৫১
ঠুঠা বাইগা কুড়ি দিন হল একটানা জঙ্গলে রয়েছে এবার। রোদে পুড়ে, চেহারাটা তামাটে হয়ে গেছে। জঙ্গলের রঙে এখন তার চোখ ভরা, শব্দেও ভরে আছে কান। জংলি, আবার জংলি হতে পেরে খুশি হয়েছে বড়।
কাল রাতে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি হয়ে গেল। প্রতি বছরই জানুয়ারির শেষাশেষি একবার তুমুল ঝড়বৃষ্টি হয়ই। কিন্তু এবার আবারও একবার হল ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি।
কাল রাতের ঝড়ের মধ্যেই এক বিশেষ কাণ্ড ঘটে গেছে ঠুঠার জীবনে। সাংঘাতিক কাণ্ড।
গুহাটার মধ্যে ঝড়-জলের ঝাপ্টা বাঁচিয়ে দু হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে উৎকর্ণ হয়ে সাবধানে বসেছিল ঠুঠা। এইরকম রাতেই তো কাট্নেওয়ালা জানোয়ারেরা সব বেরোয়। গুহাটার কাছে পৌঁছে উঁকি মেরেই বুঝেছিল যে, এক ভালুক-দম্পতির বাসা সেটা। তাই-ই বিকেল-বিকেল এসেই দখল নিয়ে নিয়েছিল। ভালুকেরা যখন গুহার দিকে ফিরে আসছিল সন্ধের মুখে, তখন ওদের দিকে বন্দুক তাক্ করে ভয় দেখাতেই পালিয়ে গেছিল ওরা। মানুষের মতো, জংলি কুকুরেরই মতো, ভালুকেরাও বড় সামান্যতেই ভয় পায়। লুকোয়, ভীরুর মত; তাদের চেয়ে অনেক কম শক্তিমানদের চোখ-রাঙানিতেই। মানুষের মধ্যে যেমন, সব প্রাণীর মধ্যে মেরুদণ্ডহীন থাকে অনেকেই।
কে জানে, বেচারা উদ্বাস্তু ভালুকেরা এই ঝড়-জলের রাতে মাথা গোঁজার কোনও আশ্রয় এখনও খুঁজে পেল কিনা!
ঘুমোতে যাবার আগে, গুহার মুখে একটি কাঁটা-ঝোপ কেটে বসিয়ে দিয়েছিল ঠুঠা। আগুন করেছিল গুহার মধ্যে, তারপর আরামে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমোবার সময় যাতে কেউ হাম্লা করতে না পারে, সে সম্বন্ধে সাবধানও হয়েছিল। ওর পাতলা ঘুম ভেঙে গেছিল বাজ পড়ার কড়াক্কড় আওয়াজে। গাছপালা, পাতা, ঘাস, লতা সব উথালপাতাল করছিল ঝড়ে, মাঝরাতে। ওইভাবেই কম্বলে গা-মাথা মুড়ে বসে থাকতে থাকতেই ঠুঠার তন্দ্ৰামত এসে গেছিল। এমন সময়, স্বপ্নই কি দেখল ও? না, সত্যি? ঠুঠা বাইগা দেখল, গুহামুখে; সমস্ত গুহার বাইরেটা চাঁদের আলোর মতো এক নরম ভিজে আলোয় ভরে দিয়ে, নাঙ্গা বাইগিন্ এসে দাঁড়িয়েছেন। মেঘগর্জনের মধ্যে অথবা মেঘগর্জনের মতোই গলায় বাইগিন্ আদেশ করলেন ঠুঠাকে: পুবের দিকে দুই ক্রোশ। না গেলে বাইগিনের রোষ। ভোঁরের মাঠে মস্ত শিমুল। পুজো দেবি তার নীচেতে। আর কালো কুকরা চারটো দেবি, লাল্চে হরিণ একটো। তাদের রক্ত দিয়ে সেই মস্ত শিমুল রাঙিয়ে দেবি। সে শিমুলের ডালে ডালে বেঁধে দেবি কাল্চে পাথর, কান খুলে শোন্ শিকড়হারা বাইগা ঠুঠা। বাঁধবি পাথর, আমার নামে; হাজার হাজার। খুশি হলে ফিরিয়ে দেব; তোর বান্জার।
পাথরের ভারে নুয়ে পড়বে শিমুল দু’ পাশে, হাড়-জিরজিরে হয়ে যাবি তুই, নড়তেও পারবি না; তখন সেই শিমুলই বলে দেবে তোকে মন্ত্র। তোর ছুটির মন্ত্র বলবে তোকে। ঠুঠা বাইগা। শহরে-যাওয়া, শহরে-থাকা ঝুঠা-বাইগা। সেই মন্ত্রে তোর শুদ্ধি হবে। অনেকই পাপ লেগেছে তোর গায়ে আর মনে শহরে থেকে থেকে। ফিরে দেব তোর গ্রাম আমি তোকে। কিন্তু সেই গ্রামে তুই একাই থাকবি। এক ভালুক্নিকে বিয়ে করবি। মনে থাকে যেন।
শহরের কোনও মানুষের পা যদি সেখানে পড়ে, তবে সেই মানুষকেও সঙ্গে সঙ্গে খুন করে তার রক্তে দিয়ে শিমুলের গুঁড়িতে সিঁদুর লাগাবি। জানবি, তা আমারই পুজো। না করলে ‘মারাই দেবী’ ঠিক খুঁজে নেবে তোকে। তারপর দেখিস।
রোজ সকালে পুজো করবি গাছকে, নদীতে চান সেরে উঠে। একটি হাজার কালো পাথরের চাঙড় অথবা গোলা যখন বাঁধা হবে, শিমুলের হাতগুলো আর মাথাটা দেখবি যখন একেবারে নুয়ে পড়েছে আমার আশীর্বাদে, তখন বললামই তো শিমুলই তোকে বলে দেবে তোর গ্রামের হদিস, ঠিক্ঠাক। অথবা সে খুশি হলে আগেভাগেই হয়তো পারে বলে দিতে। সবই তোর কপাল।
বলেই, বাইগিন্ মিলিয়ে গেলেন।
যতক্ষণ ছিলেন, ঝড়বৃষ্টির আওয়াজ শোনাই যায়নি। সব আওয়াজই থেমে গেছিল।
চলে যেতেই, এবার আবার উথালপাতাল করতে লাগল প্রকৃতি। তার ভয়ংকর শব্দে ভয়ংকর ঠুঠা বাইগাও ভয় পেয়ে গেল। এর পরে ঘুম আর হল না ঠুঠার। শেষ রাতে তন্দ্রা এসেছিল একটু আবার।
ভোর হয়ে যাবার অনেকক্ষণ পর ঠুঠার ঘুম ভাঙল। চোখ চেয়েই দেখল, গুহামুখের সামনে এক ভালুকি একা বসে আছে। ঠুঠাকে দেখেই লাজুক-লাজুক মুখ করে মুখ নামিয়ে নিল। ঠুঠা কাঁটা-ঝোপের আড়াল সরিয়ে বাইরে বেরুতেই সে লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে আস্তে আস্তে নামতে লাগল পাহাড় বেয়ে। ঠুঠা তার দিকে চেয়ে বলল, বাইগিনের আজ্ঞা! ভালই হবে বউ! কালা-বাঘের বউ, কালি-ভালকিন।
ভালুকনি তার দিকে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে ভাল করে চেয়েই আবার মিলিয়ে গেল জঙ্গলে।
এসব কি সত্যি? না, স্বপ্নই?
আহা! কী রূপ। নাঙ্গা বাইগিনের! নরম, সাদা আলোয় ভরে গেছিল যেন অন্ধকার ঝড়-জলের রাত। তাঁর গায়ে কদম ফুলের গন্ধ ছিল। হাসছিলেন যেন দেবী।
গুহার বাইরে এসেই আবার দু’ হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে ফেলল ঠুঠা। ভয় হল একটু। এবার কি সত্যি তার মরার সময় হল? দেব-দেবীর দর্শন মানেই তো মৃত্যুর ঘণ্টা বাজা। স্বপ্ন, না সত্যি?
হঠাৎ ঝড়ে ঝরে-যাওয়া পাতার স্তূপের মধ্যে খচখচ শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখল ঠুঠা, একদল বুনো মোরগ চরছে সেখানে। উক্-কুঁক্-কুঁক্-কঁরর্-আঁ-আ- অঁর্র্ করে পায়ে পায়ে পাতা ওলট-পালট করে পোকামাকড় খুঁজে বেড়াচ্ছে। সকালের রোদ তাদের রঙিন পালকে জেল্লা লাগিয়েছে।
দেবী বলেছিলেন: চারটো কাল্চে কুক্রা দেবি।
কী হচ্ছে এসব! কি?
আগে ভালুকি। তারপর কুক্রাও এসে হাজির। যেন ভোজবাজি। তবে কি সত্যিই?
গা ছমছম করে উঠল ঠুঠা বাইগার। সকালের রোদ, ঝুপ করে ঠাণ্ডা মেরে গেল। ভীষণই শীত করতে লাগল ঠুঠার। ভয়ের জন্যই বেড়ে গেল শীত। বাইগিনের আদেশমতো নিঃশব্দে গুহাতে ফিরে গিয়ে বন্দুকটা থেকে বড় জানোয়ার-মারার সিসের বলটা বের করে, ঝুরি-সীসে ভরল নলে; গেদে গেদে। মুরগি মারার জন্যে। বারুদও বের করে নিয়ে নতুন করে ভরল বারুদ দু’ আঙ্লি কস্কে। বারুদের মুখে দিল সীসে। শেষে, টোপি চড়াল তার গাদা বন্দুকে।
ইচ্ছে করেই দেরি করছিল ও, মুরগিগুলো কী করে, তা দেখবার জন্যে। যদি সত্যিই নাঙ্গা বাইগিন্ই এসে থাকেন কাল রাতে, তাহলে ওই মুরগির দলের কোথাওই পালাবার উপায়টি থাকার কথা নয়। ওই একই জায়গায় ঠুঠার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে তাদের। ওদের মৃত্যুর ঘণ্টা তাহলে বেজে গেছে। দেখা যাক। পালায় কি পালায় না।
মনে মনে প্রার্থনা করছিল ঠুঠা, ও যখন গুহা থেকে বন্দুক হাতে বেরোবে, মুরগিরা যেন না থাকে ওখানে আদৌ। দেবদেবীর রোষ ও প্রসন্নতা দুই-ই সমান ক্ষতির। মাথা খারাপ হয়ে যাবে শেষে ওর? হয়ে যাবে, হয়তো বদ্ধ উন্মাদই! পৃথুর বাবার সেই দাদার মতো। ওর নিজের জাতের কোনও লোক এই অবস্থায় ওকে দেখতে পেলে কোনও ‘দেয়ার’কে দিয়ে মন্ত্র পড়িয়ে, পূজো চড়িয়ে; তার কী বিধান দেবে কে জানে! হয়তো বড্হাদেবের পায়ে বলিই দেবে নিয়ে গিয়ে তাকে। সকলকে বলবে, ভূতের ভর হয়েছে ওর ওপর।
ঠুঠা যখন বন্দুকটা ঠিকঠাক করে নিয়ে বাইরে এল, তখন ও চমকেই গেল একেবারে। মুরগির দলের পায়ে যেন সত্যিই কেউ আঠা লাগিয়ে দিয়েছে। ওই ঝরা-পাতার স্তূপের মধ্যেই একে অন্যের গায়ে লেগে ওরা পোকা খুঁটে খাচ্ছে ঘুরে ঘুরে। অথচ এতখানি সময়ের মধ্যে খাবার খুঁজে খুঁজে ওদের অনেকই দূর চলে যাবার কথা ছিল।
হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে রইল ঠুঠা।
দলের মধ্যে পাঁচটা ছিল কালো কুক্রা। এমন করে নিশানা নেবে ভাবল; যাতে এক ঘোড়ার দাবানিতেই অন্তত চারটে কালো কুক্রাই মরে, ঝুরি-সীসের ঝাপড়ে। এমন সময় হঠাৎই ময়ুরের ক্কেঁয়া-ক্কেঁয়া-ক্কেঁয়া তীক্ষ্ণ চিৎকারে বৃষ্টি-ভেজা রোদ-ঝলমল সুগন্ধি জঙ্গল চমকে উঠল। একটা সাপ ধরেছে ময়ুরটা, সামনের বেলগাছের নীচে। সাপটা ঠিক কোন্ জাতের বোঝা যাচ্ছে না। তার সোনালি আর কালো ডোরা রোদের সোনা আর বনের সবুজ আর ময়ুরের পাখার জেল্লা-দেওয়া বেগুনির মধ্যে মধ্যে ঝিকমিক করে উঠছে। সাপটা ছটফট করছে। তাকে টুকরো করে কাটছে ময়ূর মনোযোগের সঙ্গে, তীক্ষ্ণ ঠোঁটে।
বন্দুকটা আস্তে করে তুলে নিয়ে নিশানা নিল ঠুঠা। বন্দুক ওঠানো দেখেই, মুরগির ঝাঁকের কঁক্কঁকিয়ে উড়ে যাবার কথা ছিল, কিন্তু তারা ভ্রূক্ষেপও করল না। মুরগিদের দিকে চেয়ে ভাল করে নিশানা নিয়ে গুলি করল। লদকে পড়ল চারটে কালো এবং একটা লাল মোরগ ঝুরি-সীসের ছর্রা গুলিতে। বনে বনে হর্রা উঠল সম্মিলিত পাখি আর জানোয়ারদের। নেপালি ইঁদুরেরা উঁচু গাছের মাথার ডালে ডালে ঝাঁপাঝাঁপি করতে লাগল চিঁক্-চিঁচিক্-চিঁক করে। হনুমানের হল্লা-গুল্লা ওঠাল দূরের বনে হুপ-হপ-হুপ-হুপ করে সংক্ষিপ্ত গম্ভীর অনবরত ডাক ডেকে। ময়ূরটা, সাপটাকে দু’ পায়ে ঝুলিয়ে নিয়ে উড়ে গেল ভারী ভারী ডানায় সপসপ আওয়াজ করে।
সব শান্ত হয়ে গেলে, বন্দুক হাতে ঠুঠা বাইগা এবং পালক এলোমেলো-হয়ে-যাওয়া, বিভিন্ন ভঙ্গিমায় উল্টে পড়ে-থাকা মুরগিগুলোও ভোরের নিস্তব্ধতার ভাঁড়ারে সেঁধিয়ে গেল। একটা একলা মৌটুসকি পাখি ফিসফিস করে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে, সেই প্রভাতী বনের নিস্তব্ধতা আরও বাড়িয়ে দিল যেন হঠাৎই।
উঠল ঠুঠা; পুঁটলি আর বন্দুকটা নিয়ে। তারপর কী ভেবে, বন্দুকটাতে আবারও বারুদ গাদল, এবারও দু আঙুল। হুম্মচ্কে। যে সীসের বলটা আগে বের করে নিয়েছিল এবারে সেটাকে আবার সামনে ভরে নিল। তারপর নেমে এল গুহা থেকে, কালো পাথর টপকে টপকে, ভাল্লুকেরই মতো। ভালুকনি যে বউ হবে তার! নীচে নেমে, লতা ছিঁড়ে নিয়ে কুকরা পাঁচটিকে বাঁধল একসঙ্গে। কালো চারটে দিয়ে পূজো চড়হাবে বাইগিনের। আর লালটা ওর নিজের জন্যে। ঝলসে নিয়ে খাবে।
দু’ ক্রোশ পুবে যেতে বলেছিলেন নাঙ্গা বাইগিন।
ঠুঠা কি সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছে? যাবে কি ও? পুবে? নাঙ্গা বাইগিনের দেখা পাওয়ার পর তো কারওই বেঁচে থাকার কথা নয়। কী যে হল! কী যে হল ঠুঠা বাইগার জীবনের এই শেষ বিকেলে পোঁছে!
পেছন থেকে কোনও অদৃশ্য হাত যেন সামনের দিকে হঠাৎ ঠেলে দিল ওকে।
সূর্যটা ততক্ষণে দিগন্তজোড়া দেওয়ালেরই মতো পাহাড়-শ্রেণীর মাথায় উঠে এসেছে লাল-পাগড়ি পাহারাদারের মতো। একেবারে সূর্যর দিকেই মুখ করে, কাঁধের বন্দুকটাকে লাঠির মতো করে শুইয়ে দিয়ে, তার উপরে লতা-দিয়ে-বাঁধা মুরগিগুলোকে ঝুলিয়ে নিয়ে, অন্য হাতে পুঁটলিটা তুলে নিয়ে, রওয়ানা হল ঠুঠা, একেবারে সূর্যমুখী হয়ে। সূর্যের মধ্যেই সেঁধিয়ে যাবে বলে। বাইগিনের আদেশ! ভাবতে ভাবতে; গাছ-গাছালির ফাঁক-ফোঁকরের মধ্যে দিয়ে সূর্যর দিকে চেয়ে চলতে লাগল ঠুঠা।
দেখতে দেখতেই কি দু’ ক্রোশ চলে এল? একটা শিমুল গাছ! নাঃ। এত ছোট্ট শিমুল! তাছাড়া, দু’ ক্রোশ পথ বনের মধ্যে হাঁটতে সময়ও তো লাগে। এ তো আর হাটচান্দ্রার পিচ-রাস্তা নয়। অভ্যেসও চলে গেছে, এইসব পথে অনায়াসে হাঁটার। সব দিক দিয়েই এখন ঝুটা হয়ে গেছে ও।
এবার বাঁদিকে গভীর ঘন শাল বন। দিনের বেলাতেও অন্ধকার হয়ে আছে নিচটা। অনেকক্ষণ চলল তারই পাশে পাশে। শালবনের পরে একটা মস্ত ভোঁর ঘাসের মাঠ। একদল শম্বর চরছে সেখানে। দলে, দুটি শিঙাল আর পাঁচটি মাদিন। ওকে দেখতে পেয়েই দলটা ঘবাক ঘবাক করে চম্কে ডেকে উঠেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। কোনও শিশি থেকে ছিপি একটানে খুললে যেমন এক ধরনের হঠাৎ-আওয়াজ হয়, শম্বরদের ডাকটা অনেকটা সেইরকমই মনে হয় ঠুঠার। প্রথমে ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েই পরে একই দিকে দৌড়ে যাওয়া শম্বরদের ঘন খয়েরি আর পাটকিলে রঙের মোটা-লোমে মোড়া শীতের পোশাকের দিকে কয়েক মুহূর্ত অনবধানে চেয়ে রইল ও। অনবধানে; কারণ বাইগিন এদের কথা বলেননি কিছুই। খুরে খুরে খটাখট আওয়াজ তুলে দৌড়ল ওরা, বাইসনদেরই মতো শব্দ করে; পালাবার সময়।
মুখ ঘুরাতেই হঠাৎই চোখে পড়ল শিমুলটা। মস্ত শিমুল। ভিজে সকালের সূর্যকে যেন মুকুটের মতো মাথায় পরে দাঁড়িয়ে আছে আকাশ জুড়ে। দু’পাশে টান টান করে সমান্তরালে ডাল ছড়িয়ে দিয়েছে, যেন প্রভাতী-ব্যায়াম করছে কোনও ধবধবে ফর্সা মিলিটারি জওয়ান।
থ মেরে গেল ঠুঠা। ওর হাঁটু দুটো কাঁপতে লাগল থরথর করে। কাঁধে রাখা বন্দুক থেকে পিছ্লে, নীচে পড়ে গেল লতা-বাঁধা মুরগিগুলো। থেব্ড়ে বসে পড়ল ও ভিজে ভোঁর ঘাসে ভরা মাটিতেই। এইই তো! এইই তো সেই শিমুল! এ তো তাদের বানজারিরই শিমুল! হ্যাঁ, ঠিকই ত! কিন্তু বাইগিন তবে যে বললেন, এই শিমুলে পুজো আর পাথর চড়ালে তবেই শিমুল তাকে হদিস দেবে?
আরে! এ তো পেয়েই গেছি। একি! তবে? শিমুল কি এমনিতেই প্রসন্ন আছে ঠুঠার উপর?, না না কথা এবারে রাখতেই হবে। সব কথাই রাখতে হবে এইবারে।
ঠুঠার কপালের শিরায় শিরায়, হাত পায়ের ধমনীতে ধমনীতে রক্ত দৌড়ে বেড়াতে লাগল জংলি-ইঁদুরের মতো। কী করবে এবার, ভাবতে লাগল ঠুঠা। ঠিক সেই সময়ই তার ডান দিক থেকে একটি লাল কোট্রা হরিণ ডেকে উঠল, ব্বাক্! ব্বাক্! ব্বাক্!
চমকে চাইল ও। শিমুলের ফুল ধরতে এখনও অনেকই দেরি। শিমুল ফুল খেতে ভালবাসে এরা। কিন্তু এখন?
আশ্চর্য! কোটরাটাও নড়ল না। ঠুঠার দিকে মুখ করে ডাকতে লাগল, মুখ উঁচু করে, লেজ নেড়ে নেড়ে।
হাসল ঠুঠা, মনে মনে। বাইগিনেরই দয়া! সারা জীবন জঙ্গলে কাটাল, এমন রকমসকম দেখেনি কোনও কোটরার কখনও। বন্দুকটা তুলে ধরল লাল হরিণটার দিকে।
সেটা আবার ডাকল, ব্বাক্ ব্বাক্ ব্বাক্।
কে যেন, তার পায়েও আঠা লাগিয়ে ভোঁর ঘাসের কিনারের পাথরের সঙ্গে সেঁটে দিয়েছে পায়ের খুরগুলোকে। কোট্রাটা দৌড়ে পালাতে গিয়েও যেন পারছে না। গাড়ির ব্রেক কষলে যেমন চার-চাকায় দাঁড়িয়ে-পড়া হঠাৎ-থামা গাড়িটার শরীর সামনে উছ্লে যেতে চায়; তেমন করেই ওর শরীরটাও উছ্লে যেতে চাইছে।
ঠিক ঘাড় আর বুকের মাঝামাঝি নিশানা নিয়ে ঘোড়া টেনে দিল ঠুঠা। একবার ছল্কে উঠল কোট্রাটা উপরে, এবং সেই মুহূর্তেই কোন অদৃশ্য হাত যেন তার পা চারটিকে আলগা করে দিল। পরক্ষণেই ছড়ানো-ছিটানো কালো পাথরের উপর আছড়ে পড়ল লাল হরিণটি। জিভটা হঠাৎ-আঘাতের আকস্মিকতায় বেরিয়ে গেছিল। দাঁতে ধরা ছিল সেটা।
ঠুঠা এবার ছুরিটা কোমর থেকে খুলে, এগোল। তার শরীরে কে যেন হঠাৎই অসুরের বল জোগাল। কোট্রাটাকে তুলে নিয়ে এল শিমুলতলিতে। কালো কুক্রা চারটেকেও আনল। তারপর সকলের গলা কেটে কালো কুক্রার আর লাল কোট্রার জবা-লাল রক্তের সিঁদুর দিয়ে লেপে দিল বাইগিনের স্বপ্নাদেশের শিমুলের সারা গা। লেপে দিল গুঁড়িতে, গুঁড়ির সব খোপগুলোতে। লেপে দিল যতদূর হাত পৌঁছায় ওর, ততদূর অবধি। যত রক্ত ছিল লাল হরিণের আর কালো কুক্রার সবই নিঃশেষে শুষে নিল সেই ভয়ংকর পিপাসার গাছ। রক্ত যখন লাগাচ্ছিল হাত দিয়ে তখন গাছের অদৃশ্য অসংখ্য খরখরে জিভগুলো ঠুঠার হাতে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। জ্যান্ত, পিপাসী জিভের গাছ।
গাছটার পেছনেই নদী ছিল একটা। তার কুলকুলানি আওয়াজ ভেসে আসছিল অনেকক্ষণ থেকেই।
হাত-পায়ের রক্ত ধোবে বলে, নদীর দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতেই নদীর পাড়ে পৌঁছে চমকে উঠল ও। চিৎকার করে উঠল উল্লাসে। এ তো তাদেরই বান্জার। তার ছেলেবেলার বান্জার। প্রিয় সখা। সেই বড় বড় কালো পাথরগুলো নদীর মধ্যে দু’ পাড় থেকে ঝুঁকে পড়া প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড চাঁর গাছগুলি। নদীর মধ্যের পাথরগুলোর মাথাগুলিই জেগে থাকে শুধু বর্ষায়। হেমন্তর প্রথম থেকে ওদের কালো কালো গা বের করতে থাকে ওরা, গ্রীষ্মের শেষে অবশ্য সমস্তটুকু গা-ই বেরিয়ে পড়ে। ডান দিকের মস্তবড়, কালো, চ্যাটালো পাথরটার উপরই বহুদিন আগের এক নির্জন গ্রীষ্ম-দুপুরে ঠুঠা বাইগা তার জীবনের প্রথম নারীকে অনাবৃত করে, শুইয়ে ফেলে, তার দু’ ঊরুর মাঝের স্বাদু, নিভৃত এলোকেশি রেশমি নম্রতার স্বাদ নিয়েছিল। গরম বালির মধ্যে ছটফট-করা তিতিরের মতো, এক তীব্র, প্রায়-প্রাণঘাতী অস্বস্তিতেই ভরে গেছিল ওর সমস্ত শরীর। তার সঙ্গিনীরও রকম-সকম দেখে অনভিজ্ঞ, প্রথম-যৌবনের ঠুঠার মনে হয়েছিল, মেয়েটা মরেই গেল বুঝি। আনন্দেও যে মরণ হতে পারে, জানা ছিল না…। সেই ছট্ফটানিটাই এত বছর পরে অসংখ্য গ্রীষ্ম-দুপুর পেরিয়ে আবার ফিরে এল ঠুঠার শরীরে, এই শীতের সকালে। জামা-কাপড় খুলে ওই ঠাণ্ডা জলেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তারপর সাঁতরে গেল সেই পাথরটারই উপর। উপুড় হয়ে শুলো তার বুকের উপর। তার সঙ্গিনীকে কল্পনা করল; যেন সেও আছে তার সঙ্গে।
তারপরই খলখল করে হেসে; উঠে বসল ঠুঠা।
হাসির শব্দে চলকে-চলা জলের বেগ বাড়ল, রোদের আয়না চমকে জল থেকে উঠে লাফিয়ে গেল চাঁরগাছের পাতায় পাতায়।
হাসছিল ঠুঠা। অনেক অনেকদিন পর হাসছিল ও কেঁপে কেঁপে। যা চলে যায় তা আর ফেরে না; মন, শরীর; তীব্র সব অনুভব। থেকে যায় স্মৃতি; শুধু স্মৃতিই; এই মৌন অনড় কালো পাথর আর চল্কে-চলা নদীর চলমান গায়ে লেখা কত কথাই যে মনে পড়ছিল! শিকড়-পাওয়া ঠুঠা, খুশিতে বেহিসেবি হয়ে উঠেছিল।
চাঁর গাছের মিষ্টি ছায়ায় উচ্ছল নদীর মধ্যের কালো পাথরের উপরে যে সঙ্গিনীর সঙ্গে নিঃশেষে শরীর জীবনে প্রথমবার ভাগাভাগি করেছিল একদিন, সেই সঙ্গিনী তার বুড়ি হয়ে গেছে। দেখা হয়েছিল বছর কয়েক আগে। সাদা চুল, ফোকলা দাঁত, কোলে নাতি, গায়ের চামড়া কুঁচ্কে গেছে, অমন বুক দুটি ঝুলে পড়েছে বাড়ির চাল থেকে ঝোলা লাউকির মতো। ছিঃ ছিঃ। যৌবনের আয়ু কী যে কম! কিচুল রাজার জাত, কচ্ছপদেরও বড়হাদেব কত দীর্ঘ আয়ু দিলেন। তার বদলে মানুষের যৌবনের আয়ু যদি বাড়িয়ে দিতেন কিছুটা, বেশ কিছুটা; কী ভালই না হত তাহলে!
অনেকক্ষণ ধরে চান সেরে বড় খুশি মনে পবিত্র হয়ে গাছতলায় ফিরে এল ঠুঠা। ঠিক করল, এবার একটু ছাতু খেয়ে নেবে। ওর নিজের কুক্রাটাকেও পাতা-টাতা চাপা দিয়ে রাখবে কোনও গাছতলায়, যাতে একটু পর বা রাতের বেলা ঝলসে নিতে অসুবিধা না হয়। খেয়ে নিয়ে, তারপর পাথর এনে এনে জড়ো করতে হবে গাছতলায়, আর অনেক লতা; শক্ত দেখে। তারও পর, এক একটি করে পাথর বয়ে গাছের উপরে চড়ে তাদের ডালে ডালে বেঁধে ঝুলিয়ে দিতে হবে।
ঠুঠা একবার কয়েক পা পেছনে হেঁটে এসে শিমুল গাছটার দিকে তাকাল ভাল করে। ঈরেঃ। বাবাঃ। কত উঁচু! কত যে ডাল ছড়িয়েছে সে দু’পাশে টান টান। কত বছর লাগবে তা একা একা এই গাছকে পাথর দিয়ে মুড়তে? পারবে?
গাছটার মগডালে একটা গোলাপি-গলার জঙ্গুলে শকুন বসেছিল। ঠুঠাকে দেখে সে ডানা দুটো মেলল একবার। আবার বন্ধ করল। নিজের মনে কি যেন বলল, কুৎসিত কর্কশ ভাষায়। অনেকক্ষণ রক্তে-লাল-গাছটার মাথার দিকে এবং শকুনটার দিকে চেয়ে থাকল ঠুঠা। ওর মুখ আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে এল। তারপর দু’ চোখ বেয়ে অঝোরে জল ঝরতে লাগল। উপরের দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল সে। নাঙ্গা বাইগিনের স্বপ্নের মানে বুঝতে পারল। এই প্রাচীন শিমুলের ডালে ডালে পাথর বাঁধতে বাঁধতেই জীবনের বাকি দিন কটি শেষ হয়ে যাবে। হয়তো তার অনেক আগেই উপরের কোনও ডাল থেকে নীচের পাথুরে মাটিতে হাত বা পা ফসকে পড়ে ফওত্ হয়ে যাবে ও। তার মুখ থেকে ছিটকে-ওঠা রক্ত, সিঁদুর হয়ে লেগে থাকবে বুড়ো-শিমুলের কাণ্ডে।
তারও পর শকুন। সে তো আছেই! সঙ্গে তার বন্ধুরাও আসবে।
কিন্তু পৃথু? পৃথুর প্রতি যে ঠুঠার এখনও অনেক দায়িত্ব কর্তব্য আছে বাকি!
আবারও মেঘ করে এল। হচ্ছেটা কী? কালকের মতো আজও কি দুর্যোগ হবে? এই অসময়ে?
ঝুরঝুর করে শুকনো শালপাতা উড়িয়ে গড়িয়ে ঝাঁট দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে হাওয়াটা। হলুদ, লাল, খয়েরি, সবুজ, গাঢ়-সবুজ সব পাতারা হাত ধরাধরি করে গিয়ে জঙ্গলের শাড়ির পাড়ের মতো জমা হচ্ছে এক জায়গায়; আবার একটু পরই সরে যাবে বলে।
কে যেন ঠুঠার মাথার মধ্যে বলল, নাঙ্গা বাইগিনের আদেশ শিরোধার্য। ঠুঠা বাইগা, তুমি ভুলে যেও না যে, তুমি একজন বাইগা। গোন্দ, বাইগা, অবুঝমার পাহাড়ের মারিয়ারা শহরের মানুষ নয়। শহরের মানুষরা তোমাদের কেউই নয়। তোমরা ওদের মতো হতে যেও না, ওরাও তোমাদের মতো হতে চায় না যেন। অত সহজে কি অন্য কিছু হওয়া যায়? বড় ভালবাসা লাগে তাতে। অত ভালবাসা কি সকলের বুকে থাকে?
কিন্তু পৃথু যে আমার সন্তানেরই মতো, ভাবল, দ্বিধাগ্রস্ত ঠুঠা। অনেকেই যে ভালবাসি তাকে।
হাওয়াটা শনশন করে বলে উঠল, পারবে? সেই সন্তানকে এনে এই শিমুলের নীচে বলি দিতে? সিঁদুর চাই যে! অনেক সিঁদুর। রক্ত। টাটকা, লাল; গরম রক্ত।
দু’কানে হাত চাপা দিয়ে মাটিতে ধ্বপ্ করে বসে পড়ল ঠুঠা। বড় যন্ত্রণা মাথার মধ্যে। দু’ কানের পাশে। পিপাসা বড়। পাগল হয়ে যাবে, পাগল হয়ে যাচ্ছে ঠুঠা। ঠুঠা দেখতে পাচ্ছে, নাঙ্গা বাইগিন্ শালবনের ছায়াচ্ছন্নতার মধ্যে দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে আসছেন। ঠুঠার দিকে আঙুল তুলে কী সব বলছেন। ময়ূর ডেকে উঠল চারপাশ থেকে জোরে জোরে। ময়ূর, মেঘ বড় ভালবাসে। ভালবাসে সাপ। সাপখেকো ময়ূর। ঠুঠা কি পৃথুকে খাবে!
অনেকক্ষণ পর যখন চোখ খুলল, ওর জ্ঞান হল, শুনল, বড়কি ধনেশ পাখিদের মেলা বসেছে। একটা কুচিলা (নোক্সভোমিকা) গাছে। আর তারা স্বগতোক্তি করছে ‘হঁক্ হঁক্ হ্যাঁক্কো হঁক্। দুপুরে গড়িয়ে গেছে সকাল। মেঘ, গাঢ় হয়েছে আরও। ধড়মড় করে উঠে বসল ও। এখনও অনেকই কাজ বাকি। ঠুঠা বাইগার কাজ সবে তো শুরু হল।
কবে…? কে জানে শেষ হবে কবে। হবে কি?
এমনি ঘোরের মধ্যেই কেটে গেল সারা দিনটা। একবার ঘুম একবার জাগা, একবার জাগা একবার ঘুম এই করে। মেঘ জমতে লাগল পরতে পরতে আকাশে। ক্রমাগত গাছে উঠে আর নেমে দাঁতে করে লতা আর হাতে করে পাথর বয়ে বয়ে বড় ক্লান্ত হয়ে গেল ঠুঠা। শেষ বিকেলে বৃষ্টিও নামল তুমুল। মেঘ গর্জাতে লাগল, ঘনঘন বিদ্যুৎ চম্কাতে লাগল। ওই শিমুলেরই নীচে গুড়িসুড়ি মেরে বসে রইল ঠুঠা। গাছে হেলান দেওয়ার সাহস হল না। দেবীর গাছ। যদি চটে ওঠেন বাইগিন্? দু’ হাঁটুর মাঝে মুখ গুজে ঘুমিয়ে পড়ল ক্লান্তিতে।
বৃষ্টি কখন থামল জানেও না ও। যখন ঘুম ভাঙল তখন চোখ মেলে দেখল, রাত হয়ে গেছে। আকাশ পরিষ্কার হয়ে নবমীর চাঁদ উঠেছে। বৃষ্টি-ভেজা বন পাহাড় চকচক করছে রূপোঝুরি আলোতে আর নদীর ওপার থেকে পাহাড়ের খোলে কারা যেন গান গাইছে। মাদল বাজছে। বাজছে ধামসা। সঙ্গে ধুমসো ছেলে আর ধুমসি মেয়েরা কার্মা নাচছে আর গান গাইছে।
ঠুঠার শ্লথ মস্তিষ্কের মধ্যে হঠাৎ যেন রক্ত চলাচল শুরু হল। গানের সুরটি চেনা-চেনা ঠেকল ওর কানে। বৃষ্টি ভেজা চাঁদের পাহাড়ে আর জঙ্গলে ধামসার শব্দ আর গানের কলিগুলি ছুটোছুটি করে বেড়াতে লাগল, পিছলে যেতে লাগল চাঁদের আলোরই মতো জল-পাওয়া মাটির আর গাছ-পাতার গায়ের সোঁদা-সোঁদা গন্ধের মধ্যে। ঘোর লেগে গেল ঠুঠার। গানের কথাগুলো এবার পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে ও।
আরে! এ গান তো শুনেছে ও আগে। এ গান তো বানজার বাম্নি-গ্রামে দেবী সিং-এর সঙ্গে সে শুনেছিল।
তবে? এই শিমুলটা এত কাছে ছিল, অথচ এতদিন এত ঘোরাঘুরি সত্ত্বেও তার চোখে পড়ল না। পড়ল না দেবী সিং-এর তীক্ষ্ণ চোখেও? কতদূরে হবে বান্জার-বাম্নি গ্রাম এখান থেকে? একবার ভাবল, যায় ওই শব্দ লক্ষ্য করে। তারপরই মনে পড়ল যে, ও দেবীর আদেশে এখানে এসেছে। অন্য কারও সঙ্গেই দেখা করার উপায় নেই ওর এখন। ও এখন দেবীর বন্দী। বাইগিন্-এর দাস। দেবী যখন দয়া করেছেন সেও দেবীর আদেশ পুরোপুরিই মানবে। কথার খেলাপ করবে না কোনও। আদেশ মানার আগেই দেবী তাঁর গ্রামকে ফিরিয়ে দিয়েছেন তাকে সে তো আর শহরের মানুষের মত অকৃতজ্ঞ বা কৃতঘ্ন নয়! সে বেইমানী করবে না। ফেরারী আসামীর মতো জঙ্গলেই সে লুকিয়ে থাকবে, যতদিন না এই বুড়হা শিমুল পাথরের ভারে নত হয়। এর মধ্যে যদি বাইগিন আবার দেখা দিয়ে অন্য আদেশ দেন তো অন্য কথা।
গানের কলিগুলো ভেসে আসছিল চাঁদ-ভেজা নদী-বন পিছ্লে পরিষ্কার।
চলো সাজা-তেরিকা ডাবারি ছিছেলো যাবওওওও….
পরশা ভাদারি মারে হুদারি লাগোদারি
চলো টুরি কার্মা নাচালে খারানা যাবওওওও…
মেয়েরা বলছে:
রাত ভরা কার্মা নাচাইলে
দিনাকে উগত্মোলা ছট্টি দেই দেরি
হাম যাব, ঘরা ভাগি যাবওওওও…
ছেলেরা বলছে:
রাত ভরা কার্মা নাচায়োঁওওওও
দিনাকে উগত্টুরী ঘর লায়ি যাওওওও…
এই বন, পাহাড়, এই কার্মা নাচের গান, এই রাতের নদীতে পাহাড়ী-মাছের ঘাই-মারার শব্দ, ঘাই হরিণীর ভয়-পাওয়া ডাক, শিশির পড়ার ফিসফিসানি, বুনো ফুলের গন্ধ, এইসব ছেড়ে কী করে যে ছিল এত বছর হাটচান্দ্রা শেল্যাক্ কোম্পানির আলো-ঝলমল কারখানায়; ভাবলেও নিজের উপর ঘেন্না হয় ঠুঠার। একজন মানুষের বেঁচে থাকার সব কিছু উপাদানই তো বাইগিন্ হাতের কাছেই জুগিয়ে রেখেছিলেন। কেন যে লোভী মানুষ আনন্দ ছেড়ে আরামের পিছনে ছুটল, শান্তি ছেড়ে সুখের পিছনে; কে জানে তা!
লেখাপড়া শেখাই মানুষের কাল হয়েছে।
আহা! কী করে যে ভুলে ছিল এই জীবনকে ঠুঠা এতদিন! এই গ্রাম, এই বান্জার, নদী, এই বৃষ্টির পরের আশ্চর্য শান্তির রাতকে!
দুটো পেঁচা রুপোলি রাতের স্নিগ্ধ শান্তিকে ছিঁড়ে ফালা ফালা করে ঝগ্ড়া করতে করতে উড়ে এল একেবারে শিমুলের মাথারই উপর; কিঁচি-কিঁচি-কিঁচি- কিঁচর্-কিঁচর্- কিঁচি-কিঁচর্…। শিমুলের মগডালে, দিনের বেলায় যেখানে গোলাপি-গলার জংলি শকুনটা বসেছিল, সেখানে বসে একটি ময়ূর চাঁদ-ভেজা বন পাহাড়কে চমকে দিয়ে কর্কশ গলায় ডেকে উঠল ক্কেঁয়া-ক্কেঁয়া-ক্কেঁয়া। তার ডাককে চাঁদ-চকচক ভোঁর ঘাসের মাঠ থেকে তুলে নিয়েই বনে বনে ছুঁড়ে দিল পশ্চিমের আধো-আলো আধো-ছায়ার রহস্যে ভরা ঘন শালবনের কালো গভীর থেকে একটা লাল কোটরা: ব্বাক্-ব্বাক্-ব্বাক্-ব্বাক্ করে।
বাঘ বেরিয়েছে। রাতের রোঁদে। বনের রাজা। একা একা। যে-রাজা ঘর জানেনি, কোনও রানীরই একান্ত হয়নি কোনওদিন, অপত্য স্নেহের ফালতু বাঁধনে যে কখনও বাঁধেনি নিজেকে। যে চিরদিনের একা, দোকা, শুধু অল্পক্ষণেই। যে পুরুষের সংজ্ঞা। বেশিক্ষণ, বেশিদিন মাদিনের কাছে। থাকলে যে মদ্দাও মাদিন হয়ে যায়। পুরুষকে নষ্ট করে দেয় নারী! চিরদিনই নষ্ট করেছে।
কত্তদিন বুনো বাঘের গন্ধ নেয়নি নাকে! কত্তদিন!
ঠুঠা ভাবল, বাঘ যদি কাছে আসেই তবে তাকে পাশবালিশ করে আজ রাতে শুয়ে থাকবে শিমুলতলিতে। বড় বাঘের মতো কোলবালিশ আর হয় না। যেন, বাইগিনেরই বরাত দিয়ে বানানো।
নদীপারের পাহাড়ের খোলের গ্রামে এখন মহুয়ায় মাতাল হয়ে উঠেছে ছেলেমেয়েরা। ধামসাতে চাঁটি পড়ছে জোরে জোরে, এলোমেলো-হওয়া হাতে। তাদের গান হয়েছে আগের থেকে আরও জোরদার। ছিপছিপে মেয়েগুলোর গলার শিরাগুলি তাদের গলার রুপোর গয়নার ফাঁকে ফাঁকে গানের তোড়ে ফুলে ফুলে উঠছে এখন, গ্রীষ্ম-দুপুরের তৃষিতা তিতিরের গলার শিরার মতন। না-দেখেও, দেখতে পাচ্ছে ঠুঠা বাইগা। শুনতে পাচ্ছে ওদের গান:
দিনাকে উগত্মোলা ছট্টি দেই দেরি
হাম যাব, ঘরা ভাগি যাবওওওও…
হাম যাব, ঘরা ভাগি যাবওওওও…