আজ ভোরের বাসে হাটচান্দ্রা যাবে বলে বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওয়ানা হয়েছিল ওরা তিনজন। পৃথু, ঠুঠা আর টুসু। বাসস্ট্যান্ডটি বেশ দূরেই। ইচ্ছে করলেই দিসাওয়াল সাহেবকে গাড়ি বা জীপের জন্যে বলা যেত, কিন্তু বলেনি। যার যতটুকু পাওনা তার বেশি না চাওয়াই ভাল। উপরি পাওনাতে অভ্যস্ত হলেই কিছুদিন পরই সেটাকে ন্যায্য প্রাপ্য মনে করে তার জন্যেও দাবী জানাতে চায় মন। সে মনিব কর্মচারীর সম্পর্কর বেলাতেই তোক কি অন্য সম্পর্কর বেলাতেই হোক।
বাংলো ছেড়ে বেরবার একটু আগেই কুন্তী হাফাতে হাঁফাতে এসেছিল একটা চিঠি নিয়ে, কুর্চির কাছ থেকে। বলেছিল, দিদিনে ভেজিন্।
পৃথু বলেছিল যে, হাটচান্দ্রাতে পৌঁছেই জবাব দেবে। এখন তো সময় নেই।
দিদি যে জবাব চেয়েছিলেন।
সময় কোথায়? পৃথু বলল।
তিনজন চলেছে সিংগল ফরমেশানে। আধো অন্ধকারে। আগে ঠুঠা বাইগা, তারপর টুসু! একেবারে পেছনে প্রতিবন্ধী পৃথু।
ওরা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে চায়ের দোকানের সামনের শালকাঠের তক্তার বেঞ্চে বসল।
আর এক কাপ চা খাবে নাকি ঠুঠা?
পৃথু শুধোল।
একটা শব্দ করল ঠুঠা। বেরবার আগে কুন্তী আসাতে ও উত্তেজিত হয়েছিল। ওরা রওয়ানা হবার আগে কুন্তী ঠুঠাকে বলেছিল, ফিরে এসো কিন্তু জংলী।
জংলি কে?
চা খাবে নাকি? টুসু?
চা? মা বকবে। কোনওদিনও খাইনি।
কোনওদিনও যখন খাসনি তখন তো খেয়েই দেখতে হয়। কখনও এই কথাটা বলবি না। “কোনওদিনও করিনি” কথার কোনও মানে নেই।
আর মায়ের বকুনি?
সেটা তো মাঝে মধ্যেই খাস, না? পেটে খেলে তবে না পিঠে সয়!
কোথাকার জল দিয়ে কীভাবে চা করছে তা কে জানে? মা তো বলে, এই সব দোকানে পুরনো মোজা দিয়ে চা-ছাঁকে।
নাক কুঁচকে বলল টুসু।
হো হো করে হেসে উঠল পৃথু। বলল, সত্যি! তোের মার ইমাজিনেশন আছে বটে! আরে! ও ঠুঠা! গরম গরম সিঙ্গাড়াও যে ভাজছে, আর জিলিপির সাইজ দেখেছ? এমন খাওয়া ছেড়ে কী বাসে ওঠা যায়?
বাবা! ওগুলো কিন্তু খেও না। পোড়া-মবিলে ভাজে ওগুলো। আর পা দিয়ে ডলে ডলে সিঙ্গাড়ার পুর তৈরি করে ওরা। মা অনেকদিনই বলেছে। খেলেই কলেরা নো ডাউট!
তাহলে তো খেতেই হয়, কী বলল? আমি তো খাবই। তুই যদি খেতে চাস তো বল। ঠুঠাও খাবে। আমাদের এইসব না খেলে তো মজাই হয় না। পথে বেরিয়ে পথের খাবার খাবি তবে তো। নাকি শেঠদের মতো যেখানেই যাবি সেখানেই একটা পেটমোটা টিফিন ক্যারিয়ার সঙ্গে নিয়ে ঘুরবি?
টুসু হাফ প্যান্টের দু পকেটে দু হাত ঢুকিয়ে বলল, দেখিই তাহলে খেয়ে। তুমি তো আছ। মা বকলে, তুমি আমাকে বাঁচাবে।
একশবার।
জিলিপি সিঙ্গাড়া এবং চা খেতে খেতে বাস প্রায় ভর্তি হয়ে এল। ওরাও উঠল।
বাস ছেড়ে দিল। টুসু একেবারে সামনে ড্রাইভারের পাশে বসেছে। ঠুঠা আর পৃথু বসেছে একটু পেছনে, পাশাপাশি সীটে। এখানে বাসের মধ্যে বিড়ি খেলে কেউ আপত্তি করে না।
ঠুঠা একটা চুট্টা ধরাল বাস ছাড়তেই। পৃথু বলল, বেশ স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছ তো আজকাল। একটা ছাড়ো!
সেই অমানুষিক শব্দ করে এগিয়ে একটা চুট্টা দিয়ে, শজারু মাকা দেশলাইয়ের আগুন ধরিয়ে দিল ঠুঠা।
ঠুঠা সেই শব্দ দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিল, এই চুট্টার বাণ্ডিলটা কুন্তীর দেওয়া।
পৃথু কিছুই বুঝতে পারল না। ঠুঠার এখনকার ভাষা বুনো-শুয়োর আর কুন্তী ছাড়া কেউই বোঝে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার কথা বললেই ভয়ে কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করে আর কাঁদে। শিশু তো আর নয় যে, পাঁজকোলা করে নিয়ে যাবে!
চুট্টায় টান মেরে ধুয়ো ছেড়ে পৃথু ভাবল, কথা অবশ্য যত কম বলা যায় এবং কম বোঝা যায় ততই মঙ্গল। বেশ আছে ঠুঠা একদিক দিয়ে।
বাস চলেছে ঝাঁকুনি দিতে দিতে আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে হলুদ-লাল-নীল নদী আর সবুজ কালো পাটকিলে পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে। বাইরের প্রথম সকালের সুন্দর ছবিগুলো ওর চোখের উপর ছায়া ফেলেই অতি দ্রুত সরে যাচ্ছে। মস্তিষ্কে সেই ছায়া পৌঁছে দিতে পারছে না চোখ, কারণ মস্তিষ্কে তখন অনেকই কথা। জায়গা নেই। হাটচান্দ্রায় ফিরে যাচ্ছে যে ও! পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। সারাজীবন আর কত এবং কত রকম পরীক্ষাই যে দিতে হবে। যেদিন ইংল্যান্ড থেকে এঞ্জিনিয়ারিং-এর ডিগ্রি এবং চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটি সঙ্গে করে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্লেনে উঠেছিল হথরো এয়ারপোর্টে, সেদিন বাইশ বছরের পৃথু ভেবেছিল জীবনের সব পরীক্ষা শেষ করেই উড়ল বুঝি জীবনের আকাশে। বাকি জীবন সিল্কের মতোই মসৃণ পথে হেঁটে যাবে। এখন জানে, সে সব তো সামান্য ডিগ্রি পাবারই পরীক্ষা। নেহাৎই ছেলেখেলা! জীবনের যুদ্ধ প্রতিদিনের। প্রতি প্রহরের অগণ্য পরীক্ষা প্রত্যেক পুরুষ আর নারীর সঙ্গে সঙ্গেই হাঁটে হাতে হাত রেখে, মৃত্যুর মুহূর্ত অবধি। এটাই ঘটনা।
রুষার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক আর পাতাতে পারবে না পৃথু। ভাবছিল। তবে এও ভাবছিল যে, যেখানে প্রেমের সম্পর্ক রাখা যায় না সেখানে যে শুধুমাত্র বৈরিতার সম্পর্কই রাখতে হবে এইই বা কেমন কথা। প্রেম ও বৈরিতার মাঝামাঝিও তো অনেকগুলিই স্তর আছে সম্পৰ্কর! রুষার মনের তেমনই কোনও একটি স্তরের মসৃণ গেরুয়া চরে বেঁধে রাখবে পৃথু তার নৌকোখানি বাকি জীবন। জলোচ্ছ্বাসে দোল পাবে; জল কমলে গেরুয়া-রঙা নরম আলোয় বিধুর দেখাবে। মাঝনদীতে ভরদুপুরে নানারকম অপটিক্যাল ইলশানের মতো নানারঙা সরু-মোটা সুতো বুনবে ভবিষ্যৎ। সে সব রুষারই ব্যাপার। নোঙর করা নৌকোতে মাঝে মাঝে এসে শুধু বসবেই হয়তো পৃথু। যদি আদৌ আসে।
কিন্তু…এ জীবনে সময় আর কী হবে? ফিরে আসার? মনের অয়ন পথ যে বড়ই বিচিত্র। মন একবার সরে এলে পুরনো পথে অর ফেরে না। পুরনো নৌকোতেও ফেরে কম জনই!
কুর্চিটাও এক আশ্চর্য মেয়ে! হাটচান্দ্রায় যাচ্ছে শুনেই ও কী করে ভেবে বসল যে, পৃথু আর ফিরে আসবে না। এতদিন এতটুকুই কী বুঝল ওকে? তবে, যে দাম দেয়, তার কাছেই নিজের দাম বাড়াতে গভীর এক সুখবোধ হয়। হয়তো, হারাবার ভয়টা এখনও এদেশের মেয়েদের সহজাত। জীবনের অনেক সুখ ও দুঃখের পথৈই ওরা আজও পরনির্ভর বলে। তবু, কুর্চি কি জানে না? এখনও জানে না যে, ভালবাসা কোনও লিপ্ততা নয়, কোনও বিলাসও নয়; ভালবাসা একটা প্রয়োজন। শুধু প্রয়োজনই বা বলবে কেন? ভালবাসা এমনই এক আঙ্গিক, যা নইলে; ব্রহ্মাও জগন্নাথ হতেন!
সীওনীতে এসেই পৃথু জগন্নাথ যেন ব্রহ্মা হয়েছে। মানুষটা যেন পূর্ণতা পেয়েছে। কুর্চির শরীর এবং মনের ভরা কলসের দানই হয়তো এই পূর্ণতার দিকে ঠেলে দিয়েছে তাকে। এতদিন না-পেয়ে পেয়ে, বুঝতেই পারেনি যে, তার মধ্যে ঠিক এতখানি শূন্যতা ছিল, মরুভূমির মত উষর; রুখু কাঁটাগাছের জীবন বুকে করে বেঁচেছিল সে। শূন্যতা পূরণ হলেই শুধু জানা যায় যে, তার ব্যাপ্তি এবং গভীরতা কতখানি। কে জানে? কত মানুষ মানুষী পৃথু আগে যেমন করে বেঁচেছিল রুষার ঘরে তেমন করেই বেঁচেও-মরে-থেকেই নিজেদের “চমৎকার আছি” বলে চোখ ঠেরে ঠেরে এই একটামাত্র জীবনও পুরোপুরি মাটি করেই প্রতিনিয়ত নিঃশব্দে পৌঁছে যাচ্ছে শ্মশানে বা কবরে। বাঁচা মানে যে এমন এক ভরন্ত উচ্ছল অভিজ্ঞতা তা কিন্তু কুর্চি তাকে না শেখালে পৃথুরও জানার বাইরেই থাকত।
তার পরে বিয়ে হল। জীবনের প্রথমে নারী রুষাকে জানল। কিছুদিন ভেসে থাকল হলুদ ব্যাঙের মতো নতুন বিয়ের পরের সহজ সুখের বানের জলে। সেই ঘোর কাটলে ধীরে ধীরে জানল যে, কাব্যে আর জীবনে ফাঁক আছে। এত বছর বাদে কুর্চি তার কাছে সম্পূর্ণ আনন্দর প্রকৃত ধ্রুব স্বরূপ হয়ে এল। আনন্দর তীব্রতম বিন্দুতে পৌঁছনোর পরই বোধ হয় মন বড়ই ছটফট করতে থাকে। এই মন নিয়ে বড়ই জ্বালা। দুখও সয় না; সুখও নয়!
কিন্তু এই পূর্ণতা কেমন যেন এক নির্লিপ্তিও দান করেছে পৃথুকে। জীবিকা নয়, সংসার নয়, নারী নয়, অপত্যস্নেহ নয়, জীবনের সব শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সে যেন আরও অন্য কিছুর খোঁজে এসে যেতে চাইছে। রুষার চিঠিতে উল্লিখিত রিচার্ড বাখ-এর ইলশানস-এর সেই সামুদ্রিক কীটটির মতো। সব বাঁধন আলগা করে দিয়ে। এই ভেসে যাওয়া যে কী, তা পৃথু নিজেও জানে না। তা হয়ত নিজেকেই খোঁজা, আপনাকে জানার এক তীব্র তাগিদ; ধর্ম জিজ্ঞাসা নয়, সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগী হয়ে যাওয়া নয়া দিগা পাঁড়ের মতো, বরং আধুনিক শিক্ষিত, বিজ্ঞান বিশ্বাসী মানুষ হিসেবেই সে অনুক্ষণ অনুভব করছে যে, যে মানুষটিকে সে জানত, তার নাম ধরে ডাকলে সে সাড়া দিত, সেই পদবি ডিগ্রি জীবিকা এবং ঠিকানা-সর্বস্ব মানুষটিই তার মূল শিকড়ে ফিরতে চাইছে। ঠুঠা বাইগা হয়ে যেতে চাইছে সে।
টুসু ডাকল জোরে জোরে, বাবা!
চমকে উঠল পৃথু। বলল, কী রে?
একটা কথা শোনো।
সব নির্লিপ্তি কেটে গেল। পৃথুর মনে হল এমন করে “একটা কথা শুনতে তাকে কেউই ডাকেনি ওকে এই জীবনে আগে। বুকের মধ্যে পাথর গলল। প্রাচীন জটাজুটসম্বলিত গাছ ভেসে চলল, মুক্তি প্রত্যাশী মানুষের মনকে ভাসিয়ে নিয়ে প্রাত্যহিক গার্হস্থ্য-অপত্যর জটিল আধার জীবনে।
টুসুকেই কাছে ডাকা উচিত ছিল। ক্র্যাচ নিয়ে চলন্ত বাসে চলাফেরা করা সোজা নয়। কিন্তু না ডেকে, নিজেই গেল, ঠুঠাকে পেরিয়ে। ছেলে ডেকেছে। এই “বাবা” ডাকটার মধ্যে কী যেন আছে। যতদিন বাবা হয়নি ততদিন এই ডাকের গভীর স্বননের, ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে কোনওই জ্ঞান ছিল না।
টুসু বলল, পৃথুর কানে কানে, গোপনতম কথার মতো, ফিসফিস করে, বাবা! আমার হিসি পেয়েছে।
হো হো করে হেসে উঠল পৃথু। ওর এই দীর্ঘ বাবাগিরির জীবনে এমন নির্দোষ খবরের এবং নির্মল হাসির শরিক এর আগে কখনওই হয়নি। কতদিন যে এমন মন খুলে হাসে না ও।
বাসসুদ্ধ লোক চমকে ওর দিকে চাইল।
ফিস ফিস করে, ছেলের কানে কান ঠেকিয়ে বলল, কিছুক্ষণ পরই বাস দাঁড়াবে। তখন। ঠিক আছে?
কতক্ষণ?
পনেরো মিনিট।
ঠিক আছে।
পৃথু ফিরে এসে ঠুঠা জানালার দিকে সরে গেলে ঠুঠার সীটেই বসল। পৃথুর কষ্ট লাঘব করতেই তাড়াতাড়ি সরে গেল হঠা। সরে যাবার পর ঠুঠা একটা অমানুষিক শব্দ করল। পৃথু কানে কান ঠেকিয়ে বলল, হিসি পেয়েছে ছেলের। খুব গোপন কথা।
বলতেই, খক খক করে ঠুঠাও হেসে উঠল। চমকে উঠল পৃথু। ঠুঠা কী স্বাভাবিক হয়ে গেল? নাঃ। হাসিটা নিবে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। এবং সেই গভীর বিষাদ নেমে এল আবার ওর মুখে। শিশু আর দেবতাদের সঙ্গে কথা বলার সময় বোধ হয় স্বর এসে ক্ষণিকের জন্যে বসে ওর গলায়।
দুপুরে বালাঘাটে খাওয়া সেরে নিয়েছিল ওরা। রুটি, তড়কা, আওলার আচার আর কাড়হি দিয়ে। টুসু কখনও কাড়হি খায়নি। খুব ভালবেসে খেয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, এর মধ্যে ‘ইয়োগগাহার্ট’ আছে না?
মাথা নাড়িয়েছিল হতাশ হয়ে। বাঙালির ছেলে দইকে বলে “ইয়োগগাহার্ট”। ভাবছিল ওকে। ডি-ফ্রস্ট করতে সময় লাগবে। ফালতু সাহেবীয়ানা জমে গেছে শক্ত বরফের ইটের মতো।
ঠিক সন্ধের মুখে মুখে হাটচান্দ্রায় এসে পৌঁছল বাসটা। হাটচান্দ্রার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেই চলে গেছিল, তবু দূর থেকে জায়গাটি দেখতে পেয়েই ভাল লাগছিল।
বাস থেকে নেমে, পৃথু বলল, টুসুবাবা তুমি ঠুঠা চাচার সঙ্গে তোমার মায়ের কাছে যাও। আমি কাল গিয়ে তোমাদের সকলের সঙ্গে দেখা করব। আমিইদুরকার আংকল-এর বাড়ি যাব না?
না না সেখানে নয়। আমাদের পুরনো বাড়িতে যাবে। মা আর দিদি তো সেখানে চলে এসেছে।
তাই-ই?
চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল টুসুর।
হ্যাঁ! তাই-ই তো!
তুমি কোথায় যাচ্ছ বাবা?
দেখি, হয় গিরিশদার বাড়ি নয়তো ভুচুর কাছে। বলে একটা রিকশাতে উঠল। ঠুঠা বাইগাকে বলল সে টুসুকে পৌঁছে দিয়ে যেন ভুচুর গারাজে ওই রিকশা নিয়েই চলে আসে।
নিচু গ্রামে একটি অমানুষিক শব্দ করে ঠা জানাল, যে, সে কথা বুঝেছে।
টুসুরা আগে আগে গেল। কিছুটা গিয়েই, চামারটোলির দিকের রাস্তাটা ঘুরে গেল। ওদের রিকশা ঘুরতেই টুসু হাত তুলে বলল, টাটা বাবা।
টাটা! পৃথু বলল। আসন্ন সন্ধ্যার গোলাপি পথে দীঘল বৃক্ষসারির ছায়ারা গোলাপি মুখে লেপ্টে-যাওয়া চোখের কাজলের মতো লেপ্টে গেছে। তাদের আর আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। রাত নেমে আসছে। পৃথুর নাকে উক্যালিপটাস-এর গন্ধ ছাপিয়ে টুসুর গায়ের গন্ধ লাগছে। নিজের সন্তানের গায়ের গন্ধর মত মিষ্টি গন্ধ পৃথিবীর কোনও মহার্ঘতম পারফমেও নেই। শুধুমাত্র ৰাবা-মায়েরাই সে গন্ধর কথা জানেন।
ভুচুর গারাজে পৌঁছল যখন তখন প্রায় আটটা বাজে। বাসস্ট্যান্ড থেকে অনেকটাই দূর। ভুচু ছিল না। হুদাও ছিল না। আগামিকাল ওর বিয়ে, নিশ্চয়ই ছুটি নিয়েছে। গিদাইয়া ঘর খুলে দিল। জিজ্ঞেস করল, চা আনবে কি না। পৃথু বলল, থাক। বাবু ফিরবে কখন?
জানি না।
কোথায় গেছে?
আপনার বাড়িতেই তো! মেমসাহেব এসেছিলেন। বাবা আর মেমসাহেব দুজনে তো জীপে করেই বেরোলেন এখান থেকে। তাও ঘণ্টা দুয়েক হয়ে গেল।
ও। পৃথু বলল।
ইদুরকার সাহেবের কোনও খবর জানো? সাহেবকে পাওয়া যাবে এখন বাড়ি গেলে? তুমি তো ওঁর বাড়ির কাছেই থাকো! কি, গিদাইয়া?
ইদুরকার সাহেব তো বেপাত্তা হয়ে গেছেন, তাও প্রায় আট-দশদিন হল। পুলিশ খোঁজ করছে। চারদিকে। সাহেব বেপাত্তা তো বে-পাত্তা, সাদা পেট্রোল মার্সিডিজভি বেপাত্তা। অথচ গাড়ি নাকি মান্দলা কি বাইহার কি মালাঞ্জখণ্ড কোথাওই যায়নি। আজিব বাত!
তাই?
হ্যাঁ।
আমি তাহলে ভুচুর ঘরে যাচ্ছি। বাথরুমে কি তোয়ালে আছে? আছে।
আমি নতুন তোয়ালে বের করে দিতে বলছি রামচন্দরকে।
বলেই হাঁক ছাড়ল, আর রে এ রামচন্দর…
পৃথু, ভুচুর ঘরের ইজিচেয়ারে গিয়ে পিঠটা এলিয়ে দিল। একসঙ্গে এতঘণ্টা বাসের চিপু শক্ত সীটে বসে পিঠ, কোমর এবং কাটা-যাওয়া পাটাও টনটন করছিল। রক্ত এসে মুখের কাছে এখনও ছলাৎ ছলাৎ করে। কোথায় ঝাঁপাতে চায়, কে জানে?
বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, নিজের সুটকেস থেকে পায়জামা পাঞ্জাবি বের করে রামচন্দরের দেওয়া তোয়ালেটা তুলে নিয়ে বাথরুমে গেল পৃথু। জামা কাপড় ছাড়তে ছাড়তে পৃথু ভাবছিল ইদুরকার বেপাত্তা হয়ে যাওয়ার মানে দুটো হতে পারে। হয় তাকে সাবধান করে দিয়ে এখান থেকে চলে যেতে বলেছে ভুচুরা। নয় তো… কিন্তু এতটা করার কী দরকার ছিল? তারপরই ভাবল, ইদুরকার অথবা রুষা কেউই তার কেউ নয়। অতএব তাদের ভাল হল কি মন্দ তা নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করতে রাজি নয় ও। কাল সকালে একবার সাবীর সাহেবের কবরে যাবে ফুল নিয়ে। নুরজেহানের শাদির খানা খাওয়ার চেয়েও অনেক বড় কর্তব্য সেটা।
শাওয়ার খুলে সাবান মাখতে গিয়ে ও দেখল একটি মস্ত বড় বিলিতি ক্যামে সাবানের সবুজ রঙা কেক সোপ-কেসে! বাবা! কবে থেকে এমন শৌখিন হয়ে উঠল ভুচু? ক্যামে ওর ভাল লাগে না। ভুচু তো চিরদিন নিম সাবানই মাখত। পৃথু তাই-ই মাখে। শাওয়ার বন্ধ করে বেসিনের উপরের ক্লোজেটটা খুলল পৃথু, যদি তার মধ্যে নিম সাবান থাকে! ওটা খুলতেই চমকে উঠল। রুষার ফোটো একটি। রাতমোহানার পাথরের সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে। ছবিটি অতি-সাম্প্রতিক সময়ের। হয়তো ভুচুই তুলেছে, ইদুরকারের বাড়ি থেকে চলে আসার পর রুষা নিশ্চয়ই গেছিল ভুচুর সঙ্গে রাতমোহানায়। যে-কোনও মানুষের ফোটোই ভালবেসে অন্য মানুষ রাখতেই পারে। কিন্তু সে ফোটো বাথরুমের ক্লোজেটের মধ্যে কেন?
একটি নিম সাবানে হাত দিয়েও সাবানটি রেখে দিল পৃথু। এখান থেকে সাবান নিলে ভুচু বুঝতে পারবে যে, পৃথু ফোটোটা দেখেছে। লজ্জা পাবে বেচারি। ক্যামের-এর কেকটিই তুলে নিয়ে আবার শাওয়ার খুলল। অন্যর সাবান মাখতে কেমন লাগে। ভাল করে ধুয়ে নিল। ঠাণ্ডা জলের ধারা সারা শরীরে স্নিগ্ধতা এনে দিল। তার সঙ্গে বিলিতি ক্যামের বিদিশি গন্ধ। ফেনা, সারা শরীরকে সমুদ্র করে বুদ্বুদ ফাটিয়ে এবং ফুটিয়ে তুলে স্বগতোক্তির মতো কত কী বলে যেতে লাগল। ওদের বিড়বিড় স্বগতোক্তির মধ্যেই পৃথু বলল, কে যে কখন কার কাছে হেরে যায়!
চান করে জামাকাপড় পরে বেরোতেই জীপের শব্দ শুনল একটা। ভুচু এল বোধ হয়। পৃথু চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে নিজেকে বলল, “পৃথু ঘোষ! রাইজ টু দ্যা অকেশান্। ভুচু তোমাকে সত্যিই ভালবাসে। ভুচুকে তো তুমিও ভালবাসো। ক্ষমা করো। ক্ষমা কী সকলে করতে পারে?”
ভুচু আর শামীম দুজনেই ঘরে এল। ভুচুর গা দিয়ে ভুরভুর করে ফিরদৌস ঈত্বরের গন্ধ বেরুচ্ছে। চোস্ত সাদা পায়জামার সঙ্গে ফিনফিনে সাদা কুতা পরেছে ও। এমন শুভ্র বেশে কখনও দেখেনি, পৃথু ভুচুকে। পায়ে চকচকে কালো কোলাপুরি চটি। ভুচুর চেহারাই পাল্টে গেছে।
প্রেম বোধ হয় মানুষকে বড় চেকনাই দেয়। চোখমুখ জ্বলজ্বল করছে। দিগা পাঁড়ে কী একটা দোঁহা বলত তুলসীদাসের, প্রেম কখনও লুকোনো যায় না, না কি যেন!
ভাবল পৃথু।
ভুচু বলল, পৃথুদা একবার বাইরে যেতে হবে।
চিরুনিটা নামিয়ে রেখে অবাক হয়ে পৃথু বলল, কোথায়?
কারও বাড়িতে নয়। জঙ্গলেই চলো। জীপে বসেই না-হয় কথা হবে। এখানে বলা যাবে না। দেওয়ালেরও কান আছে।
আমি এসেছি তুমি জানলে কী করে?
আমি তো তোমার বাড়িতেই ছিলাম। তুমি আসবে বলে অপেক্ষা করছিলাম। সেখানে। ঠুঠা আর টুসু এল রিকশা করে। ওরা বলল, তুমি এখানে এসেছ।
পৃথু লক্ষ্য করল, ভুচুর সঙ্গে ওর দীর্ঘদিনের পরিচয়ের মধ্যে আজই প্রথম মিথ্যা কথা বলল ভুচু ওকে। ওরা আজই আসবে এমন কথা কাউকেই জানায়নি পৃথু। তার জন্যে রুষার বাড়িতে অপেক্ষা করার প্রশ্নই ওঠে না তাই।
মজা লাগল ওর। প্রেম যখন দুজনের মধ্যে নতুন থাকে এবং গোপনও, নতুন বই বা কোরা শাড়ির গন্ধর মতো তখনই বোধ হয় তা সবচেয়ে স্পষ্ট এবং প্রকাশ্য হয়ে কাছের লোকেদের কাছে ধরা পড়ে।
পৃথু বলল, চলো। আমার স্যুটকেসটাও নিয়ে চলো। ফেরার সময় আমাকে গিরিশদার বাড়ি নামিয়ে দিও।
বাঃ। তা কেন? তুমি আজকের রাতটা আমার সঙ্গেই থাকো পৃথুদা। আবার কবে দেখা হবে। তাছাড়া, তোমার সঙ্গে কিছু পার্সোনাল কথাও আছে আমার।
পার্সোনাল?
বলে, চোখ তুলে চাইল পৃথু।
হ্যাঁ, পার্সোনাল অ্যান্ড স্ট্রিক্টলি কনফিডেনশিয়াল।
গম্ভীর মুখে বলল ভুচু। এমন ভারিক্কি কখনও দেখায়নি ওকে আগে।
ভুচু বলল, চলো পৃথুদা। ঘর থেকে বেরোবার সময় একটি বোতল নিয়ে নিল ভুচু রাম-এর। রামচন্দরকে বলল, একটা বেতের বাস্কেটে তিনটে জলের বোতল, বরফের বাকেট, আর তিনটে গ্লাস দিয়ে দিতে।
পৃথু বলল, ঠুঠা বাইগা?
তাকে পৌঁছে দিতে বলেছি গিদাইয়াকে, গিরিশদার বাড়ি। গাড়ি নিয়ে চলে গেছে গিদাইয়া।
ভুচু স্টীয়ারিংয়ে, শামীম্ মধ্যে এবং পৃথু বাইরের দিকে বসল। জীপ স্টার্ট করার আগেই পান বের করে দিল ভুচু পৃথুকে। বলল, তোমার পান।
পানটা নিতে নিতে পৃথু ভাবছিল ছেলেটা বদলায়নি বিশেষ! নদীর একদিকে পাড় ভাঙে, অন্যদিকে চর পড়ে। তাতে বলা যায় না যে নদী বদলে গেছে। বড়জোর বলা চলে তার ঋতিটাই বদলিয়েছে শুধু।
কোনদিকে যাব?
ভুচু শুধোল।
রাতমোহানায়। কাছাকাছিও হবে। নির্জনও হবে।
চমকে, পৃথুর চোখে চোখ রাখল ভুচু।
তারপর চোখ নামিয়ে বলল, তাই-ই চললো।
রাতমোহানায় পৌঁছেই শামীম হট-কেস থেকে বটি কাবাব বের করল। বলল, কালকের খনার মহড়া। সাবীর মিঞার সব কর্তব্য এখন শামীমই যেন তার কাঁধে তুলে নিয়েছে। কিন্তু সাবীর মিঞা একজনই হন। দুজন হবেন না আর। পৃথু বলল, কাল তোমার মেয়ের বিয়ে আর তুমি আজ এমন গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াচ্ছ কী রকম! শামীম বলল, বিয়ে তো হুদা আর নুরজেহানেরই। আমার থোরই বিয়ে হচ্ছে!
ভুচু নেমে বলল, দাঁড়াও তোমাকে রাম তৈরি করে দিই।
পৃথু জবাব দিল না। জীপ থেকে নেমে যে-পাথরে আরাম করে পাটাকে বিশ্রামে রেখে বসা যায়, তেমন একটি পাথর দেখে নিয়ে বসল। আজকে সপ্তমী কি অষ্টমী হবে। শুক্লপক্ষর। চাঁদ উঠেছে। হই হই করে নরম হাওয়া বইছে। বনের বুকে বুকে পাতারা জলপ্রপাতের মতো আওয়াজ করে বয়ে যাচ্ছে। দুপুরের বনের ঝাঁঝ আর পাথরের শিলাজতুর গন্ধ এখনও যেন রয়ে গেছে। শাওন আর ভাঁদো নদীতে জল খুবই কম। হাঁটুখানেক হবে বড়জোর। একটা বেওয়ারিশ ডান-পা খোঁড়া কালোরঙা রোগা ষাঁড় ওপার থেকে এপারে এল জলে ছপছপ আওয়াজ তুলে। ওর হাঁটার ভঙ্গিটি ভারি করুণার উদ্রেক করে। কী করে ভাঙল পা-টি কে জানে? এমনই কঙ্কালসার চেহারা যে, ওকে কোনও স্বাভাবিক বাঘে চিতায় ছোঁবেও না। এখানে অবশ্য বাঘ বা চিতা নেই। মানুষেরও দরকার নেই তাকে কসাইখানায় অথবা ক্ষেতে। তাকে কারওই প্রয়োজন নেই। এমনকী কোনও গরুরও নয়। তারও বোধ হয় কাউকেই প্রয়োজন নেই। ফিকে জ্যোৎস্নায় রহস্যময় হয়ে-ওঠা বনের মধ্যে দিয়ে লটরপটর করে একটু গিয়েই ষাঁড়টা থেমে পড়ল, কী ভেবে যেন। আবার একটু পরেই চলতে শুরু করল। একা একা চলেছে সে। কী অত ভাবছে কে জানে! বলদেরও এত বুদ্ধি থাকে না কি? খোঁড়া বলদটার আর পৃথুর মধ্যে বোধহয় অনেকই মিল।
রাম-এর গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে নিজে ঠোঁটের কাছে তুলে ভুচু বলল, চীয়ার্স! পৃথু বলল, চীয়ার্স!
ভুচু বলল, একটা কেচাইন হয়ে গেছে পৃথুদা!
কী?
শামীম ইদুরকারকে একেবারেই শেষ করে দিয়েছে। অনেক মানা করেছিলাম। ওকে গুলি মারার ভয়ও দেখিয়েছিলাম।
অনুমান করেছিলাম। কিন্তু তোমরা যদি ভেবে থাকো এর জন্যে তোমাদের বাহবা দেব আমি তাহলে ভুল করছ। অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে কাজটা। একে কী বিচার বলে? কাজির বিচারও যে এর চেয়ে ভাল।
দ্যাখো না। কিন্তু একথা বোঝাবে কে এই বর্ণ-ক্রিমিন্যালকে? বাহাদুর এসেছেন মস্ত। বাহবা চাই।
গভীর বিরক্তির গলায় ভুচু বলল। বাহবা আমি কারও কাছ থেকেই চাই না। শামীম বলল। বাহাদুরীর বয়স পেরিয়ে এসেছি অনেকদিনই আগে। আমি তো তোমার মতো ছেলেমানুষ নই।
তবে করলে কেন? পৃথু বলল।
সে আলোচনা ছাড়ো। তা করে লাভ কি? এখন কী করণীয় তাই-ই ঠিক করা দরকার। শামীম বলল।
ঘটনাটা ঠিক কী ঘটল শামীম? পৃথু শুধোল।
ভুচু বিস্তারিতভাবে বলল পৃথুকে, কী করে কী হল।
সব শোনার পর শামীম বলল, এবারে কী করব?
পৃথু, শামীমের চোখে চোখ রেখে বলল, তা আমি কী করে বলব? তুমি করেছ, তুমি যা ভাল মনে করো করবে। বুদ্ধি এবং বিশেষ করে দুর্বুদ্ধি তুমি তো কম রাখো না! আমার বুদ্ধির ভরসায় কী তুমি বসে আছ?
হ্যাঁ। আমি যে খারাপ সে বিষয়ে আমার নিজেরও কোনও সন্দেহ নেই। আমি বিশ্বাস করি, সুবিচার বা অন্যায়ের প্রতিকার এইভাবেই করা উচিত। অবিচারকে অবিচার দিয়েই মুছতে হয়। ন্যায় বিচারের চেয়ে অন্যায় বিচার অনেকই ভাল।
পৃথুর মনে হল এ যেন শামীম নয়, যেন গ্রীক দার্শনিক প্লাটোর “দা রিপাবলিক”-এর কথোপকথনে যে থ্যাসীম্যাকাসের কথা আছে, তার আত্মাই যেন কথা বলছে শামীমের মধ্যে থেকে। হুবহু সেই কথা।
পৃথু বলল, তুমি কী বলতে চাও যে, অবিচার এক দারুণ গুণ আর সুবিচার একটা দোষ?
নিশ্চয়ই।
অবিচারেরই দাম আছে, সুবিচারের নেই?
তা কেন?
তবে তুমি কী বলতে চাও যে সুবিচার একটা ভুল কথা। একটা দোষেরই ব্যাপার?
দোষ বলব না, বলব যে কিছু মাথা-মোটা ভালমানুষই, ভুচুর মত; সুবিচারে বিশ্বাস করে। অবিচার, পন্থা হিসেবে দারুণ? তার কোনওই বিকল্প নেই।
তুমি কী তাহলে বলতে চাও যে অন্যায় আর অবিচারে তোমারই মতো যে সব মানুষ বিশ্বাস করে তারা চরিত্রে আর বুদ্ধিতেও অন্যদের চেয়ে অনেক বড়? অন্যরা সব ফালতু?
হ্যাঁ, তাই-ই তো! অবিচারকে যারা তুঙ্গে চড়াতে পারে, খুঁতহীনভাবে তারাই একটা পুরো জাতের, শহরের, এমনকী দেশেরও মালিক হায়।
কী রকম?
যেমন কোনও কোনও রাষ্ট্রের নায়কের ক্ষেত্রে দেখা যায়। যেমন, পাকিস্তানের জিয়া।
হেসে ফেলল পৃথু। বলল, সাব্বাস! তুমি ওকালতি পড়লে না কেন?
মুখ বেচে খেতে যাব কোন দুঃখে এত রকম অন্য জীবিকা থাকতে!
ভুচু বলল, জানো পৃথুদা, ও যে শুধু ঠাণ্ডা মাথায় ইদুরকারকে জবাই করে তাকে জলের মধ্যে চালান করেছে তাই-ই নয়, তার পরেও ঠাণ্ডা মাথায় এমনই সব কাণ্ড করেছে যাতে খুনের দায়টা আমার ঘাড়েই চাপে। ডি-আই-জি এসে আমাকে যেভাবে জিজ্ঞাসারাদ করলেন তাতে মনে হল ওঁরা আমাকেই সন্দেহ করছেন, বিশেষ করে আমিই তোমার সবচেয়ে কাছের লোক বলে।
শামীম বলল, কোনও কিছুই আনাড়ির মতো করি না আমি। আমি চাই যে, ওরা তোমাকেই সন্দেহ করুক। তাহলেই ওরা ফাঁসবে। কেন ফাঁসবে, কেন ফাঁসবে, তা এখন বলব না। শামীম মিঞা অমন কাঁচা কাজ করে না।
ঠাণ্ডা-রক্তর বিষধর সাপের মতো শামীম জীপে ফিরে গিয়ে রাম-এর বোতল বের করে ওর গ্লাসে রাম ঢালল, তারপর জল।
আমরা কী করব এখন? পৃথুদা?
ভুচু বলল।
আমি কী বলব? তোমরা যা ভাল মনে করো করবে। যা করেছ তা তো আমাকে জিগ্যেস করে করোনি।
যদি ওরা আমাকে সত্যিই ধরে তাহলে তুমি ইন্দারজিল সাহেবকে বলবে তো? আমি দোষী না হয়েও শাস্তি পাব?
তাই-ই তো হয়ে এসেছে চিরদিন। দোষীরা শাস্তি কমই পায়।
মজা লাগল পৃথুর নিজের প্রাণের উপর ভুচুর হঠাৎ এমন মায়া জাগাতে দেখে। বড়লোক তো মানুষ শুধু টাকাতেই হয় না, রুষাকে যদি সত্যিই পেয়ে থাকে ভুচু তবে তো তা কুবেরেরই ভাণ্ডার। হেমিংওয়ে ঠিকই বলেছিলেন কথাটা। মানুষের বড়লোকি বাড়ার সমান অনুপাতেই তার প্রাণের ভয় বাড়ে।
পৃথু বলল, চলো তাহলে। কথা তো হল।
এইটুকু? ব্যসস? তুমি তো কিছুই বললে না পৃথুদা?
তোমরা চুরি করে বারাশিঙা মারার পর এখানেই মীটিং করেছিল মনে আছে? বারাশিঙা মারা আর ভিনোদ ইদুরকারের মতো এত ইনফ্লুয়েনসিয়াল পয়সাওয়ালা একজন মানুষকে মারা এক জিনিস নয়। এতে আমি কী বলতে পারি?
ভুচুর মুখ গোমড়া হয়ে গেল। স্টিয়ারিং-এ গিয়ে বসল। গ্লাসগুলো শেষ হলে বাস্কেটে রেখে স্টার্ট করল এঞ্জিন। জঙ্গলের মধ্যে হেডলাইটের আলোর বন্যা বইয়ে এগিয়ে চলল জীপ টপ-গীয়ারে।
শামীমকে ওর বাড়ির মোড়ে নামিয়ে দিয়ে জীপ ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ পর ওরা যখন গিরিশদার বাড়ির সামনে এল, দেখল বাইরে একটি ফিয়াট ও একটি অ্যাম্বাসাডার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
কারা আবার এল? স্বগতোক্তি করল পৃথু। লোকজন ভাল লাগে না ওর। নতুন লোক তো নয়!
ভিতরে যেতেই বুঝল, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়। হাটচান্দ্রার যত ফোটা, আধফোটা এবং ডিম কবিরা গিরিশদার বসার ঘরের গালচেতে, সোফাতে বসে আছেন নানা ভঙ্গিমায়। তুমুল সাহিত্যালোচনা চলছে। মণি চাকলাদারই মধ্যমণি। একটি অদ্ভুতদর্শন শার্ট পরেছেন জিনস-এর শর্টস-এর উপর। গিরিশদার হাতে কবিতার খাতা। বোধ হয় কবিতা শোনাচ্ছিলেন।
পৃথুকে দেখেই মণি চাকলাদার বললেন, ওয়াট্ আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ!
গিরিশদা উদ্বাহু হয়ে বললেন, আরে! এসো এসো।
পৃথু মনের ভাব মুখে না এনে চাকলাদারকে বলল, কী ব্যাপার আজ?
আমরা সবাই আজ এখানে জমায়েৎ হয়ে কবিতা, গল্প এবং নাটক পাঠ করছি, গানও।
নাচ-টাচ হয় না? পৃথু শুধোল।
হ্যাঁ! তাও হয় বইকি! গোটা সাত-আট পেটে পড়ে গেলে অনেকেই নাচানাচি করেন।
সুমিতাকে ডাকেননি? না কী আপনাদের এই সভায় নারীরা বিবর্জিতা?
তাই-ই। এ পুরুষ সমাবেশ। কোনও মহিলা কবিকেই ডাকিনি। আপনি সীওনীতেও এমন একটি কবি সমাবেশের বন্দোবস্ত করুন না।
আমি? কোন অধিকারে?
কেন? আপনি কী কবি নন? ভাল কবি হওয়ার প্রচণ্ড সম্ভাবনা আছে আপনার!
কেন?
যত যন্ত্রণা, ততই তো সৃষ্টি! বলেই, মুখ ঘুরিয়ে অন্যান্যদের সাপোর্ট চাইলেন।
হাততালি দিলেন অনেকেই।
নাঃ। আমি কবি নই। আমাকে বাদ দিন।
কবি না হলেও আপনার মধ্যে কবি-ভাব প্রচণ্ড।
মণি চাকলাদার বললেন।
সে তো গিরিশদার বাঁদর সুখময়ের মধ্যেও প্রচণ্ড ছিল, তা বলে কী সেও কবি?
আপনি অভিমানের বশে একথা বলছেন।
মানুষ মাত্ররই অভিমান থাকে। অন্তত থাকা উচিত। বাঁদরদের যা থাকে না।
আপনি কী মনে করেন না যে, হাটচান্দ্রার কবিরা তাঁদের মধ্যে খুব ঘনঘন দেখা হওয়ার, আড্ডা হওয়ার একটা পার্মানেন্ট ফোরাম থাকা দরকার বলে মনে করেন তাঁদেরও একটা পয়েন্ট আছে? সাধারণভাবে বাংলা কাব্য এবং কবিদের উন্নতির জন্যেও কী এর প্রয়োজন নেই?
হয়ত আছে। নইলে আপনারা মিলিত হয়েছেন কেন।
পৃথু ক্রমশই উত্তেজিত হয়ে উঠছিল। উত্তেজিত হবার অনেকই কারণ আজকে আগেই ঘটেছিল, গিরিশদার সঙ্গে দেখা করতে এসে যে মণি চাকলাদারের খপ্পরে পড়বে, ভাবতেও পারেনি।
ও বলল, আমি তো জানতাম না এই সমাবেশের কথা। আজ আমার একটু তাড়া আছে। আজ আসি। পরে একদিন আসব। চলি, নমস্কার।
গিরিশদা ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে হাঁ হাঁ! করে উঠলেন। বললেন, সে কী? তুমি তো রাতে থাকবে এখানে। ঠুঠা বলল যে!
ভুচু বলল, না গিরিশদা। আজ আমার কাছেই নিয়ে যাচ্ছি পৃথুদাকে। কাল রাতে এবং আপনার কাছে থাকবেন, বিয়ের নেমন্তন্ন খেয়ে চলে আসবেন একেবারে। আমরা চললাম। ঠুঠাকে ভাল করে খাওয়াবেন কিন্তু।
আরে সে চিন্তা তোমার নেই। ঠুঠার জন্যে মুনেশ্বর ইতিমধ্যেই লিট্টির বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। এই কবি-সমাবেশ ভেঙে গেলেই ওর দেখাশোনা করছি আমি। একটা নতুন কবিতা লিখেছিলাম। শুনবে না?
কী নাম দিলেন?
অধঃপতন।
চলি গিরিশদা আজ।
বলে, ভুচু এসে জীপে বসল। পৃথুও।
জীপ ঘুরিয়ে এঞ্জিন স্টার্ট করে ও বলল, তুমি ওদের এমন এড়িয়ে এড়িয়ে যাও কেন বলো তো? মনে তো হয় ওরা তোমাকে ভালইবাসে, তোমাকে ওরা সত্যিই চায়।
আমিও একটা সময় তাই-ই ভাবতাম ভুচু। তবে একথাও ঠিক যে, ভাল হয়ত এই দলের বেশির ভাগ মানুষই বাসে।
তবে, মণি চাকলদারদের এ জন্যেই সাহিত্য হবে না কোনওদিন। রাজনীতি যারা করে, সাহিত্য তাদের জন্যে নয়। সাহিত্যর রাজনীতিও ওই রাজনীতিরই মধ্যে পড়ে। আমি বোকা লোক। বুঝতে সময় লেগেছিল বহুদিন। কবির জীবন বড় একাকিত্বর জীবন; বড় কষ্টর। কবিতা গদ্য নয় যে, হাতে দু পায়ে কালি মেখে হামাগুড়ি দিলেই পাতা ভরে।
কী জানি! কবিরাই যদি একে অন্যের সঙ্গে না মিশবে তবে কী তারা আমার মতো কী হঠা বাইগার মতো লোকের সঙ্গে মিশবে?
কেন? কেন না? তোমরাই যে সাহিত্যর উপজীব্য বিষয়। তাই-ই মিশবে! ভাবছিল পৃথু। বার্নার্ড শ জন গলসওয়ার্দিকে একবার বলেছিলেন :“লিটারারী মেন শুড নেভার অ্যাসোসিয়েট উইথ ওয়ান অ্যানাদার নট ওনলী বিকজ অফ দেয়ার ক্লিকস অ্যান্ড হেট্রেডস অ্যান্ড এভীজ, বাট বিকজ দেওয়ার মাইন্ডস্ ইনাব্রীড অ্যান্ড প্রড্স অ্যাবরশনস।”
ভুচু চুপ করে রইল। জীপটা এবার বড় রাস্তার কাছে এসে গেছে।
বড় রাস্তায় উঠেই পানের দোকানের কাছে স্পীড কম করে বলল, তোমার কী মনে হয় না যে, ওঁদের মধ্যে অনেকেই সত্যি তোমার বন্ধু?
পৃথুর মনে হল এই প্রশ্নটির গভীরে ভুচুরও একটি অন্য প্রশ্ন লুকোনো আছে। ও বলল, ভুচু তুমি কখনও কোনও সীসমেহাল-এ ঢুকছে? যার উপরে এবং চার দেওয়ালেই কাঁচ?
না। কখনও ঢুকিনি কোনও সীসমেহালে।
আমি ঢুকেছি। ঢুকলে, তুমিও বুঝতে পারতে। আয়নার জগতে একবার ঢুকে পড়লে তখন কোনটা যে অবয়ব আর কোনটা প্রতিফলন তা বোঝা বড়ই মুশকিল। বন্ধুবেশী শত্রুদের চেনা। সেখানে আরও বেশি মুশকিল।
কবিতার জগতকে আয়নার জগত বলছ তুমি? সে জগৎও এক সীমেহাল?
শুধু কবিতার জগই কেন, আজকের দুনিয়ায় বোধ হয় সব জগতই তাই। আমাদের নিতান্ত ব্যক্তিগত জগৎও।
আমাদের মানে?
সন্দিগ্ধ গলায় ভুচু বলল।
মানে সকলেরই! আমার, রুষার, ইদুরকারের, তোমার, কার জগৎ নয়?
পৃথু বলল।
ভুচু একবার তাকাল পৃথুর দিকে। তারপর নেমে গেল পান আনতে।
পান নিয়ে ফিরে এসে পৃথুকে পান এগিয়ে দিয়ে জীপটা স্টার্ট করে কতগুলো শালগাছের ভিড়ের পাশে পথ থেকে সরিয়ে লালধুলোর মধ্যে দিল নামিয়ে বাঁদিকের চাকা দুটো। এঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে বলল, কারখানায় গিয়ে রাতের খাবার খাব। শামীম ওর ছেলেকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবে সাইকেলে। রাম খাও পৃথুদা এখানেই বসে। বেশ লাগছে চাঁদের আলোটা, শালের পাতায়, না?
পৃথু বলল, হুঁ।
ভাবল, প্রেম মানুষকে সৌন্দর্য অনুভব করতেও শেখায়। এসব সুক্ষ্ম বোধ ভুচুর আগে ছিল না। এতদিন সুখে ছিল। সুক্ষ্ম হলেই দুঃখ। খুশি থাকতে হলে সাধারণ হয়েই থাকতে হয়।
রাম-এর গ্লাস এগিয়ে দিয়ে নিজেও নিয়ে ও আবার ড্রাইভিং সীটে এসে বসল। বনেটের উপর চাঁদের আলো চকচক করছিল। জোর হাওয়া বইছে এখনও লু-এর মতো। গরম হাওয়া। শালবনের পাতারা হাতছানি দিচ্ছে আর তাদের লক্ষ হাতে চাঁদের আলো ছিটকে ছিটকে চমকাচ্ছে। দুর থেকে সাইকেল চালাতে চালাতে আর গান গাইতে গাইতে কেউ আসছিল। অল্প বয়সী কোনও ছেলে হবে। গলার স্বরটি এখনও মেয়েলি আছে। তার গানের মধুর সুরে শালবনের পাতারা উৎকর্ণ হয়ে উঠল যেন।
দুজনে চুপচাপ বসে আছে পাশাপাশি। ঝড় ছুটছে শালের বনে চাঁদের আলো মাথায় করে। বছরের এই সময় রাতের বন থেকে এক উগ্র গন্ধ বেরোয়, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাশভারী পুরুষের ব্যক্তিত্বের গন্ধর মতো। ভুচু যেন কী বলব বলব করছে। উসখুস করছে বলবার জন্যে, কিন্তু বলছে না।
এবার একটা বিয়ে কর ভুচু।
পৃথুই বলল।
চমকে উঠল ভুচু।
আমি? কেন? হঠাৎ?
হঠাৎ আবার কি? বিয়ের সময় তো বয়ে যাচ্ছে। আর কতদিন ঘরের খেয়ে পরের মোষ তাড়িয়ে বেড়াবে? পরোপকার তো অনেকই হল। অবশ্য এই পরদের মধ্যেই আমি অন্যতম। এবার নিজের দিকে তাকাও ভুচু। বিয়ে কর, সংসার কর, দশজন পুরুষ যা করে, যা করে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে একজন মানুষ আর মানুষী সুখী হয়েছে, সুখে থেকেছে চিরদিন তাই-ই কর। আমি তো আর নিয়ম নই; ব্যতিক্রম। সব ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম নিয়মকেই প্রমাণিত করে।
দেখি।
বলে, দীর্ঘশ্বাস ফেলল ভুচু। সিগারেট ধরাল। পৃথুকেও ধরিয়ে দিল একটা। তারপর ভাবনায় ড়ুবে গেল। পৃথুও সিগারেট টানতে টানতে ভাবছিল। জীপের মধ্যের অন্ধকারে দুজনের সিগারেটের আগুন এক এক লাফে নীচে নামছিল।
ভুচু কি সুখী হবে রুষাকে নিয়ে? রুষা কম করে ওর চেয়ে পাঁচ ছ বছরের বড় হবে। মিলি ও টুসুও আছে। কিন্তু যারা সুখী হতে জানে তাদের সুখী হওয়া আটকায় না। এ সব বাহ্য। রুষাকে সুখী করার মতো সব কিছুই ভুচুর আছে। আর ভুচুও জাতে উঠবে সমাজের চোখে রুষাকে পেলে। যে জীবনে রুষার হাত ধরে গিয়ে ও পৌঁছবে সেই জীবনই নিরানব্বই ভাগ মানুষের কাম্য। যদি ওরা দুজনে সুখী হয় তো, হোক না। খুশিই হবে পৃথু। অন্তর থেকে বলছে এ কথা।
রাম দাও।
বলে গ্লাস এগিয়ে দিল ভুচুর দিকে।
আজকে পৃথু অপ্রকৃতিস্থ হতে চায়। হাটচান্দ্রাতে এসেও সে বিপদগ্রস্ত রুষা ও মিলির সঙ্গে দেখা যে করল না এটা খুব সহজে ঘটেনি। অনেকই জোর লেগেছে ভিতরের। এখন, এই রাতের অনুষঙ্গতে ভিতরের জোরটা যেন ক্রমশই কমে আসছে। পৃথু কি হেরে যাবে? রুষাকে আঘাত দিতে কি তার বুক কাঁদছে? উপায় নেই, কোনও উপায় নেই। যখন বড় নরম ছিল তখন সকলেই পায়ে মাড়িয়ে গেছে তাকে কাদারই মতো অবহেলায়। আজ তীক্ষ্ণ কাঁকর হয়ে তাদের পদতল ক্ষতবিক্ষত করে দেবে সে।
রাম-এর ভর্তি গ্লাসটা হাত বাড়িয়ে নিল পৃথু।
শেষ পর্যন্ত রুষার কথা ভুচু কিছুই বলল না। পৃথু জানত যে, বলতে পারবে না। ছেলেটার মধ্যে এখনও বিবেক বেঁচে আছে। আঘাতে আঘাতে তা অবশ হয়ে যায়নি।
এক সময় ভুচু বলল, চলো যাই।
চলো।
পৃথু বলল।
সকালে ভুচু ওঠার আগেই উঠে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল পৃথু। তখন পুবের আকাশ সবে লাল হচ্ছে। ভোরের আজান দিকে দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। আজকাল প্রত্যেক মসজিদের মিনারে মিনারে মাইক্রোফোন বসানো হয়েছে দেখছে। কেন? কে জানে? মিষ্টি হাওয়া ছেড়েছে। রাতশেষের এই সময়টায় প্রচণ্ড গরমের দিনেও একটা ঠাণ্ডা ভাব থাকেই।
গোরস্থানটা ভুচুর কারখানা থেকে শর্টকার্ট-এ মাইলখানেক পড়ে। অনেকখানিই রাস্তা। তবু, ভুচু ওঠা অবধি আর অপেক্ষা করেনি ও। প্রেম ও শ্রদ্ধা নিবেদন বোধ হয় একা করাটাই বাঞ্ছনীয়। ভুচু উঠলে, জীপ নিয়ে সঙ্গে আসত অথবা জোর করে অন্য কাউকে পাঠাত। এখন নিজে ড্রাইভ করতে পারে না বলেই বার বার অন্যকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করে না আর। ভুচুর উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করার দিনও বোধ হয় শেষ হয়ে এল। আস্তে আস্তে সম্পর্কের সুতো এবারে ঢিলে দেওয়াই ভাল। অনেকই করেছে ও পৃথুর জন্যে। ঋণ আর না বাড়ানোই ভাল। এই পথটার দুপাশে ইউক্যালিপটাস গাছ। পথটির নামও তাই ইউক্যালিপ্টা অ্যাভি।
ভুচু রাতে বলে দিয়েছিল কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে সাবির মিঞাকে, দু সারি সোনাঝুরি আর জ্যাকারান্ডা গাছের মাঝে। উনি, মৃত্যুর পরও যদি নিজের মত ফলাতে পারতেন তাহলে হয়তো বলতেন তাঁর বনক্ষেতিতেই যেন তাঁকে কবর দেওয়া হয়। তিন দিক খোলা মাটির ঘরের ডেরার ঠিক সামনেই মহানিমগাছটার গোড়ায়। অনেকই আনন্দের দিনরাত কেটেছে পৃথুদের সকলেরই সেই গাছতলিতে।
গোরস্থানে ঢোকবার আগে মনে পড়ল ফুল আনা হয়নি। পথের পাশে বুনো লালপাতিয়ার ঝাড় ছিল অনেক। সেখানে গিয়ে অনেকগুলো লালপাতিয়া ছিঁড়ে নিল পৃথু, তারপর গোরস্থানের মধ্যে ঢুকে ভুচুর নির্দেশিত জায়গাটিতে গিয়ে পৌঁছল আস্তে আস্তে। লালপাতিয়ার পাতাগুলো কবরের উপর রেখে, পাশে ক্রাচ নামিয়ে আসনসিঁড়ি হয়ে বসল মাটির উপর।
সব ঘাসই মরে লাল হয়ে গেছে এখন। সূর্যটা সবে উঠেছে। সোনাঝুরি আর জ্যাকারান্ডাদের ফাঁক-ফোকর দিয়ে নরম লাল রোদ এসে পড়েছে কবরের উপরে। উর্দুতে লেখা আছে কোরাণের কোনও বাণী। নীচে ইংরিজিতেও লেখা আছে হিয়ার স্লীপস মহম্মদ সাবির। জন্ম ও মৃত্যু তারিখ। সাবির সাহেব পৃথুর চেয়ে বয়সে প্রায় তেইশ চব্বিশ বছরের বড় ছিলেন জেনে অবাক লাগল। অথচ এমন ইয়ার জীবনে বেশি পায়নি।
পাঁচটি জ্যাকারান্ডা, তাদের শেষ ফুলের নরম বেগুনি রাশ আজই শেষভোরে ঝরিয়ে দিয়েছে। কবরের উপরে, যেন পৃথুরই হয়ে। ঝরিয়ে দিয়েই রিক্ত হয়ে গেছে।
পৃথু ভাবছিল, সাবীর সাহেবের ছেলেরা সবাই আছে বটে, কিন্তু কেউই ওবাড়িতে উদ্ধার হয়ে, আতরদান সাজিয়ে, “আইয়ে আইয়ে” করে বুকে টেনে নেবেন না আর পৃথুকে। বকরি ঈদের ও মুহাম-এর বাঁধা নেমন্তন্ন তো ছিলই এবং প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নানা অছিলায় নেমন্তন্ন করতেন করতেন উনি। অমন উমদা বিরিয়ানী আর কেউই পেশ করবেন না। হারুনুর রশিদই যেন এসেছিলেন সাবীর সাহেবের শরীর ধরে এই জঙ্গুলে হাটচান্দ্রায়। এই মানুষটিকেও একদিনের জন্যে খাওয়াতে পারেনি পৃথু তার বাড়িতে ঢেকে। তার তো কোনও বাড়ি ছিল না! মনে পড়তেই, চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে এল ওর।
মৃত্যুর আগের দিনক’টিতে নাকি হোঁশ-বেহেশ সাবির সাহেব হরদম পৃথুরই নাম করে পুকার দিয়ে উঠতেন। পৃথুর অশেষই সৌভাগ্য বলতে হবে। কোনও কিছুই “সদকা করে ছেড়ে দিলে; মানে, উৎসর্গ করে দিলে গায়কের মুখ-নিঃসৃত সুরেরই মতো, তা তো আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না এ জন্মে। সাবীর সাহেবের প্রতি হৃদয়ের যে উষ্ণতা, পৃথু একদিন সদকা করে দিয়েছিল তা এখনও ছড়িয়ে আছে হাটচান্দ্রার আকাশে বাতাসে। এমন হমদরদি মানুষ আর তো দেখল না ও!
সাবীর মিঞা পাকা গাইয়েও ছিলেন নিজে। অথচ কখনওই নিজেকে জাহির করতেন না। বরং একজন ভাল শ্রোতা হিসেবেই পরিচিত হতে চাইতেন। একবার পরজবাহার শুনিয়েছিলেন তাদের সকলকে। বনক্ষেতিতে। উদ্বেল বাসন্তী পূর্ণিমার রাতে। সবশুদ্ দেড় ঘণ্টা মতো গেয়েছিলেন। কিন্তু সে কী গান। কী মেঘগর্জনের মতো গলা। তারই মধ্যে বিদ্যুতের চমক, ফুলের গন্ধ। কী ভাব! যে গানটি গেয়েছিলেন সেটি অবশ্য পৃথুর বহুবারই শোনা ছিল বহু গায়কের মুখে— “ডাল ফুল ফল।” কিন্তু উনি আরম্ভই করেছিলেন রেখব-ষড়জ-নিখাদের একটি “কন” দিয়ে। আহা! সে কী হন! হৃদয়-ভাঙা অভিমানের মতোই তীক্ষ্ণ অথচ মোলায়েম। পরজ ও বাহার ছাড়াও অন্য অনেক রাগই এসে মিশছিল তাতে। কত আলোছায়া নেচে যাচ্ছিল ঘুঙুর পরে সেই সুরের লুকোচুরির মধ্যে যে, আজও ভাবলে সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। পৃথু, বাবার মুখে শুনেছিল, এই গানটিই নাকি মৌজুদ্দিনের গলায় তিনি শুনেছিলেন এক সময়। মৌজুদ্দিনের গলায় শোনা সেই গানের ঘোর পৃথুর বাবার হঠাৎ-মৃত্যুর আগের মুহূর্ত অবধিও তাঁর মধ্যে ছিল।
গান তো কত লোকেই গায়! কিন্তু সুর এমন ঈজ্জৎ, গানের বাণী এমন নাজুক চেকনাই পায় ক’জন গায়কের গলায়? অথচ গান তো পেশা ছিল না সাবীর সাহেবের! পেশায় তো ছিলেন জুতো আর বন্দুকের দোকানি। হয়তো পেশা ছিল না বলেই অমন করে হৃদয় নিংড়ে গাইতে পারতেন মানুষটি। কত বছর আগের সেই রাতে উনি গান গেয়েছিলেন তো মোটে দেড়টি ঘণ্টা। কিন্তু কী যে মস্তি ছিল সে গানে! মস্তির বিচারকে তো কোনওদিনও আর সময়ের হিসাবে বাঁধা যায় না! পঞ্চাশ বছরের কারবারি লুত্ব বে-মুশকিলে একটি মুহূর্তর মস্তিরও বরাবর হতে পারে। এই সকালে সাবীর সাহেবের কবরের সামনে বসে অমিয়নাথ সান্যাল মশায়ের লেখা অবিস্মরণীয় গ্রন্থ ‘স্মৃতির অতলে’তে উল্লিখিত দুটি ছত্র যেন কে আবৃত্তি করল ওর কানের কাছে, গোরস্থানের নির্জনে :
“অবতো সোনে দেও চয়নসে,
পড়ো না তল্কি লহদসে যাও।”
আরও কিছুক্ষণ চোখ বুজে বসে থেকে, উঠে পড়ল পৃথু। তারপর আস্তে আস্তে ফিরে চলল ভুচুর গারাজের দিকে।
পৃথুর বুকের খুবই কাছের, জিন্দা-দিল, লাজোয়াব; লম্বা-চওড়া মানুষটি ঠাণ্ডা শ্বেতপাথরের একটি ফলক হয়ে পড়ে রইলেন পিছনে। পৃথুর আগে অথবা পিছনে দিল-খোলা হাসি হাসতে হাসতে তাকে উষ্ণতায় ভরে দিয়ে আর কোনওদিনও সাবীর সাহেব হেঁটে যাবেন না।