1 of 2

২০. সকাল সাড়ে সাতটা এখন

২০

সকাল সাড়ে সাতটা এখন। খবরের কাগজ উল্টেপাল্টে দেখেছিল। এখানে এমনিতে কলকাতার কোনও কাগজ আসে না। তবে ও আনন্দবাজার রাখে। যদিও পৌঁছতে খুবই দেরি হয়ে যায়। বাড়িতে বাংলা কাগজের পড়ুয়া অবশ্য ও একাই।

আজ ভোরে কী আছে, কে জানে? নিশ্চয়ই কোথাও কিছু আছে। মিলি-টুসিকে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়ে চলে গেছে রুষা সাত সকালে। কী ব্যাপার? প্রভাত-ফেরি। পতাকা তোলা? কারও জন্মদিন? কোনও কবিতা, গান, বাজনার আসর?

স্যার?

কে? চমকে উঠে, বলল, পৃথু।

মেরী।

কী বলছ মেরী?

ক’টা ডিম? স্যার?

পৃথু নিরুত্তর।

কফি? না চা? না মিল্ক শেক। না ড্রিঙ্কিং চকোলেট?

নিউজপেপার। স্যার।

নিউজপেপার। এই অপ্রয়োজনীয় খবরের রাশই মানুষের পরম শত্রু। পৃথিবীর সব খবরের কাগজ। কামাসকাটকায় খুন। সেসেলস আইল্যাণ্ডস এ ক্যু। নদীয়া জেলার অভ্যন্তরের অভ্যন্তরতম গ্রামের কাঁচা পাটক্ষেতে কচি নাবালিকার নিভৃততম অভয়ারণ্যে নীল লুঙিধারী একজন বলশালীর বলপূর্বক গমন। সাইপ্রাসে লেটারবম্ব!

এই সব খবরে, এই সব জ্ঞানে, মানুষের, কী-ই বা এসে যায়! শুধুই বিরক্তি বাড়ে, শুধুই রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হতাশা। এসবে শুধু সৎ-ইসাবগোল-এরই বিক্রি বাড়ে। এ সবই, অসৎ, গভীর চক্রান্ত।

ক’টা ডিম? স্যার?

ক’টা টোস্ট?

স্যার, কফি, না চা, না…

কোনওই বৈচিত্র্য নেই জীবনে।

এমনকী; ব্রেকফাস্টেও।

মেরীকে বিদায় দিয়ে, খবরের কাগজগুলো পাশে সরিয়ে দিয়ে চেয়ারটাকে পেছনে ঠেলে টেবলের উপর পা দুটো তুলে দিল পৃথু। কিছুদিন হল মাঝে মাঝেই, ওর মাথার মধ্যে বিদ্যুৎচমকের মতো হঠাৎ হঠাৎ যন্ত্রণা বোধ করছে একটা। পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায়। রোদের সোনালি উষ্ণতা ঝুপ করে হঠাৎই ঠাণ্ডা মেরে যায়। মাথার মধ্যে আইসল্যাণ্ডস অফ সার্সির সাইরেনের মতো বাঁশি বাজে। শী-শী-শী-ই ই ই…

সে বাঁশি সে শোনেনি। হয়তো উ্যলীসীস শুনেছিলেন। কে জানে? রুষা ভাল বলতে পারবে। ইংরিজির ছাত্রী ছিল ও। পড়ায়ও ইংরিজি। কিন্তু সেই সময়, যখন এই আক্রমণটা হয়, ও মৃত্যুর গন্ধ পায় নাকে, অনেকটা হেমন্তর শেষ বিকেলের ভোঁর ঘাসের বনের শামুকের গায়ের গন্ধর মতো বসন্ত-শেষের হলুদ-বসন্ত পাখির তলপেটের অস্বস্তিকর গন্ধর মতো। গা-শিরশির করা, ভাললাগাময়, কিন্তু ভীষণ ভয়ের এক অনুভূতি হয় ওর সেই সময়। বিজলীর দেওয়া সিদ্ধি খেয়ে যেমন দেখছিল, তেমনই চোখের সামনে লাল-নীল হলুদ-সবুজ সোনালি-রুপোলি সুতোর দল নাচানাচি লাফালাফি করে।

আঃ! উঃ! ভীষণ যন্ত্রণা! কী ভীষণ যন্ত্রণা!

অজ্ঞান হয়ে যায় পৃথু।

কে যেন তাকে ডাকে। অনেক দূর থেকে।

তাই-ই তো! পৃথুকেই তো ডাকে!

—ভইষানঘাট রেঞ্জের জঙ্গলের গভীর থেকেই কি?

কে যেন ডাকে তাকে। কোনও পুরুষ। বলে, পৃথু…উ…উ…

মনে হয়, যে ডাকে, তার ভীষণই বিপদ? বাঘে তাকে ধরেই ফেলেছে। পেড়ে ফেলেছে একেবারে। অথবা বাইসনে ফেলে দিয়ে তাকে পেটের নীচে শুইয়ে রেখে সাদা-মোজা-পরা চার পায়ের ঘেরে তাকে ঘিরে তার উপরে দাঁড়িয়ে আছে। তারই রাইফেলের গুলিতে মারাত্মক আহত বাইসনের ভেলভেট-এর মতো কালো উজ্জ্বল গা বেয়ে, গুলির রক্ত ঝরনা-ধারার মতো বয়ে যায় সেই মানুষের গা-গড়িয়ে। উষ্ণ, কালোজামের রঙের রক্ত, তার চোখে মুখে। ঝরঝর। তার চিৎকারে যেন বাইসনের রক্তেরই গান ফুৎকারিত, উৎসারিত হয়। তার মুখে, মৃত্যুর নোনা স্বাদ লেগে থাকে। তার নিজেরই মৃত্যুর গন্ধ।

কে সে?

পৃথু নিজেই কি?

আঃ।

আবার কে ডাকে?

এবারে?

মা!

কি, মা?

খোকন, আয়। পায়েস খেয়ে যা। তোর জন্যে পায়েস বেঁধেছি। আজ যে তোর জন্মদিন! সাদা পাথরের বাটিতে কালো গাইয়ের ঘন দুধের লাল সর-ফেলা পায়েস। আয় খোকন, খেয়ে যা!

আমার জন্মদিন। পৃথু ভাবে। পৃথুরও জন্মদিন! জন্মদিন তো হয় বিখ্যাত লোকেদের! ভাগ্যবানদের। যাদের অনেকে ভালবাসে; শুধু তাদেরই। হাসি পায়! পৃথুর জন্মদিন।

আজ আমার জন্মদিন। অ্যাই যে! কে আছ? রুষা, মিলি, টুসু, অ্যাই যে কুর্চি! আজ আমার জন্মদিন, জানো? পৃথু বলে, নিজেকে। আসলে, মৃত্মদিনই তো মানুষের আসল জন্মদিন।

স্যার! স্যার! স্যার…

কে, ক্কে, কে…

চমকে উঠল ও।

কে? কে তুমি? আজ আমার জন্মদিন। কে এসেছ? রুষা? কুর্চি? কুর্চি বুঝি?

আমি মেরী। আপনার কাছে একজন সাহেব এসেছেন।

মেরী! মেরী? ও মেরী। কোয়াইট কনট্রারী! কে সাহেব?

দেখতে সাহেবের মতো নন।

নন? নাম কী? নাম কী সেই অসাহেব সাহেবের?

মিস্টার দিগা পাঁড়ে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *