৪২
তিন চার মিনিট ওখানে শুয়ে থেকে পৃথু এক লাফে উঠে এবার দৌড়ে যেতে লাগল সকালে যেখানে মগনলালের ক্যাম্প দেখেছিল সেই দিকে। পেছনে পেছনে শামীম।
ত্রিপলটা সেই রকমই টাঙানো ছিল। তার কাছে একটা উনুন। সেটা নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কাঠকয়লার আগুন তখনও ছিল। কেউ কোথাওই নেই। একটা পেঁচা ডেকে উঠল দুরগুম দুরগুম দুরগুম করে ঝাঁকড়া চিলবিল গাছটার উপর থেকে, যেখানে মৌলভীকে ওরা মেরেছিল; একটি কুটরা হরিণ ব্বাক ব্বাক ব্বাক করে ডেকে উঠল হঠাৎ ভয় পেয়ে। পৃথু, যেদিকে মহুয়াগাছটার উপর মাচা ছিল সেদিক লক্ষ করে আন্দাজে রাইফেলের ম্যাগাজিন খালি করে দিল।
শামীম হঠাৎ অস্ফুটে বলল, ইয়া আল্লা!
কাঠকয়লার নিভু নিভু অঙ্গারের আভায় পৃথু চেয়ে দেখল সকালের সেই মেয়েটিকে। এলোমেলো শাড়ি। কী এক করুণ অসহায় ভঙ্গিতে শুয়ে আছে ত্রিপলের নীচে কাত হয়ে। তার গলাটা জবাই-করা। মুরগির মতো। মৃত্যুর ঠিক আগের সময়কার অসহ্য ছটফটানিতে তাজা রক্ত ছিটকে গেছে চতুর্দিকে বিচালি আর ঘাসের উপর। কালো কালো ছোপ চারদিকে। টাটকা রক্ত। প্রায়ান্ধকারে লালকে কালো দেখাচ্ছে।
পুরুষ অথবা নারীর রক্তে কি কোনওই তফাত নেই? স্বভাবে ও চরিত্রে এত তফাত? কে জানে, আছে কি নেই?
পৃথু, শামীমকে ফিসফিস করে বলল, অব দৌড়কে চলো, জীপোয়ামে। মগনলাল নেহি মরা। জরুর ভাগা হোগা। আটবারোঁয়া ঔর সামারীয়াকে তরফ গ্যয়া হোগা। জলদি। জলদি দৌড়কে চলো শামীম। টাইম নিকাল রহা হ্যায়। উহ কামিনে দুসরেকো মারায়া, আপনা জান লেকে ভাগা। সর্দারী কী তরীকাই দুসরা হ্যায় উসকা।
শামীন যেন মস্ত এক ধাক্কা খেল। হতভম্বরের মতো বলল, ডাকল মগনলাল আভভি ভি নহি মরা? তো উওলোগ কওন থা?
বাত বাদমে কয়রাগে। আভভি দৌড়কে চালো।
নদীর রেখা ধরে ওরা দৌড়ে ফিরে যেতে লাগল, তাড়াতাড়ি জীপের কাছে পৌঁছনোর জন্যে। মিনিট দশেক খুব জোরে হাঁচোর-পাঁচোর করে দৌড়নোর পরই হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে আলোর বন্যা বইয়ে দিয়ে ভুচুর জীপের হেডলাইট জ্বলে উঠল।
ভুচু চকিত সংক্ষিপ্ত স্বরে বলল, হ্যান্ডস আপ।
নূরজেহান! নূরজেহান! বলে চেঁচিয়ে উঠল ওরা দুজনেই একই সঙ্গে। শামীম আর পৃথু।
ভুচুও বলল, নূরজেহান।
শামীম আবারও বলল। নূরজেহান। নূরজেহান বলতে বলতেই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। পাগলের মতো।
পৃথু বলল, আঃ শামীম! কেয়া কর রহা হ্যায় ইয়ার? তেরা লেড়কিকি বেইজ্জতকি বদলা আভভিতক পুরী নেহি হুয়া। বাদমে, বাদমে রোণা।
ভুচু তাড়াতাড়ি জীপটা ঘুরিয়ে নিল।
বলল, মগনলাল?
পালিয়েছে।
জানলে কী করে?
পৃথু বলল, সে আমাদের সামনা করতে চাইলে আমাদের ফেরা নাও হতে পারত। সর্দার এমনিই হয় না। তার এলেম থাকে। সকলের আগে ভাবে সে, আগে চলে। কী যে ঘটতে যাচ্ছে, তার গন্ধ পেয়ে যায়।
ওই মেয়েটা কে?
শামীম অবাক গলায় বলল।
ভৈরবী! সেই বাঙালি তান্ত্রিকের ভৈরবী! ওয়েস্ট বেঙ্গলের বাগনান বা কোথাকার যেন মেয়ে। কোথায় জন্মেছিল, সবুজ ধানক্ষেতে আর বাবলার ছায়ায় বড় হল; আর মরতে এল কোথায়! মগনলালকে আমাদের পেতেই হবে ভুচু। লোকটা একটা জ্যাক দ্যা রিপার। অ্যাপার্ট ফ্রম বীইং আ ড্যাকয়েট। মিঃ লালও সেকথা বলেছিলেন।
জোরে জীপ চালাল ভুচু সামারীয়া আর আটবারোয়াঁর পথের দিকে। টপ গিয়ারে জীপটাকে ফেলে, দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ঠুঠার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে না মগনলাল, যদি ওদিকে গিয়ে থাকে। আমাদের কালো-বাঘ সেদিকে বসে আছে। যত বড় ডাকুই সে হোক না কেন। বাঁচা নেই!
হাঁ।
শামীম সায় দিল ভুচুর কথায়।
আলোর বন্যা বইয়ে ভুচু প্রচণ্ড জোরে টিকিয়া-উড়ান চালিয়ে যখন জীপটাকে আধ ঘণ্টার মধ্যে মোড়টাতে পৌঁছে দিল, দেখল হুদা বসে আছে ভুচুর জীপে। গ্লাসে করে চা খাচ্ছে ধীরে সুস্থে। সঙ্গে এক প্লেট নিমকি আর কালাজামুন।
ভুচু বিরক্তি মেশা স্বগতোক্তি করল, পিকনিক করতে এসেছে এখানে!
পৃথু বলল, এখানে এক সেকেন্ড দাঁড়াও। হুদা আন-আর্মড। আমি ওর জীপে যাই।
পৃথু নেমে গিয়েই হুদাকে বলল, চলো, চলো, তাড়াতাড়ি এগিয়ে চলল। ঠুঠা আর দৌলত সিংয়ের দলের সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার। একদৌড়ে দোকানে চায়ের গ্লাস আর খাবারের ডিশ ফেরত দিয়ে পাঁচ টাকার নোট একটা ছুঁড়ে দিয়ে এসেই জোরে ছোটাল জীপ হুদা। প্রায় ভুচুরই মতো।
মিনিট দশেক জীপ চালানোর পরই পথের বাঁদিক থেকে একটা পাঁচ-ব্যাটারির টর্চের আলো এসে আগে আগে যাওয়া ভুচুর জীপের উইন্ডস্ক্রিনে পড়ল। চোখ ধেঁধে গেল ওর। ভুচু স্পীড কমাল। সিটের পাশ থেকে ওর টর্চটা তুলে নিয়েই ভুচু হাত বাড়িয়ে আকাশের দিকে দুবার আলো দেখাল। সঙ্গে সঙ্গে বাঁদিকের জঙ্গল থেকে টর্চের আলো যে ফেলেছিল সেও তাইই করল।
ঠুঠা বাইগা।
ভুচু বলল।
সিগন্যাল এইই ছিল।
জীপ দাঁড় করাল ভুচু হঠাৎই ব্রেক করে। হুদা, প্রায় অ্যাকসিডেন্ট করতে করতে কোনওক্রমে জীপ বাঁচিয়ে, ভুচুর জীপের বাম্পারে প্রায় ঠেকিয়েই দাঁড় করাল ওর জীপটাকে। পেছনে। পৃথুর মাথা ঠুকে গেল উইন্ডস্ক্রিনের কাঁচের সঙ্গে অত জোরে ব্রেক করাতে।
ঠুঠা দৌড়ে এল। পৃথু ও ভুচু নামল, শামীম আর হুদাকে নামতে মানা করে।
কী হল?
পৃথু বলল।
নাঃ। এদিকে কেউ আসেনি।
কেউই না?
নাঃ।
একজনও না?
একজন আহির শুধু সাইকেল চড়ে গেল। ভোলোভালা লোক। গরিব আদমি।
বড় অবান্তর কথা বলো তুমি ঠুঠা। একটু আগেই কী বললে? সাইকেল চড়ে? উড়ে গেল? আহীর?
হ্যাঁ। আহীর।
হুদা জীপে বসে থেকেই বলল, হ্যাঁ। হ্যাঁ। আমিও তো তাকে দেখেছি। দু’ হ্যান্ডেলে দুধের টিন ঝুলিয়ে, গান গাইতে গাইতে চলে গেল সে মোড় দিয়ে। দুধের শব্দও হচ্ছিল ছলাৎ ছলাৎ। সন্ধে লাগার একটু পরই সে গেছে।
পৃথু উত্তেজিত হয়ে উঠল। বলল, তোমার দৌলত সিংয়ের দলের লোকরা কোথায়? তারা কি বরযাত্রীর নেমন্তন্ন খেতে এসেছে এখানে। একটা ছুঁচো দেখলেও তোমাদের তাকে আটকানো উচিত ছিল।
তিনবার পর পর জোরে হর্ন বাজান জীপের।
ঠুঠা বলল।
ভুচু দৌড়ে জীপে গিয়ে তিনবার জোরে হর্ন বাজাল।
দেখতে দেখতে, ধূলিধূসরিত নতুন-কাটা ছানা-ছানা-গন্ধ শীতের রাতের ঘি-রঙা, ঝিঁঝি পোকা-ডাকা পথে ছ’জন পায়জামা পাঞ্জাবি পরা লোককে এক এক করে দৌড়ে আসতে দেখা গেল। তাদের লোহার নাল-বসানো নাগরার শব্দ হচ্ছিল, পথের পাথরে লেগে। ভুচুর মনে হল পোশাক দেখে, শালারা যেন বরযাত্রীই খেতে এসেছে। পৃথু বলল, আপনারাও কাউকে দেখেননি?
নাঃ।
একজনও না?
ও হ্যাঁ। একজন আহীর, মানে গোয়ালা গেছিল শুধু। বহতই পিয়ে-হুয়ে-থে। গানা গাতে গাতে চলা গ্যয়া।
কী গান গাইছিল?
তা তো লক্ষ্য করিনি।
গোঁফওয়ালা দৌলত সিং লজ্জিত হয়ে বলল।
ওদের মধ্যে একজন বলল, গানটা আমার মনে আছে। সেই আহীরটাকে আমি দাঁড়ও করিয়েছিলাম। শুধোলাম, কোথা থেকে আসছ?
সে বলল, আটবারোয়াঁ।
নাম কী তোমার?
বলল, ছেদীলাল।
কী গান গাইছিল?
গাইছিল, “প্রীত ভইল মধুবনোঁয়া রামা, তোরা মোরা।” এই গানই বারবার গাইছিল। আমার কাছে থেকে খৈনিও চেয়ে খেল। ওইই তো বলল যে, বড়ই ভয় পেয়েছে। পথে আসবার সময় নইনদীয়ার দিক থেকে অনেক গুলিগোলার আওয়াজ শুনেছে। ডাকু-ফাকু এসেছে বোধহয় এই জঙ্গলে। দিনকাল খুব খারাপ পড়েছে। তারপর, হাতে খৈনি মেরে মুখে ফেলে বলল, তুমি নিজেও তো ভাই আবার ডাকু-ফাকু নও?
আমি কিষুণমহারাজকে ভজন করি। দুধ মাঠঠা বেচে খাই। এবার প্রাণ নিয়ে পালাই।
ওর দুধের পাত্র থেকে ছলাৎ ছলাৎ করে দুধের আওয়াজও আসছিল। লোকটা সত্যি আহীর।
পৃথুর বড় রাগ হয়ে গেল।
বলল, ইডিয়টস। সেই ছেদীলালকে কি আপনার রিভলভার দেখিয়েছিলেন?
রাম কহো। নেহী।
কোথায় ছিল, আপনার আরমস?
বাঁ দিকের কোমরে।
আপনার নিজের প্রাণ বেঁচেছে এইই ঢের।
তারপর পৃথু ভাবল, অন্যদের উপর রাগ দেখানোর অধিকার তার নেই। এরা পুলিশের লোক। মাথায় আর কিছু থাক আর নাই থাক; গুমোরে ভরা ঠিকই আছে। বুঝেই ঠুঠাকে বলল, ছিঃ ছিঃ ঠুঠা। লোকটাকে ছেড়ে দিলে তুমিও। কালা-বাঘ হয়ে। তোমার মাথায়ও কি গোবর? কী বলব তোমাকে। সাইকেলটা কেমন দেখতে ছিল? তুমি ছিলে এদিকে কত ভরসা ছিল আমার।
আমি তো ওকে থামাইইনি। অন্যরা দেখে ছেড়ে দিল, তাই।
পৃথু আবার বলল, সাইকেলটা কেমন দেখতে ছিল?
হুদা বলল, আমি দেখেছি। চায়ের দোকানের হ্যাজাকের আলো পড়েছিল তো পথে।
কীরকম সাইকেল? লক্ষ্য করেছিলে?
হ্যাঁ। দু’ হ্যান্ডেল থেকেই লাল-নীল প্লাস্টিকের ফালি ঝুলছিল। আমাদের গিয়াসুদ্দিন মৌলভীর সাইকেলে যেমন ছিল না, প্রায় তেমনই।
মাই গুডনেস! সিলী ফুলস। বলে, রাগে, গজগজ করতে লাগল পৃথু ঠুঠাদের উপর।
ঠুঠা বলল, কেন রাগ করছ? বনে-পালা মোষের ঘন দুধের ছলছলানির আওয়াজও তো শুনেছে সবাইই দুধের পাত্র থেকে। বলছে যে কনস্টেবলটি, লোকটা সত্যিই আহীর। আরে, নইলে দাঁড়িয়ে পড়ে কনস্টেবলের সঙ্গে গল্প করে? খৈনি চেয়ে খায়?
পৃথু মুখ বিকৃত করল বিরক্তিতে।
তারপর দৌলত সিংকে কাছে ডেকে বলল, বহতই মেহেরবানি আপলোগোঁকি। আপনাদের আমার আর দরকার নেই। আপনি থানায় গিয়ে আপনাদের সঠিক পরিচয় দিন।
দৌলত সিং নাগরা পরেই অ্যাটেনশানে কটাক করে দাঁড়িয়ে সেলাম ঠুকেছিল একটা। বলল, জী স্যার।
তারপর পৃথু বলল, এবার হুদা, তুমি ভাই ওঁদের একটু পৌঁছে দিয়ে এসো ওঁদের অ্যামবাসাডর গাড়ি অবধি। আমরা এগোচ্ছি। ঠুঠা, তুমিও কষ্ট করে একটু যাও হুদার সঙ্গে। কাজ আছে।
ঠুঠা অবাক হয়ে বলল, কাজ? কী কাজ?
ঠুঠাকে আলাদা করে ডেকে পৃথু বলল, ওদের নামিয়ে একবার থানাতেও নিজে গিয়ে দেখে আসছে মৌলভীর লাশ মর্গে পাঠাল কিনা এবং কখন পোস্ট-মর্টেম্ করে ছাড়বে বডি মান্দলা থেকে। মানে, কোন সময় মান্দলায় গেলে চলবে আমাদের। সঙ্গে বাড়ির বা পাড়ার কেউ কি গেছে? সাবীর সাহেব আর গিশিদাদাকেও বলে আসবে মান্দলার ভারটা নিতে। অনেক উপকারই করেছ মৌলভীর। আসল লোককেই চোখের সামনে দিয়ে গান গাইতে গাইতে চলে যেতে দিলে, এই শেষ উপকারটা একটু কোরো ঠুঠা।
পৃথুর হতাশার শেষ ছিল না। গলাটা ভাঙা মনে হল ভুচুর। দৌলত সিং ফিং সব আনজান লোকের উপর ভরসা ওর বিশেষ ছিলও না। কিন্তু ঠুঠার মতো জঙ্গলে পোকা, বাঘের মতো সাহসী, পাথরের দেওয়ালের মতো শক্ত মানুষও যে কী করে এমন ধোঁকা খেল ভাবলেই রাগ ধরছে ওর। “প্রীত, ভইল, মধুবনোঁয়া রামা, তোরা মোরা।” প্রীত ভইলই বটে!
হতাশার সত্যিই শেষ নেই। ভেবেছিল এই চাপা উত্তেজনা, নূরজেহানের বদলা, মৌলভীর বদলা সব একই সঙ্গে নেওয়া হবে আজ। আজই শেষ হবে এই ঘিনঘিনে, শিরা-দপ-দপ করা প্রতীক্ষার। ছিঃ ছিঃ। আবার কতদিন চলবে এর জের কে জানে। মগনলালই যদি পালিয়ে গেল, তবে…
আবার নতুন দল বানিয়ে ফিরে এসে সে হয়তো, ভুচু, ঠুঠা সকলকে শেষ করে দেবে একেক করে। ততদিনে ভুচুর বিয়ে হয়ে যাবে হয়তো। হুদাও হয়ত বিয়ে করবে। তখন…না আর ভাবতে পারছে না পৃথু।
আমরা চললাম। হুদা আর ঠুঠা ওদের নামিয়ে দিয়ে এসো।
ওরা বেরিয়ে যাবার মিনিট পনেরো পর পৃথুরা বেরুল।
ভুচুই চালাচ্ছিল। বলল, রাম আছে নাকি?
হ্যাঁ হ্যাঁ আছে।
বিরক্ত গলায় বলল পৃথু।
এই রাস্তা দিয়ে যেতে হলে জলের ট্যাংকির তলা দিয়ে যেতে হয় না?
হ্যাঁ। ভুচু বলল। সকালে বিকেলে মাছ নিয়ে বসে মাছওয়ালিরা। এই সামনেই তো জলের ট্যাংকি। এ জায়গাটাতেই দৌলত সিংদের অ্যাম্বাসাডরটা দাঁড়িয়ে থাকার কথা।
ওরা এতক্ষণে চলে গেছে। পৃথু বলল।
একটা জটলামত হয়েছে মানুষের, স্ত্রী, পুরুষ, শিশু। মাছওয়ালিরা কেউই নেই এখন।
কী হয়েছে?
ভুচু জীপ থামিয়ে শুধোল।
নইমুদ্দিন বলে ভুচুরই কারখানার এক হেল্পারের ভাই গিয়াসউদ্দিন বলল, বাবু কোতোয়ালীকা দারোগা মকবুল খাঁকো মার ডালিস।
কওন?
চমকে উঠে বলল ভুচু।
এক আহীর নে। দুধোয়াকি ক্যানোয়া সাইকেল মে লেকর গানহা গাতে গাতে আকর অচানক উহি দুধোয়াকো ক্যানোয়াইসে রিভলভার উঠাকে ধড়কা দিহিস। তিন্নো গোল্লী। একদ্দম ছাত্তিমে।
উসকো বাদ?
ঔর ক্যায়া? গোলি অন্দর, জান বাহার। সাথ্বে সাথ।
ও মাই গড!
ভুচু বলল।
উও ডাকু থা কওন!
কওন জানিস। কোঈ কহ্যা রহা হ্যায় কি ডাকু শের সিংহি খুদ থে। কোই কহ রহা হ্যায়, যো উওতো মর চুকে হ্যায়, উও আদমী জরুর খতরনাগ মগনলালই থে। কওন জানে সাচ বাত।
সকলে শোরগোল তুলল, খুদ দারোগা হি মর গয়ে, আভভি হোগা ক্যা?
জলের ট্যাঙ্কের পিলারের সঙ্গে একটা সাইকেল হেলান দেওয়ানো ছিল। অথচ, পৃথুর মনে হল না যে, ভিড়ের মধ্যেই কেউই সেই সাইকেলের মালিক। ও কিছু বলল না কাউকে। ভুচুকে আর শামীমকে ওই জটলার লোকের সঙ্গে গভীরভারে কথোপকথনে জড়িয়ে যেতে দেখে নিজেই জীপ থেকে নেমে পান-জর্দার দোকান থেকে পান আনতে গেল। দোকান থেকে ফেরার সময় ট্যাঙ্কির নীচে গিয়ে যেদিকে সাইকেলটা দাঁড় করানো আছে, সেদিকে গিয়ে পিক ফেলল।
ভুচু জীপটা নিয়ে ওদিকেই এগিয়ে এল। জীপটা সরতেই লোকগুলোও সরে এল জীপের দিকে। পরনিন্দা, খুন, জখম, বলাৎকার, স্ক্যান্ডাল—এসবের গন্ধ পেলে ভ্যাগাবণ্ড মানুষ আর খবরের কাগজের ব্যস্ত লোকেরা উৎসাহী হয়ে ওঠেন।
এক সময়ে পৃথু চট করে নেমে সাইকেলটা পরীক্ষা করে এল কাছ থেকে। হুবহু। মৌলভীর সাইকেল। এমনকি যে লালরঙা নাইলনের দড়ির টুকরোটি কোনও কাজে হঠাৎ লাগতে পারে ভেবে পেছনের কেরিয়ারে সবসময় মৌলভী বেঁধে রাখত; সেই দড়িটি পর্যন্ত আছে। দড়িটাতে হাত দিয়ে দেখল ভিজে। চাকার স্পোক, প্যাডল, রড—এসবেও হাত দিয়ে দেখল, জল চলকে পড়ে ভিজে আছে। লোকে তাকে দেখছে দেখে পৃথু বলল, অ্যায়সা হি একঠো সাইকেল থা হামরা। কুছ রোজ পহলে চোরি হো গ্যয়া থা। ইয়ে সাইকেল কিসকা হয়?
কেউই জবাব দিল না। বলতেও পারল না। একজন বলল, বাহারকা কোই আদমী মহল্লামে ঘুষসা হিঁয়েই ছোড়কে। ইভি তো দোবারা চোরিহি হো যায়গা।
ভুচু জীপ স্টার্ট করে বলল, জবলপুরসে হামলোগ জীপ চালাকে আ রহা হ্যায়। আজ টাউনমে ঈয়ে কা সব ঝামেলা মাচ ময়া, খতরাহি খতরা।
কে যেন জিজ্ঞেস করল, জবলপুর সে আপলোগ কওন কাম লে কর, গয়া থে?
কম্পানি কা কাম লে কর। ঔর ক্যা?
ইতোয়ারমে ভি কাম?
ইতোয়ার? ফুঃ।
বলে, হাসল পৃথু।
ভুচু বলল, ছুট্টি সিরিফ কেরানীকি ঔর মজদুরোঁকি কাম মে মিলতি হ্যায়, ম্যানেজারলোগোঁকো লিয়ে ছুট্টি-উট্টি কুচ্ছো নেহি।
পৃথু গলা নামিয়ে বাংলাতে বলল, অনেক হয়েছে। এবার চল ভুচু। কথায় কথা বাড়ছে। এর মধ্যে যে ওর লোক নেই জানছ কী করে? কাজও আছে।
ভুচু অ্যাকসিলারেটর দাবাল।
গারাজে পৌঁছবার একটু পরই ঠুঠাও জোরে জীপ চালিয়ে এসে উত্তেজিত হয়ে বলল, মৌলভীকে একেবারে জবাই করে মেরেছে পৃথুদা। গুলি করে নয়। আঃ কী বীভৎস! শকুনে সবই খেয়ে গেছে। ইঃ হিঃ তাকানোও যায় না। আর কী দুর্গন্ধ। কাল সকালে মান্দলা থেকে বডি দেবে পোস্টমর্টেম করে, তাও দশটা এগারোটা হবে। একটু আগে তো বডি বেরল। দারোগা, বডি রওয়ানা করিয়ে দিয়ে…
পৃথু বলল। মৌলভীও অবশ্য ওদের জবাই করেছিল। মৃত্যু মাত্রই দুঃখের।
কোতোয়ালির দারোগাকে, যে আহীরকে আমরা ছেড়ে দিলাম; সেইই মেরে দিয়ে গেছে জানো? কী ডেঞ্জারাস লোক মকবুল মিঞা! কোয়ার্টারে গেছিল চা খেতে, মৌলভীর ডেড-বডি রওয়ানা করিয়ে ক্লান্ত হয়ে। এমন সময় গোয়ালা এসে দরজায় সাইকেল নিয়ে ক্রিং ক্রিং ক্রিং করল।
দুধ লায়া। দুধ লায়া বলে।
দুধ, দারোগার গোয়ালা বিকেলে সময়মতোই দিয়ে গেছে। চাকর এই নতুন গোয়ালার খবর দিতেই বিরক্ত হয়ে মকবলু দারোগা নিজেই এগিয়ে এসে গালাগালি করছিল যখন গোয়ালাকে, তখনই দুধের পাত্রের ঢাকনা খুলে তার মধ্যে হাত ঢুকিয়েই রিভলবার বের করেছিল। বলেছিল, মুঝে নেহি না পাহচানলি রে?
বলেই, পর পর তিনটি গুলি। দুটি লাংসে। একটি হার্টে। গুলি করেই, সাইকেলে চড়ে ওই গানটিই গাইতে গাইতে অন্ধকার গলি ধরে হাওয়া।
কোন গান?
ওই যে। “প্রীত ভইল মধুবনোঁয়া রামা, তোরা মোরা।”
পৃথু একটা চেয়ারে বসে অন্য চেয়ারে পা দুটো তুলে দিয়ে নিজের মনে বল, ‘প্রীত ভইল মধুবনোঁয়া রামা, তোরা মোরা।’ দুশমন হো তো অ্যায়সা। টকরানেমে ভি মজা আ যাতা হ্যায়। ক্যা হুদা?
বিলকুল সাহী দাদা।
মগর, জান ভি বাঁচানো মুশকিল হোতা। কভভি কভভি।
ইয়ে ফাটকা তো জানহি না লেকর। নেহি তো, মজা কওন চিজ কা?
পৃথু বলল।
হুদা হাসল, বলল, জী হাঁ। কভভি কভভি।
তারপর পৃথু বলল, হুদা, তুমি শামীমকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসো। যাও শামীম, আজ ঘর যাকে নাহ-ধোকর ডাটকে খানা খাও।
ভুচু বলল, হাঁ দাদা, ডাটকে খাও ঔর মুতকে শো যাও।
অনেকক্ষণ পর হাসল ওরা তিনজনেই।
ওয়ারলেসটা নিয়ে বসেছিল ভুচু।
লালাসাহেব লাইনে আসতেই সব খবর দেওয়া হল।
মগনলালই পালিয়ে গেছে শুনে প্রচণ্ড ডিসঅ্যাপয়েন্টেড হলেন উনি। রেগে বললেন, দৌলত সিংদের সাসপেন্ড করব আমি। ওদের কি সাদিতে দাওয়াত খেতে পাঠিয়েছিলাম আমি? ছিঃ ছিঃ।
পৃথু মনে মনে বলল, ওদের রকম-সকম দেখে আমারও সেরকমই মনে হল।
ভৈরবীর কথাও বলল ভুচু।
তারপর পৃথুর সঙ্গেও কথা হল। কিছুক্ষণ।
সিক্স ডেড, ইনক্লুডিং ওয়ান ইয়াং লেডি। শি ওয়াজ টচার্ড ডে অ্যান্ড নাইট।
ইউ মীন, রেপড?
ইয়া। উইদাউট রেসপাইট।
দিস বাস্টার্ড অ্যাপিয়ারস টু বি আ সেক্স-ম্যানিয়াক।
লালসাহেব বললেন, ফিলজফিক্যালী।
পুলিশের অফিসারদের ফিলজফার না হয়ে উপায় নেই। সেন্টিমেন্ট, উত্তেজনা এসব মুছে না ফেললে ভাল অফিসার হওয়া যায় না। অথচ, পুলিশের উপরতলার বেশিরভাগ অফিসারই প্রথম জীবনে নম্র, লাজুক, অধ্যাপনাও করেছেন, প্রত্যেকেই অত্যন্ত মেধাবি ছাত্র। বেশিরভাগই খুব ভদ্রলোক। একেই বোধহয় বলে জব-হ্যাজার্ডস। ফিলজফার হয়ে যাওয়াটাও অন্যতম হ্যাজার্ড বলে মনে হয় পুলিশের উপরতলার অফিসারদের। বেচ্চারারা!
মকবুল খাঁ, ইয়োর লোক্যাল ওসি ইজ ওলসো…
ইয়া। আই নো, বাট হী ব্রট ইট হিমসেল্ফ অন হিম। সান অফ আ বিচ। আ ট্রেইটর টু ওল। আমি একজন সৎ লোক পাঠাব। কালই জয়েন করবে সে। কথা বলে নেব আই জি সাহেবের সঙ্গে।
পৃথু বলল, মোটেলালের পোস্টমর্টেমটা কোনওরকমে ওয়েভ করা যেত না?
না। ঘোষ সাহেব। দেখতেও খারাপ হত। আমার যা প্রধান চিন্তা তা হচ্ছে এইই যে মগনলাল এখনও হাটচান্দ্রাতেই আছে। ও আবার নতুন দল গড়ে নেবে, যদি একটু সময় পায়। দ্যাট ওয়ে হী ইজ আ উইজার্ড। তার আগে ওকে খতম না করতে পারলে আবার যেই কে সেই। শেয়ালেরই মতো ধূর্ত ও। তবে আমি মান্দলাতে বলে দিচ্ছি যত তাড়াতাড়ি পারে ওকে শেষ করে দেবে। দল তো আর নেই এখন। আরও একটা কথা। আপনারা কেউই, যারা নূরজেহানকে উদ্ধার করার সময় গেছিলেন, ছদ্মবেশ না নিয়ে কিন্তু মান্দলার মর্গ-এ অথবা হাটাচান্দ্রার কবরখানাতে যাবেন না। নো-ওয়ান। সাবধান। ছদ্মবেশও যেন ভাল হয়। বডি তো একেবারেই ডি-কমপোজড হয়ে গেছে। হাটচান্দ্রাতে কি ফিরিয়ে নিতে পারা যাবে? না মান্দলাতেই কবর দেবেন?
সে ওর আত্মীয়রা যা ঠিক করবেন।
আমিও কাল এসে পৌঁছব একজন বিড়ি পাতার ব্যবসাদার সেজে। হলুদ গরম জওহরকোট থাকবে গায়ে। ধুতি, দেহাতি খদ্দরের লালচে পাঞ্জাবি। মাথায় হলুদ গোল টুপি। কাঁধে সাদা আলোয়ান। চিনতে ভুল করবেন না আবার।
আজকের মতো আর কিছু কথা আছে?
না। রজার।
রজার। থ্যাঙ্ক উ ফর এভরিথিং মিস্টার ঘোষ।
আওয়ার গভর্নমেন্ট উইল বিমেম্বার উ্য ওল। এন্ড উইল ডু হোয়াট ইট ক্যান ফর মোটেলালস ফ্যামিলি এন্ড দ্যাট সাধু, হাজব্যান্ড অফ দা ডেড গার্ল। নূরজেহানের জন্যে সাইকিয়াট্রিস্টের বন্দোবস্ত করেছি। মিসেস রোহতাগী। উনি আগামী সপ্তাহে ভোপাল থেকে আসবেন শুধু ওরই জন্যে।
ওক্কে। রজার। নেভার স্ল্যাকেন দি এলার্ট। মগনলাল এলোন ইজ ইকুইভ্যালেন্ট টু মেনি। ডোন্ট আন্ডার-এস্টিমেট হিম। কাল আমার সঙ্গে অন্য আরও লোক আসবে। কালই আমরা ওকে ন্যাব করার চেষ্টা করব।
একটা কথা মিঃ লাল। পৃথু বলল। ওইরকম ঘটনা ও বিপর্যয়ের পর ডাকুরা সাধারণত কী করে? কোথায় যায়?
দে বুজ। মদ খেতে খেতে ভাবতে থাকে। অনেক সময় খারাপ পাড়ায় যায় নয়তো কোনও মেয়েকে ধরে, দরকার হলে গায়ের জোরেও। ওই সময়েই কপ্যুলেশনে ওদের মাথা নাকি সাফ করে দেয়। আমাদের ডিপার্টমেন্টের ডাক্তারদের কাছেই শুনেছি।
ওঃ। থ্যাঙ্ক উ্য। উই উইল গেট ইন টাচ এগেইন অ্যাট সিক্স ও ক্লক। শার্প।
ওক্কে। রজার।
হুদা শামীমকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে ফিরে আসতেই, পৃথু বলল, হুদা তুমি না থ্যাটার করতে? বহুরূপী সাজতে, মেলাতে? একসময় তো খুব নামডাক ছিল।
হ্যাঁ। কেন? হেসে বলল, হুদা।
আমাকে একটু দেঁহাতি করে দাও তো। ওই আহীরেরই মতো। পারবে?
হ্যাঁ।
তাড়াতাড়ি ঠুঠা বাইগার ধুতি শার্ট আর নাগরা পৃথুকে পরাল হুদা। তারপর চুলের কায়দা বদলে দিল। নাকের দুপাশে একটা ভুষোকালি মাখিয়ে দিয়ে নাকটাকে বাঁশির মতো করে দিল। ঠুঠার চাদরটাকে কারখানার ধুলোয় ফেলে ময়লা করে দিল। এদিকে ঠুঠা বাইগা পৃথুর জামা কাপড় পরে পৃথুকে ইন্সপেক্ট করে হাসিতে ফেটে পড়ল।
ওরা সকলেই রাম খাচ্ছিল। ভুচু মুগের ডালের খিচুড়ি আর আলুভাজা প্রায় করে এনেছে। খেয়েই বেরুতে হবে পৃথুর। এবার অবশ্য একাই। যদি তিথিনক্ষত্র সব ঠিক ঠাক থাকে, থাকে পৃথুর মৃতা মায়ের আশীর্বাদ, তবে ডাকু শের সিং-এর সঙ্গে ডাকু মগনলালের একটা টক্কর হয়তো আজ রাতেই হয়ে যাবে। হয়তো, আখরী টক্করই। কে বলতে পারে? হয় ইসপার, নয় উসপার।
ভুচু আর ঠুঠা বলল, একা যাবে কি? আর যাবেই বা কোথায়? খড়ের গাদায় ছুঁচ খুঁজতে?।
একাই। ভাল ভাল কাজ সব একা একাই করতে হয়। ভেবে দেখো। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই।
ভুচুর মুখে এক চিলতে হাসি এসেই মিলিয়ে গেল।
ঠুঠার মুখটা রাগে আর চিন্তায় কুৎসিত হয়ে উঠল। কিছু বলল না। পৃথু যে, ঠুঠার কাছে ছেলেরই মতো। ছেলেরই মতো কোলে কাঁখে করে মানুষ করেছে। অবাধ্য সাবালক ছেলের সামনে অসহায় বাবার মতো ও নিরুপায়ে ছটফট করতে লাগল। পৃথুকে একা যেতে দিতে ওর কিছুতেই মন সরছিল না। দুহাতা খিচুড়ি আরও এক চুমুক রাম খেয়ে দুটি পান মুখে ফেলে পৃথু বলল, কে কে দেবে ধার? আমার পাঁচশ টাকা চাই। কালই ফেরৎ পাবে।
ভুচুই দিল ঘরে গিয়ে, আলমারী খুলে।
সাইকেল নেই কারও?
না!
নাঃ। মুণ্ডা চাচার ছিল, সে তো নিয়ে ঘর চলে গেছে।
হুদা, আমাকে তোমার জীপ নিয়ে একটু এগিয়ে দিতে হবে।
কোনদিকে যাচ্ছ? পৃথুদা?
রাণ্ডী মহল্লায়।
কখন খবর করব? রাতেই? তোমাকে আনতে যাব না?
একেবারে সকালেই খবর কোরো। অবশ্য তার আগেই যদি নিজেই খবর হয়ে না যাই। হুদা, আমাকে জলের ট্যাংকির একটু দূরে নামিয়ে দিয়ে আমার বাড়িতে গিয়ে একটা খবর দিয়ে আসবে যে, আমি মৌলভীর মৃত্যুর কারণে রাতে ডেডবডির সঙ্গে মান্দলা চলে গেছি। কাল অফিস করে একেবারে রাতে বাড়ি ফিরব, ঠিক আছে।
ঠিক আছে।
হুদা বলল।
পিস্তলটা কোমরের ধুতির উপরের বেল্টে বেঁধে নিয়ে তার উপর জামাটাকে ফেলল।
ঠুঠাকে বলল, বাঃ। সাইজ তো একই। এর পর থেকে রোজই তোমার জামা কাপড় পরে বাবুয়ানি করা যাবে। ঠুঠার মেজাজ খারাপ। চুপ করে রইল। কথা বলল না।
চললাম। পানের পিক ফেলে পৃথু বলল। গুড নাইট।
হুদা বলল, চালিয়ে দাদা, ম্যায় ছোড়কর আ রহা হ্যায়।
ঠুঠা আর ভুচু কোনওই কথা বলল না।
পথেও কোনওই কথা হল না হুদার সঙ্গে।
চুপ করে ভাবছিল পৃথু।
হুদাও ভাবছিল।
হুদা ভাবছিল, দুসস শালা। সারাদিন গাড়ির বেঁকা মাডগার্ড পিটে পিটে সোজা করো, গরমে বর্ষায় শীতে তেলমবিল চিটচিটে তেরপল বিছিয়ে গাড়ির নীচে শুয়ে হাঁ করে করে রাজ্যের কালি-ময়লা খাও। হয়তো, ওয়েলডিং করো, নয়তো স্প্রে করো গাড়িতে রঙ। নাক জ্বালা করে। তার চেয়ে এইই ভাল। শালা রঙবাজি ভি আছে এই কাজে। অ্যাডভেঞ্চার আছে। হিম্মৎদারী ভি। ভাবছিল পৃথু দাদাকে বলে, পুলিশেই একটা চাকরি জুটিয়ে নেবে। যদি পায়। লাউটা, কুমড়োটা, ডিমটা, মুরগিটা, ব্যসস এইই। ঘুষঘাষ নেবে না হুদা। ঘুষ নিলে মাথা নিচু করে অন্য কারও পিছনে লাথ মারা যায় না ক্যাঁক করে। নিজের মেরুদণ্ডটা সোজা রাখাটা নিজের জন্যেই দরকার। বেঁকা হয়ে, মাথা ঝুঁকিয়ে বেঁচে থেকে শালার সুখ নেই কোনও!
এইখানে।
পৃথু বলল।
জায়গাটা অন্ধকার। জলের ট্যাংকিটা প্রায় এক ফার্লং মতো দূর হবে। শীতের রাত। রবিবার। তার উপর রাত এখন সাড়ে নটা—দশটা। একেবারে সুন-সান হয়ে গেছে এলাকা। মহল্লা এখান থেকে দূর আছে। আধ মাইল টাক।
হাত দিয়ে ইশারা করে হুদাকে চলে যেতে বলে, কোমরে একবার হাত ছুঁইয়ে তারাভরা আকাশের দিকে মুখ তুলে চেয়ে দাঁড়াল এক মুহূর্ত। তারপর এগোল পৃথু।
কাল কবর দিতে হবে মৌলভীকে। সাবীর মিঞার সেই শায়েরটা মনে পড়ে গেল পৃথুর। গুস্তাকি ম্যায় স্রিফ করেঙ্গা ইকবার, যব সব প্যায়দল চলেঙ্গে, ম্যায় কান্ধে পর, সওয়ার।
“জীবনে পাপ একবারই করব আমি। বন্ধুরা যখন সব হেঁটে হেঁটে যাবে আর আমি তাদের কাঁধের উপর জানাজাতে শুয়ে যাব।”
মুঠো মুঠো মাটি ছড়িয়ে দেবে কাল সকলে কবরের গহ্বরে শোয়ানো জানাজার উপরে।
পৃথু মরলে, টুসুরই মুখে আগুন দিতে হবে। অতটুকু ছেলে। হিন্দুদের নিয়ম কানুন বড় নিষ্ঠুর। কেমন মনে হবে? টুসুটার? রুষা হয়তো যেতে দেবে না। না দিলেই ভাল। একে শ্মশানের হাহাকার-ভরা পরিবেশ, কান্না-কাটি, শকুনশিশুর ওঁয়া-ওঁয়া, মানুষের সাদা হাড়গোড়, মাথার খুলি, তান্ত্রিক, কারণবারি, বে-সুরে গাওয়া ভজন। আর তারই মধ্যে অপাপবিদ্ধ এক শিশু, তার প্রিয় বাবার মুখে আগুন দিচ্ছে পাটকাটি দিয়ে। ভাবাও যায় না।
সান্ত্বনা এইটুকুই যে, পৃথু কারওরই প্রিয় নয়। কাউকেই দুঃখ দিতে হবে না বলে যাবার সময় এইটেই মস্ত বড় রিলিফ। ওকে নিজেকেও নয়, যারা থাকবে তাদেরও নয়।
ঠুঠা বাইগার নাল লাগানো নাগরার পায়ের শব্দে পৃথু চমকে চমকে উঠছিল। পোশাকে-আশাকে বদলে গেলে, নিজের পুরো অস্তিত্বটাই, চাল-চলন, মেজাজটাই যেন কেমন বদলে যায়। আশ্চর্য লাগছে যদিও পুরোপুরি এখনও ঠুঠা বাইগা হয়ে উঠতে পারেনি। নিজেকে মুছে ফেলে অন্য মানুষ হয়ে উঠতে সময় লাগেই। এই জন্যেই বোধহয় অনেক পুরুষ পোশাক-আশাক সম্বন্ধে এত মনোযোগী। নিজেরা যা নয়, পোশাকে তাইই হয়ে উঠতে চায়। কিন্তু সত্যিই কি তা হয়? যে মনে-প্রাণে ভিখারি, সে রাজার পোশাক পরলেই কি রাজা হয়ে যায়? যে ইতর, সে মহতের পোশাক বা মহত্তর মুখোস পরলেই কি তার ব্যক্তিত্ব বদলে ফেলতে পারে? নাঃ। বোধহয় সহজ নয় অত! ময়ূর-পুচ্ছ পরা কাকই ধরা পড়ে যায়, আর ওরা তো মানুষ!
পৃথু ভাবছিল, বেঁচে থাকার মধ্যে যদি তেমন জৌলুস নাইই থাকে, তবে মরণে জৌলুস একটু এলে তাও ভাল লাগবে। যারা পারে; তারা পারে। পৃথু তো তেমন করে বাঁচতে পারল না।
“আগো চারো তরফ দহকতি হ্যায়,
জীনা ইস বীচ কিতনা মুশকিল হ্যায়—
ফিরভী জাঁবাজ খেল লেতে হ্যাঁয়
উনকো আসান হরেক মঞ্জিল হ্যায়।”
তেমন জাবাঁজের মতো বাঁচা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কোনওদিনও সম্ভব হয়নি। এখন মরণে যদি জাবাঁজ হতে পারে। একটা বড় কিছু, ভাল কিছু করতে গিয়ে, গর্বের, বৈশিষ্ট্যর মৃত্যু আর কীইই বা আছে?
জলের ট্যাঙ্কির কাছে এসে পৌঁছল। ডানদিকে মোড় ঘুরবার আগেই দেখল মৌলভীর সাইকেলটা তখনও ওইভাবেই থামে হেলান দেওয়ানোই আছে। মগনলাল এই মহল্লার কোনও বাড়িতেই এখনও আছে নিশ্চয়ই। তার মুখ তো বটেই, তার ফিগার আর দাঁড়ানোর কায়দা বসার কায়দা সব মুখস্ত আছে পৃথুর ছবি দেখে দেখে। একবার দেখতে পেলেই চিনতে পারবে পৃথু।
রবিবার বলে, মহল্লা অপেক্ষাকৃত চুপ-চাপ। দু একটি বাড়ি থেকে শুধু গান-বাজনা আর নূপুরের আওয়াজ ভেসে আসছে। শুধুই বাজনা বাজছে শোবার ঘরে, হয়তো কোথাও কোথাও। সে বাজনা, শোনার নয়। অনুমানের, অনুভবের।
কোন বাড়িতে যাবে আন্দাজে? ভাবল, গলির পানের দোকানের পাশের চবুতরাতে বসে থাকে। চুপচাপ চারদিকে নজর রাখতে পারবে তাহলে। গলির মধ্যে যখন ঢুকল পৃথু তখন একটা বাচ্চা ছেলে, নোংরা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা; ফুলওয়ালা টুলওয়ালা হবে; চটি ফটফট করে দৌড়ে উল্টোদিক থেকে এসে পৃথুকে পেরিয়ে চলে গেল। তার পেছনে পেছনে কালোরঙা একটা লেজকাটা দিশি কুকুরীও। এই কুকুরীটাকে পৃথু চেনে। বিজলীর বাড়ির এক তলার বারান্দায় শুয়ে ছিল সেদিন। এরই বাচ্চাটা নর্দমায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল সকালে।
বিজলীর বাড়ির কাছাকাছি এসে পৌঁছতেই সেই ছেলেটি ক্রিং ক্রিং করে সাইকেলের ঘন্টা বাজিয়ে মৌলভীর সাইকেলটাই চালিয়ে নিয়ে গিয়ে বিজলীর বাড়ির সামনেই থামল। প্যাডেলে ওর পা পৌঁছচ্ছিল না। তাই সীটেও বসেনি। মধ্যের রডটার ভেতরে ব্যাঙের মতো বসে চালিয়ে এল।
বিজলীর শোবার ঘর থেকে গান ভেসে আসছিল। বসবার ঘর থেকে নয়। এবং খালি গলার গান। তার মানে, ঘরে লোক আছে।
গায়ের লোমগুলো সব সোজা হয়ে উঠল এক মুহূর্ত। শরীরের সব পেশী টানটান। তারপরই রোম শুয়ে পড়ল, ঢিলে হয়ে গেল শরীর। ফিরে এল স্বাভাবিকতায়।
বাচ্চা ছেলেটা দরজা খুলে সাইকেলটা বিজলীর কোঠারই একতলার ছোট্ট পাথরের ঘরে ঢুকিয়ে রাখল। পৃথুও ওর পেছনে পেছনে ঢুকল ঘরে। পেছনের চাকাটা কিরকির শব্দ করে ঘুরছিল তখনও।
পৃথু বলল, সাইকেলটা একটু দেবে?
ছেলেটা হাসল। নিস্পাপ হাসি। যদিও অন্যে বলবে, পাপের মধ্যেই তার বাস।
বলল, আমার নয়। বাঈয়ের কাছে শেঠ এসেছে, তার।
ফুঃ। শেঠরা কি সাইকেল চড়ে আসি নাকি? গাড়িতে আসবে তো! পৃথু বলল।
দুস্স্ কত গাড়িয়ালা শেঠ দেখি; ওই গাড়িই আছে শুধু। বটের পাখির মতো ছোট ছোট দিল। আর এই সব শেঠ হচ্ছে অস্লি শেঠ। একশ টাকার কম বকশিশই দেয় না কাউকে। আস্লি রহিস্।
তাইই?
পৃথু বলল।
এই শেঠ কি রোজই আসে নাকি বিজ্লী বাঈয়ের কাছে?
রোজ? না তো! ছেলেটি অবাক হয়ে বলল। একে দেখিনি কখনও আগে। শেঠ জবরদস্ত মগর বহতই পিয়ে হুয়ে হ্যায়।
তাতে কি? ম্যায়ভি তো পীয়ে হুয়ে হ্যায়। পীনেসেই ক্যা আদমী খারাব হোতা।
খরাব? কাহে? পরন্তু আচ্ছা হোতা। কিঁউ? আপ পিয়ে হুয়ে হ্যায় তো আপভি মুঝকো শ রূপাইয়া দিজিয়েনাগা বকশিশ? ক্যা খুশনসীবী আজ হামারা।
পৃথু ভাবল, সামান্য মত্ত অবস্থায়; এইই দোষ! বাঈজী বাড়িতে, চাকর দারোয়ান, কুকুর, বাঁদর, সব শালাই বোধহয় ডাকু আর চোর। পকেট কাটবার জন্যে কাঁচি এগিয়েই বসে আছে। না দিলে গলায় ছুরিও বসিয়ে দেবে হয় তো। এ সব জায়গা পৃথুর জন্যে নয়।
ও বলল, দেগা। জরুর দেগা। অন্দর তো যানে দেও পহিলে। বাঈকো পাস। তারপর বলল, কমলা বহীন কাঁহা?
বাঈকী পাস? বোলা না, ঘরমে মেহমান আয়ে হুয়ে।
কমলা বহীন? ছেলেটি হতবাক হয়ে তাকিয়ে।
বোঝা গেল এ নতুন। কমলা বহীনকে দেখেইনি।
সারেঙ্গীওয়ালা হ্যায় ক্যা কি? ক্যা থা ইনহিকা নাম? বিলকুল ভুল গ্যয়ে।
ইমরান খাঁ। উওভি তো শো গ্যয়া হোগা। কাম নেহী তো করনা ক্যা?
জারা বোলাকে লাও তো সাহী।
বকশিশ?
দুংগা। বে-ফিক্কর রহো।
লাল-সবুজ চেক-চেক মাফলার গলায় জড়িয়ে কুর্তা পাজামা আর জওহর কোট পরেই বেচারা সারেঙ্গীওয়ালা ঘুমিয়ে কাদা হয়ে ছিল। যার দু হাতে আটটি আংটি। বুক পকেটে তিনটি ফাউন্টেনপেন। উপরের পাটির দুটি দাঁত সোনার। হাতে সোনার জল করা ঘড়ি। পাঞ্জাবির চুড়িদার হাতার প্রান্ত থেকে মুখ বের করে সে ঘড়ি দুনিয়া দেখছে। তাছাড়া, বোতামওয়ালা গুণী ব্যক্তির হাত যে ঘড়িহীন নয়; তা সকলেই যেন বিনা-মেহনতেই দেখতে পায় সেই উদ্দেশ্যও আছে।
এই সাংঘাতিক সময়েও পৃথুর চোখ এতসব খুঁটিনাটি লক্ষ করল দেখে ও নিজেই অবাক হল। ইমরান খাঁ পৃথুকে দেখে প্রথমে চিনতেই পারল না। পৃথুও অবাক হল। মনে হল, লোকটাকে চেনে না। তারপরই মনে পড়ল যে, সে নিজেও তো আর পৃথু নেই, হুদার দৌলতে ঠুঠা বাইগাই হয়ে গেছে। ইমরান-এর দোষ কী?
পৃথু বলল, নেহী না পহচানা মুঝে ইমরান। ম্যায় ঘোষ সাব। পিরথু ঘোষ।
ইমরান সঙ্গে সঙ্গে আদাব করল। সালাম আইলেকুম। পৃথু বলল, আইলেকুম সালাম।
বলল, বৈঠিয়ে বৈঠিয়ে। বড়ী ঠাণ্ডা আজ বাহার মে। অন্দর আইয়ে না, অঙ্গোঠা রাখখা হ্যায়। হামারা কামরামে চলিয়ে।
ওর ঘরে গিয়ে লোহার মালসার মধ্যে কাঠকয়লার আগুনের পাশে বসল পৃথু।
ইমরান এদিক ওদিক চেয়ে বলল, বাঈয়ের ঘরে একজন লোক এসেছে, সত্যি কথা বলতে কি বাবু, লোকটাকে আমার একটুও পছন্দ হয়নি। এখানে কি আর সন্ত-সাধুজীরা সবসময় আসেন, তা নয়, তবে এ লোকটা অন্যরকম। সে গান শুনল না, আমাদের সবাইকে বের করে দিল অসভ্যর মতো ঘর থেকে। কোনও তারিকা জানে না। বিজ্লী এরকম বে-এতলাখ বে-তমদ্দুনের মেহমান নেয় না কখনও কিন্তু লোকটা প্রথমেই হাজার টাকা গুণে দিল বিজ্লীকে। আমাদেরও বলল, খুশ করে দেবে পরে, গান না শুনেই। বিজ্লী ওকে নিয়ে ঘরে গেল। টাকা এমনই জিনিস যে এর চেয়ে বড় পুলিশ, এর চেয়ে বড় উকিল, সওয়াল এর চেয়ে বড় বিচার আর কিছুই নেই। টাকা দিলে বেহেস্তেরও টিকিট পাওয়া যায়, দোজখের মুখও ঢাকা যায়, আর বিজ্লীবাঈ তো সামান্য বাঈজীই একজন।
ভেতরে একটু আগে পর্যন্ত গান শুনছিলাম। বিজ্লীর খালি গলার, নিচু স্বরের গান। কিন্তু এখন তো আর কোনও সাড়া শব্দই নেই। কী হল কে জানে? এমন আনজান মেহমান নেওয়াটা ঠিক নয়। ঘরে ঢুকেছে তো সন্ধে লাগার কিছু পরই।
আমার কথা একটু বলবে বিজ্লীকে?
পৃথু বলল।
বলব? লোকটা যদি গোলমাল করে? ডাকু-ফাকুও হতে পারে। আজকের খবর শুনেছেন তো?
ইমরান দ্বিধাগ্রস্ত গলাতে বলল।
হুঁ।
পৃথু বলল।
বলেই বলল, এই সাইকেলটা কার? ইমরান?
আমি তো জানি না।
ছোট্ট ছেলেটা কলকল করে বলল, শেঠ-এর সাইকেল। আবার কার? শেঠ উপরে আমাকে ডেকে পাঠিয়ে বলল পানি-ট্যাংকির নীচে আমার সাইকিলটা দাঁড় করানো আছে, গিয়ে নিয়ে আসতে। হ্যান্ডেলে লালনীল প্লাস্টিকের ফিতে ভি আছে বললেন।
আমাকে একশ টাকাও দিলেন।
কখন বলেছে?
একটু আগেই।
তুমি গিয়ে বলেছ শেঠকে যে, সাইকেলটাকে নিয়ে এসেছ?
না।
যদি রাগ করে শেঠ না বলে?
পৃথু বলল।
চিন্তা করে ছেলেটা বলল, হ্যাঁ তা করতেও পারে।
তবে, তুমি শেঠকে ইজ্জৎ দিয়ে আপ আপ করে কথা বোলো, যে লোক একশ টাকা বকশিশ দেয় তাকে আপনিই বলা উচিত।
যাইই হোক, রাগ যদি করে? গিয়ে বলই তুমি।
আচ্ছা! ছেলেটা বলল।
পৃথু ভাবছিল, মৌলভীর মৃত্যু এবং ওদের দলের এত জনের মৃত্যুর জন্যেই কি এই সাইকেলকেই বাহন করল মগনলাল? লোকের চোখে ধুলো দেবার জন্যে? জীপটা হয়তো কোনও গোপন জায়গাতে লুকিয়ে রেখেছে।
ছেলেটি ওপরে উঠতেই পৃথু একটি একশা টাকার নোট ইমরানের হাতে দিয়ে বলল, আপভি যাইয়ে ভাইসাব উসকো সাথ। বিজ্লীকে গিয়ে আমার কথা একবার বলুন। বলুন, আমি পথের ভিখিরি হয়ে গেছি, তাই ধার শোধ করতে এসেছি। আজ রাতেই শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে। দেখা হবে না আর এ জন্মের মতো আমার সঙ্গে। একমুহূর্ত দেখা করলেই হবে। কিছু কথা আছে। দরজা ফাঁক করে কথা বললেই চলবে।
ইমরান চিন্তিত মুখে উপরে উঠল। বিড়বিড় করে বলল, ইয়ে আদমী হামারা ঠিক নহী লাগ রহা হ্যায় হুজৌর। ঢাণ্ডুকে বোলা লেনা চাইয়ে।
ঢাণ্ডু কওন?
অবাক হয়ে শুধোল পৃথু।
ইস মহল্লেকে গুণ্ডা। বাঈলোগীনকে পরটেকশান, উনোনেই না দেঁতে হেঁ।
রহতা কাঁহা?
এহিত। মোড়হি পর। নজদিকোয়ামে।
উনকা সাথমে রাখনাই জরুরী হ্যায়। ম্যায় গ্যয়া ঔর আয়া সিরিফ ইক সিকেন্ড।
বলেই, ইমরান চলে গেল। তার ঘোর সবুজ রঙা র্যাপার আর কাশ্মীরী ভেড়ার লোমের টুপি চড়িয়ে। এই লোকগুলোর কোনও ফীজিক্যাল একসারসাইজ নেই বলেই বোধহয় এত ঠাণ্ডা লাগে।
ঢাণ্ডুকে ডাকতে গেল। ঠিক সময়মত যত ফ্যাচাং। রাগ হচ্ছিল পৃথুর আর ভিতরে ভিতরে বাড়ছিল উত্তেজনা। আজ মগনলালের একদিন কি ওরই একদিন! আখরি দিন আজ। আখরি ওয়াক্ত এসে গেছে এখন। আর তর সয় না।
এই ঢাণ্ডু আবার কী নিকলোবে তা ঈশ্বরই জানেন। ভাষাটাষা নিয়ে ভাবার সময় নেই এখন আর। যে মানসিক এবং শারীরিক স্তরে সে নিজেকে নামিয়ে এনেছে, খুনখারাপি, মেয়ে-খুনের সাক্ষী, বাঈবাড়ি—তাতে তার ভাষাও নেমে এসেছে সেই স্তরে অনবধানে। নেমে আসা তো সবসময়ই সোজা। ওঠাই, কঠিন বড়।
পৃথু কোমরের পিস্তলের হোলস্টারের বোতাম খুলে ফেলল। বাঁ হাত দিয়ে রাম এর পাঁইটটা বের করে খেল ঢকঢক করে। শীত ওর লাগছে না। ভিতরের ভয়-মিশ্রিত উত্তেজনাটা প্রশমিত হল একটু।
পৃথুর বাবা বলতেন, জীবনের যে-কোনও ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতাতে একবার নেমে পড়লে নিজের আলাদা সত্তা, স্বকীয়তা একেবারেই মুছে দেবে।
প্রতিযোগিতা জীবনের সব ক্ষেত্রেই। দিনের প্রতি সময়েই। যে-যোদ্ধার সঙ্গে লড়বে যখন, ঠিক তারই মতো, তারই সমতলে, উচ্চতায় বা নিম্নতায় উঠে গিয়ে বা নেমে এসেই লড়বে।
বাবার কথা মনে এল। পৃথুর। বাবার মুখটি। নেমে তো এসেছেই। মগনলালের মোকাবিলা করতে গিয়ে নিজেও তো মগনলালেরই শ্রেণীভুক্ত হয়েছে। আর কত নীচে নামবে? কোনটা যে ওঠা আর কোনটা নামা তা বুঝতেও গোলামাল হয়ে যায়।
ঢাণ্ডু এল। ওর চেহারাটা দেখে চেনা চেনা মনে হল পৃথুর। পরনে লালরঙা ট্রাউজার, উপরে নীল রঙা ফুল-হাতা সোয়েটার। টাক-মাথা কিন্তু টুপি বা মাফলার কিছু নেই। লোকটার বোধহয় শীত খুব কম। অথচ কোথায় যে দেখেছে, তা মনে করতে পারল না। হয়তো কারখানার গোলমালের সময় দেখে থাকবে। তখন কিছু গুণ্ডারা ঘোরাফেরা করত। ঢাণ্ডু, পৃথুর চেহারা দেখে, থুড়ি, ঠুঠার—নিশ্চয়ই চিনতে পারল না, ইমরানের কাছে নাম শুনে কিন্তু সেলাম করল ‘সেলাম ঘোষ সাহাব’ বলে।
ঢাণ্ডু ভাবল, পাছে বাঈ মহল্লায় লোকে চিনে ফেলে তাইই এই ভেক। পড়ে-লিখে, বড়া খানদানের মানুষ মাত্রই তো ভণ্ড হচ্ছে কিনা। তবে এখানে এসে নিজের নামও তো কেউ বলে না। সাধারণত শত্রুর নাম বলে। এ মানুষটা নিজের নামই বলছে সকলকে, পরিচয়ও। অজীব আদমী।
ছাবুক যা খুশি, ভাবুক। মনে মনে বলল পৃথু। মগনলালকে চাই শুধু।
ঢাণ্ডু একদৃষ্টে পৃথুর চোখে চেয়ে ছিল।
পৃথু বলল, চলো। সঙ্গে যন্ত্র আছে ঢাণ্ডু?
কী যন্ত্র হুজৌর? চাকু আছে আমার। বলেই, লাল ট্রাউজারে কোমরের কাছে দেখাল ডান হাতে দিয়ে। সিঁড়ি উঠতে উঠতে বলল, এতেই মাখমের তালের মতো মুণ্ড নেমে যাবে।
ওতে হবে না ঢাণ্ডু। এ যদি সেই লোক হয়, তবে সাবধান। এ সাংঘাতিক লোক।
কে লোক?
জানি না। যদি সে হয়, তবে।
অন্য যন্ত্র যে এখন নেই। কোন লোক এ? যেই হোক, আগে ঢাণ্ডুর সঙ্গে খালি হাতেই টকরে দেখুক।
ঠিকই আছে। কিন্তু তুমি বরং এগোবে না। আমাকেই এগিয়ে দেবে। পরে আমার সাহায্যের দরকার হলে আমাকে কোরো সাহায্য, বারণ করব না।
লোকটাকে আপনি চেনেন না কি?
সেইই যদি হয়, তবে ফয়সালা আছে তার সঙ্গে আমার।
বিড়বিড় করে বলল পৃথু।
পৃথুর দিকে একঝলক অবাক চোখে চেয়ে, সরু সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দরজায় পৌঁছেই ঢাণ্ডু চেঁচিয়ে উঠল, আব্বে শালা! খোল দরওয়াজা।
চুপ। চুপ। আমি আগে। তোমাকে জানেই মেরে দেবে আগে গেলে।
চাপা গলায় পৃথু বলল।
ঢাণ্ডু অপমানিত হয়ে বলল, বাঙালি বাবু, জানকা পরোয়া ম্যায় নেহি করতা। জান তো জানেকা লিয়েই হ্যায়।
ছোট ছেলেটাও দরজায় ঠুকঠুক করছিল।
পৃথু ভাবছিল, বাঙালিদের এরা ভাবেটা কী! সাহেবদের তাড়াবার সময় কারা ছিল পুরোভাগে? বীণা দাস, ক্ষুদিরাম, বিনয়-বাদল-দিনেশ? আর সাম্প্রতিক অতীতে ঠিক করুক কি ভুল করুক; মেধাবি সব নকশাল ছেলেগুলো? তারা কি ভীতু ছিল?
জীবনের ভয় বাঙালি করে না।
তবে এও ঠিক যে, বেশিরভাগ সুখী-সুখী, সখী-সখী বাঙালিই অন্যরকম। তাদের দেখেই এইরকম ধারণা করে এরা সবাই। কজন বাঙালি দেখেছে এরা? কিন্তু বাঙালির হয়ে লড়েই বা কি হবে? কলকাতার বাঙালিরা তো পৃথুদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে কিছুমাত্রও খোঁজ রাখে না। কস্তুরী মৃগরই মত নিজেদের গন্ধেই নিজেরা মশগুল।
ভিতর থেকে কোনওই আওয়াজ নেই। মুজরা যেখানে করে, সেই ফরাস-পাতা ঘর পেরিয়েই শোবার ঘর। হয়তো শোবার ঘরের দরজাও বন্ধ। নিঃশ্বাসের শব্দও নেই।
এবারে খুব জোরে জোরে ধাক্কাল দরজা। ইমরান খাঁ। ভিতর থেকে জড়ানো গলার আওয়াজ এল, কওন? সাইকিল লেকর আয়্যা শেঠ।
ছোট ছেলেটা চিকন গলাতে বলল।
কওন চি?
সাইকিল। আপকা সাইকিল।
তঙ্ক মত করো হারামিকো বাচ্চে। রাখখো নিচামে। বিস্তারামে সাইকিল লে কর ক্যা করনা মুঝে? বুরবক কাঁহাকা।
এবার ইমরান গলা তুলে বলল, বাঈ, বাঈ। বিজ্লী বাঈ!
গোঙানির মতো একটা উত্তর এল ভিতর থেকে। বোঝা গেল, বিজ্লী কথা বলতে পারছে না। কিন্তু কেন?
ক্যা হুয়া? চিন্তিত মুখে বলল ইমরান। অ্যায়সি তো কভভি নেহি হুয়ি। ইতনা দিনো সে দেখ রহা হ্যায় বাঈকো।
ঢাণ্ডু বোধহয় সন্ধে থেকেই মহুয়া টেনে ছিল। কোমরের বেল্টটা টাইট করে বেঁধে নিয়ে বলল, দরওয়াজা খোওল বে শেঠকা বাচ্চে।
কওন বে? তেরী জবান জারা মিঠঠি করনা।
ভিতর থেকে বলল মৌলভীর সাইকেল আর জানহাপিস করা লোকটা।
এবার শব্দ শুনে মনে হল লোকটা এগিয়ে আসছে ঘরের ভিতর থেকে দরজার দিকে।
কাছে এসেই বলল, কওন হ্যায় তু বাহেনচোদ?
ম্যায় ঢাণ্ডু। ইস মহল্লেকে জিম্মাদার। বাঈকি আওয়াজ কাহে না মিলতি হ্যায়? তুম শালে কওন হ্যায়? রঙবাজী দিখানে আয়া হিঁয়া?
তেরি বাঈ বহতই পি লিয়া বাচ্চে। আওয়াজ বিলকুল বন্ধ। আওয়াজসে হামারা নফরত হ্যায়। সবতরিকা আওয়াজসে। সমঝা না ঢাণ্ডু? গাণ্ডু!
ঢাণ্ডু, ইমরান এবং পৃথুও জোরে জোরে দরজায় কিল ও লাথি মারল এবার একসঙ্গে।
লোকটা মত্ত হয়ে আছে। স্বগতোক্তির মতো কথা বলছে।
ঢাণ্ডু বলল, অব দরওয়াজা খোল। হারামজাদা। নহি তো পোলিস লাউঙ্গা।
ফুচ। পোলিস? দারোগা মকবুল খাঁ তো জানাজা মে হি চড়েগা কুছ দের বাদ। পোলিস কওন চিকি? ইয়ে জাগেমে পুলিস হ্যায় থোড়ি! ডরপোক লোগোঁকা জাগে হ্যায় তোরা ঈ হাটচান্দোয়া।
জাদা বকোয়াস মত কর। দরওয়াজা খুলা ছোড়। নহি তো…
ভিতর থেকে সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ এল। নেহী ত? নেহী তো ক্যা? জবান সামহালকে বাঁতে করনা।
ঢাণ্ডুও তেতে বলল, দিখোগে মেরী জবান? দরওয়াজা খোল, জবান দিখলাতা ম্যায়। শিখলাতা তুঝে।
বলতেই, ভিতরের খিল দড়াম করে খুলেই, এক ঝটকাতে দরজা হাঁ হয়ে গেল। কিন্তু দরজার সামনেই কেউই নেই। খোলা দরজার সামনে এল না সে নিজে। বহতই হোঁশিয়ার।
ঢাণ্ডু ভিতরে না ঢুকে বলল, বাঈকে লে কর আও হিঁয়া। উনকি তবিয়ত ঠিক্কে হ্যায় কি দিখনা হ্যায় হামলোগোঁকো।
ঘরের মধ্যের প্রায়ান্ধকারের মধ্যের অদৃশ্য কোনও জায়গা থেকে হেসে উঠল মগনলাল। হঠাৎ এঘরের বাতিটাও নিবিয়ে দিল। ভিতরের ঘরের ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে আলো আসছিল একটু। মগনলাল বলল, হাজার রূপাইয়া লিয়া রাতভরকে মৌজকে লিয়ে। মেরি রূপাইয়া ক্যা মেহনতসে নেহি কামাতা? ইয়ে ক্যা হারামকা পইসা মিলা? হাজার রূপাইয়া কোঈ ছোটিসি বাত হুয়া? পরন্তু ম্যায় উনকি ক্যায়সি লাউঁ! উনোনে তো পড়ি হুয়ি হ্যায়, পীকে বে-হোঁস, জওয়ানিসে বে-হোঁস ঔর পেয়ারসে ভি বে-হোঁস। আও। দিখকে যাও। বিজ্লী বাঈকি ভাই। মেরী শালে!
বলেই, জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, মস্ত কর দো সাকী
মগর এক শর্তপর, হোঁস ইতনা রহে কি তুঝে ইয়াদ রহে।
ছোট ছেলেটিকে ঠেলে পাঠাল ঢাণ্ডু ঘরের মধ্যে।
অ্যায়! তুম কিঁউ হায়ে অন্দর? বলেই, এক বিরাট ধমক লাগাল ভিতরের নেশাগ্রস্ত মগনলাল।
ছেলেটা বলল, সাইকিল। সাইকিল।
সাইকিল ম্যায় কাঁহা ঘুষায়গা?
বলেই, ছেলেটি আলো-আঁধারিতে মোড়া তার চেহারা এবং মূর্তি দেখে ভয় পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল।
ডাকু মগনলাল, খুব সম্ভব ঘরের ডানদিকে ফরাসের উপর বসে ছিল। মনে হয়, একেবারে তৈরি হয়েই; যে-কোনও পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্যে। তাকে খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল না। এমন ‘হাঁ’-করা দরজা দিয়ে আত্মহত্যার জন্যে ঢোকার তাড়াও ছিল না পৃথুর।
ইমরান এবার ঢুকে পড়ে সেলাম করল মগনলালকে। বলল, শেঠ! অন্ধকারে একটি তাকিয়া সামনে নিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে ফরাসে বসে আছে মগনলাল। দেওয়ালের আয়নায় তাকে এবার দেখা যাচ্ছে। পৃথু দেখতে পাচ্ছে। ইমরান বলল, বাঈকি এক রিস্তেদার আয়া, উনকি মিলনেকি লিয়ে। আজই টাউন ছোড় কর চল দেগা উনোনে। জারাসে মিল লেঁতে থেঁ… পাঁচ মিনট কে লিয়ে।
কামওক্ত কাঁহাকা। রাতভরকে কড়ারমে রূপেয়া দেনেকা বাদ তুমলোগ রিস্তেদারি দিখা রাখা হ্যায় হিঁয়া? আজীব বাতেঁ কর রহ্যা হ্যায় ইয়ার। ফিন আওরত চু মারাকে খাতি, ইনকি রিস্তেদারি স্রিফ একই চিজোঁসে হোতি। জানতে তু? কোনসি চিজ হোতি উ?
বলেই, ফুক করে হাসল নিজেই। পরক্ষণেই গলা তুলে হুঙ্কার ছেড়ে বলল, ভাগো হারামজাদে। তঙ্ক মত করো মুঝকো। কাল সুব্বে সবকো বকশিশ দুঙ্গা। বাইকো রিস্তেদার কো ভি। কওন হ্যায় উও? মর্দানা ইয়া জেনানা? জেনানা হোগী তো অন্দর ভেজো। উনকি তবিয়তকিভি খুশ কর দুঙ্গা ম্যায়। ক্যেয়া নেহি তো দরওয়াজা বন্ধ। বন্ধ।
আর সময় নেই। ঢাণ্ডুকে এক ধাক্কা দিয়ে পাশে সরিয়েই, ইমরানকে পাশ কাটিয়ে পৃথু এক দৌড়ে মগনলালকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই বিজ্লীর ঘরের দিকে বিজ্লী বিজ্লী বলে ডাকতে ডাকতে চলে গেল।
কওন হ্যায় ইয়ে বদতমিজ আদমি? কিসকি ইতনা হিম্মত পড়ে যো…
কী যেন করেছে মগনলাল বিজ্লীকে। বিজ্লীর মুখে ফেনা। সারা শরীরে, এই শীতের রাতেও ঘাম। খুবই অত্যাচার করেছে কি? দেরি হলে হয়তো জবাইও করে যেত। এই রাতেরই প্রথম প্রহরে ভৈরবীকে করেছে জবাই।
জলদি আও ইমরান। ঢাণ্ডু ভাই।
ডাকল, পৃথু।
বলতেই ওরা দৌড়ে ঘরে এল। মগনলাল খুবই খেয়েছিল। নইলে এতক্ষণে সে দু’চারজনকে মেরে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করত। নেশা কিছু বিজ্লীরও ছিল। কিন্তু অসুস্থতা নেশাজনিত নয়।
পৃথু বলল, আভভি হসপিটাল লে চালো। কুছ খরাবি কর দিয়া ইয়ে আদমি। বিজ্লীর শরীরের পাশ থেকে একটা চকচকে বড় ছুরিও পাওয়া গেল। ঈসস! বিজ্লীকেও কি ভোগ শেষ করে জবাই করত ও? ঈসস… ঈসস…
চকিতে পৃথু সেটা পাঞ্জাবির পকেটে ভরে নিল। মেঝেতে পড়ে থাকা শাড়ি জামা দিয়ে জড়িয়ে নিল ওরা বিজ্লীকে। বিজ্লীকেই দেখবে না, না ওই লোকটাকে শিক্ষা দেবে তা ঢাণ্ডূ ঠিক করতে পারছিল না। হতচকিত হয়েছিল। হতচকিত মগনলালও এঘরে এল। সামান্য টলছিল পা দুটো। চোখদুটো ফোলা। শুধুই পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে ছিল। নীচে ছিল না কিছুই। অনাবৃত রোমশ সুগঠিত দুটি পা দেখা যাচ্ছিল। সুপুরুষের পা দুটিই বোধহয় সবচেয়ে সুদৃশ্য অঙ্গ। ইতিমধ্যে একটা শাড়িতে ভাল করে জড়িয়ে…মুড়ে ওরা সকলে বিজ্লীকে নামিয়ে নিয়ে গেছে সিঁড়ি দিয়ে। চেঁচামেচিতে নীচে লোকজনও জুটে গেছে। একটা জীপগাড়ির শব্দও শোনা গেল গলিতে। জীপের শব্দ কানে যেতেই, কান খাড়া করে, তীক্ষ্ণ, রুষ্ট চোখে পৃথুর দিকে তাকাল মগনলাল। ডাকু মগনলাল।
জীপের আওয়াজটা মিলিয়ে গেল। কার জীপ কে জানে! কয়েকটি জুতো-পরা পায়ের দ্রুত শব্দ শোনা গেল সিঁড়িতে ওঠার।
মগনলাল হঠাৎই দৌড়ে গেল পাশের ঘরের দরজাটা বন্ধ করতে। সেই অবকাশে পৃথু পিস্তলটা বের করে, কক করে বিজ্লীর খাটের এক কোণায় বসে; কোলের উপর একটা বালিশ টেনে ঢাকল ওটাকে।
করুক দরজা বন্ধ। যা হবার হোক দুজনেরই মধ্যে। এইই ভাল। অন্যদের এ মামলাতে ফাঁসিয়ে লাভ নেই। ইসপার নহী তো উসপার। শুধু একটা জিনিস ভুল না হয়ে যায়। লোকটা মগনলালই তো। অন্য কেউ নয় তো!
মগনলাল এবার এসে আলোর নীচে দাঁড়াল। মেদহীন, ঋজু, ছ’ ফিট লম্বা হবে। ধবধবে গায়ের রঙ। রোদে পুড়ে জঙ্গলে জঙ্গলে থেকে লাল হয়ে গেছে। পৃথুর চেয়ে ইঞ্চিখানেক বেশি লম্বা। খাড়া, খড়্গের মতো নাক। কপালে বলিরেখা। সরু কোমর। মুখের মধ্যে অবিশ্বাস্য এক নিষ্ঠুরতা। ভারী সুন্দর সুগঠিত দুটি পা। বড় বড় পাকানো দুটি গোঁফ। একমাথা বাবরি চুল, কুচকুচে কালো। বয়স, বড়জোর পঁয়ত্রিশ হবে। প্রায় সমবয়সী। সুন্দর শরীরের এক পুরুষ। সুন্দর শিঙাল শম্বরের মতো। শুধু যদি সে অমানুষ না হত।
পৃথু তার চোখের দিকে তাকিয়েছিল।
মগনলাল বলল, শুনো গাঁওয়ার। ওয়াক্ত জাদা নেহি হ্যাঁয়। তুম কওন হ্যায় বাতাও মুঝে। নাম ক্যা তুমহারা? ঠিক-ঠিক নহী বতানেসে জান লে লেগা।
পৃথু আস্তে আস্তে বলল, ডাকু মগনলাল কান খোলকর শুনলে। ম্যায় হুঁ শের সিং।
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ করে ফুলে ফুলে হাসতে লাগল ঘরের মধ্যে হাসির দমকে ঘুরে গেল মগনলাল। বাঁদিকের গোঁফে হাত দিয়ে ঘুরে যেতে যেতেই এক ঝটকায় পিস্তলটা বের করল কোমর থেকে।
সঙ্গে সঙ্গে তার হাসি থেমে গেল। বদলে গেল মুখের চেহারা।
বলল, নেহি। নেহি। তু শের সিং নেহি। তু পিরথু ঘোষ। চুহাসিং। বাঙালিয়া বাবু। ফুঃ! ডাকল, দুসরা খানদান সে বনতে হেঁ। পড়েলিখে, নোক্কর কিরানী কভভি ডাক্কু না হোনে শকতা। ডাকুভি বননেমে কুছ হিম্মৎকি জরুরৎ পড়তি হ্যায়। উও তুমলোঁগোমে হ্যায়ই নেহী। অব মরো শালে! বাঙালি কি বাচ্চে! গোলিসে আজ ভুঞ্জেগা তুঝকো। শালে ইন্দারজিৎ লালকে কুত্তে।
পৃথু বলল, মারোগে তো জরুর। পহলে উও গানা তো শুনাও এক মরতবে।
গানা? কওনসা গানা?
অবাক হল, মরার আগে বাঙালি বাবুকে ইয়ার্কি মারতে দেখে।
ওহি! “প্রীত ভইল মধুবনোঁয়া রামা, তোরা মোরা।”
হেসে ফেলল, ডাকু মগনলাল।
তারপর বলল, ইতমিনানসে শুননা তু ইয়ে গানা উপ্পর যা কর। আভভি আখরিওয়ালা চিজোঁ কুছ মাঙ্গনেকি হ্যায় ত’ মাঙ্গ লে। হ্যায় কুছ?
পাশের বাড়ির কোনও বাঈজী গাইছিল পৃথুর প্রিয় গান, রসুলন বাঈর গাওয়া : কনকর মোঁয়ে লাগ যাই হেঁ নারে/কনকর লাগলে কি কছছ ডর নেহি/গপ্পর মোরা ফুট যাইহেঁ না রে/গগ্নর ফুটলে কি কচ্ছ ডর নাহি…
বোলো? হ্যায় কুছ?
জী হাঁ।
ক্যা?
তুমহারা জান।
এহি কামিনেকে জান? ওয়াহ। ওয়াহ…
মগনলালের এই বাক্য শেষ হবার আগেই বালিশটা এক ঝটটাতে তুলেই র্যাপিড সাকসেশানে পর পর তিনটি গুলি করল পৃথু, সেমি-অটোম্যাটিক পিস্তলটি দিয়ে।
গুম। গুম। গুম।
ছোট্ট ঘরের মধ্যে প্রতিধ্বনি, বেড়ালের তাড়া-খাওয়া পায়রার ঝাঁকের মতো হুড়োহুড়ি করতে লাগল।
গুলিকটি মগনলালের বুকের দু’পাশ ও পেটও মনে হল একেবারে ছেদড়ে-ভেদড়ে দিল। ওর মুখে তখনও বিস্ময়ের ভাবটা পুরো কাটেনি। কেরানি, বাঙালির বাচ্চা যে সত্যি সত্যিই ডাকু মগনলালের দলেরই শুধু নয়, তার নিজেরও মওত হয়ে আসবে এ ভাবনাকে সে কখনও আমলই দেয়নি। ভেবেছিল, সবজান্তা ইন্দারজিৎ লালের এও আর এক মুখার্মি! বিকেল ও সন্ধের অপারেশনটিকে ও ভেবেছিল মকবুল খাঁ এবং লাল সাহেবই দুজনে মিলে করেছে অনেক প্ল্যান করে। পৃথুর সম্বন্ধে একবারও ভাবেওনি। সাঁওয়া ও শের সিংকে এই সপ্তাহেই ও একাই শেষ করে দিত। তারপর এই জায়গা ছেড়ে চলে গিয়ে নতুন দল বানাত অন্য কোথাও গিয়ে।
পড়ে যেতে যেতেও মগনলাল দেওয়াল ধরে ফেলল। এবং পৃথু ওর গুলির হাত থেকে বাঁচবার জন্যেই খাটের বাজুর দিকে দৌড়ে সরে যাচ্ছিল যদিও, কিন্তু তবুও মগনলালের ফোর-নট-ফাইভ পিস্তলের দুটি গুলি অত শর্ট-রেঞ্জ থেকে এসে লাগল। ডান পাটা মনে হল টুকরো হয়ে গেল। ডানদিকের পেটেও কে যেন গরম ছোরা ঢুকিয়ে দিল একটা। ছিটকে উঠল পৃথু। কোথায় লাগল, কী হল তা বোঝার আগেই প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনির সঙ্গে সঙ্গে তার জ্ঞান ফিকে হয়ে আসতে লাগল। কিন্তু বাঁ হাতে খাটের বাজু ধরে ঘষে ঘষে পড়ে যেতে যেতেও আরও তিনবার হাত সোজা করে, কনুই থেকে হাত ফ্রিজ করে, হাতের তেলো আর আঙুল স্কুইজ করে; খোলা, বিস্মিত, বুঁজে-আসা চোখে ক্রমশই থেবড়ে-বসে-যেতে-থাকা মগনলালকে আর তিনটি গুলি করল।
মগনলালও আরও একটি গুলি করল। কিন্তু সেটি লাগল বিজ্লীর খাটের মশারির স্ট্যান্ডে।
ওর জ্ঞান চলে যাওয়ার পূর্ব-মুহূর্তে পৃথু শুনতে পেল কে যেন, কারা যেন; দরজা ভাঙছে আর ডাকছে পৃথুদা! পিরথুবাবু! হুজৌর।
গোলমাল। চিৎকার। চেঁচামেচি। মহল্লার নানার বাড়ির বাঈজিদের চিকন ভয়ার্ত ডাকাডাকি। জোরে দরজা বন্ধ করার আওয়াজ এবং সেই কাকাতুয়াটার বুলি। কুকুরের ভুক ভুক।
এখন আর মনে হচ্ছে না কিছু। চারধারে অনেক ঘটনাই ঘটছে। পৃথুর তাতে বিন্দুমাত্রও ভূমিকা নেই। খুব আরাম লাগছে ওর। ঘোর অমাবস্যার মতো। অজ্ঞান হয়ে গিয়েও প্রথমবার চাঁদের আলোর মতোই একটু অস্পষ্ট জ্ঞান।
অনেক অনেকদিন পর একটু শান্তি পেল পৃথু।
নিজের সঙ্গে ওর অনেকই ঝগড়া ছিল। প্রত্যেক মানুষেরই আসল সব বিরোধ বোধহয় তার নিজেরই সঙ্গে। চিরদিনেরই জন্যে, হয়তো দীর্ঘদিনের জন্যে; সেই ঝগড়া সব থেমে গেল।
অনেক ঘুমও জমেছিল তার ভিতরে। অনেক ক্লান্তি, হতাশা; গ্লানি। অনেকই দিন ধরে চলছে সে। জন্মাবার পর থেকে, হাঁটা শেখার পর থেকে; বড় হবার পর থেকে! চলেছে তো চলেছেই। কাজে, ছুটিতে, জাগরণে, ঘুমে। জন্মালে, ইচ্ছে করুক আর নাইই করুক মৃত্যু অবধি মানুষকে চলতে হয়ই। নিরুপায় সে।
এবার কোনও মস্ত গভীর মহীরূহের স্নিগ্ধ ছায়ায় ঘুমোবে লম্বা ঘুম। কোনও কাজ নেই। ওর উপরে কারওই দাবি নেই আর। ওরও দাবি নেই এ সংসারে একটি মানুষেরও উপর। শুধু ঝিরঝিরে হাওয়া, পাখির ডাক, ঝরাপাতার দীর্ঘশ্বাস, কালো মৌনী পাথরের বুকের উপর ব্যর্থ প্রেমের সব অভিমান নিয়ে দৌড়ে গিয়ে আছড়ে-পড়া রঙ-বেরঙের শুকনো পাতাদের অস্ফুট স্বর, কান্নার মতো; আকাশের বুকে আর বনের ফ্রেমের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে বদলে-যাওয়া তেলরঙ, জলরঙ, টেম্পারা আর ওয়াশের মুগ্ধ-করা, ক্রমান্বয়ে ফুটে-ওঠা কত কত সব আশ্চর্য ছবি…
জীবনের এইরকম কোনও যতির বোধহয় খুবই প্রয়োজন থাকে। একটানা এই দীর্ঘ পথচলা বড়ই ক্লান্তির, একঘেয়েমির; নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়। বুকের মধ্যে কষ্ট হয় বড়।
আঃ কী আরাম! গরম জল-ভর্তি বাথটবে বড় আরামে পৃথু ঘুমিয়ে পড়ল। মেরী কি আগে বাথ-সল্ট ছড়িয়ে দিয়ে গেছিল? না। না। ও তো কখনও চান করে না বাথটাবে। নোংরা হয় বলে রুষা অ্যালাও করে না। ও তো অন্য বাথরুমে… ও তো… না না কল্পনাতেও চান করার অধিকার নেই ওর।
এখন কোন বাথরুমে শুয়ে আছে?
আসলে, জল নয়; রক্ত। রক্ত-জল-করা এই এতগুলো বছরের জীবনে জলকে রক্ত করে, অজানিতেই ও জল এবং রক্তের সঙ্গে যে আদিম সম্পর্কটি চিরদিনই ছিল; তাতেই সম্পৃক্ত হল।
ভুচু, বাইগা, ঢাণ্ডু, ইমরান, মহল্লার আরও অনেক ফুলওয়ালা, দালাল, ডিমসিদ্ধওয়ালা, ইত্বরওয়ালা, সারেঙ্গিওয়ালা, তবলচি সবাই ঘর ভরে ফেলেছে। তারা সবাই কুখ্যাত কিন্তু মৃত ডাকু মগনলালকে দেখছে। বিস্ফারিত চোখে দেখছে। উত্তেজনার শেষ নেই।
ঠুঠা তাদের ধমকে বলল, হাওয়া ছাড়ো; হাওয়া।
জানালাগুলো খুলে দিয়ে খাটে তুলে শোয়াল ও পৃথুকে, যেমন ছেলেবেলায় খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে-পড়া পৃথুকে শোওয়াত।
শুইয়ে কী বা হবে? এক্ষুণি কারখানার হাসপাতালে নিয়ে চলো। সেখানে ডাক্তার সঙ্গে করে অ্যাম্বুলেন্সে করে যেখানে বলেন সেখানেই নিয়ে যেতে হবে।
ভুচু বলল।
সময় নেই।
ঠুঠা ভুচুর দু’ হাত ধরে বলল কাতর গলায়, আমার পিরথু বাঁচবে তো?
চলো চলো ঠুঠা সময় নষ্ট করার, কথা বলার সময় নেই।
সময় যখন থাকে তখন তা জলের মতোই সস্তা। যখন থাকে না; তখন হঠাৎই বড় দামি হয়ে ওঠে। ভুচু রক্তাক্ত, অজ্ঞান পৃথুকে অন্যদের সঙ্গে ধরাধরি করে ওঠাতে ওঠাতে ভাবছিল।