আজকের পৃথু অন্য পৃথু। বড়লোক, সাহেব, কেতাদুরস্ত পৃথু। রুষা আজ সঙ্গে থাকলে খুশি হত। তার স্বামীর এই সত্তাকেই সে সবসময় কাছে চেয়েছিল। সপ্রতিভ, নিখুঁত ইংরিজিবলা, ফর্ম্যাল, ভদ্র; হাই-সোসাইটির পৃথু।
ওর বুকের মধ্যের এই বন্ধ ঘরটিকে আজ অনেকদিন পর খুলে দিয়েছে ও। অনেকই তো ঘর। তই বদলে বদলে ব্যবহার করে।
মুক্তির আই-টি-ডি-সি লজ-এর ডাইনিং রুমে বসেছিলেন টাইগার প্রজেক্টের পারিহার সাহেব। মিস্টার এ, এস, পারিহার। সঙ্গে ছিলেন ফিল্ড ডিরেক্টর লাওলেকার সাহেব। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের। আর মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজম ডেভলাপমেন্ট করপোরেশানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মিঃ বি, কে, বাগচী। আই-টি-ডি-সি’র মুক্তি লজ-এর ম্যানেজার বারাণসীবাসী সদাই মঘাই পান-চিবুনো ভালমানুষ মিষ্টি-জবানের প্রসাদ সাহেবও ছিলেন। পৃথু সেই সময়ই গিয়ে পড়েছিল ওইদিকে।
মালাঞ্জখণ্ড-এ কাজ ছিল একটু। বেরিয়েছিল হাটচান্দ্রা থেকে সেই কাক ভোরে। মালাঞ্জ খণ্ড-এর কাজ সারা হয়েছে। হাটচান্দ্রাতে ফিরবে এবারে। দুপুরের খাওয়াটা সেরে নেবার জন্যে থেমেছিল এই লজ-এ।
কোম্পানিরই একটি গাড়ি নিয়ে এসেছিল। তবে, ড্রাইভার তো ওকে অ্যালট করা গাড়িখানাই চালায়। তাই নিজেই এ গাড়িটি চালিয়ে এসেছে। সঙ্গে ভুচুর গ্যারাজ থেকে একটি ছেলেকে নিয়ে নিয়েছিল। ক্লীনার, হেল্পার; সব। গাড়ির চাকা-টাকা পাংচার হলে বদলে দেবে। ওসব পারে না পৃথু। লোকে টিটকারি দেয়, রুষা চিৎকার করে, ছেলেমেয়েরা বলে, “অদ্ভুত বাজে লোক বাবাটা।” কিছুই পারে না। আমাদের সব বন্ধুদের বাবারা কত্ব ভাল। কত্ব কী পারে।
পৃথু মানে।
সবই মেনে নেয়, কিন্তু করেও না কিছুই। কোনওদিনও করেনি বলে, এখন পারেও না। গাড়ির টায়ার বদলাতে, গভীর জঙ্গলের রাস্তায়, যে সময়টুকু নষ্ট হয়, সেই সময়টুকুতে গাড়ির সামনে, অথবা পেছনে বেশ অনেকখানি হেঁটে নেওয়া যায় একা একা সুগন্ধি নির্জনতায়। ফ্যান বেল্ট বা টায়ার বদলানোর মধ্যে নেই পৃথু। ও “অদ্ভুত বাজে লোক”।
বাগচী সাহেব বললেন, কী খবর মশাই? যাচ্ছেন না আসছেন?
যাওয়া মানেই তো আসা। আসা মানেই যাওয়া। কথাটা ও বলল না। কিন্তু মনে পড়ে গেল।
বিজ্লী বলেছিল। কোথায় গেল বিজ্লী? চলে গেছে ফিরে। জব্বলপুরে? কে জানে? কত মানুষের সঙ্গেই দেখা হয় পথে যেতে আসতে, কত্বরকমের মানুষ। ক’জনের সঙ্গে আর সম্পর্ক গড়ে ওঠে, থাকে?
মুখে বলল, মালাঞ্জখণ্ড থেকে আসছি। ফিরে যাব হাটচান্দ্রাতে।
ব্যসস, এতটুকুই বাংলায় হল কথা। কারণ পারিহার সাহেব, প্রসাদ সাহেব বা লাওলেকার সাহেব, বাংলা কেউই বোঝেন না।
ইংল্যান্ড-এর রাণীর স্বামী প্রিন্স ফিলিপ নাকি ঘুরে গেলেন কানহা ন্যাশনাল পার্ক-এ অল্প কদিন আগেই।
প্রসাদ সাহেব বললেন।
তারিখটা শুনে পৃথু, বুঝতে পারল যে যেদিন দিগা পাঁড়ের কুঁড়ের সামনে ঢোল-এ তাড়া-খাওয়া বারাশিঙাকে শামীম মারল, তার দু-তিনদিন পরে বোধহয় প্রিন্স ফিলিপ এসেছিলেন মুক্কিতে। এবং পারিহার সাহেবের মুক্তিতে আসার কথাটা পুন্নোয়া গাঁ-এর লালু যা বলেছিল, তা সত্যিই।
পৃথু দেখল ওঁরা সকলেই পোচিং সম্বন্ধেই আলোচনা করছেন। কে বা কারা নাকি গতকালই ভাইসেন ঘাট ব্লকে একটা বাইসন মেরে দিয়েছে।
পারিহার সাহেব রেগে বলছিলেন, এবার ফরেস্ট মিনিস্টারের কাছে আমি অটোমেটিক ওয়েপন চাইব—জে জে দত্ত সাহেবকে ফোন করছি কালই ভোপালে। কী অন্যায়।
পৃথু চুপ করেছিল। পৃথুর কী? পৃথু তো আর সেদিন মারেনি বারাশিঙাটা। মারতে বলেওনি। পৃথু তো দশ বছরের উপর শিকার একেবারে ছেড়েই দিয়েছে। তবুও, পৃথুর কেমন যেন চোর-চোর লাগছিল নিজেকে।
এমন সময় লজ-এর রিসেপশান থেকে একটি ছেলে এসে বলল পারিহার সাহেবকে, স্যার, দেবী সিং, সানজানা সাহেবের লোক, দেখা করতে এসেছে।
ও হ্যাঁ। ডেকে পাঠিয়েছিলাম আমি। পারিহার সাহেব বললেন।
সানজানা সাহেব রেসপেক্টেবল লোক। আদিবাসীদের জন্যে অনেক কিছু করেছেন, হাইলি কানেকটেড মানুষ। বয়সও হয়েছে অনেক। ওঁর কথাই আসছে না এসবের মধ্যে। কিন্তু কী বলে দেবী সিং? শোনা যাবে।
ভাবল পৃথু।
ডাকো তাকে।
পারিহার সাহেব বললেন।
দেবী সিং এর নাম শুনেই অবশ্য পৃথুর পিলে চমকে গেছিল। ভেবেছিল, একটু জমিয়ে লাঞ্চটা খাবে বিয়ার সহযোগে। কী বিপত্তি!
রোদ এসে পড়েছে টেবলটাতে, কাঁচের স্বচ্ছ দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে। বাংলোর পা ছুঁয়েই বয়ে-যাওয়া বানজারা নদী দেখা যাচ্ছে। ঝরঝরানি শব্দটা কাঁচে বাধা পাওয়াতে, কম শোনাচ্ছে। এরই মধ্যে এই সব ঝামেলা! সুন্দর সময়ে যত অসুন্দর ব্যাপার। ভাল লাগে না পৃথুর।
ও তাড়াতাড়ি মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে নিল।
অর্ডার দিল, মাটন বিরিয়ানী, চিকেন-দোঁ পেয়াজা, স্যালাড উইথ টাটার সস, রায়তা। এবং তার আগে বিয়ার। গোটা তিনেক খাবে কমসে কম। তারপর পান দো-চার, কমসে কম। প্রসাদ সাহেবের কাছ থেকে চেয়ে। তারপর জেলুসেল এম-পি-এস। আট ইয়া দশ। কম সে কম। ও সত্যিই খেতে ভালবাসে! মনোমত খাওয়ার পেলে তো কথাই নেই। রুষা বলে, “বিনি পয়সাতে পেলে তুমি বোধহয় দাদের মলমও খেতে।” হয়ত। খেত।
দেবী সিং কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসার আগেই প্রসাদ সাহেব পৃথুর কাছে উঠে এসে বললেন, “লীজিয়ে, দেওতা!”
বলেই, পৃথুর সামনে হাত জোড় করে মঘাই পান নিয়ে পেশ করলেন, বড়ী খশ-তমিজীর সঙ্গে।
সাদা আর কালো ডোরা কাটা একটা মারাত্মক শার্ট পরেছেন প্রসাদ সাহেব। পৃথু পান নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে, জামাটার দিকে চেয়ে তারিফ করে বলল, “আর রে প্রসাদ সাহাব! ঈ ক্যা বারিক ঔর বেতন চিজ। মালুম হোতা জৈসে কি সিতারোঁসে রওশনিকি, করিয়ে কুদ পড় রহি যায়।”
এই প্রসাদ সাহেবও কিন্তু সন্ত তুলসীদাসের বড় ভক্ত। রামচরিতমামনস এঁরও মুখস্থ। সবসময় দোঁহা আওড়াচ্ছেন। এমন পরিবেশে, এমন ম্যানেজার পাঠানো উচিত হয়নি আই-টি-ডি-সির। যে-কোনও মুহূর্তে প্রসাদ সাহেবও দিগার মতো সন্ত বনে জঙ্গলে চলে যেতে পারেন। তুলসীদাস আওড়াবেন আর খাবেন মাধুকরী করে। মধ্যপ্রদেশের এই সাতপুরা হিলস-এর জঙ্গল-পাহাড়ও ভারী ক্ষতরনাগ। চম্বলে লোকে বাগী হয়ে যায়, এখানে সন্ত হয়ে যায়। দুই-ই সমান। সমাজকে ছেড়ে যাওয়া তো!
প্রসাদ সাহাব, লাওলেকার সাহাব, বাগচী সাহাব, পারিহার সাহাব সকলেই বহত খুব! বহত খুব বলে উঠলেন।
প্রসাদ সাহাব বললেন, ইয়ে বঙ্গালী প্যায়েরভিমে তো বানারসওয়ালোঁকো ভি বুড়া হালত সে…
সেলাম হুজৌর!
দেবী সিং এসে দাঁড়াল।
কেয়া? তুম কুছ জানতে হো ইস বারেমে?
পারিহার সাহেব বললেন।
নেহী হুজৌর! ম্যায় কুচ্ছো নেহী জানতা হ্যায়।
লালু নামের কাউকে জানো, পুন্নোয়া বস্তীর?
নহি হুজৌর!
ঠুঠা বাইগা বলে কাউকে জানো? দিগা পাঁড়ে? হাটচান্দ্রার মহম্মদ শামীম? পাগলা-ঘোষষা?
দেবী সিং একবার পৃথুর দিকে চাইল। তারপর চোখ আর গোঁফ একই সঙ্গে নামিয়ে নিল।
বলল, হ্যাঁ। আমি শুধু ঠুঠা বাইগাকে চিনি।
কে সে? থাকে কোথায়?
থাকে হাটচান্দ্রায়। সাহেব-ফ্যাক্টরীতে কাজ করে! খুব ভাল শিকারি ছিল একসময়। আমরা একসঙ্গেই শিকার করেছি। কিন্তু আজকাল আমারই মতো শিকার-টিকার তো ছেড়ে দিয়েছে!
ঠুঠা বাইগা ছাড়া, অন্য যাদের নাম বললাম, তাদের একজনকেও চেনো না? ঘোষষা কোন জাত? এমন পদবি তো শুনিনি কখনও?
প্রসাদ সাহেব এ অঞ্চলে নতুন। এর আগে একজন সদারজী ম্যানেজার ছিলেন। বললেন, পানকা হবে কি? কবীরপন্থী?
পারিহার সাহেব বললেন, তাহলে তুমি পাগলা ঘোষ্ষা, শামীম মিঞা, ভুচু বাবু, দিগা পাঁড়ে…?
না হুজৌর!
বাগচী সাহেব বললেন, মিঃ ঘোষ, আপনি হয়তো পারিহার সাহেবকে এ ব্যাপারে হেলপ করতে পারেন। হাটচান্দ্রার লোক আছে বোধহয় কিছু।
আমি? আমি, মানে…।
পৃথু ঘাবড়ে গিয়ে তুলে বলল।
বিয়ারটা কি ফ্ল্যাট হয়ে গেছে? এক ফোঁটাও কিক নেই। যাচ্ছেতাই।
কাশল পৃথু একটু। কাশতে কাশতেই বলল, কাম, লেটস ওল হ্যাভ সাম বীয়র। উ্য লুক টু বী স্ক্রড-আপ মিঃ পারিহার। বেয়ারা। বিয়ার লাও আউর।
পকেটে ডাইনার্স ক্লাবের কার্ড আছে কোম্পানির। কোনও চিন্তা নেই।
কী মিস্টার ঘোষ?
নামগুলো লিখে দিন প্লিজ কাগজে। যদিও আমি এখন ছুটিতে আছি, রেসিডেন্ট ডিরেক্টর উধাম সিংকে নিশ্চয়ই বলব। আপনি একটা ওফিসিয়াল চিঠিও না হয় লিখে দেবেন আমাকে, এই যে কার্ড, তার বেসিস এ আমি আমাদের লোক লাগিয়ে পাত্তা করব। তবে ঘোষষ না কী একটা বললেন যেন নাম?
পাগলা রোষষা।
লাওলেকর সাহেব বললেন, গ্লাসভর্তি ফ্রথ-এ চুমুক দিতে দিতে।
পারিহার সাহেব বললেন, রোষষা নয় ঘোষষা। বাগচী সাহেব বললেন, আমি ট্যুওরিজম-এর লোক, দিস বীয়র ইজ অন মী। ইন ফ্যাক্ট এস এন্টারটেইনমেন্ট টু দ্যা রাইট টাইপ অফ পিপল তো তোমার, আই মীন, আই-টি-ডি-সিরই করা উচিত, তোমার লজই ফায়দা উঠোচ্ছে, উঠোবে বেশি করে, আমার গভর্নমেন্টের চেয়ে, কী বলল প্রসাদ?
প্রসাদ সাহেবের কিছুতেই “না” নেই। উনি একটা টিপিক্যাল বানারসী ভঙ্গি করলেন। যাও হয়, ‘না’ও হয়। কথা দিয়ে চিড়ে ভিজোতে বেনারস এলাহাবাদ লোকের মতো আর কেউই পারে না। অবশ্য প্রসাদ সাহেব একসেপশান। রিয়্যাল বিনয়ীর মতো হাত জোড় করে সবসময় স্মিতমুখে “ইয়েস” করেই আছেন।
লাওলেকার সাহেব পাগলা রোষাকে কারেক্ট করে বললেন, পাগলা-ঘোষষা।
ইয়স। পৃথু বলল। পাগলা ঘোষ্ষাষা।
আমি নিশ্চয়ই দেখব। আই মীন খুঁজব। কে সে!
তারপর বলল, একদিন আসা হোক।
কোথায়? আপনার বাড়িতে? তা ডিনারের নেমন্তন্ন করলেই যাই। মিসেস ঘোষকে বলবেন। উনি তো ভোপালে আসছেন নেক্সট মার্চ-এ। সেমিনার অ্যাটেন্ড করতে। রবীন্দ্র ভবনে বিরাট সেমিনার। যাই বলুন, দারুণ মহিলা আপনার স্ত্রী। ভেরী লাকী লোক। কত গুণ! এবার বলুন কবে নেমন্তন্ন? এতদুরের রাস্তা, জীপে করে যাব ঠাণ্ডাতে, সাহেব-কোম্পানির বড়সাহেবের বাড়ি! কী বলেন?
পারিহার সাহেব বললেন, নিশ্চয়ই! ভাল খাদ্য পানীয় না হলে চলবে কী করে?
নো-প্রবলেম। তবে বাড়িতে নানা অসুবিধে লেগেই থাকে। উ্য আর ওলওয়েজ ওয়েলকাম টু দা ক্লাব, টু দ্যা গেস্টহাউস। ইটস ইয়োরস। এনি-টাইম ইজ ইওর-টাইম।
লাওলেকার সাহেব বললেন, আমি একটা কথা লক্ষ্য করেছি মিঃ ঘোষ। যাদেরই সুন্দরী স্ত্রী থাকেন, তাঁরাই বাড়িতে কাউকেই নিয়ে যেতে চান না।
পৃথু হাসল।
আর কেউই হাসলেন না।
ওর একার হাসিটা রামছাগলের হাসির মতোই শোনাল ওর নিজের কানে।
মনে মনে বলল, কাউকে আসতে না বলতেই তো শুয়োর, ইদুর, কাক, চিল কত কিছু এমনিতেই আসে। আপনাদের মতো ভদ্রলোকদের খামোখা বাড়িতে ডেকে অপমানিত করা কেন? কিন্তু মুখে কিছুই বলল না। লাওলেকার সাহেব তো মারাঠি! মারাঠিই কি? “যাদের নামের শেষে ‘কার তারা মারাঠি আর যাদের নামের শেষে ‘আনি-দোয়ানি তারা সবাই সিন্ধি!” পৃথুকে তার আটবছর বয়সে বম্বে থেকে বেড়াতে-আসা একটি বাঙালি ছেলে বলেছিল। লাওলেকার সাহেবকে জিগ্যেস করলে হয় ইদুকারকে চেনেন কি না। পৃথু ভাবে। তারপর ভাবল, থাক। কোন কারের সঙ্গে কোন ‘কারের কী সম্পর্ক না জানা থাকলে আকার প্রত্যয়ে ঝামেলা বাধতে পারে। কী দরকার? বাঘেদের ডেরাতে বসে ইদুরের মতো একটি সামান্য প্রাণীকে নিয়ে আলোচনার?
বাগচী সাহেব কথা কম বলেন। রাশভারী। বরেন্দ্রভূমের মানুষ। কোনওদিনও যে ওঁর সঙ্গে ভাল করে জমিয়ে আড্ডা দেবে পৃথু তেমন সুযোগ হয়নি। এখানে-ওখানে যেতে-আসতে দেখা হয় নানা জায়গায়। ভোপাল, ইন্দোর, জবলপুর, এটসেট্রা, এটসেট্রা। পৃথুর বাবার রেফারেন্সেই চেনেন বেশি উনি ওকে, তার নিজের পরিচয়ের চেয়ে। পৃথুর নিজের কিছুই নেই। এমনকী, পরিচয়টুকু পর্যন্ত নয়।
মালাঞ্জখণ্ড-এ কেন গেছিলেন?
আরে উধম সিং এর পাগলামি। একটি ইয়াং চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছেলে, জয়েন করেছে কলকাতা থেকে এসে। একেবারেই বাচ্চা, ভাল করে গোঁফও ওঠেনি মনে হল।
তার সঙ্গে উধম সিং-এর এক বাঙালি বন্ধুর মেয়ের সম্বন্ধ করার জন্যে গেছিলাম। পাগলের কাণ্ড। ছুটিতে রয়েছি। তবু। হাত ধরে বলল, ব্রাদার। এই ব্রাদারলি কাজটা তুমি ছাড়া আর উকেই দিতে পারি না।
কেন, পাগলের হল কেন? আপনার বিয়েও তো নিশ্চয়ই কোনও পাগলেই দিয়েছে? মশাই, গেলে বিয়ে না দিলে বিয়ে হয় না। পাগলা না-হলে কেউ বিয়েও করে না। হাটচান্দ্রায় গিয়ে খোঁজ করে দেখুন গিয়ে, দেখবেন ওই পাগলা-রোষও নিশ্চয়ই বিবাহিত।
লাওলেকার সাহেব বললেন।
পারিহার সাহেব আবার কারেক্ট করলেন। পাগলা-ঘোষষা।
বাগচী সাহেব বিয়ার মাগ এ চুমুক দিয়ে বললেন, তা সম্বন্ধের কী হল? হল?
মাথা খারাপ! পৃথু বলল।
গিয়ে দেখি, সে পাত্র বাড়িতেই আছে। বাঙালির ছেলে। একেবারে খাস কলকাতার। মালাঞ্জখণ্ড-এ এসে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। আজ্ঞা নেই, বন্ধুরা নেই, কী গরম! কী শীত। এখানে ভদ্রলোকে থাকে! চাকরি ছেড়েই দেবে বলছে।
পাত্রর বাঙালিত্বর কোয়ালিটি সম্বন্ধে অন্তত কোনও সন্দেহই রইল না তাহলে। বাগচি সাহেব বললেন।
তা ঠিক। পৃথু বলল।
বিয়ে? বলুন, বিয়ের কী হল? আপনি মূল ইস্যু থেকে সরে যাচ্ছেন মিঃ ঘোষ।
পারিহার সাহেব বললেন।
ইয়েস। বিয়ে। বিয়ে, সে কাকে করবে, তা নাকি বি, এ, পাশ করার আগেই ঠিক করে রেখেছিল। বি, এ, পাশ করেছে, সি-এ পাশ করেছে সবে, একটু সিনেমা-টিনেমা দেখা, আর্ট-ফিল্ম, বইমেলা, ফার্নিচারের আর ফারনিশিং এর জন্যে পার্ক স্ট্রীট রাসেল স্ট্রীটের অকশান হাউস ঘুরে ঘুরে দেখা হচ্ছিল, পাখির নীড়ের, পাখির ডিমের জোগাড়যন্ত্র। ইতিমধ্যে মালাঞ্জখণ্ড। হোয়াট আ ট্র্যাজেডি।
ভাবা যায় না। লাওলেকার সাহেব বললেন। ট্র্যাজেডি কী মশায়। আমার নিজের ব্যাপার হলে বলতাম ক্যালামিটি! অফ দ্যা হায়েস্ট অর্ডার!
পাত্রকে, তাহলে দেখলেনটা কী? বিছানায় উপুড় হয়ে বসে ফিয়াসেকে চিঠি লিখছে নীল প্যাডের কাগজে?
দ্যাটস রাইট। ঠিকই তাই। উ্য আর অ্যাবসলুটলি রাইট।
প্রসাদ সাহেব বললেন, মগর, গোসসা মত হইয়ে ঘোষ সাহাব। আজকালকা বাঙালিলোগ ঘরকা বাহারই জানে নেহী মাংতা হ্যায়, ঔর দেখিয়ে তো পুরানা জামানামে উহনি লোঁগোনে তো তামাম ইণ্ডিয়া ছেক লিয়ে ঘেঁ। হ্যায় কী না? ক্যা?
বেয়ারা! ঔর বিয়ার।
আপনি মূল প্রশ্ন থেকে সরে এলেন ঘোষ সাহেব। ডোন্ট ইন্টারাপ্ট প্রসাদ।
ইয়েস। বলছি।
বিয়ারে একটা বড় চুমুক দিয়ে পৃথু বলল।
ইয়েস। মূল প্রশ্ন। রাইট উ্য আর!
সারাটা জীবনই মূল প্রশ্ন থেকে বারে বারেই সরে আসছে পৃথু।
ক্রমাগত।
পৃথুর মতো অনেকেই আছে। পৃথুর চারপাশে অদৃশ্য ভিড়ের অস্তিত্ব অনুভব করে ও। ও জানে, অনেকেই আছে যারা ওরই মতো সমস্ত মূল প্রশ্নকে ভয় পায়।
একটা সময়, বোধহয় সকলের জীবনেই আসে; শামুকের মতো ধীরে ধীরে মন্থরগতিতে এলেও আসে; যখন মূল প্রশ্নটাকে তেলাপেকার মতো গোঁফ ধরে টেনে তুলে, মাটিতে ফেলে, সামান্য একটু দৌড়তে অনুমতি দিয়েই, ইনকরিজিবল ডাকাতদের বা অনভিপ্রেত সাক্ষীদের যেমন করে শেখানো হয়, শোধরানো, তেমন গদ্দাম। গদ্দাম!
না, না গুলি নয়।
চটিব চাঁটি। ঘেঁৎলে দিতে হয়। চটি দিয়ে বারে বারে। রাইফেলের গুলিতে শুধুই মৃত্যু থাকে, চটির আঘাতে ঘৃণামিশ্রিত মৃত্যু।
কিন্তু কোথায় যেন পড়েছিল পৃথু, তেলাপোকা, মানুষের বিবেক এবং কচুরিপানা কখনও নাকি মরে না। শুধু ডরম্যান্ট থাকে; আবার জেগে উঠবে বলে।
ওয়েল কুড বী।
বেয়ারা, বীয়র!