2 of 2

৬০. সীওনীতে এসে অবধি স্কুলটাই দেখা হয়নি

৬০

সীওনীতে এসে অবধি স্কুলটাই দেখা হয়নি।

দিসাওয়াল সাহেব বলে গেছিলেন যেন একবার অবশ্যই যায় পৃথু। উনি ফিরে আসার আগেই। কাল খবর পাঠিয়েছিল স্কুলে যে, আজ যাবে।

বিগু নাস্তা বানাচ্ছিল। আজ তাড়াতাড়ি নাস্তা এবং দুপুরের খাওয়া সেরে ওরা সকলে মিলে হাটে যাবে। ঠিক আছে এই রকম।

যে কোনও জঙ্গুলে-পাহাড়ি জায়গার চরিত্র বুঝতে হলে তার হাটে গেলেই চলে। হাটই স্টক-এক্সচেঞ্জ, যাত্রা-থিয়েটার, ক্লাব; সবকিছুই। হাটের গায়ের গন্ধেই সেই জায়গায় পুরো পরিবেশটি ধরা পড়ে। সবচেয়ে ভাল জামাকাপড়ে সেজেগুজে নারী পুরুষ সবাইই হাটে যায়। যাদের সঙ্গে রোজই ছেঁড়া ময়লা ধুতিতে আর শাড়িতে দেখাশোনা হয়, তাদের কাছেই একেবারে অন্য মানুষ হয়ে পৌঁছতে চায় সেদিন সকলেই। নিম অথবা করৌঞ্জের তেল মেখে মেয়েরা চকচকে হয়ে ওঠে। তাদের কাটা-কাটা নাক-চোখকে তখন গর্জন তেল মাখা, কৃষ্ণা, কোনও দেবীর মুখ বলেই মনে হয়।

পৃথুর ভুলও হতে পারে।

নাস্তা এনেছিল বিগু বারান্দাতেই। এখানে তো আর রুষা নেই! মেরীও নেই। ভারত একেবারেই স্বাধীন। বারান্দায় বসেই নাস্তা করছিল ও। কাল রাতে ভাল ঘুম হয়নি। কুর্চি আর টুসুকে স্বপ্ন দেখছিল। অনেকক্ষণ ধরে। আশ্চর্য! কুর্চি নাকি সীওনীতেই আছে! অথচ, এসে অবধি তার সঙ্গে দেখাই হল না। এত ছোট্ট জায়গাতেও! অবশ্য তার খোঁজ করার কোনও চেষ্টাও পৃথু করেনি। কেন যে করেনি, তা ও নিজেও ঠিক জানে না। আসলে, হাসপাতাল থেকে হাটচান্দ্রাতে ফিরে আসার পর নানা ঘটনা পরম্পরায় পৃথু মানুষটাই বদলে গেছে অনেক। যা একদিন তার কাছে পরম প্রার্থিত ছিল, আজ তাইই চরম ভীতির হয়ে উঠেছে। ভয়, ঠিক না করলেও; মেয়েদের সম্বন্ধে সাধারণভাবে ও উদাসীন হয়ে উঠছে।

ওই স্বপ্ন দেখার পরই ঘুম ভেঙে গেছিল মাঝরাতে। পাশের ঘরে ঠুঠা বাইগা আর ঢাকা বারান্দায় বিগু অঘোরে ঘুমোচ্ছিল। পৃথু এসে বাইরের বারান্দাতে বসেছিল বেতের চেয়ারে। ঘুম যদি না-আসতে চায়, তবে মিছিমিছি বিছানায় শুয়ে তার সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তি করায় বিশ্বাস করে না ও। নিশুতি রাত। সীওনীর পরিবেশটাই এমন যে মনে হয় কোনও বনের গভীরেই আছে বুঝি। বাংলোটা থেকে চারধারে চাইলে এটি যে বন-বাংলো নয় তা বোঝার মোটেই উপায় নেই। কিপলিং-এর মোওগলির দিন থেকে খুব একটা বদলায়নি বোধ হয় সীওনী।

বাইরে চৈত্রর বনের রাত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। দুটো পেঁচা উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে তাদের কিঁচি-কিঁচি-কিঁচর-কিঁচি-কিঁরে, ডাকে ঘূর্ণী হাওয়ায় পাকিয়ে ওঠা শুকনো পাতার মতো উপরে উঠে যাচ্ছে। ঘুমন্ত সাতপুরা পর্বতমালার গায়ে ওদের কর্কশ চিৎকার ধাক্কা খেয়ে ফেটে গিয়ে আবার ফিরে আসছে।

এমন এমন অনুভবের রাতে মনের ভিতরে যেমন, তেমন প্রকৃতিতেও নানা দীর্ঘ ও হ্রস্ব ছায়া নড়ে চড়ে। এই গা-ছম-ছম নানা দৃশ্যরই মতো, অবচেতনের এবং রাতের অন্ধকারের অন্ধকারতর ঝোপ-ঝাড়ের অভ্যন্তর থেকে অনেক কিছু শব্দ ও দৃশ্যই উঠে আসে; না উঠেই।

অন্ধকারে একটা মস্ত শঙ্খচূড় সাপ রাস্তার ওপাশের বুড়ো পিপ্পল গাছের ছায়ার গভীরের অন্ধকার গহ্বরে মধ্যরাতের টহল সেরে ফিরে আসছিল। নিঃশব্দে সে অবশ্য আসতে পারেনি। তার ভারী মসৃণ বুকের চাপে লাল হলুদ খয়েরী আর ন্যাবা-রঙা পাতারা নরম মুচমুচানি তুলে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। তার দীঘল পিছল ঠাণ্ডা শরীরটাকে সে আস্তে, খুবই আস্তে গহ্বরের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছে, মাথা আগে করে। লেজটা অদৃশ্য হতে, মনে হচ্ছে যেন তার খোলসেরই মতো হঠাৎই ছেড়ে রেখে সে পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে গেল। গহ্বরের ভিতরে ঢুকে তার নিজের নগ্নশরীরের সুগন্ধে বুঁদ হয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল, আদর-খেয়ে ওঠা কোনও যুবতী নারীর মতো। গভীর অবসাদের আশ্লেষে।

অনেক দূরের ওয়াইনগঙ্গা নদীর শব্দ এখান থেকে শোনা যায় না। তবে দশ মাইলের মধ্যেও কোনও নদী থাকলে নদীর শিরা-উপশিরা মাটির আর পাথরের গভীরে গভীরে ছড়িয়ে যায়। জলের গন্ধ পাওয়া যায় দূর থেকে নারী আর ইলিশ মাছের গন্ধর মতো। বাংলোর সামনেই একটা কালভার্ট। এ পথে গাড়ি বা ট্রাকের চলাচল নেইই। পথটা আগে ছিল কানা। এখন অন্ধ হয়ে গেছে একেবারে। পুরোপুরিই মুছে গেছে, পাহাড়ের আঁচলে এসে, বাংলোর বাঁ দিকে। বাঁদিকটা পুরোই জঙ্গল আর একটা মাঝবয়েসী পাহাড়।

পাহাড় থেকে নেমে, রাতের কালো লালমাটির পথ বেয়ে লটরপটর করতে করতে চলে গেল ডানদিকে, যেদিকে দিসাওয়াল সাহেবের স্কুল বাড়ি। অন্ধকারে অন্ধকার অনুষঙ্গর মতো বসে-থাকা পৃথুকে দেখতে পেল না ও।

পৃথুর নিঃশব্দ আশীর্বাদ চিতাটার গায়ের চৈত্রর বনগন্ধমাখা মাথায় গিয়ে যে আলতো হাতে পৌঁছল তা সে জানতেও পারল না। পৃথু বলল, বাঁচো, বাঁচো। সকলে মিলে, মিশে—মিশে বাঁচো। পেঁচা, জঙ্গলী, ইঁদুর পোকা মাকড়, বাঁচো সাবীর মিঞা, ভুচু গিরিশদা, নুরজেহান, বিজলী সবাই বাঁচো। আকাশের তারারা যেন তাদের নীলাভ সবুজাভ দ্যুতিতে এই বাঁচার আশ্বাসই ছড়িয়ে দিচ্ছে রঙীন জলকণার মতো সকলের শিরে শিরে। বাঁচো। বাঁচো। সকলেই দারুণ ভাবে বাঁচো। ইতর বাঁচো, খল বাঁচো, ধূর্তও বাঁচো, ভালদেরই সঙ্গে।

ঠুঠা বাইগা ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরে যেন কী বলে উঠল। কে জানে? আবারও নাঙ্গা বাইগীনকে স্বপ্নে দেখল কি ঠুঠা?

হা হা হা রে বুক কাঁপিয়ে একটা হায়না হঠাৎ ডেকে উঠল পাহাড়তলি থেকে।

গা ছমছম করে উঠল পৃথুর। অতি বড় সাহসী লোকেরও কোনও কোনও নগ্ন নির্জন মুহূর্তে এমন গা ছমছম করে। এমন পরিবেশে যারা থেকেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই তা জানেন। নাস্তা শেষ করে চাটা খেয়েই, উঠে পড়ল পৃথু।

হাট লাগবে দশটা থেকেই। কিন্তু জমতে জমতে সেই বেলা একটা দেড়টা।

পৃথু বলল, আমি আর বাংলোয় ফিরব না। হাটেই যা হয় খেয়ে নেব। তোমরা দুজনে খেয়ে দেয়ে এসো ঠুঠা। স্কুল থেকেই পৌঁছে যাব আমি সোজা। একটা-দেড়টা নাগাদ।

স্কুলটা ওর বাংলো থেকে আধ-কিমির চেয়েও কম পথ। হেঁটে চলল পৃথু সকালের রোদে, গাছ-গাছালির ছায়ায় ছায়ায়। সেভেন-সিসটারস পাখিরা লাফিয়ে লাফিয়ে এক্কা-দোক্কা খেলছে পথের দুপাশের ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে। প্রজাপতি উড়ছে। বেশ লাগছে।

জবলপুরের হাসপাতাল থেকে সেদিন হাটচান্দ্রায় ফিরে রুষার আলো-না-জ্বলা, জানালা-বন্ধ বাংলোটাকে, ভুচুর জীপে বসে দেখামাত্রই পৃথুর বুকের মধ্যে কে যেন তীক্ষ্ণ ছুরি বসিয়ে দিয়েছিল আমূল। ও ভেবেছিল, বাঁচা আর হল না এ জীবনে! রুষাকে ছাড়া, মিলি টুসুকে ছাড়া, ও বাঁচবে কী করে?

কিন্তু বেশ তো বেঁচে আছে। আজ, এই মুহূর্তে।

আসলে যে-কোনও মানুষেরই, বেঁচে থাকার জন্যে সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন, তা তার নিজেকে। নিজেকে নিজে একটু সময় না দিলে, ভাল না বাসলে, দিনান্তে আয়নার সামনে একবারও

দাঁড়িয়ে ভালবেসে নিজের মুখের দিকে না চাইলে তার অন্যর বা অন্যদের জন্যে প্রাণাতিপাত পরিশ্রম করার মানে হয় না কোনও। আসলে, প্রত্যেক মানুষের জীবনেই বোধ হয় সে নিজেই কেন্দ্রবিন্দু। সে আছে, তাইই তার চারধার ঘিরে অন্যান্য সব সম্পর্ক আছে। সেই সব সম্পর্ক না থাকলেও বা চুকে গেলেও একজন মানুষ দিব্যি সুখে বেঁচে যে থাকতে পারে, এই সত্যটা আবিষ্কার করে এখন পৃথু খুবই সুখী মনে করে নিজেকে। যা ঘটেছে, তা না ঘটলে জীবনটা একটা একঘেয়ে অভ্যেস, দৈনন্দিনতার ছাপে সাধারণ, সকালের গরম চা অথবা টাটকা ছাপা নিউজপ্রিন্টের গন্ধভরা খবরের কাগজের মতোই সামান্য হয়ে যেত।

আনন্দম। আনন্দম। আনন্দম।

নিজেই নিজেকে বলল, পৃথু।

স্কুল বাড়িটার গেটে ঢুকতে যাবে ও, এমন সময় দেখল ভিতর থেকে দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে গেটের সামনে তিনজন মহিলা দাঁড়িয়ে পড়লেন তাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে।

সকলেই হাতজোড় করে নমস্কার করলেন। বললেন, গুড মর্নিং ম্যানেজার সাব।

দাঁড়িয়ে পড়ে পৃথু ক্রাচ থেকে হাত তুলে নিয়ে বলল, পররনাম। গুড মর্নিং।

তারপর ওঁরা স্কুল বাড়ি ঘুরিয়ে দেখালেন পৃথুকে দেখিয়ে, অফিস ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। স্কুল আজ ছুটি। প্রতি হাটবারেই ছুটি থাকে। ছেলেমেয়েদের অনেক কাজ থাকে বাড়িতে।

পৃথু লজ্জিত হয়ে বলল, ঈসস। আজ স্কুল ছুটি তো আপনারাই বা এলেন কেন? আমি না হয়। কালই আসতাম।

ওঁরা বললেন, তাতে কি স্যার? ঠিক আছে।

একটি মেয়ে গোন্দ। ভারি মিষ্টি। অন্য দুজনের একজন রেওয়ার মেয়ে। অন্যজন ইন্দোরের। সকলেই গ্র্যাজুয়েট। আরও একজন আছেন। বাঙালি, উনি আজ ছুটি নিয়েছেন। স্কুলে হেড মিসট্রেস কেউই নেই। সকলেই সমান। সমান মায়না সকলের।

দিসাওয়াল সাহেব ছেলেমেয়েদের পণ্ডিত বানাতে চান না। শিক্ষিকারা জানালেন পৃথুকে। মোটামুটি ইংরিজি, অঙ্ক, আর হিন্দি শেখানোই উদ্দেশ্য। যাতে, মহাজনরা ওদের ঠকিয়ে কাঠ বা বিড়িপাতা বা লাক্ষা না কিনতে পারেন। যা এখানে শেখানো হবে, তাতে লেখাপড়ার জগত সম্বন্ধে একটা ঔৎসুক্যই জাগিয়ে তোলা হবে শুধু। এই মাত্রই। তারপর যদি কোনও ছাত্রছাত্রীর ভাল লাগে আরও বেশি পড়তে এবং সে যদি মেধাবী হয়, তবে দিসাওয়াল সাহেবই তাদের জবলপুর বা নাগপুর বা রাইপুর এবং ভোপালের স্কুলে পড়ার বন্দোবস্ত করে দেন। হস্টেলে থাকার সব খরচও দেন। বইপত্রও কিনে দেন।

ঔৎসুক্য জাগিয়ে তোলাটাই তো আসল। “দ্যা পারপাজ অফ আ উ্যনিভার্সিটি ইজ টু ব্রিং দ্যা হর্স নিয়ার দ্যা ওয়াটার অ্যাণ্ড টু মেক ইট থারস্টি!”

কোথায় যেন পড়েছিল কথাটা পৃথু!

দিসাওয়াল সাহেবের মতো অনেকই ব্যবসায়ীর দরকার ছিল এই দেশে। ভাবছিল পৃথু। সকলেই সব দোষ ও দায় সরকারের ঘাড়ে চাপিয়েই খালাস। নিজেদেরও যে কিছু করার ছিল সে সম্বন্ধে ভাবেন কজন মানুষ?

ওঁরা বললেন, ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে দুটি বাঙালী ছেলে এবং একটি বাঙালী মেয়েও আছে। বিড়িপাতার কোম্পানীর কেরানী আর স্টোরসবাবুর ছেলেমেয়ে তারা। তাদের বাংলা পড়ান মিসেস কে রায়। বাঙালী!

মিস কে রায়ের পুরো নামটি জানার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও জানা গেল না। জিজ্ঞেস করতেও লজ্জা করল খুবই। এক সময় স্কুল-ইনস্পেকটরের মতো ইনসপেকশান সেরে পৃথু হাটের দিকে এগোল।

পথেই অ্যাকাউনট্যান্ট টিবরেওয়ালের সঙ্গে দেখা। সঙ্গে আরেকজন মোটা-সোটা ভদ্রলোক। আলাপ করিয়ে দিল টিবরেওয়াল। বলল, আমার সাড়ুভাই। জবলপুরে চালের ব্যবসা আছে। বেড়াতে আর ব্যবসার ধান্দা করতে এসেছে এখানে।

কী ব্যবসা? বিড়ি পাতার না লাক্ষার? কাঠের ব্যবসা তো এখন ফরেস্ট করপোরেশান একচেটে করে ফেলেছেন।

না। না। সে সব নয়। লেগে গেলে, আমিও পার্টনার হব সাড়ুভাই-এর।

পৃথু বলল, সারি দুনিয়া একতরফ ঔর জরুকি ভাই এক তরফ’ এই রকম কি একটা কথা আছে না? তা ভায়রাভাইও যে এমন ইম্পর্ট্যান্ট লোক তা আপনাকে দেখেই জানছি।

করি কী? জরুর ভাইই যে নেই। ওরা মোটে বারো বোন।

বলেন কী? বারো বোন?

মনে মনে বলল, সাবির সাহেব শামীম সাহেবদের টেককা দিলে আপনারাই দিতে পারবেন।

ঔর ভি হলে তো ভাল হত। ফেমিলিতে যত মেম্বার বাড়বে তত বেশি ইনকাম ট্যাক্স ঔর ওয়েলথট্যাক্সের ফাইল ভি বাড়বে। ফেমিলির সেভিংস ভি বাড়বে। সোক্কোলে ভালো খাবে, ভালো পরবে। পরে, বেওসা কী ইনডাসট্রীভি বানাতে পারবে।

তা এখানে কোন ব্যবসা করবেন ঠিক করেছেন?

মহুয়া, নিম, আর করেঞ্জের সীড থেকে তেল বানাবো একস্ট্রাকশন প্লানট বসিয়ে লিয়ে।

এই তেল কারা কিনবে?

আররে ম্যানেজার সাব!

বলে তাচ্ছিল্যর দৃষ্টিতে তাকাল পৃথুর দিকে অ্যাকাউন্ট্যান্ট টিবরেওয়াল। বলল, সব শালা কিনবে।

সব শালা মানে?

টিবরেওয়াল বলল, যদি শেষমেস ফেক্টরী হয় ত হাটচান্দরা শেল্যাক ফ্যাক্টরী থেকে দু একজন লোক ভাগিয়ে আনতে হবে ম্যানেজার বাবু।

পৃথু জবাব না দিয়ে একবার তাকাল টিবরেওয়ালের মুখের দিকে। টিবরেওয়াল কি দেখল পৃথুর মুখে বুঝল না, কিন্তু ওর মুখটা হঠাই অপ্রতিভ দেখাল।

বলল, চলি ম্যানেজারবাবু!

যে শালাদের তেল-ফেলের সাবুনের কারবার আছে। কিনবে না কোন শালা?

এতদূর থেকে পাঠাবেন, ট্রান্সপোর্ট কস্ট বেশি পড়ে যাবে না? টিবরেওয়াল পৃথুকে অ্যাপ্রিসিয়েট করে তার পিঠে এক চাপড় মেরে বলল, সেইই তো হচ্ছে কোথারে ভাই! ট্রান্সপোর্ট কোস্টেই তো সত্যনাশ হোবে। সেইই তো হচ্ছে পোরেবলেম। ভাবতেছিলম কি, দুই সাড়ুভাইতে যুক্তি করে ইখানে একটা সাবুনের ফেকটরী বসিয়ে দিলে কেমোন হয়?

কেমোন হয় তা পৃথুর জানা ছিল না।

দূর থেকে হাটের কোলাহল ভেসে আসছিল। লাল ধুলোর মেঘ ঝুলে আছে চাঁদোয়ার মতো হাটের উপরে। গরু-মোষের গায়ের গন্ধ। কেরোসিন তেল, শর্ষের তেল খোল আর শুখা মহুয়ার গন্ধর সঙ্গে মিশে গেছে গুড় আর পাকৌড়া আর নারী পুরুষের গায়ের গন্ধ। এক একটি হাটের গায়ের গন্ধ একেক রকম। নারীর গায়ের গন্ধেরই মতো।

যাতে সহজে নতুন হাটে একে অন্যকে খুঁজে পায়, তাই দিগা পরেছিল পৃথুর পুরনো-হয়ে-যাওয়া ঘোর লাল রঙা একটি প্রলিনের গেঞ্জি তার ধুতির উপরে। যদি সেই ঘোর লালিমার প্রতি মোষ এবং ষাঁড়ের ক্রোধ থেকে প্রাণে বেঁচে ঠুঠা আদৌ হাটে পৌঁছতে পেরে থাকে তবে তাকে খুঁজে বের করা খুব একটা কঠিন কাজ হবে না। বিগু বলেছে, সে ঠুঠাকে হারিয়ে যেতে দেবে না। পৃথুকে খোঁজা তো আজকাল কোনও কঠিন কাজই নয়। ও ছাড়া হয়তো আর একজন দুজন খোঁড়া ভিখিরি-টিখিরি থাকবে হাটে।

হাটের ভেতরে মানুষের নানারকম বিপরীত স্রোত থাকে। ক্রাচ-এ চলাফেরা করতে এখনও অনভ্যস্ত পৃথু তার ভিতরে গিয়ে পড়লে হয়তো টাল সামলাতে পারবে না এ কথা ভেবে হাটের কাছেই একটি কালভার্টের উপরে বসল শিরিষ গাছের ছায়ায়। ক্রাচ দুটোকে শুইয়ে রাখল পাশে। তার চারপাশে প্রচণ্ড শব্দে নানা মানুষের জীবন দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। দেনা পাওনা, খিদে তৃষ্ণা, ছিটের ব্লাউজের মধ্যে করে সাবধানে দূর থেকে নিয়ে আসা মুরগি তিতিরের ডিম। সুন্দরী সব নানারঙা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মুরগি। এই সব মুরগি দেখলে পুষতে ইচ্ছে করে। খেতে মন চায় না। অনেক নারীকে দেখে যেমন মনে হয় যে, তারা শুধু দেখার জন্যে, স্তুতি করার জন্যে; আদর করার মতো নোংরা ব্যাপারের কথা যাদের সম্বন্ধে ভাবাই যায় না।

ওর চারধারের এই আবর্তিত জলরাশির মতো নারীপুরুষের আবর্তন, মাতালের চিৎকার, নাপিতের কাঁচির কচকচ, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তিনটি খারাপ মেয়ের গ্রাহকদের সঙ্গে নিচুগলায় দরদস্তুর করা, এই সবের কিছুমাত্রও পৃথুকে ছুঁতে পর্যন্ত পাচ্ছে না। যে রাতে এসে বৃষ্টির মধ্যে সীওনীতে বাস থেকে নেমেছিল সেই রাতে যে ছোট্ট ছেলেটি হঠাৎ ‘বাপু’ বলে ডেকে তাকে টুসুর কথা মনে পড়িয়ে দিয়েছিল, সেই ছেলেটিকে যদি আরেকবার দেখতে পায় পৃথু সেই আশায় চেয়ে ছিল সে ভিড়ের মধ্যে।

নিজের ভাবনার মধ্যে বেহুঁশ হয়েছিল পৃথু। আবারও চাঁদে চলে গেছিল। “ল্য গাঁর্স এ দাঁ লা লুন্যে”। ওর চাঁদে এখনও কোনও শব্দ নেই, কোনও নভচারী হাঁটে না এখানে, চরকা-কাটা বুড়ি এখনও নিশ্চিন্তে বসে চরকা কাটে সেখানে, পুব আফরিকান রুয়োঞ্জোরী রেঞ্জের মাউনটেইন অফ দ্য মুন—চাঁদের পাহাড়ের মতোই শান্ত স্নিগ্ধ সেই চাঁদ, তার ভাবনার জগৎ।

কে যেন তার পাশে এসে বসল কালভার্টে। ছাগলটাগল হবে। ছাগলের পাশে ছাগল ছাড়া কেই বা বসবে? পাঁঠাও বসতে পারে। চোখের কোণে লক্ষ্য করল।

ছেলেটা কোথাওই নেই ভিড়ের ভিতরে। টুসু এখন কী করছে কে জানে? মিলি? তুই আমাকে না ভাল বাসতে পারিস, আমি তোকে খুবই ভাল বাসি রে মিলি। তুই যখন ছোট্ট ছিলি, তখনই টুসু হয়নি; তোর গা দিয়ে বেবি পাউডারের গন্ধ বেরুত মিষ্টি মিষ্টি। সেই মিষ্টি আধো-আধো কথা বলা মিলিটা কত কঠিন কঠিন কথা লিখলি তোর বাবাকে। কষ্ট হল না? এতটুকুও? যাকগে যাক।

আমি তো বাবা! আমি কি তোকে ভাল না বেসে পারি?

আর রুষা? তুমি কী করছ গো? আমার সুন্দরী বিদূষী বৌ?

এখন তো তুমি নাকে চশমা এঁটে গম্ভীরমুখে ভবিষ্যৎ ভারতের ইংলিশ মীডিয়াম স্কুলে-পড়া তালেবর সব নাগরিক তৈরি করতেই ব্যস্ত।

ঠুঠা আর বিগুর কোনও টিকিই দেখা যাচ্ছে না। গেল কোথায় তারা?

পৃথু ভাবল, উঠে একটু খোঁজ করে।

উঠতে গিয়ে হাত বাড়িয়েই দেখল পাশে ক্রাচ দুটি নেই। ডানদিকে তাকাতেই থমকে গেল চোখ। কুর্চি! একটি কালো তাঁতের শাড়ি পরে কালভার্টের উপর বসে তার দিকে চেয়ে আছে। রোদে তার কানের লতি আর গাল লাল হয়ে উঠেছে।

অনেকক্ষণ কথা বলতে পারল না পৃথু।

কথা বলবেন না?

প্রথম কথা বলল কুর্চি। হাসি-হাসি মুখে। রোগা হয়েছে। রোগা হয়ে যেন আরও বেশি সুন্দরী হয়েছে কুর্চি। উজ্জ্বল দুটি বুদ্ধিদীপ্ত চোখের মণিতে ক্যামেরার লেন্সের মতো নানারঙে-রাঙা হাটের ছায়া পড়েছে।

পৃথু কথা না বলে মোহাবিষ্টের মতো চেয়ে রইল তখনও কুর্চির মুখের দিকে।

কুর্চিই আবার বলল, কাকে খুঁজছেন? কাউকে কি খুঁজছিলেন?

পৃথু বলতে গেছিল, তোমাকেই। কিন্তু বলল না। মুখে বলল, ঠুঠা বাইগা।

ওঃ। তা সে তো শিশু নয়, হারিয়ে যাবে না।

যেতেও পারে। বলা যায় না। আসলে ও কিন্তু শিশুই। শরীরেই বড় হয়েছে ও।

কুর্চি হাসল। বলল, আপনারই মতো অনেকটা।

তারপরই বলল, ছেলেধরা দেখেছেন কখনও?

না। কেন? তবে, ছেলে ধরতে এসে যারা ধরা পড়ে তাদের মেরে প্রাণ বের করে দেয় শুনেছি।

হুঁ। আমিও তাইই শুনেছি। তাইই ভয় হয়। নইলে শিশু চুরি করতে খুব ইচ্ছে করে আমারও। মাঝে মাঝে।

পৃথু বোকার মতো বলল, কেন? হঠাৎ?

না। মানে প্রাপ্তবয়স্ক শিশু

হেসে ফেলল পৃথু।

তোমার হাট হয়ে গেছে?

না। কুন্তীকে পাঠিয়েছি। ওই যা হয় নিয়ে আসবে। মহারানীর হাট তো নয় আর।

নিজে হাটে যাওই না? ভাল লাগে না তোমার?

লাগে। তবু। একা একা ভাল লাগে না। মানুষকে বোধহয় ঈশ্বর একা থাকার জন্যে তৈরি করে পাঠাননি।

তাইই?

পৃথু বলল।

চলুন উঠি আমরা।

ওরা?

ওরা ঠিক খুঁজে নেবে আমাদের যার যার ডেরায়। হারাতে চাইলেই কি আর চিরদিনের মতো হারানো যাবে? কী অবিচার বলুন তো! হারাবার সুখটাও তো অবিচ্ছিন্ন হতে পারত! তাও কত কম স্থায়ী।

কোনও মানে হয়?

তোমার বাড়ি কতদূর?

কাছেই।

এখন কাছই আমার কাছে অনেক দূর। অনেক সময় লাগে একটু যেতে।

জানি। যত সময়ই লাগুক। অপেক্ষা করব আমি।

আগে আগে না গিয়ে আমার সঙ্গে সঙ্গে চল। পৃথু বলল।

মুখ তুলে তাকাল কুর্চি পৃথুর মুখে। বলল, তাইই তো চেয়েছিলাম একদিন। আপনিও তো আগে চলে গেলেন আমাকে পিছনে ফেলে।

অন্য কথা বল। কেমন আছ? সুখে আছ তো?

হ্যাঁ। না থাকার কী? সুখ মনে করলেই সুখ। সুখকে তো আর হাত দিয়ে ছোঁওয়া যায় না। মনেরই একটা অবস্থামাত্র তা। মনকে সুখী সুখী ভাব করতে বললেই মন সুখী হয়।

তাইই?

হাসি হাসি মুখে বলল, পৃথু।

সুখী সুখী ভাব হলে কেমন দেখায় মনকে?

কুর্চিও হাসি হাসি মুখে পৃথুর মুখের দিকে তাকাল পাশে হাঁটতে হাঁটতে। মুখ তুলে বলল, গেরোবাজ মেয়ে-পায়রার মুখে মনোযোগ সহকারে তাকিয়েছেন কখনও? ওদের মুখে যেমন সুখী সুখী ভাব থাকে, চোখের লাল মণি যেমন চমকে চমকে ঘোরে; তেমন।

পৃথু ভাবছিল, এও এক রকম ওয়ার্ড-মেকিং খেলা। শব্দ দিয়ে বাক্য গঠন নয়, ছবি দিয়ে ওয়ার্ড মেকিং। বেশ খেলা। নির্দোষ আনন্দের।

কুর্চি বলল, আজ রাতে আমার কাছে খাবেন তো?

কী খাওয়াবে?

এখন তো আমি গরীব হয়ে গেছি। অতি সাধারণ খাওয়া। কিন্তু এর একটা আনন্দ আছে। আমরা এ দেশের মেয়েরা যেদিন সত্যিকারের স্বাধীন হব, আজ আমি যেমন হয়েছি, দায়ে পড়ে, সেদিনই আমাদের জীবনে প্রেমের সার্থকতা অনুভব করতে পারব আমরা। স্বামীর রোজগারে যে মেয়েরা খেয়ে-পরে থাকে, সে রাজরানীর মতো থাকলেও, তাদের অনেক কষ্ট। পোষা বার্ড অফ প্যারাডাইস তারা। তার চেয়ে আমার মতো ছোট্ট ময়না বা কোকিলেরও স্বাধীনতার দাম অনেক। আজ আপনাকে আমি খাওয়াব কলাই ডাল, আলু পোস্ত, আর মোটা চালের ভাত। আপনি চাইলে, কাঁচা লঙ্কা আর কাঁচা পেঁয়াজও দেব। আজ যে আমার কত আনন্দ হবে কী বলব! যাকে ভালবাসি, তাকে স্বামীর পয়সায় খাওয়াতে বিবেকে বড় লাগে। সব মেয়েরাই এ কথা জানে। এখনও আমরা বাঁদী হয়েই আছি। অন্তত নিজের হাত খরচটা নিজে রোজগার করে নিলেও অনেক। নইলে, স্বামীর সঙ্গে থাকতে থাকতে নিজের চরিত্রটাও স্বামীরই মতো হয়ে যায়।

তা হয়তো হয়। প্লান্ট লাইফে অ্যাকুয়ার্ড ক্যারাক্টারিস্টিকস বলে একটা কথা আছে। আনারসের বনে যদি কলাগাছ পুঁতে দাও, কিছুদিন পরে নাকি কলাগাছের পাতাও আনারসের পাতার মতো হয়ে যায়। তবে আমাদের দেশে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তো কোনও তফাৎ নেই। যা স্বামীর, তাইই স্ত্রীর।

এ সব কথা পুরুষেরা তাদের সুবিধার জন্যেই এতদিন বলে এসেছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যে মেয়ের নেই তাকে বাঁদী হয়েই থাকতে হয়। আপনারা যাইই বলুন না কেন।

মিনিট পনেরোর মধ্যেই পৌঁছে গেল ওরা কুর্চির বাড়িতে। শাল কাঠের খুঁটি দেওয়া উঠোন। তাতে নানারকম লতানো ফুলের গাছ। লাইন করে সোনাঝুরি গাছ লাগানো অনেক। থোকা থোকা ফুল ধরেছে তাতে। দুটি ঘর। পিয়াশাল কাঠের দরজা জানালা। মাথার উপরে খড়ের চাল। মাটির দাওয়া। মাটির দেওয়াল। আদিবাসীদের বাড়ির মতো রঙ করা দেওয়ালে। ছবি আঁকা তাতে।

বারান্দায় একটা বেতের চেয়ার বের করে দিল কুর্চি। ক্রাচ দুটো নিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখল। বলল, বেলা বড় তাড়াতাড়ি পড়ে যাবে। লম্ফ জ্বেলে রান্না করা তো অভ্যেস নেই। আমি তাড়াতাড়ি রান্না সেরে নেই। কুন্তী ডিম নিয়ে আসবে। ওমলেট আর চা করে দেব তখন আপনাকে।

পৃথু বারান্দায় বসে ভাবছিল, যদি ভালবাসা থাকে ঘরবাড়ি কেমন তাতে কিছুমাত্র এসে যায় না। মনের, রুচির, মানসিকতার মিলই হচ্ছে আসল। সেই বাঁধনে বাঁধা হলেও ঘর হয়, নইলে নয়।

কাঁচা কলাই-এর ডালে শুকনো লঙ্কা আর কালোজিরের ফোড়ন দিল কুর্চি একটু পর। নিজেও হেঁচে উঠল হ্যাঁচ্চো বলে। বারান্দায় বসে পৃথুও হাঁচল। কুর্চির চিঠিতে-লেখা সেই পাগলা কোকিলটা ডেকে উঠল। বারবার ডাকতে লাগল। বসন্ত অপগত হলেও ও যেন কী করে জেনে গেছে যে বসন্ত এসেছে এই কুঁড়ে ঘরে। খুব ভাল লাগছিল পৃথুর।

ঠুঠা বাইগা আর বিগু এতক্ষণে হয়তো গরু খোঁজা খুঁজছে তাকে। ইচ্ছে করে হারিয়ে যাওয়ার মধ্যেও এক ধরনের আনন্দ আছে। খুঁজুক একটু। অনেক অনেকদিন ধরে ইচ্ছে করে হারিয়ে যাওয়া কুর্চিকে খুঁজছে পৃথু। আজকে ইচ্ছে করে হারিয়ে যাওয়া পৃথুকে খুঁজলই না হয় একটু ওরা।

একটু পরে কুন্তি এল ঝুড়ি মাথায় করে। পৃথুকে দেখে অবাক হল। লাল একটি ব্লাউজ, নীল শাড়ি, লম্বা ছিপছিপে পরমা সুন্দরী গোঁন্দ মেয়ে সে। পৃথুর দিকে একটু সন্দিগ্ধ চোখে চেয়ে সে ভিতরে গেল। ও আসতেই কুর্চি বেরিয়ে এল বাইরে। বলল, চায়ের জলটা চাপিয়ে দে কুন্তী।

আর দুটো ডিম ভেঙে পেঁয়াজ লঙ্কা কুচিয়ে ফেটিয়ে রাখ আমি আসছি। নুন টুন দিস না।

দাওয়ায় বসে কুর্চি বলল, বলুন এবারে।

আজ স্কুলে যাওনি কেন? কোন স্কুলে? দিসাওয়াল সাহেবের স্কুল।

হেসে ফেলল কুর্চি। বলল, ও, কে রায়? সে আমি নই। কাকলী রায় বলে একটি মেয়ে আছে। দিসাওয়াল সাহেবের বিড়িপাতা বাবু শ্যামাকান্ত রায়ের শালী সে।

তুমি নও তাহলে?

না স্যার। সব কে রায়ই কি এক? আমি কুর্চি। কুর্চি একজনই হয়।

হাসল পৃথু।

খাওয়াচ্ছ তো খুব। তারপর ভাঁটু এসে যখন আমার পেট ফাঁসাবে তখন কী হবে?

হাসতে গিয়েও থেমে গেল কুর্চি। বলল, ওর কথা থাক।

ভাঁটুর কাছে হেরে গেলাম আমি কুর্চি।

আমিও। কুর্চি বলল। কখন কে যে কার কাছে হারে কে তা বলতে পারে? আমার কাছে, আমার মতো একটা সামান্য মেয়ের কাছে হেরে গেলেন রুষা বৌদি। ইদুরকার কোনও ব্যাপারই নয়। আপনারা মেয়েদের একটুও বোঝেন না। আসলে রুষা বৌদির অভিমানে এতই লেগেছিল যে ওই ভাবে আপনাকে শিক্ষা দিলেন আপনি। দারুণ মেয়ে কিন্তু উনি। ওঁর মতো হতে হয়তো সব মেয়েরই ইচ্ছা যায়, কিন্তু সাহসে কুলোয় না।

পৃথু বলল, তোমাকে একটা কথা বলব? যতদিন আমি সীওনীতে থাকি, আমরা দুজনেই রুষা এবং ভাঁটুকে নিয়ে কোনও আলোচনা করব না। আমার আর তোমার এই দুজনের মধ্যে কি আলাদা কোনও সম্পর্ক হতে পারে না?

পারবে না কেন। প্রত্যেকটি সম্পর্কই আলাদা আলাদা। কিন্তু চলে যাবেন কেন? যাওয়ার জন্যেই কি এসেছিলেন এত জায়গা থাকতে সীওনীতে?

যাবই যে, তা তো বলিনি কুর্চি। আসলে আমি কখন যে কী করি তার আগের মুহূর্তেও নিজেই জানি না।

যা ভাল মনে করেন! আপনার ওপর জোর তো আমার কিছু নেই।

কুর্চি বলল, মুখ জঙ্গলের দিকে ঘুরিয়ে।

পৃথুর খুব ইচ্ছে করল কুর্চির বিমর্ষতাকে একটু আদর দিয়ে খুশিতে ভরে দেয়।

যখন অনেকই বাধা ছিল তাকে একটুক্ষণের জন্যে কাছে পাওয়ার তখন ছিঁচকে চোরের মতো মানসিকতা ছিল ওর। এখন, যখন জানেই যে কুর্চি দিনের চব্বিশ ঘণ্টাই তারই হতে পারে তখন আর তাড়া বোধ করল না কোনও। ও যে কাছে আছে, খুবই কাছে; হাত বাড়ালেই যে তাকে পেতে পারে এই জানাটাই তাকে সংযমী, উদাসীন করে তুলল। যা সহজেই পাওয়া যেতে পারে, তা না পাওয়ার মধ্যে যে সংযম তার গভীর আনন্দে কুঁদ হয়ে, বসে-থাকা কুর্চির মুখখানিকে পাশ থেকে মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল পৃথু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *