৩৯
সকালবেলা পৃথু ও রুষা বসবার ঘরে বসে ছিল। রোদ এসে পড়েছিল গায়ে।
ক্রীসমাস ঈভ-এ ভুচু সবাইকে ডিনারে ডেকেছে। যাবে নাকি, তুমি?
পৃথু শুধোল রুষাকে।
খবরের কাগজটা সেন্টার টেবলে নামিয়ে রেখে তাকাল রুষা পৃথুর দিকে। ভারী সুন্দর দেখাচ্ছিল তার সুন্দরী বউকে। সৌন্দর্যরও এক বিশেষ আবেদন আছে। সে সৌন্দর্য বৃদ্ধি বা গুণমণ্ডিত না হলেও। তবে রুষার কথা আলাদা। যা কিছু উপাদান দিয়ে সৌন্দর্য গড়ে ওঠে, রুষার মধ্যে তার সব কিছুই ভরে গিয়ে উপছে গেছে।
ভুচু ডিনারে ডেকেছে মানে? কোথায়?
ভুরু কুঁচকে বলল ও।
কোথায়? ওর গারাজে।
মোটর মেকানিকের গারাজে ক্রীসমাস ইভ। সত্যি। দিনে দিনে তুমি যে কোথায়, সোসাইটির কোন স্তরে নেমে যাচ্ছ তার খোঁজ রাখার মতো মেন্টাল অবস্থাও বোধহয় আজ তোমার নেই।
দোষ কী হল? ভুচুরা তো ক্রীশ্চান।
বোকার মতো বলল পৃথু।
না। দোষের কী? ক্লাবে ক্রীসমাস ঈভ-এর পার্টি হচ্ছে। কাল চিলড্রেনস পার্টি আছে। মিলি টুসুরা যাবে, বুক করে দিয়েছি। ভিনোদের বাড়ি গ্রাণ্ড পার্টি আছে। মিস্টার সেন-এর বাড়ির লন-এও দারুণ পার্টি। সকলেই বলছে ‘বার ক্রলিং’ করে অল্প সময়ের জন্যে সব পার্টিতেই ড্রপ-ইন করবে তারপর যার যেখানে এণ্ড-আপ করতে ইচ্ছে করে সেখানেই মাঝ রাত অবধি থেকে যাবে। তাই আমার পক্ষে ভুচুর পার্টিতে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
ওঃ।
তুমি কি কখনও ভেবেছ, আমি যে একা একা সব জায়গাতে যাই, আমাকে দশজনে নাচতে বলে, কখনও কখনও নাচিও, দশজন পুরুষ, তোমারই জাতের তো তারা; গণ্যমান্য হলেও এমন দৃষ্টিকটু ব্যবহার করে আমার সঙ্গে, এসব কি আমার ভাল লাগে? না সম্মানের, আমার পক্ষে? তুমি যে আমার স্বামী এ নিয়ে কোনওদিন গর্ব করার মতো কিছুমাত্রও তো দিলে না এ জীবনে, শুধুমাত্র স্বামী হিসেবেও আমার পাশে কোনও কোনও সময় থেকে আমি যে সিঙ্গল নই, স্পিনস্টার নই, খারাপ মেয়ে নই, এ কথাটা দশজনের সামনে প্রমাণ করতে তো পারো। তোমাকে বিয়ে করে আমার যে কী অবমাননা এ জন্মে হল তা আমিই জানি।
তুমি বাড়াবাড়ি করে বলছ। পার্টিতে সকলেই বুঝে নেয়। কেউই কিছু মনে করে না।
কী মনে করে না?
সবাই-ই জানে যে, তোমার স্বামী একটি অপদার্থ, বাজে লোক, আজে বাজে লোকের সঙ্গে তার মেলামেশা, তাকে তো তোমার সমাজ খরচের খাতাতে লিখেই দিয়েছে। ব্যাড-ডেট রাইট-অফফ করার মতো। এই দেনা যে কোনওদিনও আর রিকভার্ড হবে এমন মনে করার মতো বোকা তাঁরা কেউই নন। আমি তো হারিয়েই গেছি তোমাদের সো-কলড সমাজ থেকে। আমাকে আর ডাকো কেন?
কিছু বলার নেই আমার। তোমার ভাল লাগে না শিক্ষিত, ওয়েল-অফফ হাইলী প্লেসড লোকদের সঙ্গে মিশতে?
না। ভাল লাগে না। পথের দিকে চেয়ে বলল পৃথু বিরসমুখে।
কেন?
ওদের বেশির ভাগই একরকম। এক পোশাক, এক কথা, এক আলোচনা, এক উচ্চাশা, প্রোমোশান, বাড়ি, গাড়ি, টাকা। মেয়েরাও তাই। শাড়ি, গয়না; আমার দম বন্ধ লাগে ওই পরিবেশে কিছুক্ষণ থাকলে। বড়ই চর্বিত-চর্বণ। কী করে পারে মানুষ, শিক্ষিত সব মানুষ? তা জানি না। ভাল লোক, গভীর লোক যে নেই তোমাদের সমাজে তা নয়, তবে তারাও দলের মধ্যে হারিয়ে গিয়ে বোবা হয়ে থাকে। তারা কেউ স্বামীর সঙ্গে স্ত্রী হয়ে আসে, কেউ বা স্ত্রীর সঙ্গে স্বামী। তাদের নিজেদের সেক্স-এ থাকে না তারা।
রুষার দু চোখের কোণে জল চিকচিক করল। বলল, তাদের যার যার স্পাউস-এর জন্যে তারা তবু তো ঘণ্টা দু-তিন নিজেদের নিজস্বতা বিসর্জন দেয়। সেইটেই তো স্বাভাবিক! তুমি কি তাও পারো না? একদিনও? আমাকে একটু সুখী করতে? নিজস্বতা কি শুধুমাত্র তোমরাই একার আছে বলে মনে করো? সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এত উন্নত সব মানুষের কারওই নিজস্বতা নেই? তুমি কি মনে করো নিজেকে? মেগালোম্যানিয়াক হয়ে গেছো তুমি!
আমাকে ক্ষমা করে দাও রুষা। আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না। আমি কারও চেয়েই বড় নই, ভাল নই; আমি শুধু অন্যরকম। আমার মতন আমি। তোমার কাছে আমার অনেকই অপরাধ। নিজগুণে অনেক মার্জনা করেছ, আরও করবে জানি।
যদি কোনওদিন আর না করতে পারি। যদি…
তোমার যা ভাল মনে হয় করবে। তুমি সুখী হয়ো। আমার দ্বারা সুখী হওয়া হল না যখন তখন অন্য কারও দ্বারা হয়ো। আমি তো বলেইছি…
জীবনটা নাটক নয়। নভেলও নয়। মাঝ-তিরিশে এসে বড় বড় ছেলেমেয়ের মা হবার পর এখন স্বামী আমাকে মুক্তির পথ বাৎলাচ্ছেন! সত্যি! তুমি না! তোমাকে কিছুতেই বুঝতে পারলাম না।
কেই বা কাকে বোঝে বলো? বোঝা কি অত সোজা? দিগা পাঁড়ের মতো লোক, সেই বাঙালি তান্ত্রিক বনে পাহাড়ে বাস করেও বোঝার মতো কিছু এখনও বুঝে উঠতে পারল না। বোঝাটা হয়তো বড় কথা নয়, বোঝবার চেষ্টাটা চালিয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে জরুরি। বুঝতে চাইলে একদিন নিশ্চয়ই বুঝবে।
রুষা কী একটা কথা বলতে গিয়েও চুপ করে গিয়ে খাণ্ডেলওয়াল সাহেবের কালো কুচকুচে যুবতী আয়া আর সাদা ধবধবে যুবক অ্যালসেসিয়ানের ফিরে আসা দেখতে লাগল। শালের ছায়ায় ছায়ায় কমলা রঙা রোদে শুকনো পাতা মাড়িয়ে ফিরে আসছিল ওরা।
কী দেখছ?
পৃথু বলল।
ভাবছিলাম, রোজই সকাল বিকেল ওদের এই আসা-যাওয়া দেখি অথচ পুরনো হয় না কখনও।
এইটেই হচ্ছে আসল কথা। তোমাদের পার্টি পুরনো হয় কিন্তু ওদের এই আসা-যাওয়া পুরনো হয় না। কেন, জানো?
কেন?
একটি সজীব কালো মেয়ে আর চঞ্চল প্রাণবন্ত সাদা কুকুরের মধ্যে প্রাণ আছে, কোনও মেকি ব্যাপার নেই, ভণ্ডামি নেই। ওরা মিথ্যা নয়। প্রাণের, জীবনের প্রতীক। ওদের রোজ দেখে আমার কী মনে হয় জানো? প্রকৃতির মধ্যেই প্রত্যেক প্রাণীর প্রকৃত মুক্তি নিহিত আছে।
রুষা হাসল।
বলল, একসেন্ট্রিসিটির একটা লিমিট থাকা উচিত।
তা নয়। তুমি আজকে হাসছ, পাগল বলছ, বলো, কিন্তু আজ থেকে বেশিদিন নয়, মাত্র পঞ্চাশ বছর পরে পৃথু ঘোষের এই কথা দেখবে ঘরে ঘরে টাঙানো আছে। একবিংশ শতাব্দীর মানুষ পৃথু ঘোষকে উপেক্ষা করবে না, অপমান করবে না। তোমরা যা করলে তা করলে!
ইয়া। ইয়া। সক্রেটিস! স্পিনোজা! গ্যালিলিও! হাসি পায়। তোমাকে নিয়ে সামনের সপ্তাহেই জব্বলপুরে যাব ডাক্তার গুণ্ডাপ্পার কাছে। সাইকিয়াট্রিস্ট। মাথাটি একেবারে গেছে।
আমি পাগল হলে কি তোমার ডিভোর্স পেতে সুবিধে হয়? কিন্তু এমনিতেই বা অসুবিধের কী? যাকে খুশি বিয়ে করো না তুমি আমি দাঁড়িয়ে থেকে পিঁড়ি ঘুরিয়ে বিয়ে দেব। তোমার ফুলশয্যার খাট সাজাব। জমে যাবে পুরো ব্যাপারটা। নিজের স্ত্রীর বিয়ে, আনন্দে মেতে ক’জন স্বামী দিতে পারে বলে?
তা পারো তুমি! লোকে বাহাদুরী দেবে। বলবে, আহা! কী উদার মানুষ পৃথু ঘোষ! এমনটি আর কেউ কখনও দেখেনি।
তাই-ই…
না তো কী?
আসলে আমি তো জানি। তোমার মধ্যে একটি পাঁচ বছরের খোকন বাস করে। তোমার মায়ের খোকন। ইডিপাস কমপ্লেক্স-এর একটি ওয়ারসট কেস তুমি। এমন বাহাদুরী প্রবণতা কোনও অ্যাডল্ট লোককে মানায় না। তোমার বাঘ মারা, শামীমের মেয়েকে উদ্ধার করা এসবই ওই মনোবৃত্তিরই জন্যে। অ্যাডাল্ট লোক নিজের আখের দেখে, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়ায় না এমন করে।
পৃথু চুপ করে ছিল।
হঠাৎ বলল, মনে পড়ে গেছে। এক্ষুনি মনে পড়ল। তোমার সেই পার্টির কথা ওঠার পর থেকেই মনে করার চেষ্টা করছিলাম টি. এস. এলিয়ট-এর সেই কবিতাটি।
কোন কবিতা?
সে কি? তুমি তো ইংরিজিতে পণ্ডিত। তুমি পড়েছ নিশ্চয়ই!
না বললে, বুঝব কী করে?
“হোয়াট হ্যাজ হ্যাপেনড হ্যাজ মেড মী অ্যালোন
দ্যাট আই হ্যাভ ওলওয়েজ বীন অ্যালোন
দ্যাট ওলওওয়েজ ইজ অ্যালোন,
…ইট ইজনট দ্যাট আই ওয়ান্ট টু বী অ্যালোন
বাট দ্যাট এভরীওয়ান ইজ অ্যালোন—অর সো ইট সীমস টু মী,
দে মেক নয়েজেস অ্যান্ড থিংক দে আর টকিং টু ইচ আদার
দে মেক ফেসেস, অ্যান্ড থিংক দে আন্ডারস্ট্যান্ড ইচ আদার
অ্যান্ড আই অ্যাম শ্যুওর দ্যাট দে ডু নট…”
রুষা উৎসুক চোখে চাইল পৃথুর দিকে। বলল, নাম কী কবিতাটির?
“দা পার্টি।” তোমাদের পার্টি সম্বন্ধে এই-ই বোধহয় শেষ কথা।
চুপ করে রইল। দুজনেই চুপচাপ অনেকক্ষণ।
বেশ দিনটা আজকে, না?
রুষা বলল হঠাৎ।
পিকনিকে যাবে নাকি? পৃথু বলল।
চমকে উঠে, রুষা চাইল ওর মুখে। বলল, ফ্যামিলি পিকনিক? বউ, বাচ্চা থার্মোফ্লাস্ক, স্যান্ডউইচ কমলা লেবু এইসব নিয়ে? মাই! মাই! অফ ওল পার্সনস, পৃথু ঘোষ! কী হল তোমার আজকে? শরীর ঠিক আছে তো?
পৃথু হাসল। বলল, এই-ই তোমার দোষ। নির্লজ্জরও তো লজ্জা হতে পারে মাঝে মাঝে।
তা যা বলেছ। ভেরী ওয়েল-সেইড। কথা তুমি ভালই বল। দুঃখের বিষয় এই যে, কথা সব মাঠে মারা যায় ভুচু আর লাড্ডুদের আর শামীমদের কম্পানীতে। নইলে, তোমার মতো স্পারক্লিং কনভার্সেশান যে কোনও পার্টিকেই লাইভলি করে তুলত।
আমি দেবতা নই। যা মরা, ডেড অ্যাজ হ্যাম; তাকে বাঁচাবার সাধ্য অথবা ইচ্ছা, দুটোর কোনওটাই আমার নেই।
সামান্যক্ষণ চুপ করে থেকে বলল পৃথু, মিলি টুসু কোথায়?
ভিনোদের বাড়িতে। ডে স্পেন্ড করতে গেছে। হাটাচান্দ্রাতে এখন বড়দিনের হাওয়া লেগেছে। সিমসন সাহেব কি আসছেন লানডান থেকে?
ওরা আসত শিকারের জন্যে ক্রীসমাস-এ ন্যু-ইয়ার্স-এ। এখন শিকার তো বন্ধ। তবু, উধাম সিং তো বলছিলেন যে আসবে বলে টেলেক্স পাঠিয়েছে। ক্রীসমাস-এর আগের দিন জবলপুরে গিয়ে রীসিভ করতে হবে এয়ারপোর্টে। আমি বলে দিয়েছি পারব না। উধাম সিং সাহেবেরও অসুবিধে। ভাবীজীর শরীরটা খারাপ। ইমম্যাটেরীয়াল ম্যানেজার শর্মা যাবে।
কাজটা ভাল করলে? রুষা বলল।
কেন?
ও যেরকম লোক, যেমন স্মুথ-টকার আর ফিক্সার ওই-ই দেখবে তোমাকে সুপারসীড করে ডিরেক্টর হয়ে যাবে একদিন।
হোক না। আমি তো ডিরেক্টর হতে চাই না।
বাঃ! চমৎকার। তা তো চাইবেই না। অ্যামবিশান তোমার কি কিছুই নেই জীবনে? তোমার জন্যে আমার এত লজ্জা হয় কী বলব! শেষে ওই শর্মার কনুই-অবধি সোনার গয়না-পরা অশিক্ষিত বউ ক্লাবে আমার উপর ছড়ি ঘুরোবে? তোমার বসস-এর বউ হবে?
পৃথু উত্তর দিল না। বলল, চলো ভিনোদের বাড়িই যাই। ওখান থেকে ভিনোদ মিলি ও টুসু সকলকে নিয়ে কোথাও যাওয়া যাবে।
কোথায় যাবে? রাতমোহানায়?
হ্যাঁ। অথবা সুফকর-এর বনবাংলোয়।
বাঃ! বাঃ! বাঁচলে হয় আমি আজকে! এত সুখ কি সইবে কপালে?
বলে রুষা উঠে চলে গেল গোছগাছ করতে। অজাইব সিংকে খবর পাঠাতে বলল দুখীকে। মেরীকে ঘর-গেরস্থালির কাজ বোঝাতে গেল। চলে যাওয়া রুষার হঠাৎ খুশিতে ঝলমল মুখের দিকে চেয়ে পৃথুর মনে হচ্ছিল এত সামান্য দিয়েই যদি সুখ-শান্তি পাওয়া যায়, রুষার এমন অনাবিল আন্তরিক হাসি, তবে তা পায়ই বা না কেন?
পোকা। তার মাথার পোকা! তার রক্তর পাগলামি। তার প্রাগৈতিহাসিক মেল শভিনিজম বোকা-বোকা, অর্থহীন, তার অ্যাডভেঞ্চারপিপাসু সমাজ-বিরুদ্ধ ভাব-ভাবনা তাকে এই সহজ সুখের স্বচ্ছ জলের বেলাভূমি থেকে ভয়াবহ গভীর জলে টেনে নিয়ে যায়, নিয়ে যায় পাহাড়ে-কন্দরে যেখানে মুহুর্মুহু বিপদ; যেখানে বেঁচে থাকা মানে সাংঘাতিক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা অথবা গভীরতম আনন্দর স্বাদ।
কে জানে? কেন, কখন, কোথায় কী ও করে তা ও নিজেই জানে না। ওর মাথার ভেতরে একটা ঘড়ি আছে, একটা কম্পাস, এলার্ম বাজে, কাঁটা স্থির হয়ে পথ দেখায়, এ সবই হয় ভিতরে ভিতরে, আর ও রোবটের মতো বাঁচে, পাছে সত্যিকারের রোবট না হয়ে যায় এই ভয়ে।
দূর থেকে ভিনোদের বাড়িটা দেখা যাচ্ছিল। ফুলে ফুলে লনটা ভরা। লনে দোলনা। পাখি, কাকাতুয়া, খরগোশ। গেটে বন্দুক হাতে দারোয়ান। স্যালুট করে গেট খুলল। গাড়িটা ভিতরে ঢুকতেই চমকে গেল পৃথু। দোলনার একপাশে ভিনোদ বসে আছে। তখনও স্লিপিংস্যুট ছাড়েনি তবে তার উপরে হালকা সবুজ ড্রেসিং গাউন পরেছে একটা। টুসু ওর মাথায় বসে আছে দুদিকে দু পা দিয়ে। দোলনার অন্য পাশে মিলি বসে আছে হাতে একটি ক্যাসেট প্লেয়ার নিয়ে। রোলিং-সেটান গ্রুপ-এর গান শুনছে তন্ময় হয়ে। দোলনা দুলছে। হি হি করে হাসছে টুসু—হাসছে ভিনোদ—গান শুনতে শুনতে হাসছে মিলি। দোলনা দুলছে—পৃথুর চেতনার কাছে আসছে একবার পরক্ষণেই চলে যাচ্ছে দূরে তার ছেলে তার মেয়ে ভিনোদ ইন্দুরকারের সঙ্গে খুশিতে ভালবাসায় আনন্দে মাখামাখি হয়ে গেছে। তার স্ত্রী রুষা খুশিতে ডগমগ হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ভিনোদের দিকে। খুশির অনেক রকম হয়। ভিনোদকে দেখে রুষার যে ধরনের খুশি তাতে খুশির গভীরতা বুঝতে কোনও ভুল হয়নি পৃথুর।
তার স্ত্রী, তার মেয়ে, তার ছেলে, একদিন যারা তারই একার ছিল, সে এবং রুষা মিলে যা কিছু তৈরি করেছিল শরীরের রক্তবীজ, বুকের ভালবাসা দিয়ে তা আজ সবই অন্যর হয়ে গেছে।
লনের মধ্যে, ফ্ল্যানেলের ট্রাউজারের দু পকেটে দু হাত ঢুকিয়ে সেই দিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছিল পৃথু।
ভিনোদ জোরে ডাকছে “কাম অন ইন পৃথুদা”। প্লিজ কাম হিয়ার! উর্দি পরা বেয়ারারা লনে ব্রেকফাস্ট টেবল লাগাচ্ছে। সুন্দর কালো আর হলুদ চৌখুপী-চৌখুপী টেবল-ক্লথ পেতে দিচ্ছে তার উপর। নানারকম ফলের পাহাড় এনে সাজিয়ে রাখছে রূপোর ফ্রুট-বোল-এ। পরিজ আর কর্নফ্লেকস খাবার প্লেট, কাঁটা চামচ, সাজাচ্ছে থরে থরে।
পৃথু শীত সকালের উষ্ণ রোদদুরের মধ্যে, ভিনোদের মুহুর্মুহু ডাকের মধ্যেও অনড় দাঁড়িয়ে ভাবছিল, সৌন্দর্যর যেমন এক বিশেষ মূল্য আছে; স্বচ্ছলতারও এক বিশেষ মূল্য আছেই। সেই স্বচ্ছলতা কী ভাবে আসছে সে কথা বিচার করার কথা অনেকই পরে আসে। সৌন্দর্যরই মতো; স্বচ্ছলতাও চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, মোহ জাগায়, প্রেমে পড়ায় মানুষকে। এদের আকর্ষণ বড়ই দুর্বার।
রুষা ডাকল, হল কী তোমার? এসো।
এবার ভিনোদ এগিয়ে এসে হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে চন্দ্রমল্লিকা আর ক্যাসার সারির পাশে বসাল পৃথুকে সাদা-রঙা বেতের চেয়ারে। বলল, দারুণ আইডিয়া। চলুন সকলে মিলে পিকনিক-এ যাই।
পৃথু লক্ষ করেছিল যে, তার ছেলে ও মেয়ে কেউই খুশি হয়নি তাকে দেখে। তারা কেউই ডাকেনি তাকে। বরং তাদের মুখ দেখে মনে হয়েছে যেন বলতে চাইছে এত খুশি এত মজার মধ্যে বাবা আবার কেন?
পৃথু মুখে একটা হাসি বাঁচিয়ে রেখেছিল। ইলেকশানে হেরে যাওয়া নেতারা যেমন রাখেন ফোটোগ্রাফার এবং টি ভি ক্যামেরার সামনে। তবু ও জানত হাসিটা শিগগিরই মরে যাবে।
কোথায় যাওয়া হবে?
সুফকর?
রুষা বলল।
ফাইন।
তাহলে তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরেই বেরিয়ে পড়া যাক। আমাদের পিছনে অন্য গাড়িতে কুক বাওয়ার্চি খানাপিনার শামান, আইস-বক্স, বীয়ার, কাম্পাকোলা, ভডকা জিন ইত্যাদি নিয়ে আসবে। মজা আ যায়েগা। কেয়া দাদা?
পৃথু বলল, এসেই যখন পড়েছি আমি ব্রেকফাস্ট করেই চলে যাব। তোমরা সকলে যাও পিকনিকে। আমার একেবারেই মনে ছিল না একবার ভুচুর কাছে যেতে হবে। দিগা পাঁড়ে আসবে সেখানে। কী নাকি জরুরি দরকার। শামীমও আসবে বলেছে। মেয়েটা তো বোবাই হয়ে রইল। শামীমটা পাগলের মতো হয়ে রয়েছে তারপর থেকে। আমাকে ছেড়েই যাও তোমরা!
সে কী!
অবাক গলায় বলল রুষা। তুমিই তো বললে। আর এখন হঠাৎ।
মনে ছিল না। বিশ্বাস করো, আমার কিছু মনে থাকে না আজকাল। তোমরা সকলে আনন্দ করলেই আমার খুব আনন্দ হয়। ভিনোদ আছে। ও তো আমাদেরই একজন। হ্যাভ আ নাইস ডে। আ প্লেজেন্ট টাইম। রাতে দেখা হবে খাবার সময়। ভিনোদকেও ধরে নিয়ে এসো।
আমি রাতে আসতে পারব না পিরথুদাদা। ক্লাবে এনটারটেইনমেন্ট সাব-কমিটির মিটিং আছে আজকে। জানো তো চাড্ডা সাহেব আর মিস্টার গাঙ্গুলী প্রেসিডেন্টশিপ-এর জন্যে দাঁড়াচ্ছেন এবার? গোলন মুখার্জি গুচ্ছের কাগজ ছেপে মেম্বারদের বাড়ি বাড়ি পাঠাচ্ছেন। ক্লাবের ইজ্জত একেবারে গেল। ক্লাব থেকে কিছু কিছু মেম্বারদের কুইট-নোটিস সার্ভ করা উচিত, যদি ক্লাবকে বাঁচাতে হয়।
বাঁচবে না ভিনোদ। দেশই বাঁচল না আর একটা সামান্য ক্লাব কী করে বাঁচবে? দেয়ার উইল বী আ কমিটি অফ দ্যা কোয়ানটিটি, নট অফ কোয়ালিটি। ভোটের দিকে চোখ থাকলে কিছুই বাঁচানো যায় না। এই অশিক্ষিতদের দেশে এইটেই ডেমোক্র্যাসির সবচেয়ে বড় অভিশাপ। ভোটের মুখ চেয়ে জনসংখ্যা কমাতে বলা গেল না বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়কে, কালোকে কালো, সাদাকে সাদা, খারাপকে খারাপ ভালকে ভাল বলা গেল না, ভোট রঙ্গতেই এসে ঠেকে রইল স্বদেশসেবা। বেচারি গোলন মুখার্জি কী দোষ করল? গোলন মুখার্জিকে বাছতে গিয়ে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে।
এতগুলো কথা বলেই মনে হল, উঠতি বড়লোক, সবরকম ধান্দায় ওস্তাদ লক্ষ লক্ষ টাকা এই অধুনা ভারতবর্ষের ব্যাঙ্ক আর লোন আর বাণিজ্যের মোচ্ছবে মেরে দিয়ে ইয়োরোপের বনেদি বড়লোকের মতো জীবনযাত্রায় বিশ্বাসী ভিনোদকে এত কথা বলার মানে বা কী? নাথিং সারসীডস লাইক সাকসেস। একটা এইরকম বাড়ি, লন, চাকর-বাকর, চারখানা গাড়ি, তার মধ্যে দুটি বিলিতি, সুন্দর পোশাকআশাক, খুশি, আনন্দ, মজা এই অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণকে অস্বীকার করতে চরিত্রর জোর লাগে। রুষার সে জোর নেই। টুসু মিলিরও নেই। কারণ তাদের হতভাগ্য বাবার কোনওরকম প্রভাবই পড়েনি তাদের চরিত্রে। পড়লে, হয়তো অন্যরকম হত।
যা হবার তা হয়ে গেছে এ জন্মের মতো।
বিনোদ বলল, আমি চানটা সেরেই আসছি। কামিং ইন আ জিফফী!
এখন রুষা আর পৃথু মুখোমুখি। ছেলেমেয়েরা দূরের দোলনায়।
রুষা বলল, তোমাকে বুঝি না।
আমিও। পৃথু বলল। আমিও বুঝি না আমাকে।
তুমি কি জেলাস? ভিনোদকে কি তুমি…?
আমিও ঈর্ষা করতে পারি এমন পুরুষমানুষ তো এ জীবনে দেখলাম না। ঈর্ষার কথা নয়… তবে…?
সে প্রসঙ্গ যাক। তোমরা সকলেই তুমি ও আমার ছেলেমেয়েরা যে ভিনোদের কাছে এত অ্যাট-হোম ফীল করো এইটে দেখেই ভাল লাগে। সত্যি! তোমরা যা কিছুই চাইলে তার কিছুই দিতে পারলাম না তোমাদের আমি। ভিনোদের মধ্যেই তোমাদের সব অভাব পূরণ হল।
বোকার মতো কথা বোলো না। সব অভাব কেউই পূরণ করতে পারে না কারও। কিছু হয়তো পারে, যেখানে ঘাটতি থাকে।
তুমি ভিনোদকে বিয়ে করবে? করো না।
মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার।
নিয়ে তো যাচ্ছই সাইকিয়াট্রিস্ট-এর কাছে জবলপুরে তুমি। কী জিগগেস করবেন ডাক্তার?
আমি কী করে বলব তা? তারপর বলল, কী আর বলবেন? বলবেন হয়তো হাউ ডু উ্য ডু?
ভাল। আমি উত্তরে বলব, আই ডোন্ট ডু এনিথিং, মাই ওয়াইফ ডাজ এভরিথিং।
সবটাতে ইয়ার্কি ভাল লাগে না।
হঠাৎ পৃথু বলল, তুমি ভিনোদের জীবনের মতো জীবনই চেয়েছিলে না? অঢেল টাকা, ঐশ্বর্য, গাড়ির লাইন, পার্টি, দেশ-বেড়ানো, ভাল ভাল শাড়ি, বম্বের জাভেরী ব্রাদার্স-এর ডায়ামণ্ড সেটস…তোমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল আমার সঙ্গে থেকে। মিলি টুসুরও! আহা! কত কী শখ ওদের। আমি কীই-ই বা দিতে পারি? কতটুকু!
সেটা কথা নয়। কথা হচ্ছে তুমি তো একটু সময়ও দাও না, দাওনি কোনওদিন তোমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের। আমি যখন কনসিভ করি, দ্বিতীয়বার, মনে আছে তোমার গাইনির সঙ্গে প্রথম অ্যাপয়ন্টমেন্ট রাখতে তোমাদের অফিসের মঙ্গল পাঁড়ের সঙ্গে পাঠিয়েছিলে তুমি আমাকে? সে লোকটাকে কোনওদিন চোখেও দেখিনি আমি তার আগে। আর না-দেখেছি গাইনি ডাঃ চতুর্বেদীকে। এই সব কথা ভাবলে মন খারাপ হয়ে যায়। তোমাকে বোঝাতে পারব না কোথায় আমাদের ক্ষোভ। গাড়ি ড্রাইভার বেয়ারা বাবুর্চি সব থেকেও আমার স্বামী নেই, মিলি টুসুর বাবা নেই। থেকেও নেই।
ঠিক। টুসু কিরকম ভিনোদের কাঁধে চড়ে দোলনায় দুলছিল! ভারী ভাল লাগছিল দেখে। বাচ্চারা যেখানে আদর, যেখানে আনন্দ সেখানে তো যাবেই। স্বাভাবিক। এমন অদ্ভুত বাবাকে কে চায়।
চল না পিকনিকে?
অতক্ষণ তোমাদের দুজনের সঙ্গে কী কথা বলব। ভিনোদ ওর ব্যবসার কথা বলবে, ক্লাব পলিটিক্স। রনধীর সিং বাড়িতে বিরাট ককটেইলস পার্টি দিয়েছে সব মেম্বারদের মাল খাইয়ে বশ করার জন্যে। এই-ই সব। বড় দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে আমার। এই কথোপকথন, এই জগৎ, এই ছোট্ট ছোট্ট অ্যামবিশান, অদূরদৃষ্টি, এই-ই সব চেনা জানা কাছের মানুষদের; হাঁফিয়ে উঠি আমি। বিশ্বাস করো। ভাল লাগে না। বড় বক্র, সর্পিল, বড় অর্থহীন, শুধুই অর্থকরী আর অর্থ ভাবনায় মোড়া এই জীবন। আমি সত্যিই বেমানান। আমাকে ছেড়ে যাও। তোমরাও এনজয় করবে। আমিও কাজে যাই।
কেন? আমরা হাউজি-খেলতাম!
হাউজি!
বিস্ময়ের সঙ্গে বলল পৃথু। তারপর বলল, কোনও পরিণতবয়স্ক, শিক্ষিত মানুষ কী করে হাউজি খেলে সময় নষ্ট করতে পারে তা আমার মাথাতেই আসে না। ক্রিমিনাল ওয়েস্ট অফ টাইম। বাচ্চারা খেললে বুঝি। বড়রা কী করে…কী জানি?
মনে মনে বলল, আমাকে ছেড়ে দাও তোমরা। রাগ নয়, অভিমান নয়, দুঃখ নয়, নিছক এক গভীর অপরাধবোধ থেকে এই কথাটা নিরুচ্চারে বলল পৃথু। রুষা আর তার ছেলেমেয়ের জীবন নষ্ট করার কোনও অধিকার নেই তার।
ছেড়ে দাও আমাকে তোমরা। সমস্ত অন্তর থেকে বলল পৃথু।
কিছু একটা করতে হবে। এই বন্ধন ছিন্ন করবার জন্যে। কিছু একটা আত্মহত্যা করবে কি? প্রায়ই তো মনে হয়…আবার মনে হয় কত কীই করার বাকি, কত সুন্দর কিছু করা হল না, লেখা হল না, গাওয়া হল না গান, প্রতিবাদ করা হল না কত অন্যায়, আর অবিচারের, এরই মধ্যে হেরে যাওয়া…না, না, এখনও নয়।
যখন সময় হবে…
ব্রেকফাস্ট খেয়ে পৃথু যখন অজাইব সিংহে নিয়ে চলে গেল তখন অনেকক্ষণ চলে-যাওয়া পৃথুর পথের দিকে চেয়ে থাকল রুষা।
অজাইব সিংকে আজ সারাদিনের মতো রাখতে পারে পৃথু। ক্রীসমাসের আগের এই রবিবারে। দারুণ উপহার! বেচারা! গাড়ি ড্রাইভার তো পায়ই না। পৃথুও দারুণ এক উপহার দিয়ে গেল রুষাকে। শীতের বেলার এক দারুণ ফুলফলন্ত দিন! অনুমতির দিন!
চলো, আমরাও বেরোই। হোয়াটস দ্যা ডিলে ফর?
ভিনোদ বলল। অসহিষ্ণু গলায়।
হেভি ব্রেকফাস্ট খেয়ে আলসেমি লাগছিল রুষার। বেশি সে কখনওই খায় না, সবসময়ই তার ফিগার নিয়ে সচেতন সে। তবুও সমস্ত নিয়ম মানার মধ্যেই কখনও সখনও সেই নিয়মকে ভাঙার সুখও প্রচ্ছন্ন থাকে। মাঝে মাঝে না ভাঙলে, নিয়মটা একটা বেড়ি হয়ে ওঠে যে, এ কথা রুষা জানে। কিন্তু পৃথু জানে না। তাই-ই ও ওর জেদি একাকিত্বর কচুবনে শুয়োরের মতো এক গুঁয়ে দাঁত দিয়ে মাটি উপড়ে বেড়ায়। ছড়ায়, ছিটোয়; পায় কম। কী জানি কী ও পায়, ওই-ই জানে। রুষার জীবনটা কচুবন নয়। কচুবন করে তুলতে দেয়নি রুষা। দেবে না।
ভিনোদের বাবুর্চির মাইনে আটশ টাকা। গাড়োয়ালী। দিল্লির ওবেরয় ইন্টারকন্টিনেন্টালেও চাকরি করেছে নাকি একসময়। রিটায়ার করেছে অনেকদিন হল। ছেলেমেয়ে সকলেই দাঁড়িয়ে গেছে ভালভাবে উত্তর ভারতের চতুর্দিকে। হাটচান্দ্রার অফিসারস মেস-এ তার জামাই কাজ করে তাই-ই নাতনিকে দেখতে পাওয়ার লোভে বুড়ো-বুড়ি এখন এখানেই আছে। স্ক্র্যাম্বলড এগস যা বানিয়েছিল সে, একটু বেকন, হ্যামের পাতলা পাতলা ফালি দিয়ে! আহা! মাস্টার্ড দিয়ে খেয়েছিল রুষা, রেলিশ করে, ব্রেড রোলস দিয়ে। সামান্য লেটুস, টোম্যাটো, গাছ পেঁয়াজ, উপরে হালকা স্প্রিঙ্কলিং অফ টাবাসকো সস। ফাইন! তারপর দু কাপ কফি। খেয়ে উঠে এখন গর্ভিনী হরিণীর মতো লাগছে। নড়তে চড়তে ইচ্ছে করছে না।
তার লছমার সিংও বাবুর্চি ভাল। কিন্তু প্রত্যেক বাবুর্চি মাত্রই রান্নাতেই প্রত্যেক পদেরই বিভিন্নতা থাকে। তাই-ই হয়তো ভাল লাগল এত, নতুন হাতের রান্না খেয়ে।
ভিনোদ আবার বলল, শুড উই মেক আ মুভ?
আলসেমি করেই রুষা বলল, বসে বসেই : অ্যাজ উ লাইক ইট।
গাড়ি বেরুল। ডিজেল মার্সিডিজ ওদের জন্যে। পরে অন্য আম্বাসাডরে করে বেয়ারারা আসবে খাবার এবং অন্য সাজ সরঞ্জাম নিয়ে। মার্সিডিজ-এর ড্রাইভারকে ছেড়ে দিল ভিনোদ। বলল, দরকার নেই। অন্য গাড়ি তো আসছেই পিছনে।
টুসু ও মিলি সামনের সীটে বসল। ভিনোদ ড্রাইভিং হুইলে। রিয়ার গ্লাস-এ চোখ ফেলে রুষাকে দেখল একবার ও। হালকা নীল ইমপোর্টেড টিনটেল গ্লাসে-মোড়া এয়ার কন্ডিশন্ড গাড়িতে হলুদ আর লাল স্ট্রাইপের সিল্কের শাড়ি আর ম্যাচিং ব্লাউজে রুষাকে একটি লাল হলুদ প্রজাপতির মতো দেখাচ্ছিল। চোখে ফোটোসান সান-গ্লাস, আলোর সঙ্গে সঙ্গে রঙ বদলায়। ঠোঁটে লিপস্টিক, শাড়ির লালের সঙ্গে মেলানো। ভিনোদের ইচ্ছে করছিল সিট টপকিয়ে গিয়ে আদর করে দেয় রুষাকে। চমকে দেয় হামলে পড়ে। কী যেন ভাবছে রুষা জানালার পাশে বসে বাঁদিকে চেয়ে।
টুসু ড্যাসবোর্ডে এটা ওটা ধরে টানাটানি করছিল। সিগারেট লাইটারটাতে ছ্যাঁকা খেল একবার।
রুষা চাপা ধমক দিয়ে বলল, বিহেভ ইওরসেল্ফ টুসু। টুসু একটুও বিচলিত না হয়ে বলল, এটা কী আঙ্কল? এই গ্রাফের মতো মেশিনটা? ড্যাশবোর্ড-এর সঙ্গে লাগানো?
কোনটা?
চোখ ড্যাশবোর্ড-এ নামিয়ে ভিনোদ বলল, ওটা টিউনিং ইণ্ডিকেটর। টিউনিং পারফেকট আছে কী নেই ওটা দেখলেই বোঝা যায়।
আর ওইটা?
বাঃ ওটা তো থার্মোমিটার! গাড়ির মধ্যের ঠাণ্ডা মাপার যন্ত্র।
এখন কি হিটার চালিয়ে দিয়েছ আঙ্কল? না এয়ার-কণ্ডিশনার?
এখন কিছুই চলছে না। শুধু ফ্যান আর একজস্ট। শীতের দিন। তার উপর দিনেরবেলা তো। গরমও নেই। এতেই আরাম। কি নয়?
হুঁ। টুসু বলল।
রুষা বাঁ পায়ের ওপর ডান পাটা তুলে বসল। হ্যান্ড-রেস্ট-এর উপর আরাম করে রাখল হাতটা। দুপাশে গভীর জঙ্গল। সুন্দর দেখাচ্ছে। ঘন সবুজ পাতায় ছেয়ে আছে গাছপালা সব। চিলপির কাছে গিয়েই পথটা দুভাগ হয়ে যাবে। ডানদিকে গেলে মুক্কি, মোগাঁও, মালাঞ্জখণ্ড, বালাঘাট যাবার পথ, আর বাঁদিকে সুফকর-এর রাস্তা। বিয়ের পর পর পৃথু একবার ওকে নিয়ে এক রাতে এসে থেকেছিল এখানে। গরমের দিনে। চাঁদের রাতে। মানুষটার মধ্যে তখনও প্রচণ্ড পাগলামি ছিল, একটা ডাই-হার্ড রোম্যান্টিক পৃথু, অথচ বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। কতরকমের যে পাগলামি করেছিল সে রাতে রুষাকে নিয়ে, তা মনে করতেও লজ্জা করে। সেসব অনুভূতি স্বামী স্ত্রীরই একান্ত সব স্মৃতি, প্রকাশ করার নয়। ভাববারই শুধু, কোনও হঠাৎ-আসা অবসরের মুহূর্তে।
পাগলামি ভাল। পাগলামি, প্রাণেরই পূর্ণ এবং সুস্থ প্রকাশ; প্রকাশ, উদ্বেল, জীবনীশক্তির। কিন্তু পৃথু সেই হেলদি কাণ্ডিশান থেকে এগিয়ে গিয়ে সত্যিই পাগল হয়ে গেল। ওর বন্ধু- বান্ধব, জীবনযাত্রা, পোশাক-আশাক সবকিছুতেই রুষা এবং রুষাদের এই সুস্থ, স্বাভাবিক, জীবনযাত্রার প্রতি এক গভীর ডিসঅ্যাপ্রুভাল ফুটে উঠছে অনেকদিন ধরেই। ওর এখনকার পাগলামির রকমটা ডেসট্রাক্টিভ। ক্রমশই একেবারে ইনকরিজিবল উন্মাদ হয়ে উঠছে।
রুষা নিজে নিয়ে যেতে ভয় পায় সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। লোকে বলব, হয়তো পৃথু নিজেও বলবে; ভিনোদের জন্যেই পাগল বানাচ্ছে ও পৃথুকে। ওদের ফ্যামিলিতেই তো ছিল। পাগল আর কে কাকে ইচ্ছে করে বানাতে পারে, ভদ্রলোক; সৎলোক হলে?
পাটা আবার বদলে বসল ও। আরাম লাগছে। কোমরের কাছে একটু সিরসিরানি লাগছে। ভিনোদ “শ্যানেল নাম্বার ফাইভ” এনে দিয়েছিল একটা কিছুদিন আগেই। শরীরের সমস্ত নিভৃত কোমল প্রান্তরে স্প্রে করেছে অনেক যত্নে তা আজ সকালে চান করে উঠে। সিল্কের শাড়িও পরেছে ওই জন্যেই। হঠাৎ অপ্রস্তুত অবস্থায় আদর-টাদর খেতে গেলে সিল্কের শাড়িই ভাল। ক্রাশড হয় না। বোঝা যায় না।
আজকে কিছু একটা ঘটাবে ভিনোদ। সকাল থেকেই ওর চোখ দেখেই বুঝতে পারছে রুষা। বৃষ্টি নামাবে আজ মেঘ। আজ, কেন জানে না, রুষারও অনিচ্ছে নেই। ওর শরীরও তো শরীর! ম্যাগনোলিয়া গ্রান্ডিফ্লোরা পাহাড়ি এলাকার ফুল হলেও বেঁচে থাকতে হলে তারও জলসিঞ্চনের দরকার হয়। পৃথুও তো যায় বিজলীর কাছে। যায় না কি? গেছিল অন্তত কম করে একবার। কে জানে! পরেও গেছিল হয়তো! তবে?
শরীরের ভালবাসায় পাপ নেই কোনও। দই চিঁড়ে, ভেলপুরি, দই-বড়া, বিরিয়ানিরই মতো। শুধুই মুখের স্বাদের জন্যে খাওয়া এসব। পুরুষের শরীরও সেরকমই। স্বাদ বদলানোর জন্যেই খাওয়া। পাপ কিসের? পাপ হয় মনে। পাপ ভাবলেই পাপ। শরীরে কোনও পাপ লাগে না। লাগলেও তা ঝরে যায় ধুলোকণারই মতো; ধুয়ে যায় জলের মতো। শরীরকে খুশি না রাখলে বরং মনেরই বিকৃতি ঘটে যায়। পৃথুর যেমন গেছে। শরীর একটা অনস্বীকার্য রিয়্যালিটি। কাকাতুয়া, কাক, শুয়োর, হাঁড়িচাচা এবং বাঘ সকলেরই জীবনেই। ওয়েল! রুষা ভাবল, আই জাস্ট ক্যুডনট কেয়ারলেস : ক্যুডনট কেয়ারলেস।
সুফকরের বাংলোটা খুবই ভাল লাগে রুষার। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে এবারে খড়ের ছাদ। নিচু হয়ে এসেছে। একেবারে সুন-সান্নাটা পরিবেশ। সুফকর কথাটার মানে হচ্ছে নির্জন। আগে গ্রাম ছিল, তাও টাইগার প্রজেক্ট তুলে নিয়ে অন্যত্র বসিয়ে দিয়েছেন। এখন শুধু বাংলোর সামনের ধীরে ধীরে উঠে যাওয়া পাহাড়টার মধ্যে থেকে হাওয়ার দীর্ঘশ্বাস আর পাখিদের কলকাকলি ভেসে আসে। ফিসফিস; কিসকিস…
গাড়ি থেকে নেমেই এনার্জেটিক, ভিনোদ উইকেট পুঁতে মিলি ও টুসুর সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে লেগে গেছে। রোদে চেয়ার পেতে বসে রুষা ওদের খেলা দেখছে। ভিনোদ ব্যাট করছে। মিলি উইকেটকিপার। আর টুসু বোলার। ভিনোদ কি ইচ্ছে করেই বার বার টুসুর একেবারে হাতের মধ্যেই ক্যাচ তুলে দিয়ে আউট হয়ে টুসুকে বলছে “ওয়াট আ বোওলার” তা লক্ষ করছে রুষা। মিলিকে ব্যাট করতে দিয়ে অতি সোজা আলতো শর্ট-পিচড বল ফেলে মিলিকেও ইচ্ছা করেই তাড়াতাড়ি রান তুলতে দিচ্ছে।
রুষা বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে এসব দেখছিল আর ভাবছিল, ভিনোদ বাচ্চাদের মন পেতে জানে। তাদের কাছে কী করে যে হেরে গিয়ে জিততে হয় সে বিদ্যা ভিনোদ পুরোপুরি রপ্ত করেছে। টুসু মিলি যদি ওর নিজের বাচ্চা হত তাহলে ওরা কত খুশিই না হত। কিন্তু ভিনোদের নিজের যদি কখনও ইস্যু হয় তারপরেও কী টুসু মিলিকে ও এমনিই চোখে দেখবে?
যদি… জানে না। এক্ষুণি অতদূর অবধি ভাবতে চায়ও না রুষা।
ভিনোদ খেলা শেষ করে মাঠের মধ্যে মহামূল্য জামাকাপড় পরে থেবড়ে বসে পড়ে বলল, আজকে তোমাদের একটা দারুণ সারপ্রাইজ দেব আমার বাড়িতে রাতে, যখন ফিরে গিয়ে ডিনার খাব আমরা।
হোয়াট আঙ্কল? হোয়াট আঙ্কল?
বলে, ছেলে ও মেয়ে দুজনেই লাফাতে লাগল।
মিলিটা বড় হচ্ছে। ইনফ্যাক্ট, মধ্যবিত্ত বাঙালির বাড়ির মেয়ে হলে শাড়ি পরত দুবছর আগে থেকেই। কিন্তু দিনকাল পালটে গেছে। তাছাড়া মধ্যবিত্তদের দলে আদৌ পড়ে না রুষা। পড়তে চায়ও না। তবু, ওর শিশুবেলা থেকে অভ্যস্ত চোখে হঠাৎ হঠাৎ অনভ্যস্ত এই সবই একটু দৃষ্টিকটু লাগে। তাছাড়া, ভিনোদ। মিলিকে সাবধান করে দিতে হবে। সময়মতো পৃথু সম্বন্ধেও সাবধান করে দিয়েছিল। হ্যাঁ তার নিজের স্বামী সম্বন্ধেও। পুরুষ বাঘ আর পুরুষ মানুষ বিশ্বাসের নয়। রাত-বিরেতে বাড়ি ফেরে মত্ত অবস্থায়। পুরুষকে তো ভগবান মানুষ করেননি, জানোয়ারই করেছেন। পুরুষ জাতটার মধ্যে মানুষ কমই, শুধুমাত্র অঙ্গপ্রত্যঙ্গেই বেশি। পৃথু সম্বন্ধে মিলিকে সাবধান করে দেওয়ার পর থেকেই মেয়েটা একটু কুঁকড়ে থাকে, আড়ষ্ট হয়ে। পৃথু ডাকলেও কাছে যায় না। সরল পৃথু কী ভাবে, কে জানে? মেয়েকে ডেকেও সাড়া না পাওয়ায় পৃথুর ঘর থেকে স্বগতোক্তি কানে আসে। জানলে, খুবই দুঃখ পাবে। কিন্তু রুষা নিরুপায়। সে যে, মা!
একা একা শুয়ে শুয়ে কত কী আবৃত্তি করে পৃথু, বেশিই ট্র্যাশ বাঙলা কবিতা। সামান্যই ইংরিজি। ইংরিজির ছাত্র যদিও রুষাই, তবু মাঝে মাঝে পৃথুর ইংরিজির জ্ঞান ও সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা দেখে চমকে যায় ও। ভালবাসার কোনও বেড়া নেই। ভাষার ভালবাসার তো নয়ই।
বললে না ভিনোদ আংকল, কী? কী হবে রাতে?
আমি, আমি না একটা ভি সি আর কিনেছি, অনেকদিন হল। তোমরা তো এলেই না একদিনও। কত ফিল্ম নিয়ে এসেছি জানো না? একটা ক্যামেরাও। আজ তোমরা কী ছবি দেখবে বলো? ‘আ স্টার ইজ বর্ন”, “ব্রিজ অন দ্যা রিভার কাওয়াই”? “বেন-হুর”, না “লরেন্স অফ অ্যারেবিয়া”? নাকি “দ্যা ফিডলার অন দ্যা রুফ”? নয়ত “উইদারিং হাইটস”-এমিলি ব্রন্টির?
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই অন্য গাড়িটিও এসে গেল। দুজন বেয়ারা টপাটপ নেমে পড়ে বাংলোর লনের এক কোণাতে বার সেট-আপ করে ফেলল। আইস-বাকেট। শেরী, জিন, ভডকা, বীয়ার, ফ্রুট জ্যুস নানারকম। সাদা টেবল ক্লথ পাতল চাকালাগানো সাদা ট্রলির উপর।
তোমরা কী খাবে?
ফ্রেশ লাইম জ্যুস উইথ সোডা। মিলি বলল।
টুসু বলল, আমি একটা গোন্ড কয়েন অ্যাপল জ্যুস খাব।
ফাইন।
বলল, ভিনোদ।
তারপর বিয়ারারা দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও নিজে হাতে গ্লাস ঝাড়ন দিয়ে মুছে ওদের ড্রিঙ্কস সার্ভ করল।
তারপর বলল, নাউ, ইয়াং লেডি, ইয়্যাং ম্যান হোয়াট ডু উ্য প্রোপোজ টু ডু? আরও কিছুক্ষণ কি আমরা ক্রিকেট খেলব বিফোর লাঞ্চ? না তোমরা দুজনে মোগাঁওর হাটে গিয়ে দেখবে মাছ-টাছ পাওয়া যায় কি না? মাছ খেতে কে বেশি ভালবাসো?
টুসু।
মিলি বলল।
এমন সময় একটা হলুদ পাখি এসে সামনের গাছের ডালে বসল।
মিলি বলল, কী পাখি এটা আংকল? কী সুন্দর!
ভিনোদ একটুক্ষণ চেয়ে বলল, হুমম! আই সী। আ বার্ড। চিড়িয়া অফ সাম কাইণ্ড? কোয়াইট বিউটিফুল, ইজনট ইট?
টুসু হেসে ফেলল, বলল, এ তো ওরিওল।
যে গাছে পাখিটা বসে আছে গাছটার নাম কী আংকল?
আবার শুধোল মিলি।
পেঁড়ই হ্যায় ব্যসস। জঙ্গলকা পেঁড়। নাম ধাম কওন জানতা? হু নোজ? অ্যান্ড হোয়াটস দ্যা উইজ? আই আম নাইদার আ বটানিস্ট নর এন অর্নিথোলজিস্ট।
টুসু দুহাতে গোল্ড কয়েন অ্যাপলজ্যুস-এর গ্লাসটা ধরে বলল, এমা! ইভিন দিস ট্রী, আঙ্কল ডাজ নট নো! এটা চিলবিল গাছ।
মাই গুডনেস! হোয়াট আ নেম! চিলবিল!
রুষা গলা তুলে গর্বমাখা গলায় বলল, টুসু। তুই এতসব জানলি কী করে?
এতসব কী? বাবার কাছ থেকে কবে এসব চিনেছি। বচপনমে।
রুষা হেসে উঠল ওর কথার ধরনে। বচপনমে! যেন শেষই হয়ে গেছে ওর বচপন।
রুষা চেয়ারে সোজা হয়ে উঠে বসল। বলল, বাবার সঙ্গে তোর দেখাই বা হয় কতটুকু? কখন আবার উনি তোকে গাছ পাখি এসব চেনালেন?
টুসু ভুরু নাচিয়ে হাসল। দুষ্টুমির হাসি। তারপর বলল, ছুপকে ছুপকে।
মিলি ডাকল, যাবে তো চলো টুসু। আমি কাঁচের চুড়ি কিনব মোগাঁও-এর হাটে। মাছ কিনলে তুই কিনিস। মা-আ গিভ মী সাম মানি…প্লীজ।
আমার পকেট মানি সব ফুরিয়ে গেছে।
ভিনোদ তাড়াতাড়ি পার্স খুলে দুজনকেই একটি করে একশো টাকার নোট দিল।
ছেলেমেয়েরা হতভম্বমুখে তাকাল একবার মায়ের মুখে। আরেকবার ভিনোদের মুখে।
রুষা উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগ খুলল নিজের। দুটি দশ টাকার নোট দুজনকে দিয়ে বলল অ্যাংকল-এর টাকা আংকলকে ফেরত দিয়ে দাও।
ভিনোদ বলল, আই ফিল ইনসালটেড রুষা। জেনুইনলি।
রুষা বলল, আমার ছেলেমেয়েদের আর সব অন্য শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আত্মসম্মানজ্ঞানটাও শেখাতে চাই। এ নিয়ে কোনও তর্ক কোরো না প্লিজ, ডোন্ট স্পয়েল দ্যা কিডস।
বেয়ারাদের ও ড্রাইভারদের ভিনোদ টাকা দিয়ে কী সব বুঝিয়ে দিতেই ওরা সকলে মিলে গাড়িতে চলে গেল।
এখন ওরা একা। রুষা আর ভিনোদ। সাজানো বার-এর সামনে লনের মধ্যের গাছতলায়।
ভিনোদ বলল, ওয়েল, আই অ্যাম হার্ট।
উ্য শুডনট বী, ভিনোদ। মানি ক্যান বাই ওলমোস্ট এভরিথিং আন্ডার দ্যা সান। বাট, নট ওল। ডোন্ট ট্রাই টু বাই-আপ মাই চিলড্রেন্স সেল্ফ-রেসপেক্ট। তুমি ভুলে যেয়ো না ভিনোদ। ওরা শুধু আমারই নয়, পৃথুরও ছেলেমেয়ে। ওদের শরীরে পৃথুর রক্তও বইছে। এবং কী বলব তোমাকে, যখনই ও কথা ভাবি তখন যদিও জানি যে, ওদের আমিই সব, সবকিছু; তবু একটা জায়গাতে, ওদের পার্সোনালিটির কোনও কোনও এরিয়াতে ওদের বাবার রক্ত আমার রক্তর চেয়ে অনেক বেশি ডমিন্যান্ট। বিশ্বাস করো, তখন বুঝতে পাই যে, আমি সবসময় জিতে থেকেও আসলে হেরে যাচ্ছি পৃথুর কাছে, ছোট হয়ে যাচ্ছি তখন…
ট্রাউজারের দু পকেটে দু হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভিনোদ রুষার মুখে চেয়ে বলল, তখন কী? তখন খুব কষ্ট হয়, তোমার না?
না, না। তা নয়, কষ্ট নয়; কী বলব! জাননা, খুব আনন্দ হয়।
আনন্দ? স্ট্রেঞ্জ!
বলল ভিনোদ, বিমর্ষ মুখে।
কিছুক্ষণ ও টুসুর চিনিয়ে দেওয়া চিলবিল গাছ আর একটু আগে উড়ে-যাওয়া ওরিওল পাখিটার চলার পথের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল শীতের সকালে ট্রাউজারের দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে। তারপর আস্তে আস্তে রুষার পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওর দু কাঁধে হাত রাখল। ফিসফিস করে বলল, শুড আই ফিক্স উ্য আ ড্রিঙ্ক ডার্লিং?
রুষা উত্তর দিল না। মুখ নিচু করে রইল। অন্যমনস্ক হয়ে।
উ্য ওয়ান্ট আ শ্যাণ্ডী অর আ জন-কলিনস? অর, মেরী সামথিং এলস?
না। গিভ মী আ ব্লাডি-মেরী প্লীজ। অ্যান্ড মেক ইট স্টিফ। রিয়ালী স্টিফ।
হেসে উঠল ভিনোদ।
বলল, হোয়াট আ ডে। ডার্লিং রুষা ইজ আসকিং ফর আ স্টিফ ড্রিঙ্ক। ওয়েল! দ্যা প্লেজার অ্যান্ড দ্যা বেনিফিটস উইল ওল বী মাইন…।
ভিনোদ যখন খুব বড় করে একটা ভডকা ঢেলে তার মধ্যে টম্যাটো জ্যুস মিশিয়ে, ফ্লাক্স থেকে আইস কিউব বের করে মিশিয়ে ব্লাডি-মেরীটা নিয়ে এল রুষার কাছে তখন দেখল রুষার দু চোখের কোণ ভিজে। নীচের দাঁত দিয়ে উপরের ঠোঁট কামড়ে আছে। শীতের অলস হাওয়ায় অলকচূর্ণ উড়ে উড়ে পড়ছে কপালে।
ভিনোদ বলল, কাম, হানি! টেক ইওর ড্রিঙ্ক।
গ্লাসটা রুষার হাতে তুলে দিয়ে ওর পাশে চেয়ার টেনে নিজের পিংক জিনের গ্লাস নিয়ে বসতে বসতে নিজের মনেই বলল ভিনোদ, দিজ উইমেন! রিয়্যালি, আ স্ট্রেঞ্জ লট! আই অ্যাম নট গোয়িং টু টাচ আ ম্যারেজ ইভিন উইথ আ পোল।
বিয়ে-টিয়ে চলত হয়তো এক সময়ে এক যুগে, যখন বয়েল-গাড়ি করে লোকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেত। এই যুগে, এই জেট-এজ-এ বিয়ে ব্যাপারটাই অবসলিট হয়ে গেছে। কার সময় আছে এসব ফালতু সেন্টিমেন্ট, কান্না, এসব মান-ভাঙানোর? এখন গিভ অ্যান্ডটেক-এর দিন। ইট, ড্রিঙ্ক, বী মেরী, বাই এনী মিনস। চুরি করো, ডাকাতি করো, কিন্তু ভাল থাক, লাইফ এনজয় করো। সেন্টিমেন্ট, বিবেক এসবের দিন চলে গেছে বহুদিন আগে।
রুষা পথের ওপাশের পাহাড়ে চেয়েছিল উদাস চোখে। জানোয়ারদের পায়ে চলা শুঁড়ি পথ নেমে এসেছে একটা, পাহাড়টা থেকে, অন্য আরেকটা শুঁড়ি পথ তাকে পনেরো ডিগ্রিতে কেটে গেছে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট বোধ হয় নুন দিয়েছেন ধারে কাছে কোথাও জমিতে। অথবা ন্যাচারাল সল্টলিকও থাকতে পারে। এসব পৃথুর মুখস্ত। রুষা জানে না।
রুষা বলল, এই পথটা কোথায় গেছে, জানো ভিনোদ?
কোন পথটা?
ভিনোদ গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিল। চমকে উঠে বলল, কোন পথটা?
ওই যে জঙ্গলের মধ্যে চলে গেছে। দেখতে পাচ্ছ না?
কে জানে? জঙ্গলের পথ জঙ্গলেই গেছে। কে তার খোঁজ রাখে? জংলিরা রাখে হয়তো। পিচের রাস্তার কথা বলো, হাইওয়ের কথা বলো তো বলতে পারি। সেই সব পথের ডিস্টিংট ডেস্টিনেশান আছে। এই সব অস্পষ্ট, আনইমপর্ট্যান্ট জানোয়ার-চলা পথের খোঁজ রেখে লাভই বা কী? এ সব হল পৃথুদার ডোমেইন। যার কোনও কাজ নেই সেই এইসব জেনে শুনে রাখে।
রুষা জবাব দিল না। ভিনোদ ভেবেছিল, খুশি হবে রুষা। কারণ ভিনোদ জানে যে, রুষা ঘেন্না করে পৃথুকে। এক গভীর ঘেন্না। সত্যিই হয়তো করেও, কিন্তু তবুও রুষা খুশি হল না ভিনোদের এই কথায়।
রুষা, ব্লাডি মেরীর আশ্লেষে নানা কথা ভাবছিল, এলোমেলো। ভাবছিল, একজন শিক্ষিত মানুষের জীবনে অবিমিশ্র কোনও অনুভূতি বোধহয় থাকে না। ঘৃণার মধ্যে প্রেম মিশে থাকে, প্রেমের সঙ্গে ঘৃণা, মালটি লোয়ারড আইসক্রিমের মতো। মূল স্বাদটা যা, তাই বোধহয় জিভে লেগে থাকে, অন্য স্বাদগুলো ক্বচিৎ জাগে, অবচেতনের ঘুমিয়ে-থাকা সাধের মতো। পৃথুকে অনেক কারণে ভালও বাসে, শ্রদ্ধাও করে রুষা। পুরোপুরি ঘৃণাও করে না। আবার পুরোপুরি ভালও বাসে না।
ভিনোদ দেখতে দেখতে ওর গ্লাস শেষ করে ফেলল খুব কম সময়েই। করেই, রুষার গ্লাসের দিকে হাত বাড়াল। বলল, হ্যাভ আ সেকেন্ড ফীল। কুইক। আমাদের সময় কিন্তু বেশি নেই। ঘরে চলো। ওদের যেতে-আসতে-ঘুরতে বেশি তো ঘণ্টাদুয়েক লাগবে।
কেন জানে না, রুষার আজকে নেশা করতে ইচ্ছে করছিল। না, ভিনোদের আদর খাবে বলে নয়, নিজেকে একটু ভুলবে বলে; নিজের মধ্যে থেকে নিজে বেরিয়ে এসে একটি ওরিওল পাখির মতো চিলবিল গাছের উঁচু ডালে বসে নিজের ছেড়ে-রাখা খোলসটাকে শীতের চকচকে রোদদুরে দেখবে বলে। পৃথু ওকে অনেক কিছু দেয়নি এই জীবনে, আবার দিয়েওছে অনেক কিছুই। এই সব ভাবনার ক্ষমতা দিয়েছে, দিয়েছে এই অনাবিল চোখ, খোলা হওয়ায়, প্রকৃতির মধ্যে নাক ডুবিয়ে জীবনকে ভালবাসার এই তীব্র তাগিদ। স্বীকার করুক আর নাই সে করুক তা মুখে। পৃথু পৃথুই।
ভিনোদের এই ব্যাপারটা ভাল লাগে না। আদর করা বা আদর খাওয়া ব্যাপারটার মতো রোম্যান্টিকতম একটা ব্যাপারকেও বড় স্থূল, মানডেন করে ফেলে। পৃথু হলে, ওকে নিয়ে একচক্কর হেঁটে আসত জঙ্গলে, ফুল চেনাত, পাখি, প্রজাপতি, নদীর শুকনো বুকে বসত, চিকন পাখির ডাক শুনে মনে মনে হারিয়ে যেত কতক্ষণ, তারপর কাঁচপোকার শব্দে ঘোর কাটত। অনেকক্ষণ পর বলত, চলো, এবার আমার কাঠবিড়ালিকে একটু আদর করি, কতদিন হাতে নিই না আমার সুন্দর পায়রা দুটিকে! কেমন আছে গো তারা?
রুষা হেসে, মুখে বলত অসভ্য।
মনে মনে বলত একেই বলে সভ্যতার কনসেপ্ট। এই মানডেন জীবনটাকে ঘোলা, একঘেয়ে দৈনন্দিনতা থেকে জীবনকে হঠাৎই অনেক উঁচুতে গ্রীষ্মর চাঁদের রাতের সাদা ধবধবে গাছেদের বনের পত্রশূন্য ডালেদের মসৃণ পেলব চাঁদোয়াতে তুলে দিতে কী করে যে হয়, তা পৃথুই জানত।
কিন্তু সেই পৃথু আর নেই। বদলে গেছে। আর রুষা? সেই রুষাও কি আছে? বদলায়নি একটুও?
ভিনোদ রুষার জন্যে ব্লাডি-মেরী বানাতে বানাতেই আর একটা পিংক-জিন নিজে খেয়ে ফেলল। তারপর আরও একটা নিজের জন্যে নিয়ে রুষারটা হাতে করে এনে বলল, কুড উই গো ইন দ্যা রুম নাউ।
নট ইয়েট।
রুষা বলল। কেটে কেটে।
মনে মনে বলল, এখনও নয়, এখনও নয় ভিনোদ। পৃথুর চোখের চাউনি, মিলি ও টুসুর গলার স্বরে এখনও কান ভরে আছে আমার। বিবেক এখনও ঘুমোয়নি। আরও একটা ব্লাডি মেরী খাই। অ্যানাদার স্টিফ ওয়ান খাই। তারপর। ঘুমন্ত বিবেকের মনহীন শরীরের রুষাকে নিয়ে তুমি একটা জন্তুর মত যা-খুশি কোরো। তুমি এত খাওয়াও, আমার ছেলেমেয়েদের এত ভালবাসো; এত প্রেজেন্ট দাও, আমাকে সবসময় এত মনোযোগ দাও, আর তোমাকে কিছু না দিয়ে কি পারি? আমি কি এতই ইতর? জীবনের অনেক ঋণ, কৃতজ্ঞতার ভার, অনেক মেয়েদের তো শরীর দিয়েই মেটাতে হয়। মেয়েমাত্রই এ কথা জানে। ফিরিয়ে দেবার অন্য সাধ্য থাকলে হয়তো অন্যরকম হত। তা যে হয় না।
ওক্কে!
বলল ভিনোদ। অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিল ও। ওর চোখ মুখ উত্তেজিত। গাল লাল, গা দিয়ে গরমের হলকা উঠছে। মনে হচ্ছে, যেন জ্বর হয়েছে। ভালুকদেরও, শুনেছে রুষা; দিনের মধ্যে এরকম হঠাৎ হঠাৎ জ্বর আসে। আর পুরুষদের কাম-জ্বর।
একটু পর ভিনোদ হঠাৎই বলল, চল, যাওয়া যাক। ওরা এসে পড়লে এমবারাসিং অবস্থা হবে।
ততক্ষণে রুষার মস্তিষ্কে ব্লাডি মেরীর মাকড়শা জাল বিছিয়ে দিয়েছে। পায়ে ভর নেই।
বাংলোর চৌকিদারকে ডেকে বাইরে লাগানো বার দেখতে বলল ভিনোদ। পাখি-টাখি যেন গেলাস টেলাস উল্টে না দেয়। চৌকিদারকে ডেকে একটা বীয়ারের বোতলও দিল। বলল, হামলোগ চলা যানেকা বাদ পীনা। সমঝা।
ঘুষ! অন্যায় কিছু ঘটলেই সেখানে ঘুষ জন্মায়, বৃষ্টির পর ব্যাঙের ছাতার মতো। চৌকিদার বুঝল, যা বোঝার। আড়চোখে রুষার দিকে চেয়ে বলল, হাম হিঁয়া চৌকিমে হ্যায় হুজোর। আপলোগ বে-ফিক্কর রহিয়ে।
ভিনোদের মুখ ক্ষণিক লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। রুষার পেছন পেছন বাংলোর ঘরে ঢুকল।
রুষা গিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ল। ছায়াছন্ন ঘরটা। চড়ুই ডাকছে খড়ের চালে। একটা ঝাঁকড়া রাঙাজবার গাছ। অজস্র ফুল এসেছে তাতে। বুলবুলি শিস দিচ্ছে। অমলতাস গাছের নরম পাতারা মন্থর বাতাসে ধীরে ধীরে আন্দোলিত হচ্ছে। জানালা দিয়ে সামনের পাহাড়, কাটাকুটি-পথ, ঘননীল আকাশ চোখে পড়ছে। একলা পাহাড়ি বাজ উড়ছে একটা ঘুরে ঘুরে।
উঠে বসল আবার রুষা। তার স্বামীর কথা, পৃথুর কথা মনে হল তার। গ্লাসটা একচুমুকে শেষ করে দিল। বটমস আপ। আর মনে পড়বে না পৃথুকে এখন।
ভিনোদ ততক্ষণে সম্পূর্ণ অনাবৃত করে ফেলেছে নিজেকে। এগিয়ে আসছে রুষার দিকে। গুহামানবের মতো। মার্সিডিজ গাড়ি, লনওয়ালা বাড়ি, বাগান, উর্দিপরা বেয়ারা—বাবুর্চি, ভি সি আর, মর্যাদা, যশ, মান সম্মান, টাকার গরিমা সব গাছের বাকলের মতো খসে পড়েছে তার গা থেকে। এইই চিরন্তন পুরুষ। ভাবছিল রুষা। ভালুকের মতো। বুকময় চুল, হাতে পায়ে তলপেটে; জন্তু একটা।
রুষা চোখ বুজে ফেলল।