৩৬
ওই তান্ত্রিকের জন্যেই দিনটা খারাপ হয়ে গেল। মানুষটার চেহারা, কথাবার্তা, হাঁটা-চলা, মেয়েদের সম্বন্ধে নানারকম উক্তি এই সব কিছু মিলেমিশে মানুষটা যে জাল, আসলে তান্ত্রিকই নয় এমন একটা সন্দেহও হচ্ছিল সকলের।
ভুচু তো একবার দূরে ডেকে নিয়ে গিয়ে ইনডায়রেক্টলী বলেও দিল যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যেতে এ জায়গা ছেড়ে। তাতে দিগা আহত হল। দিগা সত্যিই উঁচুদরের সাধক। ওর কাছে সকলেই সমান। কিন্তু এই মানুষটা ধূর্ত, ডাকাতদের ইনফরমার হওয়াটাও আশ্চর্য নয়। হয়তো মগনলালই পাঠিয়েছে।
বেলাবেলি খাওয়া হল না। সেই দেরিই হয়ে গেল। ছাড়া-ছাড়া কথা হল। তবে, দিগা যে ভাল হয়ে গেছে তা জেনে সকলেই খুশি হল।
একসময় জীপে উঠে বসল সকলে। খাওয়ার পর গাছতলাতেই গড়িয়ে নিয়েছিল একটু।
শীতের বেলা পড়ে আসছে। ছায়ারা দীর্ঘতর হচ্ছে। ঝোপে ঝোপে তিতির, বটের আর আসকলরা নড়ে চড়ে বসে দীর্ঘ রাতের জন্যে তৈরি হচ্ছে।
জীপের মধ্যে নানা কথা বলছে ওরা। পৃথু ওদের মধ্যে থেকে একা হয়ে গেছে। ও তো একাই। বাইরের প্রকৃতিতে চেয়ে আনন্দ বাগচীর কবিতার কটি পঙ্ক্তি ভেসে এল ওর মনে।
কবিতা এমন হঠাৎ হঠাৎই মনে আসে।
“সোনা গুঁড়ো-রোদ চেলাই কাঠের করাতের নিচে।
ঝরে জরিদার চিকের মতন। মেয়েলি আলোয়
ডালে ডালে সেই কাঠবিড়ালকে খুঁজে মরা মিছে
সময় এখন আকাশের নীল গম্বুজ ছোঁয়”
জোরে জীপ চালিয়েছে ভুচু। তবে টিকিয়া-উড়ান নয়। শীতের শেষ বিকেলের গন্ধ মাথা ধুলো উড়ছে চাকায় চাকায়। মাথা-গা ভরে যাচ্ছে ওদের। পথ-পাশের পিটিসের আর কেলাউন্দার ঝোপে ঝোপে এবং শাল-চারায় থিতু হয়ে বসছে সেই মিহি মিষ্টি-গন্ধ ধুলো।
বড় রাস্তায় উঠে এল ওরা। একটা জংলি নাম-না-জানা গাছ ফিকে বেগুনি-রঙা ফুলে ছেয়ে গেছে। তার নীচে দাঁড়িয়ে আছে একটি গোঁন্দ মেয়ে। ফুলের বেগুনি ছায়া পড়েছে তার চিকন কালো গায়ে। বিকেলের মরা হলুদ মাখামাখি হয়ে গেছে কালো অঙ্গে রঙ্গ-ভরা বেগুনি ছায়ার সঙ্গে। ঝরাপাতারা উড়ে যাচ্ছে গাছ থেকে হাওয়ার সওয়ার হয়ে। ঘুরে ঘুরে নৃত্যরতা ব্যালেরিনার মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে পাথরে, টাঁড়ে।
রাত নেমে আসবে.একটু পরেই।
কে জানে, এ মেয়ে কোথায় যাবে? কোনও মেয়েই আসলে যায় না কোথাওই। ওরা কিছুটা গিয়ে মিশে যায় কিছু না কিছুর সঙ্গে। কোনও নদীতে; বা সমুদ্রে অথবা কোনও পুরুষে।
রাত নেমে আসছে।
“ফুলন্ত বৃক্ষের পাশে দাঁড়িও না কাকবন্ধ্যা নারী
বৃক্ষপতনের শব্দ সারারাত স্বপ্নের ভিতরে
সারারাত স্বস্তিহীন আর্তনাদ, রক্তাক্ত আত্মার মতো স্থির
কার প্রতিচ্ছবি হয়ে কেঁপে ওঠে বৃক্ষের শরীর।
স্মৃতির কুঠার ক্রমে আত্মঘাতী তীক্ষ্ণ তরবারি।”
কার?
প্রণব মুখোপাধ্যায়ের।
আজকে কবিতাতে পেয়েছে পৃথুকে। নিজে কবি হতে না পারলে কী হয়, সব কবিদেরই সে আত্মজ করেছে। কবি না হতে পারার সব দুঃখ ঢাকা পড়ে গেছে এই আশ্চর্য আনন্দে।
দূরে বিলিনীয়ার চৌমাথা দেখা যাচ্ছে। শালপাতার দোনা ধুলোর সঙ্গে উড়ছে হাওয়ায়। লাল-রঙা একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে সামোসা, কালাজামুন আর চায়ের দোকানের সামনে। এই মোড় থেকে অন্য একটা লাল মাটির রাস্তা বেরিয়ে গেছে রাইনার দিকে। কুর্চির বাড়ির দিকে। একথা ভাবতে ভাবতেই, জীপটা মোড়ে এসে পৌঁছল।
হঠাৎ পৃথু বলল, একটু দাঁড়াবে ভুচু?
কেন? পান খাবে? অনেক পান আছে পৃথুদা।
না। আমি নেমেই যাই।
সকলে সমস্বরে বলে উঠল, কোথায় যাবে? নামবে কেন? হলটা কী?
কেনর জবাব পৃথুর নিজের কাছেও নেই। কিন্তু এক্ষুণি যেতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। কুর্চিকে একবার দেখতে ইচ্ছে করছে খুউব।
পৃথু বলল, আমাকে বাসটা ধরিয়ে দাও। রায়নাতে যাব ভুচু।
রায়না? সেখানে কী? এ আবার কী নতুন বায়না তোমার! রোজ রোজ?
গিরিশদা বললেন।
এমনিই, যাব একটু।
যেতে চাচ্ছে, যেতে দিন না বাবা। অত কৈফিয়ৎ চাওয়া কিসের? কিন্তু পৃথুদা ফিরবে কী করে তুমি?
ভুচু শুধোল।
গিরিশদা বললেন, শ্রীকৃষ্ণ এসে যাবে একটু পরেই সাবীর সাহেবের বাড়ি। ওকেই পাঠিয়ে দেব।
বাঃ। তাহলে তো ভালই হয়। ভুচু বলল। কিন্তু এসো কিন্তু। আমরা না খেয়ে তোমার জন্যে বসে থাকব পৃথুদা।
গিরিশদা বললেন, ভায়া, আবার সেদিনের মতো যেন…
ঠিক আছে।
বলেই অপরাধীর মতো মুখ করে পৃথু নেমে গেল।
বড় অপরাধী লাগে নিজেকে। ভালবাসা বড়ই অপরাধের। যে বেসেছে; সেই-ই জানে।
বাসের জানালায় হাত রেখে বসে দেখল যে, জীপটা চলে গেল। ও জানে যে, ওকে নিয়ে; ওর জটিল ভবিষ্যৎ নিয়ে, ওর হিতার্থীরা এখন উৎকণ্ঠিত আলোচনা করছেন জীপের ভিতরে। কেউ বলছেন এ ভারী অন্যায়। এ কী! বিয়ে-শাদী করা লোকের এ কী পাগলামি! কেউ বলছে, যাক যাক। বেচারি ভালবেসে ফেলেছে। ভালবাসার মত অসুখ কি আর আছে? ওকে বোকো না। ও বোকা। করুণা কোরো ওকে। বেচারি!
রায়নার বাজারে এসে যখন নামল, তখন রাত হয়ে গেছে। কুর্চিদের বাড়ির দিকে হেঁটে চলল ও। রাত বটে, কিন্তু অন্ধকার নেই। ফুটফুট করছে জ্যোৎস্না। বনফুলের গন্ধর সঙ্গে রাতের গন্ধ জ্যোৎস্নার গন্ধে কুঁচফুলের গন্ধ মিশে গেছে। বাড়িটার কাছাকাছি এসেই প্রথম খেয়াল হল ওর যে, বাড়িটা অন্ধকার। পৃথিবীময় নরম চাঁদের আলো শুধু কুর্চির বাড়িই অন্ধকার। কেন? তবে কি ওরা চলে গেল ভোপাল, পাঁচমারী, মাণ্ডু, ভীমবৈঠকা? পৃথুকে না বলেই কুর্চি চলে গেল? এই-ই ভালবাসা?
গেটে পৌঁছে মনে হল কেরোসিনের আলো জ্বলছে যেন ভিতরে। কী হল? বাজারে তো ইলেকট্রিকের আলো ছিল। লোডশেডিং হল কি?
গেটটা খুলে ঢুকল ও ভিতরে। কোনওই সাড়া শব্দ নেই। ভুতুড়ে লাগছে পুরো বাড়িটাকে। দরজাও বন্ধ। গা-ছমছম পরিবেশ। পেছনের টাঁড় থেকে শেয়াল ডেকে উঠল হুক্কা-হুয়া করে। কড়াও নেই দরজার। যে দরজাতে কড়া নাড়ার খুবই দরকার, সেই দরজাতেই কড়া থাকে না। হাত দিয়ে ঘুষি মারল। কয়েকবার আস্তে করে। কোনও সাড়া নেই। আরও কয়েকবার করল আওয়াজ। জোরে। এবার যেন ভিতর থেকে কুর্চির গলা পেল। নাকি মনের ভুল?
কওন?
বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে কুর্চি বলল।
আমি। কুর্চি, আমি।
মুখে বলল, পৃথু।
ওর মন নিরুচ্চারে বলল, আমি এসেছি কুর্চি। আমার সমস্ত আমি। দরজা খোলো। দরজা খোলো।
কওন?
আমি, কুর্চি। আমি পৃথুদা।
বিশ্বাস হল না যেন কুর্চির। নির্জনে বাস। রাতের পথিককে দরজা খোলার আগে অনেকবারই ভাবতে হয়। কেন জানে না, কুর্চি বলল, কোন পৃথুদা।
আমি। আমি তোমার পৃথুদা।
মনে মনে বলল, কজন পৃথুদা আছে? পৃথু তো একজনই। কোনও প্রোটোটাইপ নেই পৃথুর।
আবার সঙ্গে সঙ্গে ভাবল, বহিরঙ্গে না হলেও অন্তরঙ্গে যে অনেকগুলো পৃথু! সেও তো অনেকগুলো। টুকরো টুকরো পৃথু। তার সমস্তটা তো সে নিজে ইচ্ছে করলেও দিতে পারে না কাউকে। সে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। তার সমস্তকেই তুলে দেয় কারও হাতে এমন সাধ্য কী তার?
দরজা খুলল এসে কুর্চি। রাতের সব শীত, আর জ্যোৎস্না আর সব ভালোবাসা নিয়ে ঢুকে পড়ল ও কুর্চির ঘরে।
আসুন। আসুন। কী করে এলেন? এই রাতে? গাড়ি কোথায়?
বাসে এসেছি।
বসুন। বসুন। হঠাৎ? এমন অসময়ে? কেন? কী ব্যাপার।
কেন?
আবারও কেন? কুর্চি শুধোচ্ছে, কেন?
কেন। তা কি পৃথুই জানে?
মুখে বলল, বড় অসময়ে এলাম, না?
কুর্চি বলল, আপনি যখনই আসেন তখনই আমার সুসময়।
বলছিলাম, হঠাৎ এই রাতে?
পৃথু লণ্ঠনের আলোয় কুর্চির চোখে চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। বলল, তোমাকে খুউব দেখতে ইচ্ছে করছিল, তাই-ই…
যেন অপরাধ আর রাখার জায়গা নেই। কুর্চি একটুক্ষণ ওর চোখে চেয়ে, হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বসাল ওকে সোফায়। পৃথুর মন বলল, কোনও দুর্বোধ্য কারণে কুর্চির খুবই খারাপ সময় যাচ্ছে। এর আগের বার যখন এসেছিল, তখনও লক্ষ করেছিল। চাঁদের আলোর মতো দারিদ্রও নিঃশব্দে চারিয়ে গেছে বাড়িটার ফাঁক-ফোঁকরে। ছুঁচোর গায়ের গন্ধর মতো দারিদ্র্যর গায়ের গন্ধ পাচ্ছে নাকে পৃথু! কিন্তু কেন?
সোফায় বসিয়ে, পাশের সোফায় বসল কুর্চি।
পৃথু বলল, সামনে এসে বোসো। তোমাকে দেখতে পাই না ভাল করে, পাশে বসলে।
আমি কি দেখার মতো?
তা জানি না। তবু, একটুখানি দেখতে পাব বলেই তো আসি। ভালবাসি যে!
খেয়ে যাবেন তো?
না। তেল-কই আর দই-মাছ অনেক খাইয়েছ তুমি। মনে মনে বলল।
মুখে বলল, খেতে আসিনি। তোমাকে একটু দেখতে এসেছি। ভাঁটু কোথায়?
দাঈ? বাড়িটা এত নিস্তব্ধ কেন?
দাঈ গেছে দুদিনের ছুটি নিয়ে।
আর ভাঁটু?…
ভাঁটু…
কোথায় ভাঁটু?
পরে বলব।
আজকে ফিরবে না?
না।
ফিরবে কবে?
জানি না।
তার মানে?
জানি না। পরে বলব।
তুমি একা আছ? ছিঃ। খবর পাঠাওনি কেন একটা আমাকে? কেউ এসে তোমার সঙ্গে থাকত।
কেউ?
কে কেউ?
যে-কেউ?
বন্দোবস্ত করতাম আমি।
আমার যে, কেউই নেই পৃথুদা! কে-কেউ?
তারপর কুর্চি মুখ নামিয়ে, নিচের দাঁতে উপরের ঠোঁট কামড়ে বলল, আপনি ছাড়া আমার সত্যিই কেউই নেই! অথচ, আপনিও আমার কেউ নন।
আলো জ্বালাওনি কেন? বাজারের সব আলো তো জ্বলছে। ফিউজ হয়ে গেছে? কোথায় আছে ফিউজ? চলো, আমি ঠিক করে দিচ্ছি।
ভাঙতে চেয়েছিলাম অন্ধকারেই, ভুলবশে ভেঙে ফেললাম আলো। ভালই! আসলে লাইন। কেটে দিয়েছে।
সেকি? কেন?
যে কারণে কাটে।
কী বলছ তুমি! কী হয়েছে আমাকে বলবে না? কী হয়েছে তোমাদের? হঠাৎ এই…
বলব। আপনাকে ছাড়া আর কাকেই বা বলব? তবে এখন নয়, আজ নয়। জানেন পৃথুদা আমি জানালায় বসে পিছনের টাঁড়ের জ্যোৎস্না দেখছিলাম। মাথা উঁচু পাহাড়, গভীর জঙ্গল, আর তার আঁচলেরই মত ওই টাঁড়। কত সব রাত চরা পাখি, কত জন্তু জানোয়ার! গভীর রাতে হয়ত জিন্পরীরা খেলা করে এমন জায়গাতেই। পৃথিবীটা কী সুন্দর। না? ভাবছিলাম, বসে বসে যে, কোনও কোনও মেয়ে অভাগী হয়েই এখানে আসে। সৌন্দর্য এক্কেবারে বুকের মধ্যে বাস করেও সেই সৌন্দর্যে কোনও দাবিই থাকে না তাদের।
আমি বুঝি না তোমাকে।
কেইই বা কাকে বোঝে বলুন? নিজেরাই কি বুঝি নিজেদের?
তাই…।
আমাকে বলবে না?
চা খাবেন তো?
আবারও কি পা পোড়াতে চাও আমার? কিন্তু তুমি রান্না করছ কী করে? ওই ভাবে? ওই ভাবে উদোম জায়গায় কেউ রান্না করতে পারে? স্টোভ কিনে নিয়ে আসব কালকেই আমি। ভেবেছিলাম।
ভেবেছিলাম, “এটা করব ওটা করব, আমি করব পাহাড়চুড়োয়”…আমার কথা ছাড়ুন।
ছাড়ব কী করে? তাছাড়া, একজন মেয়ের পক্ষে এইরকম নির্জন জায়গাতে অন্ধকারের মধ্যে থাকা কি সম্ভব নাকি? একা একা?
সব মেয়েরাই একা, এই বীর পুরুষদের দেশে। সব জায়গায়।
না, না। তুমি জানো না। এই সব জায়গাতে এখন ডাকাতদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। মেয়েদের যে অনেকই বিপদ! অনেকরকমের।
মেয়েরা তা জানে। সব মেয়েরাই।
তুমি আমার কাছে শুধু একটি মেয়েমাত্র নও কুর্চি। তুমি এভাবে… তুমি…
আমি আপনার কাছে কী?
কুর্চির চোখের কোণে নীরব হাসি ঝিলিক মেরে গেল।
ও আবারও বলল, বলুন। জবাব দিন। আমি আপনার কে?
পৃথু সোফা ছেড়ে উঠে গিয়ে কুর্চির দু গালে দুটি হাতের পাতা ছুঁইয়ে বলল, তুমি আমার সব কুর্চি।
মনে মনে বলল, তুমি আমার সর্বস্ব। তুমি আমার সুখ, তুমি আমার দুখ, তুমি আমার জীবন, মরণ, আমার অস্তিত্ব; অনস্তিত্ব। কুর্চির চোখ দুটি জলে ভরে এল। দু হাত দিয়ে ছাড়িয়ে দিল পৃথুর দু হাত দু গাল থেকে।
বলল, মিথ্যেবাদী! মিথ্যেবাদী! মিথ্যেবাদী! ভীষণ খারাপ লোক আপনি।
সবাই-ই তাই বলে।
পৃথুর বুকটা ভেঙে যেতে লাগল। গলার কাছে কী যেন সব দলা পাকিয়ে উঠতে লাগল।
জানালার কাছে গিয়ে জানালাটা খুলে দিল কুর্চি। শীত আর চাঁদ ঘরে ঢুকল হাত ধরাধরি করে। ধূ ধূ করছে চাঁদের আলোয় বাইরের টাঁড়। টি-টি পাখিরা ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে চমকে চমকে ডাকছে হট্টি-টি-টি-হুট টি-টি-টি-হুট। এই পাখিদের ডাক মানুষের বুকের মধ্যের নরম সব কিছুকে কাপাস তুলোর মত পিঁজে দিয়ে টংকারে আর উৎসারে উড়িয়ে দেয় আকাশময়। মন খারাপ লাগে বড়। গা ছমছম করে। শম্বরের দল রায়নার বস্তির দিকে চলেছে কুলথী আর অড়হর ক্ষেতের ফসলের লোভে। শিঙাল সর্দার শম্বরের সংক্ষিপ্ত চাপা অতর্কিত ঢাংক, ঢাংক ডাক ভেসে এল। একবার। তারপরই শীতরাতের স্তব্ধতা। টি টি পাখির ডাকে মাঝে মাঝে তা শুধু ছিদ্রিত হচ্ছে। টাঁড়ের ঠিক মধ্যিখানে একটা বুড়ো মহুয়া গাছ আছে। তার শাখা প্রশাখায় চাঁদের আলো স্বপ্ন বুনেছে যেন, ব্যঙ্গমা-বেঙ্গমী, কুঁচবরণ রাজকন্যা, যার মেঘবরণ চুল তারা যেন সব এই চাঁদের আলোয় সেই বুড়ো গাছের পাতায় পাতায় এসে বাসা বেঁধেছে। সত্যিই! পৃথিবী কী সুন্দর! এত সৌন্দর্যর বুকের মধ্যিখানে বাস করেও সেই সৌন্দর্যর দাবীদার না হতে পারার মতো দুঃখ বোধহয় বেশি নেই। কুর্চি কি একথা জানে যে, কুর্চিরই মতো তার নিজের আঁজলা গলেও সব সৌন্দর্য চুঁইয়ে গেছে। ধরে রাখতে পারেনি আরেকজনও, একাংশকেও।
পৃথু সম্মোহিতের মতো উঠে গিয়ে কুর্চির কোমর জড়িয়ে ধরল। তারপর সেই ডানাতেই বুকের কাছে টেনে নিল তাকে। এই-ই প্রথম; এ জীবনে। মুখ নামিয়ে আনল কুর্চির ঠোঁটের কাছে। তারপর তার নিজের ঠোঁটি হঠাৎ রাখল কুর্চির ঠোঁটে। চুমু খাওয়ার জন্যে নয়। কুর্চির সব ব্যথাকে নিঃশেষে শুষে নেবার জন্যে।
কুর্চি আপত্তি করল না। কিন্তু ওর আনন্দযজ্ঞে যোগও দিল না। এই মুহূর্তে অন্য দশজন মেয়ে যা করে, তাদের দুটি হাত দিয়ে পুরুষকে জড়িয়ে ধরে প্রকাশ করে তাদের গাঢ় নিরুচ্চার ভালবাসা, সমর্পণের নীরব স্বীকৃতিতে, কুর্চি তাও করল না।
কুর্চি যে দশজনের মতো নয়! হলে কি আর পৃথু ভালবাসত তাকে!
পৃথুর ভিতরে বাঘটা জেগে উঠেছিল। সেই অসভ্য জংলি বুনো-গন্ধ বাঘটা। ঘুমিয়ে-থাকা কাঁকড়াগুলোও হঠাৎ ঘুম ভেঙে কামড়াকামড়ি শুরু করেছিল। ও বুঝতে পারছিল যে, কুর্চির জন্যে তার জমিয়ে রাখা দীর্ঘ প্রতীক্ষার বছরগুলির অবদমিত কামের খড়ের ঘরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠেছে। আর সামলাতে পারবে না ও নিজেকে। এ নিছক কাম নয়; গভীর ভালবাসায় সিঞ্চিত এক জ্বালাধরা অনুভূতি। বিজ্লী আর কুর্চি তো এক নয়। কুর্চির হাতে হাত রাখামাত্রই তার শরীরের পুরুষের কেন্দ্রবিন্দু হঠাৎ সেই তীব্র আনন্দের যন্ত্রণায় দৃঢ় হয়ে ওঠে। চিরদিনই। পৃথুর হাঁটু কাঁপছে থরথর করে। রেডি, গেট সেট্… দারুণ দৌড় শুরু করবে ও আবার। প্রথম কৈশোর থেকে এই দৌড়েরই স্বপ্ন দেখে এসেছে, কল্পনা করেছে এক বিশেষ সুগন্ধি বনবীথি দিয়ে দৌড়ে যাবে। আজ…
ঠিক সেই সময়েই কুর্চি তাকে ঠেলে সরিয়ে দিল। বেশ জোরেই ঠেলল।
নাঃ। না-আ-আ-আ… অস্ফুটে বলল, কুর্চি।
কেন কুর্চি? না কেন? কেন না?
পৃথু আশাভঙ্গতায় ছাই হয়ে গিয়ে বসল। বসল বটে, তবুও ওকে নিয়ে বড় সোফাটার দিকে যেতে লাগল। পৃথুর চোখের উপবাসী ভিখিরির তীব্র খিদে জ্বলজ্বল করছে। পুরুষ মাত্রই জন্মভিখারি। উপবাসী। অন্তত এই দেশে।
কুর্চি হেসে উঠল হঠাৎ। হিঃ হিঃ হিঃ করে।
মনে হল, ডাইনি হাসল চাঁদের রাতে। এ কুর্চির হাসি নয়। অবাক হয়ে হাত আলগা করে দিয়ে ছেড়ে দিল পৃথু, কুর্চিকে।
কী পৃথুদা! একটু আগেই না ডাকাতের ভয়ের কথা বলছিলেন আমাকে আপনি? ডাকাতরা আমাকে এমন একা অরক্ষিত পেলে কী করত? আপনি যা করতে যাচ্ছেন তাই নয় কি? আপনি…
লজ্জিত পৃথু অর্থহীন শব্দ করল একটা মুখ দিয়ে। কী যে বলল, তা বোঝা গেল না।
একজন জংলি অশিক্ষিত ডাকাত যা করত আমাকে নিয়ে আপনিও কি আমাকে নিয়ে তাই-ই করবেন? আমার অনুমতি ছাড়াই…
কুর্চি ফিরে গিয়ে সোফায় বসে বলল, শান্ত হোন পৃথুদা। শান্ত হয়ে বসুন।
একটু পর স্বগোতোক্তির মতো বলল, জীবনে সব কিছুরই, মানে সব ঘটনারই একটা নির্ধারিত সময় থাকে পৃথুদা। কুঁড়ি ধরার, ফুল ফোটার, ফল হয়ে ওঠার, তারপর ঝরে পড়ারও। পাতা ঝরার দিনে কুসুম ফোটাতে চাইলেও কি তা ফোটে?
আমি এত নাটক বুঝি না কুর্চি। আমি তোমাকে ভালবাসি।
আমাকে ক্ষমা করে দাও কুর্চি।
ধরা পড়ে যাওয়া চোরের মতো বলল পৃথু।
ক্ষমা করব আমি? হাসালেন আমায়! বলে, সত্যিই হাসল কুর্চি।
আপনিই বরং ক্ষমা করে দিন আমাকে।
বলেই, উঠে এসে পৃথুর চুল দুহাতে দিয়ে এলোমেলো করে দিয়ে বলল, পাগল। আপনি পাগল একটা। সাধে কি সকলে বলে, পাগলা ঘোষ।
বলতে বলতেই, কুর্চির গলা বুঁজে এল।
এখন কোনও কথা নেই ঘরে। চোখে আলো লাগছে বলে লণ্ঠনটা নামিয়ে রেখেছিল কুর্চি সেন্টার টেবিলের নীচে। অনেকক্ষণ সময় কেটে গেল দুজনেরই কী বলবে, তা ভেবে না পেয়ে।
কুর্চি জানালার কাছে গিয়ে শিক ধরে দাঁড়িয়েছিল। জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলোর মুখে থাকায় ওর ছায়া পড়েছে মেঝেতে। দ্বিধাগ্রস্ত, ছায়াও।
কুর্চি বলল, পৃথুদা! জানেন, সব মানুষেরই না ধারণা যে, তারা সকলেই ভালবাসার মানে বোঝে। ভালবাসার মানে কিন্তু খুব কম মানুষই বোঝে আসলে।
সায়ান্ধকার ঘরের মধ্যে রাত চারিয়ে যেতে লাগল, জলের নীচে দিনের আলো যেমন করে কাঁপে তেমনি করে। বাইরেও চাঁদের আলো বনের এবং পাহাড়ের গভীরে গভীরে চুঁইয়ে যেতে লাগল আনাচে কানাচে বন্যার জলের মতন। দুজনের আর কোনও কথাও হল না। নিজের নিজের ভাবনাতে নিজেরা কুঁদ হয়ে রইল।
পৃথুর মনে হচ্ছিল, পুরুষ ও নারী যখন নীরবে থাকে তখনই তাদের সবচেয়ে সুন্দর দেখায়। মনের গন্ধ, ম্যাগনোলিয়া গ্রান্ডিফ্লোরা ফুলের গন্ধের মতো ওড়ে শুধু তখনই।
কুর্চি এসে বসল মুখোমুখি। মুখে কথা নেই। দুজনেরই বুকের মধ্যে এত বছর যেসব কথা, উষ্ণ, তরল, প্রমত্ত হয়েছিল লাভা স্রোতের মতো কার অভিশাপে তা যেন মুহূর্তে শীতল, প্রস্তরীভূত হয়ে গেছে। একদিন হয়তো ফসিলও হয়ে যাবে। কে জানে!
বাইরে গিরিশদার গাড়ির হর্ন বাজল।
চমকে উঠে কুর্চি বলল, ওকি! গাড়ির হর্ন! কে?
পৃথু অবাক হল, ওর ফ্যাকাশে মুখ দেখে।
কী যে হয়েছে কুর্চির কে জানে? বলল না এখনও কিছুই।
কার গাড়ি? একটু দেখুন না পৃথুদা।
ডাকাত! তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছে!
পৃথু বলল।
দরজা খুলতেই শ্রীকৃষ্ণ গাড়ি থেকে নেমে বলল, পরণাম সাহাব।
তুমি গাড়িতেই বোসো। আমি আসছি এক্ষুনি।
জী সাহাব।
ঘরে ঢুকতেই কুর্চি বলল, আপনার ড্রাইভার আমাকে নিয়ে একটু বাজারে যেতে পারবে?
কেন? বাজারে, তুমি কেন যাবে এই রাতে? কী আনতে হবে বলো, আমি এনে দিচ্ছি।
তেমন কিছু নয়। সালিমের দোকান আছে না, বাস স্ট্যান্ডের পাশে; সেখান থেকে আমার জন্যে দুটি হাতরুটি আর একটু তরকারি এনে দিত। আজ রাতে আর রাঁধতে ইচ্ছে করছে না। একার জন্যে…
যাচ্ছি আমি…
না, না, আপনি যাবেন না। ড্রাইভারকেই পাঠান। আপনি থাকুন আমার কাছে। কত্বদিন পরে এলেন। আবার কবে…। আপনি কাছে থাকলে আমার ভয় করে না একটুও।
তাইই? থাকব তবে। ড্রাইভারকে বলে আসি।
দাঁড়ান। পাত্র দিয়ে দিই একটা। রুটি, শালের দোনায় মুড়ে দেবে। আজকে কিন্তু আপনিই খাওয়াচ্ছেন। ডিনার অন উ্য! বলে, হাসল। করুণ হাসি।
পাত্রটা নিয়ে পৃথু শ্রীকৃষ্ণকে যা যা ভাল জিনিস পায় দোকানে সবই আনতে বলল, তবে একজনেরই মতো। বলল, দোকানের পাত্রও নিয়ে এসো, আমরা যাবার সময় ফেরত দিয়ে যাব!
গাড়িটা চলে গেল। টেইল-লাইটের আলোটা জঙ্গলের পথের ভিজে চাঁদের আলোয় লেপটে গিয়েই জ্যাবড়া হয়ে গেল ওয়াশের কাজের মতো। একটু পরে কুর্চিদের বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে পৃথু ভাবছিল যে, অনেকদিন আগে ওরা যখন দুজনেই ছোট্ট,. তখন মাণ্ডুর ছায়াচ্ছন্ন জেহাজ-মহলের ভিতর এমনিই এক চাঁদের রাতে কুর্চি বলেছিল, কিশোরীর গাঢ় ভাঙা ভাঙা স্বরে, পৃথুদা! আপনি আমাকে একা রেখে কোথাও যাবেন না, আমার ভীষণ ভয় করবে। বলেই, খুব জোরে পৃথুর হাত জড়িয়ে ধরেছিল। ওদের দুজনের পথই বেঁকে গেছে। আবার মিলেছিল রায়নাতে। অনেক আনন্দর আশ্বাস বয়ে এনেছিল সেই মিলন, কিন্তু সব যেন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। হয়ে যাবে। মন বলছে পৃথুর।
কুর্চি বড়ই চাপা মেয়ে। এই চাপা মেয়েদের নিয়েই বিপদ। কখন যে কী করে এরা! এবং যখনই যা করে না কেন, কারও কাছেই জবাবদিহি করতে রাজি থাকে না এমনই জেদি ও একগুঁয়ে।
কুর্চিকে এইভাবে ফেলে রেখে যেতে তার মনও সরছিল না। ওকে জোর করেই নিয়ে যেতে চেষ্টা করতে পারত। কিন্তু নিয়ে তুলবে কোথায়? রুষার কাছে? রুষ হয়তো বিষ খাইয়ে মেরেই ফেলবে। নইলে মেরীর ঘরে শোয়াবে ওকে। ঈর্ষা মেয়েদের যত নীচ করে তোলে ততখানি নীচ বোধহয় পিশাচীরাও ইচ্ছে করলেও হতে পারে না। সাবীর মিঞার বাড়ি নিয়ে যাবে? সে বাড়ির অন্দরমহলের পরিবেশে থাকতে পারবে না কুর্চি। অভ্যেস নেই ওইভাবে থেকে। গিরিশদা আর ভুচু তো ব্যাচেলর। অসুবিধে আছে। দু পক্ষেরই। পামেলার কাছে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু অনেক কথা বোঝাতে হবে। দীর্ঘ কৈফিয়ৎ। হয় না। তবে কি বিজ্লীর কাছেই নিয়ে যাবে? বিজ্লীও কি বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবে কুর্চিকে। কে জানে? মেয়েরা সব পারে। ভালবেসে আর ঘৃণা করে ওরা সবই পারে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার নিয়ে ফিরল শ্রীকৃষ্ণ।
কুর্চি বলল, ওমাঃ। এত্ব। এত্ব কী হবে? কে খাবে?
কেন, তুমি।
আমি জানতাম। চিরদিনই আপনি নষ্ট করার ওস্তাদ। পয়সার যেন মা-বাবা নেই। যা খেলেন সারা জীবনে; নষ্ট করলেন তার চেয়ে অনেকই বেশি, ফেলে, ছড়িয়ে, ছিটিয়ে।
দ্ব্যর্থক কথাটার মানে যে বুঝল না পৃথু, এমন নয়।
বলল, খাবে, কথা ঘুরিয়ে বলল, যতটুকু ভাল লাগবে খাবে, না পারলে ফেলে দেবে। আসলে, নষ্ট কিছুই নয় না কুর্চি। যে যেমন করে দেখে।
তুমি খাওয়া শুরু করো। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে সব।
কুর্চি উঠে প্লেট, সাইড প্লেট, কাঁটা ছুরি চামচ সব নিয়ে এল। ন্যাপকিন একটা হলদে রঙের। এক গ্লাস জল। সস্তা একটি কাচের গ্লাস। দেখল ও। রুষার বাড়িতে ও ফাইভ স্টার হোটেলের ক্রকারি-কাটলারীতে ফাইভ-স্টার হোটেলের খনা খায়।
আপনি থাকবেন না আর একটু।
তুমি খাওয়া শুরু করো। তারপর যাব।
বাঃ বাঃ কী সৌভাগ্য আমার। না। শেষ করলে যাবেন। বসুন।
তারপর, বিরিয়ানী প্লেটে বাড়তে বাড়তে বলল, বুঝলেন, মনের অবস্থাটা এমন নয় যে, এমন মোগলাই খানা রসিয়ে রসিয়ে খাই; তবু, আপনি আনালেন, খেতেই হয় একটু।
কেন যে ভাল নয়, তা আমি জানতেও পারি না কি?
এখনও নয়। সময়ে নিশ্চয়ই জানবেন পৃথুদা। আপনাকে ছাড়া আর কাকেই বা জানাব?
কী হল? খাও। আমি তুলে দেব? কাবাব নাও একটা। আগে জানলে, সাবীর সাহেবের বাড়ি থেকে উম্দা খনা নিয়ে আসতাম!
এই তো খাচ্ছি।
হাসতে গিয়ে মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল কুর্চির।
বলল, এইই কত্ব ভাল। জানেন, মা মারা যাবার পর এই প্রথম কেউ আমাকে আদর করে খাওয়াল। সামনে বসে সব মেয়েরাই শুধু অন্যদেরই খাওয়ায়, তারা কী খেলো অথবা আদৌ খেলো কি না কেউই তা দেখে না। মডার্ন পরিবারেও। আপনি কি কখনও রুষাবউদি কী খান, তা দেখেছেন? খাইয়েছেন তাঁকে এমন করে একদিনও?
পৃথু সত্যি কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। রুষা তো রোজই আগে খেয়ে নেয়। পৃথুর খাবার হট্-কেসে থাকে। অথবা দেরি হলে, থাকেই না। কিন্তু বলে কী লাভ? রুষা ছোট হয়ে যাবে কুর্চির চোখে। তার বউ তো! কাউকেই ছোট করতে নেই। যে যার কপাল নিয়ে আসে এ পৃথিবীতে। অভিযোগ অনুযোগ এসব চলে একমাত্র নিজের মা আর সৃষ্টিকর্তারই কাছে। অন্যর কাছে তা জানাতে গেলে নিজেকেই ছোট করা হয়। কী দরকার!
মুখে বলল, না। তুমি ঠিকই বলেছ। খাওয়াইনি রুষাকে কখনও।
খুবই খারাপ আপনি।
জানি আমি।
আরও একটু বিরিয়ানী নাও। পৃথু বলল, মুখ দেখে মনে হল কুর্চির যেন খুবই খিদে পেয়েছে। দুপুরে বোধহয় খায়নি কিছুই।
এই তো নিচ্ছি।
বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল পৃথুর। কী হয়েছে কুর্চির কে জানে?
বলল, একদিন তোমাকে নিজে রান্না করে খাওয়াব আমি। নিজে হাতে তোমাকে চান করাব, সাজিয়ে দেব আমার পছন্দ মতো, তারপর খাওয়াব। কেমন? দেবে তো একদিন?
মুখ তুলে কুর্চি বলল, ঠিক দেব। দেখবেন একদিন? কেন? সবদিনই দেব। সময় হলেই…
তোমার জন্যে আমি কি কিছুই করতে পারি না? কুর্চি?
ওমাঃ। কী করবেন আর?
তোমাকে এমন একা ফেলে যেতে ইচ্ছে করছে না। পারি না আমি।
একটু জল খেয়ে কুর্চি বলল, আহা! পারেন আবার না! সবই পারেন। আপনারা সব পারেন!
জল খেয়েই বলল, অ্যাই পৃথুদা! শুনুন! একটু আমার কাছে আসুন।
আমি খাব না।
আহা! আসুনই না কাছে একটু।
পৃথু কাছে গেল কুর্চির। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে।
মুখটা নামান একটু। আরও নামান। আমার মুখের কাছে। কী হল? না নামালে খাব না কিছুই কিন্তু। বলেই, মুখ নামাল পৃথু কুর্চির মুখের কাছে। এঁটো মুখেই পৃথুর গালে একটি চকিত চুমু দিল কুর্চি। ‘চুঃ’ করে শব্দ হল!
দিয়েই বলল, এ মাঃ। কী করলাম! এঁটো। আমি এঁটো করে দিলাম যে আপনাকে।
এঁটো কে নয়? মুখে বলল, পৃথু।
মনে বলল, সবাই এঁটো কুর্চি। পঁচিশ বছরের বেশি সব নারী ও পুরুষই এঁটো। অনেকে তার আগেই।
পকেট থেকে রুমাল বের করে গাল মুছল পৃথু। ওই একটি চুমুতেই ওর মস্তিষ্কে রক্ত ছুটোছুটি করতে লাগল। হুড়োহুড়ি শুরু করে দিল কাঁকড়াগুলো। এই শরীর এক আশ্চর্য ল্যাবরেটরি। কত কীইই যে ঘটে যায় এক লহমায়! কী জীবন্ত এই শরীর। অথচ তাকে অনাদরে অবহেলায় পঙ্গু করে রাখে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। শরীরও তো চায় কিছু! বেচারি। বেচারি। বেচারি। আনন্দভাণ্ডার তালাবন্ধই থাকে সবসময়। পুজো পার্বণে তালা খোলা তার। মরচে পড়ে গেল।
তুমি বললে না কিন্তু আমাকে, কিছু করতে পারি কি না তোমার জন্যে।
খেতে খেতে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে কুর্চি বলল, কিছু না। বলেছিই তো।
এবারে তাহলে যাব। খাওয়া হলেই তোমার।
পৃথু বলল।
খাওয়া হয়ে গেছে। এক সেকেণ্ড দাঁড়ান। মুখ ধুয়ে আসি দৌড়ে।
কুর্চি চলে যেতেই পৃথু ওর পার্সটা খুলে দেখল। দুশো দশ টাকা আছে সবসুদ্ধ। খাওয়ার দাম দেওয়ার পর। একশ টাকার নোট দুটো কুর্চির খাওয়ার প্লেটের নীচে রেখে দিল এমন করে যাতে প্লেটটি তুললেই চোখে পড়ে। কুর্চির হাতে একেবারেই টাকা নেই। খাওয়ার টাকাও নেই। পৃথুর মন বলছে।
কুর্চি ফিরে এল। তারপর বাইরে দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজাতে পিঠ দিয়ে বলল, যদি না যেতে দিই?
ভালই তো! থাকব তাহলে।
না! এমন বিচ্ছিরি করে রাখব না আপনাকে! যেদিন সত্যিই আটকে রাখতে পারব, সেদিন হয়তো সময় হবে না আপনার আসবার। আমি খুব অপ্টিমিস্ট পৃথুদা। দেখবেন একদিন… কী করি আমি আপনাকে… কী দিই… কেমন বাঁদীর মতো খিদমদগারী করি আমার শাহেনশাকে। দেখবেন!
দরজা খোলো।
বাঃ খুব তো চলে যাচ্ছেন! যাবার সময় আমাকে একটু আদর করে দেবেন না? আমি যে আদর করলাম আপনাকে। ভীষণই খারাপ তো আপনি। কোনও ম্যানার্স নেই! রুষাদি বকে না আপনাকে?
পৃথু মাথা নামিয়ে এনে মুখ রাখল। স্বপ্ন খুব সহজ, বাস্তব বড় কঠিন। আজও দেখা হল না। পরশের আভাস পেল শুধু। মুখ নামাতেই যুবনাশ্বর কবিতা চিড়িক চিড়িক করে চমকাতে লাগল মাথায়।
সুগন্ধে নিঃশ্বাস বুঁজে এল পৃথুর। যেন পথ ভুলেছে কনকচাঁপার বনে। প্রায়, ঠিক সেই সময়, কুর্চির যোগ্য হয়ে, কুর্চিরই মতো উচ্চতায় নিজেকে তুলে এনে, মাথা উঁচু বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে পড়ে পৃথু বলল, যাচ্ছি এবারে। ওর মনে হল শরীরের দাপাদাপিতে যে আনন্দ তার চেয়ে এই ঋজু, বিমুখ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার আনন্দটা বেশি গভীর।
যাওয়া নেই, আসুন।
কিছুই যখন চাইবার নেই আমার কাছে, তখন চলি…
আছে। আছে। আমাকে…আপনি…
তোমাকে, কী কুর্চি?
উৎসুক, উদ্বিগ্ন হয়ে শুধোল পৃথু।
আমাকে খুউব ভালবাসবেন পৃথুদা। কি? বাসবেন তো? সবসময়? প্রমিস?
বলেই, মুখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে।
বাসব।
সবসময়?
সবসময়।
প্রমিস?
প্রমিস।
বলেই, পৃথু দরজা খুলে বেরিয়ে এল।
যাওয়াটা সোজা, চলে আসাটা বড় কঠিন।
দরজায় দাঁড়িয়ে রইল কুর্চি। একটু পর বাইরের চাঁদের আলোর মধ্যে এসে ওকে আর স্পষ্ট দেখা গেল না। ঝাপসা হয়ে গেল কর্চি। ঝাপসা হয়ে গেল পৃথুর চোখ।
গাড়িতে গিয়ে বসতেই শ্রীকৃষ্ণ একটি বোতল দিল এগিয়ে। বলল, ভুচুবাবুনে ভেজিন।
হাতে নিয়ে দেখল পিটার-স্কটের বোতল একটা। জল মিশিয়ে মাপ মতো পাঠিয়েছে ভুচু। শীতের রাতে পাহাড় জঙ্গলে এতখানি পথ আসতে হবে।
ছেলেটা বড় ভাল।
কিন্তু বোতলটা ফেরত দিল পৃথু। শ্রীকৃষ্ণকে বলল, ভুচুবাবুকো ওয়াপস্ দে দেনা।
আসলে, ওর ঠোঁটে কুর্চির স্তনসন্ধির উষ্ণতা আর সুগন্ধ মাখামাখি হয়ে ছিল। এখন মুখে অমৃত দিয়েও তা নষ্ট করতে রাজি নয়। যতক্ষণ থাকে গন্ধটুকু। ভরে দিয়েছে ওকে এক গভীর বোধে। এ সুখ নয়, দুঃখও নয়, এ কামনা নয়, হতাশা নয়, এমনকী তৃপ্তিও নয়। কে জানে? একেই কি ভালবাসা বলে?
কাঁচটা নামিয়ে দিয়েছিল। বরফের মতো ঠাণ্ডা হাওয়া লাগছে চোখে মুখে। লাগুক। আজকেও সমস্ত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তুমি তোমাকে পেতে দিলে না আমাকে। ভালবাসো আমাকে? ছাই!
ঝাপ্সা চোখে বলল পৃথু নিরুচ্চারে। বড় রাগ হতে থাকল কুর্চির উপর। রাগটা যখন অসহ্য হল তখন বলল, শ্রীকৃষ্ণ, বুটল্ঠো লাও।
বড় একটা ঢোঁক গিলল পৃথু। মুখ বিকৃত হয়ে গেল। বড্ড কড়া করে মিলোয় ভুচু! পৃথুর বয়স হচ্ছে না বুঝি? সে কথা ভুচু বুঝতে চায় না।
“আয় হুসন্!
কী খোল্কর আজ সাঁতালে মুঝকো,
কাল্ মেরা ইশ্ককা আন্দাজ বদল যায়ে গা।”
মানেটা যেন কী? হ্যাঁ হ্যাঁ মানেটা?
আরও এক ঢোক খেল পৃথু। বুক জ্বলতে লাগল এবারে।
মানেটা হল, “ওহে সুন্দরী, তোমার হৃদয়ের সব সাধ মিটিয়ে আজ কষ্ট দিয়ে নাও আমাকে, তোমার যা খুশি তাইই করো আমাকে নিয়ে। আজই করো। হ্যাঁ। আজ। আজই। কেন না, আগামিকাল আমার প্রেমের পাত্রী অন্য কেউও হয়ে যেতে পারে।”
ওয়াহ! ওয়াহ! নিজেই বলল না-বলে।
কুর্চি। হুসন্। সুন্দরী কুর্চি তুমি সবই জানো। জানো না শুধু এই কথাটাই। আমার শরীরে যে নমকহারাম, সুরতহারাম, বদ্ পুরুষের রক্ত বইছে। কালকের কথা নারীদের পক্ষেই বলা সম্ভব। পুরুষ আজকের জীব। কোনও পুরুষের কাছেই আগামিকালের ভরসা বা প্রত্যাশা রেখো না।
আজ বিজ্লীর কাছে যাবে কি? যাঃ। কার সঙ্গে কার তুলনা! রুষার কাছে? দুস্স্, ডীপ-ফ্রিজে রাখা নিখুঁত নির্লোম নিরাবরণ স্বাদহীন ব্রয়লার চিকেন। রক্তমাংসের হৃদয়ের নারী চাই। কী আবদার! নারী রক্তমাংসের হয়। হৃদয়েরও হয়। দুইয়েরই হয় না। কুর্চি হবে ভেবেছিল। ভে—বে—ছি—ল।
নাঃ নাঃ। স্বপ্নই দেখবে। স্বপ্ন দেখতে বিছানা লাগে না, দরজা বন্ধ করতে হয় না, ভাঁটুর কাছে ধরা পড়ার ভয় নেই, এমনকী কুর্চিকেও প্রয়োজন নেই। মেঘের বিছানায়, চাঁদের আলোয়, রাত ভর কুর্চিকে আদর করবে আজ পৃথু। তারারা বাসর জাগবে।
কুর্চি। শুনে রাখো।
জী খোলকর, আজ সাঁতালে মুঝকো। অ্যায় হুসন্!
কিঁউ? কেন জিগগেস করছ তুমি?
কাল মেরা হিস্ক্কা আন্দাজ বদল যায়েগা।
কাল যে আমার প্রেমের প্রকৃতি, আমার ভালবাসার জনই বদলে যাবে। আমি যে চিরদিনের অস্থিরমতি পুরুষ। বেদুইনের রক্ত আমার শরীরে।