসফরচুন নেভার কামস অ্যালোন।

আজ আপনাকে দেখতে আসবেন অনেকে। রবিবার তো!

সিস্টার লাওয়ান্ডে পৃথুকে বললেন। হাসিমুখে। বোধ হয়, ওকে চাঙ্গা করবার জন্যেই।

পৃথুর মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। বড় পাণ্ডুর, ম্লান, রক্তশূন্য সে হাসি। পৃথু তো আর দশ-পাউন্ড ওজনের গাবলু-গুবলু ধবধবে ফর্সা প্রথম পুত্রসন্তান প্রসব-করা ভীষণ-খুশি মা হয়ে হাসপাতালে শুয়ে নেই যে, ভিজিটিং আওয়ার্সে শাশুড়ি, স্বামী বা নিজের মা এসে তাকে কনগ্রাচুলেট করবে বা ভেলপুরি খাইয়ে যাবে লুকিয়ে লুকিয়ে! জিজ্ঞেস করবে, কানে কানে; তার বুকে অস্ট্রেলিয়ান গাইয়ের মতোই দুধের বান ডেকেছে কিনা!

পৃথু ঘোষ, কিছুমাত্রই নিয়ে যেতে নয়; শুধু হারাতেই এসেছিল এই হাসপাতালে। সকলে জানছে, শুধু তার একটা পা-ই কাটা গেছে। পেটের ডানদিকে যে-গুলিটা মাংস খুবলে নিয়ে বেরিয়ে গেছিল সেটাকে কেউ কোনও আমলই দিচ্ছে না। শুধু পা-টার জন্যেই সমবেদনা সকলের। পা-টা যদি আজ থাকত তবে এই সমবেদনা জানাতে-আসা সবাইকেই ওই পা দিয়েই লাথি মারত পৃথু। কিন্তু কাটা গেছে কি শুধু একটি পা-ইই? তার সঙ্গে..

কিন্তু পা-টাই বা গেল কোথায়? আস্ত ডান পা-টা? অনেক বছরের সুখদুঃখের সঙ্গী। ফেলে দিল কি এরা ডাস্টবিনে? কাক-শকুনে ছিঁড়ে খেল কি? নাকি, পচেই গেল; মাটি হল মাটির তলায়?

আস্ত মানুষ মরে গেলে তাকে কবর দেয়, পোড়ায় আর আস্ত একটি পা মরে গেলে? কাকে জিগ্যেস করবে, জানে না। সিস্টারদের, ডাক্তারদের জিগ্যেস করলেই তাঁরা ভাবেন, পৃথু মানসিক রোগী হয়ে গেছে। তাঁদের মুখ দেখে অন্তত তাইই মনে হয়।

কিন্তু সেইটুকুই সব নয়। প্রকৃত ঘটনা এইই যে, ওই একটি পায়ের সঙ্গে পৃথুর এতগুলো বছরের জীবনটাও কাটা গেছে। জীবনধারণের, সঙ্গী চাওয়া-পাওয়ার স্বাদ, তার স্ত্রী, তার বন্ধুবান্ধব, তার কুর্চি সবই বৃন্তচ্যুত হয়ে গেছে এই দুর্দৈবে, তার কর্তিত পায়েরই সঙ্গে সঙ্গে। তাদের একজনেরও পাশে পৃথু আর দু’পায়ে ভর দিয়ে মাথা-উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। কোনওদিনও।

রবিবার! আজ রুষা আসবে, মিলি ও টুসুকে নিয়ে। টুসুটা কোনও কথা বলে না। পৃথুর খাটের গা ঘেঁষে বসে থাকে উদাস চোখে চেয়ে। মাঝে মাঝে হাত বোলায় পৃথুর হাতে। কার ভালোবাসার প্রকাশ যে কেমন, তা ভালোবাসা প্রকাশের সময় না এলে বোঝা যায় না বোধ হয়। সে শিশুপুত্রর ভালোবাসাই হোক কি প্রেমিকার ভালোবাসাই হোক। মানুষের মনের মত দুর্জ্ঞেয় কিছু নেই! টুসু পৃথুর কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলে, ও বাবা! বাড়ি চলো। তাড়াতাড়ি! তারপর কানের মধ্যে মুখ দিয়ে বলে, বাবা। জানো, একটা লাল পাখি এসেছে কুয়োতলায়। সে পাখি, কেউই চেনে না। কী পাখি জানি না আমি। তাড়াতাড়ি চলো, চিনিয়ে দেবে তুমি। তাড়াতাড়ি চলো।

কেন যে এমন করে বলে টুসু, বোঝে না পৃথু। এই “তাড়াতাড়ি চলো” কথাটা ওকে ভীষণই ভয় পাইয়ে দেয় মাঝে মাঝে। দেরি হলে, এখানে বেশিদিন শুয়ে থাকলে; পৃথুর সাংঘাতিক কোনও বিপদ ঘটবে হয়তো এমনই আভাস যেন প্রচ্ছন্ন থাকে এই তাগিদের মধ্যে। রাতের রেলগাড়ি, যেন স্টেশন ছেড়ে চলে যাবে, পৃথুকে ফেলে; দুলতে দুলতে অন্ধকারের মধ্যে। গাড়িভরা ঘুম, কামরা নিঝুম!

বড় ভয় হয় পৃথুর। ভয়ে কেঁপে ওঠে।

রুষা একদৃষ্টে পৃথুর দু’চোখের দিকে চেয়ে থাকে। চোখ সরায় না, চোখ থেকে। কী যেন খোঁজে পৃথুর দু’চোখে। কী খোঁজে? তা, রুষাই জানে।

মিলিই শুধু কিছু বলে না। ফিটফাট সেজে, হাতে একটা ইংরিজি বই নিয়ে পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢোকে। ঘরে ঢুকেই একবার হাসে। বলে, হাই বাবা!

আবার যাওয়ার সময় হাসে, বলে, বাইই! বাবা!

রুষার রূপের খ্যাতি পুরো হাসপাতালেই ছড়িয়ে গেছে। রুষাকে একটু দেখবার জন্যে করিডরে, ঘরের সামনে, পার্কিং লর্ট-এ, এমনকি ঘরেও ইয়াং হ্যান্ডসাম আর্মি অফিসার, পুরুষ ও নারী ডাক্তার ও নার্সদেরও ভিড় লেগে যায়। কোনও মেয়েই বোধ হয় নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতে চায় না যে, তার চেয়েও সুন্দরী কেউ আছে! অসীম কৌতূহল তাদের এই বাউণ্ডুলে, ঘরের খেয়ে, বনের মোষ তাড়ানো, ডাকাতদের সঙ্গে লড়তে গিয়ে জীবনের মতো ল্যাংড়া হয়ে যাওয়া মানুষটার এমন মাণ্ডুর রূপমতীর মতো সুন্দরী স্ত্রীর প্রতি। এমন মেয়ের সঙ্গেও এমন লোকের বিয়ে হয়? বিশ্বাস করতেই চায় না যেন কেউ।

ওরা যখন ভিড় করে আসে তখন রুষার মুখে এক আশ্চর্য অভিব্যক্তি দেখতে পায় পৃথু। ওর সৌন্দর্য, তখন যেন আরও দেদীপ্যমান হয় হাওয়া পাওয়া আগুনের মতো আরও সম্ভ্রান্ত হয়ে ওঠে তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব।

বেশ লাগে পৃথুর তখন, রুষাকে দেখে। নামকরা চিত্রতারকা বা গায়ক বা যশস্বী কবি-সাহিত্যিকেরই মতো অনেকখানি বাড়তি গাম্ভীর্যও এসে জমা হয় তখন রুষার দু’ চোখে। বেচারি ইদুরকার! রুষা যদি তার নিজের স্ত্রী না হত তবে পৃথুও আবার প্রেমে পড়ত এই রুষার। হেড ওভার হিলস্। ইদুরকার যেমন পড়েছে।

কটা বেজেছে কে জানে! ঘুমিয়েই পড়েছিল পৃথু। মাঝে মাঝে এরকম হয়। কখন জেগে থাকে, কখন ঘুমোয় নিজেই বুঝতে পারে না। খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন সবে ফেড-ইন করছিল মস্তিষ্কে, খুব আস্তে আস্তে, ঠিক এমনই সময় মিলি স্পষ্ট উচ্চারণে দরজা থেকে বলল, হাই! বাবা!

তাকিয়ে দেখল, রুষা, ভিনোদ ইদুরকার, মিলি ও টুসু চলে এসেছে ঘরের মধ্যে। সিস্টার পাশে দাঁড়িয়ে।

ভিজিটিং আওয়ার্সের আগে সিস্টারেরা ওকে ওডিকোলন মাখিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে দেন। পাউডারও মাখাতে চান। পৃথু হাসে, মানা করে। দশ-পাউন্ডের মাথা-ভরা কোঁকড়া চুলের গাবলু-গুবলু ফর্সা বাচ্চা প্রসব করলেও না হয় কথা ছিল! অঙ্গহরণের কারণে এত রঙ্গ ওর পছন্দ নয়।

কেমন আছ? পৃথুদা?

ভিনোদ বলল। তার হাস্কি, সেক্সী গলায়।

বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে কিন্তু ভিনোদকে। অর্থর প্রাচুর্যরও একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে। আগেও লক্ষ্য করেছে পৃথু! সেই সৌন্দর্য, রূপ বা গুণ কিছুই হয়তো দিতে পারে না। তবু জীবনের প্রত্যেকটি জিনিসেরই আলাদা, সুচিহ্নিত ভূমিকা হয়ত আছে; দাম আছে। এসব কথা আগে বোধ হয় ঠিক এমন করে বুঝত না।

পৃথু একটু হাসল। কথা বলল না। কী বলবে? কথা বেশি বললে ভিজিটিং আওয়ার্সের পর বড় ক্লান্তও লাগে।

ভিননাদ বলল, দুর্বল লাগছে?

পৃথু আবারও হাসল। ফিকে হাসি।

মনে মনে বলল, ভিনোদ ইদুরকার, তোমার যেটা বল, আজ আমার সেটাই দুর্বলতা। আমার দুর্বলতাই তোমার বল।

রুষা, ইদুরকারকে পাত্তা না দিয়ে চেয়ার টেনে এনে কাছে বসল। তারপর ভিনোদের দিকে একবার অপাঙ্গে চেয়ে বলল, ভিনোদ, প্লীজ লীভ আস অ্যালোন। মীট অ্যাট ফাইভ, অ্যাট দ্যা পার্কিং লট।

ভিনোদ চলে গেলে, ব্যাগ থেকে একটা চিঠি বের করল রুষা। বলল, তোমার চিঠি। অনেকই চিঠি আসছে প্রতিদিন, চেনা অচেনা বহু লোকের কাছ থেকে। সেগুলো খুলে আমি আর মিলি থ্যাঙ্কস দিয়ে উত্তর দিয়ে দিচ্ছি। বলছি যে, তুমি ভাল হয়ে উঠলে এবং সময় পেলে নিজেই উত্তর দেবে। শুধু এই চিঠিটি…

পৃথু খামটি হাতে নিল। হাতের লেখা দেখেই চিনল। কুর্চির। রুষাও নিশ্চয়ই চিনেছিল। নইলে, এই চিঠিটিই শুধু না-খুলে নিয়ে আসবে কেন?

স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল রুষা পৃথুর চোখে। পৃথুও স্থির দৃষ্টিতে চাইল রুষার চোখে। বলতে চাইল, চোখ দিয়ে; অনুদার, ঈর্ষাকাতর নারী! কুর্চি আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। অ্যাজ লাক উড হ্যাভ ইট অর অ্যাজ য়্যু উড হ্যাভ ওয়ান্টেড ইট…। শী ইজ লস্ট ফর এভার। গান ফর এভার। পৃথুর পক্ষে এখন কুর্চিকে খুঁজে বের করা, পঙ্গুর গিরিলঙ্ঘনেরই সমান। কোয়াইট লিটারেলি!

কোথায় আছে ওরা এখন?

রুষা পৃথুর চোখে চোখ রেখে বলল।

পৃথু বালিশের দু’দিকে মাথা নাড়ল। জানে না। জানে না।

বলতে ভীষণ কষ্ট হল কথাটা। সত্যিই জানে না।

ওরা রাইনাতে নেই। কুর্চিকে আনতে গাড়ি পাঠিয়েছিলাম চিঠি দিয়ে। যদি তোমাকে দেখতে আসতে চাইত তো সঙ্গে নিয়ে আসতাম।

রুষা বলল।

কী হল?

“কী হল” প্রশ্নটার কাণ্ডর দুটি শাখা ছিল। একটা, কুর্চির কী হল। অন্যটা; রুষার কী হল। কী কাণ্ড!

ওরা এখানে নেই। ভাঁটুর নাকি স্মাগলিংয়ের জন্যে জেল হয়েছে। কুর্চি কোথায় তা কেউই জানে না।

খামটা রুষাকেই দিয়ে পৃথু বলল, ঠিকানা দেয়নি? খুলে দ্যাখো তো।

খামের উপরে তো নেই। থাকলে, ভিতরেই থাকবে। খুলে দ্যাখো।

রুষা বলল।

ঠিকানা যে নেই, তা জানত পৃথু। তবু রুষাকে নিশ্চিন্ত করবার জন্যে ওর সামনেই খুলল খামটা। মধ্যে থেকে প্রসাদী ফুল ঝরে পড়ল। জবা ফুল। শুকিয়ে, কালো হয়ে গেছে।

রুষা নাক কুঁচকোল। বলল, তোমার মতো অ্যাগনস্টিক মানুষের এমন কালি-ভক্ত অ্যাডমায়ারার? আনথিংকেবল্।

পৃথু বলল, ওরা যে হিন্দু! এখনও কিছু হিন্দু আছে দেশে, যারা হিন্দু বলে পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করে না। প্রাচীনপন্থী তো ওরা। সবাইই কি আমাদের মত আধুনিক হতে পারে? তবে, শুধুমাত্র ধর্ম না মানলেই, ভগবানকে অস্বীকার করলেই, বাবার শ্রাদ্ধ অথবা ছেলের পৈতে না দিলেই তো আর মানুষ আধুনিক হয়ে যায় না! তেমন আবার উল্টোটাও সত্যি। আধুনিকতা, একটা মানসিক স্তর। গোঁড়া ধর্মাবলম্বীদের গোঁড়ামিরই মতো, অনেক তথাকথিত আধুনিকদের আধুনিকতাটাও এক ধরনের উৎকট অন্ধতা থেকেই জন্মায়। কিন্তু এ প্রসঙ্গ থাক। ঠিকানাটা কি আছে?

চিঠিটির প্রথমে এবং শেষে দ্রুত চোখ বুলিয়ে দেখল রুষা, পৃথুকে নিশ্চিন্ত করে যে; অত দ্রুত চোখ বুলোলে একটি অক্ষরও পড়া যায় না।

তবে, তাতে কীইই বা আসে যায়! ভাবল পৃথু। চিঠিটির মধ্যে যে ভালবাসা আছে তা না—বোঝার মতো বোকা রুষা নয়। ভালবাসা, কখনওই টায়-টায় হয় না। আখের থেকে উপচে যায়; গড়িয়ে পড়েই।

তুমি কি উত্তর দিতে পারবে? না, আমিই ধন্যবাদ দিয়ে…

আমি তো এখনও উঠে বসতেই পারি না। পায়ের জন্যে তো বটেই; পেটের জন্যেও। তা ছাড়া লিখব কোথায়? ঠিকানা? ঠিকানাই তো নেই।

কোনওদিনও কি ছিল?

রুষা তির্যক চোখে পৃথুর চোখে চেয়ে বলল, বিদ্রূপের সঙ্গে। কিছু মানুষ থাকে পৃথিবীতে, তারা চিরদিনের রেফ্যুজী। এক গাছতলা থেকে অন্য গাছতলায় তাদের দৌড়। ঠিকানা, তাদের কোনওদিনও ছিল না।

মিসেস লাওয়ান্ডে বাংলা বোঝেন না কিন্তু রুষা এলেই এটুকু বুঝতে পারেন যে, রুষার সঙ্গে পৃথুর সম্পর্কটা অন্য দশজন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মতো নয়।

এই যে। কেমন আছেন?

বলেই, মণি চাকলাদার ঢুকলেন ঘরে। একমুখ হাসি এবং আলখাল্লার মতো একটি জামা পরে।

পৃথু, স্মিত হাসি নিয়ে তাকাল মণি চাকলাদারের দিকে। মনে মনে খুবই বিরক্ত হল। রবিবারে রুষা ও ছেলেমেয়েরা আসে বলে ভুচু এবং অন্য কেউই আসে না। এই ভদ্রলোক, এই খবরটা ইচ্ছে করলেই নিতে পারতেন আসার আগে। যদি চাইতেন।

পৃথুর উত্তর না পেয়ে উনি আবারও বললেন, দেখুন। একেই বলে প্রভিডেন্স। গগন দাশ একটি নাটক লিখে ফেলেছেন আগামী পঁচিশে বৈশাখে অভিনয় করার জন্যে। আমাদের পত্রিকার তরফ থেকেই অভিনয় হবে।

নাটকের সঙ্গে প্রভিডেন্সের কী সম্পর্ক?

অবাক হয়ে রুষা শুধোল।

বলেন কী? নেই? নিশ্চয়ই আছে। ওতে একটি বাউলের চরিত্র আছে, যার একটি পা নেই। খোঁড়া বাউল। আপনাকে দারুণ মানাবে। গানও গাইতে পারেন, পাও নেই…হিঃ হিঃ। জমে যাবে।

রুষার চোখে আগুন জ্বলে উঠল। একবার তাকাল মণি চাকলাদারের চোখে। একটু ইতস্তত করে বলল, মিঃ চাকলাদার, সপ্তাহে তো একদিনই আসি, অনেক দূর থেকে এই রবিবারেই…

রুষার কথা শেষ হবার আগেই মণি চাকলাদার বললেন, আমারও তো সেইই ডিফিকাল্টি। রবিবার বলেই এলাম। আমি কিন্তু আপনার সঙ্গেই ফিরব। দেখলুম, নীচে ইদুরকার সাহেবের মার্সিডিজ দাঁড়িয়ে আছে।

রুষা ক্ষমা প্রার্থনার চোখে পৃথুর দিকে তাকাল। এই মানুষটির নিজের সম্বন্ধে বিন্দুমাত্রও সংশয় নেই। এবং সেইটাই তার চার পাশের মানুষকে প্রায়ই নিদারুণ সংশয়ে এবং সঙ্কটেও ফেলে। যাঁদের ইনটেলেক্ট ছাড়া আর সব কিছুই থাকে; মণি চাকলাদার হচ্ছেন সেই বিশেষ জাতের ইনটেলেকচুয়াল। হাটচান্দ্রাতে এই ধরনের ইনটেলেকচুয়ালদেরই খুব রবরবা এখন। ডাকু মগনলালদের তবুও বোঝানো যায়, পিস্তলের নল দেখিয়ে হলেও, কিন্তু মণি চাকলাদারের মতো বুড়ো-খোকাদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করার একমাত্র উপায় হল ওঁর পেছনে কোনও পাগলা শেয়াল লেলিয়ে দেওয়া। কিন্তু অর্ডারি এবং ঠিক এই ধরনের ইনটেকচুয়ালদের সম্বন্ধে আগ্রহ আছে অথচ সে পাগলাও, এমন রাজযোটক—যোগসম্পন্ন—শেয়াল চট করে পাওয়াও যে মুশকিল!

একটা কবিতা লিখেছিলাম। শুনবেন না কি মিঃ ঘোষ?

পৃথু চুপ করে রইল। তারাপদ রায়ের একটি কবিতা মনে পড়ে গেল ওর।

“কপালের চুল ছিঁড়ে, দাঁত দিয়ে মাটি কামড়ে ধরে/কবিতা লেখার কোনও মানে হয় না/কবিতা তো ডাক্তারের স্টেথিস্কোপ নয়/নয় উদ্বাস্তুর ভিটে বাড়ি/জেলের হাতের জাল, কিংবা নয় চাষার লাঙল/”

ইদুরকার রুষাদের ঘরে পৌঁছে দিয়েই চলে গেছিল। ছেলেটা ম্যানার্স জানে। দোষের মধ্যে…। না, না, তাকে দোষই বা বলে কী করে? তার স্ত্রীকে ইদুর যে ভালবাসে সে তো…। ভালবাসা তো দোষের নয়। অন্তত পৃথুর চোখে নয়। কখনওই নয়।

টুসু, পৃথুর হাতের উপর হাত রেখে কানে কানে আবার বলল, বাবা! আঙ্কল খাণ্ডেলওয়ালের বাড়ির সাদা অ্যালসেসিয়ানটার বিয়ে হয়ে গেছে। জানো?

সত্যি?

হ্যাঁ।

তোমাকে কে বলল?

মা।

কী?

রুষা শুধোল।

পৃথু বলল, টুসুর কথা।

রুষা হাসল। বলল, হ্যাঁ।

কেমন দেখতে হল বউ?

ভাল। তবে ওর মতো ধবধবে ফর্সা নয়। মেটে রঙের। লাজুক লাজুক।

টুসু বলল।

তাইই…?

হাসতে হাসতে পৃথু বলল।

বাবা! রাতমোহানার কাছে, নদীতে না, “নাকটা” হাঁস পড়েছে। গার্গনি, পিন-টেইলস, রেড-হেডেড পোচার্ড। চখাচখিতে নাকি নদীর বালি ঢেকে গেছে সোনালি রঙে।

বাঃ। তাইই…?

কে বলল রে এতসব তোকে?

আমি একদিন নিজেই গিয়ে দেখে এসেছি। ঠুঠা দাদার কথা শুনে।

অত দূরে? একা একা?

রুষাও উদ্বিগ্ন গলায় বলল, সে কি! কবে?

অজাইব সিং দাদা নিয়ে গেছিল।

তাও তো অনেকখানিই হাঁটতে হয় গাড়ি ছাড়ার পরও।

তাতে কী?

না, না। জায়গাটা ভীষণই নির্জন। একা একা আর যেও না। আমি ভাল হই, তখন আমি নিয়ে যাব।

তুমি…বাবা! তুমি…

টুসুর গলায় অবিশ্বাসের স্বর ফুটে উঠল।

কী একটা বলতে গিয়েও, হঠাৎ থেমে গেল টুসু।

পৃথুর গলার কাছে কী যেন দলা পাকিয়ে উঠল হঠাৎ। পৃথু যে এ জীবনে আর কখনও উঁচু-নিচু পায়ে-চলা পথ ভেঙে দু’ মাইল চলে রাতমোহানাতে যেতে পারবে না। এ জীবনে, আর না…

রুষা মুখ নামিয়ে নিয়েছিল। আস্তে আস্তে মুখ তুলল।

মণি চাকলাদার উঠে বললেন, টুসুকে, হ্যাঁ এবার থেকে তোমাকেই নিয়ে যেতে হবে তোমার বাবাকে, তোমার বাবা আর…

তারপরই বললেন, আমি তাহলে তোমাদের ওই মার্সিডিজ গাড়ির কাছে গিয়েই দাঁড়াচ্ছি। লোকে ভাববে, গাড়িটা আমার।

হিঃ হিঃ!

রুষা উঠে দাঁড়াল। ওর হ্যান্ড-ব্যাগ থেকে একটি বই বের করে বলল, পড়েছ?

কী? কার? কবিতা?

না। আইগর্ আকিমুশ্‌কিন্-এর লেখা। রাশ্যান ভদ্রলোক। বইটার নাম ‘অ্যানিম্যাল ট্রাভেলার্স’। তোমার ভাল লাগবে। প্রথমে একটি লেখাই পড়ো। তারপর ভাল লাগলে অন্যগুলো…

কোন্ লেখাটা?

“লাইফ্ রিটার্নস্ টু ক্র্যাকাটাও”।

ক্রেকাটাও? সেটা কী জিনিস? মানুষের নাম?

পড়োই না। পরের রবিবার এসে জিগ্যেস করব কেমন লাগল। আর…। আর চেষ্টা করব আমি, ঠিকানা জোগাড় করবার। কুর্চির।

টুসু বলল, বাবা, তুমি ভাল হয়ে আমাকে একটা ক্যামেরা কিনে দেবে? টেলিফোটো লেন্সসুন্ধু? হাঁসেদের ছবি তুলব আমি। জঙ্গলের ছবি তুলব। আমি ওয়াইল্ড-লাইফ ফোটোগ্রাফার হব বাবা।

হওয়াচ্ছি! বলল, রুষা।

পৃথু হাসল। বলল, করবে কী বলো? ইট রানস ইন হিজ ব্লাড।

সে আমি বুঝব এত বড় বড় নদীতে ড্যাম বসানো যাচ্ছে আর সামান্য রক্তস্রোত ডাইভার্ট করতে পারব না? ওসব বাজে চিন্তা একদম ছাড়ো টুসু। কখনও মনেও এনো না। তোমার ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট হতে হবে। এম বি এ। নইলে, নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট। ওয়াইল্ড-লাইফ ফোটোগ্রাফার! কী অ্যামবিশান!

ওরা সকলেই ঘরের বাইরে চলে গেল। সিস্টারও গেলেন। ঘর ফাঁকা হতেই রুষা পৃথুর কপালে আর গালে চুম-ম্-ম্-ম্-ম্ আওয়াজ করে চুমু খেল দুটো। মিছিমিছি চোখ মুখ বিকৃত করে বলল, ঈঃ দাড়ি! খোঁচা-খোঁচা! লাগে!

পৃথু হেসে বলল, এবারে দাড়ি রেখেই দেব ভাবছি। পায়ের পরিচর্যাতে যা সময় যাবে, তাতে আর দাড়ি কামানোর মতো বিলাসিতার সময় থাকবে না।

রুষা শাড়ি ঠিকঠাক করে নিল। বাইরে অনেকে ওকে দেখার জন্যে অপেক্ষা করছে।

কুর্চির ঠিকানার জন্যে তুমি এত উদগ্রীব হয়ে উঠলে কেন? হঠাৎ?

রুষা বলল, কে বলতে পারে? তুমি কুর্চির উপর এবং কুর্চিও তোমার উপর ভবিষ্যতে হয়তো অনেকই বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারো ও পারে। ভবিষ্যতের কথা অবশ্য ভবিষ্যৎই জানে। তবে, জানাশোনা কোনও মানুষকেই হারিয়ে যেতে দিতে নেই। কে কখন কোন কাজে লেগে যায়, কে বলতে পারে?

বোকার মতো তাকিয়ে থাকল পৃথু রুষার চোখে। প্রায়ান্ধকারে, বাহুবেষ্টনীর মধ্যে তার নিরাবরণা স্ত্রীকে পৃথু বুঝতে পেরেছে চিরদিনই। কিন্তু রুষার এই সত্তাকে বোঝার ক্ষমতা কোনওদিনই তার ছিল না। শরীরকে তাও বোঝা যায়। মেয়েদের মন বোঝা ভারী মুশকিল।

রুষা দরজার দিকে যেতে যেতে বলল, ভাল থেকো। খুশি থেকো। সব সময় পা একটা হারিয়েছে বলে কখনই ভেবো না যে, কিছুমাত্রও হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। একটু থেমে বলল, হারায় যে নি; তা আমি প্রমাণ করে দেব। দেখো।

দুষ্টুমির হাসি, ঝিলিক মেরে গেল রুষার চোখে।

এই রুষাকেও বুঝল না ও।

পৃথু ডাকল ওকে। বলল, এ সপ্তাহে ভুচু আসবে একদিন। ওর সঙ্গে একটা বই পাঠিয়ে দেবে? অজাইব সিংকে দিলে, ওই পৌঁছে দেবে ভুচুকে।

কী বই? লীভস্ অব গ্রাস্।

দ্যাটস গুড। হুইটম্যান জীবনকে ভালবাসতে জানতেন। পাঠিয়ে দেব। চলি। ভাল থেকো।

ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হলে, রুষার দিয়ে-যাওয়া কুর্চির চিঠিটা তুলে নিল পৃথু। এতক্ষণ দমবন্ধ উৎকণ্ঠাতে ছিল ও।

পৃথুদা,

রবিবার মান্দলাতে এসেছিলাম। সেদিনই রাতে আমি যেখানে থাকি, সেখানে ফিরে গেছিলাম। পরদিন সকালের কাগজ খুলেই সব জানলাম। আমি জানি না, আপনি এখন কেমন আছেন? এ চিঠি আপনার হাটচান্দ্রার অফিসের ঠিকানাতেই দিলাম। পাবেন কি না তাও জানি না।

আপনারা কোনওদিনও একটা কথা বোঝেননি। কার কাছে এবং কোথায় আপনাদের দাম সবচেয়ে বেশি, তা বোঝেননি বলেই, পাগলের মতো খবরের কাগজের খবর হতে চান। কে মনে রাখে, কী ছাপা হল না হল; খবরের কাগজে? খবরের কাগজ, পৃথিবীর কোনও খবরের কাগজই কাউকে স্থায়ী আসন দিতে পারে না অন্য কারও মনে। ডাকু মগনলালের সঙ্গে যুদ্ধে জিতে, নিজের পা খুইয়ে, যে পৃথু ঘোয সমস্ত দেশের মানুষের আজ শ্রদ্ধার পাত্র হলেন; তাকেই সকলে এক মাসের মধ্যেই ভুলে যাবে। কাগজের ডাঁই নিয়ে গিয়ে ঠোঙ্গাওয়ালা ঠোঙ্গা বানিয়ে মোমফুলি বিক্রি করবে।

মানুষ মরে গেলেও তাকে বারো ঘণ্টার বেশি মনে রাখে না কেউই; তার অত্যন্ত নিকটতম মানুষরা ছাড়া। তাই নিজের ছোট বৃত্তের বাইরে কে আপনাকে মালা পরাল আর কে হাততালি দিল তাতে কীই বা যায় আসে? এত বোঝেন আর এটুকু বুঝলেন না? হিরো বন্‌তে গেলেন!

যার সঙ্গে সামাজিক নিয়মে বিয়ে হল আমার সেই চোরাচালানি, নিজেই নাকি চালান যাবে জেল থেকে জেলে। গতকাল তাকে দেখে এলাম। এ ক’দিনেই তার যা চেহারা হয়েছে দেখলাম, অত বছর অবধি সে আদৌ বাঁচবে বলে মনে হয় না! সে ছাড়া, আর একজন যে ছিল আমার, যার আসন ছিল অনেকই উঁচুতে, সেও মহৎ কাজ করতে গিয়ে পা হারিয়ে বসল। যত কিছু খারাপ কি আমারই ভাগ্যে লেখা ছিল?

এখন কী আমি করি? কার ভরসাতে বাঁচি? কার জন্যে?

মনে মনে একথা ভেবে পুলকিত হয়ে উঠেছিলাম এ ক’দিন যে, আমি ঠিকানা দিই আর নাইই দিই। আপনি আমাকে ঠিকই খুঁজে বার করবেন। করলেনই বা একটু কষ্ট আমার জন্যে! নাইই যদি বা পারতেন খুঁজে বার করতে, তবে বুঝতাম আপনার ভালবাসা মিথ্যা। মিছিমিছি সব বলতেন, বানিয়ে বানিয়েই। মিথ্যে ভালবাসার চিঠি লিখতেন এত। অথচ, এখন যা কাণ্ডটা বাধালেন তাতে আমারই আসতে হবে আপনার কাছে, ঠিকানা খুঁজে। কিন্তু অনেকই দূরে থাকি যে! মন থেকে তো দূরেই, পথ থেকেও দূরে। ভাল যে আছেন, এইটাই বড় কথা। জানি না, পারব কিনা আপনাকে দেখতে আসতে। সহায় সম্বলহীন নারীর অসুবিধা অনেকই। নারীরা—একজন নারী, দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও এখনও এদেশে একজন পুরুষের অভাবে সত্যিই অসহায়। এটাই ঘটনা। ভাবলেও লজ্জা হয়।

আপনার খোঁজ আমি যাতে পাই সে বন্দোবস্ত করেছি। আরও মাস তিনেক থাকবেন শুনেছি হাসপাতালেই। কতদিন দেখিনি আপনাকে! যদিও এমন অবস্থায় দেখতে চাইনি কখনও। যত তাড়াতাড়ি পারি যাব। তবে আমি সশরীরে গিয়ে আপনার এই শারীরিক অবস্থায় মানসিক সংকট ঘটাতে চাই না। রুষা বৌদি কি হাসপাতালেই আছেন? না জবলপুরের অন্য কোথাও?

ভগবানের উপর বিশ্বাস রাখবেন। যা কিছুই ঘটে, তার পেছনে এক গভীর উদ্দেশ্য থাকে। সবই প্রি-ডেস্টিনড। এখানে জাগ্রত কালি আছেন জঙ্গলের ভিতরে। এখনও রাতে শিবাভোগ হয়। সেই মন্দিরে, শনিবার রাতে গিয়ে আপনার জন্যে পুজো দিয়ে এসেছি।

আপনার মতো একজন মানুষ কি শুধু তাঁর ডান পাখানির ভরসাতেই বেঁচেছিলেন এতদিন? একজন মানুষ, তিনি যদি মানুষের মতো মানুষ হন; তাঁর শরীরের অপূর্ণতা নিয়ে কখনওই শোকাবিষ্ট হতে পারেন না। হওয়া উচিত নয়। শারীরিক পরিচয় তো জানোয়ারের, মানুষের পরিচয় তো তার মস্তিষ্কের উর্বরতায়; তার হৃদয়ের ঔদার্যে! আমার পৃথুদা কি এমনই সস্তা একজন মানুষ যে, ডাকু মগনলালের পিস্তলের গুলিতে ছিন্ন-হয়ে-যাওয়া একটি পা তাকে মানুষ হিসেবে বিচলিত বা পরিবর্তিত করে দেবে?

কক্ষনো না। তাইই যদি হবে, তবে কোথায় থাকবে আমার ভালবাসার গর্ব? আমি কি যাকে-তাকে ভালবাসতে পারি? ভাল তো বাসে সবাইই, সব মানুষই। কুকুর বেড়ালও তো মানুষের ভালবাসা পায়। যার নজর যত উঁচু, তার ভালবাসার জন ততই কম। তার ভালবাসায় ততই কষ্ট। সারা জীবনে একজনই মেলে, কি মেলে না। যখন খুঁজে পেয়েইছি, বাকি জীবনে তাকে হারাতে চাই না কোনওমতেই।

রুষা বৌদি আমার চেয়ে অনেক বিদূষী, অনেকই গভীরতা তাঁর। এই সময়ে তাঁকেই অবলম্বন করতে হবে আপনাকে। তিনি সব জোর নিশ্চয়ই দেবেনও আপনাকে। সুখী যদি থাকেন, তাহলেই আমি সুখী। আমি তো আপনার সুখের বন্ধু নই; দুঃখের বন্ধু।

আমি তো আছিই।

এরপর যখন দেখা হবে নিভৃতে, অলস বেলায়, বিরক্ত করার কেউ থাকবে না আমাদের; থাকবে না দূরাগত ভাঁটুর মোটর সাইকেলের বেরসিক ভটভট শব্দ, তখন অনেক গান শোনাব আপনাকে। যাইই চান না কেন আমার কাছ থেকে, তাইই দেব। কিছুই অদেয় থাকবে না আপনাকে। এই আশায় অন্তত তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে উঠুন পৃথুদা। আপনাকে ঋজু গাছের মতোই অবলম্বন করে আমার মতো আরও কোনও স্বর্ণলতা বেঁচে আছে কি নেই তার খবর আপনিই জানবেন। অন্যদের কথা আমি জানি না। এক পায়েই আপনি আমার কাছে ঋজুতার সংজ্ঞা হবেন। আমি আধার হব; আপনি আধেয়।

মনে থাকে যেন।

ইতি—আপনার কুর্চি।

মনে মনে, হাসপাতালের খাটে শুয়ে কত অভিমান, অনুযোগ করেছে কুর্চির উপরে এবং বিরুদ্ধে। চিঠিটি লিখেছে কুর্চি সাত তারিখে, এই মাসের। ও পেল এতদিন পরে। অফিসের ঠিকানায় লিখেছিল। এই ঔদাসীন্য কার? না, নিষ্ঠুরতা? শর্মার না রুষার? এতদিন বাদে হাতে এল?

চিঠিটি পড়ে শরীরের মধ্যে বড় অস্বস্তি জাগল পৃথুর। মনের মধ্যেও। আজকের রুষার ব্যবহার আর কুর্চির এই চিঠি মাথার মধ্যে বড় পরস্পরবিরোধী ভাবনার ঝড় তুলল। চিঠিটা খামের মধ্যে পুরে বালিশের নীচে রাখল।

সিস্টার লাওয়ান্ডে বললেন, কার চিঠি মিঃ ঘোষ। য়্যু লুক ভেরি চিয়ারফুল!

ডু আই?

বলেই, লজ্জামিশ্রিত খুশিতে হেসে ফেলল পৃথু।

হুজ ওজ ইট?

সিস্টার আবারও শুধোলেন।

অন্যদিন, অন্য সময় হলে, পৃথু হয়তো বিরক্ত হত। কিন্তু আজ হল না। বলল, আ ফ্রেন্ড অফ মাইন। বাট আ ম্যাডক্যাপ। পাগলী একটা।

সিস্টার ইনজেকশানের ছুঁচটা ওর ডান বাহুতে ঢুকিয়ে দিতে দিতে হেসে বললেন, দ্যাট সাউন্ডস ভেরি সুইট।

হোয়াট?

অবাক হয়ে। পৃথু বলল।

উনি হাসতে হাসতে বললেন, যদি কেউ কাউকে গভীরভাবে ভালবাসে তবে প্রথম জনের চোখে ভালবাসার জন সব সময়ই পাগল। দিস ইজ ট্রু ইন কেস অফ বোথ দ্যা সেক্সেস।

বলেই বললেন, হোয়াটস হিজ নেম?

পৃথু ভাবল, মিথ্যে কথা বলে। কিন্তু কুর্চি যদি দেখতে আসে তখন এই কল্পিত নামের একজন নারী আবার বাড়তি ঝামেলার কারণ হবে। একজনকে নিয়েই হিমসিম। একটুখন চুপ করে থেকে, বলেই ফেলল নামটা। আ লেডী!

তাছাড়া, কুর্চি নামটা উচ্চারণ করলেও সিরসির করে ওঠে ওর সারা শরীর।

কুর্চি?

বলেই থেমে গেলেন সিসটার লাওয়ান্ডে। ওঁর মনে পড়ে গেল সিসটার জনসন ওঁকে বলেছিলেন যে, অপারেশানের পর জ্ঞান আসার সময় পৃথু শুধু এই নামটিই বারবার চিৎকার করে বলেছিল। ঈসস্। বেচারি মিসেস ঘোষ। কী সুন্দরী; কী অ্যাকমপ্লিশড মহিলা! ফুলের মতো ছেলেমেয়ে দুটি। কী যে হল দিনকাল! পুরুষমানুষগুলো ভীষণই আন্‌ডিপেন্ডেবল্‌, আন্‌ফেইথফুল হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন।

পৃথু বলল, আপনি যেন বলবেন কিছু আমাকে? নামটি শুনে যেন চমকে গেলেন আপনি?

নাঃ। কী বলব।

সিসটার গম্ভীর অপ্রসন্ন মুখে বললেন, ফিমেল ওয়ার্ডের একজন আয়া আছে, তারও নাম কুর্চি। প্রথমে একটু চমকে গেছিলাম সেই জন্যেই। আর কিছু না।

পৃথু বুঝল, কোনও কারণে সিসটার অপ্রসন্ন। কারণটা, আন্দাজও করতে পারল। তবু বলল, কুর্চি একটি ফুলের নাম। সুন্দর একটি ফুলের নাম।

তারপরই বলল, সেই আয়াটি দেখতে কেমন?

সিসটার বললেন, সেও অন্য দশজন আয়াদেরই মতো। আমি যেমন, অন্য সিসটারদের মতো।

বলেই, ওঁর চেয়ারে চলে গেলেন।

মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথুর, কেউ খারাপ ব্যবহার করলে, অথবা ঠাণ্ডা ব্যবহার করলে যে মরে গেলেই ছিল ভাল। ডাকু মগনলাল তাকে প্রাণে না মেরে একেবারেই মেরে গেল।

টেড হিউজ-এর কবিতাটি আবারও মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। জ্ঞান ফেরার পর থেকে এই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মন খারাপ লাগলেই কবিতাটি ঊষর গ্রীষ্মবনের জ্বালার মধ্যে যেমন রঙধরানো শিমুল তেমন করেই জ্বালা বাড়িয়ে দিচ্ছে। নাকি প্রশমিত করছে?

“লাইফ ইজ ট্রাইং টু বী লাইফ।”

ডেথ ওলসো ইজ ট্রাইং টু বী লাইফ।

লাইক দ্যা শাউট্ ইন জয়

লাইফ দ্যা গ্লেয়ার ইন দ্যা লাইট্‌নিং

দ্যাট এম্পটিজ দ্যা লোন্‌লী ওক্।

এন্ড দ্যাট্ ইজ ডেথ

ইন দ্যা অ্যান্ট্‌লারস্‌ অফ দি আইরিশ এল্ক্/ইট ইজ দ্যা ডেথ ইন দ্যা কেভ-ওয়াইফস নীডল অফ বোন।

ইয়েট ইট স্টিল ইজ নট ডেথ—”

ডাকু মগনলাল। তুমি মরে গিয়ে বেঁচে গেছ। অঙ্গহীন হয়ে বাঁচতে হবে না তোমাকে। তবে তুমি বেঁচে থাকলে সুখেই থাকতে অধিকাংশ মানুষেরই মতো; ভিনোদ ইদুরকারের মতো। সুখে থাকতে এই জন্যেই যে, অধিকাংশ মানুষেরই মতো কবিতা-টবিতার ধারে-কাছেও তোমার যাতায়াত ছিল না। সুস্থ থাকলেও, কবিতাকে যেসব মানুষ ভালোবেসেছে; তাদের বড়ই কষ্ট।

বড় কষ্ট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *