২৭
ছুটি ফুরিয়ে গেল।
অনেকদিন পর ফ্যাক্টরিতে এসেছে পৃথু। শেলাক্ প্ল্যান্ট-এর হাইড্রলিক প্রেস-এর এবং ওয়াশারের একটানা আওয়াজ অনেকদিন পর কানে বড় মিষ্টি লাগছে।
প্রত্যেক পুরুষের আসল জায়গা বোধহয় তার কাজের জায়গাই। তার জায়গা সংসারে নয়। পুরুষ পেনেলোপে নয়, সে উ্যলিসীস। তবে, পৃথুর কথা আলাদা। ওর আসল জায়গা ওর লেখার টেবল, ওর পড়াশোনার ঘর, যেখানে সে থাকলে সবচেয়েই আনন্দে থাকে। কিন্তু সে যে অগোছাল ব্যর্থ কবি, ব্যর্থ লেখক : তাই-ই নিছক রুজির তাগিদেই যেখানে তাকে একেবারেই মানায় না, সেই কারখানাতেই মানিয়ে নিয়ে থাকতে হয়।
কথাটা কি পরস্পরবিরোধী হল না?
হল।
পৃথুর সমস্ত জীবনটাই তো পরস্পরবিরোধিতার জাজ্বল্যমান উদাহরণ। তার চরিত্রর চাবি-স্বরই হচ্ছে স্ব-বিরোধ। অন্য যে-কোনও মানুষ হলে এই টানাপোড়েনে, অন্তর্দ্বন্দ্বে ছিন্নভিন্ন, তুলোপেঁজা হয়ে যেত এতদিনে।
কারখানা কুসমি লাক্ষাতে ভরে আছে। এখন খুব জোর কাজের সময়। কুসুম গাছে যে লাক্ষা হয় তাকে বলে কুসমি। ভারী সুন্দর এই গাছগুলো। মস্ত বড় বড়। ফিনফিনে পাতা, একটু গোলচে ধরনের। দোলের সময় পাতাগুলো সব লাল হয়ে যায়। বনে পাহাড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে এরা সারা শরীর দুলিয়ে বসন্তশেষের বনে হোরিখেলার আমন্ত্রণ জানায়।
বিকেল শেষ হয়ে এল। দূর দূর পাহাড় জঙ্গলের বস্তি থেকে কুলিরা দিন থাকতে থাকতেই হেঁটে চলে আসে। সন্ধে থেকে পড়ে পড়ে ঘুমোয় স্টিক ল্যাকের বস্তার উপর। রাত দশটার ভোঁ বাজলে নাইট-ডিউটিতে সামিল হবে বলে। পাঁচ থেকে সাতমাইল হেঁটে আসে; হেঁটে যায়। কোম্পানি খুব দয়ালু, ওদের ঘুম ছাড়াবার জন্যে রাত দশটার ভোঁ বাজলে এক গ্লাস করে চা দেওয়া হয় প্রত্যেককে। বিকেলেও দেওয়া হয় একবার। দিনে আট টাকা করে পায় ওরা। এই বন-বাদাড়ে যা পায়, তাই-ই যথেষ্ট। ভিখিরির আবার পর্যাপ্ত অপর্যাপ্ত কী? এই-ই না পেলে তো না খেয়েই থাকত।
দু নম্বর বয়লারটা গোলমাল করছে। কতদিনই বা এই দাসত্ব করবে বেচারিরা। ল্যাঙ্কাশায়ার বয়লার। একটা হরাইজেন্টাল, অন্যটা ভার্টিকাল। একশ ষাট পি সি আই-এর। পি সি আই মানে হচ্ছে, প্রেসার পার পাউণ্ড পার স্কোয়ার ইঞ্চ। বয়লার-এর ক্যাপাসিটি এই ভাবেই মাপা হয়। বয়লার ইনসপেকশানের দিনও এগিয়ে এল। দু নম্বর বয়লারটার একটা হিল্লে করতে হবে। দুটি মেকানিকাল সিভও এরাটিক-বিহেভিয়ার করছে। যন্ত্রদের মধ্যেও বোধহয় মনুষ্যত্বর উন্মেষ হচ্ছে। কবে না আবার বোনাস-টোনাসও চেয়ে বসে। দিনকাল খুবই খারাপ। বলা যায় না কিছু। কোম্পানির পার্সোনেল ম্যানেজার বলছিলেন।
দু নম্বর বয়লারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল পৃথু, এমন সময় বড় সায়েবের খাস বেয়ারা এসে সেলাম করল ওকে। বলল যে, উধাম সিং সাহেব সেলাম দিয়েছেন।
ভগুয়াকে স্টপ ককগুলো ভাল করে চেক করতে বলে, পৃথু উধাম সিং-এর ঘরে গেল অফিস বিল্ডিং-এ। দেখল, ঘর একেবারে ভর্তি। তার মধ্যে, একজনকেই শুধু চিনল। সেনট্রাল এক্সাইজ-এর ইনসপেক্টর। প্রতি মাসে অ্যাকাউন্টস অফিসে এবং কারখানাতে এসে খাতা-টাতা চেক করে সই করে দিয়ে যান। সঙ্গের লোকজনদের দেখে মনে হল, সকলে ওঁর সঙ্গেই এসেছেন। একজন মহিলাও আছেন। সঙ্গে দুজন হৃষ্টপুষ্ট চেহারার হোমরা-চোমরা লোক।
উধাম সিং আলাপ করিয়ে দিলেন, এই-ই যে, যাঁর কথা বলছিলাম, পি ঘোষ মানে পিরথু ঘোষ। আর ইনি হলেন দুঙ্গার সিং। সেনট্রাল এক্সাইজের বড় সাহেব। আর মিসেস সিং। ইনি, মিঃ নাগবেকার। ঘোষ, ভাই তুমি মিস্টার এণ্ড মিসেস সিংকে নিয়ে ফ্যাক্টরিটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে দাও। মিসেস সিং একজন লেখিকা। ইনি শেল্যাক ফ্যাক্টরির ব্যাকগ্রাউন্ডে একটি নভেল লিখছেন। যদিও ওঁর নভেলের ব্যাকগ্রাউন্ড মহারাষ্ট্র, তবু যে-কোনও ফ্যাক্টরি দেখলেই কিছু ধারণা হবে।
ভাগ্যিস লিখছেন! পৃথু বলল। নইলে কি আর পায়ের ধুলো পড়ত এই গরিবখানায়। কী বলেন মিসেস সিং?
মাঝে মাঝে পৃথুও রুষার মতো ভাল কথা বলে। বিশেষ করে, সৌন্দর্য-মোহিত হলে।
যদিও মিসেস সিং সত্যিই সুন্দরী বলতে যা বোঝায় তেমন নন। বয়সে, রুষাদেরই মতো হবেন। তবে, বুদ্ধি ও রুচিজনিত একরকম আলগা শ্রী তাঁর মুখমণ্ডলে লেগে আছে; প্রসাধনেরই মতো।
লজ্জার হাসি হেসে তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
বললেন, আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি; মিস্টার ঘোষ।
নট অ্যাট ওল।
বলল, পৃথু।
মনে মনে বলল, ভারী সরকারী অফসর-এর স্ত্রীদের মধ্যে এমন স্বাভাবিক সৌজন্য দেখা যায় না আজকাল। এখনও এদেশে অনেক কিছুই ভাল আছে। নইলে দেশ বোধহয় চলত না; থেমে যেত। যারা বলে এদেশ থেমে যাবে, থেমে গেছে; তারা ভুল বলে।
সিং সাহেব স্ত্রীকে বললেন, তুমিই যাও। আমি তোমার বই পড়েই সব জেনে নেব, যা জানি না; যখন লিখবে। ল্যাক-এর গন্ধটা আমার সহ্য হয় না। বমি আসে, বিশেষ করে লিকুইড এবং সেমি-লিকুইড ফর্ম-এ যখন থাকে। তোমার জন্যে ইতিমধ্যে চা-টা’র ইন্তেজাম করছেন উধম সিং সাহাব। বেশি দেরি কোরো না। তুমি না এলে, আমরা কিন্তু শুরু করতে পারব না।
মিসেস সিং খুবই সপ্রতিভ মহিলা। ওঁকে সঙ্গে করে নিয়ে কারখানার ভিতরে যেতে যেতে পৃথু ওঁকে জিজ্ঞেস করল :
কোন ভাষায় লেখেন আপনি?
হিন্দিতে। ইংরিজিতেও লিখি। তবে, ক্রিয়েটিভ লেখাটেখা নয়। প্রবন্ধ-টবন্ধ। মিস্টার উধাম সিং তো আমাকেও বলেছিলেন আপনিও নাকি লেখালেখি করেন।
পৃথু লজ্জা পেয়ে বলল, সে বলার মতো কিছুই নয়। আমার কথা থাক। বলুন মিসেস সিং, আপনি কী কী জানতে চান।
সবই বলুন। সব শুনে, যতটুকু জানতে চাই না; সেটুকু বাদ দিয়ে নেব।
সব বলব?
বলেই, হেসে ফেলল পৃথু।
তার চেয়ে আপনি প্রশ্ন করুন।
তা করছি। কিন্তু প্রশ্নর বাইরে কিছু থাকলে তা কিন্তু আপনি নিজেই বলে দেবেন।
আচ্ছা! ওই দেখুন! ওই যে দেখছেন স্তুপ করে রাখা আছে, ওইগুলোকে বলে স্টিক-ল্যাক। চার রকমের ল্যাক আসে কারখানাতে। বৈশাখী, জেঠুয়া, কাতকি আর কুসমি। পলাশ, জংলি ফুল, কুসুম এবং নানা হরজাই গাছে হয় ল্যাক। যেমন করে আম বা লিচুর কলম বাঁধে গাছে, তেমন করে ল্যাকসুদ্ধ গাছের ডাল সুতো দিয়ে বা দড়ি দিয়ে এইসব গাছে বেঁধে দেয় আদিবাসীরা। মানে, বীজেরই মতো। তারপর বলল, আরও একটু পরিষ্কার করে বলি, আম বা লিচু গাছে কলম বাঁধা দেখেছেন তো!
হ্যাঁ।
মনে করুন ওই রকমই। ফিরে যাবার সময় ভারী জঙ্গলে গিয়ে পড়ার আগে লক্ষ্য করবেন পথের দু’পাশে, দেখতে পাবেন; গাছে গাছে এমন কলম বা বীজ। সেই বেঁধে-দেওয়া ডাল থেকে লাক্ষার পোকা সারা গাছে ছেয়ে যায়। মেয়ে পোকাগুলোও গাছের ডাল আঁকড়ে অনড় থাকে আর পুরুষ পোকারা অনবরত ডালে ডালে, উপরে নীচে ঘোরাঘুরি করে মেয়েদের গর্ভবতী করে। তখন মেয়ে পোকাগুলো তাদের শরীরের অসংখ্য ছিদ্র দিয়ে ল্যাক রেজিন বের করতে থাকে। এই সময়ে তারা অনড় অবস্থাতে থাকে বলেই ওই সময়টা গাছের ডাল থেকে রস শুষে খেয়ে বাঁচে। এইভাবে লক্ষ লক্ষ ল্যাকের পোকা গাছময় ছেয়ে থেকে তাদের রসের পরতের পর পরতে ঢেকে দেয় গাছের প্রশাখাগুলোকে। যখন এই ক্ষরণ সম্পূর্ণ হয় তখন শাখা-প্রশাখার উপর প্রায় পৌনে এক ইঞ্চিমতো প্রলেপ পড়ে যায়। আদিবাসীরা সেই প্রলেপ দেওয়া ডাল কেটে নেয়, জীবন্ত ও মৃত পোকাসুদ্ধ। সেই ডালপালাকে টুকরো টুকরো করে কেটে তারা বিক্রি করে। এইগুলোকেই বলে স্টিক-ল্যাক। কেউ কেউ বা গাছের ডাল থেকে ল্যাক চেঁচে নিয়ে আলাদা করেও বিক্রি করে। ন্যাচারালী, তার দাম বেশি পায় তারা স্টিক-ল্যাক থেকে।
এই যে চার রকম নাম বললেন, এর মানে কী? বৈশাখ মাসেই কী বৈশাখী ক্রপ ওঠে?
মিসেস সিং শুধোলেন।
না, না। বৈশাখ মাসে আদিবাসীরা যে বীজ লাগায় গাছে, সেই গাছের ল্যাক যখন তৈরি হয়ে গিয়ে বিক্রির জন্যে পাহাড় জঙ্গলের বস্তির হাটে আসে, তাকেই ‘বৈশাখী’ বলে। তেমনই আবার জ্যৈষ্ঠ মাসে বীজ লাগানো হলে বলে ‘জেঠুয়া’, কার্তিক মাসে হলে বলে ‘কাতকি’। আর কুসুম গাছে যে বীজ লাগানো হয়, তাকেই বলে কুসমি।
বাঃ। বুঝলাম।
মিসেস সিং বললেন।
এবার আপনারা কী করে শেল্যাক বানান ল্যাক থেকে তা বলুন!
বলছি। বলে, পৃথু ওঁকে নিয়ে ক্রাশার প্ল্যান্টের সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, ওই দেখুন, স্টিক ল্যাকগুলোকে ওখানে ক্রাশ করা হচ্ছে। ক্রাশার মেশিনে। মেকানিকাল সীভস অর্থাৎ যান্ত্রিক ছাঁকনি স্টিক-ল্যাক থেকে কাঠ এবং অন্যান্য ইমপিউরিটিস আলাদা করছে কী করে, তা দেখুন। আলাদা করা হয়ে গেলে, ওই দেখুন ওয়াশার ব্যারেলস-এ ল্যাক-এর গ্রেইনসগুলোকে কীভাবে ধোওয়া হচ্ছে।
শুধুই জল দিয়ে ধোওয়া হয় বুঝি? এত জল পান কোথায় এমন রুখু জায়গায়?
জল পাই, নদী থেকে। পুনপুনিয়ার নালা থেকে পাম্প করে পাইপলাইনে করে জল আনা হয়। সেখানে পাম্প বসানো আছে। কারখানাতেও পাম্প আছে, ওভারশেড ট্যাঙ্ক জল তোলে সেই পাম্প।
জঙ্গলের মধ্যের নালাতে পাম্প! চুরি হয়ে যায় না? আমার বাড়ির পাম্পই তো দুবার চুরি হয়ে গেল।
পাহারা থাকে। নইলে, চুরি নিশ্চয়ই হত। এদিকের জঙ্গলের আদিবাসীরা সব সৎ। চুরি করলে এই টাউনের লোকরাই করবে। চলুন, আরও একটু আগে চলুন। ওঃ, বলা হল না আপনাকে, শুধু জল দিয়েই নয়, জলের সঙ্গে সাজিমাটি দিয়েও ল্যাক পরিষ্কার করা হয়।
সাজি মাটি! কোথা থেকে পান? নর্মদা? সাজি মাটি তো পলিই, তাই না?
পলিই। তবে আমরা নর্মদা থেকে আনি না। আনতে হয় কানপুর থেকে। গঙ্গার পলি। ট্রাকে করে আসে এখানে।
তারপর?
স্টিক-ল্যাক ধুয়ে পরিষ্কার করার পর যে পদার্থটি বেরোয় তাকে বলা হয় সীড-ল্যাক। এই সীড-ল্যাক পরিষ্কার এবং শুকনো করা হয় ম্যানুয়ালী। তৈরি হয়ে গেলে, সীড-ল্যাক হয় ওই ভাবেই রেখে দেওয়া হয় এক্সপোর্ট করার জন্যে; নয়তো ওই থেকেই আবার শেল্যাক তৈরি করা হয় কারখানায়।
শেল্যাক কী করে তৈরি করেন?
শেল্যাক প্ল্যান্টেই তৈরি করি। হাইড্রলিক প্রেস আছে। তাতে স্টীমের সাহায্যে স্টিক ল্যাককে গলিয়ে ফেলে শেল্যাক তৈরি হয়। চলুন, দেখাব আপনাকে। একশো কেজি স্টিকল্যাক থেকে পঞ্চাশ কেজি মতন সীডল্যাক বেরোয়। আবার একশো কেজি সীডল্যাক থেকে আশি-পঁচাশি কেজিমতো শেল্যাক হয়। বাকিটা ওয়েস্ট প্রডাক্ট হিসাবে থেকে যায়। তাকে বলে, কিরি।
কিরি?
হ্যাঁ।
অদ্ভুত নাম তো। মজারও বটে!
হ্যাঁ। খুব সম্ভব আর্মেনিয়ানদের দেওয়া নাম। আর্মেনিয়ান ভাষায় হয়তো এর কোনও মানেও আছে। কিরি থেকে আবারও শেল্যাক বের করা হয়, সলভেন্ট প্রসেসে। স্পিরিট এক্সট্রাকশান করে যে শেল্যাক বের করা হয় তাকে বলা হয় গার্নেট।
গার্নেট? বাঃ। এও তো চমৎকার নাম তো!
হ্যাঁ। আর জল এবং সোডা-সল্যুশান দিয়ে সেপারেট করে যে শেল্যাক বেরোয়, তাকে বলা হয় সোয়ানসন।
কী বললেন? সোয়ানসন? সোয়ানসন কি কারও নাম?
হ্যাঁ। আমাদের কোম্পানির পুরনো বড় সাহেবের নাম।
বাঃ। ভদ্রলোককে তো অমর করে দিলেন আপনারা।
সেই রকমই। আমাদের সবচেয়ে বড় কমপিটিটর হচ্ছে আচ্ছুরাম কালকাফ।
জার্মান কোম্পানি একটি। এখন ফেরা অ্যাক্ট-এর আওতাতে এসে আমাদের কোম্পানিরই মতো ভারতীয় হয়ে গেছে। তবে, আমাদের যেমন ইংলিশ ডিরেক্টর আছেন, ওঁদের আছেন জার্মান ডিরেক্টর। বিহারের মুরহুতে, রাঁচির কাছে, এবং ওয়েস্টবেঙ্গলের পুরুলিয়ার ফালদাতে তাঁদের কারখানা আছে। ওই ফেরা কোম্পানির বর্তমান মালিক সোহনলাল ব্যাহল খুবই ধার্মিক লোক। তিনি আবার তাঁদের কোম্পানির এই প্রডাক্ট এর নাম দিয়েছেন “গোপাল”। ইন্ডিয়ান লীডিং এক্সপোর্টারও তাঁরা শেল্যাক-এর। ওই “গোপাল” নামই সারা পৃথিবীতে এখন চালু হয়ে গেছে।
হ্যাঁ। আমাদের কারখানাতে আমি চেষ্টা করছি ব্লীচড ল্যাক করবার, ক্লোরিন এবং সোডা প্রসেসে। ডি-ওয়াক্সড শেল্যাকও ইন্ট্রড্যুস করার ইচ্ছে আছে শিগগিরই।
মিসেস সিং বললেন, বাঃ।
পৃথুর খুব ভাল লাগছিল ভদ্রমহিলার ঔৎসুক্য দেখে। তার নিজের স্ত্রীর কথা না হয় বাদই দিল, এই শেল্যাক ফ্যাক্টরিতে যাঁরাই কাজ করেন, তাঁরা সকলেই নেহাৎ পেটের দায়েই ল্যাক-শেল্যাক তত্ত্ব সম্বন্ধে অবগত আছেন। সকলের স্ত্রীরা হাটচান্দ্রাতেই এতদিন থাকা সত্ত্বেও তাঁদের কারও মধ্যেই এমন ঔৎসুক্য লক্ষ করেনি ও। জানার ইচ্ছা আর ঔৎসুক্যই তো মানুষকে তার ইতিহাস এত দূরের এত দুর্গম সব অজানা পথ অতিক্রম করিয়ে নিয়ে এসেছে! ইতিহাস অন্তত তাই-ই বলে। ভাবছিল পৃথু। নিরুৎসুক মানুষ তো মৃত মানুষই। যদিও উধাম সিং-এর অনুরোধে এই কর্তব্য করছে পৃথু, তবু ব্যাপারটাতে কোনওই গন্ধ পাচ্ছে না কর্তব্যর; প্রশ্নকর্ত্রীর সহজ, আন্তরিক এবং সপ্রতিভ উৎসাহরই কারণে।
আমাদের দেশে তো লাক্ষা অনেকদিন থেকেই তৈরি হচ্ছে, তাই না?
নিশ্চয়ই।
কী কী কাজে লাগত এ, প্রাচীন ভারতবর্ষে?
গয়না তৈরি হত, খেলনা তৈরি হত, আলতা তৈরি করতে লাগত লাক্ষা, রঙ তৈরি করতেও লাগত। এখনও লাগে। ঊনিশশো ঊনপঞ্চাশ সন অবধি এদেশের সব গ্রামোফোনের রেকর্ডও তৈরি হত এ দিয়ে।
তাই-ই বুঝি? আর এখন? এখন হয় না?
এখন তো সিন্থেটিক মেটেরিয়ালেই হয়। পলী-ভিনীল-ক্লোরাইড। এবং অ্যাসিটেট।
এক্সপোর্ট হয় অনেক, না? লাক্ষা?
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সতেরোশো ছাপ্পান্ন থেকে লাক্ষা রপ্তানি করছে ইংল্যান্ডে। আঠারশো পঞ্চান্নতে ইংরেজ-ইটালিয়ান কোম্পানি কলকাতার অ্যাঞ্জেলো ব্রাদার্স শেল্যাক তৈরি করা বোধহয় প্রথম আরম্ভ করে। ঊনিশশো বিরাশিতে শ্রমিক বিরোধের কারণে সেই কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায়।
ওয়েস্ট বেঙ্গলের তো এখন এই-ই ট্রাডিশান শুনতে পাই।
তাই-ই তো শুনি এদিকে বসে। নিজে সেখানে থাকলে ঘটনাটি সত্যিই যে কী তা বোঝা যেত।
কোন কোন দেশ আমাদের এখান থেকে ইমপোর্ট করে শেল্যাক?
ইউ এস এ, ইউ এস এস আর, পশ্চিম জার্মানী, ইউ কে, ইজিপ্ট, পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না, ইন্দোনেশিয়া এবং আরও অনেক দেশ।
বাঃ বাঃ! এই সব দেশ করে কী শেল্যাক দিয়ে?
অনেক কিছুই করে। ভার্নিশ, পেইন্ট, ইলেকট্রিক ইনসুলেশ্যান, মাইকা বোর্ডিং, প্রিন্টিং-ইঙ্ক এবং ফার্মাসিউটিকাল কোটিংস। আপনারা যে ওষুধের ক্যাপসুল-এর উপর কোটিং দেখেন, তাও এই শেল্যাক এরই।
সে কী? খাওয়ার জিনিসে?
হ্যাঁ। শেল্যাক একেবারেই অখাদ্য তা ভাবছেন কেন? এইবার ডানদিকে চলুন। হাইড্রলিক প্রেসের দিকে। ইউ এস এ-তে এবং ওয়েস্ট-ইউরোপিয়ান দেশগুলিতে তো ফল এবং নানারকম খাবারের উপরেও কোটিং হিসেবে ব্যবহার করছেন ওঁরা এখন শেল্যাক। নিয়মিত।
কী খাবার?
চকোলেটের উপরটা যে চকচক করে, আপেলের যে জেল্লা, ওঁরা এখন তা, এই শেল্যাক দিয়েই দিচ্ছেন। ফল এবং খাবারের প্রিসার্ভেটিভ হিসেবেও এর গুণ স্বীকৃত হয়েছে। বইয়ের মলাটেও ঢালাওভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে শেল্যাক। আমাদের দেশেও হচ্ছে।
সত্যি!
অবাক হয়ে বললেন মিসেস সিং।
এমন সময় উধাম সিং-এর খাস বেয়ারা আবার দৌড়ে এল। পৃথুকে বলল, সামোসা আর চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, মেমসাহেবকে নিয়ে তাড়াতাড়ি যেতে বললেন বড় সাহেব।
চলুন তাহলে মিসেস সিং! এতেই আপনার কাজ হবে আশা করি। তাছাড়া আপনারা যারা লেখেন-টেখেন তাঁদের ইমাজিনেশান বলেও তো একটা ব্যাপার থাকে!
তা জানি না, তবে জ্ঞান তো একটু হল না, অনেকই হল! একসঙ্গে এত জ্ঞান হলে একই সঙ্গে সবটুকু জ্ঞান দিয়ে দেবার প্রবণতাও আসতে পারে নেশাতে। ফিকশান তো আর প্রবন্ধ নয়। তাই, সব জ্ঞান একসঙ্গে দিতে নেই; একটু একটু করে গল্পের মধ্যে মধ্যে মিশিয়ে দিতে হয়।
বাঃ। ভাল বলেছেন। জানা রইল। তবে, লিখতে বসে যদি আটকে যান তখন আরও কিছু জানার থাকলে নিঃসঙ্কোচে চিঠি লিখবেন আমাকে। জানিয়ে দেব। চলুন, এবারে নামতে হবে। দেখবেন, উৎরাই আছে এ জায়গাটাতে। পা মচকে যায় অনেকের।
ঠিক আছে।
বলে, শাড়িটা সামান্য তুলে নিয়ে নামলেন মিসেস সিং। পায়ের পাতা এবং গোড়ালিটি ভারী সুন্দর। লক্ষ করল পৃথু।
অদ্ভুত মানুষ ও একটা। পৃথু ভাবল মেয়েদের শরীরে ছড়ানো-ছিটানো এত কিছু সৌন্দর্য থাকে তবু ও চিরদিনই মুখ ছেড়ে; পা, দেখে হাতের আঙুল, আর পায়ের গড়ন, চিবুক আর দাঁত দেখেই প্রেমে পড়ল। গত জন্মে বা অনেক জন্ম আগে ও নিশ্চয়ই চীনদেশে বাস করত। অথবা হাঙ্গর কিংবা ওয়ালরাস ছিল।
মিসেস সিং বললেন, আর একটা কথা জিজ্ঞেস করব। যা এক্সপোর্ট হয় তার সবই কি শেল্যাক?
না, না। সব নয়। তবে বেশিটাই। গত বছরে, পাঁচ হাজার মেট্রিক টন শেল্যাক, এক হাজার মেট্রিক টন সীডল্যাক এবং দুশো টন কিরি এক্সপোর্ট হয়েছিল।
ভারতবর্ষ ছাড়া অন্য কোথাও হয় না ল্যাক?
হাসল, পৃথু।
বলল, হয় বৈ কি! তবে, শতকরা ষাট ভাগই ভারতবর্ষে হয়। পঁয়ত্রিশ ভাগ হয়, থাইল্যান্ডে। আর পাঁচ ভাগ পীপলস রিপাবলিক অফ চায়নাতে।
ভারতবর্ষের বেশি শেল্যাক কি মধ্যপ্রদেশেই হয়?
না, না। ভারতের মধ্যে ষাট ভাগই হয় বিহারের পালামৌ, রাঁচী আর সিংভূম জেলাতে। ওয়েস্ট বেঙ্গলের পুরুলিয়াতেও হয়। এছাড়া বাকিটা ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের কিছু জায়গা এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে অন্যান্য রাজ্যে। যেখানে জঙ্গল আছে।
একটু থেমে বলল, ল্যাক ছাড়াও এখানে খুব ভাল সামোসা আর কালা-জামুনও হয়। আশা করি উধাম সিং সাহেব আপনাদের কাছে নমুনা পেশ করবেন।
মিসেস সিং হেসে উঠলেন।
বললেন, যা হাঁটালেন এতক্ষণ, চড়াইয়ে উৎরাইয়ে। খিদে যে একটু পায়নি, তা বলব না। তারপর এতটা পথ গাড়িতেই এসেছি। সামোসা এবং কালা-জামুন ‘বৈশাখী’ না ‘জেঠুয়া’, না ‘কাতকি’ না ‘কুসমি’ তাও কী এখন পরীক্ষা করে দেখতে হবে?
মিসেস সিংকে নিয়ে পৃথু উধাম সিং-এর অফিসে ঢুকল।
অনুমানে একটু ভুল হয়েছিল ওর। সামোসা ছিল। কিন্তু কালা-জামুনের বদলে বড় বড় ডবকা লাড্ডু; লাড্ডুর দোকানের।
ইয়ে ভি হিঁয়াকা কিমতি চিজ। পৃথু কালাজামুনের অভাব মেটাতে মিসেস সিংকে বলল।
লাড্ডুর অসাধারণ সঙ্গীত-প্রতিভার কথা হাটচান্দ্রাতে রাষ্ট্র হয়ে যাবার পর ওর দোকানের লাড্ডুর কদর আরও বেড়ে গেছে। ভয় হচ্ছে, হৃদয় নিঙরানো গানের চেয়েও দোকানের লাড্ডুরই ইজ্জৎ বেশি না হয়ে যায় শেষে!
মিসেস সিংকে পৌঁছে দিয়েই ওঁদের সকলের অনুরোধের উত্তরে আসছি বলে কারখানায় চলে গেল পৃথু। এই সময়ে কাজের খুবই চাপ থাকে। শেল্যাক ইন্ডাস্ট্রিটাই সীজনাল। জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে প্রডাকশন বন্ধ থাকে। যদিও কারখানা বন্ধ থাকলেও কাজ বন্ধ থাকে না। মাল চালান যায়। তখন পৃথুর কাজ আরও বাড়ে। প্লান্ট, থরোলী রিপেয়ার করতে হয়, মেইনটেনান্স, ডেভেলাপমেন্ট, কন্সট্রাকশন সব কিছুই সেই সময়ই। মেকানিকাল এঞ্জিনীয়ার হলেও জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই করে ও। এই কারাখানাকে, ওর রুজির স্থানকে, ঘেন্না যেমন করে, তেমনই তীব্রভাবে এক ধরনের ভালবাসাও আসে। কারণ, ওর নাম পৃথু ঘোষ; দ্যা লাউজিয়েস্ট পাজল; সিন্স দ্যা ডিসকভারী অফ পাজলস্। যাই-ই যখন করে, তখন তা খারাপ করে করতে পারে না ও। কোনও কিছুই। বয়লার মেরামতি থেকে রুষাকে আদর করা পর্যন্ত। পৃথু ঘোষ-এর চরিত্রর এইই একটা দিক। দোষের অথবা গুণের।
কী সুন্দর সুন্দর নাম সব। দুর্গন্ধ কারখানার মধ্যে ওই নামগুলোই এক ধরনের রোমান্টিকতা বয়ে আনে। গার্নেট অরেঞ্জ; লেমন এবং বাটন ল্যাক। ‘কাতকি’, ‘জেঠুয়া’, ‘বৈশাখী’, ‘কুসমি’।
সে যাই-ই বলুন, ওর এই দেশটা ভারী সুন্দর। আর সুন্দর এই দেশের সাধারণ সব গরিব, সরল অশিক্ষিত মানুষগুলো। এদেশের শিক্ষিত আর বড়লোকগুলোই দেশটাকে ডুবিয়ে দিল। শহরের মানুষগুলো, বাদামি, লোভী এই নব্য ভারতের সাহেবরা!
ব্যতিক্রম আছে। অবশ্যই আছে। ব্যতিক্রম তো প্রমাণ করে যে, সাধারণ সত্যি!